গ্রামগবেষণার পথিকৃৎ – নিশীথরঞ্জন রায়
সদ্য লোকান্তরিত সুধীরকুমার মিত্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যে কথাটি আমাদের সর্বাগ্রচিত্রে মনে পড়ে তা মহাত্মাজির একটি উক্তি। দেশবন্ধু দাশের পরলোকগমনের অব্যবহিত পরেই তিনি লিখেছিলেন—“A brother does not sing the praises of his father’s son.”। আমরা দু-জন—সুধীরকুমার ও আমি স্বল্পকালের ব্যবধানে জন্মেছিলাম। বয়সের হিসাবে তিনি কিছু এগিয়ে ছিলেন। তাই তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার পর থেকেই তাঁকে অগ্রজের সম্মান দিয়ে এসেছি। অবশ্য তাতে বন্ধুত্ব কিংবা অন্তরঙ্গতা এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি। যতই তাঁকে দেখেছি ততই মনে হয়েছে তাঁর কাছাকাছি এলেও আমরা রয়ে গিয়েছি কিছুটা দূরত্বে। তাঁর উদারতা আর বিনয়ের কাছে হারমানা ছাড়া উপায় ছিল না আমাদের। তাঁর ব্যক্তিসত্তা ছিল অন্তর্মুখী। সংসারের কলকোলাহলে থেকেও তিনি নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখে নিজের অন্তরে এবং পরিজনের সঙ্গে বসে সৃষ্টি করেছিলেন এক স্বতন্ত্র জগৎ—সেখানটি অন্যদের পক্ষে সহজগম্য ছিল না। এ-রকমটি সাধকপুরুষের পক্ষেই সম্ভব। সুতরাং এই গুণটি ছিল সুদুর্লভ, অথচ সুধীরকুমার ছিলেন এই সুদুর্লভ গুণের অধিকারী। আত্মস্থ সাধক নিজের নিরলস সাধনার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের সার্থকতা।
বাঙালির গড়পড়তা আয়ুর সীমা অতিক্রম করেছিলেন সুধীরকুমার। চুরাশি বছর বয়সে তিনি লোকান্তরিত হলেন। দীর্ঘকাল একটানা রোগভোগের কষ্টও ভোগ করতে হয়নি তাঁকে। সর্বোপরি যে কোনো সৃজনধর্মী গবেষক এবং সাহিত্যসেবীর পক্ষে একজীবনে যতখানি ফসল সংগ্রহ করা এবং তুলে ধরা সম্ভব সুধীরকুমার অতি কঠোর নিক্তির বিচারেও তাঁক বহু গুণে সক্রিয় করেছিলেন। সুতরাং তাঁর জন্য ক্ষোভ করব না; বরং বিধাতাপুরুষকে বলা—সুধীরকুমারের মাধ্যমে আমরা অনেক পেয়েছি।
তবু দুঃখ বোধ করি। তার কারণ এই যে, তিনি আমাদের যতখানি দিয়ে গেলেন তার প্রতিদান পাঠকগোষ্ঠীর কাছ থেকে পেলেও তিনি পেলেন না যারা সরকারের উঁচু মহল থেকে গোটা পশ্চিমবঙ্গবাসীর পক্ষে পুরস্কারের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেন সাহিত্যসেবীদের। আজন্ম বৈষ্ণব সুধীরকুমার ছিলেন মান-অভিমান বর্জিত। প্রত্যাশাকে তিনি কোনোমতেই আমল দেননি। আত্মনিবিষ্ট হয়ে তিনি যাপন করে গিয়েছেন নিষ্কাম সাহিত্যসেবীর আদর্শ জীবন। সংসারধর্ম পালন করে গেছেন সুধীরকুমার। রেখে গিয়েছেন তাঁর কৃতী পুত্র-কন্যাদের। তবু সংসারের অবিচলতা পরিহার করে তাঁর সাধনায় অবিচলিত থাকার দুর্লভ বিদ্যা তিনি সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেছিলেন।
সুধীরকুমার গজদন্তমিনারবিহারী সাহিত্যসাধক ছিলেন না, তাঁর ইতিহাসচেতনাকে তিনি শুধু কাগুজে উপাদানের মধ্যেই সীমিত রাখেননি। তাঁর রচিত যেকোনো গ্রন্থ পড়লেই বোঝা যায়, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কত গভীর আর ব্যাপক ছিল তাঁর বিচরণ। অথচ তিনি গ্রন্থভিত্তিক তথ্যের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। গ্রন্থভুক্ত হয়নি বহু মূল উপাদান—চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির অনুসন্ধান করেই তিনি নিশ্চেষ্ট থাকেননি। এগুলির যথাযোগ্য সদব্যবহার করে ইতিহাসের বহু স্বল্পজ্ঞাত তথ্যের উপর তিনি নতুন আলোকপাত করেছেন। বহু ক্ষেত্রে নতুন সিদ্ধান্তেও উপনীত হয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও ছিল ইতিহাসের পক্ষে অপরিহার্য বহু মূল্যবান তথ্য সংবলিত উপাদান।
সুধীরকুমারের তথ্য আহরণের ক্ষেত্রে শুধু ইংরেজি, ফারসি এবং বাংলা ভাষায় লেখা তথ্য উৎসের মধ্যেই সীমিত ছিল না। ইংরেজ ছাড়া অন্যান্য যেসব বিদেশি জাতি বাণিজ্যের লোভে ভারতে এসেছিল—পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি সূত্রে যে ধরনের মূল্যবান উপাদান পাওয়া যায়, বিশেষত এদের মানচিত্র এবং নকশা তারও যথাযথ সদব্যবহার তিনি করেছেন। মনে রাখা দরকার যে, এখন বিদেশি উপাদান যত শহরে পাওয়া যায়, সুধীরকুমার যখন হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ শীর্ষক গ্রন্থটি রচনার সূত্রপাত করেন, তখন এই ধরনের সূত্র সহজলভ্য ছিল না। আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে সুধীরকুমারের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তিন খন্ডে রচিত এই বিপুলায়তন গ্রন্থটি। বইটিকে শুধু আঞ্চলিক ইতিহাস বলে চিহ্নিত করলে গ্রন্থটির প্রতি অবিচার করা হবে। বস্তুত এতে রয়েছে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্রসারিত একটি যুগের ইতিহাস; যা অবলীলাক্রমে উত্তীর্ণ হয়েছে বৃহত্তর বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের স্তরে। এই বিষয়টি সম্পর্কে যারা বিস্তৃততর গবেষণা করতে আগ্রহী তাদের কাছে সুধীরকুমার আজও পথপ্রদর্শক। হুগলি জেলা ও বঙ্গীয় সমাজকে তিনি উপস্থাপনা করেছেন ভারতবর্ষের বৃহত্তর পটভূমিকায় যা সচরাচর দেখা যায় না। ইতিপূর্বে সতীশচন্দ্র মিত্র (যশোহর ও খুলনা জেলার ইতিহাস), নিখিলনাথ রায় (মুর্শিদাবাদ কাহিনী), যোগেশচন্দ্র বসু (মেদিনীপুর ইতিহাস) এবং যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (ঢাকা ও বিক্রমপুরের ইতিহাস) আঞ্চলিক ইতিহাসকে যে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন সুধীরকুমার, সেই মর্যাদার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে গেলেন তার এই অনুপম রচনাটির মাধ্যমে।
সুধীরকুমার ‘প্রোফেসন্যাল’ ইতিহাস বিজ্ঞানী ছিলেন না কিন্তু তাঁর কীর্তি ইতিহাসানুরাগী বিদ্বজ্জনমাত্রেরই অকুন্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছে। তার প্রধানতম কারণ এই যে, তিনি দলিল দস্তাবেজ সংক্রান্ত উপাদানের উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন না। রাজবৃত্তের পরিবর্তে তিনি পরিবেশন করতে আগ্রহী ছিলেন দেশের সমাজজীবন এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়। তিনি গ্রামে-গঞ্জে দীর্ঘকাল পরিক্রমা করে একদিকে যেমন সংগ্রহ করেছেন অসংগৃহীতপূর্ব বহু নির্ভরযোগ্য উপাদান, অন্যদিকে তিনি ব্রাহ্মণসমাজ এবং লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্যের সাক্ষাৎ পরিচয়ও পেয়েছিলেন। তৃণমূল পর্যায়ে এই বিবরণ তাঁর ঐতিহাসিক উপকরণে যোজনা করেছিল নতুন মাত্রা। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক কালে যে অক্লান্তকর্মী গবেষকের কথা প্রাসঙ্গিক—তিনি লোকান্তরিত রাধারমণ মিত্র।
সুধীরকুমার তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন কাব্যচর্চার মাধ্যমে। বারো বছর বয়সেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় তাঁরই সম্পাদিত হাতে লেখা তুবড়ি পত্রিকায়। পরে আরও কবিতা রচনা করে তিনি সাহিত্যিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর বয়স যখন সাতাশ, তখন প্রকাশিত হয় ইতিহাস সম্পর্কিত তাঁর প্রথম রচনা জেজুরের মিত্র বংশ। জেজুর তাঁর পৈতৃক নিবাস। এখানকার প্রসিদ্ধ মিত্র বংশের সন্তান তিনি। পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে যার সূচনা তারই পরিণতি হুগলি জেলার সামগ্রিক ইতিহাসের রচনা। সুধীরকুমার যদি অন্য কোনো বই রচনা না-ও করতেন তাহলেও এই একটিমাত্র রচনা তাঁকে এ দেশীয় সাহিত্যসমাজে, বঙ্গীয় সাহিত্যসমাজে অবিস্মরণীয় করে রাখত। হুগলী জেলার ইতিহাস এবং তারকেশ্বরের ইতিহাস একদিকে আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রতি তাঁর আনুগত্য এবং অন্য দিকে ধর্ম এবং দেবস্থান সম্পর্কিত তাঁর স্বভাবজাত অনুরাগের সাক্ষ্য বহন করে।
একদিকে ভগবৎভক্তি, অন্যদিকে সমাজ-অনুসন্ধিৎসা সুধীরকুমারকে প্রেরণা জুগিয়েছিল হুগলি জেলার দেবদেউল—সামাজিক এই মূল্যবান তথ্যসমূহ ইতিহাস রচনায়। দেবমন্দির সম্পর্কে তাঁর অনুসন্ধিৎসা এতই প্রবল ছিল যে, তিনি দক্ষিণ ভারতের দেবমন্দির নিয়ে রচনা করেন তাঁর বহু প্রশংসিত দক্ষিণের দেবস্থান। বাংলা ভাষাভাষী যাঁরা নন তাঁদের জন্য তিনি ইংরেজি ভাষায় রচনা করেন Society, Culture and Religion of Bengal, তাঁর অপর ইংরেজি গ্রন্থ India’s National Language-ও সুধীমনের কাছ থেকে লাভ করেছে প্রশংসাধন্য স্বীকৃতি।
সাহিত্যচর্চার বাইরেও সুধীরকুমার মিত্রের আরও একটি প্রত্যয়াবিষ্ট সত্তা ছিল। তিনি ছিলেন আন্তরিকভাবে সমাজসেবী। রাজনীতির আকর্ষণও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। স্বাধীন ভারতে স্বদেশসচেতন যে কোনো ভারতবাসীর পক্ষে এমনটি আকর্ষণ ছিল নিতান্ত প্রত্যাশিত। গান্ধীজি পরিচালিত আইন অমান্য আন্দোলনের ফলে যখন গোটা ভারতবর্ষ উত্তাল, সেই সময় বিপ্লবীদের সম্পর্কেও তিনি পোষণ করতেন গভীর শ্রদ্ধা। তারই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর রচিত মহাবিপ্লবী রাসবিহারী, বাঘা যতীন, মৃত্যুঞ্জয়ী কানাই, মৃত্যুঞ্জয়ী প্রফুল্ল শীর্ষক গ্রন্থাবলিতে। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ, যুগাচার্য বিবেকানন্দ, আমাদের বাপুজি, বরণীয় বাঙালি প্রভৃতি গ্রন্থ নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অপরিসীম আনুগত্যের পরিচয় সুধীরকুমার রেখে গিয়েছেন বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি সম্মেলনের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদকরূপে। হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার একচ্ছত্র মর্যাদা ও স্বীকৃতি দানের আন্দোলন যখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, তখন সুধীরকুমারের উদ্যোগে ১৯৪১ সাল থেকে পর পর সম্মিলনীর তিনটি অধিবেশনের বিপুল আয়োজন হয়েছিল। বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগে সেদিন তিনি যাঁদের আশীর্বাদ এবং সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কুমার বিমলচন্দ্র সিংহ, প্রফুল্লকুমার সরকার, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ মনীষীরা।
সমাজসেবী সুধীরকুমার শিক্ষার প্রসারেও আগ্রহী ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের পরামর্শ এবং সমর্থনে তাঁর উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ এবং তিনটি স্কুল। এই ক-টি বিদ্যাকেন্দ্র আজও সুধীরকুমারের সাংগঠনিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।
একইসঙ্গে সাহিত্যসেবা, সমাজসেবা, শিক্ষার প্রসারকল্পে যে মানুষটি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় অকাতরে ব্যয় করে গেলেন, তাঁর স্মৃতি আমাদের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। কিন্তু সেইসঙ্গে যে কথাটি আমাদের বাঁচার মতো কিছু করে তা হল এই যে, সরকারি মহলে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিলাভ না-করলেও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ যদি সাহিত্যপ্রেমী সুধীরকুমারের জীবনী ও সাহিত্যসেবার পরিচয়টি সাহিত্যসাধক চরিতমালার একটি খন্ড হিসেবে প্রকাশ করেন তাহলে প্রত্যাশাবিমুখ এই মানুষটির কাছে আমরা যা পেয়েছি তার ঋণ কিছু পরিমাণে শোধ হবে।
‘জাতীয় সমচিন্তন’, ৭:৭ মার্চ ১৯৯৩-এ সুধীরকুমার মিত্র স্মরণ-শ্রদ্ধা বিশেষ সংখ্যা-য় প্রকাশিত হয়। লেখাটি মূলানুগ পুনঃপ্রকাশিত হল।