ঘড়ি রহস্য

ঘড়ি রহস্য

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণের দুদিন থেকে সামান্য সর্দিজ্বর। পাড়ার ডাক্তার তারকবাবু তাকে দেখতে এসেছিলেন। প্রচুর আশ্বাস দিয়ে এবং লম্বা-চওড়া প্রেসক্রিপশন লিখে তিনি আড্ডার মেজাজে বসলেন। দেশের হালচাল নিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করে গেলেন। তারপর হঠাৎ মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা কর্নেলসায়েব, আপনি তো বিখ্যাত রহস্যভেদী। এ যাবৎ বিস্তর জটিল রহস্য ফাঁস করেছেন শুনেছি। কিন্তু কখনও কি এমন কোনও কেস আপনার হাতে এসেছে, যার রহস্য ফাঁস করতে পারেননি?

কর্নেল প্রেসক্রিপশনটা দেখছিলেন। বললেন, প্রশ্নটা আপনাকেও করা যায়।

ডাক্তারবাবু একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন, কেন? কেন?

ডাক্তার হিসেবে আপনার সুনাম আছে। আপনি কি সব রোগীর সঠিক রোগ ধরতে পেরেছেন?

ডাক্তারবাবু একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন, কেন? কেন?

ডাক্তারবাবু মাথা নেড়ে বললেন, কোনও ডাক্তারই এমন দাবি করতে পারেন না।

কর্নেল প্রেসক্রিপশনটা ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন। তারপর ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সাদা দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে বললেন, আমার ক্ষেত্রেও তা-ই। কিছু কিছু রহস্য ফাঁস করতে শেষাবধি আমি ব্যর্থ হয়েছি।

তারকবাবু আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, অন্তত তেমন একটা কেসের কথা বলুন। আমার জানতে ইচ্ছে করছে।

কর্নেল চোখ বুজে চকচকে টাকে হাত বুলোতে শুরু করলেন। এবার আমারও খুব আগ্রহ হল। কারণ দীর্ঘকাল যাবৎ আমি ওঁর প্রায় ছায়াসঙ্গী। অসংখ্য জটিল রহস্য ওঁকে নিপুণ দক্ষতায় ফাঁস করতে দেখেছি। আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন, কোনও ক্ষেত্রে উনি ব্যর্থ হয়েছেন। তাই না বলে পারলাম না, আশ্চর্য! কখনও তো আপনাকে ব্যর্থ হতে দেখিনি। তা ছাড়া তেমন কোনও কেসের কথা আপনি আমাকে বলেনওনি।

জয়ন্ত! তুমি সৈদাবাদ রাজবাড়ির জড়োয়া নেকলেস হারানোর ঘটনা ভুলে গেছ।

মনে পড়ে গেল। বললাম, কিন্তু নেকলেস হারানোটা যত রহস্যময় হোক, কে ওটা চুরি করেছে, আপনি তো জানতে পেরেছিলেন। এখন চোর যদি নিপাত্তা হয়ে যায়, আপনার কী করার আছে? খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার কাজটা পুলিশের।

ডাক্তারবাবু অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, একটু ডিটেলস বলুন কর্নেলসায়েব! রাজবাড়ির জড়োয়া নেকলেস যখন তখন নিশ্চয় প্রচুর দামি। কীভাবে ওটা চুরি গিয়েছিল?

কর্নেল বললেন, সেটাই একটা জটিল রহস্য। সেই রহস্য আমি ফাঁস করতে পারিনি। নেকলেসটা নাকি রাজপরিবারের সৌভাগ্যলক্ষ্মীর প্রতীক। পরিবারে নতুন বউমা এলে বউভাতে জমকালো পার্টি দেওয়া হত। পার্টিতে নতুন বউমা নেকলেস পরে সিংহাসনে বসে থাকতেন। পার্টি শেষ হলে ওটা খুলে নিয়ে গিয়ে পাতালঘরে লক্ষ্মী প্রতিমার গলায় পরানো হত। এটাই ছিল বংশানুক্রমে রীতি। সে রাত্রে পার্টি শেষ হতে তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। হঠাৎ দেখা গেল বউমার গলায় নেকলেস নেই।

ডাক্তারবাবু বললেন, জয়ন্তবাবু বলছেন আপনি নেকলেস চোরকে চিনতে পেরেছিলেন!

হ্যাঁ। কিছু সূত্র থেকে অনুমান করেছিলাম রাজবাড়ির জয়গোবিদ নামে এক কর্মচারী যেভাবেই হোক, নেকলেস চুরি করেছে। সে একা থাকত রাজবাড়ির একটা ঘরে। কিন্তু তার ঘরে শেষরাত্রে হানা দিয়ে দেখা গেল তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে উধাও হয়ে গেছে। তবে রহস্যটা থেকে গেল। জয়গোবিন্দ কখন কীভাবে নেকলেস চুরি করল? হলঘরের পার্টিতে প্রচুর লোক ছিল। চোখধাঁধানো আলো ছিল। সবচেয়ে আশ্চর্য, নতুন বউমাও টের পাননি কখন তার গলা থেকে নেকলেস উধাও হয়েছে।

ডাক্তারবাবু ঘড়ি দেখে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। উঠি কর্নেলসায়েব! এতক্ষণ রোগীরা আমার মুণ্ডপাত করছে।

তারকডাক্তার চলে যাওয়ার পর কর্নেল একটু হেসে বললেন, তারকবাবু ডাক্তার হিসেবে জনপ্রিয়। কিন্তু মশা মারতে কামান দেগেছেন। একে তো ষষ্ঠী ওষুধ খেতেই ভয় পায়, তাতে এত সব ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, সিরাপ! তুমি একটু বোসসা জয়ন্ত! দেখি, কাউকে দিয়ে ওষুধগুলো আনানো যায় নাকি।

বললাম, আমি এনে দিচ্ছি।

এই সময় ডোরবেল বাজল এবং ড্রয়িং রুমের দরজায় পর্দার ফাঁকে অবাক হয়ে দেখলাম, ষষ্ঠীচরণ গিয়ে দিব্যি দরজা খুলে দিল। তারপর প্রায় তাকে ঠেলে সরিয়ে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সটান্ত এ-ঘরে এসে ঢুকলেন। নমস্কার করে কাঁচুমাচু মুখে তিনি বললেন, কর্নেলসায়েবের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। দাদা বলে গেছেন, টাইম ইজ মানি। তো কাগজে আপনার কীর্তিকলাপ পড়েছি। ছবি দেখেছি। অনেক চেষ্টায় ঠিকানা জোগাড় করে ছুটে এসেছি। টাইম ইজ মানি। কিন্তু—

ওঁর কথার ওপর কর্নেল বললেন, আপনি বসুন। বলুন কী ব্যাপার।

ভদ্রলোক সোফায় বসে রুমালে মুখ মুছে বললেন, সব কথা গুছিয়ে বলতে সময় লাগবে। কিন্তু ওই যে বললাম! দাদা বলে গেছেন টাইম ইজ মানি! ইংরিজি প্রবাদ হলেও কথাটা সত্যি।

ভদ্রলোক পাগল নন তো? একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, বারবার বলছেন টাইম ইজ মানি! অথচ নিজেই টাইম নষ্ট করছেন।

ভদ্রলোক চটে গিয়ে বললেন, আমার কথা হচ্ছে কর্নেলসায়েবের সঙ্গে।

কর্নেল হেসে ফেললেন। ঠিক। তবে উনি একজন সাংবাদিক। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি। আপনি নিশ্চয় জানেন, রিপোর্টাররা সবকিছুতে খবর খোঁজেন? এ কী সৌভাগ্য! আপনি আমার এই খবরটা দয়া করে লিখুন! বজ্জাতদের মুখোশ খুলে দিন। হ্যাঁ, এবার খবরটা সংক্ষেপে বলি। কারণ, টাইম ইজ মানি।

বলে উনি কর্নেলের দিকে ঘুরে বসলেন। আগে আমার নাম-ঠিকানা বলি। আমার নাম প্রাণনাথ রায়। সাতাশ বাই তিন, নকুড় মিস্ত্রি লেনে একটা মেসবাড়িতে একখানা আলাদা ছোট্ট ঘরে থাকি। চাকরি করি মতিলাল ট্রেডিং কোম্পানিতে। তো কিছুদিন থেকে একটা ভূতুড়ে ঘটনা লক্ষ করছি। ধরুন, টেবিলে যে পাঁজিখানা যেখানে রেখে বেরিয়েছিলাম, বাসায় ফিরে দেখি, সেখানা ঠিক সেইখানে নেই। কিংবা ধরুন, যে শার্টটা হ্যাঙারে যেভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, ফিরে এসে, দেখি, সেটা সেইভাবে ঝোলানো নেই। একটা কাঠের ছোট্ট আলমারি আছে। তার তালা তেমনই আটকানো। অথচ ভেতরকার জিনিসপত্র এদিক-ওদিক হয়ে আছে। রোজ বিকেলে ছড়ি হাতে পার্কে বেড়াতে যাওয়ার অভ্যাস। কাল ছড়িটা দেখি, ব্র্যাকেটের যেখানে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, সেখানে নেই। এইরকম অসংখ্য ব্যাপার প্রতিদিন ঘটছে। আমি এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। চোর ঢুকলে তো সে কিছু চুরি করত। কিন্তু এ-পর্যন্ত কিছুই চুরি যায়নি। আমার সন্দেহ হয়েছিল, কেউ বজ্জাতি করে আমাকে তাড়াতে চাইছে। কিন্তু গত রাত্রে হঠাৎ একটি শব্দে ঘুম ভেঙে যেতেই টেবিলবাতি জ্বেলে দেখি কাঠের আলমারিটা নড়ছিল। সদ্য থেমে গেল। আতঙ্কে সারা রাত্রি আর ঘুম হয়নি। তো টাইম ইজ মানি। আর দেরি করা চলে না। আপনার শরণাপন্ন না হয়ে উপায় ছিল না।

কর্নেল চুপচাপ শুনছিলেন। এতক্ষণে বললেন, আপনার ঘরে কোনও দামি জিনিস আছে?

নাহ। যৎসামান্য টাকাকড়ি ব্যাঙ্কে রাখি। এই রিস্টওয়াচটা যদি দামি বলেন, এটা প্রায় সারাক্ষণ আমার হাতে বাঁধা থাকে। শুধু স্নানের সময় টেবিলে খুলে রেখে যাই। কিন্তু এটা চুরি হয়নি।

আপনার দাদার নাম কী?

আমার দাদার নাম ছিল হরনাথ রায়।

তিনি বেঁচে নেই?

আজ্ঞে না। এখন আমি মেসবাড়ির যে-ঘরে থাকি, দাদা সেখানেই থাকতেন। বাউণ্ডুলে ছন্নছাড়া প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বিয়ে করেননি। আমার সঙ্গে বহু বছর দাদার কোনও যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ দুমাস আগে টেলিগ্রাম পেলাম, হার্ট অ্যাটাক হয়ে দাদা হাসপাতালে আছেন। সঙ্গে

সঙ্গে ছুটে এলাম কলকাতা।

আপনি কোথায় ছিলেন তখন?

সাহেবগঞ্জে। আমার কোম্পানির একটা ব্রাঞ্চ আছে সেখানে। আমাদের পৈতৃক বাড়িও সেখানে। আমার ফ্যামিলি এখনও সাহেবগঞ্জে আছে।

তারপর কী হল বলুন।

হাসপাতালে দাদা তখন মরণাপন্ন। আমাকে চিনতে পেরে শুধু বললেন, পানু! উইম ইজ মানি। কথাটা মনে রাখিস! ব্যস! ওই শেষ কথা।

কথাটা একটা ইংরেজি প্রবচন। যাই হোক, তারপর?

দাদার শেষকৃত্য করে কোম্পানির হেড অফিসে গেলাম। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল কলকাতায় বদলি হওয়ার। হেড অফিসে থাকলে অনেক সুযোগসুবিধে, বুঝলেন তো?

বুঝলাম। কোম্পানি তা হলে আপনাকে কলকাতায় বদলি করল?

আজ্ঞে। দাদার সঙ্গে মেসের ম্যানেজার প্রভাতবাবুর বন্ধু ছিল। তাই দাদার ঘরটা আমাকে একই ভাড়ায় ছেড়ে দিলেন।

ওই ঘরে তো আপনার দাদার জিনিসপত্র ছিল?

ছিল। একটা তক্তাপোশ, বিছানাপত্তর, চেয়ার টেবিল, একটা সুটকেস, একটা ছোট্ট কাঠের আলমারি—এইসব।

আর কিছু?

প্রাণনাথবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আর তেমন কিছু—হ্যাঁ! একটা প্রকাণ্ড দেওয়ালঘড়ি। ঘড়িটা অচল। দাদা কেন ওটা কিনেছিলেন, কেনই বা আর সারাননি, কে জানে! আমি ওটা বেচে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু দাদার স্মৃতি।

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। টাইম ইজ মানি।

প্রাণনাথবাবু সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, কথাটা দাদা বলেছিলেন। সেই থেকে কেন কে জানে কথাটা আমাকে ভূতের মতো পেয়ে বসেছে।

আমাকেও। বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, আপনার ঘরের ভূতুড়ে ঘটনার কথা কি ম্যানেজার প্রভাতবাবু কিংবা আর কাউকে বলেছেন?

প্রভাতবাবুকে বলেছিলাম।

উনি কী বলেছিলেন?

উনি হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, আপনার দাদাও ঠিক একই কথা বলতেন।

প্রাণনাথবাবু এবার চাপা গলায় বললেন, ওই মেসবাড়িতে যাওয়ার পরদিন মেসের একজন বোর্ডার ননীবাবু আমাকে বলেছিলেন, ওই ঘরে নাকি ভূত আছে। বহুবছর আগে কে নাকি আত্মহত্যা করেছিল।

ঠিক আছে। টাইম ইজ মানি। আমরা আজ বিকেল পাঁচটা নাগাদ আপনার বাসায় যাব। তবে আপনি যেন কথাটা গোপন রাখবেন। আমরা আপনার কোম্পানির অফিসার হিসেবে যাব।

প্রাণনাথবাবু আশ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল অভ্যাসমতো টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, কী বুঝলে জয়ন্ত?।

ম্যানেজার ওঁকে তাড়াতে চাইছেন। কারণ নতুন বোর্ডার ঢোকাতে পারলে বেশি ভাড়া এবং সেলামিও পাবেন।

তাড়াতে চাইলে হরনাথবাবুর মৃত্যুর পর ওঁকে একই ভাড়ায় থাকতে দিলেন কেন?

তা হলে কোনও বোর্ডার—ধরুন, এই ননীবাবু ঘরটা পাওয়ার জন্য ওঁর পেছনে লেগেছেন।

কর্নেল হাসলেন। টাইম ইজ মানি। কথাটা গুরুত্বপূর্ণ ডার্লিং!

বিরক্ত হয়ে বললাম, কথাটা দেখছি সত্যিই ভূতের মতো আপনাকে পেয়ে বসেছে।

হ্যাঁ। ওটাই আসলে ভূত। সেই ভূতের উপদ্রব ঘটেছে প্রাণনাথবাবুর ডেরায়। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। নিচের ফ্ল্যাটের লিন্ডার দাদা গোর্সকে দিয়ে ষষ্ঠীর ওষুধগুলো আনিয়ে নিই। তুমি বোসো। দুজনে আজ রান্নাবান্না করব। তারপর বিকেলে নকুড় মিস্ত্রি লেনে যাব।

 

দোতলা মেসবাড়িটা খুঁজে বের করতে অসুবিধে হয়নি। ঘিঞ্জি গলির বাঁকের মুখে একটা ছোট্ট পার্ক দেখা যাচ্ছিল। প্রাণনাথবাবু নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ির একতলায় দোকানপাট। দোতলায় মেস। শেষপ্রান্তে প্রাণনাথবাবুর ডেরা। তার লাগোয়া ম্যনেজারের ঘর। সেই ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রাণনাথবাবু ম্যানেজার প্রভাতবাবুকে জানিয়ে গেলেন, ওঁর কোম্পানির অফিসাররা ইমপর্ট্যান্ট কাজে এসেছেন। প্রভাতবাবু চেয়ারে বসেই করজোড়ে নমস্কার করলেন। ভদ্রলোক রোগা এবং বেঁটে। মুখে অমায়িক ভাব। তালা খুলে প্রাণনাথবাবু বললেন, আপনারা দয়া করে একটু বসুন। আমি চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।

টাইম ইজ মানি! বলে কর্নেল দেওয়ালঘড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। ঘড়ির কাঁটা বারোটা তিরিশে থেমে আছে।

বললাম, একেই বলে বারোটা বেজে যাওয়া।

কর্নেল আমার রসিকতায় কান দিলেন না। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে তার ওপর উঠে আতস কাচ বের করলেন। একটু পরে বললেন, ডায়ালে কিছু কথা লেখা ছিল। ঘষে ফেলা হয়েছে। তবে ঘড়িটা বিলিতি এবং খুব দামি। হরনাথ কিংবা তার পূর্বপুরুষকে কেউ হয়তো উপহার দিয়েছিল।

চেয়ার থেকে নেমে কর্নেল চেয়ারটা আগের জায়গায় রেখে কাঠের আলমারিটার কাছে গেলেন। উঁকি মেরে পেছন দিক দেখে আপন মনে বললেন, সত্যিই এটা নাড়ানো হয়েছে। ডান দিকের দুটো পায়া ইঞ্চিটাক সরে এসেছে।

এইসময় প্রাণনাথবাবু ফিরে এলেন। তাঁর হাতে চায়ের দুটো কাপপ্লেট। বললেন, আগে চা খেয়ে নিন আপনারা। তারপর সব দেখাচ্ছি।

কর্নেল বললেন, আপনি এই আলমারিটা খুলুন।

খুলছি। ওতে দাদার জামাকাপড় আর বইপত্তর ছাড়া কিছু নেই।

প্রাণনাথবাবু কাঠের আলমারিটা খুলে দিলেন। কর্নেল আলমারির ভেতর যেন তল্লাশ শুরু করলেন, আপনার দাদার সেই সুটকেসটা দেখতে চাই।

চামড়ার সুটকেসেও কিছু জামাকাপড় আর-একটা ফাইল পাওয়া গেল। ফাইলের কাগজপত্র দেখে কর্নেল বললেন, আপনার দাদা দেখছি শেয়ার মার্কেট ব্রোকার ছিলেন!

তাই বুঝি? আমি কিন্তু দাদার কোনও কাগজপত্র এখনও খুঁটিয়ে দেখিনি।

আপনি ম্যানেজার প্রভাতবাবুকে ডাকুন। ওঁর সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে চাই।

প্রাণনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, ওঁকে ডাকা কি ঠিক হবে?

আপনি ওঁকে ডাকুন।

কর্নেলের কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ছিল। প্রাণনাথবাবু বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু উনি বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে পাশ কাটিয়ে প্রভাতবাবুর আবির্ভাব হল। প্রাণনাথও ফিরে এলেন। আমার সন্দেহ হল, প্রভাতবাবু দরজার পাশেই হয়তো আড়ি পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্নেল বললেন, আসুন প্রভাতবাবু, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

প্রভাতবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি, আপনারা লালবাজার থেকে এসেছেন। তবে সার, বড্ড দেরি করে এসেছেন। মরার আগে হরনাথ চোরাই জিনিস হাফিজ করে গেছে।

কর্নেল বললেন, চোরাই জিনিস। তার মানে?

মানে আপনারা ভালোই জানেন। তবে আমি সার ওসব সাতে-পাঁচে ছিলাম না। হরনাথ আমাকে বলত বটে, খদ্দের দেখে দাও। সিকিভাগ তোমার। আমি ওকে পাত্তা দিইনি।

কিন্তু জিনিসটা কী?

খুলে কিছু বলেনি হরনাথ। কাজেই জিনিসটা কী আমি জানি না। শুধু এইটুকু জানি, জিনিসের দাম ছিল বড্ড বেশি। হরনাথ আভাস দিয়েছিল লাখের ওপরে দাম। আমার মালিক ভদ্রলোক, যাঁর এই মেসবাড়ি, তিনি কোটিপতি লোক। হরনাথ গোপনে তার কাছেও গিয়েছিল। কিন্তু তিনিও কিনতে সাহস পাননি। আমাকে বলেছিলেন, ওই লোকটাকে তাড়াও। কিন্তু তাড়াব কী করে? এ পাড়ার সব গুণ্ডা, বদমাশ ছিল হরনাথের হাতে।

প্রাণনাথ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, এসব কী বলছ প্রভাতদা! আমার দাদা–

প্রভাতবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, খাল কেটে কুমির এনেছ। এখন তুমিই ঠেলা সামলাও পানু! আমাকে এসব ব্যাপারে জড়িয়ো না।  বলে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রাণনাথবাবু ধপাস করে বিছানায় বসে বলেন, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। আমার দাদা বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া ছিলেন বটে, কিন্তু ওঁকে চোর অপবাদ কেউ কস্মিনকালে দেয়নি। আর দামি চোরাই জিনিস যদি ওঁর কাছে থাকবে, আমি তার খোঁজ পাব না? যদি বেচে দিয়েও থাকেন, সেই টাকাই বা গেল কোথায়?

কর্নেল চুরুট ধরালেন। আমি বললাম, এবার মনে হচ্ছে, আপনার ঘরে কেউ আপনার দাদার চোরাই জিনিস বা তা বিক্রি করা টাকা খুঁজতেই ঢোকে।

প্রাণনাথবাবু প্রায় আর্তনাদ করলেন, তেমন কিছু এ ঘরে নেই।

কর্নেল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আপনার দাদা বলেছিলেন টাইম ইজ মানি। তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

টাইমের সঙ্গে ঘড়ির সম্পর্ক আছে। আপনি ঘড়িটা সারাতে দিচ্ছেন না কেন?

সারাতে অনেক টাকা লাগবে। অত টাকা পাব কোথায়?

আমি নিজের খরচে সারিয়ে দেব। আমার ধারণা, ঘড়িটা চালু হলে আপনার ঘরে আর ভূতের উপদ্রব হবে না। ওই অচল ঘড়িই আপনার ঘরে ভূত ডেকে আনছে।

প্রাণনাথবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

কর্নেল চেয়ার টেনে নিয়ে দেওয়ালঘড়ির তলায় গেলেন। তারপর চেয়ারে উঠে প্রকাণ্ড ঘড়িটা নামিয়ে আনলেন। বললেন, দিনসাতেক পরে আমার কাছ থেকে এটা ফেরত দিয়ে আসবেন। কোনও বড় কোম্পানিতে এটা সারাতে দেব।

 

ইলিয়ট রোডে তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল ঘড়িটা খুলতে শুরু করলেন। বললাম, সব ছেড়ে এই ঘড়ি নিয়ে পড়লেন কেন?

কর্নেল হাসলেন, কারণ টাইম ইজ মানি।

কর্নেল! আমার ভয় হচ্ছে এই অচল ঘড়ি আপনার মগজও অচল করে দিয়েছে।

ডায়ালের কাচ খুলে আতস কাচ রেখে কী দেখতে দেখতে কর্নেল বললেন, এবার স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। প্রেজেন্টেড টু মিঃ জয়গোবিন্দ রায় ফর হিজ সিনসিয়ার সার্ভিস অ্যান্ড অনেস্টি, অন দা অকেশন অব কুমারবাহাদুর প্রমথনারায়ণ চৌধুরিস সেভেনটি ফার্স্ট বার্থ অ্যানিভার্সারি…

চমকে উঠলাম। কর্নেল! এটা তো তা হলে সৈদাবাদ রাজবাড়ির উপহার। এই উপহার হরনাথের হাতে গেল কী করে?

ডার্লিং! হরনাথই জয়গোবিন্দ। হরনাথের সুটকেসের ভেতর কয়েকটা পুরনো নেমকার্ড খুঁজে পেয়েছি। এই দ্যাখো, হরনাথ নাম ভঁড়িয়ে রাজবাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি জুটিয়েছিল।

বুঝেছি। কিন্তু জড়োয়া নেকলেসটা গেল কোথায়?

ভুলে যাচ্ছ জয়ন্ত! মৃত্যুর সময় হরনাথ বলেছিল, পানু! টাইম ইজ মানি। কথাটা মনে রাখিস। পানুবাবু সূত্রটা বুঝতে পারেননি। নেকলেস চুরি যায় রাত সাড়ে বারোটায়। এই ঘড়ির কাল তাই সাড়ে বারোটায় রেখেছিল হরনাথ। আর নেকলেসটা— বলে কর্নেল ডায়াল খুলে ফেললেন এবং ভেতর থেকে একটা লাল ভেলভেটে মোড়া প্যাকেট বের করলেন। প্যাকেট খুলতেই দেখা গেল ঝলমলে হিরে-মুক্তোবসানো সোনার ঝালর দেওয়া একটা জড়োয়া নেকলেস। কর্নেল মিটিমিটি হেসে ফের বললেন, টাইম ইজ মানি! তবে হরনাথ কীভাবে নেকলেসটা চুরি করেছিল, এখন বুঝতে পারছি। এই দ্যাখো, পিঠের দিকে নেকলেসটার ক্লিপ ঠিকভাবে আঁটা নেই। সহজেই খোলা যায় কিংবা নিজে থেকেও খুলে পড়তে পারে। বিয়ের পার্টিতে নতুন বউমা নিশ্চয়। ঘুমে ঢুলছিলেন। সেই সময় নেকলেস খসে পড়ে থাকবে। কেয়ারটেকার উপহারসামগ্রীর দায়িত্বে ছিল। সে সুযোগটা ছাড়েনি। ক্লিয়ার?

সায় দিয়ে বললাম, অল ক্লিয়ার। টাইম ইজ মানি, এটাও ক্লিয়ার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *