ঘুঘু কাহিনি
হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার মোড়ে চলে এলেন সদাব্রতবাবু। অবশ্য মানসিক সদন থেকে এই নাগের বাজারের মোড় খুব কাছে নয়, কিন্তু কী-ই বা করা যাবে। আজ আড়াই বছর এই রকম চলছে। কোনও উন্নতিই হচ্ছে না। সেই রিটায়ার করে যখন প্রথম সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে, সি.আই.টি-র নতুন ফ্ল্যাট বাড়িটাতে এলেন সদাব্রত, তখনই ব্যাপারটার শুরু।
বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকলেই, কারণে অকারণে, দিনেদুপুরে, এমনকী রাত্রিতে ঘুমের মধ্যে পর্যন্ত মাথার মধ্যে, নাকি ঘরের মধ্যে, ঘুঘুর ডাক শুনতে পান সদাব্রতবাবু। কলকাতা শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে ঘরের মধ্যে বিছানায় শুয়ে ঘুঘুর ডাক, মাথা খারাপ হল নাকি আমার?আজ প্রৌঢ় বয়েসে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয় সদাব্রত রায়ের। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? এও তো আর বলা যায় না কাউকে, যাদের বলা যেত– একটা চাপা নিশ্বাস অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ়ের বুকের মধ্য থেকে নাক পর্যন্ত ঘোরাফেরা করে।
নিজের থেকেই বন্দোবস্ত করেছেন, প্রত্যেক শনিবার আসতে হয় এখানে, এই মানসিক সদনে, ডাক্তার সান্যালের কাছে চিকিৎসা করান। মাসে একদিন ইলেকট্রিক শক নিচ্ছেন আজ এক বৎসরের বেশি হয়ে গেল। সামনের শনিবার আবার শকের জ্বালা, ভাবতে গিয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। সদাব্রতর, না, আর পারা যায় না।
কিন্তু এই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি চাই। এখন অফিসের সময়। দশটা বাজে, বাসে ওঠা অসম্ভব। কিন্তু ট্যাক্সি তার চেয়েও অসম্ভব। শরীর অস্থির করতে থাকে তার, মাথার মধ্যে সব উলটোপালটা ভাবনা ভিড় করে। যদি একদম ক্ষেপে যেতেই হয়, খুন করে ক্ষেপে যাব, আর তখন ট্যাক্সি চালাব, দেখি কে ধরতে পারে? এই ট্যাক্সি…ছয় বার দৌড়িয়ে ব্যর্থ হলেন সদাব্রতবাবু।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে ব্যথা হয়ে গেল। ঠিক এই সময় প্রায় একটা দুর্ঘটনা। একটা বাস স্টপে একটুও না থেমে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল, একটা হিন্দুস্থানি মুটে-মজুর গোছের লোক হবে সেই বাস থেকে উলটোদিক মুখ করে ঝাঁপিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, জীবনপণ করে রাস্তায় ছিটকে পড়ল। বাসের ভেতর থেকে এবং রাস্তার চারপাশ থেকে, দোকানঘরগুলো থেকে লোকজন খুব চেঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল, এই রোককে, রোককে…গেল, গেল…।
বাসটা কিন্তু একটুও থামল না, ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেল। পতিত হতভম্ব লোকটা একটা ডিগবাজি খেয়ে প্রথমেই সদাব্রতবাবুর গায়ের ওপর, তারপর হুমড়ি, হুমড়ির পর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তায়, চরকিবাজি কিন্তু থামল না, আবার উঠে দাঁড়াতেই রাস্তার উপর পড়ে গেল। চলন্ত বাস থেকে উলটোদিক মুখ করে নামলে এই রকমই হয়, নোকটা রাস্তার উপর বেশ কয়েকটা গড়াগড়ি খেল। ভাগ্যিস বিশেষ কোনও জোর আঘাত লাগেনি, কোনও দিক থেকে একটা গাড়ি এসেও চাপা দিতে পারত। সদাব্রতবাবু এতক্ষণ ঠিক লক্ষ করেননি, একটি কালোমতন রোগা লম্বা চেহারার যুবক তার পাশেই বোধ হয় এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। সে-ই ছুটে গিয়ে লোকটাকে ধরে সোজা করে দাঁড়। করিয়ে দিল; লোকটা তখন হাঁফাচ্ছে, ঘটনার আকস্মিকতায় সে একটু হতভম্ব হয়ে গেছে। হঠাৎ সেই যুবকটি হিন্দুস্থানিটির ঘাড়ে একটা ঝাঁকি দিয়ে প্রশ্ন করল, কী, রাস্তাটা ভাঙতে পারলে না?
আশেপাশের সমস্ত লোকগুলো হো হো করে হেসে উঠল, সদাব্রতবাবুও হাসলেন। লোকটা আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
যুবকটির এই আচরণ এবং কথাবার্তা সবই সদাব্রতবাবুর কেমন যেন চেনাচেনা মনে হল। সদাব্রত একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
যুবকটি একটু ঘাড় চুলকে বলল, আপনি বোধ হয় আমার বড়দাকে দেখেছেন, আপনি কি কখনও ধানবাদে গেছেন?
সদাব্রতবাবুর এইবার মনে পড়ল এই ছেলেটিকেই মাসখানেক আগে গোলদিঘির কাছে দেখেছিলেন। সেদিনও এই রকম একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনা।
কলেজ স্ট্রিট দিয়ে আসছেন, হঠাৎ দেখলেন সমস্ত লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে, যে যেরকম পারে ছুটছে, তিনি কিছু বুঝতে না পেরে সকলের সঙ্গেই দৌড়ে গোলদিঘির মধ্যে ঢুকলেন। এর মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে এই ছেলেটিও ঢুকল, শার্টের হাতা ছিঁড়ে গিয়েছে, ফুল-প্যান্টের হাঁটুতে কাদা লেগে রয়েছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ার চিহ্ন বেশ বোঝা যাচ্ছে, এই মাত্র ধস্তাধস্তি গোছের কিছু হয়েছে। ছেলেটি এসে সদাব্রতবাবুকে সামনে পেয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনারা সব এরকম ছুটে পালালেন কেন, আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, আমি দেখতে এগুলাম, আমাকে একটা ক্ষ্যাপামতন ষাঁড় তেড়ে এসে গুঁতো দিয়ে ফেলে দিল।
কেন পালিয়েছিলেন ব্যাপারটা এতক্ষণে সদাব্রতবাবুর বোধগম্য হল। খুব বাঁচা গেছে, এই বুড়ো বয়েসে ষাঁড়ের গুঁতো, বাবা, কিন্তু ছেলেটির প্রশ্ন তাকে একটু ভাবিয়ে তুলল। পাশে কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা ফিক করে হেসে ফেলল বোধ হয় প্রশ্নটি শুনেই, তিনি একবার মেয়েদের দিকে তারপর একবার বিধ্বস্ত ছেলেটির দিকে তাকালেন। তখনই তার কেমন চেনা মনে হল, বেশ চেনা চেনা মনে হল ছেলেটিকে, জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি বলুন তো?
যুবকটি বলল, আপনি বোধহয় আমার বড়দাকে দেখেছেন, আপনি কখনও ধানবাদে গেছেন?
সদাব্রত ঘাড় নেড়ে না জানিয়েছিলেন।
তাহলে ভাগলপুর, মুঙ্গের? আমার বড়দা বিহারে স্টেশনমাস্টার, তাকেই দেখেছেন। ছেলেটি পরম বিশ্বাসের সঙ্গে বলল।
কিন্তু সদাব্রতবাবু দেওঘর ছাড়া বিহারে আর কোথাও কোনও দিনই যাননি। তার এও স্পষ্ট ধারণা এই যে, এই ছেলেটিকেই তিনি বহুবার কোথাও দেখেছেন, মাথাটা ঠিক নেই, না হলে ঠিক মনে করা যেত।
ছেলেটি যখন জানতে পারল সদাব্রতবাবু তার বড়দাকে কোথাও দেখেনি বরং তাকেই কোথাও দেখেছেন বলে মনে করছেন, বলল; তাহলে আপনি আমার ছোড়দাকে খুব সম্ভব দেখেছেন! অবশ্য ছোড়দাকে দেখলে আমার ভাই বলে চেনা কঠিন। তার রং খুব ফরসা, স্বাস্থ্য ভাল তার ওপরে বেঁটে, খুবই বেঁটে। আমার সঙ্গে তার চেহারার কোনও মিলই নেই।
যুবকটির এই ধরনের অর্থহীন, অসংলগ্ন আত্মপরিচয়ে সদাব্রত সেদিন খুব বিব্রত বোধ করেছিলেন। যথেষ্ট অবাকও হয়েছিলেন, আজও তাই হলেন। এর কথার কোনও মাথামুণ্ডু ধরা যায় না। এর ছোড়দার সঙ্গে যদি এর চেহারার একেবারে কোনও মিলই না থাকে তবে একে দেখে এর ছোড়দার কথা মনে পড়তে পারে কী করে?
এর মধ্যে ছেলেটি দুই হাত ছড়িয়ে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে একটা মিটার ডাউন ট্যাক্সি ফাঁকা যাচ্ছিল দেখে সেটা আটকাল, তারপর ড্রাইভারের সঙ্গে একচোট বচসা এবং জোর করেই একরকম ট্যাক্সির মধ্যে উঠে বসল। উঠে সদাব্রতকে ডাকল, আসুন আপনি তো ওই দিকেই বোধহয় যাবেন। আপনাকে শ্যামবাজারে নামিয়ে দিয়ে যাব।
সদাব্রত খুব খুশিই হলেন, ছেলেটা ভালই বলতে হবে। একবার শ্যামবাজার পৌঁছালে সেখান থেকে যা তোক গাড়ি-টাড়ি একটা ধরা যাবে।
ট্যাক্সিতে বসে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কতদূর যাবেন?
এই এন্টালির কাছে। আপনি?
আমিও তো এন্টালির দিকেই যাব। ঠিক আছে একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। সদাব্রত বিশেষ আশ্বস্ত কণ্ঠে বললেন।
এন্টালিতে সি আই টি-র মোড়ে এসে সদাব্রত বললেন, আমার এখানে নামলে হবে।
ছেলেটি বলল, ঠিক আছে আপনি নামুন, আমিও এখানেই নামতাম। তবে পার্কসার্কাসে একটা কাজ আছে, সেটা সেরে আসি।
ছেলেটি চলে গেল। ট্যাক্সির ভাড়াটা দিতে চাইলেন সদাব্রত, কিন্তু ছেলেটি কিছুতেই নিল না। সদাব্রত ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলেন, ছেলেটিকে কোথায় দেখেছি?
এর পরেও সদাব্রত ছেলেটিকে একাধিকবার এদিকে ওদিকে এই পাড়াতেই দেখতে পেলেন। সেই সব অসংলগ্ন উত্তরমালার কথা ভেবে বিশেষ ভরসা পেলেন না আলাপ করবার। একটু এড়িয়েই চললেন। কিন্তু ছেলেটির ব্যাপার-স্যাপার কীরকম যেন। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যার দিকে সদাব্রত রাস্তায় একটু পায়চারি করছেন, পার্কের পাশের রাস্তা, পার্কের ধারে রাস্তা ঘেঁষে একটা বড় রাধাচূড়া ফুলের গাছ, সেইখানে ফুটপাথের ওপরে একটা হাঁটু গেড়ে ছেলেটা উবু হয়ে বসে ডান হাতের কবজি গোলমতন করে কী যেন দেখাচ্ছে। পাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, মেয়েটি মৃদু মৃদু হাসছে। এই সময় সদাব্রত মুখোমুখি পড়ে গেলেন, এড়ানো গেল না; তার উপরে একটু কৌতূহলও ছিল। ছেলেটি সদাব্রতকে দেখে একটু অপ্রস্তুত অবস্থাতেই যেন উঠে দাঁড়াল। সদাব্রত জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?
আজ্ঞে, ও মানে মানু বলছিল, ছেলেটি মেয়েটার দিকে তাকাল, মানু নামে মেয়েটি তখন মুখ পার্কের দিকে ফিরিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চাপা দিয়েছে, ছেলেটি বলে চলল, ও বলছিল, এটা নাগকেশরের ফুল।
সদাব্রতকে ছেলেটি আঙুল দিয়ে দেখাল, রাধাচূড়া গাছের ডালে একটা পরগাছা, তাতে সাদা ধবধবে একগুচ্ছ ফুল ফুটেছে। সদাব্রত নাগকেশর ফুল চেনেন না, বললেন, এটা নাগকেশর নয়?
আরে না, না। ছেলেটি আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। ফুটপাথে হাঁটু গেড়ে বসে ডান হাতের কবজি বেঁকিয়ে দেখাতে লাগল নাগকেশর ফুল আসলে কীরকম। মানু মেয়েটি তখন পার্কের রেলিঙের উপর লুটিয়ে পড়েছে, সমস্ত শরীর হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিনিট কয়েক আগের ব্যাপারটা সদাব্রত কিছুটা অনুধাবন করতে পারলেন। কিন্তু ছেলেটির কি মাথা খারাপ, একে কি কোনও পাগলা গারদে দেখেছি, নাগের বাজারে মানসিক সদনে। না, তাও তো ঠিক মনে হয় না। এই সব ভাবতে ভাবতে সদাব্রত ফিরলেন, তখনও ছেলেটি ফুটপাথে উবু বসে রয়েছে।
পরের দিন আবার শনিবার। এই শনিবার ইলেকট্রিক শক নিতে হয়েছে। ভীষণ যন্ত্রণা, সমস্ত শরীরে ব্যথা, মাথা দপ দপ করছে। যেসব দিনে শক নেন, সদাব্রত সারাদিন মানসিক সদনেই থাকেন, সন্ধ্যার দিকে এই ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন। মানসিক সদনে যতক্ষণ ছিলেন বেশ ভালই ছিলেন। কিন্তু ফ্ল্যাটে এসেই অনুভব করলেন সেই পুরনো গোলমালটা, সেই মাথার মধ্যে, না ঘরের মধ্যে, না কোথায় কাছাকাছিও অসহ্য, অসহ্য বোধ হতে লাগল। দুটো বালিশ দিয়ে মাথা চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
রাত দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ ভয়ংকর হই-চই চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল তার। যখন ঘুম ভাঙল, চমকে উঠলেন, সমস্ত ঘর ভরতি আলো। তাড়াতাড়ি উঠে জানলার কাছে দাঁড়াতেই ভীষণ হলকা লাগল গায়ে।
ফ্ল্যাটের লাগোয়া একটা রঙের ফ্যাক্টরি, সেটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। বাতাসের ঝাপটায় আগুন ফুঁসে ফুঁসে এই ফ্ল্যাট বাড়িটার গায়ে একটা করে ঝাপটা দিচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে দুমদাম সবাই ছুটে নামছে। সদাব্রত মিনিটখানেক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন, সামনেই সিঁড়ি–এত বড় ফ্ল্যাট বাড়িটার সমস্ত লোক একসঙ্গে নামার চেষ্টা করছে। তাও খালি হাতে নয়। যে যার মূল্যবান জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে। কারও হাতে পুঁটলি, কারও মাথায় ট্রাঙ্ক। সদাব্রতবাবু একবার ভাবলেন; তারপর আর ঘরের দিকে ফিরলেন না, যা হয় হবে, আগুনে যদি সব পুড়েই যায়, কিছু বাঁচানোর চেষ্টা না করাই ভাল। সকলের সঙ্গে তিনিও সিঁড়ি ধরে নামতে লাগলেন।
নিরাপদ ব্যবধানে সবাই উলটোদিকের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াল। এরই মধ্যে কেউ কেউ ভয়ংকর কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেল বাড়ির মধ্যে ঠিক কেউ আটকে যায়নি। আর আগুনও এখন পর্যন্ত বাড়িটাকে ধরেনি। রঙের ফ্যাক্টরিটাই জ্বলছে, খুবই দাউ দাউ করে জ্বলছে, বহুদূর পর্যন্ত আলো ছড়িয়ে গেছে, চতুর্দিক থেকে ক্রমাগত লোক দৌড়ে এইদিকে আসছে, আশেপাশে বাড়িগুলির জানলায়, বারান্দায় ছাদে ভিড় জমে গেছে। এই সময় ঘণ্টা দিয়ে দমকল এসে পৌঁছাল। ভীষণ ভিড়ের মধ্যে দমকলের গাড়ি ঢুকতে পারছে না। এমন সময় সেই ছেলেটি হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এল, এসে ভিড় সরিয়ে দমকলের গাড়ির জায়গা করে দিল। তারপর সদাব্রতর খুব কাছাকাছি এসে কাকে যেন খুঁজতে লাগল, মানু, এই মানু।
সদাব্রত বুঝলেন, সেদিনের সেই মেয়েটিকে ডাকছে। পেছন দিক থেকে চাপা গলা শোনা গেল, কী চেঁচামেচি করছ, এই যে আমি এখানে।
আমার খাঁচা এনেছ, আমার খাঁচা? ছেলেটি ভীষণ ব্যস্ত।
মেয়েটি একটু এগিয়ে এল, গয়নার বাক্স নিয়েই বেরোতে পারি না, আবার খাঁচা! গলার স্বরে একটু তিক্ততা।
আমার খাঁচা। আমার খাঁচা। ছেলেটি পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে ছুট দিল।
এই শোনো, শোনো। মেয়েটি ভীষণ ভয় পেয়ে ওকে ডাকতে লাগল। দু-একজন লোক চেঁচিয়ে উঠল, আরে মশায় পাগল নাকি?
কিন্তু কে কার কথা শোনে। ঊর্ধ্বশ্বাস ছেলেটির পায়ের দুমদাম শব্দ সিঁড়িতে শোনা গেল, উঠল, নামল, তারপর আবার এক ছুটে রাস্তার এই পাশে, একেবারে সদাব্রতর পাশে। দুহাতে দুটি খাঁচা, রাত্রিবেলা বলে বোধহয় পরদা দিয়ে ঢাকা।
এতক্ষণ সদাব্রত সব লক্ষ করছিলেন। এইবার ছেলেটি খাঁচা দুটি সদাব্রতর পায়ের পাশে মাটিতে রেখে হাঁপাতে লাগল। এর মধ্যে মানু নামে মেয়েটিও এগিয়ে ওদের পাশের দিকে চলে এসেছে।
খাঁচার ভিতরে পাখির পাখার ঝটপটানি শোনা গেল। হঠাৎ বিদুৎ চমকের মতো কী একটা কথা সদাব্রতর মনের মধ্যে খেলে গেল। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে, তিনি একবার ছেলেটির দিকে, একবার খাঁচা দুটির দিকে গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর হঠাৎই ঝট করে ছেলেটির হাত চেপে ধরলেন। এই যে আপনি…
ঘটনার আকস্মিকতায় ছেলেটি যেন একটু হতভম্বই হয়ে গেছে। সে কী একটা কথা বলার জন্যে হাঁ করল, শুধু আ-আ-আজ্ঞে এইটুকু বলার আগেই সদাব্রত তার হাত ধরে একটা জোরে ঝাঁকুনি দিলেন। এই মুখভঙ্গি, তার ভয়ংকর পরিচিত এবং এর থেকে যে উত্তর বেরিয়ে আসবে তা তার প্রায় মুখস্থ। তিনি প্রায় চিৎকার করেই উঠলেন। না, আপনার দাদাকে আমি কোথাও কখনও দেখিনি। আমি ধানবাদ যাইনি। ভাগলপুর যাইনি। মুঙ্গের যাইনি। জীবনে স্টেশনমাস্টার দেখিনি। উত্তেজনায় সদাব্রতর সারা শরীর কাঁপছে।
ছেলেটি হতচকিত অবস্থায় আবার কী যেন বলার জন্যে হাঁ করল, কিন্তু এবারও সদাব্রত সুযোগ দিলেন না। আপনার ছোড়দা, যার রং খুব ফরসা, স্বাস্থ্য খুব ভাল, তার উপরে বেঁটে, খুবই বেঁটে, যার সঙ্গে আপনার চেহারার একেবারেই মিল নেই, আপনার ভাই বলে মনে হয় না, না–তাকে কোথাও দেখিনি। আপনাকেই দেখেছি। আপনি এই, এই ফ্ল্যাট বাড়িতেই থাকেন?
বিমূঢ় ছেলেটিকে উদ্ধার করতেই মেয়েটি এবার কথা বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তাই কী হল?
আপনারা দোতলায় পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন? উকিলের মতো জেরা সদাব্রতর।
হ্যাঁ, খুবই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল মানু। ছেলেটি কোনও কথাই বলছে না।
হ্যাঁ, প্রায় ভেংচে ওঠেন সদাব্রত, আমি থাকি ছয় নম্বর ফ্ল্যাটে, আপনার পাশের ফ্ল্যাটে বিড়বিড় করতে থাকেন তিনি। তারপরেই আবার বিস্ফোরণ, আপনার ওই খাঁচায় পাখি আছে,কী পাখি ও দুটো ঘুঘু পাখি?
এই সময় খাঁচার মধ্য থেকে পাখি দুটো ডেকে উঠল, ঘু-উ-উ-উ, ঘু-উ-উ-উ, ঘু-উ এবং সঙ্গে সঙ্গে সদাব্রত অজ্ঞান হয়ে গেলেন। মানু পাশেই দাঁড়িয়েছিল, মাটিতে পড়তে দিল না, দু হাত দিয়ে জাপটে ধরল সদাব্রতকে।
যখন জ্ঞান ফিরল সদাব্রত দেখলেন তিনি নিজের ফ্ল্যাটে বিছানায় শুয়ে আছেন। ফ্ল্যাট বাড়িটাতে আগুন লাগতে পারেনি, তার আগেই রঙের ফ্যাক্টরিটার আগুন দমকলের লোকেরা নিবিয়ে ফেলেছে। তখন ভোর হয়ে আসছে, জানলা দিয়ে ফিকে আলো, একটু হিম হিম বাতাস আসছে। মাথার কাছে একটা চাদর থাকে সেটা টানতে গিয়ে কার গায়ে হাত লাগল, তিনি উঠে বসলেন। মাথার বালিশের পাশে খাটের গায়ে হেলান দিয়ে মানু বসে রয়েছে, একটু দূরে ছেলেটি। মানু বোধ হয় সারারাত্রিই তার পাশে বসেছিল। এখন ঘুমে চোখ জড়ানো ছেলেটি সিগারেট খাচ্ছিল। তাঁকে উঠতে দেখে সিগারেটটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিল।
মানু প্রথম কথা বলল, এখন কেমন বোধ হচ্ছে?
ভাল। সদাব্রতর এখন ভালই লাগছিল।
আমরা খুব চিন্তায় পড়েছিলাম। মানু বলল, ছেলেটি চুপ করে আছে।
আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম বুঝি? সদাব্রত জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ, ঘুঘুটা খাঁচায় ডেকে উঠল আর আপনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এতবড় আগুন লাগল, এত দৌড়োদৌড়ি, ছুটোছুটি, তারপর সামান্য ঘুঘুর ডাক শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন? মানু হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করল।
সদাব্রত ম্লান হাসলেন, রিটায়ার করার পর থেকে একলা এই ফ্ল্যাটে আছি। যখন-তখন ঘরে বসে ঘুঘুর ডাক শুনি। আমি কি আর ভাবতে পেরেছি আমার পাশের ফ্ল্যাটে কেউ ঘুঘু পোষে! আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বলে আমি মাথার চিকিৎসা করছি, তিন বছর ইলেকট্রিক শক নিচ্ছি, এই ঘুঘুর ডাক মাথার মধ্যে শুনতে পাই বলে।
মানু অত্যন্ত লজ্জিত মুখে ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে তারপর বলল, দেখুন কী কাণ্ড। ওঁর যত সব উদ্ভট শখ। ঘুঘু পাখি, নাগকেশর ফুল। আমিও একদিন পাগল হয়ে যাব।
সদাব্রত যুবকটির বর্তমান অসহায়, অপ্রস্তুত অবস্থা অনুমান করে কিঞ্চিৎ সহানুভূতিশীল হওয়ার চেষ্টা করলেন। এর সঙ্গে একটু আলাপ করা যাক। মেয়েটির নাম মানু, বেশ নাম, কিন্তু এর নাম কী? ছেলেটিকে বললেন, আচ্ছা, আপনাকে…
কথা শেষ করতে হল না। তার আগেই ছেলেটি মুখ খুলল। সেই মুখস্থ উত্তরমালার বহু পরিচিত মুখভঙ্গি। আবার সেই ধানবাদ স্টেশনের স্টেশন মাস্টার, সেই একেবারে অমিল চেহারার ছোড়দা।
ভাগ্যিস, এই সময়ে দুটো ঘুঘু ডেকে উঠল, ঘু-উ, ঘু-উ, ঘু-উ-উ, ঘু-উ। সদাব্রত বেশ জোরে মাথায় একটা ঝাঁকি দিলেন; না, মাথার মধ্যে নয়।