গ্ল্যাডিয়েটরের মৃত্যু নেই (ছোট গল্প)
গ্ল্যাডিয়েটরের যুগ শেষ হয়ে গেছে।
হ্যাঁ শেষ হয়ে গেছে, লুপ্ত হয়ে গেছে আজ দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ থেকে সেই বৃষস্কন্ধ শক্তিমান মানুষগুলো অস্ত্রের শাণিত ফলকে, রুধিরের রক্তিম অক্ষরে ইতিহাস যাদের নাম রেখেছে গ্ল্যাডিয়েটর।
একখানা বর্শা বা তরবারি মাত্র সম্বল করে যারা হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে একটুও ইতস্তত করত না, যাদের গর্বিত পদক্ষেপে কেঁপে-কেঁপে উঠত রোম এবং গ্রিসের ক্রীড়ামঞ্চ, হাজার হাজার দর্শকের উদগ্রীব দৃষ্টির সম্মুখে যারা বারংবার আলিঙ্গন করত নিশ্চিত মৃত্যুকে গ্ল্যাডিয়েটর নামধারী সেই ভয়ঙ্কর মানুষগুলো আজ দুনিয়ার বুক থেকে মুছে গেছে, শেষ হয়ে গেছে গ্ল্যাডিয়েটরের যুগ…
কিন্তু সত্যিই কি তাই?
অতীতের কবর খুঁড়ে বিদেহী গ্ল্যাডিয়েটরের প্রেতাত্মা কি আজও হানা দেয় না বিংশ শতাব্দীর বুকে?
হ্যাঁ, হানা দেয়। ফিরে আসে গ্ল্যাডিয়েটর ভিন্ন দেহে, ভিন্ন নামে তারা আত্মপ্রকাশ করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে।
মোরদি হচ্ছে এমনই একটি লোক যাকে আমরা অনায়াসে আখ্যা দিতে পারি আধুনিক গ্ল্যাডিয়েটর।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে আমরা জানতে পারি যে প্রাচীন রোমের ক্রীড়ামঞ্চে মাঝে মাঝে শ্বেতাঙ্গ গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে কালো চামড়ার যযাদ্ধারাও মৃত্যু-উৎসবে মেতে উঠত।
আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়কও শ্বেতাঙ্গ নয়, নেহাত কালা বাদামি– বিংশ শতাব্দীর কৃষ্ণকায় গ্ল্যাডিয়েটর।
কাহিনি শুরু করার আগে আফ্রিকা সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলা দরকার।
এই মহাদেশের বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকে বাস করে অ্যান্টিলোপ, জেব্রা, জিরাফ, হস্তী, গণ্ডার, মহিষ প্রভৃতি তৃণভোজী পশু এবং এই তৃণভোজীদের মাংসের লোভে ঘন অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় হানা দিয়ে ফেরে সিংহ, লেপার্ড, হায়না প্রভৃতি হিংস্র জানোয়ার।
বনচারী পশুদের শিং, দাঁত, নখ ও চামড়ার উপর শ্বেতাঙ্গদের লোভ বড়ো বেশি। ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন ভূখণ্ড থেকে আফ্রিকায় এসে শ্বেতাঙ্গরা শিকারের নামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চার্লিয়ে যায়। হত্যালীলার জন্য অবশ্য কেবলমাত্র সাদা চামড়ার মানুষদের দায়ী করা উচিত নয় আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষগুলোও এজন্য যথেষ্ট দায়ী। এখানকার কৃষ্ণকায় নিগ্রো অধিবাসীরা অতিশয় মাংস প্রিয়। তাদের তীর ধনুক ও বর্শার মুখে নিরীহ অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি পশু প্রায়ই মারা পড়ে। শক্তিশালী তৃণভোজীরা কখনো কখনো মাংস-লোলুপ নিগ্রোদের দ্বারা আক্রান্ত হয় বটে কিন্তু মহাকায় হস্তী, খঙ্গধারী গণ্ডার ও ভয়ঙ্কর মহিষাসুরকে আদিম অস্ত্রের সাহায্যে মাঝে মাঝে ঘায়েল করা সম্ভব হলেও একেবারে নির্মূল করা অসম্ভব।
তবে, শ্বেতাঙ্গদের রাইফেল এইসব শক্তিশালী জানোয়ারদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদের নিরাপত্তাও আজ বিপন্ন। আধুনিক রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির মুখে দন্ত ও নখরের প্রচণ্ড বিক্রম অধিকাংশ সময়েই ব্যর্থ হয়ে যায়।
সভ্য মানুষ এক সময়ে বুঝতে পারল যে এইভাবে শিকারের নামে হত্যাকাণ্ড চললে আফ্রিকার জানোয়ার নির্মূল হয়ে যাবে। তাই বন্য প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত হল Sanctuary বা নিরাপত্তা অঞ্চল।
এই অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করার জন্য স্থানীয় গভর্মেন্ট থেকে পেশাদার শিকারিদের মোটা মাইনে দিয়ে বনরক্ষকের পদে নিয়োগ করা হয়।
নিম্নলিখিত কাহিনিটি একজন ফরাসি বনরক্ষকের লিখিত বিবরণী থেকে তুলে দেওয়া হল।
লোকটির প্রকৃত নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না, কারণ তাতে হয়ত তার শাস্তি হতে পারে। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে লোকটি গুরুতরভাবে আইন ভঙ্গ করেছিল। কিন্তু আমি তাকে অপরাধী ভাবতে পারছি না।
আমাদের কাহিনির নায়কের সত্যিকারের নামটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যা-হোক একটা নাম তো দরকার– আচ্ছা আমরা বরং তাকে মোরদি নামেই ডাকব।
কঙ্গোর উত্তর দিকে যে ভয়ঙ্কর যোদ্ধা-জাতি বাস করে, যারা কেবলমাত্র বর্শা হাতে নিয়ে উন্মত্ত হস্তীকে আক্রমণ করতে ভয় পায় না মোরদি ছিল সেই জাতিরই লোক। কোনো অজানা কারণে স্বজাতির সাহচর্য ছেড়ে এই লেক এডওয়ার্ড অঞ্চলে সে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল…
আমি একটু অসুবিধায় পড়েছিলাম।
স্থানীয় অধিবাসীরা লেক এডওয়ার্ড অঞ্চলের তৃণভূমি এবং অরণ্যের মধ্যে চিরকাল শিকার করে এসেছে। এখন এই জায়গাটা হঠাৎ নিরাপত্তা অঞ্চলে পরিণত হওয়ায় এখানে পশুবধ নিষিদ্ধ। কিন্তু চিরকাল যা হয়েছে এখন আর তা চলবে না। এই সহজ কথাটা অধিবাসীরা সহজে বুঝতে চায় না। আমি এখানকার সহকারী বনরক্ষক, কাজেই আমার এলাকায় কোনও পশু নিহত হলে আইনত আমিই দায়ী; অথচ এখানকার নিগ্রো বাসিন্দাদের বাধা দেওয়াও খুব কঠিন।
সত্যি সত্যিই বনের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে হত্যাকাণ্ড চলছিল। এই অঞ্চলের কয়েকজন অসৎ ব্যবসায়ী এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলেই আমার বিশ্বাস। হাতির দাঁতের দাম বাজারে খুব বেশি, তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে হস্তী শিকার করে গজদন্তের ব্যবসা চালায়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের ব্যবসা চালু আছে। একদল অসাধু ব্যবসায়ী এই অঞ্চলের নিগ্রোদের মোটা টাকা দিয়ে এমনভাবে বশ করেছিল যে তারা এখানে সেখানে বর্শার সাহায্যে হাতি মারতে শুরু করলে। এই পাজি ব্যবসায়ীরা নিজেরাও অনেক সময় রাইফেল ব্যবহার করত। শুধু হাতি নয়- খঙ্গধারী গণ্ডারের উপরেও এই শয়তানদের দৃষ্টি পড়েছে।
গণ্ডারের খড়্গ ভারতীয় ব্যবসায়ী মহলে খুব চড়া দামে বিক্রি হয়, তাই গজদন্ত ও খঙ্গের লোভে এই লোকগুলো নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে।
আমি প্রায়ই খবর পাই, ছুটে যাই এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি অপরাধীরা চম্পট দিয়েছে, কেবল অকুস্থলে দন্তবিহীন গজরাজের মৃতদেহ অথবা খঙ্গহীন খঙ্গীর প্রাণহীন শরীর রক্তাক্ত মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে মানুষের লোভের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
এই শয়তানগুলোকে ধরার জন্য আমি দারুণ ছুটোছুটি করছি, স্নানাহার প্রায় বন্ধ এমন সময়ে আরম্ভ হল এক নতুন উৎপাত।
হঠাৎ একদিন শুনলাম নিরাপত্তা-অঞ্চলের এক জায়গায় দেখা গেছে নিহত সিংহের দেহ। অর্থাৎ আর একদল শিকারি এবার লুকিয়ে সিংহ-শিকার শুরু করেছে।
একে মনসা তায় ধুনোর গন্ধ। জিপ গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ঠিক করলাম যদি ধরতে পারি লোকগুলোকে এমন ঠ্যাঙানি দেব যে–
কিন্তু ধরব কাকে?
ঘটনাস্থলে গিয়ে কোনও সূত্ৰই খুঁজে পেলাম না। কেবল দেখলাম একটা কেশরধারী সিংহের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে। আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার সিংহের চমৎকার চামড়াটা সম্পূর্ণ অক্ষত, শুধু তার দেহটাকে লম্বালম্বিভাবে চিরে দু-ফাঁক করে ফেলা হয়েছে এবং গোঁফগুলিও হত্যাকারী কেটে নিয়েছে। ব্যবসায়ী মহল থেকে কেউ যদি সিংহ শিকার করে তাহলে চামড়াটাকে সে নিশ্চয় ছাড়িয়ে নেবে- আমার ধারণা হল কোনও স্থানীয় জাদুকর ওঝা (witch doctor) এই সিংহটাকে মেরেছে।
সিংহের গোঁফ, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ প্রভৃতি দিয়ে এই সব ওঝারা নানারকম ক্রিয়াকাণ্ড করে। আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম, ভাবলাম এটা একটা বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড- এই নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু এক সপ্তাহ পরে যে খবর এল তা শুনেই আমার চোখ কপালে উঠল– জঙ্গলের মধ্যে নাকি আর একটা সিংহের মৃতদেহ দেখা গেছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, সেই একই ব্যাপার।
রক্তাক্ত মাটির উপর পড়ে আছে আর একটা সিংহের প্রাণহীন দেহ দেহটাকে ঠিক আগের মতোই লম্বা করে চিরে ফেলা হয়েছে।…
সেদিন রাতে ঘটল আর এক কাণ্ড।
আমার কয়েকজন আস্কারি (সশস্ত্র রক্ষী) গ্রাম থেকে ফিরে এসে জানাল যে একটা পাগল তাদের সবাইকে বেধড়ক ঠ্যাঙানি দিয়ে তাদের সঙিনগুলো কেড়ে নিয়ে একেবারে গ্রামের বাইরে তাড়িয়ে দিয়েছে।
কৌতূহল হল। চার-চারজন সশস্ত্র রক্ষীকে যে পাগল ধরে মার দিতে পারে সে কেমন পাগল একবার দেখা দরকার!
আমার সার্জেন্টকে ডেকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপারটা কী?
সার্জেন্ট বললে, বাওয়ানা, এ লোকটা সাক্ষাৎ শয়তান! নইলে ভেবে দেখুন, আস্কারিদের গায়ে হাত তুলতে কেউ সাহস পায়!
আরও প্রশ্ন-উত্তরের ফলে সমস্ত ব্যাপারটা জানা গেল। আস্কারিরা গাঁয়ে ঢুকে লোকের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। আস্কারি হল রাজার লোক, যে কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার তাদের আছে এই হল আফ্রিকার অলিখিত আইন। স্থানীয় অধিবাসীরা আস্কারিদের বাধা দিতে ভয় পায়।
কিন্তু এই লোকটি ভয় পায়নি। সে প্রথমে আস্কারিদের ভালো কথায় বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু আস্কারিরা চিরকাল একরকম বুঝে এসেছে, আজ তারা অন্যরকম বুঝতে রাজি হবে কেন?
তখন সবচেয়ে বড়ো এবং আদিম যুক্তির প্রয়োগ শুরু হল বলং বলং বাহু বলং!
বাহুবলের প্রতিযোগিতার পরিণাম আগেই বলেছি।
দারুণ মার খেয়ে আস্কারিরা শেষে আমার কাছে নালিশ করলে। অবশ্য নিজেদের দোষ তারা স্বীকার করলে না, কিন্তু আমার জেরায় সব কিছুই প্রকাশ হয়ে পড়ল।
আমি লোকটিকে খুব দোষ দিতে পারলাম না।
বরং মনে মনে তাকে বাহবা দিলাম– চার-চারটে জোয়ান আস্কারিকে পিটিয়ে যে লোক তাদের হাত থেকে সঙিন কেড়ে নিতে পারে সে আলবৎ মরদ-কি বাচ্চা।
লোকটিকে একবার দেখা দরকার।
আমি গাঁয়ের দিকে যাত্রা করলাম।
গ্রামের মোড়লের সঙ্গে দেখা করে আমি জানতে চাইলাম কোন লোকটি আস্কারিদের গায়ে হাত দিয়েছে।
মোরদি? মোড়ল একগাল হাসলেন, সে এখন ঝোপের মধ্যে শিকারের খোঁজ করছে। হ্যাঁ, লোকটা একটা মানুষের মত মানুষ বটে! তার গায়ে জোর আছে, মাথায় বুদ্ধি আছে আর কলজেতে সাহসের অভাব নেই- মোরদি কাউকে ভয় করে না।
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, এখন থেকে তাহলে তাকে ভয় করতে শিখতে হবে। আবার যদি সে আস্কারিদের গায়ে হাত তোলে তাহলে আমি তাকে ছাড়ব না, ঘাড় ধরে সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দেব। কথাটা তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিও। সে ফিরলেই তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে- এইসব অসভ্যতা আমি মোটেই সহ্য করব না।
মোড়ল আমার আদেশ পালন করেছিল।
মোরদি খবর পেয়ে সোজা এল আমার কাছে। ভালো করে লোকটির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলাম।
অল্পবয়সী জোয়ান। উনিশ কুড়ি বছর বয়স হবে। বিরাট বলিষ্ঠ দেহ, সম্পূর্ণ অনাবৃত, শুধু কটিদেশের আচ্ছাদন হয়ে ঝুলছে একটা রঙিন কাপড়, দুই বাহুর জড়ানো একজোড়া লৌহ অলঙ্কার নীরবে ঘোষণা করছে অলংকারের মালিক একজন যোদ্ধা, এবং তার পেশল বক্ষদেশে আঁকা রয়েছে নানা ধরনের চিত্র-বিচিত্র নকশা।
হ্যাঁ– একটা দেখবার মতো চেহারা বটে!
মোরদির হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না।
সে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললে, আস্কারি? কতকগুলো কুকুর? পশুরাজ সিংহের সামনে দাঁড়িয়ে কুকুর যদি ঘেউ ঘেউ করে তাহলে সিংহ তাকে ক্ষমা করে না।
আমি আশ্চর্য হলাম, তার মানে?
তার মানে, সে তেমনি দৃপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলে, আমি কাউকে ভয় করি না। মানুষ কিংবা সিংহ কাউকেই আমি ভয় করি না।
তাই নাকি? আমি নীরস স্বরে বললাম, আর একবার যদি শুনি যে তুমি গভর্মেন্টের পোশাকধারী আস্কারিদের গায়ে হাত দিয়েছ, তাহলে আমিও তোমাকে একটি নতুন ধরনের জিনিস শিখিয়ে দেব।
-বটে! বটে! কী জিনিস শেখাবে?
আমি তোমায় শেখাব কেমন করে জেলখানাকে ভয় করতে হয়। বুঝেছ?
লোকটি স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাইল, তারপর ডান হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে বললে, ক্য হরি, বাওয়ানা। অর্থাৎ ঠিক আছে বাওয়ানা।
তারপর গর্বিত পদক্ষেপে সে স্থান ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার হঠাৎ মনে হল যে দু-দুটো সিংহের হত্যালীলার সঙ্গে মোরদির একটা যোগসূত্র আছে। অবশ্য তাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই একথা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার ছিল চুপি চুপি একটি লোককে আমি মোরদিকে অনুসরণ করতে আদেশ দিলাম।
দিন তিনেক পরে আমার গুপ্তচর ফিরে এল।
তার মুখে যে সংবাদ শুনলাম তা যেমন আশ্চর্য তেমনই ভয়ঙ্কর। গুপ্তচর বললে, গ্রামের লোক মোরদিকে সিম্বা (সিংহ) বলে ডাকে। মোরদি নাকি সিংহের মাংস ভক্ষণ করে।
আমার গুপ্তচর দুদিন ধরে তার সম্বন্ধে নানারকম সংবাদ সংগ্রহ করেছে। কেবলমাত্র গত রাত্রিতে সে দূর থেকে মোরদিকে অনুসরণ করে।
চাঁদের আলোতে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিস্তীর্ণ তৃণভূমির অপরদিকে যেখানে অনেকগুলি মিমোসা গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, হালকা ঘাসজমির উপর দিয়ে মোরদি সেইদিকে এগিয়ে গেল। একটা মিমোসা গাছে উঠে সে আত্মগোপন করলে।
আমার গুপ্তচর তখন দুর থেকে মোরদির কার্যকলাপ লক্ষ করছে। গাছের ডালপালার ভিতর লতাপাতার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে হঠাৎ মোরদি জেব্রার কণ্ঠ অনুকরণ করে চেঁচিয়ে উঠল।
কয়েকটি মুহূর্ত। এবার তার কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল ন্যুর কণ্ঠস্বর।
(ন্য এক ধরনের তৃণভোজী পশু। ন্যুর মাংস সিংহের প্রিয় খাদ্য)
গুপ্তচর সবিস্ময়ে শুনতে লাগল, মোরদি একবার জেব্রার মতো চিৎকার করে উঠছে আবার তারপরেই নুর কণ্ঠ অনুসরণ করে হাঁক দিয়ে উঠছে।
কিছুক্ষণ পরেই দুর জঙ্গল ভেঙে রঙ্গমঞ্চে আত্মপ্রকাশ করলেন পশুরাজ সিংহ। বনের রাজা একা আসেননি, তাঁর সঙ্গে রানিও এসেছেন। পশুরাজ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করলে না। যে গাছ থেকে মোরদি চিৎকার করেছিল সিংহ সোজা সেই গাছটার দিকে ছুটে এল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বর্শা বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে তার দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলে।
মরণাহত সিংহ ভীষণ কণ্ঠে গর্জন করে উঠল। সিংহী পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারলে এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই তার মস্ত শরীরটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
সিংহ পলায়ন করলে না। যে গাছটায় মোরদি লুকিয়ে ছিল আহত সিংহ বারবার সেই গাছ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। প্রায় একঘণ্টা ধরে চলল বৃক্ষারোহণের ব্যর্থ প্রয়াস, তারপর রক্তপাতে অবসন্ন পশুরাজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আর উঠল না।
তখন মোরদি গাছ থেকে নেমে এসে মৃত সিংহের বুকে ছোরা বসিয়ে দেহটাকে চিরে ফেললে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল- ওই ভয়ঙ্কর মানুষ সেই তপ্ত রক্তধারা আকণ্ঠ পান করলে এবং বিদীর্ণ বক্ষপঞ্জর থেকে হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে এনে কচমচ করে চিবিয়ে খেতে লাগল।
সেই পৈশাচিক ভোজ শেষ হলে মোরদি উঠে দাঁড়াল চন্দ্রালোকিত তৃণভূমির উপর শুন্যে বশী আস্ফালন করে উন্মাদের তাণ্ডব-নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠল, তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে সে বারংবার ঘোষণা করলে নিজের বীরত্ব কাহিনি। তারপর ঘটনাস্থল ত্যাগ করে গ্রামের দিকে চলে গেল।
সমস্ত ঘটনা শুনে আমি চুপ করে রইলুম।
গুপ্তচর বললে : বাওয়ানা, এই লোকটা নিজের মখে চেঁচিয়ে বলেছে সে আজ পর্যন্ত ছ-টা সিংহের হৃৎপিণ্ড খেয়েছে!
গুপ্তচর তার সংবাদ পরিবেশন করে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম এই ভয়ঙ্কর নাটকের শেষ দৃশ্যটা কি হতে পারে…
কয়েকদিন পরেই অভাবিতভাবে মোরদির সঙ্গে আবার আমার দেখা হল।
একদিন সকালে অকস্মাৎ আমার গৃহে হল মোড়লের আবির্ভাব। ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে মোড়ল আমায় যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে, আগের দিন সন্ধ্যায় এক প্রতিবেশীর ছাগল হঠাৎ মোরদির বাগানের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করেছিল। ছাগল যদি অনধিকার প্রবেশ করেই খুশি থাকত তাহলে হয়ত কিছু ঘটত না, কিন্তু ছাগলটা নিতান্তই ছাগল- সে মোরদির বাগানের কয়েকটা গাছ মুড়িয়ে খেয়ে ফেললে।
মোরদি ছাগলটাকে বেঁধে রাখল তার উঠানে।
প্রতিবেশী ছাগল ফেরত চাইতে এল।
মোরদি তাকে ছাগল দিলে না দিলে প্রহার।
প্রতিবেশীটি স্থানীয় লোক নয়, সে একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী নাম রণজিৎ সিং। এই লোকটিও খুব নিরীহ প্রকৃতির মানুষ নয়, বিনা প্রতিবাদে মার খেতে সে রাজি হয়নি– ফলে প্রচণ্ড মারামারি।
মোড়ল এই ব্যাপারে হাত দিতে চাইলে না, সে আমার কাছে বিচার প্রার্থনা করলে।
আমি দুজনকেই ডেকে পাঠালুম।
রণজিৎ সিং খুব মার খেয়েছে, তার মুখে এখনও প্রহারের ক্ষতচিহ্ন বর্তমান। মোরদির মুখে কোনো দাগ নেই, শুধু ডান চোখটা একটু ফুলে উঠেছে।
মোরদি এসেই দম্ভের সঙ্গে জানিয়ে দিলে যে সে হচ্ছে সাক্ষাৎ সিম্বা। তার বিরুদ্ধে লাগলে সে কাউকে রেহাই দেবে না, পশুরাজ সিংহের রক্তপান করে সে সিংহের চেয়েও বলশালী।
রণজিৎ সিং হঠাৎ বলে উঠল, হা হা গাছের উপর থেকে অস্ত্র ছুঁড়ে যে সিংহ বধ করে সে তো মস্ত বীরপুরুষ! তারপর সেই সিংহের রক্তপান করার মতো কঠিন কাজ বীরের পক্ষেই সম্ভব! কিন্তু বাওয়ানা, বীরপুরুষকে আদেশ করুন আমার ছাগলটা যেন সে ফেরত দেয়।
মোরদির মুখ চোখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। আমি ভাবলুম, এই বুঝি সে রণজিতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মোরদি সে রকম কিছু করলে না।
ভ্রূকুটি-কুটিল দৃষ্টিতে সে প্রতিপক্ষকে একবার নিরীক্ষণ করল। তারপর শুষ্ক কঠিন স্বরে বললে, ছাগল আমি এখনই দিয়ে দিচ্ছি। তবে জেনে রাখো, মোরদি মাটিতে দাঁড়িয়েও সিংহের মোকাবেলা করতে পারে… আচ্ছা, এখন আমি কিছু বলতে চাই না, তবে…
ভীষণ আক্রোশে মোরদির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।
রণজিতের দিকে একটা জ্বলন্ত কটাক্ষ নিক্ষেপ করে সে দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করলে।
মোরদির উদ্দেশ্য বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি। রণজিতের বিদ্রূপ একেবারে প্রতিপক্ষের মর্মস্থলে আঘাত করেছে। আমি বুঝলাম আজ রাতে মোরদি পশুরাজ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।
সিংহের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে ফিরে এসেই মোরদি রণজিৎকে ধরে বেধড়ক ধোলাই দেবে এ-কথা বুঝতেও আমার বিশেষ অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু সে তো পরের কথা এখন এই উন্মাদ মোরদিকে নিয়ে কী করি? সত্যি-সত্যি যদি সে বর্শা হাতে মাটির উপরে দাঁড়িয়ে সিংহের সম্মুখীন হয় তাহলে তার পরিণাম কি হবে সে বিষয়ে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। বর্শার খোঁচা খেয়ে পশুরাজ মোরদিকে ছেড়ে দেবে না– ক্ষিপ্ত শ্বাপদের আক্রমণে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তার সর্বাঙ্গ।
আমি একজন গুপ্তচরকে ডেকে গোপনে মোরদির উপর নজর রাখতে আদেশ দিলাম।
রাত তখনও গম্ভীর হয়নি, আমার গুপ্তচর এসে জানালে, মোরদি বর্শা হাতে সিংহের উদ্দেশ্যে বনের দিকে যাত্রা করেছে।
আঃ! জ্বালালে!
এই নির্বোধটাকে বাঁচাবার জন্য বিছানা ছেড়ে এখনই আমায় ছুটতে হবে বনবাদাড়ে।
মোরদির উপর যতই রাগ হোক, জেনে শুনে একটা লোকের অপমৃত্যু ঘটতে দেওয়া যায় না।
দূরবীন এবং রাইফেল নিয়ে কয়েকজন আস্কারির সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকের উপর গলিত রজতধারার মতো জ্বলছে জ্যোৎস্নার আলো, আর সেই রুপালি আলোর চাদরের উপর ফুটে উঠেছে অনেকগুলি কালো কালো সচল বিন্দু।
সচল বিন্দুগুলি আর কিছু নয়– অনেকগুলি ধাবমান মানব দেহ। গাঁয়ের লোক আজ দল বেঁধে মোরদির সঙ্গে সিংহের লড়াই দেখতে এসেছে।
কিন্তু মোরদি কোথায়?
আমি একটা মস্ত ঢিপির উপর উঠে দূরবীনটা চোখে লাগালুম।
ওই যে মোরদি। একটা ঝোপের পাশ দিয়ে হাঁটছে আর হাতের বর্শা উঁচিয়ে ধরে চিৎকার করছে।
খুব সম্ভব তার জাতীয় ভাষায় পশুরাজকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে।
আমি তখন প্রায় সিকি মাইল দূরে।
তার নাম ধরে চিৎকার করার উপক্রম করছি, এমন সময়ে ভীষণ গর্জনে বন কাঁপয়ে ঝোপের ভিতর থেকে তীরবেগে বেরিয়ে এল এক প্রকাণ্ড সিংহ।
পশুরাজ এক মুহূর্তের জন্যও থামল না, ধনুক-ছাড়া তিরের মত দ্রুতবেগে সে মোদির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কিন্তু দন্ত ও নখরের আলিঙ্গনে মোরদি ধরা দিলে না, ক্ষিপ্রপদে একপাশে সরে গিয়ে সে পশুরাজের আক্রমণ ব্যর্থ করলে।
পরক্ষণেই বর্শা বাগিয়ে ধরে সে সিংহের দিকে রুখে দাঁড়াল। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে ঝকঝক করে জ্বলে উঠল বর্শার ধারালো ফলা।
আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলুম। কী করব? গুলি ছুড়লে মোরদির গায়ে লাগতে পারে।
আমার চোখের সামনে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হল এক হিংস্র মানব ও এক হিংস্র শ্বাপদ।
মোরদি বর্শাটাকে সঙিনবসানো রাইফেলের মতো বাগিয়ে ধরলে বল্লমের ধারালো ফলাটা নিচু হয়ে ঘুরতে লাগল।
সিংহ বৃত্তাকারে শত্রুকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, আর বর্শার ফলাটাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে যায়।
পশুরাজের থাবাটা বার বার এগিয়ে আসে বর্শা লক্ষ্য করে কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ ইস্পাত-ফলক নখের আলিঙ্গনে ধরা দেয় না– সাঁৎ করে সরে যায় আবার সামনে থেকে এবং পরক্ষণেই দস্তভয়াল বিস্ফারিত মুখগহ্বরের সম্মুখে চমকে ওঠে জ্বলন্ত বিদ্যুৎ-শিখার মতো।
মোরদি ওস্তাদ খেলোয়াড়।
আমি দেখলাম মোরদির অধর-ওষ্ঠ কেঁপে উঠল, সে চিৎকার করছে।
চাপা গম্ভীর গর্জনে তার উত্তর এল।
সিংহ জানে ওই চকচকে ঝকঝকে জিনিসটা অতিশয় বিপদজনক। ওটাকে এড়িয়ে যদি সে মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাহলে যুদ্ধে তার জয় অনিবার্য।
কিন্তু বর্শার ফলা যেন মোরদির হাতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে জ্বলছে শাণিত ইস্পাতফলক–সূচীমুখ অস্ত্র নেচে নেচে উঠছে সিংহের মুখের সামনে নাকের সামনে একটা শাণিত বিদ্রুপের মতো।
আমি বুঝলাম সিংহের ধৈর্য এবার ফুরিয়ে এসেছে। সে এবার আক্রমণ করবে।
ক্ষিপ্ত শ্বাপদ বর্শার শাসন আর মানতে চাইছে না। ঝকড়া কেশর দুলিয়ে সিংহ মাথাটা তুলল, গম্ভীর গর্জনে প্রতিধ্বনি জাগল বন থেকে বনান্তরে।
পরক্ষণেই সিংহ ঝাঁপ দিল শত্রুর দেহ লক্ষ্য করে। মোদি সরে গেল, বর্শার ধারালো ফলা কামড় বসালো সিংহের শরীরে।
যাতনায় আর্তনাদ করে উঠল পশুরাজ, থাবা তুলে শত্রুকে আঘাত করার চেষ্টা করলে।
মোরদির বর্শা এবার সিংহের বক্ষ ভেদ করলে।
সিংহ আবার গর্জে উঠল।
অন্য কোনো জানোয়ার হয়ত ওই আঘাতে মৃত্যুবরণ করত, কিন্তু বিখ্যাত সিংহ-বিক্রম এত সহজে ঠান্ডা হয় না শাণিত ভল্লের তীব্র দংশন উপেক্ষা করে পশুরাজ অন্ধের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুই থাবার আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শত্রুকে পেড়ে ফেলল মাটির উপর।
মোরদি উঠে দাঁড়াল।
দক্ষ মুষ্ঠিযোদ্ধার মত পাঁয়তাড়া করে সে পিছিয়ে এল। তীক্ষ্ণ বর্শাফলক এবার সঞ্চালিত হল তরবারির মতো হাতের বর্শা দিয়ে পাগলের মতো কোপ মেরে মেরে সে সিংহের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করলে।
আমি লক্ষ্য করলাম বর্শার ফলাটা আর চাঁদের আলোয় জ্বলে জ্বলে উঠছে না, জ্যোৎস্নার আলো-মাখা অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছে ইস্পাতের শাণিত ফলক- রক্ত।
মোরদি একটু থামল, গুঁড়ি মেরে বসল; বর্শা বাগিয়ে ধরে সে সিংহের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।
সগর্জনে ধেয়ে এল আহত সিংহ তার বিপুল বপুর অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল মোরদির ক্ষুদ্র নরদেহ।
রাইফেল তুলে আমি ছুটে গেলাম রণস্থলের দিকে। আমি যথাস্থানে উপস্থিত হওয়ার আগেই আবার মোরদি উঠে দাঁড়াল।
সিংহ তখন কাত হয়ে পা ছুড়ছে।
তীক্ষ্ণ বর্শা-ফলক তার ঘাড় ভেদ করে বসে গেছে আর সেই বর্শা-দণ্ডকে দুই হাতে চেপে প্রাণপণ শক্তিতে পশুরাজকে মাটিতে চেপে ধরেছে মোরদি।
আমি সিংহকে আর উঠতে দিলুম না। সামনে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় রাইফেলের নল ঠেকিয়ে গুলি করলুম। সিংহ তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল।
এবার আমি মোরদির দিকে নজর দিলুম।
কি ভীষণ দৃশ্য!
সিংহের ধারালো নখ তার সমস্ত শরীরটাকে ফালা ফালা করে ছিঁড়েছে, কালো দেহের উপর ফুটে উঠেছে লাল রক্তের বীভৎস আলপনা।
রক্তরাঙা দুই চোখ মেলে মোরদি আমার দিকে তাকাল- হত্যাকারীর উন্মত্ত চাহনি।
এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল, এই বুঝি সে বর্শাটা আমার বুকে বসিয়ে দেয়।
ধীরে ধীরে তার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এল। বক্ষ বাহুবন্ধ করে সে গর্বিত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। উত্তেজিত গ্রামবাসীরা তখন আমাদের ঘিরে ফেলে চিৎকার করছে।
আমি রুক্ষস্বরে বললুম, যাও, এখনই হাসপাতালে চলে যাও। যদি সম্ভব হয় কাল আমার সঙ্গে দেখা কোরো।
না, সম্ভব হয়নি।
আমার সঙ্গে মোরদির আর কোনো দিন দেখা হয়নি।
মোরদি হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক শুশ্রূষা গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু সেই রাতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে কোথায় সরে পড়েছে।
ভালোই করেছে; আমিও তার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।
নিরাপত্তা অঞ্চলের মধ্যে সিংহ শিকার করে সে আইন ভঙ্গ করেছে, কাজেই আমার সঙ্গে দেখা হলে আইনত আমি তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য।
কিন্তু আইনই তো সব নয়! এমন সিংহদমন বীরপুরুষকে জেল খাটাবার ইচ্ছে আমার নেই।
এবার আমি যার কথা বলব সে আফ্রিকার বাসিন্দা বটে, কিন্তু আফ্রিকা তার স্বদেশ নয়।
নাম তার চার্লস কটার- আফ্রিকায় এসেছিল সে জীবিকার প্রয়োজনে।
আমেরিকার ওকলাহামা প্রদেশ ছিল কটারের জন্মভূমি।
আফ্রিকাতে আসার আগে সে ছিল ওখানকার শেরিফ।
ওকলাহামা বড়ো বেয়াড়া জায়গা।
কোনো আদর্শ ভদ্রলোক ওকলাহামাকে পছন্দ করবে না।
সেখানকার পথে ঘাটে ও দোকানে বাজারে যে মানুষগুলি ঘুরে বেড়ায় তারা খুব নিরীহ স্বভাবের নয়।
কথায় কথায় সেখানে ঝগড়া বাধে।
ঝগড়া বাধলে মীমাংসার প্রয়োজন।
ওকলাহামার মানুষ বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না, চটপট ঘুসি চার্লিয়ে তারা ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করে নেয়।
অনেকে আবার মুষ্টিবদ্ধ হস্তের পক্ষপাতী নয়- রিভলভারের ঘন-ঘন অগ্নিবৃষ্টির মুখে তারা বিবাদের নিস্পত্তি করতে চায়।
এমন চমৎকার জায়গায় শেরিফ হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে যেমন মানুষের দরকার ঠিক তেমন মানুষ ছিল চার্লস কটার।
যে-সব মানুষ বৃহৎ দেহের অধিকারী হয় সাধারণত তাদের চালচলন হয় মন্থর এবং শ্লথ, কিন্তু ছ-ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এই নরদৈত্য ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম।
প্রয়োজন হলে মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে সে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্য ভেদ করতে পারত।
শেরিফের কাজ করে কটারের মনের গতি হয়েছিল খুব সহজ আর স্পষ্ট।
কোন মানুষকে সে হয় পছন্দ করবে আর নয় তো পছন্দ করবে না। এই পছন্দ অপছন্দের মাঝামাঝি কিছু নেই।
কাউকে অপছন্দ হলে সে তার উপরে প্রয়োগ করত মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ চার্লস কটারের জীবন-দর্শনে একটুও জটিলতা ছিল না।
কটারের পেশীবহুল হাত দুখানা ছিল বেজায় লম্বা।
সেই অস্বাভাবিক দীর্ঘ দুই হাতে ছিল অমানুষিক শক্তি।
তার উপর তার দক্ষিণ হস্তে সর্বদাই থাকত একটা বেঁটে মোটা বাঁশের লাঠি এবং কোমরে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার।
ওকলাহামার দুর্দান্ত গুণ্ডারা বুঝল, চার্লস কটার যতদিন শেরিফ আছে অন্তত সে কয়টা দিন তাদের আইন মেনে চলতে হবে।
কটার যখন স্বদেশের মায়া কাটিয়ে আফ্রিকাতে পাড়ি জমাল তখন নিশ্চয়ই ওকলাহামার গুণ্ডারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।
অবশ্য এটা আমার অনুমান কটারের জীবন-ইতিহাসের কোনো পাতায় ওকলাহামার অধিবাসীদের মনস্তত্ত্ব আলোচনা করা হয়নি।
আফ্রিকাতে এসে চার্লস কটার শিকারির পেশা অবলম্বন করলে। যে-সব লোকের শিকারের শখ আছে তারা দক্ষ পেশাদার শিকারির সাহায্য নিয়ে আফ্রিকার অরণ্যে প্রবেশ করে। নিয়োগকারীর সব রকম সুবিধা-অসুবিধা এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় শিকারি এবং এই কাজের জন্য সে প্রচুর অর্থ পারিশ্রমিক পায়।
এই কাজে অর্থ-উপার্জনের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও কাজটা অতিশয় বিপদজনক। তবে চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষে এই ধরনের পেশা পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক।
কটার ছিল বিবাহিত মানুষ। তার পরিবারটিও নেহাত ছোটো ছিল না। ছয়টি কন্যা এবং দুটি পুত্রসন্তান নিয়ে কটার প্রবল পরাক্রমে শিকারির ব্যবসা চার্লিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় এইসব ব্যবসা-সংক্রান্ত কথাবার্তা চলত টেলিগ্রাফের সাহায্যে। অফিসের কেরানিদের মধ্যে একধরনের লোক দেখা যায় যারা আইনের প্যাঁচ লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোল। এই ধরনের কোনো-কোনো কেরানি যখন চিঠি লিখে চার্লস কটারকে আইন এবং শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে উপদেশ দেবার চেষ্টা করত তখনই তার মেজাজ যেত বিগড়ে বন্দুকের বদলে কলম নিয়ে সে করত যুদ্ধ ঘোষণা।
আগেই বলেছি, চার্লসের জীবন-দর্শন ছিল খুব সহজ ও স্পষ্ট। গভর্মেন্টের বেতনভোগী কর্মচারীর সঙ্গে মারামারি করা যায় না তাই মূল্যবান উপদেশপূর্ণ চিঠিকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে চার্লস কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসত।
তার চিঠির ভাষাও ছিল খুব সহজ—
মহাশয়,
আপনার চিঠিটা এইমাত্র আমার সামনে ছিল। এখন সেটা আমার পিছনে বাজে কাগজের ঝুড়ির মধ্যে অবস্থান করছে।
–চার্লস কটার।
এমন চমৎকার চিঠি পেলে কেউ খুশি হয় না।
পোস্ট অফিসের কেরানিরা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কটারের উপর খঙ্গহস্ত ছিলেন। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য প্রায়ই কটারের উপর আদালতের সমন জারি হত। আদালতে দাঁড়াতে হলেই তার মেজাজ হত খাপ্পা তখনকার মত বিচারকের নির্দেশ পালন করে সে ঘরে ফিরে আসত বটে, কিন্তু মহামান্য আদালত তার চরিত্র একটুও সংশোধন করতে পারেননি। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য কটারকে বহুবার আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে।
এই উদ্ধত মানুষটি তার জীবনে একাধিকবার লেপার্ডের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইতে নেমেছিল। হিংস্র শ্বাপদের শাণিত নখর তার দেহের বিভিন্ন স্থানে সুগভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে প্রত্যেকবারই বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্য দুলেছে চার্লসের কণ্ঠে।
এই প্রসঙ্গে লেপার্ড নামক জন্তুটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার।
ভারতবর্ষেও লেপার্ড আছে, বাংলায় তাকে চিতাবাঘ বলে ডাকা হয়। কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে চিতা নামে বিড়াল-জাতীয় যে জানোয়ার বাস করে তার দেহচর্মের সঙ্গে লেপার্ডের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও দেহের গঠনে ও স্বভাব-চরিত্রে চিতার সঙ্গে লেপার্ডের কোনোই মিল নেই– চিতা এবং লেপার্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার। চিতা লাজুক ও ভীরু প্রকৃতির পশু। লেপার্ড হিংস্র, দুর্দান্ত।
জে. হান্টার, জন মাইকেল প্রভৃতি শিকারি লেপার্ডকে আফ্রিকার সবচেয়ে বিপদজনক জানোয়ার বলেছেন। সিংহের মতো বিপুল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী না হলেও ধূর্ত লেপার্ডের বিদ্যুৎ-চকিত আক্রমণকে অধিকাংশ শিকারিই সমীহ করে থাকেন।
লেপার্ডের আক্রমণের কায়দা বড়ো বিশ্রী।
লতাপাতা ও ঘাসঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে সে যখন বিদ্যুৎবেগে শিকারির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তখন আক্রান্ত ব্যক্তি অধিকাংশ সময়েই হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় না। প্রথম আক্রমণেই লেপার্ড তার সামনের দুই থাবার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে শিকারির চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেবার চেষ্টা করে, সঙ্গেসঙ্গে একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের মারাত্মক দংশন চেপে বসে শিকারির কাঁধে, আর পিছনের দুই থাবার ধারালো নখগুলি ক্ষিপ্র সঞ্চালনে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় হতভাগ্যের উদরদেশ।
এই হিংস্র অথচ সুন্দর জানোয়ারকে কটার অত্যন্ত ঘৃণা করত। সে প্রায়ই বলত, আঃ! ব্যাটাদের নখে কি ভীষণ ধার- আঁচড় দিলে মনে হয় যেন খুর চালাচ্ছে! শয়তানের বাচ্চা!
হ্যাঁ, একথা অবশ্য সে বলতে পারে।
তার হাত পায়ের যে অংশগুলি পরিচ্ছদের বাইরে দৃষ্টিগোচর হয় সেদিকে একনজর তাকালেই চোখে পড়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন অভিজ্ঞ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে ক্রুদ্ধ লেপার্ডের নখের আঁচড়েই ওই গভীর ক্ষতচিহ্নগুলির সৃষ্টি হয়েছে।
একদিনের ঘটনা বলছি।
বনের মধ্যে একটা গাছের ডালে ঝুলছে মরা কুকুরের টোপ, আর খুব কাছেই ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রাইফেল হাতে অপেক্ষা করছে কটার।
কুকুরের মাংস লেপার্ডের প্রিয় খাদ্য, কটার জানে মরা কুকুরের গন্ধে গন্ধে লেপার্ড আসবেই আসবে।
তা এল। একটু পরেই একটা লেপার্ড এসে উপস্থিত হল ঘটনাস্থলে।
জন্তুটার দিকে তাকিয়ে কটার হতাশ হল– লেপার্ডটা আকারে বেশি বড়ো নয়, তার গায়ের চামড়াটাও চার্লসের কাছে লোভনীয় মনে হল না।
গ্রামের আশেপাশে যে-সব লেপার্ড ঘোরাঘুরি করে তাদের দেহের আকার খুব বড়ো হয়না, গায়ের চামড়া হয় অনুজ্জ্বল, ফ্যাকাশে। কিন্তু ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে লেপার্ডগুলি বাস করে সেগুলো সত্যিই বৃহৎ বপুর অধিকারী, তাদের চামড়াগুলি অতিশয় উজ্জ্বল ও সুন্দর। কটার আশা করেছিল একটি বেশ বড়োসড়ো অরণ্যচারী লেপার্ড তার ফাঁদে পা দেবে- এই জন্তুটাকে দেখে তার মেজাজ হয়ে গেল খাপ্পা।
লেপার্ড বড়ো ধূর্ত জানোয়ার।
সে কুকুরের মৃতদেহটাকে ভালো করে লক্ষ করলে, কিন্তু চট করে ভোজের জিনিসে মুখ দিলে না। কিছুক্ষণ পরে তার মনে হল এই ভোজটা বেশ নিরাপদ, এখানে কামড় বসালে বোধহয় বিপদের আশঙ্কা নেই- লেপার্ড নিচু হয়ে বসে পড়ল, এইবার একলাফে গাছে উঠে মরা কুকুরটাকে নামিয়ে আনবে।
চার্লসের মেজাজ আগেই খারাপ হয়েছিল। তবু সে আশা করেছিল জন্তুটা হয়ত চলে যেতে পারে। কিন্তু লেপার্ড যখন লাফ দিতে উদ্যত হল তখন আর তার ধৈর্য বজায় রইল না। ইচ্ছা করলে কটার অনায়াসেই গুলি করে লেপার্ডটাকে হত্যা করতে পারত, কিন্তু হাতের রাইফেল ফেলে দিয়ে সে হঠাৎ দৌড়ে এসে জন্তুটার পিছনে ঠ্যাং দুটো চেপে ধরলে।
পরক্ষণেই দুই সবল বাহুর আকর্ষণে লেপার্ডের শরীরটা শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে সশব্দে ভূমিশয্যায় আছড়ে পড়ল।
লেপার্ডের ঊর্ধ্বতন চোদ্দ পুরুষে কেউ কখনও এমন ব্যবহার সহ্য করেনি। আকারে ছোটো হলেও লেপার্ড হচ্ছে লেপার্ড, তুচ্ছ মানুষের হাতে আছাড় খেয়ে মুখের গ্রাস ফেলে পালিয়ে যেতে সে রাজি হল না–
ভীষণ আক্রোশে গর্জন করে সে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কটারের অস্বাভাবিক লম্বা হাত দুটো এড়িয়ে লেপার্ড শত্রুর দেহে দাঁত বসাতে পারলে না- লোহার মতো শক্ত দু-খানা হাত লেপার্ডের টুটি টিপে ধরলে।
সামনের থাবার ধারালো নখগুলি কটারের হাত দুখানা রক্তাক্ত করে দিলে, তবু লৌহ কঠিন অঙ্গুলির বন্ধন একটুও শিথিল হল না।
ঝটাপটি করতে করতে মানুষ এবং পশু মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। লেপার্ডের পিছনের থাবাদুটিও নিশ্চেষ্ট রইল না, তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কটারের নিম্ন অঙ্গ।
কিন্তু তার অঙ্গুলিগুলি লেপার্ডের গলা থেকে সরে এল না।
অবশেষে কঠিন নিষ্পেষণে রুদ্ধ হয়ে এল জন্তুটার কণ্ঠনালী। উন্মুক্ত মুখ-গহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিল দীর্ঘ দাঁতের সারি, আর সেই অবস্থায় নিঃশ্বাস নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে লেপার্ড প্রাণত্যাগ করলে।
চার্লস কটারের সর্বাঙ্গ থেকে তখন ঝরঝর ঝরছে গরম রক্তের স্রোত, টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে সেই উষ্ণ তরল ধারা মৃত লেপার্ডের দেহের উপর।
চার্লস কটার এবার কী করবে?
ক্ষতগুলিতে ওষুধ দেবার জন্য এবার ফিরে যাবে বাড়িতে?
পাগল! কটার সে জাতের মানুষই নয়।
রক্তাক্ত ক্ষতগুলিতে মোটামুটি খানিকটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে পরবর্তী শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই সেখানে এসে উপস্থিত হল আর একটি লেপার্ড। এবারের লেপার্ড আকারে খুব বড়ো, তার গায়ের চামড়াটিও খুব সুন্দর। কটার বুঝল এই জানোয়ারটা গভীর অরণ্যের বাসিন্দা নিশানা স্থির করে সে রাইফেলের ঘোড়া টিপল।
অব্যর্থ সন্ধান- একটিমাত্র গুলিতেই লেপার্ডের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
.
এই ঘটনার পরে কয়েকটা দিন কেটে গেছে।
জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে চার্লস কটার।
আচম্বিতে গাছের উপরে ঘন লতাপাতার আড়াল থেকে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল দু-দুটো ছোটো জাতের লেপার্ড।
যে জানোয়ারটা কটারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে নিহত হয়েছিল এই লেপার্ড দুটো তারই পরিবারভুক্ত কি না জানি না, কিন্তু ঘটনাটা শুনলে এটাকে প্রতিশোধের ব্যাপার বলেই মনে হয়।
এমন অভাবিত ও অতর্কিত আক্রমণের জন্য কটার প্রস্তুত ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা সে যখন বুঝতে পারল তখন লেপার্ডের দাঁত ও নখের আঘাতে তার শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।
মুহূর্তের মধ্যে সে কর্তব্য স্থির করে ফেললে।
হাতের রাইফেল আর কাজে লাগবে না বুঝে সে অস্ত্রটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করতে রুখে দাঁড়াল।
কটারের দ্রুত প্রতি-আক্রমণের জন্য লেপার্ড দুটো প্রস্তুত ছিল না, তারা ছিটকে গিয়ে শত্রুর পায়ের কাছে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সেই সুযোগে কটার চট করে একটা জানোয়ারের গলা চেপে ধরলে। এত জোরে কটার লেপার্ডটার গলা টিপে ধরেছিল যে জন্তুটার চোখে রক্ত জমে গেল।
কটারের শরীরও অক্ষত থাকল না। ধারালো নখের আঘাতে বিদীর্ণ ক্ষতমুখ থেকে ছুটল রক্তের ফোয়ারা- সুদীর্ঘ শ্বাপদ-দন্তের হিংস্র শুভ্রতাকে লাল করে দিয়ে সেই তপ্ত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ল আক্রান্ত জন্তুটার হাঁকরা মুখের মধ্যে।
অন্য লেপার্ডটা কটারের খপ্পরে ধরা পড়েনি।
সে এবার পিছন থেকে শত্রুর পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিলে। কটার তখন প্রথম জানোয়ারটার সঙ্গে মারামারি করতে করতে হঠাৎ ঝুঁকে পড়েছে দুনম্বর লেপার্ডের লাফটা ফসকে গেল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার জন্য সে কটারের পিঠের উপর না পড়ে ছিটকে এসে পড়ল সঙ্গীর পিছনের দুটো পায়ের উপর।
সঙ্গী তখন কটারের কবলের মধ্যে ছটফট করছে আর লাথি ছুড়ছে। সেই সনখ থাবার একটি লাথি এসে লাগল দুনম্বর লেপার্ডের পেটে– সঙ্গে সঙ্গে ধারালো নখের আঁচড়ে বিদীর্ণ হয়ে গেল তার উদরের মাংসপেশী।
কটার সেই মুহূর্তের সুযোগ নিতে ছাড়াল না।
টপ করে হাত বাড়িয়ে সে দ্বিতীয় লেপার্ডটার কণ্ঠনালী চেপে ধরলে।
এইবার সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে সে জন্তুটাকে মাটিতে চেপে ধরে গলা টিপে মারবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু লেপার্ডের দেহের মাংসপেশীগুলি শক্তিশালী স্প্রিং-এর মতে- চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষেও তাদের মাটিতে চেপে রাখা অসম্ভব। জন্তুদুটো জোর করে ঠেলে উঠল, অতএব কটারও সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হল। কিন্তু প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালীর উপরে তার আঙুলের চাপ একটুও শিথিল হল না।
…ধারালো নখের আঘাতে কটারের কাঁধ এবং হাত দিয়ে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। এত রক্তপাতেও কটার অবসন্ন হল না বরং রক্ত দেখে তার মাথায় খুন চেপে গেল।
ক্রুদ্ধ চার্লস কটার এবার যা করলে তা প্রায় অবিশ্বাস্য।
একটা জন্তুর মাথার সঙ্গে সে আর একটা জন্তুর মাথা সজোরে ঠুকতে লাগল।
লেপার্ড দুটো কিন্তু এমন মার খেয়েও কাবু হলনা।
তারা ক্রমাগত ছটফট করতে করতে কটারের বজ্রমুষ্টি থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে, আর তাদের থাবার ধারালো নখগুলি সমানে শত্রুর দেহে আঁচড় কেটে যাচ্ছে।
রক্তে লাল হয়ে উঠেছে কটারের সর্বাঙ্গ, লেপার্ড দুটোর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে লৌহকঠিন আঙুলের নিষ্ঠুর পেষণে।
তবু কোনো পক্ষই পরাজয় স্বীকার করছে না।
কটারের সঙ্গে যে নিগ্রো সঙ্গীরা ছিল তারা প্রথমে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরে আবার ফিরে এসেছে। বিস্ফারিত চক্ষুর ভীত বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে এই আশ্চর্য দৃশ্যের দিকে কিন্তু এখন আর কটারকে সাহায্য করার উপায় নেই, মানুষ ও পশু এমনভাবে পরস্পরকে
জড়িয়ে ধরে মারামারি করছে যে গুলি চালালে কটারও আহত হতে পারে।
অতএব তখন পরিস্থিতি হচ্ছে এই যে, যে পক্ষের সহ্যশক্তি বেশি সে পক্ষই জয়লাভ করবে।
চার্লস কটারের রক্তস্নাত দীর্ঘ দেহ যেন অফুরন্ত শক্তির আধার। সে হঠাৎ বুঝতে পারলে তার দুই শত্রুর দেহ অবশ হয়ে আসছে; তাদের থাবার আঁচড়ে, শরীরের আস্ফালনে আর আগের মতো জোর নেই।
মহা উল্লাসে কটার চিৎকার করে উঠল।
যে লেপার্ডটার উদর সঙ্গীর নখের আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার ক্ষতস্থান থেকে তখন অবিরল ধারায় রক্ত ঝরে পড়ছে। কটারের অবস্থা তো আগেই বলেছি।
মানুষ ও পশুর রক্তে পিছল হয়ে উঠল রণভূমির ঘাস-জমি।
কটার যখন বুঝল তার শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়েছে, সে তখন লড়াইয়ের কায়দা বদলে ফেলল। হাতদুটো সোজা করে সে জন্তু দুটোকে এমনভাবে তুলে ধরলে যে তাদের থাবাগুলো আর তার দেহ স্পর্শ করতে পারলে না।
এইবার সে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে জন্তু দুটোর মাথা ঠুকতে লাগল।
… মাথার উপর পড়ছে প্রচণ্ড আঘাত, কণ্ঠনালীর উপর শ্বাস রোধ করে চেপে বসেছে লৌহকঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর বন্ধন
নিস্তেজ হয়ে এল দুই শাপদের হিংস্র আস্ফালন…
মুমূর্য জন্তু দুটোকে মাটির উপর আছড়ে ফেলে চার্লস কটার সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সে এক আশ্চর্য দৃশ্য!
মাটির উপর মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছে দু-দুটো লেপার্ড, আর তাদের পাশেই ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এক মহাকায় মানুষ।
গল্পের টারজান কি কটারের চেয়েও শক্তিশালী?
কটার এখন কী করবে? বাড়ি ফিরে যাবে? ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে শয্যাগ্রহণ করবে? মোটেই নয়। চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।
ক্ষতস্থানগুলিতে নিগ্রোদের সাহায্যে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে আবার সঙ্গীদের নিয়ে পথ চলতে শুরু করলে।
কথায় আছে, ডানপিটের মরণ গাছের আগায়।
চার্লস কটার অবশ্য গাছের আগায় মরেনি, তবে তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যন্ত ভয়ানকভাবে। জন্মগ্রহণ করেছিল সে সুসভ্য আমেরিকার ওকলাহাম প্রদেশে, আর তার মৃত্যু হল ঘন বন আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।
একেই বলে নিয়তি।
হ্যাঁ, নিয়তি ছাড়া আর কি বলব।
চার্লসের মৃত্যুকে একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু বলা চলে না, আর এই দুর্ঘটনার কারণ হল একটি যন্ত্রের যান্ত্রিক ত্রুটি।
না, না, রাইফেল নয়, পিস্তল নয়, একটা ক্যামেরার দোষেই এই দুর্ঘটনা ঘটল– অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, চার্লস কটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটি ক্যামেরা।
মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য- তাই না?
কিন্তু বাস্তব সত্য অনেক সময়ে কল্পনাকেও অতিক্রম করে যায়। আচ্ছা, ঘটনাটা খুলেই বলছি।
চার্লস কটার একদিন রাইফেলের সঙ্গে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বনের পথে যাত্রা করলে।
এই ক্যামেরার view-finder-টা খারাপ ছিল। (ক্যামেরার মধ্যে বসানো স্বচ্ছ কাঁচের মতো যে জিনিসটার ভিতর দিয়ে ক্যামেরাধারী ফোটো তোলার বিষয়বস্তুকে দেখতে পায় সেই অংশটিকে বলে view-finder)
ক্যামেরার সামান্য দোষ-ত্রুটি নিয়ে কটার মাথা ঘামায়নি, আর এইটুকু অন্যমনস্কতার জন্যই তাকে প্রাণ হারাতে হল।
জঙ্গলের পথে অকস্মাৎ কটারের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে একটা মস্ত গণ্ডার।
কটার রাইফেল রেখে নিবিষ্ট চিত্তে গণ্ডারের ফোটো তুলতে লাগল। হতভাগা গণ্ডার।
সে ফটো তুলে দেওয়ার জন্য একটুও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে না, খঙ্গ উঁচিয়ে ধেয়ে এল কটারের দিকে।
আগেই বলেছি ক্যামেরার view-finder খারাপ ছিল। ক্যামেরার যান্ত্রিক চক্ষুর মধ্যে দিয়ে কটার দেখছে জন্তুটা অনেক দূরে আছে, কিন্তু আসলে তখন গণ্ডার খুব কাছে এসে পড়েছে।
কটার যখন তার বিপদ বুঝতে পারলে তখন আর সময় নেই- গণ্ডারের খঙ্গ প্রায় তার দেহ স্পর্শ করেছে।
সশব্দে অগ্নি-উদগার করলে কটারের রাইফেল সঙ্গেসঙ্গে গণ্ডারের সুদীর্ঘ খঙ্গ সেই অতিকায় নরদানবের দেহটাকে বিদীর্ণ করে দিলে।
কটারের মুখ থেকে একটা অস্ফুট আর্তনাদও শোনা গেল না, সে তৎক্ষণাৎ মারা গেল।
চালর্স কটার জীবনে কখনও পরাজয় স্বীকার করেনি, মৃত্যুকালেও জয়লক্ষ্মী তার কণ্ঠে পরিয়ে দিল জয়মাল্য।
মরার আগে কটার একবারই গুলি চালাবার সুযোগ পেয়েছিল, এবং সেই একটিমাত্র গুলির আঘাতেই কটারের আততায়ী মৃত্যুবরণ করলে।
চার্লস কটারের মৃতদেহের পাশেই লুটিয়ে পড়ল গুলিবিদ্ধ গণ্ডারের প্রাণহীন দেহ।