ঘুঙড়ি কাশির ব্যাপারে ম্যাকউইলিয়ামস পরিবারের অভিজ্ঞতা

ঘুঙড়ি কাশির ব্যাপারে ম্যাকউইলিয়ামস পরিবারের অভিজ্ঞতা
 Experience of the Mcwilliamses With Membranous Croup

ঘটনাক্রমে কোন যাত্রাপথে নিউ ইয়র্ক-এর জনৈক সহৃদয় ভদ্রলোকের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়েছিল; কাহিনীটি তার মুখেই শোনা।

দেখুন, সেই ভয়ংকর দুরারোগ্য ঝিল্লির প্রদানজনিত ঘুড়ি কাশি কি ভাবে গোটা শহরটাকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছিল এবং সব মায়েদের আতংকে উন্মাদপ্রায় করে তুলেছিল সে কথা বলবার আগে আমি গোড়ার কথায়ই ফিরে যাচ্ছি। ছোট্ট পেনিলোপ-এর দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি মিসেস ম্যাকউইলিয়ামসকে বললামঃ

প্রিয়তম, আমি হলে কিন্তু মেয়েটি কে ঐ দেবদারুর কাঠি চুষতে দিতাম না।

ধন আমার, এতে ক্ষতি কি হচ্ছে? মুখে এ কথা বললেও কার্যত সে চুষিকাঠি টা নিয়ে নিতে রাজী হল-অতি বড় যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবকেও। মেয়েরা কখনও বিনা তর্কে মেনে নিতে পারে না; মানে, বিবাহিতা মেয়েরা।

আমি জবাব দিলাম, ভালবাসার ধন, একথা তো সকলেই জানে যে শিশু দের পক্ষে দেবদারুই হচ্ছে সব চাইতে পুষ্টিহীন কাঠ।

আমার স্ত্রীর হাতটা থেমে গেল, কাঠি টা আর নেওয়া হল না। নিজেকে যথেষ্ট সংযত করে বললঃ

হুবি, এর চাইতেও বেশী কিছু তুমি তো জান। আর সে কথা তোমার অজানা নয়। সব ডাক্তাররাই বলেন যে, দেবদারু কাঠে যে তার্পিন থাকে সেটা দুর্বল শিরদাঁড়া ও মূত্রাশয়ের পক্ষে উপকারী।

ওহো-আমার তাহলে ভুল ধারনা ছিল। আমি জানতাম না যে আমাদের মেয়েটির মূত্রাশয় ও শিরদাঁড়ার রোগ আছে, আর বিখ্যাত ডাক্তারবাবুটি বলেছেন যে-

কে বলল যে মেয়ের শিরদাঁড়া ও মূত্রাশয় খারাপ হয়েছে?

সে কি গো, তুমিই তো বললে।

কী আশ্চর্য! এরকম কোন কথাই আমি বলি নি।

সে কি প্রিয়, দু মিনিট ও হয় নি এই তো তুমি বললে-

রেখে দাও আমি কি বলেছি! কি বলেছি না বলেছি তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। মেয়েটি যদি ইচ্ছা করে একটু পাইন-কাঠি চুষে থাকে তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর সেটা তুমি ভাল করেই জান। এটা ও চুষবেই! এই নাও তো মামণি!

আর কোন কথা নয় প্রিয়। তোমার যুক্তির জোর আমি বুঝতে পেরেছি। আজই গিয়ে দুই-তিন বাণ্ডিল ভাল পাইন-কাঠির ওর্ডার দিয়ে আসব। আমার মেয়ে চাইবে আর আমি-

দয়া করে তোমার আপিসে যাও তো, আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। কেউ কিছু বললেই হল, অমনি তুমি তর্কের পর তর্ক জুড়ে দাও আর শেষ পর্যন্ত কি যে বল তা নিজেই বুঝতে পার না। হ্যাঁ, তাই তুমি কর!

ঠিক আছে, তুমি যা বলছ তাই করব। কিন্তু তোমার শেষ কথাটির মধ্যে যে কোন যুক্তিই নেই-

যা হোক, আমার কথা শেষ হবার আগেই সে মেয়েকে নিয়ে সগৌরবে নিষ্ক্রান্ত হল। আর রাতে খাবার সময় সে যখন সামনে এসে দাঁড়াল তখন তার মুখ কাগজের মত সাদা:

ওঃ মার্টিমার, আবার একজন! ছোট জর্জি গর্ডনকেও ধরেছে।

ঘুঙড়ি কাশি?

ঘুঙড়ি কাশি।

আশা আছে তো?

কোন আশা নেই। ওঃ, আমাদের কি হবে!

একটু পরে শুভরাত্রি জানাতা ও মায়ের পায়ের কাছে বসে যথারীতি প্রার্থনা জানাতে পেনিলোপকে নিয়ে নার্স ঘরে ঢুকল। এবার আমি ঘুমিয়ে পড়ব, বলতে বলতেই সে একটু কাশল! আমার স্ত্রী মৃত্যু-তাড়িতের মত চমকে সরে দাঁড়াল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আত্মস্থ হয়ে যথাবিহিত কাজে মনোনিবেশ করল।

তখনই হুকুম করল, শিশুটির বিছানা যেন আমাদের শোবার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর সে হুকুম তামিল হল কি না দেখবার জন্য তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অবশ্য আমাকেও সঙ্গে নিয়ে গেল। অতি দ্রুত সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেল। আমার স্ত্রীর সাজ-ঘরে নার্সের জন্য একটা খাঁটি য়া পাতা হল। কিন্তু তখনই মিসেস ম্যাকউ ইলিয়ামস্ বলে উঠল, আমরা যে অন্য ছেলের কাছ থেকে অনেকটা দূরে চলে এলাম; রাতের বেলায় তার মধ্যেও যদি রোগের লক্ষণ দেখা দেয় তখন কি হবে-বেচারি আবার ভয়ে একেবারে সাদা হয়ে গেল।

তখন আমরা সেই ছোট বিছানা ও নার্সকে আমার ছেলেমেয়েদের ঘরেই ফেরৎ পাঠালাম এবং আমাদের বিছানাটা পাতলাম পাশের একটা ঘরে।

ইতিমধ্যে মিসেস ম্যাকউইলিয়ামস্ আবার বলল, ধর পেনিলোপ-এর রোগ যদি ছেলেকে ধরে? একথা ভাবতেই তার মনে আবার ভয় ধরে গেল এবং আমরা সকলে মিলে ছোট বিছানাটা নার্সারিতে নিয়ে যাবার পথেই সে নিজে এসে সেটাতে হাত লাগাল এবং তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সেটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

আমি নীচে নেমে গেলাম; সেখানেও নার্সের থাকবার মত কোন জায়গা ছিল না। তাছাড়া, মিসেস ম্যাকউইলিয়ামস্ বলল, নার্সের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত প্রয়োজন। কাজেই মালপত্র নিয়ে আমরা আবার নিজেদের শোবার ঘরে ফিরে গেলাম, এবং ঝ ঞ তাড়িত পাখিদের নীড়ে ফেরার মত পরম সুখ লাভ করলাম।

সব কিছু নিজের চোখে দেখবার জন্য মিসেস ম্যাক উইলিয়ামস পুনরায় নার্সারিতে গেল। একমুহূর্ত পরেই সভয়ে ফিরে এসে বলল, ছোট বাচ্চাটা এত ঘুমুচ্ছে কেন?

আমি বললাম আরে বাবা বাচ্চারা তো সব সময় পাথরের মূর্তির মতই ঘুমিয়ে থাকে।

জানি, জানি; কিন্তু এ ঘুমের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মনে হচ্ছে-মনে হচ্ছে সে নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস টানছে। উঃ, এ যে সাংঘাতিক

কিন্তু সে তো সব সময়ই নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস টানে।

আঃ, সেকথা আমি জানি। কিন্তু এখন যেন ব্যাপারটা খুবই ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছে। তার নার্সটি ও অল্পবয়সী আর অনভিজ্ঞ। মারিয়া তার কাছে থাকুক, যাতে কোন কিছু ঘটলে সে দেখতে পারে।

সেটা খুব ভাল কথা, কিন্তু তোমাকে সাহায্য করবে কে?

আমার যেটুকু সাহায্য দরকার সে তো তুমিই করতে পারবে। যাই হোক, এরকম অবস্থায় সব কিছুই আমি নিজের হাতে করতে চাই, কারও সাহায্য চাই না।

আমি বললাম, আমাদের ছোট রোগীটির পাশে জেগে বসে থেকে সে ক্লান্ত রাত কাটিয়ে দেবে আর আমি বিছানায় শুয়ে ঘুম দেব, সেটা যে আমার পক্ষে খুবই নীচ তার পরিচয় হবে। কিন্তু সে জোর করে আমাকে দিয়ে তাই করাল। কাজেই বুড়ি মারিয়া চলে গেল। এবং নার্সারিতে তার নিজের জায়গায়ই বহাল রইল।

পেনিলোপ ঘুমের মধ্যে দুবার কাশল।

আঃ, ডাক্তার এখনও আসছে না কেন! মার্টিমার, এ ঘরটা বড় গরম। সত্যি বড় বেশী গরম। রেগুলেটারটা অফ করে দাও-শিগগির!

রেগুলেটারটা ঠেলে দিলাম; সঙ্গে সঙ্গে থার্মোমিটারটা দেখে নিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, একটি অসুস্থ শিশুর পক্ষে ৭০ ডিগ্রি কি বড় বেশী গরম।

কোচয়ান খবর নিয়ে ফিরে এল, আমাদের ডাক্তারটি অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। মিসেস ম্যাকউইলিয়ামস্ মৃত্ম-শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মৃত-কঠিন গলায় বলল;

এর মধ্যে নিয়মিত ইঙ্গিত রয়েছে। এটা পূর্বনির্দিষ্ট। এর আগে তো তিনি কখনও অসুস্থ হন নি। কখনও না। আমাদের যে ভাবে থাকা উচিত সে ভাবে আমরা থাকি কি মার্টিমার। এ কথা বার বার তোমাকে আমি বলেছি। এখন তার ফল ভোগ কর। আমাদের বাচ্চা কোনদিন ভাল হয়ে উঠবে না। নিজেকে যদি ক্ষমা করতে পার তো কর, আমি কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।

তাকে আঘাত করবার ইচ্ছা আমার ছিল না; কোন রকম না ভেবেচিন্তেই বললাম, আমরা যে এ রকম সমাজবহির্ভূত জীবন যাপন করছি তা আমি জানতাম না।

মার্টিমার! বাচ্চাদেরও তুমি এর মধ্যে জড়াতে চাও!

সে কাঁদতে শুরু করে দিল। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল:

ডাক্তার নিশচয় ওষুধ পাঠিয়েছেন!

আমি বললাম, নিশ্চয়। তুমি কখন বলবার সুযোগ দেবে তার জন্যই তো অপেক্ষা করে আছি।

ওগুলো আমাকে দাও। তুমি কি জান না যে এখন প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান। কিন্তু তিনি যখন জানেন যে এ রোগ দুরারোগ্য, তখন ওষুধ পাঠাবার দরকারটা কি ছিল?

আমি বললাম, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

আশা! মার্টিমার, যে সন্তান এখনও জন্মে নি তার মতই তুমি যা বলছ তার কিছুই তুমি জান না। তা যদি জানতে-এই তো। সেবন-বিধিতে লেখা রয়েছে, প্রতি ঘণ্টায় এক চা-চামচ ওষুধ খাওয়াতে হবে। ঘটায় একবার!-যেন বাচ্চাকে বাঁচাবার জন্য আমাদের হাতে একটা গোটা বছর পড়ে আছে! মার্টিমার, দয়া করে তাড়াতাড়ি কর! বেচারি মরতে বসেছে, ওর মুখে এক বড় চামচ ওষুধ দাও। তাড়াতাড়ি কর!

সে কি প্রিয়ে, বড় চামচ ওষুধ দিলে-

আঃ, আমাকে পাগল করে দিও না!…এই যে, এই যে আমার আদরের সোনা শুয়েছে; ওষুধটা বাজে, তেতো, কিন্তু মায়ের নয়নের মণি নেলির জন্য ওষুধটা ভাল-ওটা খেলে ও সেরে উঠবে। এই যে, এই যে সোনা, মায়ের বুকে ছোট্ট মাথাটা রেখে শুয়ে পড়, ঘুমিয়ে পড়। ওঃ, আমি তো জানি, সকাল পর্যন্ত ও বেঁচে থাকবে না! মার্টিমার, প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর বড় চামচের এক চামচ দিলে-ওঃ, বাছার আমার বেলাড়োনা দরকার; আমি জানি দরকার-আর একোনাইট ও। সব নিয়ে এস মার্টিমার। আহা, আমার মত চলতে দাও আমাকে। এ সব ব্যাপারে তুমি কিছু বোঝ না।

এবার আমরা শুতে গেলাম। ছোট বিছানাটা রাখা হল আমার স্ত্রীর বালিশের লাগোয়া। এই সব গোলমালে আমার বড়ই ধকল গেছে, দুই মিনিটের মধ্যেই আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়লাম। মিসেস ম্যাকউইলিয়ামস্ আমাকে জানিয়ে দিল: প্রিয়তম, রেগু লেট রটা কি অন করা আছে?

না।

আমিও তাই ভেবেছিলাম। দয়া করে এখনই ওটা অন করে দাও। ঘরটা বড় ঠাণ্ডা।

অন করে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আবার আমার ঘুম ভাঙানো হল:

প্রিয়তম, ছোট বিছানাটাকে তোমার খাটের দিকে টেনে নিতে তোমার আপত্তি আছে কি? এখানে ওটা রেগুলেটারের বড়ই কাছাকাছি রয়েছে।

বিছানাটাকে টানতে গিয়ে ধাক্কা লেগে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে গেল। আমার স্ত্রী তাকে শান্ত করতে করতেই আমি আবার ঘুমে ঢুলে পড়লাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তন্দ্রার আবছা কুয়াশার ভিতর দিয়ে এই কথাগুলি যেন অনেক দূর থেকে কানে এসে লাগল:

মার্টিমার, ভাল হাঁসের চর্বি যদি পাওয়া যেত-একবার ঘণ্টাটা বাজাবে?

ঘুমের মধ্যেই বাইরে বেরিয়ে গেলাম, একটা বিড়ালকে মাড়িয়ে দিলাম, প্রতিবাদে সেটা ফ্যাচ করে উঠল, আমিও তাকে একটা আচ্ছা লাথি কসাতাম, কিন্তু সেটা পড়ল গিয়ে একটা চেয়ারের উপর।

আহা মার্টিমার, গ্যাসটা জ্বালাতে গেলে কেন? বাচ্চাটা জেগে উঠবে যে?

আমার কতটা আঘাত লেগেছে সেটা দেখতে চাই ক্যারোলিন।

ভাল কথা, চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে দেখ-ওটার বারোটা বেজে গেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বেচারি বিড়ালটা, ধর তুমি যদি-

না, এই বিড়াল সম্পর্কে কোন কিছুই ধরে নিতে আমি রাজী নই। মারিয়াকে যদি এখানে থাকতে দেওয়া হত তাহলে এ সব কিছুই ঘটত না; এ সবই তো তার কাজ, আমার নয়।

দেখ মার্টিমার, আমি মনে করি, এ ধরনের কথা বলতে তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত। এমন একটা ভয়ঙ্কর সময় যাচ্ছে, আমাদের বাচ্চাটার এই হাল, আর আমার কথা মত দুএকটা টুকিটাকি কাজও তুমি করতে পারবে না এটা খুবই দুঃখের কথা!

ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি যা করতে বলবে তাই করব। কিন্তু এখন ঘণ্টা বাজিয়ে আমি কাউ কে পাব না। সবাই শুতে গেছে। হাঁসের চর্বি কোথায় আছে?

নার্সারিতে ম্যান্টে লপিসের উপরে। পাটা বাড়িয়ে যদি মারিয়াকে বল–

হাঁসের চর্বি এনে দিয়ে আবার ঘুমোতে গেলাম। আবার ডাক এল:

মার্টিমার, তোমাকে বিরক্ত করতে আমি ঘৃণা বোধ করি, কিন্তু ঘরটা এত ঠাণ্ডা যে এটা লাগাতে পারছি না। আগুনটা জ্বেলে দেবে কি? সবই ঠিক আছে, শুধু একটা দেশলাইয়ের কাঠি ধরিয়ে দিলেই হল।

শরীরটাকে টানতে টানতে এগিয়ে গিয়ে আগুন জ্বেলে দিলাম এবং বিরক্ত হয়ে সেখানেই বসে পড়লাম।

মার্টিমার, ওখানে বসে থেকে আর মরণ ডেকে এন না। বিছানায় এস।

পা বাড়াতেই সে বলল:

কিন্তু এক মিনিট সবুর কর। বাচ্চাটাকে আরও ওষুধ দাও।

দিলাম। এ ওষুধটা খেলেই বাচ্চারা কিছুটা ঝরঝরে হয়ে ওঠে। আর সেই সুযোগে সে জেগে উঠলেই বাচ্চাটার জামা খুলে আমার স্ত্রী তার সারা গায়ে হাঁসের তেল লাগাতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম এবং যথারীতি আবার উঠতে হল।

মার্টিমার, বাতাসের ঝাপ্টা লাগছে। আমি পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি। এ রোগের পক্ষে ঠাণ্ডা বাতাস বড়ই খারাপ। দয়া করে ছোট বিছানাটা আগুনের কাছে সরিয়ে দাও।

তাই দিলাম; আর সে কাজ করতে গিয়ে পাথরটায় ঠোক্কর খেয়ে সেটাকে আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিলাম। মিসেস ম্যাকউ ইলিয়াস বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে সেটাকে উদ্ধার করল; কিছু কথা-কাটাকাটি ও হল। আবার যৎসামান্য একটু ঘুমিয়েই উঠতে হল; এবার বানাতে হল একটা মনের পুটি স। বাচচাটার বুকের উপর সেটা লাগিয়ে দেওয়া হল, তাতে যদি রোগ সারে।

কাঠের আগুন স্থায়ী বস্তু নয়। প্রতি কুড়ি মিনিট অন্তর উঠে আমাকে নতুন করে আগুন জ্বালাতে হল, আর তার ফলে মিসেস ম্যাকউ ইলিয়ামস্-এর পক্ষে ওষুধ খাওয়াবার সময়ের ব্যাবধানটা দশ মিনিট করে কমে গেল, আর তাতেই সে মহা খুশি। আমিও মাঝে মাঝেই মনের বীজের পুটি সটা পাল্টে দিলাম, এবং বাচ্চাটার শরীরের যেখানে যেখানে ফাঁকা রয়েছে সেখানেই সরষের পুটিস বা অন্য ধরনের বেলেস্তারা লাগাতে লাগালাম। যা হোক, সকালের দিকে কাঠ ফুরিয়ে গেল এবং আমার স্ত্রী নীচ থেকে আরও কাঠ নিয়ে আসতে বলল।

আমি বললাম, দেখ গো, ওটা বড় খাটুনির কাজ; তাছাড়া বাড়তি জামা-কাপড়ে বাচ্চাটা তো বেশ গরমই আছে। এখন বরং আর এক পর পুটি স লাগালে–

আমার কথা শেষ হল না। বাধা পেলাম। কিছুক্ষণ নীচ থেকে কাঠ বয়ে আনলাম, আর তারপরই এমনভাবে নাক ডাকতে শুরু করলাম যেন আমার সব শক্তি-সামর্থ্য গলে জল হয়ে গেছে, মনও ঝিমিয়ে পড়েছে। দিনের আলো পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠতেই কে যেন। আমার ঘার চেপে ধরতেই হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরে এল। আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার স্ত্রী হাঁপাচ্ছে। তারপর কথা বলবার মত অবস্থা হতেই সে বলে উঠল:

সব শেষ হয়ে গেছে! সব শেষ! বাচচাটা ঘামছে! আমরা কি করব?

উঃ, তুমি আমাকে কি ভয় পাইয়ে দিয়েছ! কি যে করব কিছুই তো বুঝতে পারছি না। হয় তো জামাগুলো ছাড়িয়ে আবার একটু ঠাণ্ডা বাতাসে নিয়ে গেলে-

উঃ, কী নির্বোধ! একমুহূর্ত সময় নষ্ট করো না। ডাক্তারের কাছে যাও। নিজে যাও। তাকে বল, জীবিত বা মৃত তাকে আসতেই হবে।

বেচারি অসুস্থ লোকটি কে বিছানা থেকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম। বাচ্চাটাকে ভাল করে দেখে সে বলল, মরবার কোন লক্ষণ নেই। আমার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করবার নয়, কিন্তু আমার স্ত্রী এতই পাগল হয়ে উঠল যেন তাকে ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা হয়েছে। তখন ডাক্তার জানাল যে, গলায় সামান্য প্রদাহ বা অন্য কোন তুচ্ছ কারণেই কাশিটা হয়েছে। এ কথা শুনে আমার মনে হল, আমার স্ত্রী এখনই তাকে দরজাটা দেখিয়ে দেবে। এবার ডাক্তার বলল যে বাচ্চাটা আর একটু বেশী করে কাশলেই গোলমালটা কেটে যাবে; সুতরাং সে তাকে এমন একটা ওষুধ দিল যাতে সে ক্রমাগত কাশতে লাগল। আর তার ফলেই একটা ছোট কাঠের টুকরো বা ঐ রকম একটা কিছু বেরিয়ে এল।

ডাক্তার বলল, বাচ্চাটির ঝিল্লির প্রদাহজনিত ঘুঙুরি কাশি মোটে ই হয় নি। সে পাইনের কাঠি বা ঐ রকম একটা কিছু চুষছিল এবং তারই একটা টুকরো গলায় আটকে গিয়েছিল। এতে তার কোন ক্ষতি করবে না।

আমি বললাম, তা করবে না আমি জানি। আসলে ওতে যে তাৰ্পিন থাকে সেটা বাচ্চাদের কোন কোন অসুখের খুবই উপকারী। সে কথা আমার স্ত্রীই আপনাকে বলবে।

আমার স্ত্রী কিন্তু কিছুই বলল না। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে ঘর থেকে চলে গেল। সেই থেকে আমাদের জীবনের এই একটি অধ্যায়ের কথা আমরা কখনও উল্লেখ করি না। সুতরাং গভীর অচঞ্চল প্রশান্তির ভিতর দিয়ে আমাদের জীবনের স্রোত বয়ে চলেছে।

ম্যাকউইলিয়ামস্-এর মত এমন অভিজ্ঞতা খুব অল্প বিবাহিত লোকেরই হয়েছে; সুতরাং এই বইয়ের লেখক মনে করে যে এর অভিনবত্ব পাঠকের মনকে ক্ষণকালের জন্যও আকৃষ্ট করবে।

[১৮৭৫]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *