ঘড়ির কাঁটা – ৩

হোটেল থেকে বার হবার মুখেই একটা কথা কানে গেল বাসু-সাহেবের। ঘুরে দেখলেন, তিন-চারজন দাঁড়িয়ে আছে প্রবেশ-পথের বাইরে। একজন লাউঞ্জ থেকে বার হয়ে এসে ওদের উদ্দেশ করে বললে, কমলেশ না পাত্তা। লাউঞ্জে নেই। এখন কী করবে বল? কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ করব? বাসু এগিয়ে এলেন দলটির দিকে। বললেন, আপনারা কমলেশ মিত্রের নিমন্ত্রণে এখানে এসেছিলেন?

একটি যুবক বলেন, হ্যাঁ আপনিও কি তার নিমন্ত্রণে এসেছিলেন?

—না। আমার নাম পি. কে. বাসু। আমি ব্যারিস্টার। আপনারা কেউ আমার নাম জানেন?

যুবকটি বলে, বিলক্ষণ। আপনি তো স্বনামধন্য ব্যক্তি। আমরা সবাই আপনাকে চিনি। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই–ইনি নবীন চ্যাটার্জি, বিজনেসম্যান; ইনি মিস মীনাক্ষী মজুমদার, আর আমার নাম সুদীপ লাহিড়ী।

বাসু বলেন, ইতিমধ্যে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেছে হোটেলের ভিতর। পুলিশি তদন্ত হচ্ছে। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আপনারা আসুন—আমরা বরং সামনেই ওই রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসি।

দলটিকে এক কোনায় বসিয়ে এসপ্রেসো কফির অর্ডার দিয়ে বাসু বললেন, আমি এসেছিলাম একটা তদপ্তে, যাতে আপনাদের বন্ধু কমলেশ মিত্রও ইনভল্ভড্ হতে পারে! মিস মজুমদার, আপনি কখন জানতে পারেন, কমলেশ প্রাইজটা পেয়েছে?

—সকাল প্রায় সাড়ে নটায়। কমলেশ ফোনে জানিয়েছিল।

—কোথা থেকে ফোন করছে তা সে বলেছিল?

—হ্যাঁ, এই হোটেল থেকেই।

—আপনাকে সে কখন আসতে বলেছিল?

—সন্ধ্যা ছয়টায়। বলেছিল, আরও দু-চারজন বন্ধুকে সে নিমন্ত্রণ করছে। রাত্রে সে আমাদের ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছিল।

—এই চারজনকেই

—তাই তো দেখছি এখন।

—আমি শুনেছি, ডাঃ প্রকাশ সেনগুপ্ত আর রবীন বোস ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের নিমন্ত্রণ ছিল না?

—কী জানি! থাকলে ওঁরাও হয়তো এখনই এসে পড়বেন।

—আপনি কমলেশের তরফে এদের দু’জনের কাউকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন?

—কমলেশের তরফে। নিশ্চয় নয়। কমলেশ আমার বন্ধু, যেমন এঁরাও তার বন্ধু। কমলেশের তরফে আমি কাউকে নিমন্ত্রণ করতে যাব কোন অধিকারে? কেন বলুন তো?

বাসু-সাহেব এবার সুদীপকে বলেন, আপনাকে সে কখন নিমন্ত্রণ করে?

সুদীপ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললে, ব্যারিস্টার সাহেব, এবার আপনি আমাদের একটা প্রশ্নের জবাব দিন। হোটেলে কী ঘটেছে? আর কমলেশের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?

বাসু-সাহেব চুরুটের ল্যাজ কাটতে কাটতে বললেন, কমলেশ যে ঘরটা ভাড়া নিয়েছিল তার নম্বর 528। আজ বিকাল পাঁচটা নাগাদ সেই ঘরের বাথরুমে একটি মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। কমলেশ কোথায় তা কেউ জানে না, অফকোর্স যদি মৃতদেহটা তারই না হয়।

মনে হল, ভূকম্পনে টেবিলটা নড়ে উঠল। আধ মিনিট সবাই নির্বাক। তারপর নবীনবাবু বললেন, এ-ক্ষেত্রে সবার আগে গিয়ে মৃতদেহটা আমাদের শনাক্ত করা উচিত। তাই নয়?

—হ্যাঁ, তাই—কিন্তু তৎক্ষণাৎ পুলিশের জেরার সম্মুখীন হতে হবে আপনাদের জবাবে কে কী বলবেন তা স্থির করে রেখেছেন তো?

সুদীপ বললে, জবাবে আবার কী বলব? যা সত্য কথা তাই বলব। মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার অনেক পরে আমরা এসেছি,–

বাসু বলেন, সেইটাই হবে পুলিশের প্রথম প্রশ্ন। আপনারা সদন, কি এ হোটেলে আজ এখনই প্রথম এলেন?

নবীন তৎক্ষণাৎ বললে, নিশ্চয়ই!

সুদীপ কোনও জবাব দিল না।

মীনাক্ষী আর সুদীপ পরস্পরের দিকে তাকায়।

বাসু বলেন, ঠিক আছে। এবার আপনারা হোটেলে খান। মৃতদেহ শনাক্ত করুন। সম্ভবত আপনাদের বন্ধুই মারা গেছে। অটোপ্সি-সার্জেন মৃত্যুর কী সময় নির্ধারণ করেন সেটা দেখুন।

মৃতদেহ শনাক্ত করে ওরা তিনজন যখন বেরিয়ে এল তখন কলকাতার রাস্তায় আলো জ্বলেছে। বাইরে বেরিয়ে এসে ওরা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নবীন বললে, এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে যাবে তা কি আজ সকালেও ভেবেছিলাম? কমলেশটা…

মীনাক্ষী বাধা দিয়ে বললে, ও সব কথা ভেবে লাভ নেই নবীনবাবু। যাক, আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিন।

সুদীপ বললে, বাড়ি ফিরবে? তার চেয়ে চল না-

নবীনকে খুব অন্যমনস্ক মনে হচ্ছিল। সে বাধা দিয়ে বলে, আমাকে তাহলে বাদ দাও ভাই। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি বাড়ি যাব।

নবীন বাস ধরে রওনা হয়ে যাবার পর মীনাক্ষী বললে, কোথায় যাবার কথা বলছিলে তখন?

—কোন ফাঁকা জায়গায়। চল, ভিক্টোরিয়ার সামনের ময়দানে গিয়ে বসি।

পায়ে পায়ে দু’জনে সরে এল ময়দানের দিকে। এ-সময়ে ও জায়গাটা মোটেই নির্জন নয়। তবু ওরই মধ্যে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দু’জনে বসল।

সুদীপই নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল : মীনু, তুমি কি আশঙ্কা করছ এই ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশ আমাদের ঝামেলায় ফেলতে পারে?

—তোমাকে না ফেললেও আমাকে ফেলতে পারে। মার্ডার চার্জ অবশ্য আমার উপর আসবার কোনও কারণ নেই, কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে অনেক সাপই বেরিয়ে পড়তে পারে। তুমি তো জান—কমলের সঙ্গে আগামীকালই আমার দার্জিলিং যাবার কথা ছিল।

—তা ছিল। তাতে কী? সে কথা বলছি না; আমি বলছি, হত্যা মামলায় কি তোমাকে বা আমাকে জড়ানোর কোনো সম্ভাবনা আছে?

মীনাক্ষী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখে নিয়ে বললে, এ কথা বলছ কেন?

—বাসু-সাহেবের কথা থেকে মনে হল, মৃত্যুর সময় বেলা দুটোর পর এবং বিকাল চারটার আগে। ওই সময়টুকুর জন্যে তোমার কি কোনও অকাট্য ‘অ্যালিবাই’ আছে?

আরও গম্ভীর হয়ে যায় মীনাক্ষী। সরাসরি জবাব না দিয়ে বলে, কেন? তোমার নেই?

—বিকাল পৌনে চারটে পর্যন্ত আছে। তারপর নেই। তোমার?

—কী আমার?

—বেলা দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে, তার অকাট্য প্রমাণ দিতে পারবে? মীনাক্ষী অনেকক্ষণ কী ভাবল; তারপর বললে, কিছু মনে পড়ছে না। এত নার্ভাস লাগছে!

—মনে করতে হবে মিনু, মনে করা দরকার! নেহাৎ যদি মনে না পড়ে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি…

—তুমি কীভাবে?

—তুমি ঠিক তিনটে সাতচল্লিশ মিনিটে হোটেল হিন্দুস্থানের লাউঞ্জে ছিলে!

মুখটা সাদা হয়ে গেল মীনাক্ষীর। আমতা আমতা করে বললে, মানে! তুমি কী বলতে চাইছ?

—আমি বলতে চাইছি যে, তুমি যে বেলা পৌনে-চারটে নাগাদ এ হোটেলে এসেছিলে তার অকাট্য প্রমাণ আছে। সেটা অস্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তোমাকে একজন দেখে ফেলেছিল। যে তোমাকে চেনে!

দু-হাতে মুখ ঢেকে মীনাক্ষী অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে বললে, সুদীপ! তুমি কেন এসেছিলে বলত?

—আমি! আমি কোথায় এসেছিলাম? কখন?

—ঠিক তিনটে সাতচল্লিশ মিনিটে হোটেল হিন্দুস্থানের লাউঞ্জে?

এবার জবাব দিতে সুদীপই ইতস্তত করছিল।

মীনাক্ষী বললে, তুমিই আমাকে দেখতে পেয়েছিলে; না হলে এখনই এভাবে ও-কথা বলতে পারতে না। তাই না?

—হ্যাঁ, তাই।

—আমার মনে হয়—আমরা দুজনেই পরস্পরের কাছে সত্য ঘটনা খুলে বললে ভালো হয়। আমার নিজের কথা আগে বলি—হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম—কমলেশই আমাকে আসতে বলেছিল। সাড়ে-তিনটে নাগাদ। একটা বিশেষ কারণে। কারণটা কী, তা এ-ক্ষেত্রে অবান্তর—আসল কথা হচ্ছে এই যে, আমি এসেছিলাম—তুমি যখন আমাকে দেখতে পেয়েছ তখনই। ওই পৌনে চারটে নাগাদ। কমলেশ আমাকে আসতে বলেছিল, অথচ সে নিজে ঘরে ছিল না। অন্তত তখন তাই মনে হয়েছিল আমার। এখন মনে হচ্ছে ওর রুদ্ধদ্বার কক্ষের ভিতরেই ও পড়ে ছিল, বাথরুমের মেঝেতে!

—রিসেপশন কাউন্টারে কোনও কথাবার্তা বলেছিলে?

—হ্যাঁ, বলেছিলাম। তাতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না—কী ‘স্ট্যান্ড’ নেব!

—পুলিশ যদি জানতে চায়, তবে আদ্যন্ত সত্য কথা বলাই ভালো। তুমি এসেছিলে, নক করেছিলে, কাউন্টারে কথা বলেছিলে, ফিরে গিয়েছিলে-

—আর তুমি?

—আমিও অস্বীকার করব না। কারণ একই সময়ে আমি ওই হোটেলে এসেছিলাম এক বন্ধুর গাড়িতে। সে আমাকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। কমলেশকেও সে চেনে। ফলে আমি যে এখানে এসেছিলাম এটা চেপে যাওয়া ঠিক হবে না।

—তুমি কখন কোথায় আমাকে দেখতে পেয়েছিলে?

—তুমি তখন রিসেপশন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছিলে। তুমি আমার দিকে পিছনে ফিরে ছিলে। তুমি আমাকে দেখতে পাওনি, আমি পেয়েছিলাম।

—তাহলে তুমি এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বললে না কেন?

—সত্যি কথা বলব?

—সত্যকথা বলতে তো আমরা দুজনেই প্রতিশ্রুত, সুদীপ।

—আমি কমলেশের ঘরের সামনে গিয়ে দেখি, বাইরে একটা ‘ট্যাগ’ ঝুলছে ‘Do not disturb’ (বিরক্ত করবেন না)। আমি অনাহুত এসেছিলাম, সন্ধ্যায় আমার নিমন্ত্ৰণ ছিল—কিন্তু তার আগেই আমি এসেছিলাম ওকে একান্তে পেতে। আমি ওর কাছে কিছু টাকা ধার চাইতাম। কিন্তু ওর ঘরের সামনে বিরক্ত করবেন না’ বিজ্ঞপ্তিটা দেখে ফিরে আসি। কাউন্টারে তোমাকে দেখেই বুঝতে পারলাম, কেন ওই বোর্ডটা টাঙানো আছে। অর্থাৎ কমলেশ তোমার প্রতীক্ষাতেই আছে।

—আই সি! এতক্ষণে বুঝলাম।

—আমি কিন্তু এখনও সবটা বুঝতে পারিনি মীনু!

—কী বুঝতে পারনি?

—আবার জিজ্ঞাসা করি; সত্য কথা বলব?

—বার বার ভণিতা করছ কেন?

—বিকাল তিনটে সাতচল্লিশে তোমাকে যখন দেখি, তখন তোমার পরিধানে ছিল একটা লাল রঙের মুর্শিদাবাদী। অথচ সন্ধ্যা ছয়টায় যখন আবার এলে, অর্থাৎ এখন তোমার পরিধানে একটা নীল রঙের জর্জেট! কেন মীনাক্ষী? এত দ্রুত তোমাকে শাড়ি পাল্টাতে হল কেন?

মীনাক্ষী প্রথমটা অবাক হয়ে যায়। তারপর সামলে নিয়ে বলে, হোয়াট ডু য়্যু মিন? আমার সেই শাড়িটায় কোন রক্তের দাগ লেগেছিল বলতে চাও?

—আমি কিছুই বলতে চাই না মীনাক্ষী। আমি শুধু তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এ মামলায় ওই প্রশ্নটাও তো উঠে পড়তে পারে। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কী জবাব দেবে তা ভেবে রাখা উচিত নয় কি?

মীনাক্ষী একটুক্ষণ চুপ করে কী ভেবে নেয়। তারপর হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, আমাকে কেন সন্দেহ করছ সুদীপ? কমলেশকে আমি….তুমি তো সবই জান! আমার কী মোটিভ থাকতে পারে?

—নী মীনু। তুমি ভুল করছ। তোমাকে আমি আদৌ সন্দেহ করছি না। তোমার কোনও ‘মোটিভ’ খুঁজে পাচ্ছি না বলে নয়, তার কারণ কে কমলেশকে খুন করে এসেছে তা আমি জানি। শুধু তোমাকেই নয়, তাকেও ঠিক একই সময়ে হোটেল হিন্দুস্থানে আমি দেখতে পেয়েছিলাম। বোধকরি মার্ডার ওয়েপন সমেত!

মীনাক্ষী উৎসাহে ওর হাতটা চেপে ধরে। বলে, কে? কাকে? কাকে দেখেছ তুমি?

সে-কথা এখন আমি বলব না। প্রয়োজন হলে পুলিশকেই বলব। তাই তোমাকে আড়ালে ডেকে এনেছিলাম। তোমাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলাম যে, তুমি যে একই সময়ে হোটেল হিন্দুস্থানে এসেছিলে এই সত্যটা পুলিশের কাছে গোপন কোরো না। আমার ‘ডিপজিশানে’ তোমার কথাও থাকবে। তোমাকে আমি দেখেছি তা আমি বলব। আমি চাই না সেটা তুমি অস্বীকার করে বিপদগ্রস্ত হও! আর কেউ না জানলেও তুমি তো জান মীনু—আমি তোমাকে…..

মুহূর্তমধ্যে রূপান্তর ঘটে মীনাক্ষী মজুমদারের। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে তার। বলে, জানি! তাহলে এস না সুদীপ, আমার দুজনে দুজনের অ্যালিবাই হই। পুলিশকে বলি, আমরা দুজনে একই সঙ্গে…

—না! আদালতে দাঁড়িয়ে আমি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারব না! তাছাড়া আমি এসেছিলাম অন্য এক বন্ধুর গাড়িতে। কোথা থেকে কী বিপর্যয় হয়ে যাবে! ঠিক যা যা ঘটেছে তাই বলব আমরা। তুমি আর আমি।

—বেশ তুমি যা চাইছ তাই হবে।

—আমি কি শুধু এইটুকুই চাইছি মীনু?

এক মুহূর্ত বিলম্ব হল মীনাক্ষীর। তারপর বললে, আজকে আমায় মাপ কর সুদীপ আজ নয়। কমলেশের মৃতদেহটা আমাকে এখনও ‘হন্ট’ করছে!

—আই নো! আজই জবাব দিতে বলছি না। চল, এবার ওঠা যাক। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

—প্লিজ সুদীপ! আমাকে একটু একা থাকতে দাও। একটা ট্যাক্সি ধরে দাও শুধু।

সুদীপ শ্রাগ করল। উঠল ট্যাক্সির খোঁজে। আবার মনে হল ওর—তার সিদ্ধান্ত কি ভুল? যে লোকটাকে লিফটে নামতে নামতে এক লহমার জন্য দেখতে পেয়েছিল সেই কি হত্যা করেছিল কমলেশকে? সেই কি টাঙিয়ে দিয়ে এসেছিল ওই বোর্ডটা : ‘বিরক্ত করবেন না।’ তাহলে মীনাক্ষী মজুমদার মাত্র দুঘণ্টার মধ্যে লাল রঙের শাড়িটা পাল্টে এল কেন? প্রথমবার লালরঙের শাড়িই বা বেছে নিয়েছিল কেন? তাতে রঙের দাগ সহজে নজর পড়ে না বলেই?

.

লীটন হোটেলে ফিরে বাসু-সাহেব প্রথম সাক্ষাতেই প্রকাশকে বললেন, এই নিন ধরুন। উইশ্ য়ু বেস্ট অব্ লাক! আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি।

বাসু-সাহেবের প্রসারিত হাতে একটি এক-টাকার অঙ্ক লেখা চেক। প্রকাশ অবাক হয়ে বলে, মানে? আপনি কেসটা নেবেন না?

—না। আমার বিবেক বাধা দিচ্ছে।

—তার মানে আপনি বিশ্বাস করছেন, কমলশকে আমিই খুন করেছি? বাসু-সাহেব হেসে বললেন, দেড়সেকেন্ড আগেও কিছুটা সন্দেহ ছিল। এখন নেই। কারণ আপনার জানার কথা নয়, কমলেশ খুন হয়ে পড়ে আছে ওর ঘরে। বস্তুত আপনার জবানবন্দি অনুসারে ডিসচার্জড্ বুলেটের সঙ্গে কমলেশের কোনো সম্পর্ক নেই।

মাথাটা নিচু হয়ে গেল প্রকাশের। বললে, আপনি আর একটু বলবেন? তাহলে আপনাকে সব কথা খুলে বলি।

বাসু-সাহেব বলেন। বলেন, আপনার প্রথম স্টেটমেন্ট শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম, আপনি ‘হোল-টুথ’ বলছেন না। আসল কথাটা বাদ দিয়ে যাচ্ছেন। কেন জানেন?

—না। কেন?

—আপনার জবানবন্দি অনুসারে আপনি আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারেন গাড়ির সিটের নিচে রিভলভারটা আবিষ্কারের পরমুহূর্ত থেকে। তার পূর্বেই কিন্তু আপনি বলেছেন—ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় আপনি কাউকে লক্ষ করেননি! সেটা কেন লক্ষ করবেন আপনি? বলেছেন, লিফটে না নেমে আপনি সিঁড়ি দিয়ে নেমেছেন। আর সব চেয়ে বড় কথা, খোলা মনে চাবিটা কাউন্টারে জমা দিয়ে আপনার গাড়ির কাছে যাবার কথা, সুতরাং খুন নিজে করুন বা না করুন, এ-কথা সুর্যোদয়ের মতো স্পষ্ট যে, ঘর ছাড়ার আগে আপনি জানতেন—বাথরুমে কমলেশ মরে পড়ে আছে।

প্রকাশ অসহায়ের মতো বলে ওঠে, বিশ্বাস করুন। খুন আমি করিনি। তবে আপনার ও-কথা সত্য। বাথরুমের দরজা খুলে আমি দেখেছিলাম।

—বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর রুমাল দিয়ে হাতলটা মুছে দিয়েছিলেন নিশ্চয়ই।

—না তো! কেন?

বাসু ওর চোখের দিকে পুরো এক মিনিট একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। তারপর চেকটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে বললেন, আই উইথড্র! না! আপনি খুন করেননি! বলুন। সব কিছু আবার বিস্তারিত বলে যান। টাইম-ফ্যাক্টারটা ঠিক রেখে আজকের সকাল থেকে শুরু করুন। ঘুম থেকে ওঠা দিয়ে শুরু করে

—আমি কাল রাত্রে আদৌ ঘুমাইনি। বলি শুনুন—

সারা দিনের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত বলে গেল সে। বাসু মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছিলেন।

—প্রথম বলুন, রবি বসুকে কেন মিথ্যা কথা বলে ডেকে পাঠালেন?

—কমলেশের প্ররোচনায়। সেই পৌনে পাঁচটার সময় আমাকে পত্রিকা অফিস থেকে ফোন করে এই পরিকল্পনার কথা বলে। আমি আপত্তিও করেছিলাম। ও শোনেনি। বলেছিল, পত্রিকা অফিস থেকে সে সোজা মেডিকেল কলেজ আসবে। রবির আগেই। রবির ঠেলা সেই সামলাবে। তাই এপ্রিল ফুল করতে রবিকে ফোন করি-

—তাহলে তখনও আপনি জানতেন না যে, তার পনেরো মিনিটের ভিতরেই অমল সোম আহত হয়ে হাসপাতালে আসবে?

—তা কেমন করে জানব? ওটা নিতান্ত কাকতালীয় ঘটনা। কমল আর অমল নাম দুটো শুনতে এক রকম। তাই ওরা ভেবেছিল—

—বুঝলাম। মীনাক্ষী মজুমদারের কণ্ঠস্বর আপনি চেনেন?

—না। তার সঙ্গে কখনও কথা হয়নি আমার। চোখেও দেখিনি কখনও।

—তার মানে আজ পৌনে-দুটো নাগাদ যে মেয়েটি আপনাকে ফোন করে, সে যে মীনাক্ষী মজুমদার এ কথা হলপ নিয়ে আপনি বলতে পারেন না?

—নিশ্চয় নয়! কেন? সে কি অস্বীকার করেছে?

বাসু-সাহেব ওর কাছ থেকে কমলেশের বাসার ঠিকানা, তার পৈতৃক বাড়ির পাত্তা, সুদীপ ও রবির টেলিফোন নম্বর নোটবুকে টুকে নিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, পারতপক্ষে হোটেল ছেড়ে বার হবে না। আমি অনেক কষ্টে পুলিশের নজর এড়িয়ে এসেছি। কাউকে এখান থেকে ফোন করবেন না। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে। কাল আপনাকে সকাল সাড়ে নটার সময় তুলে নিয়ে যাব। থানায়। সেখানে সমস্ত ঘটনা আদ্যন্ত সত্য বলবেন। কিছু গোপন করবেন না। বুঝেছেন?

—রিভলভারের কথাটাও?

—নিশ্চয়! রিভলভারটা নিয়ে যাবেন। জমা দিতে হবে।

—ওঁরা যদি জানতে চান, মৃতদেহ আবিষ্কার করা মাত্র কেন পুলিশে জানাইনি?

—বলবেন, আপনার সন্দেহ হয়েছিল—কেউ অপরাধটা আপনার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। তাই তৎক্ষণাৎ আপনি আমার কাছে চলে আসেন। আমাকে সব কথা খুলে বলেন। আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম—পুলিশে আমিই খবর দেব। ফলো?

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *