1 of 2

ঘণ্টা – অদ্রীশ বর্ধন

ঘণ্টা – অদ্রীশ বর্ধন

হরিশকাকা বললেন—’বাড়িতে নিশ্চয় ভূত আছে।’

শুনে, পদ্মমাসি ছাড়া সবাই হেসে উঠল। পদ্মমাসি ভীতু মানুষ। শহুরে মেয়ে। ভূতপ্রেতের নাম শুনলেই তার গা ছমছম করে।

তবুও জোর করে হাসল মাসি। বলল—’আমার শোবার ঘরটাই নিশ্চয় ভূতের বসবার ঘর!’

হরিশকাকার চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। বললেন—’সত্যি কথা বলতে গেলে কিন্তু তাই। বাড়ির সেরা ঘরটাতেই ভূতের আসর বসে। তোমার ঘরটাও এ বাড়ির পয়লা নম্বর ঘর। কী হল? ঢোক গিলছ কেন? গলা শুকিয়ে গেছে? লেবুর শরবত দেব? চা?’

‘আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচি না।’ ঝংকার দিল পদ্মমাসি।

হাসির অট্টরোলে হরিশকাকা কী বললেন, শোনা গেল না। পাড়াগাঁয়ে এই আমাদের প্রথম রাত্রিবাস। এসেছিলাম ভাইপোর বিয়েতে। বরকনে এখন কনেবাড়িতে। আমরা জনাদশেক এসেছি হরিশকাকার পৈতৃক ভিটেতে। সেকেলে জমিদারবাড়ি। তিনমহলা। এখন অবশ্য দেউড়িতে বট গজিয়েছে। জানলার খড়খড়ি হাওয়ায় নড়ে। ছাদের ফাটলে জল ঝরে দারুণ বর্ষায়! তাহলেও একটা রাত হইহই করে কাটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

হরিশকাকার বাল্যবন্ধু ডাক্তার ননী চাটুয্যে বললেন—’নিশ্চয় ভূত আছে বললে কেন?’

‘বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকলেই পাড়াগাঁয়ের ভূতরা সেখানে আড্ডা গাড়ে। কানাঘুষো সেইরকম শুনছিলাম মাসখানেক আগে কলকাতায়। মাঝখানে দিন তিনেক থেকেও ছিলাম। সিঁড়িতে খসখস আওয়াজ ছাড়া কিছু শুনিনি বা দেখিনি।’

‘ভাঙা বাড়িতে খসখস আওয়াজ হাওয়া দিলেই শোনা যায়।’ বলল নগেন দত্ত। সাংবাদিক। আমার বন্ধু।

‘তা তো বটেই’ বললেন হরিশখুড়ো। ‘হাওয়া দিলে অনেক ভূতুড়ে আওয়াজ শোনা যায়। গাছের পাতা সরসর করে, জানালা খটখট করে, দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ করে। ভূতের ওঝারা তখন খড়ি পেতে ভূত তাড়ায়। মানে, হাওয়া থামলেই আওয়াজ থামে।’

ননী চাটুয্যে বললেন—’মনে হচ্ছে ভূতে বিশ্বাস নেই?’

‘আলবত আছে। নেই বলার মতো বুকের পাটা আমার নেই। তবে সব বাড়িতে থাকে না। সবার ভাগ্যে ভূতদর্শনও ঘটে না।’

আমি বললাম—’কাকা, আপনি কিন্তু ননীকাকার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেন। এ বাড়িতে সত্যি সত্যিই ভূত আছে কিনা বললেন না।’

হরিশকাকা অপাঙ্গে পদ্মমাসির দিকে তাকালেন। মাসি কাঠ হয়ে বসে ছিল। বেশ বুঝলাম, ভয় পেয়েছে।

বললাম—’কি মাসি, ভূতের বসবার ঘরে শুতে মন চাইছে না?’

‘তুই থাম’ খ্যান খ্যান করে উঠল মাসি। ‘ভূত থাকলে আমার কি? পারুল তো রইল। দোরগোড়ায় ও শোবে’খন; বলি ঘণ্টা—টণ্টা আছে?’

হরিশকাকা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন—’ঘণ্টা কী হবে?’

‘বাজাবো, বাজাবো। ভয় পেলেই ঘণ্টা বাজাবো। পারুলের ঘুম ভেঙে যাবে।’

আমি বললাম—’অত সাহসে দরকার কি মাসি? ঘরটা পালটে নিলেই তো হয়।’

কটমট করে পদ্মমাসি তাকাল আমার দিকে।

হরিশকাকা বললেন— ‘সিন্দুক খুঁজলে আরতির বাড়তি ঘণ্টা দু—একটা পাওয়া যেতে পারে। আর কারও ঘণ্টা লাগবে নাকি?’

আবার হাসির হররা ছুটল। পদ্মমাসি গজ গজ করতে করতে পারুলকে নিয়ে ওপরে চলে গেল। হরিশকাকাও গেলেন। ফিরে এসে বললেন—’একটা ঘণ্টা দিয়ে এলাম।’

আমি বললাম—’মাসি কিন্তু বড্ড ভয় পেয়েছে।’

‘স্বাভাবিক। এ বাড়িতে আগে কোনো উপদ্রব ছিল না। ইদানীং কানাঘুষো শুনছি।’

‘সত্যি?’

‘দোতলার যে ঘরে তোর মাসি শুয়েছে, ও ঘরটা আগে নাচঘর ছিল! এখন পালঙ্ক পাতা হয়েছে, যাতে অতিথি এসে রাত কাটতে পারে। মুশকিল হচ্ছে ওই পালঙ্ক নিয়েই।’

‘কীরকম?’

‘পালঙ্কটার পূর্ব ইতিহাস আমি জানি না। একতলার গুদোমে পড়েছিল। আমি দেখলাম, দামি কাঠ। পালিশ করল খোলতাই হবে! তাই করলাম। পালঙ্কের চেহারা ফিরে গেল! রাখলাম নাচঘরে। ওই ঘরটাই সব চাইতে বড়ো অতিথিঘর হল। মাস তিনেক আগে পাখি শিকার করতে আমার এক বন্ধু এল। ওই ঘরে ওই খাটে এক রাত কাটাল। পরের দিন সকালে ঘর পালটে অন্য ঘরে রইল।’

‘কেন?’

‘খাটটা নাকি মোটেই সুবিধের নয়। ঘুম হয় না।’

‘অ।’

ননী চাটুয্যে বললেন—’জেনেশুনে তুমি ওকে ও ঘরে পাঠালে?’

‘আমি তো ভয় দেখালাম। কিন্তু ওঁর জেদ চেপে গেলে কী করব? তা ছাড়া গোড়া থেকেই পারুল ওঁর জিনিসপত্র ওই ঘরে তুলেছে। এখন মালপত্র সরানোও ঝামেলা। আমি গোড়ায় জানলে ও ঘর ওঁকে দিতামই না।’

‘এখন উপায়?’

‘না, ভয়ের কিছু নেই। তোমরা আবার দু পাতা ইংরাজি পড়ে নাস্তিক হয়েছো তো! তাই এতক্ষণ বলি নি। এবার বলি। মাসখানেক আগে আমি এসেছিলাম ওঝা নিয়ে। বাড়ি ঝাড়ফুঁক করে গেছি। কাজেই কোনো ভয় নেই।’

এরপর আর আসর জমল না। হাই তুলতে তুলতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল। কাজেই যে যার ঘরে গিয়ে নিদ্রার আয়োজন করলাম।

পরের দিন রবিবার। আগের দিন খাটাখাটুনির ফলে গায়ে—গতরেও ব্যথা হয়েছিল। তাই ঘুম ভাঙতে আটটা বাজল। একতলার বৈঠকখানায় পুরুষরা জমায়েত হলাম। চা—পানের পর হরিশকাকা বললেন—’চ, আমাদের ভিটে দেখিয়ে আনি।’

প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কলকাতার ছেলেদের সঙ্গে শ্যামলা বাংলার গ্রাম্যরূপ এমনিতেই মধুর। তার ওপর স্মৃতিবিজড়িত জমিদার—ভবন। সুতরাং আমরা হইহই করে বেরিয়ে পড়লাম। আস্তাবল দেখলাম। দেখলাম রঙমহল—এককালে যেখানে কাশী—কাঞ্চীর বাইজিরা এসে ঘুঙুরের ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করে গেছে। কচুরিপানায় ঢাকা দেখলাম ‘বিন—বাদল—বরসাত’—মোগলাই অনুকরণে একটা বিরাট বাগান। মাঝে ঝিল আর ফোয়ারার সারি। দারুণ গ্রীষ্মেও নাকি এখানে বর্ষার আমেজ সৃষ্টি করা হত। সব দেখে ফিরতে বেলা প্রায় এগোরোটা হল। বৈঠকখানার দোরগোড়ায় দেখি পিণ্টি দাঁড়িয়ে। পিণ্টি আমার খুড়তুতো বোন। হরিশকাকার মেয়ে।

মুখ আমসি করে পিণ্টি যা বলল, তা শুনে আমরা তো হতভম্ব। পদ্মমাসি নাকি এখুনি চলে যাচ্ছে। নিশুতি রাতে নাকি ভূতে হানা দিয়েছিল মাসির ঘরে।

শুনেই আমরা তিন লাফে সিঁড়ি টপকে পিণ্টির পেছন পেছন দোতলায় উঠলাম। পদ্মমাসি ঘর পালটেছে দেখলাম। বড়ো ঘর ছেড়ে শুকনো মুখে শুয়ে রয়েছে পিণ্টির ঘরে।

আমরা ঘিরে দাঁড়াতেই চোখ খুলল পদ্মমাসি। চোখের কোলে দেখলাম কালি পড়েছে। চিঁ চিঁ স্বরে মাসি বলল—’ব্যাপারটা এতক্ষণে খোলসা হল। পারুল আসতেই মানটা হালকা হল। কালরাতে খুব তো ভয় দেখালে আমাকে। জানলা খটখট আওয়াজ করে, সিঁড়িতে সরসর শব্দ হয়—আরও কত কি! সত্যি কথা বলতে কি, ঘরে ঢুকে পর্যন্ত গা ছমছম করছিল। সারাদিন খাটুনির জন্যে তবুও শুতে—না—শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ জেগে উঠলাম। দেখলাম জানলা দিয়ে চাঁদের আলো মেঝেতে এসে পড়েছে। আর আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা সাদা মূর্তি। থান কাপড় জড়ানো সাদা মূর্তি। না, না, আমি ভুল দেখিনি।

আমার দিকে চেয়েছিল মেয়েটা। থান কাপড়ের মতোই সাদা তার মুখ। যেন হাড় ছাড়া কিছু নেই সেখানে। চোখের জায়গায় দুটো ছেঁদা। ঝকঝকে দাঁতের সারি। অবিকল মড়ার মাথার খুলির মতো দেখতে। কিন্তু মুখটা খুব বিষণ্ণ। কী যেন বলতে চাইছে। ওই পর্যন্ত দেখেই আমার হাত—পা ঠান্ডা হয়ে গেল। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। বেশ বুঝলাম, আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোল না। আমি জ্ঞান হারালাম। তারপর চোখ খুলে দেখি, ভোর হয়ে গেছে। বিষম ভয় পেয়েছিলাম। এখন অবশ্য ভয় আর নেই। পারুল আমার ভয় ভেঙে দিয়েছে।’

‘পারুল ভয় ভেঙে দিয়েছে মানে? পারুল কি ওঝা?’ হরিশকাকা বললেন।

‘পারুলকে সকালে পেতনির কথা বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ল। আসলে হয়েছে কী, ঘণ্টার আওয়াজ শুনেই পারুলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি ও ঘরে আসে। এসে দেখে আমি চোখ বুঁজে শুয়ে আছি। আসলে ওর থান কাপড় দেখেই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। ও ভাবল, আমি ঘুমোচ্ছি। তাই আর বিরক্ত না করে আবার শুতে চলে যায়।’

‘তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। পারুলই কাল রাতে পেতনি হয়েছিল।’ বললাম আমি। একটু হতাশ হয়েই বললাম। ভূতপ্রেত নিয়ে কেবল গল্পই করলুম! চোখে দেখা আর হল না।

পদ্মমাসি বলল—’সে যা হোক, আমি বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। অনেক কাজ আছে। এ বাড়িতে আর ঢুকছি না। যা ভয় পেয়েছিলাম।’

পদ্মমাসি চলে গেলে আমরা আবার বৈঠকখানায় এলাম। চায়ের কাপ এল। চুমুক দিয়ে ননী চাটুয্যে বললেন—’যাক, একটা ফাঁড়া কাটল। পারুল প্রেতিনী—রহস্য পরিষ্কার না করলে ভদ্রমহিলার নার্ভের ব্যায়রাম দাঁড়িয়ে যেত।’

‘রহস্য কি সত্যিই পরিষ্কার হয়েছে?’ হরিশকাকা বললেন।

‘বাকি কী রইল? ঘণ্টার ডাকা শুনেই পারুল ঘরে ঢুকেছে। মাসি তাকেই পেতনি ভেবেছে।’ বললাম আমি।

‘বুঝলাম। কিন্তু তোর মাসি তো খাট ছেড়ে নামেই নি। তার আগেই অজ্ঞান হয়েছে।’

‘তাতে কী হয়েছে।’

‘ঘণ্টাটা তাহলে বাজালো কে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *