ঘড়ির কাঁটা – ২

রবি যখন তার বাহনের গর্জনে পাড়া সচকিত করে বাড়ি ফিরে এল ততক্ষণে কলকাতা শহর রীতিমতো সরগরম। মুন্নির মা হরিণঘাটা ডিপো থেকে দুধ এনে দিয়েছে। খবরের কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে গেছে। অঞ্জলির উনানে তখন ডাল সিদ্ধ হয়ে গেছে, সাঁতলানোর আয়োজন হচ্ছে। দ্বার-পথ থেকেই রবি বলে ওঠে, বাজারের থলি আর টাকা দাও।

বাজারের জন্য রবিকে রোজ হাত পাততে হয় গৃহলক্ষ্মীর কাছে—কারণ মাসকাবারি টাকা অঞ্জলির কাছেই থাকে। মাসকাবার হয়ে গেছে, তবুও। অঞ্জলি এগিয়ে এসে বলে, বাজার থাক। শোন, ইতিমধ্যে এক কাণ্ড হয়ে গেছে। তোমার বন্ধু এসেছিলেন—

—বন্ধু! কে বন্ধু? কখন?

—যাকে দেখতে তুমি হাসপাতালে গিয়েছিলে—কমলেশবাবু। তুমি বেরিয়ে যাবার পরেই। আমার এমন ভয় করছিল, জান-

—ভয়? কেন? ভয় করার কী আছে?

—ভয় করবে না? লোকটা বললে ‘ঘুম পাচ্ছে।’ বলেই সোজা ঢুকে পড়ল আমাদের শোবার ঘরে। তারপর ধড়াস করে শুয়ে পড়ল তোমার বিছানায়।

—বল কী! কমলেশ এসেছিল? কেন?

—তোমাকে প্রকাশবাবু এপ্রিল ফুল করায় সে নাকি মর্মাহত!

—তাই সে অমনি আমার ঘরে এসে আমার খাটে ধড়াস করে শুয়ে পড়ল? বাঃ তুমি ঢুকতে দিলে কেন?

—বা রে! আমি কী করব?

এর বেশি কী-বা বলতে পারি অঞ্জলি? এমনিতেই সে কিছুটা গোপন করেছে। মিথ্যা কথা বলেছে। কমলেশ রবির বিছানাতেও আদৌ শোয়নি। শুয়েছিল অঞ্জলির বিছানাতেই। পাশাপাশি সিঙ্গল-বেড খাট; ভুল তো হতেই পারে। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে ভুলটা বুঝতে পেরেছিল কমলেশ। যাবার সময় সে-কথা সে স্বীকার করে গেছে। চা খাবার খেয়ে, জামা-জুতো পরে রওনা দেবার জন্য যখন সে তৈরি তখন অঞ্জলি বলেছিল, আপনার মানিব্যাগটা—

—মানিব্যাগ? কেন? আমার পকেটে নেই—ইনসাইড-পকেট হাতড়াতে থাকে।

—ওখানে নেই! আমি সরিয়ে রেখেছিলাম, নিন–ব্লাউজের ভিতর থেকে মানিব্যাগটা বার করে বাড়িয়ে ধরেছিল অঞ্জলি।

কমলেশ বিচিত্র হেসে বলেছিল, আমি চলে যাচ্ছি, আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আপনি নিশ্চয় নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছেন, কিন্তু আমার মানিব্যাগটা তাতে রাগ করছে অঞ্জলি দেবী।

অঞ্জলি বুঝে উঠতে পারে না ধাঁধাটা। বললে, তার মানে?

—মানিব্যাগটা আমাকে বলছে—তুমি যদি ওই নরম বালিশে মাথা রেখে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে তাহলে আমি শুয়ে থাকতাম নরমতর বালিশে!

অঞ্জলি রীতিমতো রাঙিয়ে উঠেছিল। বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে এ জাতীয় রসিকতা করা চলে কি না জানা নেই বেচারির। কমলেশ-মীনাক্ষীর মতো সে পার্টিতে যায় না—এ জাতীয় কমপ্লিমেন্টস্ ওদের সমাজে স্বাভাবিক কি না, তাও জানা নেই। জবাব জোগায় না তার মুখে। কমলেশ নিজে থেকেই বলেছিল, যাক ও কথা! অসভ্য জংলি মানুষটার কথায় কান দেবেন না; কিন্তু যাবার আগে আর একটা কথা আমার না বললেই নয়। আপনার কাছে আর একটি কারণে অপরাধী হয়ে আছি। ক্ষমা চেয়ে নিই—

কথা না বাড়লেই চলত, তবু এমন ভাবে কথাটা শেষ হল যে, এর পর অঞ্জলিকে প্রশ্ন করতেই হল —কী আবার অপরাধ?

—রবির বিছানায় শোবার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমি ভুল করে শুয়েছিলাম আপনার বিছানায়। কৌতূহল দমন করতে পারেননি অঞ্জলি। বলে, কী করে বুঝলেন?

মানিব্যাগটা আঘ্রাণ করে কমলেশ বলেছিল, এই মানিব্যাগটাই আমাকে বলে দিচ্ছে। পুলিশের দারোগা নিশ্চয়ই ক্যান্থারাইডিন মাখে না?

এ সব কথা অঞ্জলি খোলাখুলি বলেনি তার স্বামীকে। বলা যায় না। অর্থাৎ না বলাই মঙ্গল। যেমন কাঠ-গোঁয়ার মানুষ—কে জানে কীভাবে নেবে কথাটা। তাই কমলেশ যে ভুল করে—ভুল করেই তো….. শুধু জানাল মোটামুটি ঘটনাগুলো। কমলেশ এসেছিল, জামা জুতো খুলে—হ্যাঁ, রবির বিছানায় শুয়েছিল। মুন্নির-মা ডেকে দেওয়ায় উঠে এসে চা-টোস্ট-অমলেট খায় এবং ঠিক সাড়ে ছয়টায় চলে যায়।

—এরপর আমি বাড়িতে না থাকলে ওকে ঘরে ঢুকতে দিও না। মাতালটা কখন কী করে বসে ঠিক কি? দাও, বাজারের থলিটা দাও—

অঞ্জলি বাজারের থলিটা আনতে যায়।

ইতিমধ্যে রবি অমলের বাড়িতে দুঃসংবাদটা দিয়ে এসেছে। মুখ হাত ধুতে ধুতে সেই গল্পটা শোনাচ্ছিল অঞ্জলিকে। অঞ্জলি ততক্ষণে ডাল সাঁতলিয়ে আবার চায়ের জল বসিয়েছে। খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে রবি শোবার ঘরে ঢুকে যায়। অঞ্জলি রান্নাঘর থেকেই বলে ওঠে—কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় এখনও ঢোকেনি বাপু। অমলবাবু হাসপাতালে এসে পৌঁছনোর আগেই কেমন করে প্রকাশবাবু তোমাকে ফোন করলেন—’কমল’-’অমল’ যাই বলে থাকুন না কেন?

রবি জবাব দিল না। সে হঠাৎ বেরিয়ে এল শোবার ঘর থেকে। হঠাৎ যেন কোনো জরুরি কথা মনে পড়ে গেছে তার। বার কতক টেলিফোনে কী নম্বর ডায়াল করল। কথাবার্তা কী হল কানে যায়নি অঞ্জলির। হঠৎ তার লক্ষ হল, রবি আবার জামা জুতো পরছে।

—নাও বাজারের থলি। মাছ যদি না পাও ভালো মতো।

—বাজার থাক। যা হোক ভাতে-ভাত রান্না করে রেখো। আমি ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাই—

—কী হবে তলিয়ে দেখে? শোন—শুনে যাও!

কে কার কথা শোনে। মোটর-বাইকটা ঠেলতে ঠেলতে রবি আবার পথে নামে। রেডিওতে তখন বাংলা খবর চলছে।

.

ডক্টর সেনগুপ্ত নাইট ডিউটি সেরে যখন বাড়ি ফিরে এল, তখন ওদের বাড়িতে অফিস-কলেজ যাত্রীরা সবাই সচকিত। প্রকাশদের বাড়িটা বড়। একান্নবর্তী পরিবার। ওরা তিন ভাই; ও-ই ছোট। এখনও বিয়ে করেনি। বাকি দুই দাদাও এ বাড়িতে আছেন সস্ত্রীক। ছোট বোন সতী এবার ইকনমিক্সে এম.এ দেবে। বাড়িতে পদার্পণমা সতী ঘোষণা করে—সুদীপদা ফোন করেছিল, বলেছে তুই এসেই যেন ফোন করিস। খুব জরুরি ব্যাপার।

যত জরুরিই হোক, প্রকাশ সর্বপ্রথমে বাথরুমে ঢুকল। প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে চায়ের পেয়ালাটা টেনে নিয়ে ফোন করল সুদীপকে : কী রে? বাড়ি ফিরেই তোকে ফোন করতে বলেছিলি নাকি?

—হ্যাঁ, মানে….কোনও দারুণ, অসাধারণ রকমের দারুণ কোনো খবর আছে তো?

—যা ব্বাবা! তার মানে?

—সকালে কাগজ দেখেছিস?

—কাগজ? খবরের কাগজ? দেখছি! কেন? কী আছে তাতে?

—ছাই দেখেছিস! ঠিক আছে! কাগজে দেখতে হবে না, আমারই দেখা আছে। শোন, কিছুদিন আগে আমরা তিন-চারজন—আই মীন, তুই, আমি কমলেশ, রোবে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট লটারির টিকিট কিনেছিলাম একসঙ্গে—মনে পড়ছে?

—হ্যাঁ, মনে আছে। কেন?

—এখনও বুঝলি না? আমার টিকিটের নম্বর হচ্ছে C/506937! কী কাঠ বরাত দেখ মাইরি? ফার্স্ট প্রাইজ উঠেছে ওই ‘সি’ গ্রুপেই, আর নম্বরটা হচ্ছে, C/506909! আমরা ক’জন পর পর, মানে কন্‌জিকিউটিভ টিকিট হোল্ডার তো? তাই তোকে ফোন করে…. হ্যালো….হ্যালো…..হ্যালো!

সুদীপ বুঝতে পারেনি। ভেবেছে যান্ত্রিক গোলযোগে লাইনটা কেটে গেল বুঝি। আসলে তা নয়। উত্তেজনায় প্রকাশ টেলিফোনটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখেছে। তার হাতটা কাঁপছে! চলকে পড়ল কিছুটা চা। চায়ের কাপটা সে কোনোক্রমে নামিয়ে রাখল। ফার্স্ট প্রাইজ যেন কত ছিল। সওয়া লাখ? ওই অঙ্কটা কি সেই ‘প্রিমিয়াম প্রেসিডেন্ট কার’ সমেত?

সতী উঠে এসেছে ততক্ষণে—কী হল রে ছোড়দা? মাথাটা টলে উঠল?

—না! মাথা ঠিক আছে। শোন, তুই একটা কাজ করবি সতী? আমার টেবিলের ওই বাঁ-দিকের দেরাজটা খোল—একটা টফির বাক্স আছে। নিয়ে আয় তো।

বিস্মিত সতী তৎক্ষণাৎ বাক্সটা নিয়ে আসে।

—ওটা খোল। একটা লটারির টিকিট আছে। পেয়েছিস?…হ্যাঁ, ওই তো! দে তো ওটা… না থাক। দিতে হবে না। ওর নম্বরটা পড়ে শোনা শুধু।

সতীর বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়ছে। সে কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না। আদেশমাত্র পড়ে শোনাতে থাকে C/5…0…6…9….

চাপা গর্জন করে ওঠা প্রকাশ, জানি! লাস্ট ডিজিটটা বল—য়ুনিটের ঘরে যেটা আছে। শোন সতী! ঠিক মতো যদি বলতে পারিস-আমি বাদশা! তোকে….তোকে একটা স্টিরিও সেট রেডিওগ্রাম কিংবা টি-ভি-

—কী বকছিস্ পাগলের মতো? কী হয়েছে বল তো?

প্রকাশ শান্ত হয়ে ওঠে। বলে, ঠিক আছে। আমি তৈরি…তুই আর কী করবি? যা ভাগ্যে আছে তাই হবে, বল নাম্বারটা….

— C/506908 1

—এইট? ঠিক দেখছিস? এইট!

—এই দেখ না। টিকিটটা মেলে ধরে সতী।

প্রকাশ এলিয়ে পড়ে সোফায়। বলে, সতীরে। হাতের মুঠো থেকে ফসকে গেল। ঈস। ফার্স্ট প্রাইজ উঠেছে আমার ঠিক পরের নাম্বারটা! 506909! সওয়া লক্ষ টাকা! কোনো মানে হয়?

ফসকে যখন গেছে তখন আর হা-হুতাশ করে কী হবে! তবু সতীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইস্! এখনই কী কাণ্ডটা ঘটতে যাচ্ছিল।

হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে পড়ে প্রকাশ। টেলিফোনটা নিয়ে ডায়াল করতে থাকে। কিন্তু টেলিফোনের ধরনই ওই। অকাজে খোশগল্প করতে চাও তো একবারে লাইন পাবে, আর জরুরি প্রয়োজন থাকলে দুটো ডিজিট ডায়াল করতেই এনগেজড টোন!

সতী বলে, তুই তাড়াহুড়া করছিস। আমাকে দে ফোনটা। কত নম্বর?

প্রকাশ যন্ত্রটা হস্তান্তরিত করে। বলে, সুদীপ, আমি আর কমলেশ পর পর টিকিট পেয়েছিলাম। তিনটে কনজিকিউটিভ নাম্বার হবেই। সুদীপের হচ্ছে 907 আমার। 908 এখন লাস্ট চান্স কমলেশের ফিফটি পার্সেন্ট চান্স। তার টিকিট নম্বর হয় 906 অথবা 909।

—কমলেশদার নম্বরটা কত তাই বল!

—আমিও তাই জানতে চাই। 906 না 909!

—হেত্তেরি! ওর টেলিফোন নাম্বারটা কত?

শেষ পর্যন্ত অবশ্য টেলিফোনে যোগাযোগ হল; কিন্তু এতবড় সংবাদটা জানা গেল না। কমলেশ বাড়ি নেই। অফিস থেকে আদৌ ফেরেনি। কিন্তু অফিস থেকেই টেলিফোনে ভৃত্যকে নির্দেশ দিয়েছে, সে সপ্তাহখানেক বাড়ি ফিরবে না। কোথায় গেছে তা-ও জানে না কমলেশের গৃহভৃত্য।

রীতিমতো অবাক হল প্রকাশ। এর মানেটা কী? আজ ভোর পাঁচটায় সে প্রকাশকে এমার্জেন্সি রুমে ফোন করেছিল। কই, তখনও তো সে বলেনি, যে এক সপ্তাহের জন্য বাইরে যাচ্ছে। বরং বলেছিল, রবি হাসপাতালে আমার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও এসে পড়বে। তা সে আসেনি। কমলেশের অফিসে ফোন করেও কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না। জানা গেল সে সাতদিনের ছুটিতে আছে।

কাল রাত্রে নাইট ডিউটি গেছে। এমন দিনে ও সকাল সকাল খেয়ে একটা টানা ঘুম দেয়। আজ কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মেজবউদি এসে বললেন, আর হা-হুতাশ করে কী হবে ভাই? বরাতে নেই কো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী? খেয়ে দেয়ে একটা ঘুম দাও।

তা ঠিক! কমলেশ প্রাইজটা পাক আর না পাক, সে যে পায়নি এটা তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। স্নানাহার করে নিদ্রার ক্রোড়েই আশ্রয় নিল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না, হঠাৎ বাজল টেলিফোন। মেজবৌদি ছিলেন যন্ত্রটার কাছে। ওকে বললেন, তোমাকে খুঁজছে। মহিলা-কণ্ঠ। নাম জানাতে চায় না, মানে তোমাকে ছাড়া-

প্রকাশ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার তাকায় মেজবৌদির দিকে। অণিমা নিশ্চয় নয়। অণিমা তাকে বাড়িতে ফোন করে না কখনও। টেলিফোনটার কথা-মুখে বললে প্রকাশ সেনগুপ্ত বলছি-

—ডক্টর সেনগুপ্ত, আমার নাম মীনাক্ষী মজুমদার। নামটা কখনও শুনেছেন?

—শুনেছি। যদি ভুল না করি তবে কমলেশের কাছে।

—হ্যাঁ, আমি সেই মীনাক্ষী! আপনাকে একটা খবর দেবার আছে। দারুণ…দারুণ খবর… প্রকাশের আনন্দিত হবার কথা; কিন্তু তার বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল। টিকিটটা একঘর আগু-পিছু হলে আজ মীনাক্ষীর বদলে সতী অথবা অণিমা তাদের বান্ধবীদের ঠিক এইভাবে ফোন করত। হয়তো কমলেশ সংবাদটা জানালে ওর এই প্রতিক্রিয়া হত না। মানীক্ষীকে সে ন্যাকা ন্যাকা গলায় খবরটা বলতে দিল না। বরং উল্টে ডাহা মিছে কথা বললে, আমাকে জানাতে হবে না। কমলেশ নিজেই আমাকে জানিয়েছিল!

—কী খবর বলুন তো?

—বললাম তো, আমি জানি। কমলেশের টিকিটের নম্বরটা 506909! সবার আগে সে আমাকেই টেলিফোন করে জানায়

—সবার আগে? কটার সময়?

—সকাল পাঁচটা দশ! কমলেশ কোথায়?

—এক মিনিট লাইনটা ধরুন তো। বলছি।

কথার কথা নয়, পুরো একটি মিনিটই লাগল। প্রকাশ বুঝতে পারে, মীনাক্ষীর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কমলেশ। মীনাক্ষী তাই যাচাই করে নিচ্ছে। মনে মনে হাসে প্রকাশ এইবারে বেধে যাবে দুজনে। প্রাণের বান্ধবীর আগে কমলেশ কেন প্রকাশকে খবরটা দিয়েছে?

মিনিটখানেক পরে মীনাক্ষী বললে, আপনার বন্ধু কোথায় তা আমি জানি না। আমি দূতমাত্র। তার নির্দেশমতো আজ বিকাল সাড়ে তিনটায় আপনাকে হোটেল হিন্দুস্থানে আসতে বলছি।

—সাড়ে তিনটেয়? এখন কটা?

—পৌনে দুটো! যদি কোনো কারণে দেরি হয় যায়, সোজা ওর ঘরে চলে যাবেন। ওর রুম নাম্বার অবশ্য জানি না, সেটা কাউন্টারে জেনে নেবেন। ও আজ-কালের মধ্যে হোটেল হিন্দুস্থানে একটা পার্টি থ্রো করতে চায়। সেই বিষয়েই আপনার সঙ্গে পরামর্শ করবে। আই মীন, কাকে কাকে বলা যায়—

—আপনিও থাকবেন নিশ্চয় আলোচনায়?

—নিশ্চয়। আমিও রওনা হচ্ছি। ট্রাই টু বি পাঙ্কচুয়াল!

—আপনার ও নির্দেশটা বাহুল্য। আমি ডাক্তার। ঘড়ির কাঁটা মেনে চলি।

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়াতে যাবে মেজবৌদি বললেন, ভাগ্যবতীটি কে?

—ভাগ্যবতী মানে?—ফুঁসে ওঠে প্রকাশ।

মেজবৌদি মুখে টিপে বলেন, আমার শাঁসালো ব্যাচিলার দেবরটি যাঁর আহ্বানমাত্র গায়ে পাঞ্জাবি চড়ান, ঘড়ির কাঁটা মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি ভাগ্যবতী নন?

প্রকাশ গম্ভীর হয়ে বলে, ও হচ্ছে মীনাক্ষী মজুমদার। যার জন্য কমলেশের স্ত্রী ডিভোর্সের মামলা এনেছে।

সতী বলে তাহলে কমলেশদার ভাগ্যটাই খুলেছে! উঃ! ঈশ্বরের কী সূক্ষ্ম বিচার তেলটা ঢালার আগে ঠিক দেখে নিয়েছেন কোন মাথাটা সবচেয়ে তৈলাক্ত!

.

হোটেল হিন্দুস্থানের পার্কিং প্লেসে গাড়িটা রেখে প্রকাশ প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে এল। বাতানুকূল করা লাউঞ্জটা পার হয়ে রিসেপশান কাউন্টারে। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েটিকে ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, মিস্টার কমলেশ মিত্রর রুম নম্বরটা কত?

মেয়েটি রেজিস্টার দেখে বললে : 528

—মিস্টার মিত্র কি ঘরে আছেন?

মেয়েটি তার পিছনে নম্বর দেওয়া পায়রা-খোপ বাক্সের দিকে তাকিয়ে বললে, খুব সম্ভবত আছেন চাবি দেখছি না। আচ্ছা, দাঁড়ান, ফোন করে দেখি…

টেলিফোন রেজেই গেল। কেউ সাড়া দিল না।

প্রকাশ একটু ইতস্তত করে বললে, আমার নাম ডক্টর পি. সেনগুপ্ত। মিস্টার মিত্র আমাকে পাঙ্কচুয়ালি সাড়ে তিনটের আসতে বলেছিলেন। কোনও মেসেজ কি উনি রেখে গেছেন?

মেয়েটি যন্ত্রচালিতের মত 528 নম্বর খোপটা হাতড়ে বললে, ডঃ পি সেনগুপ্ত? হ্যাঁ, আপনার নামে একটা চিঠি রেখে গেছেন দেখছি।

বড় আর মোটা একটা সীলমোহর করা খাম। বেশ অবাক হয় প্রকাশ। এ আবার কী? মেয়েটির সামনে সে কিন্তু কোনও কৌতূহল দেখায় না। খামটা নিয়ে লাউঞ্জের একেবারে ও-প্রান্তে চলে যায়। তারপর সাবধানে খুলে ফেলে। আশ্চর্য! তার ভিতর পুরানো খবরের কাগজ ঠাসা। কাগজগুলো আড়াআড়িভাবে কাটা—অর্থাৎ ছাপা কাগজের কোনও বক্তব্য নেই। প্রকাশের মনে হল, এগুলির ভিতর কী যেন একটা পদার্থ আছে। ঠিক তাই। কাগজের গহ্বর থেকে শেষ-মেশ বেরিয়ে এল একটা চাবি। এই হোটেলেরই নামাঙ্কিত তাতে নম্বর লেখা আছে : 528!

—কী কাণ্ড! কমলেশের সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি! সব কিছুতেই রহস্যঘন আস্তরণ! প্রকাশকে ভোরবেলা জানাতে পারল না যে, সে এক সপ্তাহ অজ্ঞাতবাসে থাকছে; লটারিতে পেল টাকা, খবরটা দিল ওর বান্ধবী! ওর ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলতে চায়, তার জন্য এই পেল্লায় খামে সীলমোহর করেছে!

লিফট বেয়ে পাঁচতলায় উঠে যায়। ঘর তালাবন্ধ; কিন্তু বাইরে একটা বোর্ড ঝুলছে DO NOT DISTURB। এর মানে কী? মানে যাই হোক, প্রকাশ তালা খুলে নির্জন ঘুরে ঢুকল। দরজাটা খুলেই রাখে। এখনই কমলেশ অথবা মীনাক্ষী এসে পড়বে। মিনিটপাঁচেক বসেই থাকল। তারপর ধরাল সিগারেট। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবে?

.

বাসু-সাহেব ইন্টারকমের সুইচটা টিপে দিয়ে বললেন—বল? রিসেপশান কাউন্টার থেকে মিসেস রানি বাসু বলেন, তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন, ডক্টর পি. সেনগুপ্ত। পাঠিয়ে দেব।

ব্যারিস্টার সাহেব প্রতিপ্রশ্ন করেন, কী কেস জিজ্ঞাসা করেছিলে?—করেছিলাম। বলছেন অত্যন্ত গোপন এবং জরুরি। শুধু তোমাকেই বলতে পাবেন।

—আহ্! গোপন আর জরুরি না হলে আমার কাছে মরতে আসবে কেন? দ্যাটস নট দ্য পয়েন্ট…ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও।

চারটে বত্রিশ মিনিটে বাসু-সাহেবের চেম্বারের দরজাটা খুলে গেল। আগন্তুক লক্ষ করে। দেখে—ব্যারিস্টার-সাহেব শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। বেচারি স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি—ওদিকে ফিরে বাসু-সাহেব ওকেই লক্ষ করেছেন—ওপাশে অন্ধকারে টাঙানো একটি আয়নায়। বাসু-সাহেববের ধারণা : ওই প্রবেশ মুহূর্তটিই তাঁর ক্লায়েন্টের পক্ষে দুর্বলতম মুহূর্ত। যদি সে কোনো মিথ্যার নির্মোকে আবৃত হয়ে এসে থাকে তাহলে তার অ্যাটর্নির চোখে চোখ রাখার ঠিক আগের মুহূর্তটিতেই সে সবচেয়ে অসহায়; তাঁর ভাষায়; ভানারে! বাসু-সাহেবের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে যাঁদের পরিচয় নেই তাঁদের দুটি সংবাদ জানিয়ে রাখি। প্রথম কথা–আসামী নির্দোষ বলে যদি উনি নিজে নিঃসন্দেহ হন তবেই তার কেস হাতে নেন। যাদের নির্দোষ বলে বিশ্বাস করতে পারেন না তাদের বলেন : হয় দোষ কবুল করে সাজা নিন, অথবা অন্য কোনও উকিলের দ্বারস্থ হোন। এ ব্যাপারটা এতই জানাজানি হয়ে গেছে যে, কলকাতা আদালতের প্রায় প্রত্যেকটি বিচারক জানেন—বাসু-সাহেবের মক্কেল দোষী হ’ক আর নির্দোষ হ’ক, বাসু-সাহেবের বিশ্বাস মতে সে নির্দোষ।

দ্বিতীয় সংবাদ—আজ পর্যন্ত বাসু-সাহেবের কোনও মক্কেল—মানে খুনের দায়ে অভিযুক্ত মক্কেল, কখনও ‘কনভিক্‌শন’ পায়নি। এ বিষয়ে তাঁর বিশ বছরের আনব্রোকেন রেকর্ড!

সামনের চেয়ারটার দিকে ইঙ্গিত করে বাসু-সাহেব বলেন, ইয়েস! স্টার্ট টকিং!

—আমার নাম ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্ত। একটা অত্যন্ত জরুরি এবং গোপন… ধমকে ওঠেন বাসু-সাহেব, দেখুন মশাই, সময়ের দাম আপনারও আছে আমারও আছে। ফালতু কথা বলছেন কেন? আপনার নাম-ঠিকানা তো ভিজিটিং কার্ডেই আছে, আর জরুরি এবং গোপন ব্যাপার না থাকলে এমন হন্তদন্ত হয়ে ক্রিমিনাল লইয়ারের কাছে ছুটে আসবে কেন? কাজের কথা যেটুকু আছে বলুন। নাউ স্টার্ট টকিং এগেন।

প্রকাশ একটু থতমত খেয়ে যায় ব্যারিস্টার পি.কে বাসু যে একজন বিচিত্র মানুষ। এটুকু জানা ছিল তার। এর আগে কখনও দেখেনি। বিপদে পড়ে কিন্তু সবার আগে তাঁর কথাই মনে হয়েছে। ছুটে এসেছে তাঁর চেম্বারে। বললে, আমার সন্দেহ হচ্ছে কেউ আমাকে ফাঁদে ফেলতে চায়। একটা মিথ্যা অপরাধের চার্জে, মানে….

—কী জাতীয় অপরাধ?

—ঠিক জানি না। খুনের মামলাও হতে পারে-

—আই সি! এবার বিস্তারিতভাবে বলুন। শুরু হতে শুরু করুন।

প্রকাশ সব কথাই খুলে বলে। কমলেশের প্রাইজ পাওয়ার কথা, কী ভাবে খবরটা পায়, কী ভাবে হোটেলে গিয়ে বোকা হয় ইত্যাদি। কমলেশ, সুদীপ, মীনাক্ষীর পরিচয় দেয়।

—বুঝলাম। কিন্তু এতে ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়াবহ তো কিছু বলেননি এখনও?

—না। তার পরের ঘটনাটুকু শুনুন—

হোটেলের ওই ফাঁকা ঘরে প্রকাশ নাকি মিনিট পনেরো ছিল। তারপর বিরক্ত হয়ে সে উঠে পড়ে। ঘরটা তালাবন্ধ করে করিডরে বেরিয়ে আসে। কেউ তাকে ঘর থেকে বার হতে দেখেনি। লিফট দিয়ে নয়, এবার সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। তারপর হোটেল ছেড়ে গাড়ির কাছে আসে। গাড়ি সে লক করে যায়নি। হোটলের পার্কিং-জোনে দারোয়ানের নাকের ডগায় ছিল বলে ও-কথা তার মনেও পড়েনি। গাড়িতে ড্রাইভারের সিটে বসতে গিয়ে ওর মনে হল—সিটের নিচেশক্ত কী একটা জিনিস রয়েছে। গদিটা উঁচু করতেই বার হল জিনিসটা। প্রকাশ পকেট থেকে বার করে বাসু-সাহেবকে দেখাল বস্তুটা। একটা পয়েন্ট টু-টু বোরের রিভলভার!

বললে, আমার প্রচণ্ড ভয় হল তখন। সন্তর্পণে চেম্বারটা খুলে দেখলাম, ছয়টা খোপের মধ্যে পাঁচটায় তাজা গুলি ভরা আছে; এবং ট্রিগারের সামনে একটা ডিসচার্জড বুলেট! গন্ধ শুঁকে দেখলাম, ব্যরেলে বারুদের তাজা গন্ধ! অর্থাৎ কিছু পূর্বেই ওই পিস্তলটা ছোঁড়া হয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে বিশ্রী লাগল। স্পষ্ট বুঝলাম—কেউ আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। আমি বাড়ি গেলাম না। আপনার ঠিকানা জানা ছিল। সোজা চলে এসেছি তাই। এখন বলুন, আমার কী কর্তব্য? পুলিশে যাওয়া?

—বলছি। তার আগে বলুন, হোটেলের সেই 528 নম্বর চাবিটা কী করলেন?

প্রকাশ তার পকেট থেকে একটি চাবি বার করে বাসু-সাহেবের গ্লাস্টপ টেবিলে রাখল। বাসু বললেন, ওটা কাউন্টারে জমা দিয়ে এলেন না কেন?

—কেমন করে দেব? আমার নাম কমলেশ মিত্র নয়। রিসেপশনিস্ট যদি সন্দেহ করত? তাছাড়া, আমি চাইনি সে আমাকে বারে বারে দেখে চিনে রাখুক!

—ঠিক বুঝলাম না। আমার মনে হচ্ছে, আপনি কিছু একটা গোপন করছেন।

—নো স্যার! আমি আদ্যন্ত সত্যি কথা বলছি।

—আই সি! দেখুন ডক্টর সেনগুপ্ত, আমার কতকগুলো ‘হুইম’ আছে, মানে বাতিক। আমি শুধু সেই কেসগুলোই হাতে নিই যেখানে বুঝি আমার মক্কেল নির্দোষ এবং সে আমাকে আদ্যন্ত সত্যি কথা বলছে। এ-ক্ষেত্রে আমার ধারণা আপনি আদ্যন্ত সত্যিকথা বলেননি—নো! নট দ্য হোল ট্রুথ!—জাস্ট এ মিনিট! বাধা দেবেন না। আমাকে শেষ করতে দিন! তবু আমি শর্তসাপেক্ষে সাময়িকভাবে আপনার কেসটা নিচ্ছি। কারণ কেসটা আমার কাছে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং লাগছে।

—থ্যাঙ্কু স্যার!—পকেট থেকে চেকবুক বার করে প্রকাশ বললে, আপনাকে কত টাকার ‘রিটেইনার’ দেব?

—অ্যাকাউন্ট-পেয়ী চেক-এ এক টাকা।

—এক টাকা! মানে?

—হ্যাঁ, এক টাকা! শর্তসাপেক্ষে। ওই এক টাকার চেকটা নিচ্ছি আপনাকে মক্কেল বলে আইনত স্বীকৃতি দিতে। শর্তটা হচ্ছে এই—প্রাথমিক তদন্তে যদি বুঝি, আপনি নির্দোষ এবং আমাকে নির্ভেজাল সত্য কথা বলেছেন, তাহলেই আমি কেসটা চালাব। না হলে ওই এক টাকা ফেরত দিয়ে আমি হাত ধুয়ে ফেলব। রাজি?

প্রকাশ তাতেই রাজি।

বাসু বললেন, রিভলভারটা আর একবার দেখি। না, না, ওটা আপনার হাতেই থাক। খুলে আলোর সামনে ধরুন। দ্যাটস ইট।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্পর্শ বাঁচিয়ে উনি মারণাস্ত্রটা পরীক্ষা করলেন, গন্ধ শুঁকলেন। তারপর বললেন, থ্যাঙ্কু। এবার ওটা পকেটে রেখে দিন। আর ওই টেলিফোনটা তুলে পর পর তিনটে ফোন করুন। একটা আপনার বাড়িতে—বলুন, বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে রাত্রে আপনি ফিরবেন না। দ্বিতীয়টা আপনার কর্মস্থলে—জানিয়ে দিন, জরুরি দরকারে কাল আপনি যেতে পারছেন না। তৃতীয়টা সদর স্ট্রিটের লীটন হোটেলে, দেখুন সিঙ্গল-সিটের একটা ঘর পান কি-না। পেলে স্ব-নামে ঘরটা বুক করুন।

নির্দেশমতো প্রকাশ টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বাসু-সাহেব ঘর থেকে ‘সুকৌশলী’র কৌশিক মিত্রকে ডেকে পাঠালেন।

.

লিটন হোটেলে প্রকাশকে নামিয়ে দিয়ে বাসু-সাহেব যখন কৌশিককে নিয়ে হোটেল হিন্দুস্থানে এসে পৌঁছালেন তখন বিকাল পাঁচটা সাঁইত্রিশ। কৌশিককে তামিল দেওয়া শেষ হয়েছিল। সে বললে, এরকম মিথ্যা পরিচয় দেওয়া বেআইনি হবে না-কি?

কী মুশকিল! মিথ্যা পরিচয় দেবে? ঠিক যেভাবে বললাম সেভাবে কথোপকথন চালালে মেয়েটিকে কোনো মিথ্যা কথা না বলেও তুমি কার্যোদ্ধার করতে পারবে। আমি বুঝে নিতে চাই, ওই রিসেপশনিস্ট মেয়েটির মনে আছে কি না—সেনগুপ্তের আকৃতি, ভবিষ্যতে সে প্রকাশকে শনাক্ত করতে পারবে কি-না। প্রকাশ যদি কাঠগড়ায় দাঁড়ায় ওই মেয়েটিই হবে প্রসিকিউশনের প্রধান সাক্ষী—তাতে গুলিয়ে দেবার এই হচ্ছে সুযোগ।

—তাহলে আপনিই গিয়ে বলুন না কেন?

—কী আপদ! প্রকাশ আর তুমি একই এজ-গ্রুপের; একই রকম লম্বা। সেই জন্যেই তোমাকে পাঞ্জাবি পরিয়ে এনেছি। আমি যে একেবারে ভিন জাতের

অগত্যা দুজনে গুটি গুটি এগিয়ে যান রিসেপশান কাউন্টারের কাছে। বসু ফুট-তিনেক দূরে দেওয়ালে প্রলম্বিত একটি চিত্রকর্মের প্রতি নিবন্ধদৃষ্টি এবং উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করেন। কৌশিক এগিয়ে এসে মেয়েটিকে বললে, মিস্টার কমলেশ মিত্রের 528 নং খোপটা কাইন্ডলি একটু দেখবন? ডক্টর পি. সেনগুপ্তের নামে তিনি কি কোনো মেসেজ রেখে গেছেন?

যন্ত্রচালিতের মতো মেয়েটি চিহ্নিত খোপটা হাতড়ে বলে, না।

—মিস্টার কে, মিত্র কি ঘরে আছেন?

মেয়েটি কী-যেন ভাবছিল। টেলিফোনের রিসিভারের দিকে অভ্যাসবশে হাতটাও বাড়িয়েছিল। হঠাৎ থমকে থেমে পড়ে। বলে, ইয়ে, ডক্টর ঘণ্টাদুয়েক আগে আপনি কি একটা মোটা খাম নিয়ে যাননি?

কৌশিক প্রশ্নটার সরাসরি জবাব দিল না। বললে, আমি নূতন কোনও চিঠির কথা বলছিলাম। ইতিমধ্যে ফিরে এসে সে কি নূতন কোনও মেসেজ রেখে গেছে?

মেয়েটি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ওকে খুঁটিয়ে দেখছিল। ভ্রু কুঁচকে বললে, মাপ করবেন, ঘণ্টাদুয়েক আগে আপনি নিজেই এসেছিলেন চিঠিখানা নিতে?

বাতানুকূল-পরিবেশেও কৌশিক ভিতরে ঘেমে ওঠে। তবুও হেসে বলে, আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে?

কেউই কারও প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। প্রতি-প্রশ্নের মধ্যেই রয়েছে তির্যক জবাব। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক মেয়েটি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে। বললে, কিছু মনে করবেন না, আপনি প্রমাণ করতে পারেন যে, আপনি ডক্টর সেনগুপ্ত? মানে, এর আগে আপনার হাতেই সেই খামটা আমি দিয়েছি?

কৌশিক বলে, গাড়িতে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। এনে দেখাতে পারি। আমার নাম, ফোটো, সই, লাইসেন্স নাম্বর। দেখবেন?

মেয়েটি ইতস্তত করে। হয়তো লোকটা ওদের বোর্ডার-এর বিশিষ্ট বন্ধু। এতবড় চ্যালেঞ্জ করা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না তো?

ওর নীরবতার সুযোগ নিয়ে কৌশিক পকেট থেকে একটা চাবি বার করে টেবিলের উপর রাখে। হেসে বলে, এ-ভাবে খামকা অপমানিত হতে হবে জানলে আমি আসতুম‍ই না! এনি ওয়ে, এই চাবিটা রাখুন। মিস্টার মিত্র ফিরে এলে বলবেন, তার বন্ধুকে সে যে ডুপ্লিকেট চাবিট দিয়েছিল….

—আয়াম সো সরি, ডঃ সেনগুপ্ত। প্লিজ এক্সকিউজ মি! আমারই ভুল। আমি অকপটে ক্ষমা চাইছি ছি-ছি-ছি। কী অন্যায়!

চাবিটা আবার কুড়িয়ে নিয়ে কৌশিক বললে, ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করিনি। আফটার অল, আপনি যা কিছু করছেন আপনাদের বোর্ডার-এর স্বার্থেই করছেন।

—অসংখ্য ধন্যবাদ! আপনি আমাকে নিশ্চিত করলেন ডক্টর সেনগুপ্ত।

কৌশিক ফিরে এল বাসু-সাহেবের কাছে। বললে, তাহলে চলুন, ঘরে গিয়ে বসি। মেয়েটি এতক্ষণে বাসু-সাহেবকে দেখল। তিনি মিষ্টি করে হাসলেন।

লিফট্ ধরে দুজনে উঠে এলেন চারতলায়। নির্জনে করিডরে পদার্পণ করে কৌশিক জানতে চায়, আমি মেয়েটিকে কোনো মিথ্যা কথা বলেছি?

ঊর্ধ্বমুখ দার্শনিকের ভঙ্গিতে বাসু-সাহেব চিবুকে হাত বুলাতে বললেন, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ভিন্ন মিথ্যা বলিব না এবং এইভাবে সত্য বলিতে বলিতে মিথ্যার সাতমহলা প্রাসাদ বানাইব!

528 নম্বর ঘরে ঢুকলেন দুজনে। ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিনের প্রথমেই কৌশিকের কানে কানে বললেন, কোনো কিছু স্পর্শ কোরো না। ফিঙ্গার-প্রিন্ট না পড়ে।

—তারপর গঙ্গাস্নানান্তে নিষ্ঠাবান বিধবা যেভাবে বকের মতো পা ফেলে স্পর্শ বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরেন সেই ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলেন তিনি। ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাতে বাস করেনি। অ্যাশট্রেতে একটি মাত্র সিগ্রেটের দগ্ধাবশেষ। বাসু বলেন, ওই দেখ প্রমাণ প্রকাশ সেনগুপ্তের ফিঙ্গার-প্রিন্ট রয়েছে অ্যাশট্রেতে!

কৌশিক পকেট থেকে রুমাল বার করে বলে, মুছে দেব?

বাসু ঝাঁপিয়ে পড়েন, সার্টেনলি নট! আমরা তদন্ত করতে এসেছি, কোনও এভিডেন্স ট্যাম্পার করতে নয়।

—কিন্তু প্রকাশবাবু তো আপনার মক্কেল। তাকে বাঁচানোই তো—

তাকেমাঝখানে থামিয়ে দেন বাসু-সাহেব বলেন, প্রকাশ আমার শর্তসাপেক্ষে মক্কেল। সাবধানে হাতে রুমাল জড়িয়ে উনি বাথরুমের দরজাটা খুলে ফেলেন।

কৌশিক অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে ওঠে!

স্নানাগারে উবুড় হয়ে পড়ে আছে একজন। রক্তের একটা ধারা ক্ষীণ রেখায় বয়ে গেছে জলনিকাশি নর্দমাটার দিকে। বাসু নিচু হয়ে ওকে পরীক্ষা করলেন। তারপর কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, ডেড অ্যাজ এ ডোডো!

—এখনই পুলিশে খবর দেওয়া উচিত—কৌশিক টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যায়।

—অফ কোর্স! তবে এ ঘর থেকে নয়। এসো, নিচে যাই।

ঘরটা আবার তালাবদ্ধ করে ওঁরা নিচে নেমে এলেন। লাউঞ্জের একান্তে একটি পাবলিক টেলিফোন বুথ ছিল। বাসু-সাহেব সেখান থেকে ফোন করলেন থানায়। ও-প্রান্ত থেকে সাড়া দিলেন ইন্সপেক্টর সতীশচন্দ্র বর্মন। বাসু-সাহেবকে তিনি ভালোমতই চেনেন। বলেন, বসু স্যার। কীভাবে আপনার সেবা করতে পারি?

বাসু বলেন, আমাকে নয়, সেবাটা করতে হবে জনগণকে। আপাতত আপনি দয়া করে হোটেল হিন্দুস্থানে চলে আসুন। সেখানে 528 নম্বর ঘরে এইমাত্র একটি মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। আমার অনুমান কেসটা খুনের।

—কে মৃতদেহ প্রথম আবিষ্কার করেছে?

—আমি।

—আপিনি ওই ঘরে কেন গিয়েছিলেন?

—প্রফেশনাল প্রয়োজনে, আমার মক্কেলের স্বার্থে।

—কে আপনার মক্কেল?

বাসু বললেন, মনে হচ্ছে, আপনি টেলিফোনেই আমার গোটা জবানবন্দিটা শুনতে চান। আমার আপত্তি নেই। তবে ইতিমধ্যে লাশটা পাচার হয়ে গেলে আমাকে দায়ী করবেন না। দয়া করে আপনার ডায়েরিতে লিখে নিন, আমি পাঁচটা বাহান্ন মিনিটে খবরটা আপনাকে জানিয়েছি! এবার আমার বিস্তারিত জবানবন্দিটা লিখে নিন। কাগজ-কলমে বার করেছেন?

বর্মন হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, লুক হিয়ার মিস্টার বাসু! এটা আদালত নয়। আপনাকে প্যাঁচ কষতে হবে না। আমি এখনি আসছি। আপনি হোটেল ছেড়ে যাবেন না। ঘরটা খোলা আছে?

—না। তালাবন্ধ আছে। চাবি আমার কাছে। আমি অপেক্ষা করছি।

পুলিশ ভ্যান এসে পৌঁছলো ছয়টা বেজে বারো মিনিটে। বর্মন এগিয়ে এসে বললে, চাবিটা দিন।

বাসু বিনা বাক্যব্যয়ে চাবিটা হস্তান্তরিত করলেন। বর্মন তার দুজন সহকারী সমেত উঠে গেল ওপরে। যাবার সময় বলে গেল বাসু যেন স্থানত্যাগ না করেন।

মিনিট পাঁচেক পরে ক্যামেরা বগলে এক ভদ্রলোক এসে কাউন্টারে প্রশ্ন করলেন, লাশ কোথায় পাব?

মেয়েটি আঁতকে ওঠে। প্রশ্নটার কোনও অর্থ গ্রহণ হয় না। ভদ্রলোক পান চিবোতে চিবোতে নির্বিকারভাবে ভাষান্তরে বলেন, আই মিন, খুন হয়েছে কত নম্বর ঘরে?

মেয়েটির চোখ দুটি যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বলে, মানে খুন কেন হতে যাবে?

নির্বিকার পুলিশ ফোটোগ্রাফার দেশলাইয়ের কাঠির সাহায্যে দাঁতের ফাঁক থেকে একটি সুপুরির কুচি বার করে স্পিটুনে থুথু ফেললন। একগাল হেসে বললেন, খুন কেন হয়েছে তা কি এখনই বলা যায়? আগে লাশ দেখি।

বাসু এগিয়ে এসে বললেন, 528 নম্বরে। ইন্সপেক্টর বর্মন সেখানেই আছেন। আপনি পুলিশ ফোটোগ্রাফার তো?। সোজা চলে যান উপরে। ফিফ্থ ফ্লোর।

মেয়েটি আমতা আমতা করে বললেন, কী বলছেন আপনারা? কে খুন হয়েছে? বাসু বললেন, পরিচয় এখনও জানা জায়নি। একজন ভদ্রলোক। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স ওই ঘরে বাথরুমে মরে পড়ে আছে।

—আপনি…আপনি তা কেমন করে জানলেন?

—স্বচক্ষে দেখেছি বলে। থানায় জানিয়েছি। আপনার সামনে দিয়েই তো ইন্সপেক্টর আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে গেল। দেখেননি?

মেয়েটি এক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপরেই টেলিফোনটা তুলে নিল। খুব সম্ভবত ম্যানেজারকে খবরটা জানাতে।

আধ ঘণ্টা পরে বর্মন নেমে এল নিচে। বাসু-সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, নাউ স্টার্ট টকিং। আপনি কেন এসেছিলেন এ হোটেলে।

—এ প্রশ্নের জবাব আমি আগেই দিয়েছি। আমার মক্কেলের স্বার্থে।

—কে আপনার মক্কেল?

সরি। নামটা জানতে পারছি না।

—লুক-হিয়ার ব্যারিস্টার সাহেব। কেসটা খুনের। এখানে আপনি হত্যাকারীকে লুকিয়ে রাখতে পারেন না।

—আপনি কী করে জানলেন, আমার মক্কেলই হত্যাকারী?

—আপনি কী করে জানলেন যে, সে হত্যাকারী নয়?

—যে-হেতু সে বলেছে যে, সে হত্যা করেনি।

—আপনি কি বলতে চান আপনার মক্কেল যুধিষ্ঠিরের বাচ্চা?

—একজ্যাক্টলি! তবে কথাটা আমি বলছি না, বলছে আমাদের সংবিধান! সে যে তাই নয়, সেটা প্রমাণ করার দায় আপনার।

—কিন্তু লোকটার নাম না জানলে-

—আমি দুঃখিত। তবে আমি আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কাল সকাল দশটার সময় আমি আমার মক্কেলকে নিয়ে আপনার অফিসে আসব। আমার মক্কেল জবানবন্দি দেবে!

—কাল সকাল দশটায়! তার মানে সারারাত আপনি তাকে তালিম দেবেন? বাসু একগাল হেসে বলেন, তাই কি পারি? আজ সারারাত যে আমি আপনার নজরবন্দি। বাসু উঠে দাঁড়ান। বলেন, আশা করি আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই?

—আছে! বসুন, বসুন—ইন্সপেক্টর ভেবে পায় না কোন দিক থেকে আক্রমণ করবে। ঠিক তখনই কাউন্টার ছেড়ে উঠে আসে মেয়েটি। বলে, এক্সকিউজ মি, ইন্সপেক্টর! আমি জানি কে ওঁর মক্কেল। ওই ভদ্রলোক—ওঁর নামও জানি। ডক্টর পি, সেনগুপ্ত।

বর্মন মেয়েটিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললে, আপনি কি নেশা করেছেন? ওঁর নাম কৌশিক মিত্র। উনি মিস্টার বাসুর শাগরেদ।

মেয়েটি বলে, কিন্তু উনি এখানে এসে নিজেকে ডক্টর পি. সেনগুপ্ত বলে পরিচিত দেন। উনি দু’বার এসেছিলেন। একবার সাড়ে তিনটা নাগাদ, একবার সাড়ে পাঁচটায়। প্রথমবার একটা মোটা খাম আমার, হাত থেকে নিয়ে যান ডক্টর সেনগুপ্তের পরিচয়ে। আমার বিশ্বাস সেই খামের ভিতরেই ওই ঘরের চাবিটা ছিল।

বর্মন উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটিকে ছেড়ে কৌশিকের মুখোমুখি হয়ে বলে, উনি যা বলেছেন তা সত্য? বাসু বাধা দিয়ে বললেন, উনি ভুল বলছেন। কৌশিক একবারও বলেনি যে, সে ডক্টর সেনগুপ্ত। সে আমার সামনেই ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল—ডক্টর সেনগুপ্তের নামে কোনো চিঠি আছে কি না।

মেয়েটি রুখে ওঠে, তখন আমি বলিনি—উনি নিজের আইডেন্টিটি’ প্রমাণ করতে পারেন কি না?

—কারেক্ট! কিন্তু ওই ভদ্রলোক যখন তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে চাইলেন, আপনি তখন রাজি হননি!

—হ্যাঁ। কারণ উনি তখনই ওই ঘরের চাবিটা বার করে যে দেখালেন আমাকে।

—কারেক্ট! কিন্তু তাতে কী প্রমাণ হয়? ওঁর নাম ডক্টর সেনগুপ্ত?

বর্মন ওঁর সওয়াল-জবাবে বাধা দিয়ে কৌশিককে প্রশ্ন করে, আপনি আজ বিকাল সাড়ে তিনটা নাগাদ এ হোটেলে আর একবার এসেছিলেন?

—না।

মেয়েটি গর্জে ওঠে, না? আপনি আমার কাছ থেকে একটা খাম নেননি?

বাসু-সাহেব কৌশিককে বলেন, ভদ্রমহিলার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় তোমার নয়! বর্মন উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনারা দু’জন অপেক্ষা করুন। আমি এখনই আসছি। সে এগিয়ে গেল টেলিফোনটার দিকে। কৌশিক নিম্নস্বরে সাদা বাংলার প্রশ্ন করে, মেয়েটির প্রশ্নের জবাব দিতে বারণ করলেন, কিন্তু বর্মন যদি জানতে চায়?

—আদ্যন্ত সত্যভাষণ করবে। সাতমহলা বাড়ি বানাবার চেষ্টা কোরো না।

—যদি আপনার মক্কেলের নাম জানতে চায়?

—বলবে। সে আমার মক্কেল। তোমার নয়। তুমি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সব সময়েই পুলিশকে সাহায্য করতে হবে তোমাকে।

ওদের বাংলা-কথোপকথনের অর্থ গ্রহণ হচ্ছিল না মেমসাহেবের। সে আবার ফুঁসে ওঠে, আপনি অস্বীকার করতে পারেন—বিকাল ঠিক সাড়ে তিনটায় এসে আপনি ডক্টর সেনগুপ্তের পরিচয়ে আমার হাত থেকে একটা খাম নেননি?

কৌশিক জবাব দেবার আগেই বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, আপনি আদালতে দাঁড়িয়ে হলপ নিয়ে বলতে পারেন—ওর হতেই খামটা দিয়েছিলেন আপনি?

—আলবাৎ পারি।

—কিন্তু একটু আগে আপনি অতটা ‘শিওর’ ছিলেন না!

–কে বলল ছিলাম না?

—আপনার আচরণ। না হলে ওঁকে আত্মপরিচয় দিতে বললেন কেন?

—আমি জানতে চেয়েছিলাম উনিই ডাঃ সেনগুপ্ত কি না।

—তার মানে আপনি ‘শিওর’ ছিলেন না।

মেয়েটি দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ায়। বলে, লুক হিয়ার স্যার, এটা আদালত নয়, এবং আপনিও কিছু ব্যারিস্টার নন! এভাবে আমাকে ক্রস করতে পারেন না আপনি

—আর ইউ শিওর নাউ?

আবার সেই ‘শিওর’। মেয়েটি একেবারে খেপে ওঠে। হোয়াট ডু ইউ মিন?

—আপনাকে ক্রস করার অধিকার আমার নেই?

—না নেই। ইউ শ্যাল নেভার ব্রাউ-বিট মি দ্যাট ওয়ে!

—আই উইল, মাডাম! আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি— কাঠগড়ায় তুলে ক্রস-এগজামিনেশন বস্তুটার অর্থ কী, তা আমি আপনাকে অস্থিতে অস্থিতে সমঝিয়ে দেব! তবে মানুষজনকে মনে রাখার ক্ষমতা আপনার যে-রকম তাতে হয় তো আপনি আমাকে তখন চিনতে পারবেন না। আমার কার্ডটা তাই রাখুন।

নামাঙ্কিত একটি কার্ড টেবিলে রাখলেন বাসু-সাহেব। মেয়েটি স্তম্ভিত। অস্ফুটে শুধু বললে, পি কে বাসু বার-আট-ল মানে ওই যাকে খবরের কাগজে একবার বলেছিল ‘পেরি মেসন অফ দ্য ইস্ট?’

বাসু-সাহেবকে জবাব দিতে হল না। তার আগেই ফিরে এল বর্মন। বাসু-সাহেবকে বললে, আপনি যেতে পারেন কিন্তু মিস্টার কৌশিক মিত্রের জবানবন্দি আমি এখনই নেব। ওঁকে অপেক্ষা করতে হবে।

বাসু বলেন, ঠিক আছে। আমিও অপেক্ষা করছি। আমার যাবার তাড়া নেই। বর্মন বললে, আপনার না থাকে আমার আছে। আপনাকে তাড়াবার। মিস্টার কৌশিক মিত্র আপনার মক্কেল নন, জবানবন্দি আমি জনান্তিকেই নেব।

বাসু শ্রাগ করেন। উঠে পড়ে বলেন, তাহলে কাল সকালেই দেখা হচ্ছে। সকাল দশটায়। গুড নাইড টু এভরিবডি।

.

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *