৫৫
রুদ্রদের নৌকো যখন ভেসে চলেছে নদীতে, তখন আবার ফোন করলেন রাধানাথ স্যার। সেই একই স্পুফ করা নম্বর।
রুদ্র ফোনটা রিসিভ করেই বলল, “আপনার জন্মদিন কি ১২ই বৈশাখ?”
রাধানাথ স্যার একটু চুপ করে থেকে শ্লেষজড়িত স্বরে বললেন, “কল্কিপুরাণ পড়েছ তাহলে? যাক! কোনো প্রলয় যখন পৃথিবীতে নেমে আসে, তখন তা সকলের বোঝার ক্ষমতা হয় না। আর কেউ কেউ বুঝলেও তা বিশ্বাস করতে চায়না। তুমি হচ্ছ দ্বিতীয় গোত্রের।”
রুদ্র উত্তর না দিয়ে বলল, “কলিযুগ যে শেষ হতে চলেছে, সেটা আপনি কী করে বুঝলেন স্যার?”
রাধানাথ স্যার আবার বললেন, “কলিযুগের যে শেষ উপস্থিত হয়েছে, তা তোমরা কি বুঝেও বুঝছ না? না বোঝার চেষ্টা করছ না? আমার পূর্বপুরুষ জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন নিজেও ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। কিন্তু তোমাদের মতো লোকদের জন্য একশো বারো বছর বেঁচে থেকেও তিনি উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেননি।”
“জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন নিজেকে কল্কি অবতার ভেবে সবকিছু ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, এই আজগুবি কথা আপনার মাথায় কে ঢুকিয়েছে? আপনার মামা গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য? যিনি নিজেই সম্পর্কে ওই বংশের পাতানো বংশধর ছিলেন?” রুদ্র মিহি গলায় কেটে কেটে বলল।
“চুপ করো।” আহত সিংহের মতো ফুঁসে উঠলেন রাধানাথ রায়, “যাকে চেনো না, যাকে জানো না, যার নখের যোগ্য তোমরা কেউ নও, তাঁর সম্পর্কে কথা বলার সাহস হয় কি করে?”
রুদ্র বলল, “বেশ। আমরা না হয় চিনি না। কিন্তু আপনি তো একদিকে যেমন তর্কপঞ্চাননের উত্তরসূরি, তেমনই অন্যদিকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরও উত্তরসূরি। একজন কৃষ্ণভক্ত, অন্যজন শাক্ত।”
“তাতে কী?”
“তাতে এটাই যে, আমার তো মনে হচ্ছে, তর্কপঞ্চানন নয়, আপনার স্বভাবপ্রকৃতি একেবারেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো। আপনি কি জানেন না যে, জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিবাদ ছিল? এবং সেই বিবাদের অন্যতম কারণ ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রক্ষণশীলতা এবং তর্কপঞ্চাননের উদারমনস্কতা? কৃষ্ণচন্দ্র নারীপ্রগতির বিপক্ষে ছিলেন। যে কারণে ঢাকার রাজবল্লভ সেন চেয়েও তাঁর বাচ্চা মেয়ের পুনর্বিবাহ দিতে পারেননি। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন পুরো সম্মতি দিলেও কৃষ্ণচন্দ্রের প্ররোচনায় গোটা নবদ্বীপের পণ্ডিতকুল রে রে করে উঠেছিল। সেই একই কাজ আপনিও করে চলেছেন। তাও আবার এই একবিংশ শতাব্দীতে। যেখানে সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে মেয়েরা নিজেদের প্রমাণ করেছে। আপনার লজ্জা করছে না স্যার? যে ছেলেগুলো আপনার ওই নরককুণ্ড থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, তাদের অবধি আপনি খুন করেছেন। তার ওপর নিজে আইনের একজন রক্ষক হয়ে ইচ্ছে করে ভুল দিকে মিসগাইড করেছেন আমাদের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা একটা গুণ। সময়কে কখনো অস্বীকার করা যায়না। আর যারা তা করতে চায়, যারা ঘড়ির কাঁটাকে স্তব্ধ রেখে বাঁচতে চায়, তারা অসুস্থ, উন্মাদ।”
ফোনের ওপারে শুধুই নিস্তব্ধতা। রুদ্রদের নৌকো এখন প্রায় মাঝনদীতে। রুদ্র কান থেকে মোবাইলটা সরিয়ে চোখের সামনে আনল।
না। লাইন কেটে যায়নি।
রাধানাথ স্যার চুপ করে আছেন কেন?
ফোনটা কেটে গেল কিছুক্ষণ পর। নৌকো একই মৃদুমন্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে জল কেটে। বেশ কিছুক্ষণ পর ও ফিসফিস করল, “জয়ন্ত, একটা আলো দেখতে পাচ্ছ?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম।” জয়ন্ত বলল, “আগুন জ্বলছে মনে হচ্ছে। এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না সেভাবে।”
“হ্যালো ওয়ান টু থ্রি ফোর ফাইভ সিক্স। সিক্স ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান। মঞ্জিল, শুনতে পাচ্ছ?” ওসি আশুতোষ তরফদার তাঁর ওয়াকিটকিতে কথা বলছিলেন, “আমরা অলমোস্ট চলে এসেছি। তোমরা আর ঠিক দশ মিনিট পর ফার্ম হাউজের সামনের দিক থেকে এন্ট্রি নেবে। হ্যালো। হ্যালো।”
ফোনটা রেখে এদিকে তাকালেন আশুতোষ তরফদার, “ফার্ম হাউজের ওদিকটা তো দোগাছিয়া থানার আন্ডারে। ওদের ওসিকে বলে রাখলাম। অসুবিধা নেই। কমিশনারের অর্ডার সব জায়গাতেই এসে গেছে।”
রুদ্র সরু চোখে দেখছিল। ওদের নৌকো ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে অদূরের সেই অঞ্চলের দিকে, যাতে এতকাল বাইরের কারুর পা পড়েনি। ইনফর্মার মিন্টু বলছিল, ওরা ছোট থেকে জেনে এসেছে, চৌধুরীদেরই একটা বড় তালুক রয়েছে ওখানে। ব্যাস, ওইটুকুই।
কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর রাত। ম্লান চন্দ্রালোকে সত্যিই যেন দূরের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে কিছু শব্দ। সেই শব্দ ভাল করে শুনলে বোঝা যায় শাঁখ ও কাঁসরঘণ্টার।
“কী হচ্ছে ওখানে?” জয়ন্ত উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়। নৌকো মুহূর্তে টলমল করে ওঠে।
দাঁড় টানতে থাকা মাঝি বলে ওঠে, “বাবু! এভাবে উঠে দাঁড়াবেন না। ছোট নৌকো। আমি একা দাঁড় বাইছি। টাল সামলাতে পারব না। এদিকটায় সরু হলেও গভীর আছে সরস্বতী। নোঙর করি, তারপর দাঁড়াবেন।”
জয়ন্ত অপ্রতিভমুখে বসে পড়ল।
রুদ্রর মনের মধ্যে ঝড় উঠছিল।
রাধানাথ স্যার কি এখানেই রয়েছেন?
৫৬
ক্ষমা একটা ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখছিল। একটা উঁচু পাহাড়।
পাহাড় ও কোনোদিনও দেখেনি। কিন্তু মাসির বাড়িতে ছবি দেখত অনেক। মাসি আর মেসোর অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার ছবি।
প্রথম প্রথম ছবি দেখে ও ভয়ে আঁকড়ে ধরত মা’কে। মনে হত, কোন জীবিত মানুষের আত্মাকে ওইভাবে ভেতরে আটকে রাখা হয়েছে কোন তন্ত্রমন্ত্রবলে। মাসি তখন জোরে ধমক দিত।
সেই ছবির কিছু পাহাড় ছিল সাদা। মাসি বলেছিল সেগুলো বরফে ঢাকা। বরফও ও প্রথম মাসির বাড়িতেই দেখেছিল। সেই ঠান্ডা ঘরটার মধ্যে থরে থরে জমে থাকত। কী যেন বলতো সেই ঠান্ডা ঘরটাকে?
হ্যাঁ মনে পড়েছে। ফ্রিজ।
ক্ষমা এখন স্বপ্নতে যে পাহাড়টা দেখছে, তাতে কোনো বরফ নেই। একটা সবুজে ঢাকা পাহাড়। উঁচু-নীচু টিলা। লাল রঙের পথ, এদিক ওদিক কিছু গাছ ছড়ানো ছিটানো।
ক্ষমা আর চলতে পারছে না। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে, “আর পারব না গো মাসি, খুব কষ্ট হচ্ছে। ওই দ্যাখো, আমার মা বসে পড়েছে।”
মাসি তাড়া দিচ্ছে, “এইটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলি? তোদের বয়সে আমরা কত ছোটাছুটি করতাম! আরেকটু চল। ওই যে, ওই দূরের লম্বা গাছটা …!”
বলতে বলতে মাসি অনেকদূরে চলে যাচ্ছে ওর থেকে। ও ভয়চোখে দেখছে। ফুসফুসে অনেকটা বাতাস পূর্ণ করে নিয়ে আবার ছুটছে। চিৎকার করছে, “মাসিইইই! মাসিইইইইই! আমাকে ছেড়ে যেও না! আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে!”
মাসি যেন শুনতেই পাচ্ছে না ওর কথা। হাসতে হাসতে সরে যাচ্ছে আরও দূরে। ক্ষমা প্রাণপণ চেষ্টা করছে জোরে ছুটতে, কিন্তু পারছেনা। কারা যেন তাড়া করছে ওকে পেছনে!
ওর দম আটকে আসছে। মনে হচ্ছে, ওকে কি ওরা মেরে ফেলবে? মাসির থেকে ওকে ওরা জোর করে নিয়ে এল কেন? ওখানে ও কত ভালো ছিল। মেসোর কাছে লেখাপড়া শিখত ঘুরত, বেড়াত।
“ক্ষমা! আর দেরি করিস না! ওঠ শিগগীর!”
হ্যাঁচকা টানে ক্ষমার স্বপ্নটা ছিঁড়ে যায়। দেখে দ্বারিকাদাদা ওকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। ওর হাত আর পা শক্ত করে বেঁধে রাখা ছিল যে দড়ি দিয়ে, সেগুলোকে একটা দা দিয়ে ছিঁড়ছে ক্ষিপ্রগতিতে।
এটা কোথায় শুয়ে রয়েছে ও? চোখ জ্বালা করছে ধোঁয়ায়। ক্ষমা চারপাশে তাকিয়ে চিনতে পারে শ্মশানটাকে। ওদের সেই বৈদিক সমাজের শ্মশান। যেখানে এর আগে একবারই নিয়ে আসা হয়েছিল ওকে।
ওর বর মারা যাওয়ার পর।
দ্বারিকা ব্যগ্রভাবে বলে, “চল ক্ষমা। দেরি করিস না। ওরা তোকে পুড়িয়ে মারবে।”
“কারা?” সাদা চোখে তাকায় ক্ষমা।
দ্বারিকা বলে, “কারা আবার, কেষ্টহরি ঘোষালের ছেলেরা। তোর ভাশুরপো’রা। বুঝতে পারছিস না? যারা তোর মা’কেও মেরেছে?”
“আমার মা’কে মেরে ফেলেছে?” ক্ষমার চোখদুটো কেঁপে উঠল, “ কী করে জানলে?”
দ্বারিকা একটু থেমে বলল, “তোকে নিয়ে আসার পরের দিনই তো ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সব পাড়ায় গিয়ে গিয়ে বলছিল। তুই জানিস না?”
ক্ষমা একটা লম্বা হাই তোলে। বলে, “আমার খুব ঘুম পাচ্ছে!”
দ্বারিকা উদ্ভ্রান্তের মতো তাকায় ওদিকে। বৈদিক সমাজ আজ প্রায় পুরুষশূন্য। সকলেই চলে গিয়েছে মাহেন্দ্রমহোৎসবে নারায়ণী সেনা হয়ে। শুধু কেষ্টহরি ঘোষালের ছেলেদের ছোট দলটা রয়ে গিয়েছে। যারা আজ ক্ষমাকে এই শ্মশানে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে।
সহমরণের পবিত্র চিতা থেকে যে উঠে পালায়, সে নাকি মহাপাপিষ্ঠা, তার পাপের গোটা পরিবার নাকি কলুষিত হয়। এত বড় পাপীর বেঁচে থাকা মানে দিনদিন সেই পাপের বোঝা ভারী করা। তাই আজ এই মাহেন্দ্র মহোৎসবের শুভলগ্নেই ক্ষমাকে মেরে ফেলা হবে। ওকে সিদ্ধি জাতীয় কিছু পাতার রস বেঁটে খাইয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। ক্ষমা তাই থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়ছে।
দ্বারিকা ছটফটিয়ে উঠল। এখানে আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। নারায়ণী সেনাদের নিয়ে যে নৌকোগুলো রওনা দিয়েছে, সেগুলো বোধহয় এতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। অনেক কৌশলে ও সরে পড়েছিল শ্মশান থেকে, গিয়ে লুকিয়েছিল বাগদিপাড়ায়।
শ্রীহরি কিছু বলে দেয়নি তো? ভাবতে ভাবতে দ্বারিকা টান দিল ক্ষমার হাত ধরে। মেয়েটা ঝিমোচ্ছে, প্রয়োজনে ওকে কাঁধে করে দ্বারিকাকে এখান থেকে পালাতে হবে।
কিন্তু ক্ষমা হঠাৎ স্পষ্টস্বরে বলল, আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।”
“যাবি না মানে?” দ্বারিকা বিস্মিতচোখে ফিসফিস করল, “ওরা তোকে মেরে ফেলবে। মেলা তর্ক না করে আমার সঙ্গে চল।”
“না।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল ক্ষমা।
“কেন?”
“আমাকে বাঁচাতে গিয়ে এরমধ্যেই ব্রজেন্দ্রদাদাকে মরতে হয়েছে। আমার মা’ও মরে গিয়েছে। আমার জন্য তোমাকেও আমি মরতে দেব না, দ্বারিকাদাদা। তার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভালো। সবার জ্বালা জুড়োবে।”
“বোকার মতো কথা বলিসনা ক্ষমা। আমি মরতে যাব কেন? আজ গোটা গ্রামে লোক বলতে গেলে নেই। ব্রজেন্দ্রদাদা’র মতো অবস্থা আমার হবে না। আমি আর তুই সাঁতরে পার হয়ে যাব এই জরা নদী। একবার ওপারে উঠতে পারলেই … ব্যস! আর কোনো চিন্তা নেই।” দ্বারিকার গলা উত্তেজনায় কাঁপছিল।
“তারপরেই বা কী হবে?” ক্ষমার গলা ধরে এল, “সেই তো বিধবার জীবনযাপন, সংসারের এঁটোকাঁটা খেয়ে এক কোণে পড়ে থাকা। সে’ও তো মরাই। তার চেয়ে একবারে মরে যাওয়াই তো ভালো, দ্বারিকাদাদা!”
৫৭
কৃষ্ণাষ্টমীর রাতে বৈদিক সমাজের আকাশ কেমন যেন থম মেরে রয়েছে। কালবৈশাখীর আগে যেমন সবদিক চুপচাপ হয়ে যায় তেমনই।
দ্বারিকা দৃপ্ত কণ্ঠে বলছিল, “তুই কি ভাবছিস, এই অন্যায় অবিচার দিনের পর দিন চলবে? দেশে কি আইন শৃঙ্খলা নেই? এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আধুনিক জগতের কাছে সব নোংরামি তুলে ধরব আমি, বের করে দেব ধর্মের নামে এইসব ভণ্ডামি!”
বলতে বলতে দ্বারিকা নিজেই যেন নিজের গলা চিনতে পারে না। মনে হয়, ও নয়, অচ্যুতই যেন কথা বলছে ওর মধ্য দিয়ে।
ক্ষমা বিহ্বলচোখে তাকায়, “সত্যি বলছ?”
“তা নয় তো কী?” দ্বারিকা হঠাৎ গ্রামের ভেতরদিকে মশাল দেখতে পায়, বেশ কয়েকটা মশাল দ্রুতগতিতে নিকটবর্তী হচ্ছে ক্রমশ।
”ওই … ওই ওরা আসছে! আর দেরি করিস না ক্ষমা। শিগগীর আমার সঙ্গে আয়! ওরা এক্ষুনি এসে পড়বে!”
ক্ষমা অতিকষ্টে উঠে দাঁড়াল, “তুমি … তুমি আমাকে আমার মাসির কাছে নিয়ে যাবে গো দ্বারিকাদাদা? মাসির বাড়িতে বিশাল বড় বাগান। আমি অ থেকে ঔ শিখেছিলাম, জানো!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যাব। একটু কষ্ট করে সাঁতরাবি, সেবারের মতো। তুই পারবি। পারতে তোকে হবেই।” দ্বারিকা আর দেরি করে না, ক্ষমার হাত শক্ত করে ধরে এগোতে থাকে ঘাটের দিকে।
শ্মশানের এঁটেল মাটি সকালের অপর্যাপ্ত বর্ষণে পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে। মাথার ওপরে কৃষ্ণাষ্টমীর চাঁদ। সেই ক্ষীণ আলোয় দ্বারিকা ক্ষমাকে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছিল। নেশার ঘোরে ক্ষমা মাঝে মাঝেই এলিয়ে পড়ছিল, হাঁটু ভেঙে চাইছিল শুয়ে পড়তে। কিন্তু দ্বারিকা শক্তহাতে ওকে টেনে তুলে নিয়ে ছুটছিল।
শ্মশানে সেই অর্থে ঘাট কিছু নেই। পাড়ে এসে নৌকো থামে। দ্বারিকা ছুটতে ছুটতে একেবারে পাড়ে পৌঁছতেই হিমচোখে দেখল, কেষ্টহরি ঘোষালের লোকেরা পাড়ের সমান্তরালে উলটোদিক দিয়ে ছুটে আসছে।
দ্বারিকা বিভ্রান্ত হল না, ক্ষমার হাতে সজোরে টান মেরে ডানদিক বেঁকে ছুটতে লাগল কৈবর্তপাড়ার দিকে। সেদিকটা একেবারেই অন্ধকার। ঘেঁষাঘেঁষি করে পরপর ঘর, সেভাবে আলোও ঢোকে না। অন্ধকারে কোন কুঁড়েঘরের পেছনে লুকিয়ে পড়তে পারলে ওদের কেউ খুঁজে পাবে না। দ্বারিকা ক্ষমার হাত ধরে সেদিকেই ছুটতে লাগল।
“ওই ওদিকে যাচ্ছে। ধর ধর! ধর শিগগীর!”
“সঙ্গের ছোঁড়াটা কে? নষ্ট মাগীটার নাগর নাকি? হাতে পেলে হাড়গোড় গুঁড়ো করে দেব!”
পেছনে হিংস্র উল্লাসে ধেয়ে আসছে উন্মত্ত কয়েকজন। যারা মানুষ হলেও ধর্মোন্মত্ততায় পরিণত হয়েছে শ্বাপদে। যাদের যুক্তি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে বহুকাল আগেই।
পাড় থেকে কৈবর্তপাড়ার দিকে বেঁকার ঠিক আগের মুহূর্তেই ওদের একজন ধরে ফেলল ক্ষমার মাটিতে লুটোতে থাকা থানের একপ্রান্ত। তার কর্কশ টানে দ্বারিকার হাতের বাঁধন ছেড়ে মাটিতে সজোরে আছড়ে পড়ল ক্ষমা।
দ্বারিকা একটা ঝোপের আড়ালে লুকোতে গিয়েও পারল না, ওকে হিড়হিড় করে বাইরে টেনে আনল দুজন। চাঁদের মায়াবী আলোয় ও দেখল ক্ষমাকে দুপাশে দুজন চেপে ধরে নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমার মুখে গুঁজে দেওয়া হয়েছে তারই কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো। ক্ষমার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে বাইরে। পা-দুটো ছটফট করছে প্রাণপণে।
ওরা কি ওইটুকু নিষ্পাপ মেয়েটাকে নদীতে ডুবিয়ে মারবে? কী দোষ মেয়েটার? স্বামীর মৃত্যুর পরেও সে বাঁচতে চেয়েছিল, সেটাই একমাত্র অপরাধ?
শ্মশান সংলগ্ন অরণ্য থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন। দূরে জলের শব্দ হচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ। দ্বারিকা শরীরের সব শক্তি একত্র করেও দুপাশে দাঁড়ানো কেষ্টহরি ঘোষালের লোকদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারছে না নিজেকে। তাদের একজনের হাতে চকচক করছে ধারালো ছোরা।
বিদ্যুৎ গতিতে যেন ঘটে যাচ্ছে সবকিছু। তার কানে আসছে ক্ষমার চাপা গোঙানি। মুখে কাপড় গোঁজা অবস্থায় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আর্তনাদ করলে যেমন আওয়াজ হয়।
ডানদিকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা দ্বারিকার মাথার পেছনদিকে ঝুলতে থাকা টিকিটা ধরে হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে টান দিল।
ব্যথায় দ্বারিকা ককিয়ে উঠতেই ওর বাঁ গালে এসে পড়ল থাপ্পড়।
“এত বড় সাহস তোর? আমাদের বাড়ির বউকে নিয়ে ভাগছিলি?”
ব্যথায় দ্বারিকা চোখে অন্ধকার দেখছিল। মনে হচ্ছিল, প্রচণ্ড সেই চপেটাঘাতে ওর মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে গেছে। এখুনি গলগল করে বেরিয়ে পড়বে রক্ত। তবু সেই অবস্থাতেও ও বলতে চেষ্টা করল, “ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে আবার বউ কি? ওর জীবনটা তোমরা নষ্ট করছ!”
কথা শেষ হল না, ওর মুখে এসে পড়ল একটা ঘুষি। মুহূর্তে ওর জিভে এসে লাগল রক্তের গরম নোনতা স্বাদ।
বাঁ দিকের লোকটা ওর হাতটা মুচড়ে আরও একটা ঘুষি মারতে উদ্যত হল, কিন্তু নদীর পার থেকে ডাক এল, “ওই বিশু, এদিকে আয়! বাঁধা হয়ে গেছে। কলসিটা কোথায়, খুঁজে পাচ্ছি না।”
বিশু নামের লোকটা ডানদিকের লোকটার হাতে ছুরিটা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে গেল। দ্বারিকার বুকের ভেতরটা কাঁপছিল। ক্ষমার হাত পা বেঁধেছে। এবার কি গলায় কলসী বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেবে?
ওর মুহূর্তের জন্য মনে পড়ে গেল ব্রজেন্দ্রদাদার সেই ভয়ংকর মুখটা। কালোপুকুরের একেবারে মাঝখানে বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকে। জিভ ক্রমশ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল বাইরে। চোখ ঘোলাটে, মরা মানুষের মতো। গোটা সমাজ কাজে যেতে আসতে বিস্ফারিত চোখে দেখত ন্যাকড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসা তার গোঙানির অমানুষিক আর্তনাদ।
না। কিছুতেই আরেকটা তরতাজা প্রাণকে ও মরতে দেবে না।
মুহূর্তের মধ্যে সর্বশক্তি একত্র করে ডানদিকের লোকটার তলপেট লক্ষ্য করে সে চালাল এক লাথি। লোকটার হাতে ধরে থাকা ছুরিটা গিয়ে পড়ল সামনে। লোকটা প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে বসে পড়তেই দ্বারিকা ছুরিটা তুলে নিয়ে ছুট লাগাল সামনের দিকে।
ক্ষমাকে বাঁচাতেই হবে।
ওই তো, ওই তো ক্ষমার গলায় কলসী বাঁধছে ওরা। ডুবিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে নদীর জলে। মেয়েটা মুখে ন্যাকড়া গোঁজা অবস্থায় ছটফট করছে। হাত পা বাঁধা অবস্থায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
চারটে কালো কালো পাকা মাথা নিবিষ্ট মনে বুনছে হত্যার ষড়যন্ত্র। দ্বারিকা দিগবিদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটে গেল। আহত বাঘের মতো গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকগুলোর ওপর। ওর হাতে ধরা ধারালো ধাতব ফলা দেখে সবাই একটু থমকে গেল।
দ্বারিকা আর ভাবল না। আজ ওর শরীরে যেন অচ্যুত ভর করেছে। ক্ষিপ্রগতিতে ও ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল নদীতে।
কিন্তু পারল না। কারণ তার আগেই ওর পিঠে কে যেন আমূল গেঁথে দিয়েছে একটা ধারালো ছোরা। প্রচণ্ড আঘাতে ওর শরীর কাঁপছে, বিবশ হয়ে আসছে মন, লুপ্ত হয়ে আসছে চেতনা!
তবু তারই মধ্যে ও দেখতে পেল, ডানদিকের বাঁক দিয়ে হঠাৎই পারে এসে পড়েছে একটা নৌকো।
সেখান থেকে ঝপাঝপ নামছে কিছু লোক।
কারা এরা? এদের পোশাক আশাক যে একেবারে অন্যরকমের!
হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে গর্জে উঠল একটা কানফাটানো শব্দ। সঙ্গে তীব্র আলোর ঝলকানি।
কেষ্টহরি ঘোষালের লোকেরা পালাচ্ছে দুরদারিয়ে।
দ্বারিকা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।
তার আগেই ও জ্ঞান হারাল।
৫৮
সবেমাত্র ভোর হচ্ছে। সূর্যদেব অলস চোখে উঁকি দিচ্ছেন পূর্বদিকে। দূরের সবুজ ধানখেতের আলগুলোয় এখনো লেগে রয়েছে ভেজা শিশিরবিন্দু।
তবে এর মধ্যেই গোটা গ্রাম জেগে গিয়েছে।
খোশলাপুর গ্রামের ‘শম্ভল ফার্ম হাউজ’ এর প্রধান প্রবেশপথের বাইরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। সেই জায়গার চারপাশে থিকথিক করছে কৌতূহলী গ্রামবাসীদের ভিড়। ছেলেবুড়ো, বাড়ির বউ, মেয়ে সবাই হাঁ করে দেখছে এদিকে।
দেখবে নাই বা কেন? ওদের এই নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে এত বড় ঢেউ আগে এসেছে নাকি কখনো? অন্তত কুড়িখানা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে রয়েছে ফার্মহাউজের গেটের সামনে। তার মধ্যে দু-তিনটের মাথায় দপদপ করছে লাল-নীল আলো।
একটু আগে অবধিও দাঁড়িয়েছিল দুটো অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সে দু’টো গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল। তারপর আবার বেরিয়ে এসে রওনা দিয়েছে শহরের দিকে।
গ্রামবাসীদের সামনে দিয়ে ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছে, কঠোর নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে গোটা এলাকা। পুলিশের গার্ডরা পাহারা দিচ্ছে সেখানে।
রুদ্র গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতস্বরে কারুর সঙ্গে কথা বলছিল। ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে সপসপ করছে। চুল উসকোখুসকো। পুলিশ উর্দির শার্ট এদিক ওদিক উঠে রয়েছে, কালো বুট কাদামাখা। প্যান্টের নীচের দিকেও কাদা শুকিয়ে শক্ত হয়ে লেগে রয়েছে।
মুখেচোখে রাতজাগা ক্লান্তির ছাপ।
“কমিশনার স্যার ছিলেন, একটু আগে বেরিয়ে গেলেন। আমাদের পুরো অপারেশন সাকসেসফুল … না, খোঁজ চলছে … ওকে!”
নৌকো করে বদনপুর থেকে এসে বাংলার এই গোপন আমীশ সমাজে ওরা যখন ঢুকেছিল, তখন ঘড়িতে রাত প্রায় বারোটা।
এখন বাজে ভোর পাঁচটা। এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা একটানা চলেছে ওদের অপারেশন।
সত্যি বলতে কি, ওদের নৌকোটা যখন নদীর বাঁক পেরিয়ে এপারে আসছিল, তখনই ওরা বুঝতে পেরেছিল ডাঙায় কিছু একটা চলছে। কিছু লোকের ধস্তাধস্তি, সঙ্গে একটা চাপা গোঙানি।
রুদ্র আর দেরি করেনি। ডাঙায় নামার সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে দু’বার ফায়ার করেছিল। জয়ন্ত, আশুতোষ তরফদার ও অর্জুন গিয়ে উদ্ধার করেছিল রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটাকে।
ছেলেটার তখনও সংজ্ঞা ছিল। ইশারায় বারবার দেখাচ্ছিল জলের দিকে।
ক্ষমাকে যখন নদী থেকে তুলে আনা হল, ততক্ষণে তার নাকমুখ দিয়ে অনেক জল ঢুকে গিয়েছে।
পুলিশের জোরালো টর্চলাইটে ক্ষমার চোখবোজা মুখটা দেখে বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গিয়েছিল রুদ্র। পুলিশ উর্দিতে থেকেও ওর গলার কাছটা দলা পাকিয়ে উঠেছিল।
তবে বেশি ভাবার সময় ছিল না। দ্রুত গতিতে ওরা ঢুকে পড়েছিল গ্রামের মধ্যে।
আর তারপরের দু’ঘণ্টায় আবিষ্কার করেছিল এক সম্পূর্ণ আলাদা জগত। যে জগতের কোন অস্তিত্ব বাইরের পৃথিবীর জানা নেই।
শুভাশিসবাবু আমেরিকার আমীশ সম্প্রদায় প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ওরা নিজেরাই শস্য উৎপাদন করে, পশুপালন করে, বিনিময় প্রথায় জীবন নির্বাহ করে। অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী একেবারে প্রাইমারি বা অ্যাগ্রো ইকোনমিতেই ওরা আটকে রেখেছে নিজেদের। যে কোনো রকম পরিবর্তনকে ওরা মনে করে স্খলন।
রুদ্র অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল কীভাবে সার সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাটির কুঁড়েঘর। কীভাবে সুপরিকল্পিতভাবে রয়েছে শস্যখেত, পুকুর, মন্দির। স্বনির্ভর অর্থনীতির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলার এই আমীশ সমাজ।
ওরা একের পর এক বাড়িতে ঢুকেছে, নির্দয় সার্চ করে তোলপাড় করেছে, বেরিয়ে এসেছে। ততক্ষণে কমিশনার পাঠানো ফোর্স ফার্ম হাউজের সামনে দিয়ে এসে জঙ্গল টপকে ঢুকেছে এদিকে। পুরুষ, মহিলা, সবাইকে সার দিয়ে দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে এক খোলা মাঠে।
গোটা অপারেশন চলাকালীন একটা বড় মন্দিরের সামনে আবক্ষ এক মূর্তি দেখে অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে চিনতে ভুল হয়নি ওর।
কিন্তু কোথায় দণ্ডমুণ্ডকর্তা?
কোথায় রাধানাথ রায়?
জয়ন্ত এগিয়ে এল দ্রুত পায়ে, “ম্যাডাম, সদর হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। ছেলেটা নিয়ে যাওয়ার আগেই কোল্যাপ্স করে গিয়েছে।”
“সেকি!” রুদ্র অবাক হয়ে যায়।
“হ্যাঁ। পিঠের ইনজুরিটা যে খুব ডিপ ছিল। বেচারা!” জয়ন্ত বলল।
রুদ্র কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারে না। কিছুক্ষণ পর রুদ্ধস্বরে বলে, “আর ক্ষমা?”
“ওর কন্ডিশন কিছুটা স্টেবল। ফুসফুসে অনেকটা জল ঢুকেছে। সে’সব পাম্প করে বের করা হচ্ছে।” জয়ন্ত বলল।
“ক্ষমাকে বাঁচাতে গিয়ে ছেলেটা প্রাণ দিল!” রুদ্র অস্ফুটে বলল।
“হ্যাঁ। সেটাই মনে হচ্ছে।” জয়ন্ত বলল, “আচ্ছা, ওদিকের কোনো আপডেট পেলেন?”
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ। প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে কথা হল। দুর্দান্তভাবে পুরো ম্যাটারটাকে বের করে এনেছে ও। নদীয়া পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে প্রায় দুশোজনকে। প্রত্যেকেই বাগডাঙা সরলাশ্রমের তরফ থেকে গিয়েছিল কিচেন ম্যানেজমেন্টের কাজে। মন্দিরের মহাপ্রসাদের স্যাম্পল ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর, পয়জন মিলবেই।”
জয়ন্ত চিন্তিতভাবে বলল, “সবই তো হল। কিন্তু এস পি স্যার কোথায়? মায়াপুর মন্দির চত্বর, এই গোটা শম্ভল ফার্ম হাউজ, সব জায়গাই তো তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কেউই তো কোনো খোঁজ দিতে পারছেনা।”
রুদ্র চুপ করে রইল। জয়ন্তর কথায় কোনো ভুল নেই। বাগডাঙ্গা সরলাশ্রমের সেই ভর্তৃহরি মহারাজকেও কাল রাতে উদ্ধার করা হয়েছে এই ফার্ম হাউজের পূজামণ্ডপ থেকে। বালিগঞ্জ থেকে আটক করা হয়েছে মৃন্ময়ী টেক্সটাইলসের মালিক শেখর চৌধুরীকেও।
ওদিকে মায়াপুর মন্দিরে যাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের ছবি তুলে প্রতিটা থানায় সার্কুলেট করছে প্রিয়াঙ্কা। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বংশধর মধুময় ভট্টাচার্য এর মধ্যেই নির্ভুলভাবে শনাক্ত করেছেন ব্রিজেশ তেওয়ারির দোকানে কিছুদিন কাজ করে যাওয়া কানাইকে।
কমিশনার সুনীত বসু স্যার আরো উইটনেস জোগাড় করছেন। কেসে কোনো ফাঁক রাখতে চান না তিনি।
কিন্তু রাধানাথ রায় যেন উবে গিয়েছেন। স্যারের নিজস্ব নম্বর বা কাল রাতের সেই অচেনা নম্বর, কোনটাকেই ট্র্যাক করা যাচ্ছে না।
জয়ন্ত আরো কি বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র অর্জুনকে দেখতে পেল। জঙ্গলের মাঝের একমাত্র শুঁড়িপথ দিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে আসছে। ভেতরে গোটা কমিউনিটির লোকজনকে ভেতরে একটা বড় মাঠে দাঁড় করানো হয়েছে। চলছে পরপর ইন্টারোগেশন। মহিলার সংখ্যাই প্রায় নিরানব্বই শতাংশ। যাদের মধ্যে গরিষ্ঠভাগই কোনোদিনও বাইরের জগতটাকে দেখার সুযোগ পাননি। যারা এক অসুস্থ অনুশাসনের মধ্যে থাকতে থাকতে ভুলে গিয়েছেন স্বাধীন জীবনের মর্ম। রুদ্র কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও ওখানেই ছিল।
অর্জুন এদিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে একটা লোক। তার পরনে এই কমিউনিটির বাকিদের মতোই ধুতি ফতুয়া।
“ম্যাডাম, এর নাম বাসুদেব। যেবার আমি স্যারের পিছুপিছু এসেছিলাম, একেই দেখেছিলাম স্যারের পিছুপিছু ঘুরতে। তখন অবশ্য জামাপ্যান্ট পরে ছিল, এই ধুতি ফতুয়ার ভেক ধরেনি।” অর্জুন কথাটা বলেই লোকটার দিকে কড়া চোখে তাকাল, “এই বল, স্যার কোথায়?”
বাসুদেব লোকটা মধ্যবয়সি। মুখচোখে ভয়ের ছাপ। বলল, “আমি জানি না। আমি তো রাতের বেলাটা এই বাইরের দিকের ফার্মহাউজে থাকতাম, গুরুদেব আদৌ কাল এখানে ছিলেন কিনা, তাও জানি না!”
অর্জুন আবার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “শেষ কবে গুরুদেবকে দেখেছ তুমি?”
বাসুদেব ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “আজ্ঞে, গতপরশু। যেদিন সবাই এখান থেকে মাহেন্দ্রমহোৎসবে গেল। সেদিনই গুরুদেব এসেছিলেন।”
অর্জুন ভ্রূ কুঁচকে কী জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, রুদ্র বলল, “উনি কোন দিক দিয়ে বেরিয়েছিলেন? নদীপথে না এদিক দিয়ে?”
“তা বলতে পারব না দিদি। আমি এদিকে ছিলাম।” বাসুদেব আড়ষ্ট গলায় বলল।
৫৯
রাধানাথ স্যার রুদ্রকে আবার ফোন করলেন ঠিক দশ মিনিট পর। অর্জুন আর জয়ন্ত দুজনেই তখন চলে গিয়েছে গ্রামের ভেতরের দিকে।
“বলেছিলাম না রুদ্রাণী, কল্কি অবতারকে আটকানো অত সহজ নয়!”
রুদ্র চমকে এদিক ওদিক দেখল। রাধানাথ স্যার কি ওকে দেখতে পাচ্ছেন? এই ফার্ম হাউজের মধ্যেই কোথাও সবার অলক্ষ্যে বসে নজর রাখছেন ওদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর?
কিন্তু তা কী করে হয়? এই ফার্ম হাউজ তো ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে চষে ফেলা হয়েছে এর মধ্যে!
“আটকেছি তো স্যার!” শান্ত গলায় রুদ্র বলল।
“সে তো সাময়িক। আজ পর্যন্ত কল্কিকে কেউ মারতে পারেনি। এমনি জরা, ব্যাধিও কাবু করতে পারেনি। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন নিজে শতায়ু হওয়ার পর অন্তর্জলি যাত্রায় স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। আমার আমার মামা প্রথম গুরু গোপালকৃষ্ণ মহারাজও অনশনে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। আমি যদি বুঝি আমার কাজ ফুরিয়েছে, আমিও তাই করব।”
“আবারও ভুল করছেন স্যার! জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মত ছিল সম্পূর্ণ আপনার বিপরীত। তিনি ছিলেন অনেক উদার। আর আপনাদের এই চক্রান্ত তো আমাদের ফোর্স পুরোপুরি ফাঁস করে দিয়েছে।”
“সে তো প্রথমে শ্রীরামচন্দ্রের স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল জিতেছিল রাবণ। কিন্তু সেই কি অন্তিম পরিণতি? তোমার মতো এমন তুচ্ছ বাধা আসবে যাবে, মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দেবে। তাই বলে কলিযুগের অবসানকে তো রোধ করা যায় না। পরম গুরু পারেননি, প্রথম গুরু পারেননি, আমি যদি নাও পারি, আমার পরিবর্তে আরেকজন কল্কি তৈরি হবে। সে না পারলে আর একজন। আটকাতে পারবে না। আমাদের বৈদিক সমাজের এই সংকল্প একদিন না একদিন, কোনো না কোনো মহোৎসবের দিনে সফল হবেই।”
রুদ্র চুপ করে গেল। যে জেগে ঘুমোয়, তাকে নতুন করে জাগানো যায় না। রাধানাথ স্যারের যুক্তিবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছেন।
ও ইশারায় অর্জুনকে দ্রুত নম্বরটা লিখতে বলল। কিন্তু তার আগেই রাধানাথ স্যার বললেন, “কাল রাতেই তো বললাম, এই নম্বর ট্র্যাক করে কোনো সুবিধা করতে পারবে না। ক্রিপ্টেড সার্ভার দিয়ে স্পুফ করা এই কল। অত কাঁচা কাজ রাধানাথ রায় করে না। এবার বানচাল করেছ তো কী হয়েছে, ফিরে আমি আসবই। অশুভশক্তির পরাজয় ঘটবেই।”
“অশুভ শক্তি কে স্যার?” রুদ্র বলল, “আপনি কি আদৌ ভেবে দেখেছেন? নাকি মামার মগজ ধোলাইতে পরিণত হয়েছেন আজ্ঞাবহ রোবটে? আপনার লজিক অনুযায়ীও যদি ভাবি, সত্য যুগে লড়াই ছিল দেবতা ও অসুরদের মধ্যে। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। একটা দেবলোক, অন্যটা পাতাললোক। পাতাললোক ছিল অশুভশক্তি।”
“তো? অশুভশক্তি অসুরেরা তো পরাজিত হয়েছিল দেবতাদের কাছে!”
“ত্রেতা যুগে এলেন শ্রীরামচন্দ্র। লড়াই তখন দুই ভূখণ্ডের মধ্যে। ভারত ও লঙ্কা অর্থাৎ সিংহল। সেখানে আপনার কথা অনুযায়ী অশুভশক্তি লঙ্কারাজ রাবণ।”
“এখানেও তাই রাবণ হেরে গিয়েছিল।”
“দাঁড়ান স্যার, বলতে দিন। তারপর দ্বাপর যুগ। মহাভারতে আমরা দেখলাম একই পরিবারের দুই জ্ঞাতির মধ্যে যুদ্ধ। কৌরব বনাম পাণ্ডব। অশুভ শক্তি কৌরব। আর এখন কলি যুগ। শুভ-অশুভ গন্ডি আরো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। এখানে তো মানুষের মধ্যেই শুভ অশুভ লুকিয়ে আছে স্যার। আমরা প্রত্যেকে দ্বৈত সত্তার অধিকারী। শুভ সত্তাটা বলে মানুষকে ভালোবাসতে, দয়া, মায়ামমত্বে সম্পৃক্ত হতে। অন্যদিকে অশুভ সত্ত্বা মাঝেমাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন হিংসা, রাগ, পরশ্রীকাতরতা আমাদের অন্ধ করে দেয়!”
রুদ্র একটা লম্বা দম নিল। বলল, “আপনি যদি সত্যিই বিষ্ণুর দশম অবতার হতেন স্যার, আপনি বুঝতে পারতেন, কলি যুগে কেউ কারুর শত্রু নয়। প্রত্যেকের শত্রু তার ভেতরের এই অশুভ দিক। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এই প্রতিটা যুগে অশুভ শক্তি অনেক বেশি ক্ষমতাধর হয়েও হার মেনেছে শুভ শক্তির কাছে। কলিযুগে কেন তা হবে না স্যার? কেন আমাদের ভেতরের হিংসা, সংকীর্ণতা হেরে যাবে না ভালোবাসার কাছে? বিশ্বাস করুন স্যার, এর সঙ্গে সমাজের রক্ষণশীলতা, মেয়েদের পরাধীন থাকা, বা ঈশ্বরসাধনার কোনো সম্পর্ক নেই!”
ফোনটা হঠাৎ কেটে গেল সশব্দে। রুদ্রর গলাটা ধরে এসেছিল। কয়েকজন মানুষের ভুল মানসিকতার জন্য শিবনাথ বিশ্বাসের মেয়েটা কোনোদিনও ওর বাবার সঙ্গ পেল না। কিছুজনের ধর্মীয় সংকীর্ণতার জন্য মহম্মদ তারেকের বউ আমিনা বিয়ের পরই তার স্বামীকে হারাল। কয়েকজনের অন্ধ বিশ্বাসের জন্য ক্ষমার মতো মেয়েরা জীবনের মানেটাই বুঝতে পারল না। মল্লিকাদি’র মতো কয়েকজন মানুষ ঝরে গেল নীরবে।
পুলিশে জয়েন করেও নিজের আবেগ পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে এখনো ততটা পেশাদার হয়ে উঠতে পারেনি রুদ্র। এইঘটনাগুলো ওকে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়। ভেতরে ভেতরে ভেঙে দেয়।
”ম্যাডাম! স্যার এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে।”
জয়ন্তর ডাকে চমকে পেছন ফিরল রুদ্র।
জয়ন্তর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রিয়ম। মুখচোখ উদ্বিগ্ন।
“তুমি! তুমি কী করে এলে এখানে?” রুদ্র চোখের জল মুছে এগিয়ে গেল প্রিয়মের দিকে।
প্রিয়ম বলল, “কাল রাতের পর তো তোমার আর কোনো খবর পাচ্ছিলাম না, ফোনেও পাচ্ছি না। টেনশনে সারারাত ঘুমোতে পারলাম না। তারপর ভোরের দিকে জয়ন্তকে ফোনে পেলাম। তারপর ওর থেকে ডিরেকশন নিয়ে নিয়ে বাইকে চলে এলাম। তুমি ঠিক আছ তো?”
“হ্যাঁ।” রুদ্র বলল, প্রিয়ম তুমি জানো, ক্ষমা …!”
“শুনেছি।” প্রিয়ম মাথা নাড়ল, “তোমাদের আরেকটু দেরি হলে …!”