ঘটনা-চক্র (অর্থাৎ দ্বীপান্তরিত কয়েদীর অদ্ভুত আত্মত্যাগ কাহিনী)
প্রথম পরিচ্ছেদ
যে সকল অপরাধী দ্বীপান্তরে প্রেরিত হইয়া থাকে, তাহাদিগের দণ্ডের সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেলেই, তাহারা কলিকাতায় আনীত হইয়া থাকে।
কলিকাতার পাঠকবর্গের মধ্যে কেহ কেহ অবগত থাকিলেও বোধ হয়, মফঃস্বলের পাঠকবর্গের মধ্যে কেহই অবগত নহেন যে, উক্তরূপ দ্বীপান্তর প্রত্যাগত অপরাধীগণ কি নিমিত্ত কলিকাতায় আগমন করে, এবং কোন স্থানেই বা অবস্থিতি করে।
কলিকাতার যে স্থানে আমাদিগের বিভাগের কর্মচারীগণ অবস্থিতি করেন, দ্বীপান্তর প্রত্যাগত অপরাধীগণ আনীত হইলে, সেইস্থানেই প্রথমে অবস্থিতি করে, এবং সেইস্থান হইতে প্রত্যেককে সরকারী ব্যয়ে তাহাদিগের স্বদেশে প্রেরণ করা হয়। এইরূপে মাসে মাসে বিস্তর কয়েদী দ্বীপান্তর হইতে আগমন করে, এবং তিন চারি দিবস কলিকাতায় অবস্থিতি করিয়া, তাহারা আপন আপন দেশে প্রত্যাগমন করিয়া থাকে।
চারি বৎসর গত হইল, ভাদ্র মাসের একদিবস এইরূপে কতকগুলি কয়েদী আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হয়। তাহার মধ্যে অধিকাংশই পঞ্জাব দেশবাসী, এবং কতগুলি মাদ্রাজী। ইহাদিগের মধ্যে অনেকেই স্ত্রীলোক অপরাধীগণের সহিত দ্বীপান্তরেই বিবাহ করিয়াছে, এবং অনেকেরই পুত্র কন্যা জন্মিয়াছে; সুতরাং পুত্র কন্যাগণও উহাদিগের সহিত আনীত হইয়াছে। এই সকল ব্যক্তিগণের মধ্যে দেখিলাম, একজন বাঙ্গালী। তাহার ভাবগতি এবং অপর কয়েদীগণের উপর তাহার সদ্ব্যবহার, ও নম্র প্রকৃতি দেখিয়া সহজেই আমাদিগের নয়ন তাহার উপর আকৃষ্ট হইল। দ্বীপান্তর-প্রত্যাগত সহস্ৰ সহস্ৰ ব্যক্তিকে দেখিয়াছি, কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে এরূপ উদারস্বভাব মনুষ্য কখনও আমার নয়নগোচর হয় নাই। উহার অবস্থা দেখিয়া উহার সহিত দুই চারিটি কথা কহিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত ইচ্ছা হইল। আমি উহাকে আমার নিকট ডাকিলাম। ডাকিবামাত্র সে আমার নিকট আসিয়া প্রণাম করিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?”
উত্তরে সে কহিল, “আমার নাম শ্রীক্ষীরোদচন্দ্র দাস বসু।”
আমি। তোমার নিবাস কোথায়?
ক্ষীরোদ। বর্দ্ধমান জেলার মধ্যস্থিত—একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে।
যে গ্রামে ক্ষীরোদচন্দ্রের বাসস্থান, তাহা সে আমাকে বলিয়াছিল; কিন্তু অনেক দিবস অতীত হওয়ায় আমার প্রথর স্মরণ-শক্তির গুণে সে নামটি আমি ভুলিয়া গিয়াছি!
আমি। কি অপরাধে তোমার মেয়াদ হইয়াছিল?
ক্ষীরোদ। হত্যা-অপরাধে।
আমি। কত দিবসের নিমিত্ত তোমার মেয়াদ হয়?
ক্ষীরোদ। আজীবন মেয়াদ হইয়াছিল; কিন্তু আঠার বৎসর পরেই আমাকে মুক্তি দিয়াছে।
আমি। দেখিতেছি, জাতিতে তুমি কায়স্থ, এবং কথাবার্তায়ও বোধ হয়, তুমি বিশিষ্ট ভদ্রবংশ-সম্ভূত, এরূপ অবস্থায় হত্যা-অপরাধে তোমার দণ্ড হইল কেন?
ক্ষীরোদ। ইংরাজের বিচারালয়ে দোষের প্রমাণ হইলে, দণ্ড না হইবেই বা কেন?
আমি। দোষের প্রমাণ হইয়াছিল বলিয়া তোমার দণ্ড হইয়াছিল; কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সেই মোকদ্দমায় তুমি দোষী ছিলে কি না?
ক্ষীরোদ। দোষী না থাকিলে, আমি এই আঠার বৎসর কারাদণ্ড ভোগ করিলাম কেন? অবশ্যই আমি কোন না কোন দুষ্টকার্যে লিপ্ত ছিলাম।
আমি। অপর কোন দোযের কথা আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি না, যে কার্য্যের নিমিত্ত তুমি আঠার বৎসরকাল দ্বীপান্তরে অবস্থিতি করিলে, সেই কার্য্যে কিরূপে তোমার সদৃশ লোকের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছিল, তাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছি। যদি তোমার কোনরূপ বাধা না থাকে, তাহা হইলে বলিতে পার; নতুবা জানিতে ইচ্ছা করি না।
ক্ষীরোদ। যাহা গত হইয়া গিয়াছে, যাহার নিমিত্ত আমি আঠার বৎসরকাল দ্বীপান্তরে অবস্থিতি করিয়া আসিয়াছি, তাহার ব্যাপার এখন বলিতে আমার কোনরূপ প্রতিবন্ধক নাই। কিন্তু মহাশয়! আমাদিগের সদৃশ দরিদ্র ব্যক্তির দুঃখের কাহিনী শ্রবণ করিয়া আপনার লাভ কি? উহাতে আপনার কোনরূপ উপকারের সম্ভাবনা নাই। আপনার হৃদয় আমি জানি না, কিন্তু অনেক পুলিস-কৰ্ম্মচারীর কঠিন হৃদয়ের মধ্যেও দয়ার একটু সংস্রব আছে; তাহা আমি অনেক সময়ে দেখিয়াছি। আপনার হৃদয়ে যদি সেই প্রকার কোনরূপ দয়ার সংস্রব থাকে, তাহা হইলে আমার কাহিনী শ্রবণ করিয়া! আপনার হৃদয়ে কখনই সুখের সঞ্চার হইবে না; অধিকন্তু একটু কষ্টের উদয় হইবারই সম্ভাবনা। এরূপ অবস্থায় আমার নিবেদন যে, কিরূপ ঘটনা-চক্রে পড়িয়া আমি এইরূপ দণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছি, তাহা আপনি শ্রবণ করিবেন না।
ক্ষীরোদচন্দ্রের এ সকল কথা শ্রবণ করিয়া ভাবিলাম যে, যে হত্যা-অপরাধে ক্ষীরোদচন্দ্র এই দীর্ঘ দণ্ডভোগ করিয়া আসিয়াছে, সেই অপরাধে ক্ষীরোদচন্দ্র হয় ত একেবারেই নির্দোষ। কোনরূপ অসম্ভাবিত ঘটনা-চক্রে পড়িয়া তাহার এই অবস্থা ঘটিয়াছে। যাহা হউক, যেরূপে পারি, ক্ষীরোদচন্দ্রের অবস্থা শ্রবণ করিতেই হইবে। এই ভাবিয়া ক্ষীরোদচন্দ্রকে কহিলাম, “দীর্ঘকাল পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিয়া আমার হৃদয় পাযাণ অপেক্ষাও কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং তোমার কাহিনীতে যতই কেন হৃদয়-বিদারক ঘটনার বিবরণ থাকুক না, আমার হৃদয় কিন্তু কিছুতেই দ্রবীভূত হইবে না। এরূপ অবস্থায় যদি তুমি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর, তাহা হইলে আমি সবিশেষ উপকৃত হই, এবং বোধ হয়, অনেক বিষয়ে শিক্ষালাভ করিতেও সমর্থ হই।”
আমার কথায় ক্ষীরোদচন্দ্র সম্মত হইল, এবং কহিল, “সন্ধ্যার পর আপনার নিকট গমন করিব। আর আমার আত্মকাহিনী যতদূর সমূল বর্ণন করিতে পারি, তাহা আপনার নিকট করিব।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দিবাভাগে যে স্থানে বসিয়া ক্ষীরোদচন্দ্রের সহিত আমার কথাবার্তা হইয়াছিল, সন্ধ্যার পর ক্ষীরোদচন্দ্র বিনা—সন্ধানেই সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই ক্ষীরোদচন্দ্রের অপেক্ষায় সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম। ক্ষীরোদচন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইবামাত্র আমি তাহাকে সেইস্থানে বসিতে বলিলাম, ক্ষীরোদচন্দ্র সেইস্থানে উপবেশন করিল। তাহার সহিত অপরাপর দুই চারিটি কথাবার্তার পর সে আপনার কাহিনী সকল বলিতে আরম্ভ করিল, আমি ও আমার বিভাগস্থ অপরাপর কর্মচারীগণ, যাঁহারা সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, সকলেই বিশেষ মনোযোগের সহিত তাহার কাহিনী শ্রবণ করিতে লাগিলাম। সেই কাহিনী যতদূর আমার স্মরণ আছে, পাঠকগণের অবগতির নিমিত্ত তাহা এইস্থানে বিবৃত হইল।
ক্ষীরোদচন্দ্র কহিল, “মহাশয়! পূৰ্ব্বেই আমি আপনাকে বলিয়াছি, আমার বাসস্থান বর্দ্ধমান জেলার মধ্যস্থিত একখানি অতি সামান্য পল্লীগ্রামে। কুলীন কায়স্থের কুলে আমার জন্ম। আমাদিগের দিনপাতের কষ্ট না থাকিলেও, আমার পিতামাতা অগাধ অর্থের অধিকারী ছিলেন না। সবিশেষ কষ্টে না হউক, একটু স্বচ্ছলতার সহিত তাঁহারা সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন বটে; কিন্তু পিতার মৃত্যুকালে তিনি তাঁহার সৎকার ও শ্রাদ্ধোপযোগী নগদ অর্থ কিছুই রাখিয়া যাইতে সমর্থ হন না। পিতার মৃত্যুর প্রায় দুই বৎসর পূর্ব্বে আমার মাতা ইহজীবন পরিত্যাগ করেন। যে সময় আমার পিতার মৃত্যু হয়, সেই সময় আমি নিতান্ত বালক ছিলাম না, তখন আমার বয়ঃক্রম প্রায় বিংশতি বৎসর হইয়াছিল। পিতা তাঁহার মৃত্যুকালে যদিও কিছুমাত্র নগদ অর্থ রাখিয়া যাইতে সমর্থ হন নাই, কিন্তু আমাকে যে একেবারে নিঃসম্বলে রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা নহে। মৃত্যুকালে তিনি তিন চারি মরাই ধান্য, এবং চাষ করিবার উপযোগী বিশ পঁচিশটা গরু আমাকে অর্পণ করিয়া যান। পিতার মৃত্যুর পূর্ব্বেই আমার বিবাহ হইয়াছিল, এবং আমার একটি শিশু সন্তানও জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। যাহা হউক, পিতার পরিত্যক্ত ধান্যের কিয়দংশ বিক্রয় করিয়া তাঁহার শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করিলাম, এবং তিনি যেরূপভাবে কৃষিকার্য্য করিয়া আপনার সংসার প্রতিপালন করিতেন, আমিও পরিশেষে সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া সংসার প্রতিপালন করিতে আরম্ভ করিলাম।
“আমাদিগের গ্রামে অধরচন্দ্র দাস নামক জনৈক বৈষ্ণবের বাসস্থান। আমি ও অধর উভয়েই সমবয়স্ক, বাল্যকালে আমরা উভয়েই একই পাঠশালায় লেখাপড়া শিক্ষা করি। সেই সময় হইতে আমাদিগের উভয়ের মধ্যে কেমন একরূপ ভালবাসার সঞ্চার হয়। বাল্যকালে উভয়েই একত্র ক্রীড়া, কৌতুক করিয়া মনের সুখে সময় অতিবাহিত করিতাম। আমোদ-প্রমোদেই বলুন, লেখাপড়া শিক্ষা করিবার কার্য্যেই বলুন, বা সাংসারিক কোন কার্য্যেই বলুন, যখন যাহাতে নিযুক্ত হইতাম, তাহাতে একাকী কখনও গমন করিতাম না। আমার প্রয়োজন হইলে অধরচন্দ্র আসিয়া আমার সহিত মিলিত হইত, বা অধরের প্রয়োজন হইলে আমি তাহার সহিত গমন করিতাম। এক-কথায় দিবসের অধিকাংশ সময়ই আমরা একত্র যাপন করিতাম। আমাদিগের পিতা মাতাও আমাদিগের এই অবস্থা উত্তমরূপে অবগত ছিলেন। আমাদিগের আহারাদি করিবার বা শয়ন করিবারও কিছুমাত্র স্থির ছিল না; আহারের সময় অধর আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলে, সেইস্থানে উভয়ে আহার করিতাম; কোন দিবস বা আমিও তাহাদিগের বাড়ীতে গমন করিয়া আহারাদি সমাপন পূৰ্ব্বক সেইস্থানেই অবস্থিতি করিতাম। এইরূপে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল, আমরাও ক্রমে বড় হইতে লাগিলাম। আমাদিগের মধ্যে ভালবাসাও ক্রমে বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল।
“প্রকৃত বন্ধুত্ব যে কি, উভয়ের মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব স্থাপিত হইলে যে কিরূপে সুখে দিনযাপন করিতে পারা যায়, তাহা আমরা যেরূপ অনুভব করিতে পারিয়াছিলাম, সেই সুখ অপর কেহ কখন অনুভব করিতে পারিয়াছেন কি না, জানি না। যাহা হউক, বাল্যকাল এই প্রকারেই অতিবাহিত হইয়া গেল। পিতা আমার বিবাহ দিলেন, ক্রমে আমার একটি সন্তানও জন্মগ্রহণ করিল। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, বিবাহ হইলে বা সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করিলে, বাল্যকালের বন্ধুত্ব ক্রমে লোপ পাইয়া যায়। কিন্তু আমার পক্ষে তাহা হইল না। বাল্যকালের যে মধুর প্রণয়ে অধরের সহিত আবদ্ধ হইয়াছিলাম, ক্ৰমে সেই প্রণয়ে কিছুমাত্র হ্রাস না হইয়া, দিন দিন ক্রমেই বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল।
“আমার বিবাহ হইল; কিন্তু আমার বন্ধুর বিবাহ হইল না। আমার পিতা তাঁহার মৃত্যুর পূর্ব্বেই আমার বিবাহ দিয়াছিলেন, অকথা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই জানিতে পারিয়াছেন। কিন্তু আমার বন্ধুর বিবাহ না হইবার পূর্ব্বেই তাহার পিতার মৃত্যু হয়। তাহার পিতার মৃত্যু হইবার কিছুদিবস পরেই তাহার মাতা তাহার বিবাহের উদযোগ করিতে লাগিলেন, আপনার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদিগকে একটি ভাল পাত্রীর অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত বার বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু অধর তাহা জানিতে পারিয়া তাহার মাতাকে বিবাহের উদযোগ করিতে নিষেধ করিল, ও কহিল, ‘আমি এখন বিবাহ করিব না, বিবাহ করিবার সময় এখন আমার নহে। যখন আমি বিবাহ করা বিবেচনা করিব, তখন আমি আপনাকে বলিব, আপনি সেই সময়ে পাত্রীর অনুসন্ধান করিবেন, সেই সময়ে আমি বিবাহ করিব।’ পুত্রের কথা শুনিয়া মাতা অনেক করিয়া অধরকে বুঝাইলেন, কিন্তু অধর কিছুতেই তাঁহার কথা শুনিল না, কোনক্রমেই বিবাহ করিতে সম্মত হইল না, বা তাহার মনের যে কী অভিপ্রায়, তাহাও কিছু স্পষ্ট করিয়া বলিল না।
“অধরের মাতা যখন কোনরূপেই তাহার মতের পরিবর্তন করিতে পারিলেন না, তখন একদিবস তিনি আমাকে ডাকাইলেন। কারণ, তিনি সবিশেষরূপে অবগত ছিলেন, কাহারও কথা না শুনিলেও কোন প্রকারেই অধর আমার কথার অন্যথাচরণ করিবে না। সময় মত আমি তাঁহার নিকট গমন করিয়া, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন, ও আমার দুই হস্ত ধারণ করিয়া একান্ত অনুনয় বিনয় পূর্ব্বক যাহাতে আমি অধরের মনের গতি ফিরাইতে পারি, তাহার নিমিত্ত সবিশেষরূপে যত্ন করিতে কহিলেন। বৃদ্ধার আগ্রহ মিনতি দেখিয়া আমার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইল। তখন এই বিষয়ে যাহাতে আমি অধরকে সম্মত করাইতে পারি, তাহার সবিশেষ চেষ্টা করিব, এই বলিয়া বৃদ্ধার নিকট হইতে চলিয়া আসিলাম।
“বৃদ্ধার নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়া আসিলাম সত্য; কিন্তু হঠাৎ অধরকে আমি সে কথা বলিতে সাহসী হইলাম না। কারণ, মনে হইল, যে বিষয়ের নিমিত্ত অধর তাহার গর্ব-ধারিণীর পর্য্যন্ত কথায় সম্মত হয় নাই, তখন আমার কথায় সে সম্মত হইবে কি? এদিকে অধর নিতান্ত মূর্খ নহে, এরূপ অবস্থায় যখন সে বিবাহ করিতে একবারে অসম্মত, তখন তাহার বিবাহ না করিবার নিশ্চয়ই কোনরূপ বিশিষ্ট কারণ আছে। সেই কারণ কি, যে পৰ্য্যন্ত তাহা আমি সবিশেষ অবগত হইতে না পারিব, সেই পর্যন্ত অধরকে বিবাহ করিতে অনুরোধ করা কোনরূপেই কর্তব্য নহে।
“এইরূপ ভাবিয়া ভিতরের কারণ জানিবার জন্য আমি বিশিষ্টরূপে চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কিন্তু অধরকে জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি কোন প্রকারে যে তাহা অবগত হইতে পারিব, তাহা আমার বোধ হইল না। তখন অনন্যোপায় হইয়া মনে মনে স্থির করিলাম, এ বিষয় অধরকেই জিজ্ঞাসা করিব। কিন্তু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিবার উপযুক্ত সুযোগ কয়েক দিবসের মধ্যে ঘটিয়া উঠিল না। এদিকে অধরের মাতা আমাকে বার বার ডাকাইয়া পাঠাইতে লাগিলেন, ও অধরের মতের পরিবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছি কি না, তাহাও জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইতে লাগিলেন; কিন্তু আমি তাঁহার কথায় কোন প্রকার উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ না হইয়া, সুযোগ মতে অধরের সহিত সাক্ষাৎ করিবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলাম। আমি যে তাহার মাতার বিশেষ অনুরোধে পড়িয়াছি, একথা অধর জানিতে পারিয়া কয়েক দিবস আমার সহিত সাক্ষাৎই করিল না। যে অধর দিনান্তে অভাব পক্ষে একেবারও আমার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া কোনরূপেই স্থির থাকিতে পারিত না। সেই অধর কয়েক দিবস পর্য্যন্ত আমার নিকট একবারও না আসায় আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম, এবং অনেক অনুসন্ধানের পর একদিবস তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
“অধরকে সঙ্গে করিয়া অন্য গল্প করিতে করিতে আমি ময়দানাভিমুখে গমন করিলাম। যে সময় আমরা গ্রামের বাহিরে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময়ে সূর্য্যদেব প্রায় অস্তাচলাবলম্বী হইতেছিলেন। সেই সময়ে আমরা উভয়ে আমার একখণ্ড জমীর আইলের উপর উপবেশন করিলাম, ও অধরচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার বিবাহ দিবার নিমিত্ত তোমার মা এত ব্যগ্র হইয়াছেন, কিন্তু তুমি বিবাহ করিতে একেবারে অসম্মত হইতেছ কেন?’
“উত্তরে তাধর কহিল, “বিবাহ করিতে আমি অসম্মত নহি, তবে—-’ এই বলিয়া অধর চুপ করিল। অধরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি বুঝিলাম, অধরের অন্তরে এক নূতন ইচ্ছা প্রবেশ করিয়াছে। তখন তাহাকে পুনরায় কহিলাম, ‘দেখ অধর! আজ পর্য্যন্ত তোমার নিকট আমার কোন বিষয়, বা আমার নিকট তোমার কোন বিষয় গুপ্ত নাই। কিন্তু আজ তুমি আমার নিকট তোমার মনের ভাব গুপ্ত করিতেছ দেখিয়া, আমার মনে অতিশয় কষ্টের উদয় হইতেছে। বন্ধুর নিকট মনের ভাব গুপ্ত রাখা বন্ধুর কার্য্য নহে। এইরূপ অবস্থায় তোমার মনের ভাব আমার নিকট প্রকাশ করা তোমার একান্ত কর্তব্য। তুমি আমাকে যে একটিমাত্র কথা বলিলে, তাহাতেই আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, তোমার মনে যে কোন নূতন ভাবের উদয় হইয়াছে, তাহা তুমি তোমার মাতার নিকট বলিতে সমর্থ হইতেছ না। এদিকে উহা যদি আমার নিকটও প্রকাশ না করিবে, তাহা হইলে তোমার মনের ভাব কে অবগত হইতে পারিবে, বা তুমি কি প্রকারে তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইবে? তোমার মনের কথা আমার নিকট স্পষ্ট করিয়া বল, আমি দেখি, আমার দ্বারা সেই কার্য্য কোনরূপে সম্পন্ন হইতে পারি কি না?”
“আমার কথা শ্রবণ করিয়া অধর যেন একটু লজ্জিত হইল ও কহিল, ‘না বন্ধু! তোমার নিকট আমার গোপনীয় বিষয় কিছুই নাই, তবে যে আমি এতদিবস উহা তোমার নিকটবলি নাই, সে আমার ভ্রম। যাহা হউক, আমার অন্তরের কথা আমি তোমার নিকট বলিতেছি—শ্রবণ কর, এবং যাহা তোমার ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই কর। মাতা আমার বিবাহের জন্য সবিশেষ ব্যস্ত হইয়াছেন, এবং লোক পাঠাইয়া নানাস্থানে পাত্রীর অনুসন্ধান করিতেছেন; কিন্তু মাতার প্রস্তাবিত বিবাহে আমি কোন প্রকারেই সম্মত হইতে পারি না। কারণ, আমি একজনের নিকট প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়াছি।’
“অধরের কথা শ্রবণ করিয়া আমি বুঝিলাম, এতদিবস পরে আমার বন্ধু কোন রমণীর প্রণয়ে মজিয়াছে, এবং তাহাকেই বিবাহ করিবে বলিয়া তাহার নিকট প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়াছে। তখন আমি তাহাকে কহিলাম ‘এ অতি উত্তম কথা; একথা তুমি পূর্ব্বে আমাকে বল নাই কেন? যখন তুমি তোমার মনের কথা তোমার মাতাকে বলিতে অসমর্থ, তখন আমাকে বলিলে যে কোন প্রকারে পারিতাম, আমি তোমার মাতার মত করাইয়া লইতাম, এবং এতদিবস শুভকাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া যাইত। তুমি জাতিতে বৈষ্ণব, এ কার্য্যে তোমার জাতিত্ব লইয়াও কোনরূপই গোলযোগ হইতে পারিত না। যদি সে বৈষ্ণবের কন্যা হয়, ভালই; নতুবা তাহাকে প্রথমে বৈষ্ণবধর্ম্মে দীক্ষিতা করিয়া, পরিশেষে তোমার সহিত তাহার পরিণয় কার্য সম্পন্ন করিয়া দিতাম। যাহা হইবার—তাহা হইয়াছে। এখন বল দেখি, কোন রমণী তোমার হৃদয় অধিকার করিয়াছে?’
“আমার কথায় উত্তরে অধরচন্দ্র কহিল, ‘আমাদিগের বাড়ীর নিকট গৌরমোহন দাস নামক জনৈক বৈষ্ণব বাস করিত, তোমার মনে হয় কি?’
“বেশ মনে হয়? গৌরমোহন দাস একজন বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ বৈষ্ণব ছিলেন। তাঁহার প্রথমা পত্নী পরলোক গমন করিবার পর, তিনি পুনরায় দার পরিগ্রহ করেন। দ্বিতীয় দারপরিগ্রহের কিছুদিবস পরেই গৌরমোহন ও তাহার জনৈক বন্ধু ক্ষেত্রমোহন দাস শ্রীবৃন্দাবনধামে গমন করিবার মানসে বাড়ী হইতে বহির্গত হন। কিন্তু কিছুদিবস পরেই সংবাদ পাওয়া যায় যে, গৌরমোহন ও ক্ষেত্রমোহন উভয়েই শ্রীবৃন্দাবনের পথে বিসূচিকা রোগে ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। গৌরমোহনের বিধবা স্ত্রী বামা তাঁহার বাড়ীতেই থাকিত জানি; তুমি সেই বামাকে বিবাহ করিবে বলিয়া প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়াছ না কি?’
“আমার কথার উত্তরে অধরচন্দ্র কহিল, “বামা কিরূপ রূপবতী, তাহা তুমি স্বচক্ষেই প্রত্যক্ষ করিয়াছ; কিন্তু সে যে কিরূপ গুণবতী, তাহা তুমি জান না। তাহার রূপ ও গুণ উভয়েই আমার কাল হইয়াছে, এবং আমি তাহাকে আমার অর্দ্ধাঙ্গী করিব বলিয়া, কঠোর প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়াছি। এরূপ অবস্থায় বল দেখি ভাই! আমি কিরূপে মাতার ইচ্ছানুযায়ী কৰ্ম্ম করিতে সম্মত হইতে পারি, এবং কিরূপেই বা অপর স্ত্রীলোককে আমার সেই একই হৃদয়ে স্থান দিতে পারি?’
“অধরের সহিত এইরূপ কথাবার্তায় তাহার মনের ভাব উত্তমরূপে অবগত হইলাম। সেইদিবস সন্ধ্যার পরই অধরের বাড়ীতে গমন করিয়া তাহার মাতার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, এবং আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা তাঁহাকে কহিলাম। আরও কহিলাম, ‘আপনি যদি বামার সহিত অধরের বিবাহ দিতে অসম্মত হয়েন, তাহা হইলে পুত্রকে লইয়া মনের সুখে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করা আপনার কঠিন হইয়া উঠিবে। অধরের মাতা আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিলেন, এবং যাহাতে তিনি এই কার্য্য সম্পন্ন করিতে পারেন, তাহার সবিশেষ চেষ্টা করিবেন কহিলেন। আরও কহিলেন, ‘আত্মীয়স্বজন এবং জ্ঞাতিকুটুম্বদিগকে ডাকাইয়া তিনি এ বিষয়ের পরামর্শ করিবেন।’
“বৃদ্ধা কথায় যাহা বলিয়াছিলেন, কার্যেও দেখিলাম, ক্রমে তাহাই করিলেন। জ্ঞাতিকুটুম্ব এবং আত্মীয়স্বজনকে ডাকাইয়া এই বিবাহে কোনরূপে তাহাদিগের মত করাইয়া লইলেন; আর বামাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিলেন, অধরের সহিত পুনরায় বিবাহ করিতে সে সম্মত আছে, কি না। এইরূপে সমস্ত বন্দোবস্ত হইয়া গেল, বিবাহের দিন ও স্থির হইল। বিবাহ উপযোগী সমস্ত আয়োজন আরম্ভ হইল।
“নির্দ্ধারিত দিবসে বিবাহ-সভায় অধরের আত্মীয়স্বজন, এবং জ্ঞাতিকুটুম্ব, বন্ধু প্রভৃতি সকলেই উপস্থিত হইলেন। বন্ধুত্বের অনুরোধে আমিও সেইস্থানে উপস্থিত ছিলাম। এদেশীয় প্রথানুসারে কন্যাদান কন্যার বাড়ীতে সম্পন্ন হইয়া থাকে; কিন্তু এ বিবাহে তাহার ব্যতিক্রম ঘটিল। কন্যার পিতা তাহার কন্যাকে পুনরায় দান করিলেন সত্য; কিন্তু সে দান আপন বাড়ীতে না হইয়া, বরের বাড়ীতেই হইল। বৈষ্ণবদিগের বিবাহ পদ্ধতি আমাদিগের সদৃশ না হইলেও, তাহাদিগের নিয়মানুসারে এই বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল। জ্ঞাতিকুটুম্ব, আত্মীয়স্বজন এবং অতিথি-অভ্যাগত প্রভৃতিকে আহারাদি করাইয়া আমি সেই রাত্রির নিমিত্ত আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলাম।
“আমি বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিয়া কেবলমাত্র শয়ন করিয়াছি। এমন সময়ে অধর আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল ও কহিল, ‘সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইয়াছে, শীঘ্র আমার সহিত গমন করিয়া যদি ইহার কোনরূপ প্রতিবিধান করিতে পার—কর; নতুবা আমার যে কি অবস্থা হইবে, তাহা বলিতে পারি না!”
“অধরের কথা শ্রবণ করিয়া আমারও মনে ভয়ের উদয় হইল।” ভাবিলাম, বিবাহ রাত্রিতে আবার কি ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হইল! কি বিপদ, তাহাও হঠাৎ অধরকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হইল না; কিন্তু কি করি, জিজ্ঞাসা না করিলেও নয়, কাজেই তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—‘এরূপ সময়ে আবার হঠাৎ কি বিপদ উপস্থিত?’
“উত্তরে অধর কহিল, ‘বিপদের কথা কি কহিব ভাই! যাহার রূপ ধ্যান করিয়া এতদিবস জীবিত ছিলাম, যাহার জন্য মাতার ইচ্ছার বিপরীতেও কার্য্য করিতে প্রস্তুত ছিলাম, এবং পরিশেষে তোমার অকপট বন্ধুতার গুণে যাহাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহাকে হারাইয়াছি। সে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় পলায়ন করিয়াছে, বা কোন দুষ্ট লোক তাহাকে অপহরণ করিয়া আমার সর্ব্বনাশের পথ প্রস্তুত করিতে বসিয়াছে।’
“অধরের কথা শ্রবণ করিয়া ভাবিলাম, এ আবার কিরূপ হইল? বিবাহের রাত্রিতে কন্যা পলায়ন করিল কেন? বিশেষতঃ এ নামে কন্যা, কিন্তু বস্তুতঃ যুবতী; তাহার হিতাহিত সে উত্তমরূপে অবগত আছে। বিশেষতঃ তাহার অনিচ্ছায় এ বিবাহ সম্পন্ন হয় নাই। এরূপ অবস্থায় সে হঠাৎ পলায়ন করিবে কেন? এই প্রকার চিত্তার পর আমি অধরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কিরূপভাবে বামা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল?’
“উত্তরে অধর কহিল, ‘সে আমার সহিত বাসর গৃহেই ছিল। পাড়ার আরও কয়েকটি স্ত্রীলোক সেইস্থানে বসিয়া আমোদ আহ্লাদে নিযুক্ত ছিল। সেই সময়ে একটি জলপাত্র হস্তে লইয়া বামা গৃহ হইতে বহির্গত হইল। আমরা সকলেই ভাবিলাম, সেই শৌচাদি কোন প্রকার কার্য্যের নিমিত্ত বাহিরে গমন করিতেছে। এই ভাবিয়া কেহই কিছু বলিল না, বা কেহই তাহার সমভিব্যাহারে গমন করিল না। কিন্তু তাহার ফিরিতে যখন অতিশয় বিলম্ব হইল, তখন তাহার অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। সমস্ত স্থান উত্তমরূপে দেখা হইল, কিন্তু কোনস্থানেই তাহাকে পাওয়া গেল না। অনুসন্ধান করিতে আর কোনস্থান বাকি নাই, এরূপ অবস্থায় বল দেখি ভাই! সে কোথায় গমন করিল? আমার বোধ হয়, সে যখন বাহিরে গিয়াছিল, সেই সময় কোন দুষ্ট লোক তাহাকে অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে।’
“অধরের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমিও অতিশয় বিস্মিত হইলাম। যাহা হউক, বন্ধুর নবপত্নীর অনুসন্ধানের নিমিত্ত তখনই বন্ধুর সহিত আমার বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
“বন্ধুর নিকট যেরূপ শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহার বাড়ীতে গিয়াও সেইরূপ দেখিলাম। জানিলাম, বাস্তবিকই নববধূর কোন উদ্দেশ পাওয়া যাইতেছে না। পাড়ার সকলেই তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়া বিফল মনোরথ হইয়াছেন। তাহার পিতাও নিতান্ত চিন্তিতান্তঃকরণে একস্থানে স্থির ভাবে বসিয়া রহিয়াছেন।
“এইরূপ গোলযোগে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। পরদিবসও নানাস্থানে নববধূর অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু কোনস্থানেই তাহার কোনরূপ অনুসন্ধান পাওয়া গেল না।
“যে গ্রামে আমাদিগের বাসস্থান, তাহার প্রায় এক মাইল দূরে একটি প্রকাণ্ড বিল আছে। সেই বিলের চতুষ্পার্শ্বস্থিত জমীতে চাষ আবাদ হইয়া থাকে। কিন্তু উহার মধ্যস্থলে অগাধ জল, সেইস্থানে লোকজনের প্রায়ই যাতায়াত নাই। তবে মধ্যে মধ্যে ধীবরগণ মৎস্য ধরিবার নিমিত্ত ছোট ছোট নৌকাতে আরোহণ করিয়া, সেইস্থানে গমন করিয়া থাকে। আমাদিগের গ্রামের কয়েকজন ধীবর মৎস্য ধরিবার নিমিত্ত সেইদিবসও সেই বিলে গমন করিয়াছিল। সন্ধ্যার পর তাহাদিগের মধ্যস্থিত এক ব্যক্তির সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়, এবং কথায় কথায় তাহার নিকট হইতে অবগত হই যে, আজ মৎস্য ধরিবার সময় ধীবরগণ সেই বিলের মধ্য হইতে একখানি নূতন বস্ত্ৰ প্ৰাপ্ত হইয়াছে।
“ধীবরের মুখে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া যে ব্যক্তি বিলের ভিতর নূতন বস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহার নিকট গমন করিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে বস্ত্রের কথা স্বীকার করিল, ও বস্ত্রখানি আনিয়া আমার সম্মুখে রাখিয়া দিল। দেখিলাম, উহা প্রকৃতই একখানি নূতন শাড়ী। আরও দেখিলাম, বিবাহের সময় যেরূপ শাড়ী বামার পরিধানে ছিল, ইহাও সেই প্রকারের।
“যেরূপ স্থানে ধীবর এই শাড়ীখানি প্রাপ্ত হইয়াছে, সে প্রকার স্থানে এ প্রকারের বস্ত্রাদি প্রাপ্ত হওয়া একেবারেই অসম্ভব। একথা উক্ত ধীবরের প্রমুখাৎ অবগত হইয়া আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহের উদয় হইল। মনে হইল—কোন দুষ্ট লোক কোন প্রকারে বামাকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়া তাহাকে হত্যা করিয়াছেন, এবং তাহার লাস সেই বিলের অগাধ জলে নিক্ষেপ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। নতুবা এরূপ স্থানে বামার পরিহিত বস্ত্র পাওয়া যাইবে কি প্রকারে? বামার পরিহিত বস্ত্র প্রাপ্ত হওয়ার ব্যাপার জানিতে পারিয়া আমার মনে যে প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল, গ্রামের অধিবাসীবর্গের মধ্যে যিনি এ ঘটনা শ্রবণ করিলেন, তাঁহার মনেও সেই ভাবের উদয় হইল।
‘এই ঘটনা ক্রমে গ্রামস্থ চৌকিদারের কর্ণগোচর হওয়ায়, সে থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করিল। চৌকিদারের নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া, থানার দারোগা আমাদিগের গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যেরূপে বামা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইয়াছে, এবং যেরূপে তাহার পরিহিত বস্ত্র বিলের ভিতর পাওয়া গিয়াছে, তাহার সমস্ত অবস্থা আমাদিগের নিকট হইতে অবগত হইয়া দারোগাবাবুও স্থির করিলেন যে, বামা হতা হইয়াছে।
“এখন বামার লাসের অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। ডুবুরি নামাইয়া এবং জাল ফেলাইয়া সেই বিলের ভিতর তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করা হইল; কিন্তু কোনস্থানেই লাসের চিহ্ন পর্যন্তও পাওয়া গেল না। গ্রামের নিকটবর্তী স্থান সকল, ময়দান সকল, এবং জঙ্গল সকলের মধ্যেও লাসের অনুসন্ধান বিশিষ্টরূপে করা হইল; কিন্তু লাসের কোন ঠিকানাই হইল না।
“বামা বৈষ্ণবের কন্যা, এবং এতদিবস প্রথম পত্নীহীন বৈষ্ণবের পত্নী ছিল। তাহার জাতিব্যবসা ভিক্ষা উপলক্ষে সে গমনাগমন না করিত, এমন স্থানই নাই। সুতরাং সেই প্রদেশে তাহাকে না চিনিত, এমন লোকই ছিল না। বামা সৰ্ব্বজন-পরিচিত, সুতরাং পুলিসের অনুসন্ধানে ইহা অতিশয় উপকারে আসিল।
“দারোগাবাবু যখন আমাদিগের গ্রামে বামার অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময়ে একটি লোক আসিয়া অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত নির্জ্জনে তাঁহার সহিত কি পরামর্শ করিল, এবং পরিশেষে দারোগা বাবুকে সঙ্গে লইয়া গ্রাম হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, ‘আমি অপর কোন কার্য্যোপলক্ষে অন্য স্থানে গমন করিতেছি। সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গেলে, পুনরায় এইস্থানে আগমন করিব।’
“যে সময় দারোগাবাবু আমাদিগের গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া গমন করিলেন, সেই সময় সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। পরদিন বৈকালে তিনি পুনরায় আমাদিগের গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এবার তিনি একাকী নহেন, তাঁহার সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক। সেই স্ত্রীলোকটি কে, তাহা জানিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকটে গমন করিলাম। কিন্তু গিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। দেখিলাম, যাহার নিমিত্ত আমরা এত চিন্তিত, ইনি আমার বন্ধুর সেই নব-পরিণীতা স্ত্রী বামা। ইহাকে দেখিয়া আমরা সকলেই যেমন বিস্মিত হইলাম, বিবাহ বাসর হইতে কেন সে পলায়ন করিল, তাহা জানিবার নিমিত্ত মনে তেমনই কৌতূহল জন্মিল। ইহার ব্যাপার দারোগা মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কহিলেন, ‘বামা হঠাৎ কেন পলায়ন করিয়াছিল, তাহার সন্তোষজনক উত্তর সেই আপনাদিগকে প্রদান করিবে; আমি ইহার কিছুমাত্র অবগত নহি।’ এই বলিয়া কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহার প্রকৃতকথা আমাদিগের নিকট বর্ণন করিবার নিমিত্ত তিনি বামাকে আদেশ করিলেন। দারোগা বাবুর আদেশ পাইয়া বামা তাহার পলায়ন বৃত্তান্ত সেইস্থানে সর্ব্বসমক্ষে বলিতে আরম্ভ করিল।
“বামার এই কথা শুনিবার নিমিত্ত সেইস্থান লোকাকীর্ণ হইয়া পড়িল। গ্রামস্থ পুরুষমাত্রই প্রায় সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমার বন্ধু অধরচন্দ্র সেইস্থানেই উপস্থিত ছিল, বামার পিতাও আসিয়া আমাদিগের নিকট উপবেশন করিল। বৈষ্ণবের কন্যামাত্রেরই প্রায় লজ্জার ভাগ কিছু অল্প হইয়া থাকে। সুতরাং বামা এই সকল লোকের মধ্যে বসিয়া যে তাহার আত্মকাহিনী অবলীলাক্রমে বর্ণন করিবে, তাহার আর বিচিত্র কি?
“বামা কহিল, ‘আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, বহুদিবস হইতে আমি গৌরমোহন দাসকে বিবাহ করিয়া এই গ্রামে বাস করিতেছি। আরও আপনারা জানেন যে, তিনি তাঁহার একজন বন্ধু ক্ষেত্রমোহন দাস বাবাজী নামক জনৈক বৈষ্ণবের সহিত তীর্থপর্যটন করিবার মানসে শ্রীবৃন্দাবনে গমন করেন, এবং সেইস্থানে উভয়েই কালগ্রাসে পতিত হন। স্বামীর মৃত্যুর পর এতদিবস আমি সৎপথে থাকিয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া, কোনরূপে আপন জীবন যাপন করিয়া আসিতেছিলাম। কিন্তু এরূপভাবে একাকী একস্থানে অবস্থান পূর্ব্বক দিনপাত করা, একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। কারণ, অসহায়া রমণীর উপর কখন যে কিরূপ বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইবে, তাহা অনুমান করা আমাদিগের মত স্ত্রীলোকের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। আমার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া এবং আমার পরিণাম ভাবিয়া, পুনরায় পিতা আমার বিবাহ দিতে সঙ্কল্প করেন, আর সময় মত তাঁহার মনের কথা আমার নিকট প্রকাশ করেন। আমি তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হই, এবং পরিশেষে এই অধরচন্দ্র দাসের সহিত আমার পুনরায় বিবাহ হইয়া যায়।
“আমার পূর্ব্ব স্বামীর বন্ধু ক্ষেত্রমোহন দাসের বাসস্থান এ গ্রামে নহে, বা কোন্ গ্রামে যে তাঁহার বাসস্থান, তাহাও আমি অবগত নহি। কিন্তু প্রায়ই তিনি আমার স্বামীর নিকট আগমন করিতেন বলিয়া, আমি তাঁহাকে উত্তমরূপে চিনিতাম।
“অধরচন্দ্রের সহিত যখন আমার পুনরায় বিবাহ হয়, সেই সময় অপরাপর লোকের মধ্যে হঠাৎ একটি লোকের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হওয়ায়, আমি সবিশেষরূপে আশ্চৰ্য্যান্বিত হই; কিন্তু হঠাৎ আমার চক্ষুতে বিশ্বাস না করিয়া পুনরায় তাহাকে উত্তমরূপে দেখি, দেখিলাম, আমার পূর্ব্বস্বামীর বন্ধু ক্ষেত্রমোহন দাস যিনি আমার স্বামীর সহিত বৃন্দাবন লাভ করিয়াছেন, তিনিই স-শরীরে আমার সম্মুখে উপস্থিত। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে যে কি এক প্রকার অনির্বচনীয় ভাবের উদয় হইল, তাহা আপনারাই বিবেচনা করিয়া দেখুন। সেই সময় আমার মন এরূপ চিন্তায় অভিভূত হইয়া পড়িল যে, কিরূপে বা কখন আমার বিবাহ কাৰ্য্য সমাপ্ত হইয়া গেল, তাহা আমি কিছুমাত্র জানিতে পারিলাম না।
“ইহার পর বাস গৃহ হইতে আমি যখন বাড়ীর বাহিরে গমন করি, সেই সময় আমি পুনরায় তাহাকে দেখিতে পাই। আমাকে দেখিবামাত্র সে ক্রোধভরে আমাকে কহে, ‘পাপীয়সি! এক স্বামী বর্ত্তমান থাকিতে তুই পুনরায় বিবাহ করিতেছিস্, তোর মত নীচান্তঃকরণ-বিশিষ্ট স্ত্রীলোক বারবনিতাগণের মধ্যেও আছে কি না, তাহাতে সন্দেহ আছে! তোর চরিত্রের উপর যে সন্দেহ করিয়া তোর স্বামী আমাকে দেখিতে পাঠাইয়াছিল, এক্ষণে কার্য্যেও দেখিলাম, তাহার সেই সন্দেহ মিথ্যা নহে। তুই কুল-কলঙ্কিনী! বিশ্বাসঘাতিনী! ব্যভিচারিণী হইয়া, এক স্বামী বর্তমান থাকিতে পুনরায় অপরের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইতেছিস?’
“ক্ষেত্রমোহন দাসের এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া আমি হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম, ও চতুর্দিক অন্ধকার দেখিয়া সেই অন্ধকার রজনীতে সেইস্থানে বসিয়া পড়িলাম, এবং পরিশেষে তাহাকে কহিলাম, “কি? আমার স্বামী এখনও জীবিত? ইহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে আমি কি সর্ব্বনাশই করিয়াছি! এখন কি করিব বলুন? কি করিলে—এখন সর্ব্বদিক রক্ষা হয়। আমার স্বামী এখন কোথায়?’
“আমার কথার উত্তরে ক্ষেত্রমোহন কহিল, ‘নানাস্থান পর্য্যটন করিয়া আমরা উভয়েই প্রত্যাগমন করিয়াছি। তোমার স্বামী গৌরমোহন দাস এখন আমাদিগের বাড়ীতেই আছেন, এরূপ অবস্থায় এখনই এইস্থান হইতে পলায়ন ব্যতীত আর কোন সদুপায় আমি দেখিতেছি না। এই অবস্থাতেই তুমি আমার সহিত আইস; আমি তোমাকে তোমার স্বামীর নিকট লইয়া যাই। তুমি এখনই আমার সহিত তোমার স্বামীর নিকট গমন করিলে, তিনি ইহার কিছুই জানিতে পারিবেন না। সুতরাং তোমার সকলদিক্ রক্ষা পাইবে!”
“ক্ষেত্রমোহনের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি আর কোন কথা বিবেচনা করিবার অবকাশ পাইলাম না, বিনা—বাক্যব্যয়ে তখনই আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। সেই নিশীথ রাত্রিযোগে এইরূপে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া সেই সামান্য পরিচিত পুরুষের সহিত গমন করিতে লাগিলাম। সেই সময় আমি এরূপ হিতাহিত জ্ঞান-বাৰ্জ্জিত হইয়াছিলাম যে, কি কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, তাহা তখন নিজেই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু ছায়ার ন্যায় তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। ক্রমে গ্রাম অতিক্রম করিয়া ময়দানের মধ্যে উপস্থিত হইলাম।
“সেই সময় ক্ষেত্রমোহন তাহার নিকট হইতে একখানি বস্ত্র বাহির করিয়া আমাকে প্রদান করিল এবং কহিল, “তোমার পরিধানে যে বস্ত্র আছে, তাহা এখনই পরিবর্তন করিয়া লও। কারণ, এই বিবাহ-বস্ত্র পরিহিত দেখিলে, তোমার স্বামীর মনে সন্দেহ হইতে পারে। ক্ষেত্রমোহনের কথা যুক্তিপূর্ণ দেখিয়া আমি আমার পরিহিত বস্ত্র সেইস্থানেই পরিবর্তন করিয়া লইলাম, ও পুনরায় ক্ষেত্রমোহনের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। যখন আমরা বিলের নিকটে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন ক্ষেত্রমোহন আমার পরিত্যক্ত বস্ত্র সেই বিলের ভিতর নিক্ষেপ করিল।
“এইরূপে আমি যে কতদূর গমন করিলাম, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু ক্ষেত্রমোহন আমাকে একখানি বাড়ীতে লইয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, ‘তুমি এইস্থানে অবস্থিতি কর। এইস্থানেই তোমার স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ হইবে।’ ক্ষেত্রমোহনের কথায় বিশ্বাস করিয়া আমি সেই অপরিচিত বাড়ীতে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। সেই বাড়ীতে অপর জন-মানব কেহই ছিল না। সুতরাং আমার মনে মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। যাহা হউক, আমি আমার স্বামীর দর্শন-লালসার সেইস্থানেই অবস্থিতি করিলাম; কিন্তু আমার স্বামীকে দেখিতে পাইলাম না। অধিকন্তু যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মনে নিতান্ত ভয়ের সঞ্চার হইল। স্বামীর পরিবর্তে অধর্ম্মের ছায়া আসিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত হইল। বলিতে কি, রাত্রিকালে ক্ষেত্রমোহন আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং আমার ধর্ম নষ্ট করিবার মানসে প্রথমে নানা ছল অবলম্বন করিল; কিন্তু তাহাতে যখন সে কিছুতেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিল না, তখন বুঝিলাম, তাহার মনোভীষ্ট সিদ্ধ করিবার নিমিত্ত আমার উপর বল-প্রয়োগ করিতেও সে পরাঙ্মুখ নহে। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমিও তাহার সহিত ছল অবলম্বন করিলাম, এবং কৌশলে সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া সেই রাত্রিকালে সেইস্থান হইতে একাকী প্রস্থান করিলাম। কিন্তু কোথায় যে গমন করিলাম, তাহা বলিতে পারি না। সমস্ত রাত্রি কেবল চলিতেই লাগিলাম, ক্রমে রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে সেই দুর্বৃত্তের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া, কোনরূপে আপন ধর্ম্ম রক্ষা করিয়া আমার গ্রামে চলিয়া আসিতেছিলাম। ইতিমধ্যে একখানি গ্রামে দারোগাবাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়, ও সেইস্থান হইতে তিনিই আমাকে সঙ্গে করিয়া এইস্থানে আনয়ন করেন।” এই কথা বলিয়া বামা চুপ করিল।
বামার এই অদ্ভুত কথা শ্রবণ করিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন, এবং ক্ষেত্রমোহনের প্রতি সহস্র গালিবর্ষণ করিতে লাগিলেন। বামা যেরূপভাবে তাহার আত্মকাহিনী বর্ণন করিল, তাহাতে কেহই তাহার কথায় কোনরূপ অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না; অধিকন্তু সকলেই তাহার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ক্ষেত্রমোহন দাস যে কে, তাহা জানিবার নিমিত্ত সকলেই উৎসুক হইলেন। কিন্তু বামা তাহার সম্বন্ধে আর অধিক কিছু সংবাদ প্রদান করিতে পারিল না, বা কোন্ গ্রামে যে তাহার বাসস্থান, তাহাও বলিতে পারিল না।
বামার আত্মকাহিনী যখন আমরা বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতেছিলাম, দারোগাবাবুও সেইস্থানে উপবেশন করিয়া তাহার সমস্ত কথা শ্রবণ করিতেছিলেন। বামার কথা শেষ হইলে তিনি কিছুই বলিলেন না, কিন্তু তাহার মুখমণ্ডলে যেন একটু হাসির জ্যোতিঃ প্রকাশ পাইল। সে হাসির অর্থ সেই সময় যদিচ আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম না; কিন্তু পরে বুঝিয়াছিলাম, এবং শ্রোতৃগণও পরে বুঝিতে পারিবেন।
বন্ধু অধরচন্দ্র তাঁহার স্ত্রীকে পুনরায় প্রাপ্ত হইয়া যে কি পৰ্য্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগলেন, তাহা আর কি বলিব? পরিশেষে তিনি তাঁহার স্ত্রীকে আপন অন্তঃপুরের ভিতর লইয়া গেলেন। গ্রামস্থ সমস্ত লোকই ক্রমে আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিল, দারোগাবাবুও আমাদিগের গ্রাম পরিত্যাগ করিলেন। কিরূপ অবস্থায় এবং কোথায় যে তিনি বামাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা তাহাকে বার বার জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু তিনি কোন রূপেই তাহার উত্তর প্রদান করিলেন না, কেবলমাত্র এইমাত্র কহিলেন, ‘সময় মত তোমরা সকলেই ইহা জানিতে পারিবে।’
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এই ঘটনার পর কয়েক বৎসর অতীত হইয়া গেল। প্রথমতঃ কিছুদিবস বামা তাহার স্বামী অধরচন্দ্র ও তাহার শাশুড়ীর সহিত অধরের বাড়ীতেই বাস করিল। কিন্তু কিছুদিবস একত্র বাস করিতে করিতে জানি না, কি কারণে উভয় স্ত্রীলোকের মধ্যে মনোবিবাদ উপস্থিত হইল। অধরের মাতা সবিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া আপনার পুত্রের সহিত যে বামার বিবাহ দিয়াছিলেন, এবং যাহাকে লইয়া চিরদিবস মনের সুখে কালাতিপাত করিতে পারিবে মনে করিয়াছিলেন, সেই বামার সহিত ক্রমে তাঁহার মনোবিবাদ পরিলক্ষিত হওয়ায়, তিনি মনে মনে বড়ই আন্তরিক কষ্ট উপভোগ করিতে লাগিলেন। এই কারণে অধরও যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া মনের কষ্টে কয়েক দিবস অতিবাহিত করিল। প্রথম প্রথম অধর ভাবিয়াছিল যে, এ বিবাদ চিরস্থায়ী নহে, প্রত্যেক সংসারে পরিবারবর্গের মধ্যে সময় সময় যেরূপ মনোবিবাদ ঘটিয়া থাকে, ইহাও তাহাই। কিছুদিবসের মধ্যে এ বিবাদের চিহ্নও থাকিবে না; পুনরায় সংসারে শান্তি বিরাজ করিবে। এইরূপ ভাবিয়া অধর প্রথমে কাহারও পক্ষ অবলম্বন করিল না, নিরপেক্ষ ভাবে দিনযাপন করিতে লাগিল।
এইরূপ কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, উভয়ের মনোবিবাদ ক্রমে হ্রাস হইবার পরিবর্তে আরও বর্দ্ধিত হইতেই লাগিল। কি কারণে উভয়ের মধ্যে যে এইরূপ মনোবিবাদ আরম্ভ হইল, অধর তাহার প্রকৃত কারণ অবগত হইতে পারিল না, বা জিজ্ঞাসা করিয়াও কাহারও নিকট হইতে সন্তোষজনক উত্তর প্রাপ্ত হইল না।
সেই সময় একদিবস অধরের মাতা আপনার পুত্রকে ডাকাইলেন। অধরচন্দ্র নিকটে আসিলে কহিলেন, ‘তোমার পত্নীকে লইয়া একত্র বসবাস করিবার নিমিত্ত আমি অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না। আমার বিশ্বাস—যতদিবস সে এই বাড়ীতে থাকিবে, বা আমি এই বাড়ীতে থাকিব, ততদিবস বামা কোন প্রকারেই সন্তুষ্ট থাকিবে না। তাহার ইচ্ছা—সে একাকী এক বাড়ীতে বাস করে। এরূপ অবস্থায় তাহাকে পৃথকভাবে রাখিতে তোমরা কোনরূপ বন্দোবস্ত কর, না কর, তোমার বিবেচনার উপর নির্ভর করে। আমার বিবেচনায় যদি সে পৃথকভাবে একাকী বাস করে, তাহা হইলে তাহার পরিণাম অতিশয় শোচনীয় হইবে, এবং তোমাকে নানারূপ মনোকষ্ট সহ্য করিতে হইবে। এইরূপ অবস্থায় আমার মনের কথা তোমাকে বলিয়া, আমার কর্ত্তব্য কর্ম্ম আমি প্রতিপালন করিলাম। এখন তোমার যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহা তুমি করিতে পার।’
এই ঘটনার তাতি অল্পদিন পরেই সামান্য ছল অবলম্বন করিয়া বামা শ্বাশুড়ীর সহিত বিবাদ করিল, এবং কাহাকেও কিছু না বলিয়া বর্তমান স্বামীর বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক, তাহার পূর্ব্বস্বামী গৌরমোহনের বাড়ীতে গমন করিল।
গৌরমোহনের মৃত্যুসংবাদ পাইবার পর, বামা সেই বাড়ীতেই অবস্থিতি করিতেছিল, তাহা আপনারা পূৰ্ব্ব-হইতে অবগত আছেন। কিন্তু পুনরায় বিবাহের পর বামা সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া, তাহার নব-স্বামীর বাড়ীতেই অবস্থিতি করিতেছিল। কোন লোকজন না থাকায় গৌরমোহনের বাড়ী একবারে হতশ্রী হইলেও, ঘর দরজা প্রভৃতি এখনও পতিত হয় নাই। সুতরাং বামা অনায়াসেই সেই গৃহে এক্ষণে বাস করিতে লাগিল।
কুহকিনী বামার প্রণয়-কুহকে অধরচন্দ্র এরূপ মোহিত হইয়া পড়িয়াছিল যে, বামার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাৰ্য্য করিবার ক্ষমতা অধরের একেবারেই ছিল না। বামা যাহা বলিত, ইচ্ছাতেই হউক বা অনিচ্ছাতেই হউক, অধরকে তাহা করিতে হইত। সুতরাং বামা তাহার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করাতেও অধর তাহার প্রতিবাদ করিতে কোনরূপেই সমর্থ হইল না। বরং তাহাকে পরিশেষে তাহার মতেই মত দিতে হইল, ও মনে করিল, মাতা ও স্ত্রী উভয়ের মধ্যে যখন ক্ষণকালের নিমিত্তও মনের মিল নাই, তখন উভয়ে পৃথক্ পৃথক্ স্থানে অবস্থিতি করিলে যদি উভয়ের বিবাদ ভঞ্জন হইয়া যায়, তাহাতে ইষ্টভিন্ন অনিষ্টের সম্ভাবনা নাই। এই ভাবিয়া অধর উভয়কে পুনরায় একত্র রাখিবার নিমিত্ত আর কোনরূপ চেষ্টা করিল না। এদিকে যে দিবস হইতে বামা একান্তে বাস করিতে লাগিল, সেইদিবস হইতে তাহারও মনের ভাব পরিবর্তিত হইল। তাহার সেই সময়ের অবস্থা বা তাহার কথাবার্তা শ্রবণ করিয়া এরূপ মনে হইল না যে, এরূপ স্ত্রীলোক কখন বিবাদ-বিসম্বাদে নিযুক্ত হইতে পারে। অধর এইরূপে শান্তিলাভ করিয়া কিছুদিবস মনের সুখে কালযাপন করিল।
বন্ধু-পত্নীর স্বভাবের এইরূপ হঠাৎ পরিবর্তন দেখিয়া, এবং অধরের মাতা অধরকে তাহার স্ত্রী একাকী বাস করা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছিল, তাহা হঠাৎ আমার মনে উদয় হওয়ায়, আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহের উদয় হইল। কিন্তু আমি আমার বন্ধুকে কোন কথা না বলিয়া বামার চাল-চলন, এবং চরিত্র সম্বন্ধে গোপনে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। কয়েক দিবস গোপনে অনুসন্ধান করিয়া বামার চরিত্র সম্বন্ধে আমি যাহা অবগত হইলাম, তাহাতে আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইল। ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান-বৰ্জ্জিত হইয়া পড়িলাম, ও বামা সম্বন্ধে কি করা উচিত বা অনুচিত, মনে মনে তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলাম। একবার ভাবিলাম, আমি যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহা আমি বন্ধুকে বলিয়া দিই। তাহার বিবেচনা-মত যাহা ভাল হয়, সে তাহা করিবে। আবার ভাবিলাম, এরূপ সংবাদ যে পর্য্যন্ত বন্ধু আপনা-আপনি অবগত হইতে না পারে, সেই পর্যন্ত তাহাকে বলিয়া তাহার হৃদয়ে বিষম দুঃখের সূত্রপাত করিয়া দেওয়া বন্ধুর কার্য্য নহে। এই ভাবিয়া মনের কথা মনেই রাখিলাম। বন্ধুর নিকটে সেই সকল কথা ঘূণাক্ষরেও প্রকাশ করিলাম না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বামার চরিত্র-সম্বন্ধে আমি যে সকল বিষয় সেই সময় অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা বন্ধুর নিকট সেই সময় প্রকাশ না করিলেও, এখন আপনাদিগের নিকট তাহা প্রকাশ করিতেছি।
জানিতে পারিয়াছিলাম,—বিবাহ বাসর হইতে পলায়ন করিবার পর পুনরায় যখন তাহাকে পাওয়া যায়, সেই সময়ে সে যে সকল কথা বলিয়া তাহার উপর আমাদিগের বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছিল, তাহার সমস্তই মিথ্যা। গৌরমোহনের মৃত্যুসংবাদ পাইয়া যে সময় সে একাকী তাহার বাড়ীতে বাস করিত, সেই সময় হতভাগিনী একজনের অবৈধ-প্রণয়ে আবদ্ধ হইয়া তাহার সতীত্ব রত্ন নষ্ট করিয়া ফেলে। এই সকল কাৰ্য্য সে এত গোপনে সম্পন্ন করে যে, গ্রামে কোনও ব্যক্তি ইহার আভাষ পর্যন্তও প্রাপ্ত হয় নাই। যে পুরুষের সহিত সে এই রূপ অবৈধ-প্রণয়ে আবদ্ধ হয়, তাহার বাসস্থান একে আমাদিগের গ্রামে নহে, তাহাতে অধিক রাত্রিতে সে একাকী আসিয়া সেই নির্জ্জন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিত বলিয়া, কেহই এ বিষয় কিছুমাত্র জানিতে পারিত না।
ইহার কিছুদিবস পরেই আমার বন্ধু অধরেরও কপাল পুড়িয়া যায়; সেও এই পিশাচিনীর রূপে ও মায়ায় এরূপ অভিভূত হইয়া পড়িল যে, পরিশেষে অন্যকে বিবাহ করিতে সম্মত না হইয়া, এই হতভাগিনীকেই আপনার অর্দ্ধাঙ্গীরূপে বরণ করিল। যে সময় বামা অধরের সহিত অবৈধ-প্রণয়ে আবদ্ধ হয়, তাহার কয়েক মাস পূর্ব্বে তাহার পূর্ব্ব প্রণয়ী কোন একটি ফৌজদারী মোকদ্দমায় জড়ীভূত হইয়া পড়ে, এবং প্রাণের ভয়ে আপন গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে পলায়ন করে। পুলিস ইহার অনেক অনুসন্ধান করেন; কিন্তু কোনস্থানেই ইহাকে সন্ধান করিতে না পারিয়া, ইহার নামে এক গ্রেপ্তারী ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দেন। এই কারণে রাত্রিকালে বামার বাড়ীতে আগমন করাও তাহার বন্ধ হইয়া যায়। তখন বামা উহার মায়া পরিত্যাগ করিয়া আমার বন্ধুর সহিত গুপ্ত প্রণয়ে আবদ্ধ হয়; এবং পরে কণ্ঠি পরিবর্তনই বলুন বা বিবাহই বলুন, তাহাও হইয়া যায়।
বিবাহের সময় অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে বামা তাহার পূর্ব্ব প্রণয়ীকে দেখিতে পায়। জানি না, সে কোথা হইতে সেই সময়ে হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। পূৰ্ব্ব প্রণয়ীকে দেখিতে পাইয়া তাহার পূর্ব্ব প্রণয় উথলিয়া পড়ে, এবং কোনরূপে আপন মনের বেগ সম্বরণ করিতে না পারিয়া, সেই বাড়ীর নিকটবর্তী কোনস্থানে অপেক্ষা করিবার নিমিত্ত তাহাকে সঙ্কেত করে। সঙ্কেতানুযায়ী প্রণয়ী সেইস্থানেই প্রণয়ীর নিমিত্ত অপেক্ষা করে। পরে সময়-মত বামা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া তাহার পূর্ব্ব প্রণয়ীর সহিত মিলিত হয়, এবং তাহারই সহিত সেইস্থান হইতে পলায়ন করে।
উভয়েরই ইচ্ছা ছিল—উভয়েই কোন অপরিচিত স্থানে গমন করিয়া সুখে দিন অতিবাহিত করিবে। আরও ভাবিয়াছিল, সেই বিলের ভিতর তাহার বিবাহের বস্ত্র প্রাপ্ত হইলে, সকলে সহজেই মনে করিবে যে, কোনরূপে বামা সেই বিলের ভিতর ডুবিয়া মরিয়াছে। সুতরাং কেহই আর তাহার অনুসন্ধান করিবে না, এদিকে উভয়ে নির্ব্বিবাদে সুখভোগ করিতে সমর্থ হইবে। উহারা যাহা ভাবিয়াছিল, কাৰ্যে কিন্তু তাহা পরিণত করিতে পারিল না। দারোগাবাবু আসিয়া এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবার পরই প্রকৃত ঘটনা তাঁহার কর্ণগোচর হইল। প্রণয়ীর জনৈক শত্রু এই সংবাদ জানিতে পারিয়া, চুপি চুপি আমাদিগের গ্রামের দারোগাবাবুর নিকট গমন করিল, এবং বহুদিবসের সেই ফেরারী আসামীকে ধরাইয়া দিবার নিমিত্ত আমাদিগের গ্রাম হইতে তাহাকে লইয়া গেল। যে গ্রামে সে বামাকে লইয়া লুক্কায়িত ভাবে অবস্থিতি করিতেছিল, দারোগাবাবু সেই গ্রামে উপস্থিত হইতে না হইতেই সে তাহা জানিতে পারিয়া, বামাকে সেই গ্রামের বাহিরে পরিত্যাগ পূর্ব্বক প্রাণভয়ে আপনি পলায়ন করিল। দারোগাবাবু তাহার নিমিত্ত অনেক অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোনস্থানেই তাহার আর কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না। অপরন্তু সেই গ্রামের বাহিরে একটি ময়দানের ভিতর বামাকে প্রাপ্ত হইলেন। বামা আমাদিগকে যে সকল কথা বলিয়া বুঝাইয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিয়া দারোগাবাবুও তাহার নিকট হইতে তাহাই জানিতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি প্রকৃতকথা পূৰ্ব্বেই অবগত হইতে পারিয়াছিলেন বলিয়া, ইহার কোন কথা বিশ্বাস করিলেন না; বরং ইহাকে সঙ্গে করিয়া আমাদিগের গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। উঃ! দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোকের কি ভয়ঙ্করী বুদ্ধি! সে একবারে সমস্ত মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগকে বেশ বুঝাইয়া দিল যে, তাহার কোনরূপ দোষ নাই! আর আমরা তাহার চক্রান্তের ভিতর প্রবেশ করিতে না পারিয়া তাহাই বুঝিলাম, ও তাহাকে গৃহে স্থান প্রদান করিলাম!
এই ঘটনার কিছুদিবস পরেই তাহার সেই পূৰ্ব্ব প্রণয়ী গোপনে আগমন করিয়া, বামার সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিতে লাগিল। কিন্তু বাড়ীর ভিতর তাহার শাশুড়ী সৰ্ব্বদা থাকিত, অথচ সে এখন গৃহস্থের স্ত্রী। সুতরাং ইচ্ছামত বাহিরেও যাইতে পায় না। এইরূপে পূর্ব্ব প্রণয়ীর সহিত তাহার কথাবার্তা বা আলাপ পরিচয় করিবার জন্য সবিশেষ অসুবিধা ঘটিতে লাগিল। এই নিমিত্ত সামান্য সামান্য কারণ অবলম্বন করিয়া সে শাশুড়ীর সহিত কেবল বিবাদ করিতে প্রবৃত্ত হইল। কারণ, তাহার আন্তরিক ইচ্ছা এই ছিল যে, তাহার স্বামী অনবরত এইরূপ বিবাদ সহ্য করিতে না পারিয়া, তাহাকে কোন পৃথক স্থানে রাখিয়া দিবে, তাহা হইলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবে। কারণ, সেইস্থানে সময় মত সে উপপতি এবং পতিকে লইয়া আমোদ আহ্লাদে দিনযাপন করিতে পারিবে। বামা যখন দেখিল, তাহার স্বামী আপন ইচ্ছায় তাহাকে স্থানান্তরিত করিল না, তখন সে নিজের উপায় নিজেই দেখিল। সামান্য কারণে আপনার শাশুড়ীর সহিত বিবাদ করিয়া আপনার পূর্ব্বের নির্জ্জন বাড়ীতে গিয়া অবস্থিতি করিতে লাগিল, এবং সেইস্থানে আপনার মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ করিতে লাগিল। এদিকে বিবাদ বিসম্বাদও মিটিয়া গেল। কিন্তু আমার বন্ধু তাহার স্ত্রীর চরিত্র এবং ভিতরের অবস্থা কিছুমাত্র অবগত হইতে না পারিয়া দিনযাপন করিতে লাগিল। আমি আমার মনের কথা মনেই রাখিলাম। আপন স্ত্রীকে পর্য্যন্তও ইহার কিছুমাত্র আভাষ প্রদান করিলাম না।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, এক ঘোর রাত্রি আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি যতদিবস বাঁচিব, সেই ভয়ানক রাত্রির কথা আমি কখনই বিস্মৃত হইব না। বহুদিবস হইল, সেই রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু আমার হৃদয়ে সেই রাত্রির কার্য্য সকল এখনও জাগরূক রহিয়াছে। এখনও বোধ হইতেছে, সেই রাত্রির ঘটনা সকল এখনও আমার চক্ষের উপর বিদ্যমান। সেই ঘোর রাত্রিতে আমি আমার গৃহের ভিতর আপন স্ত্রী-পুত্র লইয়া মনের সুখে শয়ন করিয়াছিলাম,—সেই আমার শেষ শয়ন! সেই সময় আমার বন্ধুর স্বরে হঠাৎ আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। বুঝিলাম, বন্ধু নিতান্ত ভয়-বিহ্বল অন্তঃকরণে বাহির হইতে ধীরে ধীরে আমাকে ডাকিতেছে। আমি গৃহ হইতেই জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে? বন্ধু? ‘
বন্ধু উত্তরে কহিল, ‘হাঁ, আমি অধর।’
আমি। এত রাত্রিতে কি মনে করিয়া?
অধর। একবার শীঘ্র বাহিরে আইস, বলিতেছি।
আমি। তুমিই ভিতরে আইস না কেন?
অধর। আমার ভিতরে যাইবার অধিকার নাই, তুমিই বাহিরে আইস।
বন্ধুর এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না, আমি আস্তে আস্তে গাত্রোত্থান করিয়া গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। আমার স্ত্রী ও অল্পবয়স্কা বালকটি সেই সময়ে নিদ্রিত ছিল। বন্ধু আসিয়া যেরূপভাবে আমাকে উঠাইয়া বাড়ীর বাহিরে আনিল, তাহা তাহারা কিছুমাত্র অবগত হইতে পারিল না। আমিও তাহাদিগকে কিছুমাত্র না বলিয়া, চোরের ন্যায় আপন গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। ভাবিলাম, বন্ধুর কথা শ্রবণ করিয়া যখন এখনই আবার গৃহে আসিয়া শয়ন করিব, তখন আর উহাদিগকে উঠাইবার প্রয়োজন কি? কিন্তু মহাশয়! যাহা ভাবিয়া গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছিলাম, কার্য্যে তাহার বিপরীত হইল। জানি না, কি কুক্ষণে গৃহের বাহিরে পদার্পণ করিয়াছিলাম! সেই রাত্রিতে যে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছি, আজ পর্যন্ত আর সে গৃহে পদার্পণ করিতে পারি নাই। পারিব কি না, তাহাও জানি না। যাহা হউক, গৃহ হইতে বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, বন্ধু সম্মুখে দণ্ডায়মান। কিন্তু দিবাভাগে তাহাকে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, সে এখন তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব ধারণ করিয়াছে। মুখ শুষ্ক, চক্ষু রক্তবর্ণ, বর্ণ যেন আরও বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। মুখ হইতে সহজে কথা বাহির হইতেছে না, এবং মধ্যে মধ্যে এদিক্ ওদিক্ কি যেন দেখিতেছে। বন্ধুর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সংবাদ কি, ভাল ত।’ আমার কথা শ্রবণ করিয়া বন্ধু হঠাৎ তাহার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিল না, বা যে স্থানে দণ্ডায়মান ছিল, সেইস্থানে আর দাঁড়াইতেও না পারিয়া, সেইস্থানের মৃত্তিকার উপর উপবেশন করিল। ইহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমারও মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি এরূপ করিতেছ কেন? এবং এরূপ অবস্থায় আমার নিকট কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছ?”
অধর। সর্ব্বনাশ হইয়াছে!
আমি। সৰ্ব্বনাশ? কি সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে?
অধর। হত্যা!
আমি। হত্যা? কে হত হইয়াছে?
অধর। বামা, আমার স্ত্রী বামা।
আমি। কে তাহাকে হত্যা করিল?
অধর। আমি।
আমি। তুমি? সৰ্ব্বনাশ! বল কি? কেন তাহাকে হত্যা করিলে?
অধর। কেন? অবিশ্বাসিনীকে হত্যা না করিয়া, কে স্থির থাকিতে পারে?
আমি। বামা অবিশ্বাসিনী, একথা তুমি জানিলে কি প্রকারে?
অধর। জানিতে পারিয়াছিলাম বলিয়া, এই অবস্থা ঘটিয়াছে। এখন উপায় কি?
আমি। উপায় হইবে। এখন কিরূপ অবস্থায় এবং কিরূপে তাহাকে হত্যা করিয়াছ, তাহা বেশ মন স্থির করিয়া বল দেখি। সমস্ত অবস্থা শ্রবণ না করিলে কোন উপায় অবলম্বন করিব, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিব না।
অধর। প্রায় এক মাস অতীত হইল, এক রাত্রিতে অনিয়মিত সময়ে হঠাৎ আমি আমার স্ত্রীর বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম। গমন করিয়া দেখি—সদর দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। দ্বার খুলিয়া দিবার নিমিত্ত আমি বামাকে বারম্বার ডাকি, কিন্তু অন্য দিবস দুই এক বার ডাকিলেই সে যেমন দ্বার খুলিয়া দেয়, সেইদিবস কিন্তু সেইরূপ ভাবে দ্বার খুলিয়া দেয় নাই। দ্বার খুলিতে অনেক বিলম্ব হয়। দ্বার খোলার পর আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া নিয়মিতরূপ উপবেশন করি। সেই সময় আমার বোধ হয়, বাড়ীর ভিতর হইতে যেন একটি লোক বহির্গত হইয়া চলিয়া যায়। বামাকে বলায়, সে আমার কথা একবারে অগ্রাহ্য করিয়া উড়াইয়া দেয়, এবং আমি জাগিয়া জাগিয়া স্বপ্ন দেখিতেছি বলিয়া, আমাকে অনেক ঠাট্টা তামাসাও করে। এই ঘটনার পাঁচ সাত দিবস পরে পুনরায় সেইরূপ অবস্থা ঘটে, সেইদিবসও বামা অনেক বিলম্ব করিয়া দ্বার খুলিয়া দেয়, এবং সেইরূপে একটি মনুষ্যমূর্ত্তি বহির্গত হইয়া যাইতে দেখিতে পাই। এবারেও একথা বামাকে বলায় সে হাসিয়া উড়াইয়া দেয়। সেইদিবস বামার চরিত্র সম্বন্ধে প্রথম আমার মনে সন্দেহ হয়, এবং সেইদিবস হইতে আমি গুপ্তভাবে বামার উপর দৃষ্টি রাখি। বামার চরিত্রের উপর যদিও ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার মনে সন্দেহ হইয়াছিল সত্য; কিন্তু আমার সহিত যেরূপভাবে সে ব্যবহার করিতেছিল, তাহা ভাবিয়া সেই সন্দেহকে সহজে মনে স্থান দিতে পারি নাই। অথচ মনের সন্দেহ একেবারে মিথ্যা ভাবিতেও পারি নাই। প্রায় প্রত্যহই রাত্রি এগারটার পর আমি বামার গৃহে গমন করিতাম, এবং কোনদিবস বা সেইস্থানে আহারও করিতাম। যে সময় আমার মনে এইরূপ সন্দেহ আসিয়া উদয় হইল, সেই সময় হইতে আরও অধিক রাত্রি করিয়া বামার বাড়ীতে গমন করিতে লাগিলাম। কিন্তু সন্ধ্যার পরই বামার বাড়ীর সন্নিকটস্থ কোনস্থানে না কোনস্থানে লুক্কায়িত ভাবে অবস্থিতি পূর্ব্বক তাহার কার্য্য সমূহ দর্শন করিতে লাগিলাম।
‘একদিবস রাত্রি প্রায় নয়টার পর দেখিলাম, একটি লোক বামার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং আস্তে আস্তে দ্বারে ধাক্কা দেওয়ায় দ্বার খুলিয়া গেল। সে সেই মুক্তপথে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, উক্ত দ্বার খুলিয়া বামা বাহিরে আসিল, এবং এদিক ওদিক চতুদিক্ উত্তমরূপে দেখিয়া যেমন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, অমনি সেই পুরুষটি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। সে কে, জানিবার নিমিত্ত আমিও অলক্ষিত ভাবে, অথচ দ্রুতপদে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। কিন্তু কিয়দ্দূরগমন করিতে করিতে, সেই ঘোর অন্ধকার রাত্রির ভিতর সে যে কোন দিকে চলিয়া গেল, তাহার আর কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না।
‘সেইদিবসেই আমার মনে এত ক্রোধের উদয় হইয়াছিল যে, যদি আমার নিকট কোনরূপ অস্ত্রাদি থাকিত, তাহা হইলে সেইদিবসেই আমি যে কি করিতাম, তাহা বলিতে পারি না। যাহা হউক, আমি সেই রাত্রি আর বামার গৃহে গমন করিলাম না। ভাবিলাম, সেইস্থানে গমন করিলে রাগের মাথায় কি করিতে কি করিয়া বসিব। আরও ভাবিলাম, এ বিষয় আরও উত্তমরূপে আমি দেখিব, ও আমার অনুমান যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে উভয়কেই যাহাতে সমুচিত প্রতিফল প্রদান করিতে পারি, তাহার বিশিষ্টরূপে চেষ্টা করিব।
‘পরদিবস নিয়মিত সময়ে পুনরায় বামার গৃহে গমন করিলাম। সাধ্যমত আমার মনের ভাব গোপন করিয়া প্রত্যহ যেরূপভাবে তাহার সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া থাকি, সেইরূপেই সে রাত্রি যাপন করিলাম, ও গত রাত্রিতে শারীরিক অসুস্থতা নিবন্ধন যে আসিতে পারি নাই, তাহাই তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম। এইরূপে আরও কয়েক দিবস অতীত হইয়া গেল। আমার গৃহে একখানি পুরাতন তরবারি ছিল, উহা বাহির করিয়া উত্তমরূপে পরিষ্কার করিলাম, এবং প্রত্যহ সন্ধ্যার পর উহা হস্তে লইয়া বামার বাড়ীর নিকটবর্তী স্থানে লুক্কায়িত ভাবে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম।
পরে নিয়মিত সময়ে অন্য স্থানে তরবারি লুকাইয়া রাখিয়া বামার বাড়ীতে গিয়া নিয়মিতরূপে রাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। এইরূপে কয়েক দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু সেই অপরিচিত পুরুষকে আর দেখিতে পাইলাম না। তখন আমার মনে হইল, বামার চরিত্রের উপর আমি মিথ্যা সন্দেহ করিয়াছি। উহার কোন পরিচিত লোক সে দিবস হয় ত কোন কার্য্যবশতঃ বামার বাড়ীতে আগমন করিয়াছিল, আমি তাহাকেই দেখিয়া বামার চরিত্রের উপর অযথা সন্দেহ করিয়াছি। সেইদিবস মিথ্যা সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া যে কোনরূপ গোলযোগ করি নাই, ইহার নিমিত্ত ঈশ্বরকে ধন্যবাদ প্রদান করা উচিত। যাহা হউক, আরও দুই-এক দিবস দেখিয়া আমি বামাকে সকল কথা খুলিয়া বলিব, এবং তাহার উপর যে অন্যায় সন্দেহ করিয়াছি, তাহার নিমিত্ত তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিব, ইহাই মনে মনে স্থির করিলাম। এই ভাবিয়া অদ্য সন্ধ্যার পর পুনরায় বামার বাড়ীর নিকট গুপ্তভাবে বসিয়া রহিলাম। কিন্তু আজ যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মনের ভাব পুনরায় পরিবর্তিত হইয়া গেল, পুনরায় বামার চরিত্রের উপর সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম, সেই দিবসের মত একটি লোক ধীরে ধীরে আসিয়া বামার দ্বারের নিকট উপস্থিত হইল, এবং দ্বার ঠেলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমিও আস্তে আস্তে গাত্রোত্থান করিয়া দ্বারের নিকট গমন করিলাম, ও দ্বার ঠেলিয়া দেখিলাম, উহা ভিতর হইতে বন্ধ। আমার তরবারির অগ্রভাগ দিয়া উক্ত দ্বারের ভিতরস্থিত খিল খুলিবার চেষ্টা করিলাম। কারণ, আমি জানিতাম, দ্বারের ফাঁক দিয়া কোন পাতলাদ্ৰব্য প্রবিষ্ট করাইয়া চেষ্টা করিলে, সেই খিল খোলা যায়। তরবারির অগ্রভাগ দিয়া আস্তে আস্তে একটু চেষ্টা করাতেই বুঝিলাম, খিল খুলিয়া গেল; কিন্তু দ্বার খুলিল না। তখন বুঝিতে পারিলাম, সেই দ্বার কেবলমাত্র খিল দ্বারা ভিতর হইতে আবদ্ধ হয় নাই, একটি তালাদ্বারাও আবদ্ধ হইয়াছে। তখন অনন্যোপায় হইয়া কিরূপে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কারণ, সেই সময় আমার মন এরূপ ক্রোধের বশবর্তী হইয়াছিল যে, আমি কিরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতেছি, তাহা নিজেই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না।
‘এইরূপে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার কোনরূপ উপায় না দেখিয়া, দ্রুতপদে আমি আমার বাড়ীতে আগমন করিলাম। বামার বাড়ী হইতে আমার বাড়ী দূরবর্তী নহে; সুতরাং আবার বাড়ীতে একখানি বাঁশের মই ছিল, দ্রুতপদে সেই মইখানি লইয়া গিয়া আমি বামার প্রাচীরের গায়ে স্থাপিত করিলাম, ও সেই ম’য়ের সাহায্যে তরবারি হস্তে বামার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। যে গৃহে বামা শয়ন করিত, দ্রুতপদে সেই গৃহের নিকট উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, গৃহের দ্বার উন্মুক্ত। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, বামা ও সেই অপরিচিত পুরুষ একই শয্যায় শয়ন করিয়া আছে। এরূপ অবস্থায় আমাকে দেখিবামাত্র উভয়েই পলায়নের চেষ্টা করিল। সেই সময় আমার সংজ্ঞা লোপ হইল। আমি যে কি করিলাম, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু পরিশেষে যখন আমার জ্ঞানের উদয় হইল, তখন দেখিলাম, বামাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিয়াছি! তাহার রক্তে গৃহ প্লাবিত হইয়া গিয়াছে, ও তাহার মৃতদেহ সেই রক্তের উপর পড়িয়া রহিয়াছে। অপরিচিত পুরুষের কোন চিহ্ন সেইস্থানে দেখিতে পাইলাম না। এই ব্যাপার দেখিয়া ক্ষণকালের নিমিত্ত পুনরায় আমি আবার চৈতন্য হারাইলাম, ও সেইস্থানে বসিয়া পড়িলাম। এইরূপ অবস্থায় আমি যে কতক্ষণ সেইস্থানে বসিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু যখন চৈতন্য হইল, তখন ভাবিলাম,—যাহা ঘটিবার, তাহা ঘটিয়াছে; এখন কিরূপে এই বিপদ হইতে উদ্ধার পাইতে পারিব? তোমার শরণ না লইলে, এই বিপদ হইতে উদ্ধার হইবার আর সম্ভাবনা নাই; এই ভাবিয়া তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। এখন যাহা করিতে হয়—কর, এখন আমার নিজের বুদ্ধির স্থিরতা নাই।’
বন্ধুর এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি একেবারে বিস্মিত হইলাম। যে মরিবার সে ত মরিয়াছে, এখন কিরূপে বন্ধুর প্রাণরক্ষা করিতে পারিব, সেই ভাবনায় অস্থির হইলাম। তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘যে ব্যক্তি বামার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল, সে কে?’
অধর। তাহা জানি না। তাহাকে আমি চিনি না। আমাদিগের গ্রামের কোন ব্যক্তি বলিয়া বোধ হয় না।
আমি। বামার লাস এখন কোথায়?
অধর। সেই গৃহের ভিতরেই পড়িয়া আছে।
আমি। কোনরূপে লাসের গতি করিতে না পারিলে আর উপায় নাই। চল দেখি, কোনরূপে সেই লাসের গতি করিতে সমর্থ হই কি না।
অধর। যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই কর। চল, আমি তোমার সহিত গমন করিতেছি।
বন্ধুর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হওয়ার পর, গৃহ হইতে আমি যেরূপ অবস্থায় বহির্গত হইয়াছিলাম, সেইরূপ অবস্থাতেই আমি তাহার সহিত বামার বাড়ীতে গমন করিলাম। বন্ধুর বিপদ দেখিয়া আমিও হিতাহিত জ্ঞান হারাইলাম। তখন আমি মুহূর্তের নিমিত্তও বুঝিতে পারিলাম না যে, আমি কিরূপ ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার জন্য গমন করিতেছি।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
বন্ধুর সহিত বামার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। যে গৃহের ভিতর বামা হত হইয়াছে, বন্ধু আমাকে সেই গৃহ দেখাইয়া দিল। আমি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া যে দৃশ্য দেখিলাম, তাহা কখনও আমার হৃদয় হইতে দূরীভূত হইবে না। সেই খণ্ড-বিখণ্ডিত মৃতদেহ, সেই রক্ত-প্লাবিত গৃহ প্রভৃতি ভয়ানক দৃশ্য দেখিয়া ক্ষণকালের নিমিত্ত আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান হারাইলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আমি আমার মনকে স্থির করিয়া সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম, ও বন্ধুর নিকট গমন করিয়া তাহাকে কহিলাম, ‘তুমি যাহা করিবার—তাহা করিয়াছ, এবং বামার অদৃষ্টে যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে। এখন কোনরূপে লাসের গতি করিতে না পারিলে, তোমার অবস্থাও পরিশেষে বামার অবস্থায় পরিণত হইবে।’
আমার কথা শ্রবণ করিয়া বন্ধু কহিল, ‘তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। বামার মৃতদেহ যদি কোন প্রকারে পুলিসের হস্তে পতিত হয়, তাহা হইলে আমাকে যে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। ইহা উত্তমরূপে আমার হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে। আরও বুঝিতে পারিতেছি, মৃতদেহ যদি পাওয়া না যায়, তাহা হইলে পুলিস কিছু কষ্ট দিতে পারেন সত্য; কিন্তু ফাঁসীকাষ্ঠে সহজে ঝুলাইতে পারেন না। এরূপ অবস্থায় এখন কি করা যায়? এই বাড়ীর ভিতর একটি গর্ত কাটিয়া উহাকে পুতিয়া ফেলিলে হয় না?’
বন্ধুর কথায় উত্তরে আমি কহিলাম, ‘পুতিয়া ফেলিলে যে হয় না, তাহা নহে। কিন্তু ইহাতে ভয়ের সম্ভাবনা থাকে। কোন প্রকারে পুলিস যদি অনুসন্ধান পাইয়া সেই মৃতদেহ মৃত্তিকার মধ্য হইতে উত্তোলন করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে কোন প্রকারেই রক্ষা পাইবার সম্ভাবনা থাকে না। আমার মতে সেই মৃতদেহের অস্তিত্ব যাহাতে একবারে লোপ হয়, তাহার চেষ্টা করা কর্তব্য।’
আমাদিগের উভয়ের মধ্যে এইরূপে দুই চারিটি কথাবার্তা হইবার পর সাব্যস্থ হইল যে, সেই রাত্রির মধ্যেই সেই মৃতদেহ একবারে ভস্মে পরিণত করিতে হইবে। যে স্থানে আমাদিগের গ্রামে শব সকলের দাহন হইয়া থাকে, সেইস্থান গ্রাম হইতে বহুদূরবর্তী নহে। সেই মৃতদেহ ভস্মে পরিণত করিবার পরামর্শ যেমন স্থির হইল, কালবিলম্ব না করিয়া অমনি উভয়ে মিলিয়া সেই মৃতদেহ গৃহের বাহির করিলাম। উহা একখানি মাদুরে জড়াইয়া তাহার উপর একটি বাঁশ বাঁধিয়া যেরূপে পল্লীগ্রামের মৃতদেহ শ্মশানে লইয়া গিয়া থাকে, সেই প্রকারে দুই বন্ধু মিলিয়া সেই মৃতদেহ গ্রামের বাহিরে শ্মশানে লইয়া গেলাম। মনে করিলাম, দেহ ভস্মীভূত হইলে পর পুনরায় বামার বাড়ীতে গমন করিয়া, রক্তাদি সমস্ত পরিষ্কার করিয়া ফেলিব।
যেরূপ অবস্থায়, যেরূপ কার্য্যে আমরা হস্তক্ষেপ করিলাম, তাহাতে বুদ্ধিকে স্থির রাখিয়া কার্য্য করা বোধ হয়, কাহারই পক্ষে সহজ নহে। শ্মশান-ভূমিতে উপনীত হইয়া যখন সেই মৃতদেহ পুড়াইয়া ফেলিতে অগ্রসর হইলাম, তখন দেখিলাম, আমরা উভয়েই একটি মহাভ্রমে পতিত হইয়াছি। মৃতদেহ জ্বালাইতে আসিয়াছি, কিন্তু কি দিয়া যে উহা জ্বালাইব, তাহার কোনরূপ সংস্থান করিয়া আসি নাই। এইরূপ অবস্থায় অনন্যোপায় হইয়া সেই মৃতদেহ লইয়া আমি সেই শ্মশান-ভূমিতে রহিলাম, ও জ্বালান উপযোগী কাষ্ঠাদি আনিবার নিমিত্ত বন্ধুকে পাঠাইয়া দিলাম, এবং বলিয়া দিলাম, “যত শীঘ্র পার, কাষ্ঠাদি লইয়া প্রত্যাগমন করিবে।”
মহাশয়! যাহা ঘটিবার—তাহা ঘটিবেই। প্রাক্তনের গতি রোধ করিতে পারে, এ ক্ষমতা কাহারই নাই। সেই ঘোর অন্ধকার রজনীর শেষ অংশে, মনুষ্যরব-বিবর্জিত সেই শ্মশান ভূমিতে, সেই রক্তাক্ত মৃতদেহ সম্মুখে লইয়া আমি একাকী বসিয়া বসিয়া যে কতরূপ চিন্তা করিতেছি, তাহার স্থিরতা নাই। তথাপি মধ্যে মধ্যে মনের ভিতর ভয়ের উদয় হইতেছে, এবং থাকিয়া থাকিয়া সর্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হইতেছে। এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইয়া গেল; তথাপি বন্ধু কাষ্ঠ লইয়া প্রত্যাগমন করিল না। সেই সময় দেখিলাম, তিন চারিজন লোক যেন কি সন্ধান করিতে করিতে আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। হঠাৎ তন্মধ্যস্থ একজন বলিয়া উঠিল, “এই এই”। অমনি আমি ধৃত হইলাম। তখন বুঝিতে পারিলাম যে, হত্যা-অপরাধে হতব্যক্তির দেহের সহিত আমি পুলিস কর্তৃক ধৃত হইলাম, ও এরূপ অবস্থায় উহাদিগকে কোন কথা বলা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনায় চুপ করিয়া রহিলাম। কারণ, সেই সময় মনে মনে স্থির করিলাম যে, আমি যেরূপ অবস্থায় ধৃত হইয়াছি, তাহাতে প্রকৃতকথা বলি বা না বলি, কিছুতেই আমার নিষ্কৃতি নাই। প্রকৃতকথা বলিলে আমি ত বাঁচিবই না, অধিকন্তু বন্ধু ও আমার সদৃশ বিপদে পড়িবে, আর হয় ত আমার সহিত তাহার প্রাণ পর্যন্ত নষ্ট হইবে—অন্ততঃ কোন কঠিন দণ্ডও ত পাইবে। এরূপ অবস্থায় যাহা ঘটিবার তাহা আমার উপর দিয়াই ঘটুক, কিছুতেই আমি প্রকৃতকথা বলিব না, বা বন্ধুর নামও প্রকাশ করিব না।
সেই শ্মশান-ভূমিতে মৃতদেহের সহিত যে দারোগাবাবুর হস্তে আমি পতিত হইলাম, দেখিলাম, তিনি আমার পরিচিত নহেন, বা বিবাহ-বাসরে বামা পলায়ন করিলে যে দারোগাবাবু আসিয়া অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, ইনি তিনিও নহেন। দারোগাবাবু সেই সময়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?”
আমি। আমার নাম ক্ষীরোদচন্দ্র ঘোষ।
দারোগা। এ কাহার মৃতদেহ?
আমি। বামানাম্নী একটি স্ত্রীলোকের।
দারোগা। এ মৃতদেহ এখানে কে আনিল?
আমি। আমি।
দারোগা। কেন এখানে আনিলে?
আমি। সৎকার করিবার মানসে।
দারোগা। তুমি ইহাকে হত্যা করিলে কেন?
আমি। আমি হত্যা করি না।
দারোগা। কে হত্যা করিয়াছে?
আমি। জানি না।
দারোগা। কে হত্যা করিয়াছে, যদি না জান, তবে ইহার সৎকার করিবার নিমিত্ত এখানে আনিলে কেন?
আমি। দেখিলাম, হত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, সুতরাং মনে কেমন দয়া হইল। তাই সৎকার করিবার মানসে ইহাকে লইয়া আসিয়াছি।
দারোগা। তোমার সহিত আর কোন্ ব্যক্তি এই লাস বহন করিয়া আনিয়াছে?
আমি। আমার সহিত আর কেহই ছিল না, আমি একাকীই উহাকে আনিয়াছি।
(যে বাঁশ বাঁধিয়া সেই মৃতদেহ আমরা বহন করিয়া আনিয়াছিলাম, পুলিস সেইস্থানে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই সেই বাঁশ আমরা খুলিয়া একটু দূরে ফেলিয়া দিয়াছিলাম। সুতরাং এ লাস কিরূপে বহন করিয়া আনা হইয়াছে, তাহা বুঝিবার সহজ উপায় ছিল না)
দারোগা। সৎকার-উপযোগী কাষ্ঠাদি ত কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। তাহার নিমিত্ত কোন ব্যক্তি গমন করিয়াছে?
আমি। কেহই গমন করে নাই। আমি একাকী বলিয়া অগত্যা এখানে লাস লইয়া বসিয়া আছি। কারণ, কাষ্ঠ না আনিলে ইহার সৎকার করিতে পারিব না, অথচ এই মৃতদেহ কোন ব্যক্তির নিকট রাখিয়া যে কাষ্ঠ আহরণে গমন করিব, এমন কোন ব্যক্তিকে দেখিতে পাইতেছি না।
আমার এই কয়েকটি কথা শ্রবণ করিয়া আমাকে পাগল ভাবিয়াই হউক, বা মিথ্যাবাদী ভাবিয়াই হউক, দারোগা—বাবু আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। আমাকে উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া দুইজন পাহারাওয়ালার পাহারায় রাখিয়া দিয়া, তাহাদিগের আবশ্যকীয় “সুরতহাল” প্রভৃতি অন্যান্য লেখা পড়ার কার্য্য সমাধা করিতে লাগিলেন।
পুলিস আসিয়া আমাকে ধৃত করিবার অতি অল্পক্ষণ পরেই বন্ধু কাষ্ঠাদি সংগ্রহ করিয়া আমার নিকট আগমন করিতেছিলেন; কিন্তু সম্মুখে পুলিসের এই ব্যাপার দেখিতে পাইয়া তিনি আর সম্মুখে আগমন করেন নাই।
রাত্রিকালে বিশেষ কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে আমাদিগের দেশীয় পুলিসকে ঘটনাস্থলে আনয়ন করা যে কিরূপ দুঃসাধ্য ব্যাপার, তাহা পল্লীগ্রামের লোকমাত্রই অবগত আছেন। এরূপ অবস্থায় এত শীঘ্র পুলিস কি প্রকারে আসিল, এবং কোন ব্যক্তিই বা তাহাদিগকে সংবাদ প্রদান করিল, তাহার কিছুমাত্র সেই সময় বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, বামার উপপতি বন্ধুর হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া দ্রুতপদে থানার নিকট যায়। কিন্তু সে নিজে ফেরারী আসামী; সুতরাং থানায় ভিতর যাইতে সাহসী না হইয়া, একখানি বেনামী পত্র লিখিয়া অপর ব্যক্তি দ্বারা থানায় পাঠাইয়া দেয়, এবং নিজে সে স্থান হইতে প্রস্থান করে। পত্রের মর্ম্ম এইরূপ ছিল;
“গ্রামে বামা বৈষ্ণবীকে এখনই কোন ব্যক্তি হত্যা করিয়াছে, এবং হত্যাকারী মৃতদেহ লইয়া তাহারই গৃহের ভিতর এখনও বসিয়া আছে। শীঘ্র গমন করিলে লাস ও আসামী একস্থানে পাইবেন। বিলম্ব করিলে, পরে আর এ মোকদ্দমার সন্ধান হইবে না।”
এই পত্র পাইয়া দারোগা বাবু আর কালবিলম্ব করেন নাই। অশ্বারোহণে দ্রুতপদে বামার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হন। তাহার গৃহের রক্ত-রঞ্জিত অবস্থা ও নিকটে তরবারি দেখিয়া, বামা যে প্রকৃতই হত হইয়াছে, তাহা স্থির করিয়া লন, এবং ইহাও অনুমান করেন যে, হত্যাকারী মৃতদেহের অস্তিত্ব নষ্ট করিবার নিমিত্ত মৃতদেহ লইয়া কোনস্থানে চলিয়া গিয়াছে। এই অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া পরিশেষে তাঁহারা শ্মশানে গিয়া উপস্থিত হন, এবং সেইস্থানে পূৰ্ব্ববর্ণিত অবস্থান আমাকে ধৃত করেন।
বলা বাহুল্য, এই হত্যা-অপরাধে আমি আসামী হইলাম। প্রথমতঃ পুলিস, পরে মাজিষ্ট্রেট, এবং সর্ব্বশেষে জজসাহেব আমার সহিত অপর কোন ব্যক্তি ছিল কি না, জানিবার জন্য সবিশেষ চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোনরূপেই আমি প্রকৃতকথা বলিলাম না।
যে সময় আমার মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হয় নাই, আমি আবদ্ধ অবস্থায় হাজতে আছি, সেই সময় একদিবস বন্ধু গিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিল, ও তাহার অপরাধে আমার শাস্তি হইতেছে বলিয়া বিশেষ দুঃখপ্রকাশ করিল, এবং যাহাতে আমি প্রকৃতকথা বলিয়া তাহার নাম প্রকাশ করি, তাহার নিমিত্ত আমাকে একান্ত অনুরোধ করিল; কিন্তু আমি কিছুতেই যখন সম্ভব হইলাম না, তখন সে কহিল, ‘বিনাদোষে তুমি দণ্ডিত হইবে, আর আমি দোষ করিয়া জীবিত থাকিব, ইহা কখনই হইতে পারে না। তুমি আমার কথা প্রকাশ কর বা না কর, হাকিমের নিকট আমি নিজেই গমন করিয়া সমস্ত প্রকৃতকথা বলিব, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তোমার উপর তাঁহার দয়ার উদ্রেক হইবে।’
বন্ধুর এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাহাকে নানারূপে বুঝাইলাম, ও পরিশেষে তাহাকে স্পষ্টরূপে কহিলাম, “আমি যেরূপ অবস্থায় ধৃত হইয়াছি, তাহাতে কোনরূপেই আমার রক্ষা নাই; অধিকন্তু তোমার নাম প্রকাশ হইলে তোমারও সর্ব্বনাশ হইবে! এরূপ অবস্থায় যখন তুমি আমি উভয়ের কেহই বাঁচিব না, তখন দুইজনের পরিবর্তে একজনের উপর দিয়া যাহা ঘটিবার, তাহা হইয়া যাউক বিশেষতঃ তুমি জীবিত থাকিলে আমার স্ত্রী-পুত্রের অন্ন বস্ত্রের কোনরূপ ক্লেশ হইবে না, তুমি অনায়াসেই তাহাদিগকে প্রতিপালন করিতে পারিবে। এরূপ ঘটনায় আমি একাকী যাইতেছি। তোমার পরামর্শ শুনিলে কেবল আমরা দুইজনেই যে যাইব তাহা নহে; অধিকন্তু তোমার বৃদ্ধা মাতা তোমার শোকে আত্মহত্যা করিবেন। তাহার উপর অনশনে আমার স্ত্রী-পুত্রও আমাদিগের অনুগমন করিবে। এরূপ অবস্থায় আমার একাকী যাওয়াই মঙ্গলকর কি না?”
এইরূপে যখন বন্ধুকে সবিশেষ করিয়া বুঝাইলাম, তখন সে অনেক কষ্টে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে আমার নিকট হইতে প্রস্থান করিল।
ইহার পর দায়রায় আমার বিচার হইল। আমি নিজে যে বামাকে হত্যা করিয়াছি, তাহার কোন প্রমাণ না হওয়ায়, আমার প্রাণদণ্ড হইল না, আমি দ্বীপান্তরে প্রেরিত হইলাম। যাহাতে আমার সাজা হইয়াছে, তাহার বৃত্তান্ত এই।
এই বলিয়া ক্ষীরোদচন্দ্র চুপ করিল।
ক্ষীরোদচন্দ্রের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমার চক্ষে জল আসিল। তথাপি পুনরায় আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার বন্ধু অধরচন্দ্র এখন কোথায়? তাহার কোন সংবাদ রাখ কি? তোমার স্ত্রী-পুত্রের উপর সে এখন কিরূপ ব্যবহার করিয়া আসিতেছে?”
উত্তরে ক্ষীরোদচন্দ্র কহিল, “অধর তাহার পর পুনরায় বিবাহ করিয়া সুখে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছে, এবং যে দিবস হইতে আমি কারারুদ্ধ হইয়াছি, সেইদিবস হইতেই সে আমার স্ত্রী-পুত্রকে বিশিষ্ট আদর ও যত্নের সহিত প্রতিপালন করিয়া আসিতেছে।”
ক্ষীরোদচন্দ্রের আত্মকাহিনী শ্রবণ করিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। আপনা-আপনিই আমার মুখ হইতে বাহির হইল, “ক্ষীরোদ! তুমি কয়েদী নহ! তুমি দেবতা! দেবতাই বা বলি কেন, তোমার যেরূপ আত্মত্যাগ, সেইরূপ আত্মত্যাগ দেবতাদিগের মধ্যেও আছে কিনা, সন্দেহ! মনুষ্য ত পরের কথা। যাও, তুমি এখন স্বদেশে গিয়া স্ত্রী-পুত্র লইয়া মনের সুখে সুখী হও। আত্মত্যাগ-জনিত তুমি যে মহাপুণ্য সঞ্চয় করিয়াছ, যাও, সেই পুণ্যজনিত মহাসুখ ইহকালে ও পরকালে ভোগ কর।”
পাঠক! আপনারা অশিক্ষিত নহেন—সুশিক্ষিত। দরিদ্র নহেন—ধনী। কিন্তু এই অশিক্ষিত দরিদ্র পল্লীগ্রামবাসী ক্ষীরোদচন্দ্রের ন্যায় আপনাদিগের আত্মত্যাগ আছে কি? যদি না থাকে, তবে আমার প্রার্থনা যে, আজ আপনারা দ্বীপান্তর প্রত্যাগত এই কয়েদীর নিকট হইতে আত্মত্যাগের গূঢ় মন্ত্র শিক্ষা করুন।
[ ভাদ্র, ১৩০২]