২০
রুদ্র ম্লানমুখে ঘরে ঢুকতেই প্রিয়ম বলল, “এসে গেছ? দাঁড়াও, শুভাশিসদাকে ফোন করি।”
“কে শুভাশিসদা?” ক্লান্ত শরীরে রুদ্র বসে পড়ল সোফায়।
“আরে, সেই যে, জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বংশধর। আমার ছোটবেলার বন্ধু। তোমায় বলেছিলাম না? এখন আমেরিকায় থাকে। তুমি যে ওর কাছ থেকে কিছু জানতে চাও, সেটা ওকে বলেছি।” প্রিয়ম মোবাইলে নম্বর টিপছিল, “ওকে ডেটা কল করছি দাঁড়াও।”
“আর করে কোনো লাভ নেই।” রুদ্র হাত তুলল, “ডি এম আর এস পি জয়েন্ট মিটিং এ আজ আমাদের মিশনটা ক্যানসেল করে দিলেন।”
“ক্যানসেল করে দিলেন?” প্রিয়ম হাঁ, “কেন?”
রুদ্র বলল, “এস পি স্যার তো প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন, এখন ডি এম ও বলছেন, তেমন কোনো প্রোগ্রেস যখন নেই, তখন সম্ভবত সব কটা কেসই ডিসটিংক্ট। কোনো লিঙ্ক নেই। তো লোক্যাল থানা যেমন তদন্ত চালাচ্ছে চালাক। আমাদের আর রেখে কী হবে। বরং সামনে পুরসভা ভোট, সেইদিকে নজর দিতে বললেন।”
“যাব্বাবা!” প্রিয়ম বলল, “তবে যে তুমি রাত জেগে এত পড়াশুনো করলে, বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা মুখস্থ করে ফেললে?”
“ওই তিথিনক্ষত্রের মিলটা হয়তো নেহাতই কাকতালীয়।”
“আর প্রত্যেকটা দোকানে ভাঙচুর?”
“সেটাও হয়তো ক্ষতি করার জন্য। সব দোকানে তো হয়নি।” রুদ্র বলল, “আর কিছু অপশন তো দেখছি না। সিরিয়াল কিলিং এর সম্ভাবনাটা আস্তে আস্তে ফেডেড আউট হয়ে যাচ্ছে। হায়ার অথরিটি যখন আর ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে না, আমি আর কী করতে পারি! যাকগে বাদ দাও, ক্ষমা’র কী খবর?”
“এখন একটু বেটার। কোনো কারণে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মা মেয়ে দুটোই ভিতুর ডিম। সবেতেই ভয়।” প্রিয়ম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ওর ফোনে একটা কল ঢুকতে লাগল।
“শুভাশিসদা ভিডিও কল করছে।” প্রিয়ম বলল, “আচ্ছা, তবু একবার ওর সাথে কথাটুকু বলে নাও। আমি বলে রেখেছি, বেচারা খারাপ ভাববে।”
রুদ্র হাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করল, “হ্যালো, নমস্কার শুভাশিসবাবু।”
স্ক্রিনে একজন ফর্সা গোলগাল টাকমাথা চেহারার ভদ্রলোক দেখা গেল। পরনে লাল টি শার্ট, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট। মুখখানা হাসি হাসি।
“হ্যাঁ নমস্কার। আসলে প্রিয়ম বলল, আমাদের বাড়িতে একটা মার্ডার হয়েছে, আর আপনি তার তদন্ত করছেন?”
রুদ্র বক্রচোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল। ভ্রূ কুঁচকে স্ক্রিন থেকে সরে ফিসফিস করে চোখ পাকিয়ে বলল, “আমি লোকের বাড়ি বাড়ি মামুলি খুনের তদন্ত করি?”
প্রিয়ম হাত উলটে কিছু বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র ওকে থামিয়ে দিয়ে স্ক্রিনের সামনে এসে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “হ্যাঁ, মানে ওইরকমই। সোমনাথ ভট্টাচার্য বলে একজন শরিকের ভাড়াটে যিনি বাড়ির একদিকে দোকান চালাতেন, তিনি খুন হয়েছেন।”
“হ্যাঁ, আমি খবর পেয়েছি।”
“আচ্ছা, আপনি কোন শরিকের বংশধর?”
“আমি কোনো শরিক বললে ঠিক বুঝতে পারবেন না। আসলে আমাদের বাড়ির হায়ারার্কিটা এত জট পাকানো। সময় থাকলে বলতে পারি।” শুভাশিসবাবু আবার হাসলেন।
“হ্যাঁ বলুন না।” রুদ্র অন্যমনস্কভাবে বলল।
“আপনি নিশ্চয়ই জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কথা শুনেছেন। উনি আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা। উনি প্রায় একশো বারো বছর বেঁচেছিলেন, জানেন নিশ্চয়ই। নিজের নাতির নাতিকেও দেখে গিয়েছেন। তো, বংশের ডালপালা এত বিস্তার করেছে যে ওই বিশাল জগদ্দলের মতো বাড়ির বাসিন্দা হয়েও আমরা সবাই সবাইকে চিনি না।”
“মানে আপনি সোমনাথবাবুকে চেনেন না?”
“না। সম্ভবত উনি নকলদাদুর বংশধর। নকলদাদুর বাড়ির কাউকেই আমি চিনিনা। কারণ আমি যখন আমেরিকায় চলে আসি, তা ধরুন, প্রায় দশবছর হল, নানা ঝামেলায় আমাদের সঙ্গে ওদের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”
“মাফ করবেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” রুদ্র বলল, “নকলদাদু মানে?”
শুভাশিসবাবু বললেন, “আপনার না বোঝারই কথা। আমাদেরই মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়। আসলে আমার ঠাকুরদার বাবা শ্রী রমণীমোহন ভট্টাচার্যর ছিল একটিমাত্র পুত্র। কিন্তু কোনো কারণে সেই পুত্রর সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। তখনকার দিনের ব্যাপার, তিনি ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। এদিকে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বংশ বলে কথা, বংশরক্ষা তো করতেই হবে। তখন তিনি দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের পুত্রকে দত্তক নেন। সেই দত্তক পুত্র বাড়ির ছেলে হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর আগে রমণীমোহন নিজের ছেলেকে ক্ষমা করেন ও বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। উইলও পরিবর্তন করেন। এইভাবে আমাদের বংশের দুটো ধারা হয়ে যায়। রমণীমোহন ভট্টাচার্যের আসল পুত্রকে আমরা বলতাম আসল দাদু। আর দত্তক পুত্রকে নকল দাদু। এইভাবেই চলতে থাকে। আমি হলাম আসল দাদুর বংশধর। নকল দাদুর সঙ্গে আসলে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।”
“বুঝলাম। আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মধুময় ভট্টাচার্য, উনিও কি নকলদাদুরই বংশধর?”
“ঠিক বলেছেন। মধুময়কাকাকে মনে আছে। উনিও ওই তরফের। নকলদাদু নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর ওদের ছেলেমেয়েরা এখন ওই দিকটাতেই থাকে। আমরা থাকি পেছনদিকটায়। তাও থাকি বলতে, ঘরগুলো পড়ে আছে তালাবন্ধ হয়ে। বেশিরভাগই বাইরে। তবু আমরাই উদ্যোগ নিয়ে দুর্গাপুজোটা করি।”
“নকল দাদু নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন? কেন?”
“সে অনেক ব্যাপার! বহু বছর আমেরিকায় ছিলেন, তারপর দেশে ফিরে… আসলে রক্তের সম্পর্ক নেই তো, ওরা বরাবরই একটু অন্যরকম। রমণীমোহনের সাময়িক হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য এত জটিলতা।” শুভাশিসবাবুর ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল, “বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।”
“ও আচ্ছা!” রুদ্র অন্যমনস্কভাবে বলল, “ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আমার একটা ফোন ঢুকছে, আপনি একটু প্রিয়মের সঙ্গে কথা বলুন।”
ফোনটা প্রিয়মের হাতে দিয়ে রুদ্র বাইরের বাগানে নেমে এল। লোকেশবাবু ফোন করছেন।
“হ্যাঁ বলুন।”
“ম্যাডাম, একটা ব্যাপার বলার ছিল।”
“কী?”
“ওই যে চন্দননগরের মহম্মদ তারেক, ওর দেশের বাড়ি সুগন্ধার দিকের এক গ্রামে। মানে ওর বউ তাই বলেছিল জেরায়। সুগন্ধা জানেন তো? চুঁচুড়া মহকুমাতেই, পোলবা দাদপুর ব্লক।”
“জানি। তো?”
“আপনি সেদিন আমাকে হৃষীকেশ জয়সোয়াল আর মহম্মদ তারেকের কেসদুটো নতুন করে ইনভেস্টিগেট করতে বললেন, তাই আমি খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। তো, সুগন্ধায় গিয়ে সবকটা গ্রামে ঘুরলাম, কিন্তু কেউ মহম্মদ তারেকের বাড়ির কোনো খোঁজ দিতে পারল না। আমি ফেরত এসে ওর বউকে জিজ্ঞেস করলাম। তো আমিনা বিবি বলল, ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ’মাস। ও নিজেও কোনোদিন তারেকের দেশের বাড়িতে যায়নি। দুজনে চুঁচুড়া স্টেশন চত্বরের বস্তিতে থাকত, সেখান থেকেই পরিচয়। তারেক সেখানে একাই থাকত, পরিবার পরিজন বলতে কেউ ছিলনা।”
“তারপর?” রুদ্র মন দিয়ে শুনছিল। দূরে দেখতে পাচ্ছিল ক্ষমাকে।
আজ ক্ষমার ভয়টা একটু কেটেছে। সে আবার বাগানের একদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
“তারপর আমি তারেকের ছবি নিয়ে সুগন্ধায় গেলাম। সেখানকার ব্লক অফিসের সাহায্য নিয়ে সব গ্রামগুলোয় ঘুরলাম। তো একটা গ্রামের নাম বদনপুর। খুব রিমোট গ্রাম। বাঁশবেড়িয়ার গঙ্গা থেকে একটা খাল বয়ে গিয়েছে পশ্চিমমুখে, সেই খালের ধারে। তো বদনপুর গ্রামের একটা লোক তারেকের ছবি দেখতে চিনতে পারল। কিন্তু বলল, ওর নাম তারেক নয়।”
“তারেক নয়? তবে কী?”
“তা মনে করতে পারল না ম্যাডাম। তবে বলল, তারেক মুসলিম নয়। হিন্দু। কয়েকবছর আগে কোথা থেকে যেন হঠাৎ এসেছিল, আবার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। যে ক’দিন ছিল, গ্রামের মন্দিরের বাইরে শুয়ে থাকত, মুড়ি-চিঁড়ে এইসব খেত। আর চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোত। লোকটা আমাকে ওই মন্দিরের পূজারির কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু সেও কিছু বলতে পারলনা।”
“হুম। রিয়েলি কমেন্ডেবল জব, লোকেশবাবু! কিন্তু আনফরচুনেটলি আমাদের মিশনটা অ্যাবর্ট করা হয়েছে। আপনি হয়তো আজকের মধ্যেই অফিশিয়াল লেটার পেয়ে যাবেন রুটিন ডিউটিতে ফিরে যাওয়ার জন্য। তাই এ’সব জেনে আর কোনো লাভ নেই।” রুদ্র ম্লানস্বরে কথাগুলো বলল। তারপর ফোনটা রেখে এগিয়ে গেল ক্ষমার দিকে।
মেয়েটাকে কাল থেকে সময় দেওয়া হয়নি।
২১
“ক্ষমা?” রুদ্র এগিয়ে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল।
“উঁ?” মেয়েটা যেন ভূত দেখেছে, এইভাবে চমকে উঠল আকস্মিক ডাকে, ভয়ার্তচোখে একবার তাকাল ওর দিকে, তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে বসে পড়ে মাটির মধ্যে কী করতে লাগল।
ভেজা মাটি। আজ ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। মালি সনাতন কয়েকদিন হল আসেনি। ক্ষমা একটা খুরপি নিয়ে একটা জায়গায় বেশ কিছুটা মাটি খুঁড়েছে, এখন সেই মাটির মধ্যে থেকে কাঁকড় বাছছে। এর মধ্যেই সে এত কাঁকড় বেছেছে, যে ছোটখাটো একটা কাঁকড়ের পাহাড় হয়ে গেছে।
“কী করছিস তুই?”
ক্ষমা বলল, “গাছ লাগাব।”
“কী গাছ?”
ক্ষমা বলল, “তুলসী গাছ। তোমার এত বড় বাড়ি, অথচ তুলসীমঞ্চ নেই কোথাও। ঠাকুর পাপ দেবেন না?”
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “ক্ষমা, তুই কাকে দেখে অত ভয় পেলি সেদিন?”
ক্ষমার মুখটা আবার বিবর্ণ হয়ে গেল। ফ্যাকাসে চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে, তারপর বলল, “উঁকি মারছিল। আমার … আমার ভাশুরপো।”
“ভাশুরপো মানে?” রুদ্র বলল, “কীসব উলটোপালটা বকছিস তুই?”
“ঠিকই বলছি। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে গো। আমি না গেলেও জোর করে নিয়ে যাবে। তারপর … তারপর জোর করে …!”
“তারপর? তারপর কী?” রুদ্র ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করে।
ক্ষমার চোখদুটো যেন ভয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, গলাটা কেমন ফ্যাসফেসে শোনায়। ঢোঁক গিলে বলে, “তারপর পরম গুরুর চরণামৃত খাইয়ে…।”
“অ্যাই ক্ষমা, কী সব বকছিস তুই?”
রুদ্র চমকে তাকায়। দেখে, মল্লিকাদি কখন এসে দাঁড়িয়েছে পায়ে পায়ে। মল্লিকাদি যেন ওকে দেখতেই পায়না, দ্রুতপায়ে এসে ক্ষমাকে টেনে হিঁচড়ে কোলে তুলে নেয়। তারপর রুদ্রর কিছু বলার অপেক্ষা না করেই সোজা চলে যায় বাড়ির ভেতরে।
রুদ্র কিছু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। পাঁচু এর মধ্যে বাগান ও বাইরের সব আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই আলো- আঁধারির মধ্যে সবকিছু ওর কেমন রহস্যময় ঠেকতে লাগল।
ওর হঠাৎ মনে হল, এই যে মল্লিকাদি আর ওর মেয়ে ক্ষমা গত কয়েকমাস ধরে ওর বাংলোয় রয়েছে, ওদের পরিচয় সম্পর্কে ও কী জানে? এইভাবে অজ্ঞাতপরিচয় কাউকে দিনের পর দিন নিজের সরকারি বাসস্থানে থাকতে দিয়ে ও কি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে?
আচ্ছা, মল্লিকাদি কি সত্যিই ক্ষমার মা? নাকি ক্ষমার মতো একটা বাচ্চামেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে চলে এসেছে? শিশুপাচার জাতীয় কোনো ব্যাপার নেই তো? কিন্তু, মল্লিকাদি যদি কোনো অপরাধই করে থাকে, তবে সে মেয়েকে নিয়ে খোদ পুলিশ বাংলোর সামনে বসে থাকবে কেন?
রুদ্র কী করবে বুঝতে পারেনা, বাগানেরই একটা বেঞ্চে বসে পড়ে ভাবতে থাকে আকাশপাতাল।
প্রিয়ম রাতে সব শুনে বলল, “ধুস, ওসব কিছু নয়। তবে, এটা ঠিক, ওদের কিছু একটা গন্ডগোলের ব্যাপার আছে। আমিও কয়েকটা ব্যাপার নোটিস করেছি, তোমায় এতদিন বলিনি।”
“কী?”
“একদিন আমি একটা এমনি কারণ দেখিয়ে মল্লিকাদি’র কাছ থেকে আইডি চেয়েছিলাম। ভোটার আধার, যা হোক কিছু। ও কিছুই দিতে পারেনি। যেটা খুবই অস্বাভাবিক। রুদ্র, তোমার ওদের শেল্টার দেওয়াটাই ভুল হয়েছে।”
“তাহলে এখন কী করবো?” রুদ্র খেতে খেতে বলল, “ওদের কোনো কারণ ছাড়া তাড়িয়ে দেওয়া যায় নাকি? মেয়েটা পড়াশুনো শিখছে, মল্লিকাদি’ও যাহোক একটা আশ্রয় পেয়েছে, কিছুতেই এখন চলে যেতে বলা যায় না।”
“সে নাহয় বললে না। কিন্তু ওদের আসল পরিচয় জানার রাইট নিশ্চয়ই তোমার রয়েছে।” প্রিয়ম বলল, “সরকারি বাংলোয় রয়েছ, নিজেও একটা দায়িত্বপূর্ণ পোস্ট হোল্ড করছ, কিছু গন্ডগোল হলে তুমিই কিন্তু ফাঁসবে, এটা মনে রেখো!”
২২
প্রিয়মের সাবধানবাণী অদ্ভুতভাবে ফলে গেল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রুদ্রদের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম কাজ করা বন্ধ করলেও হুগলী জেলায় হত্যালীলা বন্ধ হল না।
৬ জুলাই থেকে ২০শে জুলাইয়ের মধ্যে দুটো চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল।
এক, হুগলী জেলার অন্যতম বড় বেসরকারি নার্সিংহোম ‘বাসুদেব ভবন’ এর একচ্ছত্র মালিক ড. সুবল ভট্টাচার্য খুন হলেন। ৮ই জুলাই গভীর রাতে। বাঁশবেড়িয়ায়।
দুই, মল্লিকাদি বাংলো চত্বরেই ভয়ংকর ভাবে খুন হল।
ঘটনার সূত্রপাত বেলা বারোটা নাগাদ। সেদিন রুদ্র বা প্রিয়ম কেউই ছিল না। মল্লিকাদি ক্ষমার হাত ধরে গঙ্গার পাশের রাস্তা ধরে গিয়েছিল কাছের একটা দোকানে টুকিটাকি জিনিস কিনতে। পুলিশ বাংলোর দিকটা এমনিতেই বেশ নির্জন থাকে, তার ওপর গ্রীষ্মের দুপুর।
জ্যোৎস্নাদি রান্নাঘরে ব্যস্ত, এমন সময় মল্লিকাদি ছুটতে ছুটতে এল। তার ঘোমটা খসে পড়েছে। চোখ উদ্ভ্রান্ত, মুখে আতঙ্ক উপচে পড়ছে। হাউমাউ করে বলল, “আমার ক্ষমাকে … আমার ক্ষমাকে ওরা ধরে নিয়ে গেল গো!”
“কারা ধরে নিয়ে গেল? কোথায় ধরে নিয়ে গেল?” বলতে বলতে জ্যোৎস্নাদি যখন বেরিয়ে এল, যখন বাংলোর সামনে প্রহরারত দুই গার্ডকে নিয়ে ছুটল নদীর দিকে, ততক্ষণে সব শুনশান। ক্ষমার কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। শুধু রাস্তার এককোণে পড়ে রয়েছে ক্ষমার বেগুনি রঙের ফ্রকের একটা অংশ। ধস্তাধস্তিতে ছিঁড়ে গেছে সেটা।
এ এস পি বাংলো থেকে মাত্র একশো মিটার দূরত্বে এমন কাণ্ডে সবাই হতভম্ব। মল্লিকাদি কাঁপছে থরথর করে। গ্রামের সহজ সরল অশিক্ষিত মহিলা সে। জ্যোৎস্নাদি’কে খবর দেওয়ার আগে যে বাংলোর বাইরের গার্ডদুটোকে ডাকা উচিত ছিল কিংবা উচিত ছিল তারস্বরে চিৎকার করার, সে’সব মাথায় আসেনি তার।
কিন্তু আসল ঘটনার তখনও বাকি ছিল।
রুদ্র সেদিন এস পি রাধানাথ স্যারের অফিসে একটা মিটিং এ ছিল। আসন্ন পুরসভা ভোটের ব্যাপারে কোর্স অফ অ্যাকশন সংক্রান্ত একটা আর্জেন্ট মিটিং ডেকেছিলেন স্যার। খবর পেয়ে যখন প্রায় আধঘণ্টা পরে এল, তখন জ্যোৎস্নাদি হাউমাউ করে কান্না জুড়েছে। মল্লিকাদি পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে বাগানের মাঝখানের লবিতে। যেখানে ক্ষমা খেলে বেড়াত।
রুদ্র প্রথমেই সঙ্গে আসা পুলিশদের পড়ে থাকা ফ্রকটা কালেক্ট করতে বলল। তারপর জয়ন্তকে ওদিকটা দেখতে বলে শক্ত হাতে মল্লিকাদি’কে নিয়ে গিয়ে ঢুকল ওদের ঘরে।
মল্লিকাদি নিজের ঘরে ঢোকামাত্র থেবড়ে বসে পড়ল। তার চুল আলুথালু। আঁচলের প্রান্ত এলিয়ে পড়ে রয়েছে মাটিতে। চোখ দিয়ে ঝরছে জল। বিড়বিড় করে কী যেন বকে চলেছিল নিজের মনে।
রুদ্র দরজা বন্ধ করে তীক্ষ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “দ্যাখো মল্লিকাদি, তুমি যদি সত্যি কথা বলো, আমি কিছু বলব না। তোমরা কারা? ক্ষমাকে কারা ধরে নিয়ে গেল? কেন ধরে নিয়ে গেল? কী করেছ তোমরা?”
মল্লিকাদি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, সে এবার মুখে আঁচলচাপা দিয়ে কাঁদতে লাগল। পাশেই জানলা, উঠে দাঁড়িয়ে জানলার রেলিং ধরে সে ফোঁপাতে থাকল। কান্না চাপার প্রাণপণ চেষ্টায় তার ছোটখাটো শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছিল।
“মল্লিকাদি!” কিছুটা অস্থির হয়ে বলল রুদ্র, “তুমি বললে ভালো, নাহলে আমি বাধ্য হব তোমাকে বাংলো থেকে বের করে দিতে। শুধু তাই নয়, তোমার বিরুদ্ধে আমি অ্যাকশনও নেব।”
“না দিদি! আপনার পায়ে পড়ি।” মল্লিকাদি এবার কেঁদে ফেলল, “আপনি আমায় বন্দি করে রেখে দিন তাও ভালো, কিন্তু বাংলোর বাইরে ছাড়বেন না। বাংলোর বাইরে গেলে ও-ওরা আমাকে মেরে ফেলবে!”
“ওরা মানে কারা? কারা তোমায় মেরে ফেলবে?” রুদ্র চোখ সরু করল।
“বলছি। কিন্তু আপনি আমায় ঠিক বাঁচাবেন তো দিদি?” মল্লিকাদির মুখেচোখে আতঙ্ক, “ওরা কিন্তু ভয়ঙ্কর!”
“আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হবেনা মল্লিকাদি!” রুদ্র বলল, তুমি বলো, এই ওরা কারা?”
মল্লিকাদি কোনোমতে নিজেকে সামলে কী যেন একটা বিড়বিড় করতে শুরু করল, কিন্তু বলতে পারল না। হঠাৎ কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল সামনের দিকে।
রুদ্র ছুটে এগিয়ে গিয়ে দেখল, ওর ঘাড়ের পেছনে ফুটে রয়েছে অনেকটা লম্বা একটা তির।
মল্লিকাদির মুখ যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে যাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে। তবু তার মধ্যেই ও যেন আপ্রাণ চেষ্টায় কী বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারল না। কয়েকবারের চেষ্টার পর চোখের পাতাগুলো নিঃস্পন্দ হয়ে থেমে গেল। দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল একদিকে।
রুদ্র দ্রুত গতিতে বাইরে বেরিয়ে এল। জয়ন্ত দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের নিয়ে ও ছুটতে লাগল বাংলোর পেছন দিকের বাঁশবাগানে। মল্লিকাদির ঘরের জানলার বাইরে রয়েছে সেই জঙ্গল।
বাংলো থেকে বেরিয়ে পেছনদিকে ঘুরে পৌঁছতে হয় সেই বাঁশবাগানে। রুদ্ররা যখন সেখানে পৌঁছল, তখন বিশাল বাঁশবাগান পুরো শুনশান।
রুদ্র জয়ন্ত’র দিকে তাকাল, “ক্ষমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্তত আধঘণ্টা আগে। তার মানে এতক্ষণ কেউ বা কারা এই বাগানে লুকিয়ে ছিল। তারাই মল্লিকাদির গায়ে তির ছুঁড়েছে।”
“কিন্তু এদিকটায় ঢুকল কীভাবে!” জয়ন্ত বলল।
“পার্থ আর তিমির, তোমরা ভালো করে সার্চ করো। এখনো হয়তো এখানেই লুকিয়ে রয়েছে।” রুদ্র চাপাস্বরে দুজন কনস্টেবলকে নির্দেশ দিল।
প্রচণ্ড ঘন বাঁশবাগান। মাঝেমাঝে মাথা চাড়া দিয়েছে অন্যান্য গাছ। যত্নের অভাবে এতটাই দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছে যে দিনের আলোটুকুও ভালো করে ঢুকছেনা।
রুদ্র পুলিশ ইউনিফর্মেই ছিল। পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে ও সন্তর্পণে এগোচ্ছিল একেকটা গাছের পাশ দিয়ে। ওপর দিকে দেখছিল মাঝে মাঝে। যদিও গাছের ওপর লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা কম। মল্লিকাদির ঘাড়ে যে তিরটা এসে ফুটেছে, সেটা নীচ থেকে ওপরদিকে গেঁথে রয়েছে। কেউ নীচু জায়গা থেকে ধনুকের জ্যা টেনেছে বলেই মনে হচ্ছে।
প্রায় আধঘণ্টা খোঁজার পর রুদ্র হাল ছেড়ে দিল। পার্থ আর তিমিরও ফিরে এসেছে হতাশ মুখে।
ক্লান্ত দেহে ওরা যখন বাংলোয় ফিরে এল, তখন জ্যোৎস্নাদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইতিমধ্যেই এ এস পি বাংলো ক্যাম্পাসে হাজির হয়েছে আরও বেশ কিছু পুলিশ। রাধানাথ স্যার সব শুনে নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তাদের।
মল্লিকাদির নিষ্প্রাণ দেহটা পড়ে রয়েছে মাটিতে। ঘাড়ের নীচ দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত।
কেউ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে পুলিশ বাংলোর মধ্যে কেউ খুন হতে পারে!
রুদ্র চোখ সরু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে বসে দেখতে লাগল গেঁথে থাকা তিরটা। খুব সরু করে ছুঁলে তৈরি করা বাঁশের তির, কিন্তু ফলাটা ধাতব। নিশ্চয়ই ফলায় বিষ জাতীয় কিছু মাখানো রয়েছে, নাহলে মল্লিকাদির এত দ্রুত মৃত্যু হত না। ফরেনসিক টেস্টেই বোঝা যাবে।
ওর কানে বাজছিল মল্লিকাদি’র বলা শেষ কথাগুলো!
আপনি আমায় ঠিক বাঁচাবেন তো দিদি?
২৩
এস পি রাধানাথ রায় থমথমে মুখে বললেন, “সেই জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। সাতখানা বিজনেসম্যান মার্ডার। ‘বাসুদেব ভবন’ এর মতো বড় নার্সিং হোমের মালিক বলে কথা! এবার আমাদের প্রত্যেকের বদলি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আর রুদ্রাণী, তোমাকে আর কী বলব! শ্রীরামপুর পুলিশের এতবছরের ইতিহাসে যা কখনো হয়নি, তুমি তা করে দেখালে। প্রতিটা নিউজপেপারের ফ্রন্ট স্টোরি, শ্রীরামপুর এ এস পি বাংলোয় খুন। পুলিশ বাংলোয় সবার নাকের ডগা দিয়ে একটা জলজ্যান্ত মার্ডার। হোপলেস! আমার আর কিছু বলার নেই।”
বিশাল ঘরের গোল কনফারেন্স টেবিলের একেকটা আসনে বসে রয়েছে সবাই। প্রত্যেকের সামনে বাধ্যতামূলক জলের বোতল। গোটা ঘরটায় এমন এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, যে ঘরের একপাশে দাঁড় করানো বিশাল গ্র্যান্ডফাদার’স ক্লকটার পেন্ডুলামের শব্দটা বড় কর্কশভাবে কানে লাগছে।
রুদ্রর মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সবার সামনে এত বড় অপমানে ওর কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কিন্তু এস পি স্যারের কথাগুলো অপ্রিয় হলেও মিথ্যে তো নয়!
আজ আবার চুঁচুড়ায় ডি এম অফিসে হাই এন্ড মিটিং ডাকা হয়েছে। জেলাশাসক ছাড়াও এসেছেন চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার মি. সুনীত বসু এবং প্রতিটি মহকুমার পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট। যেহেতু রুদ্র ওই ইনভেস্টিগেশন টিমের হেড ছিল, সবার চেয়ে জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাকেও রাখা হয়েছে মিটিং এ।
“দাঁড়ান মিঃ রায়।” পুলিশ কমিশনার সুনীত বসু অভিজ্ঞ আই পি এস, তিনি বোধ হয় একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করাতে চাইলেন এই তরুণী অফিসারটিকে। বললেন, “মিসেস সিংহরায়, আপনাদের টিমটার প্রোগ্রেস কতদূর হয়েছিল?”
রুদ্র গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আমরা তো প্রতিটা কেসই আলাদাভাবে ইনভেস্টিগেট করা শুরু করেছিলাম স্যার। বেশ কিছু ক্ল্যুও পেয়েছিলাম যাতে করে লিঙ্ক করা যায়। কিন্তু তারপরই ডি এম ম্যাডাম কাজটা পোস্টপোন করতে বললেন …।”
“হুম।” সুনীত বসু শ্রীরামপুরের এস পি’র দিকে তাকালেন, “আমার মনে হয়, একটা স্পেশাল টিম যখন কাজ শুরু করেইছিল, ওরাই আবার রেজিউম করুক, সেটাই বেটার হবে।”
এস পি রাধানাথ রায় তখনও বিরক্ত। বললেন, “কিন্তু স্যার, রুদ্রাণী নিজের বাংলোয় এতদিন দুজন অচেনা মানুষকে রেখে দিল, তাদের কোন আইডি পর্যন্ত না দেখে। তাদের মধ্যে একজন কিডন্যাপড, অন্যজন মার্ডারড। দুজনেরই কোনো পরিচয় জানা নেই। এতটা নেগলিজেন্স কি কোনো পুলিশ অফিসারের সাজে? তাও আবার আই পি এস ক্যাডার?”
রুদ্র পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল। হায়ারার্কি অনুযায়ী ওর ইমিডিয়েট বস এস পি রাধানাথ রায়। তার ওপরে কমিশনার সাহেব। অন্য কোনো এস পি হলে ওকে বোধ হয় এতক্ষণে সাসপেন্ড করে দিতেন। ওদের এই পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কথায় কথায় সাসপেনশন অর্ডার বেরোয়। রাধানাথ স্যার মানুষটা সত্যিই ভালো, মুখে হম্বিতম্বি করেন, কিন্তু অধস্তনদের ক্ষতি করেন না। সেদিন বাংলোয় ওই ঝামেলার সময় উনিই ফোর্স পাঠিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য।
কিন্তু তবু ওর চোখ ফেটে জল আসছিল।
কমিশনার বললেন, “ইটস ওকে। শি ইজ স্টিল অন হার প্রোবেশন। আমার মনে হয়, পুরোনো টিমটাকেই অপারেশনাল করা হোক, কী বলেন ম্যাডাম?”
জেলাশাসক গুরশরণ কৌর আগেরবার রুদ্রর ওপর অনেক বেশি ভরসা রেখেছিলেন। কিন্তু এবার বোধহয় তাঁরও বিশ্বাস টলে গিয়েছে। তিনি বললেন, “আপনাদের ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার, কাকে দায়িত্ব দেবেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমার রেজাল্ট চাই। ব্যাপারটা এবার মিনিস্টার লেভেলে পৌঁছে গিয়েছে। ওই ডাক্তারবাবুর স্টেট লেভেলে ভালো জানাশোনা রয়েছে।”
কমিশনার বললেন, “তাহলে পুরোনো টিমটাতে একজন সিনিয়র অফিসারকে লিড করতে দেওয়া হোক। মিসেস সিংহরায় তাঁকে অ্যাসিস্ট করবেন। কেমন হয়?”
রুদ্রর মুখটা কালো হয়ে গেল। নতুন তৈরি হওয়া কোন টিমে একজনের আণ্ডারে থাকা অন্য কথা, কিন্তু পুরনো টিমে যেখানে ও এতদিন নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, সেখানে ওর মাথার ওপর একজনকে বসানো মানে ওর কর্মদক্ষতাকে সরাসরি সন্দেহ করা। সেক্ষেত্রে টিমের বাকি সদস্যদের কাছে ওর সম্মান অনেক নীচে নেমে যাবে।
এবারেও ওকে বাঁচালেন রাধানাথ স্যার। বললেন, “না, আমার মনে হয়, রুদ্রাণীর টিমটাকেই আরেকবার কাজটা করতে দেওয়া হোক। নতুন কাউকে ঢোকালে তার ডিরেকশন অফ ইনভেস্টিগেশন এতদিনের প্রোগ্রেসের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। সেক্ষত্রে আরও দেরি হবে।”
কমিশনার সুনীত বসু সায় দিলেন, “বেশ। তাই হোক।”
রুদ্র কৃতজ্ঞ চিত্তে তাকাল রাধানাথ স্যারের দিকে। এত দুঃখের মধ্যেও ওর মনে হল, রাধানাথ স্যার এই পুলিশ সার্ভিসে ওর অভিভাবক। এমন অভিভাবক যিনি বাবার মতো প্রয়োজনে বকতেও পারেন, আবার দরকারে বটগাছের মতো আগলে রাখতেও পারেন।
ও অস্ফুটে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!”
রাধানাথ স্যার যেন শুনতেই পেলেন না রুদ্রর কথা। কড়া কণ্ঠে বললেন, “দিজ ইজ ইয়োর লাস্ট চান্স রুদ্রাণী! এরপর কিন্তু আমরা টিমটা লিড করার জন্য অন্য কাউকে দিতে বাধ্য হব।”
২৪
বীরেনবাবু বললেন, “ডঃ সুবল ভট্টাচার্য খুব নামকরা গাইনোকোলজিস্ট ছিলেন। বাঁশবেড়িয়ার মানুষ বলে নার্সিং হোমটা ওখানে করেছিলেন, কিন্তু মাসে অনেকবার চেন্নাই, মুম্বাই আর দিল্লির সব বড় বড় হসপিটালে রুগি দেখতে যেতেন। আর তিনি শুধুই ‘বাসুদেব ভবন’ এর মালিক ছিলেন না, ওঁর কিন্তু আরও অনেকরকম পরিচয় ছিল।”
“যেমন?” রুদ্র গাড়ির সামনের সিটে বসেছিল। ওর কোলে শিবনাথ বিশ্বাসের ল্যাপটপ। তাতে বিশেষ কিছু নেই। লোকটা আদ্যন্ত ঘরোয়া ছিল। মেয়ের বলতে গেলে প্রতি মুহূর্তের ছবি তুলে ষ্টোর করেছে ল্যাপটপে।
আহা! সেই মেয়ে কোনোদিন বাবাকে চিনলই না।
গাড়ির পেছনে রয়েছে জয়ন্ত আর বীরেনবাবু। গাড়ি চালাচ্ছিল পাঁচু।
বীরেনবাবু বললেন, “আমি এই তিনদিন ধরে ইনফরমেশন কালেক্ট করছি। ড. ভট্টাচার্য বাসুদেব ভবনে সমস্ত গরিব মানুষদের জন্য একেবারে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। কলকাতার অনেক বড় বড় ডাক্তার সেখানে চ্যারিটেবল সার্ভিস দিতেন। তাছাড়া উনি মায়াপুরের ইসকন মন্দিরের গভর্নিং বডিতেও ছিলেন। মায়াপুরে ইসকনের যে নিজস্ব দাতব্য নার্সিং হোম, তাতেও উনি বছরে দু-তিনবার গিয়ে ফ্রিতে রুগি দেখতেন, অপারেশন করতেন। ভালো লোক ছিলেন। আমাদের লোকেশবাবু তো ইসকনের ভক্ত, উনি আরও ভালো বলতে পারবেন।”
“মার্ডার কীভাবে করা হয়েছে?” রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ওই একইরকমভাবে। রাত একটার সময় গিয়ে বাড়িতে বেল বাজিয়ে কাকুতিমিনতি করেছে একটা লোক। তার স্ত্রী নাকি প্রেগন্যান্ট, আট মাস চলছে। হঠাৎ ব্লিডিং হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী লোকটাকে প্রথমে বলেছেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তখন সে হাতে পায়ে ধরেছে। সে নাকি রিকশা চালায়। এই মাঝরাতে গাড়ি করে বউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। তখন ডাক্তারবাবু তার সঙ্গে বেরিয়েছেন। সেই লোকটার রিকশা চেপেই। আর ফেরেননি। তারপর থেকে কোনো ট্রেস নেই। ফোনও বন্ধ। পরেরদিন বিকেলে গঙ্গার ঘাটে বসে থাকা অবস্থায় বডি মিলেছে। গলায় গামছা জাতীয় কিছু দিয়ে চেপে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে।” বীরেনবাবু মুখ দিয়ে আপসোসের শব্দ করলেন, “মানুষ কী নির্মম। লোকটা সাহায্য করতে গেল, আর তাকেই কিনা …!”
“এসব কী হচ্ছে?” রুদ্র বিরক্তিতে হাতের তালুতে ঘুষি মারল, “পরপর একরকমভাবে খুন … অথচ কোনো ক্ল্যু নেই। কোনো উইটনেস নেই। কোনো সিসিটিভি নেই।”
“ডাক্তারের স্ত্রী, সেক্রেটারি, নার্সিং হোমের অনেককে ইন্টারোগেট করা হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি। ফোনটা ভাঙা অবস্থায় মিলেছে অনেক দূরের এক ঘাটে। রিকশা’টা মিলেছে অন্য একটা পাড়ায়। রিকশার যে মালিক সে দিশি মদ খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল রাস্তার পাশে।”
রুদ্র কী বলতে যাচ্ছিল, জয়ন্ত মাঝখানে বলে উঠল, “বীরেনদা, আপনি ডাক্তারবাবুর আরেকটা পরিচয় তাহলে জানতে পারেননি।”
“কী ভাই?”
“হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয়, কিন্তু এই ড. সুবল ভট্টাচার্যও কিন্তু ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বংশধর!” জয়ন্ত বলল।
“অ্যাঁ?” চমকে উঠল রুদ্র, “তুমি কী করে জানলে?”
“আজ সকালে ডিউটিতে আসছি, মধুময়দা’র সঙ্গে দেখা। তিনিই বললেন। ওই ডাক্তারবাবু অবশ্য জন্মেছিলেন বাঁশবেড়িয়াতেই। ওঁর ঠাকুরদাই ত্রিবেণীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে আলাদা বাড়ি করেছিলেন। তাই আমরা জানতাম না।”
জয়ন্ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র বলল, “এই দাঁড়াও। গাড়ি দাঁড় করাও।”
“কী হল?” পাঁচু অবাক। গাড়ি জিটি রোড দিয়ে ছুটছে বাঁশবেড়িয়ার উদ্দেশ্যে।
রুদ্র গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “তোমরা বেরিয়ে যাও। সব ভালো করে দেখে এসো। আমি অন্য একটা কাজে যাচ্ছি।”
জয়ন্ত আর বীরেনবাবু বিস্মিত হলেও ঊর্ধ্বতন ম্যাডামের ওপর কোনো প্রশ্ন করলেন না। গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেল।
জিটি রোড থেকে কিছুক্ষণ অন্তরই সরু গলি চলে গিয়েছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। তেমনই একটা গলি দিয়ে রুদ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।
গঙ্গার ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফোন বের করে কল করল।
এখন ক’টা বাজে? সকাল ন’টা। তার সামনে ওয়াশিংটনে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। এত রাতে ফোন করা কি ঠিক হবে?
বেশি কিছু না ভেবে ও ফোন করেই ফেলল।
দু-দু’বার ডেটা কল কেটে গেল। তিনবারের বার কল রিসিভড হল।
“হ্যালো?”
“হ্যালো, শুভাশিসবাবু? আমি … আমি প্রিয়মের স্ত্রী রুদ্রাণী বলছি।”
“আরে হ্যাঁ, বলুন। কী ব্যাপার?”
“আচ্ছা, আপনি সেদিন কী বলতে চাইছিলেন? নকল দাদুরা কেন নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন?”
ওপাশে কিছুক্ষণের নীরবতা।
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“মি. ভট্টাচার্য, প্লিজ আমাকে একটু খুলে বলুন!” রুদ্রর গলা থেকে আকুতি ঝরে পড়ছিল।
শুভাশিসবাবু আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আপনি আমীশ কমিউনিটির নাম শুনেছেন?”