ঘুমপাড়ানি গল্প

ঘুমপাড়ানি গল্প

বাবা, একটা গল্প বলো৷’’ শোবার সময় সোহিনী বলল৷

‘‘কীসের গল্প?’’ সোহিনীর বাবা বললেন ওকে৷

‘‘সেই পাণ্ডা ভালুকের গল্প৷’’

‘‘মা৷ আজকে একটা অন্য গল্প শোনো৷ ক্রাকাটাও-এর গল্প৷’’

‘‘ক্রাকাটাও? সেটা কি কোনো জানোয়ার? না পাখি? না কাকাতুয়ার ভাই?’’

‘‘না রে৷ ক্রাকাটাও একটা আগ্নেয়গিরির দ্বীপ৷ জাভা আর সুমাত্রার মধ্যে৷ মুণ্ডা প্রণালীতে৷’’

‘‘না৷ আজকে ওসব শুনব না৷’’

‘‘শুনবে না? তবে কী শুনবে বলো?’’

‘‘আচ্ছা বাবা, তুমি যে বলেছিলে শীতকালে পাখিরা হাজার-হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে আসে—আবার শীত ফুরোলে চলে আসে নিজের দেশে, তা কী করে হয়?’’

‘‘কেন?’’

‘‘হাঁসেরা, রাজহাঁসেরা পথ চলে কী করে? এত হাজার কিলোমিটার পাহাড়, নদী, সমুদ্র সব পেরিয়ে ওরা গত বছরে যে পুকুরে বা হ্রদে এসে নেমেছিল, সেই একই জায়গায় চিনে আসে কী করে? আকাশে তো রাস্তা নেই, ওদের কাছে অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের বইও নেই, ট্রেনে কিংবা প্লেনে করেও আসে না ওরা, আসে কী করে তাহলে?’’

‘‘শুধু সেই বিল বা সেই হ্রদেই নয়৷ গত বছর যে বিশেষ গাছে বসে যে পাখি শীতের গান গেয়েছিল, এ বছরও সেই গাছের ডালে এসে বসে হাজার-হাজার মাইল দূর থেকে৷’’

‘‘তা তো বুঝলাম৷ কিন্তু কী করে পারে?’’

‘‘জানো, গ্রীকদের দেব-দেবীর মধ্যে নেমোসিন বলে এক দেবী ছিলেন৷ তিনি ছিলেন স্মৃতিশক্তির দেবী৷ উনি আবার সবরকম কলাবিদ্যারও মা৷ নেমোসিনের দয়াতে একটি ছোট্ট নাইটিঙ্গেল পাখির ছোট্ট মস্তিষ্কেও সবকিছু ছবির মতো আঁকা থাকে৷ শীতের সময় আফ্রিকা থেকে ঘুরে এসে সেই ছোট্ট নাইটিঙ্গেল আবার ইউরোপে তার বাড়ি ফিরে নিজের গাছে নিজেরই ডালে বসে গলা ফুলিয়ে তার প্রাণের বন্ধুকে ডাকে৷ নেমোসিনের করুণাতে ওদের স্মৃতিশক্তি এমনই প্রখর যে, ওরা যেমনি ওড়া শুরু করে নিজের দেশ থেকে পরের দেশের দিকে, অথবা পরের দেশ থেকে নিজের দেশের দিকে, অমনি ওদের মস্তিষ্কের মধ্যে গত বছরের ছবি এক-এক করে টেলিভিশনের পর্দার মতো সুন্দর ভাবে ভেসে উঠতে থাকে৷ ওরা আবার সেই ছবি মিলিয়ে-মিলিয়ে কোথায় যেন উড়ে যায়৷ কোনো কোনো পাখির ডানায়
র‍্যাডারের মতো যন্ত্রও বসানো আছে৷ গভীর অন্ধকারেও ওরা অচেনা দেশের উপর দিয়ে যেখানে যাবার সেখানে ঠিক উড়ে যায়৷’’

‘‘সত্যি ভাবা যায় না!’’ সোহিনী বলল অবাক হয়ে বাবাকে৷

তারপর বলল, ‘‘আচ্ছা বাবা, মাছেরা সমুদ্রে থাকে, তারা কি সাঁতরে এক সমুদ্র থেকে অন্য সমুদ্রে যায়? কিংবা এক সমুদ্রের মধ্যে তো কত হাজার—হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে জল থাকে; ছোট-ছোট মাছেরা হারিয়ে যায় না?’’

‘‘না৷ কেউই হারিয়ে যায় না৷ সমুদ্রের মধ্যেও হাইওয়ে আছে৷ আমাদের ন্যাশানাল হাইওয়ের মতো৷’’

‘‘যাঃ, তুমি বাজে বলছ৷ আমাকে খ্যাপাচ্ছ৷’’ সোহিনী বলল৷

‘‘নারে সনু, সত্যিই আছে,’’ সোহিনীর বাবা বললেন, ‘‘ঈল বলে একরকমের মাছ আছে৷ ইয়োরোপিয়ান মাছ৷ কখনো নাম শুনেছ?’’

‘‘ঈল? ইলিশের কাজিন নাকি?’’ সোহিনী চোখ বড় করে বাবাকে শুধাল৷

‘‘হতেও তো পারে৷’’

সোহিনী বলল, ‘‘ওরা কী করে সমুদ্রের মধ্যের হাইওয়ে দিয়ে যাতায়াত করে?’’

‘‘সমুদ্রের মধ্যে এইসব চওড়া-চওড়া পথগুলোতে আমাদের পথের মতো কোনো রোড লাইনস বা পথনির্দেশক থাকে না৷ পথ তো আর মাটির বা পিচের নয়৷ সবই জলের পথ, জলের ফুল, জলের গাছ৷’’

‘‘তাহলে ওরা বোঝে কী করে কোনটি পথ?’’

‘‘গন্ধ দিয়ে৷ পথে-পথে ওরা গন্ধ ছুড়ে দেয়৷ সেই গন্ধ চিনে নিয়ে ওরা চলাচল করে৷’’

‘‘কুকুররা যেমন গন্ধ শুঁকে-শুঁকে চলে?’’

‘‘অনেকটা সেইরকমই৷ প্রতি বছর ইয়োরোপের সমুদ্র থেকে সারগাসো সমুদ্র পেরিয়ে হাজার-হাজার কিলোমিটার চলে যায় অ্যাটলান্টিক সমুদ্রে ঈল মাছেরা৷ কী করে যায়? দেখা গেছে সমুদ্রের নীচে, বিভিন্ন গভীরতায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন জলস্রোত বয়ে চলেছে একই পথ হয়ে একই দিক থেকে অন্য দিকে৷ এই সামুদ্রিক রাস্তাগুলিই সামুদ্রিক ভ্যাগাবন্ডদের কাণ্ডারী৷ বিজ্ঞানীরা জেনেছেন যে, গালফ স্টীমের মধ্যে আটশো মিটার মতো তলা দিয়ে খুব জোরে এক জলস্রোত বয়ে চলেছে৷ ঈল মাছগুলো নদী ছেড়ে সমুদ্রে এসে পড়ে৷ তারা ডুব দিয়ে আটশো মিটার মতো নীচে নেমে সেই জলপথের তোড়ে মধ্যিখানে এনে ফেলে নিজেদের৷ আর তারপর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিব্যি আরামে প্রচণ্ড বেগে হাজার-হাজার কিলোমিটার অতি অল্প সময়ে পেরিয়ে আসে৷ এই তলার জলস্রোত এসে থেমেছে একেবারে সারগাসো সমুদ্রেই৷ জলস্রোতের সঙ্গে তারাও এমনি বিনা আরামে, বিনা টিকিটে এতখানি পথ চলে আসে৷ কিন্তু বিনা টিকিটের জার্নির জন্য স্রোতের মধ্যে এসে পড়া সোজা কথা নয়৷ নেমোসিনের সাহায্যে বহু বুদ্ধি খরচ করে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে অনেক মাছকে এই স্রোতের সুবিধা নিতে হয়৷ সকলেই যে সামুদ্রিক হাইওয়ে হাতের কাছে পায়, এ কথা মোটেই সত্যি নয়৷’’

‘‘সত্যি! কিন্তু ওরা পথ চেনে কী করে? কিছু তো থাকবে যাতে ওরা পথ চিনতে পারে? জলের মধ্যে কী থাকবে?’’

‘‘কী না থাকে? যা থাকার সব তোমাদের স্থলেই আছে? জলের নীচে পাহাড় আছে, পাথর আছে, জঙ্গল আছে, ফুল আছে, নদীর মধ্যে নদী আছে, সমুদ্রের সমুদ্র, পথঘাট, চৌমাথা সবই আছে৷ ওরা নিশ্চয়ই এই সব মনে রেখে চলাচল করে; আমরা যেমন করি তেমনই৷ তারপর কোনো সময়ে রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো জলস্রোতে চড়ে পড়ে আরামে৷’’

‘‘বাঃ রে, রাজধানী এক্সপ্রেস বললে কেন? ওখানে তো মাছেরা খাবার পায় না৷ আমরা যখন গুলমারে গিয়েছিলাম, তখন দিল্লির পথে খুব ভালো বিরিয়ানি পোলাও খেয়েছিলাম, না বাবা?’’

‘‘হ্যাঁ৷ কিন্তু আবারও গুলমার! গুলমার্গ৷ ছিঃ সোহিনী তুমি বড় হয়ে গেছ না? এখনও গুলমার্গকে গুলমার বলবে?’’

সোহিনী বলল, ‘‘জানো বাবা, অর্জুন খুব গুল মারে৷’’ তারপর বলল, ‘‘আচ্ছা বাবা, তুমি একদিন বললে না যে, পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা বানানোর সময় এঞ্জিনিয়ারেরা হাতির চলাচলের পথ খুঁজে বার করেন৷ কারণ হাতির মতো বুদ্ধি আর কারও নেই৷ হাতিরা যেই পথে চলাচল করে, সেই পায়ে হাঁটা পথ ধরে যদি রাস্তা তৈরি করা যায়, তবে সব দিক দিয়ে ভালো রাস্তা হয়৷ বলেছিলে না?’’

‘‘হ্যাঁ৷ বলেছিলাম৷’’

‘‘কিন্তু হয় কেন তা তো বলোনি? হাতিরা কী করে বোঝে কোথা দিয়ে যেতে হবে, আর কোথা দিয়ে যেতে হবে না!’’

সোহিনীর বাবা বললেন, ‘‘জানো, হাতিদের পথগুলো অদ্ভুত ভাবে তৈরি৷ যখন হাতিরা পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়, তখন পায়ের পাতা ফুলে উঠে মোটা হয়ে যায়৷ আর যেই পাটা তুলে নেয়, সেটা শুকিয়ে পাতলা হয়ে যায়৷ তাই কোনো হাতি যদি কোনো জায়গায় দু-তিন ফিট ডুবেও যায়, তবু সে অনায়াসে সেখান থেকে উঠে আসতে পারে৷ ওদের শরীর বিরাট আর ভারী বলেই সৃষ্টিকর্তা এই বন্দোবস্ত করে পাঠিয়েছেন এখানে৷ এইসব কারণে, অন্য সব জানোয়ারের থেকে হাতিরা জোলো জায়গায় ও তৃণভূমিতে সবচেয়ে আরামে চলাফেরা করে৷ অসমান ও পাহাড়ি জমিতে হাতির মতো তাড়াতাড়ি আর কোনো জানোয়ার চলতে পারে না৷ এমন কি ঘোড়াও নয়৷ তা কি জানো?’’

‘‘সত্যি?’’ অবাক হয়ে বলল সোহিনী৷

তারপর বলল, ‘‘আচ্ছা বাবা, হাতিরা যদি একই পথে চলে, তাহলে তো চলতে-চলতে সেখানে ওদের পায়ের চাপে জঙ্গলের! মধ্যে রাস্তা হয়ে যায়৷ তাই না?’’

‘‘যায়ই তো! তোমাকে একবার নিয়ে যাব জঙ্গলে—হাতিদের রাস্তা দেখাতে৷ সেই সব রাস্তা দিয়ে মানুষ এবং সময়-সময় জিপগাড়িও স্বচ্ছন্দে যেতে পারে, অবশ্য খাদ বা নদী-নালা থাকলে জিপগাড়ি পেরোতে পারে না৷ আফ্রিকায় কোনো-কোনো জায়গায়, অনেক বড় হাতির পাল থাকে৷ সেইসব জায়গাতে ওদের পায়ের ঘষায় পথ ক্ষয়ে-ক্ষয়ে, পাথরের ওপর গর্ত হয়ে গেছে দেখা যায়৷ এরাস্তা দিয়ে, সমুদ্রের নীচের জলস্রোত ধরে যেমন ঈল মাছেরা যায়, কত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হাতিরা ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে যাতায়াত করছে যে, তার খবর কে রাখে? পায়ে চলে-চলে শক্ত পাথরের ওপর গর্তের সৃষ্টি তো দু-চার বছরে হয় না৷’’

‘‘আগে কত হাতি ছিল?’’ সোহিনী শুধাল৷

‘‘কোথায়? আফ্রিকাতে? অনেক ছিল৷ প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড দল ছিল মেঘের মতো৷ মেঘের গর্জনের মতোই ছিল ওদের বৃংহণ৷ এখন এত বড় দল আর দেখা যায় না৷’’

‘‘দেখা যায় না কেন?’’

‘‘মানুষ মেরে ফেলেছে৷’’

‘‘হাতি কেন মারে বাবা? ওরা তো খুব ভালো৷ ওদের কতো বুদ্ধি৷ তাই না?’’

‘‘তা তো ঠিকই৷ মারে নানা কারণে৷ মানুষের মতো লোভী আর দাম্ভিক জানোয়ার তো আর নাই৷ হাতির দাঁত দিয়ে নানারকম গয়না হয়, মেয়েদের কারুকার্য হয়, জানলা-দরজার জাফরি হয়, নানা শৌখিন আসবাবপত্র হয়৷’’ তারপর একটু থেমে সোহিনীর বাবা বললেন, ‘‘ইয়োরোপে কোন জিনিসের জন্য হাতির দাঁতের সবচেয়ে বেশি কদর কি জানো? বিলিয়ার্ডের বল৷’’

‘‘বিলিয়ার্ডের বল? যে বিলিয়ার্ড ঋজুজ্যাঠার বাড়িতে আছে? মস্ত সবুজ ভেলভেটে ঢাকা টেবল, লম্বা-লম্বা লাঠি দিয়ে বল মেরে-মেরে খেলো তোমরা?’’

‘‘হ্যাঁ৷’’

‘‘বিলিয়ার্ডের একটি বল তো টুকটুকে লাল? না বাবা? অন্যগুলো সাদা৷ সাদাগুলো কি হাতির দাঁতের?’’

‘‘হ্যাঁ৷’’

‘‘তা বিলিয়ার্ডের বল তো প্লাস্টিক দিয়েও করতে পারে সহজেই৷ বলের জন্য হাতি মারতে হবে কেন?’’

‘‘সে কথা আর কে বোঝে বলো?’’ তারপর সোহিনীর বাবা বললেন, ‘‘এখনও ঘুম পায়নি তোমার সনু?’’

সোহিনী একটা হাই তুলে বলল, ‘‘না৷’’ তারপর বলল, ‘‘তুমি প্রথমে যে গল্পটা বলবে বলেছিলে, সেই ক্রাকাটাও না কে৷ কোথাকার কী যেন, সেই গল্পটা বলো বাবা৷’’ বলেই আরও একটা হাই তুলল৷

সোহিনীর বাবা হাসলেন৷ বললেন, ‘‘আজকে ঘুম পাচ্ছে৷ ক্রাকাটাও সম্বন্ধে অনেক কিছু বলার আছে৷ আমিও দেখতে পাচ্ছি তোমার বেশ ঘুম পেয়ে গেছে৷ ছুটোছুটি করেছ বোধহয় স্কুলের মাঠে?’’

‘‘না, ঘুম পায়নি৷ বলো না বাবা, ক্রাকাটাও-এর গল্প৷’’

‘‘কাল বলব৷ আজ ঘুমোও৷’’

‘‘ঠিক?’’

বলেই সোহিনী পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল ওর বাবার হাতটা দু-হাতের মধ্যে নিয়ে৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *