ঘাতক – সন্মাত্রানন্দ
আজ দুপুরে বৃষ্টি হোল খুব, তারপর তীব্র রোদ, তারপর ছায়া, তারপর ঘুম… এখন নিঃশব্দ সন্ধ্যা নেমেছে, ঘরের ভিতর পাখার শনশনানি, বাইরে ঘরের পেছনের জঙ্গলে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর পর জলফড়িং ঘুমিয়ে পড়ল এইমাত্র ঘাসের ডগায় ঝুলে, তার পাশ দিয়ে একটা সাপ বিবর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সন্ধ্যায় গা ঢেকে জ্যোৎস্না খাবে বলে, যেখানে সেই খয়েরি শালিখটা মরে গিয়ে মাটি হয়ে গিয়েছিল, ধুলার সেই স্তূপের উপর চন্দ্রাহত সাপটা বসে থাকে, কয়েক বিন্দু বৃষ্টি মাধবীলতার গা বেয়ে সাপের চোখের উপর এসে পড়ে, সাপটার গায়ে মাথায় আদর ক’রে হাত বোলায় বিনিপিসি, যাকে গত কার্ত্তিক মাসে মারা যাবার পর ছেলেরা পুড়িয়ে এসেছিল সিদ্ধি আশ্রমের শ্মশানে। দুটি জোনাকি বিনিপিসির চিবুকের উপর বসে গল্প ক’রে আর ভেজা সবুজ আলো ছড়ায়, সেই চিবুক যেখানে হাত রেখে ফুলশয্যার রাতে প্রথম আদর করেছিলেন বিনিপিসির বর।। ছোট পাখিটা বলল, মা একটু সরে এস, তোমার বুকের মধ্যে ঘুমোব, প্রজাপতি চিবিয়ে খেয়েছি আমি, শরীর খারাপ লাগছে। কেন খাস, কেন খাস এসব? বড় বাড়ির ছাদে বড়ি রোদে দেয়, ওগুলো খাবি, তারপর একপেট জল… আজকে উড়ে যেতে যেতে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম… কি দেখলে গো, মা? সবুজ মাঠের মধ্যে গেরুয়া কাপড় পরা একটা মানুষ ভিজছে, আর কাপড় থেকে জল নিংড়োচ্ছে… হ্যাঁ, তাকে আমি জানি, পাগল হয়ে গেছিল ছোট বেলায়, তারপর বাকি জীবন খেসারত… ওর কে আছে মা?…কেউ নেই বোধ হয়… পাগলের কি কোনও ঠিক ঠিকানা থাকে? তুই ঘুমো, তোর ঠোঁটে দিলাম চুমো… ওই লাল চাঁদ উঠে গেল….
আরও একটু রাত হলে যখন অন্যরা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে আসে সে। কালো রঙ তার গায়ের, হয়তো কিছুটা ছাই ছাই। ওরা বৃত্তিতে ঘাতক। এই রাত্রিকাল ওদের চোখে দিন। আজও তাকে যেতে হবে নদীতীরে। তার উপর নির্দেশ আছে, খুন করে আসতে হবে নিরীহ কাক-দম্পতিকে, যারা থাকে নদীতীরে বড় গাছের মাথায়। পুরুষানুক্রমে ওরা এই ঘাতকতাকে বৃত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছে। দিনের বেলা দেখতে পায় না, রাতের বেলা সমস্ত উজ্জ্বল পরিষ্কার। জ্যোৎস্নায় পাখা মেলে ধরে সেই শিকারী প্যাঁচা, উড়ে যায় মাঠের উপর দিয়ে নদীর দিকে। নীচে স্তব্ধ মাঠ ফ্যাল ফ্যাল ক’রে চেয়ে থাকে, এক নিঃশব্দ হত্যাকাণ্ডের প্রাক-মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে। গাছ ঘুমায়, বাতাস ঘুমায়, ঘাস ঘুমায়। আতপ চালের গন্ধ ভেসে আসে। আসে তো, আসে। প্যাঁচার লক্ষ্য নয় এখন এইসব। কাজের সময় কাজ, ফেরার পথে চালের খোঁজ করা যাবে। ইঁদুরেরও। ওড়ার সুখ তার সারাদিনের ঘুমের আলস্যকে ভেঙে দেয়। মাঝে মাঝে কোনও ঝোপে ঝাড়ে বসে, দু একটা জোনাকি মুখে দেয়। ভাল লাগে না। তিতকুটে স্বাদ। স্কুলবাড়িতে ঢোকে। সেই বারান্দা যেখানে সারাদিন ছেলেমেয়েরা হুটোপুটি করে, সেসব এখন নীরব। অন্ধকার। কার্নিশে পায়রা ঘুমিয়ে আছে, সারি সারি একে অপরের মুখে মুখ গুঁজে। সুস্বাদ সেই মাংস খেতে সাধ জাগে প্যাঁচার। ও অনেক মেহনতির কাজ। চোখ পাল্টে হাই তোলে। নোখ দেওয়ালে ঘসে ধার করে। থাক। কাজের সময় কাজ। টিনের চালের উপর দিয়ে উড়ে যায়। টিনের চালে জ্যোৎস্না পড়ে চকমক করে।
স্কুল পেরিয়ে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে পুকুর। জলতলের উপর দিয়ে সে ওড়ে। কয়েকটা জলপোকা ধরে। পদ্ম, শালুখের কুঁড়ি ঘুমোয়। প্যাঁচার চোখ জলের নীচে কী আছে দেখতে পায়। ওই নীচে পদ্মের শালুখের ডাঁটা সদ্য কিশোরীর দেহলতার মতো কোমল লাবণ্যে কমনীয় ভঙ্গিমায় উঠে এসেছে। পদ্ম, শালুখের পাতায় জলের বিন্দু বড় বড় পাতার মাঝখানে জমে আছে মুক্তোর মত। বাতাস দিলে একখুনি জলে জল মিশে যাবে। জলে প্যাঁচা মুখ দেখে। হ্যাঁ, বেশ ভয়ঙ্কর মুখ তার। দেখে তার সন্তোষ হয়। আর একটু পোকা ধরবে কি? দেরী হয়ে যাচ্ছে। রাত এত ছোটো কেন? কত রাত তার জীবনে যে কেটে গেল। সেই যখন সে ডিমের ভেতরে ছিল, সেই সব কথা মনে পড়ে। মনে হয়েছিল, ডিম ভেঙে বেরিয়েই সে পেট ভরে খাবে। আকন্ঠ খিদে তার পেটে। কিন্তু খাওয়ার সময় পেল কই। প্রতিদিন নির্দেশ আসে, একে খুন করে এস, ওকে খুন করে এস। এর পরের জন্মে সে শকুন হবে। স্বাধীন। বিশাল পাখা নিয়ে যেখানে খুশি উড়ে যাবে। বড় বড় বনস্পতির মাথায় লোহার মত শক্ত আর ধারালো ঠোঁট নিয়ে বসে থাকবে। কখনো উড়ে যাবে দক্ষিণে। সেখানে কোনও শ্মশানের ধারে অর্জুন গাছের মগডালে রাজার মত বসে থাকবে, আর প্যাঁচাদের নির্দেশ পাঠাবে, একে লুটে নাও, ওকে মেরে রেখে এস।
ঘাটের কাছে এসে প্যাঁচাটা একটু অবাক হোল। ঘাটের রানার উপর মানুষের একটা মেয়ে। তার চুল খোলা, হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে। কড়ির তৈরী হাত তার, শাঁখের মুখ। দীঘল কালো দুটি চোখে বড় বড় পাতা। ধুপছায়া রঙের শাড়ি পরে হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে বসে আছে। শাঁখের তৈরী দুই পায়ের পাতায় আলতা পরা। চাঁদের আলোয় তার ছায়া পড়ে না। শঙ্খিনী নারী তার অস্থিময় দুই হাত বুকে চেপে কাঁদে। বিলাপের ভাষা প্যাঁচা বোঝে, অনেক শুনেছে, সে ঘাতক। এই শঙ্খিনী নারীর কান্নার পেছনে হয়তো সেরকমই কোনো ইতিহাস। গর্ভে তার শিশু ছিল জলে ডুবে মরবার সময়? মানুষকে বিশ্বাস ক’রে ঠকে গেছিল সেই মেয়ে? এখন সে বিলাপ করে। তার বিলাপের সুর জলের কোমলে মিশে যায়।
প্যাঁচাকে যেতে হবে অনেক দূর… মেয়েটির কাতর কান্না তার রক্তে উন্মাদনা জুগিয়েছে আজ মৃত্যুর কালো আলকাতরার রঙে সে আকাশ বাতাস কালো ক’রে দিয়ে আসবে। অনেক রক্ত ঘাসে পড়ে কালো হয়ে থাকবে কাল ভোরে। সে ছিঁড়ে খাবে কাক দুটিকে। প্রথমে ডানা ছিঁড়ে নেবে, তারপর নখরে ওদের পেট ফাঁসিয়ে দেবে, নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে কাকেদের, তার অনুপম লবনাক্ত স্বাদ ! আহা ! থাবা দিয়ে সেই সব ঘুমন্ত কাকেদের গলার নলী ছিঁড়ে নেবে। ডিমগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে আসবে। ভোর হবার আগেই যখন বাসামুখো হবে, তখন পেছনে ফেলে আসবে ছিন্ন পাতা, ভগ্ন ডাল, বিলাপরত বনস্পতিদের। বিলাপে বিলাপে চোখের পাতার ভিতরের লাল রঙের মত লাল রক্তের উৎসব প্রত্যূষের রক্তিম আভার সঙ্গে মিশে যাবে। দুই ডানা দুপাশে টানটান ছড়িয়ে লাফ দিয়ে সে আকাশে উঠে আসে। তারপর অনিরুদ্ধ আবেগে বাতাসের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা চলে সুদীর্ঘ উড়ানে।
নদীর তীরে এসে সে একটু থামল। রাংতার পাতের মত জ্যোৎস্নায় রূপালি জলের বৈভবে যৌবনবতী নদী নিদ্রিতা বান্ধবীর মত শুয়ে আছে। অলস নৌকা তীরে বাঁধা। মাঝে মাঝে সেই নদী বালুচরের বিছানায় পাশ ফিরে শুচ্ছে। গাছগুলো বোকা। এমন মোহনীয় দৃশ্যের সামনে বোকা নীরস নীতিবাগীশ বুড়োর মতন ঘুমোচ্ছে। ওদেরই মধ্যে একটি গাছ আজ প্যাঁচার গন্তব্য। সেইখানে কাকদম্পতী নিদ্রা গেছে। হয়তো সারাদিন পরিশ্রমের পর। দুজনকে কাছে পাওয়ার আনন্দের পর। মূর্খ কাকদম্পতি! জীবনের তাৎপর্য শ্রমে নয়, প্রেমে নয়, হত্যায়। জিঘাংসার মত তৃপ্তি আর কিছুতেই নেই। এখনই সে ওখানে যাবে। তার আর তর সইছে না। শুধু নদীটি তার বিথারিত সৌন্দর্য নিয়ে তাকে আটকে রেখেছে। আর একটুক্ষণ এই নিদ্রিতা নদীর রূপ পান ক’রে আসঙ্গতৃপ্ত যুবকের মত সে উড়ে যাবে হত্যার আনন্দের দিকে। প্যাঁচা এসে বসে একটা কেয়াঝোপের উপর।
ছোটবেলায় সে তার পিতামহের কাছে এক সুপ্রাচীন কাহিনী শুনেছিল। সব প্যাঁচাদেরই শুনতে হয়। তাদের পূর্বপুরুষের কীর্তিকাহিনী, বীরগাথা। সহস্র সহস্র যুগাতিযুগ আগে, একবার এক অন্ধকার রাত্রে তাদের এক কীর্তিমান, ঋদ্ধি মান পূর্বপুরুষ এক নদীর তীরে, এক বড় গাছে নিদ্রিত কাকেদের বাসায় ঢুকে ঘুমন্ত কাকপরিবারের কাকসন্ততিদের মেরে মেরে মাটিতে ফেলেছিল। ছিন্নপক্ষ, ছিন্ন অন্ধ্র, রক্তাক্ত সেই সব কাকেদের হত্যা ক’রে প্যাঁচাদের মহামহিম সেই পূর্বপুরুষ এক মুহূর্ত বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় হোল কি, সে গাছের তলায় তিনজন মানুষের গলার স্বর শুনতে পেল। তিনজন ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ। একজন সহর্ষে বলল, “পেয়েছি। এই হচ্ছে উপায়!’আর একজন প্রবীণ মানুষ অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘কী হোল, অশ্বত্থামা ? তোমার মস্তিষ্ক বিকৃত হোল নাকি? কী পেয়েছ?” প্রথম লোকটি, অশ্বত্থামা যার নাম, অন্য দুজনের কাছে সরে এসে অনুচ্চ স্বরে বলতে লাগল, “শোনো কৃপাচার্য, শোনো কৃতবর্মা। মন দিয়ে শোনো। এই পেচকটি আমাকে উপায় দেখিয়েছে। আমি এই অন্ধকার নিশীথেই পাণ্ডবশিবিরে গিয়ে দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্রকে এই কাকশাবকদের মতোই নিদ্রিত অবস্থায় মেরে রেখে আসব। পাণ্ডবশিবিরে কেউ আজ আমার হাত থেকে রক্ষা পাবে না। আমি পাণ্ডবশিবিরে শিশুশিকার ক’রে হাহাকার তুলে দিয়ে আসব। তারপরও তাদের মধ্যে কীসব সাঙ্ঘাতিক শলাপরামর্শ হোল। তারপর তিনজন তিনদিকে বেরিয়ে গেল। এই পর্যন্ত বলে প্যাঁচার পিতামহ বলতেন, তবেই দেখ। হত্যা কী করে করতে হয়, আমাদের পূর্বপুরুষই মানুষকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। আমরা কি কম ? সেই বীরগাথা মনে ক’রে আজ রাত্রে ঘাতক প্যাঁচার শরীরে আত্মতৃপ্তির আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল বিষের আচ্ছন্ন নেশার মত।
সেই নেশায় টলতে টলতে প্যাঁচার চোখে অবসাদ নামে অল্পক্ষণ। হঠাৎ সেই অবসন্ন তন্দ্রা ভেঙে যায় রাতচরা দুটি পাখির টী-টী-টী শব্দে। তীক্ষণ চোখে সে তাকায় শব্দের অভিমুখে। দুটো ছোট পাখি, হয়তো তাদের নাম টিট্টিভ, উড়ে যাচ্ছে নদীর উপর জেগে থাকা একটি দ্বীপসদৃশ ভূমিখণ্ডের দিকে। নদীর উপর ওই একটুকরো চর, ওইখানে জড়ামড়ি ক’রে উঠেছে বুনো ঝোপ, জলজ ঘাস, ফণিমনসার ঝাড়। নদীটির নাভির উপর যেন ওই প্রেমিক পাখিদুটি উড়ে গিয়ে আলগোছে বসে। প্যাঁচা দেখে, পাখি দুটি এ ওর পালক মিলিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে। কখনো একজন আরেকজনের চারিদিকে বৃত্তাকারে ঘুরে এসে পাশে বসছে। উড়ে যাচ্ছে, কাছে আসছে, চঞ্চু তে চঞ্চু চালনা ক’রে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকছে। পক্ষিণীর চোখ আবেশবিহ্বল, তার প্রেমিক তাকে জাদু করেছে। প্যাঁচা ভাবে, এখনই সে ওদের মধ্যে উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে বিদ্যুতের মত। পক্ষীমিথুনকে ছিন্নভিন্ন ক’রে দিতে পারে এক লহমায়। ওদের সেদিকে কোনও হুঁশ নেই। ওরা অদ্ভুত শব্দ করছে। পক্ষীভাষায় তার কোনও অর্থ নেই। ওরা কি ওদের প্রেমকে, রাত্রিকে, জ্যোৎস্নাকে অনুবাদ করছে মিলনকূজনের আপাত অর্থহীন শব্দে? প্যাঁচাও উড়ে যায় সেই দ্বীপের উপর, নদীর নাভির উপর। ঘুমন্ত নদী নিঃশ্বাস ফেলে। প্যাঁচা এগিয়ে যায় তার শিকারের দিকে। ওরা ওকে দেখেছে। পালিয়ে যেতে পারছে না। চাইছেও না। ওরা কি মরতে চাইছে ওদের এই তন্ময় মুহূর্তে? স্থান, কাল ভুলে গেছে ওরা? শুধু ঘোরলাগা উল্লাসধ্বনিতে আকাশের অপরিসীম শূন্যতাকে ভরে দিচ্ছে। নদীর বাতাসে প্যাঁচা থরথর ক’রে কাঁপে, কেন জানি ভয় পায়। জীবনে প্রথমবার ভয় পায় সে। পিছিয়ে ফিরে আসে ডানা মেলে আবার আগের জায়গায়। ঘোলা চোখে নদীর দিকে শূন্যমনে তাকিয়ে থাকে। নদীজলে চাঁদ খেলা করে। চাঁদকে ঈর্ষা হয় তার।
তবু সে নদীর দিকেই তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। সুপ্তিমগ্না নদীটির একখানি হাত ক্ষীণ স্রোতোধারা হয়ে চাষের জমির দিকে এলিয়ে রয়েছে। ঘুমের মধ্যে নদীর বুক সঘন নিঃশ্বাসে উঠছে পড়ছে। আহা! যদি এই রূপসী নদী একবার ঘুম ভেঙে তার দিকে চেয়ে দেখত, প্যাঁচা ভাবে। অথবা, ও ঘুমিয়েই থাকুক। আমি শুধু এই একভাবে ওকে দেখি। কোনও কোনও রূপালি মাছ জলের গভীর থেকে স্বপ্নের আবেগের মত নিদ্রিত নদীটিকে উতলা ক’রে দিয়ে যাচ্ছে। ঘুমের ভিতর ঈষৎ বিরক্ত হয়ে নদীটি আবার পাশ ফিরে শুচ্ছে। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে প্যাঁচার। ওকে যে যেতে হবে। কোথায় যেন ? মনে পড়ছে না। আর জন্মে শকুন নয়, নদ হবে সে। নদীটিকে ভালোবাসবে। এই পেচকজন্ম বড় অভিশপ্ত। ভালোবাসতে দেয় না। বুকের মধ্যে বিষব্যথা করে। ভুলে যায় সে হত্যার পরিকল্পনার কথা, অমোঘ রাজনির্দেশের কথা। তার সমস্ত শরীর আজ জল হতে চাইছে, নদীজলে মিশে যেতে চাইছে।
সে আজ আর কোথাও যাবে না। কাকদম্পতি ঘুমিয়ে থাক শান্তিতে। সে আজ এই রাত্রে শুধু নিদ্রিত নদীটির উপর দিয়ে এপার থেকে ওপারে যাবে, ওপার থেকে এপারে আসবে। এই সুষুপ্তা নদীটির মন্দিরের মত অমিতলাবণ্যশালিনী দেহবল্লরীকে সে পরিক্রমা করবে সমস্ত রাত জুড়ে মুগ্ধ প্রেমিকের বিভঙ্গ-মুদ্রায়।
সে জানে। ভোর হয়ে যাবে একসময়। আর সে গাছের কোটরে ফিরতে পারবে না। শকুনেরা তাকে খুঁজে পাবে। লোহার ঠোঁটে তাকে ছিন্নভিন্ন করবে রাজরোষে। তার ডানা, পালক, অন্ত্র, তন্ত্র, হৃৎপিণ্ড খুবলে খেয়ে অবশিষ্টাংশ নদীর ভিতর নিক্ষেপ ক’রে চলে যাবে। নদী জেগে উঠবে তখন। তবু নদী ফিরেও তাকাবে না। বহে যাবে। তা হোক। প্রেমে নিহত হয়ে সে তো শুয়ে থাকবে নদীটির ভিতর। এক অকৃতার্থ ঘাতকের অপমৃত শরীরের ভগ্নাংশ নদীবান্ধবীর শ্রোণিদেশে লগ্ন হয়ে থাকবে জন্মপাপ ধুয়ে দেবার আকুলতায়।