ঘুমন্ত পুরী – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য

ঘুমন্ত পুরী – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য

রঙ্কুলাল আর কঙ্কাবতী পিঠোপিঠি ভাইবোন। কঙ্কাবতী বছর দুই-এর বড়ো। ছেলেবেলা থেকে দুজনেরই বিজ্ঞানের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ।

সেই ছোট্টবেলার কথাই বলি। কত আর বয়স হবে তখন রঙ্কুলালের? বড়োজোর দশ কি বারো। নেহাত খেলার মাঠের অল্পসল্প একটু সময় আর ইস্কুলের জন্য একটু পড়াশোনা, — ব্যস, বাকি সময় সর্বদাই হাতে একটা কাঁচি নিয়ে বসে। সামনে স্তূপীকৃত বিজ্ঞানের পত্রিকা পুরোনো ম্যাগাজিনের স্টল থেকে কেনা, — স্বদেশি বিদেশি সব রকম। প্রথমে গোগ্রাসে গেলার মতো করে পড়ছে। তারপর, মনের মতন কোনো বিষয় পেলেই, আর কথা নেই, ঘ্যাচাং করে চালাচ্ছে কাঁচি। এরপর ছবি সমেত সেই কাটিংটা নিয়ে আঠা দিয়ে সঁেটে রাখছে ইয়াব্বড় একটা দু-কিলো ওজনের খাতায়। বাবা খাতাটার নাম দিয়েছিলেন ‘জাব্দা খাতা’। মা বলতেন, ‘না, ওটার নাম রাখ ‘পঞ্চশস্য’ — মা আবার সংস্কৃতে পন্ডিত, থুড়ি পন্ডিতাইন ফিগ! কিন্তু দাদু বলতেন, ‘না, ওটা ওর স্বরচিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’। যখন খাতা ভরতি হয়ে যাবে কাটিং-এ, তখন দেখা যাবে আপনা থেকেই একটা বিজ্ঞানের এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি হয়ে গেছে।’ ‘অবশ্য ঠিক স্বরচিত না হলেও ওরই সংকলন করা বা সম্পাদিত তো! আঃ, কে না জানে, এসব ক্ষেত্রে যা মুন্সিয়ানা তা সম্পাদকেরই প্রাপ্য।

কঙ্কাবতীর ঠিক ও-রকম অভ্যাস না থাকলেও ওর ছিল বই পড়ার নেশা। ছোট্ট একটা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিল সে, যার বেশির ভাগই ছিল সহজ বিজ্ঞানের বই দিয়ে ঠাসা, — ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পপুলার সায়ান্স’। জন্মদিনে, ভাইফোঁটায়, পুজোয় অন্য কোনও উপহার পছন্দ করত না ও, খুশি হত বই পেলে। কি চাই জিজ্ঞেস করলে সব সময়েই এক উত্তর — ‘বই। — পপুলার সায়েন্সের বই।’ এ বিষয়ে ওর গুরু ছিলেন মাস্টারমশাই কুঞ্জবাবু স্যার।

এখন অবশ্য দু-জনেই বড়ো হয়েছে। দু-জনেই পড়াশোনার পাট শেষ করে কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়েছে, আর বিজ্ঞানের প্রতি সেই দুরন্ত আগ্রহ কারও এক তিল কমেনি। তবে এখন আর শুধু বই পড়া নয়, হাতে-নাতে নানা পরীক্ষা, নানা দুর্গম জায়গায় অভিযান এই সব নিয়েই মেতে উঠেছে ওরা। তা সেবরফ-ঢাকা পাহাড়ই হোক, আর ধু ধু-করা মরুভূমিই হোক, কিংবা দূর সমুদ্রের নাম-না-জানা কোন ছোটোখাটো দ্বীপই হোক। ইতিমধ্যেই ওরা এরকম তিন-চারটে অভিযান সেরেও এসেছে এবং এ নিয়ে বেশ কিছুটা নামও হয়েছে ওদের বিজ্ঞানী-মহলে —বাঙালির মধ্যে যা বড়ো একটা দেখা যায় না।

সেবার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের দু-জনেরই ডাক পড়ল — ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কয়েকটা লেকচার অর্থাৎ বক্তৃতা দিতে হবে। দু-জনকেই। অবশ্য এজন্য ওঁরা যে সম্মান-দক্ষিণা দেবেন তা আমাদের দেশের হিসেবে বেশ মোটা। ওরা তাই প্রস্তাবটা লুফে নিল, কারণ ক্যালিফোর্নিয়ার নানা জায়গায় এত সব বৈচিত্র্যময় জায়গা আছে যা খুব কম লোকই ঘুরে দেখবার সুযোগ পায়। তাছাড়া শুধু ইচ্ছে আর সুযোগ থাকলেই হয় না, খরচটাও ভাববার বিষয়। ওরা ঠিক করল লেকচার দেবার পর যে বাড়তি টাকাটা হাতে থাকবে তা নিয়ে ওরা ওই জায়গাটা চষে বেড়াবে।

ক্যালিফোর্নিয়ার ইর্নিওতে যাবার সাধ ওদের বহুদিনের। ওইখানেই আছে সেই মৃত্যু-উপত্যকা, ওখানে যার নাম ডেথ ভ্যালি। ওই ডেথ ভ্যালিই নাকি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে গরম জায়গা। কতটা গরম? আমাদের দেশে জ্যাকোবাবাদের সবচেয়ে গরম জায়গা বলে একটা দুর্নাম আছে। গ্রীষ্মকালে সেখানে থার্মোমিটারে ৪৬ ডিগ্রি সেলশিয়াস অর্থাৎ ১১৪ ডিগ্রি ফারেইনাইটেরও ওপর তাপমাত্রা উঠে যায়। কলকাতায় যখন ৪০-৪১ ডিগ্রি সেলশিয়াস উঠলেই আমরা ত্রাহি ত্রাহি করি তখন জ্যাকোবাবাদে গেলে কী অবস্থা হবে ভাবা যায় না। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার এই ডেথ ভ্যালিতে নাকি তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে সময় সময় ৭৭ ডিগ্রি সেলশিয়াসও ছাড়িয়ে যায়। তার মানে ১৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চাইতেও বেশি। ১০০ ডিগ্রি সেলশিয়াস হলেই জল ফুটে বাষ্প হয়ে যায়, কাজেই এই গরমটাও যে কতখানি তা কল্পনা করা কঠিন নয়। ওই গরমে মানুষের গায়ের জল সব শুকিয়ে যায়, চামড়া যায় পুড়ে। একটা ৭০-৭৫ কিলোগ্রাম ওজনের মানুষ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শুকিয়ে ৩০-৪০ কিলোগ্রাম হয়ে গেছে এমনও নাকি ঘটেছে ওখানে।

রঙ্কুলাল বলল, ‘কুছ পরোয়া নেই। ওই ডেথ ভ্যালিই আমরা দেখতে যাব। তবে হ্যাঁ, দস্তুরমতো তৈরি হয়ে যেতে হবে। অ্যাসবেসটসের আঁশ দিয়ে বুনে পোশাক বানিয়ে নিতে হবে যাতে গরমে ঝলসে যেতে না হয়। তাছাড়া কালো চশমা, ঠাণ্ডা জলভরা থার্মোফ্লাক্স, মিনি জেনারেটর দিয়ে চালানো এয়ারকুলার — এসবও চাই।’

কঙ্কাবতীরও উৎসাহ কিছুমাত্র কম নয়। যদি বিপদের ঝুঁকিই না নেওয়া গেল তবে আর অ্যাডভেঞ্চার হল কোথায়? বৈজ্ঞানিক অভিযান চালাতে হলে এসব তো মেনে নিতেই হবে। আর তারা তো শুধু অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় যাচ্ছে না, ওখানে গিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও নিশ্চয়ই চালাবে। তার জন্যও সঙ্গে দরকারি যন্ত্রপাতি নিতে হবে। একটা জিপ গাড়িরও দরকার হবে।

রঙ্কুলালেরও সেই মত। তাই দু-জনে মিলে তোড়জোড় শুরু করে দিল।

ডেথ ভ্যালিতে যে লোকে যায় না এমন নয়, তবে সকলেই প্রায় যায় শীতকালে, দু-চার দশ জন অবশ্য গরমের দিনেও গেছে, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ভয়ানক। খুবই বিপদে পড়েছে, তারা সবাই ফিরতেও পারেনি।

রঙ্কুলাল শুনে বলল, ‘যেতে হলে ওই গ্রীষ্মকালেই যেতে হবে, শীতকালে যাবার কোনো মানেই হয় না। এই তো সবে গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে, যেতে হলে এখনই যাব।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আর ডেথ ভ্যালি যাওয়া হল না। ব্যাপারটা আর কিছু নয় ক্যালিফোর্নিয়ায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ওরা একটা নতুন খবর পেল যার কথা ওদের জানা ছিল না। ডেথ ভ্যালি থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে একটা নতুন জায়গা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। জায়গাটা পাহাড়ি তো নয়ই, এমন কী সমতলও নয়। বরঞ্চ একটা বেসিন বলা যেতে পারে ওটাকে। অনেকটা গামলার মতো মাঝখানে ঢালু হয়ে অনেকটা নেমে গেছে সমতল থেকে। তা যাক, কিন্তু ওইখানেই সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া গেছে একটা পরিত্যক্ত শহর। পরিত্যক্ত না বলে মৃতের শহর বললে আরও ঠিক বলা হয়। অসংখ্য বাড়িঘর, অট্টালিকা দিয়ে গোটা শহরটা সাজানো, কিন্তু একটি জনপ্রাণীও নেই সেখানে। এ যেন রূপকথার সেই ঘুমন্তপুরী। শুধু মানুষই নয়, একটি গাছগাছালিও খুঁজে পাওয়া যাবে না ওখানে। আর গরম? কোথায় লাগে ডেথ ভ্যালি ওর কাছে? ওখানকার আবহাওয়ার উত্তাপ নাকি ৯৫ ডিগ্রি সেলশিয়াস ছাড়িয়ে গেছে এবং তা ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। খুব শিগগিরই হয়তো ১০০ ডিগ্রি সেলশিয়াস অর্থাৎ ফুটন্ত জলের তাপমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাবে। তার মানে যদি কখনও ওখানে এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে কিংবা ওর কোথাও যদি কোনো জল জমা থাকে তবে সেমুহূর্তে বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যাবে।

কী করে ওই জায়গাটার খবর পাওয়া গেল? সেও এক কান্ড। একবার এক ঝাঁক সামরিক এরোপ্লেন, — তা সংখ্যায় গোটা পনেরো হবে, — ওই জায়গার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঝুপ ঝুপ করে সবগুলি ভেঙে মাটিতে আছড়ে পড়ল। না, কেউ গুলি করে নামায়নি, যুদ্ধ নয়, শান্তির সময় ওটা। তবে কেন পড়ল? একসঙ্গে পনেরোটা প্লেনের ইঞ্জিনই কি অচল হয়ে গেল? আশ্চর্য ব্যাপার। বলাবাহুল্য ওই সব এরোপ্লেনের একটি লোকও বেঁচে ছিল না; অত ওপর থেকে পড়লে কি কেউ বাঁচে? সামরিক কতৃপক্ষ স্বভাবতই উৎকন্ঠিত হলেন। তার পর সঠিক ব্যাপারটা জানার জন্য আবার একটা পর্যবেক্ষণ প্লেন পাঠালেন। কথা রইল, কোনও খবর দেবার থাকলে বা বিপদে পড়লে প্লেন থেকেই যেন সঙ্গে সঙ্গে বেতারে তা জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁরা উদ্ধারের ব্যবস্থা করবেন।

কিন্তু এ প্লেনটিরও হল ওই একই দশা। উদ্ধারের চেষ্টা করার আগেই সেটাও আবার ভেঙে পড়ল নীচে। শুধু ক্ষণিকের জন্য বেতারে একটা আর্তস্বর শোনা গেল — ‘থার্মোমিটারে ৯৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাচ্ছে! — উঃ, কী গরম—মরে গেলাম! — দম বন্ধ হয়ে গেল।’ তারপরেই সব চুপ।

এরপর আর সামরিক কতৃপক্ষ নতুন করে পর্যবেক্ষক প্লেন পাঠাতে সাহস পেলেন না। তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। রহস্যের মীমাংসা আজও হয়নি। বিজ্ঞানীরা বেশ খানিকটা চেষ্টা করেও কিছু হদিশ পাননি। জায়গাটার কাছে যেতেও সাহস পাননি। অগত্যা ওটাকে একটা ‘অতিপ্রাকৃত রহস্য’ — ওঁদের ভাষায় ‘সুপারন্যাচারাল মিস্ট্রি’ অ্যাখ্যা দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। অর্থাৎ বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা হয় না। তবে হ্যাঁ, জায়গাটার নাম দেওয়া দরকার। ডেথ ভ্যালি নামটা তো আগেই অন্য এক জায়গাকে দেওয়া হয়েছে, তাই ওঁরা এই জায়গাটির নাম দিয়েছেন — ‘স্লিপিং ল্যাণ্ড’ অর্থাৎ ‘ঘুমন্তপুরী’।

ডেথ ভ্যালি যাবার সংকল্প পরিত্যাগ করল রঙ্কুলাল আর কঙ্কাবতী। ওদের মাথায় এবার খেয়াল চাপল — যদি যেতেই হয় তবে এই ঘুমন্ত পুরীতেই যেতে হবে। উদ্ধার করতে হবে এর রহস্য।

সবাই শুনে বলে, ‘বলো কি! এমন গোঁয়ার্তুমি কেউ করে? এ যে জেনেশুনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়া!’ কিন্তু রঙ্কুলাল একবার যা জেদ ধরবে তা না করে ছাড়বে না। দিদি কঙ্কাকেও সেজপিয়ে জাপিয়ে নিজের মতে নিয়ে এল। বলল, ‘আমরা তো খালি হাতপায়ে যাব না, দস্তুরমতো আটঘাট বেঁধে তবেই যাব। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয়ই আমাদের এই অভিযানে সাহায্য করবে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সাহায্যও নিশ্চয়ই পাব। তাছাড়া আমেরিকার মহাকাশ গবেষণাগার থেকেও আমরা কিছু কিছু জিনিস ধার চেয়ে নেব। আমরা শুনেছি ওই বিভাগে বহু ভারতীয় কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক বাঙালিও আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবেন।’

সকলের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সত্যিই রঙ্কুলাল আর কঙ্কাবতী ঘুমন্ত পুরী অভিযানের জন্য তৈরি হল। পোশাকের মধ্যে রইল — মহাকাশচারীরা যেমনটা ব্যবহার করেন সেই রকম স্পেস স্যুট। তার ওপর অতিরিক্ত মাথা সমেত সর্বাঙ্গ মুড়ে-দেওয়া একটা আলখাল্লা গোছের ঘেরা টোপ— হালকা অথচ অ্যাসবেসটস ও আধুনিক উত্তাপ ও অগ্নিনিরোধক জিনিস দিয়ে তৈরি সেটা। মুখের সঙ্গে আঁটা রইল গ্যাস মুখোশ ও কথাবার্তা বলার জন্য নিরাপদ চোঙা, পিঠে অক্সিজেন-সিলিণ্ডার আর একটা ঝোলা— যার মধ্যে রইল ছোটো বাক্সে ভরা খুদে একটা ল্যাবরেটরি। দু-ভাইবোনের একই পোশাক। ঠিক হল যতটা যাওয়া সম্ভব ওরা জিপে করেই যাবে। তারপর সেই তথাকথিত ঘুমন্ত পুরীর কাছে নেমে, সম্ভব হলে, পায়ে হেঁটেই ঘুরে বেড়াবে। কারণ সেই জনমানবহীন নির্জীব পুরীতে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে না পারলে সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব হবে না। আর, তা করতে হলে, পায়ে হেঁটে ঘোরাই সুবিধাজনক। তবে কাছাকাছি একটা হেলিকপ্টারও থাকবে এবং সেটিকেও অগ্নিনিরোধক বর্মে সুসজ্জিত করে রাখা হবে যাতে সেই সামরিক এরোপ্লেনগুলির দশা না হয়। মহাকাশচারিরা ইতিপূর্বেই এ ধরনের বর্ম ব্যবহার করেছেন তাঁদের মহাকাশ জাহাজে — যখন মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকবার সময় প্রচন্ড ঘর্ষণে তাঁদের জাহাজের বাইরের দিকটা প্রচন্ড রকম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওদের আগ্রহ দেখে ও পরিকল্পনা পরীক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়, জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি, সামরিক বাহিনী এবং ওখানকার মহাকাশ গবেষণাগার নিজে থেকেই এইসব ব্যয়বহুল ব্যবস্থা করে দিলেন।

দস্তুরমতো তৈরি হয়ে ওরা ঢুকে পড়ল সেই পরিত্যক্ত শহরে।

সারি সারি বাড়ি, মাঝে মাঝে বিরাট অট্টালিকা এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। বাড়িগুলোর ছাদ দেখে মনে হয়, স্প্যানিশরা যখন এখানে এসে উপনিবেশ গড়ে তোলে তখনই এগুলো তৈরি হয়েছিল। এ অঞ্চলে তখন কাঠের ছড়াছড়ি, বেশির ভাগ বাড়িই তাই কাঠের তৈরি। বাড়িগুলির ভিতরে ঢুকে দেখা গেল তার মধ্যে প্রচুর আসবাবপত্র ইতস্তত ছড়ানো — সেগুলোও প্রায় সবই কাঠের। তার গায়ে কতদিন ধরে ধুলো জমে আছে কে জানে! এত বাড়ি এত আসবাবপত্র, কিন্তু কোথাও লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই।

ওরা আশ্চার্য হয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল। মুখে গ্যাস-মুখোশ,তার সঙ্গে কথা বলার চোঙা, পিঠে অক্সিজেন-সিলিণ্ডার, কাঁধে ঝোলা। পরনের পোশাকও তাপনিরোধক। থার্মোমিটার দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল জায়গাটার টেম্পারেচার অর্থাৎ উষ্ণতা বা তাপমাত্রা সত্যি প্রায় ৯৫ ডিগ্রির কাছাকাছি। কী সাংঘাতিক! পৃথিবীর ওপর কোনো জায়গা যে এত গরম হতে পারে তা ভাবাই যায় না।

হঠাৎ কঙ্কাবতী চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই রঙ্কু, দেখ!’

রঙ্কুলাল ফিরে তাকাল। এক জায়গায় পাশাপাশি চার পাঁচটা নরকঙ্কাল পড়ে আছে। চামড়া, মাংস শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে লেপটে গেছে। ঠিক যেন ম্যমি! কতদিন আগে এই হতভাগ্যদের মৃত্যু হয়েছিল কে জানে!

রঙ্কুলাল বলল, ‘আর একটা জিনিস লক্ষ করেছিস দিদি? এত বড়ো শহরটায় এ পর্যন্ত একটা গাছ চোখে পড়ল না! রোদে পুড়ে ঝলসে গেলেও কোনো গাছ থাকলেও তার অঙ্গার অংশটুকু তো অন্তত থাকবে। তাও নেই কোথাও। তাজ্জব ব্যাপার নয় কি?’

‘হু’, বলে কঙ্কা আর একটু এগিয়ে গেল, বলল, ‘ওই দিকটায় চল। ওই যে উঁচু ঢিবির মতো কী একটা রয়েছে দেখছি।’

কাছে গিয়ে দেখল, এগুলোও কঙ্কাল, তবে মানুষের নয়, কতকগুলো নানা ধরনের চতুষ্পদ জন্তুর। কোনো কোনটা বেশ বিরাট আকারের। সবাই ভয় পেয়ে হয়তো আশ্রয়ের আশায় এই জায়গায় জড় হয়েছিল। কঙ্কা বলল, ‘দেখছিস না, শুকনো পুকুরের মতো কী একটা রয়েছে — হয়তো জলের খোঁজেই এসেছিল, তারপর এখানেই মৃত্যুবরণ করেছে।’

তারপর ক্রমাগত সেই একই দৃশ্য। কোথাও নরকঙ্কাল, কোথাও ইতর প্রাণীর। কিন্তু এত বড়ো শহরে কোথাও একটাও গাছ নেই। গাছগুলি যেন মন্ত্রবলে উধাও হয়ে গেছে।

সামনে একটা বিরাট ছাউনি দেওয়া জায়গা। বোধহয় কোনও সময় সেটা ছিল গুদাম ঘর। কঙ্কাবতী পায়ে পায়ে তার মধ্যে ঢুকে গেল, তারপরই চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখ দেখ রঙ্কু, এখানে রাশি রাশি কাঠ পাঁজা করে রাখা হয়েছে, কিন্তু সব ঝলসানো! ওরে বাবা, এ যে অফুরন্ত কাঠ! কিন্তু একটারও চেহারা স্বাভাবিক নয়। কাঠ তো ঠিক? হ্যাঁ, কাঠই কিন্তু সব ঝলসে কালো হয়ে গেছে।’

রঙ্কুলাল ছুটে এল। বিস্ময়বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে দেখল; তারপর, যেন আপন মনেই বলল, ‘এখন বুঝেছি গাছগুলি কোথায় গেল। সব ওরা কেটে সাফ করে দিয়েছে। গাছগুলো কেটে, চিরে তাই দিয়ে কাঠের তক্তা বানানো হয়েছে। একটা গাছও আস্ত রাখেনি।’

পরক্ষণেই সেএকটু চুপ করে গেল। মনে মনে কী যেন ভাবছে সে। কীসের যেন হিসেব মিলাচ্ছে মনে মনে। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, ‘দাঁড়া দিদি, এখানকার বাতাসটা একটু পরীক্ষা করে দেখি। আমার মনে একটা সন্দেহ হচ্ছে।’

ছোটো একটা ক্ষুদে ল্যাবরেটরি ওদের পিঠের ঝোলার মধ্যেই ছিল। ল্যাবরেটরি বলতে একটা বড়ো বাক্স, — তার মধ্যে এটা ওটা কয়েকটা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, কিছু রাসায়নিক পদার্থ — এই অ্যাসিড ট্যাসিড জাতীয়। রঙ্কু তার থেকে একটা ছোট্ট স্পিরিট ল্যাম্প বার করে নিয়ে দিয়াশলাই জ্বালাতে গেল, কিন্তু দিয়াশলাই জ্বলল না — জ্বলার কোনো লক্ষণও দেখা গেল না। পর পর এগারো বারোটা কাঠি নষ্ট করে রঙ্কু বলল, ‘তবে কি এখানকার বাতাসে অক্সিজেন নেই! দেখি?’

হ্যাঁ, ঠিক তাই। পরীক্ষা করে দেখা গেল এক ফোঁটা অক্সিজেন নেই বাতাসে। তবে কি আছে? আছে রাশি রাশি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস।

‘হুঁ, কার্বন ডাইঅক্সাইড তো বাতাসের চেয়ে অনেক ভারী, প্রায় দেড়গুণ। তাই বাতাসের অক্সিজেন নাইট্রোজেনকে সরিয়ে তার জায়গা দখল করেছে, আর জায়গাটা কতকটা ঢালু গামলার মতো হওয়ায় সব গিয়ে সেখানে জমেছে। এখন বুঝতে পারছি, এত লোক — এত জন্তু কেমন করে মারা গেল তার কারণ। কার্বন ডাইঅক্সাইডের আবহাওয়ায় পুরো ডুবে গেলে তো অক্সিজেনের অভাবে মারা পড়বেই।’

‘কিন্তু এই কার্বন ডাইঅক্সাইড ওপরে কতদূর পর্যন্ত উঠে গেছে দেখতে হবে।’ — কঙ্কা বলল, ‘এবার একটু হেলিকপ্টারটা নিয়ে এসে উঁচু আকাশে ওঠা যাক।’

দু-জনেই হেলিকপ্টার চালাতে ওস্তাদ। হেলিকপ্টারটার কাছে চলে এল ওরা, তারপর দিল চালিয়ে। দেখা গেল হেলিকপ্টারের গতিও বেশ মন্থর, তবু সেটা আকাশের দিকে সোজা উঠতে লাগল। রঙ্কু সমানে বাতাস পরীক্ষা করে চলেছে। না, কোথাও অক্সিজেন নেই,— কেবল কার্বন ডাইঅক্সাইড — কার্বন ডাইঅক্সাইড আর কার্বন ডাইঅক্সাইড, আর কিছু না! প্রায় হাজার খানেক ফুট ওপরে উঠে গিয়েও দেখা গেল ওই একই অবস্থা।

কঙ্কাবতী বলল, ‘আর উঠে কী হবে? আমাদের সঙ্গের অক্সিজেন সিলিণ্ডার তো আর অফুরন্ত নয়, চল, এবার নামা যাক!’

রঙ্কুলাল আবার ধীরে ধীরে হেলিকপ্টার চালিয়ে দিল নীচের দিকে।

ঘণ্টা কয়েক পরের কথা। বিকেলের দিকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হল- ঘরে একদল ছাত্রছাত্রী আর বিজ্ঞানীদের সামনে বসে ওরা ওদের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলছিল আর সবাই তা বিস্ময়ের সঙ্গে শুনছিলেন। হঠাৎ একটি ছেলে, বোধ হয় ছাত্রই হবে, উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা তো শুনলাম, কিন্তু রহস্যটা কি তা তো এখনও বুঝলাম না! আপনারা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন?’

অধ্যাপক বিজ্ঞানীরা এ ওর মুখের দিকে তাকালেন। রঙ্কুলাল বলল, ‘রহস্যের সমাধানও কিন্তু আমরা সত্যিই করে ফেলেছি। তবে একটু খুলেই বলি। ওই শহরটির পত্তন করেছিল স্প্যানিশরা — যখন তারা এদেশে এসে উপনিবেশ গড়তে শুরু করে। জায়গাটি হয়তো কোনো কারণে ওদের বেশি পছন্দ হয়ে থাকবে, তাই ওরা ঘরবাড়ি তৈরি করে ওখানেই একটা বড়ো বসতি স্থাপন করে। স্প্যানিস যে, সেবিষয়ে সন্দেহ নেই, কেননা ওদের ঘরবাড়ি ঘুরে আমরা বিস্তর স্প্যানিশ লেখার নমুনা দেখতে পেয়েছি। এ অঞ্চলের কাঠের এক সময়ের খুব নাম ছিল, তাই ওরা বাড়িঘর-দোরও যতটা সম্ভব তৈরি করেছিল কাঠ দিয়েই। শুধু বাড়িঘরই নয়, ঘরের আসবাবপত্রও তৈরি করত কাঠ দিয়ে। উনুন, চুল্লি এ সবের জ্বালানি হিসেবেও নিশ্চয়ই ওরা কাঠই ব্যবহার করে গেছে। ফলে যেখানে যত গাছ ছিল সব তারা কাটতে শুরু করে দেয় কাঠের চাহিদা মেটাবার জন্য। শেষে গাছ কাটতে কাটতে এমন একদিন এল যখন আর একটি গাছও অবশিষ্ট রইল না। গাছ কাটতে হলে সঙ্গে সঙ্গে নতুন গাছও যে সমানে লাগিয়ে যেতে হয় এ খেয়াল বা বুদ্ধি নিশ্চয়ই তাদের হয়নি। ফলে এমন একটা সময় এল যখন এই শুধু মানুষ আর মানুষ আর হয়তো তাদের কিছু পোষা জন্তু। কিন্তু একটাও গাছ নয়।

‘ওইসব মানুষ আর জন্তুরা বাতাস থেকে ক্রমাগত অক্সিজেন টেনে নিচ্ছিল শ্বাসগ্রহণের তাগিদে — কতদিন ধরে কে জানে! আর সেই সঙ্গে নি:শ্বাসের সঙ্গে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছিল কার্বন ডাইঅক্সাইড — কার্বন ডাইঅক্সাইড আর কার্বন ডাইঅক্সাইড। আপনারা সবাই জানেন গাছেরা এই কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিয়েই জল আর সূর্যের আলোর সাহায্যে তৈরি করে তাদের খাদ্য কার্বোহাইড্রেট আর বাতাসে ছেড়ে দেয় অক্সিজেন। এ কাজটাকে আমরা বলি ফোটো-সিন্থেসিস, আমাদের দেশে কেউ কেউ বলেন সালোক-সংশ্লেষ। আমরা ফের ওই অক্সিজেন ব্যবহার করি শ্বাস গ্রহণের কাজে, কার্বোহাইড্রেটটাও ব্যবহার করি খাদ্য হিসেবে, কারণ ও জিনিস আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারি না। অথচ জীবন্ত শরীরের তাপ রক্ষার জন্য ওই খাদ্যটি অপরিহার্য। সমস্ত গাছ অন্তর্ধান করায় এ কাজটি আর চলল না — অর্থাৎ প্রকৃতির ভারসাম্য মানুষই দিল নষ্ট করে। ধীরে ধীরে বাতাসের অক্সিজেন কমতে লাগল আর তার জায়গা দখল করতে লাগল তার চাইতে অনেক ভারী কার্বন ডাইঅক্সাইড। অক্সিজেন যেটুকু ছিল হালকা বলে তা ক্রমাগত ওপরে উঠে যেতে লাগল। কতটা জায়গা জুড়ে এ ব্যাপার চলল আর অত উঁচু পর্যন্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড জমাতে হলে কত মানুষ, কত জন্তুর দরকার আর কতটা সময় লাগবার কথা তা হিসেব করে দেখতে হবে। তবে মনে হয় শহরটি নানা অনুকূল অবস্থার জন্য খুবই জনাকীর্ণ ছিল। আমরা প্রায় হাজার খানেক ফুট ওপরে উঠেও পেয়েছি শুধু এই কার্বন ডাইঅক্সাইড, অক্সিজেনের ছিটেফোঁটাও পায়নি।’

কঙ্কা রঙ্কুর কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও পরীক্ষা করে দেখেছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই কার্বন ডাইঅক্সাইড উঁচু আকাশে উঠে নিশ্চয়ই একটা আস্তরণ তৈরি করে ফেলেছিল।’

‘হ্যাঁ, ঠিক চাদরের মতো আস্তরণ’। — বলল রঙ্কুলাল। — ‘আর সেচাদরের মতো আস্তরণটা সবটাই গড়ে উঠেছিল কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস দিয়ে।’

 সমবেত বিজ্ঞানীরা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার তাঁদের মধ্যে একজন প্রবীণ বিজ্ঞানী দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘অর্থাৎ আপনি বোধহয় বলতে চাইছেন যে ওই কার্বন ডাইঅক্সাইডের আস্তরণ ওপরের আকাশের নীচে এমন একটা প্রাচীরের মতো বাধার সৃষ্টি করেছিল যার ফলে ওর নীচেকার আবহাওয়া বিজ্ঞানের নিয়মেই ক্রমাগত গরম হতে লাগল। ওই রকম বাধা বা প্রাচীরকেই তো বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় ‘বেরিয়ার’। হ্যাঁ, আপনার কথাটা খুবই যুক্তিগ্রাহ্য।’

 ‘হ্যাঁ। আর সেই কারণেই ওখানকার শুধু মাটিতেই নয়, মাটির ওপরকার আকাশেও অনেক দূর পর্যন্ত তাপমাত্রা— টেম্পারেচার ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে এক সময়ে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যা কোনও জীবিত মানুষ বা প্রাণীর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয় — যেমন সম্ভব নয় ওর মধ্যে নি:শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া।’

প্রবীণ বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবার বললেন, ‘বুঝেছি, এই জন্যেই এরোপ্লেনগুলি যখন ওর ওপর দিয়ে যায় তখন চালকেরা দমবন্ধ হয়ে প্লেনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তাছাড়া এখন মনে পড়ছে শেষ যে পর্যবেক্ষক প্লেনটি গিয়েছিল তার চালকও আর্তকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন — উঃ, কী গরম! ৯৫ ডিগ্রি সেলশিয়াস। দম বন্ধ হয়ে গেল —’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’ রঙ্কুলাল ও কঙ্কাবতী প্রায় একসঙ্গে উত্তর দিল। তারপর জিজ্ঞাসু ছাত্রটির দিকে চেয়ে রঙ্কুলাল বলল, ‘তোমার প্রশ্নের জবাব এবার নিশ্চয়ই পেয়ে গেছ ভাই? রহস্যের সমাধান আমরা ঠিকই করতে পেরেছি, তাই না?’

হলশুদ্ধু লোক নির্বাক বিস্ময়ে শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। এতদিনে ঘুমন্ত পুরীর রহস্যের সমাধান তারা সত্যি খুঁজে পেয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *