গ্রহান্তরে

গ্রহান্তরে

জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে বরুণবাবুর। সকাল থেকে গভীর রাত্রি অবধি খেটেখুটে যা আয় হয় তাতেও সংসারটা ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। বাড়িতে নিত্য খিটিমিটি লেগেই আছে। ছেলেপুলেগুলো ঠিকমতো মানুষ হচ্ছে না। বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়ার জন্য চোখ রাঙাচ্ছে। চাকরির জীবন প্রায় শেষ হয়ে এল। আয়ুও কি আর বেশিদিন আছে! বরুণবাবুর খুব ইচ্ছে করে সংসারের ঝামেলা থেকে বিদায় নিয়ে কোনো নির্জন জায়গায় গিয়ে শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে। তিনি টের পাচ্ছেন সংসারের ওপর তাঁর আর কোনো টান বা মোহ নেই। সারাদিনের শেষে বাড়ি ফিরতেও তাঁর ইচ্ছে করে না।

দূরের একটা টিউশনি সেরে শেষ ট্রামে বাড়ি ফিরছিলেন বরুণবাবু। মনটা বড়োই খারাপ। বুড়ো হতে চললেন, অথচ জীবনে একটা দিনও সুখে বা শান্তিতে কাটিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। নিজের ওপর, সংসারের ওপর, গোটা দুনিয়ার ওপর তাঁর বিরক্তি ধরে গেছে।

ট্রাম ফাঁকা। একেবারে ফাঁকা। শুধু আর একটা লোক র্যাপার মুড়ি দিয়ে সামনের সিটে বসা। আর কেউ নেই।

হঠাৎ লোকটা ফিরে তাকিয়ে বলল, কেমন আছেন বরুণবাবু?

আর যাই হোক বরুণবাবুর স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো। লোকটা রীতিমতো সুপুরুষ, বয়সও কম, চব্বিশ—পঁচিশের মধ্যেই হবে। কিন্তু লোকটাকে বরুণবাবু কিছুতেই চিনতে পারলেন না।

ভদ্রতা করে বললেন, চলে যাচ্ছে কোনোরকম। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক—

লোকটা ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসল, চিনতে পারছেন না তো! চেনার কথাও নয়। আপনি জীবনে এই প্রথম আমাকে দেখছেন।

বরুণবাবু অবাক হয়ে বললেন, তাহলে—

লোকটা বলল, আমিও আপনাকে চিনতাম না। এই ট্রামেই আমাদের প্রথম দেখা হল।

তাহলে আমার নামটা জানলেন কী করে?

লোকটা তেমনি হাসি—হাসি মুখ করে বলে, সেটাও শক্ত কিছু নয়। চেষ্টা করলেই পারা যায়। আপনি যে বরুণ সরকার সেটা অহরহ তো আপনার মনের মধ্যে ভুরভুরি কাটছেই। সেই স্পন্দনটা ধরতে পারলেই হল।

বরুণবাবু অবাক হয়ে বললেন, অ্যাঁ! স্পন্দন ধরতে পারলেই হল! সেটাই কি খুব সহজ কাজ?

লোকটি হেসে বলল, চেষ্টা করলেই সহজ। অভ্যাসে কি না হয় বলুন।

আপনি কি থট—রিডার?

লোকটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, কথাটা মন্দ বলেননি। ওরকমই ধরে নিতে পারেন।

বরুণবাবু একটু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা, আমি এখন কী ভাবছি তা বলতে পারেন?

পারি। আপনি আমার সম্পর্কে ভাবছেন, হুঁ হুঁ বাবা তুমি একখানি আস্ত বুজরুক।

ও বাবা! আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক দেখছি!

বললাম তো অভ্যাসে সব হয়। এইমাত্র আপনি ফুলকপির পোড়ের ভাজা আর সোনা মুগডালের কথা ভাবলেন …এইমাত্র ভাবলেন আপনার চলে—যাওয়া ছেলে ছোটকুর কথা …এইমাত্র ভাবলেন …

থাক থাক, আর বলতে হবে না। আপনার ঠিকানাটা একটু দিন তো। সময় করে আপনার সঙ্গে একদিন বসতে হবে। আপনি যখন এত জানেন তখন আপনার কাছ থেকে কিছু জেনে নিতে হবে। কোথায় থাকেন আপনি?

লোকটা মিটিমিটি হাসল, আমার ঠিকানা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। আমি অনেক দূরে থাকি। যদি যেতে চান তো আমিই নিয়ে যাব আপনাকে।

কলকাতা শহরটা আমি টিউশনি করে করে হাতের তেলোর মতো চিনি। এই তো খিদিরপুর থেকে ফিরছি।

কলকাতা চিনলে তো হবে না। আমি যে অনেক দূরের লোক।

কত দূরের?

আপনাদের হিসেবে অন্তত আড়াই হাজার লাইট ইয়ার।

দূর মশাই, আপনি এবার গুল মারতে শুরু করেছেন। ঠিক আছে ঠিকানা না হয় না—ই বললেন, দেখা তো হতে পারে আমাদের।

লোকটি মাথা নেড়ে বলে, আমি এই সামনে ময়দানে নেমে যাব। আর দেখা হওয়ার সুবিধে নেই।

ময়দানে নামবেন! সেখানে কী আছে?

সেই কথাই তো বলতে চাইছি। আপনার তো আর সংসার—টংসার ভালো লাগছে না, তাই না?

আজ্ঞে না।

বেঁচে থাকার আনন্দটাই আর তেমন টের পাচ্ছেন না!

না। কিন্তু—

দাঁড়ান। আমি সব জানি। আপনাকে তাই একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। বেশ চটপট জবাব দেবেন।

আজ্ঞে সে আর বলতে!

ধরুন যদি আমি আপনার বয়স কমিয়ে দিই, যদি অমর করে দিই, শরীরটা যদি সুস্থ করে দিই, তাহলে কেমন হয়?

উঃ মশাই, এ তো স্বপ্নের কথা বলছেন।

স্বপ্ন নয়। সত্যি। আমরা ময়দানে পৌঁছে গেছি। শুভস্য শীঘ্রম। নেমে পড়ুন।

বরুণবাবু একটু দ্বিধা করলেন। নামিয়ে ছিনতাই করবে না তো!

লোকটা বলল, আপনার পকেটে ছ—টাকা পঁচাত্তর পয়সা আছে। হাতঘড়িটা পুরোনো, ওটা বেচলে পঁচিশ টাকাও পাওয়া যাবে না। জীবন তার চেয়ে অনেক মূল্যবান। নেমে পড়ুন।

বরুণবাবু নেমে পড়লেন। লোকটা আজগুবি কথা বলছে বটে, কিন্তু একবার এই গুলবাজকে একটু বাজিয়েই দেখা যাক না।

ময়দানে বেশ ঘোর অন্ধকার। কুয়াশা চেপে পড়েছে। লোকটা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পকেট থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মতো একখানা জিনিস বের করে বোতাম টিপতেই সামনে একখানা ডিমের মতো দেখতে মোটরগাড়ির মতো জিনিস দেখা গেল। একখানা অ্যাম্বাসাডার গাড়ির চেয়ে বেশি বড়ো নয়।

বরুণবাবু সভয়ে বললেন, এটা কী?

আমরা বলি মনোরথ। আলোর গতির চেয়ে মনের গতি অনেক বেশি। এক লহমায় কোটি কোটি লাইট ইয়ার পেরিয়ে যেতে পারে। আমাদের এ গাড়িও তাই।

বলেন কী মশাই! ইয়ার্কি মারছেন না তো!

ইয়ার্কি হলে না হয় কান মলে দেবেন। আসুন।

লোকটা কলকাঠি নেড়ে একটা দরজা খুলল। ভিতরে বিশেষ যন্ত্রপাতি দেখা গেল না। বসার জন্য বেশ আরামদায়ক গদি আছে। শীত বা গরম কিছুই লাগছে না।

বরুণবাবু, আপনার খিদে পায়নি তো?

আজ্ঞে না।

পেলেও একটু চেপে রাখুন। একেবারে পৌঁছে খাবারের ব্যবস্থা হবে।

বরুণবাবু দুশ্চিন্তায় একটু ঘামতে লাগলেন।

কোনো ঝাঁকুনি লাগল না, শব্দও হল না। তবে শরীরটা হঠাৎ খুব হালকা লাগতে লাগল বরুণবাবুর। লোকটা মুখোমুখি বসে হাতের ছোট্ট যন্ত্রটা নিয়ে কীসব যেন করছে।

বরুণবাবু বাইরের দিকে চাইলেন। যা দেখলেন তাতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ঘোর অন্ধকার আকাশে বিশাল বড়ো বড়ো সব সূর্য দেখা যাচ্ছে, সাঁ সাঁ করে পেরিয়ে যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে।

লোকটা একটু হেসে বলল, আমরা এক সেকেন্ডেই পৌঁছে যেতে পারতাম। ইচ্ছে করেই একটু নীহারিকাটা পাক দিয়ে নিলাম। এসে গেছি।

শরীরটা আবার স্বাভাবিক লাগল বরুণবাবুর। লোকটা দরজা খুলে বলল, আমাদের গ্রহ আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছে বরুণবাবু। আসুন।

বরুণবাবু নামলেন। নেমেই টের পেলেন, পরিষ্কার বাতাসে তাঁর বুক ভরে গেল। অনেক তরতাজা লাগছে নিজেকে। চারদিকে চেয়ে দেখলেন, বাড়ি—ঘর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটও নয়। চারদিকে শুধুই নিবিড় জঙ্গল। আকাশে দু—দুটো চাঁদ, তার আলোয় চারদিকটা জ্যোৎস্নায় একেবারে ভেসে যাচ্ছে। বিশাল বড়ো বড়ো গাছ যেন মেঘ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ে মোটা মোটা লতা পাকিয়ে উঠেছে। সুন্দর ফুলের গন্ধে ম—ম করছে বাতাস।

বরুণবাবু বললেন, এ তো দেখছি শুধুই জঙ্গল!

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, ওপরটা আমরা জঙ্গলের আবরণই রেখে দিয়েছি। তাতে আবহমণ্ডল সুস্থ থাকে। বন্যজন্তুরও অভাব নেই। আমরা থাকি ভূগর্ভে।

এখানে দেখছি শীত নেই!

না। শীত—গ্রীষ্ম কিছুই নেই। সবসময়েই বসন্তকাল। তবে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়।

এসব গাছপালা কি পৃথিবীর মতোই?

না। তবে তুলসী, নিম এরকম কিছু গাছ এখানেও পাবেন। আর সব অন্যরকম।

আচ্ছা, আমি তো পৃথিবী থেকে আসছি, আমার কোনো ইনফেকশানের ভয় নেই তো এখানে?

লোকটা হাসল, না। কারণ মনোরথের মধ্যেই আপনাকে সূক্ষ্ম রশ্মি দিয়ে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। আর আমাদের এই গ্রহে কোনো ক্ষতিকারক জীবাণুই নেই। এখানে কারও কখনো কোনো অসুখ করে না।

কক্ষনো না?

না বরুণবাবু। আমরা সম্পূর্ণ রোগমুক্ত। আমাদের কোনো হাসপাতাল নেই। ওষুধ তৈরি হয় না।

বরুণবাবু উত্তেজিত হয়ে বলেন, কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হলে?

তাও হয় না। আমার চল্লিশ হাজার তিনশো একানব্বই বছর বয়েসে কখনো কোনো অসুখবিসুখ হয়নি।

অ্যাঁ! কত বললেন?

চল্লিশ হাজার তিনশো একানব্বই বছর, আপনাদের হিসেবে। আমাদের এখানে অবশ্য এক বছর আপনাদের সাড়ে তিনশো বছরের সমান।

এই বলে লোকটা হাতের যন্ত্রটা টিপতেই পায়ের নীচে একটা আলোকিত সিঁড়ির মুখ খুলে গেল।

নীচে সারি সারি প্রকোষ্ঠ। লম্বা লম্বা হলঘর। করিডোর। চলন্ত সিঁড়ি। চলন্ত মেঝে। সব ঝকঝক তকতক করছে। কাচের আড়ালে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষ নানা ধরনের অদ্ভুত যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে।

আপনার নামটি কিন্তু আমাকে বলেননি স্যার।

আমার নাম ধৃতি। আসুন, এই ঘর।

ঘরটা একটা কাচের বর্তুলাকার চেম্বার। তাঁকে একখানা যন্ত্রের সামনে টুলের মতো জিনিসে বসিয়ে ধৃতি বলল, আপনার বয়সটা কমিয়ে দিচ্ছি। কত বছর বয়সে ফিরে যেতে চান?

বরুণবাবু ভয়ে ভয়ে বললেন, পঁচিশ।

ঠিক আছে। বলে ধৃতি একটা বোতাম টিপে তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে চেম্বারের দরজাটা সেঁটে দিল।

কোনো শব্দ নেই, কম্পন নেই। অথচ বরুণবাবু টের পাচ্ছেন তাঁর শরীরের ভিতরে কী যেন একটা হয়ে যাচ্ছে। তিনি বদলে যাচ্ছেন। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পর তিনি বুঝতে পারলেন, প্রক্রিয়াটা থেমে গেছে। সামনে একটা ঘষা কাচের পর্দায় বাংলা অক্ষরে এই ক—টা কথা ফুটে উঠল, অভিনন্দন! আপনি এখন পঁচিশ বছরের যুবক।

বরুণবাবু যন্ত্রকেই জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আবার যখন বুড়ো হব তখন ফের বয়স কমানো যাবে কি?

পর্দায় ফুটে উঠল, আর কখনোই পঁচিশের বেশি বয়স হবে না আপনার। যেমন আছেন তেমনই চিরকাল থাকবেন।

চিরকাল বলতে?

চিরকাল বলতে চিরকাল। ইটারনিটি।

উরেব্বাস! তাহলে কতদিন বাঁচবো?

চিরকাল।

হার্ট অ্যাটাক, ব্লাড প্রেশার, স্ট্রোক এসব হবে না?

কস্মিনকালেও নয়।

খুব রিচ খাবার খেলেও নয়?

খাবার কেন খাবেন?

খাবো না?

না। আপনার আর কখনো খিদেই হবে না।

বলেন কী?

খিদে হবে না, ঘুম পাবে না, ক্লান্তি আসবে না।

বটে! তাই তো আমার খিদের ভাবটা আর টের পাচ্ছি না, না?

কখনো পাবেন না।

তাহলে পুষ্টি হবে কী করে?

শরীরে ক্ষয় না হলে, পূরণেরই বা কী প্রয়োজন?

আচ্ছা জলতেষ্টা পাবে তো?

কেন পাবে?

বাথরুমও তো পাবে, তখন শরীরের জল বেরিয়ে যাবে না?

বাথরুমও পাবে না।

বড়ো বাইরে বা ছোটো বাইরে কোনোটাই নয়?

না।

ব্যায়াম করার দরকার আছে কি?

করতে পারেন, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ নেই।

আচ্ছা ধরুন কেউ যদি আমাকে গুলি করে, কি ছোরা মারে বা আমি যদি আগুনে পুড়ে যাই তাহলেও মরব না?

না। আমাদের বায়োনিক ল্যাবরেটরির অটোমেটিক মেশিন আবার আপনার সব কিছু নতুন করে দেবে। আপনি কিছুতেই মারা যেতে পারবেন না এখানে।

ব্যথা তো লাগবে।

তাও লাগবে না। ব্যথার স্নায়ু এখানে আনন্দের তরঙ্গ তোলে, ব্যথার নয়।

ওরে বাবা! এ তো সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড দেখছি!

কিছুই সাঙ্ঘাতিক নয়। খুব সোজা ব্যাপার।

আমি কিন্তু খুব ঘুম—কাতুরে মানুষ।

শুয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু ঘুমোনো অসম্ভব।

আর একটা কথা। পৃথিবীতে আমার বউ আর ছেলেপুলে, আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধবেরা আছে, তাদের কথা তো আমার মনে পড়বে!

পড়বে। স্মৃতিঘর বলে একটা চেম্বার আছে। সেখানে গিয়ে আপনি ইচ্ছে করলে যেকোনো স্মৃতিকে মুছে ফেলতে পারবেন। আবার যেকোনো স্মৃতিকে জাগিয়েও তুলতে পারবেন। আপনার যা ইচ্ছা।

মন যদি খারাপ হয়?

এখানে মন খারাপ হয় না। পাশেই আনন্দ—ঘর আছে। সেখানে গিয়ে আনন্দের মাত্রাটা একটু বাড়িয়ে নেবেন, তাহলেই হবে।

সবসময়ে আনন্দে থাকতে পারব?

অবশ্যই।

এ সময়ে দরজা খুলে ধৃতি ঘরে ঢুকল। বলল, বাঃ, এই তো যুবক হয়ে গেছেন।

আচ্ছা, আমি যদি আর একটু সুপুরুষ হতে চাই?

কোনো বাধা নেই। আসুন।

এরপর ধৃতি তাঁকে বিভিন্ন ঘরে নিয়ে গিয়ে সুপুরুষ করে দিল। আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। পৃথিবীর স্মৃতি খানিকটা আবছা করে দিল।

সব হয়ে যাওয়ার পর বরুণবাবু বললেন, এবার কী হবে ধৃতি?

এখানে তো কিছুই হয় না।

একটা কাজ—টাজ কিছু দেবে না?

কাজ অনেক আছে। সেগুলো সবই যন্ত্র—মানুষেরা করে। ইচ্ছে করলে আপনিও করতে পারেন।

কিন্তু আমি যে ইঞ্জিনিয়ারিং জানি না।

চিন্তা নেই। বলে আর একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং মস্তিষ্ক চালু করা হল বরুণবাবুর। তিনি দিব্যি কলকবজার ব্যাপার বুঝতে শুরু করলেন।

যদি ডাক্তার হতে চাই?

তাও পারেন।

কবি?

তাও।

নাঃ, এ যে দেখছি সব পেয়েছির দেশ। এখানকার মানুষেরা তাহলে বেশ আরামেই আছে বলো! তোফা আছে।

মানুষ! এখানে মানুষও নেই।

ওই যে কতজনকে দেখছি। কাজ—টাজ করছে।

কেউ মানুষ নয়। সব যন্ত্রের তৈরি।

বরুণবাবু আঁতকে উঠে বললেন, বলো কি হে! মানুষ কি তাহলে তুমি একা! অ্যাঁ!

ধৃতি একটু হেসে বলে, তাও নই!

মানে?

আমিও মানুষ নই বরুণবাবু। যন্ত্র মাত্র। এই গ্রহে বহু লক্ষ বছর কোনো মানুষ নেই। একসময়ে ছিল। তারা আমাদের হাতে এই গ্রহ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য গ্রহে, নীহারিকার ওপাশে অন্য নীহারিকায় চলে গেছে। পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য আমাদের একজন মানুষ বড়ো দরকার ছিল। তাই আপনাকে আনা।

অ্যাঁ!

ভয় পেলেন নাকি?

হ্যাঁ, আমার যে ভয় হচ্ছে।

ওই একটা জিনিসকেই আমরা জানতে চাই। ভয়। মানুষের ভয়কে আমরা জয় করতে পারিনি। কেন পারিনি তা জানার জন্যই আপনাকে আনা।

বরুণবাবু হঠাৎ বিকট গলায় বললেন, তাহলে কি এই গ্রহে আমি একা একটা মানুষ!

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ওরে বাবা রে! আমি কিছুতেই এখানে থাকব না …কিছুতেই না… ও ভাই ধৃতি, শীগগির আমাকে আমার নোংরা পৃথিবীতেই দিয়ে এসো। রোগ—ভোগ বয়স মৃত্যু ওসব নিয়েই আমি থাকতে চাই… ও ভাই ধৃতি, তোমার পায়ে পড়ি …

এসপ্লানেড আ গয়া বাবু। উঠিয়ে।

পটাং করে চোখ মেললেন বরুণবাবু। ট্রাম এসপ্লানেডে এসে গেছে। চোখ কচলে তিনি চারদিকে চাইলেন। যা দেখছেন তা অতি সত্য। এ কলকাতাই বটে। তিনি পৃথিবীতেই আছেন।

মস্ত একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন তিনি। নেমে পড়লেন। মনটায় বড়ো আনন্দ হচ্ছে।

শ্যামবাজারমুখো একখানা বাসে উঠে দেখলেন, বেশ লোকজন আছে। প্রথম যার সঙ্গে দেখা হল তাকেই আনন্দের চোটে বললেন, খুব বাঁচা বেঁচে গেছি মশাই!

লোকটা কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *