গ্রামের নাম গোপাইরবাগ
যেমন আমার মনে আছে, আমাদের বাল্য ও কৈশোরে বাবা আমাদের প্রতি বছর দিন পনেরোর জন্য দেশের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। সেই সব দিনের স্মৃতি আজও আমার মনে আশ্চর্য রকম উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। আমাদের গ্রামের নাম গোপাইরবাগ। তখন ছিল রামগঞ্জ থানায়। এখন নতুন প্রশাসনিক বিন্যাসে এটা পড়েছে চাটখিলে। আমার মনে আছে, ১৯২০-এর দশকের শেষ ও ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে আমাদের গায়ের পাশ দিয়ে জেলা বোর্ডের রাস্তা চলে গিয়েছিল। কাঁচা কিন্তু বেশ ভাল রাস্তা। গরুর গাড়ি, পায়ে হাঁটা মানুষ ও সাইকেলই বেশির ভাগ সময় চলাচল করত। তবে শীতের মৌসুমে কালেভদ্রে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে দু’একটা মোটরগাড়িকেও আমরা চলাচল করতে দেখেছি। ওই রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল একটা খাল। সারা বছর পানি থাকত সেখানে। খালের ওপর ছিল একটা সরু বাঁশের সাঁকো। প্রথম দিকে ভয় করত, পরে তরতর করে সাঁকো পার হয়ে ওপারে চলে যেতাম। আমাদের গ্রাম থেকে সব চাইতে কাছে যে রেল স্টেশন ছিল তার দূরত্ব প্রায় সাত-আট মাইল। সোনাইমুড়ি। কী চমৎকার নাম, তাই না? সোনালি রঙের মুড়ি? গুড় মাখালেই তো তাই হয়। ছেলেবেলায় আমরা দেশের বাড়ি গেছি দু’ভাবে। চাঁদপুর পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে সেখান থেকে বেশ বড় সুন্দর নৌকা বন্দোবস্ত করে একেবারে বাড়ির কাছে খালের পাড়ে গিয়ে থেমেছি। নদীর বুকে আমাদের সে কী ফুর্তি! বন্দরে-গঞ্জে নৌকা থামিয়ে বাজার করা হচ্ছে, চাল-ডাল, তরিতরকারি, নদীবক্ষে সরাসরি জেলে নৌকা থেকে কেনা হচ্ছে সদ্যধৃত মাছ, নৌকাতেই রাঁধাবাড়া হচ্ছে, খেতে বসে মনে হতো যেন অমৃত। নদী তীরে গ্রাম জীবনের কত ছবি। নৌকা যখন আমাদের গাঁয়ের দশ-পনেরো মাইলের মধ্যে এসে পৌঁছত তখনই কেমন করে যেন বাবা যে বার্ষিক ছুটি কাটাতে দেশে আসছেন সে খবর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ত। মাঝে মাঝেই খালের পাড়ে লোকজন এসে দাঁড়াতেন, বাবা মাঝিদের নৌকা থামাতে বলতেন, তাঁদের সঙ্গে প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময় এবং বাক্যালাপ করতেন। কিন্তু এর চাইতেও অন্য এক স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বলতর হয়ে জেগে আছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের সেই ছবি যেন আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। খালের পাড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এসে জড়ো হয়েছে। নৌকার ছইয়ের নিচ থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আমার ছোট ভাই মুনীর, আর বাবা। গাঁয়ের সাধারণ মানুষের জীবনে সেদিনও প্রাচুর্য বা সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু সে জীবন কিছুতেই আজকের মতো এতটা হতশ্রী, নিরানন্দ ও দারিদ্র্যলাঞ্ছিত ছিল না। খালের পাড়ে যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসে জড়ো হতো তাদের বেশির ভাগের মুখেই থাকত ঝলমলে হাসি, চোখে ঔৎসুক্য ও কৌতুকের ছটা, কণ্ঠে আনন্দিত কলকাকলি। বাবা নৌকা থামাতে বলতেন, ভেতর থেকে একটা বড় টিন নিয়ে আসতেন। সেই টিনে থাকত সেকালের বিখ্যাত সুস্বাদু জনপ্রিয় চ্যাপ্টা গোল বিস্কুট। বেলা বিস্কুট। বাবা ছেলেমেয়েদের হাতে বিস্কুট তুলে দিতেন কেউ কেউ লাজুক মুখে, হৈ চৈ করতে করতে, তাঁর হাত থেকে বিস্কুট গ্রহণ করত। তুলনাহীন আঞ্চলিক ভাষায় বাবার সঙ্গে কথা বলত, তিনিও সে ভাষাতেই তাদের … সঙ্গে আলাপ করতেন। তারপর আমাদের নৌকা আবার এগিয়ে যেত আমাদের বাড়ির দিকে। গ্রামে পৌঁছে খালের পাড়ে নৌকা থেকে নেমে বাড়ি অবধি যাবার জন্যে আমাদের অল্প একটু পথ হেঁটে যেতে হতো। বাড়ির সীমানায় এসে প্রথমেই চোখে পড়ত পারিবারিক গোরস্তান। গাছগাছালিতে ঢাকা, পুকুরের এক পাড়ের পাশে, লম্বা টানা আকারের। নিতান্ত অনাড়ম্বর ঘরোয়া গোরস্তান, মার্বেল বাঁধাই নেই, মার্বেল ফলক নেই। অধিকাংশ কবরই সবুজ ঘাস আর মাটি দিয়ে ঘেরা, কারো কারো কবরের চারপাশে দু’একটি পাতাবাহার ও ফুলের গাছ। এইখানেই শুয়ে আছেন আমাদের কয়েক পূর্বপুরুষ। বাবা বাড়িতে ঢোকার আগে এখানে দাঁড়িয়ে কবর জেয়ারত করতেন, দোয়াদরূদ পড়তেন, হাত তুলে প্রার্থনা করতেন। আমরাও তার সঙ্গী হতাম। এত বছর কেটে গেছে, এক দশকে এক দিনও এসব কথা মনে পড়ে কিনা সন্দেহ, কিন্তু আজ লিখতে বসে স্মৃতির গভীর থেকে তুলে আনতে গিয়ে দেখি যে তা অক্ষয় ও অমলিন হয়ে টিকে আছে। নদীপথে নৌযান ছাড়াও আমরা কখনো কখনো দেশে গেছি সোনাইমুড়ি পর্যন্ত ট্রেনে, তারপর ধূলিধূসরিত জেলা বোর্ডের সড়ক ধরে গরুর গাড়িতে। সে আরেক অভিজ্ঞতা। একবার কুয়াশাঘেরা শীতের সকালে মাথায় চাদর জড়িয়ে ওই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলাম সেকথা স্পষ্ট মনে আছে। রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার চাদর, গলার মাফলার, গায়ের সোয়েটার সব একে একে খুলে ফেলে হাতে নিতে হয়েছিল। কত বয়স তখন আমার? বারো-তেরোর বেশি নয়। খুবই কষ্ট হয়েছিল বলে তো মনে পড়ছে না। পথে পথে থেমেছি, গৃহস্থ বাড়ির উঠানে বসে বিশ্রাম করেছি, গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা ডাবের পানি ও তার ভেতরকার সর খেয়েছি। সেবার বাবা সঙ্গে ছিলেন না। সহযাত্রী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনরত আমার এক চাচাতো ভাই। নোয়াখালীর স্মৃতি মানেই আমার কাছে মূলত দেশের বাড়ির স্মৃতি, যৌথ পারিবারিক জীবনের স্মৃতি। দশ-বারো বছরের বালক আমি, নিজেকে মনে করতাম রীতিমতো বড়। অথচ চাচী-জেঠি-ফুফুরা জোর করে কোলে বসাবেন, হাত দিয়ে চিবুক তুলে ধরে গালে চুমু খাবেন, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করবেন। দারুণ অস্বস্তি বোধ করতাম, কিন্তু মধ্যে যে কী গভীর স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকত তা সেই অপরিণত বয়সেও বুঝতে ভুল হতো না। আমার মেজ জেঠিমা ছিলেন নিঃসন্তান। লম্বা-চওড়া, কালো রঙ, দেখতে তেমন ভাল নন, কিন্তু অসম্ভব ভাল মানুষ ও অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ। আমি রাতে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানাতেই ঘুমাতাম। কত গল্প করতেন, পুঁথির কাহিনী — ইমাম হানিফা, বিবি সোনাভান, কারবালার গল্প। ভারি সুন্দর দেখতে আমার এক তরুণী চাচাতো বোন ছিলেন, ফাতিমাবু’। ফর্শা রঙ, ঢলঢলে মুখ, ঠোঁটের কোনায় সব সময় একটা মিষ্টি হাসি। আর আমার আরেক চাচাতো বোন ছিলেন, বিবাহিতা তিনিও খুব সুন্দর ছিলেন দেখতে। মাহমুদাবু’। সংসারকর্মে অত্যন্ত নিপুণ, খুব গোছালো আর পরিশ্রমী। আমি আর মুনীর একবার মাইল তিনেক হেঁটে তাঁর ওখানে বেড়াতে যাই। আমাদের পেয়ে তার খুশি আর ধরে না। তখনই তার ধীর স্থির স্বামীকে ডাকাডাকি করে অস্থির করে তুলেছিলেন। গাছ থেকে ডাব পাড়াতে হবে, ঝাঁকি জাল ফেলে পুকুর থেকে মাছ ধরাতে হবে, মুরগি জবাই করতে হবে, এখুনি ছুটে গিয়ে বাজার থেকে এটা ওটা কিনে আনতে হবে। বুবু নিজে যেন তখন দশভুজা। নারকেল কুড়িয়ে বাটিতে করে চিড়া আর গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন। তরতর করে কাঠবিড়ালীর মতো মই বেয়ে উপরে উঠে ঘরের মাচা থেকে শুকনো তালশাঁস পেড়ে এনে বঁটি দিয়ে দুভাগ করে খেতে দিচ্ছেন। এক ফাঁকে উনুনের সামনে বসে রান্না শুরু করে দিয়েছেন, আর আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন, শহরের নানা খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন। আমার ওই বোন অনেক দিন আগে মারা গেছেন। তাঁর কথা প্রায়ই মনে পড়ে, যদিও খুব বেশি তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আমার হয়নি। শৈশবের নোয়াখালীর স্থস্মৃতিতে মনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে পুকুর ঘাট, নারকেল-সুপারির বাগান, বাঁশবন, টানা জাল দিয়ে মাছ ধরা, ছিপ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা, দিনের মধ্যে দশবার ডাব খাওয়া, সকালে খেজুরের রস, মাঝে মাঝেই হরেক রকম পিঠা, রাত্রিবেলায় কুপির ম্লান আলোয় পুঁথি পড়া, পুকুরের অপর পাড়ে মসজিদে মিলাদ-মাহফিল। সন্ধা রাত্রেই সব কিছু নিঝুম হয়ে যেত। ঝিঁঝিঁর একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে রাত্রের পাখির ডাক ও পাখা ঝাপটানি, এমনকি শিয়ালের হুক্কা হুয়া ধ্বনিও যেন আজও কানে বাজে। আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল বারুইদের পাড়া। সেখানে তাদের ঠাণ্ডা ছায়াছায়া পানের বরজের ভেতর দিয়ে হাঁটতে যে কী ভালোই লাগত। কয়েক বছর আগে যখন গ্রামে গিয়েছিলাম তখন তাদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম যে ওরা বহু দিন আগেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
আমাদের ছেলেবেলায় জেলাটির নাম ত্রিপুরা-ই ছিল। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকরা বলত টিপারা। ওই রকম অনেক কাণ্ডই তারা করেছে। কলকাতা হয়েছে ক্যালকাটা, বর্ধমান বার্ডওয়ান, ময়মনসিংহ মাইমেনসিঙ্গ, চট্টগ্রাম চিটাগঙ্গ। টিপারা নামকরণের ক্ষেত্রে, কে জানে হয়ত ইট ইজ এ লঙ্গ ওয়ে টু টিগারারি গানের অনুরণন তাদের মনে একটা দোলা জাগিয়েছিল। পরে জেলার নাম আর ত্রিপুরা থাকেনি, কুমিল্লা হয়ে গিয়েছিল। আমার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে ত্রিপুরা তথা কুমিল্লা জেলায় আমার নানাবাড়ি আর মামাবাড়িকে ঘিরে। নানাবাড়ি হলো ত্রিপুরা জেলার মুরাদনগর থানার ভুবনঘর গ্রামে। গ্রামের নামটি কী সুন্দর। স্কুলে পড়ার সময়ই বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী পড়া হয়ে যায়। নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের নাম মনে গেঁথে আছে। ভুবনঘর নামটি তার চাইতে কম আকর্ষণীয় নয়। মা আমাদের নিয়ে প্রায় নিয়মিতভাবে, বছরের একবার না হলেও এক বছর অন্তর অন্তর, ভুবনঘরে যেতেন, দু’তিন সপ্তাহের জন্য। দাদাবাড়ির তুলনায় আমাদের নানাবাড়ি ছিল অনেক বেশি জমকালো।