গ্রহ থেকে – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
টুনুকে তার বাবা মামার বাড়ি চালান করে দিল। এ ছাড়া আর উপায়ও ছিল না। ঠিক একমাস পরে টুনুর ম্যাট্রিক পরীক্ষা, আর শহরে গোলমাল শুরু হয়ে গেল।
গোলমাল বলে গোলমাল। শহরের লোকগুলো যেন সবাই একসঙ্গে খেপে উঠল। সময়ে অসময়ে বোমার শব্দ, গলির মোড়ে মোড়ে একটা-দুটো লাশ। আর সে সব লাশ প্রায়ই টুনুর বয়সি সব ছেলেদের।
টুনুর বাবাই বললেন মাকে, শোনো, এই আবহাওয়ায় টুনু পরীক্ষার পড়া তৈরি করবে কী করে? তুমি তোমার দাদাকে বরং লিখে দাও, এসে টুনুকে নিয়ে যাক।
মা আপত্তি করেছে, কিন্তু ওই অজ পাড়াগাঁয়ে টুনু থাকতে পারবে?
এ ছাড়া উপায় কী? দেখছ তো শহরের অবস্থা। পড়াশোনা করবে কী, তার প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে।
অতএব টুনু মামার সঙ্গে হরগোবিন্দপুরে এসে হাজির হল। তাও কি একটুখানি পথ। ট্রেনে তিন ঘণ্টা, তারপর গোরুর গাড়িতে পুরো আড়াই ঘণ্টা। পথ নেই, শেষ ঘণ্টাখানেক শুধু মাঠের ওপর দিয়ে যাত্রা।
গোরুর গাড়ি থামতে একটা টিমটিমে লণ্ঠন, গোটাতিনেক লোক টুনুকে অভ্যর্থনা জানাল।
তার মধ্যে একজন মামি, একজন মামাতো বোন আর শেষের লোকটি তুলসীচরণ। একাধারে চাকর, পাচক, মামার দেহরক্ষী।
বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়ে টুনুর গা ছমছম করে উঠল। পুরনো, শ্যাওলা-পড়া, ইট বের করা একতাল জমাট বাঁধা গুপসি আস্তানা। টুনুর মনে হয়েছিল বাড়িটা বোধহয় পাঠান আমলের। বহু শতাব্দীর ঝড় জল অত্যাচারে আজকের এই ভয়াবহ অবস্থা।
সেই মুহুর্তে টুনুর ইচ্ছা হয়েছিল চিৎকার করে কেঁদে উঠবে। না, মা বাবার জন্য নয়, আলোকিত শহরের জন্য। হোক সে খুনের শহর।
দিন সাতেকের মধ্যে টুনু অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে এল। ভোরবেলা উঠে পুকুরের পাড়ে সবুজ নারকেল গাছের গুঁড়ির ওপর বসে ছাই দিয়ে দাঁত মাজা। তারপর মামাতো বোনের আনা মুড়ি-নারকেল সহযোগে চা। সে চায়ের রং আলকাতরার মতন, স্বাদে যেন পাঁচন।
তারপর কোণের ঘরে বই নিয়ে বসা। ইংরাজি, বাংলা, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, বীজগণিত, জ্যামিতি। পড়ার যেন আর শেষ নেই।
পুকুরে স্নান, দুপুরে খেয়ে নিয়ে একটু নিদ্রা, তারপর উঠে আবার পড়া। বিকালে তুলসীচরণের সঙ্গে গাঁয়ের পথে একটু হাঁটা। আবার হারিকেনের আলোয় পড়তে বসা।
এর একটু এদিক-ওদিক নেই। দিনের পর দিন এক রুটিন।
ওরই মাঝে একটু বৈচিত্র্যও দেখা যায়।
যেমন একদিন পড়তে পড়তে খসখস আওয়াজে টুনু চমকে উঠেছিল। প্রথমে ভেবেছিল, বাতাসে শুকনো পাতার শব্দ। কিন্তু শব্দটা যেন খুব কাছে।
মুখ তুলে দেখেই টুনুর শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল। মাথার চুল শজারুর কাঁটার মতন খাড়া।
বাইরে থেকে জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকছে। দেয়াল বেয়ে। কালো কুচকুচে রং। বাঁশ পাতার মতন সরু চেরা জিভ। লাল রক্তকম্বলের মতন দুটি চোখ।
টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে টুনু প্রাণপণ শক্তিতে চিৎকার করে উঠেছিল।
তার মামাতো বোন ছুটে ঘরে এসেছিল।
কী হল কী? টেবিলের ওপর দাঁড়িয়েছ কেন?
টুনু ভাল করে কথা বলতে পারেনি। জানলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, সা-সাপ।
মামাতো বোন বিন্দু হেসেই খুন।
জানলার কাঠে আস্তে আস্তে চাপড় মেরে বলেছিল, যা, যা, এখান থেকে। বাইরে কলসিতে যা।
আশ্চর্য কাণ্ড, সাপটা ঘুরে জানলা দিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল।
সাপটা চলে যেতে বিন্দু টুনুর দিকে ফিরে হিহি করে হেসে বলেছিল, আরে ভয় কী। ওটা বাস্তু সাপ। কোনও অনিষ্ট করে না। একজোড়া আছে।
টুনুর ভয় ভাঙেনি। বাবা, একটাতেই রক্ষা নেই, আবার একজোড়া।
একটু একটু করে সব ঠিক হয়ে গেল। ক্রমেই পড়ার চাপ বাড়তে টুনুর অন্য কোনওদিকে আর নজর দেবার সুযোগই হল না। অন্য বিষয়গুলো যাও-বা একটু তৈরি হয়েছে, ইতিহাস নিয়ে টুনু অথই চলে পড়েছে। বিশেষ করে কয়েকটা ব্যাপার।
বাবর আর হুমায়ুন, কে বাপ আর কে ছেলে কিছুতেই মনে রাখতে পারে না। তাজমহল মমতাজের স্মৃতিচিহ্ন না নূরজাহানের, গোলমাল হয়ে যায়। তা ছাড়া ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেছিল শের শাহ, এ-কথাটার অর্থ টুনু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তার মানে শের শাহের আগে কি ঘোড়া ডাকত না?
উপায় নেই, পরীক্ষা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। এখানে পড়ার অনন্ত অবসর। বাড়ি ফাঁকা। কোনও গোলমাল নেই।
ভোরবেলা মামা বেরিয়ে পড়ত। মাইল চারেক দূরে তার জমি। চাষিরা চাষ করত, মামা করত তদারক। ধান, পাট আর তামাক। টুনু বুঝতে পারে না এমএসসি পাশ মামা চাষবাস করে কেন?
মামা যখন বাড়ি ফিরত তখন চারদিক অন্ধকার। দাওয়ায় বসে কিছুক্ষণ ভুড়ুক ভুড়ুক করে তামাক খেয়ে তারপর খেতে বসত।
সারাটা দিন মামি আর মামাতো বোন বিন্দু কাজে ব্যস্ত। দু’বেলা খাবার সময় শুধু তাদের সঙ্গে দেখা হত।
টুনুর পড়ার ঘর একেবারে কোণের দিকে। সেটা তার শোবার ঘরও। ছেলেপিলেদের হইহল্লা নেই, শহরের চেঁচামেচি নয়, একেবারে নিঃঝুম।
রাতের বেলা অবশ্য নানারকম শব্দ শোনা যায়। পেঁচার চিৎকার, ঝিঁঝির আওয়াজ, প্রহরে প্রহরে শিয়ালের ডাক।
এসব এখন টুনুর গা-সহা হয়ে গেছে। তা ছাড়া পড়ার মধ্যে মন চলে গেলে চারপাশের আওয়াজ কানেই আসে না।
একরাতে কিন্তু সবকিছু পালটে গেল।
পড়ার বই থেকে মুখ তুলে জানলা দিয়ে দেখেই টুনু আর মুখ ফেরাতে পারল না।
জানলার বাইরে আকন্দ, রাংচিতা, ফণীমনসার ঝোপ। তারপর অনেকটা জায়গা জুড়ে জলা জায়গা। দিনে বকের পাল ঘুরে বেড়ায়, রাতের বেলা মনে হয় কে যেন বিরাট একটা শ্লেট পেতে রেখেছে।
সেই কালো শ্লেটের বুকে দপ করে আলো জ্বলে উঠল। তীব্র আলো। মনে হল একসঙ্গে বুঝি চল্লিশটা টর্চ টিপে কেউ সংকেত করছে।
টুনু বই ছেড়ে জানলার ধারে সরে এল।
আলোটা আর নেই। জমাট কালো অন্ধকার।
আটটা বাজলেই গ্রাম নিশুতি। এত রাতে কে এমনভাবে আলো জ্বালবে। বিশেষ করে এত জোরালো আলো।
জানলা থেকে সরে আসতে গিয়েই টুনু দাঁড়িয়ে পড়ল।
আবার সেই আলো। একই রকম কিন্তু ঠিক এক জায়গায় নয়। একটু যেন সামনে সরে এসেছে।
শুধু আলো নয়, আলোর সামনে খোঁচা খোঁচা চুল বেঁটে চেহারার গোটা তিন-চার প্রাণী সবেগে মাথা নাড়ছে।
ভাল করে কিছু বোঝবার আগেই দপ করে আলো নিভে গেল।
আধ ঘন্টার ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও টুনু আর আলো দেখতে পেল না।
টুনু পড়ার টেবিলে ফিরে দু’ গালে দুটো হাত দিয়ে বসে রইল।
বাবর, জাহাঙ্গির, হুমায়ুন যে যার কবরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। শের শাহ আর তার ঘোড়ার ডাক নিশ্চিহ্ন। এমনকী বীজগণিত, জ্যামিতি সব বেমালুম চাপা রইল বইয়ের স্তূপের মধ্যে।
নতুন চিন্তায় টুনুর মন আলোড়িত হতে লাগল।
আচমকা এই আলোর দীপ্তি। তার পাশে খর্বকায় লোকদের ইশারা। কী হতে পারে?
কোন শত্রুর গুপ্তচর এভাবে সংকেত করছে।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কথাটা মনে হল।
জানলার দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখল, অনেক দূরে আলোর ক্ষীণ বিন্দু। জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
বেশ কিছুদিন আগে শহরের সব কাগজে বের হয়েছিল। আনন্দবাজারে তো ছিলই।
উড়ন্ত চাকি, উড়ন্ত চাকি। দেশ-বিদেশে নানা বয়সের লোক বিভিন্ন সময়ে এই উড়ন্ত চাকি দেখেছে।
পিরিচের মতন আকাশের একদিক থেকে বিদ্যুৎগতিতে আর-একদিকে ছুটে চলে গেল। পলকের মধ্যে অদৃশ্য।
দু’-একজন আবার বেশিও দেখেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এক চাষি চাষ করতে করতে দেখল তার মাঠের মাঝখানে পাতলা নীল পোশাক-পরা অদ্ভুত দর্শন একটি লোক এদিক-ওদিক দেখছে। চাষির দিকে নজর পড়তেই ছুটে একটা গাছের নীচে চলে গেল। আর তাকে দেখা গেল না।
ইরানে প্রায় একই ব্যাপার। একজন ক্লান্ত পথিক পথের ধারে বিশ্রাম করছিল, হঠাৎ দেখল, পাহাড়ের গা বেয়ে দু’জন ছোট্ট মানুষ, লম্বায় দু’ ফিটের বেশি নয়, তরতর করে নেমে আসছে। কিছুটা নেমে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর ঝোপের পিছনে হারিয়ে গেল।
পথিক ছুটে তন্নতন্ন করে ঝোপ অনুসন্ধান করল। কেউ নেই, শুধু ঝোপের সবুজ পাতাগুলো আগুনে ঝলসে যেন লালচে হয়ে গেছে।
পত্রিকাগুলো মন্তব্য করেছিল, খর্বকায় এই লোকগুলো নিঃসন্দেহে অন্য গ্রহের বাসিন্দা। আমরা যেমন অন্য গ্রহ সম্বন্ধে আগ্রহী, তারাও তাই। পৃথিবীতে নেমে এখানকার জল হাওয়া, মাটির অবস্থা, লোকের হালচাল নিরীক্ষণ করে।
কারও দেখা পেলেই অদৃশ্য বায়ুযানে মিলিয়ে যায়।
পত্রিকাগুলো এও লিখেছে।
এরা বোধহয় এসেছে মঙ্গলগ্রহ থেকে, কারণ একমাত্ৰমঙ্গলগ্রহে এ পর্যন্ত জলের চিহ্ন দেখা গেছে। জল আছে বলেই জীবন থাকা সম্ভব।
টুনু ঠিক করে ফেলল, আজ সে যাদের মাথা নাড়তে দেখেছে তারা নির্ঘাত মঙ্গলগ্রহ থেকে ঘুমন্ত এই গ্রামের ওপর নেমেছে। তারা কল্পনাও করতে পারেনি, এই পৃথিবীর এক কিশোর তাদের হালচালের ওপর নজর রেখেছে।
টুনু মতলব করল, দিনে যতটা সম্ভব পড়ে নেবে, আর রাত্রে এই মঙ্গলগ্রহের এই প্রাণীগুলোর ওপর নজর রাখবে। ওই আলোটা আর কিছু নয় জ্বলন্ত হেলিকপ্টার জাতীয় কিছু। অন্ধকার কক্ষপথে পথ দেখানোরও কাজ করে।
আনন্দে টুনুর নাচতে ইচ্ছা করল।
পড়াশোনার হয়তো একটু ক্ষতি হবে। তা হোক। ম্যাট্রিক পাশ করে কে আর দিগ্বিজয়ী হয়েছে। তার চেয়ে এমন একটা আবিষ্কারের ব্যাপার যদি ফলাও করে কাগজে ছাপাতে পারে, বিশদ বিবরণ দিয়ে, তা হলে টুনুকে ঘিরে বিজ্ঞানীদের ভিড় জমে যাবে। কাগজে কাগজে তার ফোটো ছাপা হবে।
তার ওপর কোনওরকমে যদি ওই খুদে চেহারার অন্তত একটা বাসিন্দাকেও খাঁচার মধ্যে পুরতে পারে, তা হলে তো কথাই নেই। সারা পৃথিবী টুনুকে নিয়ে লোফালুফি করবে।
মুখে বললেও সেরকম কিছু করতে টুনুর সাহস হল না। বিজ্ঞানে ওরা যথেষ্ট এগিয়েছে। খাঁচা চাপা দিতে গেলে এমন অস্ত্র টুনুর গায়ে ছুঁইয়ে দেবে যে টুনু কালো তরল পদার্থ হয়ে যাবে।
পরের দিন মামি দেখে বলবে, ওমা, এখানে গুড় ফেলল কে? বলেই পাতা দিয়ে মুছে নেবে।
সারাটা রাত টুনুর ঘুম হল না। এপাশ আর ওপাশ করল।
মাঝে মাঝে উঠে জানলা দিয়ে দেখল। কোথাও একটু আলো নেই।
ভোরে উঠেই টুনু স্থির করল, এসব গোপন কথা কাউকে বলবে না। আরও কিছুদিন মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দাদের আনাগোনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়ে, তবে সবকিছু ফাঁস করবে।
কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টুনু ছটফট করতে লাগল।
কাউকে কথাটা বলতে না পারলে তার পেট ফেটে যাবার দাখিল।
এতবড় একটা কথা কাকেই বা বলবে!
মামা ভোরবেলা থেকে বাড়িছাড়া। মামির বেশিরভাগ সময় কাটে রান্নাঘরে। বাকি থাকে বিন্দু।
টুনু ঠিক করল কথাটা বিন্দুকে বলবে।
বিন্দু যখন ঘর মুছতে এল, তখন টুনু বলল, বিন্দুদি একটা কথা আছে।
আমার সঙ্গে? কী কথা?
জানো তো, আমাদের পৃথিবী যেমন গ্রহ, তেমনই আশেপাশে আরও অনেক গ্রহ আছে। মঙ্গল, শুক্র, হার্সেল, বৃহস্পতি।
বাধা দিয়ে বিন্দু বলল, ওমা, তা আবার জানি না। গ্রহ কম আছে নাকি! মা তো কথায় কথায় বলে, কোন গ্রহ আমি সামলাব! বাবা বলে, গ্রহের ফের চলেছে।
টুনু তর্ক করল না। তর্ক করলে আসল কথা বলা হবে না।
তাই সে বলল, ওইসব গ্রহে প্রাণী আছে। মানে আমাদের মতন প্রাণী।
এবার বিন্দু মেঝের ওপর বসে পড়ল।
উৎসাহিত হয়ে টুনু বলতে লাগল।
প্রাণী আছে বটে কিন্তু দেখতে আমাদের মতন নয়। ছোট ছোট চেহারা। মাথায় লোহার মতন শক্ত শক্ত চুল। তুমি শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবে কোন একটা গ্রহ থেকে অদ্ভুত চেহারার সব প্রাণী তোমাদের গাঁয়ে নেমেছে।
আমাদের গাঁয়ে? বিন্দুর দুটো চোখ বিস্ফারিত।
হ্যাঁ বিন্দুদি, শুধু তোমাদের গাঁয়ে নয়, এই পিছনের মাঠে। আমি কাল রাত্রে স্বচক্ষে দেখেছি। একবার নয়, বার দুয়েক। জ্বলন্ত একটা প্লেন এসে নামল। তারপর খুদে খুদে সব লোকেরা বের হল সেটা থেকে।
বিন্দু উঠে দাঁড়াল। তুমি নিজের চোখে দেখেছ?
আলবত। তুমি রাত্রে যদি এ ঘরে আসো তোমাকেও দেখাব। এই জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়।
টুনুর কথা শেষ হবার আগেই বিন্দু ছুটে বেরিয়ে গেল।
টুনু গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসল।
এত বড় একটা আবিষ্কারের ব্যাপার পৃথিবীর লোককে কী করে সে জানাবে। এমন ব্যাপার হবে জানলে, সে নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে আসত। কয়েকটা ফোটো তুলে নিতে পারলে কেউ অবিশ্বাস করতে পারত না।
টুনু যখন চিন্তায় বিভোর, তখন আচমকা পিছন থেকে কে তাকে জাপটে ধরল।
প্রথমে টুনু ভাবল অন্য গ্রহের বাসিন্দারাই কেউ হবে, কিন্তু একটু পরেই বিন্দুর চিৎকারে তার সংবিৎ ফিরে এল।
ভাল করে ধরে থাকো মা, আমি তেলটা মাথায় ঢেলে দিই।
তারপরই মামির গলা, আহা রাতদিন পড়ে পড়ে বাছার আমার মাথাটাই বিগড়ে গেছে গো, নইলে এরকম আবোল তাবোল কথা বলে! মধ্যমনারায়ণ তেলে পাগলেরও মাথা ঠান্ডা হয়। দে বিন্দু একটু বেশি করে ঢেলে দে।
হড়হড় করে টুনুর মাথায় তেলের স্রোত নামল। গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবার জোগাড়। বহু কষ্টে সে বমি সামলাল।
টুনু অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না। মামির বজ্ৰবন্ধন। বিন্দুও রীতিমতো জোরে চেপে ধরেছে।
নিরুপায় হয়ে টুনু বসে রইল।
সেই তেল কপাল বেয়ে গালের ওপর। সেখান থেকে টপটপ করে শরীরে। রাগে, দুঃখে, অপমানে টুনুর দু’চোখ জলে ভরে গেল।
টুনু একবার ভাবল, সারাদিন কিছু খাবে না। চুপচাপ এইভাবে বসে থাকবে।
তারপর তার মনে পড়ে গেল বিজ্ঞানের সাধনায় অনেক বাধা। যুগে যুগে দেশে দেশে বহু বিজ্ঞান সাধককে নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, মৃত্যুও বরণ করতে হয়েছে।
আজ যারা এরকম ব্যবহার করছে, ভাবছে টুনুর মাথায় গোলমাল হয়েছে, তারাই একদিন ফুলের মালা নিয়ে টুনুর কাছে এসে দাঁড়াবে।
অনেকক্ষণ ধরে টুনু সাবান ঘসে ঘসে স্নান করল। সাবান ফুরিয়ে গেল, কিন্তু গন্ধ বিশেষ কমল না। গম্ভীর হয়ে খাওয়াদাওয়া সারল। কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলল না। তবে বুঝতে পারল, বিন্দুদি আর মামি তাকে কেমন সন্দেহের চোখে লক্ষ করে যাচ্ছে।
সারা দুপুর টুনু বসে বসে পড়ল। এ ছাড়া উপায় নেই। আজ সারা রাত জেগে বসে থাকবে। অন্য গ্রহের বাসিন্দারা যদি নামে, তবে তাদের হালচাল নোট করবে।
রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে টুনু জানলার ধারে বসল। একটা বই দিয়ে হারিকেনটা আড়াল করল, যাতে আলোর রেখা বাইরে কোথাও না পড়ে। কী জানি কাছাকাছি আলো দেখলে গ্রহের বাসিন্দারা সাবধান হয়ে যেতে পারে।
বরাত টুনুর।
একটু পরেই আলোর ঝলক দেখা গেল। সেই সঙ্গে খাড়াচুল বেঁটে চেহারার বাসিন্দাদের মাথা নাড়া।
টুনু উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। আজকের আলো খুব তীব্র। একবার নিভেই তপ করে আবার জ্বলে উঠল।
এ দৃশ্য টুনু কাকে ডেকে দেখাবে। ভাবল মামি কিংবা বিন্দুদিকে ডেকে আনবে। তারা নিজের চোখে দেখুক।
কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মামার কাশির শব্দ কানে এল। খাওয়ার পর মামা দাওয়ায় বসে অনেকক্ষণ তামাক খায়।
চেঁচিয়ে মামাকে ডাকতে টুনুর সাহস হল না। কী জানি যদি গ্রহের বাসিন্দাদের কানে আওয়াজ যায়। তারা কোনওরকম আলোর রশ্মি ফেলে টুনুকে ছাই করে দেয়।
তাই টুনু ঘর থেকে বেরিয়ে আমার পিছনে গিয়ে আস্তে আস্তে ডাকল, মামা, শিগগির আসুন। দেরি করবেন না।
হুঁকো সরিয়ে মামা উঠে দাঁড়াল। কীরে সাপ নাকি?
টুনু কোনও উত্তর না দিয়ে মামার হাত ধরে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল।
জানলার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, বাইরে দেখো।
মামা দেখল। জমাট অন্ধকার। মাঝে মাঝে শুধু জোনাকির জ্বলা-নেভা।
টুনু মনে মনে কপাল চাপড়াল। হায়রে মামাকে কিছুই দেখানো গেল না।
মামা জিজ্ঞেস করল, কী দেখব কী বাইরে? শেয়াল টেয়াল দেখেছিস, না কি?
না, না, টুনু মাথা নাড়ল, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না মামা। আমি স্পষ্ট দেখেছি, অন্য গ্রহ থেকে একটা জ্বলন্ত যান ওইখানে নামে আর বেঁটে বেঁটে খাড়াচুল বাসিন্দারা মাথা নেড়ে ইশারা করে।
অ্যাঁ? মামা অবাক হয়ে যায়।
সঙ্গে সঙ্গে দূরে আবার আলোর দীপ্তি। খাড়াচুল বেঁটে লোকগুলো মাথা দোলায়।
ওই দেখো মামা, নিজের চোখে দেখো।
মামা দেখল। বারবার তিনবার আলো জ্বলে উঠল আর নিভল।
দেখা শেষ করে মামা হো হো করে হেসে উঠল। এত জোরে যে বিন্দু আর মামি ঘুম ছেড়ে উঠে টুনুর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
মানে, তুমি একে শহরের ছেলে তার ওপর বিজ্ঞানের ছাত্র নও, তাই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারোনি। ওদিকটা জলা। আমরা বলি ভৈরবের জলা। ওইসব জলা জায়গায় ওইরকম গ্যাস দেখা যায়। মিথেন গ্যাস। তার সঙ্গে ফসফিন যোগ হলেই ওইরকম জ্বলে ওঠে।
টুনুর মুখটা কালো হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে সে আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু ওই বেঁটে খাড়াচুল মানুষগুলো?
মামা আবার হাসিতে ফেটে পড়ল।
ওগুলো মোটেই ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা নয়। তালগাছের চারা। একসঙ্গে গোটা চার-পাঁচ। আলেয়ার আলোয় ওরকম দেখাচ্ছে, আর বাতাসে পাতাগুলো নড়ছে বলে তুমি ভাবছ, মাথা নেড়ে ইশারা করছে। কাল সকালে তুমি নিজে গিয়ে দেখে এসো। তা হলেই আমার কথা সত্যি না মিথ্যা বুঝতে পারবে।
এবার শুধু মামা নয়, মামার সঙ্গে মামি আর বিন্দুও খিলখিল করে হেসে উঠল।
শ্রাবণ ১৩৮২
অলংকরণ: মদন সরকার