৮
কেন যে লোকে অন্য সময় গঙ্গাসাগরে বেড়াতে আসে না! মেলার সময় এখানে প্রচুর ভিড়ভাট্টা, সাধু, চোর–ছ্যাঁচোড় আর ভিখিরির সংখ্যাই থাকে প্রচুর, তার ওপর আবার কলেরার ইঞ্জেকশান ইত্যাদির ঝঞ্ঝাট। কিন্তু অন্য সময় জায়গাটা কী সুন্দর নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন। ফিনফিনে হাওয়া দিচ্ছে। মেলার সময় যেখানে প্রচুর তাঁবু থাকে, এখন সেখানে তরমুজ ফলে আছে। বেলাভূমিতে ছোট ছোট লাল লাল কাঁকড়া দৌড়ে বেড়াচ্ছে মনের সুখে, কেউ তাদের বিঘ্ন ঘটাতে আসবে না।
নামখানা থেকে সাইকেল ভ্যান কিংবা নৌকোয় এখানে বেশ স্বচ্ছন্দে আসা যায়। একটা ছোট ডাকবাংলো আছে। একলা একলা বসে স্যান্ডহেডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, এক হিসেবে ভারতের এক প্রান্তে চলে এসেছি। এরপর আন্দামান চলে যেতে পারলে হতো। এককালের কয়েদিদের আন্দামানে পাঠানো হতো। এক হিসেবে আমিও তো তাদেরই দলে। অন্তত এক রাত তো হাজতে কাটিয়েছি। পরদিন হাকিম আমাকে ইচ্ছে করলেই জেলে ভরে দিতে পারতেন। একদল পলিটিক্যাল প্রিজনার এসে পড়ায় তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
হাকিমের রায়ের মধ্যে কোনো নাটকীয়তা ছিল না। তিনি ফিসফিস করে তাঁর পাশের পেশকারকে কী যেন বললেন। কোর্ট ইন্সপেক্টর আমাকে জানাল যান, প্রথম অপরাধ হিসেবে ছাড়া পেয়ে গেলেন। ফার্স্ট ওয়ানিং। আসামী রাজা সরকার খালাস!
কিন্তু ঐ একরাত হাজতবাসই আমার পক্ষে একযুগ নরকবাসের সমান। ঐটুকু ছোট ঘরের মধ্যে ছ’জন লোক, ভেতরে উৎকট পেচ্ছাপের গন্ধ। একটা দাড়িওয়ালা লোক গাঁজার নেশায় ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে খুব খারাপ ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আপন মনে। আমার মুখোমুখি বসে থাকা ঐ চঞ্চল নামের লোকটা আমার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি বটে, কিন্তু আমি একটু অন্যমনস্ক হলেই সে টুক করে একটা লাথি মারছিল আমাকে। আমার ওপর তার রাগ কেন কে জানে? আমি যে আসল রাজা সরকার নই তা তো সে জানেই। তবে? আমিও লাথি ফিরিয়ে দিচ্ছিলুম। সারা রাত ধরে চলল সেই লাথি মারামারির প্রতিযোগিতা!
এখানে এসে যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম। এই টাটকা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিলে বুকটা যেন পবিত্র হয়ে যায়। দিকশূন্যপুরেই থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ভাঙা মন নিয়ে সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। একটু সারিয়ে নিই, তারপরই আবার দিকশূন্যপুরে পালাব।
বিদায় রাজকুমারী, বিদায় রাজা সরকার, চন্দনদা–উজ্জয়িনী, বিদায় রেকর্ড প্লেয়ার, বাউল গান, শান্তিনিকেতন, জয়দেবের বাড়ি ও গাড়ি…আমি এখানে বেশ সুখে আছি!
বাংলোর রাঁধুনিটি চমৎকার ঝিঙে–পোস্ত রাঁধে। গরম বাড়া ভাত, মুসুরির ডাল আর ঝিঙে পোস্ত, এর চেয়ে আর কী চাই। নৌকোর মাঝিদের কাছ থেকে পার্শে মাছ পেলে তো সোনায় সোহাগা!
খানিকটা দূরে একটা ইরিগেশানের লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। কোনো স্টিমার বা লঞ্চ একেবারে তীরে ভিড়তে পারে না, নৌকো করে যাতায়াত করতে হয়।
ঐ লঞ্চের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। প্রায়ই বাংলোতে আসে টিউবওয়েলের জল নিতে। ভারী হাসি–খুশি সজ্জন মানুষগুলি। নদীর বুকে যারা ঘোরে তারা বুঝি এরকমই হয়।
একটা নৌকো আমার কাছাকাছি এলো। একজন হেঁকে বলল, আসবেন নাকি লঞ্চে? আসুন, একটু চা খেয়ে যাবেন।
এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার কোনো মানে হয় না। বিকেলের আকাশ লাল হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। এখন লঞ্চের ডেকে বসে চা খেতে চমৎকার লাগবে।
নৌকোয় দু’জন ভদ্রলোক, রবীনবাবু আর অমলবাবু। এর মধ্যে অমলবাবু বেশ বড় অফিসার, তিনি সরকারি পরিদর্শনে এসেছেন, কোনোরকম অহংকার নেই, অতি সদালাপী। এই লঞ্চখানা তাঁরই অধীনে।
ডেকে বসে সবে মাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, আর একখানা নৌকো এসে ভিড়ল লঞ্চের পাশে। একজন বৃদ্ধ ব্যাকুলভাবে ডেকে উঠল, বাবু! বাবু। আমার ছেলেটাকে বাঁচান!
আমরা সবাই রেলিং ধরে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলুম, কী ব্যাপার? কী হয়েছে তোমার ছেলের?
বৃদ্ধটি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, তার জোয়ান ছেলেকে সাপে কামড়েছে। তার ঐ একমাত্র ছেলে, সে মরে গেলে তার সংসার ভেসে যাবে!
রবীনবাবু এখানকার বি. ডি. ও। তিনি দায়িত্বপূর্ণ গলায় বললেন, সাপে কামড়েছে তো ওকে নৌকোয় নিয়ে ঘুরছ কেন? হেলথ্ সেন্টারে যাও।
বৃদ্ধটি জানাল, এখানকার পাঁচখানা হেলথ্ সেন্টারে সাপের বিষের কোনো ওষুধ নেই। সে খবর নিয়েছে। একমাত্র ডায়মণ্ড হারবারে নিয়ে গিয়ে বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে।
রবীনবাবু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অমলবাবু তাকে বাধা দিলেন। অমলবাবু দয়ালু লোক। তিনি ছেলেটিকে ওপরে তোলার নির্দেশ দিয়ে বললেন, এখুনি লঞ্চ স্টার্ট করতে বলুন। ডায়মণ্ড হারবার যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?
ডান পায়ে অনেকগুলি দড়ির বাঁধন দেওয়া প্রায় অচৈতন্য চব্বিশ–পঁচিশ বছরের যুবকটিকে লঞ্চে তোলা হলো। কিন্তু তার বাবা আমাদের সঙ্গে এলো না। তার নৌকোটার কী হবে? নৌকোর চিন্তাও ছেলের চিন্তার চেয়ে কম নয়।
বৃদ্ধটির নাম আকবর আলি। সে বলল, কাল ভোরেই সে ডায়মণ্ড হারবার হাসপাতালে চলে যাবে। ছেলেটি যাতে বাঁচে, আমরা যেন সেই দোয়া করি।
অমলবাবু আমাকে বললেন, চলুন, ডায়মণ্ড হারবার ঘুরে আসি।
ছেলেটির গালে ছোট ছোট চড় মেরে তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতে লাগল, আমরা উদগ্রীব হয়ে ঘিরে বসে রইলুম তাকে। রীতিমতন জোয়ান ছেলে, সামান্য একটা সাপের কামড়ে এর অযথা মৃত্যুর কোনো মানে হয় না। অমলবাবু ছটফট করে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে বারবার বলতে লাগলেন, কী হবে? কী হবে? ছেলেটা বাঁচবে তো। অ্যাঁ? আরো জোরে লঞ্চ চালাও না। এত আস্তে যাচ্ছে কেন?
আমরা বললুম, অমলবাবু, আপনি শান্ত হোন!
অমলবাবুর বয়েস বাহান্ন–তিপ্পান্নর কাছাকাছি। সেই তুলনায় স্বাস্থ্য বেশ ভেঙে গেছে। ওঁর এত উদ্বেগ দেখে আমরা ভাবলুম, অমলবাবুরই না শরীর খারাপ হয়ে যায়।
ডায়মণ্ড হারবার পৌঁছে ছেলেটিকে দ্রুত নিয়ে আসা হলো সরকারি হাসপাতালে। সুখের বিষয় সেখানে সাপের বিষের সিরাম আছে। স্থানীয় ডাক্তারটি আফশোষের সুরে বললেন, কাকদ্বীপ, নামখানার দিকেই ম্যাকসিমাম স্নেক বাইট হয়, অথচ ওখানকার হেল্থ সেন্টারেই এই ওষুধ ফুরিয়ে যায়। কী কাণ্ড বলুন তো! একে এত দেরি করে এনেছেন, দেখি কী করা যায়। অবশ্য বাঁধনগুলো ভালো দিয়েছে। আমি ও অমলবাবু বসে রইলুম সেই হাসপাতালে। উনি একটা কিছু পাকা খবর না পেয়ে সেখান থেকে নড়তে চান না। একদম অচেনা–অজানা একটি নৌকোর মাঝির ছেলের জন্য ওঁর কী দুশ্চিন্তা! এরকম মানুষও এখনো আছে পৃথিবীতে।
দু’জনের মুখে প্রায় কোনো কথা নেই। অমলবাবু ঘন ঘন সিগারেট টেনে যেতে লাগলেন। সামান্য আলাপেই অমলবাবুকে আমার নিকট আত্মীয়ের মতন মনে হলো।
এক ঘণ্টা বাদে ডাক্তারটি এসে বলল, আপনারা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন? মোটামুটি আপনাদের বলতে পারি, ছেলেটা বেঁচে যাবে। না, সেরকম আর ভয়ের কিছুই নেই, বেঁচেই যাবে।
অমলবাবু ডাক্তারটির হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, দেখুন, ছেলেটির বাবা সঙ্গে আসেনি, আমিই ওর দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! ডাক্তারটি বলল, আমি আর কী করেছি! আপনার দেখা পেয়ে গেল ওর বাবা, আপনি তাড়াতাড়ি নিয়ে এলেন, তাই তো বাঁচল। অনেক অফিসার এসব কেস শুনে পাত্তাই দিতে চাইত না।
আমি আর অমলবাবু হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলুম। অমলবাবু গভীর তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, আমার যা চিন্তা হচ্ছিল! আমার নিজের ঠিক ঐ বয়েসী ছেলে আছে। একটাই ছেলে আমার। বার বার মনে পড়ছিল তার কথা। আমার কাছে আমার ছেলে যেমন প্রিয়, ঐ আকবর আলির কাছে তার ছেলেও তো তাই?
আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়লুম।
অমলবাবু আবার বললেন, দেখুন, এই পৃথিবীতে প্রতিদিন কত লোক বিনা কারণে মারা যাচ্ছে! কত খুনোখুনি। তার মধ্যে একজন লোকও যদি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে, তা হলে আনন্দ হয় না?
—নিশ্চয়ই!
—চলুন, নীলুবাবু, আমরা এখানে কোনো হোটেলে খেয়ে নিই। লঞ্চ ফিরতে ফিরতে…
অমলবাবু কথা শেষ করতে পারলেন না, সিঁড়ির শেষ ধাপে ঝুপ করে পড়ে গেলেন।
আমি চমকে গিয়ে নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কী হলো অমলবাবু, পায়ে লাগল?
অমলবাবু ফিসফিস করে বললেন, ব্যথা, বুকে খুব ব্যথা করছে। হার্ট—
আমি দু’তিন সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে সেই ডাক্তারটিকে সামনেই পেয়ে যেতে তার হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এলুম নিচে।
ডাক্তারটি সামান্য পরীক্ষা করেই বিবর্ণ মুখে বললেন, সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, এ তো মনে হচ্ছে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। দাঁড়ান, স্ট্রেচার আনতে বলি…
আমার বুকটার মধ্যে ধড়ফড় করতে লাগল, এইমাত্র দেখলুম মানুষটাকে সুখী, তৃপ্ত, তার পরের মুহূর্তেই মৃত্যু এসে থাবা দিল? মৃত্যুর কি সামান্য বুদ্ধি–বিবেচনা নেই? এইরকম একটা সত্যিকারের ভালো মানুষকে আঘাত দেবার এই কি সময়?
অমলবাবুকে আনা হলো ওপরে। উনি আমার হাত চেপে ধরে রইলেন। ওঁর সাঙ্ঘাতিক যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝতে পারছি, কিন্তু চৈতন্য একেবারে লোপ পায়নি। ফিসফিস করে বারবার বলতে লাগলেন, আমাকে কলকাতায় নিয়ে চলুন, কলকাতায়, আমার ছেলের কাছে, আমার স্ত্রী যেন একটা খবর পায়, অন্তত একবার যেন দেখা হয়…
ডাক্তারটিকে আমি সেই কথা জানাতে তিনি বললেন, দেখুন, আমার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন, যে–রকম ম্যাসিভ অ্যাটাক, এর ভালো মতন চিকিৎসার ব্যবস্থা এখানে নেই। কলকাতার পি জি বা অন্য কোনো ভালো হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখলে ঠিক মতন চিকিৎসা হতে পারে। আবার অতটা রাস্তা নিয়ে যাওয়া, সেটাও রিস্কি। কে দায়িত্ব নেবে? আপনি কি ওঁর আত্মীয়?
– না, আমি ওঁর কেউ না!
—তবে?
–যে করেই হোক, অমলবাবুকে বাঁচাতেই হবে।
—সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার সাধ্য তো খুব বেশি নয়। দাঁড়ান, এস. ডি. ও.–কে খবর দিচ্ছি।
আমি খানিকটা উত্তেজিতভাবে বলে ফেললুম, শুধু খবর দেওয়া নয়, তাঁকে এক্ষুনি এখানে আসতে বলুন!
অমলবাবু আমার কথা শুনতে পেয়েছেন, ফ্যাসফেসে গলায় আবার বললেন, নীলুবাবু, আমায় কলকাতায় নিয়ে চলুন। আমার ছেলেকে, আমার স্ত্রীকে …..অন্তত একবার…আমার হার্ট আগেই খারাপ ছিল, আমি জানি, বাঁচব না আর….অন্তত একবার বাড়ির লোকদের…
এস. ডি. ও. তাস খেলছিলেন, খেলা ছেড়ে উঠে এসে তিনি খুব বিভ্রান্ত বোধ করলেন। তারপর বললেন, অমলবাবু একজন সিনিয়র অফিসার, উনি নিজেই যখন বলছেন কলকাতায় যেতে চান…আমাদের এখানে রাখা…ভালো মতন চিকিৎসা না হলে…আমি গাড়ি দিতে পারি, কিন্তু আমার পক্ষে তো কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়, কাল একজন মিনিস্টার আসছেন…সঙ্গে কে যাবে?
ইরিগেশান ডিপার্টমেন্টের একজন জুনিয়র অফিসার, ডাক্তারবাবুটি এবং আমি অমলবাবুকে নিয়ে উঠলুম এস. ডি. ও.–র দেওয়া স্টেশান ওয়াগনে। গঙ্গাসাগরের ডাকবাংলোয় আমার সুটকেস ও অন্য জিনিসপত্র পড়ে রইল, কিন্তু তা নিয়ে এখন চিন্তা করা যায় না। অমলবাবু আগাগোড়া আমার হাত ধরে আছেন।
গাড়ি জোরে চালাবার উপায় নেই। একটুও যাতে ঝাঁকুনি না লাগে সেইভাবে চালাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ড্রাইভারকে। ডাক্তারবাবু অমলবাবুর পাশে বসে আছেন। কয়েকটা জরুরি ওষুধ দেওয়া হয়েছে এর মধ্যেই। তার মধ্যে একটা ঘুমের ওষুধ। চোখ বুজে যাচ্ছে, তবু তার মধ্যেও তিনি ফিসফিস করে বলে যাচ্ছেন, আগে আমার বাড়ি ঘুরে যাবেন, আমার ছেলেকে, স্ত্রীকে, অন্তত একবার…
কলকাতায় আমরা পৌঁছলুম রাত একটায়। অমলবাবুর বাড়ি বালিগঞ্জে স্টেশনের কাছে। বাড়ির নম্বর এইটি সি। সেই ঠিকানা খুঁজে সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই চিনতে পারলুম। উজ্জয়িনীর বড়দির সেই বাড়ি। অমলবাবুরা দোতলায় ভাড়া থাকেন।
নিয়তি; গঙ্গাসাগরের কাছে একটা সাপ নিয়তির ছদ্মবেশে আকবর আলির ছেলেকে কামড়ে তারপর ঘটনা পরম্পরায় আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।
অমলবাবুর ছেলের নাম সুশান্ত। বাড়ির সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। গাড়ি থেকে নেমে আমি ডাকতে লাগলুম। সুশান্ত! শিগগির দরজা খোলো। সুশান্ত!
শুধু দোতলা নয়, তিনতলারও জানলা খুলে গেল। সুশান্ত আগে নেমে এলো। তারপর তার মা। তিনি কেঁদে উঠতেই তিনতলা থেকেও নেমে এলো কয়েকজন। তাদের মধ্যে রয়েছে চন্দনদা ও হাসি।
আকাশে ফ্যাকাসে জ্যোৎস্না, তার মধ্যে আলুথালু শাড়ি জড়ানো হাসিকে যেন আমি একযুগ পরে দেখলুম। হাসি জিজ্ঞেস করল, আপনি? আপনি এখন কোথা থেকে এলেন?
আমি বললুম, গঙ্গাসাগর থেকে। কাল সকালেই ফিরে যাব।
তা অবশ্য হলো না। অমলবাবুকে পি জি হাসপাতালে ভর্তি করতে করতেই রাত তিনটে বেজে গেল। তারপর বাড়ি ফিরে ঘুমোলুম বেলা দশটা পর্যন্ত। আবার ছুটলাম পি জি হাসপাতালে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কারুকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না বটে, তবে জানা গেল অমলবাবু অনেকটাই ভালো আছেন। তাঁর ছেলে সুশান্ত জানাল যে ডায়মণ্ড হারবার থেকে ওঁকে নিয়ে আসা খুব সুবিবেচনার কাজ হয়েছে। ওখানে থাকলে উনি টেনশানেই মারা যেতে পারতেন। তাছাড়া ওখানে কী চিকিৎসাই বা হতো!
আমি অবশ্য ভাবলুম, অমলবাবুর অবস্থা যদি আজ সকালে খারাপ হতো, তা হলে এই ডাক্তাররাই বলতেন, অতখানি রাস্তা নিয়ে আসা খুব মুর্খামির কাজ হয়েছে। ডায়মণ্ড হারবারে রেখে চিকিৎসা করাই উচিত ছিল।
উজ্জয়িনীর বড়দির ছেলে বিক্রমের সঙ্গে সুশান্তর খুব ভাব। ও বাড়িতে বাড়িওয়ালা–ভাড়াটের প্রায় আত্মীয়তার সম্পর্ক। সেই সুবাদে বিক্রম আর চন্দনদা এসেছেন একবার অমলবাবুর খবর নিতে। যদিও ওঁদের আজ খুবই ব্যস্ততা, আজই সন্ধেবেলা হাসির বিয়ে।
চন্দনদা বলল, নীলু, তুমি কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলে? একদম বেপাত্তা? আজ সন্ধেবেলা কিন্তু আসতেই হবে, নইলে হাসি খুব দুঃখ পাবে!
রাত একটার সময় হাসি যদি রাস্তায় নেমে না আসত এবং ম্লান চাঁদের আলোয় আমাকে জিজ্ঞেস না করত আপনি কোথা থেকে এলেন—তা হলে আমি আজ বিকেলেই পালিয়ে যেতাম। কিন্তু বিয়ের আগের রাতেও যে মেয়ে রাত একটায় কৌতূহলী হয়ে রাস্তায় নেমে আসে, তার চুম্বক–টান কিছুতেই এড়ানো যায় না।
কেয়াতলায় একটা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বিয়ের জন্য। আমি আমার এক মাসতুতো দাদার কাছ থেকে একটা ধুতি ধার করেছি, অনেক দিন পর ধুতি– পাঞ্জাবি পরে আমি বোকা বোকা মুখ করে বসে রইলুম এক জায়গায়। চন্দনদা– উজ্জয়িনী এবং ওদের বড়দির ছেলেমেয়েরা ছাড়া বরপক্ষ–কন্যাপক্ষের আর কারুকেই আমি চিনি না। এমনকি হাসির বাবা–মা’কেও আগে দেখিনি। বরের বেশে রাজা সরকার পৌঁছেছে একটু আগে। তার সঙ্গে প্রায় শতাধিক বরযাত্রী–যাত্রিণী। অনেকেই দু’পক্ষেরই চেনা। আধা–শান্তিনিকেতনী আর বাকিটা যৌথ–পারিবারিক ব্যাপার। এর মধ্যে আমি কে? সম্পূর্ণ একটা থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার।
আমি যেখানে বসে আছি, তার প্রায় সামনেই একটা সিঁড়ি। দারুণ সাজগোজ করা সুন্দরী মেয়েরা সিল্কের শাড়ি সপসপিয়ে ঐ সিঁড়ি দিয়ে উঠছে আর নামছে। আজ যদি হাসির বিয়ে না হতো, তা হলে ঐসব মেয়েদের লাস্য দেখেই আমি চমৎকার সময় কাটিয়ে দিতে পারতুম।
কিন্তু মনের মধ্যে পাতলা পাতলা সাদা মেঘের মতন বিষাদ কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছি না। এর নাম দুঃখ–বিলাসিতা। হাসিকে কি আমি নিজের করে চেয়েছি কখনো–না, কক্ষনো চাইনি। তবু একটা বিচ্ছেদবেদনা। এর কী মানে আছে? গঙ্গাসাগরের সেই নির্জন ডাকবাংলোয় কী চমৎকার ছিলাম, সেখানে হাসির মুখ আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছিল, আমি তৈরি হচ্ছিলাম দিকশূন্যপুরে যাবার জন্য
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে দু’তিনটি মেয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করছে এক সদ্য যুবক। তার হাতে একটা রসগোল্লার ভাঁড়। সে একটা করে রসগোল্লা ঐ মেয়েদের খাওয়াবেই। তাই নিয়ে জোরাজুরি, হাসাহাসি, বিশুদ্ধ কৌতুক।
আজকাল সবাই ক্যাটেরার দিয়ে খাওয়ায়, বাড়ির ছেলেরা পরিবেশন করার সুযোগ পায় না। ঐ ছেলেটার হাতে মিষ্টির হাঁড়ি কী করে এলো? বোধহয় বরযাত্রীদের জন্য স্পেশাল। এখন মেয়েরাও এত ডায়েটিং সচেতন যে কিছুতেই মিষ্টি খেতে চায় না। তবু ছেলেটি জোর করে খাওয়াতে গেল, খানিকটা রসগোল্লার রস উথলে পড়ল সিঁড়িতে।
আমি এখন খেয়েদেয়ে পালাতে পারলেই বাঁচি। এরকম অচেনা লোকজনের মধ্যে বসে থাকতে ভালো লাগে? কতক্ষণ বসে থাকব? এ যেন আরেক হাজত– বাস! কিন্তু চন্দনদা দু’তিনবার এসে বলে গেছে, নীলু, আগে খেয়ে নিসনি। আমরা একসঙ্গে বসব। খবরদার, পালাসনি যেন!
চন্দনদা আমার বাড়ি চিনে গেছে, এখন আর পালাবার কোনো উপায় নেই। রেডিও স্টেশনে একটা কোনো চেনা লোক খুঁজে বার করতেই হবে!
হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়াল উপেনদা। সাড়ম্বর উল্লাসের সঙ্গে বললেন, নীলু, তুই এখানে?
আমি বললুম, উপেনদা, তুমি? এসো, এসো, এতক্ষণে একটা বেশ লোক পেলুম। তুমি কি এখানেও ম্যারাপ বেঁধেছ নাকি? সেদিন বলোনি তো? বলেছিলে বউভাতের কথা?
উপেনদা আমার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বললেন, আরে নাঃ, সব জায়গাতেই আমি ম্যারাপওয়ালা নাকি? তোকে বলেছিলুম না, ডেকরেটরদের কেউ নেমন্তন্ন করে না? আসলে ব্যাপার কী জানিস, আজকের যে কনে, অনামিকা না অনিন্দিতা কী যেন নাম—
—অনিন্দিতা!
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনিন্দিতা, সে যে আমার ছোট মেয়ের সঙ্গে দিন কতক পড়ত। ঐ তোদের ফিলোজফি না কী বলে?
—ফিলসফিটা আমাদের কেন হবে, উপেনদা? আমিও কোনোদিন ও জিনিস পড়িনি। তুমিও পড়োনি।
—ঐ হলো রে! সেই কানেকশানে মেয়েটা আমাদের মেনন্তন্ন করেছে। হোল ফ্যামিলিকেই করেছিল। কিন্তু জানিস তো, আমার পরিবার কোথাও যায় না। তাই মেয়েকে নিয়ে আমাকেই আসতে হলো।
—খুব ভালো করেছ, উপেনদা, এতক্ষণ আমার বড্ড একা একা লাগছিল। এরপর একসঙ্গে খেতে বসব।
উপেনদা চেয়ারটা একটু টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, খাবারের মেনু কী আছে এসেই খোঁজ নিয়েছি, বুঝলি? চিংড়ির কাটলেট আছে। এই ক্যাটেরাররা আমার চেনা। আজকাল কেউ আসল বাগদা চিংড়ির কাটলেট দেয় না। কিন্তু এরা দেয়। আমি তো চিংড়ির কাটলেট ছাড়া আর কিছুই খাব না ঠিক করেছি!
–বাঃ, খুব ভালো কথা।
—ক্যাটেরারদের চোখ টিপে দেব। তোকে বেশি করে দেবে!
হঠাৎ একটা হৈ হৈ শব্দ। চোখ তুলে দেখি, চন্দনদা ওপর তলা থেকে দ্রুত নামতে গিয়ে সেই রসগোল্লার রসে পা পিছলে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে।
আমি দৌড়ে ধরতে গেলুম, ততক্ষণে চন্দনদা পৌঁছে গেছে একেবারে নিচের ধাপে। অনেক লোক দৌড়ে এলো। আমি চন্দনদাকে তুলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ঠিক আছে, চন্দনদা?
চন্দনদা খানিকক্ষণ মুখ বিকৃত করে রইলেন। চোখ বোঁজা। আস্তে আস্তে চোখ খুললেন। ঝাপসা থেকে ক্রমশ চোখের ফোকাস পরিষ্কার হলো।
অকূল সমুদ্রে একটা দ্বীপ দেখার মতন চন্দনদা চমকে উঠে বললেন, নীলু! পা–টা মচকে গেছে না ফ্র্যাকচার হয়েছে বুঝতে পারছি না। দারুণ ব্যথা। সে কিছু না। কিন্তু হাসির বিয়েতে আমার পিঁড়ি ধরার কথা। এক্ষুনি শুভদৃষ্টি হবে। নীলু, তুমি একটু আমার হয়ে…
গঙ্গাসাগরের সেই সাপটাই নিশ্চয় ষড়যন্ত্র করে সিঁড়ির ওপর রসগোল্লার রস ফেলিয়েছে। নইলে আমাকেই হাসির বিয়ের পিঁড়ি ধরতে হবে কেন?
একদিকে হাসির এক মাসতুতো ভাই, আর একদিকে আমি। হাসি আমাদের দু’জনের গলা জড়িয়ে ধরেছে, এই প্রথম হাসির স্পর্শ।
আগেকার কালে যখন গৌরীদান হতো, তখন বাচ্চা মেয়েদের পিঁড়িতে তুলে বরের চারপাশে ঘোরানো হতো। এখন চব্বিশ পঁচিশ বছরের কমে মেয়েদের বিয়ে হয় না, তবু ঐ প্রথা চলে আসছে। আমার খালি মনে হচ্ছে, হাতটা পিছল লাগছে। হাত ফসকে পড়ে যাবে না তো হাসি!
সাতপাক ঘোরাবার পর শুভদৃষ্টি। একটা পাতলা চাদর দিয়ে হাসিকে আর রাজাকে আলাদাভাবে ঢেকে দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে আমার দিকে তাকাল হাসি।
কোনো কোনো সময় মুহূর্তই অনন্ত মুহূর্ত।
হাসির চোখে চোখ ফেলে আমার বুক কাঁপল না। আমার সেরকম ফালতু বুক নয় যে যখন তখন কাঁপবে। একটা পিঁড়ির ওপর বসা যুবতীকে তুলে ধরে আছি, এর মধ্যে বুক কাঁপলেই হলো! এখন আমার প্রধান চিন্তা পিঁড়িটা যেন হাত থেকে খসে না পড়ে যায়।
রাহুলদা একটা বিনা পয়সায় টিকিট দিয়েছিলেন। পাঁচমিশেলি জলসায় একটি নাম–না–জানা নর্তকীকে দেখে আমার বুক কেঁপেছিল। নাচ অনেক দেখেছি, গান অনেক শুনেছি, শুধু একজনই কাঁপিয়েছিল আমার বুক। সে আমাকে ঋণী করেছিল, আজ সেই ঋণ শোধ হলো।
হাসির মুখের থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি রাজার দিকে তাকালুম। মনে মনে বললুম, তুমি এই মেয়েটির যোগ্য হও, রাজা। তোমার নিজেরই স্বার্থে! এর পর ফের যদি কোনোদিন তোমাকে বেচাল হতে দেখি, তাহলে রণেন বা তাপসের সাহায্য লাগবে না। আমিই তোমাকে…ইয়ে….মানে…না না, ছি ছি, এখন এই শুভ মুহূর্তে এসব কথা ভাবতে নেই। যাঃ, আমি যে কী একটা হয়ে গেছি,… রাজা, ভালো করে হাসির দিকে তাকাও, আগে তুমি হাসিকে অনেকবার দেখলেও …এই মুহূর্ত থেকে তোমার দৃষ্টি শুভ হোক!