2 of 2

ঘটকী লাগালেন অনুকূল বর্মা – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

ঘটকী লাগালেন অনুকূল বর্মা – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

অনুকূল বর্মা মানুষটি ছোট্টখাট্টো। একটু মোটার দিকেই ঝুঁকেছেন। বয়েস আন্দাজ করা শক্ত। পঞ্চাশ হতে পারে। পঁয়ষট্টি হওয়াও বিচিত্র নয়। চোখ দুটো বড়ও নয়, ছোটও নয়। চোখের তারা কটা। কিন্তু সেই চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত। ঠিক ধূর্ত বলা চলে না। বরঞ্চ ধারালো বললেই খানিকটা সঠিক বলা হয়।

তাঁর মাথার মাঝখানের চুল পাতলা হয়ে এসেছে। ছোট্ট একটা টাক পড়ি-পড়ি করেও এখনও পড়েনি। দুপাশের জুলপিতে কয়েকটা পাকা চুল চোখে পড়ে।

টেবিল থেকে অদ্ভুত গড়নের মোটা পাইপটা তুলে অনুকূল বর্মা ধরালেন। এই পাইপটাকে তিনি বলে থাকেন, তাঁর ফ্রেন্ড, ফিলসফার এবং গাইড।

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সকালের ডাকে-আসা চিঠিগুলো তিনি দেখতে লাগলেন।

আজকের চিঠির সংখ্যা খুব বেশি নয়। দুটো বিয়ের, একটা অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ। একটা টেলিফোন, একটা ইলেকট্রিকের বিল। একজন ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের দুঃস্থ অবস্থার কথা জানিয়ে কিছু অর্থ-সাহায্য চেয়েছে।

কিন্তু শেষ চিঠিটা পড়ে তাঁর ভুরু কুঁচকে উঠল। তাঁর কটা চোখের দৃষ্টি ধূর্তও হয়ে উঠল না, ধারালোও হয়ে উঠল না। তাঁর চাউনির মধ্যে শুধু ফুটে উঠল দারুণ একটা বিরক্তি।

চিঠিটা ইংরেজিতে টাইপ করা। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের অফিস থেকে লিখছে তাঁর সেক্রেটারি—মালবিকা রায়।

চিঠিটার ভাবার্থ এই মিস্টার সাহা ছোট একটা ব্যাপারে অনুকূল বর্মাকে অ্যাপয়েন্ট করতে চান। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। সময় খুব কম। তাই নিজে আসতে পারলেন না। অনুকূল বর্মা যেন আজ বিকেল তিনটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে অতি অবশ্য (‘উইদাউট ফেল’ কথাগুলোর তলায় লালকালিতে দাগ দেওয়া) মিস্টার সাহার সঙ্গে তাঁর অফিসে দেখা করেন।

চিঠিটার মধ্যে এমন একটা ঔদ্ধত্য ফুটে উঠেছে, যেটা প্রায় ধৃষ্টতার সামিল। বিশেষ করে ওই কথাগুলোর মধ্যে—’অ্যাপয়েন্ট’ আর ‘উইদাউট ফেল’।

চিঠিটা টেবিলে রেখে স্যুইভেল চেয়ারে হেলান দিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে অনুকূল বর্মা নিঃশব্দে পাইপ টানতে লাগলেন।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহার নাম তাঁর বিলক্ষণ জানা। শুধু তাঁর কেন, বাংলার বহু লোকের এবং বাংলার বাইরেও অনেকের। লোকটার গোটা-তিনেক কোলিয়ারি, একটা ফায়ার ব্রিকস-এর কারখানা, দুটো চালকল আর কয়েকটা রেসের ঘোড়া আছে। অর্থাৎ মানুষটা যে প্রায় কোটিপতি, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু যে সাদা বাজারেই তাঁর কারবার, তা নয়। লোকে বলে, কালোবাজারের কারবারেও তিনি কম যান না।

তাঁর সম্বন্ধে আরও নানা গুজব আর সন্দেহের কথা অনুকূল বর্মার কানে এসেছে।

সেই মানুষটার অনুকূল বর্মার সাহায্যের দরকার হলে কোনও ‘ছোট ব্যাপারের’ জন্য হওয়ার কথা নয়।

চিঠিতে এই ‘ছোট ব্যাপারের’ উল্লেখ থাকার জন্যই অনুকূল বর্মা সেটা ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিলেন না। আরও খানিক পাইপ টেনে তিনি টেবিলের গায়ে আটকানো কলিংবেলের বোতাম টিপলেন।

পাশের ঘরের টাইপরাইটারের খটখট শব্দ থেমে গেল। হাতে শর্টহ্যান্ডের খাতা আর পেনসিল নিয়ে দরজা ঠেলে একটি মেয়ে ঘরে এল। পরনে তার লালপাড় শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। বয়েস ত্রিশের কাছাকাছি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা।

মেয়েটির বাবা-মা নেই। অনুকূল বর্মার দূরসম্পর্কের ভাইয়ের মেয়ে। তাঁর কাছেই মানুষ। ইতিহাসে এম-এ পাশ করে শর্টহ্যান্ড আর টাইপরাইটিং শিখেছে। তারপর থেকেই অনুকূল বর্মার সে সেক্রেটারি।

বিয়ে সে করেনি। বিয়ের কথা বললে অনুকূল বর্মাকে সে হেসে বলে, ‘জেঠু, এখনও মনের মতো কোনও ক্রিমিন্যালকে খুঁজে পাচ্ছি না।’ মেয়েটির নাম মাধবী।

সে আসতে মৃদু হেসে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘মাধু-মা, এই চিঠিটা দেখেছিস?’

অবাক স্বরে মাধবী বলল, ‘এখনও ওটাকে ওয়েস্ট পেপার বাক্সেটে ফেলে দাওনি, জেঠু?’

পাইপটা টেবিলে নামিয়ে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘নারে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সেক্রেটারিকে ফোনে জানিয়ে দিস, বিকেল তিনটে পঁয়তাল্লিশে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের আপিসে আমি দেখা করতে যাব।’

যেন আকাশ থেকে পড়ে মাধবী বলল, ‘বলছ কী, জেঠু? এরকম একটা ইম্পার্টিনেন্ট লোকের সঙ্গে তার আপিসে গিয়ে দেখা করবে?’

‘ইম্পার্টিনেন্ট বলে নয় রে,’ পাইপটটা তুলে নিলেন অনুকূল বর্মা ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বড়-বড় কারবার করে। আমিও বড়-বড় কেস করি। কিন্তু কী কারণে একটা ছোট ব্যাপারের জন্যে আমাকে সে অ্যাপয়েন্ট করতে চায়, জানতে ইচ্ছে করছে।’

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বিরাট বাড়িটার একতলা আর দোতলা জুড়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অফিস। অনুকূল বর্মা সময় সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। কিন্তু কী যেন ভেবে তিনি সেখানে পৌঁছলেন মিনিট পনেরো আগে। একতলার বেয়ারা জানাল, সাহাসাহেবের কামরা দোতলায়।

রিসেপশন রুম দোতলায়। ঘরটায় আগাগোড়া পুরু কার্পেট বিছানো। গদিমোড়া দামি-দামি সোফা-সেটি। এককোণে রিসেপশনিস্টের ছোট টেবিল আর চেয়ার।

রিসেপশনিস্টের মাথায় বাবুইপাখির বাসার মতো বেয়াড়ারকম বড় খোঁপা। ঠোঁটে টকটকে লিপস্টিক। চোখ আর ভুরু নিখুঁতভাবে আঁকা। তার ফিকে নীল, প্রায় স্বচ্ছ নাইলন শাড়ির ভেতর দিয়ে অতি-সংক্ষিপ্ত চোলি-ব্লাউজ আর বুকের নীচ থেকে নাভি পর্যন্ত ধবধবে শরীরের অনেকটা অংশ এমনভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দেখলে যে-কোনও শালীনতাবোধসম্পন্ন মানুষের বিব্রত হওয়ার কথা। মেয়েটি নিখুঁত সুন্দরী। সমস্ত শরীর থেকে উদ্ধত যৌবন যেন উপচে পড়ছে। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে যেটা উদ্ধত, সেটা তার মুখের ভাব। ঔদ্ধত্যের সঙ্গে কেমন যেন একটা নিষ্ঠুরতা মেশানো। পায়ে উঁচু হিলের জুতো।

সমস্ত শরীরে ঢেউ খেলিয়ে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে অনুকূল বর্মার কাছে এগিয়ে এসে সে বলল, ‘ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’

অনুকূল বর্মা নিজের কার্ড এগিয়ে দিলেন।

মেয়েটি ইন্টারকম টেলিফোন তুলে খুব সম্ভব বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সঙ্গেই কথা বলল। তারপর আবার সমস্ত দেহ হিল্লোলিত করে অনুকূল বর্মার দিকে ফিরে বলল, ‘ইউ আর ফিফটিন মিনিটস টু আর্লি। প্লিজ ওয়েট। আপনার কার্ডটা দিয়ে আসছি।’

পাশের ঘরের দরজা ঠেলে মেয়েটি ভেতরে গেল।

সঙ্গে-সঙ্গেই দরজার উপরকার ‘Don’t Disturb’ লেখা লাল একটা আলো জ্বলে উঠল।

অনুকূল বর্মা মৃদু হাসলেন। তারপর নরম একটা গদিমোড়া চেয়ারে বসে তাঁর সেই অদ্ভুত গড়নের মোটা পাইপটা বের করে তামাক ভরতে লাগলেন।

কাঁটায়-কাঁটায় তিনটে পঁয়তাল্লিশে সেই দরজা খুলে সমস্ত দেহ দুলিয়ে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বেরিয়ে এল। মুখে তার চাপা হাসি। আর সামান্য যেন হাঁপাচ্ছে।

দরজার ওপরকার লাল বাতিটা নিভে গেল।

নিজের চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর থেকে গাঢ় নীল রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছোট্ট গোল কম্প্যাক্ট কেসের আয়নায় নিজের মুখ চট করে দেখে নিল সে। তারপর খুট করে কম্প্যাক্ট কেস বন্ধ করে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরতে-ভরতে অনুকূল বর্মার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ইয়েস, নাও ইউ ক্যান গো ইন। মিস্টার সাহা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ফরসা। একটু নাদুসনুদুস গড়নের। খানিকটা বেঁটে মতো। বিরাট টেবিলটার ওপাশে দাঁড়িয়ে ব্যস্তভাবে কতকগুলো কাগজপত্র গোছাচ্ছিলেন।

অনুকূল বর্মাকে দেখে বললেন, ‘আই অ্যাম সো সরি, মিস্টার বর্মা। আপনাকে কিছুটা অপেক্ষা করতে হল। আই অ্যাম এ ফ্রাইটফুলি বিজি ম্যান। হাজার ঝামেলা সামলাতে হয়। সিট ডাউন, সিট ডাউন।’

স্পষ্টভাবে মুখের দিকে না তাকিয়েও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মানুষের চেহারার সব কিছু খুঁটিনাটি লক্ষ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা অনুকূল বর্মার আছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঠোঁটের ডানপাশের ওপরকার অস্পষ্ট ছোট্ট লালচে ছোপটা তাঁর চোখ এড়িয়ে গেল না!

মৃদু হাসলেন তিনি।

তারপর চেয়ারে বসে পাইপে তামাক ভরতে-ভরতে গম্ভীর স্বরেই প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, মিস্টার সাহা?’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণও তখন সামনে থেকে কাগজপত্র সরিয়ে টেবিলের ওপাশে স্যুইভেল চেয়ারে বসে পড়েছেন।

তিনি বলে চললেন, ‘দেখুন মিস্টার বর্মা, আমি মানুষটা খুব সিম্পল গোছের। কিন্তু বোকা নই! পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মাড়োয়ারি—নানা জাতের বিচ্ছু-বিচ্ছু লোক চরিয়ে আমাকে খেতে হয়। সবাই সবসময় ঠকাবার জন্যে যেন ওত পেতে আছে। কিন্তু আমাকে ঠকানো ভারী শক্ত মিস্টার বর্মা—ভারী শক্ত! এ-কথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আই অ্যাম ভেরি রিচ। পাঁচশো টাকা আমার কাছে কিছুই নয়। কিন্তু তাই বলে পাঁচশো টাকা কেউ ঠকিয়ে নেবে—এটা কিছুতেই বরদাস্ত করব না। আই শ্যাল নট টলারেট!’ উত্তেজিত হয়ে টেবিলের ওপর সজোরে তিনি ঘুষি মারলেন।

বাঁ-পায়ের ওপর ডান-পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আধবোজা চোখে সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে পাইপ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘মাত্র পাঁচশো টাকার ব্যাপারে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? কিন্তু জানেন বোধহয়, আমার ফি খুব চড়া। তাই ছোটখাটো কেসে আমাকে কেউ ডাকে না। লোকে আমাকে কনসাল্ট করে সাধারণত মার্ডার কেসে—।’ বলতে-বলতে চট করে তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন।

হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।

অনুকূল বর্মা আবার সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে আধবোজা চোখে বলে চললেন, ‘হ্যাঁ, মার্ডার কেসে, বড়-বড় ডাকাতির কেসে, লাখ-লাখ টাকার হীরে-জহরত চুরির কেসে।’

‘জানি, মিস্টার বর্মা, জানি।’ ততক্ষণে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছেন। ‘কিন্তু ওই যে বললাম, কেউ আমাকে একপয়সা ঠকায়, সেটা আমি বরদাস্ত করতে পারি না। তাই এই সামান্য পাঁচশো টাকার ব্যাপারে আপনাকে ডেকেছি। খরচের জন্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তোয়াক্কা করে না। ব্যাপারটা আপনাকে গোড়া থেকে বলি। এটা একটা কুকুর চুরির ব্যাপার—।’

‘কুকুর চুরি!’ বাস্তবিকই অবাক হয়ে চেয়ারে খাড়া হয়ে বসলেন অনুকূল বর্মা।

‘হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর কুকুর চুরি। শুনুন, ব্যাপারটা ঘটেছিল—।’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যে-ঘটনার কথা বললেন, সংক্ষেপে সেটা এই তাঁর স্ত্রীর ছোট একটা পমেরেনিয়ান কুকুর আছে। নাম জংলি। রোজ সন্ধেয় দেশপ্রিয় পার্কে সেটাকে বেড়াতে নিয়ে যায় তাঁদের বাড়ির কমলা নামে এক মাঝবয়েসি মেয়ে। কমলা ঠিক ঝি নয়—তাঁদের বাড়িতে থাকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গিনী হিসেবে। মেয়েটি বিশেষ চালাক-চতুর না হলেও ভদ্রঘরের মেয়ে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্ত্রীর স্বাস্থ্য কোনওকালেই ভালো নয়। হালে তাঁর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটেছে। তাই তাঁর দিন-রাতের একজন সঙ্গিনীর দরকার। ব্যাপারটা ঘটে সাতদিন আগে। জংলিকে নিয়ে যথারীতি কমলা গেছে সেদিন সন্ধেয় দেশপ্রিয় পার্কে বেড়াতে। টেনিস-কোর্টের কাছে কমলার সঙ্গে দেখা হয় তার এক পরিচিতা মেয়ের। তারা দুজনে সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খানিক গল্প করছিল। চামড়ার স্ট্র্যাপে বাঁধা ছিল জংলি। বাড়ি ফেরার সময় স্ট্র্যাপে টান দিতে গিয়ে কমলা দেখে স্ট্র্যাপ কাটা। জংলি নিখোঁজ। কমলার হাউহাউ কান্না শুনে ভিড় জমে যায়। টেনিস-কোর্টের যে-মার্কার সেও ছুটে আসে। সবাই জংলিকে খোঁজে। কিন্তু কোনও হদিশ পাওয়া যায় না। কাঁদতে-কাঁদতে কমলা বাড়ি ফিরে মিসেস সাহাকে সব কথা জানায়। কিন্তু তার আগেই মিসেস সাহা কুকুর-চুরির খবর পেয়েছিলেন টেলিফোনে। অজানা মেয়েলি গলায় কে একজন টেলিফোনে জানায় এলিয়ট রোডের হোটেল ‘নেপচুনে’ মিস্টার হার্বার্টের নামে পাঁচ টাকার নোটে পাঁচশো টাকা দিনদুয়েকের মধ্যে না পাঠালে কিংবা পুলিশে খবর দিলে জংলির বদলে বাড়িতে পৌঁছবে জংলির মৃতদেহ। মিসেস সাহা সঙ্গে-সঙ্গে করকরে নতুন পাঁচ টাকার নোটে পাঁচশো টাকা খামে ভরে সেই রাতেই কমলাকে দিয়ে বালিগঞ্জের পোস্ট আফিসে সেটা পোস্ট করান। তাঁদের বাড়িতে সবসময়েই প্রচুর ডাকটিকিট মজুত থাকে। তাই কোনও অসুবিধে হয়নি। পরের দিন রাতে দরজা আঁচড়ানোর শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখা যায় জংলি হাজির।

একটা সিগারেট ধরিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘জংলিকে কিনে দিয়েছিলাম মাত্র দুশো টাকায়! পাছে থানা-পুলিশ করি সেই ভয়ে আমার স্ত্রী এ-ঘটনার কথা আগে আমায় জানাননি। পরে জানতে পেরে আমি খুব রাগারাগি করি। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে তো ঝগড়া করে জেতা যায় না! তাই পাঁচশোটা টাকা জলে গেল ভেবে ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়েই ফেলেছিলাম। হয়তো বেবাক ভুলেই যেতাম, যদি না গত পরশু হরিনারায়ণ সান্যালের সঙ্গে ক্যালকাটা ক্লাবে দেখা হত। সান্যাল অনেকগুলো চা-বাগানের মালিক। আমার অনেকদিনের বন্ধু। আমি থাকি ল্যান্সডাউন টেরেসে, সান্যাল কেয়াতলায় প্রকাণ্ড বাড়ি করেছে। তার বেলাতেও হুবহু একই ঘটনা ঘটে। তার স্ত্রীকেও পাঁচশো টাকা খেসারত দিয়ে তাঁর পমেরেনিয়ান কুকুর উদ্ধার করতে হয়েছে। তফাতের মধ্যে এই—আমার স্ত্রীর কুকুর চুরি যায় দেশপ্রিয় পার্কে, তার স্ত্রীরটা যায় ট্যাঙ্গুলার পার্কে। মনে হল, ব্যাপারটা মাত্রা ছাড়াতে চলেছে। তাই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। জংলির ব্যাপারে কিছুতেই আমার স্ত্রী পুলিশে খবর দিতে দেননি। তাঁর ধারণা, পুলিশে খবর দিলে তাঁর জংলির নিশ্চয়ই কোনও বিপদ ঘটবে। তিনি জানেন, আপনি পুলিশের লোক নন। তবুও আপনাকে ডেকেছি বলে তিনি খুশি হননি।’

মৃদু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একবার আমার দেখা করা দরকার। তিনি হয়তো আরও কিছু নতুন খবর দিতে পারবেন। ভবিষ্যতে তাঁর জংলি আর কোনও বিপদে পড়বে না—আমার মুখ থেকে সে-কথা শুনলে তিনি হয়তো খানিকটা স্বস্তি পাবেন। তাঁকে ফোনে জানিয়ে দিন আধঘণ্টার মধ্যে আমি যাচ্ছি।’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়ির ড্রইংরুম দামি-দামি আসবাবপত্রে ঠাসা। যেন একটু বাড়াবাড়ি ধরনের সাজানো। দেখে মনে হয়, মার্জিত রুচিকে টেক্কা দিয়েছে নিজেদের ঐশ্বর্য জাহির করার প্রচেষ্টা।

মিসেস সাহার চেহারাটা রুগণ শুকনো গোছের। রুজ-পাউডারের প্রলেপও তাঁর মুখের ক্লান্তির ছাপ চাপা দিতে পারেনি। চোখের কোল বসা। চাউনি দেখলেই মনে হয়, মানুষটা খিটখিটে গোছের। সবুজ নরম একটা সোফার কোণ ঘেঁষে তিনি বসেছিলেন। তাঁর পিঠে আর চারপাশে নানা রঙের কুশন। কোলে লোমওলা ছোট একটা কুকুর।

অনুকূল বর্মা ঘরে ঢুকতেই কুকুরটা চক্ষের নিমেষে তাঁর কোল থেকে একলাফে নেমে ঘেউঘেউ করতে-করতে এগিয়ে এল।

‘এই জংলু, জংলু—চলে আয় মানিক আমার, মা’র কোলে ফিরে আয়। এই কমলা, হাঁ করে দেখছ কী! জংলুকে তুলে নিতে পারছ না! আমার কাছে এনে দাও।’ শেষের দিকে কথাগুলো তিনি প্রায় খিঁচিয়ে বললেন।

কমলা নামে মেয়েটির দোহারা চেহারা—মুখটা ভালোমানুষ-ভালোমানুষ, খানিকটা যেন বোকাসোকা ধরনের। দেখলেই মনে হয়, মিসেস সাহাকে সে যমের মতো ভয় করে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে কুকুরটাকে তুলে নিয়ে মিসেস সাহার কোলের ওপর সে ছেড়ে দিল।

একটা গদিমোড়া চেয়ারে বসে অমায়িক হেসে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘বাঃ, এ তো দেখছি ডগ-শো’তে প্রাইজ পাওয়ার মতো কুকুর! জংলি নামটাও খুব সুন্দর দিয়েছেন, মিসেস সাহা। বাঙালি বাড়িতে কুকুরের বিলিতি নাম আমার একেবারে বরদাস্ত হয় না।’

জংলির প্রশংসা শুনে স্পষ্টই প্রসন্ন হয়ে উঠলেন মিসেস সাহা।

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘আপনার স্বামীর কাছে মোটামুটি ঘটনাটা শুনেছি। কিন্তু স্বামীরা হাজার কাজের ঝামেলায় থাকেন। অনেক খুঁটিনাটি কথা মনে থাকে না। তাই আপনার কাছে এলুম আর-একবার শুনতে। যত তুচ্ছই মনে হোক, কোনও কথা বাদ দেবেন না।’

কুকুর চুরির কাহিনি কমলার মুখে আবার শুনলেন অনুকূল বর্মা। টেলিফোনের কথা শুনলেন মিসেস সাহার মুখে। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে মিসেস সাহা জানালেন, টেলিফোনের স্বর একেবারে তাঁর অচেনা—তবে সেটা যে কোনও বাঙালি মেয়ের গলা, তাতে সন্দেহ নেই।

কমলা আর মিসেস সাহার কাছ থেকে নতুন কোনও তথ্য সংগ্রহ করতে না পেরে খানিকটা হতাশই হলেন অনুকূল বর্মা।

এমনসময় দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং-ঢং করে পাঁচটা বাজল।

চমকে উঠে কমলা বলল, ‘আপনার টনিক খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, বউদি। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’

কমলা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে সামনে ঝুঁকে গলা নামিয়ে অনুকূল বর্মা প্রশ্ন করলেন, ‘কমলা সম্বন্ধে আপনার কী মনে হয়? ওর কাছ থেকেই আপনার জংলু যখন চুরি গিয়েছিল, তখন ওর সম্বন্ধে ভালো করে খবর নেওয়া দরকার।’

হেসে মিসেস সাহা বললেন, ‘না, না, ওকে সন্দেহ করার কিছু নেই। আমার কাছে বছরখানেক আছে। তার আগে ছিল মিত্তিরদের বাড়িতে পাঁচ বছর। মিত্তিরগিন্নির শাশুড়ির খুব সেবা-যত্ন করেছে। মিত্তিরগিন্নি নিজে আমাকে বলেছে, মানুষটার স্বভাব-চরিত্র খুব ভালো। খুব বিশ্বাসী। তা ছাড়া, জংলুকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। জংলুও ওকে পছন্দ করে খুব। একমাত্র দোষ, ভয়ানক বোকা। মাথায় একেবারে গোবর ভরা।’

এমনসময় একটা ট্রেতে কাঁচের গ্লাসে এক গ্লাস জল, একটা খালি পেয়ালা-পিরিচ, একটা চামচ আর পেটমোটা একটা বেঁটে শিশি নিয়ে কমলা ঘরে এল।

সেই শিশি থেকে লালচে রঙের দু-চামচ টনিক পেয়ালায় ঢেলে সামান্য জল মিশিয়ে ঢক করে খেয়ে মিসেস সাহা মুখ বিকৃত করলেন। তারপর সাদা ন্যাপকিনে মুখ মুছে অনুকূল বর্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জংলু চুরি যাওয়ার পর থেকে মুখে কিছু রোচে না। এই টনিকটা খেতে খুব ভালো। কিন্তু আজকাল এটাও কেমন যেন বিস্বাদ লাগে।’

অনুকূল বর্মা সেই বেঁটে শিশিটা তুলে নিয়ে দেখলেন সেটা বিখ্যাত স্যান্ডোজ কোম্পানির Santevini নামের টনিক।

শিশিটা খাবার ট্রেতে রেখে তিনি বললেন, ‘এটা তো বিখ্যাত টনিক, মিসেস সাহা। বিস্বাদ হওয়ার তো কথা নয়।’

মিসেস সাহা বললেন, ‘আমার স্বামীও তাই বলেন। তিনি এটা নিজে কিনে আনেন চৌরঙ্গির ফ্র্যাঙ্ক রস থেকে। তবে আজকাল কোনও জিনিসে বিশ্বাস নেই। সব কিছুতেই ভেজাল।’

দাঁড়িয়ে উঠে খানিকটা আপনমনেই যেন অনুকূল বর্মা বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন, মিসেস সাহা। সব কিছুতেই ভেজাল—।’

তখন তাঁর মনে পড়ছিল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঠোঁটের ডানপাশের ওপরকার অস্পষ্ট লালচে ছোট্ট ছোপটার কথা।

কমলা মেয়েটিকে বোকাসোকা ভালোমানুষ বলে মনে হলেও তার সম্বন্ধে খুঁটিয়ে খবরাখবর নেওয়া দরকার বলে অনুকূল বর্মার মনে হল। ল্যান্সডাউন টেরেস থেকে দেশপ্রিয় পার্ক খুব কাছেই। হাঁটতে-হাঁটতে সেখানে গিয়ে টেনিস-ক্লাবের মার্কারদের সঙ্গে তিনি কথা বললেন।

মার্কাররা সংখ্যায় আটজন। তাদের অনেকেই কমলাকে সন্ধের দিকে একটা পমেরেনিয়ান কুকুর নিয়ে বেড়াতে দেখেছে। দিন-সাতেক আগেকার সেই কুকুর চুরির কথা যার স্পষ্ট মনে পড়ল, সে-লোকটার নাম আর্নেস্ট—বাঙালি ক্রিশ্চান, বয়েস প্রায় চল্লিশ। তার নিজেরও কুকুর আছে। কুকুর চুরির পর কমলাকে কান্নাকাটি করতে দেখে স্বভাবতই কমলার প্রতি তার সমবেদনা জাগে। সমস্ত পার্ক তোলপাড় করে সে খোঁজে। কিন্তু কুকুরটার হদিশ পায় না। বলল, ‘সমস্ত ইন্সিডেন্টটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে বইকি। আই অ্যাম অলসো এ ডগ-লাভার, স্যার!’

দেশপ্রিয় পার্ক থেকে অনুকূল বর্মা গেলেন গড়িয়াহাটায় মিত্তিরদের বাড়ি।

মিস্টার মিত্রকে কমলার কথা জিগ্যেস করতে তিনি বললেন, ‘কমলাকে আমরা সবাই খুব ভালো করে জানি। পাঁচ বছর ধরে মা’র কী সেবা-যত্নই না করেছে! ভারী বিশ্বাসী আর ভালোমানুষ গোছের। কুকুর খুব ভালোবাসত। মা’র একটা পমেরেনিয়ান ছিল। নাম ঝুমড়ু। বলতে গেলে, সেটা তো চব্বিশ ঘণ্টা কমলার পেছন-পেছন ঘুরত। মা মারা যাওয়ার আগে বলে যান, কুকুরটা কমলাকে যেন আমরা দিয়ে দিই। তাই দেওয়া হয়েছিল। বছরখানেক আগে কমলার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের কাছে খবরাখবর নেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহার স্ত্রী। আমার স্ত্রী তো কমলা সম্বন্ধে খুবই ভালো সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। মাঝে কমলা একবার আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। মা যে-কুকুরটা কমলাকে দিয়েছিলেন, সেটা নাকি মারা যায়। কুকুরটার জন্যে আমার স্ত্রীর কাছে সে খুব কান্নাকাটি করেছিল। তখনও সে কোনও কাজ জোটাতে পারেনি। নিজের এক রুগণ বোনের দেখাশোনা করত।’

মিত্তিরদের বাড়ি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে অনুকূল বর্মা সোজা চলে এলেন এলিয়ট রোডের ‘নেপচুন’ হোটেলে। সন্ধে তখন সাড়ে সাতটা। এটা মোটামুটি ফিরিঙ্গি পাড়া। কয়েকটা ছোট ‘বার’, ‘নেপচুন’ জাতীয় নানা ছোটখাটো হোটেল, আর বোর্ডিং-হাউস আছে।

সেখানে ঢুকতেই রসুন-পেঁয়াজ দিয়ে মাংস রান্নার কড়া একটা গন্ধ অনুকূল বর্মার নাকে এল। সামনের ঘরটা ছোট। কম পাওয়ারের একটা ইলেকট্রিক বালব টিমটিম করে জ্বলছে। ডান দিকের কোণে ছোট একটা টেবিল-চেয়ার। তার পাশের দেওয়ালে একটা কাঠের বোর্ডে নানা খাম-পোস্টকার্ড আটকানো। দেখলেই বোঝা যায়, এখানকার বাসিন্দাদের চিঠিপত্র—তারা নিজেরাই সেগুলো সংগ্রহ করে নেয়।

ঘরে কেউ ছিল না। অনুকূল বর্মা সেই চিঠির বোর্ডের কাছে গিয়ে খানিক তাকিয়ে রইলেন, তারপর কলিংবেল টিপলেন।

পাশের দরজা দিয়ে এক রোগা রোদে-পোড়া চেহারার লোক বেরিয়ে এল। তার পরনের সাদা টাউজার বিশেষ পরিষ্কার নয়। শার্টটার অবস্থাও তথৈবচ। সবুজ টাইটা পোকায় কাটা, নোংরা।

ইংরেজিতে সে বলল, ‘সরি, একটু কাজে ভেতরে যেতে হয়েছিল। আপনার ঘরের দরকার?’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘না, এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর খোঁজে। নাম মিস্টার হার্বার্ট। তিনি আছেন?’

‘না মিস্টার, এখানে হার্বার্ট নামে কেউ এখন নেই।’

চিঠির বোর্ডটা দেখিয়ে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘আপনার হোটেলে যারা থাকে না, মাঝে-মাঝে তাদের নামেও এখানে চিঠি আসে, তাই না?’

‘হ্যাঁ, অনেকসময় আসে।’

‘সেইসব চিঠিপত্র নিয়ে কী করেন?’

‘ওই চিঠির বোর্ডে আটকে রাখি। এখন না থাকলেও পরে সেই নামের লোক আসতে পারে। বহুবার সেরকম ঘটনা ঘটেছে। দিন-সাতেকের মধ্যে সে-নামের লোক না এলে চিঠি যারা পাঠায় তাদের নামে পোস্টে ফেরত পাঠাই।’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘আমার বন্ধু হার্বার্টের নামে দিনকয়েক আগে এখানকার ঠিকানায় একটা চিঠি দিয়েছিলাম। সে-চিঠিটা বোর্ডে দেখছি না।’

‘নিশ্চয়ই, সেটা আপনার নামে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আজকালের মধ্যেই ফেরত পাবেন।—আমার হোটেলের ঘর-টর দেখবেন না, স্যার? ব্যবস্থা ফার্স্ট ক্লাস। রান্নাবান্না খুব ভালো। মোগলাই ডিশ থেকে ইউরোপিয়ান ফুড—যা চাইবেন পাবেন। আমাদের রেটও খুব সস্তা। আশা করি, দরকার হলে এখানে আসবেন, আপনার বন্ধু-বান্ধবদেরও রেকমেন্ড করবেন।’

‘অফ কোর্স! অফ কোর্স!’ বলতে-বলতে অনুকূল বর্মা ‘নেপচুন’ হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন। সন্ধে তখন সোয়া আটটা।

এলিয়ট রোডের এক ডাক্তারখানার বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল সেখান থেকে টেলিফোন করা যায়। নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে অনুকূল বর্মা সেই ডাক্তারখানায় ঢুকে হরিনারায়ণ সান্যালের বাড়ির টেলিফোন নম্বর ডিরেক্টরি থেকে বের করে ডায়াল করলেন।

মেয়েলি গলায় উত্তর এল ‘হ্যালো, আমি মিসেস সান্যাল কথা বলছি!’

‘আমার নাম অনুকূল বর্মা। একটা কুকুর চুরির ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। দেখা করার পক্ষে এখন হয়তো একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। কাল কোনও সময়ে—।’

বাধা দিয়ে মিসেস সান্যাল বললেন, ‘মোটেই না—মোটেই না। আমার স্বামী ক্যালকাটা ক্লাবে পার্টিতে গেছেন। রাত বারোটার আগে ফিরবেন না। স্বচ্ছন্দে এখনই আসতে পারেন। এমনিতেই আমার ঘুম হয় না। আপনি কি সেই বিখ্যাত অনুকূল—।’

বাধা দিয়ে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘হ্যাঁ, ডিটেকটিভ! ন’টার মধ্যে পৌঁছচ্ছি।’

ডাক্তারখানা থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে তিনি বললেন, ‘বালিগঞ্জ—কেয়াতলা।’

হরিনারায়ণ সান্যাল আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহার ড্রইংরুম মোটামুটি একইরকম সাজানো। মিসেস সান্যালের পমেরেনিয়ানটাও মিসেস সাহার কুকুরের মতো হুবহু একইরকম দেখতে। তাঁর সঙ্গিনীর সঙ্গেও কমলার চেহারার অনেক মিল। মিল নেই শুধু বীরেন্দ্রকৃষ্ণর স্ত্রীর সঙ্গে মিসেস সান্যালের চেহারার আর বেশভূষার।

মিসেস সান্যালের চেহারা যাকে বলে গোলগাল ধরনের। বব করে চুল ছাঁটা। পরনে কমলা রঙের বেল-বটম আর হাতকাটা টি-শার্ট। ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক আর সিগারেট। অনর্গল তিনি কথা, বলে যান, যেন তুবড়ি ফুটছে।

‘—বাস্তবিকই সব দোষ এই চপলার। আমার প্যানজিকে নিয়ে ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে বেড়ানোর কথা। আর উনি কিনা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে মোহিত হয়ে ভালুক-নাচ দেখছিলেন। বলুন, মিস্টার বর্মা, ওর কি এখন ভালুক-নাচ দেখার বয়েস আছে?’

তারপরের ঘটনাগুলো হুবহু এক। এমনকি মেয়েলি গলায় টেলিফোনে পাঁচ টাকার নোটে পাঁচশো টাকার দাবি, নইলে প্যানজির মৃতদেহ পাঠানোর ভয় দেখানো পর্যন্ত। তফাত শুধু হোটেলের নাম-ঠিকানায় আর লোকের নামে। মিসেস সান্যালকে বলা হয়েছিল রাসেল স্ট্রিটের ‘কাফে ডি ফ্যানটাসি’তে উইলিয়াম জোনস-এর নামে ডাকযোগে টাকা পাঠাতে।

‘প্যানজি ফিরে আসার পরের দিন সকালেই নিজে ড্রাইভ করে গিয়েছিলাম ”কাফে ডি ফ্যানটাসি”তে। ফ্যানটাসিই বটে! একেবারে ওঁচা একটা থার্ড ক্লাস হোটেল। দেখি, সামনের ঘরটার দেওয়ালে চিঠির বোর্ডে আমার হাতে ঠিকানা লেখা সেই খামটা আটকানো রয়েছে। ঘরে তখন কেউ ছিল না। চক্ষের নিমেষে খামটা আমার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে গাড়িতে উঠে বাড়ি ফিরে আসি। এই ড্রইংরুমে খামটা খুলে দেখি—ওহ মাই গড—!’

তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘দেখলেন, নোটের বদলে কতকগুলো সাদা কাগজ!’

সিগারেট টানতে ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে মিসেস সান্যাল বললেন, ‘কী করে গেস করলেন, মিস্টার বর্মা?’

‘এটা তো খুব সহজ কথা, মিসেস সান্যাল। চোর তো আর বোকা নয়! প্যানজিকে ফেরত পাঠানোর আগে টাকাগুলো হাতিয়ে নেওয়া তার পক্ষে তো খুবই স্বাভাবিক। তারপর সেই খামে সাদা কাগজ ভরে যথাস্থানে রেখে আসাও তার পক্ষে খুব একটা কঠিন কাজ নয়।’

‘—সব কথা জানতে পারার পর আমার স্বামীর সে কী রাগ, যদি দেখতেন মিস্টার বর্মা! যাকে বলে একেবারে ফায়ার! তাঁকে আগে আমি কিছু জানাইনি। জানতুম, জানালে নিশ্চয়ই তিনি পুলিশের কাছে ছুটতেন আর আমার প্যানজির ডেডবডি দোরগোড়ায় পড়ে থাকত! পুরুষরা ওই এক জাত, মিস্টার বর্মা। তাদের মাথায় শুধু টাকার চিন্তা ছাড়া আর কিছু নেই। তাঁকে কী করে বোঝাব, প্যানজি আমার কাছে আমার ছেলের চেয়েও বেশি—।’

সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় অনুকূল বর্মার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। মনে হল, তিনিও যে একজন পুরুষ, সে-কথা খুব সম্ভব উত্তেজনার মাথায় মিসেস সান্যালের খেয়াল ছিল না।

অনুকূল বর্মা বাড়ি ফিরেই অমিয় সেনকে ফোন করলেন। ধনী পরিবারের ছেলে অমিয় সেন—তাঁর বিশেষ বন্ধু বিখ্যাত অ্যাটর্নি শিবনাথবাবুর সে ভাগ্নে। আর্টিস্ট মহলে তার খুব নাম-ডাক। একবার নাগপুরে একটা জটিল কেসের তদন্ত করার সময় অমিয়র সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়। তারপর থেকে বয়েসের যথেষ্ট ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।

‘হ্যালো, অমিয় সেন বলছি—।’

‘আমি অনুকূল বর্মা। কী করছিলেন?’

‘কিছুই করছিলাম না। ভাবছিলাম, গাড়িটা নিয়ে একপাক ঘুরে আসি।’

‘কুড ইউ ডু মি এ ফেভার, মিস্টার সেন?’

‘একশোবার। বলুন, কী করতে হবে?’

‘এখনি একবার ক্যালকাটা ক্লাবে যেতে পারেন? আপনার পৌঁছতে অবশ্য সাড়ে দশটা হবে।’

‘ইট ডাজন্ট ম্যাটার। বেয়ারা-বাবুর্চি থেকে ম্যানেজার—সবাই আমাকে চেনে—।’

‘খুব ভালো কথা। সেখানে হরিনারায়ণ সান্যাল আজ পার্টি দিচ্ছেন। খুব সম্ভব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহাও থাকবেন। তাঁদের চেনেন?’

‘খুব চিনি। আমার লাস্ট এগজিবিশন থেকে তাঁরা ছবি কিনেছিলেন। এখনও চেক পাইনি—।’

‘সেটাই তো বড়লোকের লক্ষণ! আমার কাজটা খুব কঠিন নয়। একটু গসিপ করা। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের একজন দারুণ চেহারার আলটা-স্মার্ট রিসেপশনিস্ট আছে। একটু খবর বের করা—সেই রিসেপশনিস্টের প্রতি তিনি কতট্রা স্যুইট! সে-ভদ্রমহিলাও সেখানে থাকতে পারেন। কিছু হুইস্কি পেটে পড়ার পর আর বল-রুমের মিউজিক জমে ওঠার সময় ন্যাচারেলি লোকের মুখ খুলে যায়। খুব একটা রেখে-ঢেকে তখন তারা কথা বলে না।’

‘এ তো খুব সহজ কাজ। ইন ফ্যাক্ট ভুলেই গিয়েছিলাম—সান্যালসায়েব আমাকেও নেমন্তন্ন করেছিলেন। এক্ষুনি বেরোচ্ছি।’

টেলিফোনের রিসিভার নামাতেই মাধবী ঘরে এসে বলল, ‘জেঠু, খাবার দেব?’

অনুকূল বর্মা মৃদু হেসে বললেন, ‘এখন খাবারের চেয়ে আমার জরুরি দরকার একজন ঘটকীর!’

‘এত রাতে ঘটকী?’ অনুকূল বর্মার কাছে মানুষ হয়ে খুব সহজে মাধবী অবাক হয় না। তবু অবাক না হয়ে সে পারল না ‘কোনও পাত্রের খবর চাও? নাকি পাত্রীর?’

পাইপ ধরাতে-ধরাতে অনুকূল বর্মা আবার মৃদু হেসে বললেন, ‘খুব সম্ভব পাত্র। ঠিক জানি না। তবে সে মানুষ নয়। একটা কুকুর—পমেরেনিয়ান। মাধু-মা, পঞ্চাকে গিয়ে বলো, এক্ষুনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে তার জগাপিসিকে নিয়ে আসতে। সে খুব তুখোড় ঘটকী, পঞ্চা যাকে গেজেট বলে। বোলো, ট্যাক্সিতে তাকে বাড়ি ফেরত পাঠাব। ফি দেব পঁচিশ টাকা।’

পঞ্চা বহু বছর রয়েছে অনুকূল বর্মার কাছে। মাধবীর নানা সম্বন্ধ নিয়ে প্রায়ই তার জগাপিসি এ-বাড়িতে আসে।

রাত পৌনে এগারোটার সময় পঞ্চা তার জগাপিসিকে ট্যাক্সি করে এনে হাজির করল। মানুষটা আধবুড়ি। পরনে থান কাপড়। হাতে একটা পুঁটলি। সবসময়েই জর্দা-পান চিবোয়। খরখর করে হাঁটে। মুখে যেন খই ফুটছে।

ঘরে ঢুকে সে বলল, ‘পেন্নাম হই, বড়বাবু। কার জন্যে পাত্তর গো?’ তারপর মেঝেয় আসনপিঁড়ি হয়ে বসে মুখ টিপে হেসে অনুকূল বর্মার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নাকি কনে চাই—ছিমছাম সুন্দরী কনে? তা বাপু আপনার কী আর বয়েস! এ-বয়েসের ঢের মিনসেকে বিয়ে করতে দেখেছি—।’

লজ্জা পেয়ে পঞ্চা ধমকে উঠল, ‘জগাপিসি, তোমার জিভে কিছু আটকায় না? বড়বাবুর সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়, জানো না?’

জগাপিসি খেঁকিয়ে উঠল, ‘তুই থাম, পঞ্চা। বড়বাবুর সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়, তোর চেয়ে ঢের ভালো করেই জানি। বড়বাবুকে কি আর মিনসে বলছি? মিনসে বলছি অন্য মিনসেদের! বড়বাবু তো মহাদেবতুল্য মানুষ। কত মেয়ে তো ওনার পাদোদক পেলে নিজেদের ধন্যি মনে করবে। তা যা বলছিলাম, বড়বাবু—আমার সন্ধানে সব বয়েসের এমন সব মেয়ে আছে, যাদের হুরিও বলতে পারেন, পরিও বলতে পারেন। একেবারে ডানাকাটা পরি! আর কী রং—জল খেলে জল দেখা যায়—।’

পাইপ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে অনুকূল বর্মা তার উচ্ছ্বাসে বাধা দিলেন, ‘সেসব কথা পরে হবে, ঠাকরুণ। আপাতত আমার একটা জরুরি খবর দরকার। তুমি তো দিনরাত টইটই করে ঘুরে বেড়াও। কারুর হাঁড়ির খবর জানতে তোমার বাকি নেই। আমার একটা সাদা ছোট লোমওলা কুকুরের খোঁজ দরকার। সেইসঙ্গে তার মালিকের। মালিক মেয়ে—বয়েস বোধহয় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। অবস্থা মোটেই ভালো নয়। শরীরও খারাপ। বড় একটা বাড়ি থেকে বেরোয় না। দেশপ্রিয় পার্ক কিংবা তেকোণা পার্কের কাছাকাছি কোথাও থাকে। খুব সম্ভব কোনও বস্তিতে, নয়তো খুব সস্তা ভাড়ার একটা-দুটো ঘর নিয়ে। মাঝে-মাঝে ওই দুটো পার্কের কোনওটায় কুকুর নিয়ে সে বেড়াতে আসে—খুব সম্ভব সকালে। তার সঙ্গে যেসব মেয়ে দেখা করতে আসে, তাদের সঙ্গেও থাকে সাদা ছোট লোমওলা কুকুর। তারা দেখা করতে আসে সন্ধের দিকে। কাল বিকেলের মধ্যে খবরটা দিতে পারলে আরও দশ টাকা দেব। তোমার রাহাখরচের জন্যে এখন এই পঁচিশ টাকা রাখো। পঞ্চু তোমাকে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিয়ে আসবে। খবরটা জোগাড় করতে পারবে তো? আর-একটা কথা—কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না করে খবরটা আমি জানতে চেয়েছি।’

করকরে পঁচিশ টাকা পেয়ে এবং আরও দশ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনায় পঞ্চার জগাপিসির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, ‘খুব পারব, বড়বাবু, খুব পারব। যেখান থেকে পারি মাগিকে খুঁজে বার করব—।’

পঞ্চা ধমকে উঠল, ‘এই পিসি, ভালো করে কথা বলতে কবে শিখবে?’

তার জগাপিসিও খেঁকিয়ে উঠল, ‘তুই থাম তো, পঞ্চা!’

পরের দিন সকাল দশটায় অনুকুল বর্মা যথারীতি তাঁর মোটা পাইপটা ধরিয়ে ডাকের চিঠিগুলো দেখছিলেন। পাশের ঘরে মাধবী যথারীতি খটখট করে টাইপ করছিল। এমনসময় তাঁর টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল।

পাইপ নামিয়ে রিসিভার তুলে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘হ্যালো—!’

‘আমি অমিয় বলছি। কাল রাতে ফিরতে অনেক দেরি হল। একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছি। আপনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন। হ্যারির, মানে হরিনারায়ণ সান্যালের পার্টিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহা আর তাঁর রূপসী রিসেপশনিস্ট মিস লিলি সিনহাও ছিলেন। উঃ, ভদ্রমহিলা যা একটা ব্লাউজ পরেছিলেন! মনে হয়, আধ-গজ কাপড় থেকে ও-ধরনের খানচারেক ব্লাউজ অনায়াসে বানানো যায়! হ্যারি স্কচের ফোয়ারা খুলে দিয়েছিলেন। আপনার খবরটা বের করতে খুব একটা গসিপ করতে হয়নি। লিলির ওপর সত্যিই তিনি স্যুইট, অতিমাত্রায় স্যুইট। একজন বলল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্ত্রী খুবই অসুস্থ। বেশিদিন তিনি নাকি বাঁচবেন না। তাঁর মৃত্যুর শুভক্ষণের অপেক্ষায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নাকি দিন গুনছেন। তারপরেই—দেখা হলে আরও নানা ডিটেলস বলব—।’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘ডিটেলস-এর দরকার নেই। এতেই হবে। থ্যাঙ্কস।’

দুপুরে অনুকূল বর্মা বেরিয়ে নিজের কয়েকটা দরকারি কাজ সারলেন। ফিরতি পথে চৌরঙ্গির ফ্র্যাঙ্ক রস থেকে কিনলেন স্যান্ডোজ কোম্পানির একশিশি Santevini টনিক।

তিনটে নাগাদ বাড়ি পৌঁছতে মাধবী তাঁকে বলল, ‘জেঠু, পঞ্চার জগাপিসি বাস্তবিকই অসাধ্য-সাধন করেছে! সেই ভদ্রমহিলার নাম উৎপলা। থাকেন মহানির্বাণ রোডের কাছে একটা বস্তিমতো জায়গায়। একটা সাদা পমেরেনিয়ান তাঁর আছে। আর যা-যা বলেছিলে সবই মিলে গেছে। পঞ্চার জগাপিসি আমার জন্যে কার্তিকের মতো নানা পাত্রের কথা বলে জ্বালিয়ে মারছিল। তাকে দশটা টাকা দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছি। এই নাও, সেই ভদ্রমহিলার নাম-ঠিকানা।’

অনুকূল বর্মার হাতে একটুকরো কাগজ সে এগিয়ে দিল।

মৃদু হেসে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘জানতাম, পঞ্চার জগাপিসির অসাধ্য কিছু নেই!’

তারপর চেয়ারে বসে ফোনের রিসিভার তুলে তিনি ডায়াল করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়িতে।

উত্তর এল, ‘হ্যালো, মিসেস সাহা কথা বলছি।’

‘নমস্কার। আমি অনুকূল বর্মা। আপনার স্বামী কখন ফিরবেন?’

‘বিকেল সাড়ে পাঁচটা-ছ’টায়। কেন?’

‘আপনার সঙ্গে একটা প্রাইভেট ডিসকাশন আছে। চারটে নাগাদ গেলে অসুবিধে হবে?’

‘কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু কী ব্যাপার, মিস্টার বর্মা? জংলু সম্বন্ধে?’

‘জংলু সম্বন্ধে ততটা নয়—কারণ, আপনার জংলুর আর কোনও বিপদ ঘটবে না, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। এটা আপনার ওই টনিকটা সম্বন্ধে। খুব সম্ভব ওটা ভেজাল। আমি ইতিমধ্যে খানিক খোঁজখবর নিয়েছি। আমার দুটো অনুরোধ আছে। এক নম্বর, ছোট একটা কাগজে আপনার নাম সই করে, আপনার ঠিকানা আর আজকের তারিখ দিয়ে সেটা ওই টনিকের শিশির গায়ে সাঁটিয়ে রাখবেন। ওই শিশি থেকে আর টনিক খাবেন না। আপনাকে আমি তাজা আর-একশিশি টনিক দেব। দু-নম্বর, কমলাকে আজ বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ছুটি দিয়ে দেবেন। জংলুকে আজ আর বাড়ি থেকে বেরুতে দেবেন না। আপনার কাছেই রাখবেন। —রাজি?’

‘রাজি। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, মিস্টার বর্মা—।’

‘দুর্ভাবনা করার কিছু নেই, মিসেস সাহা। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

অনুকূল বর্মা ফোন কেটে দিলেন।

কাঁটায়-কাঁটায় বিকেল চারটেয় অনুকূল বর্মা ল্যান্সডাউন টেরেসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়িতে পৌঁছলেন। সকালে কেনা নতুন টনিকটা মিসেস সাহাকে দিয়ে পুরোনো টনিকের শিশিটা নিয়ে নিজের পোর্টফোলিওতে ভরলেন। ওষুধের দোকানের মালিকের সঙ্গে জাল ওষুধ বিক্রি করা নিয়ে তাঁর একটা কাল্পনিক বচসার কথা খুব ফলাও করে বললেন। তারপর মিসেস সাহাকে জংলুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে সেই চিরকুট দেখে মহানির্বাণ রোডের বস্তিমতো জায়গাটার একতলা বাড়িটার সামনে যখন পৌঁছলেন, তখন সাড়ে পাঁচটা।

তিনি কড়া নাড়তেই ঘরের মধ্যে একটা কুকুরের উত্তেজিত ডাক শোনা গেল। দরজা খুলল কমলা। তারপর অনুকূল বর্মাকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো আঁতকে এক-পা পিছিয়ে গেল। চাপা গলায় সে বলে উঠল, ‘হা ভগবান!’ তার কথাগুলো শোনাল আর্তনাদের মতো।

ঘরের মধ্যে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চারদিকে তাকালেন অনুকূল বর্মা। চারদিকেই দারিদ্র্যের চিহ্ন। আসবাবপত্র বলতে কেরোসিন কাঠের ছোট একটা টেবিল, হাতল-ভাঙা একটা চেয়ার আর সরু একটা তক্তপোশ। তক্তপোশের বিছানাটা ময়লা। সেখানে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে মাঝবয়েসি একটা ভারী রোগা মেয়ে। চুলগুলো রুক্ষ, চোখের তলায় কালি, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে রং। দেখলেই বুঝতে অসুবিধে হয় না, কোনও কঠিন রোগে সে ভুগছে।

অনুকূল বর্মাকে দেখে তার কোলের কাছ থেকে একলাফে নেমে উত্তেজিত গলায় ডাকতে-ডাকতে তেড়ে এল সাদা লোমওলা একটা কুকুর—হুবহু মিসেস সান্যাল আর মিসেস সাহার কুকুরের মতো দেখতে। বুঝতে দেরি হয় না, এটাও জাতে পমেরেনিয়ান।’

কুকুরটাকে কমলা কোলে তুলে নিল। হাতল-ভাঙা চেয়ারটায় অনুকূল বর্মা বসলেন।

ভাঙা গলায় কমলা বলল, ‘সব কিছু আপনি তাহলে জানেন, মিস্টার বর্মা?’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘সব কিছু বলতে পারি না, তবে প্রায় সব কিছু বলতে পারো। উনিই তোমার দিদি উৎপলা?’

তক্তপোশের দিকে তিনি তাকালেন। তারপর কমলার কোলের কুকুরের দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করলেন, ‘আর ইনিই সেই ঝুমড়ু, মিস্টার মিত্রের মায়ের কুকুর? যিনি সমস্ত রহস্যের নায়ক? রহস্যটার সমাধান তাহলে হয়ে গেল! আমার কাজও ফুরোল!’

উত্তেজনায় কমলার চোখদুটো তখন প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়। ভাঙা গলায় আবার সে বলল, ‘আপনি তো সব কথাই জানেন দেখছি, মিস্টার বর্মা।’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘জানি বলার চেয়ে ঠিক-ঠিক অনুমান করতে পেরেছি বলাই ভালো। এই কুকুর চুরির প্ল্যান তোমার মাথাতেই প্রথম আসে। ঝুমড়ুর সাহায্যে সব কিছু তুমি অর্গানাইজ করেছিলে। মিসেস সাহার জংলুকে নিয়ে সেদিন সন্ধেয় বেড়াতে বেরিয়ে তুমি সোজা চলে আসো তোমার দিদির কাছে। তারপর জংলুকে এখানে রেখে ঝুমড়ুকে নিয়ে যাও দেশপ্রিয় পার্কে—রোজ যেমন সেখানে সন্ধের দিকে যাও জংলুকে নিয়ে বেড়াতে। টেনিস-ক্লাবের মার্কার আর্নেস্ট তোমাকে দ্যাখে একটা পমেরেনিয়ান কুকুর নিয়ে বেড়াতে। পার্কে যারা রোজ আসে, কুকুরের সঙ্গে তোমাকে বেড়াতে তাদের আরও অনেকেই লক্ষ করে। কুকুর নিয়ে তোমাকে বেড়াতে দেখা নতুন কিছু নয়। কারণ, কুকুর নিয়ে রোজই তুমি ওখানে বেড়াতে যাও। পমেরেনিয়ান কুকুরদের দেখতে একইরকম। বাইরের লোকের পক্ষে চেনা অসম্ভব—কে জংলু, কে প্যানজি, কে ঝুমড়ু। তারপর একটি মেয়ের সঙ্গে গায়ে পড়ে তুমি আলাপ জুড়ে দাও। কথা বলতে-বলতে একসময় ব্লেড দিয়ে তুমি কেটে দাও ঝুমড়ুর চামড়ার ফিতেটা। ঝুমড়ু খুব ইন্টেলিজেন্ট। তার ওপর তোমার ট্রেনিং পেয়েছে। একদৌড়ে সে ফিরে আসে তোমার দিদির কাছে। তার মিনিটকয়েক পরে তুমি হইচই জুড়ে দাও কুকুর চুরি গেছে বলে। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে মিসেস সান্যালের কুকুর প্যানজির বেলায়। তোমার বোন চপলার কাছ থেকে প্যানজি চুরি যায় ট্যাঙ্গুলার পার্কে। আসলে কিন্তু প্রথমে চপলা এখানে আসে প্যানজিকে নিয়ে আর ট্যাঙ্গুলার পার্কে যায় ঝুমড়ুকে নিয়ে—।’

‘বাধা দিয়ে কমলা বলে উঠল, ‘কিন্তু চপলা যে আমার বোন, সে-কথা জানলেন কী করে?’

মৃদু হেসে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘সব কিছু জানাই তো আমার পেশা! চেহারার আদল আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। তা ছাড়া, আরও একটা আদল আছে—সেটা নামের। লক্ষ্মীর এক নাম কমলা, আর-এক নাম চপলা। তারপর উৎপলার যখন খবর পেলাম, তখন বুঝতে দেরি হল না—কমলা, চপলা, উৎপলা তিন বোনের নাম!’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমলা বলল, ‘আপনার সব কথাই অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি, মিস্টার বর্মা। আমি চোর। ধরা পড়ে গেছি। আমার বলার কিছু নেই।’

তক্তপোশে শুয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল উৎপলা।

পকেট থেকে নিজের সেই অদ্ভুত গড়নের মোটা পাইপটা বের করে তামাক ঠাসতে-ঠাসতে অনুকূল বর্মা প্রশ্ন করলেন, ‘স্মোক করতে পারি?’

তাঁর প্রশ্নের জবাব কেউ দিল না।

পাইপ ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে অনুকূল বর্মা প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার স্বপক্ষে সত্যিই কি বলার কিছু নেই, কমলা?’

হঠাৎ মুখ-চোখ আরক্ত হয়ে উঠল কমলার। তার স্বরের মধ্যে ফুটে উঠল বেপরোয়া ভাব। সে বলে চলল, ‘আছে, মিস্টার বর্মা, আছে। আমিও লোক চিনতে পারি, মিস্টার বর্মা। আমার বুঝতে ভুল হয়নি—আপনার হৃদয় দরাজ, আসলে আপনি ভারী দয়ালু মানুষ। আমাদের সব কথা আপনাকে বলছি।

‘আমার দিদির খুব অসুখ। বড়-বড় অনেক ডাক্তার-সার্জেন দেখিয়েছি। কারুর ফি বত্রিশ, কারুর চৌষট্টি। তাঁদের দামি-দামি ওষুধের নানা প্রেসক্রিপশন। তা ছাড়া, ফল-ডিম-দুধ—এসবের খরচও কম নয়। দিদির, চপলার, আমার যা-কিছু পুঁজি ছিল, সোনা-দানা ছিল—ডাক্তারে আর ওষুধে সব প্রায় শেষ হতে চলেছে। আপনাদের বিখ্যাত সার্জেন লাহিড়ী বলেছেন, মস্তবড় একটা অপারেশান না করলেই নয়। ইউটাস আর কী-কী যেন কেটে বাদ দিতে হবে। নইলে ক্যান্সার। সব কিছুর খরচ অন্তত হাজার-দুয়েক টাকা। অত টাকা কোথা থেকে জোগাড় করি? হঠাৎ ঝুমড়ুর বুদ্ধি দেখে সমস্ত প্ল্যানটা আমার মাথায় আসে। সাধারণ লোকের চোখে সব পমেরেনিয়ানই দেখতে একরকম। আর কাছে-পিঠে কত বড়লোক বউদেরই তো পমেরেনিয়ান আছে! কাজ শুরু করার আগে মিত্তিরগিন্নিকে আমি বলে এসেছিলাম, ঝুমড়ু মারা গেছে।

‘বড়লোকদের এই সব নিষ্কর্মা বউরা কুকুর পোষে আর আমাদের মতো মেয়েদের সঙ্গিনী হিসেবে চাকরি দেয়। বলে কম্প্যানিয়ন, কিন্তু আমাদের সঙ্গে যে-ব্যবহার করে তা ঝিদেরও বেহদ্দ। কথায়-কথায় দাঁত খিঁচোয়, গালাগালি দেয়। মনে হয়, তারা কুকুর পুষে যেরকম আনন্দ পায়, আমাদের গালিগালাজ করে তার চেয়ে কম আনন্দ পায় না। তাদের বড়লোক স্বামীরা যে সবসময় সাধু উপায়ে টাকা কামায় না, নানা ছোটখাটো ঘটনায়, নানা কাটা-কাটা কথায় সে-কথা আমার জানতে বাকি নেই। আর তাদের নিষ্কর্মা, দাম্ভিক, খামখেয়ালি, অপদার্থ, নিষ্ঠুর বউরা সেই টাকা দু-হাতে ওড়ায়—হাজার-হাজার টাকা ওড়ায়, মিস্টার বর্মা! নিজের চোখে দেখেছি। তাদের সেই টাকার মোটা থলি থেকে শ’ পাঁচেক টাকা গেলে তাদের গায়ে আঁচড়ও লাগে না। তাই ঝুমড়ুর সাহায্যে খুব একটা সদুপায়ে না হোক, কিছু টাকা জোগাড় করাটা কোনওরকম নৈতিক অপরাধ বলে আমার মনে হয়নি। আমার আরও দুই খুড়তুতো বোন আছে। দিদিকে তারাও খুব ভালোবাসে। আমাদের মতো তারাও বড়লোকের বউদের কম্প্যানিয়ন। ঝুমড়ুর সাহায্যে তারাও কিছু টাকা জোগাড় করেছে। আমাদের ফান্ডে দিদির অপারেশানের জন্যে এখন সবসুদ্ধু জমেছে মোট আড়াই হাজার। আপনাদের ওই বিখ্যাত সার্জেন লাহিড়ীর স্ত্রীর কাছ থেকেও আমরা পাঁচশো টাকা আদায় করেছি!’

বলতে-বলতে কমলার মুখে বিজয়িনীর হাসি ফুটে উঠল।

পাইপ থেকে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন অনুকূল বর্মা। তাঁর ঠোঁটের মৃদু হাসি সেই ধোঁয়ায় আড়াল পড়ল।

তিনি বললেন, ‘তারপর?’

কমলা বলে চলল, ‘তারপর আর বিশেষ কিছু বলার নেই, মিস্টার বর্মা। এক বোন কুকুর চুরি করার পর অন্য যে-কোনও বোন টেলিফোন করত। বড়লোকের বউরা প্রতিবারেই টাকা-ভরা খাম দিত আমাদেরই পোস্ট করতে। খাম খুলে নোট বের করে তার বদলে সাদা কাগজ ভরে আমরা পোস্ট করে দিতাম!’

কমলা থামল। ঘরের মধ্যে সবাই চুপচাপ। এমনকী ঝুমড়ু পর্যন্ত।

তারপর ভাঙা-ভাঙা গলায় কমলা বলল, ‘আমাকে হয়তো আপনার সঙ্গে এখুনি থানায় যেতে হবে, তাই না, মিস্টার বর্মা? শুধু বিশ্বাস করবেন, মিস্টার বর্মা, টাকার লোভে চুরি করিনি। দিদির চিকিৎসার জন্যেই চুরি করেছিলাম।’

অনুকূল বর্মার পাইপ নিভে গিয়েছিল। সেটাকে আর না ধরিয়ে তিনি পকেটে ভরলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘এখনই তার দরকার নেই। হয়তো কখনওই তার দরকার হবে না। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে, আজ থেকে কুকুর চুরি বন্ধ।’

উৎপলা আর কমলা সাগ্রহে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নিশ্চয়ই।’

‘আর মিসেস সাহার পাঁচশো টাকা আমার ফেরত চাই।’

তক্তপোশের তলা থেকে পুরোনো একটা ট্রাঙ্ক টেনে তার ভেতর থেকে একটা মোটা খাম বের করে কমলা অনুকূল বর্মার হাতে দিল। নোটগুলো গুনে তিনি নিজের পোর্টফোলিওতে ভরলেন। তাঁর হাতে সেই টনিকের শিশিটা ঠেকল।

পোর্টফোলিও বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘আশা করছি, তোমার নামে চুরির অভিযোগ আনার সাহস বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহার হবে না।’

ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন।

উৎপলা আর কমলা পরস্পরের দিকে তাকাল। দুজনেরই চোখের কোণে তখন জল চিকচিক করছে।

শুধু একলাফে খাটে উঠে ল্যাজ নাড়তে-নাড়তে ঝুমড়ু ঘেউঘেউ করে উঠল।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের অফিস-ঘরে অনুকূল বর্মার সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহার কথা হচ্ছিল। বাইরের দরজার ওপর ‘Don’t Disturb’ লেখা বাতিটা জ্বলছিল তখন।

নিজের পোর্টফোলিও খুলে অনুকূল বর্মা পাঁচ টাকার নোটের পাঁচশো টাকার গোছাটা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন, মিস্টার সাহা, আপনার স্ত্রীর সেই পাঁচশো টাকা।’

একমুখ হেসে নোটগুলো বাঁ-পকেটে ভরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘এর মধ্যেই কাজ হাসিল করেছেন? মাই গুডনেস! লোকে তাহলে ঠিকই বলে : মিস্টার বর্মা নেভার ফেলস! কিন্তু ক্রিমিন্যাল কে? ক্রিমিন্যালকে আমার চাই!’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘ক্রিমিন্যাল কে আমি জানি। আমার হাতে এমন প্রমাণ আছে, যাতে তাকে সহজেই অভিযুক্ত করা যায়। কিন্তু, মিস্টার সাহা, আমার অ্যাডভাইস, সে-চেষ্টা করবেন না।’

খেঁকিয়ে উঠলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, ‘হোয়াট রাবিশ! কেন সে-চেষ্টা করব না?’

‘কারণ, তাহলে আমাকে আরও একটা সিরিয়াস কেস নিয়ে কাজ করতে হবে। সে-কেসটা হচ্ছে অ্যাটেমটেড মার্ডারের কেস,’ বলতে-বলতে অনুকূল বর্মা সেই টনিকের শিশিটা তাঁর পোর্টফোলিও থেকে বের করে টেবিলে রাখলেন ‘এই টনিকটা আপনার স্ত্রী খাচ্ছিলেন। আপনি কিনে দিয়েছিলেন। শিশির গায়ের আটকানো কাগজে আপনার স্ত্রীর সই আর তাঁর নিজের হাতে লেখা ঠিকানা আর তারিখ আছে! আর মজা কী জানেন, মিস্টার সাহা, আমি নিজে কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে দেখেছি, টনিকের মধ্যে আছে আর্সেনিক বিষ।’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মুখ তখন খড়ির মতো সাদা হয়ে গেছে। গলার স্বর শুকনো। বাঁ-পকেট থেকে সেই পাঁচশো টাকার নোটের তাড়াটা বের করে অনুকূল বর্মার দিকে ঠেলে দিলেন। তারপর বুকপকেট থেকে আর-এক তাড়া নোট বের করে কাঁপা-কাঁপা হাতে সেটা অনুকূল বর্মার দিকে এগিয়ে তিনি বললেন, ‘এতে হাজার টাকা আছে। আপনার ফি বাবদ এটা রাখুন। ক্রিমিন্যালকে আমার দরকার নেই, আমার স্ত্রীর টাকাগুলোরও দরকার নেই।’

অমায়িক হেসে নোটের দুটো তাড়া আর টনিকের শিশিটা নিজের পোর্টফোলিওতে ভরে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘থ্যাঙ্কস!’

ব্যস্ত হয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘কিন্তু ওই শিশিটা?’

‘শিশিটা আমার কাছে রইল। এর ফলে এক মহিলা মার্ডার হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবেন। আর এই দেড় হাজার টাকা খরচ হবে একটি দুঃস্থ মহিলার চিকিৎসার ব্যাপারে। আর ভালো কথা, মিস্টার সাহা, সাবধানে থাকবেন। দেখবেন, আপিসের মধ্যে আপনার ঠোঁটে যেন না আর লিপস্টিকের দাগ পড়ে!’

অনুকূল বর্মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহা ‘Don’t Disturb’ লেখা লাল বাতিটা নেভাতে ভুলে গেলেন।

পরের দিন সকালে অনুকূল বর্মা কমলার নামে দেড় হাজার টাকার একটা চেক লিখছিলেন। এমনসময় টেলিফোনটা ঝনঝন করে উঠল।

রিসিভার তুলে তিনি বললেন, ‘হ্যালো—!’

‘আমি অমিয় সেন বলছি। কী কাণ্ড! লেটেস্ট স্ক্যান্ডাল জানেন? গতকাল বিকেলে আপিস-ঘরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর সেই রূপসী রিসেপশনিস্টকে চড় মেরেছিলেন—স্ল্যাপড হার রিয়েলি ভেরি হার্ড! দারুণ হইচই! মিস লিলি সিনহা এখন হরিনারায়ণ—মানে মিস্টার হ্যারির প্রাইভেট সেক্রেটারি! আপনি কী কলকাঠি নাড়লেন, মিস্টার বর্মা?’

‘ডিটেলস শুনতে হলে এখানে আসতে হবে। আর শোনবার ফি হিসেবে একটা কুকুরের খুব ভালো স্কেচ করে দিতে হবে। কুকুরটার নাম ঝুমড়ু।’

‘আপনার সব কথাই একটা হেঁয়ালি, মিস্টার বর্মা। আমি এক্ষুনি আসছি—।’

মাসিক রোমাঞ্চ

আগস্ট, ১৯৭৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *