ঘুষ
ঘুষ অতি প্রাচীন ব্যাপার, বোধহয় মানব সভ্যতার সমান বয়েসি। যেদিন থেকে সমাজে বিধিনিষেধ তৈরি হয়েছে, লাভ-লোকসান, লোভ-লালসা এসেছে, তারপর থেকেই ঘুষও শুরু হয়েছে। ক্ষমতাবান অথচ দুর্নীতিপরায়ণ রাজপুরুষকে কিছু উৎকোচ দিয়ে কার্যোদ্ধার করা, লাভবান হওয়া কখনও কখনও খুব কঠিন নয়। তবে এর জন্যে উৎকোচ প্রদানকারীকে কিঞ্চিৎ সাহসী এবং যথেষ্ট নীতিহীন হতে হবে।
সেই কবে মহামতি চাণক্য বলেছিলেন, মাছ কখন জল খায় আর রাজপুরুষ কখন ঘুষ খায় এটা বোঝা সহজ কাজ নয়।
এত প্রাচীন যুগে গিয়ে লাভ নেই। নিবন্ধের পরিসরে কুলোবে না। বরং আধুনিককালে আসি।
‘খাই খাই’ কবিতায় সুকুমার রায় নানারকম খাওয়ার সঙ্গে ‘ঘুষ খায় দারোগায়’ একথাও বলেছিলেন।
‘উৎকোচ তত্ত্ব’ লিখেছিলেন পরশুরাম, তাঁর ‘চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প’ নামক গ্রন্থে এই নামের কাহিনীটি আছে।
‘উৎকোচ তত্ত্ব’ গল্পের নায়ক শ্রীযুক্ত লোকনাথ পাল জেলা জজ, অতি ধর্মভীরু খুঁতখুঁতে লোক। তিনি সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকেন, পাছে ধূর্ত লোকে তাঁকে দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ করিয়ে নেয়।
শুধু তাই নয়, উৎকোচতত্ত্ব বিষয়ে একটি বই লেখার ইচ্ছে আছে লোকনাথবাবুর। সময় পেলেই তার জন্যে তিনি একটি খাতায় নোট লিখে রাখেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘ঘুষগ্রাহী অনেক ক্ষেত্রে নিজেই বুঝতে পারে না সে ঘুষ নিচ্ছে। স্পষ্ট ঘুষ, প্রচ্ছন্ন ঘুষ আর নিষ্কাম উপহার—এদের প্রভেদ নির্ণয় সবসময় করা যায় না।’
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, নিষ্কাম উপহার ভেবে লোকনাথবাবু এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় মারফত যেসব দ্রব্য পেয়েছিলেন সেগুলো ছিল প্রচ্ছন্ন ঘুষ। কাশ্মীরী শাল, মেওয়া, বুক-কেস এইসব শৌখিন জিনিস পেয়ে লোকনাথবাবু এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনেই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু লোকনাথবাবু ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে তাঁরই আদালতে একটি দায়রা মামলার আসামির পক্ষ থেকে এগুলি উপঢৌকন।
ন্যায়পরায়ণ, নীতিসিদ্ধ বিচারক লোকনাথবাবু ব্যাপারটি টের পাওয়া মাত্র দুটি কাজ করেছিলেন। প্রথমটি হল, তাঁর নিজের এজলাস থেকে মামলাটি সরিয়ে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় হল যা উপহার পেয়েছিলেন কড়ায় গণ্ডায় দাম ধরে, হিসেব কষে তার দাম উপঢৌকনদাতাকে সম্পূর্ণ মিটিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো দাম একটু বেশিই দিতে হয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, উক্ত উপঢৌকনদাতা অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন উৎকোচদাতা লোকনাথ পালকে অবসর গ্রহণের পরে একটি চমৎকার চাকরির প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। লোকনাথবাবুর সে সময় রিটায়ারমেন্টের মাত্র ছয় মাস বাকি। সরকারি চাকুরেরা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এ সময়ে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু লোকনাথ পাল এই দুর্বলতা শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি নমস্য।
স্বনামধন্য অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ব্যক্তিগত জীবনে বিচার বিভাগে কাজ করতেন, জজিয়তি করতেন। জজের ঘুষ খাওয়া নিয়ে অচিন্ত্যকুমারের এমন একটি জটিল গল্প ছিল। গল্পটি চমৎকার। অচিন্ত্যকুমার যেমন লিখতেন ছিমছাম, গোছানো অথচ তির্যক রচনা। গল্পটা হাতের কাছে নেই, আমি নিজের মতো করে মন থেকে বলছি।
ওই লোকনাথবাবুর মতোই এক জজসাহেব, নীতিবাগীশ, দুর্নীতিবিরোধী। সেই জজসাহেবকে ঘুষ দেওয়া অসম্ভব। ঘুষ কেন, ভেট উপহার কিছুই তাঁকে দেওয়া যায় না।
কিন্তু জগৎসংসারে ধুরন্ধর লোকের অভাব নেই। এক মামলায়, সেটা ওই জজসাহেবের এজলাসে, এক পক্ষ জজসাহেবের এই নীতিপরায়ণতা মাথায় রেখে মামলায় রায়দানের আগের দিন তাঁকে বিশাল ভেট পাঠিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, জজসাহেব সে ভেট গ্রহণ করেননি। তবে ফেরত দেওয়ার সময় কে ভেট পাঠিয়েছে সেটা দেখে নিয়েছিলেন।
এর ফলে যা হল সেটা মর্মান্তিক। ওই ধুরন্ধর ব্যক্তিটি বিপরীত পক্ষের নাম লিখে মূল্যবান ভেটটি পাঠিয়েছিলেন, যাতে জজসাহেব ওই পক্ষের উপর খেপে যান।
এবং সম্ভবত সেই জন্যেই সেই মামলার রায় উক্ত বিপরীত পক্ষের বিরুদ্ধে গিয়েছিল।
পরশুরাম এবং অচিন্ত্যকুমারের কাহিনী হয়তো কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি। কিন্তু আমার দীর্ঘ সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এঁদের গল্পের চরিত্র দুটি খুব একটা ব্যতিক্রমী নয়।
সত্যি কথা বলতে কী, ঘুষখোর লোকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। দুয়েকটি ক্ষেত্র বাদ দিলে সর্বত্রই এদের সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়।
কলকাতা এখনও দিল্লি হয়ে উঠতে পারেনি। ঘুষের মানসিকতা সাধারণভাবে বঙ্গীয় সমাজে গড়ে ওঠেনি, প্রশ্রয় পায়নি। ঘুষখোর মানুষ এখনও সমাজে একটি ঘৃণিত চরিত্র। পাড়ায় পাড়ায় এবং সরকারি আবাসনে তারা চিহ্নিত ব্যক্তি এবং মোটামুটি সবাই তাদের এড়িয়ে চলে। ঘুষখোরকে বেপাড়ায় গিয়ে বসবাস করতে হয়।
আমি ঘোষ উপাধিধারী এক দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি ডাক্তারকে জানতাম। ভাল ডাক্তার ছিলেন তিনি। অমায়িক, হাসিমুখ, পরিশ্রমী। কিন্তু ঘুষ খাওয়া তাঁর জলভাত ছিল। মিথ্যে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিতেন। দূরদূরান্ত—এ-জেলা ও-জেলা থেকে তাঁর কাছে লোক আসত সার্টিফিকেট নিতে। ভয়াবহ সেইসব সার্টিফিকেট। তার জন্যে ডাক্তার ঘোষকে কখনও কখনও ফৌজদারি আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠতে হত। তবে সে ব্যাপারে তাঁর কোনও আপত্তি ছিল না, কারন সেজন্যে তিনি বহু টাকা পেতেন।
দুঃখের বিষয়, ভদ্রলোকের কোনও সামাজিক সম্মান ছিল না। অফিসার্স ক্লাবে দুয়েকজন ছাড়া অন্যদের কাছে তিনি অবাঞ্ছিত ছিলেন। উৎসবে-ব্যসনে তিনি দামি উপহার দিতেন, কিন্তু বিয়ে-অন্নপ্রাশনে কদাচিৎ তাঁর নেমন্তন্ন হত। সবচেয়ে মর্মান্তিক, তাঁর অধীনস্থ জুনিয়র ডাক্তার, নার্স ওয়ার্ড-বয় এমনকী রোগি-রোগিনী, সাধারণ লোকজন তাঁকে ডাক্তার ঘোষ না বলে ডাক্তার ঘুষ বলত। তিনি কিছু মনে করতেন তা মনে হত না, তাঁর মুখভাব দেখে মনে হত, তিনি ভাবছেন বক্তার উচ্চারণে দোষ আছে, যেমন কোথাও কোথাও, কেউ কেউ পোকাকে পুকা বলে, মোয়াকে মুয়া বলে—তেমনিই এরা ঘোষকে ঘুষ বলছে।
গোরাচাঁদ নামে (পদবি জানি, কিন্তু বলা ভাল হবে না) এক বড়বাবুকে জানতাম, তিনি উলটোপালটা ঘুষ খেতেন, টাকা দেখলেই বাঁ হাত বাড়াতেন। লোকে প্রায় প্রকাশ্যে তাঁকে চোরা-গোরা বলত। এমনকী অফিসে তাঁর কোনও ফোন এলে, তিনি নিজে না ধরে সে ফোন অন্য কেউ ধরলে স্পষ্টই শোনা যেত, ‘চোরাগোরাকে একটু ডেকে দিন তো।’
এতদসত্ত্বেও বলব, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে ঘুষ একটা মার্জিনাল ব্যাপার। গত বছর পাঁচেক ঘুষের রমরমা চলছিল দিল্লিতে। আমার এক বাল্যবন্ধু নৃপতি এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করে, সে বলে—‘ইধারকা মাল উধার আর উধার কা মাল ইধারের ব্যবসা।’ নৃপতি সকাল-বিকেল দিল্লি-কলকাতা করে। সে বলে আগে ছিল হাজারি-হাজরাদের যুগ, এখন সবাই লাখুভাই। হাজারি হাজরা মানে যাঁরা হাজার টাকায় সন্তুষ্ট থাকত, আর লাখুভাই মানে এখনকার লাখ লাখ টাকার ব্যাপার। দিল্লির ঘুষকালচারই আলাদা। সেখানে অনেক ফ্ল্যাটে এমন অনেক বাথরুম আছে যার সোনার ট্যাপ, রুপোর শাওয়ার, দরজার নবে মুক্তো লাগানো। পুরোপুরি ঘুষের টাকায় দক্ষিণতম দিল্লি এবং ট্রান্স যমুনার অসংখ্য বিলাসপুরী তৈরি। সেই সঙ্গে হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে দেহাতে খামারবাড়ি।
এ বিষয়ে যথেষ্ট জানি না, বরং আমাদের গরিব শহরের একটা অবাস্তব ঘুষের কথা বলি।
আদালতে গিয়েছিলাম একটা সাধারণ এফিডেভিট করতে। কলকাতার মধ্যেই সেই আদালত, কিন্তু তার নাম করব না, অবমাননার দায়ে ফেঁসে যেতে পারি।
এফিডেভিটের কাজ সাঙ্গ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছি, পুরনো আমলের লোহার রেলিং দেওয়া কাঠের সিঁড়ি—আমার সামনে ময়লা ধুতি, ফুলশার্ট পরা কেমন হেরে যাওয়ার চেহারার এক ভদ্রলোক ঘামতে ঘামতে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। বোধহয় ঘর্মাক্ত কপাল মুছবার জন্যে ভদ্রলোক পকেট থেকে রুমাল বার করছিলেন, রুমালের সঙ্গে এক টাকা কি দু’টাকার একটা কয়েন বেরিয়ে কাঠের সিঁড়ির উপরে পড়ে গড়িয়ে গেল। এবং সিঁড়ির ফাঁকে গলিয়ে গেল।
ভদ্রলোকের এই টাকাটাই বোধহয় শেষ সম্বল। তিনি উবু হয়ে বসে সিঁড়ির ফাক থেকে কয়েনটি উদ্ধার করার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু কাজটা সহজ নয়। হাতের আঙুলে টাকাটার নাগাল পেলেন না। তখন সিঁড়ির উপর থেকে একটা পোড়া দেশলাই কাঠি কুড়িয়ে নিয়ে টাকাটাকে তুলতে গেলেন। ফল হল বিপরীত, সিঁড়ির ফাঁকে টাকাটা আরও তলিয়ে যেতে লাগল। অবশেষে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে বেচারা ভদ্রলোক রণে ভঙ্গ দিলেন।
আমি খুব কৌতূহল সহকারে ব্যাপারটি লক্ষ করছিলাম। যাঁরা আমাকে চেনেন তাঁরা জানেন অপরিমিত কৌতূহল আমার একটা খারাপ ও প্রাচীন দোষ।
সে যা হোক, অতঃপর ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন যে আমি তাঁর কার্যকলাপ লক্ষ করছি।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতের জামার হাতায় ডান হাতের ধুলো এবং ডান হাতের জামার হাতায় বাঁ হাতের ধুলো ঝেড়ে আমাকে বললেন, ‘দেখলেন তো ব্যাপারটা?’
আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘ব্যাপার আর কী, এই কোর্টের সিঁড়ি পর্যন্ত ঘুষ খায়! শেষ টাকা দুটো খেয়ে নিল। বহু কষ্টে বাঁচিয়েছিলাম। এখন হেঁটেই বাড়ি ফিরতে হবে।’
ভদ্রলোক বাড়ি ফিরুন। ততক্ষণ একটু ইতিহাস চর্চা করি। ঐতিহাসিক ঘুষের কাহিনীতে যাই। একটা অবশ্য গল্পগাথা নয়। খাঁটি ইতিহাস। একথা আজ যতই অসম্ভব শোনাক, এটা সত্যি যে ধনবান মার্কিন দেশের ভুবনবিদিত রাজধানী ওয়াশিংটন শহর একদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব ভারতের রায়ত ও সামন্তদের দেওয়া ঘুষের টাকায়।
ঘটনাটা পরিষ্কার করে বলি।
ভারতে ইংরেজ রাজত্বের প্রথম যুগে টমাস ল নামে এক ব্রিটিশ সিভিলিয়ান এসেছিলেন। তিনি খুবই কর্মপটু ছিলেন। লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যাঁরা হাতেকলমে রূপায়ন করেছিলেন, টমাস ল সাহেব তাঁদের অন্যতম।
এই ল সাহেব বিবাহসূত্রে আত্মীয় ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের।
টমাস ল যদিও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, তাঁর ছিল হাতটানেরও অভ্যেস, উৎকোচ গ্রহণে তাঁর উৎসাহ ছিল অপরিসীম। অবশ্য সেকালের ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের মধ্যে তিনি এ ব্যাপারে বিশেষ কোনও ব্যতিক্রম ছিলেন না।
খুব অরাজকতার সময় ছিল সেটা। মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে। পূর্ব ভারতে চলছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদণ্ড রূপে।
এ সেই শর্বরীকালের অন্ধকার সময়ের কথা। ইংরেজ রাজপুরুষদের নীতিজ্ঞান ছিল না। চুরি করা, উৎকোচ গ্রহণ শাসককুলের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
এদিকে এসব খবর যখন বিলেতে পৌঁছাল সেখানে খুব কড়াকড়ি শুরু হল। নতুন সিভিলিয়ান যাঁরা বিলেত থেকে আসছিলেন তাঁদের দেশ থেকে, রওনা হওয়ার আগে ধনসম্পত্তির হিসেব দিতে বলা হল। চাকুরি-শেষে ফিরে আসার পর মিলিয়ে দেখা হবে অবৈধ সম্পদ কিছু আছে কী না।
আমাদের এই টমাস ল সাহেব যেন-তেন প্রকারেণ নানা অনাচার, অত্যাচার করে দেশি প্রজাদের রক্ত শুষে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর অধিক্ষেত্র ছিল সাবেকি বাংলা-বিহার।
বিলেতে ভারতীয় রাজপুরুষদের ধনসম্পত্তির হিসেব নিয়ে কড়াকড়ি শুরু হয়েছে এই সংবাদ যথাসময়ে এদেশে এসে পৌঁছাল। টমাস ল ভাবলেন আমি তো আসার সময় ধনসম্পত্তির হিসেব দিয়ে আসিনি, এখন তাড়াতাড়ি ফিরে গেলে ঝামেলা হবে না। তিনি দেশের দিকে রওনা হলেন।
কিন্তু এডেন বন্দরে পৌঁছে তিনি এক দুঃসংবাদ পেলেন। এখন থেকে দেশের বন্দরে নামার সময়ও কী ধনদৌলত সঙ্গে আছে তার ফিরিস্তি দিতে হবে। অসংগতি দেখলে সেসব বাজেয়াপ্ত করা হবে। এত কষ্টের এই চুরির ধন এত সহজে কেউ ছাড়তে চায়?
টমাস ল করিতকর্মা পুরুষ। তিনি এডেন বন্দরে জাহাজ বদল করে এক আমেরিকাগামী জাহাজে উঠে বসলেন। এবং ধনদৌলতসহ যথাকালে নিরাপদে আমেরিকা পৌঁছালেন।
তিনি তাঁর সমস্ত ধনদৌলত বিনিয়োগ করলেন একটি জনপদ পত্তনে এবং তার পাশে একটি চিনির কারখানা স্থাপনে। পরবর্তীকালে ওই ভূসম্পত্তি মার্কিন সরকারের কাছে তিনি প্রভূত অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন এবং সেখানেই মার্কিন সরকার নতুন রাজধানী গড়ে তোলে।
আমাদেরই অত্যাচারিত পূর্বপুরুষদের রক্ত জল করা ঘুষের টাকায় একদিন মার্কিন রাজধানী তৈরি হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ঘুষের ইতিহাসে এমন ঘটনা বোধহয় আর একটিও নেই।
আর নয়।
এ রকম নোংরা বিষয়ে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করার প্রবৃত্তি নেই।
বরং দুটো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কাহিনী দিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করি। দুটো কাহিনীই পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো।
ঘুষ খাওয়ার চেয়ে ঘুষ দেওয়া কম কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন বা তাগিদ যতই হোক, কাকে ঘুষ দিতে হবে, কীভাবে দিতে হবে, কত দিতে হবে—এগুলি খুবই জটিল সমস্যা। সাধারণ নাগরিকেরা ঠিক এগুলো ধরে উঠতে পারেন না, সাহসও পান না।
কিন্তু আমি নিজে একবার ঘুষ দিয়েছিলাম। শুধু একবার নয়, নিয়মিত মাসে মাসে ঘুষ দিয়েছি। সে যে আমি খুব দুঃসাহসী বলে কিংবা বিশেষ বেকায়দায় পড়েছিলাম বলে তা কিন্তু নয়।
ঘটনাটি একটি দৈনিক পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলমে কিছুদিন আগেও লিখেছি, কিন্তু পুনরায় প্রণিধানযোগ্য।
তখন আমি কালীঘাটে মহিম হালদার স্ট্রিটে আমাদের পুরনো বাড়িতে থাকি। সদ্য সরকারি চাকরি পেয়েছি, রাইটার্সে অফিস। সেই সময়ে অফিস টাইমে ডবল-ডেকার টু-সি বাসের এক্সপ্রেস সার্ভিস চালু হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বালিগঞ্জ থেকে ডালহৌসিগামী সেই বাস আমাদের হাজরার মোড়ে দাঁড়াত না। রাসবিহারীর পর হাজরা, হরিশ মুখার্জি রোড, ময়দান পার হয়ে সরাসরি প্রথম স্টপ রাজভবন। টিকিটের দাম ছয় পয়সার জায়গায় দু’ আনা, দু’পয়সা বেশি কিন্তু পনেরো মিনিট সাশ্রয় হয়। সেই দু’ পয়সার দাম একালের পাঠকেরা বুঝতে পারবেন না, দু’পয়সা হল ডালহৌসি (বি বা দী বাগ) থেকে হাইকোর্ট সেকেন্ড ক্লাস ট্রামভাড়া, এলাচ-যষ্টিমধু-মিষ্টি সুপুরি দেওয়া একটা গালভরা পান, দুটো চারমিনার সিগারেট সবই দু’-পয়সা।
সে যা হোক, আমি ছিলাম অলস এবং আড্ডাবাজ। সকালবেলায় পনেরো মিনিট ছিল আমার কাছে অমূল্য। আমি ভাবতাম যদি এক্সপ্রেস বাসটা হাজরার মোড়ে দাঁড়াত!
আমার এই সমস্যার একদিন সমাধান হয়েছিল। আমার প্রতিবেশী রমেনদাকে একদিন দেখলাম হাজরার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে একটা টাকা দিতে। রমেনদার গাড়ি নেই, স্কুটার নেই, সাইকেল নেই। রাজপথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ট্রাম-বাসের মাধ্যমে, ট্রাফিক পুলিশকে তিনি কেন তোয়াজ করছেন!
পরদিনই রমেনদার কাছে এই রহস্য নিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি বললেন, ‘মাসে এক টাকা করে দিই। ট্রাফিকের সেপাই অফিসের সময় যখন আমাকে বাসস্টপে দেখে হাত তুলে এক্সপ্রেস বাসটা আটকিয়ে দেয়, আমি উঠে পড়ি।’
রমেনদার পন্থা অনুসরণ করে আমিও এরপরে মাসে মাসে ট্রাফিক সেপাইকে এক টাকা করে দিয়েছি।
জানি, এই পাপ সহজে স্খালন হওয়ার মতো নয়। তবু পাঠক-পাঠিকাকে সবিনয় অনুরোধ, দয়া করে মাফ করে দেবেন, মনে রাখবেন তখন আমার বয়েস তেইশ-চব্বিশ, করি সরকারি চাকরি, লিখি কবিতা। এক বিশাল সংসারের প্রাচীন উনুনে আগুন জ্বালিয়ে রাখার ইন্ধন জোগাতে হয়।
এরপরে আমার একটা সার্টিফিকেট লাগবে। সেটাই দ্বিতীয় কাহিনী। এটাও সেই এক্সপ্রেস বাসের সমকালীন গল্প।
সরকারি চাকরি শুরু করেছিলাম সম্প্রতি লুপ্ত ইতিহাসবাসী বঙ্গীয় রাজস্ব পর্ষদের সনাতন রাইটার্স বিল্ডিংসের অনন্ত পশ্চিম প্রান্তে দোতলায় ধুলিধূসর অন্ধকার হলঘরে।
রাজস্ব পর্ষদের কাজ তখন প্রায় শেষের পর্যায়ে। জমিদারি ব্যবস্থা তৈরি থেকে জমিদারির অবসান, দুই শতাব্দী চলে গেছে। আমার প্রথম পোস্টিং হল জমিদারির ক্ষতিপূরণ শাখায়।
সেখানে গিয়ে দেখলাম, নতুন শাখা। প্রায় সবাই আমার মতো আনকোরা। সহকর্মীদের সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা জন্মে যাওয়ার আগেই একদিন এক ভদ্রলোক অফিসে এলেন, তাঁর হাতে একটা পোস্টকার্ড। তিনি একটা ক্ষতিপূরণ মামলার তদ্বির করতে এসেছেন। তাঁর মামা তাঁকে লিখেছেন। ভদ্রলোক সিউড়ি থেকে আনা পোস্টকার্ডটা শক্ত করে ধরে আমাকে কেস নম্বর ইত্যাদি বললেন। আমার কেমন একটা খটকা লাগল, ভদ্রলোক এত শক্ত করে পোস্টকার্ডটা ধরে আছেন কেন?
তদ্বিরকারী ভাগিনেয় কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগে আমি পোস্টকার্ডটা তুলে উলটো দিকটায় কী লেখা আছে দেখলাম। দেখলাম সেখানে লেখা আছে,
‘পুনশ্চঃ
এই বোর্ড অফ রেভিনিউয়ের নতুন ছেলেগুলি, ইহাদের মোটেই বিশ্বাস করিও না। ইহারা ঘুষও খাইবে না, কাজও করিবে না। সর্বদা ইহাদের পিছনে লাগিয়া থাকিতে হইবে।’
ইতি
আশীর্বাদক
বড়মামা।