ঘড়ি বিবি
বিয়ের আগে ওর নাম ছিল রাবেয়া। বিয়ের পর নাম দিলাম রেবা।
আমি যা ছিলাম, তাই রয়ে গেলাম। মিন্টু পাইন। সুবর্ণ বণিক।
সিকিখানা কলকাতার মালিক বলতে পারেন আমাকে। বাপ-ঠাকুরদার আমলে আরও প্রপার্টি ছিল। এখনো মোহর আছে, হিরে-জহরত আছে। থাকে ব্যাঙ্কের লকারে। টাকা ফিক্সড ডিপোজিটে। সুদ যা পাই, তা শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে আপনার। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়ার অঙ্ক যদি শোনেন, হিংসে হবেই।
তাই থাকি সাদাসিধেভাবে। সোনার বেনেদের ওপর হিংসে অনেকেরই। সপ্তগ্রামী বেনে তো। কবে কোনওকালে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আমার পূর্বপুরুষরা দেদার টাকা জমিয়েছিলেন, সুদে-আসলে তা বাড়তে-বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, সারা জীবন লাটসাহেবি করে কাটালেও আমার পরের সাতপুরুষ বসে খেয়ে যেতে পারবে।
আমি কিন্তু কোনওরকম নষ্টামির মধ্যে যাইনি। বাবা এবং মা অকালেই স্বর্গধামে রওনা হওয়ার সময়েও আমি ব্যাচেলর। কিন্তু সাতগেঁইয়া স্টাইলে রক্ষিতা-ফক্ষিতাও রাখিনি। আমার একমাত্র নেশা সন্ধে নাগাদ একটা ধনে পরিমাণ আফিং দুধ দিয়ে খাওয়া। আর কেবল দেশ দেখে বেড়ানো। পৃথিবীটাকে বারকয়েক পাক দিয়ে এসেছি।
ফ্র্যাঙ্কলি সব কথা বললাম। এরপর আমার এই আশ্চর্য কাহিনি বিশ্বাস করা না করা আপনার অভিরুচি।
মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারী দেখে বেরিয়ে আসার সময় গাছতলায় একটি পরমাসুন্দরীকে একদিন বসে বসে কাঁদতে দেখে চমকে উঠেছিলাম। আমি সাতগেঁইয়া। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই ডাকসাইটে সুন্দরীদের দেখেছি ছোটবেলা থেকেই। রূপটুপ তাই কোনওকালেই আমাকে টলাতে পারে না। কিন্তু হাজারদুয়ারির বাইরে সেই অনিন্দ্যসুন্দরীকে দেখে আপনা থেকেই পা থেমে গেল আমার।
বয়স তার বড়জোর বিশ। কসমেটিকসের ভড়কি একদম নেই চোখে-মুখে। সবটাই ভগবানের দেওয়া। অমন কালো চোখ আমরা সাতগেঁইয়া মহলেও কখনো দেখিনি। অমন ঘন কালো কেঁকড়া চুল, দুধে আলতায় গোলা গায়ের রং আর নিখুঁত গড়ন-পেটন সারা পৃথিবী ঘুরে এসেও দেখিনি।
গাছতলায় একলা বসে এমন ভুবনমোহিনীকে কাঁদতে দেখে আমার মন চঞ্চল হয়েছিল। পাশে তার একটিমাত্র বোঁচকা। পরনে সাদা জমিনের লালপাড়ের সাদামাটা শাড়ি। শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছছে আর কেঁদেই চলেছে সে।
কাছে গেলাম। বৃত্তান্ত শুনলাম। আমিও পরম রূপবান। বিশ্বাস না হয়, এসে দেখে গেলেই পারেন। দুধ আফিংয়ের দৌলতে আর টাকা টনিকের কল্যাণে সাতগেঁইয়া চেহারা দেখলে মনে হবে নিশ্চয় ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কোনও নবাবপুর বুঝি। যদিও সাদাসিধেভাবে থাকি কিন্তু চেহারায় জুলুষ ঢাকা যায় না।
মেয়েটা চোখ মুছে আমাকে দেখেই প্রেমে পড়েছিল। তাই সব কথা খুলে বলেছিল। বাড়ি তার পুব-বাংলায়। বাপ-মাকে খেয়েছে অকালে। এক চাচা তাকে বর্ডার পার করে নিয়ে আসে। তারপর সোনার গয়না ভর্তি পুঁটলিটা সঙ্গে নিয়ে তাকে গাছতলায় বসিয়ে সরে পড়েছে। রেখে গেছে। কেবল এই বোঁচকাটা।
আমি মেয়েটাকে নিয়ে এলাম কলকাতায়। জ্ঞাতিগুষ্ঠিদের তোয়াক্কা করলাম না। একবার মসজিদে আর একবার পুরুত ডাকিয়ে–মুসলমানি মতে আর হিন্দুমতে তাকে বিয়ে করলাম। সেই থেকে রাবেয়া হল রেবা।
এইবার আসি আসল গল্পে। রেবার বোঁচকা দিয়েই এই বিচিত্র কাহিনির শুরু। বোঁচকার মধ্যে যেন সাত রাজার ধন আছে, এমনিভাবেই সবসময়ে তা আগলে রাখত রেবা। একদিন দেখলাম সেই সাত রাজার ধন।
বললে পেত্যয় হবে না আপনার। তবুও বলি। জিনিসটা একটা ঘড়ি। সেকেলে পেন্ডুলাম ঘড়ি। কিন্তু বাইরের গড়নটা মামুলি ঘড়ির মতো নয়। একটা মেয়েছেলের মুর্তি। ঘোমটা ফাঁক করে যেন সে উঁকি দিচ্ছে বাইরে। কিন্তু মুখের বদলে একটা ঘড়ি।
আমি এমন আজব ঘড়ি মশাই জীবনে দেখিনি। সাতগেঁইয়াদের সাতমহলা বাড়িতে হাজার রকমের দিশিবিলিতি ঘড়ি দেখেছি এতটুকু বয়স থেকে। কিন্তু মেয়েমানুষের চেহারাওয়ালা এমন অদ্ভুত ঘড়ি লাইফে দেখিনি। মেয়েটার মুখ নেই–অথচ তাকে বেশ সুন্দরীই মনে হয়। মনে হয় ঘোমটা সরিয়ে মুখটা দেখি। তার হাঁটু বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমার মধ্যেও এমন একটা আকর্ষণ যে একবার তাকালে আবার তাকাতে ইচ্ছে যায়–একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে যায়।
আমিও চেয়েছিলাম। ঘাড়ের ওপর ফোঁস করে নিঃশ্বেস পড়তেই বুঝলাম রেবা এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় না ফিরিয়েই বললাম–চমৎকার ঘড়ি তো!
রেবা জবাব দিল না। আমারও চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ঘড়ি-সুন্দরীর ওপর থেকে।
ঘাড় না ফিরিয়েই বললাম–এমন ঘড়িকে বোঁচকায় রেখেছ কেন? ঝুলিয়ে দাও দেওয়ালে। দু-চোখ ভরে রোজ দেখি।
রেবা তখনও জবাব দিল না।
আমিও একদৃষ্টে ঘড়ি-সুন্দরীকে দেখতে দেখতে বললাম–সত্যিই সুন্দরী। তোমার মতোই।
তাই বুঝি? খুব আস্তে কানের কাছে কথাটা বলল রেবা। গলার স্বর আর বলার ভঙ্গিটা এমন যে শুনেই খটনা লাগল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম। রেবা অনিমেষে তাকিয়ে আছে সেই ঘড়ির দিকে।
কার ঘড়ি, রেবা?
রেবা জবাব দিল না। কোনওদিনই দেয়নি। জিগ্যেস করে করে মুখ ব্যথা হয়ে যাওয়ায় আমিও আর জিগ্যেস করিনি। শুধু বুঝেছি, ঘড়িটা তার প্রাণ। এবং ঘড়ি নিয়ে কাউকে কোনও কথা বলতেই সে রাজি নয়।
ঘড়িটা কিন্তু জোর করেই আমি আমার শোওয়ার ঘরে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। দিন-কতক ঠিকমতো চলেছিল, সময়ও দিয়েছিল। তারপর একদিন রাত্রে দেখলাম ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে।
মাঝ রাতে উঠেছিলাম পেট ব্যথা করছিল বলে। আফিং খেলে পেটে বড় বায়ু হয়। পেট ফাঁফে। আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। এমনিতে বায়ুর রোগ। তার ওপর আফিং। রেবা ঘুমোচ্ছে দেখে আমি নেমে এলাম খাট থেকে। চোখ পড়ল ঘড়ির ওপর।
.
দেখলাম, পেন্ডুলাম দুলছে না। তার মানে ঘড়ি থেমে আছে। দম দেওয়া হয়নি বোধহয়। ও ঘড়িতে দম দেওয়ার ভার অবশ্য আমার নয়–রেবার। দম দেওয়া, তেল দেওয়া–সব ওর কাজ। তাই ঘড়ি বন্ধ দেখে আমি আর ঘড়িতে হাত না দিয়ে খাটের পাশ দিয়ে বাথরুমের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময়ে টিক-টক টিক-টক আওয়াজ কানে ভেসে এল।
ঘড়ি তো বন্ধ। অথচ স্পষ্ট পেন্ডুলাম দোলার আওয়াজ হচ্ছে। ফিরে দেখলাম পেন্ডুলাম দুলছে না। ঘড়ি বন্ধ। টিক-টক টিক-টক আওয়াজটা বেশ শোনা যাচ্ছে। ঘর নিস্তব্ধ বলেই স্পষ্ট কানে বাজছে।
ধুত্তোর। আফিংয়ের মৌতাত তো। বাথরুম থেকে ঘুরে শুয়ে পড়লাম। টিক-টক আওয়াজ শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে চা খেতে খেতে রেবাকে ঘটনাটা বলতেই ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার পাশে। এক হাঁটু বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমাটা অনেকটা ওই ঘড়ি-সুন্দরীর মতোই। ঘাড় বেঁকিয়ে মুখের দিকে তাই চেয়েছিলাম। ঘড়ির বদলে অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা দেখলাম। যেন সমস্ত রক্ত নেমে গেছে সেই মুখ থেকে।
কী হল?
ত্রস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল রেবা। এ সম্পর্কে আর কোনও কথাও হল না পরে।
এরপরেও একদিন রাত্রে দেখলাম, আর শুনলাম সেই একই কাণ্ড। ঘড়ি তো বন্ধ কিন্তু টিক-টক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে রেবা।
সকালবেলা কথাটা বললাম রেবাকে। আবার সেইভাবে মুখখানা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে করে ঘর থেকে ছুটে পালাল রেবা।
তারপর থেকেই দেখতাম, রাত্রে আর রেবা ঘুমোয় না। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে দেওয়ালের ঘড়ির দিকে। ভোর হলেই ঘুমিয়ে পড়ে অকাতরে। যতক্ষণ জেগে থাকে, ঘড়িও চলে বেশ টিক-টক করে।
জোর করে ওকে নিয়ে এলাম পুরীতে। ঘড়িটা আনতে চেয়েছিল সঙ্গে। আমি রাজি হইনি। আমার মন বলছে, ওই ঘড়িই যত নষ্টের গোড়া। ওকে দূরে রাখা দরকার।
পুরীতে রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল ঢেউয়ের গর্জনে। শুধু ঢেউয়ের গর্জনে নয়–আরও একটা আওয়াজে। টিক-টক শব্দটা যেন কানের কাছেই বাজছে।
উঠে বসলাম। ঘরে কোথাও ঘড়ি নেই। আমার হাতে ইলেকট্রনিক রিস্টওয়াচ। শব্দের বালাই নেই।
টর্চ জ্বেলে দেখছিলাম আশপাশ। হঠাৎ টর্চের আলো রেবার চুলের ওপর পড়তেই চমকে উঠলাম। ওর মাথা ভর্তি ঘন কালো চুলের মধ্যে সেই প্রথম সাদার ঝিলিক চোখে পড়ল। এর আগে ওর মাথায় পাকা চুল কখনো দেখিনি। এই বয়েসে চুল পাকার কথা ভাবাও যায় না। উদ্বেগে অবশ্য পাকে। ঠিক করলাম, কলকাতায় ফিরেই ডাক্তার দেখাতে হবে।
সকাল হল। আমার আগে অনেক ভোরে উঠে পড়েছিল রেবা। মুখ-চোখ বড্ড ক্লান্ত দেখলাম। যেন রাতারাতি বুড়িয়ে গেছে। মাথার পাকা চুলের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
ক্লান্ত চোখে ক্লান্ত কণ্ঠে ও বললে–বাড়ি চলো এখুনি।
সে স্বর, সে চাউনি উপেক্ষা করতে পারলাম না। ফিরে এলাম কলকাতায়। বাড়িতে ঢোকার মুখেই দেখলাম দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, চোর পড়েছিল, যা পেয়েছে, নিয়ে গেছে। শোবার ঘরে মেঝের ওপর আছড়ে ফেলে গেছে ঘড়ি সুন্দরীকে।
ধপ করে একটা শব্দ হল পেছনে। রেবা দু-হাতে বুক খামচে ধরে বসে পড়েছে মেঝেতে। মুখ নিরক্ত।
টেলিফোন তুললাম ডাক্তারকে ফোন করব বলে। লাইন খারাপ। বেরোতে যাচ্ছি–বাধা দিল রেবা। কোনও কথা না শুনে ছুটে গিয়ে ডেকে আনলাম ডাক্তার।
শোবার ঘরে ঢুকে কিন্তু রেবাকে দেখলাম না–ঘড়ি সুন্দরীকেও দেখলাম না। এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে রেবা–সঙ্গে নিয়ে গেছে ওর প্রাণ সেই ঘড়িটাকে।
রেবাকে আজ পর্যন্ত আর দেখিনি। আপনার চোখে পড়লে কাইন্ডলি খবর দেবেন। আমার মন বলছে ওকে কাছে পেলে সেই অদ্ভুত রহস্যের ব্যাখ্যা ঠিক পেয়ে যাব। নিস্তব্ধ রাতে ঘড়ি বন্ধ থাকলেও ঘড়ি চলার আওয়াজ কোত্থেকে হয়। ঠিক জানতে পারব–কানটা শুধু পাততে হবে–ওর বুকে!
* ক্রাইম পত্রিকায় প্রকাশিত, ১৯৬৩