ঘরে-বাইরে
প্রতি সোমবার তোমাদের আনন্দমেলার জানালার বাইরে বসে তোমাদের কথাবার্তা শুনি আর ভাবি হায়, আমাকে কেউ ভেতরে ডেকে নেয় না কেন? জোর করে সবাই আমাকে বসিয়ে রেখেছে গুরুজনদের সঙ্গে, বয়স আমার বেশি বলে। কেউ জানে না, আমার বয়স কমতির দিকে; বয়স কমতির দিকে কী তার মানে জানো না? কেন সুকুমার রায়ের হ য ব র ল পড়নি? ওরকম বই দু খানা হয়নি। তাতে টেকো বুড়ো জিগ্যেস করছে, বয়স কত? ছেলেটি বলল, আট। টেকো জিগ্যেস করল, বাড়তি না কমতি ছেলেটি বলল, সে আবার কী? টেকো বলল, তা-ও জানো না? এই মনে কর আমার বয়স চল্লিশ, একচল্লিশ, বিয়াল্লিশ হচ্ছে, তখন “বাড়তি”। বিয়াল্লিশে পৌঁছতেই ঘুরিয়ে দিলুম, তখন ফের একচল্লিশ, চল্লিশ, উনচল্লিশ হয়ে কমতিতে চলল। তা না হলে বুড়ো হয়ে মরি আর কি? এখন আমার বয়স চোদ্দ। “কমতি” চলছে! শুনে ছেলেটি হেসেই খুন– টেকো বুড়োর বয়স নাকি চোদ্দ।
হেসো না, সত্যি বলছি আমার বয়স কমতির দিকে। সেদিন দেখি চিঠির থলিতে তোমাদেরই এক বন্ধু নদীয়ার সভ্য (১৪৪১৬) সত্যপীরের লেখা নিয়ে মৌমাছির সঙ্গে আলোচনা করেছে। জানালার পাশে বসেছিলুম, তখুনি ডিঙিয়ে এসে আনন্দ-মেলার খেলাঘরে ঢুকে পড়লুম। ভাবলুম অসভ্য থেকে সভ্য হয়ে গিয়েছি; এইবার দুনিয়ার নানাদেশ ঘুরে যে নানাগল্প যোগাড় করে রেখেছি তারই এক একখানা ছাড়ব আর তোমরা বুঝে নেবে আমার বয়স কমতির দিকে কি না।
.
পয়লা নম্বর এই বেলা শুনে নাও।
স্বর্গীয় জগদানন্দ রায় শান্তিনিকেতনে স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। জগদানন্দ রায়ের নাম শোনোনি, বই পড়নি? তবে ভুল করেছ। তিনি একদিন ক্লাসের একটি ছেলের কান মলে দিচ্ছিলেন। শান্তিনিকেতনের ভেতরে অবশ্যি মারধোর করা বারণ, কিন্তু একদম কেউ যদি সে আইন না ভাঙে তবে লোকে জানবে কী করে যে আইনটা আদপেই আছে। তাছাড়া তিনি তাকে কানে ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন সে তো তখন আর আশ্রমের ভেতর নয়- উপরে। আশ্রমের ভেতরেই তো মারধোর বারণ। তা সে আইনের কথা থাক—-জগদানন্দবাবু ছেলেদের এত প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন যে কেউ কখনও ওসব জিনিসে খেয়াল করত না।
কিন্তু ঠিক ওই সময় বড়বাবু বেড়াতে বেরিয়েছেন, আর দূর থেকে দেখতে পেয়েছেন। বড়বাবু কে জানো? তিনি রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড়দাদা। শুরুদেব, গান্ধীজি ওঁকে বড়দাদা বলে ডাকতেন। গেল শতক আর এই শতক নিয়ে হিসাব করলে আমাদের দেশে দু জন সত্যিকার দার্শনিক জন্মেছেন– একজন বড়দাদা, আরেকজন স্বর্গীয় ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। ব্যাপারটা দেখে বড়বাবু বাড়ি গিয়ে জগদানন্দবাবুকে একটা দোহা লিখে পাঠালেন,
শোনো হে জগদানন্দ দাদা,
গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব, অশ্বেরে পিটিলে হয় সে গাধা!
আমরা তো হেসেই খুন। গাধাকে পিটলে ঘোড়া হয় না, সেকথা তো সবাই জানতুম, কিন্তু ঘোড়াকে পিটলে যে সে গাধা হয়ে যায় এটা বড়বাবুর আবিষ্কার! আর জগদানন্দ দাদার সঙ্গে গাধা শব্দের মিল শুনে আমাদের খুশি দেখে কে?
জগদানন্দবাবু মনের দুঃখে সেদিন থেকে কানমলা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪.৯.১৯৪৫]