গ্রীসের গৌরব
প্রাচীন গ্রীস। কী অপরূপ গৌরবের সভ্যতা। গ্রীকদের কীর্তিকলাপের কথা বুঝি শতমুখে বলেও ফুরোয় না। ছেনি আর হাতুড়ি হাতে সাদা পাথরের বুকে ওরা যেন প্রাণের স্পন্দন জাগিয়ে তুলতে পারতো, এমনই আশ্চর্য ওদের মূর্তি গড়বার কায়দা। ওদের লেখা কবিতার বই আর নাটক পড়তে পড়তে আজকের দিনের মানুষও মুগ্ধ হয়ে যায়, ওদের লেখা জ্ঞানের কথা পড়তে পড়তে আজকের দিনের পণ্ডিতরাও অবাক হয়ে যান। আর বিজ্ঞান-বিজ্ঞানের বেলাতেও ওদের জুড়িদার খুব কমই হয়েছে।
এদিকে যুদ্ধ বলো, রাজনীতি বলো, ব্যবসা বলো, বাণিজ্য বলো, কোথাও ওরা পিছ-পা ছিলো না। যুদ্ধে ওরা ট্রয়কে হারিয়ে প্রায় একেবারে শেষ করে দিয়েছিলো, পারস্য দেশ থেকে বিশাল সৈন্যবাহিনীর ঢেউ ওদের ওপর বারবার আছড়ে পড়েছে, তবুও হটাতে পারে নি ওদের। সওদাগরিতেই বা ওদের সঙ্গে পাল্লা দেবে কে? ওদের সওদাগররা বড়ো বড়ো নৌকায় পাল খাটিয়ে কতো দূর-দেশ পর্যন্তই না পাড়ি দিতে পারতো! আর রাজনীতি? গ্রীকরাই প্রথম দেখিয়ে দিলো রাজাকে বাদ দিয়েও কেমন করে রাজত্ব চালানো যায়। গ্রীসের ছোটো ছোটো শহরগুলো কেমন করে শাসন করা হতো শুনলে অবাক হয়ে যাবেঃ শহরের সমস্ত বাসিন্দা জমায়েত হতো মাঠে বা হাটবাজারের পাশে, আর সেখানে সবাই মিলে সাব্যস্ত করতো কেমন করে চালাতে হবে শহরটার শাসন । সাধারণ লোকের মত নিয়ে দেশের কাজ চালানোকে বলে গণতন্ত্র; গ্রীসের ছোটো শহরগুলোতেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম গণতরের পরিচয়।
অথচ, দেশটা সত্যিই এমন কিছু সুজলা-সুফলা নয়। বরং রুক্ষ অনুর্বর দেশ, পাহাড় আর পাথর আর কঠিন মাটি। তাই পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করবার দায়টা অনেক বেশি। নীল নদ কিংবা গঙ্গা আর সিন্ধুর কিনারায় সভ্যতা গড়বার জন্যে যতোখানি মেহনত দরকার
তার চেয়ে অনেক বেশি মেহনত দরকার পড়েছিলো গ্ৰীক সভ্যতা গড়ে তোলবার জন্যে। আর যদি তাই হয় তাহলে ওরা অমন আশ্চর্য শিল্প, অমন নাটক আর কবিতা, অমন গভীর জ্ঞানের চর্চায়। এতোটা মন দিতে পারলো কেমন করে? কেমন করে ওরা সময় পেলো রাজনীতি নিয়ে অতো মাথা ঘামাবার, সাগর পাড়ি দিয়ে আমন সওদাগরি জমাবার, যুদ্ধ-বিগ্রহের ব্যাপারে আমন অসাধারণ ওস্তাদ হয়ে ওঠাবার? আমন রুক্ষ দেশে নিছক বেঁচে থাকবার জন্যেই যতোটা মেহনত দরকার সেই মেহনত করতেই তো মুখে রক্ত ওঠবার কথা।
এইসব ভেবেচিন্তে অনেকে বলেন, ওরা—ওই গ্রীকরা—সত্যিই বুঝি এক সৃষ্টিছাড়া জাত ছিলো। তাই এমন রুক্ষ দেশের বাসিন্দা হয়েও সভ্যতার যেটা সবচেয়ে চোখধাধানো দিক, সেই দিকে কতোই না মন দিতে পেরেছিলো!
হয়তো সত্যিই তাই। ওদের প্রতিভা সত্যিই ছিলো অসামান্য। কেননা, অমন রুক্ষ দেশের বাসিন্দা হয়েও ওরা এমন এক ব্যবস্থা করে নিয়েছিলো যার ফলে বাঁচবার জন্যে যে মেহনতের দায় তার একটুখানিও ওদের নিজেদের ঘাড়ে পড়লো না। ঘরকন্নার কাজ থেকে শুরু করে পশুপালন, হরেক রকম জিনিসপত্তর তৈরি করা আর এমন কি সেই জিনিসপত্তরগুলো নিয়ে সওদাগরি করতে যাওয়া—কোনো কিছুর দায়ই ওরা নিজেরা ঘাড়ে নেয় নি। আর তাই অতো ঢালাও অবসর, সুক্ষ আর শৌখিন ব্যাপারগুলোর দিকে অতোখানি মন দিতে পারা।
মেহনতের দায়টা তাহলে কাদের ঘাড়ে? অন্য একদল মানুষের ঘাড়ে। তারা গ্রীক নয়। তাদের নাম ক্রীতদাস। আর গ্রীকরা বলতো, ওরা— ওই ক্রীতদাসরা-ঠিক মানুষ নয়। কিংবা মানুষ দু-রকমের, এক হলো স্বাধীন গ্ৰীক আর এক হলো ক্রীতদাস। গ্রীকদের মধ্যে একজন মস্ত বড়ো পণ্ডিতমশাই ছিলেন, তার নাম অ্যারিস্টটল। তিনি বলতেন, ক্রীতদাসদের জন্মই হয়েছে গতর খাটাবার জন্যে, শুধু মুখ বুজে মেহনত করবার জন্যে। গ্রীকদের প্রতিভা সত্যিই অসামান্য ছিলো : কেননা ওদের আগে পর্যন্ত আর কোনো সভ্যতার বেলাতেই মেহনত করবার সমস্তটুকু দয়া অমনভাবে ক্রীতদাসদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার পথ বের হয় নি। অবশ্য আমাদের দেশের শূদ্রদের কথাও এখানে মনে রাখতে হবে। তাই গ্ৰীকদের সমাজকে বলে দাস-সমাজ। অথচ, গ্ৰীক সভ্যতার কথা ভাবতে গেলে সত্যিই ভুললে চলবে না। ওই ক্রীতদাসদের কথা। ওদেরই কঙ্কাল দিয়ে গাথা হয়েছে আমন অপরূপ আর আশ্চৰ্য / সভ্যতার ভিত্তি।
সত্যিই ভারি আশ্চর্য সভ্যতা এই গ্ৰীক সভ্যতা, আশপাশের অন্ধকারের মধ্যে যেন প্রদীপের মতো জ্বলজ্বল করছে, আর সেই প্রদীপের আলো দু-তিন হাজার বছরের ফাঁক পেরিয়েও আমাদের চোখ পর্যন্ত ঠিকরে আসে, আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অথচ,
প্ৰদীপ জ্বালতে গেলে তেল পোড়াতে হয়। ওদের বেলায় তেল ছিলো এই লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাসের জীবন, তাদের জীবন তিলে তিলে ক্ষয়ে গিয়েছে, শেষ হয়ে গিয়েছে, আর তবেই জ্বলে উঠেছে। ওদের সভ্যতার অমন উজ্জ্বল আলো!
কিন্তু এতো ক্রীতদাস ওরা জোটালো কোথা থেকে? মনে রাখতে হবে, এই রকম ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করে নেবার জন্যে ওদের পক্ষে অনেক অনেক দিন সময় লেগেছিলো। গ্রীকরা যখন অসভ্য অবস্থায় ছিলো তখন থেকেই একটা কাজে ওরা দারুণ ভালো হাত পাকিয়েছিলো, সে-কাজ হলো যুদ্ধের কাজ। আর যুদ্ধের কাজে অমন পাকা বলেই আশপাশের নানান জাতিকে ওরা অনায়াসে হারিয়ে দিতে পেরেছে, পেরেছে পালে পালে ক্রীতদাস জোগাড় করতে।
এইখানে আবার আগেকার একটা কথা মনে করিয়ে দিই। মানুষের গল্পকে ভুল বুঝে না। ক্রীতদাসদের মেহনতের ওপর অমন নির্মমভাবে নির্ভর করেছিলো বলেই গ্ৰীক সভ্যতাকে খাটো করতে যাবার কোনো মানে হয় না। মনে রেখো, তখনকার অবস্থাটা ছিলো তখনকার মতো অবস্থাই। সে-অবস্থায় ক্রীতদাসদের মেহনতের ওপর অমনভাবে নির্ভর করতে না পারলে সভ্যতার আমন আশ্চর্য কীর্তি সম্ভব হতো কি?
গ্রীক সভ্যতা মানুষের ইতিহাসে যে অপরূপ ঐশ্বর্য দিয়ে গিয়েছে তার তুলনা সত্যিই খুব কম। বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, রাজনীতি । কতোই না। অবশ্যই এ-সভ্যতার ভিত্তিতে ছিলো ক্রীতদাসদের নির্মমভাবে শোষণ করবার ব্যাপার। সে-কথা ভুলে যাওয়া যে-রকমের ভুল হবে, সেই রকমেরই গলদ হয়ে যাবে। যদি শুধু সেই কথাটুকুই মনে রাখো, আর গ্রীক সভ্যতার অন্য দিকগুলোর কথা যাও ভুলে। গ্রীকদের ঘরে বিজলিবাতি আবিষ্কারই হয় নি, আবিষ্কারই হয় নি। উড়োজাহাজ। আর ঠিক তেমনিভাবেই, তখনকার কালে ওদের পক্ষে ক্রীতদাসের মেহনত বাদ দিয়ে আমন আশ্চর্য সভ্যতা গড়ে তোলবার মতো অবস্থারই সৃষ্টি হয় নি।
আরো একটা কথা আছে। আজকের মানুষ যে এতোখানি। ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছে তা তো আর রাতারাতি হবার মতো নয়। তার জন্যে এগুতে হয়েছে ধাপেধাপে, অনেক দুঃখ আর অনেক হাহাকারের অন্ধকার ঠেলে ঠেলে। এ ছাড়া এগুবার আর কোনো পথই হয় না, সম্ভবই নয়।
আজকের মানুষের সামনে এক বিরাট বিশাল ভবিষ্যৎ— যেন আলোয় ঝলমল, আনন্দে টলমল। কিন্তু অতো বছর আগে মানুষের সামনে অমন ভবিষ্যৎ কোথায়? আর ওই দাস-সমাজকে পেরিয়ে আসতে মানুষ যদি রাজি না হতো তাহলে আজকের এই অবস্থায় পৌছানো তার পক্ষে সম্ভবই হতো না? তাই ক্রীতদাসের মেহনত লুঠ করবার নির্মম কাহিনী ভুলে যাওয়া যে রকম ভুল হবে সেই রকমই ভুল হয়ে যাবে গ্রীক সভ্যতার সমস্ত মূল্য উড়িয়ে দিতে যাওয়া।