৭
রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরতেই মা বললেন, তুই কোথায় থাকিস? একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা এসেছিল তোকে খুঁজতে, অনেকক্ষণ বসেছিল, এই তো একটু আগে গেল। কী সুন্দর কথা বলে। ভারী ভালো লাগল।
—কারা, কী নাম?
—চন্দন দত্ত আর উজ্জয়িনী। এর মধ্যে উজ্জয়িনী তো মাসিমা বলে ডেকে ফেলল আমায়, দু’বার চা খেল, আমাকে নেমন্তন্ন করল শান্তিনিকেতনে যেতে।
আমার এক মাসতুতো ভাইকে জপিয়ে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে তার হাত দিয়ে চন্দনদার পাজামা–পাঞ্জাবি ফেরত পাঠিয়েছিলুম। আমি আর ওদের বড়দির বাড়িতে যেতে চাইনি। কিন্তু চন্দনদা রেডিও–র ব্যাপারটা ভোলেননি। চন্দনদা আমার মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করেছেন অনেকক্ষণ, তার হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন একটা। এবারে সস্ত্রীক এসে হাজির হয়েছেন আমার বাড়িতে।
এবারে মাস দুয়েকের জন্য কোথাও উধাও হয়ে যেতে হবে। দিকশূন্যপুরে চলে যাব, অনেকদিন বন্দনাদির খবর নেওয়া হয়নি।
মা বললেন, ছেলেটি একটা লেখা রেখে গেছে তোর পড়বার জন্য। আর একটা নেমন্তন্নর চিঠি।
-নেমন্তন্নর…
—হ্যাঁ, বিয়ের চিঠি। বারবার বলেছে, তোকে যেতেই হবে। আমি যেন অবশ্যই পাঠাই তোকে…এর মধ্যে ওরা আর একবার আসবে বলেছে। হ্যাঁ রে, ওদের সঙ্গে তোর কী করে ভাব হলো রে।
হাসির বিয়ের নেমন্তন্ন, আমাকে!
কিন্তু হাসির বিয়ে শেষ পর্যন্ত হবে কি? পুলিশ এসেছিল ঐ থ্রি–এ ফ্ল্যাটটা রেইড করতে। পুলিশের ভাব–ভঙ্গি এমনই নিশ্চিত ছিল, যেন তারা আগে থেকেই কোনো খবর পেয়ে এসেছে।
বিহারের সেই এম. পি….কালকের কাগজে ছাপা হবে খবর…কাগজের লোকেরা কি পুলিশের পেছনে ওত পেতে থাকে। এত তাড়াতাড়ি তারা সব খবর পেয়ে যায় কী করে? কেন রাজা ওখানে গেল?
রাজা, রাজা, তুমি কেন পবিত্র, সুন্দর, খামখেয়ালি একটি মেয়ের এই ক্ষতি করলে?
জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হাসি বৃষ্টির জল নিয়ে চোখে লাগাচ্ছিল…হাসি চেয়েছিল অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে খোয়াইয়ের ধারে যেতে…গাছের ওপর একটা ময়ূরের পালক…চৌরঙ্গিতে সব গাড়ি–ঘোড়া থামিয়ে রাস্তার মাঝখানে নাচতে চেয়েছিল হাসি…সেই হাসি কি এতবড় একটা আঘাত পাবার যোগ্য? ওর স্বপ্ন ভেঙে যাবে…এই রকম মেয়েরা স্বপ্নের মধ্যেই বাস করে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে কি আর মুখ–চোখের ঐ দীপ্তি থাকবে?
পুলিশ দেখে আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি থাকলেই বা কী করতে পারতাম। কেমন যেন মনে হচ্ছে, রাজার ঐ দলের মধ্যেই কারুর উদ্দেশ্য ছিল রাজাকে ঐ রকম ভাবে ফাঁদে ফেলার। রাজাই বা বোকার মতন সেই ফাঁদে কেন পা দিল, নিশ্চয়ই মদ কিংবা পণ্যা স্ত্রীলোকের লোভে নয়।
ভাত খেতে খেতে বিদ্যুৎ চমকের মতন একটা কথা মনে পড়ে গেল। দুপুরবেলা জয়দেব বলছিল, আমাদের কলেজের বন্ধুরা এখন কে কোথায় কাজ করে। তার মধ্যে রণেন আছে পুলিশে কড়েয়া থানায়…। রণেন এক সময় আমার খুব বন্ধু ছিল। এক সঙ্গে চাইবাসায় বেড়াতে গিয়েছিলুম…একবার পরীক্ষার সময় রণেন প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল, ওর টুকরো টুকরো কাগজের একদলা চালান করে দিয়েছিল আমার হাতে, ইনভিজিলেটরকে দেখে সেই কাগজ আমি টপ করে গিলে ফেলেছিলুম…সেসব কথা কি রণেনের মনে পড়বে না? মাত্র সাত–আট বছর আগেকার ব্যাপার!
যদি কিছু করতে হয় আজ রাত্তিরেই করা দরকার।
একসময় ভাবলুম, ভোরবেলাই দিকশূন্যপুরে পালাব, এসব ঝামেলার মধ্যে আমি থাকতে চাই না। ওখানে গেলে হাসির কথা, চন্দনদা–উজ্জয়িনীর কথা আমার মন থেকে মুছে যাবে…
কিন্তু হাসির মুখটা মনে পড়তেই আমার বুকটা মুচড়ে উঠছে। এই রাতটা কাটবে কী করে?
বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর চুপি–চুপি নিচে নেমে টুক করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে পড়লুম। কড়েয়া থানাটা আবার কোথায় তা কে জানে। এর আগে কোনো থানার খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন হয়নি।
এত রাতে ট্যাক্সি ছাড়া গতি নেই। ট্যাক্সিওয়ালারা নিশ্চয়ই সব থানা চেনে। আমার পুঁজি ছিল পনেরো টাকা, সব নিয়ে এসেছি।
একটা ট্যাক্সি কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশে গিয়ে আমি কিছু বলবার আগেই ড্রাইভারটি বলল, হাওড়া? হাওড়া গেলে নিয়ে যেতে পারি।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, কড়েয়া কি হাওড়ার দিকে? কিংবা হাওড়া কি কড়েয়ার আগে?
লোকটি বলল, হাওড়ার সঙ্গে কড়েয়ার কোনো সম্পর্কই নেই, দাদা!
—আমার সঙ্গে আছে। আমি কড়েয়াতেই যেতে চাই। শুধু কড়েয়া গেলেই চলবে না, কড়েয়া থানার মধ্যে।
– আপনি থানায় যাবেন, এত রাত্রে? কেন, বাড়িতে কোনো খুন টুন হয়েছে?
—ভবানীপুরে খুন হলে তুমি কড়েয়া থানায় যেতে কি?
—তা হলে?
গোঁফের অভাবে একটা জুলপি চুলকে বললুম, আমি কড়েয়া থানায় কাজ করি, সেখানে যাবার বদলে আমার কি হাওড়া গেলে চলবে, বলুন?
লোকটি বিরক্ত ভাবে একটা দরজা খুলে দিয়ে বললে, উঠুন। আপনারা পুলিশের লোকেরা মাইরি রাত্তিরের দিকে বড্ড ঝামেলা করেন!
আমি ভেতরে ঢুকে গ্যাঁট হয়ে বললুম, আর দিনের বেলা যে কিছু বলি না! সারাদিন ধরে কত জেনুইন প্যাসেঞ্জারদের রিফিউজ করে যে শুধু শেয়ারের ট্যাক্সি হিসেবে খাটেন, তখন কি ডিসটার্ব করি? এখন এত রাত্রে শেয়ার পাবেন?
—আমার হাওড়ার দিকে যাবার দরকার ছিল।
—ভাড়া দেবো আমি আর দরকারটা থাকবে আপনার? বাঃ দাদা, বেশ! আমি হাওড়ার দিকেই গেলে আপনি আমায় বিনা পয়সায় নিয়ে যেতেন?
–সে কথা হচ্ছে না।
—কোনো কথারই আর দরকার নেই। সোজা কড়েয়া থানায়!
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, কিন্ত থানার মধ্যে বেশ একটা কর্মচাঞ্চল্য আছে। দু’তিনজন লোক ভাঁড়ের চা খেতে–খেতে গল্প করছে কম্পাউন্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে। উজ্জ্বল আলো, কয়েকটা রিক্সা, লোকজনের গলার আওয়াজ।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিতে একবার আমার সন্দেহ হলো, রণেনটা কী চাকরি করে, কনস্টেবল না তো! আজকাল অনেক কনস্টেবল দেখতে পাই!
তার পরেই মনে হলো, নেহাত ছোট চাকরি করলে জয়দেব ওর সন্ধান রাখত না।
যে দু’তিনজন লোক চা খেতে খেতে গল্প করছিল, তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, মিঃ রণেন ভৌমিক কোথায়?
লোকটি আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, আমি বাইরের লোক!
একজন বাইরের লোক রাত সাড়ে এগারোটায় থানার কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে চা খায় কেন কে জানে!
ভেতরে ঢুকে দেখলুম, দু’তিনটে বেঞ্চিতে একগাদা লোক বসে আছে, তাদের মধ্যে নারী ও বুড়োও বাদ নেই। টেবিলের উল্টোদিকে পুলিশের পোশাক–পরা একজন লোক একটা লম্বা খাতায় কী যেন লিখে যাচ্ছে একমনে।
ঐ লোকটাই রণেন না তো? বেশির ভাগ পুলিশেরই লম্বা–চওড়া একরকম চেহারা।
আমি ডাকলুম, রণেন?
লোকটি মুখ তুলল, তারপর কয়েক পলক নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এ লোকটা রণেন নয়, কিন্তু এত কী দেখছে আমাকে? একেই বলে মর্মভেদী দৃষ্টি।
একটু বাদে হাত তুলে সে বলল, পাশের ঘরে যান।
পাশের ঘরে একজন পুলিশ টেবিলের ওপর লম্বা ঠ্যাং তুলে রয়েছে, আর একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে, আর একটি লোক বসে আছে চেয়ারে, এই লোকটি রাজার সঙ্গীদের একজন!
টেবিলের ওপর ঠ্যাং তোলার ভঙ্গি দেখেই রণেনকে চিনতে পারলুম। কলেজের আমল থেকেই ওটা ওর মুদ্রাদোষ।
—রণেন, আমি নীলু!
—হ্যাঁ, কী চাই?
—রণেন, চিনতে পারছিস না? আমি নীলু, তোর সঙ্গে কলেজে পড়তুম, জয়দেব, অজয়, প্রীতম, সবাই একসঙ্গে, মনে নেই?
—হ্যাঁ মনে থাকবে না কেন? তুই যে নীলু তাও তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এত রাত্তিরে তো হঠাৎ কলেজের বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার ঠিক উপযুক্ত সময় নয়। এখন কাজে বিশেষ ব্যস্ত আছি!
–আমি একটা বিশেষ দরকারে এসেছি।
—সেইজন্যই তো বারবার জিজ্ঞেস করছি, কী চাই। কী দরকার সেটা চটপট বলে ফ্যাল!
আমি রাজার বন্ধু ও অন্য পুলিশটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললুম, সেটা একটু প্রাইভেটলি বলতে চাই।
অন্য পুলিশটি ভুরু কুঁচকে বলল, আপনি…আপনাকে কোথায় দেখেছি… আজই…আজ সন্ধেবেলা আপনি হিরনানি ম্যানসানে একটা বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন না?
আমি আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গি করে বললুম, হিরনানি ম্যানসান? সেটা আবার কী? জীবনে নাম শুনিনি!
আবার রণেনের দিকে তাকাতেই সে অতিকষ্টে চেয়ার ছেড়ে উঠল। বেশ বিরক্ত ভঙ্গি করে বলল, চল, ঐ ঘরটায় চল।
অন্য পুলিশটিকে বলল, আপনি চালিয়ে যান!
পাশের ঘরটি বেশ সুসজ্জিত। গদি–মোড়া চেয়ার। দেয়ালে রাজীব গান্ধীর ছবি।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে রণেন কড়া গলায় বলল, আমরা সত্যি খুব সিরিয়াস কাজে ব্যস্ত। পাঁচ বছর বাদে রাত বারোটার সময় তুই ইয়ার্কি করতে আসিসনি আশা করি। কী ব্যাপার, কোনো চুরি–ডাকাতিতে ফেঁসে গেছিস? রেপ কেস? বউয়ের আত্মহত্যা হলে কিন্ত কোনো সাহায্যই করতে পারব না, আগে থেকে বলে রাখছি।
আমি অভিমানের সঙ্গে বললুম, রণেন, তুই আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছিস? তোর জন্য আমি এই অ্যাতখানি কাগজ খেয়ে ফেলেছিলুম…তারপর তিনদিন আমার যা কনস্টিপেশান গেছে।
এতক্ষণে রণেনের ঠোঁট ফাঁক হলো। প্রথমে আস্তে, তারপর বেশ জোরে হেসে উঠল। অবিকল জয়দেবের স্টাইলে আমার পিঠে একটা বিরাশি সিক্কা চাপড় মেরে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই আমার জন্য কাগজ খেয়ে ফেলেছিলি, কী করে খেলি, রে? ঠিক ম্যাজিশিয়ানদের মতন…যাক, ও ঘটনাটা মনে করে রেখেছিস কেন? খবরদার আর কারুকে বলিস না এখন।
—রণেন, তোর কাছ থেকে একটা ব্যাপারে সাহায্য চাই।
—তার আগে বল তো, তুই আজ হিরনানি ম্যানসানে গিয়েছিলি কেন?
–কে বলল গিয়েছিলুম?
–শোন, নীলু, পাশের ঘরে ঐ যে আমার কলিগ তাপস ভৌমিক, ওর চোখের কোনোদিন ভুল হয় না। ও যখন বলেছে, তখনই বুঝেছি, তোকে ঠিকই দেখেছে। তোর মতন ভীতু–ভীতু ছেলে ওখানে গিয়েছিল শুনে আমি আশ্চর্য হচ্ছি।
–কেন, হিরনানি ম্যনসানে বুঝি শুধু সাহসী আর বীরপুরুষরা থাকে? যাক গে যাক, আচ্ছা রণেন, পাশের ঘরে যে লোকটাকে তোরা দু’জনে মিলে জেরা করছিলি, তার নাম কী রে?
—নীলু, কেউ থানায় এসে আমাদের প্রশ্ন করে না। আমরা প্রশ্ন করি। অন্যরা উত্তর দেয়। তুই এখনও উত্তর দিসনি, তুই হিরনানি ম্যানসানে কী করছিলি?
–তা বলে তুই আমার সঙ্গেও পুলিশী ব্যবহার করবি নাকি? তা হলে আমি এক্ষুনি পাশের ঘরে গিয়ে তোর ঐ কলিগ তাপস ভৌমিককে বলে দেব যে তুই পরীক্ষায় টুকলি করতে গিয়ে আর একটু হলে ধরা পড়ে যাচ্ছিলি। আমি তোকে বাঁচিয়েছি।
—চুপ চুপ, নীলু, তোর একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই। চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? এতদিন পর ঐ সব কথা কেউ তোলে!
–তা হলে বল ঐ লোকটার নাম কী?
– ওর নাম চঞ্চল বক্সী। তা জেনে তোর লাভ কী!
–ও কী কাজ করে?
–কী মুশকিল! তুই শুধু শুধু সময় নষ্ট করছিস, নীলু! যদি আমার কাছ থেকে সত্যি সত্যি কোনো সাহায্য চাস, তা হলে আসল কথাটা বল তাড়াতাড়ি।
—হিরনানি ম্যানসান থেকে তোর ঐ কলিগ তাপস ভৌমিক আজ কয়েকজনকে ধরে এনেছে। তাদের মধ্যে রাজা সরকার নামে কেউ আছে? তাকে যে–কোনো উপায় হোক ছেড়ে দিতে হবে।
রণেন থুতনিতে হাত দিয়ে গুম হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার চোখের দিকে। যদিও সে আমার কলেজের বন্ধু, তবু সে পুলিশী মর্মভেদী দৃষ্টি দেবার লোভ সামলাতে পারছে না।
—চুপ করে রইলি কেন, রণেন? রাজা সরকার নামে কেউ আছে?
— আছে।
—তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
—রাজা সরকার তোর কে হয়? আত্মীয়? বন্ধু? বিজনেস পার্টনার?
–এর একটাও না।
—তবে?
—তবু ওকে ছেড়ে দিতে হবে। আমার বিশেষ দরকার।
—নীলু, আমাকে অগাধ জলে রেখে তোর কোনো লাভ হবে না। সব কথা আগে খুলে বলতে হবে। উইথ ফুল ডিটেইলস। তুই কেন হিরনানি ম্যানসানে গিয়েছিলি। আগে সেখান থেকে শুরু কর।
এরপর আমাকে খুলে বলতেই হলো, যথাসম্ভব সংক্ষেপে। এবং হাসির নাম বাদ দিয়ে। এই থানার মধ্যে হাসির নাম উচ্চারণ করাও যেন অপরাধ।
কিন্তু পুলিশে কাজ করে রণেনের এর মধ্যেই অনেকটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। সে ঘটনার বর্ণনা শোনামাত্র বলল, এর মধ্যে একটা মেয়ে আছে। ফিমেল ক্যারেকটার ছাড়া কোনো নাটক–গল্প জমে না। এর মধ্যেও একটা মেয়ে আছে, যার সঙ্গে ঐ রাজা সরকারের বিয়ে হবার কথা ক’দিন বাদেই। সেই মেয়েটা তোর কে হয়?
—কেউ নয়!
—অর্থাৎ তার ওপর তোর উইকনেস আছে। এই কথাটা আগে বলবি তো! এখনো কাগজের লোকদের কিছু জানানো হয়নি। এক্ষুনি সব খবরের কাগজে টেলিফোন করে দিচ্ছি, কাল সকালেই সব কাগজে বেরিয়ে যাবে। তারপর ওকে কোর্টে প্রোডিউস করব, এমন প্যাচ মেরে কেস লিখব যাতে ও বেইল না পায়। আবার হাজতবাস। অন্তত এক মাস। বিয়ে ভণ্ডুল। তুই গিয়ে এবার চান্স নে!
আমি হুমড়ি খেয়ে রণেনের হাত জড়িয়ে ধরে বললুম, খবরদার, ও কথা চিন্তাও করিস না। রাজা সরকারের কথা ঘুণাক্ষরে কারুকে জানানো চলবে না। ওর কোনো দোষ নেই। ওর বন্ধুরা ওকে জোর করে হিরনানি ম্যনসানে ঐ ফ্রি এন্টারপ্রাইজে নিয়ে গিয়েছিল। যে–করেই হোক ওকে আজ ছেড়ে দিতে হবে, ওর বিয়ের ব্যাপারে যেন কোনো ক্ষতি না হয়!
–তুই একটা বোকা, নীলু! এ বিয়ে ভাঙবেই। তুই না চান্স নিস, অন্য কেউ চান্স নেব। আড়ালে আর একজন কেউ আছে।
–তার মানে?
–ঐ ফ্রি এন্টারপ্রাইজে কী করবার চলে, তা আমরা জানি। তবু ইচ্ছে করেই ওটা একেবারে তুলে দিই না, কারণ মাঝে মাঝে ওখানে রাঘববোয়াল ধরা পড়ে। ফ্রাংকলি বলছি, তাতে আমাদের দু’চার পয়সা আসে। তোরা বুঝবি না। কিছু উপরি রোজগার না থাকলে থানা চালানো যায় না। একটা এত বড় থানা চালানো কি চাট্টিখানি কথা? আজকাল সব জিনিসের যে–রকম দাম বেড়েছে!
–এদের অ্যারেস্ট করে তোরা টাকা আদায় করবি?
—শোন্ ভালো করে। আমাদের ইনফরমার আছে, তারা খবর আনে। কিন্তু এই কেসটার ব্যাপারে আমরা আগে কোনো খবর পাইনি। কিন্তু একজন কেউ সন্ধে ছ’টা নাগাদ ফোন করে খবর দিল, অ্যাননিমাস কল। বলল যে আজ ফ্রি এন্টারপ্রাইজে একটা পার্টি আসবে, তাদের মধ্যে একজন একটা বড় কোম্পানির অফিসার। কয়েক দিন পরেই তার বিয়ে। তা হলে বোঝ, যে–ফোন করেছে, সে নিশ্চয়ই ওদেরই দলের লোক। এই বিয়েটা ভাঙায় তার ইন্টারেস্ট আছে।
—তোরা সেই বাজে লোকটাকে সাহায্য করবি?
–রাজা সরকার একটা ক্রাইম করেছে, তা তো ঠিকই। ইম্মরাল ট্রাফিক…পুলিশ যখন ঘরে ঢোকে, তখন বোতল তুলে মারতে এসেছিল।
–রাজা সরকার মারতে এসেছিল?
–ও বোতল তোলেনি, তবে ওর নামেই চার্জটা দিয়ে দেব!
–না, প্লীজ রণেন, না, তোকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
—রাজা সরকার একটা ভালো কোম্পানিতে পারচেজ অফিসারের কাজ করে। এসব হচ্ছে প্রাইজ পোস্ট, বুঝলি? ওরা ইচ্ছে করলে লাখ লাখ টাকার অর্ডার দিতে পারে। সেই জন্য ওদের ঘিরে অনেক ইন্টারেস্টেড পার্টি থাকে, দু’পক্ষেরই দেওয়া–নেওয়া চলে। এখন দেখা যাচ্ছে, ঐসব লোকের মধ্যেই কেউ একজন রাজা সরকারকে খুব অপছন্দ করে, সে ওর বিয়েটা ভেঙে দিতে চায়।
—সেই লোকটাকে জেলে দে। রাজা সরকারকে ছেড়ে দে!
—এটা অনেক বড় ব্যাপার রে, নীলু! আমার একার কিছু হাত নেই। এ থানার বড়বাবু দু’দিন ছুটি নিয়েছেন, তিনি থাকলে আমি তোকে এ ঘরে বসাতেই পারতুম না। কেস–টেস সব লেখা হয়ে গেছে, একটু বাদেই আমরা রাজা সরকারকে হাসপাতালে পাঠাব।
—অ্যাঁ। হাসপাতালে কেন? রাজা উন্ডেড হয়েছে নাকি? তোরা মেরেছিস?
—না। সেরকম কিছু না। ও একেবারে ডেড ড্রাংক। ওকে কেউ দু’তিনরকম ড্রিংকস মিশিয়ে ইচ্ছে করে ওরকম করে দিয়েছে, তা বোঝাই যায়। এখন হাসপাতালে পাঠিয়ে ওর স্টমাক পাম্প করিয়ে ডাক্তারি রিপোর্ট নেব। তাতে ওর এগেইনস্টে কেসটা আরও স্ট্রং হবে।
—স্টমাক পাম্প?
—হ্যাঁ, তারপর আর সাতদিন বাছাধন জল খেতেও ভয় পাবে।
–রণেন, রণেন, তুই একটা মেয়ের সর্বনাশ করতে চাস? তুই সেই মেয়েটাকে দেখিস নি, একবার যদি তাকে দেখতি নিজের চোখে—
— আমি এখনও বিয়ে করিনি রে, নীলু! বুঝতেই পারছি, মেয়েটা খুব সুন্দর। আমি তাকে দেখলে নিশ্চয়ই আমিও তার প্রেমে পড়ে যেতুম। তাতে ব্যাপারটা আরও কমপ্লিকেটেড হয়ে যেত না?
—রণেন, তোর জন্য আমি কাগজ খেয়েছিলুম, সেই জন্য তুই আজ এই পুলিশের চাকরিটা করতে পারছিস। সেদিন ধরা পড়ে গেলে তুই রাস্টিকেটেড হয়ে যেতিস, ওরকম ব্যাড রেকর্ড থাকলে তোকে কোনোদিন পুলিশের চাকরিতে নিত না।
—তুই এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছিস কেন, নীলু? হ্যাঁ, তুই একবার আমার উপকার করেছিস, দ্যাট ইজ এ ফ্যাক্ট। তার বদলে আমি তোর জন্য কিছু করতে রাজি আছি। কিন্তু কোথাকার কে রাজা সরকার, তার জন্য তোর অত মাথাব্যথা কেন?
–তুই আমার এই অনুরোধটা শোন, আর কোনো দিন তোর কাছে আমি কোনো উপকার চাইতে আসব না।
—তুই একটা জিনিস বুঝতে পারছিস না, আমার একার এত ক্ষমতা নেই। থানাটা হচ্ছে একটা সংসারের মতন, এখানে গোপনে কিছু করা যায় না। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা নিজেরই তরে—এই হচ্ছে আমাদের সিসটেম, বুঝলি। এখন তোর কথা শুনে যদি আমি একার দায়িত্বে রাজা সরকার সম্বন্ধে কিছু করি, তাতে অন্যরা ভাববে, আমি গোপনে তোর কাছে থেকে টাকা খিঁচে নিয়েছি। তোর কোনো মন্ত্রী–টন্ত্রির সঙ্গে চেনা নেই? কোনো মন্ত্রীকে দিয়ে ফোন করাতে পারলে আমরা এককথায় ছেড়ে দেব!
–মনে কর কোনো মন্ত্রী ফোন করেছে।
—তার মানে?
—কোনো মন্ত্রী ফোন করলে তার কথা কি তোরা টেপ–রেকর্ড করে রাখিস? না লিখিত কোনো ডকুমেণ্ট থাকে? টেলিফোনে মুখের কথা, ধর আমিই বাইরে গিয়ে কোনো জায়গা থেকে মন্ত্রী সেজে ফোন করলুম!
–অত সহজ নয় রে! অত সহজ নয়। মন্ত্রী কি আর আমার মতন কোনো চুনোপুঁটিকে ফোন করে? মন্ত্রী ফোন করবে কোনো আই জি, ডি আই জি, পুলিশ কমিশনার র্যাংকের কর্তাদের, তারা আবার ফোন করবে আমাদের বড়বাবুকে, সেই ফোন পেয়ে আমাদের বড়বাবু ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে ল্যাজে–গোবরে হয়ে ছুট আসবে।
—তা হলে?
—দাঁড়া, আমার কলিগ তাপসবাবুর সঙ্গে কনসাল্ট করে দেখি। তুই এখানেই একটু বোস!
এখন কত রাত হলো কে জানে? আমার হাতে ঘড়ি নেই, দেয়ালের একটা বড় ঘড়িতে অনেকক্ষণ ধরে বারোটা বেজে আছে। বারোটা বেজে যাওয়া তা হলে একেই বলে।
কোন্ একটা ঘরে কে যেন তারস্বরে চ্যাচাচ্ছে। কেউ কারুকে মারধোর করছে নাকি? জেরা করার সময় নাকি হাতে পায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়? আজকাল আর ফাঁসি দেবার দরকার হয় না, থানার মধ্যেই কয়েদিরা যখন তখন মরে যায়। ওরা নাকি হার্টফেইল করে কিংবা গলায় দড়ি দেয়!
একটু পরেই সহকর্মীটিকে নিয়ে ফিরে এলো রণেন। দরজা বন্ধ করে দিল। এই তাপসবাবুটি ফর্সা টুকটুকে চেহারা, দেখলে পুলিশ বলে মনেই হয় না, কিংবা সিমেনার নায়করা এইরকম পুলিশ সাজে।
লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তাহলে আজ সন্ধেবেলা হিরনানি ম্যানসানের বারান্দায় আপনি ঠিকই ঘুরছিলেন, অ্যাঁ? তখন মিথ্যে কথা বললেন কেন?
আমি মিহি গলায় বললুম, হ্যাঁ, আপনাকে মিথ্যে কথাই বলেছিলুম। ক্ষমা চাইছি। আপনি বুঝি জীবনে কখনো মিথ্যে কথা বলেন না?
রণেন হা হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, জানেন, তাপসবাবু, এই নীলু আমাদের কলেজে ডিবেটে ফার্স্ট হতো প্রত্যেকবার!
আমি বললুম, বাজে কথা। আমি জীবনে কখনো ডিবেট করিই নি! কোনো দিন শুনতেও যেতুম না।
রণেন বলল, ও ডিবেট নয়, আবৃত্তি! নীলু একবার রবি ঠাকুরের আফ্রিকা কবিতাটা পুরো মুখস্থ বলেছিল। তোর এখনও মনে আছে, নীলু?
তাপস রণেনের দিকে ধমকের চোখে তাকিয়ে বলল, ওসব কথা থাক। কাজের কথা হোক। আপনি রাজা সরকার সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড? এই লোকটা একটা টায়ার কোম্পানিতে পারচেজে কাজ করে। একটা প্রাইভেট গ্রুপকে সাতাশ লাখ টাকার অর্ডার পাইয়ে দিয়েছে। তার বিনিময়ে ওরা রাজা সরকারের বিয়েতে একটা গাড়ি প্রেজেন্ট করবে কথা দিয়েছিল। সাতাশ লাখ টাকার অর্ডারের বদলে একটা গাড়ি এমন কিছু না। ঠিকই ছিল। কিন্তু ওদের দলের মধ্যে একজন ডাবল ক্রস করেছে। রাজা সরকারের ওপর তার রাগ আছে। কন্ট্রাক্টটা সই হয়ে যাবার পর ওরা একটু সেলিব্রেট করার নামে রাজা সরকারকে উল্টোপাল্টা মদ খাইয়ে মাতাল করে দিয়েছিল। হুইস্কির সঙ্গে জিন মেশালে তা হজম করার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই আছে। এই রাজা সরকার তো ছেলেমানুষ। তারপর ওকে সেই অবস্থায় ভুলিয়ে–ভালিয়ে ওরা হিরনানি ম্যানসনের ফ্রি এন্টারপ্রাইজের খপ্পরে এনে তোলে। রাজা সরকারকে বলেছিল, ঐখানে ওর হাতে নতুন গাড়ির চাবিটা তুলে দেবে। এর মধ্যে ওদেরই একজন টেলিফোনে আমাদের খবর জানিয়ে দেয়।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলুম, আমাকে থামিয়ে দিয়ে রণেন বলল, তাতে ওদের লাভ হলো এই যে কনট্রাক্টটা তো অলরেডি পাওয়া হয়ে গেছে, গাড়িটা আর ওকে দিতে হলো না।
তাপস তার সঙ্গে যোগ করল, রাজা সরকারের বিয়েটাও ভেঙে দেবার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল।
—কিন্তু রাজা সরকারের বিয়ে ভেঙে দিয়ে ওদের কী লাভ?
–ঐ যে বললুম, ওদের একজনের রাজা সরকারের ওপর গোপন হিংসে আছে।
—কী জন্য হিংসে তা বলতে পারেন?
– আরে মশাই কে কাকে কী জন্য হিংসে করে, তা কি কেউ বলতে পারে? অনেক সময় কোনো কারণই থাকে না। আমাকে আমার পাড়ার কয়েকটা ছেলে হিংসে করত। কেন জানেন? শুধু আমার গায়ের রংটা ফর্সা বলে। ভাবতে পারেন?
—কিন্তু আপনারা তো ওদের সবাইকে ধরে এনেছেন, তাই না?
—তাতে কী হয়েছে? ওদের কারুর তো আর আট–দশদিন বাদে বিয়ে নয়! না হয়, কয়েকদিন গারদে থাকবে, তাতে আর এমন কি ক্ষতি হবে! ওদের মধ্যে একজন অবশ্য ছাড়া পাওয়ার জন্য দশ হাজার টাকা অফার করেছে। ক্যাশ টাকা আনতে পাঠিয়েছে।
–কে, রাজা?
–না, রাজা সরকারের এখনও ভালো করে কথা বলার ক্ষমতা নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু কাঁদছে দেখুন গিয়ে! টাকাটা অফার করেছে চঞ্চল বক্সী। সে–ই পালের গোদা। টাকাটা এসে পড়ুক আগে, তারপর এমন গোবেড়ন দেব ব্যাটাকে!
আমার মুখের ভাবের নিশ্চয়ই কিছু পরিবর্তন হয়েছিল, তাই দেখে তাপস আবার বলল, অবাক হচ্ছেন বুঝি? আমার মশাই সাব–সব কথা। ক্রিমিনালদের কাছে থেকে বদমাসদের কাছে থেকে আমরা টাকা নিই। যতটা পারি। কথায় আছে না, বর্বরস্য ধনঃ ক্ষয়ম্। ওদের হাতে টাকা থাকলেই তো তার মিস–ইউজ হবে।
রণেন বলল, এদিকে আমাদের থানা চালাবার কত খর্চা। সব কি গভর্নমেন্ট দেয়?
তাপস বলল, টাকা নিই বটে কিন্তু ছাড়ি না ঐ ক্রিমিনালদের। টাকা নেবার পরেও পেটাই। কিন্তু কোনো এম. এল. এ, এম. পি কিংবা বিশিষ্ট কোনো ভদ্রলোক ধরা পড়লে আমরা কি তাদের কাছে টাকা চাই? কক্ষনো না। টাকাও চাই না, পেটাই–ও না, তাদের নামে খবরের কাগজে জানিয়ে দিয়ে তারপর জেনুইন কেস ঠুকে দিই। শুধু মন্ত্রীদের কাছ থেকে যাদের নামে অনুরোধ আসে, তারাই ক্লিন ছাড় পেয়ে যায়। টাকাও দেয় না, কাগজেও তাদের নাম ওঠে না, আমাদের প্রমোশন নির্ভর করে এই সব কেসগুলোর ওপর। মন্ত্রীদের কাছ থেকে টেলিফোন এলে আমরা খুশিই হই, কী বলেন, রণেনবাবু?
-এ ব্যাটাদের নামে না টেলিফোন এসে যায়!
– আজ রাত্তিরে আর চান্স নেই। মন্ত্রীরাও তো মানুষ নাকি, তারা এত রাতে ঘুমোবে না?
আমি অনেকখানি দমে গিয়ে বললুম, তা হলে রাজা সরকারকে নিয়ে আপনারা কী করবেন ঠিক করেছেন?
তাপস বলল, ওর নামে ডায়েরি লেখা হয়ে গেছে, এখন আর তো কোনো উপায় নেই। রাতটা আটকে রেখে কাল সকালে কোর্টে প্রোডিউস করতে হবে।
তাপসের তুলনায় রণেনের ব্যক্তিত্ব কিছু কম। সে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে বলল, তা–তো বটেই, আর কোনো উপায়ই তো নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, রাজা সরকার কি সত্যি একজন ক্রিমিল্যাল?
তাপস আঙুল মটকাতে মটকাতে বলল, দেখুন, আমার স্পষ্ট কথা। ঐ সাতাশ লাখ টাকার কনট্রাক্টের বিনিময়ে ও যে একটা গাড়ি নিতে চেয়েছিল, তাতে পুলিশের মাথা গলাবার কিছু নেই। সেটা ওদের প্রাইভেট ব্যাপার। কিন্তু ফ্রি এন্টারপ্রাইজে গিয়ে বেলেল্লা করা, সেটা একটা অপরাধ।
—কিন্তু আপনিই তো বললেন, সেখানে ও নিজের ইচ্ছেতে আসেনি। ওকে ভুলিয়ে–ভালিয়ে নিয়ে এসেছে।
—তা তো বলেইছি।
—তা হলে একটা লোক নিরপরাধ জেনেও আপনারা তার সর্বনাশ করবেন? এই খবর রটে গেলে ওর বিয়ে ভেঙে যাবে।
–কিন্তু আমরা তো এখন কেস ডায়েরির খাতা ছিঁড়ে ফেলতে পারি না। সে রিস্ক কে নেবে? রণেনবাবু, আপনি রাজি আছেন?
রণেন আঁতকে উঠে বলল, মাথা খারাপ! আমায় চাকরি বাঁচাতে হবে না! কলেজের বন্ধু বলে কি তার কথায় আমি যা খুশি করতে পারি?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললুম, রণেন, তা হলে তোর সহকর্মীকে আমি সেইকথাটা ফাঁস করে দিই?
রণেন দু’হাত তুলে বলল, চুপ, চুপ, নীলু, চুপ কর!
তাপস সকৌতুকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? আপনার কিছু সিক্রেট আছে বুঝি?
রণেন বলল, সে কথা আপনাকে পরে বলব। এমন কিছু না। শুধু যেন বড়বাবুর কানে না যায়। ও ভাই তাপসবাবু, এই ছেলেটার জন্য যে একটা কিছু করতেই হয়। একটা উপায় বার করুন!
তাপস বলল, উপায় আমি আগেই ভেবে রেখেছি। একটাই রাস্তা খোলা আছে।
তারপর সে রণেনের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, আপনার বন্ধুকে ইম্পারসোনেট করতে হবে। উনি রাজি আছেন কিনা জিজ্ঞেস করুন!
রণেনের চোখ জ্বলে উঠল। সে মহা উৎসাহের সঙ্গে বলল, ঠিক ঠিক? এইটাই একমাত্র উপয়। নীলু, তোকে ইম্পারসোনেট করতে হবে।
আমি বললুম, তোদের ঐ পুলিশি ইংরিজি আমি বুঝি না। ইম্পারসোনেট করতে হবে মানে কী? কাকে ইম্পারসোনেট করব?
—বুঝিয়ে দিচ্ছি। বুঝিয়ে দিচ্ছি। রাজা সরকারের নামে ডায়েরি লেখা হয়ে গেছে, সেটা তো ছিঁড়ে ফেলা যায় না। মানে, খুব এক্সট্রা অর্ডিনারি কেস না হলে আমরা ছিঁড়ি না। এটা তো পেটি কেস। রাজা সরকারকে কাল কোর্টে প্রোডিউস করতেই হবে। তোর কথা মতন আমরা রাজা সরকারকে এখন ছেড়ে দিতে রাজি আছি। তার বদলে তোকে রাজা সরকার সাজতে হবে। রাত্তিরটা তুই হাজতে থেকে কাল সকালে কোর্টে যাবি! জজ সাহেব যদি ভালো মেজাজে থাকেন…
আমি লাফিয়ে উঠে বললুম, কী? আমি অন্য লোকের নামে হাজতে থাকব? কোর্টে যাব? জেল খাটব? ওরে বাবা, না, না!
আমি ছুটে পালাতে যাচ্ছিলুম, তাপস আর রণেন দু’দিক থেকে এসে আমায় চেপে ধরল। আমি চিৎকার করে বললুম, আমাকে ছেড়ে দাও! আমাকে ছেড়ে দাও! আমি জেলে যেতে রাজি নই।
রণেন আমার পিঠ চাপড়ে বলল, আরে এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। আমরা কেসটা নরম করে লিখে দেব। জজ সাহেব তোকে বেকসুর খালাস দিতে পারেন। না হয় বড়জোর মাসখানেক জেল–টেল খেটে আসবি। দেখিস খুব একটা খারাপ লাগবে না, জেলের মধ্যে সব কিছু পাওয়া যায়।
তাপস বলল, এত কষ্ট করে এসেছেন, আমাদের এতটা সময় নষ্ট করলেন, এখন আপনি ব্যাক আউট করলে চলবে কেন? আমাদের টাইমের দাম নেই? এখন আর আপনাকে ছাড়ছি না!
দু’জনে আমাকে ঠেলে ঠেলে এনে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিল। তাপস নিজের প্যাকেট খুলে বলল, নিন, একটা সিগারেট খান। চা খাবেন? আমাদের এখানে সারা রাত চা পাওয়া যায়!
যেন আমার জীবনে এই শেষ চা খাওয়া। মাথা নেড়ে বললুম, খাব! একজন কনেস্টবল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে খটাস করে এক স্যালুট দিয়ে তাপসকে বলল, স্যার চিড়িয়া ওয়াপস আয়া।
তাপস বলল, দশ হাজার হ্যায়? গিনতি কর লে–ও।
—গিনতি কর লিয়া, স্যার। সব ঠিক হ্যায়।
—যে লোকটা নিয়ে এসেছে, তাকেও ধরে রাখো।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন, এবারে যাওয়া যাক।
রণেন বলল, একটু দাঁড়ান, ও বেচারা চা–টা শেষ করে নিক। শোন নীলু, তোর বন্ধু ঐ রাজা সরকারকে আমরা ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। থানার গাড়িতে গেলে ওর বড়ির লোক ভয় পেয়ে যেতে পারে!
তাপস বলল, থানার গাড়ি পাচ্ছেনই বা কোথায়। তিনটের মধ্যে দুটো খারাপ হয়ে পড়ে আছে, একটা রাউন্ডে গেছে।
–তোকে ট্যাক্সি ভাড়াটা দিতে হবে না। সে আমরা ম্যানেজ করে নেব। আমাদের কত দিকে কত খরচ হয় দ্যাখ। এসব তো তোরা বাইরে থেকে বুঝিস না!
থানার ভেতরের এই অংশটা শুধু সিনেমাতেই দেখেছি দু’একবার। লোহার একটা গেট খোলার পর ভেতরে ছোট ছোট খুপরি। তার মধ্যে কেউ শুয়ে আছে, কেউ বসে আছে, কেউ ওরই মধ্যে থুতু ফেলছে। বমির বিকট গন্ধ এলো নাকে দু’একজন লোকের চেহারা দেখে মনে হয়, দু’দশটা খুন করা ওদের পক্ষে কিছুই না।
একটা ঘরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে রাজা। এখনও একটু একটু ফোঁপাচ্ছে। নেশা অনেকটা কেটে গেছে মনে হয়।
তাপস বলল, রাজা সরকার! উঠে আসুন, রাজা সরকার!
আমি উল্টো দিকে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালুম। রাজা যেন আমাকে দেখতে না পায়। আমারও তো একটা প্রেস্টিজ আছে!
রাজা উঠে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। তাপস বলল, এইসব বাজে লোকের সঙ্গে মেশেন কেন? মদ খেতে হয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে। অন্য কেউ স্কচ খাওয়াতে চাইলেও হুট করে রাজি হয়ে যেতে নেই
রণেন বলল, এবারে আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। ফের যদি কোনো দিন হিরনানি ম্যানসানের ধারে–কাছে দেখি, এক বছর জেলের ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়ব, আর কাগজে নাম ছাপিয়ে দেব!
রাজা একটি কথাও বলল না। কথা বলার ক্ষমতা নেই বেচারার। রণেন তার হাত ধরে নিয়ে গেল।
তাপস আমার দিকে ফিরে বলল, নিন, এবারে আপনি ঢুকে পড়ুন।
সেলটার মধ্যে দু’জন লোক শুয়ে আছে, আর একজন লোক বসে আছে তীব্র চোখ মেলে। সব ঘটনাটা সে দেখল ড্যাবডেবিয়ে। এবারে সে বলে উঠল, তাপসবাবু, আপনি ওকে…
তাকে শেষ করতে না দিয়ে তাপস হুংকার দিয়ে বলে উঠল, চোপ! তারপর তাকে ক্যাৎ করে একটা লাথি কষাল।
সঙ্গে সঙ্গেই আবার আমার দিকে ফিরে হেসে বলল, আপনাকে এখানেই থাকতে হবে, অন্য কোনো সেলে জায়গা নেই। এই লোকটাই পালের গোদা, এর নাম চঞ্চল বক্সী। এ যদি আপনাকে আঁচড়ে কামড়ে দিতে আসে, আপনি দরওয়াজা, দরওয়াজা বলে চ্যাঁচাবেন। আমরা এসে ওর হাত–পায়ের কবজিগুলো ভেঙে দেব। এমনিতেই আমি খাওয়া–দাওয়া সেরে আর একবার রাউন্ডে আসছি। ওর সঙ্গে কথা আছে।
আমি ধপ করে বসে পড়লুম সেখানে। একেবারে সেই লোকটার মুখোমুখি। আমি এখন রাজা সরকার!