ঘাসবন
হাতের লম্বা লাঠিটার ওপর ভর দিয়ে শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে দিলে সামনের দিকে; তারপর সেই অবস্থাতেই একটা লাফ দিলে শ্যামলাল। সঙ্গে সঙ্গে লাঠির মাথা আর শরীরটার একটা নির্ভুল সমকোণ রচনা করে শূন্যে উড়ন্ত একটা পাখির মতো ছোটো নালাটা সে পার হয়ে গেল। লাঠির নীচেটা গিয়ে পড়েছিল জলের মধ্যে, সেটাকে তুলে নিতে বেশি সময় লাগল না।
কোমর সমান নরম ঘাসের ভেতর দাঁড়িয়ে সে উৎকর্ণভাবে তাকাতে লাগল চারদিকে। হাতের একটা মুঠোকে চোঙার মতো গোল করে ধরলে চোখের সামনে, যেন ওতে আরও বেশি করে দেখতে পাবে। কিন্তু দিগদিগন্তজোড়া ঘন শ্যামল ঘাসবনের মধ্যে কোথাও দেখা গেল না আকাশের কোণে আঁকা গাঢ় নীলরঙা তিন পাহাড়ের রেখার মতো একটা পিঠের আভাস কিংবা শিংওয়ালা অতিকায় মাথাটা।
একটু দূরেই সবুজ তৃণপ্রান্তরের মাঝখানে আকস্মিক ব্যতিক্রমের মতো খানিকটা রাঙামাটির জাঙ্গাল বিকীর্ণ হয়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কেউ যেন মস্ত উঁচু করে একটা রাস্তা তৈরি করতে চেয়েছিল এখানে, কিন্তু যে-কারণেই হোক তার ইচ্ছাটা সম্পূর্ণ হয়নি। প্রাকৃতিক হোক আর ভুলে-যাওয়া কোনো মানুষের হাতের কাজেই হোক, এখন ওর নাম ভূতের জাঙ্গাল। কঠিন লালমাটি, ছোটো-বড়ো অসংখ্য কাঁকরে একেবারে বোঝাই। কেউ যেন আগুনে পুড়িয়ে মাটিটাকে লোহার মতো শক্ত আর নীরস করে দিয়েছে; তাই গোটা দুই শিমুল ছাড়া আর কিছু গাছগাছালি গজাতে পারেনি, হাঁ হাঁ করছে ন্যাড়া জাঙ্গাল। শুধু সর্বাঙ্গে জলার হিংস্রতম সাপ আলাদ গোখুরের ফোকর নিয়ে পড়ে আছে অতিকায় একটা কঙ্কালের মতো, আর তারই চারপাশে সবুজের ঐশ্বর্য ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোলা খাচ্ছে।
কপাল কুঁচকে এক বার জাঙ্গালটার দিকে তাকাল শ্যামলাল। উঠবে নাকি ওর ওপরে? সুবিধে হয় তাহলে, চারদিকের অনেকটা ভালো করে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু উঠতেও ভরসা হয় না। সবাই জানে জাঙ্গালটা গোখরো সাপের আস্তানা, তাদের ভয়ে একটা শেয়াল পর্যন্ত এগোয় না জাঙ্গালের দিকে।
শেয়াল নাহয় এগোয় না, কিন্তু আপাতত যা দেখা যাচ্ছে, না-এগিয়ে উপায় নেই শ্যামলালের। চোখ গিয়ে পড়ল মাঠের ওপারে প্রান্তরেখায়। সেখানে ম্লান হয়ে আসছে সূর্য। ছাড়া ছাড়া মেঘে রক্তাভ দীপ্তি। আর বেশি দেরি নেই। দেখতে দেখতে ধাঁ করে নেমে যাবে বেলাটা। তারপর মাঠের ওপরে ঘনাবে আলেয়া-জ্বলা কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার। সে-অন্ধকারে এই মাঠকে ভয় করতে থাকবে শ্যামলালের, নিজের লাঠির ওপরেও তার বিশ্বাস থাকবে না।
তবে আপাতত আকাশে সূর্য জেগে আছে এবং আস্থা আছে লাঠিখানার ওপরে। এক বার চোখাচোখি হয়ে গেলে যত জাঁদরেল আলাদ গোখুরই হোক, তাকে আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে হবে না। অলক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্ভাবনা কল্পনা করতেই কাঁধের পেশিগুলো ফুলে উঠল শ্যামলালের। নীচের ঠোঁটটাকে এক বার সে শক্ত করে চেপে ধরলে দাঁত দিয়ে, তারপর নির্ভীক পায়ে এগিয়ে চলল জাঙ্গালের উদ্দেশে। ওর ওপর থেকে ভালো করে চারদিকটা এক বার দেখে নেওয়া দরকার।
সন্তর্পণে মাটির দিকে চোখ রেখে শ্যামলাল উঠল জাঙ্গালে। কাঁকরগাঁথা শক্ত মাটির গা দিয়ে বর্ষার জল গড়িয়ে গড়িয়ে নামে, তাই তার সর্বাঙ্গে কতকগুলো খাঁজের মতো সৃষ্টি হয়েছে। সেই খাঁজের ভেতরে লাঠি ফেলে ফেলে শ্যামলাল উঠতে লাগল।
একটা শিমুল গাছের নীচে এসে সে দাঁড়াল। তলায় মসৃণ তকতকে মাটি, যেন যত্ন করে নিকিয়ে রাখা। দুটি-চারটে শিমুলের ঝরাপাতা ছাড়া আর কিছুই নেই। এখানে আর যা-ই হোক, ফস করে সাপে এসে ছোবল মারতে পারবে না।
চারদিকে তাকাতে একটা আশ্চর্য আর অপরূপ পৃথিবী ধরা দিল শ্যামলালের চোখে। সবুজ আর সবুজ—ধান নয়, ঘাস। বর্ষার জল নেমে গেছে জলা থেকে, নরম মাটির ওপরে স্তবকে স্তবকে গুচ্ছে গুচ্ছে ঘন সবুজ ঘাস উঠেছে, মাটিকে ঢেকে দিয়েছে। যতদূর চোখ যায়, এর আর শেষ নেই, ছেদ নেই। কোথাও ঢেউ-খেলানো জমি নেমে গেছে, কোথাও আস্তে আস্তে উঠে গেছে পাহাড়ের মতো অনেকখানি, মাথার ওপর হাতছানি দিচ্ছে তালের গাছ। সবুজ আর শান্ত, বিকেলের পড়ন্ত বেলা নিবিড় হয়ে আসছে, পাখপাখালির শব্দ নেই, শুধু বাতাসে একটা শিরশির আর সোঁ সোঁ স্বনন বাজছে।
ওরই মাঝখানে সাদা সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটা রেখা, ডুবে আসা রোদে এখন সোনার মতো ঝলমলে। এই নদীটা কাঞ্চন। ওর গায়ে খান কয়েক চালাঘরের আভাস, একটা লম্বা বাঁশের ওপর মহাবীরজির লালপতাকা। অস্ফুটস্বরে শ্যামলাল বললে, শালা!
কিন্তু মহিষটার কোনো চিহ্নই তো দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ গলা ফুলিয়ে একটা বিশ্রী আওয়াজ তুলল শ্যামলাল। তার কর্কশ আওয়াজটা চারপাশের শান্ত স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে দিলে। বাতাসের তরঙ্গে তরঙ্গে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল লহরে লহরে। শিমুল গাছের মাথার ওপর থেকে ভয়ার্ত দুটো বক ডানা মেলে দিলে আকাশে।
শ্যামলাল ডাকলে, আঃ আঃ আঃ–আঃ ইঃ–।
এক বার, দু-বার, তিন বার। কিন্তু দিগন্তবিস্তার ঘাসের বনে কোনোখানে এতটুকু সাড়া পাওয়া গেল না। শুনতে পাওয়া গেল না পরিচিত গম্ভীর গলার মৃদু প্রত্যুত্তর। এমন তো হয় না। শ্যামলালের মন আশঙ্কায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। বাথানের সবচাইতে দুধেল মহিষ, খোয়া গেলে সর্বনাশ। কিন্তু গেল কোথায়?
শালা। মহিষটার বাপ-মা তুলে একটা অশ্লীল গাল দিলে শ্যামলাল। তারপরে আবার তারস্বরে ডাকলে, আঃ আঃ আঃ…
এবার ডাকটা শেষ করবার আগেই শ্যামলাল চমকে থেমে গেল। সাড়া পেয়ে গেছে; কিন্তু মহিষটার নয়। একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ-কাছাকাছি কোথায় কে যেন খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল।
পাথরের মতো শক্ত জোয়ান, বাইশ বছরের নির্ভীক গোঁয়ার মানুষটার বুকের ভেতর ধক করে চমক লাগল। এই নির্জন মাঠের ভেতরে এমন করে কে হাসল? সন্ধ্যা হয়ে আসছে, শ্যামলাল দাঁড়িয়ে আছে ভূতের জাঙ্গালের ওপরে। চারদিকে জনপ্রাণীর সাড়া নেই, এমন সময় কে হাসতে পারে?
সারা শরীরটা নিজের অজ্ঞাতেই শিউরে উঠল এক বার। শক্ত মুঠোয় শ্যামলাল আঁকড়ে ধরলে লাঠিগাছকে। ভূত হোক, অপদেবতা হোক, বিনা যুদ্ধে কাউকে আমল দেওয়া হবে না। দু-চার ঘা লাঠি আগে হাঁকড়াতে হবে। তারপরে যা হওয়ার হোক।
আবার হাসির শব্দ শোনা গেল, খিলখিল করে মিষ্টি হাসি। একটু আগেই যে কর্কশ শব্দ তুলে সমস্ত মাঠখানাকে ভরিয়ে তুলেছিল শ্যামলাল, এরসঙ্গে তার কোনো মিল নেই। এ যেন শান্ত স্তব্ধ পৃথিবীকে গানে আর সুরে উল্লসিত করে দিলে। শ্যামলালের মন বললে, ভয় পাওয়ানোর হাসি এ নয়, খুশি করে তোলার; এমন হাসি আর যে-ই হাসুক, ভূতে হাসতে পারে না।
অনুমান নির্ভুল। এতক্ষণ দূরে দূরে দৃষ্টিটাকে ছড়িয়ে রেখেছিল বলেই কি এত কাছের জিনিসটা দেখতে পায়নি শ্যামলাল? জাঙ্গাল থেকে কয়েক-পা এগিয়েই ঘাসবনের ভেতর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। হিন্দুস্থানি মেয়ে, কানের বড়ো বড়ো রুপোর গয়না দুটো দেখেই তা বুঝতে পারা গেল। মাথায় লালশাড়ির ঘোমটা তোলা, কালো সুছাঁদ মুখোনা সকৌতুক মিষ্টি হাসিতে উজ্জ্বল। তার পাশেই লটপটে-কান একটা রামছাগলের মুখ চোখে পড়ছে। সেটাও যেন শ্যামলালের দিকে তাকিয়ে আছে কৌতুকভরা ভঙ্গিতে।
গোঁয়ার শ্যামলালের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত রাগে জ্বলে উঠল। মহিষটা পাওয়া যাচ্ছে না, তারজন্যে একেই মেজাজ বিগড়ে আছে, তার ওপরে এইরকম মর্মান্তিক ঠাট্টা! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়বার মতো অনুভূতি হল শ্যামলালের। তা ছাড়া আচমকা ভয় পাইয়ে মেয়েটা যেভাবে তাকে অপদস্থ করে দিয়েছে, সেটাও ক্ষমাযোগ্য অপরাধ নয়।
হাতের লম্বা লাঠিতে ভর দিলে শ্যামলাল, শরীরটাকে আকাশে ভাসিয়ে দিলে সরলরেখায়। তারপর মস্তবড়ো একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে সোজা লাফিয়ে পড়ল ঘাসবনের ভেতরে। এসে দাঁড়াল একেবারে মেয়েটার মুখোমুখি। ভয় পেয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা।
রূঢ়স্বরে শ্যামলাল হিন্দিতে বললে, এই, তুম কৌন হ্যায়?
শ্যামলালের হিন্দি শুনে মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেলল। গোঁয়ারগোবিন্দ মানুষ, পাথরে গড়া শরীর, মেজাজ সম্প্রতি বিলক্ষণ চড়া! হাতে প্রকান্ড একটা পাকা বাঁশের লাঠি, ইচ্ছে করলে এই নির্জন ঘাসবনের ভেতরে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করে দিতে পারে তাকে। আশ্চর্য, তবু ভয় পেল না মেয়েটা। স্বাভাবিক সংস্কারেই বোধ হয় কেমন করে জানতে পেরেছে লোকটা যত চোয়াড়ই হোক, সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ তার পক্ষে।
জবাব দিলে, আদমি হ্যায়।
আরও চটে গেল শ্যামলাল, আদমি হ্যায় সে তো হাম জানতাই হ্যায়। তুম যে ভূত নেহি হ্যায়, সে হাম বুঝতে পারা থা। লেকিন হাসত কেঁও!
আশ্চর্য বুকের পাটা মেয়েটার। বললে, হামারা খুশি।
তাজ্জব লাগল শ্যামলালের। এই এক ফোঁটা মেয়ের দুঃসাহসের পরিমাণ দেখে রাগ। করতেও ভুলে গেল শ্যামলাল। জানতা হ্যায়, হাম কৌন?
হাম কথাটার উপর জোর দিলে শ্যামলাল, কৌন শব্দটা উচ্চারণ করলে বেশ দরাজ কণ্ঠে। কিন্তু এবারেও মেয়েটা তাক লাগিয়ে দিলে। তুম ঘোষ হো৷
আর রাগ করা চলে না, এবার অবাক হওয়ার পালা। হিন্দি ভুলে গিয়ে শ্যামলাল বললে, কী করে জানলে। মেয়েটা হাসতে লাগল, জবাব দিলে না।
আর তুম?
ঘাটোয়ালকা লেড়কি। রুকনি।
মুহূর্তে ভাবান্তর ঘটে গেল শ্যামলালের। বিস্ময়, কৌতূহল, সব কিছু মিলিয়ে গিয়ে ক্রোধে দপ করে জ্বলে উঠল রক্ত। তাই বলো। শত্রুর মেয়ে না হলে এমন বুকের পাটা হয়! এতক্ষণে সে কৌতুকভরা হাসিটা একটা নতুন অর্থ নিয়ে দেখা দিল তার কাছে।
রাগে বেশি কথা আর বেরুতে চাইল না মুখ দিয়ে। হাতের লম্বা লাঠিটাকে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শ্যামলাল বললে, ভাগো।
তারপর নিজেই আর অপেক্ষা করল না। লাঠির ওপর ভর দিয়ে এক লাফে উঠে পড়ল জাঙ্গালের ওপরে, আর একটা লাফে চলে গেল ওপারে। দুজনের মাঝখানে ব্যবধানের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রইল ভূতের জাঙ্গালটা। বাতাসে শোনা যেতে লাগল ঘাসবনের শিরশির আর সোঁ সোঁ শব্দ।
পশ্চিম আকাশে তালবনের মাথার ওপর দিয়ে ডুবছে সূর্য। আর দেরি করা চলে না, লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘাসবন ঠেলে ঠেলে এগোতে লাগল শ্যামলাল। সমস্ত ক্রোধ, বিদ্বেষ, ক্লান্তি আর হতাশা ছাপিয়েও কী আশ্চর্য! সেই খিলখিল মিষ্টি হাসিটা অপূর্ব মাদকতার মতো ছড়িয়ে রইল তার চেতনার মধ্যে।
খেয়াঘাটের ঘাটোয়ালের ওপর জাতক্রোধ শ্যামলালের। ঘাটোয়ালকে এক বার কায়দামতো হাতের কাছে পেলে লাঠির মুখে তার মাথাটা গুঁড়িয়ে দেবে, পুঁতে দেবে জলার পানা আর গুঁড়ি কচুরির ভেতর, এইরকম একটা সাধু সংকল্প মনে মনে পুষে আসছে অনেক দিন থেকে। কিন্তু ঘাটোয়াল শ্যামলালের চাইতেও চালাক, সুতরাং এ-পর্যন্ত সুযোগটা আর ঘটে ওঠেনি।
এই নীরব নির্জন মাঠের মাঝখানে উল্লেখযোগ্য মানুষ বলতে এরা দুজন। সুতরাং শত্রুতার চেয়ে মিত্রতা হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল বেশি, কিন্তু হয়নি।
ডুবা জলাজমি-বর্ষায় সমুদ্র। বর্ষার পরে ঘাসের জমি। সেও সমুদ্র, কিন্তু নীলচে ঘোলাজলের নয়, সবুজ ঘাসের। আদি অন্তহীন এমন একটা গোচারণভূমি সারা উত্তরবাংলার কোথাও নেই। এর একপ্রান্তে ছ-মাইল দূরে গ্রাম, আর একপ্রান্তে চার মাইল। মাঝখানে এই দশ মাইল জায়গাজুড়ে বিস্তীর্ণ প্রকৃতি-প্রাথমিক পৃথিবী। আর এরই ভেতরে প্রক্ষেপের মতো ঘাটোয়ালের ঘাট আর শ্যামলারের মহিষের বাথান।
চার-পাঁচ পুরুষ আগে হিন্দুস্থানি ছিল শ্যামলালেরা। কিন্তু সে-কৌলীন্য আর নেই এখন। মাতৃভাষার জায়গা দখল করেছে প্রাদেশিক বাংলা, কখনো কখনো তার ভেতরে বালিয়া জেলার এক-একটা বেখাপ্পা শব্দ উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জিত। পিতৃপুরুষের ভাষা আর নেই, রুচিরীতিও বদলেছে, কিন্তু বদলায়নি পেশাটা।
এই দিগবিস্তার মাঠের ভেতরে মহিষের বাথান। মহিষের সংখ্যা কম নয়, ছোটো-বড়ো বাছুরগুলোসুদ্ধ প্রায় আঠারোটি। আগে আরও ছিল, তবে দু-বছর আগে মড়ক লাগাতে অনেকগুলো শেষ হয়ে গেছে। সেজন্যে শোকবোধটাও পুরোনো হয়ে গেছে। আপাতত ওই আঠারোটিকে নিয়েই খুশি আর পরিতৃপ্ত আছে শ্যামলাল।
প্রায় তিন মাইল এগিয়ে উঁচু টিলার ওপরে শ্যামলালের ঘর, চাকরদের আস্তানা, মহিষের গোয়াল। আপনার বলতে কেউ নেই, একান্তভাবে একা। কিন্তু ক্ষোভ নেই এই একাকিত্ববোধের জন্যে, বেদনাও নেই। এই মহিষগুলোকে নিয়েই তার দিন কাটে। বড়ো ভালো লাগে অতিকায় চেহারার অবোলা প্রাণীগুলিকে। জলার ঘাস খেয়ে নধর মসৃণ দেহ তাদের তৈলাক্ত স্বাস্থ্যে চকচক করে, তাদের স্নেহস্নিগ্ধ পরিতৃপ্ত চোখগুলির দিকে তাকিয়ে ভারি তৃপ্তি বোধ হয় শ্যামলালের। মায়ের মতো আদর করে সে, মহিষগুলোর গলার নীচে হাত বুলিয়ে দেয়, আরামে চোখ বুজে আসে তাদের। এত বড়ড়া বড়ো বিশালকায় পশুগুলোকে শিশুর মতো অসহায় বলে বোধ হতে থাকে।
আবার বর্ষায় আর একরকম। মাঠে তখন থইথই করে জল, মহিষগুলোর স্বেচ্ছাভোজনের পথ বন্ধ। বছরের সঞ্চিত পোয়ালগুলো দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হয়। কিন্তু অত বড়ো বড়ো পেট তাতে ভরে না, খড়ি-ওঠা চামড়ার নীচে দেখা যায় পাঁজরের হাড়, সারা গায়ে ডাঁশ আর এঁটুলি, পিঠের হাড়টা উঁচু হয়ে ওঠে তলোয়ারের ফলার মতো। ভারি কষ্ট হয় শ্যামলালের।
সুখে-দুঃখে এমনি করে দিন কাটে। মাঝে মাঝে আসে নবিপুরের বাজার থেকে হিন্দুস্থানি ভগৎজি আর পাঁড়েজি, পাইকারি দরে ঘি কিনে নিয়ে যায়, ভেজিটেবল মিশিয়ে এক নম্বর ঘি বানিয়ে ছেড়ে দেয় বাজারে।
খোলা মাঠে, সবুজ ঘাসের জগতে দিন কাটে শ্যামলালের। ভালোই কাটছিল, কিন্তু একদিন গন্ডগোল বাঁধল ঘাটোয়ালের সঙ্গে।
কাঞ্চন নদীর ওপারে ছোটো খেয়াঘাটের সে ইজারাদার। নবিপুরের যাত্রী পার করে আদায় করে দু-পয়সা ধানের গাড়ি এলে ছ-আনা, খালি গাড়ি তিন আনা। কানে আংটি, ন্যাড়া মাথা আধবুড়ো লোক। সারাদিন গাঁজা খেয়ে চোখ লাল করে বসে থাকে, রোজগারপাতি মন্দ হলে খিটখিট করে বিশ্রী রকমে।
তা করুক, শ্যামলালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না বিশেষ। কিন্তু মহিষের পিঠে একদিন সবে নদী পার হয়ে ডাঙায় উঠেছে শ্যামলাল, এমনসময় এসে পথ আগলাল ঘাটোয়াল।
শ্যামলাল বললে, কেয়া হুয়া?
ঘাটোয়াল জবাব দিলে, পয়সা?
কীসের পয়সা?
পারানির।
পারানি! শ্যামলাল আশ্চর্য হয়ে গেল, নৌকায় পার না হলেও পয়সা?
জরুর। গাঁজার ঝোঁকে ঘাটোয়াল ব্যাখ্যা করে দিলে, এ ঘাট তার ইজারা। এ ঘাট যে পেরুবে, তাকেই পয়সা দিতে হবে। জমিদারের কাছ থেকে বহু টাকার ডাক দিয়ে ঘাট নেওয়া হয়েছে, ইয়ার্কি নয়। পয়সা জরুর দিতে হবে, তা নৌকোতেই পার হও আর ভৈঁসায় চেপেই চলে যাও।
বলা বাহুল্য যুক্তিটা শ্যামলালের ভালো লাগবার কথা নয়। মহিষের পিঠ থেকে তখনি সে লাফ দিয়ে পড়ল—মারামারি করবে। ঘাটোয়ালও তৈরিই ছিল, উরু চাপড়ে বললে, ত আও বাবুয়া!
ঘাটোয়ালের লোকজন মাঝে পড়ে ছাড়িয়ে দিলে। বিদায়লগ্নে দুজন পরস্পরের দিকে যে দৃষ্টিক্ষেপণ করলে তার অর্থ জলের মতো প্রাঞ্জল।
একজন মনে মনে বললে, ফিন ইধার আয়েঙ্গে তো…
আর-একজন স্বগতোক্তি করলে, এক বার ওদিকে যায়েগা তো…
আসতে আসতে গভীর ক্ষোভের সঙ্গে শ্যামলালের মনে হয়েছিল, কেন আজ সে লাঠিটা সঙ্গে আনেনি!
এই হল শত্রুতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
সন্ধ্যার মলিন ছায়ায় যখন ঘাসের বন ধরেছে কালো সমুদ্রের রূপ, তখন ঘরে ফিরল শ্যামলাল। আর ফিরে এসে দেখল, কখন কোন ফাঁকে দু-দিনের হারানো মহিষটা আপনা থেকেই বাথানে ফিরে এসেছে।
কষে মহিষটাকে একটা চাঁটি বসাল শ্যামলাল। গাল দিয়ে বললে, কাল থেকে বেঁধে রাখব। রাত্রে নিজের খাঁটিয়াতে শুয়ে শুয়ে একটা আশ্চর্য নতুন ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল মন। ঘাটোয়ালের মেয়ের ওপরে একটা অপরিসীম ক্রোধ আর বিরক্তি নিয়ে যে-চিন্তাটা শুরু হয়েছিল, কখন তার ধারাটা ঘুরে গেছে সম্পূর্ণ উলটো দিকে সেটা টেরই পায়নি শ্যামলাল। মন বলতে লাগল, ভারি সুন্দর তার মুখোনা, নদীর স্রোতের মতো তার হাসির শব্দ। ঘাসবনের নিরবচ্ছিন্ন শিরশির আর সোঁ সোঁ শব্দের মধ্যে পড়ন্ত রোদের শান্ত কোমল নির্জনতার একটা অপরূপ আবির্ভাবের মতো এসে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা।
সমস্ত রাত্রি ধরে ওই ছবিটা স্বপ্নসঞ্চার করতে লাগল তার ঘুমের মধ্যে। শ্যামলাল স্বপ্ন দেখতে লাগল— শত্রুর মেয়ের সঙ্গে ক্রমাগত সে ঝগড়া করে চলেছে।
পরের দিনটা আবার শুরু হল বাঁধা কাজের তাগিদে। চাকরগুলোকে দিয়ে দুধ-দোয়ানো, সেই দুধ জ্বাল দিয়ে ঘি-তৈরির বন্দোবস্ত। কাল সকালেই আসবে রামরতন ভগৎ, এক মন ঘি চাই তার।
কিন্তু বেলা যেই পড়ে গেল, যেই আকাশের ছাড়া ছাড়া মেঘে ধরল লালের রং, সঙ্গে সঙ্গে অকারণে চনমন করে উঠল বুকের ভেতরে। আগুনে পোড়া তামাটে রঙের বিশাল কঙ্কালের মতো ভূতের জাঙ্গালটা তার শিমুলের শাখা দুলিয়ে দূর থেকে হাতছানি দিলে তাকে। আজ মহিষ হারায়নি, সবগুলোই আছে চোখের সম্মুখে, তবু লম্বা লাঠিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শ্যামলাল। আর রওনা হল সেদিকেই, যেদিকে হিংস্র আলাদ গোখুরের ভয়ে মানুষ এগোতে চায় না।
লাঠিতে ভর দিয়ে মাটির সঙ্গে শরীরটাকে সমান্তরাল করে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে শূন্যের ওপর দিয়ে খালটা পার হয়ে গেল শ্যামলাল। দাঁড়াল এসে জাঙ্গালের নীচে। আর তখনি যেন ফিরে এল চৈতন্য, খেয়াল হল এ সে করেছে কী!
একে তো এই সাপের জাঙ্গালে আসা এমনিতেই বিপজ্জনক। তার ওপরে কাল যে মেয়েটি দৈবাৎ এখানে ছাগল চরাতে এসে পড়েছিল, আজও যে এখানে সে আসতে পারবে তার সম্ভাবনা কোথায়! তা ছাড়া শত্রুর মেয়ে।
ফিরে যাবে কি না ভাবতে ভাবতেই শ্যামলাল দেখলে কখন সেই বর্ষার জলনামা টিলার খাঁজে খাঁজে লাঠি আটকিয়ে উঠে বসেছে জাঙ্গালের মাথায়। এসে দাঁড়িয়েছে সেই শিমুল গাছটার নীচে, ঝরাপাতাগুলোর ওপরে। কিন্তু…
মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল মুখ, বিষণ্ণ হয়ে গেল চোখের দৃষ্টি। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল নিরাশায়। তবু চেষ্টা করতে দোষ নেই। মুখে হাতটা চাপা দিয়ে অকারণেই বিশ্রী বাজখাঁই আওয়াজ তুললে শ্যামলাল, আঃ-আঃ-আঃ–
কিন্তু ডাকটা শেষ হওয়ার আগেই জলতরঙ্গের মতো উচ্ছল হাসির কলরোল ভেসে উঠল। এবারে আর ঘাসবনের ভেতরে নয়, ঠিক তার পেছনে, শিমুল গাছটার আড়াল থেকে।
চমকে পেছন ফিরল শ্যামলাল। বিশ্বস্ত পরিচিত গলায় বললে, এখানে উঠলে কেন? বড্ড সাপের ভয়।
রুকনি হাসল, এখানে না উঠলে তো দেখা যেত না তুমি আসছ কি না।
তাহলে ব্যাপারটা একতরফা নয়। শত্রুর মেয়েও তারই মতো ঝগড়া করবার প্রতীক্ষা করছিল, জাঙ্গালে উঠে দেখছিল শ্যামলাল আসছে কি না। চোয়াড় কাঠখোট্টা মুখে হাসি দেখা দিল। বলল, চলো, এখানে নয়, ঘাসবনের ভেতরে গিয়ে বসি।
উজ্জ্বল চোখে রুকনি বলল, চলো।
পাখির মতো হালকা মেয়েটা, এক হাতে তাকে তুলে নেওয়া চলে।
অনাবৃত আদিম পৃথিবীতে আদি অন্তহীন ঘাসের বন। অনাবৃত, অনায়োজন সহজ ভালোবাসা। আজ ঘরে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল শ্যামলালের। কিন্তু আজ আর ভয় করল না, ভয় করল না জলার ওপরে তমিস্রাঘন রাত্রিকে। ঘন অন্ধকারেও তারার আলোয় এমন করে পথ দেখতে পাওয়া যায়, একথা কি আগে কোনোদিন জানতে পেরেছিল শ্যামলাল?
খেয়া পারাপার করে ঘাটোয়াল। পারানির পয়সা আদায় করে, ঝগড়া করে গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের সঙ্গে। গাড়ি বেশি বোঝাই থাকলে ছ-আনার জায়গায় আট আনা আদায় করতে চায়, মুখচেনা থাকলে কখনো এগারো আনায় রফা করে দু-খানা গাড়িকে। কাঞ্চনের শান্ত নীল জলের ওপর দিয়ে অনবরত পারাপার করে ঘাটোয়ালের জোড়া নৌকো। আর আনে নবিপুরের বাজার থেকে তোলায় তোলায় গাঁজা, কখনো কখনো দু-চার বোতল তিরিশ লম্বর কা দারু। মদের মধ্যে এইটেই সবচেয়ে কড়া, আর এটা নইলে গাঁজাখোরের কড়া মগজে নেশা চড়তে চায় না।
ওদিকে পার হয়ে গেছে কৃষ্ণপক্ষ। ফালি ফালি করে আকাশে বড় হচ্ছে চাঁদ, ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ঘাসের বন, জ্যোৎস্নায় আশ্চর্য সুন্দর আলোছায়া নেচে যায় তার ওপর দিয়ে। বহুদূরের সাঁওতাল পাড়া থেকে নিশুতি রাত্রে বাঁশির সুর আসে, আসে মাদলের শব্দ। জল-মেশানো পাতলা মহিষের দুধের মতো রংধরা আকাশের তলা দিয়ে উড়ে যায় রাজহাঁসের ঝাঁক, খাঁটিয়ার ওপরে বসে বসে জাগ্রত স্বপ্ন দেখে শ্যামলাল।
মহিষগুলোকে এখনও আদর করে, যত্ন করতে চেষ্টা করে এখনও। কিন্তু সে-আন্তরিকতা আর নেই, এখন পরিষ্কার দ্বিমুখী হয়ে গেছে মনের গতিটা। যা নিয়ে এতদিন সে সম্পূর্ণ হয়েছিল, আজ মনে হয় তার ভেতরে কত বড়ো একটা ফাঁকি লুকিয়ে ছিল। এভাবে একা একা আর বাস করা চলে না, একা একা থাকা এখন অসম্ভব তার পক্ষে।
আজকাল আর অপেক্ষা করতে হয় না বিকেলের ছায়া ঘনানো পর্যন্ত। দুপুরের পরেই আসে রুকনি। নিরিবিলি ভূতের জাঙ্গালের পাশে ঘন সবুজ ঘাস স্নিগ্ধ নিবিড় আবরণ দিয়ে ওদের ঢেকে রাখে। এমনিতেই বুক পর্যন্ত ঘাস, মাথা উঁচু করে না দাঁড়ালে দেখতে পাওয়া যায় না। তার আড়ালে নিভৃত নিঃসঙ্গ অপরূপ অবকাশ।
সবুজ ঘন ঘাস। বিচিত্র একটা মিষ্টি গন্ধে ভরা। প্রজাপতি উড়ে আসে, উড়ে আসে ফড়িং; মাথার ওপর সকৌতুকে চক্র দিয়ে উড়ে যায় ওদের নিভৃত প্রেমের নিঃশব্দ সাক্ষী। রাজারাজড়াদের বিছানা কি এই সবুজ ঘাসের চাইতেও নরম?
শ্যামলালের বাহুতে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে গুনগুন করে গান গায় রুকনি। শিরশির শরশর সোঁ সোঁ করে তার সঙ্গে সুর মেলায় ঘাসবনের গান। ভূতের জাঙ্গালের ওপরে শিমুলের ছায়াটা ঘন হয়ে আসতে থাকে, সূর্য পাটে নামে পশ্চিমের তালবনের ওপারে, এদিকে উঁকি মারে চাঁদের পান্ডুর রেখা। রুকনি ছাগল নিয়ে ফিরে যায় খেয়াঘাটের দিকে, লম্বা লাঠির ওপরে লাফ দিয়ে ঘরের দিকে রওনা হয় শ্যামলাল।
তারপর জ্যোৎস্নার মাতাল-করা সন্ধ্যা। একা একা খাঁটিয়ায় পড়ে ঝিমুতে অসহ্য লাগে এখন। অথচ উপায় নেই। ঘাটোয়ালকে বলা যাবে না, তেড়ে মারতে আসবে। অবশ্য মারামারিতে ভয় পায় না শ্যামলাল, কিন্তু তাতে কোনো ফয়দা হবে না। লাভের ভেতরে ঝামেলাই বাড়বে খানিকটা, ওতে করে রুকনিকে পাওয়া যাবে না।
একদিন রুকনির দুখানা সুডৌল হাত প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলে শ্যামলাল।
চল পালিয়ে যাই।
রুকনি হাসল, কোথায়?
যেখানে খুশি, যতদূরে হোক। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব তোকে।
রুকনি তেমনি হাসতে লাগল, পারবে?
মাথার ভেতরে টগবগ করে রক্ত ফুটছিল শ্যামলালের। পারব না কেন? নিশ্চয় পারব। এই বাথান, এই ভৈঁসার পাল? এগুলোকে তো সবসুদ্ধ তাড়িয়ে দিতে পারবে না। ফেলে যেতে পারবে?
হাত দুটো আপনা থেকে ছেড়ে দিলে শ্যামলাল। এই মহিষের পাল। কত যত্ন, কত আশঙ্কা, কত সজাগ পরিচর্যা! মুখে যত সহজেই বলা যাক, মনের দিক থেকে অত জোর নেই তার।
তা ছাড়া যাবেই-বা কোথায়? এত বিরাট, এত বিপুল পৃথিবীতে কতটুকু জানে শ্যামলাল, কতটুকুই-বা তার চেনা? এই ঘাসের বন—সমুদ্রের মতো যার বিস্তার, ওই রাঙামাটির টিলাগুলো, দূরে দূরে তাল গাছ, আকাশে ছাড়া ছাড়া মেঘে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়ের রং, তাল গাছের মাথার ওপরে রুকনির হাসিভরা মুখের মতো উঁকি দেওয়া চাঁদ, কাঞ্চন নদী, খেয়াঘাট, আর দুরের নবিপুরের বন্দর—কী আছে এর বাইরেও সেখানে অপরিচয়, সেখানে এমন কি কিছু আছে যার ওপরে ভর দিয়ে সে দাঁড়াতে পারে নিজের পায়ে। গভীর রাত্রিতে এই দিগন্তসমাকীর্ণ মাঠের ভেতরে কেউ যদি পথ হারায় তাহলে যেমন আলেয়ার আগ্নেয়শিখা বিভ্রান্ত করে ঘুরিয়ে মারে তাকে, তেমনি করে সেই অচেনা জগৎ ঘুরিয়ে ভুলিয়ে মারবে তাকে। এবং সেই অন্ধকারে তাকে কি পথ দেখাতে পারবে রুকনি?
সংশয় কাটে না মনের ওপর থেকে।
তবু জোর করে জবাব দিলে শ্যামলাল, তোর জন্যে সব পারব।
আচ্ছা, ভেবে দেখো।
রুকনির চোখ তেমনি লীলামধুর কৌতুকে জ্বলজ্বল করছে। প্রতিবাদ করা উচিত, রুকনি বিশ্বাস করেনি বুঝতে পারছে শ্যামলাল; কিন্তু তবুও প্রতিবাদ করা চলে না। মুখে বলা সোজা, কিন্তু কাজটা নয়। ভয় আছে অপরিচিত অনাত্মীয় পৃথিবীর। সমস্ত নাড়িতে নাড়িতে জড়িয়ে আছে বাথানের প্রতি অন্ধ দুর্বলতা—সারাটা জীবন ধরে সবচাইতে একান্ত করে জেনেছে যাকে; আর আশঙ্কা আছে সেইসব আলেয়ার, রাত্রির অন্ধকারে নিথর কালো ঘন ঘাসবনে যারা অসতর্ক পথিককে বিভ্রান্ত করে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়, কখনো কখনো-বা ডুবিয়ে মারে জলার হাতি-তলিয়ে-যাওয়া অথই কাদাজলের মধ্যে!
মনের ভেতরে অসহ্য অস্বস্তি। নিজের হাত কামড়ে খেতে ইচ্ছে করে শ্যামলালের। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে ওই শালা গাঁজাখোর ঘাটোয়ালের কাছে। তার পা ধরে সে বলতে পারে…
কিন্তু বাধা দিয়েছে রুকনি। কেমন চমকে উঠেছে, আশঙ্কায় ছলছল জ্বলজ্বল করে উঠেছে কালো চোখ, বলেছে, না না।
না না কেন? টাকা যদি চায়, আমি দেব। শ রুপেয়া, দেড়শো রুপেয়া— আমার টাকার অভাব নেই।
রুকনি তবুও বলেছে, না, সে হবে না!
কেন?
হঠাৎ একটা ঢোঁক গিলেছে রুকনি, কী-একটা কথা সামলে নিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। রপর দ্বিধা করে বলেছে, আমার বাপের ভারি রাগ তোমার ওপরে। হাজার টাকা দিলেও রাজি হবে না। বরং ঝামেলা হবে খানিকটা। তার চাইতে এই ভালো।
এই ভালো! মনের দিক থেকে মেনে নিতে পারে না শ্যামলাল। এ ভালো নয়, এ লুকোচুরি এখন রীতিমতো পীড়া দিচ্ছে তাকে। অপরাধবোধ, লজ্জা। কারও কাছে কখনো ছোটো হয়নি শ্যামলাল, চলেছে মাথা উঁচু করে, সোজা মনের মতো হাতের সোজা লম্বা লাঠিটার ওপরে নিঃসংকোচ জোর রেখে। আজ হীন মনে হয় নিজেকে, মনে হয় ঘাটোয়ালের কাছে সে হেরে যাচ্ছে। এমন একটা জায়গাতে এখন দাঁড়িয়ে আছে ঘাটোয়াল, যেখানে তার দিকে মুখ উঁচু করে তাকানোর সাহস নেই শ্যামলালের।
আরও অসহ্য লাগে রাত্রি। দুর্বিষহ বোধ হয় একেবারে। খোলা বারান্দায় খাঁটিয়ায় ঘুমোয় শ্যামলাল। গভীর রাত্রে শুনতে পায় বহু দূরের সাঁওতাল পাড়া থেকে বাঁশির সুর, ওই সুরটা রক্তের ভেতরে যেন ঝিনঝিন করে বাজে—দক্ষিণের হাওয়াটায় যেমন বিশ্রী একটা অস্বস্তি, শরীরকে আচ্ছন্ন করে তুলতে চায়। বড়ো একা, বড়ো বেশি নিঃসঙ্গ।
নাঃ, আর পারা যায় না। এবার বলতেই হবে ঘাটোয়ালকে, কপালে যা থাকে তাই হোক। সারারাত ছটফট করে বলেই ঘুমটা ভাঙতে দেরি হচ্ছে আজকাল। মুখের ওপরে রোদ এসে পড়েছে শ্যামলালের, ঘুমের ভেতরে কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। হঠাৎ–
চমকে ধড়মড় করে উঠে বসল শ্যামলাল।
এ কি সত্যি? এ কি বিশ্বাস করবার মতো? তার দাওয়ার নীচে দাঁড়িয়ে ঘাটোয়াল। ন্যাড়া মাথা, কানে আংটি। এই সকালেই নেশা করে এসেছে—টকটকে লাল চোখের দৃষ্টি। হাতে একখানা তেল-পাকানো মস্ত লাঠি। ডাক দিচ্ছে, হোই হো ঘোষ, শুনত হো?
আতঙ্কে মড়ার মতো পাড়ুর হয়ে গেল শ্যামলাল। রুকনির ব্যাপারটা টের পেয়েছে নাকি ঘাটোয়াল? বিহ্বল চোখ বুলিয়ে এক বার তাকিয়ে দেখে নিলে লাঠিটা তার তৈরি আছে কি না।
কিন্তু তাজ্জব লাগিয়ে দিয়ে ঘাটোয়াল হাসল। বললে, এত বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাক কেন? কাজের কথা আছে তোমার সঙ্গে।
কাজের কথা! এবং ঘাটোয়াল হাসছে। তাহলে…
এবারেও চমক লাগল শ্যামলালের, কিন্তু আনন্দের চমক। রুকনিই তবে ব্যবস্থা করে ফেলেছে সব! কিন্তু ঘাটোয়াল পাকা লোক, অনেক টাকা চাইবে নিশ্চয়। তা হোক, তা হোক। রুকনির জন্যে দুশো টাকা খরচ করতে তার আপত্তি নেই।
আও, বৈঠো খাঁটিয়ামে
আমন্ত্রণ গ্রহণ করে খাঁটিয়ার এসে বসল ঘাটোয়াল। রোমাঞ্চিত আনন্দে সর্বাঙ্গ কাঁপছে শ্যামলালের। তার উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে এই সবুজ ঘাসবনের ওপর দিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে রুকনির বুকে। কিন্তু আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে, করতে হবে আরও একটু প্রতীক্ষা।
কথা আরম্ভ করবার আগে হাতের চেটোতে বেশ খানিকটা খৈনি পাকিয়ে নিলে ঘাটোয়াল। ভাগ দিলে শ্যামলালকে, নিজে মুখে পুরলে খানিকটা। তারপর ধাতস্থ হয়ে বললে, ভেবে দেখলাম তোমার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে কোনো লাভ নেই।
শ্যামলাল বললে, জরুর।
যা হয়ে গেছে ভুলে যাওয়াই ভালো। পিচ করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে খানিকটা থুথু ফেললে ঘাটোয়াল, এখন একটু কাজে এসেছি।
নিজের বুকের স্পন্দন যেন শুনতে পাচ্ছে শ্যামলাল। কী কাজ?
দু-সের ভালো ঘি চাই। কত দাম?
এও কি ভূমিকা, না শুধু এইটুকুই মাত্র বলতে এসেছে ঘাটোয়াল? আশায় আশঙ্কায় দুলতে লাগল শ্যামলালের মন। দু-সের ভালো ঘি? ওর আর দাম লিব না তোমার কাছ থেকে, হাজার হোক যখন দোস্তি হয়ে গেল।
খুশিতে ঘাটোয়ালের মুখ ভরে গেল। আচ্ছা, আচ্ছা, তব তো ঠিক হ্যায়। আজ থেকে তোমার আর পারানির পয়সা লাগবে না দোস্ত। আসল কথাটা কী জান? ঘি আমার জন্যে নয়, আমার বেটির বর আসবে, তাকেই…
তোমার বেটির বর? শ্যামলালের মাথার ওপর মস্ত একটা লাঠির ঘা এসে পড়ল, মাথাটা যেন চুরমার হয়ে গেল মুহূর্তে। কোন বেটি?
একটাই তো বেটি আমার। ওই রুকনি।
রুকনি! প্রতিধ্বনি করলে শ্যামলাল। কিন্তু এত ক্ষীণকণ্ঠে যে ঘাটোয়াল তা শুনতে পেল না। ঘাটোয়াল বলে চলল— শাদি তো হয়েছে দু-বছর বয়েসে, কিন্তু এতদিন গাওনা হয়নি কিনা, তা এইবারে নিতে আসবে। জামাই আমার খুব মানী লোক, হবিবপুর থানার সিপাহি। শনিবারে সে আসবে মেয়েকে নিতে। বলেছে একটু ভালো ঘিয়ের জোগাড় রাখতে।
নিস্পন্দ হয়ে রইল শ্যামলাল। হাতের চেটোয় আবার নতুন করে খানিকটা তামাক পাতা নিয়ে ঘাটোয়াল ডলতে লাগল, জামাই বড়ো ভালো লোক। খত পাঠিয়েছে চৌকিদারের সঙ্গে, মেয়েকে পাঠিয়েছে লালশাড়ি। লিখেছে গয়নাও নিয়ে আসবে। বরাত ভালো রুকনির, কী বল। দোস্ত?
হঠাৎ শ্যামলাল হেসে উঠল, জরুর।
কেমন সন্দিগ্ধ হয়ে তাকাল ঘাটোয়াল, হাসিটার অর্থ যেন ঠিক বুঝতে পারল না। তারপর জিজ্ঞাসা করলে, ঘি-টা কখন পাওয়া যাবে?
কাল। কাল সন্ধের পরে নিজেই দিয়ে আসব আমি।
রুকনি অস্বীকার করেনি কিছুই। তেমনি ঘাসবনের শান্ত কোমল ছায়ায় নিজেকে লীলাভরে এলিয়ে দিয়েছে শ্যামলালের বুকের ভেতরে। বলেছে, তোমাকে বলিনি, বললে তোমার কষ্ট হত। তা ছাড়া তোমার মতো জোয়ান মানুষটাকে পাওয়ার জন্যে ভারি লোভও হয়েছিল।
ঠিক কথা, কোনো অন্যায় হয়নি। ঘৃণাভরে রুকনিকে বুকের ভেতর থেকে ছিটকে ফেলে দেয়নি শ্যামলাল। এই ঘাসের বনে, এই দিগন্তজোড়া মুক্ত মাঠের ভেতরে এমনি নির্ভাবনায় ভালোবাসাই তো ভালো। এখানে যেমন ঘরের বেড়া নেই, তেমনি কোনো নিয়মের বেড়া নাই-বা থাকল এই গোপন ভালোবাসায়। পৃথিবীর ধর্মকেই মেনে নিয়েছে রুকনি। ক্ষতি কী? নির্জন প্রেম মাঠের খোলা বাতাসেই উড়ে চলে যাক।
আস্তে আস্তে শ্যামলাল বললে, তুই চলে যাবি?
কথাটার সোজা জবাব দিল না রুকনি। হয়তো বেদনাবোধ হয়েছে, হয়তো জেগে উঠেছে মৃদু করুণ একটুখানি সহানুভূতি। ঘুরিয়ে বলল, তোমাকে ভুলব না।
আশ্বাসের কোনো প্রতিক্রিয়া হল না শ্যামলালের মুখে। বললে, কাল এক বার আসবি শেষ বারের মতো? এর পরে তো তোকে আর দেখতে পাব না।
রুকনি ম্লানমুখে বললে, আসব।
আর একটা অনুরোধ। তোর নতুন রাঙাশাড়িটা পরে আসবি রুকনি, যেটা টকটকে লাল। আমার দেখতে ভারি ইচ্ছে করছে।
রুকনি এবার টিপে টিপে হাসল একটু, আচ্ছা।
পরদিন দুপুরে বাথানের সবচাইতে বড় মহিষটাকে বেছে নিলে শ্যামলাল। হিংস্র চেহারা, খাঁড়ার মতো প্রকান্ড দুটো শিং। মাঠের প্রচুর ঘাস খেয়ে ইদানীং এটাই একটু বেয়াড়া হয়ে উঠেছে, মাঝে মাঝে চলতি দেহাতি লোককে তেড়ে যেতে চায়। চোখের দৃষ্টিতে লালের আভাস লেগেছে, আজকাল কেমন আশঙ্কা হয় সেদিকে তাকালে।
সেই মহিষটার পিঠে চড়ে বসল শ্যামলাল। এগিয়ে চলল জাঙ্গালের দিকে। খানিকটা আসতেই পেছনের জগৎটা হারিয়ে গেল ঘন ঘাসবনের নেপথ্যে। শুধু জেগে রইল নিস্তব্ধ নির্জনতা। বাতাসে রাশি রাশি ঘাসের আনন্দিত আন্দোলনে শব্দ উঠেছে শিরশির সোঁ সোঁ। এ সেই স্তব্ধতা যেখানে নির্জনে ভালোবাসা চলে, আর আর হত্যা করা চলে নিঃশব্দে।
নালা পার হয়ে মহিষটা শ্যামলালের তাড়া খেতে খেতে অনেকটা মাটি আর পাথর ভেঙে বহু কষ্টে উঠে পড়ল জাঙ্গালে। ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাচ্ছে মহিষটা, মাঝে মাঝে অসন্তুষ্টভাবে নাড়ছে শিং দুটো, মুখের কষ দিয়ে গড়াচ্ছে ফেনা। তা ছাড়া আকাশে প্রখর রোদ—মাথাটা যে দস্তুরমতো তেতে উঠেছে তার, সে-বিষয়ে আর সন্দেহ নেই।
হ্যাঁ, রুকনি এসেছে, লালশাড়ি পরেই এসেছে। শ্যামলালের শেষ অনুরোধটা ভোলেনি। হাসিমুখে এগিয়ে এল সামনের দিকে। আজ শেষ বাসর।
আর সেই মুহূর্তেই একটা ভৈরব গর্জন করল মহিষটা। সজোরে সামনের পা-দুটো ঠুকল জাঙ্গালের ওপরে, ঠিকরে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ মাটি আর পাথর, লাফিয়ে নেমে পড়ল শ্যামলাল। টকটকে লাল রং দেখে খুন চেপেছে উত্তেজিত মহিষের। চোখ দুটোতে ঠিকরে বেরুল আদিম পৃথিবীর আরণ্য হিংসা। শিং দুটো নীচু করে সোজা ছুটল রুকনির দিকে।
আর্তনাদ করে পালাতে গেল রুকনি, পারল না। টিলা থেকে দৌড়ে নামতে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল ঘাসবনের মধ্যে। চেঁচিয়ে উঠল, বাঁচাও—বাঁচাও–
কিন্তু বুনো খ্যাপা মহিষের হাত থেকে কাউকে বাঁচানো কি সম্ভব? অনর্থক চেষ্টা করে লাভ নেই। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরাল শ্যামলাল।
নির্জন দিগন্তপ্রসার ঘাসের বন। বাতাসে সোঁ সোঁ শব্দ। খানিকটা এগিয়ে গেলেই বাতাসের শব্দ সব কোলাহল উড়িয়ে নিয়ে যায়, কয়েকটা চাপা আর্তনাদের তো কথাই নেই। কিছুক্ষণ পরে যখন পেছনের গোঙানিটা একটু কমে এসেছে, তখন এক বার, শুধু এক বারের জন্যে ফিরে তাকিয়ে দেখল শ্যামলাল। ঘাসবনের মধ্যে কিছু দেখা যায় না, তবে ল্যাজটা ওপরের দিকে তুলে মহিষটা ক্রমাগত কী যেন গুঁতিয়ে চলেছে আর গর্জন করছে হিংস্র ভয়ংকরভাবে। পায়ের দাপটে ঘাসের বন ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘূর্ণির মতো। পলকের জন্যে শিং দুটো চোখে পড়ল; লালশাড়ির চাইতে আরও গাঢ়, আরও গভীর রঙে সে-দুটো টকটক করছে। সে-রক্ত ঘাসবনের হিংসা, ঘাসবনের ভালোবাসার মতোই নগ্ন আর নিরাবরণ।
শ্যামলাল নিশ্চিন্তে বিড়িটায় একটা টান দিল, তারপর হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে জাঙ্গালের ওপর দিয়ে সোজা হেঁটে চলল। তার কাজ এখনও আর একটু বাকি। একটা আলাদ গোখুর দরকার, দরকার খানিকটা তাজা বিষ। ঘাটোয়ালের জামাইয়ের জন্যে খাঁটি ঘি-টা সন্ধের মধ্যেই পৌঁছে দিতে হবে যে!
অসাধারন