ঘনশ্যাম সার্বভৌম – নবম পৰ্ব

ঘনশ্যাম সার্বভৌম—নবম পৰ্ব

রূপেন্দ্রনাথ এবার পূর্বাভিমুখী।

গঙ্গার স্রোতধারায় যাত্রীবাহী বজরায় এবার চলেছেন গৌড়মণ্ডলের দিকে। জন্মভূমির সন্ধানে, আত্মজা-জননীর সন্ধানে, রূপমঞ্জরীর সন্ধানে। বজরা এসে ভিড়ল নবদ্বীপের ঘাটে প্রায় তিন মাস পরে। সেদিন রূপেন্দ্রনাথের মনটা চনমন করে উঠল। এখানে নেমে নৌকা বদল করে অনায়াসে চলে যাওয়া যায় জলাঙ্গী বেয়ে, কৃষ্ণনগরে। সেখান আছেন ওঁর পরমসুহৃদ রায়গুণাকর কবি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি প্রাকবিবাহ জীবনে রূপেন্দ্র একবার কৃষ্ণনগরের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ঝষধ্বজের চিকিৎসা করতে এসেছিলেন। ঘটনাচক্রে আলাপ হয়েছিল মহাকবি ভারতচন্দ্রের সঙ্গে। বস্তুত যে কয়দিন কৃষ্ণনগরে ছিলেন ঐ প্রোষিতপত্নীক কবির ভদ্রাসনে অতিথি হিসাবে বাস করে যান। তখন কুসুমমঞ্জরীর সঙ্গে রূপেন্দ্রনাথের বিবাহ স্থির হয়েছে। রূপেন্দ্রের কাছে সে খবর শুনে কবি ভারতচন্দ্র বলেছিলেন তোমাদের যদি পুত্রসন্তান হয় তবে তার নাম দিও : ‘আত্মদীপ’ ‘আর যদি কন্যাসন্তান হয় তবে তার নাম দিও : ‘রূপমঞ্জরী।’ রূপেন্দ্র বলেছিলেন, ‘রূপমঞ্জরী’ শব্দটির অন্বয় ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। সহজ, সরল দ্বন্দ্বসমাস। আমাদের দুজনের নামের অংশবিশেষ, কিন্তু কবি! ঐ ‘আত্মদীপ’ শব্দটির তাৎপর্য কী?

ভারতচন্দ্র বুঝিয়ে বলেছিলেন, এতবড় পণ্ডিত হয়েও সেটা তুমি ধরতে পারলে না? শোন! অশীতিপর শাক্যসিংহ যখন কুশীনগরে শেষশয্যায় শায়িত, তখন তাঁর মহাপরিনির্বাণ শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন একমাত্র বুদ্ধশিষ্য : আনন্দ। তিনি গৌতমবুদ্ধকে প্রশ্ন করেছিলেন, প্রভু! আপনার মহাপরিনির্বাণের পরে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে আমর। সমাধানের জন্য কার কাছে যাব?

মহাজ্ঞানী প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন :

আত্মদীপো ভব।
আত্মশরণো ভব।।
অনন্যশরণো ভব।।।

বলেছিলেন, নিজেকে প্রদীপ করে জ্বালিও। সেই বিবেক-নির্দেশিত পথে গমন কর। অপরের কথায় জীবন পরিচালিত কর না। ভাই রূপেন্দ্র! আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, বুদ্ধদেবের ঐ নির্দেশটি তুমি জানো বা না জানো জীবনে সেই পথনির্দেশটি তুমি কঠোরভাবে মেনে চল। যেন ওটাই তোমার জীবনের মূলমন্ত্র। তাই এই নামকরণ করলাম তোমার পুত্রের।

আজ রূপেন্দ্রের তাই ইচ্ছা হল নবদ্বীপের ঘাট থেকে গোয়াড়ি কৃষ্ণনগরে চলে যেতে। মালতীর বেড়া দিয়ে ঘেরা কবির সেই পর্ণকুটীরে। গিয়ে বন্ধুকে দু-বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করতেন। বলতেন, ‘আত্মদীপের’ পরিবর্তে ‘রূপমঞ্জরী’ অবতীর্ণ হয়েছে এ ধরাধামে। ঐ মেয়েটিকেই দীক্ষা দেবেন তিনি আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মন্ত্রটায় : “আত্মদীপো ভব।”

কিন্তু তা হল না। ‘মাহেশ’ গ্রামখানি ওঁকে টানছে। স্তনভারনম্র গাভী যেমন বাছুরকে ডাকে, রূপেন্দ্রের আত্মজা-জননী যেন ব্রতউদযাপনের তাগিদে ওঁকে সে ভাবে ডাকছেন। সবার আগে ওঁকে মাহেশ যেতে হবে। বজরা ছাড়ল। অতিক্রান্ত হল কালনার ঘাট। এখান থেকে পশ্চিমমুখো রওনা হলে নদীপথে যাওয়া যায় তাঁর পিতৃভূমিতে : সোঞাই গ্রামখানিতে। কিন্তু না। রূপেন্দ্র সে পথেও গেলেন না। নৌকাটি যাবে ফ্রেডরিকনগর পর্যন্ত। উনি নৌকা থেকে অবতরণ করবেন তার পূর্বেই—ফরাসীডাঙার ঘাটে। আজ যার নাম চন্দননগর কারণ ওঁর পিসাশ্বশুরের ভদ্রাসনটি যে গ্রামে, সেই মাহেশে যেতে হলে ঐ ঘাটেই নামতে হবে।

তাই নামলেন। ফরাসী অধিকৃত ফরাসীডাঙার ঘাটে। পুঁটুলিটি বগলে নিয়ে আম- কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে চলেন মাহেশের দিকে, রাত্রি তখন তৃতীয় প্রহর।

মঞ্জরী নেই। কুসুমমঞ্জরী অকালে ঝরে গেছে; কিন্তু ব্যর্থ হয়নি তার আত্মদান—মহাসাধক ত্রৈলঙ্গস্বামী তাই বলেছেন। যাবার আগে সে রেখে গেছে রূপমঞ্জরীকে। সেই মহাসাধকের নির্দেশমতো রূপেন্দ্র কন্যাকে নিয়ে যাবেন স্বগ্রামে : সোঞাই গ্রামে। সেখানে আছেন বৃদ্ধা জগুপিসিমা, আছে কাত্যায়নী। তারাই শিশুটিকে মানুষ করে তুলবে, শিশুকাল থেকে যত্ন না নিলে মানসিক গঠন অন্যরকম হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন তীর্থ পরিক্রমা করেছেন। ভাগীরথীর দুই তীরের বহু বর্ধিষ্ণু জনপদ। তারপর শ্রীচৈতন্যদেবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাম্রলিপ্তি, দন্তপুর, ভদ্রক, পুরুষোত্তমপুর, কটক, একাম্রকানন (ভুবনেশ্বর), সাক্ষীগোপাল হয়ে নীলাচল শ্রীক্ষেত্র। সেখানে ব্যর্থ হয়ে পদব্ৰজে অরণ্যভূমির অজানা পথে এসে বাদশাহী সড়ক (জি. টি. রোড)। তারপর আর পথসন্ধান নিতে হয়নি। বাদশাহ শের শাহ্-এর সরলীকরণ পথে সোজা বাবা সচল বিশ্বনাথের চরণতলে। সেখানেই পেলেন নির্দেশ : রূপমঞ্জরীকে ‘আত্মদীপ’-মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলতে হবে।

তীর্থপরিক্রমা কালে অনেক-অনেক কিছু দেখেছেন। ওঁর এখনো বিশ্বাস : ‘ধর্মসংস্থাপনার্থায়’ তিনি যখন আসবেন যদি আজও না এসে থাকেন তবে তাঁর লীলাক্ষেত্র ঐ ভাগীরথী-বিধৌত ‘গঙ্গাহৃদির’ কোন একটি জনপদ। পুরীতেও নয়। কাশীধামেও নয়।

কিন্তু বঙ্গভূমের কী অবস্থা! গঙ্গার দুই তীরে গায়ে গায়ে গড়ে ওঠা বর্ধিষ্ণু গণ্ডগ্রাম। আলিবর্দীর সুশাসনে ব্যবসায়-বাণিজ্য চলছে নির্বিঘ্নে। রেশমশিল্পীরা কাপড় বোনে। কুম্ভকারেরা চাকা ঘোরায়, তাঁতিরা তাঁত বোনে। দিগন্ত-অনুসারী মাঠে টোকা মাথায় কৃষকদল সোনা ফলায়। গ্রামজীবনের মধ্যমণি ব্রাহ্মণ-সমাজ! মহামহোপাধ্যায়েরা ন্যায়ের ভাষ্য নিয়ে চুল- চেরা বিচার করেন : তৈলটা পাত্রাধার অথবা পাত্রটা তৈলাধার! পাঠশালা, টোল, চতুষ্পাঠী—কিন্তু ব্যতিক্রম হিসাবেও কোন পাঠশালায় দেখতে পাননি বেণী-দোলানো ডাগর-চোখো কোনও বালিকা বা কিশোরীকে! ওদের অক্ষর-পরিচয় হওয়া মানা। স্ত্রীলোকের অক্ষর-পরিচয় মাত্রেই অনিবার্য অকালবৈধব্য। কোন্ যুক্তিতে? বাঃ। কোন্ গণ্ডমূর্খ এটা জানে না! ন্যায়রত্ন মশাই স্বয়ং বিধান দেছেন। শাস্ত্রে নাকি তাই নেখা আছে!

জল-অচল অদ্ভুতেরা বাস করে ভদ্রপল্লীর বাহিরে। তারা অন্তেবাসী। গঙ্গাস্নান তারা করতে পারে। তবে ঐ আঘাটায়। পথেঘাটে তাদের সন্ত্রস্ত পদক্ষেপ : বামুন-গায়ে যেন ছায়াপাত না ঘটে যায়!

সে নীরন্ধ্র অন্ধকারে রাজা-রাম, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, বা মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সম্ভাবনার আভাসমাত্ৰ নাই!

প্রায় তিনশবছর পূর্বে এই ভাগীরথী-বিধৌত নবদ্বীপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক বিদ্রোহী যুগাবতার। তিনি গৌড়মণ্ডলকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন প্রেমের বন্যায়। যবন হরিদাসকে তিনি কোলে টেনে নিয়েছিলেন। আচণ্ডাল ভক্তকে এক মন্ত্রে আবদ্ধ করে শিখিয়েছিলেন ‘হরিনাম’- ছাড়া এ কলিযুগে মুক্তির আর কোনও পথ নেই। যুক্তি নয়। ভক্তি আর বিশ্বাস! বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর। কিন্তু মাত্র তিনশ বছরের ভিতরেই তাঁর প্রভাব লুপ্ত হতে বসেছে। সম্প্রদায় হিসাবে বৈষ্ণবেরা সমৃদ্ধিলাভ করেছে বটে শাক্ত গৌড়মণ্ডলে সে ধর্ম এতদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত—কিন্তু তা নিতান্ত আচারসর্বস্ব! মূল তাত্ত্বিক লক্ষ্য থেকে তারা সরে গেছে। তারা মাথা কামায়, তিলক সেবা করে, খঞ্জনী বাজিয়ে দোরে দোরে মাধুকরী করে ফেরে, আর কিশোরী-ভজনের তাল খোঁজে! চৈতন্যদেবের ঋজু ধর্মবিশ্বাস থেকে তা অনেক দূরে সরে গেছে। কূপমণ্ডুক ব্রাহ্মণ্যসমাজপতিদের চণ্ডীমণ্ডপের বিধানে যাদের জাত গেছে তারাই ক্রমে দলে দলে হয়েছে নেড়া-নেড়ি—বোষ্টম-বোষ্টমী। ঠিক যেভাবে প্রাক-শঙ্করাচার্য যুগে সমুদ্রযাত্রা করার অপরাধে জাত খুইয়ে দিশেহারা শত শত দক্ষ নাবিক ঝুঁকেছিল বৌদ্ধধর্মের দিকে, নাথ সম্প্রদায়ের দিকে।

মুষ্টিমেয় কিছু সাত্ত্বিক বৈষ্ণব—প্রভু নিত্যানন্দের প্রভাবে—নবদ্বীপ, শান্তিপুর, খড়দহ, ত্রিবেণী, তেঘড়া আর ভাটপাড়ায় হয়তো সেই প্রেমের ঠাকুরের পবিত্র দীপশিখাটি আজও জ্বালিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তাঁদের প্রভাব আখড়ার চতুঃসীমায়। বৃহত্তর বঙ্গসমাজে তার প্রভাব নেই।

এই কূপমণ্ডুক সমাজে কাশীধাম থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন রূপেন্দ্রনাথ। তাঁর প্রথম প্রতিজ্ঞা—যা পরবর্তী শতাব্দীতে পুনরুজ্জীবিত হবে বিদ্যাসাগর এবং মদনমোহনের মাধ্যমে—সেই স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার। আত্মজাকে তিনি নিয়ে যাবেন মাহেশের এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাতাবরণ থেকে! নিয়ে যাবেন তাঁর সোঞাই গাঁয়ে। যেখানে আছেন তাঁর পিসিমা, আছে ছোট বোন কাত্যায়নী, তার স্বামী গঙ্গারাম আর আধুনিকমনা বৃদ্ধ জমিদার : ভাদুড়ীমশাই।

রূপমঞ্জরীর বয়স এখন কত? হিসাবমতো দু-আড়াই বছর। এতটুকু শিশুকে মানুষ করার অভিজ্ঞতা বা পারদর্শিতা তাঁর নাই। কিন্তু কাতু আছে। পিসিমা আছেন। তারা দেখভাল করবে! যতদিন না সেই ছোট্ট মেয়েটির হাতেখড়ির বয়স হয়। কথা ছিল, হাতেখড়ি দেবে ওর মা। সে কথা আর রক্ষা করা গেল না।

না! ঐ অর্বাচীন কুসংস্কারটা উনি আদৌ স্বীকার করেন না : অক্ষর-পরিচয় হলে, শিক্ষিতা হলে একটি কুমারী মেয়ে অকাল-বৈধব্যের দিকে পদক্ষেপ করে। যাজ্ঞবল্কজায়া মৈত্রেয়ীর স্বামী অতি দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। গার্গী এক দুর্লভ প্রতিভা। বাল্মীকির শিষ্যা আত্রেয়ী ছিলেন মহাপণ্ডিতা; বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণী শ্রীকৃষ্ণকে কী করে স্বহস্তে গোপনপত্র লিখে পাঠান, যদি তিনি নিরক্ষরা হয়ে থাকেন? রূপেন্দ্রনাথের মতে ঋগ্বেদের সূত্রকারদের ভিতর অন্যূন সাতাশজন মহিলার নাম পাওয়া যায়। গার্গীপ্রণীত ঋগ্বেদের টীকা আজও প্রামাণ্য। ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অন্তর্গত অন্যূন আঠাশটি সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা হচ্ছেন একজন অত্রি-বংশীয়া মহাপণ্ডিতা : বিশ্ববারা! কাশীধামের পৌরাণিক মহারাজা অলকের জননী মদালসা এক আশ্চর্য পণ্ডিতা। রাজপুত্র অলর্ককে ব্রহ্মবিদ্যালাভের জন্য কোনও গুরুর আশ্রমে যেতে হয়নি। রাজান্তঃপুরে তিনি ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করেছিলেন রাজমহিষী মদালসার কাছে।

তাহলে?

সোঞাই-গ্রামের ব্রাহ্মণ্যসমাজ যদি ওঁর আত্মজাকে কোন চতুষ্পাঠীতে ভর্তি করতে অনুমতি ‘না দেয়? তাহলে তিনি নিজেই একটি চতুষ্পাঠী খুলে বসবেন। প্রয়োজনে তাতে একটি মাত্র ছাত্রীই থাকবে : রূপমঞ্জরী!

হয়তো এই অপরাধে সমাজ ওঁকে জাতিচ্যুত করবে! করে করুক। উনি ভ্রূক্ষেপ করবেন না। রোগযন্ত্রণায় যখন কূপমণ্ডুক সমাজপতিরা কাতর হবে তখন তাদেরই এসে জাতিচ্যুত রূপেন্দ্রনাথের কাছ থেকে আয়ুর্বেদিক ঔষধ নিয়ে যেতে হয় কি না তিনি দেখতে চান। কন্যার বিবাহ না হয় নাই দিলেন! নিমন্ত্রণ কাউকে করবেন না, ফলে নিমন্ত্রণ রাখতে যাবার বিড়ম্বনাও নাই। ক্ষারে কাপড় কাচলে রজক নিষ্প্রয়োজন। চুল-দাড়ি-গোঁফ না কামালে নাপিতেরই বা প্রয়োজন হবে কেন?

একঘরে বা জাতিচ্যুত হবেন ধরে নিয়েই তিনি চলেছেন নদীর ঘাট থেকে শ্বশুরালয়ে। আত্মজাকে স্বগ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।

ফরাসীডাঙ্গার ঘাটে পুটুলি-বগলে যখন নৌকা থেকে অবতরণ করেছিলেন, তখনও আকাশে তারা ছিল। চেনা পথ, আলিবর্দীর শাসনে চোর-ডাকাত ঠেঙাড়ের দল অন্য জাতির জীবিকা বেছে নিয়েছে। রূপেন্দ্রনাথ নির্ভয়ে আমকাঁঠালের ছায়াঘেরা বনপথ দিয়ে শেষরাতে যখন মাহেশে এসে পৌঁছলেন ততক্ষণে পুব আকাশটা সিঁদূর-বরণ হতে শুরু করেছে। ফরাসীডাঙ্গার বাজারে কিছু পথচারী সারমেয়-শীৎকারে আর বনপথে একটানা ঝিঁঝিপোকার ডাক ছাড়া জীবনের সাড়া পাননি। মাহেশের কাছাকাছি এসে দেখলেন, মানুষজন শয্যাত্যাগ করেছে। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আগন্তুকের দিকে। পথে-ঘাটে অপরিচিত বহিরাগতকে দেখতে সেযুগের মানুষ আদৌ অভ্যস্ত ছিল না। অধিকাংশ মানুষই গ্রামের চেনা- চৌহদ্দীতে পাক খেত, কলুর চোখবাঁধা বলদের মতো। রূপেন্দ্রনাথ ভ্রূক্ষেপ করলেন না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন মাহেশের সেই সবচেয়ে বড় চকমেলানো প্রসাদের দিকে। নায়েব ভবতারণ গাঙ্গুলী মাহেশের সব চেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি। স্বয়ং ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর দক্ষিণ হস্ত ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরে ফরাসী গভর্নর ডুপ্লেক্সের দেওয়ান। অর্থকৌলিন্যে ইন্দ্রনারায়ণকে বলা যায় নাটোরের রানী ভবানী বা কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সমকক্ষ। সুতরাং সেই ইন্দ্রনারায়ণের দক্ষিণহস্ত ভবতারণও মাহেশে হাতে মাথাকাটার কৃতিত্বের অধিকারী।

নগ্ন পদে, নগ্ন গাত্রে, শতচ্ছিন্ন উত্তরীয়-সর্বস্ব রূপেন্দ্রনাথ এসে থামলেন দেড়মানুষ উঁচু পাঁচিল-দেওয়া দেউড়ির প্রবেশদ্বারে। ঢালাই-লোহার শিক দেওয়া গেট। খুলে দিলে চার ঘোড়ার চৌঘুড়ি অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। গাদাবন্দুকধারী দ্বাররক্ষক এগিয়ে এসে জানতে চাইল: ক্যা চাহিয়ে বাবুজি?

‘বাবু-কালচার’ ডিহি-কলকাতায় সদ্য জন্মেছে। দ্বারোয়ান কলকাত্তাইয়া লবজ্‌টা আয়ত্ত করেছে: ‘বাবুজী’।

রূপেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন, গঙ্গোপাধ্যায়-মশাই কি উঠেছেন?

—বড়াসা’ব? জী নেহি। ঔর একঘণ্টা পিছে আনা…

দারোয়ান সাহেব-সুবোদের নিয়ে কারবার করে, ‘ঘণ্টা’ ‘মিনিট’ চেনে। সাহেব-বিবি- গোলামের ফারাক বুঝতে পারে। রূপেন্দ্র লোহার গেটের এপারে দাঁড়িয়ে কী করবেন স্থির করে উঠতে পারছিলেন না। সহসা একটি চকিত এবং সুললিত বামাকণ্ঠে চমকিত হয়ে ওঠেন:

—বাঁড়ুজ্জেমশাই না?

শব্দ লক্ষ্য করে তাকিয়ে দেখলেন। দু-বছরে পঞ্চদশী হয়েছে সপ্তদশী—কিন্তু তুলসীকে চিনতে অসুবিধা হল না ওঁর। বললেন, ভাল আছ, তুলসী?

ভবতারণের অনূঢ়া কন্যা। মঞ্জরীর পিসতুতো ছোট বোন। ওঁর শ্যালিকা। ভোরবেলা পাঁচিল-ঘেরা বাগানে পূজার ফুল তুলতে এসেছে। সদ্য স্নান করেছে। মাথায় ভিজে চুল। সেকালে মেয়েরা বাড়িতে বক্ষবন্ধনী বা জ্যাকেট ব্যবহার করত না। তুলসী তার আঁচলটাই সাবধানে মাজায় জড়িয়ে নিয়েছিল। তবু তার হৃদয়ের যুগ্ম-উচ্ছ্বাসের আভাস লুকানো সম্ভবপর হয়নি।

তুলসীর আদেশে দ্বারপালকে গেট খুলে দিতে হল।

ওঁরা দুজনে পায়ে-পায়ে প্রকাণ্ড উদ্যান অতিক্রম করে লাল সুরকি বিছানো পথে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। তুলসী বলে, একটু দাঁড়ান, জামাইবাবু, পেন্নামটা সেরে নিই।

—তুমি সদ্য স্নান করেছ, আর আমি সাত রাজ্যের ময়লা পথ অতিক্রম করে আসছি, এখন আমার পদস্পর্শ নাই করলে, তুলসী।

তুলসী শুনল না। পথের মাঝেই ওঁকে থামিয়ে পদস্পর্শ করে প্রণাম করল। বলল, কোথায় ছিলেন এতদিন? একবস্ত্রে বেরিয়ে গেলেন, কেমন করে দু-দুটো বছর কাটালেন?

হাসলেন রূপেন্দ্রনাথ। বললেন, সে অতি দীর্ঘ কাহিনী। ইতিমধ্যে নীলাচলের শ্রীক্ষেত্র আর কাশীধাম ঘুরে এলাম।

—পুরী-কাশী দুটোই? সে তো অনেক অনেক দূরের পথ। নয়?

—সেজন্যই তো এত দেরি হল।

—চুল-দাড়ি কাটেন না কেন? বাউণ্ডুলের মতো!

রূপেন্দ্র সে-কথার জবাব এড়িয়ে বললেন, তোমার বাবা-মশাই আর মা ভাল আছেন? বাড়ির আর সবাই?

তুলসী জবাব দেবার আগেই ও পাশের খিড়কির দরজা খুলে বার হয়ে এলেন এক প্রৌঢ়া। তুলসীর মা।

তুলসী বললে, ঐ তো মা!…মা, দেখ, কাকে ধরে এনেছি।

ভবতারণজায়া মাতঙ্গী যেন ভূত দেখলেন! মাথার উপর ঘোমটা তুলে দিয়ে বললেন, তুই ভিতরে যা, মেজ। আমি দেখছি।

রূপেন্দ্রনাথ এগিয়ে এসে প্রণাম করলেন। স্পর্শ বাঁচাতে মহিলা দুপা পিছিয়ে গেলেন। বললেন, এতদিনে মনে পড়ল আমাদের কথা?

রূপেন্দ্র অপরাধীর মতো, সলজ্জে নীরব রইলেন।

—কী কঠিন প্রাণ গো জামাই, তোমার! মেয়েটার ছেরাদ্দ পয্যন্ত তর্ সইল না? এক কাপড়ে কাউকে কিছু না বলে ঘর ছাড়লে?

রূপেন্দ্র নতনেত্রে বললেন, দেখতেই তো পাচ্ছেন মা, আমি আজও অশৌচ পালন করে চলেছি। চুল-দাড়ি কাটি না, মাথায় তেল দিই না। একাদশীতে উপবাস করি…

প্রৌঢ়া বিস্মিতা হলেন। বললেন, কেন? কেন? একাদশীতে উপবাস কর কেন?

—আমি মনে করি: দাম্পত্যজীবনে স্বামী-স্ত্রীর সমান অধিকার, সমান দায়িত্ব। স্বামীর প্রয়াণে স্ত্রী যদি একাদশীতে উপবাসী থাকে, তাহলে স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামীকেও একই ভাবে একাদশী পালন করতে হবে।

প্রৌঢ়ার বাক্যস্ফুর্তি হল না। সম্বিত ফিরে এল পাশ থেকে বর্ষীয়সী পরিচারিকা কানাইয়ের-মায়ের কণ্ঠস্বরে, মা! কর্তামশাই বললেন, ঐ ওঁনারে বৈঠকখানায় বসতে বলতি। আর আপনারে এট্টু ভিতরবাগে আসতি বলেন।

প্রৌঢ়া কিছু বলার আগেই কানাইয়ের মা রূপেন্দ্রকে বললে, আয়েন, জামাইবাবু, আমার লগে লগে…

পথ দেখিয়ে সে নিয়ে এসে ওঁকে বসালো ভবতারণের শ্যান্ডেলেয়ার-শোভিত প্ৰকাণ্ড বৈঠকখানা ঘরে। ঘরের একদিকে একটা বিশাল পালঙ্ক। তাতে ধপধপে ফরাস ও চাদর পাতা। তাকিয়া ছড়ানো। আশপাশে কিছু কেদারা। মর্মর পিজে মার্বেলের ভেনাস, ব্যাক্কাস, সাটার, ফন। ফরাসী অনুকরণে গ্রীক ভাস্কর্য।

কানাইয়ের মায়ের নির্দেশমতো একটি কেদারায় গিয়ে বসলেন। ঘরের ও-প্রান্তে আর একজন খিদমদগার ঝাড়ন দিয়ে আসবাবের ধুলো ঝাড়ছিল। সে আড়চোখে বার-দুই দেখল ওঁকে। কানাইয়ের মায়ের কাণ্ডজ্ঞান আছে। লোকটাকে বললে, ঝাড়-পোঁচ থাক এখন, ধুলো ওড়াস না। তুই বরং টানাপাখাটা একটু টান দিনি, কালিপদ…

কালিপদ প্রতিবাদ করে, এত সাত-সকালে? এখন তো ঠাণ্ডা!

রূপেন্দ্র বলে ওঠেন, না, না। টানা-পাখা টানতে হবে না।

কালিপদ আর কানাইয়ের মা ভিতর বাড়িতে চলে গেল।

একটি বিলাতী ঘড়ি ঢং ঢং করে ছয়বার শব্দে জানান দিল সময় বয়ে চলেছে। বাহিরের বাগানে অগুনতি পাখির প্রভাতী কলকাকলি। চুপচাপ বসে রইলেন রূপেন্দ্র। প্রায় এক দণ্ড পরে ভিতরবাড়ি থেকে আবির্ভূত হলেন গৃহস্বামী। দু-বছরে একটু স্থূলকায় হয়েছেন। সদ্য স্নান করে এসেছেন। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি রেশমের উত্তরীয়, নিম্নাঙ্গে ফরাসডাঙ্গায় বোনা ধুতি। পায়ে চন্দনকাঠের খড়ম। তিনি ধীর পদক্ষেপ এগিয়ে এসে বসলেন পালঙ্কে। তাকিয়াটা টেনে নিলেন। হুঁকোবরদার আসছিল পিছন-পিছন। আলবোলাটা নামিয়ে রৌপ্যনির্মিত ফরসির নলটা এগিয়ে দিল কর্তামশায়ের দিকে।

রূপেন্দ্র উঠে এসে প্রণাম করলেন পিসশ্বশুরকে। সাবধানে, স্পর্শ বাঁচিয়ে। ভবতারণ বললেন, কোথা থেকে আসা হচ্ছে বাবাজীবনের?

—আজ্ঞে আপাতত কাশীধাম থেকে। নৌকায় প্রায় তিমনাস লাগল।

—অ। তা চুলদাড়ি কামানো হয় না কেন? অশৌচ? নাকি সময় হয় না? অথবা সংসারে বীতরাগ?

রূপেন্দ্র এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, গৌড়মণ্ডলে আজই এসে পৌঁচেছি। এদিককার সংবাদ কুশল?

—না, বাবাজী। রাজনৈতিক সংবাদ আদৌ শুভ নয়। গৌড়দেশ একটি উদ্‌গীরণ-উন্মুখ আগ্নেয়গিরির উপর বসে আছে। কিন্তু সেসব প্রসঙ্গ থাক। তোমার বেশবাস দেখে মনে হচ্ছে না যে, দেশের হালচাল নিয়ে তোমার কোনও কৌতূহল আছে। তুমি বরং প্রথমে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে নাও। মনে হচ্ছে বাসিমুখে জলও দাওনি। সকালে প্রাতরাশের পূর্বে আহ্নিক-টাহ্নিক করা হয়?

রূপেন্দ্র জবাব দেবার সুযোগ পেলেন না। তার পূর্বেই ভবতারণ হাঁকাড় পাড়লেন, ওরে, কে আছিস?

থামের আড়াল থেকে তৎক্ষণাৎ রঙ্গমঞ্চে যুক্তকরে আবির্ভূত হল একজন খিদ্‌মদ্‌গার। কর্তা তাকে বললেন, জামাই-বাবাজিকে অতিথিশালার গোছলখানায় নিয়ে যা। খাজাঞ্চিবাবুকে বলে এক জোড়া ধুতি আর …

কথার মাঝখানেই ভৃত্যটি বলে উঠল, যে আজ্ঞে!

রূপেন্দ্র উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রশ্ন করেন, আপনি দফতরে যাবেন কখন?

—কেন বল তো? সে খোঁজে তোমার কী প্রয়োজন?

—মানে যে-কারণে আমি এসেছি, যে-কথা বলতে এসেছি…আপনি দফতরে বেরিয়ে যাবার আগেই সেই আর্জিটা পেশ করতে চাই।

—বেশ তো! একেবারে বাসিমুখে সে-কথা নাই বা বললে! বিনা এত্তেলায় তুমি এ বাড়ি ছেড়ে যেতেও পার, আবার বিনা সংবাদে ফিরে আসতেও পার– কিন্তু তাই বলে আমরা তো ভুলতে পারি না তুমি আমাদের জামাই। যাও ওর সঙ্গে।

স্নানান্তে রূপেন্দ্র তার পুঁটুলির ভিতর থেকে একটি কাচা-ধুতি বার করে পরিধান করলেন। মার্বেল-পাথরে-মোড়া গোছলখানার আলনায় গিলে-করা ‘পৌন-ধনু*-বহরের শান্তিপুরে ধুতিখানি অস্পর্শিত পড়ে রইল। স্নানান্তে অতিথিশালার একটি কামদার কক্ষে ওঁকে নিয়ে গিয়ে বসালো সেই খিদমদগারটি। জমিদার-মশায়ের দেওয়া ধুতি পরিধান করবার জন্য সে কোনও আর্জি নিজে থেকে দাখিল করল না।

[*একধনু = ষাট ইঞ্চি; ফলে পৌনধনু = 45” = 1.14 মিটার।]

অতিথিশালায় পাশাপাশি তিন-চারখানি কক্ষ। বিভিন্ন মহাল থেকে জমিদারির কাজে যাঁরা আসেন, দু-চারদিন যাঁদের থাকতে হয়, তাঁদের ব্যবহারের জন্যই এই অতিথিশালা। রূপেন্দ্র ইতিপূর্বে এখানে কোনদিন আসেননি। তিনি বুঝলেন, কুসুমমঞ্জরীকে হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে অন্দরমহলে জামাই আদর পাওয়ার সৌভাগ্য থেকেও তিনি বঞ্চিত হয়েছেন।

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কর্তামশাই কয়টার সময় অশ্বারোহণে ফরাসীডাঙায় যাবেন; কিন্তু প্রশ্নটা করা হল না। ঠিক সেই মুহূর্তেই পর্দাটা দুলে উঠল। বৃদ্ধা কানাইয়ের- মা একটি অল্পবয়সী পরিচারিকাকে নিয়ে ঢুকল ঘরে। অতিথিশালার কক্ষে মেজ ও কেদারা দুইই ছিল; কিন্তু কানাইয়ের-মা অন্য রকম ব্যবস্থা করল। মার্বেল মেঝের একাংশ মুছে নিয়ে পেতে দিল পশমের আসন। সঙ্গিনী এবার নামিয়ে রাখল পাথরের থালায় প্রাতরাশ: গৃহদেবতা ‘শ্যামসুন্দরের’ বালভোগের প্রসাদ। তিন-চার রকম কাটা ফল, মুগ ভিজে, লোচিকা, মিছরির সরবৎ, পায়েস।

রূপেন্দ্রনাথ বিনাবাক্যব্যয়ে প্রসাদ গ্রহণ করলেন। পাখা হাতে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকল কানাইয়ের-মা।

আচমন করে মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন, কর্তামশাই কি এখনো বৈঠকখানাতেই আছেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার অপেক্ষায়। আসেন আপনি—

কানাইয়ের মা উচ্ছিষ্ট পাথরের থালাখানা উঠিয়ে নিয়ে অন্দরের দিকে বিদায় হল। সেই খিদ্‌মদ্‌গারটি পথ দেখিয়ে ওঁকে আবার নিয়ে এল বড়কর্তার দরবারকক্ষে। ইতিমধ্যে সেখানে সাত-আটজন উমেদার বা প্রার্থী এসে জুটেছে। তারা বসে আছে কার্পেটের উপর উবু হয়ে রূপেন্দ্রকে নিয়ে ভৃত্যটি সে-কক্ষে প্রবেশ করতেই কর্তামশাই ওদের বললেন, আজ এই পর্যন্তই। তোরা যা। আমার জরুরি কাজ আছে ঐ কোবরেজমশায়ের সঙ্গে। তোরা কাল আসিস্।

রূপেন্দ্র বসলেন ওঁর মুখোমুখি। ঘর নির্জন হল।

ভাবতারণ প্রশ্ন করলেন, স্নানাদি হয়েছে? প্রসাদ পেয়েছ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। এখন আপনি অনুমতি করলে আমার আর্জিটা পেশ করতে পারি।

—তাড়া কী, বাবাজীবন? দু-চারদিন বিশ্রাম করে যাও না আমার এই গরিবখানায়। অতিথিশালা তো খালিই পড়ে আছে…

বোধকরি আর সহ্য হল না রূপেন্দ্রর। তাঁর নাসারন্ধ্র কিঞ্চিৎ স্ফুরিত হয়ে উঠল এই দাম্ভিক ভূম্যধিকারীর বাচালতায়। বললেন, গাঙ্গুলীমশাই! আপনি প্রথমে স্থির করুন, আপনার- আমার মধ্যে সম্পর্কটা কী? কোবরেজমশায়ের সঙ্গে জরুরি কথা বলার অজুহাতে আপনি সমবেত প্রার্থীদের বিদায় করলেন। এখন আমাকে সম্বোধন করছেন ‘বাবাজীবন’ বলে। দুনিয়াদারীতে আপনি অভিজ্ঞ প্রথমে মনস্থির করুন। ‘বাবজীবন’ হলে আমার স্থান অতিথিশালায় হয় না। হয় অন্দরমহলে, মায়ের কাছে। সেখানে কানাইয়ের-মা নয়, তুলসী আমার প্রাতরাশ নিয়ে আসবে। আর কোবরেজমশাই বলে মেনে নিলে আমার কিছু সম্মানদক্ষিণাও প্রাপ্য। অথচ না ডাকতেই আমি এসেছি—নিশ্চয় চিকিৎসক হিসাবে নয়। ফলে, প্রথমেই স্থির হয়ে যাক আপনার-আমার সম্পর্কটা কী?

—তুমি এককালে আমার কন্যাপ্রতিম কুসুমঞ্জরীর স্বামী ছিলে। যে স্ত্রীর সৎকারের ব্যবস্থা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ধৈর্য না ধরে তুমি পালিয়ে গেছিলে। এই তো আমাদের সম্পর্ক!

—এগুলো তো কতকগুলো বাস্তব তথ্যের উপর আপনার ব্যাখ্যা, আপনার টিকা-টিপ্পনি! আমার বিচারে যেমন : আপনি ছিলেন আমার পিসাশ্বশুর—যে ব্যক্তিটি কুসংস্কারের কৈঙ্কর্যে প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষভাবে শিক্ষিত গোকুলানন্দ আচার্যর শ্রেষ্ঠ ছাত্রটিকে সূতিকাগারে প্রবেশ করতে না দিয়ে আদরি। কন্যাপ্রতিম প্রসূতিকে বস্তুত হত্যা করেছেন! যার ফলে আপনার জামাতা তীব্র ঘৃণায় একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করেছিল। এটাও আমাদের সম্পর্ক!

ভবতারণ ফরাসের নলটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, তখন তুমি বলেছিলে–কী একটা বিশেষ কথা আমাকে বলতে এসেছ। সেটা কী?

—আমি আমার কন্যাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

–কন্যা! তোমার কন্যা! সে জীবিতা আছে এ-কথা কেমন করে জানলে?

—এ-প্রশ্ন অবান্তর। আপনি অস্বীকার করতে পারেন: কুসুমমঞ্জরী একটি জীবিতা কন্যাসন্তানকে প্রসব করেনি? সেই দু-আড়াই বছরের মেয়েটি আপনার ভদ্রাসনে নেই।

—না নেই!

এ কথা বলেই গাত্রোত্থান করলেন ভবতারণ, বললেন, তোমার অভিরুচি হয় দু-চার- দশ দিন আমার এই ভদ্রাসনে অতিথিশালায় বাস করতে পার। তাতে স্বীকৃত না হলে এখনই স্থানত্যাগ করতে পার।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো গাত্রোত্থান করলেন রূপেন্দ্রনাথ। বললেন, নেই? রূপমঞ্জরী বেঁচে নেই?

—রূপমঞ্জরী! সে কে?

—রূপেন্দ্রনাথ আর কুসুমমঞ্জরী কন্যা।

—ও! না, না, সে আছে। আমার বাড়িতে এখন নেই। এই যা।

—কেন? আপনার এতবড় বাড়িতে ঐ একফোঁটা মেয়েটার স্থানাভাব ঘটল কেন?

–তার পূর্বে বল, সে এ বাড়িতে থাকলে তুমি কী করতে?

—তাকে নিয়ে যেতাম। সোঞাই গাঁয়ে। আমার পিতৃপুরুষের ভিটেতে। তাকে মৈত্রেয়ী- গার্গী-মদালসার উত্তরসাধিকা করে তুলব আমি। তার মূলমন্ত্র হবে শাক্যসিংহের সেই অন্তিম অনুশাসন: আত্মদীপো ভব, আত্মশরণো ভব, অনন্যশরণো ভব!

ভবতারণ বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন বক্তার মুখমণ্ডলে কী একটা দীপ্তি ফুটে উঠেছে। বোধকরি উত্তেজনায়। বললেন, বুঝলাম না, বাবাজী—

—আপনার পক্ষে এ-কথার মর্ম উপলব্ধি করা কঠিন। তার প্রয়োজন নেই। আপনি বরং বলুন–সে কোথায়? রূপমঞ্জরী?

—তোমার আগমনমাত্র আমি তাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছি।

—সে কী! কেন?

—যাতে পিতৃস্মৃতি বলে তার মস্তিষ্কে কোন ছাপ না পড়ে। তাকে আমি অন্যভাবে মানুষ করতে চাই।

—অন্যভাবে! কী ভাবে?

—আর পাঁচটা মেয়ে যেভাবে মানুষ হয়। তোমার খপ্পরে পড়লে তা হবে না। সে ‘একবগ্গা’ হয়ে উঠবে!

বহুক্ষণ নীরব রইলেন রূপেন্দ্রনাথ। তারপর বললেন, গাঙ্গুলীমশাই! আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, বিচক্ষণ। আপনার তিন তিনটি কন্যা। আপনি তাদের নিজ অভিরুচি অনুযায়ী মানুষ করুন—আমি তো বাধা দিতে আসছি না; কিন্তু আমার সন্তানকে …

মাঝপথেই উনি বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, তুমি সন্তানপালনের কী জান? কী তোমার অভিজ্ঞতা যে, ঐ এক ফোঁটা মেয়েটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছ?

—হ্যাঁ, পিসেমশাই, এ-কথা আপনি বলতে পারেন। শিশুপালনের কোন অভিজ্ঞতা আমার নাই। কিন্তু পৈত্রিক ভিটাতে আমার পিসিমাতা আছেন, আমার পিস্তুতো বোনও আছে। তারা…

একটা হাত সামনে বাড়িয়ে ভবতারণ রূপেন্দ্রনাথকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন। বিচিত্র হেসে বললেন, এতেই বোঝা যাচ্ছে তুমি কতটা সংসার-অভিজ্ঞ! শোন বাবাজী! তোমার পূজ্যপাদ পিসিমাতা ঠাকুরানী আজ একবছর হতে চলল স্বর্গলাভ করেছেন। তুমি সে খবরটুকুও রাখ না। তার উপর তোমার ভগিনী আর ভগিনীপতিও বর্তমানে সোঞাই গাঁয়ে থাকে না। বর্ধমানের পত্তনিদার নগেন দত্ত গঙ্গারামকে বর্ধমানের মানকরে ত্রিশবিঘে জমি লাখেরাজ বন্দোবস্ত দিয়েছে, একটি পাকা মোকামও বানিয়ে দিয়েছে। তার মাতৃশ্রাদ্ধের দান। তোমাকেই দেবার জন্য লোক পাঠিয়েছিল। তোমাকে না পেয়ে তোমার ভগিনীপতিকেই মাতৃশ্রাদ্ধে নিয়ে এসে দিয়েছে। কুসুম মরে বেঁচেছে। তার শ্বশুরের ভিটেতে আজ সন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ জ্বালে না, শাঁখে ফুঁ পাড়ে না। যাও, বাবাজীবন, গাঁয়ে ফিরে গিয়ে দেখ জানলা-দরজাগুলো স্বস্থানে আছে কি না। গত বর্ষায় কখান ঘর মুখ থুবড়ে পড়েছে তার হিসেব করগে।

রূপেন্দ্রনাথ কোন প্রত্যুত্তর করতে পারলেন না।

এবার সোজা হয়ে বসলেন ভবতারণ। বললেন, শোন, রূপেন্দ্রনাথ! একটি শর্তে আমি স্বীকৃত হতে পারি। তোমার শিশুকন্যাকে তোমার হাতেই সমর্পণ করতে পারি। তুমি শর্তটা রাখবে?

ওঁর চোখে চোখ রেখে রূপেন্দ্র বললেন, কী শর্ত?

—না, ধনুকভাঙা কোন পণ নয়। স্ত্রীবিয়োগে সাধারণ সুস্থমস্তিষ্কের মানুষে যা করে থাকে। স্ত্রী বর্তমানেও করে। তোমার ভগিনীপতি শ্রীমান গঙ্গারাম যা দেড় দুশ বার করতে পেরেছিল…

—পুনর্বিবাহ?

—হ্যাঁ! পাত্রীর সন্ধানে তোমাকে ভূ-ভারত দাবড়ে বেড়াতে হবে না। তার যোগান দেব আমিই। তোমার মেয়েকে যে মেয়েটি নিজের মেয়ের মতো এই আড়াই বছর ধরে মানুষ করছে, সেই তুলসীর কথাই বলছি আমি। আমরাও নৈকষ্য কুলীন, তোমাদের পাটি ঘর। তুলসীকে তুমি ঘনিষ্ঠভাবে চেন, দেখেছ। কুসুমমঞ্জরীর মৃত্যুর পর আমি একটি দুগ্ধবতী ধাত্রীর ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিলাম; কিন্তু তোমার কন্যা আজও তুলসীকে ‘মা’ বলেই জানে!

দীর্ঘক্ষণ রূপেন্দ্রনাথ নতনেত্রে চিন্তামগ্ন রইলেন। তারপর বললেন, আমাকে মার্জনা করবেন, পিসেমশাই। বিবাহ করব না এই রকমই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কৈশোরকালে। সে প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারিনি নিতান্ত নিরুপায় হয়ে। আমি কুসুমমঞ্জরীকে বিবাহ না করলে তার সঙ্গে এক বৃদ্ধের…

—জানি বাবাজী, আমি পূর্ব-ইতিহাস সবই জানি। শোন। একবার উপরোধে পড়ে যখন ঢেঁকি গিলতে পেরেছ, তখন দ্বিতীয়বারই বা পারবে না কেন? এবারও তো তুমি নিতান্ত নিরুপায়। লাঠিয়াল নিয়ে এসে তোমার মেয়েকে আমার দেউড়ি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না, এ-কথা তুমিও জান, আমিও জানি। তাহলে দ্বিতীয়বার টোপর-মাথায় এসে এই শ্বশুরবাড়ি থেকেই সস্ত্রীক কন্যাটিকে স্বগ্রামে নিয়ে যেতে অস্বীকৃত হচ্ছ কেন বাবাজী?

রূপেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে শিরশ্চালন করে তাঁর অসম্মতিটাই পুনরায় জ্ঞাপন করলেন।

ভবতারণ রূঢ়স্বরে কী-একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার পূর্বেই বৃদ্ধা কানাইয়ের মা অতর্কিতে আবির্ভূত হল অন্তঃপুর থেকে। বললে, বড়-মা বললেন অঁরে ভিতর বাড়িতে নে যেতে।

ভবতারণ গর্জে উঠতে গিয়ে সামলে নিলেন। বুঝলেন, বাকি কাজটা তুলসীর মায়েরই বটে। পাইক-বরকন্দাজ-লাঠিয়াল দিয়ে আর যেকোন কাজই উদ্ধার করা যাক না যাক, কন্যাদায় থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় না। বললেন, ঠিক আছে। যাও!

কানাইয়ের মায়ের পিছন-পিছন অনেকটা পথ যেতে হবে। সদর আর অন্দর এই দুই মহলের মাঝখানে যে বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ তাতে হা-ডু-ডু খেলা যায়। রূপেন্দ্রের মনে পড়ে গেল প্রথমবার ঐ অন্দরমহলে পদার্পণের কথা। সেবার নতুন জামাইয়ের অবস্থা হয়েছিল সপ্তরথীবেষ্টিত অভিমন্যুর মতো! না—উপমাটা ঠিক হল না। বরং বলা উচিত অভিমন্যুর বাপের মতো। প্রমীলারাজ্যে পদার্পণের পরে! নতুন জামাই দেখতে একঝাঁক প্রজাপতির মতো সুন্দরী ভিড় করে এসে জুটেছিল। ভবতারণের দুই বিবাহ, ফলে রূপেন্দ্রের দুই পিসশাশুড়ী! কোনটি আসল, কোনটি নকল তখনো চিনে ওঠার অবকাশ পাননি। তার উপর তাঁদের দুই জা, তিন ননদ, পুত্রবধূ—সর্বোপরি রূপেন্দ্রের তিন শ্যালিকা। বড়দি বিবাহিতা, শ্বশুরবাড়িতে, মেজদি : পঞ্চদশী : তুলসী, আর কনিষ্ঠা একাদশী: শেফালি। সে এক প্রজাপতির হাট! কে যে প্রণম্যা আর কার প্রণাম গ্রহণ করতে হবে বুঝে উঠতে পারেননি।

এবার কিন্তু তা হল না। কানাইয়ের-মা ওঁকে নিয়ে এল একটি কক্ষে যা বাহির- মহলেরও নয়, আবার অন্দর-মহলেরও নয়। বলা যায় তা: ঘরেও নহে, পারেও নহে!

প্রাক-ইংরাজ যুগে বাঙলার জমিদার বাড়ির স্থাপত্যে এই কক্ষটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোন গবেষক আলোচনা করেছেন বলে জানি না। সবচেয়ে বিস্ময়কর এই কক্ষটির নামকরণ : ‘অন্তরাল’।

পাঠক-পাঠিকা আমাকে মার্জনা করবেন। ঔপন্যাসিককে থামিয়ে এখানে স্থপতিবিদ কিছুটা বকবক করবে। আপনারা ক্ষমা-ঘেন্না করে মেনে নেবেন।

মন্দিরের একটি অঙ্গের নাম: ‘অন্তরাল’। মণ্ডপ থেকে গর্ভগৃহে প্রবেশের পথে ছোট্ট একটি স্থান। হিন্দু মন্দিরে মণ্ডপ বা জগমোহন থেকে সরাসরি গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করা যায় না। ঐ অন্তরালের ক্ষুদ্র পরিসরে থমকে দাঁড়াতে হয়। মনটাকে সংযত করতে হয়, তৎগত করতে নয়। তন্নিষ্ঠ করতে হয়। সূর্যের আলো থেকে প্রদীপালোকে অভ্যস্ত হতে, দৃষ্টিকে সূচীমুখ করতে, মস্তিষ্ক কিছুটা সময় চায়। তারপর তদগত চিত্তে গর্ভগৃহের মূলাধারে প্রবেশ করতে হয়।

‘প্রাক-ফেরঙ্গ’ যুগের স্থপতি ঐ ভাবটিই গ্রহণ করেছিলেন রাজ প্রাসাদ নির্মিতিতে। যদিও এখানে ‘অন্তরালের’ প্রয়োজন ও ব্যবহার ভিন্ন প্রকারের। রানী-মায়েদের অথবা বধূমাতাদের বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্ব নিয়ে বা তত্ত্বতালাশ নিতে কখনো কখনো এমন মানুষ আসেন—নায়েব, গোমস্তা, এমনকি দেওয়ানজী, অথবা দূর-সম্পর্কের খুড়ো, মামা, মামাতো- পিস্তুতো ভাই—যাঁদের সরাসরি অন্দরমহলে ঠাঁই দেওয়া যায় না। তাঁরা আশ্রয় নিতে বাহির-মহলের সদর-সংলগ্ন অতিথিশালায়। তা তো হল, কিন্তু ‘চোরে-কামারে’ সাক্ষাৎটা হয় কোথায়? বহিরাগত আগন্তুক যেমন অন্দর-মহলে আসতে পারেন না, ঠিক তেমনি রানী- মা অথবা বধূমাতাও যেতে পারেন না সদর-সংলগ্ন অতিথিশালায়।

স্থপতিবিদ এই সমস্যার চমৎকার একটি সমাধান করেছিলেন, দুই মহলের মাঝামাঝি ঐ একটি ‘অন্তরাল-কক্ষ’ নির্মাণ করে। কখনো কখনো সে-কক্ষের মাঝখানে এড়োএড়ি একটি চিক্ টাঙানোর ব্যবস্থাও থাকে। শরদিন্দুর ভাষায় যা-নাকি ‘লূতাতন্ত্ৰীসদৃশ্য-স্বচ্ছ’! প্রোষিতভর্তৃকা অথবা বিগতভর্তা রানীরা যাতে দেওয়ান অথবা উকিলবাবুর সঙ্গে বৈষয়িক আলোচনা করতে পারেন। তাই ঐ চিকের ‘অন্তরাল’। হয়তো তা থেকেই কক্ষটির নামকরণ।

যাক ও-সব স্থাপত্যের কচকচি। যে-কথা বলছিলাম। কানাইয়ের মা বিরাট প্রাঙ্গণ পার হয়ে রূপেন্দ্রকে অন্দরমহলে নিয়ে এল না। চোখের পলকে একটি পর্দা সরিয়ে ওঁকে ডাক দিল: আসেন!

এখন দিবাভাগের প্রথম-প্রহর, তবু কক্ষটি আলো-আঁধারী। জানলা নেই, একটিই দরজা। অনেক উচুঁতে পায়রাখোপ ফোকর, যেমন আছে সাসারামে শেরশাহ্ সূরের সমাধিতে সেই ফোকর দিয়ে স্থপতির কেরামতিতে আলো এসে কক্ষটিকে স্নিগ্ধ মায়াজালে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ঘরে একটি মেজ, দুটি মাত্র কামদার কেদারা। পিছনের দেওয়ালে একটি ফরাসীদেশীয় দেওয়াল ঘড়ি।

রূপেন্দ্র কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র কেদারা থেকে উঠে দাঁড়ালো তুলসী। তার পরিধানে এখন সিঁদূরবরন রেশমের শাড়ি। ব্রোকেডের কাজ করা জ্যাকেট। মাথায় এক-বিনুনী। দুই কানে ঢেঁড়ি-ঝুমকো। গলায় জড়োয়া শতনরী। দুই হাতে কাচের ও সোনার চুড়ি। কপালে কুমকুমের টিপ, নাকে নোলক।

রূপেন্দ্র সবিস্ময়ে তাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলেন। তারপর কানাইয়ের মাকে বললেন, তুমি যে তখন বললে বড়-মা আমাকে ডেকেছেন?

কানাইয়ের মাকে জবাব দিতে হল না। তার আগেই আগ বাড়িয়ে তুলসী বললে, ও মিছে কথা বলেছিল বাঁড়ুজ্জেমশাই। ওর দোষ নেই। আমিই ওকে মিছে কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। ফলে, আপনাদের শাস্ত্রে এজন্য যদি নরক দর্শনের বিধান থাকে তাহলে ও যাবে না, আমাকেই নরকে যেতে হবে। বসুন। অনেক কথা আছে।

তুলসী এবার এপাশ ফিরে কানাইয়ের-মাকে বললে, এবার তুমি নিজের কাজে যাও কানাইয়ের-মা। আমি দরজায় আগড় দেব।

কানাইয়ের-মা চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে যীশুখ্রিস্টের ভঙ্গিতে দুই হাত দুদিকে বাড়িয়ে চেপে ধরল দোরের দুই পাল্লা। অনুচ্চ অথচ দৃঢ়স্বরে শুধু বললে : না!

তুলসী সবিস্ময়ে বললে: ‘না’? কী না?

—ঐ দোরে আগড়-দ্যাওনের কথাডা! আমি হেথায় ডাইরে থাকব, কিংবা বসব গে ঐ দূরের রোয়াকে। তোমরা কতা-কও, আশ্ মিটিয়ে কতা কও আমি শুতে আসপনি; কিন্তুক ব্যস! ঐ পয্যন্তই! দোরে আগড় দেওয়া চলবেনি!

তুলসী লজ্জিত হয়, অপমানিতও বোধ করে। রুক্ষস্বরে বলে, তুমি কী বলছ কানাইয়ের মা? তুমি কি আমাকে বিশ্বাস…

কথাটা বৃদ্ধা শেষ করতে দিল না। মাঝপথেই বলে ওঠে। দেখ মেজদি, আমি না-বিইয়ে কানাইয়ের মা হইনি। তিন-কুড়ি বয়স হল আমার! তাই বলি, এটা বিশ্বেস-অবিশ্বেসের কতা নয়। এটাই হল নিয়ম। তোমার মা-মাসিরেও এই ঘরে পরপুরুষের সাথে কতা কইতে দেখিছি। তাতে দোষ নাই; কিন্তুক ব্যস। ঐ পর্যন্তই! দোরে আগড় দেওয়া চলবেনি। বাড়ির নিয়মডা তো মানবে? না কী?

রূপেন্দ্র বললেন, ও তো ঠিক কথাই বলছে, তুলসী। তোমার যদি বিশেষ কোন গোপন কথা বলার থাকে তাহলে পরিবারের হিতৈষিণী ঐ বৃদ্ধার সামনেই তা বলতে হবে।

কানাইয়ের মা বললে, অ্যা অ্যাই! বলেন কেনে জামাইবাবু! আমি কি বে-হক কতা কইছি কিছু?

জবাবের জন্য সে অপেক্ষা করল না। গটগট করে চলে গেল কিছুটা দূরে। শ্রুতিসীমার ওপারে, কিন্তু দৃষ্টিসীমার ভিতরেই, থাপন-জুড়ে বসে কানে একটা পাখির পালক গুঁজে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। নজর কিন্তু এদিক পানে।

রূপেন্দ্র তাগাদা দিলেন, এবার বল তুলসী, কেন ডেকেছ। সময় কম।

তুলসী সামলে নিল নিজেকে। বললে, সেটাই তো সমস্যা, জামাইবাবু। সময় বড় কম, জীবন বড় ছোট। তার মধ্যে ‘অন্তরালে’ আলাপচারী করার মতো দুর্লভ মুহূর্ত শুক্তির ভিতর মুক্তোর মতো দুষ্প্রাপ্য। বেশিক্ষণ তোমাকে আটকাবো না। আর সে অধিকারই কি ছাই আছে নাকি আমার? আমি…

রূপেন্দ্র কথার মাঝখানেই বলে ওঠেন, একটা কথা! তুমি কিন্তু আমাকে বরাবর ‘আপনি’ বলে কথা বলে এসেছ, তুলসী।

—আজ্ঞে না হুজুর। আপনার ভুল হল। সেটা দু বছর অতীতের কথা। তখন আমি ছিলাম পঞ্চদশী, এখন সপ্তদশী! তখন আমি ছিলাম শুধুই শ্যালিকা, এখন…

—এখন?

—স্বকর্ণেই তো শুনে এলাম বাবামশাইয়ের প্রস্তাব আর তোমার প্রত্যাখ্যান। আর তাছাড়া ইতিপূর্বে ‘অন্তরাল’-এ এমন নির্জন প্রেমালাপ তোমার-আমার তো কখনো হয়নি, সোনাদা!

—সোনাদা! মানে?

—গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তির পদস্পর্শ করার অধিকার আমি কোনদিনই পাব না জানি–তুমি সে অধিকার আমাকে দেবে না কিন্তু এই ‘অন্তরাল’ পর্যন্ত যে আসতে পেরেছি এটাই বা সারাজীবন ভুলব কেমন করে? তাই আমার এই কিছুক্ষণের প্রগলভতাটুকু স্বীকার করে নিও এ সম্বোধন মীনুদির অনুকরণে। কয়েকটা খণ্ডমুহূর্তের জন্য আমার রুপোদা হয়ে গেছে: সোনাদা!

—মীনুর কথা তোমার দিদি তোমাকে বলেছে দেখছি—

—শুধু মীনুর কথা? সে তো সব সময় তোমার কথাই বলত। তোমার প্রেমে পাগলিনী রাই সর্বক্ষণ শুধু বলত তোমার সব কথা, সব কথা! দিদি আমাকে রাধাদির গপ্পোও বলেছে।

—রাধাদি! কোন রাধাদি?

—বাঃ! এরই মধ্যে ভুলে গেলে? রাধাবোষ্টমী! ফরসীডাঙা যাবার পথে যে তোমার ঠোটে চুমু খেয়েছিল। তুমি বাধা দিয়ে নিজের মুখ সরিয়ে নিতে পারনি। মনে নেই?

—আমাকে এইসব কথা বলবার জন্যই কি তুমি আমাকে এখানে ডেকে এনেছ?

—না তো কী? তুমি কি ভেবেছিলে রাধাবোষ্টমীর মতো সংযম হারিয়ে তোমার মুখে চুমু খাবার জন্য?…না, না, মুখখানা অমন প্যাঁচার মতো কর না, সোনাদা। আমি রাধাবোষ্টমীর মতো বোকাও নই, হ্যাংলাও নই! আমি অতীতে তোমার শ্যালিকা ছিলাম, ভবিষ্যতেও তাই থাকব। সুতরাং ঠাট্টা-তামাশা করবার অধিকারটা তুমি কেড়ে নিতে পারবে না। আরও একটা অধিকার তুমি কেড়ে নিতে পারবে না আজ। সেটা কী জান? তোমার চুন্নিমুন্নি মেয়ের মুখে আমার ‘মা’-ডাক! তোমার স্ত্রী আমি কোনদিন হব না, কিন্তু তোমার মেয়ের মা আমি ইতিপূর্বেই হয়ে গেছি।

রূপেন্দ্র বাধা দিয়ে বললেন, শোন তুলসী! তোমাকে বুঝিয়ে বলা দরকার, কেন আমি সংসারী হতে পারছি না।

তুলসী তার কাঁকন-পরা হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে চেপে ধরল রূপেন্দ্রের মুখ। বলল, থাক সোনাদা! ঐ এক-কথা ভূমি জীবন কতবার আর বলবে? আমি ওদের মতো বোকা নই। নিজের মনকে আমি ঠিক মতো বুঝ দিতে পারব।

—কাদের কথা বলছ তুমি? কাদের মতো বোকা নও?

—তোমাকে নিয়ে আর পারি না, সোনাদা! সমোস্কৃত-শাস্ত্রের অত কচকচি তোমার মাথায় ঢোকে আর এই সহজ সরল কথাটা বুঝতে পারছ না? শোন! তুমি কি জান যে, তুমি দেখতে খুব সুন্দর? দারুণ, দা-রুণ সুন্দর? মেয়ে-মন আপনিই মোহিত হয়ে যায় তোমার সেই পৌরুষময় ব্যক্তিত্বের আকর্ষণী শক্তিতে। মীনুদি, দিদি, রাধাবোষ্টমী…আর হ্যাঁ, অস্বীকার করে লাভ কী…এই পোড়ারমুখি…জানি না, আরও কেউ-কেউ এসেছিল কি না তোমার গোপন জীবনে! লক্ষ্মীটি, তুমি আমাদের উপর রাগ কর না, সোনাদা! তোমার আগুন- বরন গায়ের রঙ, অথবা দাহিকাশক্তির জন্য যেমন তুমি দায়ী নও, ঠিক তেমনি আমরাও আমাদের এই পতঙ্গবৃত্তির জন্য দায়ী নই। আমরা জানি, ঝাঁপ দিলে নিশ্চিত মৃত্যু– তবু লোভ সামলাতে পারি না। পুড়ে মরি।

রূপেন্দ্রনাথ অভিভূত হলেন। পঞ্চদশী তুলসী ছিল প্রগলভা, এখনো সে তাই; কিন্তু ওর কথার পিছনে কিছু জোরালো যুক্তিও আছে।

তুলসীই আবার বলে, মেয়েকে জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা কর না যেন, বাবামশাই অত্যন্ত জেদী, সময়-সময় অত্যন্ত নিষ্ঠুরও। পরাজয় স্বীকার করা ওঁর ধাতে নেই। কাজীর বিচারে যদি বাপের অধিকার স্বীকৃত হয় তাহলে হয়তো মেয়েকে পাবে, জীবিতা নয়। তার চেয়ে, অনিবার্য নিয়তিকে মেনে নাও। সে আমাকেই মা বলে জানে। তাই তাকে জানতে দাও। আর নাও–এটা ধর।

আঁচলের তলা থেকে একটা ভেলভেটের পুলিন্দা বার করে ধরে।

—কী আছে এতে?

—দিদির গায়ের গহনা। তোমাদের গাঁয়ের জমিদার-মশায়ের উপহার। দিদি আমাকে গিয়ে গেছিল।

–ও! কিন্তু সেগুলো তো আমি নিতে পারব না, তুলসী। এগুলো তোমার দিদি তোমাকে দিয়েছিল। এ তোমার।

—না! তা হয় না বাঁড়জ্জে-মশাই। আপনি নিজে হাতে এই আশীর্বাদ-অলঙ্কার আমার গায়ে পরিয়ে দিতে অস্বীকার করেছেন। শালী হিসাবে এই করুণার দান আমি নেব কেন?

রূপেন্দ্রনাথ ওর দুটি হাত তুলে নিলেন নিজের হাতে। বললেন আমি মনে-মনে সন্ন্যাস নিয়েছি, তুলসী। তুমি এগুলো প্রত্যাখ্যান করলে কুসুমমঞ্জরী স্বর্গে বসে চোখের জলে ভাসবে। আমি তোমাকে মিনতি করছি ‘রূপার-মা’!

—কী? কী বললে?

—হ্যাঁ, তাই! তুমি যখন নির্দ্বিধায় দিদির হাত থেকে একফোঁটা মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়েছিলে তখন তো তুমি রূপমঞ্জরীর বাবার কথা ভাবনি, তুলসী। আমার অজ্ঞাতেই তুমি আমাকে কৃতার্থ করেছ। রূপমঞ্জরীর জননীত্ব তুমি স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিয়েছ। রূপার বিয়েতে এই অলঙ্কার পরিয়ে তুমি তাকে সাজিয়ে দেবে, রূপার মা!

তুলসী বাঁ-হাতে চোখটা মুছতে গেল। গণ্ডে লাগল কজ্জলচিহ্ন। নিচু হয়ে প্রণাম করল রূপেন্দ্রনাথকে। উনি তাকে দুই বাহুমূল ধরে তুললেন। মুদিতনেত্র কপালে একটি চুম্বনচিহ্ন এঁকে দিয়ে অস্ফুটে কী যেন আশীর্বাদ করলেন।

“অঙ্গাঙ্গী ভাবমজ্ঞাত্বা কথং সামর্থ্যনির্ণয়ঃ?
পশ্য টিট্টিভমাত্রেণ সমুদ্রঃ ব্যাকুলীকৃত।।”

ছোট্ট টিট্টিভ-টিট্টিভী-পক্ষী। খঞ্জনার মতো জোড়া-পায়ে সমুদ্রের পারে ভিজা বালিতে দুজনে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়। তারপর সমুদ্রতীরের খাড়া পাহাড়ের ফোকরে টিট্টিভী ডিম পাড়ল। বাপ-আর মা পালা করে পাহারা দেয়। ডিমে তা দেয়। এদিকে চাঁদ যতই প্রতিপদ থেকে অমাবস্যার দিকে এগিয়ে চলে সমুদ্র ততই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে জোয়ারের টানে। টিট্টিভ-টিট্টিভনী কিচির-কিচির করে গাল পাড়ে। সমুদ্রকে সাবধান করতে চায়। না হলে সমুদ্রের ঢেউয়ে ওদের চুন্নুমুন্নু ডিমটা ভেসে যাবে যে!…কোথায় দিগন্তচুম্বিত যাদঃপতি নীলাম্বুধি আর কোথায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টিট্টিভ-দম্পতি!

শেষমেশ টিট্টিভ দম্পতি এসে দরবার করল পক্ষিকুলতিলক গরুড়-এর কাছে। গরুড় মহা-শক্তিধর; কিন্তু সমুদ্রের কাছে তাঁর ক্ষমতাই বা কতটুকু? ফলে গরুড় দরবার করেন তাঁর প্রভু স্বয়ং নারায়ণের কাছে : দীনদয়াল! তুমি না বাঁচালে তো রক্ষা করা যাবে না টিট্টিভ-দম্পতির সন্তানকে।…শ্রীহরির যোগনিদ্রা ভগ্ন হল। সমুদ্রকে ডেকে অ্যাইসা কড়কে দিলেন যে, সমুদ্র ভাঁটার টানে পিছিয়ে গেল কয়েক যোজন!

তোমরা জান কি জান না জানি না, মহাপণ্ডিত এ. এল. ব্যাশমের মতে হিতোপদেশ রচিত হয়েছিল এই অতিভঙ্গ, তবু রঙ্গভরা বঙ্গভূমেই। লেখক জনৈক নারায়ণ-পণ্ডিত! বাঙালি! মোটকথা আমাদের নায়ক পণ্ডিত রূপেন্দ্রনাথের পড়া ছিল পঞ্চতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এই হিতোপদেশ কাহিনী। এখানে একাধিক উপমান, একাধিক উপমেয়।

ক্ষমতাগর্বে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন যিনি সেই ভবতারণ জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিতে চান টিট্টিভ-দম্পতির ভালবাসার শেষ অবশেষ, ঐ একফোঁটা মেয়েটাকে। যদি তার বাবা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার বিপদটা বুঝতে না পারে, তুলসীর মতো সুন্দরী মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে। কেন? ওঁর চেয়ে রূপেন্দ্রকে কৌলিন্যমর্যাদা আর কারও দেবার হিম্মৎআছে? রূপেন্দ্র কি বাজার যাচাই না করে কথা দেবে না? তিনিও দেখে নেবেন—কী করে ঐ এক ফোঁটা মেয়েটাকে কেড়ে নিয়ে যায় ঐ হাড়-হাবাতে একবগ্গা কোবরেজ!

কিন্তু রূপেন্দ্র জানতেন, ফরাসী-গভর্নর ডুপ্লেক্সের দক্ষিণহস্ত ইন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সখ্যতার সম্পর্ক। প্রাকবিবাহ জীবনে ঝষধ্বজ নামে এক ধনবান ব্যবসাদারের চিকিৎসা করতে রূপেন্দ্র একবার সোঞাই থেকে কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন। সেই সময়েই সখ্যতা হয়েছিল ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের সঙ্গে। তিনি তখন ‘অন্নদামঙ্গল’ শেষ করে ‘বিদ্যাসুন্দর’ রচনা করছেন। ঐ সূত্রে মহারাজের অন্দরমহলেও একদিন তাঁকে যেতে হয়। মহারানীকে পরীক্ষা করে ঔষধপথ্যাদির ব্যবস্থা দিতে এবং মধ্যাহ্ন আহারের নিমন্ত্রণ রাখতে। সেসব কথা অন্যত্র বিস্তারিত বলেছি। রূপেন্দ্র স্থির করলেন মহারাজের মাধ্যমে ইন্দ্রনারায়ণকে ধরবেন। ভবতারণ তাঁর নিয়োগকর্তার আদেশ অমান্য করতে পারবেন না নিশ্চয়।

ফরাসীডাঙার ঘাট থেকে আবার গঙ্গা বেয়ে উজানে চললেন নবদ্বীপ। সেখান থেকে জলাঙ্গী বেয়ে কৃষ্ণনগর তো একবেলার জলপথ। রাজবাড়ি থেকে খেয়াঘাট পর্যন্ত টানা উত্তর- দক্ষিণ খোয়া-বাঁধানো সড়কটার নাম সেকালে ছিল ‘রাজপথ’। পরে যার চলিত নাম হয় ‘হাই স্ট্রিট’, স্বাধীনতার পর এখন যা ‘আর. এন. টেগোর রোড’। তার দুপাশে অতি প্ৰকাণ্ড- প্রকাণ্ড শিশুগাছ, মাঝে দুটি তালাও, তিনটি বড় ইঁদারা। তখনো গো-আড়ি গ্রামে জনবসতি বিশেষ ছিল না। ঐ খেয়াঘাটে ছিল কিছু মালো, মৎস্যজীবীদের আবাস। জলাঙ্গীর স্রোতধারা ধরে ক্রোশ দুই উজানে গেলে মৃৎশিল্পীদের গ্রাম। হাস্যার্ণব গোপাল ভাঁড়ের বাস সেখানে।

রূপেন্দ্রনাথ তাঁর পুঁটুলি বগলে ঐ রাজপথ ধরে দক্ষিণমুখো রাজপ্রাসাদের দিকে চলেছেন। পথে লোকজন আছে। অধিকাংশই পদব্রজে চলেছে, কিছু গো-গাড়ি, ক্বচিৎ কখনো কোন রাজপুরুষ অশ্বারোহণে ধুলার ঘূর্ণী তুলে ছুটছেন। হঠাৎ একটি দু-ঘোড়ার সৌখীন গাড়ি এসে থেমে গেল ওঁর পাশে ‘রোখকে! রোখকে!’ শব্দে।

গাড়োয়ান এবং আরোহী উভয়েই নির্ভেজাল বাঙালি; কিন্তু আদেশ ও গালাগালের সময় অষ্টাদশ শতাব্দীর নব্য-বাঙালি উত্তরভারতের ভাষা ব্যবহার করতেন। ক্ষমতায় কুলালে উর্দু, না-কুলালে হিন্দি!

গাড়ি থেমে গেল। পিছনের একমাত্র আরোহী সৌখিন লোক। ঊর্ধ্বাঙ্গে রেশমের পিরান, রেশমের উত্তরীয়। মাথায় উষ্ণীষ, পরিধানে মলমলের কোঁচানো ধুতি। তাঁর বাঁ হাতে একটি শিক্‌রে-বাজপাখি।

গাড়ি থেকে মুখ বার করে যুবকটি বললে, কোবরেজ-মশাই না?

রূপেন্দ্র চোখ তুলে দেখলেন। চিনতে পারলেন। উলার বর্ধিষ্ণু ভূম্যধিকারী রসিকলাল। তিনি বলেন, উঠে আসুন গাড়িতে। কবে এসেছেন? গঙ্গারাম কোথায়?

রসিকলাল ধনীব্যক্তি। আনুষঙ্গিক সবকয়টি চরিত্রদোষও আছে। রূপেন্দ্র ওঁর সঙ্গ পছন্দ করেন না বিশেষ। রাস্তায় দাঁড়িয়েই বলেন, আজ এইমাত্র এসেছি। গঙ্গারাম ভালই আছে।—তা গো-আড়ি গাঁয়ে থাকবেন কোথায়? আপনার বয়স্যকে তো মহারাজ দেশছাড়া করেছেন, শুনেছেন নিশ্চয়।

ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যে আর কৃষ্ণচন্দ্র (তখনো তিনি মহারাজ নন, রাজা কিন্তু মুখেমুখে সবাই মহারাজই বলে) রায়ের সভাকবি নন এ তথ্যটা জানা ছিল না। উনি স্থির করেছিলেন ভারতচন্দ্রের ভদ্রাসনেই আতিথ্য গ্রহণ করবেন; এখন বুঝলেন সেটা সম্ভবপর নয়। তাই বললেন, মহারাজের অতিথিশালায় উঠব স্থির করেছি।

—ইচ্ছে করলে আমার গরিবখানাতেও থাকতে পারেন। তবে সেটা রাজবাড়ি থেকে বেশ দূরে, উলায়।

—না। আমার প্রয়োজনটা গো-আড়িতেই।

—তা বেশ তো। উঠে আসুন। রাজবাড়িতেই নামিয়ে দেব। উলা যেতে সেটা তো আমার পথেই পড়বে।

অগত্যা উঠতে হল গাড়িতে। গাড়ি ছাড়ল। রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, আমার বন্ধু তো দেশছাড়া, আপনার বয়স্য কেমন আছেন? ঝষধ্বজ দত্ত?

—ঝষা? হতভাগা ফৌত হয়েছে। কুষ্ঠ হয়েছিল। হবেই! পাপে আকণ্ঠ মগ্ন হয়ে থাকত ইদানীং।

রূপেন্দ্র বুঝতে পারলেন। কুষ্ঠ নয়। রতিজ রোগ উপদংশ। পরবর্তী শতাব্দীতে যার নাম হবে ‘সিফিলিস!’ কিন্তু সে-কথা বললেন না।

রাজবাড়িতে এসেও দুঃসংবাদ পেলেন। রাজামশাই মুর্শিদাবাদে গেছেন নবাবী তলব পেয়ে। কবে ফিরবেন তা দেওয়ানজী হয়তো জানেন, তাঁর দপ্তর জানে না। তবে অতিথিশালায় আশ্রয় পেতে কোনও অসুবিধা হল না। নায়েব ওঁকে চিনতে পেরেছে। কুশলপ্রশ্ন করে ওঁর যাবতীয় বন্দোবস্তের আয়োজন করল। একটু পরে স্বয়ং শিবচন্দ্র এল রূপেন্দ্রর তত্ত্বতালাশ নিতে। শিবচন্দ্র রায় কৃষ্ণচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপুত্র—যুবরাজ। রূপেন্দ্রকে প্ৰণাম করে বললে, বাবামশাই মুর্শিদাবাদ থেকে কবে ফিরে আসবেন তার স্থিরতা নেই। আপনার অভিরুচি হলে এখানে যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারেন। আর আপনার সাক্ষাতের প্রয়োজনটা যদি আমাকে জানানো সম্ভবপর হয় তাহলে আমিও চেষ্টা করে দেখতে পারি।

রূপেন্দ্র কী জবাব দেবেন স্থির করে উঠতে পারেন না।

শিবচন্দ্র নিজে থেকেই বলে, বুঝেছি! আপনাকে আর একটা কথা বলার আছে। আপনি এসেছেন সংবাদ পেয়ে বড়মা একবার আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কখন আপনি অন্দরমহলে পদধূলি দিতে আসবেন বলুন। আমি সেইমতো ব্যবস্থা করে দেব। সব চেয়ে ভাল হয় যদি স্নানান্তে বড়মার মহলে মধ্যাহ্ন-আহার সেবা করেন।

রূপেন্দ্র জানতে চাইলেন, কেমন আছেন তোমার বড়মা?

—ভালই আছেন। আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন।

কৃষ্ণচন্দ্রের দুই বিবাহ। শিবচন্দ্রের জননীকে আগের বার চিকিৎসক হিসাবে পরীক্ষা করতে হয়েছিল। রূপেন্দ্র সম্মত হলেন।

কৃষ্ণনগর রাজবাটিতেও একটি ‘অন্তরাল’ আছে। ইতিপূর্বে রূপেন্দ্র সেখানে বসেই মহারাজের সঙ্গে মধ্যাহ্ন-আহার করেছিলেন। তারপর রাজসমভিব্যাহারে বড়মার মহলে গিয়ে তাঁকে পরীক্ষা করেছিলেন। এবার শিবচন্দ্র তাঁকে সরাসরি বড়মার অন্দর-মহলে নিয়ে এসে একটি ‘প্রতীক্ষা-কক্ষে’ বসালো।

একটু পরেই বড়-রানীমা এলেন। রূপেন্দ্রের প্রায় সমবয়সী। উনি রানীমার প্রণাম গ্রহণ করেন না। তাই রানীমা ঝুঁকে নমস্কার করলেন। রূপেন্দ্রও আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিও নত হয়ে প্রতিনমস্কার করলেন।

রানী-মা জানালেন, এ তিনবছর তিনি অনেকটা ভাল আছেন। শিরঃপীড়া এবং বুকের ব্যথাটা আর হয়নি। জানতে চাইলেন, আপনার ঔষধ-বটিকা প্রায় বছরখানেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমি বর্ধমানে সোঞাই গাঁয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম। শুনলাম আপনি তীর্থ করতে গেছেন। এখন যখন ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে গেল তখন বলুন—ঐ ঔষধটিকা কি আরও খেতে হবে?

রূপেন্দ্র বললেন, না, রানীমা। মাথা বা বুকের বেদনা যখন সম্পূর্ণ সেরে গেছে তখন ঐ ওষুধটা আর খেতে হবে না। কিন্তু ঐ সঙ্গে আপনাকে আরও নির্দেশ দিয়েছিলাম রোজ প্রত্যুষে কুলুখকলাই ভিজানো এক ঘটি জল পান করতে। সেটা কি করছেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। শুধু তাই নয়, আপনার নির্দেশে শিশির-ভেজা ঘাসে সূর্যোদয়ের পূর্বে খালি পায়ে বেড়াই। সে নির্দেশটাও মানি মানে, বর্ষাকাল বাদে।

—খুব ভাল কথা। ও দুটি নির্দেশ মেনে চলবেন। তাতে উপকারই হবে। একটা কথা শুনলাম রানীমা, গো-আড়ি গাঁয়ে এসে ভারতচন্দ্র নাকি আর মহারাজের সভাকবি নন?

রানীমা হেসে বললেন, কথাটা বুঝি ঐভাবে প্রচার পেয়েছে? তা নয়। আসল ব্যাপারটা শুনুন :

বিদ্যাসুন্দর রচনা শেষ করে কবি কিছু ক্লান্তি অনুভব করেন। পাঠকদের ভিতর কাব্যের মিশ্র প্রতিক্রিয়াতেও বোধ করি ওঁর মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয়েছিল। উনি শহর থেকে দূরে কিছুদিন থাকবেন বলে স্থির করেন। রাজা সানন্দে স্বীকৃত হন। কবিকে বিদ্যাসুন্দর রচনার পুরস্কারস্বরূপ মহারাজ তাঁকে মূলাজোড় গ্রামখানি বার্ষিক ছয়শত টাকা রাজস্বের বিনিময়ে ইজারা দেন এবং ঐ গ্রামের যে কোন প্রত্যন্তদেশে একটি গৃহ নির্মাণের জন্য একশত টাকা দান করেন। কবি নাগরিক জীবন ত্যাগ করে গ্রামবাসী হলেন। আযৌবন প্রোষিতভর্তা প্রিয়াকে নিয়ে এসে মূলাজোড়ে বসবাস করতে থাকেন। রানীমা আরও জানালেন ইতিমধ্যে বর্গীর উৎপাতে ভীত হয়ে বর্ধমানরাজ তিলকচন্দ্র মূলাজোড়ের পার্শ্ববর্তী কাউগাছি গ্রামে এসে কয়েক মাস ছিলেন। গ্রামখানি বর্ধমানরাজমাতার পছন্দ হয়ে যায়। তিনি ঐ গ্রামটি নিজের নামে পত্তনি নিলেন। আর একজন কর্মচারীকে পত্তনিদার নিযুক্ত করলেন। বর্ধমানরাজের সঙ্গে ভারতচন্দ্রের সদ্ভাব কোন কালেই ছিল না। কৈশোরে ভারতচন্দ্র বর্ধমানরাজের কারাগারে আবদ্ধও হয়েছিলেন। বিদ্যাসুন্দর রচনায় বর্ধমানরাজ বোধ করি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। মোটকথা, কাউগাছি গ্রামের পত্তনিদার রামদেব নাগ পার্শ্ববর্তী গ্রাম মূলাজোড়ের ইজারাদার অর্থাৎ কবি ভারতচন্দ্রকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেন। নাগরিক জীবন ত্যাগ করে গ্রামে বাস করা কবির পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতচন্দ্র নিরুপায় হয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে সংস্কৃতে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেন। কবিতাটির নাম : ‘নাগাষ্টক’। কবিতাটির প্রত্যেকটি স্তবকের শেষ পংক্তি ছিল—”সমস্তং মে নাগো গ্রসতি সবিরাগো হরি হরি।”[১]

মহারাজ বুঝলেন। তিনি কবিকে পরামর্শ দেন নাগ-মহাশয়ের নাগালের বাহিরে গুস্তে গ্রামে গিয়ে বাস করতে। গৃহনির্মাণের ব্যয়ভার দিতেও তিনি স্বীকৃত হয়েছিলেন।

রানীমা জানালেন, কবি এখন নূতন গ্রামে নুতন ভদ্রাসনে যাওয়ার আয়োজন করছেন।[২]

[১. অনন্তনাগের উপর সুষুপ্ত শ্রীহরিকে স্মরণ করে কবি জানাচ্ছেন যে বিরাগবশত নাগেই কবির সব কিছু গ্রাস করছে।

২. কাহিনীর বহির্ভূত হলেও এখানে জানিয়ে রাখা ভাল যে, মূলাজোড়ের গ্রামবাসী এ ব্যবস্থাপনায় বাধা দেয়। তারা কবিকে ভালবেসে ফেলেছিল। তারা প্রতিশ্রুতি দেয় রামদেব নাগ বেশি বাড়াবাড়ি করলে গ্রামবাসী সম্মিলিতভাবে প্রতিবিধান করবে। আনন্দের কথা : কবি সে প্রস্তাবে স্বীকৃত হন এবং মূলাজোড়েই বাকি জীবন সানন্দে কাটিয়ে যান।]

এবার রানী-মা বললেন, আপনি রাজামশায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে। শিবচন্দ্রকে সে কথা জানাতে আপনি ইতস্তত করেছেন—শিবচন্দ্ৰই বলল। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে তা জানাতে পারেন। আমার ক্ষমতায় কুলালে এখনি তার প্রতিবিধান করব। অন্যথায় মহারাজ প্রত্যাবর্তন করলে তাঁকে জানাব। আপনি অবশ্য তাঁর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে পারেন। কিন্তু ততদিন হয়তো আপনার সহধর্মিণী—

রূপেন্দ্র ওঁকে থামিয়ে দিলেন। স্থির করলেন রানীমাকেই সব কথা খুলে বলবেন। কুসুমমঞ্জরীর মৃত্যু, কন্যাসন্তান প্রসব, ভবতারণের বিরূপতা।

রানীমা সব শুনে একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করেই ফেললেন, গাঙ্গুলী- মশায়ের দ্বিতীয়া কন্যা তুলসী দেখতে কেমন?

রূপেন্দ্র লজ্জিত হলেন। মাথা নেড়ে বললেন, না, রানীমা। সেসব কারণে নয়। তুলসী খুবই সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। যেকোন সংসারে সে বাঞ্ছনীয়, উপযুক্তা। কিন্তু আমি আর দ্বিতীয়বার সংসারী হব না বলে স্থির করেছি।

—এটা একটা কথা হল? আপনি কুলীন ব্রাহ্মণ …

বাধা দিয়ে রূপেন্দ্র বললেন, সমাজের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়াটাকেই আমি জীবনের পরমার্থ বলে মনে করি না। আমার ইচ্ছা রূপমঞ্জরীকে পণ্ডিতা করে তুলব। এটাই হবে আমার জীবনের ব্রত। এই অষ্টাদশ শতাব্দীতে সে হয়ে উঠবে নতুন যুগের মৈত্রেয়ী, গার্গী, মদালসা। একা সে নয় গৌড়মণ্ডলের বালিকাদের বিদ্যাদানের সুযোগ এনে দেবার জন্য আমি প্রাণপাত চেষ্টা করব। আমার মতে সমাজের অধঃপতনের দুটি মূল হেতু। একটি জাতিভেদপ্রথা—সমাজের একটা বলিষ্ঠ এবং বৃহৎ অংশকে জল-অচল করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়টি, সমাজের অর্ধাংশকে—নারীদের—অশিক্ষিতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেব প্রথম সমস্যাটা নিয়ে লড়াই করেছিলেন, আচণ্ডালকে কোল দিয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় সমস্যাটা নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউই কোনও চেষ্টা করেননি। এ বিষয়ে আমি মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। গ্রামে গ্রামে তিনি চতুষ্পাঠী খুলে চলেছেন, কিন্তু স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে এই নদীয়াতেও কিছু কাজ আজ পর্যন্ত করা হয়নি।

রানীমা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, সেটা হবে না পণ্ডিতমশাই। গৃহাভ্যন্তরে ব্রাহ্মণকন্যার অক্ষর পরিচয়দানে মহারাজের আপত্তি নেই—এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বালিকাবয়সেও কোনও স্ত্রীলোক গৃহাবরোধের বাহিরে পাঠশালায় গিয়ে পড়াশুনা করুক এটাতে তাঁর দৃঢ় আপত্তি। ওঁর স্থির বিশ্বাস : কলিযুগে স্ত্রীশিক্ষার আয়োজন হলে সমাজের বনিয়াদ ধসে পড়বে। ফিরিঙ্গি মেমসাহেবদের মতো তারা ভ্রষ্টচরিত্রের বিবি বনে যাবে। তাঁর মতে কন্যাদের অষ্টমবর্ষেই গৌরীদান করা বিধেয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল রূপেন্দ্রনাথের।

রানীমা বললেন, আপনাকে আরও একটা গোপন কথা বলি। অপ্রিয় সত্য; কিন্তু আপনাকে জ্ঞাত করানোই মঙ্গল। প্রথম কথা : ফরাসীডাঙার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে মহারাজের সম্পর্কটা ইদানীং ভাল নয়। দ্বিতীয় কথা : নৈতিক কারণেও সম্ভবত মহারাজ বোধহয় আপনার পরিবর্তে আপনার পিসাশ্বশুর গাঙ্গুলীমশাইকেই সমর্থন করবেন। হিন্দুধর্মে আবহমান কাল ধরে যেসব লৌকিক প্রথা প্রচলিত সেগুলি উনি পরিবর্তন করতে চান না। তাঁর মতে, কুলীন ব্রাহ্মণ হিসাবে আপনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করতে অস্বীকার করে সামাজিক বিধানকে অগ্রাহ্য করছেন।

রূপেন্দ্র বললেন, মহারাজের কথা বরং থাক, রানীমা। আপনি আমাকে নিজের কথা বলুন। আপনি কি অন্তর থেকে এইসব লোকাচারকে সমর্থন করেন?

—কোন সব লোকাচার?

—ধরুন সতীদাহ?

—’সতীদাহ’ লোকাচার হতে যাবে কেন? এতো হিন্দুধর্মের একটা অঙ্গ।

—আদৌ নয়। কোনও প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থে এর সমর্থন নেই। অথবা ধরুন, বন্ধ্যানারী যে মানত করে থাকে সন্তানবতী হলে সে তার সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দেবে? এই কুপ্রথা আপনি সমর্থন করেন? মুসলমানেরা চারটির অধিক বিবাহ করতে পারে না, আর কুলীন ব্রাহ্মণেরা পঞ্চাশ-ষাট-একশটি মেয়েকে বিবাহ করছে! এগুলো কুপ্রথা নয়? মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ব্রাহ্মণ, তিনি সমাজের মধ্যমণি– তাঁর পক্ষে এইসব কুপ্রথা রোধ করার চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন না আপনি?

রানীমা বললেন, আমার মনে করায় না করায় কিছুই যায়-আসে না পণ্ডিতমশাই। আমি বরং অন্য একটি প্রসঙ্গ আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।

—বলুন?

—চিন্তা করে দেখুন, আপনার কন্যা রূপমঞ্জরীর বয়স মাত্র দুই আড়াই বৎসর। পাঠাভ্যাসের বয়স তার হয়নি। মায়ের অভাব সে অনুভব করে না; পিতার অভাব সম্বন্ধে এখনো সে অনবহিত। আপনার পিসাশ্বশুরের রাজবাড়িতে সে সুখে-স্বচ্ছন্দে তার শৈশব কাটাচ্ছে। অপরপক্ষে আপনি নিজেই জানেন না, সোঞাই গাঁয়ে আপনার ভিটার কী অবস্থা। আপনার পিসিমা স্বর্গে গেছেন। জনমানব সেখানে বাস করে না। বাস্তুভিটাখানি খাড়া আছে কি না তাও আপনি জানেন না। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ না করে আপনি কোন্ বিচারে মেয়েটিকে সোঞাই নিয়ে যেতে চাইছেন?

রূপেন্দ্রনাথ এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারলেন না।

ঠিকই বলেছিলেন রানীমা। রূপেন্দ্রনাথ যে নারীমুক্তি, নারীজাগরণ এবং সমাজ সংস্কারের উদ্যোগ করতে চাইছেন, তাতে কোনক্রমে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে পাওয়ার আশা নাই। কৃষ্ণচন্দ্র গুণগ্রাহী ছিলেন। ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, শঙ্কর তর্কবাগীশ, গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, রাধামোহন বিদ্যাবাচস্পতি গোস্বামী, শিবরাম বাচস্পতি, বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার, হরদেব তর্কসিদ্ধান্ত ইত্যাদি প্রভৃতি অসংখ্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সকলকেই নিষ্কর ভূখণ্ড দান করেছিলেন, চতুষ্পাঠী স্থাপনে অর্থসাহায্য করেছিলেন। সেকালে নদীয়াতে একটি প্রবচনই প্রসিদ্ধি লাভ করে : মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দান গ্রহণ যিনি করেননি তাঁর ব্রাহ্মণত্বেই সন্দেহ জাগে।

বলাবাহুল্য একমাত্র ব্যতিক্রম : রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত—

‘বুনো রামনাথ’!

সে-কালে পাঁচবছর বয়সে বালকদের চূড়াকরণ ও বিদ্যাকরণ শুরু হত। ইদানীং যাকে আমরা ‘হাতে-খড়ি’ বলি। প্রথমে তারা অ-আ-ক-খ, শুভঙ্করী আর নামতা মুখস্ত করত। তারপর ক্রমে ক্রমে ছাত্রকে শেখানো হত ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, ন্যায়, স্মৃতি, জ্যোতিষ (গণিত ও ফলিত), ষড়দর্শন, এবং বৈদিক ছন্দ তথা বৈদিক ব্যাকরণ। সারা বাঙলাতেই গ্রামে ও নগরে ছিল চতুষ্পাঠী। বঙ্গদেশের এইসব চতুষ্পাঠীতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে গৌড়দেশের বাহির থেকেও যথেষ্ট ছাত্র আসত এতই খ্যাতি ছিল নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রামের চতুষ্পাঠী আর টোলের। কবি রামপ্রসাদ বর্ধমানের একটি চতুষ্পাঠীর বর্ণনায় লিখছেন :

চৌদিকে চৌপাড়িময়           পাঠ চায় পড়ুয়াচয়,
দ্রাবিড়-উৎকল-কাশীবাসী।
কারো বা ত্রিহুচ বাড়ি          বিদেশ স্বদেশ ছাড়ি
আগমন বিদ্যা অভিলাষী।।[১]

[১. ‘সাধক কবি রামপ্রসাদ’-যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, 1954, পূঃ 398-99.]

সংস্কৃত শিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান ছিল টোল। চতুষ্পাঠীর পাঠ সমাপনান্তে উৎসাহী ছাত্ররা টোলে উচ্চতর জ্ঞানের জন্য উপস্থিত হত।

ডঃ আলোককুমার চক্রবর্তী লিখছেন[২]

[‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’—ডঃ আলোককুমার চক্রবর্তী, প্রগ্রেসিভ বুক কোরাম, 1989, পূঃ 79.]

তৎকালীন বাংলার চব্বিশ পরগণার ভাটপাড়া, গুপ্তিপাড়া, কৃশদহ, বর্ধমান, ত্রিবেণী, হাওড়ার বালী, ঢাকার রাজনগর ও বিষ্ণুপুর ইত্যাদি বহু স্থানে সংস্কৃতশিক্ষার টোল ছিল। ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, স্মৃতি, কাব্য, দর্শন, জ্যোতিষ, বেদ, পুরাণ, অভিধান ইত্যাদি পড়ানো হত। ছাত্ররা ন্যায়শাস্ত্র শিখবার জন্য নবদ্বীপ যেত। অনেকে আবার দর্শন ও স্মৃতিতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য মিথিলায় যেত। ব্যাকরণ, অলংকার ও বেদ-এ উচ্চতর জ্ঞানের জন্য ছাত্ররা কাশী যেত। শিক্ষান্তে সাধারণতঃ তারা নিজ নিজ গ্রাম বা শহরে ফিরে চতুষ্পাঠী ও টোল খুলে ছাত্রদের শিক্ষা দিত। …এডামের অনুমান তখন সারা বাংলায় ১,৮০০টি টোল ও ১২,৬০০ অধ্যাপক ছিলেন।

কৃষ্ণচন্দ্ৰীয় যুগে মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থা মক্তব ও মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।…ছাত্রদের মক্তবে আরবী, উর্দু, ফারসী বর্ণমালা লেখা ও পড়া, প্রাথমিক অংক এবং ইসলামী ধর্মশাস্ত্র শেখানোর ব্যবস্থা ছিল।… মাদ্রাসাগুলি বেশীর ভাগ মসজিদ বা ইমামবাড়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মাদ্রাসাগুলিতে ছাত্রদের কোরাণ, হাদিস, সরাহ্, আরবী, ফারসী সাহিত্য, আরব দেশের বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাশাস্ত্র শেখানো হত। এগুলি নবাব, অভিজাত, আমির ও ধনী মুসলমানদের অর্থানুকূল্যে পড়ানো হত।  

তুলনায় সেযুগে—কী-হিন্দু, কী-মুসলমান–স্ত্রীজাতির শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। বর্ধমানরাজ, নদীয়ারাজ, নাটোর, বা ঢাকার রাজবল্লভ তাঁদের এলাকায় স্ত্রী-শিক্ষার বস্তুত কোন ব্যবস্থাই করেননি। আট বছর পর্যন্ত হিন্দু বালিকারা পিতামাতা বা গুরুস্থানীয় কোনও পুরুষের কাছে পাঠগ্রহণ করত। সচরাচর সাংসারিক জীবনের প্রয়োজনে যতটুকু পড়াশুনা দরকার, তার বেশি তাদের শেখানো হত না। শুভংকরী অংক, নামতা, কিছু ছড়া, চিঠি লেখার কায়দা। ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা হলে অশুদ্ধ উচ্চারণে কিছু স্তবস্তোত্র–গঙ্গার, শিবের। বছর-আষ্টেক বয়সের আগেই ‘গৌরীদান’ করে তাদের গোত্রান্তরের আয়োজন। তারপর তো ভিন্ন গোত্রের সদ্যপরিচিত একটি পুরুষের “ভুক্তেবাচ্ছিষ্টংবধৈ দদাৎ” [আহারান্তে যা খেতে পারলে না সেই ভুক্তাবশিষ্ট-সমেত এঁটো পাতাখানা ধর্মপত্নীকে ধরে দিও—(গৃহ্যসূত্র ১/৪/ ১১)] আইনে জীবনধারণের আয়োজন। যতদিনে না স্বামীসোহাগিনীরূপে তার চিতায় ওঠার সৌভাগ্য হয়। হিন্দু বালিকাদের তুলনায় দরিদ্রশ্রেণীর মুসলমান মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেত আরও অল্প। তাদের চিতায় উঠতে হত না, তালাক যেতে হত।

অথচ আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল, ধনাঢ্য পরিবারে অবস্থাটা সবসময় এমন ছিল না। কী হিন্দু, কী মুসলমান। স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল, এতে সন্দেহ নেই; কিন্তু ধনবানদের গৃহাভ্যন্তরে স্ত্রীশিক্ষার অভাব সবক্ষেত্রেই ছিল না। সরফরাজ খাঁর জননী জিন্নতুন্নেসা, এবং ভগ্নী জাফিসা বেগম বিদুষী ছিলেন। সুজাউদ্দীনের কন্যা দরদানা বেগমও পড়াশুনায় আলিম ছিলেন। রিয়াজ-উস্-সালাতীন (লেখক, গোলাম হুসেন সলিম, ইংরেজি অনুবাদ আবদুস্ সালাম, 1904) আলিবর্দির প্রধানা বেগমসাহেবা : শরফ উন্নিসাকে বলেছেন সমকালীন বঙ্গদেশের “সুপ্রীম পলিটিকাল অফিসার”। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের (মুর্শিদাবাদ কাহিনী) মতে কর্মবীর আলিবর্দী খাঁর রাজনৈতিক জীবন তাঁহার প্রিয়তমা মহিষীর সহায়তায় পূর্ণতালাভ করিয়াছিল বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। আলিবর্দীর উচ্ছৃঙ্খল সংসার যেমন এই মহিলার তর্জনীতাড়নের অধীন ছিল, সেইরূপ বিপ্লব সাগরে নিমগ্ন সমগ্র বঙ্গদেশের শাসনও তাঁহারই পরামর্শানুসারে চালিত হইত। জ্ঞান, ঔদার্য, পরহিতৈষিতা ও অন্যান্য সদগুণে তিনি রমণীগণের মধ্যে অতুলনীয়া ছিলেন। রাজ্যের যাবতীয় হিতকর কার্য তাঁহারই পরামর্শের উপর নির্ভর করিত।”

মুসলিম-শাসনে প্রথম পর্যায়ে পাঠান যুগে স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না; অন্তত এ গ্রন্থের লেখক ইতিহাসকারদের গ্রন্থ ঘাঁটাঘাটি করে তেমন কোনও তথ্য সংগ্ৰহ করতে পারেননি; কিন্তু মুগল-জামানার আদি যুগ থেকেই প্রতিটি ক্ষেত্রে হারেমের ভিতর বিদুষীদের সন্ধান পাওয়া গেছে। অন্তত গ্র্যান্ড-মুগল জমানায়। আওরঙজেবের পরবর্তী যুগে মুগলগরিমার সবকিছুর মতো এই স্ত্রীশিক্ষার গৌরবময় ঐতিহ্যও পশ্চিমে ঢলে পড়ে। তুলনায় বাবর থেকে আওরঙজেব প্রতিটি যুগে হারেমসারাহ্-র (বেগম-মহলের সর্বময়ীকর্ত্রী) সকলেই আরবী-ফার্সিতে আলিম। বাবুর-বাদশাহর আত্মজা গুলবদন বেগম দিয়ে তার সূচনা। তিনি আজীবন হুমায়ুনের সঙ্গেই বিচরণ করেছেন এবং “হুমায়ুননামা” রচনা করেছেন। বস্তুত তাঁর ঐ জীবনী গ্রন্থ থেকেই ইতিহাস বাবুরতনয় সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে। যেত হুমায়ুনের ভাগীনেয়ী সালিমা সুলতানাও ফার্সিতে আলিম ছিলেন। জাহাঙ্গীরপত্নী নুরজাহাঁ, মমতাজমহল, জাহানআরা এবং জেব-উনিসা প্রত্যেকেই আরবী ও ফার্সী দুটি ভাষাতেই মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। কেউ জীবনীধর্মী গ্রন্থ, কেউ শয়ের, কেউ বা কাব্যগ্রন্থ। আলিমগীরের কন্যা জেব-উননিসা বেগমের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের সঞ্চয় নাকি বিস্ময় উদ্রেক করত। জাহাআরার একটি শয়ের এত উচ্চমানের হয়েছিল যে, স্বয়ং সত্যেন দত্ত মুগ্ধ হয়ে তার বঙ্গানুবাদ করে যান। অপ্রাসঙ্গিক হলেও সেটি উদ্ধৃত না করে থামতে পারছি না। হতভাগিনী জাহানআরা তাঁর সমাধিমূলে উৎকীর্ণ করার জন্য যে ফার্সি শয়েরটি রচনা করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ কৃত তার অনুবাদ :

গরিব গোরে দীপ জ্বেল না
দিও না কেউ ফুল ভুলে;
প্রজাপতির না পোড়ে পাখ
দাগা না পায় বুলবুলে।।

আরও বলি, এই মূগল যুগেই আকবরের হিন্দুপত্নী অম্বরমহিষীর প্রেরণায় শাহ্-এন- শাহ্ আকবর চেষ্টা করেছিলেন হিন্দুদের ভিতর প্রচলিত নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা রদ করতে। সে-হিসাবে আকবর বাদশাহ রাজা রামমোহনের পূর্বসূরী।

হিন্দুসমাজের উচ্চকোটি মহলেও চিত্রটি একই রকম। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দুই রানীই বিদুষী ছিলেন। নাটোরের রানী ভবানী অসাধারণ বিদুষী ছিলেন। সংস্কৃত কাব্য ও ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতেন। রাজবল্লভের আত্মীয়া কবি ও’ পণ্ডিতা আনন্দময়ী সম্বন্ধে একটি তথ্য পাওয়া যায় : রাজা রাজবল্লভ বৈদ্যদের যজ্ঞোপবীত-ধারণ উপলক্ষে একটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন কিন্তু যজ্ঞবেদীর মাপ কী হবে তা নির্ণয়ের সময় মতানৈক্য দেখা দেয়। বিদুষী আনন্দময়ী অথর্ব বেদ ঘেঁটে প্রামাণ্য মন্ত্রটি উদ্ধার ও ব্যাখ্যা করে এ প্রতর্কের মীমাংসা করেন। সে-কথা শুনে মনে পড়ে যায় পৌরাণিক কালে রাজা জনকের সভায় মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মর্ষি কি-না তাই বিচার করতে সমবেত পণ্ডিতবর্গকে সরিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মহাপণ্ডিতা গার্গী!

এ কিন্তু ব্যতিক্রমের চিত্র। সমগ্র বঙ্গভূমের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে স্ত্রীলোকেরা অক্ষরপরিচয়হীনা। হিন্দুঘরের মেয়েরা বালিকাবয়সে ‘পুন্নিপুকুর’ করে, ‘সুবচনী’র পুজো করে, ইতু করে, ভাদুপুজো করে। বামুনবাড়ির মেয়ে হলে বেস্পতিবারে লক্ষ্মীপুজো করে, পাঁচালী পড়ে অথবা মুখস্ত বলে। বড় জোর পুকুরে স্নানান্তে গামছায় ভিজে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে তোতাপাখির মতো আওড়ায়, “দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি গঙ্গে…”

মুসলমান মেয়েদের অবস্থা আরও করুণ। তারা শাদির দলিলে মৌলভির নির্দেশে নির্দিষ্টস্থানে কালো কালির টিপছাপ দেয়!

প্রাক-পলাশীযুদ্ধের আমলে বঙ্গদেশে মেয়েদের জন্য কোনও পৃথক বিদ্যালয়ের উল্লেখ কোথাও পাইনি। কোম্পানির আমলে বোধ করি প্রথম স্কুলটি খোলেন কলকাতায়, মিসেস্ হজেস 1760 খৃষ্টাব্দে। তাতে বাঙালি মেয়ে কী হিন্দু, কী মুসলমান আদৌ পড়তে যেত বলে মনে হয় না। সম্ভবত সেটি ছিল কোম্পানির ইংরেজ অথবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কর্মচারীদের কন্যাদের শিক্ষার আয়োজনে!

আলোককুমার চক্রবর্তীর মতে (মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, 1989) “এ যুগের (প্রাক-পলাশীযুদ্ধ) বিদ্যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হলেন মুর্শিদকুলী, সুজাউদ্দিন, আলিবদ্দী, বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাদ ও তিলকচাঁদ, বীরভূমের আসাদুল্লাহ ও বদিউজ্জামান খানের পরিবার, নাটোরের রামকান্ত ও তাঁর স্ত্রী রানী ভবানী, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা গোপাল সিংহ ও চৈতন্য সিংহ, ঢাকার রাজবল্লভ সেন এবং নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রমুখ। এঁদের মধ্যে শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকরূপে কৃষ্ণচন্দ্রের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। এমন পৃষ্ঠপাষকতা বাংলার আর কোন ব্যক্তি করেছেন বলে জানা নেই।”

এই এতগুলি ধনকুবেরের মধ্যে কেউ কোথাও ব্যতিক্রম হিসাবেও বালিকাদিগের জন্য একটিমাত্র বিদ্যায়তনের ব্যবস্থা করেছেন বলে জানা যায় না। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ঐতিহাসিক পণ্ডিতদের দৃষ্টির আড়ালে ব্যক্তিগত বা পরিবারগত বাতাবরণে কোন কোন দূরদর্শী পণ্ডিত নিশ্চয় তা করেছিলেন। ক্ষুদ্র পরিসরে হয়তো নিজের ভদ্রাসনেই। দু- পাঁচ-দশটি বালিকা বা রমণীকে নিয়ে তাঁরা বসেছেন। বিদ্যাদানের ব্যবস্থা করেছেন। আমার এ প্রতীতি অনেকটা ‘প্লুটো’ গ্রহকে দূরবীনে দেখতে পাওয়ার আগেই নেপচুন গ্রহের গতিচ্ছন্দে হেরফের লক্ষ্য করে ‘প্লুটো’র অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার মতো। অথবা প্লুটোর চেয়েও দূরবস্থিত ‘এক্স’-গ্রহকে স্বীকার করে নেওয়া। সেই অজানা-অনামা মুষ্টিমেয় পণ্ডিতদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হচ্ছে বাস্তব কিছু সমকালীন পণ্ডিতাদের উপস্থিতিতে। না হলে কেমন করে ষোড়শ শতাব্দীর পাটবাড়ি-মৈমনসিংহে কবি চন্দ্রাবতী রচনা করেন : মৈমনসিংহ- গীতিকা? কেমন করে হটী বিদ্যালঙ্কার (1743?-1810) কাশীর পুরুষপণ্ডিতদের পরাজিত করেন? কেমন করে হটু বিদ্যালঙ্কার (1775-1875) স্বগ্রামে নরনারী নির্বিশেষে আর্তরোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে সক্ষম হন? এঁরা কেউ তো কৃষ্ণচন্দ্র-বর্ধমানরাজ-রানী ভবানীর দানধন্য নন!

সুতরাং রূপমঞ্জরীর পিতার, রূপেন্দ্রনাথের এই প্রচেষ্টা—অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অবাস্তব ‘লেখককল্পনা’ নয়। যদিও স্বীকার্য, আমরা তার প্রামাণ্য দক্ষিল প্রমাণ দাখিল করতে অক্ষম।

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ষোড়শ শতাব্দীতে লিখেছিলেন :

“বামদিকে হালিশহর দক্ষিণে ত্রিবেণী
যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি।”

গঙ্গাতীরে সেই ত্রিবেণীতেই আমাদের কাহিনীর কালে বাস করতেন রূপেন্দ্রনাথের শিক্ষাগুরু ভারতবিখ্যাত মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, যাঁর পাণ্ডিত্য-মূল্যায়নে রামমোহন লিখেছেন,

“Jagannath was universally acknowledged to be the first literary of his day and his authority has as much weight as that of Raghunandana.”

জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বিদ্যা, বুদ্ধি, মেধা এবং শ্রুতিধরপ্রতিম স্মৃতিশক্তির বিষয়ে নানান কাহিনী আজও প্রচলিত আছে। সংসদ ‘বাঙালী চরিতাভিধানে’ তাঁর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–“দীর্ঘজীবী এই পণ্ডিত একক প্রচেষ্টায় সংস্কৃতচর্চায় নবদ্বীপের খ্যাতি প্রায় নিষ্প্রভ করে তোলেন।”

দীর্ঘজীবী–সন্দেহ নাই।–একশ তের বছর! শতাধিক বর্ষ বয়সের পণ্ডিত তবু দুই একটি দেখেছি; কিন্তু ‘চেমবার্স বায়োগ্রাফিক্যাল ডিক্সনারী’ ঘেঁটে আমি তো জগন্নাথ ব্যতিরেকে দ্বিতীয় কোন প্রতিভার সন্ধান সারা মানব-সভ্যতার ইতিহাসে পাইনি যাঁর পদপ্রান্তে একটা গোটা শতাব্দী বুড়িয়ে বুড়িয়ে ফুরিয়ে গিয়ে শেষ-প্রণাম জানিয়ে বাধ্য হয়ে বিদায় নিয়েছে। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের জন্ম 1694 খৃষ্টাব্দে সপ্তদশ শতাব্দীতে; প্ৰয়াণ 1807 খৃষ্টাব্দে—উনবিংশ শতাব্দীতে। গোটা অষ্টাদশ শতাব্দী ইহলোকে তাঁর অনুজ পরলোকে : ‘সেথা তুমি অগ্রজ আমার!’

এই পণ্ডিতপ্রবর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের শিষ্য ছিলেন আমাদের কাহিনীর নায়ক, রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষ্ণনগরে মহারানীর কাছে ব্যর্থ হয়ে রূপেন্দ্রনাথ এসে উপস্থিত হলেন ত্রিবেণীতে গুরুদেবের আশ্রমে।

জগন্নাথ একই সঙ্গে সরস্বতী ও লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পেয়েছেন। তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি—যা তিনি উত্তরাধিকার-সূত্রে লাভ করেছিলেন–সুবল মিত্র মশায়ের অভিধানের হিসাবে দেখছি, তা একটি পিতলের গাড়ু, একটি ‘অমৃতি’ জলপাত্র, অনধিক দশবিঘা নিষ্কর ভূমি এবং একটি একচালা পর্ণকুটীর। নিজের মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান : অন্যূন এক লক্ষ টাকা, নগদ, বার্ষিক চারিসহস্র তঙ্কা লাভের নিষ্কর ভূমি, তিন পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র এবং তস্যপুত্রদের।

আমাদের কাহিনীর কালে–যখন রূপেন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন,—পলাশীর যুদ্ধের নয় বৎসর পূর্বে—সেই 1748 খৃষ্টাব্দে, তখন তর্কপঞ্চাননের বয়স চুয়ান্ন। তখনই তাঁর চতুষ্পাঠীতে ছাত্রের প্রচণ্ড ভিড়।

জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের চতুষ্পাঠীর টানা বারান্দায় কাব্য, ব্যাকরণ ইত্যাদি পঠন-পাঠনের আয়োজন। গৃহাভ্যন্তরে ন্যায়, নব্যন্যায়, দর্শন, বিশেষ করে বেদান্ত অধ্যয়নের ব্যবস্থা। পণ্ডিত মশাই এসব শ্রেণীতে পড়ান না। তাঁর একটি পৃথক গবেষণা-গৃহ আছে। উন্নত শ্রেণীর ছাত্ররা পর্যায়ক্রমে সেখানে আসে। কোনও অনুপপত্তি থাকলে তার মীমাংসা জেনে যায়। সচরাচর টোল ও চতুষ্পাঠীর শিক্ষকেরা সেখানে পাঠ নিতে আসেন। অবসর সময়ে পণ্ডিতমশাই অধ্যয়ন করেন, অথবা রচনায় ব্যাপৃত থাকেন। তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি—‘বিবাদভঙ্গার্ণব গ্রন্থ রচনা আরও চল্লিশ বছর পরের ঘটনা। বস্তুত ইংরেজ কোম্পানি বাঙলার দেওয়ানি লাভ করার পর এ দেশীয় বিচার পদ্ধতি ও আইন প্রস্তুতির জন্য জগন্নাথ পণ্ডিতের দ্বারস্থ হয়। স্মৃতি-সমুদ্র মন্থন করে তর্কপঞ্চানন ঐ গ্রন্থটি রচনা করেন 1788 থেকে 1792 খৃষ্টাব্দের মধ্যে। এজন্য তিনি মাসিক সাতশত তঙ্কা বেতন পেতেন।

রূপেন্দ্রনাথ সুযোগমতো গুরুদেবকে তাঁর সমস্যার কথা জানালেন। রূপেন্দ্রনাথের স্ত্রী- বিয়োগের সংবাদ তর্কপঞ্চানন পেয়েছিলেন, কিন্তু সে যে একটি কন্যাসন্তান রেখে গেছে তা জানতেন না। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বললেন, তা বাবা রূপেন্দ্রনাথ, ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায় তো অন্যায় কিছু বলছেন না। তুমি যদি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ না কর, তাহলে তোমার কন্যাকে সোঞাই নিয়ে যেতেই বা চাইছ কেন? একহাতে কী করে শিশুপালন করবে?

কৃষ্ণনগরে রানীমাকে যে যুক্তি শুনিয়েছিলেন এখানেও সেই একই কথা অনর্গল বলে গেলেন। দুর্ভাগ্য রূপেন্দ্রনাথের; দেখা গেল পুরীর শঙ্করাচার্য, নদীয়ারাজ মহিষী এবং পণ্ডিতপ্রবর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন একই মতের পোষক।

দেশে এখন মুসলমান শাসন। শাসক সম্প্রদায় কী হিন্দু, কী মুসলমান—কী অঙ্গে, বঙ্গে অথবা কলিঙ্গে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে। ইসলামের কী নির্দেশ জানা নেই, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ঘরানা ঘরের মুসলমান মহিলা গৃহাবরোধের বাহিরে আসেন না। নিতান্ত বাধ্য হলে বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে পথে নামেন।

হিন্দুস্থানে, প্রাক্-মুসলমান যুগে, নারীসমাজের এতটা বাধ্যবাধকতা ছিল না। তারা অনায়াসে অনবগুণ্ঠিতা অবস্থায় পথে ঘাটে যাতায়াত করত। অজন্তাগুহার কোনও প্রাচীর চিত্রে অবগুণ্ঠিতা নারী চিত্রায়িতা হয়নি। অজন্তা ষোড়শ গুহাবিহারে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের পাঠশালায় একটি বালিকার চিত্র আজও দেখতে পাওয়া যায়। নারীর বিদ্যাভ্যাসে কোনও বাধানিষেধ ছিল না। প্রাচীরচিত্রটি প্রাক-মুসলমান যুগে, অষ্টম শতাব্দীতে অঙ্কিত।

কিন্তু ভারতের শাসনভার যখন ক্রমে ক্রমে বহিরাগত মুসলমান আগন্তুকদের কব্জায় চলে গেল তখন হিন্দুনারীরা হারালো তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা। পথে-ঘাটে অনবগুণ্ঠিত পরিভ্রমণ হয়ে উঠল অত্যন্ত বিপদজনক। আরব-পারস্য থেকে পুরুষ মুসলমানেরাই এসেছে দলে দলে, নারীরা নয়। ফলে হিন্দুনারী অপহরণের মাত্রা অত্যন্ত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাধ্য হয়ে হিন্দুনারীদেরও গৃহাবরোধের নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার আয়োজন হল। অনবগুণ্ঠ নিরঙ্কুশ মুক্তি এবং বোরখায় সর্বায়ববের বন্ধনদশার মাঝামাঝি ব্যবস্থা হল : অবগুণ্ঠন! মাপে তা ছোট-বড় করা যায় প্রয়োজন অনুসারে। বয়ঃকনিষ্ঠ ঠাকুরপোর সম্মুখে যা ‘আধো-ঘোমটা’, ঠাকুর বা ভাশুরের সামনে তাই ‘আবক্ষ।’

মৈত্রেয়ী, গার্গী, বিশ্ববারা, মদালসার উত্তরসূরীরা সামাজিক বিবর্তনে ডাইনোসর- ডোডোদের সমগোত্রীয় হয়ে উঠলেন। মনুসংহিতায় প্রক্ষিপ্ত হল কালোপযোগী নববিধান : ‘অষ্টম বর্ষে তু ভবেৎ গৌরী;’ ‘পথি নারী বিবর্জিতা’ এবং

‘পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রাঃ ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমহতি।।’

এই যুক্তিগুলিই শুনিয়ে গেলেন তর্কপঞ্চানন তাঁর প্রিয় শিষ্যকে।

রূপেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করলেন না, তর্ক করলেন না, নীরবে নতমস্তকে শুধু শুে গেলেন। সেটাই ছিল সে-কালের শিষ্টাচার। অগাধবিদ্য হওয়া সত্ত্বেও, অসীম প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর গুরু জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন সেই অনবদ্য বিনাসুতোয় গাঁথা ‘ভারত-সংস্কৃতি মালার’ একটি রত্নখণ্ড হতে পারবেন না কোনদিন রূপেন্দ্রনাথের যে মালিকায় গাঁথা আছেন: বাল্মীকি—বশিষ্ঠ–বেদব্যাস যাজ্ঞবল্ক্য—ঋষি গৌতম— বুদ্ধ গৌতম–অশোক—শঙ্করাচার্য—নানক– শ্রীচৈতন্য!

গুরুদেব প্রশ্ন করলেন, কী করবে অতঃপর? কী মনস্থ করেছ?

—এখনই তা স্থির করে উঠতে পারছি না।

—আমার কথা শোন : পুনরায় দারপরিগ্রহ কর। ভবতারণের কন্যাটিকে যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে আমাকে বল, আমি তোমার মনোমত একটি সৎবংশের সর্বাঙ্গসুন্দরী কুলীনকন্যার ব্যবস্থা করে দিই।

রূপেন্দ্র যুক্তকরে বলেন, এমন আদেশ করবেন না, গুরুদেব।

—না, না, আদেশ নয়, পরামর্শ।

—গুরুদেবের পরামর্শ মানেই আদেশ। আমি পুনরায় বিবাহ করব না, এ বিষয়ে স্থিরসিদ্ধান্ত নিয়েছি।

—তাহলে এক কাজ কর। আমার বিদ্যানিকেতনে নিজেকে যুক্ত করে দাও। ত্রিবেণীতে নয়, উখুড়া পরগণায়। সেখানে নদীয়ারাজ আমাকে সাতশত বিঘা আউশ ধানের জমি দান করেছেন। তার ভিতর কিছু বন্ধ্যা ঊষর ডাঙা জমি আছে। তুমি সেখানে একটি গৃহনির্মাণ কর। সেখানে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপনের আয়োজন কর। চতুর্বেদের আলোচনা ত্রিবেণীতে আমিই করছি—তুমি পঞ্চমবেদ অর্থাৎ আয়ুর্বেদ-মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষপদ গ্রহণ কর। যাবতীয় ব্যয়ভার আমার। তোমাকে উপযুক্ত সম্মানদক্ষিণা প্রদানের ব্যবস্থাও থাকবে।

এবারও অস্বীকৃত হলেন রূপেন্দ্রনাথ। বললেন, বাবামশাই আমাকে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করতে যখন পাঠিয়েছিলেন তখনই বলেছিলেন, সোঞাই গ্রামের ত্রিসীমানায় কোনও কবিরাজ নাই। তুমি স্বগ্রামে আর্তের সেবা করবে। এ জন্য নদীয়ারাজের প্রস্তাব পর্যন্ত আমি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছি। দ্বিতীয় কথা : আমি যেখানেই বসবাস করি না কেন, সেখানে একটি পাঠশালা খুলব, ক্রমে চতুষ্পাঠী। তাতে শুধু বালিকা এবং কিশোরীরাই সারস্বত সাধনায় ব্রতী হবে। সে কাজ উখড়ায় হবে না। নদীয়ারাজ স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের বিরুদ্ধে। আপনিও তো দেখছি তাই!

জগন্নাথ বাধ্য হয়ে রূপেন্দ্রকে বিদায় জানাতে স্বীকৃত হলেন। ভাল একটি অধ্যাপক হাতছাড়া হয়ে গেল। উপায় কী? লোকটা পণ্ডিত, কিন্তু ঐ : একবগ্গা!

বললেন, ঠিক আছে রূপেন্দ্রনাথ, তুমি যদি নিতান্তই সোঞাই গাঁয়ে ফিরে যেতে চাও আমি বাধা দেব না। তবে যাবার আগে আমার একটি আত্মীয়কে একবার দেখে যাও। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা তো দূরের কথা রোগটা কী তাও নির্ণীত হয়নি। বড়ই দুর্ভাগা সে।

—রোগীটি কে? আর রোগের উপসর্গ কী?—রোগী আমার ভাগিনেয়। আর রোগ আমরা এ পর্যন্ত যা অনুমান করেছি তা বিচিত্র! সে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে থাকে দু-তিন মাস অথবা বছরের পর বছর, তারপর হঠাৎ তার জ্ঞান ফিরে আসে, পাঁচ-সাত দিনের জন্য। তখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। কেন যে উন্মাদ হয়ে যায়, আবার কেনই বা তার জ্ঞান ফিরে আসে আমরা কিছুই বুঝতে পারি না।

—তাঁর বয়স কত? কতদিন ধরে এ রোগের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে? তাঁর সম্বন্ধে আর কী কী তথ্য জানাতে পারেন?

—বলছি বাবা। শোন বিস্তারিত।

রোগীর নাম ঘনশ্যাম সার্বভৌম। আমাদের কাহিনীর কালে তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ। ঘনশ্যাম ছিলেন অলোকসামান্য ক্ষণজন্মা এক মহাপণ্ডিত। বিশ্বাস করা কঠিন যে, তিনি সে-কালীন গৌড়মণ্ডলের সর্ববিখ্যাত মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে প্রতিটি বিষয়ে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন–বিদ্যা, বুদ্ধি, মেধা, প্রতিভা এবং, হ্যাঁ, স্মরণশক্তিতেও!

এখানে ঔপন্যাসিক হিসাবে কিছু কৈফিয়ৎ অনিবার্য। প্রকৃতপক্ষে ‘ঘনশ্যাম সার্বভৌম’ একজন ঐতিহাসিক বাস্তব চরিত্র। তিনি ছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কনিষ্ঠপুত্র কৃষ্ণচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপুত্র। এই অলোকসামান্য পৌত্রটির প্রসঙ্গে স্বয়ং জগন্নাথ লিখে গেছেন, “বাগদেবীর কৃপায় আমি তাঁহার প্রসাদ কিছু কিছু লাভ করিয়াছি বটে, কিন্তু পৌত্র ঘনশ্যাম যে প্রসাদ লাভ করিয়াছে তাহা আমার সৌভাগ্যকে অনায়াসে অতিক্রম করিয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ যৌবনকালেই সে ঘোর উম্মাদ হইয়া যায়” (‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ অনুসারে)।

অথচ ‘সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান’ অনুসারে; “প্রথম সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হলে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে প্রধান পণ্ডিতের পদগ্রহণে আহ্বান করা হয়। তিনি অস্বীকৃত হলে পৌ ঘনশ্যাম এই পদে নিযুক্ত হন।”

মনে হয়, কোথাও কিছু গণ্ডগোল আছে। “যৌবনকালেই ঘোর উম্মাদ” হয়ে গেলে জগন্নাথের শেষ জীবনে ঘনশ্যাম সুপ্রীম কোর্টের প্রধান পণ্ডিত হতে পারেন না।

তবে এসব গবেষণা ঐতিহাসিকদের জন্য মুলতুবি থাক। আমরা সাহিত্যরসের কারবারী। ইতিহাসের কাছ থেকে একটি ব্যর্থ ক্ষণজন্মার নামটুকু গ্রহণ করেছি মাত্র। আমাদের কল্পনায় এই ঘনশ্যাম পৃথক চরিত্র। তিনিও অসাধারণ পণ্ডিত, যৌবনেই ঘোর উম্মাদ হয়ে যান। কিন্তু তিনি মহাপণ্ডিত জগন্নাথের পৌত্র নন, ভাগীনেয়।

ঔপন্যাসিক-কল্পিত ঘনশ্যামের পিতা অর্থাৎ জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ভগিনীপতি গঙ্গাপ্রসাদ তর্কতীর্থের ঐ একটিই বৃদ্ধবয়সের সন্তান। আঠার বৎসর বয়সে পুত্রের পুনরায় মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখে জগন্নাথের পরামর্শেই তিনি তড়িঘড়ি পুত্রের বিবাহ দিলেন। পাত্রী ধনীর দুলালী, কুলীন এবং জগন্নাথের পৃষ্ঠপোষক যজমান। একটি বংশধরের নিতান্ত প্রয়োজন ছিল গঙ্গাপ্রসাদের। দত্তকপুত্র গ্রহণে উদ্দেশ্যসিদ্ধি হবে না। দানপত্রে দত্তকপুত্রের ব্যবস্থা নেই! হেতুটি বিচিত্র, জটিল এবং মর্মান্তিক।

গঙ্গাপ্রসাদ চক্রবর্তী এক বিশাল দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত। সাতপুরুষ ধরে ওঁরা এই সম্পত্তি ভোগ করে আসছেন দেবতার অছি হিসাবে। বংশের আদিপুরুষ, প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে, ছিলেন নিতান্ত গরিব, জমিদারের গৃহদেবতার নিত্যপূজার পুরোহিত। কিন্তু তাঁর ছিল একটি রূপসী লক্ষ্মীপ্রতিমাপ্রতিম সুন্দরী কন্যারত্ন : সতী।

তদানীন্তন জমিদার মশাই পুরোহিত-কন্যার রূপগুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিনা পণে পুত্রবধূ করে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস! রাজসুখ সেই অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েটির ভাগ্যে লেখা নেই। সর্পাঘাতে জমিদার পুত্রের মৃত্যু হল। সদ্যবিবাহিতা, স্বনামধন্য সতী, সহমরণে গেল। বধূমাতার স্মরণে জমিদার শর্তসাপেক্ষে একটি সতীমায়ের মন্দির ও একটি তালুক চক্রবর্তী পরিবারকে দান করেন যান। গোটা তালুকের আদায় থেকে রাজসরকারের খাজনা দিয়েও প্রচুর উদ্‌বৃত্ত থেকে যায়। শর্তটি অকিঞ্চিৎকর। আদি সতীমায়ের পদাঙ্ক অনুসরণে প্রতিটি পুরুষে বংশের জ্যেষ্ঠপুত্রের দেহান্তে তাঁর সহধর্মিণীর ভিতর অন্তত একজনকে সহমরণে যেতে হবে। চক্রবর্তী পরিবার প্রায় ছোটখাটো একটি জমিদারই।

ঘনশ্যামের পিতামহী বংশের শেষ সতী। গঙ্গাপ্রসাদের দেহান্ত হলে তাঁর দুই সহধর্মিণীর মধ্যে যে কোন একজন সহমরণে যাবেন। কিন্তু তার পরের পুরুষে? ঘনশ্যাম অপুত্রক অবস্থায় লোকান্তরিত হলে চক্রবর্তী পরিবার সেবায়েতের অধিকার হারাবে। সম্পত্তি জমিদারে খাস হয়ে যাবে। জমিদার নুতন সেবায়েত নিয়োগ করবেন।

মাত্র সতের বৎসর বয়সেই ঘনশ্যাম ‘সার্বভৌম’ উপাধি লাভ করেছে বাণেশ্বর বিদ্যাবিনোদের চতুষ্পাঠী থেকে। সে দিবারাত্র পুঁথি মুখে নিয়ে পড়ে থাকে। পাগলের মতো কীসব সাধন-ভজনও করে। পিতা চতুর্দশবর্ষীয়া যে মেয়েটিকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনলেন ঘনশ্যাম তার প্রতি কৌতূহলী হল না আদৌ। বাস্তবে সে তখন উন্মাদ; বছর-কয়েক অপেক্ষা করে পৌত্রের আগমন সম্ভাবনা না দেখতে পেয়ে গঙ্গাপ্রসাদ পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে পুরুষোত্তমধামে চলে যান। পুত্রবধূর সন্তান কামনায় সাড়ম্বরে পুরশ্চরণাদি দৈবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। তাঁর উপর প্রত্যাদেশ হয়, “তোমার পুত্রবধূর গর্ভে এক অমূল্যরত্ন পুত্রসন্তান জন্মগ্ৰহণ করিবে। তাহার নাম রাখিও বলভদ্র।”

অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল স্বয়ং জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ক্ষেত্রেও। প্রভেদ এই যে, জগন্নাথের পিতা রূদ্রদেব তর্কবাগীশের বয়স তখন ছিল ছয়ষট্টি বৎসর আর ঘনশ্যাম মাত্ৰ বাইশ বৎসরের যুবক।

গঙ্গাপ্রসাদের স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাসের ভিতরেই তাঁর পুত্রবধূর গর্ভসঞ্চারের লক্ষণ দেখা গেল। কালে তিনি নাতির মুখ দেখলেন। বলাবাহুল্য তার নাম রাখা হল : বলভদ্র চক্রবর্তী।

ঘনশ্যামের মস্তিষ্কবিকৃতির অবশ্য কোনও উন্নতি হল না। ক্রমে ক্রমে তিনি ঘোর উম্মাদ হয়ে গেলেন। শুধু কী-এক বিচিত্র কারণে বছরের মধ্যে দু-চারবার তিনি স্বাভাবিক হয়ে যান। সচরাচর পরবর্তী পূর্ণিমা পর্যন্ত তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে মনে হয়। তারপর পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে উদিত হলেই পূর্ণচন্দ্রদর্শনে ঘনশ্যামের চিন্তার পারম্পর্য হারিয়ে যায়। আহারে রুচি থাকে না, পরিধানে থাকে না বস্ত্রখণ্ড। বাক্যালাপ সম্পূর্ণ বন্ধ। পদ্মাসনে বসে থাকেন প্রহরের পর প্রহর। আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকেন। ইদানীং বছরে নয় মাস!

আজ বিশ বছর হল ঘনশ্যাম চিকিৎসার বাহিরে।

ইতিমধ্যে গঙ্গাপ্রসাদ স্বর্গলাভ করেছেন। সহমরণে গেছেন ঘনশ্যামের বিমাতা। আইনত ঘনশ্যামই এখন সেবায়েত। তাঁর আমমোক্তারনামা নিয়ে বাস্তবে ঘনশ্যামের যুবকপুত্র বলভদ্ৰই এখন সতীমা-তালুকের আদায়পত্র দেখে, বস্তুত তালুকদারী করে।

রোগীর যাবতীয় পূর্ব ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত হয়ে রূপেন্দ্র এবং তাঁর গুরু এসে উপস্থিত হলেন সতীমা-তালুকের ‘মায়ের বাড়ি’ গাঁয়ে। এখানকার তালুকদার-বাড়িই হচ্ছে চক্রবর্তীবাড়ি। জগন্নাথের বোনাইবাড়ি। ভগিনীপতি গঙ্গাপ্রসাদ গত হয়েছেন, ভগিনীও গেছেন সহমরণে; কিন্তু ঘনশ্যামের প্রতি জগন্নাথের একটা দুর্বলতা বরাবরই আছে। আহা! কী প্রতিভার কী পরিণাম!

সে দিন সকালে জগন্নাথ এলেন পাকিতে, রূপেন্দ্র অশ্বারোহণে। সংবাদ দেওয়াই ছিল। বলভদ্র আদর-আপ্যায়ন করে ওঁদের নিয়ে গিয়ে বসালো বৈঠকখানায়। প্রণাম করল দুজনকেই।

জগন্নাথ বলভদ্রকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। বলভদ্রের পিতা সার্বভৌম, পিতামহ তর্কতীর্থ অথচ বলভদ্র পাঠশালার চৌকাঠ ডিঙাতে পারল না। বংশের কুলাঙ্গার! বলভদ্র সে-কথা জানে; তর্কপঞ্চাননকে শ্রদ্ধা না করলেও সে ভয় করে যথেষ্ট। উপরমহলে তাঁর অগাধ প্রতিপত্তি। কোতোয়াল তাঁর ইচ্ছামাত্র যেকোন মানুষের হাতে মাথা কাটে!

দ্বিতলের একটি কক্ষে বলভদ্র নিয়ে এল ওঁদের দুজনকে। শয়নকক্ষটি বাহির থেকে অর্গলবদ্ধ ছিল। অর্গল মোচন করে ওঁরা তিনজনে গৃহমধ্যে প্রবেশ করলেন। কক্ষটি বৃহৎ। ঘরের একপ্রান্তে বড় পালঙ্ক। কিন্তু গৃহের একমাত্র বাসিন্দা বসে আছেন পদ্মাসনে ভূশয্যায়। সম্পূর্ণ নগ্ন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। একমুখ দাড়ি-গোঁফ। রুদ্ধদ্বারের অর্গলমোচন হল, ঘরে তিনজন আগন্তুক প্রবেশ করলেন, কিন্তু কক্ষের একমাত্র বাসিন্দার কোনও প্ৰতিক্ৰিয়া হল না। তর্কপঞ্চানন বললেন, কী? কেমন আছ ঘনশ্যাম?

উন্মাদ নির্বাক। নিস্পন্দ। জগন্নাথ তাঁর দিকে অগ্রসর হবার উপক্রম করতেই বাধা দিল বলভদ্র। বলল, বাবামশাই মাঝে মাঝে একেবারে ক্ষেপে ওঠেন। আক্রমণ করে বসেন। ওঁর কাছে যাবেন না। দূর থেকে যা হয় করুন।

জগন্নাথ জানতে চাইলেন, সকাল-সন্ধ্যা ওকে আহার্য-পানীয় দিয়ে যায় কে? শৌচাগারে নিয়ে যায়, স্নান করিয়ে দেয় কে?

—ছোট-মা। একমাত্র তাঁকেই উনি সহ্য করেন। আমাকে অথবা বড়মাকে একেবারেই সহ্য করেন না। ঝি-চাকর কেউ কাছে যেতে সাহস পায় না।

রূপেন্দ্র বলে ওঠেন, সে-ক্ষেত্রে তোমার ছোটমাকে এখানে পাঠিয়ে দাও। আর তুমি ঘরের বাইরে যাও। ওঁর মেজাজটা খারাপ করতে চাই না।

বলভদ্র এককথায় মেনে নিল। তার প্রস্থানের একটু পরেই একটি যুবতী আবক্ষ- অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে দ্বারের প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। জগন্নাথ তাঁকে বললেন, ভিতরে এস ছোট বৌমা। ইনি আমার একজন প্রিয় ছাত্র। বর্তমান গৌড়মগুলের বিশ্রুতকীর্তি শ্রেষ্ঠ কবিরাজ। ওকে আমি নিয়ে এসেছি ঘনশ্যামের চিকিৎসার জন্য। ও যা যা জানতে চাইবে অকুণ্ঠচিত্তে জানাবে…

রূপেন্দ্র বললেন, গুরুদেব! আপনি সম্পর্কে ওঁর মামাশ্বশুর। ওঁদের দাম্পত্য-জীবন সম্বন্ধে আমি হয়তো এমন প্রশ্ন…

বাক্যটা শেষ হল না। জগন্নাথ বললেন ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমিও না হয় বাইরে যাই।

রূপেন্দ্রনাথ বললেন তাই যান। বলভদ্রকে আগলে রাখবেন। দেখবেন, এ-ঘরে কোনমতেই কেউ যেন না আড়ি পাতে।

জগন্নাথ প্রখর বুদ্ধিমান। গ্রীবাসঞ্চালনে সম্মতি জানিয়ে নিষ্ক্রান্ত হলেন। রূপেন্দ্র ভিতর থেকে কবাটটি অর্গলবদ্ধ করে যুবতীর দিকে ফিরে বললেন, মা! আমি চিকিৎসক! আপনার স্বামী মানসিক রোগী। আমার কাছে লজ্জা করলে তো চলবে না, মা! আপনি অবগুণ্ঠন অপসারিত করুন।

মেয়েটি লজ্জা পেল না। অকুণ্ঠচিত্তে মাথার ঘোমটা কিছুটা সরিয়ে রূপেন্দ্রর চোখে- চোখে তাকালো। এগিয়ে এসে রূপেন্দ্রর পদধূলি নিল। অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়ে স্বামীর পদপ্রান্তেও নামিয়ে রাখল অস্পর্শিত একটি প্রণাম। ঘনশ্যাম নির্বিকার। পদ্মাসনে বসে আছেন। চোখ দুটি কিন্তু খোলা। সে-চোখে পাগলের ঘোলাটে দৃষ্টি।

রূপেন্দ্র লক্ষ্য করে দেখলেন, মেয়েটির বয়স ঊনিশ-কুড়ি। শ্যামবর্ণা, স্বাস্থ্যবতী। পল্লীবাঙলার একটি শ্যামশ্রী যেন তার কানায় কানায় ভরা তনুদেহকে ঘিরে আছে। ওর অঙ্গে আভরণ অল্প, পায়ে আলতা, সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে টিপ। বাঙলামায়ের প্রতিমূর্তি।

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, উনি তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন না?

অজান্তেই ‘তুমি’ সম্বোধন। ওঁর কেন যেন মনে হল ছোট বোন কাত্যায়নীর সঙ্গে কথা বলছেন, অথবা মৃন্ময়ী, কিংবা মঞ্জরীই।

মাথা নেড়ে মেয়েটি জানালো : না।

—দুর্ব্যবহার তো করেন না, কিন্তু আদর-সোহাগ? নির্জন ঘরে?

নিরতিশয় লজ্জায় এবার নতনেত্র হল। জবাব দিল না।

রূপেন্দ্র বললেন, তুমি যদি আমাকে সব কথা খোলাখুলি না বল, মা, তাহলে আমি ঐ মানসিক রোগীর চিকিৎসা কেমন করে করব বল? ও পাগল তো নিজে থেকে কোন কথা বলবে না। এইমাত্র শুনলাম একমাত্র তোমাকেই সে বরদাস্ত করে, তোমার কথা শোনে। ফলে, তোমাদের দাম্পত্য জীবনের সব কথা, হ্যাঁ সব কথা আমাকে জানাতে হবে। আমি চিকিৎসক, ধন্বন্তরির কাছে আমার প্রতিজ্ঞা করা আছে যে, রোগীর গোপন কথা আমি গোপন রাখব। আমার কাছে লজ্জা করতে নেই, মা। বল, কত দিন হল বিবাহ হয়েছে তোমাদের?

—গত ফাল্গুনে। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়ায়।

–তার মানে তের মাস। দীর্ঘ সময়! বিবাহের সময় উনি সুস্থ ছিলেন?

নেতিবাচক গ্রীবাভঙ্গি করে মেয়েটি।

রূপেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন, তাহলে বিবাহের মন্ত্র উনি উচ্চারণ করলেন কেমন করে?

—করেননি তো!

—তাহলে বিবাহটা সিদ্ধ হয় কী করে? কুশণ্ডিকার প্রতিজ্ঞা, মন্ত্রোচ্চারণ ব্যতিরেকে তো বিবাহ সিদ্ধ বলে গ্রাহ্য হবে না!

মেয়েটি এতক্ষণ নতনেত্রে জবাব দিয়ে যাচ্ছিল, এবার হঠাৎ রূপেন্দ্রের চোখে-চোখ তাকিয়ে বললে, ত্রিবেণীর মহাপণ্ডিত বিধান দিলে সেই অশাস্ত্রীয় বিবাহও সিদ্ধ! অস্বীকার করবার হিম্মৎ কার আছে বলুন?

অবাক হলেন রূপেন্দ্রনাথ। বললেন, তার মানে ঐ পাগলটাকে তুমি অন্তর থেকে নিজের স্বামী বলে মান না, যেহেতু তোমাদের বিবাহটাই অসিদ্ধ। তবে যেহেতু ত্রিবেণীর মহাপণ্ডিত নিদান হেঁকেছেন তাই…

মেয়েটি বাধা দিয়ে বলল, আপনি আমার কথা কিছুই বুঝতে পারেননি। আমি মোটেই তা বলতে চাইনি। ওঁকে আমি স্বামী বলেই মানি। আমার পতিদেবতা বলেই মনে-প্রাণে স্বীকার করি। উনি পাগল কি স্বাভাবিক, উনি কুশণ্ডিকায় কোন্ কোন্ মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না! আমি নিজের বিবেকের নির্দেশে চলি।

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, তোমার কথায় আমি ক্রমেই মুগ্ধ হয়ে উঠছি, মা! তুমি বস। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। প্রথমে বল, তোমার নামটি কী?

—মালতী।

—বাঃ সুন্দর নাম। তুমি বললে, বিয়ের সময় তোমার স্বামীর মানসিক সুস্থতা ছিল না। তবে তিনি স্বাভাবিক হলেন কত দিন পরে?

মালতী নতনেত্রে বললে, ঐ ফাল্গুনের কৃষ্ণা ষষ্ঠী তিথিতে।

—বাঃ! তিথিটাও তোমার মনে আছে?

একটু চিন্তা করে পুনরায় বললেন, ও! বুঝেছি। তার হেতুটি কি এই যে, সেটা ছিল তোমাদের ফুলশয্যার রাত? তৃতীয়া থেকে ষষ্ঠী–তিনটি তিথি?

মালতী আঁচল দিয়ে মুখটা ঢাকল। গ্রীবা সঞ্চালনে স্বীকার করল কিন্তু। রূপেন্দ্রনাথ অম্লানবদনে পরস্ত্রীর মণিবন্ধটি ধরলেন। মালতী শিউরে উঠল। রূপেন্দ্র জোর করে ওর মুখ থেকে আঁচলটা সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মা’ বলে ডেকেছি তোমাকে। আমাকে সবকথা বলতে হবে, মালতী! বল, কতদিন তিনি সেবার সুস্থমস্তিষ্ক ছিলেন?

মালতী বললে, পূর্ণিমা পর্যন্ত।

—তার মানে পঁচিশ দিন। সে তো দীর্ঘ সময়। তার মধ্যে তোমাদের ভাবসাব হয়নি? উনি তোমাকে স্ত্রী হিসাবে কি মেনে নিয়েছিলেন এই পঁচিশদিনের ভিতর?

মালতী সঙ্কোচ করল না। বলল, জ্ঞান ফিরে আসার পর একবার মাত্র প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কে? এখানে কেন?’ তারপরেই ফুলে-ছাওয়া বিছানাটা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন ‘ও! তোমার সঙ্গে আমার বুঝি বিয়ে হয়েছে? তোমার বুঝি আজ ফুলশয্যা?’—এই পর্যন্ত বলে মালতী থামল।

রূপেন্দ্র বলেন, তারপর?

—কী তারপর? আপনি কি সব কিছুই শুনতে চান? তা কি বলা যায়?

রূপেন্দ্র বললেন, না, বলা যায় না। আমি জানি—বুঝিয়ে তা বলা যায় না! সব কথা বলা যায় না। কিন্তু রোগনির্ণয়ের জন্য যেটুকু আমার জেনে নেওয়া দরকার সেটুকু যে আমাকে জানতেই হবে, মালতী।

মালতী অসহায়ের মতো তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখে। পদ্মাসনে নির্বাক বসে আছে পাগলটা। এঁদের কথোপকথন হয়তো ওর শ্রুতিতে প্রবেশ করছে, মস্তিষ্কে কোনও অনুরণন জাগাচ্ছে না। রূপেন্দ্র বলেন, তোমাকে বউ বলে চিনতে পারার পরে, ওটা তোমাদের ফুলশয্যা এ কথা বুঝতে পারার পরেও তোমাকে আদর-সোহাগ করেননি? চুমু-টুমু খাননি?

দুরন্ত লজ্জায় মেয়েটি আবার দু-হাতে মুখ ঢাকে। রূপেন্দ্র সহজ হবার জন্য বলেন, তোকে দেখতে ঠিক আমার ছোট বোন কাত্যায়নীর মতো। আমি কিন্তু কাতুর কাছে স্বীকার করেছিলাম যে, ফুলশয্যার রাত্রেই আমি…

মালতী মুখ থেকে কাঁকন-পরা হাত দুটি সরালো। কৌতূহলী দু-চোখ অন্যদিকে মেলে অপেক্ষা করল অসমাপ্ত বাক্যের শেষাংশ শোনার জন্য। রূপেন্দ্র নীরব আছেন দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার চোখে-চোখে তাকালো। বলল, কী? কী কথা?

—ঐ যেকথা জিজ্ঞেস্ করছিলাম। চুমু খাওয়ার কথা।

আবার ওর মুখটা নেমে পড়ল বুকের উপত্যকায়।

রূপেন্দ্র এবার অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন, তোমার বিয়েতে বোধহয় বরপণ লাগেনি। না?

আবার চোখে-চোখে তাকালো। বলল, বরপণ! কী বলছেন আপনি! বলভদ্র আমার মামাকে পাঁচ শ সিক্কা তঙ্কা কন্যাপণ দিয়েছে! তাছাড়া পঞ্চাশ বিঘে ধানীজমি!

—কেন? মামাকে কেন? তোমার বাবা…

—না! কেউ নেই আমার! বাবা-মা-ভাই-বোন–নিজের বলতে কেউ নেই! মামার সংসারে মানুষ হচ্ছিলাম। মামার তিন-তিনটে আইবুড়ো মেয়ে। মামারা কুলীন। অনেক টাকা লাগবে। তাই তো আমি…

—কী? জেনে-বুঝে পাগলকে বিয়ে করলে?

মৌনতা যদি সম্মতির লক্ষণ হয় তবে বলতে হবে মালতী অভিযোগটা স্বীকার করে নিল। রূপেন্দ্র তখন প্রশ্ন করেন, পাগলকে বিয়ে করছ, শুধু এটুকুই কি জানতে? নাকি…

—নাকি?

—বিয়ের আগে তুমি জানতে অত টাকা খরচ করে বলভদ্র কেন তার বাপের বিয়ে দিয়ে আনল?

রূপেন্দ্রের চোখে-চোখ রেখে মালতী বলল, জানি। জানতাম। ওর নিজের মাকে চিতার আগুন থেকে বাঁচাতে! না হলে সেবায়েতি হাতছাড়া হয়ে যাবে!

রূপেন্দ্র বিনাদ্বিধায় ওর শাঁখা-পরা হাতটা চেপে ধরে বললেন, তাও যদি জান মালতী, তাহলে কেন আমাকে সাহায্য করবে না? ঐ বলভদ্র আর তার মায়ের পৈশাচিক চক্রান্ত ব্যর্থ করতে? বল? সব কথা খুলে বল আমাকে। ঘনশ্যাম যখন স্বাভাবিক থাকেন তখন কি তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন? তোমাকে নিয়ে বিছানায় শোন? তোমার নারীজন্ম সার্থক করতে…

মালতী হঠাৎ ঝর্ঝর্ করে কেঁদে ফেলে। রূপেন্দ্র সলজ্জে ওর হাত ছেড়ে দেন। মালতী ও-পাশ ফিরে তার স্বামীর দিকে চকিতে দৃকপাত করে। রূপেন্দ্রনাথ তিলমাত্র নড়াচড়া করেন না। কারণ তিনি প্রথম থেকেই এমন একটি স্থানে দণ্ডায়মান হয়েছিলেন যেখানে দাঁড়িয়ে গ্রীবা সঞ্চালন না করেও প্রাচীরে প্রলম্বিত একটি দর্পণে রোগীকে দেখা যায়। না ঘনশ্যাম, না মালতী, কেউই জানে না রূপেন্দ্র এতক্ষণ প্রশ্ন করছিলেন মালতীকে কিন্তু লক্ষ্য করে চলেছেন সে প্রশ্নের কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তার পিছন দিকে উপবিষ্ট ঐ পাগলটার মুখে—দর্পণ প্রতিবিম্বে। এবারও দেখলেন ঘনশ্যাম না-য়ের ভঙ্গিতে গ্রীবা-সঞ্চালন করলেন। রূপেন্দ্র স্থিরসিদ্ধান্তে এলেন। বললেন, ঠিক আছে, মালতী, তুমি এবার যাও। কিন্তু তুমিও দেখ, কেউ যেন আড়ি না পাতে। তোমার মঙ্গলের জন্য, তোমার স্বামীর মঙ্গলের জন্য।

মালতী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে শয়নকক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হল। রূপেন্দ্র কবাটটি অর্গলবদ্ধ করে ঘনশ্যামের মুখোমুখি হলেন। ঘনশ্যাম নির্বিকার। রূপেন্দ্র উপবীতটিকে ব্যতিক্রম করে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হলেন। উদাম পাগলের অনুকরণে উদাম উলঙ্গ!

ঘনশ্যাম বসেছিলেন পদ্মাসনে। উনি বসলেন বদ্ধ-পদ্মাসনে। এক বদ্ধ পাগলের মুখোমুখি আর এক বদ্ধ পাগল!

আমরা মনে ভাবি : পাগলে যা খুশি তাই করতে পারে। তা কিন্তু পারে না সে। সঙ্গত কারণে সে হাসতে পারে না, নিদারুণ দুঃখজনক ঘটনায় বেচারি কাঁদতেও পারে না। বিস্ময়কর ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখলে অবাক হবার অধিকার তার নেই। ঘনশ্যাম যেন পাগল, রূপেন্দ্র তো তা নন। তিনি যখন সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ওঁর সামনে বসলেন পদ্মাসনের উপর টেক্কা দিয়ে বদ্ধপদ্মাসনে, তখন ঘনশ্যাম বিস্ময়ে বিস্ফারিতনেত্রও হতে পারলেন না। সামান্য নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন, কস্ত্বম্?

পাগল মানুষ তো তাই শাদা-বাঙলায়, ‘তুমি কে?’ প্রশ্নটা মাথায় এল না।

কিন্তু রূপেন্দ্র যে আরও বড় জাতের পাগল! পাগলামির প্রতিযোগিতায় হার মানবেন কেন? বললেন : ‘যাজ্ঞবল্ক্যোহম্’।

ঘনশ্যাম তৎক্ষণাৎ মেনে নিলেন। এমনটা তো হতেই পারে! ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এসে বদ্ধপদ্মাসনে বসেছেন ওঁর সামনে। তাই বিশুদ্ধ বৈদিক ভাষার প্রশ্ন করলেন, ভো ভো যাজ্ঞবল্কঃ! এক্ষণে এই জটিল প্রশ্নের যথাযোগ্য উত্তর প্রদান করহ! এই যে নভোলোকের ঊর্ধ্বস্থিত দ্যুলোক তাহারও ঊর্ধ্বে কী রহিয়াছে? এবং তৎসহ ইহাও কহ : এই যে অধস্থ পৃথিবী তাহার তলদেশে কী বর্তমান? অপিচ : এই যে নিরবলম্ব দ্যুলোক-ভূলোক তাহাদের অভ্যন্তরে কোন ধারণশক্তি রহিয়াছে যাহাতে তাহারা বিযুক্ত বা কক্ষচ্যুত হইতেছে না?

রূপেন্দ্র বললেন, শৃণ্বন্তু সুপণ্ডিতা গার্গী! দ্যুলোক-ভূলোক আদৌ নিরবলম্ব নহে। তাহারা একমেবাদ্বিতীয় সূত্রাত্মায় গ্রথিত! অপিচ অবধান কর : সেই সূত্রাত্মাই ব্ৰহ্ম!

ঘনশ্যাম ঘন ঘন মাথা নাড়লেন। মনে হল উত্তরটি তাঁর মনমতো হয়েছে। তিনি আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বাধা পেলেন। রূপেন্দ্র একটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ক্ষান্ত হোন, সার্বভৌম! আপনি আর অতি-প্রশ্ন করবেন না। এর পরেও পাগলের ঢং ধরে বসে থাকলে আপনার মস্তকপাতন হবে!

ঘনশ্যাম তৎক্ষণাৎ পদ্মাসন পরিত্যাগ করে শবাসনে শায়িত হলেন।

রূপেন্দ্রও যোগাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন। রজ্জুতে প্রলম্বিত একটি গাত্রমার্জনী নিয়ে সার্বভৌমের কোলের উপর ফেলে দিলেন। নিজেও বস্ত্র পরিধান করতে করতে বললেন, এবার বলুন, এভাবে কেন পাগল সেজে বসে আছেন?

ঘনশ্যাম উঠে বসলেন। বস্ত্রখণ্ডটি কটিদেশে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, আপনি আমার অপরিচিত নন। আপনি যখন মাতুলশ্রীর চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন করতেন তখন আপনাকে দেখেছি…

রূপেন্দ্র বলেন, এটা আমার প্রশ্নের সদুত্তর হল না, সার্বভৌমমশাই।

—জানি। বলছি। তার পূর্বে বলুন, কেমন করে বুঝলেন যে, আমি উন্মাদের অভিনয় করছি মাত্র, উম্মাদ নই?

প্রাচীরে প্রলম্বিত দর্পণটিকে নির্দেশ করে রূপেন্দ্র বললেন, এ গৃহে প্রবেশমাত্র ঐটি আমার নজরে পড়েছিল। তাই এমন স্থানে মহড়া নিয়েছিলাম যেস্থান থেকে ঘাড় না ঘুরিয়েও পিছনে অবস্থিত আপনাকে লক্ষ্য করা যায়। আপনার স্ত্রীর নিকট পেশ করা প্রতিটি প্রশ্নে আপনার উপর কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা আমার নজর এড়ায়নি। শেষ প্রশ্নটিতে আপনি যে ঘাড় নেড়ে স্ত্রীকে নিষেধ করলেন তাও লক্ষ্য করেছি। এবার বলুন? কেন এমন পাগল সেজে আছেন?

ঘনশ্যাম প্রাচীরে প্রলম্বিত দর্পণটি লক্ষ্য করে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, বিচার্য বিষয়ের সংজ্ঞার্থ প্রথমে নির্ণীত হওয়া প্রয়োজন। ‘উন্মাদ’-এর সংজ্ঞা কী?

—যার চিন্তার পারম্পর্য নেই। নিজের মঙ্গল যে বোঝে না। যুক্তি-নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে যে অশক্ত, সে : ‘উন্মাদ’!

—এটাই যদি উম্মনাবস্থার সংজ্ঞা হয়, তাহলে স্বীকার করছি ভেষগাচার্য—আমি মাঝে- মাঝে উম্মাদ হয়ে যাই। কখনো দুই-তিন মাস, কখনো কয়েক বছর ঐ অবস্থায় থাকি। তখন যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়া তো দূরের কথা, নিদ্রা, মূত্রত্যাগ বা বিরেচন প্রভৃতি দেহকর্ম আমার নিয়ন্ত্রণানুসারে হয় না। আহারে স্পৃহা থাকে না। হয়তো দীর্ঘদিন ঐ অবস্থায় থাকি। তারপর কীভাবে জানি না—ঠিক যেমন মানুষের ঘুম ভাঙে, সুষুপ্তির অজ্ঞানবস্থা থেকে মানুষ জেগে ওঠে তেমনি নিজের অভিজ্ঞান ফিরে পাই। উন্মাদ অবস্থায় কী করেছি তা স্মরণে আনতে পারি না

কিন্তু প্রাগুন্মাদনাবস্থায় যা অধ্যয়ন করেছি, যে জ্ঞান অর্জন করেছি তা সবই স্মরণে আনতে পারি। ঠিক যেমন ঘুম ভেঙে যাবার পর স্বপ্নরাজ্যে কী কী করেছি তা কখনো আবছা মনে পড়ে, কখনো কিছুই মনে পড়ে না, কিন্তু পূর্বদিনের সবকথাই স্মরণ করা যায়। আমার অবস্থাও ঠিক সে রকম হয়।

—এঁরা বলছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন পরবর্তী পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত। সেটা কি সত্য?

ঘনশ্যাম বললেন, আপনার প্রশ্নটা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রসম্মত কি না জানি না, ন্যায়শাস্ত্র সম্মত নয়।

—কেন?

—উপাধানের পার্শ্বে একটি বালু-ঘটিকা স্থাপন করলে আপনি কি পরদিন সকালে উঠে বলতে পারবেন ঠিক কয়টার সময় আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?

রূপেন্দ্র বললেন, ঠিক কথা! না, পারব না! এমন অদ্ভুত রোগলক্ষণ আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। এটি সম্পূর্ণ মানসিক রোগ। দীর্ঘদিন আপনার সঙ্গে একত্র বসবাস করলে, আপনার অন্তরের অন্দর-মহলের নিজ্ঞান অঞ্চলে কী জটিলতা আছে তার হয়তো সন্ধান পাব। তখনই চিকিৎসার প্রশ্ন উঠবে। সে-ক্ষেত্রে আমাদের দুজনের মধ্যে বাধাবন্ধহীন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা প্রয়োজন। কেউ কারো কাছে কিছু গোপন করব না।

ঘনশ্যাম বললেন, তথাস্তু। তবে তার প্রথম পর্যায় এই মুহূর্তেই শুরু হতে পারে রূপেন্দ্র, যদি আমরা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকি। ‘তুমি’-র নৈকট্যে সরে আসি।

রূপেন্দ্র তৎক্ষণাৎ স্বীকৃত। বলেন, প্রথমে বল তো ঘনশ্যাম, তোমার মনে আছে প্রথমে কবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলে?

ঘনশ্যাম বললেন, হ্যাঁ, আছে! আট বছর বয়সে। কী পারিপার্শ্বিক ঘটনায় মুহূর্তমধ্যে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলাম সেটাও মনে আছে। কিন্তু তার পূর্বে বল : তুমি আমাদের সম্বন্ধে কতটা জান। এই যে আমাদের পরিবারের ধনৈশ্বর্য, এই প্রাসাদ, এই অনায়াস পরিশ্রমহীন ভোগের আয়োজন, এর মূলে কী আছে?

—কিছুটা শুনেছি।

—এই সব কিছুর বনিয়াদে আছে একটি মর্মান্তিক কুসংস্কার। বংশের আদিপুরুষ তাঁর একমাত্র সুন্দরী কন্যাকে জীবন্ত দগ্ধ করে এই সম্পত্তি বংশানুক্রমিকভাবে ভোগ করার অধিকার লাভ করেছিলেন।

—হ্যাঁ, জানি। তার সঙ্গে তোমার এই মনোরোগের কী সম্পর্ক?

—সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি এবং অতি ঘনিষ্ঠ। তাহলে আমার জীবনকথা বিস্তারিত শুনতে হবে।

—তাই তো শুনতে চাইছি, বন্ধু। রোগের ইতিহাস না জানা থাকলে রোগীর চিকিৎসা সম্ভবপর নয়। বিশেষত মনোরোগ!

ঘনশ্যাম তখন তাঁর জীবনেতিহাস বিস্তারিত জানাতে থাকেন।

আঁতুড় ঘরেই ঘনশ্যাম মাতৃহীন। তাঁকে মানুষ করেন তাঁর মাসি আর পিতামহী। অতি শৈশবকাল থেকেই বংশের এই সন্তানটি প্রখর বুদ্ধিমান বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন। মাত্র চার বছর বয়সেই জগন্নাথ তাঁর ভগিনীপতির কাছে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন–এ ছেলে জীবিত থাকলে ভারতজোড়া খ্যাতির অধিকারী হবে। নিতান্ত শিশুকালেই ঘনশ্যাম বুঝতে পেরেছিলেন কীভাবে ওঁদের বংশের সমৃদ্ধি। জ্ঞানবুদ্ধি হবার বয়স তখনো হয়নি—মাত্র ছয় বৎসরের বালক কিন্তু ক্ষণজন্মা পুরুষদের কীর্তি-কাহিনী ঐ রকমই হয়। একদিন ছয় বৎসরের এটা একটা শিশু তার পিতার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল ‘সতীদাহ’ প্রথা নিয়ে। শিশুর মতে বর্বর ব্যবস্থা। গঙ্গাপ্রসাদ শিশুপুত্রকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যা বুঝিস্ না, ইঁচড়ে পাকার মতো তা নিয়ে কথা বলিস্ না। হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণ তুই কী বুঝি রে? সমস্ত ভারত-ভূখণ্ডে এই প্রথা প্রচলিত আছে, তা জানিস? বিনা হেতুতে?

ছয় বছরের বালক বলেছিল, সারা দেশের কথা ছেড়ে দিন। আমাদের পরিবারে এই কুপ্রথাটি কেন আপনি এবং আপনার পিতা-পিতামহ বংশানুক্রমে জিইয়ে রেখেছেন? সেটা ধর্মের অঙ্গ বলে? না, নিজেদের স্বার্থে?

কে বলবে ছয় বৎসর বয়সের বালকের কথা! রুখে উঠেছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ : কেন?

—না হলে ‘সতীমায়ে’র সেবায়তী আমাদের বংশের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি পুরুষে এক-একটি বিধবাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। আপনাদের এই জমিদারীর ঠাট বজায় রাখতে!

–কে? কে বলেছে তোকে এসব অবান্তর কথা?

—কে বলেছেন, সেটা বড় কথা নয়, বাবামশাই। কথাটা যে মিথ্যে নয় তা তো মানছেন?

গঙ্গাপ্রসাদ গর্জে উঠেছিলেন, বেরিয়ে যা! দূর হ আমার সমুখ থেকে! তুই…তুই আমাদের বংশের কুলাঙ্গার!

ঐ বালক বয়সেই পিতার সঙ্গে প্রথমে মতান্তর, পরে মনান্তর হয়ে যায়। ভাগিনেয়র এই সব দুর্বিনীত প্রশ্নের কথা শুনে স্বয়ং জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন এসেছিলেন তাকে বোঝাতে। ফলে শুধু পিতা নয়, মাতুলের সঙ্গেও বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গেল। সেই সময় থেকেই উনি ঠাকুমার আরও ন্যাওটা হয়ে পড়েন। বস্তুত মায়ের নিজের ছোট বোন, মাসিমা যাঁকে শৈশবকাল থেকেই উনি ‘মা’ ডাকতেন এবং ঐ বৃদ্ধা ঠাকুরমাকে ঘিরেই ওঁর শৈশবকাল গড়ে ওঠে। মাসিমা অবশ্য সংসারের নানা কাজে সর্বদা ব্যস্ত। গৃহস্বামিনীর বিকল্প তিনি। কুলীন ব্রাহ্মণঘরের অরক্ষণীয়া অনূঢ়া কন্যা। এসেছিলেন এ সংসারে বড়বোনের দেহান্তে তার ছেলেটিকে কোলে তুলে নিতে। আর বাপের সংসারে ফিরে যাওয়া হয়নি। তিনি সদা- ব্যস্ত। তাই ঘনশ্যামকে কাছে টেনে নিলেন তাঁর পিতামহী। তাঁরই কাছে মুখে-মুখে রামায়ণ- মহাভারতের নানান কাহিনী শুনেছেন। ধ্রুব-নালক-নচিকেতার উপাখ্যান। বস্তুত অক্ষর- পরিচয় হবার পূর্বেই। পিতামহীর নিজেরও অক্ষরপরিচয় ছিল না। কিন্তু কথক ঠাকুরদের কল্যাণে সে-কালীন যাবতীয় বামুন-ঘরের বর্ষীয়সীর মতো পুরাণ-ভাগবতের নানান কাহিনী ছিল ঠাম্মার ঠোঁটস্থ!

ঘনশ্যামের পিতামহ ছিলেন দীর্ঘদিনের শয্যাশায়ী রোগী। তাঁর সঙ্গে ঘনশ্যামের ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তবে মাঝেমাঝে তাঁর শিয়রের কাছে গিয়ে বসতেন। পাঙ্খার হাওয়া করতেন। তিনি ইঙ্গিত করলে গঙ্গাজল ঢেলে দিতেন বৃদ্ধের কণ্ঠনালীতে।

ঘনশ্যামের বয়স যখন আট তখন তাঁর পিতামহের দেহান্ত হল। ঠাকুমা নাতিটিকে ছেড়ে সহমরণে যেতে চাননি। কিন্তু কেউ সেকথায় কর্ণপাত করেনি। ঘনশ্যাম বিদ্রোহ করলেন। প্রথমে পিতা ও মাতুলের চরণযুগলের উপর আছাড়ি-পিছাড়ি কান্না : ‘–বাবাগো মামাগো! ঠাম্মাকে আপনারা পুড়িয়ে মারবেন না।’ অবোধ বালকের কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। তখন ঘনশ্যাম পিতামহের পরিত্যক্ত লাঠিগাছ থানা কুড়িয়ে নিয়ে লড়াই করতে এগিয়ে এল। মাটির কলসী, ঘড়া, সরা, কাচের সেজবাতি চূর্ণ হয়ে গেল যষ্টিপ্রহারে। পাঁচ-সাত জন জোয়ান মানুষ জড়িয়ে ধরল বালককে।

ঠাকুর্দার নিস্পন্দ দেহটা ওরা খাটিয়ায় তুলে নিল : বল হরি, হরি বোল!

তারপরেই একটা পাল্কিতে সিন্দুরচর্চিত ও অলক্তকরঞ্জিত এক পক্ককেশা বৃদ্ধা। তিনি চীৎকার করে কী-যেন বলছেন, শোনা যাচ্ছে না। গ্রামবাসীদের কাঁসর-ঘণ্টার শব্দে আর শতশত ধার্মিকের সমবেত পুকারে : ‘সতী মাঈকী জয়।’

বালক ঘনশ্যাম সুকৌশলে খড়ো-চাল ঘরের বাঁশের বাতা আর উলুখড় ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল রুদ্ধদ্বার-কক্ষের বাহিরে। ছুটতে ছুটতে উপস্থিত হয়েছিল শ্মশান ঘাটে। বৃদ্ধার সেই মর্মান্তিক সহমরণ প্রত্যক্ষ করেছিল আড়াল থেকে। সহসা বৃক্ষান্তরাল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ছুটে যায় জ্বলন্ত চিতার দিকে। বৃদ্ধার তখনো জ্ঞান ছিল। চিৎকার করে উঠেছিলেন : পাগলা, এখানে আসিসনি। পুড়ে মরবি!

তিন-চারজনে ওঁকে চেপে ধরে; কিন্তু তার পূর্বেই বিশ্রীভাবে ওঁর হাত-পা পুড়ে যায়। উনি অজ্ঞান হয়ে যান। পুরোপুরি তিন দিন অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকেন। তারপর যখন উঠে বসলেন তখন বালক ঘনশ্যাম ঘোর উন্মাদ।

সেই তাঁর প্রথম আক্রমণ।

সেবার যে কতদিন ঐ অবস্থায় ছিলেন কেউ তার হিসাব রাখেনি। উন্মাদ, কিন্তু কোনও উপদ্রব নেই। আপন মনে বসে থাকে। খেতে দিলে খায়, না দিলে খায় না। ঠাম্মা নেই, মাসিমা সংসারের পঞ্চাশটা কাজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। বালক ঘনশ্যামকে সেবা-যত্ন করত প্রতিবেশিনীর একটি অনূঢ়া কন্যা। বয়সে সে ঘনশ্যামের চেয়ে মাত্র দু-বছরের ছোট। প্রতিবেশী বিশ্বম্ভর ঘোষালের আত্মজা। বিশ্বম্ভরও ব্রাহ্মণ, তবে কুলীন নন, শ্রোত্রীয়। উন্মাদ ঘনশ্যামের কাছে যেতে অনেকেই ভয় পায়, সুভা পায় না। সুভা যে ওর খেলার সাথী নিতান্ত শৈশবকাল থেকে। মেয়েটির ডাক নাম সুভা—‘সুভাষিণী’ নামের অপভ্রংশ। নিদারুণ দুঃখের কথাটা এই : বিশ্বম্ভর যখন কন্যার নামকরণ করেন তখনো বালিকার বোল ফোটেনি। তাই পরে ঘোষালমশাই প্রণিধান করেছিলেন বিশ্বনিয়ন্তা কী নিষ্ঠুর কৌতুক করেছেন তাঁকে নিয়ে। বোল ফোটার বয়স হলে দেখা গেল : সুভাষিণী মূক ও বধির!

সে ছিল ঘনশ্যামের শৈশবের নির্বাক খেলার সাথী, উন্মত্তাবস্থায় নীরব সেবাব্রতী।

কবে জ্ঞান ফিরে এল মনে নেই; তবে এটুকু মনে আছ যে, জাগতিক সব কিছুর কারও সঙ্গে তাঁর উপরেই তাঁর তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মেছে। পিতা, মাতা, মাতুল, সহাধ্যায়ী কোনও যোগাযোগ ছিল না, বন্ধুত্ব তো নয়ই। একমাত্র ব্যতিক্রম ঐ অসহায়া মুক মেয়েটি! জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়নে অস্বীকৃত হওয়ায় গঙ্গাপ্রসাদ বালককে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাণেশ্বর বিদ্যাবিনোদের চতুষ্পাঠীতে। ঘনশ্যাম দিবারাত্র আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকতেন পুঁথির জগতে। ব্যাকরণ, কাব্য, ন্যায়, ষড়দর্শন, ক্রমে ক্রমে আয়ত্ত করলেন সবকিছুই। চতুষ্পাঠীতে সহাধ্যায়ীদের সঙ্গে বিশেষ বাক্যালাপ করতেন না, বাড়িতেও কারও সঙ্গে কথাবার্তা নেই। একমাত্র ঐ মূক-বধির শুভাকে দেখলেই উনি উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। চতুষ্পাঠী ও টোলের শেষ পরীক্ষায় যখন উত্তীর্ণ হলেন তখন ঘনশ্যামের বয়স অষ্টাদশ। সুভা তখন ষোড়শী। এ বাড়ি যাতায়াত তার বন্ধ হয়ে গেছে। হোক পাশের বাড়ি। তবু খরজিহ্ব প্রতিবেশিনীদের বাক্যবাণ থেকে রক্ষা করতে ওর মা বোবা মেয়েটাকে আগলে রাখতেন।

এই সময় ঘনশ্যাম তাঁর মামিমার কাছে সংবাদ পেলেন যে, গঙ্গাপ্রসাদ পুত্রের বিবাহের জন্য পাত্রীর সন্ধান করছেন। মাতুলশ্রী জগন্নাথের সঙ্গে এ বিষয়ে পিতৃদেবকে দু-একবার ঘনিষ্ঠ আলোচনা করতে শুনলেন।

ঘনশ্যাম সোজা কথার মানুষ—ওঁদের সেই গোপন আলোচনা সভায় একদিন অযাচিত উপস্থিত হয়ে দুজনকে প্রণাম করে বললেন, মামিমার কাছে শুনলাম আপনারা নাকি আমার বিবাহের আয়োজন করছেন। সে বিষয়ে দু-একটি কথা নিবেদন করতে এলাম। আপনারা অনুমতি দিলে…

গঙ্গাপ্রসাদ গর্জে ওঠেন, এমন দুর্বিনীত, নির্লজ্জ কখনো দেখিনি। নিজের বিবাহ-সংক্রান্ত কথাবার্তা নিজেই বলতে এসেছ তুমি! লজ্জা হল না! যাও! অনুমতি দিলাম না!

তর্কপঞ্চানন ওঁকে থামিয়ে দিলেন; আহা হা! মাথা গরম করছে কেন গঙ্গা? এ কি মাথা-গরম করার বিষয়, না সময়?… হ্যাঁ, বল ঘনশ্যাম, তোমার বিবাহ সম্বন্ধে কী বলতে এসেছ?

—আমি বলছিলাম যে, আমি তো ঠিক স্বাভাবিক নই। মাঝে-মাঝে উন্মাদ হয়ে যাই। এ-ক্ষেত্রে একটি অনুঢ়া কন্যার ভাগ্য কি আমার ভাগ্যের সঙ্গে বিজড়িত করা উচিত?

জগন্নাথ বললেন, তুমি বুদ্ধিমানের মতোই কথাটা বলেছ, ঘনশ্যাম। তোমার অস্বাভাবিকত্বের বার্তাটা আমরা কন্যার পিতার কাছে গোপন করব না। তিনি যদি সব জেনে- বুঝেই কন্যা সম্প্রদান করেন তাহলে আপত্তির কথা ওঠে না।

ঘনশ্যাম সবিনয়ে বলেছিলেন, ওঠে বইকি, মাতুলশ্রী! পাগলের ঘর করতে তো পাত্রীর অভিভাবক আসবেন না। আর মেয়েটির মতামত গ্রহণের কথা নিশ্চয় আপনাদের পরিকল্পনায় নেই, তাই না?

গঙ্গাপ্রসাদ রুখে উঠে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে আবার থামিয়ে দিয়ে জগন্নাথ বলেন, তুমি চুপ করে থাক গঙ্গা, কথাবার্তা আমাকেই বলতে দাও।… হ্যাঁ, তাহলে তোমার কী সিদ্ধান্ত, বাবা ঘনশ্যাম? চিরকুমার থাকা? ব্রহ্মচারী হয়ে থাকা? সন্ন্যাস নেওয়া?

—আজ্ঞে না। তেমন কোন সিদ্ধান্ত এখনো করিনি। আমি বরং চাইছি এমন একটি পাত্রীকে আপনারা নির্বাচন করুন যে, এই পাগল মানুষটাকে সেবাযত্ন করতে স্বেচ্ছায় স্বীকৃত! গঙ্গাপ্রসাদ আর স্থির থাকতে পারেন না। বলেন, সেটা কীভাবে হবে? গাঁয়ে গাঁয়ে ঢেঁড়া দিতে হবে বোধকরি : ওগো তোমাদের গাঁয়ে কোন আধাপাগলী পাত্রী কি আছে, যে আমার পুরোপাগল ছেলেটিকে বিবাহ করবে?

ঘনশ্যাম প্রত্যুত্তর করার পূর্বেই গর্জে উঠলেন তর্কপঞ্চানন। গঙ্গা! তুমি ওঠো। ভিতর বাড়িতে যাও! যা–ও!

গঙ্গাপ্রসাদ এ কণ্ঠস্বরকে চেনেন। গোটা ত্রিবেণী চেনে। মাথা নিচু করে তিনি ভিতর বাড়িতে চলে যান। জগন্নাথ অন্দরের দিকের কবাটটা রুদ্ধ করে দিয়ে ফিরে এলেন। নিজ আসনে বসে শান্তস্বরে বললেন, বেশ তো ঘনশ্যাম। এ উত্তম প্রস্তাব। কন্যা যদি স্বেচ্ছায় এ রকম রোগাক্রান্ত স্বামীকে বরণ করতে প্রস্তুত থাকে তাহলে আমরা আপত্তি করব কেন? এমন কোন পাত্রীর সন্ধান কি তোমার জানা আছে?

ঘনশ্যাম বলছিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। ঘোষালখুড়োর একমাত্র কন্যা সুভা : সুভাষিণী!

জগন্নাথ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বললেন, কী বলছ ঘনশ্যাম! বিশ্বম্ভর ঘোষালের কন্যাটি তো মুক এবং বধির! না, না, না! এ বিবাহ সম্ভবপর নয়! তাছাড়া বিশ্বম্ভর কুলীন নয়, শ্রোত্রীয়। কুলীন পাত্র যদি শ্রোত্রীয় ঘরের কন্যাকে বিবাহ করে তাহলে কুলীনঘরের অরক্ষণীয়াদের গতি হবে কী? কৌলীন্যপ্রথা তো ক্রমে ক্রমে ভেঙে যাবে!

ঘনশ্যাম বলেছিলেন, মামা! আপনাকে এ-কথার প্রত্যুত্তরে যে-কথা জানাব তা আমার মাতুলকেই শুধু বলছি না আমি, বলছি গৌড়মণ্ডলে ব্রাহ্মণ্য-সমাজের অন্যতম স্তম্ভকে। আপনি বিবেচনা করে দেখুন, সুভা, অর্থাৎ সুভাষিণী মূক-বধির হওয়ার জন্যই হয়তো আজীবন উপেক্ষিতা অনূঢ়া হয়ে থাকবে। তার বিবাহ হবে না। এদিকে আমিও সুভার মতো একদিক থেকে পঙ্গু–আমার মানসিক ভারসাম্য মাঝে-মাঝে হারিয়ে যায়। আমরা দুজনে আংশিকভাবে পঙ্গু। কিন্তু হয়তো যৌথভাবে নয়। স্কন্ধস্থিত খঞ্জ সহধর্মিণীর নির্দেশে অন্ধমানুষ সংসারে উপলবন্ধুর পথ অতিক্রম করতে পারে। আমাদের দু-জনের এ রাজযোটকে কেন বাধা দিচ্ছেন আপনারা? আর কৌলীন্য প্রথা? আমি তো অন্তর থেকে বিশ্বাস করি এই বর্বর প্রথা বিলুপ্ত হলেই হিন্দু-সমাজের, ব্রাহ্মণ্যসমাজের মঙ্গল। গৌড়মণ্ডলের অন্যতম সমাজপতি হিসাবে আপনি কি তা উপলব্ধি করেন না?

জগন্নাথ গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, কৌলীন্য প্রথা বা গোটা ব্রাহ্মণ্যসমাজের ভালমন্দ বিষয়ে আলোচনা আমি তোমার সঙ্গে করতে বসিনি, ঘনশ্যাম। আমরা তোমার বিবাহের প্রস্তাব আলোচনা করছিলাম। আমাদের বংশে এবং তোমাদের বংশেও কেউ কোনদিন স্বয়ং পাত্রী নির্বাচন করেনি। পিতৃস্থানীয়দের নির্বাচন আবহমান কাল ধরে মেনে এসেছে। দ্বিতীয়ত, না আমাদের বংশে, না তোমাদের বংশে—কেউ কখনো কোন মুকবধির কন্যাকে সজ্ঞানে গৃহবধূ করে আনেনি।

ঘনশ্যাম সবিনয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না মামাশ্রী! আপনার বক্তব্যটি কিন্তু যুক্তিসঙ্গত নয়! ‘কেউ কোনদিন করেনি’ এটা কোনও যুক্তি নয়! আমাদের বংশে কেউ কোনদিন গৌড়মণ্ডলের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলে ইতিপূর্বে স্বীকৃতি গ্রহণ করেননি। ‘কেউ কোনদিন করেনি’ যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে আপনি তা করেছেন। তাতে ক্ষতি তো কিছু হয়নি। আমরা গর্বিত হয়েছি! ঠিক তেমনি একটি মূক-বধির কিশোরীর নারীত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে না হয় আমিই প্রথম ব্যতিক্রম হলাম! স্ত্রীর মূকবধিরত্বের জন্য অসুবিধা যখন আমি স্বেচ্ছায় সহ্য করতে রাজি, তখন আপনাদের অনুমতি দিতে বাধা কোথায়?

ঘনশ্যাম জানেন না প্রকৃত বাধাটা কোথায় ছিল। মাসিমা সম্মত হয়েছিলেন : আহা আবাগিটা খোকাকে সত্যিই প্রাণ ঢেলে ভালবাসে!

গঙ্গাও শেষপর্যন্ত স্বীকৃত হয়েছিলেন, ছেলেটা পাগল! যা হয় করুক।

কিন্তু সম্মত হতে পারেননি জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। ঘনশ্যামের মনে হল– জগন্নাথ এটাকে ভাগিনেয়র নিকট পরাজয় বলে ধরে নিয়েছিলেন। তিনি এ প্রস্তাবে অস্বীকৃত!

অচিরেই এক অন্তর্জলী-যাত্রী বিপত্নীক বৃদ্ধের সঙ্গে সুভাষিণীর বিবাহ হয়ে গেল। বিবাহের এক সপ্তাহের মধ্যেই বৃদ্ধ বৈকুণ্ঠলোকে যাত্রা করলেন। সুভাষিণী গেল সহমরণে! এমন “সতী” কেউ কোনদিন দেখেছ! লেলিহান আগ্নিশিখার আবেষ্টনীতে মূকবধির মেয়েটি আর্তনাদ করেনি একটুও!!

এবারও সেই সহমরণ রুখতে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছুটে গিয়েছিলেন ঘনশ্যাম। ফিরে এলেন পুনরায় বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায়, পালকিবাহকদের কাঁধে চেপে।

অষ্টাদশ থেকে চতুর্বিংশতি—দীর্ঘ ছয় বৎসর উনি উম্মাদ হয়ে গৃহবন্দি অবস্থায় পড়েছিলেন। এবার কী করে ওঁর অভিজ্ঞান ফিরে এল তা মনে নেই; কিন্তু ক্রমে ক্রমে ওঁর দৃষ্টি হল স্বচ্ছ। আশপাশে যেসব কথাবার্তা কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে তার অর্থ বুঝতে পারছেন। ঐ সময়ে লক্ষ্য করেন; একটি সুন্দরী যুবতী মহিলা অনায়াসভঙ্গিতে ওঁর শয়নকক্ষে প্রবেশ করছেন, নানান জিনিসপত্র নাড়াচাড়ি করছেন, আবার বেরিয়েও যাচ্ছেন। মেয়েটির বয়স বছর কুড়ি-বাইশ হবে–ওঁদের আত্মীয়-স্বজন নিশ্চয় নয়, তাহলে চিনতে পারতেন। মহিলা সধবা, মাথায় আবক্ষ অবগুণ্ঠন; কিন্তু ঘনশ্যামের নির্জন শয়নকক্ষে এসে মাঝে-মাঝে মাথার ঘোমটা ফেলেও দিচ্ছেন। তখনি নজরে পড়ছে–ওঁর সিঁথিতে সিঁদূর, নাকে নোলক, কপালে কুমকুমের টিপ্ আর মুখে শ্বেতীর বিশ্রি দাগ। কথা বলছেন না, কিন্তু মাঝে-মাঝে ওঁর দিকে তাকিয়ে মৃদুমৃদু হাসছেন। সন্ধ্যার পর একবার পাথরের বাটিতে কী-একটা পানীয় নিয়ে এসে ওঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, খাও!

ঘনশ্যাম একটু অবাক হলেন। অপরিচিতা যুবতী মহিলাটির ‘তুমি’ সম্বোধনে। পানীয়টি গ্রহণ করলেন। কপিখ সুরভিত তত্রু। পানান্তে ঘনশ্যাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?

মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মেয়েটি খিলখিল করে কিছুক্ষণ হাসল। হাসির দমকে সে পালঙ্কে ‘লুটিয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎ পালঙ্ক থেকে লাফিয়ে নেমে রুদ্ধদ্বারের অর্গল মোচন করে বেরিয়ে গেল বাইরে। ফিরে এল পরক্ষণেই। তার ক্রোড়ে একটি নিদ্রিত শিশু। বৎসরখানেক বয়স। পুত্রসন্তান। দেখ্‌-না-দেখ শিশুটিকে ওঁর কোলে নামিয়ে দিয়ে বললে, এটি তোমার পুত্র, নাম ‘বলভদ্র’। এখন বুঝতে পারছ আমি কে? হুঁশ ফিরেছে?

দুরন্ত বিস্ময়ে ঘর ছেড়ে বাইরে এলেন ঘনশ্যাম। ডাকলেন : মা!

মাসিমা বোধকরি রান্নাঘরে ছিলেন। নিদারুণ চমকে উঠলেন। এ কণ্ঠস্বর তো ভুল হবার নয়! ছুটে বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে, কী বাবা?

মাসিমা দেখছিলেন, ঘনশ্যাম দাঁড়িয়ে আছেন অন্দরমহলের বারান্দায়, একটা কাজকরা খাম্বিরার পাশে। দেখছিলেন ঘনশ্যামের ধুতি মাটিতে লুটাচ্ছে না, তার চোখে আর সেই পাগলের ঘোলাটে দৃষ্টি নেই। ছেলে ওঁর ভাল হয়ে গেছে।

ঘনশ্যামও দেখছিলেন, মাসিমা দাঁড়িয়ে আছেন পাকঘরের সমুখে। তাঁর পায়ে আলতা, হাতে শাঁখা-খাড়ু, মাথায় ঘোমটা আর সিঁথিতে সিঁদূর!

বিমাতা বারান্দার ও-প্রান্ত থেকে ছুটে এসে বললেন, খোকা! তুই ভাল হয়ে গেছিস্? চিনতে পারছিস আমাকে?

ঘনশ্যাম ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছেন জিজ্ঞেস করতে যে, ঘরে ঐ মহিলাটি কে, শিশুটি কার সন্তান। কিন্তু সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হল না। বললেন : মা! তোমার বিয়ে হয়ে গেছে? বাবার সঙ্গেই তো?

ঘরের ভিতর থেকে ভেসে এল যুবতী নারীর খিলখিল হাসি আর শিশুর কান্না!

ক্রমে বুঝলেন। তীক্ষ্ণধী ঘনশ্যাম তিল-তিল করে প্রণিধান করলেন পরিস্থিতিটা। তাঁর দীর্ঘদিনের বিস্মরণকালের মধ্যে কী কী ঘটেছে!

ঘনশ্যামের পিতা ইতিমধ্যে বিবাহ করেছেন তাঁর মাসিমাতাকে– তাঁর গর্ভধারিণীর অনুজাকে। এবং মাতুলশ্রীর ব্যবস্থাপনায় উন্মাদ অবস্থাতেই তিনি নিজে বিবাহ করেছেন জগন্নাথের এক ধনী যজমানের একমাত্র কন্যাটিকে। বলভদ্রজননীকে! ক্রমে সকলকেই চিনলেন। বলভদ্রের গর্ভধারিণী সুভদ্রাকে, শ্বশুর-শাশুড়িকে, মায় বলভদ্রকেও। নিজের সন্তান! না চিনবেন কেন? শুধু একটা সমস্যার সমাধান হল না : সুভদ্রার পিতা হৃষীকেশ জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের একজন প্রধান শিষ্য! কুলীন রায়চৌধুরী প্রচুর সম্পত্তির মালিক তিনি; কিন্তু সব জেনে বুঝে কেন তিনি এমন উম্মাদকে জামাই করলেন?

১০

ঘনশ্যামের সুদীর্ঘ রোগ-ইতিহাস শুনে রূপেন্দ্রনাথ বললেন, ভাই ঘনশ্যাম, তোমার সমস্যার অনেক কিছু বুঝেছি, অনেক কিছু বুঝিনি। তাতে ক্ষতি নেই। তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে, এ বিশ্বাস আমার আছে। তোমাকে আমার সঙ্গে সোঞাই যেতে হবে। তোমাকে থাকতে হবে আমার চোখের সম্মুখে। তাছাড়া তোমার মতো দুর্লভ প্রতিভা তো এখানে পড়ে নষ্ট হতে পারে না। তুমি সর্বান্তঃকরণে আমার কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়—দেখবে উন্মাদ হবার অবকাশই পাবে না।

ঘনশ্যাম হাসতে হাসতে বলেন, সোঞাই গ্রামে তুমি কী জাতির কর্মযজ্ঞ শুরু করতে চাও? চতুষ্পাঠী, টোল, না মন্দির-টন্দির ঘিরে আশ্রম?

—তিনটের একটাও নয়। শোন বলি—

ওঁর যা জীবনের লক্ষ্য, যে সাধনা তা বললেন–কী কারণে হিন্দু সমাজ ক্রমাবনতির অতলান্ত গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। তার দুটি হেতু। এক: দেশবাসীর সুবৃহৎ অংশকে ব্রাহ্মণ্যসমাজপতিরা দূরে সরিয়ে রেখেছে। জল-অচল, অচ্ছুৎ আখ্যা দিয়ে। দুই: সমাজের অর্ধাংশ—নারী জাতিকে–যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। স্ত্রীশিক্ষার কোন ব্যবস্থা সারা দেশে কোথাও নেই। এ ছাড়া আছে নানান জাতির কুসংস্কার। সর্বপ্রধান : সতীদাহ। তারপর কৌলীন্য প্রথা—কুলীনদের বিশ-পঞ্চাশ-শতাধিক বিবাহ মেনে নিচ্ছে সমাজ। অভ্যন্তরভাগে এখনো বহু কালীমন্দিরে নরবলি হয়। প্রকাশ্যে মানত করে সন্তান বিসর্জন দেয় বন্ধ্যা নারী, গঙ্গার জলে! যারা সমাজপতি হয়ে এসব কুপ্রথা রদ করতে পারতেন, তাঁরা আশ্চর্যভাবে নীরব। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সতীদাহ ও গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন দেওয়ার পক্ষপাতী, গৌরীদান প্রথার সপক্ষে। তিনি শুধু সংস্কৃত চতুষ্পাঠী খুলে যাচ্ছেন একের পর এক। বর্ধমান মহারাজ ও একই পথের পথিক। এমন কি নাটোরের মহারানীর মতো বিদুষীও এ বিষয়ে উদাসীন। একের- পর-এক মন্দির গড়ে যাওয়ার মধ্যেই তিনি ধর্মসেবার পরমার্থ খুঁজে পেয়েছেন! সকলেই গড্ডলিকাপ্রবাহে স্বর্গে দুন্দুভি বাজানোর আয়োজনে ব্যস্ত!

রূপেন্দ্র বললেন, সোঞাই ফিরে যাচ্ছি আমি। সেখানে আমার প্রথম কাজ হবে গৌরমণ্ডলে এই সহস্রাব্দিতে প্রথম নারী পাঠশালার উদ্বোধন। যেখানে ছাত্র থাকবে না, থাকবে শুধু ছাত্রী। আমার প্রস্তাব : এখানকার সব কিছু বলভদ্রকে লিখে দিয়ে তোমরা দুজন আমার সঙ্গে চল। আমি বিপত্নীক, আমার ভিটায় স্ত্রীলোক নেই। তোমরা দুজন যদি বালিকাদের সারস্বত সাধনায় সহায়তা কর…

ঘনশ্যাম বাধা দিয়ে বললেন, দ্বিবচন নয়, বয়স্য, একবচন! তোমার বৌঠান সাক্ষর নন। তা হোক তিনি তোমাকে অন্য নানাভাবে সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু প্রথমে, বল, এতগুলি সমস্যার মধ্যে স্ত্রীশিক্ষার ব্যবস্থাপনাটাই কেন প্রথম কর্তব্য বলে গ্রহণ করতে চাইছ? রূপেন্দ্র জানালেন, কাশীধামের পরপারে ব্যাসকাশীতে তিনি সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এক ত্রিকালজ্ঞ মহাযোগীর: ত্রৈলঙ্গস্বামী! সেই অলৌকিক-ক্ষমতাসম্পন্ন মহর্ষির কাছ থেকে তিনি প্রত্যাদেশ পেয়েছেন: গৌরমণ্ডলে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের মধ্যেই তাঁর সাধনার সূচনা হওয়া উচিত। রূপমঞ্জরীকে বেদাশ্রয়ী করে তোলা!

যে যুক্তির কোন অর্থ খুঁজে পাননি ভবতারণ গাঙ্গুলী, নদীয়ার বিদুষী রাজমহিষী, কাশীর শঙ্করাচার্য, এমনকি ক্ষুরধারবুদ্ধি জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, সে যুক্তি বিনা তর্কে, বিনা ব্যাখ্যায় সর্বান্তঃকরণে প্রণিধান করলেন ঘনশ্যাম সার্বভৌম। বললেন, আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, বন্ধু। কিন্তু বিশেষ হেতুতে আমি তোমার সহযোগী হিসাবে এ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারছি না। মালতী হয়তো পারবেন যদি তিনি স্বীকৃতা হন, যদি তুমি তাঁকে স্বীকার করে আশ্রয় দাও!

রূপেন্দ্র বলেন, কী বলছ পাগলের মতো! তুমি না গেলে তিনি কেমন করে যাবেন?

সার্বভৌম বলেন, পাগল মানুষ তো! পাগলের মতো কথাই বলব ভাই! আচ্ছা সেসব কথা পরে আলোচনা করা যাবে, আপাতত এস, আমরা আলোচনা করি: স্ত্রীজাতীয়ার বিদ্যায়তনে কী ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে?

রূপেন্দ্র দৃঢ়স্বরে বলেন, একই ধরনের। সারা দেশে শত শত চতুষ্পাঠীতে ছাত্ররা যা- যা শেখে—এমনকি বৈদিক শাস্ত্ৰ মেয়েরাও ঠিক তাই তাই শিখবে। কোন প্রভেদ থাকবে না। আমার মতে পুরুষ-স্ত্রীর অধিকার ও স্বাধীনতা অভিন্ন। কোনও পার্থক্য থাকবে না।

ঘনশ্যাম বললেন, উত্তেজিত হয়ো না, বন্ধু! সামাজিক অধিকার নিয়ে আমি এ তর্ক করছি না; কিন্তু এ-কথা তো মানবে যে, সৃষ্টিকর্তার বিধানে পুরুষ ও স্ত্রী কখনই সমান নয়? তাদের ক্ষমতা, তাদের অধিকার, সমাজে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সমান নয়?

রূপেন্দ্র দৃঢ়স্বরে বললেন, আমি তা মানি না! এ-সমস্তই পুরুষশাসিত সমাজ- অধিপতিদের একদর্শী চিন্তাধারার প্রতিফলন।

—না, রূপেন্দ্র, স্ত্রীজাতীয়ার গর্ভধারণের ক্ষমতা আছে, সন্তান প্রসবের ক্ষমতা আছে। পুরুষের নেই। কিন্তু প্রমীলারাজ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধি হতে পারে না, যতক্ষণ না সে-রাজ্যে পুরুষের পদার্পণ ঘটে।

রূপেন্দ্র বললেন, সে তো দৈহিক পার্থক্য। জৈবিক হেতুতে।

—মানলাম। তা থেকেই ‘গুণকর্মবিভাগ’ হয়েছে। প্রতিটি সংসারে। পুরুষ উপার্জনে সক্ষম হবার প্রয়োজনে নানান শিক্ষা গ্রহণ করে কামারের ছেলে হাতুড়ি চালানো শেখে, সূত্রধরের ছেলে শেখে করাত চালাতে, তন্তুবায়ের পুত্র তাঁত চালাতে। কোনও শাঁখারির মেয়ে যদি শাঁখা কাটে, বা কোন তাঁতির বৌ যদি তাঁত চালায় তাহলে বুঝতে হবে সে কর্তব্যের বেশি করছে; ঠিক যেমন চাষীভাই মাঠ থেকে ফিরে এসে যদি বলে, কই দুধের বাটি আর ঝিনুকটা দাও খোকনকে আমিই খাইয়ে দিচ্ছি। তাই পুরুষ ও স্ত্রী জাতীয়ারা পাঠশালায় একই বিষয়ে শিখবে না। শুধুমাত্র ব্যাকরণ, কাব্য, ন্যায়, আর দর্শন নিয়ে পড়ে থাকলে আমাদের চলবে না, রুপেন। বিজয়সিংহের মধুকর, সপ্তডিঙা, ময়ূরপঙ্ক্ষী হারিয়ে গেছে—সমুদ্র জয় করে হাজার হাজার যোজন দূর থেকে যারা এদেশে বাণিজ্য করছে সেইসব পর্তুগীজ, দিনেমার, ইংরেজ শিক্ষিত; কিন্তু তারা ব্যাকরণ, কাব্য, ন্যায় পড়েনি! সংক্ষেপে আমার বক্তব্য হল: আগামীযুগে গৌড়মণ্ডলকে উন্নততর করতে হলে পুরুষ ও স্ত্রী-জাতীয়া বাঙালির পাঠক্রম ভিন্ন ধরনের হবে। স্ত্রীলোকের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের পূর্বে এ নিয়ে তোমাকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। মেয়েরা শিখবে ধাত্রীবিদ্যা, শিশুপালন, গার্হস্থ্যবিধির স্বাস্থ্যসম্মত বিধান ইত্যাদি…শুধু তর্ক, ন্যায়, নব্যন্যায় নয়!

রূপেন্দ্র বললেন, আশ্চর্য! কী আশ্চর্য। এ-ভাবে তো ভাবিনি কোনদিন। তুমি আমার জীবনে এত দেরি করে কেন এলে, ঘনশ্যাম?

ঘনশ্যাম সহাস্যে বলেন, ফুলশেষের রাত্রে এ প্রশ্নের জবাবে নববধূ বলে, আজকের এই মিলনমধুর রাত্রিটি সার্থক হবে বলে!

রূপেন্দ্র বন্ধুর দুটি হাত সাগ্রহে নিজ করমুষ্টিতে গ্রহণ করে বললেন, কথা দাও, আমার সঙ্গে সোঞাই যাবে। আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে?

ঘনশ্যাম হঠাৎ কী-জানি কেন ম্লান হাসলেন। একটু চিন্তা করে বললেন, কাল তোমার এ-প্রশ্নের জবাব দেব। একটা রাত আমাকে একটু ভাবতে দাও। কিন্তু আমারও একটা সনির্বন্ধ অনুরোধ আছে, বন্ধু : কথা দাও! আমি যদি কোনও অনিবার্য কারণে তোমার আশ্রম নির্মাণের কাজে যোগ দিতে না পারি, তাহলে তুমি তোমার ঐ বৌঠানকে এই ‘সতী-মা’ গাঁ থেকে নিয়ে যাবে? তোমার আশ্রমে ঠাঁই দেবে?

—সে কী! তুমি যদি পুনরায় তোমার অভিজ্ঞান হারিয়ে ফেল, যদি উন্মাদ হয়ে যাও, তখন তাঁর উপস্থিতিটাই যে সবচেয়ে প্রয়োজন হবে তোমার…

—না। উন্মাদ নয়, ধর আমি যদি সন্ন্যাস নিই, অথবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে আমার যদি আকস্মিক মৃত্যু হয়, তাহলে কথা দাও বলভদ্রের ঐ কারাগারে ওকে রেখে যাবে না?

ভ্রূকুঞ্চন হল রূপেন্দ্রের। বললেন, আমরা দু-জনেই পরস্পরের কাছে প্রতিশ্রুত যে, কোন কিছু গোপন রাখব না…

—ঠিক কথা। কিন্তু আমরা দুজনেই বিবাহিত। স্ত্রীর গোপন কথা তো বন্ধুকেও বলা যায় না।

—ঠিক আছে। তাহলে তোমার ঐ প্রশ্নটির প্রত্যুত্তরও মুলতুবি থাক। তুমি সন্ন্যাস গ্রহণ করলে বৌঠানের দায়িত্ব আমি নেব কি নেব না!

ঘনশ্যাম বললেন, তাহলে আজ রাত্রিটা তুমি এখানেই বিশ্রাম নিয়ে যাও। এস আমরা তোমার ঐ স্ত্রীশিক্ষার পরিকল্পনাটা আজকেই মোটামুটি ছকে ফেলি। কী হবে ওদের পাঠক্রম? ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণদের পাঠক্রম কি একই জাতির হবে? ওরা কি একই সঙ্গে পড়তে বসবে, না কি একই পাঠশালায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে? স্ত্রীশিক্ষার ব্যবস্থা করছি শুনলেই গোঁড়া বামুনেরা তেড়ে আসবে, বাধা দেবে, তার উপর কি একই সঙ্গে জাতের বাধা দূর করার প্রচেষ্টা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে? সব কথাই আলোচনা করি। কে বলতে পারে

আগামী কাল এসব আলোচনা করার মতো মানসিক স্থৈর্যই হয়তো আমার থাকবে না।

দুই বন্ধু নানান বিষয়ে আলোচনা করলেন। সতীদাহ প্রথা থেকে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার, তা থেকে ক্রমে বিধবা-বিবাহের প্রবর্তন। ওঁরা জানতেও পারলেন না অজাত রামমোহন- মদনমোহন তর্কালঙ্কার-বিদ্যাসাগর-ডেভিড হেয়ারের জীবনব্যাপী সাধনার অঙ্কুরোদগম হতে থাকে ওঁদের দুজনের মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নৈশ আহারান্তেও দুই বন্ধু উঠে গেলেন ছাদে। সূর্য এখন মেষরাশিতে। প্রায় মধ্যরাত্রে যখন খ-মধ্যবিন্দুর দিকে হাত বাড়িয়েছে বৃশ্চিকরাশির অনন্ত জিজ্ঞাসা তখন দুজনে নেমে এলেন নিচে। ঘনশ্যাম বন্ধুকে পৌঁছে দিলেন নিচের বৈঠকখানা ঘরে। সেখানে একটি চৌকিতে মশারি পাতা। ঘনশ্যাম দেখে নিলেন শয্যাপার্শ্বে পানীয় জল ও ঘটি আছে কি না, চিনিয়ে দিলেন শৌচাগারের দিকে যাবার গলিপথ, তারপর প্রদীপে তৈলের পরিমাণ লক্ষ্য করে সেটিকে এমনস্থানে স্থাপন করলেন যাতে শায়িত রূপেন্দ্রের চোখে আলো না লাগে।

রূপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ছোট বৌঠান কোথায়?

—সারাদিন পরিশ্রম করে, এতক্ষণে বোধহয় ঘুমিয়ে কাদা। এবার তুমিও শুয়ে পড় বন্ধু!

—আর তুমি?

—আমার এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। যাই, তাহলে?

রূপেন্দ্র বললেন, ‘যাই’ বলতে নেই, বল, ‘আসি।’

হঠাৎ কী যেন হল। ঘনশ্যাম সার্বভৌম নিতান্ত ভাবাবেগে দৃঢ় আলিঙ্গনবদ্ধ করলেন রূপেন্দ্রকে। পরক্ষণেই আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

বিস্মিত রূপেন্দ্রনাথ এর কোনও কার্য-কারণ সূত্র খুঁজে গেলেন না।

১১

ঘুমটা ভেঙে গেল কোলাহলে।

শয্যাত্যাগমাত্র সচরাচর ইষ্ট-স্মরণ করেন রূপেন্দ্র। আজ ভুল হয়ে গেল তাঁর। মনে হল, দ্বিতল থেকে ভেসে আসছে নারীকণ্ঠে ক্রন্দনরোল।

সূর্য ওঠেনি, কিন্তু আলো ফুটেছে। বাসিমুখে জল দেওয়াও হল না। দ্রুতপদে রূপেন্দ্রনাথ উঠে এলেন দ্বিতলে। ঘনশ্যামের গৃহের সম্মুখে একটা জটলা। কক্ষের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ক্রন্দনধ্বনি। এগিয়ে গেলেন সেদিকে।

নিদারুণ দুঃসংবাদ! গৃহস্বামী উদ্ববন্ধনে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁকে সদ্য উদ্ববন্ধন দশা থেকে মুক্ত করে পালঙ্কে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশেই মূর্ছিতা হয়ে পড়ে আছে মালতী।

রূপেন্দ্র ভিড় সরিয়ে এগিয়ে এলেন। ঘনশ্যামকে পরীক্ষা করার কিছু নেই। দেখেই বোঝা যায় মেরুদণ্ডের সঙ্গে তাঁর মস্তকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন—তিনি মৃত। মালতীর হাতটি তুলে নিয়ে মণিবন্ধে নাড়ির গতি লক্ষ্য করলেন। সে মূর্ছাগতামাত্র। হাতটি তুলে ধরার সময় লক্ষ্য হল ওর মুঠিতে কয়েকটি ভূর্জপত্র। পুঁথির পৃষ্ঠা। সাবধানে সেটি খুলে নিয়ে অঙ্গরাখার পকেটে রেখে দিলেন। কক্ষে অধিকাংশই স্ত্রীলোক। একজন মাত্র ভৃত্যশ্রেণীর পুরুষ। তাকে প্রশ্ন করলেন, বলভদ্র কোথায়?

—কোতোয়ালরে খপর দিতি ঘোড়া ছুইটে তিনি চলি গ্যালেন আইজ্ঞে!

—আর তোমাদের বড়-মা?

—তা তো জানি না, কোবরেজমশাই। আছেন ভিতরবাগে কুথাও। দেখপ?

রূপেন্দ্র পরিচারিকাদের বললেন, মালতী মূর্ছা গেছে মাত্র। ভয়ের কিছু নাই। তার মুখে- চোখে জল দাও। নীবিবন্ধের বাঁধন আলগা করে দাও। ভিড় করে ঘিরে ধর না। ওকে বাতাস থেকে নিশ্বাস নিতে দাও।

ধীরে ধীরে বার হয়ে গেলেন কক্ষ থেকে। বাড়ি থেকে উদ্যানে। সূর্য উঠেছে। গাছ- গাছালিতে পাখ-পাখালির সদ্য-জাগরিত কলকাকলি। ঘনশ্যাম সার্বভৌম নামের এক উন্মাদ–যার সম্ভাবনা ছিল জগন্নাথোত্তর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার–সেই লোকটা ঐ শুকতারার সঙ্গে ডুবে গেল আকাশের নীলিমায়। প্রকৃতিতে সে জন্য কোনও পরিবর্তন হয়নি। পুব-আকাশ প্রতিদিনের মতোই লালে-লাল। ইতিমধ্যে খবরটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। দলে দলে কৌতূহলী জনতা সহানুভূতি জানানোর অছিলায় ভিড় করে ছুটে আসছে। উদ্যানের এক দূরতম অর্জুন গাছের তলায় গিয়ে বসলেন।

কেন ঘনশ্যাম আত্মহত্যা করলেন? কিন্তু আত্মহত্যাই তো? হত্যা নয়? আগে খুন করে পরে কেউ দড়ি থেকে ঝুলিয়ে দেয়নি?

হঠাৎ একটা কথা খেয়াল হল রূপেন্দ্রের। এত তড়িঘড়ি বলভদ্র কোতোয়ালিতে খবর দিতে নিজে ছুটল কেন? বোধহয় লোক জানাজানি হবার পূর্বেই কোতোয়ালের উপস্থিতিতে মৃতদেহটা সৎকার করে ফেলতে চায়–আর ঐ সঙ্গে জ্ঞানহীন মালতীর দেহটা চিতায় তুলে দেওয়া চাই। তাহলেই শর্তানুযায়ী দেবোত্তর সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবে বলভদ্র।

ওঁর মনে হল কালবিলম্ব না করে এখনি ত্রিবেণীতে ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা হয়ে পড়া দরকার’ একটা তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন–এটা হত্যা, না আত্মহত্যা?

উঠে দাঁড়াতেই অঙ্গরাখা থেকে একটুকরো ভূর্জপত্র পড়ে গেল মাটিতে। তখনই মনে পড়ে গেল রূপেন্দ্রের–এটি মূর্ছাতুরা মালতীর মুঠি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। আবার বসে পড়েন গাছতলায়।

কী আশ্চর্য! মুর্ছাতুরা মালতীর মুঠিতে যা ধরা ছিল তা কোন পুঁথির ছিন্নপত্র নয়! এটি একটি লিপি। মৃত্যুকে বামমুঠায় কব্জা করে মহাপণ্ডিত ঘনশ্যাম তা রচনা করেছেন খাগের কলমে, ভূর্জপত্রে। এটি ঘনশ্যামের শেষ পত্র। সার্বভৌমের স্বেচ্ছায় আত্মহননের স্বীকৃতি পত্র। কিন্তু লিখেছেন তাঁর অহোরাত্রের বন্ধু রূপেন্দ্রনাথ দেবশর্মণঃকে সম্বোধন করে। ভাষা সংস্কৃত কিন্তু লিপ্যক্ষর ব্রাহ্মী। যে লিপ্যক্ষরে সম্রাট অশোক লিখিয়েছিলেন তাঁর যাবতীয় শিলালেখ-অনুশাসন। সম্ভবত সার্বভৌম এ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন বিশেষ উদ্দেশ্যে। যাতে ওঁর পত্রটি কোন অর্বাচীনের হাতে পড়লে সে পাঠোদ্ধার করতে না পারে। বুঝবেন রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্য। এবং বুঝবেন মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন :

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্
বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্।
যুযোধ্যস্মজ্জহুরাণমেনো,
ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম।।

বন্ধুবর রূপেন্দ্রনাথ,

আত্মহননের অন্তিম সমাধান ভিন্ন আর কোন পথ ছিল না বলিয়াই এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত। তুমি আমার বাল্য, কৈশোর, ও যৌবনের গোপনকথা জানিয়াছ নিশ্চয় ভেষগাচার্য হিসাবে প্রণিধান করিয়াছ যে, আমার যে-রোগ—মাঝে-মাঝে আমি যে মানসিক ভারসাম্যচ্যুত হইয়া যাই, তাহার জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী একটি সর্বব্যাপী সামাজিক কুসংস্কার: সতীদাহ! আমার ব্যক্তিগত জীবনে সে জন্য দায়ী আমার স্বর্গত পিতৃদেব এবং পরমপূজ্য মাতুলশ্রী মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।

তোমাকে বলিয়াছি, আমি প্রথমবার বিবাহ করি উন্মাদ অবস্থায়। কুশণ্ডিকায় প্রতিজ্ঞা করি নাই, কোন মন্ত্রোচ্চারণের ক্ষমতাই আমার ছিল না। কিন্তু পিতৃদেবের একটি পৌত্রের নিতান্ত প্রয়োজন হইয়া পড়ে, তাই এই অশাস্ত্রীয় বিবাহের আয়োজন। যেহেতু স্বয়ং দ্বিভুজ জগন্নাথ এ বিবাহ-বাসরে বরকর্তা, তাই এই অশাস্ত্রীয় বিবাহ সিদ্ধ বলিয়া সমাজে গৃহীত হইল।

অভিজ্ঞান ফিরিয়া আসিবার পর স্ত্রীকে প্রথম দেখিলাম। সপুত্র! লোকমুখে শুনিলাম, পিতৃদেব সদ্যবিবাহিত দম্পতিকে বিবাহের অব্যবহিত পরে জগন্নাথ- ক্ষেত্রে লইয়া গিয়াছিলেন। বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেখানে সাড়ম্বরে পুরশ্চরণাদি যজ্ঞ করার ফলশ্রুতি হিসাবে আমার অজ্ঞাতে আমার স্ত্রী গর্ভবতী হন। আমার প্রথমা পত্নী একথা জানিয়াই আমাকে বিবাহ করেন যে, আমি ঘোর উম্মাদ। তিনি মাতুল মহাশয়ের এক ধনবান যজমানের কন্যা। দুর্ভাগ্যবশত মুখে বীভৎস শ্বেতীর দাগ থাকায় তাঁহার কোনও কুলীন পাত্রে বিবাহ হওয়া অসম্ভব ছিল একেবারে অন্তর্জলিযাত্রার জ্ঞানহারা কুলীন বৃদ্ধ ব্যতিরেকে। কন্যার পিতা তাই আমাকে জামাতা হিসাবে গ্রহণ করিতে আপত্তি করেন নাই। কৌলীন্যও বজায় রহিল, কন্যাও শাঁখা-সিঁদুর লইয়া সধবার জীবন যাপনের অধিকার পাইল।

তুমি জান, জন্ম-সময়েই আমার গর্ভধারিণীর মৃত্যু হইয়াছিল। ফলে মাসিমাতার নিকট মানুষ হইয়াছি। আমি পুনরায় উন্মাদ হইলাম আমার পিতার মৃত্যুতে। ততদিনে আমার ক্ষেত্রজ পুত্র বলভদ্র উঠতি জোয়ান। পাইকের সাহায্যে তাহার উন্মাদ পিতাকে রজ্জুবদ্ধ করিয়া আমার মাসিমা তথা বিমাতাকে পুড়াইয়া মারিল: সহমরণ! বলাবাহুল্য ‘ত্রিবেণীর গর্ব’ পণ্ডিত-মহাশয়ের অনুমত্যনুসারেই শুধু নয়, বর্বর উপস্থিতিতে। সেবার আমি দীর্ঘদিন উন্মাদ হইয়া রহিলাম। সকলে স্থিরসিদ্ধান্তে আসিল, আমি চিকিৎসার বাহিরে চলিয়া গিয়াছি। বলভদ্র আমাদের ভদ্রাসনেই একটি কারাকক্ষ বানাইল। শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় বেশ কয়েক বৎসর সেখানে পড়িয়া ছিলাম। হয়তো এভাবেই জীবনের শেষ হইত। হইল না! কেমন করিয়া হইবে? মাতুল মহাশয়ের সেই ধনী যজমানের কন্যার তো একটা গতি করা দরকার! ফলে বলভদ্র তাহার বাপের দ্বিতীয়বার বিবাহ দিল। এবারও উম্মাদ অবস্থায় টোপর পরিলাম, চন্দন-চর্চিত হইলাম এবং কুশণ্ডিকায় মন্ত্রোচ্চারণ না করিয়া হিন্দু বিবাহ করিলাম। কেন করিব না? বিবাহ বাসরে সমস্তক্ষণ খাড়া ছিলেন জগন্নাথ। ঠুটো জগন্নাথ নয়। গৌড়মণ্ডলের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত দ্বিভুজ জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন! যজমানের স্বার্থে!

অতিশয় বিস্ময়ের কথা, এবার ফুলশয্যা রাত্রে আমার অভিজ্ঞান ফিরিয়া আসিল। দেখিলাম নববধূ আমাকে ভয় পাইতেছে না। প্রশ্ন করিয়া জানিতে পারিলাম, সে পিতৃমাতৃহীনা—মাতুলের অন্নঋণ পরিশোধ করিতে উন্মাদকে বিবাহ করিয়াছে, যে উম্মাদের দেহান্তে সে সহমরণে যাইতেও স্বীকৃতা। স্ত্রী না হইলে ফুলশয্যার রাত্রে আমি তাহাকে প্রণাম করিতাম, রূপেন্দ্ৰ!

আমাদের বিবাহ দেড় বৎসরও হয় নাই। কিন্তু আমরা পরস্পরকে প্রাণাধিক ভাল বাসিয়াছিলাম। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে গঙ্গাফড়িং যেভাবে নিজের অজান্তে ঘাসের রঙ ধরে, আমিও তেমনি আত্মরক্ষার্থেই পাগলের ঢঙ ধরিলাম। নববধূ ভিন্ন কেহই জানিতে পারিল না যে, বাহ্যদৃষ্টিতে যে লোকটা বদ্ধ উন্মাদ সে আদৌ পাগল নহে।

বিচিত্র হেতুতে তাহার পর এই দীর্ঘদিন পাগল সাজিয়াই ছিলাম। আমার আশঙ্কা ছিল, বলভদ্র বিষপ্রয়োগে আমাকে হত্যার চেষ্টা করিবে। সেজন্যই পাগলের ভেক পরিত্যাগ করি নাই। বাপের দ্বিতীয়বার বিবাহ না দিয়া আমাকে সে হত্যা করিতে পারিতেছিল না; কারণ সেক্ষেত্রে তাহার গর্ভধারিণীকে পোড়াইয়া মারিতে হয়। বলভদ্রের মুশকিল হইল এই যে, বাপের বিবাহ দেওয়ার পর আমাকে বিষপ্রয়োগ করা তাহার পক্ষে কঠিনতর হইয়া পড়িল। নববধূর সতর্কতায়।

এইবার বলি: কেন আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিলাম :

বলভদ্রের প্রতি মাতুলমহাশয় আদৌ প্রীত নহেন। কিন্তু যজমানের কন্যাটিকে রক্ষা করার জন্য তিনি নিরতিশয় যত্নশীল। সেই সূচ্যগ্রবুদ্ধি ত্রিবেণীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতটির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিতে পারিলাম বলিয়া সানন্দে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতেছি! মাতুলশ্রীর গ্রন্থাগারে মা সরস্বতী এবং ধনাগারে মা লক্ষ্মী যুগপৎ বন্দিনী। কিন্তু পুত্রস্থানীয়ের নিকট পরাজয়েই তো শ্রেষ্ঠ আনন্দ! আজ তাই তাঁহারও আনন্দের দিন!

শারীরবিদ্যা সম্বন্ধে. যেটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করিয়াছি তাহাতে দৃঢ়স্বরে বলিতে পারি: আমার দ্বিতীয়া স্ত্রী মালতী বর্তমানে চারিমাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার ক্ষেত্রজপুত্র বলভদ্র তা অপ্রমাণ করিতে উৎকোচ দিয়া একাধিক ধাত্রীর মতামত গ্রহণ করিবে। সেজন্য তোমার উপস্থিতিতেই আত্মহননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইল। ত্রিবেণীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের মতে তুমি বর্তমানে গৌড়মণ্ডলের শ্রেষ্ঠ ভেষগাচার্য। এ কথা আজই তিনি সর্বসমক্ষে ঘোষণা করিয়াছেন। তুমি মালতীকে পরীক্ষা করিয়া তথ্যটা সকলকে জ্ঞাত করাইও। বিশেষ, আমার মাতুলকে।

কারণ সেই মহাপণ্ডিত সবিশেষ জ্ঞাত আছেন: মনুসংহিতা-মতে আমার কনিষ্ঠা পত্নী মালতী সহমরণে যাইবার অনধিকারী। নারদীয় পুরাণের দ্বিতীয় খণ্ডে মহামুনি নারদ স্পষ্টাক্ষরে বলিয়াছেন—গর্ভবতী অবস্থায় কেহই সহমরণে যাইতে পারিবে না। টীকাকার ঋষি বৃহস্পতিও একই নির্দেশ দিয়াছেন। বস্তুত ত্রিবেণীর অবিসংবাদিত মহাপণ্ডিত একাধিক ক্ষেত্রে সদ্যমৃতের শ্বশুরকে এই বিধানটি ভূর্জপত্রে লিখিয়া দিয়া বহু আকবরী মোহর প্রণামী লইয়াছেন। তাঁহার যজমানেরা ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি দিতে দিতে বিধবা কন্যাকে লইয়া স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে।

অস্যার্থ? আমার প্রথমা পত্নীর ক্ষেত্রজ-পুত্র বলভদ্র যদি ঐ বিষাক্ত দেবোত্তর সম্পত্তিলাভের মোহমুক্ত না হইতে পারে, তাহা হইলে তাহার সম্মুখে একটিই রাজপথ উন্মুক্ত রহিল: পাইক বরকন্দাজের সাহায্যে দাদামহাশয় এবং তস্য গুরুকে রজ্জুবদ্ধ করিয়া আমার মৃতদেহের সহিত স্বীয় গর্ভধারিণীকে চিতায় দগ্ধ করা। সম্ভবত অর্থলোভে সে সতী মায়ের জয়ধ্বনি দিয়া তাহাই করিবে। করুক! সে দ্বৈরথ সমর আমি দেখিতে পাইব না। দ্বৈরথ-সমর নিঃসন্দেহে। যজমানের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দ্বিভুজ জগন্নাথ বনাম অর্থলোভে মাতৃহত্যায় উদ্যত বহুভুজ বলভদ্র! স্বামী হিসাবে আমার কর্তব্য ছিল সহধর্মিণীকে প্রাণ দিয়া রক্ষা করা। আক্ষরিক অর্থে তাহাই করিয়া গেলাম।

বন্ধু বলিয়া স্বীকার করিয়াছ। তাই কিছু দায়িত্ব দিয়া গেলাম:

এক : আমার মুখাগ্নি করিবে দ্বিতীয়া স্ত্রী মালতী– ক্ষেত্রজ পুত্র নহে।  

দুই : আমার শ্রাদ্ধাধিকারিণী আমার দ্বিতীয়া স্ত্রী।

তিন : মালতীকে সোঞাই লইয়া যাইও! লোকলজ্জাকে ভ্রুক্ষেপ করিও না। তাহার প্রসব তুমি নিজে করাইবে। কোন ধাত্রী নহে। মালতী যেন দ্বিতীয়া কুসুমমঞ্জরী না হয়।

চার : মালতীর কন্যাসন্তান জন্মিলে সে তোমার পাঠশালায় পড়িবে। পুত্র সন্তান জন্মিলে তাহাকে ত্রিবেণী পাঠাইও না। পরন্তু নদীয়ায় পরমারাধ্য- মহাত্মা রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের চতুষ্পাঠীতে প্রেরণ করিও।

আমার পরমপূজ্য মাতুল-মহাশয়কে আমার অর্বুদকোটি প্রণাম জানাইও। কী দুঃখের কথা রূপেন্দ্র। কী অপরিসীম দুর্ভাগ্যের কথা: বর্ণনিকৃষ্ট’ ব্ৰাহ্মণ- কুলে কেন আমার জন্ম হইল? আহা যদি ম্লেচ্ছ হইতাম! যদি খৃষ্টান হইতাম। মুসলমান হইতাম। নিতান্ত পক্ষে যদি অচ্ছুৎ চণ্ডালবংশে জন্মিতাম (আজ্ঞে হ্যাঁ, মাতুলশ্রী! মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়াইয়া আমি পুনরায় উন্মাদ হইয়া গিয়াছি। আপনি ঠিকই বুঝিয়াছেন!) তাহা হইলে তোমাকে অনুরোধ করিতাম : বন্ধুবর রূপেন্দ্র! তুমি সতীদাহপ্রথা রদ করিয়াই ক্ষান্ত হইও না! বিধবা-বিবাহ প্রচলনের ব্যবস্থা করিও! স্বয়ং উদাহরণ স্থাপন করিও হতভাগিনী মালতীকে সহধর্মিণীরূপে গ্রহণ করিয়া।

তাহার ন্যায় কল্যাণময়ী, শুচিশুভ্র অন্তঃকরণ, নিঃস্বার্থ প্রেম, নিরলস সেবা—কী বলিব?–দক্ষিণাবর্ত শুক্তির গর্ভে লুক্কাইত মুক্তার মতোই সুদুর্লভ।

বিদায় বন্ধু!

ঘনশ্যাম দেবশর্মণঃ।।

১২

রূপেন্দ্রনাথ যখন ত্রিবেণীতে এসে পৌঁছালেন তখন এক প্রহর অতিক্রান্ত। গঞ্জ ও শহরে কর্মচঞ্চলতা শুরু হয়েছে। অশ্বারোহণে তর্কপঞ্চাননের চতুষ্পাঠীতে পৌঁছে অশ্বটিকে একটি আমগাছের সঙ্গে রজ্জুবদ্ধ করে এগিয়ে এলেন। প্রতিটি শ্রেণীতে অধ্যয়ন-অধ্যাপন শুরু হয়েছে। সংবাদ নিয়ে জানা গেল, তর্কপঞ্চানন প্রত্যুষে গঙ্গাস্নান সেরে অনেকক্ষণ ফিরেছেন। তাঁর আহ্নিক ও প্রসাদ গ্রহণও শেষ হয়েছে। ভদ্রাসন থেকে টোলে আসবার জন্য তিনি প্রস্তুত হচ্ছিলেন। রূপেন্দ্রনাথ সেই সময় ওঁর সর্বতোভদ্রে গিয়ে দেখা করলেন।

তর্কপঞ্চানন বললেন, এত সকাল-সকালই ঘনশ্যাম তোমাকে ছেড়ে দিল যে বড়? আহ্নিক হয়েছে?

তারপর রূপেন্দ্রের দিকে ভাল করে তাকিয়েই তীক্ষ্ণধী পণ্ডিত অনুধাবন করলেন অপ্রত্যাশিত কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন করেন, কী হয়েছে রূপেন্দ্র? তোমাকে অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

রূপেন্দ্র বললেন, মর্মান্তিক দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি, গুরুদেব। কাল শেষ রাত্রে সার্বভৌম দেহত্যাগ করেছেন।

—দেহত্যাগ করেছে! বল কী! ঘনশ্যাম? কিন্তু তার স্বাস্থ্য তো…?

—ঘনশ্যাম আত্মহত্যা করেছে! উদ্বন্ধনে!

স্তম্ভিত হয়ে গেলেন পণ্ডিতজী। সংবাদটা পরিপাক করাতে কিছুটা সময় লাগল। তারপর নিম্নস্বরে বললেন, তুমি নিঃসংশয়? আত্মহত্যাই? অন্য কিছু নয়?

—অন্য কিছু?

—মৃত্যুর পরে তাকে কেউ কড়িকাঠ থেকে ঝুলিয়ে দেয়নি?

—আজ্ঞে না, হত্যা নয়। সার্বভৌম্য সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করেছে। একটি স্বীকৃতিপত্রে সে আমাকে সে কথা স্পষ্টাক্ষরে জানিয়ে গেছে। সেটি জাল-পত্র হতেই পারে না; কারণ লিপ্যক্ষর ব্রাহ্মী-হরফ, ভাষা সংস্কৃত। আপনি-আমি এবং লেখক ব্যতীত সে জাতীয় পত্র এ অঞ্চলে কেউ রচনা বা পাঠ করতে পারবে না।

—স্বীকৃতিপত্রটি কি সে তোমাকে লিখেছে, না আমাকে?

—আমাকেই লিখেছে। তবে পত্রে সে অনুরোধ করেছে সেটি আপনাকে দেখাতে।

রূপেন্দ্রনাথের হাত থেকে ভূর্জপত্রগুলি—বাব্‌লার কাঁটায় পৃষ্ঠাগুলি পরপর গ্রথিত—নিয়ে জগন্নাথ ধীরে ধীরে পাঠ করতে থাকেন। সৌজন্যবোধে নিঃশব্দে রূপেন্দ্রনাথ গৃহদ্বার অতিক্রম করে বাহিরের টানা-বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘনশ্যাম তাঁর মাতুলকে অর্বুদকোটি প্রণাম জানিয়েছেন বটে কিন্তু মৌলবাদী মামার অন্যায় আচরণের জন্য তাঁকে শ্লেষাত্মক শাণিত ভাষায় বারংবার তীরবিদ্ধ করতেও পরাজুখ হননি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন দ্বারের কাছে সরে এসে বললেন, ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে।’ অত বড় মহাপ্রাণ অকালে চলে গেল। ওর যদি ঐ জাতির ব্যাধি না থাকত, আমি নিশ্চিন্ত বলতে পারি রুপেন, ও রঘুনন্দনের সমপর্যায়ের পণ্ডিত হয়ে উঠত।… সে যাই হোক, তুমি কি বৌমাকে পরীক্ষা করে দেখেছ?

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, পরীক্ষা করা নিষ্প্রয়োজন। এ বিষয়ে শতকরা শতভাগ সুনিশ্চিত না হলে ঘনশ্যাম ও-কাজ করত না।

—তা বটে! তাহলে চল, এখনি বেরিয়ে পড়ি। তুমি কালিপদকে বল পাল্কি বাহকদের খবর দিতে। সতী-মা গাঁয়ে যাব। তুমিও যাহোক কিছু মুখে দিয়ে নাও। আমাদের ফিরতে হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

রূপেন্দ্রনাথের লক্ষ্য হল, জগন্নাথ একটি টাকার থলি কোমরে গুঁজে নিলেন। কার্যকারণসূত্র বোঝা গেল না, কারণ দাহকার্যের জন্য বলভদ্রের নিশ্চয় অর্থের প্রয়োজন হবে না।

অর্ধদণ্ডের মধ্যেই দুজনে পুনরায় রওনা দিলেন সতী-মা তালুকের অভিমুখে। আট বেহারার কাঁধে পালকিতে তর্কপঞ্চানন এবং অশ্বপৃষ্ঠে রূপেন্দ্রনাথ। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই পালকি অন্য এক ভিন্ন পথে বাঁক নিল। রূপেন্দ্র বাধা দিলেন না। পথ জগন্নাথ খুব ভাল ভাবেই চেনেন; এ-দিকে মোড় নেওয়ার নিশ্চয় কোন বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। একটু পরেই কী-এক গাঁয়ে উঁচু পাঁচিল-দিয়ে-ঘেরা একটি ধনিক ব্যক্তির গৃহের কাছাকাছি পাল্কি নামানো হল। দশরথ লাঠিয়াল–জগন্নাথের নিত্যসঙ্গী দেহরক্ষী—ঐ মোকামের দিকে এগিয়ে গেল। উড়ুনি-কাঁধে তর্কপঞ্চানন পাল্কির বাহিরে এসে খড়ম খটখট করতে করতে এগিয়ে এসে বসলেন একটি অশ্বত্থগাছের বাঁধানো বেদিমূলে। রূপেন্দ্র কোনও কৌতূহল প্রদর্শন করলেন না। তিনি জানেন, এ-সব ক্ষেত্রে কেউ কৌতূহলী হলে পঞ্চাননঠাকুর বিরক্ত হন। একটু পরেই গৃহাভ্যন্তর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন একজন মুসলমান বৃদ্ধ ভদ্রলোক। নগ্নগাত্রে, লুঙ্গি পরিধান করে। এক মুখ পাকা দাড়ি, এক বুক পাকা চুল। এগিয়ে এসে বললেন, সেলাম আলেকম ঠাকুরমশাই। আপনে এই সাত-সকালে? হইছেডা কী? তা আমারে টুক ডাক দিলিই তো হাজির হতাম আমি।

জগন্নাথ বললেন, ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি তাই নিজেই চলে এসেছি, হাজী সাহেব। এ দিকে সরে আসুন। আমি চাই না কথাটা পাঁচ কান হোক।

‘হাজী সাহেব’ বলে যাঁকে ডাকলেন, সেই বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন, স্পর্শ-বাঁচানো ঘনিষ্ঠ নৈকট্যে। পঞ্চানন-ঠাকুর তাঁকে নিম্নস্বরে কিছু বললেন। বৃদ্ধ ঘনঘন শিরশ্চালনে স্বীকৃত হলেন। তারপর পিছন ফিরে গৃহাভিমুখী হতেই জগন্নাথ ওঁকে আবার ডাকলেন। বললেন, ছেলেমেয়েদের কিছু মিষ্টি খেতে দেবেন।

বলে, সিক্কা টাকা-ভর্তি থলিটা আলগোছে ওঁর হাতে ফেলে দিলেন। হাজী সাহেব বললেন, আরে এসব কী কাণ্ড! এর কোনও প্রয়োজন আছিল না ঠাকুরমশাই। তবে পোলাপানদের মিষ্টান্ন বিতরণের জন্য দিচ্ছেন, আমি আপত্তি করনের কে?

বৃদ্ধ গৃহে ফিরে যেতেই একটি ছোট ছেলে ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। তার দু-হাতে দুটি ছাড়ানো ডাব; কিন্তু মুখ-কাটা নয়। বগলে কাটারি। দশরথ ছেলেটির হাত থেকে ডাব কাটারি নিয়ে মুখ কেটে জগন্নাথ ও রূপেন্দ্রকে দিল। ওঁরা মুসলমান বাড়িতে জাতি- বাঁচানো সৌজন্য রক্ষা করলেন। তারও কিছুক্ষণ পরে হাজী সাহেব ফিরে এসে জগন্নাথের পাশে স্পর্শ-বাঁচানো একটি পত্র দাখিল করলেন। জগন্নাথ সেটি তুলে নিয়ে তাঁর হাত-বটুয়ায় রাখলেন।

হুম্‌ব্রো-হুম্‌ব্রো রবে পাল্কি চলল সতী-মা তালুকে।

তালুকদারের বাড়িতে লোকে-লোকারণ্য। বেলা তখন প্রায় দ্বিপ্রহর। সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে খবর পেয়ে মানুষজন ছুটে আসছে। সতীমায়ের স্বর্গারোহণ দেখতে। যারা জীবনে কখনো মিছে কথা বলেনি, কোন পাপ কাজ করেনি, তারা স্বচক্ষে দেখতে পায় স্বর্গ থেকে রথকে নেমে আসতে চিতা থেকে সতী-মাকে তুলে নিয়ে আবার স্বর্গের সেই সোনার রথ স্বর্গে ফিরে যায়। অধিকাংশ দর্শকই তা আবছা দেখতে পায় ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভিতর দিয়ে। না-হলে যে মেনে নিতে হয় তারা মিছে-কথা বলে থাকে।

তর্কপঞ্চাননের পালকি এসে থামল তালুকদারের বাড়ির সামনে। ভিড় দু-ফাঁক হয়ে গেল ওঁর পরিচয় পেয়ে। ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল বলভদ্র– নগ্নপদ, নগ্নগাত্র–সে এসে হাউমাউ করে কী বলল তা বোঝা গেল না।

জগন্নাথ দৃঢ়হস্তে তার বাহুমূল চেপে ধরে বললেন, চল! ভিতরে চল। তোমার ঘরে। এ সময় কি অত উতলা হলে চলে? এস…

বলভদ্রের ঘরে এসে উনি একটি কেদারায় বসলেন। বলভদ্র ভূশয্যাতেই কম্বলের টুকরো পেতে বসল। বলল, এ কী সর্বনাশ হয়ে গেল, দাদু!

সে-কথার জবাব না দিয়ে জগন্নাথ প্রশ্ন করলেন, কোতোয়ালিতে খবর দিয়েছ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। বড়-দারোগা ঘোষাল-সাহেব এসেছিলেন। স্বচক্ষে দেখে চলে গেছেন। তাঁর পার্বণীও মিটিয়ে দিয়েছি। দাহ করার অনুমতি দিয়ে গেছেন।

—কোথায় ফিরে গেলেন তিনি? কোতায়ালিতে, না নিজের মোকামে?

—আজ্ঞে না। উনি বললেন শ্মশানে অপেক্ষা করবেন। শ্মশানকালীর পূজা করবেন। দাহকার্য হয়ে গেলে সব মিটিয়ে বাড়ি যাবেন। সহমরণের ব্যাপার তো! বড় হুজ্জোৎ হয়! প্রতিবারই তিনি তাই করেন। কাজী সাহেবের তাই নির্দেশ।

জগন্নাথ বলেন, একটা গোপন কথা বলব বলে তোমাকে আড়ালে ডেকেছি বলভদ্র! ছোট বৌমা মালতী গর্ভিণী। সে তো সহমৃতা হতে পারবে না। শাস্ত্রে সেরকম নির্দেশ নেই।

বলভদ্রের চোয়ালের নিম্নাংশটা ঝুলে পড়ল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, কে বলেছে?

—তোমার বাবা আত্মহত্যা করার আগে একটি স্বীকৃতিপত্রে তা জানিয়েছেন।

—আমি বিশ্বাস করি না। এ ছিরু পালের ষড়যন্ত্র! কই, দেখি সেই স্বীকৃতিপত্র?

জগন্নাথ তাঁর পুঁটলি থেকে ভূর্জপত্রটি বার করে দেখালেন। বললেন, যে ভাষায় লেখা তা তোমার বোধগম্য হবে না, বাবা। কিন্তু আমার কথাটা মেনে নাও বলভদ্র!

—মেনে নেব? আপনার কথা মেনে নেব? মেনে নিয়ে কী করব? বুড়ো আঙুল চুষব? আর ইদিকে অবস্থাটা নিজ চোখে এসে দেখুন।

এবার জগন্নাথের বাহুমুল পাকড়াও করে বলভদ্রই ওঁকে নিয়ে এল অন্দর মহলে। উঠোনের মাঝখানে একটা চৌকির উপর বসানো হয়েছে একটি জলচৌকি। যাতে দর্শকদের দৃষ্টিপথে বাধা না পড়ে। তার উপর বসে আছে মালতী। একবস্ত্রা। লালপাড় পট্টবস্ত্র। তার পায়ে আলতা, হাতের তালুতে আলতা, মাথায় ব্রহ্মতালু পর্যন্ত লালে-লাল সিন্দুর। এয়োস্ত্রীরা তাকে ঘিরে আছে। শাঁখ বাজাচ্ছে, মাঝে-মাঝে হুলুধ্বনি দিচ্ছে। নিজ নিজ সৌভাগ্য সিন্দুরের কৌটা মালতীর পায়ে ছুঁইয়ে নেবার জন্য হুড়াহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। কাঁসর-ঘণ্টার ঠ্যাঙাঠ্যাঙ লেগেই আছে!

বলভদ্র বললে, এখন ও-কথা কে শুনবে বলুন? শেষে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যাবে, দাদু! এরা অনেকেই এসেছে ভিন গাঁ থেকে। এখনো সার দিয়ে গো-গাড়ি আসছে তো আসছেই! আমার এতবড় বুকের পাটা নেই যে, এখন গিয়ে ওখানে বলব ছোট মা সতী হবেন না! তাঁর ‘পেট’ হয়েছে!

—তুমি না পারলে আমি বলব। আমার কথা ওরা মেনে নেবে। তুমি চিন্তা কর না!

—কিন্তু ছোট-মা সতী না হলে তালুক যে আমাদের বেহাত হয়ে যাবে দাদু?

—তা তো যাবেই। যদি না… ভাল কথা, তোমার গর্ভধারিণী জননী কোথায়?

—তিনি সকাল থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। সান নেই।

—রূপেন্দ্রনাথকে বলব গিয়ে দেখতে?

—না না! ভয়ের কিছু নেই। জ্ঞান আপনিই ফিরবে। আপনি ইদিকে বরং সরে আসুন। কতা আছে।

জনান্তিকে পুনরায় জগন্নাথকে টেনে এনে বলভদ্র বললে, আপনি আর অমত করবেন না, দাদু! কাকপক্ষীতে জানে না যে, ছোট-মার পেটে বাচ্চা। ওঁর মামাকে আমি অনেক টাকা গুনে দিয়েছি—শুধু এই দিনে এই উগ্গারটি করার জন্যই। যারা সিঁদূর সংগ্রহ করতে এসেছে তারা বামুনবাড়িতে রীতিমতো প্রণামী দিয়েই সিঁদুর সংগ্রহ করছে। অনেকে সিঁদুর নিয়ে চলেও গেছে! তারা ছাড়বে কেন? শেষে লাঠালাঠি শুরু হয়ে যাবে!

জগন্নাথ দৃঢ়স্বরে বলেন, বলভদ্র! আমি যখন নিদান হেঁকেছি তখন তার আর কোন পরিবর্তন হবে না। তোমার ছোটমা মালতী বৌমা সহমরণে যাবেন না। এখন কী করবে? সম্পত্তির আশা ত্যাগ করবে, না গর্ভধারিণীকে পোড়াবে? কী চাও তুমি?

বলভদ্র তৎক্ষণাৎ নিজমূর্তি ধারণ করল। বলল, তিনি শুধু আমার গব্বোধারিণী? না কি আপনারও যজমানের মেয়ে?

—হ্যাঁ তাই। দুটোই সত্য! সে জন্য আমার পরামর্শ : সম্পত্তির আশা তুমি ত্যাগ কর। ঘনশ্যামের সঙ্গে কেউই সহমরণে যাবে না।

বলভদ্র বললে, ইল্লি! ভাববেন না আমি তৈরি নই। আপনার ঐ দশরথ লেঠেলকে দরকার হলে আমার বাপের সঙ্গে চিতেয় তুলে দিতে পারব। এমন আশঙ্কা ছিলই। তবে আমার আনজাদ ছিল বাধা দিতে আসবে ছিরু পাল। এই তালুকটার উপর তার অনেকদিনের নজর। শুনুন, পঞ্চানন ঠাকুর! ইদিক-উদিক খরচপাতি যা করার করেছি। একশ লেঠেল মোতায়েন করেছি কাজ্জোদ্ধারের জন্যে! সুতরাং ঐ নিদেন-হাঁকার কেরামতি আপাতত ছিকেয় তুলে রেখে বাড়ি যান। ছোট-মার যে পেট হয়েছে, তা আম্মো আজাদ করেছি। তবে কতাটা এখনো পাঁচ কান হয়নি। কাক-পক্ষীতে টের পাবে না। রোদের তেজ বাড়ছে। আপনি দয়া করে বাড়ি যান।

—তুমি আমার কথাটা শুনবে না?

—আমার বাপ পাগল ছিল মানছি! আম্মো তো পাগল নই।

জগন্নাথ আর কথা বাড়ালেন না। উঠে পড়লেন। প্রতিবেশী গ্রামের সধবা মহিলারা তখনো সার বেঁধে অন্দরের দিকে চলেছেন। বলভদ্র পিছন থেকে বললে, মনে করবেন না ঠাকুর যে, আপনারে অচ্ছেদ্দা করছি। অশৌচ চলছে, তা নইলে ত্রিবেণীর পঞ্চাননঠাউরকে এট্টা পেন্নম অন্তত করতাম!

জগন্নাথ বললেন, চলে এস রুপেন। ও আমার কথা শুনবে না।

রূপেন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে বললেন, এই অনাচারের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করব না?

জগন্নাথ পাল্কিতে উঠে বসেছিলেন। বললেন, তুমি আমার সঙ্গে আসবে, না এখানেই তামাশা দেখতে থেকে যাবে?

রূপেন্দ্রনাথ বিনা বাক্যব্যয়ে অশ্বারোহণ করলেন।

জগন্নাথের নির্দেশে পাল্কিটা এসে থামল শ্মশানে। একটা প্রকাণ্ড গোলকচাঁপা গাছের তলায়। জগন্নাথ পাকি থেকে নেমে দশরথকে ডেকে বললেন, দেখ তো রে দশরথ। ঘোষাল দারোগা ঘাটে আছে কি না। শ্মশানকালীর পুজো দিতে এসেছে। অর্থাৎ মদ গিলতে। শিবঅ কে চিনিস তো?—শ্মশান-চণ্ডাল—ও বলতে পারবে।

অনতিবিলম্বেই বড় দারোগা সহদেব ঘোষালকে নিয়ে দশরথ ফিরে এল। সহদেব যথারীতি এই সাত সকালেই শ্মশানকালীর ঠাঞে কিছু কারণবারি পান করেছে বলভদ্রের হাত থেকে এক মুঠো কাঁচা সিক্কাটাকা পেয়ে। কিন্তু ত্রিবেণীর পঞ্চানন ঠাকুরকে চিনতে ভুল হবার মতো নয় সে নেশার পরিমাণ। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললে, শ্মশানে এয়েছেন কেন, দ্যাবতা? আমারে এট্টু জানান দিলেই তো আপনার ঠায়ে দৌড়ে যেতাম!

জগন্নাথ আঙরাখা থেকে এক-টুকরো কাগজ বার করে ঘোষালের হাতে দিলেন। বললেন, পড়তে পারবে? না পড়ে শোনাব?

—আজ্ঞে না! কী যে বলেন ঠাউর! এ তো কাজী-ছায়েবের হুকুমনামা। র’ন, পড়ে দেখি।

চিঠিখানা কিছুটা পড়ে সে রক্তাক্ত ঘোলাটে চোখদুটো জগন্নাথের মুখে মেলে বললে, আম্মো তাই আন্দাজ করেছিলাম। শালা, বাপ্‌কে খুন করে ফাঁসিতে লটকেছে। এখন কী করণীয়?

—দেখ, গোটা চিঠিটা পড়ে দেখ। কাজীসাহেবই তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

ঘোষাল বলে, কিছু মনে করবেন না ঠাউর-মশাই, কাজী সাহেবের হাতের লেখাটা বড্ড জড়ানো। মনে লাগে, পুরো বোতল কালীমার্কা সেবন করে তারপর খাগের কলম হাতে নিয়েছিলেন। আর তাছাড়া এই উল্টোমুখো ফার্সি হরফগুলো…

জগন্নাথ ওর হাত থেকে চিঠিখানা ফেরত নিয়ে পড়ে শোনালেন। কাজী-সাহেব বড় দারোগার উপরওয়ালা। হজ সেরে এসেছেন বলে সবাই কাজীর বদলে ওঁকে হাজী বলে। তিনি স্পষ্টাক্ষরে বড় দারোগাকে নির্দেশ দিচ্ছেন : “আশঙ্কা করার যথেষ্ট হেতু বর্তমান যে, পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ভাগীনেয় উন্মাদ ঘনশ্যাম সার্বভৌমকে সম্পত্তির লোভে তস্যপুত্র বলভদ্র কণ্ঠরোধ করিয়া হত্যা করিয়াছে। এবং তৎপরে ফাঁস রজ্জু হইতে ঝুলাইয়া দিয়া প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছে যে ঘনশ্যাম আত্মহত্যা করিয়াছেন। ফলে শ্মশানযাত্রীরা শ্মশানে উপস্থিত হওয়ামাত্র আসামী বলভদ্রকে গ্রেপ্তার করিবে। ঘনশ্যাম সার্বভৌমের কনিষ্ঠা পত্নী মুখাগ্নি এবং শ্মশানের যাবতীয় কৃত্যাদি করিবেন। ত্রিবেণীর পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের আদেশানুসারে ঐ বিধবা সহমরণে যাইবার অধিকারী নহেন। ঘনশ্যামের প্রথমা পত্নীকেও যেন সহমরণের জন্য চিতায় তোলা না হয়। ঘোষাল দারোগা স্বয়ং শ্মশানে উপস্থিত থাকিয়া এই দাহকার্য সুসম্পন্ন করাইবেন। ইতি—”

জগন্নাথ বললেন, শোন ঘোষাল। আমার এই ছাত্র ও শিষ্য রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্য তোমাকে সাহায্য করতে শ্মশানেই থেকে যাবেন। তুমি তোমার একটি পাইক কোতোয়ালিতে পাঠিয়ে দাও। কিছু বন্দুকধারী সেপাই আনাবার বন্দোবস্ত কর। বলভদ্রের সঙ্গে শতখানেক লাঠিয়াল আসবে। শ্মশানযাত্রীদের আসতে দেখলে প্রথমেই আকাশের দিকে দু-চারটা ফাঁকা আওয়াজ করবে। তাতেই ওদের ঢোল-কাঁসির বাদ্য থেমে যাবে। তখন সরকারি আদেশটা ঘোষণা করবে। বলভদ্রকে হাতকড়া পরাবে, মাজায় দড়ি দেবে। তাহলেই ওর লেঠেলরা থমকে যাবে। স্ত্রীলোকদের জানিয়ে দেবে নবাবী ফর্মান অনুযায়ী মৃতের কোন স্ত্রী সতী হতে পারবেন না। …আমি ত্রিবেণী ফিরেই এই পালকিটা পাঠিয়ে দেব। দাহকার্য সম্পন্ন হলে বলভদ্রকে চালান দেবে আর মালতী—অর্থাৎ সদ্যোবিধবাকে আমার পালকিতে করে ত্রিবেণী পাঠিয়ে দেবে। পাল্কির সঙ্গে আসবে একজন বন্দুকধারী সেপাই আর আমার শিষ্য রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্য। ঠিক ঠিক মতো বুঝতে পেরেছ তো?

ঘোলাটে চোখ মেলে ঘোষাল দারোগা পুনরায় সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললে, প্রভু! আমার অবস্থাটা তো বুঝতেই পারছেন। বুঝতে কিছু ভুল হলে কোবরেজ-মশাই শুধরে দেবেন। উনি তো রইলেনই

—হ্যাঁ, আমার অবর্তমানে ওর আদেশই আমার আদেশ। আর, ও, হ্যাঁ ঘোষাল! ঘনশ্যামের শ্রাদ্ধ আমার ভদ্রাসনেই হবে। তুমি সপরিবারে নিমন্ত্রণ রাখতে আসবে। তোমাকে যাতে ভালমতো ব্রাহ্মণ-বিদায়ের ব্যবস্থা করা হয়, সেটা আমি দেখব।

ঘোষাল বললে, জয় জগন্নাথ প্রভু।

১৩

দিন-দশেক পরের কথা। আজ ঘনশ্যাম সার্বভৌমের আদ্যশ্রাদ্ধ। নিজ বাটিতে নয়, মাতুল-মহাশয়ের ভদ্রাসনে। জগন্নাথ বেশ বড় মাপের আয়োজনই করেছেন। ত্রিবেণীর পণ্ডিতেরা সকলেই চিনতেন ঘনশ্যাম সার্বভৌমকে—জগন্নাথের ভাগিনেয় বলে শুধু নয়, অসাধারণ সম্ভাবনাময় এক নবীন পণ্ডিত হিসাবে। সুতরাং নিমন্ত্রিতের তালিকাটি সুবৃহৎ হয়ে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী জনপদ থেকেও অনেক এসেছেন। স্বর্গত পণ্ডিতের দুই বিধবাই উপস্থিত–কারও সহমরণে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু বলভদ্র অনুপস্থিত। না, কারাগারে সে আবদ্ধ নেই। ঘনশ্যামের পুতাস্থি গঙ্গাজলে বিসর্জন দেবার পর বড়-দারোগা কাজী সাহেবের আদেশে বলভদ্রকে মুক্তি দেন। ইতিমধ্যে জানা গেছে, ঘনশ্যাম আত্মহত্যাই করেছেন। হত্যার ঘটনা এটি নয়।

বলভদ্ৰ মুক্তি পেয়ে কোথায় গেছে কেউ জানে না।

সে নাকি যাবার আগে বলে গেছে, ছেরাদ্দ করার দায় আমার নয়। যে পাগলটা পটল তুলেছে সে আমার বাপ ছিল থোড়াই!

শ্মশানে মৃতের মুখাগ্নি করেছিল মালতী। তর্করত্ন মশাই একটা ক্ষীণ আপত্তি তুলেছিলেন–পুত্রের অবর্তমানে, পৌত্র বা নিকট আত্মীয় শ্মশানে উপস্থিত না থাকলে মৃতের স্ত্রী মুখাগ্নি করতে পারেন বটে; কিন্তু গর্ভিণী অবস্থায় তা পারেন না। যে-কারণে সদ্যোবিধবাকে সহমরণে তোলা গেল না, সেই হেতুটাই এ-ক্ষেত্র বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কিছু মতান্তর দেখা দেয়। মালতী রূপেন্দ্রনাথকে জনান্তিকে জানিয়েছিল, স্বামীর শেষ ইচ্ছা সে ঐকান্তিকভাবে পূরণ করতে ইচ্ছুক। তাই রূপেন্দ্রনাথ পণ্ডিতদের বাধা দিয়ে বলেছিলেন, দেখুন, আপনারা সকলেই মহামহা পণ্ডিত। কিন্তু এই বিধানটি দিয়ে গেছেন আমার পূজ্যপাদ গুরুদেব স্বয়ং পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। আপনাদের কারও যদি ভিন্ন মত থাকে–

পণ্ডিতেরা একযোগে বলে ওঠেন, সে-ক্ষেত্রে তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। নিশ্চয় কোনও সংহিতায় বিকল্প কোন সূত্র আছে, যা আমাদের জানা নেই। তবে আর বিলম্বে কাজ কী? মুখাগ্নির আয়োজন করা হোক!

মালতীই মুখাগ্নি করেছিল, ঘনশ্যাম পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবার পর চিতায় জলও ঢেলে দিয়েছিল।

ঘনশ্যামের প্রথমা পত্নীর মুর্ছা সারাদিনেও ভাঙেনি।

শ্মশানযাত্রীরা ফিরে এলে তিনি মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি পেলেন।

ছোট-জা বহাল তবিয়তে ত্রিবেণী চলে গেছেন। তার পরিবর্তে বলভদ্রকে ফাটকে পাঠানো হয়েছে। তৎক্ষণাৎ তাঁর মূর্ছাভঙ্গ হল।

বিধবার শাঁখা-নোয়া অপসারণের পর বড় বধূমাতার পিতৃদেব তাঁকে স্বগৃহে নিয়ে গেলেন।

শ্রাদ্ধ-বাসরে দুই বিধবাই উপস্থিত। তর্কপঞ্চাননের নির্দেশে কনিষ্ঠাই শ্রাদ্ধ করছে। এবার আর ঐ প্রশ্নটা কেউ তুলতে সাহসই পাননি : গর্ভিণী অবস্থায় কোনও সদ্যোবিধবা শ্রাদ্ধাধিকারিণী হতে পারে কি না।

রূপেন্দ্রনাথের কাছে অধিকাংশ নিমন্ত্রিতই অপরিচিত। তর্কপঞ্চাননের অযুত-নিযুত শিষ্য।’ভূতে আনে গন্ধর্বে বয়’ নীতিতে শ্রাদ্ধবাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম এগিয়ে চলেছে। মালতী মানসিক স্থৈর্য হারায়নি। এ-কয়দিন প্রাণভরে কেঁদে নিয়ে আজ সে দাঁতে-দাঁত দিয়ে স্বামীর শেষ কাজ করতে বসেছে। তার মামা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। ভাগ্নীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেননি। তার কতটা বেদনায়, কতটা লজ্জায়, তা অনুমান করা কঠিন। কিন্তু ওর তিন মামাতো বোন ওকে জড়িয়ে ধরে যখন হু-হু করে কেঁদে উঠল, তখন মনে হল—দিদি বিধবা হওয়ায় ওরা যতটা ব্যথিত, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি দিদি জ্বলন্ত চিতা থেকে ফিরে আসায়। দিদিকে ওরা সবাই প্রাণাধিক ভালবাসত।

জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সর্বতোভদ্র গঙ্গার ধারে, প্রায় বিশ বিঘা জমির উপর। তার একদিকে চতুষ্পাঠী, এক দিকে টোল। এক প্রান্তে মন্দির, পুষ্করিণী, অপর প্রান্তে আমবাগান ঐ আম-বাগানের একান্তে পণ্ডিতের ভদ্রাসন। রূপেন্দ্রনাথ একটু ফাঁকায় গিয়ে একটি উঁচু টিলার উপর একটি ছাতিম গাছের ছায়ায় এসে বসলেন। সম্ভবত এখানে একটি পৃথক মাটির ঘর ছিল। সূতিকাগৃহ কি? কয়েক দশক আগে তা ভূমিসাৎ হয়েছে। তারই ভগ্নস্তূপের উপর গজিয়েছে এই সপ্তপর্ণীর গাছটি।

একটা অপরিসীম নির্বেদে মনটা আজ ওঁর ভারাক্রান্ত। কাশীধাম থেকে অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন গৌড়মণ্ডলে। ফরাসীডাঙ্গায় পৌঁছেই খেলেন প্রথম ধাক্কাটা। আত্মজাকে বুকে জড়িয়ে ধরার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলেন। চোখের দেখাও দেখতে দিলেন না ভবতারণ গাঙ্গুলী। বললেন, তাহলে নাকি শিশুর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। রূপেন্দ্র দরবার করতে গেলেন নদীয়ারাজের কাছে। সুবিধা হল না। রাজমহিষী জানিয়ে দিলেন, কৃষ্ণচন্দ্ৰ স্ত্রীশিক্ষা-বিস্তারের বিপক্ষে। অর্থাৎ ভবতারণের সপক্ষে। তারপর উনি ছুটে এলেন ওঁর গুরুদেবের কাছে। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ‘নিদান হাঁকলে’ গৌড়মণ্ডলে কেউ তার প্রতিবাদ করতে সাহসী হবে না। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলেন রূপেন্দ্রনাথ। গুরুদেব ওঁকে শর্ত-সাপেক্ষে সমর্থনে স্বীকৃত। শর্তটি মারাত্মক: বিপত্নীক কুলীন ব্রাহ্মণটিকে পুনর্বিবাহ করতে হবে। ভবতারণ গাঙ্গুলীর কন্যাটিকে পছন্দ না হলে গুরুদেব তাঁর গণনাতীত যজমানের ভিতর থেকে কুলীনঘরের একটি রাঢ়ী শ্রেণীর ভিন্নগোত্রের সর্বগুণান্বিতা কুমারীকে নির্বাচন করে দিতে চাইলেন। রূপেন্দ্র প্রত্যাখ্যান করায় গুরুদেবও মুখ ফেরালেন।

ইতিমধ্যে নানান দুঃসংবাদও পেয়েছেন: জগুঠাকরুণ স্বর্গে গেছেন। রূপেন্দ্রের অন্তঃকরণে ঐ বৃদ্ধার প্রতি একটা প্রচণ্ড শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসা ছিল। পিসিমাতা ঠাকরুণ সকন্যা ভাইয়ের সংসারে ফিরে এসেছিলেন তাঁর স্বামীর জীবিতকালেই। এমনকি স্বামীর মৃত্যু- সংবাদ পেয়েও শ্বশুরালয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে যাননি। সোঞাই গাঁয়েই শাঁখা-সিন্দুর ঘুচিয়ে থান পরে কন্যা কাত্যায়নীকে দিয়ে পৃথকভাবে চতুর্থীশ্রাদ্ধ করিয়েছিলেন।

হেতুটি সমকালীন বিচারে সামান্য অথচ রূপেন্দ্রনাথের বিচারে অসামান্য। পিসিমার এই বিদ্রোহের হেতু বৃদ্ধ বয়সে পিসেমশাই একটি পঞ্চদশীকে দ্বিতীয় পক্ষে ঘরে এনেছিলেন। সে আমলে অভিযোগটা ছিল হাস্যকর। গ্রামশুদ্ধ মহিলা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল : ওমা, আমি কনে যাব! কুলীন বামুন—আড়াইকুড়ি বয়সে মাত্তর দ্বিতীয়-পক্ষ করল, আর তাও সইলনা বুড়ি জগুঠাকরুণের!

সেই তেজদীপ্তা জগুঠাকরুণ দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছেন। বার্তাটা শুনতে হল ভবতারণের ভর্ৎসনা এবং ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠে! রূপেন্দ্র জানেন না, কোন ঘটনাটি আগে ঘটেছে। খঞ্জ-গঙ্গারামের হাত ধরে কাত্যায়নী আগে ভিনগাঁয়ে চলে গেছে, না আগেই জগুঠাকরুণের সব জ্বালাযন্ত্রণার অবসান ঘটেছে। প্রথমটি সত্য হলে বিধবা কি শেষ সময়ে এক ফোঁটা জলও পাননি? কে তাঁর শবদাহ করল? কে শ্রাদ্ধ করল? কিছুই জানেন না!

হতাশা যখন সব দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছিল তখন নিতান্ত ঘটনাচক্রে লাভ করলেন এক অপ্রত্যাশিত অসাধারণ বন্ধুকে! এই মৌলবাদী কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে প্রথম সাক্ষাৎ পেলেন একটি মানুষের যিনি, আধুনিকতায় বোধ করি রূপেন্দ্রনাথের অপেক্ষাও কয়েক-দশক এগিয়ে।

রূপেন্দ্রনাথ কখনো আক্ষেপ করতে পারতেন না: ‘কেন ম্লেচ্ছ হইলাম না, কেন মুসলমান হইলাম না, অন্ততপক্ষে কেন অচ্ছুৎ চণ্ডাল বংশে জন্মগ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করিলাম না…’

কিন্তু, ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস। মাত্র একদিনের ঘনিষ্ঠতায় দুজনে দুজনের প্রাণের বন্ধু হয়ে উঠলেন। আবার একরাত্রির অন্তেই এল চিরবিচ্ছেদ। ছাতিম গাছতলার বসে বসে রূপেন্দ্রনাথ চিন্তা করছিলেন, সেদিন কী-কী বিষয়ে দুজনের আলোচনা হয়েছিল। গৌড়মণ্ডলে বালিকাদের জন্য প্রথম পাঠশালা খোলা হলে যদি আদৌ খোলা সম্ভবপর হয় তবে পাঠ্যসূচী কী হবে? সেখানে শিক্ষালাভ করতে আসবে কারা?–শুধুই ব্রাহ্মণ কন্যা? শুধুই বর্ণহিন্দু? জল-অচল অদ্ভুতের ম্লানমুখী আত্মজার দল কি সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হবে?

—এই শোন, তুমি আমাদের বুড়ি হবে?

চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল মধ্যপথে। দেখলেন, শিক্ষাবঞ্চিতা ম্লানমুখী বালিকার দল মুহূর্তে এক ঝাঁক প্রজাপতিতে রূপান্তরিতা হয়ে গেছে। প্রশ্নটা যে পেশ করেছে সে একটি বালিকা। হিমালয়-দুহিতা উমা-মাকে বোধ করি এমনিই দেখতে ছিল, তিন-চার বছর বয়সে। অথবা মা গঙ্গাকে, গোমুখ-গঙ্গোত্রীর উৎসমুখে। উপলবন্ধুর ঝরনার মতো ওরা ঘনিয়ে এসেছে রূপেন্দ্রনাথের চারিদিকে। রূপেন্দ্রনাথের যে ধ্যানভঙ্গ করেছে তার নাকে মুক্তোর নোলক, কপালে জড়োয়া টায়রা, গলায় সোনার হার, পরনে বিচিত্র ফ্রক। মসলিনের কাপড় কিন্তু উবুড়-করা-গামলার মতো তা ফুলে ফুটে আছে। রূপেন্দ্রনাথ ফরাসী-গাউন জীবনে দেখেননি। ফুটফুটে সুন্দরী। আধফোটা কমলকলির মতো গাত্রবর্ণ। আর সব চেয়ে অবাক- করা ওর দুটি… কিন্তু এ কী! এই ভ্রমরকালো চোখ দুটি কেন এত চেনা চেনা লাগছে? আর দেবীপ্রতিমার মতো মুখের ডৌলটা?

মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বলে? কী চাইলে তুমি?

—কতা বোঝ না? বলি-কি: তুমি বুড়ি হবে?

রূপেন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন, তা কেমন করে হব, মা? বুড়ো হতে পারি যদি বছর ত্রিশ-চল্লিশ অপেক্ষা কর; কিন্তু ‘বুড়ি’ হব কোন মন্ত্রবলে?

খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি। আবার চমকে ওঠেন! ঐ হাসির ঝরনার শব্দটাও যেন খুবই পরিচিত! এ ঝরনার জলে যেন স্নান করেছেন কোন্ বিস্মৃত অতীতে। শিশু গিরিরাজসুতা বললে, তুমি এত বোকা কেন গো? আমি কি তোমারে খুনখুনে জটিবুড়ি হতে বলেচি? ‘বুড়ি’! মানে গোল্লাছুট খেলার বুড়ি। আমরা দৌড়ে এসে শুধু তোমারে ছোঁব! ব্যস!

—শুধু ছোঁবে? তাহলে আমি রাজি নই। বল, গালে চুমু খাবে?

মেয়েটি হতাশ হয়। বিরক্তও। সঙ্গিনীদের বলে, এ বোকাডারে দে হবেনি। আমি কী বলনু আর এ কী বলছে!

ওর পাশের মেয়েটি বলে, চল হটি, আমরা অন্য আর কারেও পাকড়াও করি।

রূপেন্দ্রনাথ ওর হাত ছাড়েননি। বলেন, ‘হটী’! তোমার নাম বুঝি হটী? কী বিদঘুটে নাম গো তোমার। ‘হটী’ কখনো এমন একটি ফুটফুটে মেয়ের নাম হতে পারে?

মেয়েটি তার টোব্লাগালে আঙুল ঠেকিয়ে বললে, কী বোকা গো তুমি! কেন হবে না? এই তো আমার হয়েছে। অবিশ্যি তুমি আমারে ‘হটু’ও ডাকতে পার। দাদু আমারে ডাকে ‘হটী’ আর দিদা ডাকে ‘হটু’।

ওর বান্ধবীরা ততক্ষণে রূপেন্দ্রনাথকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।

রূপেন্দ্র বললেন, ও-সব ‘হটি-হটু’ হচ্ছে ডাক নাম। তোমার পোশাকী ভাল নামটা কী গা? সেটাই আমাকে শোনাও।

মেয়েটি রুখে ওঠে, কেন? ‘হটি-হটু’ দু-দুটো নাম বলনু, তোমার পছন্দ হলনি?

ওর ভাষা এবং বাচনভঙ্গিতে একটু বিস্মিত হলেন রূপেন্দ্র। মেয়েটি অতি সুন্দরী। তার সাজ-পোশাক, অলঙ্কার দেখে বোঝা যায় যে, সে অভিজাত ধনী বংশের সন্তান। তাহলে তার কথ্যভাষা এত গ্রাম্য কেন? বোধকরি ও মানুষ হচ্ছে পরিচারকবর্গের মাধ্যমে। তাদের ঘরেই থাকে চৌপর দিন। তাদের ভাষাটাই আসে জিহ্বাগ্রে।

রূপেন্দ্র ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, না, মা। পছন্দ হয়নি তা বলিনি। ও দুটি ডাকনামও খুব ভাল। কিন্তু ও-দুটো তো দাদু-দিদার দেওয়া নাম। মা কিংবা বাবা তোমাকে বেশ জমকালো একটা নাম দেয়নি? যা তোমার এই সুন্দর চেহারার সঙ্গে মানানসই হয়? মেয়েটি ঠোঁট উলটে বলে, হুঃ! মা-বাবা থাকলে তো? বাবা তো একটা বদমাশ বাউণ্ডুলে!

রূপেন্দ্রের ভ্রুকুঞ্চন হল, বললেন, ‘বদমাশ বাউণ্ডুলে!’ এসব ভাষা তুমি শিখলে কোথায়? কে তোমার বাবাকে ও কথা বলেছে?

—দাদুই বলে! যখন-তখন বলে, আমার মা আঁতুড়ে মরে যেতেই সেই বদমাশ বাউণ্ডুলেটা আমারে ফেলে পাইলে গেল!

থরথর করে কেঁপে উঠলেন রূপেন্দ্রনাথ! একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল যেন তাঁর সর্বাবয়বে। তাই তো! তাই এত চেনা-চেনা লাগছে। তাই বুকের মধ্যে এমন মুচড়ে-মুচড়ে উঠছে। সেই চোখ! সেই মুখ! কোথাও কিছু নেই, মেয়েটিকে উনি সবলে বুকে টেনে নিলেন। চুমায় চুমায় ওর টোব্‌লা গাল দুটো ভরিয়ে দিলেন।

—এই ছাড়ো, ছাড়ো! কী করছ তুমি? আমার লাগে না বুঝি?

রূপেন্দ্র বললেন, ছাড়ব; কিন্তু তার আগে বল : তোমার মা—ছোট-মা—কি কখনো তোমাকে বলেনি যে, সেই বাউণ্ডুলে বাপটা তোমার জন্যে একটা দারুণ সুন্দর পোশাকী নাম দিয়ে গিয়েছিল?

—ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ছোটমা বলেছিল বটে! আমার একটা জমকালো নামও আছে: রুপোমনচুরি।

—মন চুরি! হ্যাঁ, ঠিক কথা! রুপোর মন তো চুরিই করলি রে তুই! আবার টেনে নিলেন বুকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে কোন অন্তরাল থেকে ঝড়ের বেগে এসে উপস্থিত হলেন ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায়। ঊর্ধ্বাঙ্গে রেশমের বেনিয়ান, মাথায় প্রাক-রামমোহনী শামলা, পরনে চুনট-করা ফরাসডাঙার ধুতি, পায়ে প্রাক-বিদ্যাসাগরী শুঁড়তোলা চটি। ছুটে এসে চেপে ধরলেন শিশুটির মোমের মতো নরম হাত। একটা হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নিলেন বাপের বঞ্চিত বুক থেকে

—একা-একা এখানে এসেছিস্ কেন, হতচ্ছাড়ি!

মেয়েটি ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। অস্ফুটে বললে, একা তো আসিনি দাদু, এ-রা সকলেই তো…

—আবার মুখে-মুখে চোপা!–কোথাও কিছু নেই ওর কচি গালে ঠাস করে বসিয়ে দিলেন বিরাশি-সিক্কার একটা চড়। রাগটা রূপেন্দ্রনাথের উপর, কিন্তু চপেটাঘাতের বেগটা সহ্য করতে হল অতটুকু শিশুকে। গালে হাত দিয়ে ধুলোর মধ্যেই বসে পড়ল বেচারি। তার নরম গালে দাদুর পাঞ্জাছাপ ফুটে উঠেছে।

দুরন্ত ক্রোধে উঠে দাঁড়ালেন রূপেন্দ্রনাথ। বলিষ্ঠ গঠন যুবাপুরুষ। মেদসর্বস্ব ভবতারণ তাঁর অপেক্ষা অন্তত পঁচিশ বছরের বড়। মাথায় একবিঘৎ ছোট! রূপেন্দ্রের একটি মুষ্ট্যাঘাতে ঠিক ঐভাবে চোয়ালে হাত দিয়ে ধুলোর উপর বসে পড়তেন দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর নায়েবমশাই। কিন্তু নিতান্ত ঘটনাচক্রে সে দুর্ঘটনা ঘটল না। তার পূর্বেই অন্তরীক্ষ থেকে বজ্রগম্ভীরস্বরে যেন দৈববাণী হল!–ক্ষান্ত হও রূপেন্দ্ৰনাথ!

রূপেন্দ্রনাথ ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন, পূর্বমুহূর্তে আড়াআড়িভাবে উদ্যানটা অতিক্রম করছিলেন গৃহস্বামী স্বয়ং। সমস্ত ঘটনাটা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। দীর্ঘদেহী মানুষটি বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলেন ঘটনাস্থলে। প্রথমেই ধুলো থেকে কোলে তুলে নিলেন, প্রায় জ্ঞানহীন বালিকাটিকে। তারপর এদিকে ফিরে বললেন, তুমি ওকে ওভাবে মারলে কেন, ভবতারণ?

ভবতারণ ততক্ষণে আত্মস্থ হয়েছেন, বললেন, দিন ওকে—

দুটি হাত বাড়িয়ে দিলেন নাতনিকে কোলে নিতে।

এক-পা পিছিয়ে গেলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। বললেন, কথা ঘুরিও না ভবতারণ। প্রথমে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও! তোমার এই চণ্ডালী ক্রোধের কৈফিয়ৎ দাও।

ভবতারণ স্পষ্টই বিরক্ত বলেন। বললেন, কৈফিয়ৎ আবার কী দেব? অন্যায় করেছিল, তাই শাসন করেছি। আমার নাতনিকে আমি শাসন করতে পারব না?

—পারবে। তোমার ভদ্রাসনের চৌহদ্দিতে। এখানে এই বাড়িতে তোমার মতো এই শিশুটিও আমার নিমন্ত্রিতা অতিথি। ফলে, আমাকে ব্যাপারটা সমঝে নিতে হবে বইকি, গাঙ্গুলী। বল, শিশুটি কী-এমন অন্যায় করেছিল, যাতে এ-ভাবে ওকে চপেটাঘাতে অজ্ঞান করে দিলে।

ভবতারণ কুণ্ঠিত হয়ে হলেন, না, না, কী বলছেন! অজ্ঞান কেন হবে? দিন ওকে আমার কোলে-

বজ্রগম্ভীরস্বরে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বললেন, না! উপযুক্ত কৈফিয়ৎ দিতে না পারলে দৌহিত্রীকে কোলে নেবার অধিকার তুমি চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলেছ, ভবতারণ। এখন থেকে ও থাকবে ওর পিতার কাছে!

—মানে? আপনি কি সেই জন্যই এভাবে ষড়যন্ত্র করেছেন? কৌশলে হটীকে কেড়ে নিয়ে নিজের শিষ্যের হাতে তুলে দিতে চান? তাই জন্যেই কি আমার সপরিবার নিমন্ত্রণ হয়েছে এই শ্রাদ্ধবাড়িতে?

জগন্নাথ বললেন, তুমি আমার অতিথি। তাই আজ তোমার এই ঘৃণিত অভিযোগের জবাব আমি দেব না। তবে এটা জেনে রাখ, এ শিশুটিকে আর তুমি ফেরতও পাবে না!

ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায় ফরাসীডাঙার ডাকসাইটে নায়েব। ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর দক্ষিণহস্ত। যে ইন্দ্রনারায়ণ হচ্ছেন ফরাসী গর্ভনর ডুপ্লেক্সের দেওয়ান এবং অর্থকৌলিন্যে একমাত্র জগৎশেঠ ছাড়া গৌড়মণ্ডলের আর সকলের সঙ্গেই যিনি টেক্কা দিতে পারেন- বর্ধমানরাজ, নদীয়ারাজ, নাটোরের রানী। ভবতারণের দাপটে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। টুলোপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। বললেন, কাজটা যত সহজ হবে মনে করছেন, অতটা সহজ হবে না কিন্তু, ঠাকুরমশাই। ত্রিবেণী থেকে হটীর বাপ্ সোঞাই গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না, যদি না উপযাচক হয়ে নিজে কোলে করে আমার নাতনিকে ফরাসডাঙায় আমার ভদ্রাসনে ফিরিয়ে দিয়ে যায়!

জগন্নাথ পুরো দশ-মুহূর্ত অগ্নিগর্ভ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন ভবতারণ গাঙ্গুলীর দিকে—নির্বাক, নিস্পন্দ। তারপর বললেন, কেন গাঙ্গুলী? তোমার সৈন্যবল আছে, তাদের বন্দুক আছে, গাঙে যে ফরাসী জাহাজ ভাসছে তাতে কামান বসানো আছে! সেই জন্য?

—আপনি তো সবই জানেন। তবে একটি কথা আপনাকে, জানিয়ে যাচ্ছি, পঞ্চানন- ঠাকুর। জীবিতকালে ঘনশ্যাম সার্বভৌমের প্রতি আপনি অনেক অন্যায় করেছেন তার শ্রাদ্ধটাও নির্বিঘ্নে হতে দিলেন না, নিজের দম্ভে! নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ অভুক্ত ফিরে যেতে বাধ্য হবে আপনি যদি আমার নাতনিকে ফিরিয়ে না দেন।

এবারও দীর্ঘসময় জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে জগন্নাথ তাকিয়ে রইলেন অতিথির দিকে। তারপর কোন কথা না বলে ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে নিয়েই বড় বড় পা ফেলে চলে গেলেন বার- মহলে।

দ্বিতলের অলিন্দ থেকে তুলসী অনেকক্ষণ ধরে ঘটনাটা দেখছিল। বস্তুত রূপেন্দ্রনাথ যখন ছাতিম গাছতলায় নির্জনে এসে বসেন তখন থেকেই। সম্পর্কে শালী, তবুও নিমন্ত্রণ বাড়িতে সর্বসমক্ষে সে সাহস পাচ্ছিল না ওঁর দিকে এগিয়ে যেতে। কে-কী মনে করবে! এখন সে দ্রুতপদে নেমে এল নিচে। প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছালো ঘটনাস্থলে। বললে, কী হয়েছে বাবা? ঠাকুরমশাই হটীকে নিয়ে কোথায় চলে গেলেন?

ভবতারণ বললেন, সে-সব কথা তোর না জানলেও চলবে। তুই ভিতরে যা। তোর মাকে চলে আসতে বল। আমরা এখনই ফরাসীডাঙায় ফিরে যাব। এখনি!

—এখুনি? মানে? আমাদের কারও তো মধ্যাহ্ন আহার হয়নি? তুমি খেয়েছ?

—আমরা কেউই এই শ্রাদ্ধবাড়িতে জলস্পর্শ করব না। যা, তোর মা-কে ডেকে নিয়ে আয়। এই মুহূর্তে।

তুলসী ঘুরে দাঁড়ালো। রূপেন্দ্রনাথের মুখোমুখি। তিনি যে ভঙ্গিমায় বাহুবদ্ধপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেটিকে আর দেড়-দুশ বছর পরে বলা হবে বিবেকানন্দের দার্ঢ্য-বিকশিত সমুন্নত ভঙ্গি। তাঁকেই প্রশ্ন করল তুলসী, কী এমন ঘটল বাঁড়ুজ্জে-মশাই ইতিমধ্যে, যাতে…

গর্জে উঠলেন ভবতারণ, তুই ভিতরে যাবি, না তোকেও হটীর মতো শাসন করতে হবে?

তুলসী তার বাপের দিকে ফিরে তাকালো। কী-একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না, তার পূর্বেই ওদিক থেকে এগিয়ে এলেন চতুষ্পাঠীর জনৈক অধ্যাপক। নগ্নগাত্রে উত্তরীয়, নগ্ন পদ, মাথায় অর্কফলার বৈজয়ন্তী, মস্তকের সম্মুখভাগ বিদ্যাসাগরী-রীতিতে ক্ষৌরীকৃত। যুক্তকরে ভবতারণ ও রূপেন্দ্রকে নমস্কার করে বললেন, আমার নাম হরেরাম বাচস্পতি। আমি এই টোলে ন্যায় ও বেদান্তের অধ্যাপনা করি। আপনাদের দুজনকে ডাকতে এসেছি। আপনাদের দুজনকে বৈঠকখানা ঘরে ডাকছেন।

ভবতারণ বলেন, কে? আপনাদের মালিক পঞ্চানন ঠাকুর?

ওঁর বাচনভঙ্গিতে একটু ক্ষুব্ধ হলেন হরেরাম। ভূযুগলে একটি কুঞ্চনরেখা জেগেই মিলিয়ে গেল। বললেন, আজ্ঞে না। আপনাদের আহ্বান করেছেন ফরাসীডাঙার দেওয়ান মহিমার্ণব ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী!

ভবতারণ একটু চমকে ওঠেন! বলেন, তিনি এসেছেন? কতক্ষণ? তাঁরও আসার কথা ছিল তা তো জানতাম না।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, এসেছেন। এই কিছুক্ষণ হল। সস্ত্রীকই এসেছেন। আপনাদের দুজনকে ডাকছেন।

—চলুন।

তুলসী ভিতরবাড়ির দিকে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল; বাচস্পতি বললেন, আপনাকেও ডেকেছেন, মা-লক্ষ্মী। আপনিও আসুন আমার সঙ্গে!

তুলসী অবাক হয়ে বলে, আমাকে? আমাকে তো দেওয়ানজী চেনেনই না!

—আজ্ঞে না। আপনাকে ডেকেছেন আমাদের গুরুদেব তর্কপঞ্চানন-ঠাকুর।

–ও আচ্ছা। চলুন।

১৪

পঞ্চানন-ঠাকুরের বৈঠকখানাটি প্রকাণ্ড। ঘরের মাঝামাঝি বিশাল একটা নিচু জাজিম- ফরাস বিছানো চৌকির সঙ্গে জোড়া দেওয়া চৌকি। ইতস্তত তাকিয়া ছড়ানো। দু-দিকের প্রাচীর বরাবর কাঁঠাল-কাঠের হাতলহীন কেদারা। তার উপর পশম অথবা কুশের আসন। সেগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের জন্য, যাঁরা জাজিম-ফরাসের স্পর্শ বাঁচিয়ে দরবার করতে চান। মাথার উপর প্রকাণ্ড টানা-পাখা। যে দুজন টানে তারা থাকে পাশের ঘরে। শ্রুতি ও দৃষ্টিসীমার বাহিরে। কক্ষের দূরতম প্রান্তে একটি বেতের আরাম-কেদারা। পাশে একটি কাঠের সাদামাঠা টুল। তার উপর তাম্রকূট-সেবনের আয়োজন–আলবোলা।

ভবতারণ, রূপেন্দ্রনাথ আর বাচস্পতি ঘরে ঢুকে দেখলেন, আরামকেদারায় অর্ধশায়িত দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। রাজকীয় পোশাক, মস্তকে হীরকখচিত রেশমী উষ্ণীষ। তাতে একছড়া মুক্তার মালা জড়ানো। কণ্ঠেও মুক্তামালা। কটিদেশে বিলম্বিত তরবারি—মোঘল- পাঠান ঢঙের বঙ্কিম তরোয়াল নয় ফরাসী-রীতির ঋজু কৃপাণ। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বসে আছেন কাছাকাছি কাষ্ঠাসনে। কুশাসনে। তাঁর কাঁধে ঘুমন্ত বালিকাটি। বোধ করি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওঁরা তিনজনেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন। তুলসী কপাটের বাইরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ওঁদের দেখতে পেয়ে ইন্দ্রনারায়ণ ফরসির নলটি নামিয়ে রাখলেন। ভবতারণকে আহ্বান করলেন, আরে এস, এস, গাঙ্গুলী। কতক্ষণ এসেছ? বস এইখানটায়

ভবতারণ যুক্তকরে নমস্কার করে ফরাসের একান্তে একটি তাকিয়া টেনে নিয়ে বসলেন; কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিছু বলার পূর্বেই ইন্দ্রনারায়ণ পুনরায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠেন, আর উনিই বুঝি সেই ভেষগাচার্য? মন্ত্রবলে যিনি বর্গীসর্দারকে দামোদরে হস্তিসমেত ডুবিয়ে মেরেছিলেন?

রূপেন্দ্রনাথ করজোড়ে প্রতিবাদ করেন, এ-সব বিশ্বাসপ্রবণ গ্রাম্য লোকের রটনা মাত্র। বর্গীসৈন্যদের প্রতিহত করেছিল গ্রামের প্রতিরোধশক্তি বিশেষ করে কিছু অচ্ছুত সম্প্রদায়ের ধানুকীর দল।

ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, তাই বুঝি? আর বর্ধমানের নায়েব-কানুনগো নগেন দত্তজার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী? তার মৃগীরোগটা সারালো কে? কী ভাবে? শুনেছি, গতবছর দত্তজা পুরুষোত্তমধামে গেছিল?

স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রূপেন্দ্রনাথ। ফরাসীডাঙায় বসে ঐ দেওয়ানজী কেমন করে জ্ঞাত হলেন, নগেন দত্তের পরিবারের এই গুহ্য তথ্য! তিনি কী জবাব দেবেন বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু এবারেও ইন্দ্রনারায়ণ তার পূর্বেই বলে ওঠেন, আর প্রবেশদ্বারের বাহিরে হঠাৎ যেন একটা বিদ্যুৎঝলক নজরে পড়ল মনে হচ্ছে। মালক্ষ্মীর ইতস্তত করার হেতুটা কী?

তুলসী সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে এল, সর্বপ্রথম প্রণাম করল না, বৈঠকখানার মধ্যমণি দেওয়ানজীকে নয়, নগ্নগাত্র পণ্ডিতমশাইকে। তারপর পর্যায়ক্রমে সকল ব্রাহ্মণকেই।

ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, তোমাকে আগে একবারমাত্র দেখেছি তুলসী-মা! কিন্তু জগদ্ধাত্রীকে তো ভোলা যায় না। তাই তোমার শাড়ির বিদ্যুৎঝলক প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি দেখেই চিনেছি। তোমাকে একটি দায়িত্ব দিচ্ছি তুলসী, মা। অন্দরমহলে গিয়ে তোমার জননী এবং জেঠিমা, অর্থাৎ আমার সহধর্মিণীকে, খুঁজে বার কর। বাচস্পতি-মশাই ব্যবস্থা করে দেবেন। তাঁর কোন ছাত্র একটি পৃথক কক্ষে তোমাদের আর আমাদের পরিবারের মহিলাদের পংক্তি-ভোজনে বসিয়ে দেবেন। শ্রাদ্ধকার্য এখনো সমাপ্ত হয়নি, ঠিক কথা, ষোড়শ-শ্রাদ্ধ এত শীঘ্র সমাপ্ত হয়ও না; কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে আমাদের অবিলম্বে ফরাসীডাঙায় ফিরে যেতে হবে। পংক্তি-ভোজন শুরু হয়ে গেছে, সুতরাং এতে আপত্তির কিছু নেই!

তুলসী কোন কথা বলার আগেই ইন্দ্রনারায়ণ বাচস্পতি-মশাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, ঠাকুরমশাই! আপনার কোন দায়িত্বশীল ছাত্রকে বলুন, অন্দরমহলে একটি একান্ত কক্ষে আমার এবং গাঙ্গুলীর পরিবারস্থ সকলকে পংক্তি-ভোজন বসিয়ে দিতে। আর আমাদের—দু’জনকেও বাহির-মহলের কোন একটি পৃথক কক্ষে…

বাচস্পতি একটি নমস্কার করে বললেন, এখনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

ভবতারণ কী-যেন বলতে চাইছিলেন; তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, তোমাকে এখনো বলাই হয়নি। সাহেব সন্ধ্যা ছয়টার সময় তাঁর কাসল-এ আমাদের দেখা করতে বলেছেন। একান্তে তোমাকে আর আমাকে। কারণটা জানি না।

বলাবাহুল্য ‘সাহেব’ অর্থে ফরসী গভর্নর-জেনারেল ডুপ্লেক্স।

বাচস্পতি ততক্ষণে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেছেন। জগন্নাথ এ পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তুলসী আদিষ্ট হয়েও প্রাচীর-সই সই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। তার কারণ, সে বিস্মৃত হয়নি, বাচস্পতি-মশাই তাকে বলেছিলেন ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন স্বয়ং জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।

ভবতারণ নড়ে-চড়ে বসলেন। প্রণিধান করলেন, এটি তর্কপঞ্চাননের একটা ‘ওটসাই- কিস্তি’! আগেভাগেই ইন্দ্রনারায়ণকে কব্জা করে জানিয়েছেন যে, তাঁর নায়েব ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায় জলস্পর্শ না করে শ্রাদ্ধবাড়ি থেকে প্রত্যাবর্তনের সংকল্প জানিয়েছেন। তাতেই ইন্দ্রনারায়ণ দক্ষ অসিচালকের মতো চতুর্দিকে লক্ষ্য রেখেই আত্মরক্ষা ও আক্রমণ করে চলেছেন।

ভবতারণ বললেন, একটা কথা! আমি কিছু আহার করতে পারব না এখানে। আমাকে মার্জনা করবেন। আপনি মধ্যাহ্ন আহার সেরে নিন, তারপর আপনার সঙ্গে একসঙ্গে বরং ফরাসীডাঙায়…

কথাটা শেষ করতে দিলেন না ইন্দ্রনারায়ণ। বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি! ক্ষুধামান্দ্য! তা তো হতেই পারে। তোমার বেশ মেদবৃদ্ধি হয়েছে গাঙ্গুলী। মাসে দু-একদিন উপবাস তোমার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালই। তবে কী জান, ভবতারণ? তোমারই গরহজম হয়েছে—নাগ, কূর্ম, কৃকরায়, দেবদত্ত আর ধনঞ্জয়ের তো তা হয়নি। সুতরাং পশমের আসনে বস। পঞ্চদেবতাকে অন্ন নিবেদন কর। তদনন্তর যেটুকু তোমার উদর অনুমতি দেয় সেটুকুই সেবা কর। তারপর আচমন করে উঠে যেও। আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ভব, এখানে কোন লাস্যময়ী সুন্দরী এসে তোমাকে পীড়াপীড়ি করবেন না: ‘এটা খাও, ওটা খাও, নাইলে আমার মাথা খাও!’ উপরোধে ঢেঁকি গিলতে হবে না তোমাকে। সেজন্যই এই বার-মহলের একান্তে ব্যবস্থা করতে বলেছি।

ভবতারণ একগুঁয়ে বলিবদের মতো ঘাড় নিচু করেই রইলেন। হঠাৎ বলে ওঠেন, আমাকে মার্জনা করবেন। আমার সিদ্ধান্ত আমি ইতিপূর্বেই গৃহস্বামীকে জানিয়ে দিয়েছি: আমি এ শ্রাদ্ধবাড়িতে জলগ্রহণ করতে পারব না।

যে স্কুল কদর্য কথাটাকে এড়িয়ে যাবার জন্য এত কলাকৌশল, এত কৌতুক, এত হাস্যরস, তা সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। যেন পঙ্ককুণ্ড থেকে উঠে-আসা এক বন্যবরাহের স্থূল দেহাবলেপনে ফেনশুভ্র ফরাসটি কর্দমলিপ্ত হয়ে গেল। ইন্দ্রনারায়ণ চারিদিকে দৃকপাত করলেন। বাচস্পতি প্রস্থান করেছেন, তুলসী কপাটের আড়ালে আত্মগোপন করেছে, রূপেন্দ্রনাথ মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টি, আর জগন্নাথ নিমীলিতনেত্র।

সোজা হয়ে উঠে বসলেন ইন্দ্রনারায়ণ। বললেন, তুমি একটা সুপরিচিত চাণক্য শ্লোক বিস্তৃত হয়েছ ভবতারণ: “স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।” ফরাসীডাঙার চৌহদ্দির বাইরে প্রবল প্রতাপান্বিত নায়েব ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায়কে কেউ চিনতে পারবে না। ঠিক যেমন গাঙ্গেয় গৌড়মণ্ডলের বাহিরে এই হীরক-উষ্ণীষ শোভিত ইন্দ্রনারায়ণের পরিচয় হচ্ছে: ‘কোই আজান্ শেঠ হোগা সায়েদ!’ কিন্তু বদরীকাশ্রম থেকে কন্যাকুমারিকা, কামাক্ষ্যা থেকে দ্বারকা—তুমি ঐ নগ্নপদ-নগ্নগাত্র টুলো পণ্ডিতটার নাম উচ্চারণ করে দেখ, ভবতারণ,—প্রতিটি জনপদের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ওঁকে চিনবেন। উদ্দেশে হাত তুলে প্রণাম জানাবেন। আজ থেকে একশ বছর পরে এই গৌড়দেশে তোমার-আমার নাম যদি আদৌ উচ্চারিত হয়, তবে তা কেন হবে জান? আমরা দুজনে ছিলাম যুগান্তকারী মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সমকালের মানুষ! তুমি তোমার ঐ চণ্ডালে ক্রোধকে মূলধন করে অমন একজন সর্বভারতীয় সর্বজনমান্য মহাপণ্ডিতকে অপমান করবে, আর আমরা তা নীরবে সহ্য করে যাব? তুমি ভেবেছটা কী?

ভবতারণ বললেন, কিন্তু আমার দৌহিত্রী—হটী। উনি যে কায়দা করে তাকে অপহরণ করলেন?

ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, আমার বক্তব্যটা বুঝবার মতো শিক্ষা ও বুদ্ধি তোমার নেই, তাই বলতে পারলে ‘কায়দা করে অপহরণ করলেন।’ হ্যাঁ, শোন, ভবতারণ। দৌহিত্রীকে ওভাবে আটকে রাখাটা তোমার অন্যায় হচ্ছিল। সামাজিক অন্যায়। নৈতিক অন্যায়। ফরাসী ভাষাটা আমি যতটা যত্ন নিয়ে শিখেছিলাম, সংস্কৃতটা ততটা যত্ন নিয়ে শিখিনি। তবু কৈশোরে শেখা একটা শ্লোকের কিছুটা আজও মনে আছে। পুরো শ্লোকটা আজ আর মনে নেই—তোমার কৌতূহল হলে তর্কপঞ্চানন ঠাকুর তোমাকে শুনিয়ে দেবেন। তার প্রথম চরণটি ছিল: ‘পিতা রক্ষতি কৌমারে…’ অর্থাৎ কুমারী অবস্থায় অনূঢ়া কন্যার যাবতীয় দায়দায়িত্ব তার জনকের পিতার ‘লতায়-পাতায়-সম্পর্ক-ধরে’ কোনও পিসশ্বশুরের নয়। কন্যা পিতার ভদ্রাসনে …

মাঝপথেই গর্জে ওঠেন ভবতারণ: ভদ্রাসন! ছিল তো কুল্লে একটি পর্ণকুটীর, ইতিমধ্যে তা মাটিতে মিশিয়ে গেছে। মাথার উপর একখানা ছাদও নেই! ঐ কপর্দকহীন ব্রাহ্মণের নিজের অন্নসংস্থান কীভাবে হবে তারই স্থিরতা নেই। আমার নাতনিকে সে খাওয়াবে কী?

ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এবার নিজমূর্তি ধরতে বাধ্য হলেন। বললেন, ভবতারণ! ভদ্রসমাজে যদি ভদ্রভাষায় বাক্যালাপ করা ভুলে গিয়ে থাক, তাহলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। একবার বলেছি, দ্বিতীয়বার বলছি : দূর-সম্পর্কের ঐ নাতনির উপর তোমার কোনও অধিকার নেই। না আইনত, না ন্যায়ত, না ধর্মত। তুমি শুনলাম তর্কপঞ্চানন ঠাকুরকে আরও একটি যুক্তি নাকি দেখিয়েছ—বাহুবলের যুক্তি। সেটার কথা ভুলে যাও ভবতারণ—কারণ সে- ক্ষেত্রে তুমি আমাকে স্বপক্ষে পাবে না, পাবে বিপক্ষে। রূপমঞ্জরী আজ থেকে ভেষগাচার্যের কাছে থাকবে। এই মুহূর্ত থেকে। ওঁর ভদ্রাসন না থাকলে বাপ-বেটিতে গাছতলায় শয়ন করবে। অথবা হয়তো মন্দির চাতালে শোবে। কিংবা খোলা আকাশের নিচে। বাপবেটিতে হয়তো শাকান্ন খাবে, অথবা উপবাস করবে। এ বিষয়ে কোন অনধিকার চর্চা তুমি করতে যেও না ভবতারণ, তার ফল ভাল হবে না। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি!

অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরির মতো বসে রইলেন ভবতারণ।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন তুলসীর দিকে। তার পিঠে একটা হাত রেখে ইঙ্গিত করলেন ওঁকে অনুগমন করতে। দুজনে বেরিয়ে গেলেন। পাশের একটি নির্জন কক্ষে–বোধকরি এটিও দুই মহালের মাঝখানে ‘অন্তরাল’– প্রবেশ করে পঞ্চানন ঠাকুর বললেন, তুলসী, এবার এটাকে নে-মা। হতভাগী কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে।

তুলসী ইতস্তত করল। শেষে বলেই ফেলল, আমি কেন নেব ঠাকুরমশাই? এইমাত্র তো স্থির হল রূপমঞ্জরীকে তার পিতার হাতে সমর্পণ করা হবে। মাঝখান থেকে আমি কেন?

জগন্নাথ হাসলেন: পাগলি মেয়ে! হ্যাঁরে, বাপে সন্তান লাভ করে কি গুরুদেবের হাত থেকে? ওটা যে মায়ের জাতির কাজ। রূপমঞ্জরীর মা হতভাগিনী এ সৌভাগ্য লাভ করতে পারল না। অন্তত তার ছোট-মাই কাজটা করুক। তুই নিজে হাতে ওকে তুলে দিবি বাপের কোলে। আমি শুধু পথের বাধাগুলো সরিয়ে দিয়ে গেলাম। কী আক্ষেপের কথা! রূপেন্দ্র একটা অনড্রান! একটা বলিবর্দ! কুলীন ব্রাহ্মণ বংশের বিপত্নীক যুবক। কন্দর্পকান্তি রূপ। জিদ্দিবাজি না করলে শুধু কন্যাসন্তান নয়, তার ছোট-মাকেও বরণ করে ঘরে তুলতো আজ। কিন্তু না! তা হবার নয়। একবগ্গা-ঠাকুর বিশ্বাস করে হিন্দু-বিধবা যদি পুনর্বিবাহ করতে না পারে তাহলে হিন্দু বিপত্নীকও পুনর্বিবাহের অধিকারী নয়। এ মূর্খামির কোনও অর্থ নয়?

তুলসী বলল, হয়-কি-না হয় তা আমি কী জানি ঠাকুরমশাই? শাস্ত্রে কী বিধান আছে তা আপনারাই জানেন। তবে জামাইবাবু যা বলেন—পুরুষ এবং স্ত্রীলোকের সামাজিক অধিকার সমান হওয়া উচিত সে কথা স্বীকার করলে, কথাটা অযৌক্তিক নয়।

পণ্ডিত বললেন, তোরা দুটোই উন্মাদ।

তুলসী নিঃশব্দে ঘুমন্ত রূপমঞ্জরীকে বৃদ্ধের কোল থেকে নিয়ে নিল।

বৃদ্ধ বললেন, একটা কথা, মা। তুই কালপরশুর মধ্যে ওর পুতলা-পুতলিগুলি আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি।

—পুতলা-পুতলি! তার মানে?

—বুঝলি না? কাল থেকে শুরু হবে ওর কৃচ্ছ্রসাধনা। দাদামশায়ের প্রাসাদে বিলাসের দিন শেষ হয়ে গেল ওর। ঐ-সঙ্গে হতভাগিনী নতুন করে মাতৃহীন হল ঐ অনড্রানটার জিদ্দিবাজিতে! বাপকে সে চেনে না, দ্বিতীয়বার হারালো মাকে। পুতুলগুলো না পেলে ও বাঁচবে কী নিয়ে?

তুলসী অবাক হয়ে গেল ঐ কট্টর পণ্ডিতের অন্তরে প্রবাহিত স্নেহ-জাহ্নবীর পরিচয় পেয়ে। বৃদ্ধকে প্রণাম করে বলল, আপনি কাল আপনার কোন বিশ্বস্ত ছাত্রকে ফরাসীডাঙায় পাঠিয়ে দেবেন। আমাকে হাতচিঠি দিয়ে যাতে ছাত্রটিকে চিনতে পারি।

—তোর অক্ষর পরিচয় হয়েছে?

—তা হয়েছে। আমি চিঠি দিতে বলছি এজন্য যে, আমি অপনার ছাত্রের হাতে দিদির গহনাগুলিও পাঠিয়ে দেব একটা তালিকা সমেত। এগুলো দিদির বিবাহ-যৌতুক। সোঞাই গাঁয়ের জমিদারমশাই ওকে দিয়েছিলেন। জামাইবাবুকে আমি সেগুলি ফেরত দিতে চেয়েছিলাম, তিনি গ্রহণ করেননি। বলেছিলেন, হটীর বিবাহে সেগুলি যৌতুক দিতে। আজ যখন হটীকেই ফেরত দিতে হচ্ছে তখন অলঙ্কারগুলিও আমি প্রত্যর্পণ করতে চাই।

জগন্নাথ বললেন, ঠিক আছে। তুই এখানে অপেক্ষা কর। আমি সেই হস্তিমূর্খ অনড্রানটাকে এখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

একটু পরেই রূপেন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন উন্মুক্ত দ্বারপ্রান্তে। প্রশ্ন করলেন, ভিতরে আসতে পারি?

তুলসী তখনো মুখে কাপড় গুঁজে হাসছে। হাসতে হাসতেই বললে, আসুন, আসুন শ্রীযুক্ত হস্তিমূর্খ অনড্রান!

রূপেন্দ্র ভিতরে এসে বলেন, হঠাৎ এমন গৌরবময় সম্বোধন?

—না, বাঁড়ুজ্জে মশাই! এটা আপনার শ্যালিকার দেওয়া উপাধি নয়। আপনার গুরুদেবই বলে গেলেন। কেন জানেন? যেহেতু আপনি বিকল্প-মাতা সহ কন্যাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন। এই নিন, আপনার বুক-জুড়ানো ধন।

অতি সাবধানে রূপেন্দ্রনাথ ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, তুমি তো জানই তুলসী, কেন আমি…

—ব্যস্! ব্যস্! আমাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে না। আমি জানি আপনার মতামত: যতদিন না বিধবাদের বিবাহ সমাজে গৃহীত হচ্ছে, ততদিন বিপত্নীকেরাও বিবাহ করার অধিকারী নয়। তাই তো?

—তুমি কি এই যুক্তিটা মান না?

—আমার প্রশ্ন তা নয়। আমার জিজ্ঞাস্য : যতদিন সতীদাহ প্রথা রোধ না হচ্ছে ততদিন স্ত্রীর বিয়োগে বিপত্নীক স্বামীদের সহমরণে যেতে বাধ্য করতে কেন আপনি আন্দোলন করছেন না?

—কৌতুকের সময় নেই তুলসী। হয়তো এই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ। আজ তোমার বাবার যা অবস্থা হয়েছে, তাতে প্রাক্তন জামাতা হিসাবে তোমাদের বাড়িতে যদি কোনদিন মাথা গলাই…

—থামুন আপনি। তাই বলে আমাদের আর কখনো দেখা হবে না কেন? মহম্মদ যদি পর্বতের কাছে না আসতে পারেন, তাহলে পর্বতই যাবে মহম্মদের কাছে।

—তার মানে? তুমি সোঞাই আসবে? পিসেমশাই অনুমতি দেবেন? কক্ষনো নয়।

তুলসী ঠোঁট উল্টে বললে, ঠিকই বলেছেন আপনার গুরুদেব। আপনি একটি হস্তিমূর্খ অনড্রান। দেওয়ানজী যে উদ্ভট শ্লোকটা শোনালেন যার জোরে আপনি আজ হটীকে ফেরত পেলেন তার পরের চরণটি মনে নেই? “ভর্তা রক্ষতি যৌবনে!” আপনি, মুখ ফিরিয়ে রইলেন বলে আমি তো সারা জীবন ‘থুবড়ি’ হয়ে থাকব না। আমার মালিকানাও বদলাবে। তেমন সুদিন এলে সোঞাই তীর্থেই বা যাব না কেন?

—এস, তুলসী। আমার নিমন্ত্রণ রইল।

—সেদিন কিন্তু আমার আজকের দান কড়ায়-গণ্ডায় শোধ দিতে হবে। বুঝেছেন?

রূপেন্দ্রর ভ্রূকুঞ্চন হয়। বলেন, না, বুঝলাম না!

নতনয়নে তুলসী বলল, দিদির জীবনে যে দুর্ঘটনা ঘটল, আমি তা ঘটতে দেব না আমার জীবনে। আপনি শুধু আমার ভগ্নিপতি নন, আপনি ভেষগাচার্য! তাই সঙ্কোচ করব না। স্পষ্টই বলছি, তেমন-তেমন অবস্থা যেদিন হবে সেদিন আমি পালকি চেপে সোঞাই চলে যাব। আমার বুকজোড়া ধন আজ আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। সেদিন আপনি তা

আমাকে ফেরত দেবেন।

রূপেন্দ্রর কণ্ঠে রসিকতার বাষ্পমাত্র রইল না। বললেন, ঠিক কথাই বলেছ তুলসী। তোমার বিবাহে আমার নিমন্ত্রণ হবে না; কিন্তু তোমার সন্তানকে জন্ম দেবার সৌভাগ্য থেকে যেন বঞ্চিত কোরো না আমাকে।

তুলসী নত হয়ে প্রণাম করল রূপেন্দ্রকে

রূপেন্দ্র যুক্ত করে বললেন: ওঁ নমো নারায়ণায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *