ঘড়ির কাঁটা – ৫

প্রকাশকে নিয়ে বাসু-সাহেব থানা থেকে বেরিয়ে আসতেই প্রকাশ বললে, যাক বাবা, ঘাম দিয় জ্বর ছাড়ল আমার! ভাগ্যে ওটা টু-টু বোরের!

বাসু গম্ভীর হয়ে বললন, কিন্তু আমার কম্প দিয়ে জ্বর এল ডক্টর! আমি যে কিছুতেই বর্মনের সেই অসহায় প্রশ্নটা ভুলতে পারছি না—এর মানে কী?

—মানে নিয়ে কি আমরা ধুয়ে খাব? এটা যখন মার্ডার-ওয়েপন নয়, তখন ওরা আমাকে ধরা-ছোঁওয়ার মধ্যে পাবে না।

—তা তো পাবে না, কিন্তু মার্ডার-ওয়েপন ছাড়া কেউ খামকা তোমার গাড়িতে একটা পিস্তলই বা রেখে যাবে কেন? যাতে আছে একটা ডিসচার্জড বুলেট, যার ব্যারেলে বারুদের গন্ধ! ওটারই দাম তো হাজার তিন-চার।

প্রকাশ হেসে বলে, সে চিন্তা আমার নয়, ব্যারিস্টার সাহেব পুলিশের!

—এবং আমার!

প্রকাশ বাড়িতে ফিরে আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল সকলের। বড়বউদি ছুটলেন কালীঘাটে। মানত সারতে। মেজবৌদি বললেন, কোথায় লাখ টাকার স্বপ্ন দেখছিলে ঠাকুরপো—একবারে থানায় নিয়ে তুলল। সতী ওকে জনান্তিকে কানে কানে বললে, রাতারাতি আর একটা যন্তর কোথা থেকে পয়দা করলি রে ছোড়দা? মস্তান-পার্টির সঙ্গে তোর খাতির আছে নাকি?

প্রকাশ বলে, বাজে কথা একদম বলবি না। দেওয়ালেরও কান আছে, জানিস।

কিন্তু এ আনন্দ বারো ঘণ্টাও স্থায়ী হল না। ওই দিন রাত দশটায় সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে থানা থেকে লোক এল। তছনছ হয়ে গেল সব কিছু। রাত একটা নাগাদা ওদের বাড়ির পিছনে আঁস্তাকুড়ের আবর্জনার ভিতর থেকে আবিষ্কৃত হল একটি রিভলভার। এটি পয়েন্ট থ্রি-এইট বোরের। পুলিস বাড়ি ছেড়ে গেল রাত দুটোয়। রিভলভারটা নিয়ে গেল। এবং ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্তকেও গ্রেপ্তার করে।

বেশি কিছুদিন পরের কথা। জজের আদালতে যেদিন বিচার শুরু হল সেদিন কোর্টে লোক হয়েছে যথেষ্ট। ইতিমধ্যে পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত করে রিপোর্ট দাখিল করছে। ম্যাজিস্ট্রেট কেসটা দায়রায় সোপর্দ করেছেন। আজ জাস্টিস সদানন্দ ভাদুড়ীর কোর্টে মামলাটা শুরু হল। বাদীপক্ষে আছেন নিরঞ্জন মাইতি। স্বনামধন্য পাবলিক প্রসিকিউটার। বিবাদীপক্ষ ব্যারিস্টার বাসু। বাদী ও প্রতিবাদী প্রস্তুত কি না জেনে নিয়ে বিচারক বললেন, মিস্টার পি.পি আপনি কি একটা প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে চান?

—চাই মি-লর্ড! কেসটা জটিল — প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই, কিন্তু সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সে আমরা কী কী প্রমাণ করতে চাই, তার চুম্বকসার প্রথমেই শুনিয়ে দিলে মামলার গতিপথ অনেকটা সরল হয়ে যাবে। বাদীপক্ষ আশা রাখেন, তাঁরা প্রমাণ করবেন আসামি ওই ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্ত মাত্র দশ হাজার টাকা লোভে অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাঁর সহপাঠী বন্ধুকে হত্যা করেন। মাত্র দশ হাজার টাকা বলছি এজন্য যে, ওই অর্থ ডক্টর সেনগুপ্তের ছয় মাসের উপার্জনের অপেক্ষা কম। তাঁর বন্ধু—মৃত কমলেশ মিত্র যে একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি ছিলেন এমন দাবি আমরা করছি না। তাঁর চরিত্রে অনেক দোষ—ছিল কিন্তু সেজন্য তাঁর প্রাণধারণের মৌলিক অধিকার নিশ্চয় নাকচ হয়ে যায় না।

আমরা প্রমাণ করব, মৃত কমলেশ মিত্র গত তিরিশে মার্চ, শনিবার, ইড-বি-আই ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে দশ হাজার টাকা নগদ তোলেন। পয়লা এপ্রিল তাঁর দার্জিলিং যাবার কথা ছিল, তিনি প্লেনের টিকিটও কেটেছিলেন। শনিবার বারোটা থেকে ওই টাকা তাঁর বাড়িতে লোহার আলমারিতে নগদে রাখা ছিল। কমলেশবাবু ছিলেন কৌতুকপ্রিয় লঘু চরিত্রের মানুষ। একত্রিশে, রবিবার, তাঁর নাইট-ডিউটি ছিল। পয়লা এপ্রিল ভোর পাঁচটা নাগাদ তিনি আসামিকে অনুরোধ করেন রবি বসুকে ফোন করে জানাতে যে, তিনি আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন। বলাবাহুল্য এটা নিছক কৌতুক—রবি বসুকে এপ্রিল ফুল করা। আমরা আশা রাখি প্রমাণ করব যে, সকাল সওয়া পাঁচটা নাগাদ কমলেশ অফিস থেকে বের হন এবং ছয়টা পাঁচ মিনিটে রবি বসুর বাড়িতে আসেন। সেখানে পৌঁছে কমলেশ দেখতে পান, ভুল খবর পেয়ে রবি বসু তার পূর্বেই মেডিকেল কলেজে রওনা হয়ে গেছে। মিসেস বসু স্বামীর অনুপস্থিতিতে যখন স্বামীর বন্ধুকে আপ্যায়ন করেন তখন রাত্রি-জাগরণে ক্লান্ত কমলেশ রবিবাবুর শয়নকক্ষে চলে যান এবং শুয়ে পড়েন।

আমরা আশা রাখি, সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সে প্রতিষ্ঠা করব—নির্জন কক্ষে কমলেশ দেখতে পান, ঘরে লোহার আলমারিটা বন্ধ করা নেই। কমলেশবাবু— আগেই বলেছি—অত্যন্ত লঘুচরিত্রের খেয়ালি মানুষ। নিছক কৌতূহলে তিনি আলমারির পাল্লা খুলে দেখতে পান, ভিতরে ইন্সপেক্টর রবি বসুর সার্ভিস রিভলভারটা রয়েছে। কৌতুকপ্রিয় কমলেশ তৎক্ষণাৎ সেটি পকেটে ভয়ে ফেলেন। চুরির উদ্দেশ্যে নয়, বন্ধুকে নাকাল করার অভিলাষে। রবিবাবুর রিভলবারটি ছিল থ্রি-এইট বোরের স্যাক্সবি কোম্পানির। তার নম্বর 397526। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে—কমলেশের একটি নিজস্ব রিভলভার ছিল। সেটি রুবি কোম্পানির টু-টু বোরের।

কমলেশ সাড়ে ছয়টার সময় রবি বসুর সূর্য সেন স্ট্রিটের বাসা থেকে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন। তাঁর গৃহভৃত্যের সাক্ষ্যে আমরা প্রমাণ করব, প্রাতরাশের সময় তিনি খবরের কাগজে দেখেন যে, তিনি এবার লটারিতে সওয়া লক্ষ টাকার ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি দার্জিলিং ভ্রমণের সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে একটি পার্টি দেবার বাসনা জাগে তাঁর। গৃহে স্থানাভাব—তাই তিনি হোটেল হিন্দুস্থানে একটি সুইট ভাড়া নেন। বন্ধু-বান্ধবীদের টেলিফোন করে সন্ধ্যা ছটার সময় তাঁর সঙ্গে হোটেলে দেখা করতে বলেন। শুধু তাঁর নিকটতম বন্ধু ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্তকে বিকাশ তিনটায় ওই হোটেলে দেখা করতে বলেন।

মামলা চলাকালীন আমরা দেখাব যে, কমলেশবাবু বেলা পৌনে এগারোটায় ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট লটারির দপ্তরে ফোন করেন এবং তাঁরা ওঁকে বেলা সাড়ে তিনটায় আসতে বলেন। সেই অনুসারে তিনটা নাগাদ তিনি যখন হোটেল ত্যাগ করে যাচ্ছেন তখন তাঁর মনে পড়ে যে, বন্ধু ডক্টর সেনগুপ্তকে তিনি সাড়ে তিনটায় আসতে বলেছেন। তিনি অনায়াসে কাউন্টারে চাবিটি রেখে নির্দেশ দিয়ে যেতে পারতেন যে, বন্ধু এলে যেন তাঁকে চাবিটি দিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু কৌতুকপ্রিয় কমলেশ সে পথে যাননি। তিনি কী বিচিত্র ব্যবস্থা করেছিলেন তা মামলা চলাকালীন আমরা দেখাব। আমরা প্রমাণ করব, আসামি প্রকাশবাবু কীভাবে কাউন্টার-ক্লার্কের হাত থেকে চাবি নিয়ে বন্ধুর অনুপস্থিতিতে ওই ঘরে ঢোকেন। একটা সিগারেট খেতে যতটুকু সময় লাগে অন্তত সেই সময়টুকু তিনি ওই নির্জন ঘরে ছিলেন। তারপর চুরির উদ্দেশেই হোক অথবা খেয়ালবশেই হোক তিনি ঘরের আলমারির পাল্লাটা খোলেন এবং দেখতে পান, সেখানে থাক দেওয়া নোট ও একটি রিভলভার রয়েছে।

আলমারির ভিতরে নোটগুলি ছিল একশো টাকার—একশত নোট—দশ হাজার টাকা! রিভলভারটি রবি বসুর। আসামি তৎক্ষণাৎ টাকাটি পকেটজাত করে রিভলভার হাতে অপেক্ষা করেন কিছু পরে কমলেশ তাঁর ডুপ্লিকেট চাবির সাহায্যে দরজা খুলে ঘরে ঢোকা মাত্র প্রকাশ তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। তখন কমলেশের পকেটে ছিল তাঁর নিজস্ব রিভলভার; কিন্তু তিনি সেটা বার করার সুযোগ পান না। আসামি মৃতদেহকে বাথরুমে টেনে নিয়ে যান। তিনি যে বাথরুমের দরজা খুলেছিলেন—ফিঙ্গার-প্রিন্ট এক্সপার্টের সাক্ষ্যে তা আমরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করব।

প্রস্থানের সময় আসামি লিফট দিয়ে নামেন না, যাতে লিফটম্যান তাঁকে পরে শনাক্ত না করতে পারে। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন তখন সাক্ষী সুদীপ লাহিড়ী লিফট বেয়ে উপরে উঠছিলেন। দ্বিতলের ল্যান্ডিঙে সুদীপ তাঁকে দেখতে পান। আসামির সঙ্গে কোনও ব্যাগ ছিল না। তার দুই পকেটে তখন দশ হাজার টাকা এবং দুটি রিভলভার। সুদীপবাবু আসামির হিপ-পকেট থেকে একটি রিভলভারের মাথা উঁচু হয়ে আছে দেখতে পান।

আমরা প্রমাণ করব, গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য আসামি ওই রাত্রে বাড়ি ফেরেন না। হোটেলে রাত্রিবাস করেন এবং মধ্যরাত্রে নিজের বাড়িতে আসেন। মার্ডার-ওয়েপন, অর্থাৎ রবি বসুর পয়েন্ট থ্রি-এইট বোরের রিভলভারটি নিজ বাড়ির বাগানে লুকিয়ে রেখে হোটেলে ফিরে যান।

মাননীয় আদালতকে আমার শেষ বক্তব্য—বাদীপক্ষের প্রতিবেদনে কোনও লুকোছাপা নেই। আমরা আমাদের সম্পূর্ণ কেসটি প্রথমেই পেশ করলাম। এ জাতীয় মামলায় বাদীপক্ষ এমনভাবে তাদের আক্রমণ পদ্ধতি খোলাখুলি পেশ করেন না; আমরা সে-পথে যেতে চাই না! আমরা বলতে চাই, আসামির অপরাধ সূর্যোদয়ের মতো স্পষ্ট—সে অপরাধ অপ্রমাণ করার পূর্ণ সুযোগ আমার সহযোগী প্রতবাদীপক্ষকে দিতে চাই। তাই এই দীর্ঘ প্রারম্ভিক ভাষণ। আমাদের শেষ বক্তব্য—মাননীয় আদালত এ জাতীয় অপরাধে আসামির চরমতম দণ্ডবিধান করে আদালতের মর্যাদা রক্ষা করুন।

কপালের ঘাম মুছে মাইতি আসন গ্রহন করেন।

জাস্টিস ভাদুড়ী বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, এবারে আপনি প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে পারেন।

—থ্যাঙ্কু মি-লর্ড। আমাদের কোনো প্রারম্ভিক ভাষণ নেই। বাদীপক্ষ তাঁদের সাক্ষীদের ডাকতে পারেন।

প্রথম সাক্ষী অটোপ্সি-সার্জেন ডক্টর শ্রীশ ধর। মাইতির প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, তাঁর মতে মৃত্যুর সময় এ বৎসর পয়লা এপ্রিল বৈকাল তিনটা থেকে চারটের ভিতর। ক্রস একজামিনেশনে বাসু জানতে চাইলেন, ডক্টর ধর, মৃত্যুর সময়টা আপনি কীভাবে নির্ধারণ করলেন? রিগস মর্টিস দেখে?

—না। মৃতের পাকস্থলী ও অন্ত্রে প্রাপ্ত ভুক্তাবশেষের জীর্ণতার পরিমাণ থেকে। আহারের পর থেকেই খাদ্য জীর্ণ হতে থাকে। কোনও সময় আহারকারীর মৃত্যু হলে হজম হওয়াও বন্ধ হয়। পাকস্থলী ও অন্ত্রে যেসব অর্ধজীর্ণ ভুক্তাবশেষ পাওয়া যায় তার রাসায়নিক পরীক্ষা করে বলা যায়—আহার গ্রহণের কত পরে মৃত্যু হয়েছে।

—এক্ষেত্রে আহার গ্রহণের কত পরে মৃত্যু হয়েছে?

—প্রায় দুই ঘণ্টা

—যেহেতু আপনি মৃত্যুর সময় তিনটে থেকে চারটে বলেছেন তাই আপনি ধরে নিয়েছেন যে, মৃতব্যক্তি একটা থেকে দুটোর মধ্যে আহার করেছিল। তাই নয়?

—হ্যাঁ তাই।

—আপনি কেমন করে জানলেন, মৃত ব্যক্তি কখন আহার করেছিল?

—হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। বেলা পৌনে দুটো নাগাদ রুম নম্বর 528 -এ মধ্যাহ্ন আহার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্রেডরোল, চিকেন সুপ, মাখন, ফিশ্-ফিঙ্গার এবং চিকেন রোস্ট। যেহেতু এগুলি গরম গরম খেতে ভালো লাগে, তাই ধরে নিচ্ছি বেলা দুটো নাগাদ তিনি আহারে বসেন।

—আপনি যে খাদ্য-তালিকার কথা বললেন, সেটা নিশ্চয় লাঞ্চ মেমো অনুযায়ী। ওই আইটেমগুলির প্রত্যেকটির অর্ধজীর্ণ ভুক্তাবশেষ কি আপনি শবব্যবচ্ছেদে পেয়েছিলেন? মৃতের পাকস্থলী বা অস্ত্রে?

—হ্যাঁ, পেয়েছিলাম।

—ওই তালিকাভুক্ত নয় এমন কোনো খাদ্যের অবশেষ কি পেয়েছিলেন?

সাক্ষী একটু চিন্তা করে বলেন হ্যাঁ, তাও পেয়েছিলাম। ‘গ্রিন পিজ’, মানে মটরশুটি।

—সেটা কেমন করে হয়? উনি তো মটরশুঁটি খাননি, মানে লাঞ্চ মেমো অনুযায়ী! এতে আপনার মনে কোনো সন্দেহ হয়নি?

—হয়েছিল। এজন্য আমি হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে, গ্রিন পিজ এর একটি পদও লাঞ্চে সরবরাহের ব্যবস্থা ওইদিন ছিল। শেষদিকে ওই আইটেমটা ফুরিয়ে যায়। হোটেলের হেডকুক বললেন যে হয়তো 528 নম্বর কামরায় ওটা পাঠানো হয়েছিল, ভুলে লাঞ্চ মেমোতে দাম ধরা হয়নি। যেহেতু মৃতের পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে অর্ধজীর্ণ মটরশুঁটি ছিল তাই আমি ধরে নিয়েছিলাম—এই ব্যাখ্যাই যুক্তিসঙ্গত।

—তার মানে, ডক্টর ধর, আপনি মৃত্যুর যে সময়টা নির্ধারণ করছেন তা ওই হেডকুক এবং রুম-সার্ভিস বেয়ারার কথার উপর নির্ভর করে। নিছক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় নয়।

বেজ্ঞানিক পরীক্ষার ভিত্তিতেই! তবে আহারের সময়টা ওদের কথা থেকে নিতে হয়েছে। আমাকে।

—আমিও তাই বলছি—মৃত্যুর সময়টা আপনি নির্ধারণ করেছেন পরের কথায়—যাকে আইনের ভাষায় বলে হেয়ার-সে-রিপোর্ট! দ্যাটস অল মি লর্ড।

দ্বিতীয় সাক্ষী সতীশ বর্মন। ইন্সপেক্টর। যিনি টেলিফোনে সংবাদ পেয়ে প্রথম তদন্তে গিয়েছিলেন। মাইতির প্রশ্নে তিনি বিশদ বর্ণনা দিলেন। বিকাল পাঁচটা বাহান্ন মিনিটে তিনি প্রথম টেলিফোন পান। টেলিফোন করেন ব্যারিস্টার পি.কে বাসু। তারপর হোটলে এসে যা যা দেখেন তার দীর্ঘ বিবরণ দেন। তদন্তের অন্যান্য পর্যায়ের বর্ণনাও দিলেন।

জেরায় বাসু তাঁকে প্রশ্ন করলেন, মৃতের পকেট থেকে আপনি কী কী জিনিস উদ্ধার করেন?

—একটি ফাউন্টেন পেন, রুমাল, একটি মানিব্যাগ, যার গর্ভে ছিল বিভিন্ন নোটে মোট পাঁচশো বাহাত্তর টাকা আটত্রিশ নয়া পয়সা। একটি লটারির টিকিট, কলকাতা-বাগডোগ্রার দু-খানি প্লেনের টিকিট, দোশরা তারিখের।

—আপনি এই জিনিসগুলি মামলার এক্‌জিবিট হিসাবে জমা দেননি কেন?

—কেউ দিতে বলেননি তাই। এগুলি তদন্তকারী অফিসার হিসাবে আমার কাছেই আছে।

বাসু-সাহেব দাবি করেন এগুলিকে মামলার একজিবিট হিসাবে আদালতে নথিভুক্ত করা হোক। মাইতি আপত্তি জানালেন, বললেন, এগুলিকে পিপলস্-এক্সিবিটি হিসাবে নথিভুক্ত করার কোনো প্রয়োজন তিনি দেখছেন না।

বাসু বললেন, তাহলে ওইগুলি প্রতিবাদীর এক্সিবিট হিসাবে নথিভুক্ত করা হোক। অগত্যা তাই করা হল। বাসু ফাউন্টেন পেন-এর ক্যাপ খুলে দেখলেন, তাতে কালি আছে কি না। ছিল—সবুজ রঙের কালি। প্লেনের দুটি এবং লটারির টিকিটের নম্বরটা টুকে নিলেন। মানিব্যাগ খুলে দেখে সাক্ষীকে বললেন, আপনি বলেছেন, ব্যাগে শুধু টাকা-পয়সা ছিল। আমি দেখছি টাকা-পয়সা ছাড়াও আছে কিছু ভিজিটিং কার্ড এবং একটি মহিলার ফটো। এগুলো কি মৃতব্যক্তির পকেট থেকে সংগ্রহ করার সময়েই মানিব্যাগে ছিল, না কি আপনি পরে ভরে দিয়েছেন?

—আমি কিছু ভরে দিইনি। ব্যাগে যা ছিল তাই আছে।

—তাহলে আপনার আগের স্টেটমেন্টটা ‘হোল ট্রুথ’ নয় কেমন? ওই ফোটোখানি কার?

—মিস মীনাক্ষী মজুমদারের।

—প্লেনের একখানি টিকিট তো শুনলাম কমলেশবাবুর। দ্বিতীয়টি কার নামে?

—টিকিটখানা তো পড়েই আছে, দেখলেন জানতে পারবেন।

—তা নয়। আমি জানতে চাইছি ইনভেস্টিগেটিং অফিসার’ হিসাবে আপনি তা দেখেছেন কি না। নামটা বলতেই বা অত ইতস্তত করছেন কেন?

—মিস মীনাক্ষী মজুমদারের।

—আপনি ডাইরেক্ট এভিডেন্সে বলেছেন যে, দোশরা এপ্রিল রাত এগারোটা থেকে তেশরা এপ্রিল রাত একটার মধ্যে আসামি ডক্টর সেনগুপ্তের বাড়ি সার্চ করার সময় একটি রিভলভার খুঁজে পেয়েছেন। ওই তল্লাশির আগে প্রকাশবাবু বা তাঁর বাড়ির কোন লোক কি আপনাদের দেহ তল্লাস করে দেখেছেন?

— না।

—তাহলে আপনারা নিজেরাই ওটা ওখানে গুঁজে রেখে নিজেরাই সেটা আবিষ্কার করে থাকতে পারেন! ঠেকাচ্ছে কে? তা পারতেন না আপনারা?

—অবজেকশন য়োর অনার! উনি পুলিশ বিভাগকে ডিফেম করছেন—মাইতির আপত্তিতে জাস্টিস চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন রুলিং দিতে।

বাসু বলেন, য়োর অনার। আদালতের অনুমতি গেলে আমার প্রশ্নটির প্রয়োজনীয়তা যাথার্থ্য সম্বন্ধে কিছু নিবেদন করতে চান।

—বেশ বলুন—জাস্টিস ভাদুড়ী শুনতে চান।

—মাননীয় সহযোগীর ওপনিং স্টেটমেন্ট অনুযায়ী আসামি মধ্যরাত্রে লিটন হোটেল থেকে নিজ বাড়িতে এসে আঁস্তাকুড়ে রিভলভারটা ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে একটি অনিবার্য প্রশ্ন ওঠে—লিটন হোটেলে থেকে আসামির বাড়ি যেতে কি অসংখ্য ম্যানহোল কভার ছিল না? বেছে বেছে নিজের বাড়ির আঁস্তাকুড়ে কেন সে মার্ডার-ওয়েপনটা রেখে এল? অপরপক্ষে অস্ত্রটা পুলিশের রিভলভার। ঘটনার কিছু পূর্বে সেটা ছিল ইন্সপেক্টর রবি বসুর হেপাজতে। যাঁর স্টেটমেন্ট—সেটা ঘটনার আগেই খোয়া গেছে এবং ইন্সপেক্টর রবি বসু হচ্ছেন বর্তমান সাক্ষীর অধীনস্থ কর্মচারী এবং তল্লাশির পূর্বে তাঁদের সার্চ করা হয়নি। ফলে এ সন্দেহ যদি প্রতিবাদীর মনে জাগে তাহলে সেটা কি অস্বাভাবিক, না পুলিশ বিভাগকে ডিফেম করা?

জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, অবজেকশান ওভাররুলড। নাউ আনসার দ্যাট কোশ্চেন!

—না। আমরা নিজেরাই রিভলভারটা ওভাবে গুঁজে দিইনি।

—উঁহুহু। ওতে হবে না মিস্টার বর্মন। ওটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম—যেহেতু তল্লাশির আগে আপনাদের সার্চ করা হয়নি, তাই ইচ্ছা করলে আপনারা নিজেরাই হাতসাফাই করে ওটা ওখানে রেখে নিজেরাই তা আবিষ্কার করতে পারতেন। তা পারতেন না আপনারা?

—অমন ইচ্ছে আমরা করিনি। হাতসাফাই করিনি।

প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওঠেন বাসু, ন্যাকা সাজবেন না মিস্টার বর্মন। জবাব যতক্ষণ না দিচ্ছেন সারাদিন আমি ওই একই প্রশ্ন করে যাব। এবং এটা মনে রাখবেন, সহজ সরল জবাবটা যতবার এড়িয়ে যাবেন ততবারই আপনার ‘গিল্টিকনশাস্’ মনের প্রমাণ লেখা হয়ে থাকবে আদালতের নথিতে!

উঠে দাঁড়ান মাইতি, অবজেকশান! জেরার পদ্ধতিতে আমার আপত্তি। উনি সাক্ষীকে ধমক দিচ্ছেন।

জাস্টিস ভাদুড়ী তৎক্ষণাৎ বলেন, ওভাররুলড! আমি ডিফেন্স কাউন্সেলের সঙ্গে একমত! সাক্ষী গ্রামের চাষি নন, থানার দারোগা। আদালত তাঁকে নির্দেশ দিয়েছে প্রশ্নের জবাব দিতে, অথচ তিনি ক্রমাগত সেটা এড়িয়ে যাচ্ছেন।

বর্মন বললে, হ্যাঁ, ইচ্ছা করলে তা আমরা পারতাম!

— থ্যাঙ্কু! এবার বলুন, তল্লাশির সময় রবি বসু কি উপস্থিত ছিলেন?

—না ছিলেন না।

—কে ওই রিভলভারটা খুঁজে পায়?

—আমি নিজেই।

—রবি বসু আপনার অধীনস্থ কর্মচারী?

—সে তো আপনি জানেনই।

—তা হলে সোজাসুজি স্বীকার করে ‘হ্যাঁ’ বলতে বাধছে কেন? মিস্টার বর্মন? মাইতি গাত্রোত্থান করবার উপক্রম করতেই বাসু বলেন, এখানেই জেরা শেষ।

এর পর ব্যালাস্টিক এক্সপার্ট জীতেন বসাকের সাক্ষী হল। তার সাক্ষ্যে প্রমাণ হল : কমলেশ মিত্র রবি বসুর অপহৃত পয়েন্ট থ্রি-এইট বোরের রিভলভারের গুলিতেই মারা গেছেন। বাসু তাকে জেরাই করলেন না। এরপর সাক্ষী দিতে এলেন নবীন চট্টোপাধ্যায়। বাসু তাকে জেরায় প্রশ্ন করলেন, নবীনবাবুর এ কথা কি সত্য যে, কমলেশবাবুর অনুরোধে এবং তার অর্থে আপনি দোশরা এপ্রিল তারিখের দুখানি প্লেনের টিকিট কিনে দেন?

—হ্যাঁ, সত্য।

—একটি টিকিট ছিল কমলেশবাবুর, দ্বিতীয়টি মিস মীনাক্ষী মজুমদারের। তাই নয়?

—হ্যাঁ, তাই।

আপনি কুণ্ডু-ট্র্যাভেলস্ অফিসে গিয়ে কমলেশবাবুর অনুরোধে এবং তাঁর অর্থে দার্জিলিঙে ‘হোটেল কুণ্ডুজ’-এ ওদের জন্য সিট রিজার্ভ করেছিলেন, এ কথা সত্য?

—হ্যাঁ, সত্য।

—আপনি একটি ডবল্-বেডরুম বুক করেন। ঠিক?

সাক্ষী একটু চঞ্চল হয়ে পড়ে : হ্যাঁ, ঠিক।

—কমলেশ মিত্রের স্ত্রী অনুপমা মিত্র আপনার আপন জাঠতুতো বোন—এ কথা সত্য?

— হ্যাঁ, সত্য।

—এবার নবীনবাবু, আদালতকে বলুন কোন স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে আপনি আপনার ভগ্নীর সর্বনাশ করছিলেন!

মাইতি আপত্তি তোলেন প্রশ্নের ধরনে। ভাদুড়ী সে আপত্তি মেনে নেনে।

বাসু পুনরায় জেরা শুরু করেন, আপনি একত্রিশে রবিবার সন্ধ্যায় কমলেশবাবুর ফ্ল্যাটে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যখন গল্প করছিলেন তখন আপনি জানতে পারেন যে, পূর্বদিন শনিবার কমলেশবাবু ব্যাঙ্ক থেকে নগদ দশ হাজার টাকা তুলেছেন এবং সে টাকা নিজের কাছে রেখেছেন—তাই নয়?

সাক্ষী ইতস্তত করছে দেখে বাসু বলে ওঠেন, এসব কথা তো কমলেশবাবুর চাকর শিবুর সাক্ষাতে হয়েছিল, মনে পড়ছে না আপনার?

—হ্যাঁ, পড়েছে। আমি জানতাম।

—আপনি এ-কথাও জানতেন যে, হোটেল থেকে কমলেশবাবু সোজা প্লেন ধরবে, ফলে হোটেলে তার কাছে নগদে দশ হাজার টাকা ছিল? জানতেন তো?

—তাতে কী হল?

—হয়নি এখনও, হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি জানতেন, না—না?

—না, প্রত্যক্ষজ্ঞানে জানতাম না।

—অর্থাৎ পরোক্ষজ্ঞানে জানতেন। এবার বলুন, তাহলে কেন পয়লা তারিখে দুপুরবেলা আপনি হোটেল হিন্দুস্থানে এসেছিলেন?

—লীডিং কোশ্চেন, য়োর অনার!—হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন মাইতি।

নবীনবাবু এই সুযোগে রুমাল বার করে কপালের ঘামটা মুছে ফেলে।

অপরাহ্ণের সেশনে প্রথমেই সাক্ষী দিতে এলেন সুদীপ লাহিড়ী। মাইতির প্রশ্নে তিনি বললেন, পয়লা এপ্রিল বিকাল প্রায় পৌনে চারটেয় তিনি হোটেল হিন্দস্থানে কমলেশের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি যখন লিফট দিয়ে উঠেছিলেন তখন সিঁড়ি দিয়ে প্রকাশ সেনগুপ্তকে নেমে যেতে দেখেন। প্রকাশের পকেট উঁচু হয়ে ছিল এবং পিছনের পকেটে কালো রঙের কোনো কিছু জিনিস দেখা যাচ্ছিল। মাত্র দু-এক সেকেন্ডে তিনি ওকে দেখতে পান, যখন লিফটটা উপরে উঠছে তাই তিনি হলপ নিয়ে বলতে পারবেন না যে, হিপ-পকেট থেকে উঁচু হয়ে থাকা বস্তুটা রিভলবার কি না। তারপর তিনি কমলেশের 528 নম্বর ঘরে গিয়ে দেখতে পান একটি বোর্ড ঝুলছে। তাতে বিজ্ঞপ্তি লেখা আছে—’বিরক্ত করবেন না।’ সুদীপ তখন আবার লিফট বেয়ে নিচে নেমে আসে। হোটেল ছেড়ে চলে যাবার সময় সে দেখতে পায় কাউন্টারের কাছে মিস মীনাক্ষী মজুমদার দাঁড়িয়ে আছে। না, মিস মজুমদারের সঙ্গে তার কোনও কথা হয়নি—মীনাক্ষী তাকে দেখতেও পায়নি। অতঃপর সে হোটেল ছেড়ে চলে যায়। ফিরে আসে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ এবং তখনই সে জানতে পারে কমলেশ খুন হয়েছে।

বাসু-সাহেব জেরা করতে উঠে প্রথমেই প্রশ্ন করেন—আপনি এভিডেন্সে বলেছেন যে, কমলেশ আপনাকে সন্ধ্যাবেলায় আসতে বলেছিল। তাহলে পৌনে চারটের সময় আপনি কেন এসেছিলেন?

—আমার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল। সর্বসমক্ষে টাকাটা কমলেশের কাছ থেকে ধার চাইতে পারব না বলে জনান্তিকে দেখা করতে এসেছিলাম। সে ব্যস্ত আছে এবং ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব’ বোর্ড টাঙিয়েছে দেখে ফিরে যাই।

—আপনি তো মীনাক্ষী দেবীকে ভালো করেই চেনেন। যখন ফিরে যাচ্ছেন তখন তাকে কাউন্টারে দেখতে পেয়েও এগিয়ে এসে কথা বললেন না কেন?

সাক্ষী একটু ইতস্তত করে বলে, ওকে দেখেই আমি বুঝতে পারি কমলেশ ওর প্রতীক্ষাতেই প্রহর গুনছে। তাই অন্যান্য বন্ধুদের জন্য সে বোর্ড টাঙিয়েছে। এ কথা বুঝতে পেরে আমি মীনাক্ষী দেবীকে ডিসটার্ব করিনি।

—আপনি কি জানতেন পরদিন কমলেশ ও মীনাক্ষী দার্জিলিং যাচ্ছে?

—জানতাম।

—আপনি এ-কথাও জানতেন যে, প্রাইজ পাওয়া লটারির টিকিটটা কমলেশের কাছে আছে?

—প্রত্যক্ষ জ্ঞানে জানতাম না, আন্দজ করেছিলাম।

—আপনি বলেছেন—লিফট উঠতে উঠতে আপনি দেখতে পান যে, আসামি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে এবং তার হিপ-পকেট থেকে কালো মতো কিছু বেরিয়ে আছে? বলেছেন, নয়?

—হ্যাঁ, সেটা যে রিভলভার, তা আমি বলিনি।

—তা তো আমিও বলিনি। আপনার ভাষায় ‘কালোমতন কিছু একটা জিনিস’ তাই তো?

—হ্যাঁ, তাই।

—যদি ধরা যায় সেটা মার্ডার-ওয়েপন, তাহলে কোনো আততায়ী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে যন্ত্রটা কি এমনভাবে নিয়ে যেতে পারে যাতে দূর থেকে কেউ সেটাকে ‘কালোমতন একটা জিনিস’ বলে শনাক্ত করবে?…

মাইতি আপত্তি তোলেন

—হিপ-পকেটে অনেক পেপার-ব্যাক বইও রাখে, এমনভাবে রাখে যাতে দূর থেকে তার কালো রং বোঝা যায়, তাই নয়?

—এবারও মাইতি আপত্তি তোলেন, একই অজুহাতে।

বাসু-সাহেব বুঝতে পারেন, প্রশ্ন দুটি বাতিল হলেও তাঁর বক্তব্য আদলত বুঝতে পেরেছেন, আদালতের নথিতে তা লেখা হোক আর না হোক

পরবর্তী সাক্ষী—মিস মীনাক্ষী মজুমদার।

মাইতি জানতে চাইলেন, আপনি ঠিক কখন কীভাবে জানতে পারলেন যে, কমলেশ ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে?

—আন্দাজ সকাল সাড়ে নয়টার সময়। কমলেশ নিজেই আমাকে টেলিফোন করে জানায়; হোটেল হিন্দুস্থান থেকে। সে আমাকে বেলা তিনটের সময় ওই হোটেলে আসতে বলে। সে বলেছিল, সে রিসেপশন কাউন্টারে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

—আপনি কি সেইমতো বেলা তিনটে নাগাদ হোটেল হিন্দুস্থানে এসেছিলেন? এসে থাকলে কী ঘটেছিল আনুপূর্বিক বলে যান।

জবাবে মীনাক্ষী জানায়, সে নির্ধারিত সময়েই হোটেলে উপস্থিত হয়। লাউঞ্জে কমলেশকে দেখতে পায় না। মিনিট দশেক অপেক্ষা করে সে রিসেপশন কাউন্টার ক্লার্ককে প্রশ্ন করে কমলেশ মিত্রের রুম নম্বর কত। মেয়েটি বলে, 528। এরপর মীনাক্ষী লিফটে করে ওর ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজার সামনে বোর্ড ঝুলছে দেখে সে ‘কলিং বেল’ বাজায়। অনেকক্ষণ পরেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে নিচে নেমে আসে। কাউন্টার-ক্লার্ককে অনুরোধ করায় সে নিচে থেকে টেলিফোনও করে। তবু কমলেশ সাড়া দেয় না। তখন সে ফিরে যায়। হোটেলে আসে সন্ধ্যা প্রায় ছয়টায় এবং তখনই জানতে পারে কমলেশ খুন হয়েছে।

—কমলেশের প্রাইজ পাওয়ার কথা আপনি নিজে থেকে কাকে কাকে জানান?

—নবীনবাবুকে এবং সুদীপবাবুকে।

— প্ৰকাশবাবুকে?

—না। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ই ছিল না।

—য়ু মে ক্রস এগজামিন হার!-আসন গ্রহণ করেন মাইতি!

বাসু সাক্ষীকে বলেন, মিস্ মজুমদার, আপনি ডাইরেক্ট এভিডেন্সে বলেছেন, যে প্রকাশবাবুকে আপনি এই সুসংবাদটা দেননি। এখন বলুন, ওই পয়লা এপ্রিল তারিখে আসামি প্রকাশ সেনগুপ্তের সঙ্গে টেলিফোনে আদৌ কোনও কথাবার্তা হয়েছিল কি?

—না, হয়নি।

—ওইদিন সকালে ইন্সপেক্টর রবিন বসুর সঙ্গে টেলিফোনে আপনার কোনো কথা হয়েছিল কি?

—হয়েছিল।

—তাঁকে আপনি জানিয়েছিলেন, ওই প্রাইজ পাওয়া কথা—ইয়েস আর নো?

— ইয়েস।

—তাহলে ডাইরেক্ট এভিডেন্সে যখন পি.পি প্রশ্ন করলেন তখন কেন বললেন, শুধু নবীনবাবু আর সুদীপবাবুকেই জানিয়েছেন?

দেখা গেল, সাক্ষী জবাবের জন্য প্রস্তুত। সপ্রতিভাবে কথার পিঠে কথার মতো তৎক্ষণাৎ বললে, দুটি কারণে। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল—কমলেশের প্রাইজ পাওয়ার কথা আমি কাকে কাকে জানিয়েছি।’ এক্ষেত্রে রবিবাবুকে আমি নিজে থেকে কিছুই জানাইনি, তিনিই প্রথমে ফোন করেন, তিনিই জানতে চান প্রাইজ পাওয়ার কথা। দ্বিতীয়ত রবিবাবুকে আমি একথাও বলিনি যে, কমলেশ প্রাইজ পেয়েছেন। বরং বলেছিলাম, প্রাইজটা আমিই পেয়েছিলাম।

—বুঝলাম। ও-কথা কেন বলেছিলেন রবিবাবুকে?

—যেহেতু তারিখটা ছিল পয়লা এপ্রিল, তাই

—বাসু বুঝলেন এদিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে লাভ নেই। তিনি এবার একেবারে অন্য দিক থেকে আক্রমণ শুরু করলেন : মিস মজুমদার, আপনি কি জানেন কমলেশ মিত্র বিবাহিত।

—জানি।

—এবং এ-কথাও জানেন যে, তাদের সেপারেশন চলছিল, ডিভোর্সের মামলা কোর্টে চলছিল?

—হ্যাঁ, তাও জানি।

—তা-সত্ত্বেও আপনি কমলেশবাবুর সঙ্গে দার্জিলিঙে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলেন?

—’তা সত্ত্বেও’ মানে কী? কমলেশবাবু এবং আমি, আমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। একসঙ্গে এক প্লেনে দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়ায় দূষণীয় তো কিছু দেখছি না?

—কিন্তু আপনি কি এ-কথা জানতেন না যে, আপনাদের জন্য দার্জিলিং-এ হোটেল কুণ্ডুজ-এ একটি ডবল-বেড রুম বুক করা হয়েছে?

—সাক্ষী একটু ইতস্তত করে বললে, জানতাম।

—এতেও দূষণীয় কিছু নজরে পড়েনি নিশ্চয়? যেহেতু আপনার দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক? সাক্ষী চকিতে একবার মাইতি-সাহেবের দিকে তাকায়। সেখান থেকে আপত্তি উঠবে এমন একটা আশা করেছিল হয়তো। মাইতি নির্বিকার থাকায় সে বললে, কমলেশ সেটা আমাকে না জানিয়েই করেছিল। দার্জিলিঙে পৌঁছে আমি ও ব্যবস্থায় রাজি হতাম না। পৃথক রুম নিতাম।

—আপনারা কি ইতিপূর্বে—আই মীন কমলেশবাবু বিবাহ করবার পরে কোনও হোটেলের ডবল-বেড রুমে রাত্রিবাস করেননি?

মীনাক্ষী পুনরায় তার উকিলের দিকে অসহায়ের ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখে। মাইতি যথারীতি নির্বিকার। মীনাক্ষী অতঃপর স্বয়ং জজ সাহেবকে প্রশ্ন করে, য়োর অনার, আমি কি এ প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য?

—জজ-সাহেব এবার মাইতির দিকে একটি ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, যদিচ আপনার উকিল আপত্তি পেশ করেননি, তবু আদালত মনে করেন—এ প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক ও বৈধ নয়। আপনি এ প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নন। মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেল, আপনি অন্য প্রশ্ন করুন!

বাসু প্রশ্ন করেন, আপনি ডাইরেক্ট এভিডেন্সে বলেছেন যে, সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ কমলেশবাবু আপনাকে ফোন করে প্রাইজ পাওয়ার কথা বলেন এবং বেলা তিনটের সময় হোটেলে আপনাকে আসতে বলেছিলেন। এবার বলুন, ওই সময় কি কমলেশবাবু আপনাকে একটি বিশেষ জিনিস সঙ্গে করে। আনতে বলেছিলেন?

সাক্ষী বেশ একটু ভেবে নিয়ে বললে, হ্যাঁ বলেছিলেন।

—কী জিনিস সেটা?

সাক্ষী এবার মাইতি সাহেবের দিকে তাকাতেই মাইতি উঠে দাঁড়ান : অবজেকশন য়োর অনার! সাক্ষী ইতিপূর্বেই তাঁর জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন যে, মৃত কমলেশ মিত্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল! এক্ষেত্রে মৃত বন্ধুর সঙ্গে তাঁর কতটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সে-কথা প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করা সাক্ষীর পক্ষে সঙ্কোচের। যে জিনিসটি কমলেশবাবু সাক্ষীকে আনতে বলেছিলেন তা যে বর্তমান মামলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এ-কথা মনে করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। ফলে প্রশ্ন ইররেলিভ্যান্ট অ্যান্ড অ্যাবসার্ড! জজ-সাহেব চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। একটু ভেবে নিয়ে বলেন, মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেল, আপনি কি আপনার উদ্দেশ্যটা একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন?

বাসু একটা ‘বাও’ করে বলেন, আমার উদ্দেশ্য একটাই—সত্য উদ্ঘাটন। মাননীয় সহযোগী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন—সাক্ষীকে যে-বস্তুটি সঙ্গে করে আনতে বলা হয়েছিল তা বর্তমান মামলার সঙ্গে সম্পর্কবিমুক্ত এবং এ প্রশ্নের জবাব দিতে সাক্ষী সঙ্কোচ বোধ করেছেন। আপত্তির প্রথমাংশ বিষয়ে পূর্বেই কোনো অভিমত দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু দ্বিতীয়াংশ স্পষ্টই প্রতীয়মান—অর্থাৎ সাক্ষী এ প্রশ্নের জবাব দিতে সঙ্কোচ বোধ করছেন। মিস মজুমদারের সঙ্গে মৃত কমলেশ মিত্রের ঘনিষ্ঠতা কতদূর গভীর হয়ছিল সে বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। অপরপক্ষে আমি আশা করি, এই প্রশ্নের জবাব থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স পাওয়া যাবে। আমার প্রস্তাব, বর্তমান সাক্ষীর সাক্ষ্য আপাতত মুলতুবি রেখে অন্যান্য সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হোক। কারণ প্রতিবাদীপক্ষ আশা রাখেন, সে-কথা, বলতে ওঁর সঙ্কোচ হচ্ছে সেই কথাটা অন্যান্য সাক্ষীর জবানবন্দি থেকে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। তখন মিস মজুমদারের পক্ষে সে-কথা ‘করোবরেট’ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তখন সঙ্কোচের কোনো প্রশ্ন থাকবে না। আদালত যদি অনুমতি করেন, তবে মিস্ মজুমদারের ‘জেরা’ অসমাপ্ত রেখে বাদীপক্ষ অন্যান্য সাক্ষীদের ডাকতে পারেন।

মাইতি আপত্তি জানালেন। কিন্তু সে আপত্তি ধোপে টিকল না। আদালতের নির্দেশে মীনাক্ষী মজুমদার নেমে এল সাক্ষীর মঞ্চ থেকে। কোর্ট-পেয়াদা হাঁকল পরবর্তী প্রসিকিউশান উইটনেস্-এর নাম : মনোরঞ্জন হাঁসদা, হা—জি—র?

কৌশিক বাসু-সাহেবের কানে কানে প্রশ্ন করে, কমলেশ মিত্র যে মীনাক্ষীকে একটা জিনিস আনতে বলেছিল সে-কথা আপনি জানলেন কী করে?

—ইটস্ এ ওয়াইল্ড—ওয়াইল্ড গুজ চেজ! স্রেফ আন্দাজিক্যালি।

—কিন্তু জিনিসটা কী?

—এখনি শুনতে পাবে, যদি আমার ডিডাকশন ঠিক হয়।

ততক্ষণে পরবর্তী সাক্ষী শ্রীমনোরঞ্জন হাঁসদা হলপ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে শুরু করেছেন। মাইতির প্রশ্নে জানা গেল—মনোরঞ্জন হাঁসদা ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট লটারির ডাইরেক্টরেটের অ্যাকাউন্টেন্ট। তিনি স্বীকার করলেন, পয়লা এপ্রিল সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটার সময় তিনি অফিসে একটি টেলিফোন পান। যিনি টেলিফোন করেছিলেন তিনি তাঁর নাম বলেননি; শুধু বলেছিলেন, তাঁর কাছে একটি লটারির টিকিট আছে, যার নম্বর C/506909—যেটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। ওই অজ্ঞাতনামা ভদ্রলোককে মিস্টার হাঁসদা প্রশ্ন করেছিলেন—ফার্স্ট প্রাইজ যিনি পেয়েছেন, অর্থাৎ ওই টিকিটধারীর নাম কী? তাতে ভদ্রলোক অহেতুক চটে যান। বলেন, তা নিয়ে আপনার এত কৌতূহল কেন? আপনি শুধু বলুন, কোন সময়ে গেলে চেকটা পাওয়া যাবে? হাঁসদা জবাবে বলেন, ওই টিকিটধারী যেন বিকাল তিনটা থেকে চারটের মধ্যে টিকিটটি সঙ্গে নিয়ে এসে ডিরেক্টার সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। টিকিট পরীক্ষা করে তবে প্রাপকের নামে চেক কাটার ব্যবস্থা হবে।

মাইতি প্রশ্ন করেন, ওই টেলিফোন কে করেছিলেন তা আপনি জানেন?

—না, জানি না। পুরুষমানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি নাম, পরিচয় দেননি।

—কিন্তু তিনি কোথা থেকে টেলিফোন করেছিলেন তা জানেন?

—জানি।

—কেমন করে জানলেন?

—আমাদের অফিসে ডাইরেক্ট টেলিফোন নেই। পি.বি এক্স বোর্ড আছে। যে অপারেটর আমার সঙ্গে বহিরাগত লাইনের যোগাযোগ করিয়ে দেয়, সেই বলেছিল—

—কী বলেছিল?

—কলটা অরিজিনেট করে হোটেলে হিন্দুস্থানের পি.বি.এক্স বোর্ড থেকে। হোটেল হিন্দুস্থানই প্রথমে আমাদের ডিরেক্টরকে চায়, না পেয়ে জানতে চায় নেক্সট-ইন-অফিস কে? তখনই আমার সঙ্গে আমাদের অপারেটর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এই সূত্রে আমি জানি, টেলিফোনটা হোটেল হিন্দুস্থান থেকে আসে।

—য়ু মে ক্রস একজামিন।

বাসু জানতে চান, ওই ভদ্রলোক কি বলেছিলেন তিনিই ফার্স্ট-প্রাইজ পেয়েছেন?

—আজ্ঞে না। এ-কথার জবাব আমি আগেই দিয়েছি! তিনি বলেছিলেন, যে নম্বরে ফার্স্ট-প্রাইজ উঠেছে সেই নম্বরের টিকিটখানা তাঁর কাছে আছে।

—তিনি কি এ-কথা বলেননি যে, তাঁর এক বান্ধবী প্রাইজটা পেয়েছেন?

—আজ্ঞে না।

—আচ্ছা মিস্টার হাঁসদা, প্রতি টিকিটে কি ক্রেতার নাম অথবা ‘নম-ডি প্লুম’ থাকে? –আগে থাকত। আজকাল আর থাকে না।

—অর্থাৎ বর্তমানে লটারির টিকিট প্রায় বিয়ারার চেক-এর মতো! মানে, যে ওই প্রাইজ-পাওয়া টিকিটখানি উপস্থিত করবে সেই টাকাটা নগদে পাবে।

—নগদে পাবে নয়, ‘অ্যাকাউন্ট-পেয়ী চেক’-এ পাবে….. যে ওই টিকিটধারী।

—তার মানে, ধরা যাক যদি ওই পয়লা এপ্রিল বিকাল চারটার সময় কমলেশবাবু কোনো একজন মহিলাকে সঙ্গে করে আপনার ডাইরেক্টরের সঙ্গে দেখা করলেন, এবং প্রাইজ পাওয়া টিকিটখানি দাখিল করে বললেন যে, তাঁর বান্ধবীই ওই টিকিটের অধিকারিণী তাহলে সেই বান্ধবীর নামেই অ্যাকাউন্ট-পেয়ী চেক সওয়া লক্ষ টাকা দেওয়া হত?

—হ্যাঁ, যদি সেই মহিলা প্রাপ্তবয়স্কা হতেন, স্বীকার করতেন তিনিই ঐ টিকিট-এর মালিক।

—দ্যাটস্ অল মি লর্ড। আদালত অনুমতি করলে আমি এখনই মিস মজুমদারের অসমাপ্ত জেরা শেষ করতে প্রস্তুত। সহযোগী ঘটনাচক্র প্রথমেই মিস্টার হাঁসদাকে আহ্বান করায় আমার আর কোনও অসুবিধা নেই।

অগত্যা মীনাক্ষী মজুমদারকে আবার উঠে দাঁড়তে হল সাক্ষীর মঞ্চে। কোর্ট-পেস্কার স্মরণ করিয়ে দিল, হলপ পূর্বেই নেওয়া আছে, বর্তমানে সে যা বলবে তা ‘হলফ্ নেওয়া’ জবানবন্দিই।

বাসু আদালতকে বলেন, মি লর্ড! আমি প্রথমেই আমার পূর্বেকার প্রশ্নটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি—অর্থাৎ কমলেশবাবু মিস মজুমদারকে কী জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বলেছিলেন।

সাক্ষীর দিকে ফিরে বাসু বলেন, মিস মজুমদার, আপনিও এবার একটি লটারির টিকিট কেটেছিলেন, তাই নয়?

—হ্যাঁ।

—সেটা কি বর্তমানে আপনার কাছে আছে?

—এখন আমার কাছে নেই, বাড়িতে আছে।

—আমি যদি বলি—কমলেশ মিত্রের টিকিটখানি নয়, আপনার টিকিটখানিরই নম্বর ছিল C/506909 –অর্থাৎ মৃত কমলেশ মিত্র ওয়ারিশ নয়, আপনিই ওই সওয়া-লক্ষ টাকার ন্যায্য অধিকারিণী তাহলে কি আপনি আপত্তি জানাবেন?

সাক্ষী বিহ্বল হয়ে পড়ে। ইতস্তত করে বলে, আমি জানি না।

—প্রাইজ ঘোষিত হবার পর আপনি নিজের টিকিটখানির নম্বর মিলিয়ে দেখেননি—ঠিক কি না! মীনাক্ষীর বিহ্বলতা ঘোচেনি। যন্ত্রচালিতের মতো বলে, ঠিক!

—অর্থাৎ আপনি জ্ঞানত জানেন না যে, মৃত কমলেশের পকেট থেকে যে লটারির টিকিটখানা উদ্ধার করা হয়েছে ওটাই আপনার টিকিট কিনা—

—আমি… আমি জানি না।

—এবার স্বীকার করুন মীনাক্ষী দেবী। কমলেশ টেলিফোনে বলেছিল, আপনার টিকিটখানা নিয়ে যেতে, এবং সেখানা নিয়েই গিয়েছিলেন হোটেলে—তাই নয়?

—হ্যাঁ তাই।

—অর্থাৎ, কমলেশ আপনাকে টেলিফোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, সে আপনাকে নিয়ে লটারি অফিসে যাবে, আপনাকেই টিকিটধারী বলে স্বীকার করবে—অর্থাৎ প্রাইজ-মানি আপনিই পাবেন। তাই নয়?

সাক্ষী অধোবদনে স্বীকার করে, হ্যাঁ তাই।

—কিন্তু কেন এ ব্যবস্থা করা হল?

—আমি… আমি জানি না।

—জানেন! স্বীকার করছেন না! আপনি জানেন যে, কমলেশ ভয় পেয়েছিল সে যদি লটারিতে সওয়া লক্ষ টাকা পায় তাহলে ডিভোর্স মামলায় তাকে স্ত্রীর খোরপোশ ও খেসারত বাবদ অনেক টাকা দিতে হবে! আপনি জানেন, ডিভোর্স-মামলার ফয়সালা হয়ে গেলে কমলেশ আপনাকে বিবাহ করত এবং ওই টাকার সবটাই আপনাদের দুজনের হত। স্বীকার করুন!

সাক্ষী দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে। মাইতি উঠে দাঁড়ান : অবজেকশন য়োর অনার বাসু বিচারকের রুলিং-এর অপেক্ষায় থাকেন না। বলেন, দ্যাটস্ অল মি লর্ড!

দিনের শেষ সাক্ষী ইন্সপেক্টর রবি বোস। মাইতি-সাহেবের প্রশ্নে সে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আদ্যোপান্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গেল। সকাল পৌনে সাতটায় সে বাড়ি ফিরে জানতে পারে যে, কমলেশ তার শয়নকক্ষে নির্জনে আধঘণ্টা কাটিয়ে গেছে। তখনই সে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে। কমলেশের প্র্যাক্টিক্যাল জোক’ যে কী-জাতের তার প্রমাণ তো সদ্য-সদ্যই পেয়েছে। ওর মনে হল, ওই আধঘণ্টা রুদ্ধদ্বার কক্ষে কৌতুকের একটি টাইম-বম্ব নিশ্চয়ই রেখে গেছে তার খেয়ালি বন্ধু। তাই সে আলমারি খুলে পরখ করে। যা ভেবেছে তাই—তার সার্ভিস রিভলারটা আলমারিতে নেই। কমল যে এটা চুরি করেনি এটা নিশ্চিত—ও তার আর একটা উৎকৃষ্ট রসিকতা। তাই সে তৎক্ষণাৎ খবরটা থানায় রিপোর্ট করে না, বরং কমল কোথায় গেল তাই জানতে উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ে। বাড়িতে ফোন করে তার চাকরের কাছ থেকে জানতে পারে যে, তার সাহেব সাতদিনের ছুটি নিয়ে দার্জিলিং গেছে। অতঃপর সে নবীনকে ফোন করে জানতে পারে যে, কমলেশের দার্জিলিং যাওয়ার কথা পরদিন এবং সঙ্গে মীনাক্ষী যাচ্ছে। ওরা ‘হোটেল কুণ্ডুজ’-এ উঠবে। এর পর সে মীনাক্ষীকে ফোন করে শোনে দারুণ খবরটা অর্থাৎ মানীক্ষী লটারিতে সওয়া লক্ষ টাকা পেয়েছে! ওই সঙ্গে আরও শোনে যে, কমলেশ হোটেল হিন্দুস্থানে আছে। রবি অতঃপর হোটেল হিন্দুস্থানে যায়, তার খোয়া যাওয়া রিভলভারটার খোঁজে। সেখানে পৌঁছায় দশটা নাগাদ। কমলেশ তখন হোটেলে ছিল না। আর দেরি করা অনুচিত বিবেচনা করে সে থানায় সংবাদ দেয় যে, তার সার্ভিস রিভলভারটি খোয়া গেছে। তবে বড় দারোগাকে সব কথা খুলে বলেছিল। এ কথাও বলেছিল যে, সন্ধ্যায় কমলেশ কয়েকটি বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছে। হয়তো তখনই সে ওই হারানো অস্ত্রটা উদ্ধার করতে পারবে।

মাইতি প্রশ্ন করেন, সন্ধ্যায় যে কমলেশবাবু কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছে সে-কথা আপনি কেমন করে জানলেন?

—মীনাক্ষী দেবী টেলিফোনে বলেছিলেন।

অতঃপর প্রতিবাদী পক্ষের জেরা! বাসু-সাহেব রবিকে প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তাতেই আপত্তি জানালেন বাদীপক্ষ। প্রশ্নটি ছিল—আপনি কি এই লটারির একটি টিকিট কিনেছিলেন?

মাইতি-সাহেবের আপত্তির কারণ—এ প্রশ্ন বর্তমানে মামলার সঙ্গে সম্পর্কহীন। জর্জ-সাহেব আপত্তি মেনে নিলেন না। ফলে রবিকে স্বীকার করতে হল।

—টিকিট কি আপনি নিজে কেটেছিলেন?

–না, আসামি, প্রকাশ সেনগুপ্ত এক সঙ্গে পাঁচ-ছয়খানি টিকিট কাটে। বন্ধুরা এক-একখানি করে টিকিট তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে।

—তাহলে আপনার টিকিট নম্বর ওই প্রাইজ পাওয়া টিকিটের নম্বরের খুব কাছাকাছি হবে! যেহেতু আপনার কয়জন পরপর সিরিয়াল-নম্বরের টিকিট পেয়েছিলেন।

—হ্যাঁ, তাই হবে।

—আপনার টিকিটের নম্বর কত ছিল?

—আমার মনে নেই!

—প্রাইজ ঘোষিত হবার পর কি আপনার নিজের টিকিটটা যাচাই করে দেখেছিলেন?

—না। প্রাইজ ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার রিভলভারটা খোয়া যায়। তার পরেই মীনাক্ষী দেবীর কাছে শুনতে পাই যে, তিনি ফার্স্ট-প্রাইজ পেয়েছেন। ‘C’-গ্রুপের এমন দুটি পর পর টিকিট প্রাইজ পেতে পারে না। তাই মীনাক্ষী দেবী প্রাইজ পেয়েছেন জেনে নিজের টিকিটের নম্বর মিলিয়ে দেখার কথা আমার মনেও পড়েনি। তাছাড়া আমার বন্ধু কমলেশ খুন হয়ে যাওয়ার ও-সব দিকে চিন্তাই ছিল না আমার।

—আপনার সেই টিকিটখানা কোথায়?

—ঠিক বলতে পারব না। বাড়িতে বাক্সে বা আলমারিতে থাকতে পারে। ইতিমধ্যে ফেলেও দিয়ে থাকতে পারি—

—দ্যাটস অল মি লৰ্ড!

সেদিনকার মতো আদালতের অধিবেশন এখানেই শেষ হল।

আদালত থেকে ফিরে বাসু-সাহেব দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনে একটি প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বৈঠকখানায় ঢুকে বুঝতে পারেন কারণটা। অনেকেই সেখানে উপস্থিত। মিসেস-বাসু, সুজাতা, কৌশিক, প্রকাশের দাদা বিকাশ, তার স্ত্রী এবং সতী। বিকাশবাবু নমস্কার করে বললে, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। কোর্টে হাজির ছিলাম। এখন বলুন—কী বুঝছেন?

বাসু বলেন, এক মিনিট। একটা কাজ আগে সেরে নিই।

ওঁর সহকারী ল-ক্লার্ককে ডেকে জেনে নিলেন—প্রতিবাদীর প্রত্যেকটি সাক্ষীকে আগামীকাল কোর্টে হাজির হবার সমন ধরানো হয়েছে কি না।—ছেলেটি জানাল—প্রত্যেকেই সমন পেয়েছেন।

বাসু এবার আসন গ্রহণ করে বললেন, এবার বলুন?

—কী বুঝছেন? কিছু আশা আছে?

—আছে।

—বেকসুর খালাসের?

—বেকসুর খালাসের।

—কিন্তু আমাদের বাড়ি থেকেই যে মার্ডার-ওয়েপনটা পাওয়া গেল?

—তা গেল। উপায় কী?

কৌশিক বলে, আপনাদের উচিত ছিল—পুলিস বাড়ি সার্চ করতে নামার আগে তাদের সার্চ করে দেখা। আইনত সে অধিকার আপনাদের ছিল।

বাসু বলেন, আমি তোমার সঙ্গে একমত কৌশিক, কিন্তু তা হলেও কিছু লাভ হত না। পুলিস বাড়ি সার্চ করার সময় রিভলভারটা ওখানে নিজেরাই রাখেনি। অনেক আগে থেকেই ওটা ওখানে ছিল।

সতী অবাক হয়ে বলে, তাহলে মিস্টার বর্মনকে জেরা করার সময়-

বাধা দিয়ে বাসু-সাহেব বলেন, ধরে নাও ওটা ওকালতি প্যাচ। বর্মন-জানে, আমিও জানি, বিচারকও জানেন যে, রিভলভারটা আগে থেকেই ওখানে ছিল—

বিকাশ ইতস্তত করে বলেন, তার মানে বলতে চান, প্রকাশই ওটা—

—না। তার মানে তা নয়। প্রকাশ ওটা রাখেনি, রেখেছে সেই লোকটা যে ওর গাড়ির সিটের তলায় এক নম্বর রিভলভারটা রেখেছিল। যে ওকে ফাঁসাতে চায়। লোকটার বুদ্ধিকে আপনারা তারিফ করুন! সে এমন সুন্দরভাবে কেসটা সাজিয়েছে যে, স্বতই মনে হয় প্রকাশ নিজেই রাতারাতি রিভলভারটা বদলিয়ে ভালোমানুষ সাজতে চেয়েছে!

—কিন্তু সে লোকটা তাহলে কে?

—যে লোকটা কমলেশকে খুন করেছে।

—তা তো বুঝলাম; কিন্তু সে যে কে হতে পারে তা কি আন্দাজ করা যায় না একেবারেই? বাসু বিচিত্র হেসে বলেন, আন্দাজ? না, এখন আর ওটা আন্দাজের পর্যায়ে নেই। আমি নিশ্চিত জানি, লোকটা কে!

মিনিটখানেক কেউ কোনো কথা বলতে পারে না!

নৈঃশব্দ্য ভেঙে বিকাশবাবু প্রথম কথা বলেন! বলেন, বাসু-সাহেবের উচ্চারিত শেষ শব্দ দুটিই— লোকটা কে?

—তা নিয়ে আপনার কোনো মাথা ব্যথা! আপনি কী চাইছেন? আপনার ভাই বেকসুর খালাস হক। এই তো?

মাথা নেড়ে সায় দেন বিকাশবাবু, নিশ্চয়ই! সেটুকুই আমার কাম্য। এখন বলুন আমাদের কতখানি আশা! আই মীন, প্রকাশের বেকসুর খালাস পাওয়ার চান্স কত পার্সেন্ট?

—আই শুড সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট!

সতী উঠে দাঁড়ায়। বলে, ব্যস! আর কিছু শুনতে চাই না আমি। এসো বড়দা।

বড়দার কৌতূহল কিন্তু তখনও মেটেনি। বলেন, কিন্তু আসল ব্যাপারটা—

বাসু হেসে বলেন, মাপ করবেন, এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারব না। ওরা চলে গেলে কৌশিক বলে, ও-ভাবে বলাটা কি ঠিক হল?

—কী ভাবে? কোন কথাটা?

—ওই যে মক্কেলকে আশ্বাস দেওয়া—হান্ড্রেড পার্সেন্ট চান্স!

বাসু শ্রাগ করে বলেন, কী করব বল কৌশিক? হলপ যদিচ নেওয়া নেই, তবু খামকা মিথ্যা কথাই বা বলি কেন? আমার যা ধারণা তাই বলেছি।

এর পর আর কী কথা?

তবু কথা বলল কৌশিক। বললে, কিন্তু আমরা যে এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না।

—পারছ না, তার কারণ তোমরা আসল ‘ক্লু’টা নজর করছ না।

—ক সেই আসল কু?

—মহাকাল!

—মহাকাল?

—ঘড়ির কাঁটা।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *