ঘরেই জামাই
আমাদের পাড়ায় যে জায়গাটাকে আমরা চৌমাথা বলি সেখানে একই সঙ্গে একটা শীতলান্দির, একটা কালীবাড়ি ও একটা রাধাগোবিন্দের মন্দির আছে। সেই মোড়ের বাঁ পাশে পাঁচিল-ঘেরা যে বিশাল একটা বাগান বাড়ি আছে সেই বাড়িটিকে আমরা বলি মিত্তির বাড়ি। মিত্তিররা খুব বিখ্যাত লোক। পাড়ার লোক মিত্তিরদের খুব ভালোবাসে। প্রবীণ এবং নবীন সকলেই বলে মিত্তির বাড়ি আমাদের এই তল্লাটে একটা ল্যান্ডমার্ক। আমাদের এই গল্প সেই মিত্তির বাড়ির অন্দর মহল নিয়ে। বড় মজার বাড়ি। ভাইয়েরা খুব আমুদে। সকলেই সুপ্রতিষ্ঠিত। আর এক বোন যার নাম কুসুমিকা, পাড়ার সবাই তাকে কুসুদি বলে ডাকে।
ঝকঝকে সকাল। আমার বড়মামা ডাক্তার, নাম বিমল মিত্তির। আজ মনে হয় কোথাও মেডিক্যাল কনফারেন্স আছে। বড়মামা তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজে ব্যস্ত। একটা টাই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফাঁস বাঁধবার চেষ্টা করতে করতে ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘ধ্যাৎ তেরিকা, এত বয়েস হল এখনও টাই বাঁধাটাই শিখতে পারলুম না। আমার বাবাকে দেখ, ওই তো ছবি। কত ভাবে কত কায়দায় টাই বাঁধতে পারতেন! দিস সিম্পল মেকানিজম ফ্রাস্ট্রেটস অল মাই এফার্টস!’ বলতে বলতে আয়নার সামনে থেকে বাবার ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন বড়মামা। মুখ দেখে মনে হয় ভেতরে খুব ভাঙচুর চলেছে। বাবার ছবিটার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, ‘ও ফাদার টিচ মি, হাউ টু নট এ টাই! বলেই মারল একটান। বড়মামার চোখ-মুখ বদলে গেল। টাই ফাঁস হয়ে এমন আটকাল আর খুলতে পারছে না। গলার কাছটা ফুলে ঢোল। চিৎকার করে ডাকছে, ‘কুসি, কুসি।’
পাশের ঘর থেকে দৌড়ে চলে এল কুসি। বলল, ‘সাত-সকালে কী হল আবার!’
বড়মামা দম আটকানো স্বরে বলল, ‘সেই ওল্ড প্রবলেম, লাগ লাগ লাগ…লাগিয়ে বসে আছি।’
মাসি বলল, ‘শোন দাদা, টাই তোমার জিনিস নয়, স্কার্ফ মাফলার নিদেন একটা গামছা—এই নিয়ে থাকার চেষ্টা কর না। তোমাকে কতবার দেখিয়েছি টাইয়ের নট হবে আলগা ফাঁস। একটা পাশ ধরে টানবে খুস করে খুলে যাবে।’
‘আরে সাতটা থেকে তো সেই চেষ্টাই করছি এখন ঘড়িটা দেখ! ওদিকে আমার সেমিনার আরম্ভ হয়ে গেল। প্লিজ দে ভাই, শেষবারের মতো বেঁধে!’
মাসি নিমেষের মধ্যে টাইটা বেঁধে ঠিকঠাক করে দিল। তারপর দাদার বুকে একটা চাপড় মেরে বলল, ‘নাউ ইউ আর রেডি। ইউ ক্যান গো।’
বড়মামার বুকের ভেতরে সাবানের ফ্যানের মতো আবেগ যেন বুজকুড়ি মেরে উঠল। মাসির মাথাটাকে আচমকা বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল, ‘মেরি পেয়ারি বাচ্চে!’
মাসি বাছুরের মতো গুঁতো মেরে বলে উঠল, ‘লেগে যাবে লেগে যাবে। মাথায় জবা আর কেশুতপাতা একসঙ্গে মেখেছি। যাহ, জামাটার সর্বনাশ হয়ে গেল বোধহয়!’
বড়মামা মাসির মাথাটা ছেড়ে দিয়ে জামার দিকে তাকিয়ে তালি দিতে দিতে বলে উঠল, ‘বাঁচ গিয়া বাঁচ গিয়া!’
মাসি বলল, ‘আর একটু হলেই যেত। শেষ রাতে লাগিয়েছি তো শুকিয়ে গেছে।’
বড়মামা বলল, ‘তোর নাম বদলে রাখব ঘৃতকুমারী। আচ্ছা, গুডবাই।’
কিন্তু বেরোবার মুখেই বাধা। এক হাতে একটা লম্বা কাগজের রোল অন্যহাতে বেত নিয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরা একটা লোক বড়মামাকে প্রায় ধাক্কা মেরে একতলার ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়ল। বাড়ির মালিক যেন সে এই রকম ভঙ্গি করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগল, ‘ভূগোল, ভূগোল। বাঙালির ভূগোল জ্ঞান আর হবে না। কলকাতার বাইরে কিছু কি নেই গাধা! হিমালয় কোন দিকে বঙ্গোপসাগর কোন দিকে সে জ্ঞানটাও নেই উল্লুক। অ্যায় খাঁদু! অ্যায় খ্যাঁদা! আজ ওয়াল ম্যাপ এনেছি। দেয়াল, দেয়াল কোথায়?’
বড়মামা যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। কী ঘটতে চলেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সেমিনার তার মাথায় উঠেছে। সাহস করে বলল, ‘আপনি কে?’
আগন্তুক ভদ্রলোকের এতক্ষণে যেন খেয়াল হল। বড়মামার দিকে কটমট করে তাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কে?’ তারপর নিজেই উত্তর দিলেন, ‘একালের অপদার্থ এক পিতা! সাজ দেখো, যেন মোড়ের কার্তিক! বারবাডোস কোথায়? বাঁকুড়া কোথায়? দাঁড়াও, ম্যাপটা ঝোলাই তারপর দেখাচ্ছি মজা! যার ছেলে গর্দভ, তার আবার সায়েব সাজা! উরুগুয়ে কোথায়!’
ভদ্রলোকের চেঁচামেচিতে মাসিও এই ঘরে চলে এসেছে। সেও বড়মামারই মতো ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। কোথাকার মাল যে কোনদিকে গড়াচ্ছে কেউই বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোক এইবার মাসির দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এদের বাড়িতে আবার কাজের লোক টেঁকে না। নিত্য নতুন! ওহে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে একটা পেরেক আর হাতুড়ি নিয়ে এসো। রাতারাতি ঘরের ভোল পালটে গেল। কালো টাকায় কী না হয়! কেবল ছেলেটাই মানুষ হয় না।’
ভদ্রলোকের হাঁকডাক সারা বাড়িকে মাৎ করে দিয়েছে। ওপরে ছিল মেজমামা, ভেবেছে বাড়িতে বুঝি ডাকাত পড়েছে। দাড়ি কামাতে ঢুকেছিল বাথরুমে। সেখানে থেকে এক ছুটে সিঁড়িতে। নামতে নামতে বলছে, ‘কী রে, কী হল রে!’
মেজোভাইকে নামতে দেখে বড়ভাই যেন বাঁচল। তারপর ইশারায় দেখাল, ‘এই যে!’
আগন্তুক ভদ্রলোক এইবার মেজোমামাকে দেখে ফেলেছেন। ভুরু কুঁচকে বলছেন, ‘এই যে মোদক মশাই, দইতে কত আর দালদা চড়াবে? রসগোল্লায় সবেদা!’
মেজোমামা সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে বলল, ‘সর্বনাশ! বিখ্যাত শিক্ষক জগমোহন বোস! ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন। ক্র্যাকড।’
বীরের ভঙ্গিতে জগমোহন হাঁটছিলেন। মেজোমামার কথাটা কানে যেতেই খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘কি বললে? তোমার চোদ্দ পুরুষ ক্র্যাকড। বেটা ময়রা! সন্দেশে ময়দা!’
ঠিক সেই মুহূর্তে কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে এক মহিলা এসে ঢুকলেন। আলুথালু শাড়ি। দেখলে মনে হয় গরীব। কিন্তু মহিলার মুখ জুড়ে ছেয়ে আছে প্রশান্তি। আক্ষেপ করে বলে উঠলেন, ‘উঃ, আর কত যন্ত্রণা দেবে ভগবান। দরজা যেই খোলা পেয়েছে ও অমনি চলে এসেছে। আপনারা কিছু মনে করবেন না। বড় ছেলেটা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল না!’
মাসি বলল, ‘কী অ্যাকসিডেন্ট!’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ও তো ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ায়ার ছিল। পাওয়ার প্ল্যান্টে জেনারেটার ঠিক করতে গিয়ে কারেন্টে পুড়ে কাঠ কয়লা হয়ে গেল!’
বড়মামার মনটা খারাপ হয়ে গেল। বলল, ‘থাক, থাক, ওসব কথা থাক!’
ভদ্রমহিলা এবার জগমোহনবাবুর হাত ধরে আদর করে বললেন, ‘চলো, চলো, তোমার রাজহাঁস এসে গেছে। বিছানায় এই এত বড় একটা ডিম পেড়েছে।’ তারপর দুঃখ করে বলতে লাগলেন, ‘পাগলের সঙ্গে আমিও পাগল হলুম।’
বড়মামা, মেজোমামা, মাসি জমা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। জগমোহনবাবুকে তাঁর স্ত্রী ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। ঠিক যেন মনে হচ্ছে দস্যি ছেলেকে তার মা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। ঘরে শুধু সিলিং ফ্যানের আওয়াজ আবহাটাকে জীবন্ত করে রেখেছে।
বড়মামা বলল, ‘নাঃ, মনটা বিগড়ে গেল।’
মেজোমামা বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ। একটু বসে যাও। না গেলেই নয়! দেখ, আমরা কেমন আছি? তোফা! চালাও পানসি বেলঘরিয়া! কেন বলত?’
বড়মামা বলল, ‘বরাত! কপালে যা আছে লেখা তাই হবে সখা। কপাল গুনে ভাত, কপাল দোষে হাভাত! মনে আছে, ফট করে বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের স্ট্রাগল!’
মেজোমামা বলল, ‘মনে আবার নেই! তোর আর আমার বয়েসের ডিফারেন্স কত? আর একটু হলেই তো যমজ হয়ে যেতুম!’
‘দেখ মেজো, তোর মেমারি ভীষণ উইক। কিচ্ছু মনে রাখতে পারিস না। সাধে আর্টসের লাইনে যেতে হল। আমি মাঠে ক্রিকেট খেলছি ট্যাঁ করে শব্দ হল। দৌড়ে এলুম দেখি তুই হয়ে বসে আছিস!’
মেজোমামা বলল, ‘তোমার তখন বয়েস কত?’
বড়মামা বলল, ‘দশটশ হবে।’
মেজোমামা বলল, ‘তার মানে, আমি যখন জন্মালুম আমার বয়েস আট; কারণ আমি তোমার চেয়ে দু’বছরের ছোট।’
বড়মামা জানতে চাইল, ‘তাহলে জন্মালটা কে?’
মেজোমামা বলল, ‘ছেড়ে দাও। অতীত ভেবে লাভ নেই। কপালে লিখিতং ধাতা কোন শালা কিং করিষ্যতি!’
ঠিক সেই সময়ে একজন এসে ঢুকলেন ঘরে। সুদর্শন চেহারা। পরনে ধুতি। উন্নত ললাট। তীক্ষ্ন নাসা। নাকের ফুটো দুটো নস্যি নেবার মতো ফাঁদালো। মাথায় টাক। যেন গাছপাকা পেয়ারা…।
মেজোমামা চৌকাঠ পেরিয়ে এসে ভেতর থেকে ডাকছে, ‘আসুন, আসুন পণ্ডিতম। আসুন!’ তারপর দাদা ও বোনের দিকে ফিরে গর্বভরে বলে উঠল, ‘সেই যে বলছিলুম, ইন্টারন্যাশনাল জেট সেট জ্যোতিষী! প্লেনে আলাপ। প্লেনটা আটকে গেল না!’
বড়মামা বলল, ‘কোথায়, আকাশে! ট্রাফিক জ্যাম!’
মেজোমামা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আঃ, দাদা! আইয়ে, আইয়ে পণ্ডিতজি, প্লিজ প্লিজ…।’
‘ওয়েলকাম, ওয়েলকাম। জাস্ট নাও উই ওয়্যার সিকিং অফ বরাত!’
পণ্ডিতজি ঘরে এসে পড়েছেন। খুব মার্জিত ভঙ্গিতে তাঁর চলন। কথা বলছেন যেন দৈব্যবাণী হচ্ছে। বললেন, ‘সৌভাগ্য বললেন। দেখুন ভাগ্য আসতে না আসতেই সৌভাগ্য!’
মেজোমামা সবাইকে বলল, ‘ইনি সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেছেন-সারডাস্ট! সমস্ত চক্রান্ত ফাঁস করে দিয়েছেন। কাউকে আর ট্যাঁ ফোঁ করতে হচ্ছে না। একটা রেভলিউশান। প্ল্যানেটদের সমস্ত অসভ্যতা বন্ধ। ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! হেঃ!’
বড়মামা অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী রে! কী ভাবে করলেন পণ্ডিতজি? ভয়ঙ্কর রকমের ভয়ঙ্কর। কী বল মেজো! নাঃ, আর সেমিনারের বারোটা বাজল!’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘সত্যি সত্যি, বারোটা বাজালে সে তো সব কুছ হো হি যাতা। ছোটা কাঁটা ভি বড়া কাঁটাকে সাথ…মিলজুলকে এক! বেপারটা হল কি মানুষ আর ভগবান এক হয়ে গেলো।’
মেজোমামা মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘লে হালুয়া!’
পণ্ডিতজি নিজের মনেই বলে চলেছেন, ‘এটা কুছু না। মঙ্গল ভি একটু ঢিলা আছে। টাইট দেনে সে ঠিক হো জায়গা। চলনে ফিরনে সে হোঁচট লাগতা হ্যায় কেয়া?’
মেজোমামা বলল, ‘আশ্চর্য! কী করে বললে?’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘ওই যো আপনে বোলা থা, লে হালুয়া। এ বাত আপ নেহি, আপনা আত্মা বোলতা হ্যায়।’
বড়মামা খুব বিস্মিত। বলল, ‘কেয়া বাত!’
পণ্ডিতজি এইবার পরিষ্কার বাংলায় বলতে শুরু করলেন। যেন খোলস ছেড়ে বেরলেন। বললেন, ‘আপনার স্মরণশক্তি কম। ভুলে যান। মনে রাখতে পারেন না।’
বড়মামার ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা। বলল, ‘এ বাব্বা! এ ডেনজারাস! মানুষ খুন করতে পারেন। ওরে! কে কোথায় আছিস!’
বড়মামার আর্তনাদে উদ্ধারকর্ত্রীর মতো ছুটে এল গান্ধারী। এ বাড়ির সব কিছু সে। হাতে বড় গেলাসে এক গেলাস জল। বড়মামার মুখের সামনে ধরে বলল, ‘ফিল্টারের জল। গরম-ঠান্ডা মেশানো। বডি টেম্পারেচার।’
বড়মামা বলল, ‘তোর কাছে আমি জল চেয়েছি!’
গান্ধারী বলল, ‘ওই যে বলে মেঘ না চাইতেই জল!’
বড়মামা বলল, ‘ওঃ, এগুলো সব পেকে ঝুনো হয়ে গেছে। ডাক সবাইকে। দ্যাখ কে এসেছেন! আমাদের কত সৌভাগ্য যে, দয়া করে এসেছেন! রাজা মহারাজারাই তো এঁকে ঘিরে থাকেন!’
বড়মামা থামতেই এ ঘরে মাসি এসে পড়ল। পণ্ডিতজিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে এক পাশে বসে পড়ল।
পণ্ডিতজির মুখখানা সর্বদাই যেন আনন্দে চোবানো। বললেন, ‘আর বলেন কেন? রাজা মহারাজারাই আমাকে শেষ করে দিল। সাধারণ মানুষের কাছে আসতে চাই। নো উপায়! গেছি পশুপতিনাথে। নেপালের রাজার কানে খবরটা ঠিক চলে গেছে। আমারই দোষ। মাস্ক ব্যবহার করিনি।’
মাসি মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। অবাক হয়ে বলল, ‘মুখোশ! মুখোশ পরেন নি?’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘বালিকা! সুইট গার্ল। মুখোশ নয় দেহোশ!’
বড়মামা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘হোয়াটস দ্যাট!’
পণ্ডিতজি এবার করলেন কি, কাঁধে ফেলা নিজের চাদরখানা নিয়ে আপাদমস্তক নিজেকে ঢেকে নিলেন। ঠিক যেন ব্যান্ডেজবাঁধা মমি! বললেন, ‘এটা দৃশ্য চাদর। অদৃশ্য চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলা। যেমন, পৃথিবী, সূর্যের আলো থেকে নিজেকে মেঘে ঢাকে।’
মেজোমামা খুব বিনীতভাবে বলল, ‘এখন একটু করে দেখাবেন! খুব ইচ্ছে করছে।’
পণ্ডিতজি একটু যেন বিরক্ত হলেন। মেজোমামার চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘অবিশ্বাস! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। বিশ্বাসের পৃথিবীতে বসবাস করো বাবাজি!’
কেসটা অন্য দিকে ঘুরে যেতে পারে দেখে মাসি বলল, ‘তারপর কী হল ভগবানজি!’
মাসির কথায় তিনি বিরক্ত হলেন না বটে কিন্তু সম্বোধনটা ঠিক পছন্দ হল না তাঁর বললেন, ‘অতটা নয়। ভগবান সেই এক। আমরা দাসানুদাস। আমার গুরুজি আগমাচার্য ডমরুবল্লভ বলতেন পৃথিবীতে যত ভেড়া আছে, সেই ভেড়াদের সব লোম এক জায়গায় করে তার থেকে একটা লোম তুলে নাও। সেইটে তুমি।’
কথাটা মেজোমামার মনের মতো হয়েছে। বলল, ‘কেয়া বাত!’
বড়মামা বলল, ‘তারপর কী হল? নেপাল?’
পণ্ডিতজি শান্ত স্বরে বললেন, ‘রাজার কাছে খবর চলে গেছে। মানে, আমার ‘ভাইব্রেশান!’
মাসি অবাক। চোখ দুটো এত বড় করেছে যেন পায়রার ডিম! বলল, ভাইব্রেশান?’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘কলকাতায় ভূমিকম্প হল। কোথায় হল?’
মেজোমামা বলল, ‘কলকাতায় হল।’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘কেয়া বাত! কলকাতায় হল না। হল তেজপুরে। সেই কম্পনে কলকাতা থরথর। মহারাজার হাওদা চড়ানো হাতি এসে হাজির। যেতেই হবে। নেপালের একটু ক্রাইসিস যাচ্ছে তো!’
মাসি বলল, ‘হাতি কেন? রাজার তো মার্সিডিজ, রোলস সবই আছে!’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘আমি লোহার গাড়ি চড়ি না। চড়লে গাড়ি আর চলবে না। আমি ম্যাগনেট। আমার বাহন হাতি, ঘোড়া, কাঠের রথ, গরুর গাড়ি, পুনপুন, রাশিয়ায় শীতকালে স্লেজ, সুইজারল্যান্ডে স্কি।’
মাসি একরাশ কৌতূহল ঠেলে বলল, ‘কলকাতায়?’
পণ্ডিতজি বসেছিলেন খাড়া হয়ে। একটু পেছনে হেলে গিয়ে বললেন, ‘পদব্রজে। অস্ট্রেলিয়ার প্রাইম মিনিস্টার আমাকে একটা ঘোড়া দিতে চেয়েছিলেন। বলে দিয়েছি, না। এদেশে ঘোড়ায় চাপলে ডাকাত ভাববে। চম্বলের গব্বর সিং। সামান্য একটা উপহারের জন্যে অত বড় পুরস্কার।’
বড়মামা বলল, ‘কী উপকার পণ্ডিতজি?’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘আরে ওর বউ দুর্ঘটনায় মরতই। এ দেশের মেয়ে তো! ভীষণ ডাকাবুকো। রোজই একটা না একটা কিছুতে রক্তপাত হবেই হবে। দেখলুম, মঙ্গলটা ড্যামেজ আছে। দিলুম অ্যামপুট করে!’
মেজোমামা বলে উঠল, ‘অ্যাঁ! অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অ্যামপুট হয়! লেগ-অ্যামপুট। গ্রহও অ্যামপুট করা যায়? কেতা বাত।’
পণ্ডিতজি সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি বলেছিলুম? বিশ্বাস করবে না মানুষ। জ্যোতিষ ভাগ্যগণনা নয় বিজ্ঞান। টেকনোলজি।’ পণ্ডিতজির ডান হাতটা সোফার অনেকখানি জায়গা জুড়ে খেলা করছিল। সেই হাতে কী যেন একটা আটকেছে। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে বললেন, ‘এটা কী?’
সকলে সমস্বরে বলে উঠল ‘হুইশল!’
পণ্ডিতজি শান্ত গলায় বললেন, ‘কী সামান্য, অথচ কী ভয়ঙ্কর!’
গান্ধারি বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক। আমার কাকা হাবিলদার ছিল। ওই হুইশল গলায় আটকে মরে গেল।’
পণ্ডিতজি তাকে পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কীসে মরবে?’ বলেই আশ্বাস দিলেন, ‘বেটি তুই যে বড়লোকের বউ হবি। পুষ্পক রথে চড়ে স্বর্গে যাবি।’
মাসি বলল, ‘ও তো আমাদের গান্ধারী!’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘গান্ধারী শুধু তোমাদের কেন? গান্ধারী সমগ্র ভারতের, মহাভারতের। ওর ভাইব্রেশান শুক্রের ভাইব্রেশান। কত মেগা হার্জ বলে দিচ্ছি।’ এইবার তিনি হুইশলটার ফুঁ মেরে বারকতক ফিরির ফিরির করে বাজিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী কেমন লাগছে গান্ধারী?’
গান্ধারী বলল, ‘মনে হল কানের ভেতর একটা গোদা মতো ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে।’
পণ্ডিতজি খলবলিয়ে বলে উঠলেন, ‘ধরে গেছে। রেখে দাও। রাতে স্বপ্ন দেখবে। উলটো মহাভারত, সিংহাসনে ধৃতরাষ্ট্র। অন্ধ নয়। চোখ ভালো হয়ে গেছে। গোল্ড ফ্রেমের চশমা। পাশে তুমি গান্ধারী। চোখের ফেট্টি খোলা। ধৃতরাষ্ট্রের হাতে একটা আয়না। মাঝে মাঝে তোমার মুখের সামনে তুলে ধরছেন, আর তুমি তোমার মুখ দেখে বলছ…’
বড়মামা আনন্দে পণ্ডিতজিকে থামিয়ে দিয়ে আহ্লাদে বলে উঠল, ‘কেয়া বাত!’
কথা শুনতে শুনতে গান্ধারী যেন হস্তিনাপুরে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে পড়ে বলল, ‘যাঃ, পুড়ে গেল।’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘কী জতুগৃহ?’
গান্ধারী বলল, ‘ডাল।’ বলেই দৌড় দিল।
মেজোমামা দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লে হালুয়া!’ তারপর বলল, ‘আপনার যন্ত্রটা এনেছেন। গ্রহ অ্যামপুট করার যন্ত্র।’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘সে তো পেসমেকারের মতো। ব্রহ্মতালুতে ফিট করে রাখতে হয়। ভাইব্রেশান মেপে ঠিক করে দি। শুক্রগ্রহ যে তালে চলছে, তার উলটো তালে বেঁধে দিলেই, সেই পার্টিকুলার গ্রহটা শুকনো সুপুরি পাতার মতো খুস করে খুলে পড়ে যাবে।’
বড়মামা বলল, ‘কোথা থেকে খুলে পড়ে যাবে? কোথায় পড়বে?’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘আঃ, এই সামান্য জিনিসটা…আচ্ছা, এই আমি কথা বলছি, এখানে ওখানে যাচ্ছি। রেগে যাচ্ছি, ধমকাচ্ছি। গেলাস পত্তর ভাঙছি। তারপর একদিন ফট।’
মেজোমামা বলল, ‘মানে মরে গেলেন!’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘তখন আমি ছবি হয়ে ওই দেয়ালে। নড়ি চড়ি না। বে-বাক! গ্রহটাকে ছবি করে দেব। অর্থাৎ ওই গ্রহটার থ্রম্বোসিস, পক্ষাঘাত। এর নাম অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল থ্রম্বোসিস! না, আমাকে এবার উঠতে হবে। ওদিকে মহাসমস্যা।’
বড়মামা বললেন, ‘কোন দিকে?’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘ওই ভারতের লেজে! যুগে যুগে লঙ্কাকাণ্ড! চাটার্ড ফ্লাইটে সিলোন যেতে হবে। দেখি। বড় শক্ত কাজ। পুরো দেশটার ভাইব্রেশান পাল্টাতে হবে। একটা ট্রান্সমিটারের কাজ আর এটা ভূকম্পন মাপার যন্ত্রের কাজ। কঠিন কঠিন সব সমস্যা। সৃষ্টি থাকে কি যায়! আচ্ছা, এই হুইশলটা রাখো। ঘরের ওই ঈশানকোণে দাঁড়িয়ে, নিয়ম করে ঘণ্টায় ঘণ্টায় তিনবার, তিন মিনিট গ্যাপে গ্যাপে, তিনমাত্রা বাজাবে। আর ওই জায়গাটায় একটা বড়চাঁড়ালের গাছ।’
মাসি জানতে চাইল, ‘গান্ধারীর কি হবে!’
পণ্ডিতজি উঠে দাঁড়িয়েছেন। চাদরখানা অর্ধেক কাঁধে অর্ধেক হাতে। বললেন, ‘বিয়ে হবে।’
মাসি আঁতকে উঠে বলল, ‘সে কী ওকে ছাড়াব কি করে! মিত্তির বাড়ি অচল হয়ে যাবে।’
পণ্ডিতজি দরজার দিকে পা বাড়িয়েছেন। শরীর থেকে আভা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। চৌকাঠ পেরিয়ে পেছনে ফিরলেন। উদ্ভাসিত হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘ঘরজামাই হবে!’
সকাল আর নাবালক নেই। বাইরে ভাদ্রের চরম রোদে মধ্যাহ্ন বেহুঁশ হয়ে আছে। মিত্তির বাড়ির অন্দরমহল যেন মশা মারার পাকানো কয়েল! মাসি ঘরময় পাক মেরে মেরে পায়চারি করছে আর বলছে, ‘ঘরজামাই। মানে ঘরেই জামাই।’
মাসি ঘুরছে। পেছন পেছন দুই ভাই। যেন সংকীর্তনের দল বেরিয়েছে। দুই ভাইও আউড়ে যাচ্ছে। গান যেমন সমে এসে পড়ে ঠিক সেই ভাবে সমবেত কণ্ঠে বলছে, ‘ঘরেই জামাই, ঘরের জামাই, ঘরের…।’