১০
অচ্যুতের গলা দিয়ে প্রাণপণ আওয়াজ বেরিয়ে আসতে চাইছিল। নিজের বারোবছরের দেহে যতটুকু শক্তি আছে, গোটাটাকে কণ্ঠনালীর ভরকেন্দ্রে এনে চিৎকার করতে চাইছিল ও। কিন্তু ঠোঁটদুটো উন্মুক্ত করতেই ঢুকে আসছিল জল।
মড়াপোড়া কাঠের ছোট ছোট টুকরোতে ভরতি পচা জল।
সমাজের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে শ্মশান। সেই শ্মশানের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে একটি প্রশস্ত খাল। লোকে তাকে নদী বলেই চেনে। ওদের কাছে সেই নদীর নাম জরা। কাল কৈবর্তের দল এসে শ্মশান লাগোয়া এই জরা নদীর পাড়ে এক মানুষ পাঁকের মধ্যে অচ্যুতকে পুঁতে দিয়ে গিয়েছে। অচ্যুতের চিবুক পর্যন্ত মাটির নীচে পোঁতা। চিবুকের উপরিভাগে মাঝে মাঝেই ঢুকে আসছে শ্মশানঘাটের দাহ করা মড়ার কাঠের জল।
অচ্যুতের চোখের দুই পাশ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। সেই নোনা জল মিশে যাচ্ছিল নদীর জলের সঙ্গে। পেট থেকে ভাত ঠেলে উঠে আসছিল। ওর হাত পা, গোটা শরীর এমন শক্তভাবে পাঁকে পোঁতা রয়েছে যে চাইলেও কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াতে পারছিল না।
ও কি মরে যাচ্ছে?
কেন? কী অপরাধে এমন শাস্তি পেতে হচ্ছে ওকে? যুক্তিগ্রাহ্য কোনো প্রশ্ন মনে উদয় হলে কৌতূহল নিরসন করতে চাওয়া কি অপরাধ?
অচ্যুতের মনে পড়ল, কালু কৈবর্তদের ওকে এই চরে টানতে টানতে নিয়ে আসার সময়ে নিজেদের মধ্যে বলা কথাগুলো।
“ই ছোঁড়াটো খুব বাড় বেড়েছে। রাতভর ইটিকে ফেলি রাখতি হবেক চরে। তবে খতম করলি চলব না। তেমনই হুকুম!”
অচ্যুত আবার সর্বশক্তি দিয়ে ছটফট করে উঠল। কিন্তু মুণ্ডু ছাড়া ওর শরীরের কোনো অংশই একচুল নড়ল না।
ও আবার কেঁদে ফেলল। গভীর রাত। নিস্তব্ধ শ্মশানের চর। ভয় ও পায় না। এমন নিশুতি রাতে ও হেলায় বনের মধ্যে কিংবা শ্মশানে ঘুরে বেরিয়েছে আগে। কিন্তু প্রচণ্ড একটা রাগ এসে ওকে এখন আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, ওকে এই সারারাত ধরে প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে রেখে সহবৎ শেখানোটাই গুরুদেবের নির্দেশ।
এখন ওর মনে হচ্ছে, জন্মানো ইস্তক ওর জীবনের গোটাটাই যেন মস্ত বড় এক প্রহসন! আজ পর্যন্ত ও জানেনা ওর বাবা-মার পরিচয়। আর এই যে বৈদিক সমাজ, পুরোটাই একটা ফাঁপা কলসী! আর এই সমাজে জন্মানোর মাশুল ওকে, দ্বারিকাকে, কিংবা বনমালির মতো ছেলেদের দিতে হয় সারাজীবন ধরে। শুধু ছেলেরাই বা কেন? ওরা তবু সামান্য হলেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে।
কিন্তু মেয়েরা?
অচ্যুতের মাঝে মাঝেই চেতনা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। গতকাল দুপুরের সেই আহারের পর থেকে পেটে কিচ্ছু পড়েনি। তার মধ্যে চারপাশের এই ভয়ংকর গন্ধে ওর বিবমিষা জাগছিল।
ছোটবেলা থেকে কী যেন শেখানো হয় ওদের?
অচ্যুত চোখ বন্ধ করে ঘাড় একদিকে হেলিয়ে গোঙাতে গোঙাতে মনে করার চেষ্টা করছিল।
“বাইরের পৃথিবী ক্রমশই পাঁকে অধঃপতিত হচ্ছে। প্রযুক্তি আর যন্ত্র একটু একটু করে গ্রাস করে ফেলছে মানুষদের। মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, আন্তরিকতা আজ তলানিতে। দেখনদারি, কৃত্রিমতা আর উচ্ছৃঙ্খলতায় ভরে যাচ্ছে সমাজ। স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমজ্জিত আধুনিক মানুষ ভুলে যাচ্ছে যে সে একদিন সামাজিক জীব ছিল।
“পরিবর্তনকে স্বাগতম তখনই, যখন সে ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনে। কিন্তু এই পরিবর্তন ক্ষতিসাধন ছাড়া আর কী করছে? লাগামছাড়া স্বাধীনতায় মেয়েদের চরিত্র আর দেবীসম নেই, তারা প্রত্যেকে পরিণত হয়েছে অভিজাত বারাঙ্গনায়। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সমাজকে দাঁড় করাচ্ছে বিপজ্জনক খাদের ধারে। সবকিছুই অতি দ্রুত, সবকিছুই অতি তাৎক্ষণিক, সবকিছুই অতি ক্ষণস্থায়ী। আর এই সবকিছুর পেছনেই প্রযুক্তির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
“তাই আমাদের বৈদিক সমাজে আমরা সময়কে এগোতে দিইনি। দেব না। সময়কে আমরা এখানে আটকে রেখেছি অষ্টাদশ শতাব্দীতে। যেখানে এখনো পবিত্রতা আছে, নির্মলতা আছে, শুচি আছে, প্রাণ আছে …!”
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় বহুবার শোনা এই কথাগুলো মনে করতে করতে আবার রাগে কেঁপে উঠল অচ্যুত। কী নির্মলতা আছে ওদের সমাজে? সারাক্ষণ ছোঁয়াছুঁয়ি, আচারবিচার। বাগদি বা নমঃশূদ্রদের ছায়া মাড়ালেই স্নান করতে হয় ব্রাহ্মণদের। বুড়ো স্বামী মারা গেলেই দশ-বারোবছরের মেয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় এই শ্মশানে।
আর বাইরে? বাইরে যন্ত্র থাক, প্রযুক্তি থাক, তবু তো মানুষের স্বাধীনতা আছে। নীচুজাতে জন্মেও সমানাধিকার আছে!
সংজ্ঞা হারাতে হারাতেও অচ্যুত কেমন যেন ধড়মড় করে জেগে উঠল। মাথার ওপরে নিকষ কালো আকাশ। ওদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আকাশকে বাঁধা যায়নি শৃঙ্খলার বন্ধনে। বৈদিক সমাজের পবিত্র আকাশ প্রসারিত হয়েছে আধুনিক জগতেও।
আকাশে এখন মিটমিট করছে অসংখ্য নক্ষত্র। সেগুলো দেখতে দেখতে অচ্যুতের মনে হল, এমনিতে তো শ্মশান সীমানায় আসা অসম্ভব, কড়া প্রহরা থাকে শ্মশানের বাইরে। কারণ একমাত্র শ্মশানের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে জরা নদী। নদী তো মানুষের অনুশাসন মানেনা, তাই বৈদিক সমাজ হয়ে নদী চলে গিয়েছে আধুনিক জগতের দিকে।
শুধু গুরুদেবের আজ্ঞাপালনে যাদের সেই জগতে যেতেই হবে, একটা ছোট্ট নৌকো করে তারা ভেসে যায় উত্তরদিকে। তাদের জন্য রয়েছে আলাদা ঘাট। কয়েকমাস পর লক্ষ্যপূরণ করে তারা আবার ফিরে আসে। পূজামণ্ডপে তখন সাদর অভ্যর্থনা করা হয় তাদের। স্বয়ং গুরুদেব এসে তাদের কপালে পরিয়ে দেন জয়টিকা।
এই জরা নদী বেয়েই কয়েকমাস আগে পালিয়েছিল সেই বাচ্চা মেয়েটা আর তার মা। যার জন্য তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল ব্রজেন্দ্রদাদাকে।
অচ্যুত অতিকষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে দূরে তাকাল। দূরে, অনেক দূরে আবছা যেন দেখা যাচ্ছে আধুনিক জগতের বৈদ্যুতিন আলো। মাঝে মাঝে যখন ও খুড়োর বাড়ির উঠোনে রাত্রিবেলা একাকী শুয়ে থাকত, হঠাৎ দেখতে পেত, আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কিছু একটা।
মিটমিট করে জ্বলছে আলো। কখনো শোনা যেত মৃদু শব্দ।
নারায়ণী চতুষ্পাঠীর আদেশমতো তখন চোখ বুজে কৃষ্ণনাম জপ করতে চাইলেও ও পারতনা। অদম্য কৌতূহল ওর আঁখিপল্লবগুলোকে টেনে রাখত। মনে প্রশ্নের উদয় হত, ওগুলো কী? আধুনিক জগতে কি মানুষ উড়তে পারে?
তবে ওরা কেন পারবে না? কী লাভ এই বৈদিক সমাজে কূপমণ্ডূক হয়ে থেকে? সময় তো পশ্চাৎগামী নয়, তবে ওরা কেন এখানে ঘড়ির বিপরীতমুখে চলছে?
আচ্ছা, ও-ও কি একবার চেষ্টা করে দেখবে? মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য শেষ একটা চেষ্টা? গিয়ে নিজের চোখে একবার দেখবে আধুনিক জগৎটাকে?
ভগবান সকলকেই তো সুযোগ দেন! ওকেও হয়তো দিচ্ছেন। এই সুযোগ হেলায় হারালে হয়তো আর কোনোদিনই আসবে না।
এই তীব্র যন্ত্রণাময় পরিস্থিতির মধ্যেও আকাশপাতাল ভাবছিল অচ্যুত। হঠাৎ একটা জান্তব ডাকে চমকে উঠল। আর পরক্ষণে বালির মধ্যে গেঁথে থাকা ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল।
ওর ঘাড়ে কোনো বন্য পশু জিভ দিয়ে চাটছে।
অচ্যুত দ্রুত হিসেব করতে লাগল। শ্মশানে এসে মিশেছে দূরের অরণ্য। সেই অরণ্যে হিংস্র পশু নেই। তবে শিয়াল আছে প্রচুর। নিজের ঘরে যখন ও রাতে শুয়ে থাকত, তখনও গভীর রাতে শিয়ালের হুক্কা হুয়া শুনেছে। একবার নিজের চোখে একটা শিয়ালকে ব্যাঙ ধরে খেতেও দেখেছিল।
আচ্ছা, শিয়াল কি জ্যান্ত মানুষের মাংস খায়?
ভাবনাটা মনে আসামাত্র ঘাড়ের কাছে মৃদু কামড় অনুভব করল অচ্যুত। এবার সত্যিই ওর ভয় লাগছে। ভীষণ ভয় লাগছে। কান্নায় ওর গলা বুজে এল।
কী অন্যায় করেছে ও?
ঘাড়ে দাঁতের দংশন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। সেই কামড় থেকে ছাড়াতে মাথাটা আপ্রাণ দুদিকে ঝাঁকাচ্ছে অচ্যুত। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। ও বেশ বুঝতে পারছে, এতক্ষণে ওর পেছনে এসে উপস্থিত হয়েছে আরও কয়েকটা শিয়াল।
সবাই মিলে প্রতিযোগিতায় মেতেছে, কে প্রথম নেবে কচি নরমাংসের আস্বাদ!
১১
“আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে, কানাই, বলরাম আর ওই গোবিন্দ —তিনজনের মধ্যে কোন সংযোগ রয়েছে।” রুদ্র বিড়বিড় করল।
জয়ন্ত বলল, “এরকম মনে হওয়ার কারণ, ম্যাডাম?”
“তুমি নিজেই ভেবে দ্যাখো। তিনজনেই হঠাৎ করে কাজে ঢুকে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছে। তিনজনেরই কোনো পরিচয়পত্র আমাদের কাছে নেই।” রুদ্র বলল, “আর তিনজনের কাজকর্মে মিলও রয়েছে। যেমন কানাই আর বলরাম পুজো করত, মোবাইল ফোন ব্যবহার করত না। আর স্বপন সরকারের আন্ডারে কাজ করা গোবিন্দ কিছুতেই কোনো বাইকে বা মোটরগাড়িতে উঠতে চাইত না। এই তিনটে ব্যাপারের মধ্যে কিছু তো একটা যোগসূত্র আছেই!” হয়ত তিনজন আসলে একই ব্যক্তি।
“কিন্তু, তিনজনের চেহারা বা মুখের যা বর্ণনা পেয়েছি, তাতে কিন্তু মিল তেমন পাইনি।” বীরেন শিকদার ফাইলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “কানাই ছিল ছোটখাটো, রং ফর্সা। বেঁটে হলেও গাঁট্টাগোঁট্টা গড়ন। বলরাম লম্বা চওড়া দশাসই চেহারার, রং কালো, কপালে একটা গভীর কাটা দাগ। আর গোবিন্দ খুবই রোগা, মাঝারি গায়ের রং, উচ্চতাও মাঝারি।”
রুদ্র হাতের পেনটা অন্যমনস্কভাবে চিবুকে ঠেকিয়ে টোকা দিচ্ছিল। বলল, “হুম। এক লোক না হলেও কিছু লিঙ্ক শিওর আছে। আপনি সুনীল ধাড়ার পড়শি দোকানদার রসিকলাল বিশাইয়ের স্টেটমেন্টটা পড়ুন। বলরাম সারাক্ষণ লুঙ্গি পরে থাকতে পছন্দ করত। সেইজন্য মি. বিশাই সন্দেহ করতেন, ছেলেটা মুসলিম হতে পারে।”
“তো?” বীরেনবাবু বুঝতে পারলেন না।
এবার রুদ্র কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি তো স্বপন সরকার মার্ডার কেসের প্রথম থেকেই যুক্ত আছেন, ডিটেইলিং ফাইলে ওঁর স্ত্রী কী বলেছিলেন ভুলে গেলেন? গোবিন্দ মালকোঁচা মেরে লুঙ্গি পরত। এই নিয়ে দলের অনেকে হাসিঠাট্টাও করত।”
বীরেনবাবু এবার জিভ দিয়ে একটা আফসোসের শব্দ করলেন, “হ্যাঁ। তাই তো! আমি কি আরেকবার স্বপন সরকারের কেসের লোকগুলোকে জেরা করবো, ম্যাডাম?”
রুদ্র টেবিলের ওপর রাখা ভারী পেপারওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “আপনারা সবাই ফিল্ডে খুব ডেডিকেটেডলি কাজ করছেন আমি জানি। ছ’টা মার্ডার, সেগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট, মোটিভ খুঁজে বের করা, সাসপেক্টদের জেরা করা এভরিথিং। আপনারা যে নিজেদের একশো শতাংশ দিচ্ছেন, সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু আমাদের এই স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিমের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু চেইনটাকে খুঁজে বের করা। তাই লোকাল পুলিশ স্টেশন যেটা করছে, সেই একই কাজ করে আমাদের খুব একটা লাভ নেই”। সবাই চুপ করে বসে আছেন গোলটেবিলটার চারপাশে। একটা ছুঁচ পড়লেও শব্দ হবে, এমনই নিস্তব্ধতা গোটা ঘরে।
রুদ্র একটা সাদা কাগজ টেনে নিল।
“আপাতত আমার কিছু অবজারভেশন বলি। তারপর আপনারাও সেগুলো নিয়ে ব্রেইনস্টর্ম করুন। আগেই বলেছিলাম, এই ছ’টা খুনই হয়েছে কোনো না কোনো বুধবারে, তাই তো?”
“ইয়েস ম্যাডাম!” সবাই সমস্বরে সায় দিলেন।
“মার্ডারের তারিখগুলো থেকে আপনারা কিছু আইডিয়া করতে পারেন?” রুদ্র বলল, “এমনও তো হতে পারে, সাত নম্বর খুনের ক্ল্যু লুকিয়ে আছে তার মধ্যেই?”
সবাইকে নীরব দেখে ও কাগজে খসখস করে লিখতে লাগল, “দেখুন।”
প্রথম খুন | ১৫ই জানুয়ারি | বুধবার |
দ্বিতীয় খুন | ১২ই ফেব্রুয়ারি | বুধবার |
তৃতীয় খুন | ১১ই মার্চ | বুধবার |
চতুর্থ খুন | ১৫ই এপ্রিল | বুধবার |
পঞ্চম খুন | ১৩ই মে | বুধবার |
“আপাতদৃষ্টিতে এই তারিখগুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে না। কোনটা মাসের দ্বিতীয় বুধবার, কোনটা তৃতীয়।” রুদ্র কাগজে দাগ টানতে টানতে বলল, “কিন্তু দেখুন, যদি আমরা তারিখগুলো তিথিনক্ষত্রের হিসেবে দেখি?”
রুদ্র লেখা শেষ করে সবার দিকে তাকাল, “প্রতিটা খুন হয়েছে বাংলামাসের কৃষ্ণপক্ষে। যদি আমার ক্যালকুলেশন ঠিক হয়, তবে সাত নম্বর খুনটাও কৃষ্ণপক্ষেই হবে। অর্থাৎ ৬ই জুলাই থেকে ২০শে জুলাইয়ের মধ্যে।”
“ও মাই গড!” বীরেন শিকদার বিস্ফারিতচোখে বললেন, “কিন্তু এই কৃষ্ণপক্ষকে বেছে নেওয়ার কারণ কী, ম্যাডাম?”
“সেটার একটা লজিক আমি ভেবেছি, কিন্তু এখনই বলছি না।” রুদ্র কাঁধ ঝাঁকাল, “কারণ এটাই যে সত্যি, তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে আমাদের ওই সময়টায় অ্যালার্ট থাকতে হবে।”
প্রিয়াঙ্কা একটা কাগজ টেনে নিয়ে হিসেব কষতে লাগল, “কিন্তু দিনটা? পঞ্চমী, চতুর্থী, দ্বিতীয়া, তারপর আবার অষ্টমী, ষষ্ঠী, পঞ্চমী …! ধুর! সব গুলিয়ে যাচ্ছে!”
“কোন প্যাটার্ন যে থাকবেই, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবু এটা একটা পয়েন্ট।” রুদ্র বলল, “আপাতত, বীরেনবাবু বৈদ্যবাটি আর কোন্নগরের কেসটা একেবারে গ্রাসরুট লেভেল থেকে রি-ওপেন করুন। আর লোকেশবাবু আপনি টেকওভার করুন চন্দননগর আর চুঁচুড়ার কেসদুটো।”
রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছিল, “কানাই হোক, বলরাম হোক বা গোবিন্দ, এবারে আমাদের তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর এখন আমি একবার ত্রিবেণী যাব। জয়ন্ত চলো আমার সঙ্গে।”
১২
সাধারণ একটা একতলা বাড়ি। বহুদিনের মেরামতির অভাবে নানা জায়গায় রং খসে হাড়গোড় বেরিয়ে পড়েছে। সামনের একচিলতে বারান্দায় ঝুলছে বাচ্চার ছোট ছোট জামাকাপড়।
ওসি সুকেশ সান্যাল একজন কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে-ই নিয়ে এল। তার নাম বিমল।
ওরা ডাইনিং এ বসে ছিল, একটা তেলচিটে সোফায়। ডাইনিং অবশ্য নামেই, গোটা বাড়িতে সাকুল্যে দুটো ঘর। একটা এই বসার ঘর, এর মধ্যেই বোধহয় খাওয়াদাওয়া সব কিছু। আর উলটোদিকে শোবার ঘর। এই দুটো ঘর আর রান্নাঘর, বাথরুম ছাড়া তো আর কিছু চোখে পড়ছেনা।
ছোট্ট একটি শিশু গোটা ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে নিজের মনে খেলছে, আ – উ জাতীয় অবোধ্য সব শব্দ করছে। মাঝেমাঝে কোনো কিছুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু টলোমলো পায়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই আবার থেবড়ে বসে পড়ছে মাটিতে। জয়ন্ত তার দিকে চেয়ে মুখ দিয়ে বিচিত্র কিছু আওয়াজ করতে সেও প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করল।
শাড়ি পরা অল্পবয়সি মেয়েটি রুদ্রর চেয়ে বয়সে ছোটই হবে, বড়জোর বাইশ-তেইশ। বিবর্ণ শাড়ি, শুভ্র সিঁথি। রোগা। অতিরিক্ত পরিশ্রমে কেমন ফ্যাকাসে। চুলের খোঁপা এলিয়ে পিঠের ঘামে লেপটে রয়েছে। রান্নাঘরের নুন-হলুদ লেগে থাকা মলিন শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে এসে সে ওদের সামনে গ্লাস বাড়িয়ে দিল।
”এই নিন, গরমে এসেছেন, একটু শরবত খান।”
“আমি অন ডিউটি কিছু খাই না, থ্যাঙ্ক ইউ।” বিব্রত রুদ্র বলে ওঠে। কিন্তু ততক্ষণে সুকেশ সান্যালের কনস্টেবল বিমল হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিয়েছে গ্লাসটা। সবে চুমুক দিতে যাবে, এমন সময় ম্যাডামের এমন উলটোকথা শুনে জয়ন্ত তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল।
বিমল দ্বিধাগ্রস্ত মুখে গ্লাসটা ধরে বসে রইল। এই ম্যাডাম ওসি সাহেবের থেকেও উঁচুতে, তিনি না খেলে সে খাবে কি করে!
মেয়েটা ম্লান হাসে, “এটা তেমন কিছু না দিদি। একটু নুন – চিনির শরবত। রোদে তেতেপুড়ে এসেছেন, তাই। আর কীই বা আছে ঘরে, যে দেব! বাড়িতে অতিথি এলে এইটুকু তো দিতেই হয়।”
রুদ্রর অস্বস্তি হয়। খানিকটা দোনোমনা করে গ্লাসটা তুলে নেয় ও।
সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির সঙ্গে বিমলও ঠোঁটে গ্লাস ছোঁয়ায়।
রুদ্র ইচ্ছে করেই ‘আপনি’ না বলে সরাসরি ‘তুমি’তে নেমে আসে, “এখন কীভাবে চলছে তোমাদের?”
মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “কীভাবে আর চলবে। আমাদের মানে তো আমি আর আমার মেয়ে। আমি এখানেই একটা ছোট অফিসে রান্নার কাজ নিয়েছি। তিন হাজার টাকা পাই। ওতেই মোটামুটি চালিয়ে নিতে হয়। মেয়েটার দুধ নিয়ে একটু যা টানাটানি হয়। সবে তো দশমাস বয়স।”
জয়ন্ত বলল, “শিবনাথ বিশ্বাসের দোকানটা?”
“সেটা পড়েই আছে। বাজারে ওর বেশ কিছু ধার ছিল। কম্পিউটারগুলো বেচে সেই ধার শোধ করলাম। তাও ভেঙে গিয়েছিল বলে খুব কম দাম পেয়েছি। দোকানটা আর খুলিনি। ওই গঙ্গার ধারে ফাঁকা রাস্তায় কিসেরই বা দোকান করব? আর আমি একা চালাবই বা কী করে! মেয়েটাকে পাশের বাড়িতে রেখে কোনোরকমে গিয়ে দু-তিনঘণ্টায় রান্না সেরে আসি।” মেয়েটার গলা বলতে বলতে ধরে আসে, “আপনি বিশ্বাস করুন দিদি, আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমি … আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। আমি কিচ্ছু করিনি।”
“তোমার নাম কী?” রুদ্র নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।
“আরতি।”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জয়ন্ত গাড়িতে আসতে আসতে বলছিল, “খুব স্ট্রেঞ্জ কেস। ওসি সুকেশ সান্যাল যতই বউ আর পাড়ার ওই ছেলেটাকে অ্যাকিউজ করুক, প্রুফ কোথায়? শিবনাথের দোকান শ্রীহরি সাইবার ক্যাফের লোকেশনটা একদম ফাঁকা জায়গায়। দুদিক থেকে দুটো বড় রাস্তা দিয়ে ওই গলিতে আসা যায়। সেই দুটো রাস্তাতেই বড়বড় দুটো মিষ্টির দোকান। তাদের দোকানের সামনে সিসিটিভি লাগানো আছে। কিন্তু ফুটেজ চেক করে ওইসময়ের দু-তিনঘণ্টা আগে পর্যন্ত এমন কাউকে পাওয়া যায়নি যে সন্দেহ করা যেতে পারে।”
রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল, “ওর ক্যাফেতে সেদিন যারা এসেছিল?”
“সেদিন গোটা দিনে কোনো কাস্টমারই আসেনি ওর সাইবার ক্যাফেতে। দোকান থেকে বেরোনোর কিছুক্ষণ আগেই নিজের স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিল শিবনাথ। আর ওর দোকানে যেই যাক, দুদিকের দুটো মিষ্টির দোকানের যে কোনো একটার সামনে দিয়ে যেতে হবে। তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। জায়গাটা খুবই নির্জন।”
“এমনও তো হতে পারে, মিষ্টির দোকান আর শিবনাথের ক্যাফে, দুটোর মাঝখানের কোন বাড়িতে কেউ লুকিয়েছিল।”
“হুম, তা পারে।” জয়ন্ত বলেছিল, “সেইজন্যই ইনভেস্টিগেশন ফাইলে দেখবেন, লোকাল পুলিশ অফিসার কাছাকাছি সব বাড়িতে জেরা করেছিলেন। কিন্তু সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছুই পাননি।”
রুদ্র বর্তমানে ফিরে এল। বলল, “আরতি, আমরা তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। এও জানি যে তুমি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। তবু, তোমার কাছে এসেছি কিছু বিষয় জানতে।”
আরতি চুপ করে রইল।
“তোমার নিজের বাড়ি কোথায়?”
“নিজের বাড়ি মানে?” আরতি সামান্য থমকাল, “ওহ, বাপের বাড়ি? বারুইপুর। বাবা-মা কেউ নেই। ছোটবেলাতেই মারা গেছে। আমি মামার বাড়িতে মানুষ। ওই বারুইপুরেই। মামারাই সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছিল।”
“১৫ই জানুয়ারি শেষ কখন তোমার সঙ্গে শিবনাথের কথা হয়েছিল?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
“সাড়ে আটটার সময়।” একটুও না ভেবে উত্তর দিল আরতি, “ও খুব মনমরা হয়ে কথা বলছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। বলল, সারাদিনে একটাও খদ্দের আসেনি। আমি বললাম, ঠিক আছে, তুমি বাড়ি চলে এসো।”
“কারুর আসার কথা আছে, এমন কিছু কি বলেছিল তোমায়?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
“নাতো। আসলে শিবুর বন্ধুবান্ধব তেমন ছিল না। ঘরে থাকতেই বেশি ভালোবাসত। দোকানে যেত, দোকান বন্ধ করেই আবার ঘরে চলে আসত।” আরতির গলাটা বুজে এল।
“কেউই কি ছিল না যে শিবনাথের দোকানে আড্ডা মারতে যেত?”
আরতি একটু ভেবে বলল, সে’রকম তো আমি কাউকে চিনি না।”
রুদ্র বলল, “দোকানে রাজু বলে যে ছেলেটি আগে কাজ করত …।”
আরতি বোধ হয় এতক্ষণ ধরে এই প্রশ্নটারই প্রতীক্ষা করছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল, “বিশ্বাস করুন দিদি, রাজু আমার ভাইয়ের মতো। আমি এখানে এসে থেকে ওকে রাখি পরাই। হ্যাঁ, এটা ঠিক ওইসময় কয়েকদিন ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতাম। কিন্তু তার কারণ আপনারা যেটা ভাবছেন সেটা নয়। তখন বান্ধবীর সঙ্গে রাজুর ঝগড়া হয়েছিল। বেচারা মন খারাপ নিয়েই ট্যুর নিয়ে গিয়েছিল পুরীতে। আমি তাই ওকে ফোনে বোঝাচ্ছিলাম। দিদির মতো।”
রুদ্র কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আরতির চোখের দিকে। তারপর বলল, “রাজু এখন কোথায়?”
“ওকে পুলিশ বেশ কয়েকবার থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছে। মারধোরও করেছে। এখন কোথায় আমি জানি না। আমার বাড়িতে অনেকদিন আসেনি।”
রুদ্র উঠে দাঁড়াল। একেবারেই ছন্নছাড়া বাড়ি। এখানে ঝাঁটা পড়ে রয়েছে, ওখানে হাড়ি-খুন্তি, এদিকে কিছু ময়লা জামাকাপড়, ওদিকে বাচ্চার দুধের টিন। বোঝাই যাচ্ছে, আরতি একা পেরে ওঠে না। একটা কাঠের টেবিল, তার ওপর স্তূপাকৃতি করা বইপত্র।
বইপত্রের ওপরের দেওয়ালে তিনটি বড় বড় বাঁধানো ছবি। মাঝেরটা শিশু গোপালের হামাগুড়ি দেওয়া ছবি। দুদিকের ছবিদুটো এক পুরুষ ও এক মহিলার। তাতে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া।
“এঁরা কারা?”
আরতি বলল, “আমার শ্বশুর শাশুড়ি। দুজনেই মারা গিয়েছেন, অনেকদিন হল। আমার বিয়ের অনেক আগে।”
রুদ্র টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। বেশিরভাগই বাজারচলতি পত্রপত্রিকার পুজোসংখ্যা। একেবারে নীচে একটা ল্যাপটপ। ধুলোর পুরু আস্তরণ তার ওপর। ও ওপরের বইগুলো সাবধানে ধরে ল্যাপটপটা বের করল। কিন্তু সেটা অন হল না। চার্জ নেই।
“এটা কার ল্যাপটপ?”
আরতি ম্লান গলায় বলল, “ওরই ছিল। বাড়ির কাজে ব্যবহার করত। আমাকে মাঝেমাঝে সিনেমাও দেখাত। এখন অনেকদিন খোলা হয় না।”
১৩
এস পি স্যার রাধানাথ রায় বসেছিলেন তাঁর বাংলোর বাগানে। রুদ্রর বাংলোর চেয়ে আকারে আয়তনে অন্তত আড়াইগুণ বড় শ্রীরামপুরের এই পুলিশ সুপারের বাংলো। বিশাল বাগান, তাতে নানারকম গাছ। আজ সকালে বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তাই গাছের পাতাগুলো ভিজে আরও ঝকঝকে দেখাচ্ছে।
রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকে সোজা এগিয়ে এল, তারপর স্যালুট ঠুকে বলল, “গুড মর্নিং, স্যার!”
“মর্নিং, রুদ্রাণী! বোসো।” রাধানাথ রায় একটা ছুরি দিয়ে নিজেই আপেল কাটছিলেন। পরনে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি। এই সকালেই স্নান টান করে একেবারে পরিপাটি।
টেবিলে রাখা একটা দুধসাদা প্লেট, তাতে নানারকমের ফল। আপেল, মুসুম্বি, কলা, আঙুর, আম, কিছু বাকি নেই। পাশে আরেকটা প্লেটে থাক থাক সাজানো পাউরুটি। রয়েছে মাখন আর জ্যামের শিশিও। সব মিলিয়ে প্রাতঃরাশের এলাহি আয়োজন।
“এই নাও। আপেল খাও। সকাল সকাল আপেল শরীরের জন্য খুব উপকারী।” এস পি স্যার দুটো আপেলের টুকরো এগিয়ে দিলেন রুদ্রর দিকে।
“থ্যাংক ইউ স্যার!” রুদ্র একটু আগে পেট ভরে রুটি আলু চচ্চড়ি খেয়ে এলেও এখন আপেল খেতে ‘না’ করল না। স্যারের উলটোদিকের লোহার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল।
পাশেই গঙ্গা। হু হু করে ভেসে আসছে ঠান্ডা নদীর হাওয়া। এস পি রাধানাথ রায় একজন সিনিয়র আই পি এস অফিসার হলেও উনি কর্মজীবনে কোনো প্রোমোশন নেননি। বেশ কয়েকবছর তিনি এই জেলাতেই আছেন। রুদ্র এসেই শুনেছিল, ওঁর চেয়ে অনেক জুনিয়র অফিসাররা এখন অনেক ওপরে উঠে গিয়েছেন, কিন্তু পদে অধস্তন হয়েও রাধানাথ রায়কে সকলে খুব মানেন।
স্যারের রেকর্ড নাকি ঈর্ষণীয়। প্রথম জীবনে দারুণ কিছু কেস উনি একাই সলভ করেছিলেন। উনি নাকি এমন কাজপাগল, যে কেরিয়ারের জন্য বিয়েই করেননি। তবে বেশ খামখেয়ালি মানুষ, নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার জন্য অনেকবার অপ্রীতিকর শো-কজেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি এখনো অত্যন্ত সুদর্শন ও দীর্ঘকায়।
“তারপর? কেমন কাজ করছে তোমার টিম?” স্যার বললেন।
রুদ্র বলল, “স্যার, আমি তো প্রতিদিন রাতেই আপনাকে ইমেলে ডিটেইল প্রোগ্রেস পাঠাচ্ছি।”
এস পি স্যার বললেন, “আহা সে তো আমি পড়েছি। কাকে কী ইন্টারোগেশন করলে, কোথায় ইনভেস্টিগেট করতে গেলে, এইসব ফর্ম্যাল প্রোগ্রেস রিপোর্ট নয়, আমি তোমার থেকে শুনতে চাইছি, তুমি এমনিতে কতটা এগিয়েছ বা কোনদিকে ভাবছ। মানে আদৌ কি ডি এমের অনুমান ঠিক? আদৌ কি কোনো লিঙ্ক আছে সবকটা খুনের মধ্যে? নাকি প্রতিটাই অ্যাবস্ট্রাক্ট!”
রুদ্র একটু চুপ করে রইল।
রাধানাথ রায় বিরক্তমুখে বললেন, “ডি এম তো কোনো কথাই শুনতে চাইছেন না। ওঁর এই আজগুবি থিয়োরি আবার জানিয়েছেন কমিশনারকে, তিনিও নাচছেন। আমার হয়েছে যত জ্বালা! গোটা রিজিয়ন সামলাব, না এই মার্ডার মিস্ট্রি সলভ করব? রিটায়ারমেন্টের আর পাঁচ মাস বাকি, এইসময়ে এত ঝুটঝামেলা আর ভালো লাগেনা।”
রুদ্র বলল, “কিন্তু স্যার, আমার কিন্তু ম্যাডামের ধারণাটা একেবারে অযৌক্তিক লাগছেনা। আপনাকে রিপোর্টে কানাই, বলরাম, গোবিন্দর ব্যাপারটা তো লিখেইছিলাম, আরও কিছু ইন্টারেস্টিং লিঙ্ক রয়েছে।”
“তাই? কীরকম শুনি?” রাধানাথ স্যার কৌতূহলী চোখে তাকালেন।
রুদ্র সংক্ষেপে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বুধবারের সাদৃশ্যের কথা বলল। প্রতিটা খুনই যে ঘটছে কৃষ্ণপক্ষে, সেটাও বোঝাল।
রাধানাথ রায় বললেন, “কৃষ্ণপক্ষ! প্রোফেশনাল রাইভ্যালরির জন্য ব্যবসাদারদের খুন করছে যদি ধরেও নিই, শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষ বেছে বেছে কেন খুন করতে যাবে?”
“সেটাই এখনো বুঝতে পারছিনা, স্যার!” রুদ্র ম্লানমুখে বলল, “হতে পারে এটা আমার ভুল অনুমান।”
রাধানাথ রায় পাউরুটিতে জ্যাম লাগাতে লাগাতে বললেন, “দ্যাখো রুদ্রাণী, তুমি একেবারেই জুনিয়র। কোনো প্রোবেশনারকে এই রকম কেস লিড করতে দেওয়ার কথাই নয়। হায়দ্রাবাদে শুধু ট্রেনিং করে এলেই তো হয়না, চাই ফিল্ড লেভেলে অভিজ্ঞতা। কিন্তু তবু আমি ডি এম এর সঙ্গে ডিসকাস করে তোমায় ভার দিয়েছি। কারণ আমার মনে হয়েছে তুমি পারবে। কিন্তু আমিও তো অনেকের কাছে আন্সারেবল, তাই না! গোটা সার্ভিস লাইফ সুনামের সঙ্গে কাজ করে এসেছি। শেষ সময়ে এসে সেটায় আমি দাগ লাগাতে দিতে পারিনা।”
“সে তো অবশ্যই, স্যার!” রুদ্র বলল, “তবে তর্কপঞ্চাননের বাড়ির ভিক্টিমের কর্মচারী কিছু ফলস স্টেটমেন্ট দিয়েছে। আমরা তাকে আরও ভালো করে ইন্টারোগেট করছি।”
“তর্কপঞ্চানন?” এস পি ভ্রূ কুঁচকোলেন, “মানে?”
রুদ্র হেসে সঙ্গে সঙ্গে ভুলটা শুধরে নিল, “স্যরি স্যার। আমি ওই ব্রিজেশ তিওয়ারির কথা বলছি। উনি যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেটা এইট্টিন্থ সেঞ্চুরির লেজেন্ডারি পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বাড়ি। আমিও জানতাম না, কিন্তু জানা ইস্তক ইতিহাসের অনেক ঘটনা জানতে পারছি। হি হ্যাড ইনক্রেডিবল ট্যালেন্টস।”
রাধানাথ স্যার একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিলেন। রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইতিহাস ছেড়ে এবার বর্তমানে ফিরে এসো রুদ্রাণী। বুঝতেই তো পারছ। স্বপন সরকার আর হৃষীকেশ জয়সোয়ালের জন্য পলিটিক্যাল পার্টি থেকেও বেশ প্রেশার আসছে। ইতিহাস দেখলেই তুমি নেচে ওঠো তা আমি জানি। কিন্তু এখন এ’সব ঘাঁটার সময় নয়।”
রুদ্র বকুনি খেয়ে চুপ করে গেল। বলল, “রাইট স্যার।”
এস পি বললেন, “নিজেকে অ্যামেচার গোয়েন্দা না ভেবে পুলিশ ভাবো। ফরেনসিক রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে পড়ো। প্রতিটা ওসির সঙ্গে কথা বলে সেই লোকালিটির দাগি ক্রিমিনালদের ম্যারাথন ইন্টারোগেট করতে বলো। প্রয়োজনে ইনফর্মার লাগাও। জয়ন্ত, প্রিয়াঙ্কা, লোকেশ, বীরেন, এদের একেকটা ভাগের দায়িত্ব দাও। দেখবে কিছু না কিছু ঠিক বেরিয়ে আসবে। কয়েকদিন পরেই একটা মিটিং থাকবে, সেখানে একটা উল্লেখযোগ্য প্রোগ্রেস যেন থাকে!”
কথা শেষ করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে স্যার একটা ডায়েরি বের করলেন। সেটা খুলে মেলে ধরলেন রুদ্রর দিকে। পরপর সব খুনগুলোর ডিটেইল লেখা রয়েছে তালিকার আকারে।
হুগলী সিরিয়াল কিলিং কেস :
রুদ্র অন্যমনস্কভাবে দেখছিল লিস্টটা। এটাই ওকে প্রথমদিন ডি এম অফিসে রাধানাথ স্যার দেখিয়েছিলেন।
স্যার বললেন, “এই লিস্টে যেন আর একটাও না রো অ্যাড হয়, মেক শিওর অ্যাবাউট দ্যাট, রুদ্রাণী!”
১৪
গুরুদেব নারায়ণী চতুষ্পাঠীর উচ্চবেদিতে পদ্মাসনে বসেছিলেন। অনুরূপ ভঙ্গিতে বসে ছিল চারটি প্রাথমিক শ্রেণীর ছাত্রেরাও। মধুসূদন, গোবর্ধন ও বংশীধরের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্ররা বসে ছিলেন অদূরে।
গুরুদেব একটা সুদীর্ঘ প্রশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, “আমি বুঝতে পারছি, তোমাদের খুব পরিশ্রম হচ্ছে। তোমরা হয়তো ভাবতে পারো এত কঠিন নিয়মশৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে কেন তোমাদের যেতে হচ্ছে। তার কারণ, যে মহৎ উদ্দেশ্যে বৈদিক সমাজের সূচনা ঘটেছিল, তা চরিতার্থের মাহেন্দ্রক্ষণ ক্রমেই উপস্থিত হচ্ছে। গত কয়েকমাসে গোবর্ধনের মতো উচ্চশ্রেণীর ছাত্রেরা করে দিয়েছে তার শুভারম্ভ। অন্তিম লক্ষ্যপূরণের জন্য আমার প্রয়োজন তোমাদের সকলকে। তার আগে তোমাদের কিছু ঘটনা জানা প্রয়োজন।
গুরুদেব থামলেন। তাঁর ইশারায় বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্রদের একজন দ্রুতপদে চলে গেলেন। অনতিবিলম্ব পরেই ফিরে এলেন বিষ্ণুমন্দিরের প্রসাদ নিয়ে। পরমগুরুর প্রসাদ। সকলকে একটু করে হাতে দিতে লাগলেন তিনি।
প্রসাদপর্ব মিটলে গুরুদেব আবার শুরু করলেন।
“ভগবান বিষ্ণু তিনি প্রতিটি যুগে নানা অবতারে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর প্রথম অবতার মৎস্য। তোমরা কি মৎস্য অবতারের কাহিনী জানো?”
“না গুরুদেব।”
“সত্যযুগে সত্যব্রত নামে এক ধার্মিক রাজা ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে পৃথিবীতে হঠাৎ নানারকম অন্যায় ও অত্যাচার দেখা দেয়। রাজা তখন জগতের সার্বিক কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের করুণা প্রার্থনা করেন। একদিন সত্যব্রত জলাশয়ে স্নান করছেন। একটি অতিক্ষুদ্র পুঁটিমাছ এসে তাঁর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়।
“অনুগ্রহ করে আমাকে রক্ষা করুন হে রাজন। নাহলে অচিরেই জলাশয়ের বৃহৎ মাছেরা আমায় খেয়ে ফেলবে।”
রাজা সত্যব্রতর দয়া হল। তিনি একটি কমণ্ডলুতে করে মাছটাকে বাড়ি নিয়ে এলেন। কিন্তু পুঁটিমাছটির আকার ভীষণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। কমণ্ডলু ছাড়িয়ে বড় পাত্র, পাত্র ছাড়িয়ে স্নানাগারের জলাধার, জলাধার ছাড়িয়ে পুকুর, সরবর, নদী, যেখানেই তাকে রাখা হয়, আয়তনে ধরে না।
রাজা বুঝতে পারলেন, ইনি নিশ্চয়ই ভগবান বিষ্ণু তাঁর কাতর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে মৎস্যরূপে পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁর স্তবে তুষ্ট হয়ে তখন মৎস্যরূপী বিষ্ণু বললেন, “গোটা বিশ্ব অনাচারে ভরে গেছে। তাই সাতদিনের মধ্যেই শুরু হবে মহাপ্রলয়। বিনষ্ট হবে বর্তমান সমস্ত কিছু। নতুন করে সবকিছু শুরু হবে ধরাধামে। প্রলয় শুরুর আগে একটি স্বর্ণতরী এসে তোমার ঘাটে ভিড়বে। তুমি সবরকমের প্রাণীযুগল ও সবপ্রকারের খাদ্যশস্য, বৃক্ষবীজ নিয়ে সেই স্বর্ণতরীতে আরোহণ করবে। আমি শৃঙ্গরূপী মৎস্য হয়ে প্রলয় শুরু করব। আমার শৃঙ্গের সঙ্গে তুমি তোমার তরীখানি বেঁধে রাখবে। প্রলয়শেষে যখন সব শান্ত হয়ে যাবে, অন্যায়মুক্ত পৃথিবীতে তোমার নৌকোয় থাকা সব প্রাণের আবার নবোন্মেষ ঘটবে।”
দ্বারিকার মন টিকছিল না। গুরুদেবের রক্তহিম চাহনি ওর ওপর বর্ষিত হতে পারে জেনেও ওর মন বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। আজ দুদিন হয়ে গেল অচ্যুতের কোনো সন্ধান নেই। কালু কৈবর্তের দল কোথায় নিয়ে গেল ওকে?
এই প্রশ্নটা যতবার ওর মনের মধ্যে আসছে, ততবার ওর গলায় একটা চাপা কষ্ট দলা পাকাচ্ছে। অচ্যুতের আপনার বলতে এই গোটা সমাজে কেউ নেই, তাই ওর নিরুদ্দেশ নিয়ে কেউ বিচলিতও নয়।
কিন্তু দ্বারিকা? দ্বারিকা যে অচ্যুতকে বড় ভালোবাসত! এই দমবন্ধ করা সমাজে অচ্যুতই ছিল একমাত্র মানুষ, যার কথা শুনলে ভয় করত, কিন্তু একইসঙ্গে শিহরণ জাগত গোটা শরীরে। সব ভয় সরিয়ে ইচ্ছে হত স্বপ্ন দেখার।
দ্বারিকা এমনিতে ভিতু হলেও অসীম সাহসে ভর করে গতকাল বিকেলে গিয়েছিল কৈবর্তদের পাড়ায়। কালু কৈবর্তের দলে একটা ছেলে আছে, তার নাম নিশাদ। নিশাদ ওদেরই বয়সি, জরা নদীতে মাছ ধরে। ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করেছিল দ্বারিকা। কলাপাতায় মুড়ে অনেকটা ক্ষীরও নিয়ে গিয়েছিল লুকিয়ে।
ছেলেটা ক্ষীরটা চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছিল, তারপর বলেছিল, “উসব আমি জানেক লাই রে। উ ছিলাডারে শ্মশানপানে লিয়ে গেছল, ইটুকু শুধু জানি।”
শ্মশান? দ্বারিকার বুক কেঁপে উঠেছিল। শ্মশানে কেন? অচ্যুতকে কি পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে? লঘু পাপে গুরু দণ্ড নয় কি? শ্মশানের ওদিকে তো যাওয়া অসম্ভব, কীভাবে ও জানবে ওর প্রিয়বন্ধুর পরিণতি?
গুরুদেবের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে দ্বারিকা আবার বর্তমানে ফিরে এল।
“ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,
অহং সর্বস্যপ্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধাভাবসমন্বিতাঃ।।*
শ্লোকটা উচ্চারণ করে গুরুদেব বনমালীকে ইঙ্গিত করলেন, “এর মর্মার্থ প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করো তো বাবা।”
বনমালী উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য গলা পরিষ্কার করে বলল, “আমি জড় এবং চেতন— দুই জগতেরই সমস্ত কিছুর উৎস। সমস্ত কিছুই আমার থেকে প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে যারা শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন, তাঁরাই যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী।”
“বাহ, অতি উত্তম।” গুরুদেব বললেন, “বাবাসকল, একটা কথা ভালো করে বোঝো, ভাগবতপুরাণে বলা হয়েছে, কৃষ্ণস্তু ভগবানস্বয়ম শ্রীকৃষ্ণই বিষ্ণু বিষ্ণুই শ্রীকৃষ্ণ। শুধু তাই নয়, ভগবান বিষ্ণু শিব—ব্রহ্মা—আদি সকলের উৎস।
ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষিনাং চ সর্বশঃ।”*
“বুঝতেই পারছ, যখনই মর্ত্যলোক পাপিষ্ঠ ও অশুভ লোকে ভরে গিয়েছে, ভগবান বিষ্ণু তখনই কখনো মৎস্য, কখনো বরাহ, কখনো কূর্ম অবতারে আবির্ভূত হয়েছেন। বিনাশ করেছেন সমস্ত দুষ্ট শক্তিকে। কখনো তিনি পরশুরাম, কখনো তিনিই রাম। আবার কখনো তিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।” গুরুদেবের মেঘমন্দ্র স্বর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা চাতালে।
____
* ভগবদগীতা ১০/৮
* দেবতারা বা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন না। কারণ আমি দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ। – ভগবদগীতা — ১০/২