গ্রহান্তর

গ্রহান্তর

এ পাড়ার রমেনবাবুকে চেনেন না এমন কেউই নেই। রমেনবাবু, মানে রমেন রায়। হোম ডিপার্টমেন্টে খুব বড়ো চাকরি করতেন। অনেকদিন হল রিটায়ার করেছেন। স্ত্রী নলিনীবালা বেঁচে আছেন। তবে, বহাল তবিয়তে নয়। নানারকম অসুখে তিনি প্রায়ই ভোগেন। ছেলেরা সকলেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোজগারপাতিও ভালো সকলের। প্রত্যেকের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বড়োমেয়ে রানু। তার বিয়ে দিয়েছেন কাস্টমস-এর এক অফিসারের সঙ্গে।

শীতকাল।

রমেনবাবু বাইরের ঘরে বিকেলবেলা বসেছিলেন। ঠিক বিকেল নয়। সবে সন্ধে হয়েছে। এমন সময় তাঁর বাল্যবন্ধু হরেনবাবু ঘরে ঢুকলেন। হরেন মৈত্র। বরেন্দ্রভূমির মানুষ। তীক্ষ্ণনাসা, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। হরেনবাবু ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ দম নিলেন। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে বললেন, আছিস কেমন?

চলে যাচ্ছে রে!

চলে গেলেই হল।

হরেনবাবু বললেন।

তার পর? তোর সেই চাকরিটার কিছু হল? সেই যে সাইকেল ম্যানুফ্যাকচারিং না কি একটা কোম্পানিতে। রিটেইনারশিপের কথা বলেছিলি।

হরেনবাবু একটু কাশলেন। বললেন, হল আর কই? হলে তো বেঁচে যেতাম। বাড়িতে বসে হাঁফিয়ে উঠলাম। তার ওপর তোর বান্ধবী সুনীতির যন্ত্রণায় তো আর পারি না। ছেলেবেলায় শুনতাম, আসল দাম্পত্যপ্রেম নাকি শরীর ঢিলে হয়ে যাবার পর—একেবারে রিয়েল কামগন্ধহীন সত্যিকারের ভালোবাসা। আমার তো ভাই প্রাণ যাবার জোগাড়।

কেন? হলটা কী তোর?

হবে আর কী? এত বছর ঘর করার পরে হঠাৎ সুনীতির মনে পড়েছে যে আমি ওঁকে নাকি জীবনে মর্মান্তিকভাবে ঠকিয়েছি। সারাজীবন আমার তদবির তদারকি, আমার জন্যে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক রেঁধে, শোবার সময়ে ইসাবগুল এগিয়ে, গড়গড়ায় তামাক সেজে এবং…।

এই বলে হরেনবাবু একবার চারধার দেখে নিয়ে বললেন এবং আমার জন্যে বছর বছর ছেলে বিইয়ে তাঁর নাকি জীবনের সর্বস্বই হারিয়ে গেছে।

রমেনবাবু ডিবে থেকে একটা পান বের করে মুখে দিলেন, তার পর লুঙ্গির কোনা দিয়ে রুপোর পানদানিটা মুছতে মুছতে উদাসীন মুখে বললেন, পান খেতে পারবি? তোর দাঁত তো নতুন বাঁধানো।

হরেনবাবু মাথা নাড়লেন। জানালেন যে, পারবেন না। তার পর রমেনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে তাঁর স্ত্রীর এহেন আচরণ সম্বন্ধে রমেনবাবুর কী মতামত জানার জন্যে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলেন।

রমেনবাবু জীবনে কখনো তাড়াহুড়ো করেননি। পানটা ভালো করে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে লাগলেন। তার পর বললেন, এইসব কুবুদ্ধি শেখাচ্ছে কে? কোন বউমা?

হরেনবাবুর গলা অভিমানে ভারী হয়ে এল। বললেন, সব বউমাই! সঙ্গে ছেলেরাও আছে। তারা সকলে মিলে তাদের মাকেও দলে টেনেছে। তারা সকলেই একমত যে, আমি বুড়ো নাকি সারাজীবন শুধু নিজের দিকটাই দেখে এসেছি। আর কাউকেই দেখিনি।

রমেনবাবু মুখ নীচু করে বললেন, এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? এ তো তবু ভালো! আমার অফিসের বড়োবাবু আমারই কন্টেমপোরারি, রিটায়ার করেছেন। এসে বলছিলেন, তাঁর ছোটোছেলে নাকি তাঁকে বলেছে, ‘আমাকে পৃথিবীতে আনতে বলেছিল কে? আনলেই যখন, তখন কেন ভালোভাবে লেখাপড়া শেখাবে না, কেন জামাকাপড় কিনে দেবে না? আমরা তো স্বেচ্ছায় এখানে আসিনি?’

এর পর রমেনবাবু এবং হরেনবাবু দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন।

এমন সময় রমেনবাবুর সেজোবউমা ঘরে ঢুকলেন। বাইরে কোথাও যাবেন। ছিপছিপে চেহারা, মিষ্টি মুখ, কপালে একটি টিপ, সিঁথেয় সামান্য সিঁদুর আছে কি নেই বোঝা যায় না।

হরেনবাবু বাঁধানো দাঁতে একগাল হেসে বললেন, ভালো আছ তো রমা?

হ্যাঁ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন কাকাবাবু? অনেকদিন তো আসেন না।

হ্যাঁ মা, এই কাজকর্মে সময় পাই না। যদিও সব অ-কাজ। যে কাজ করে টাকা রোজগারই না হল সে আবার কাজ কী?

কাকিমা ভালো আছেন?

মোটামুটি। তবে জানো তো ওঁর হাই ব্লাডপ্রেশার। এত বছর সংসার করে করে বড়োই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বেচারি।

রমেনবাবু বললেন, কোথায় চললে? রমা? শ্যামল ফেরেনি অফিস থেকে?

আমার কলেজের এক বন্ধুর আজ বিয়ের তারিখ। আমাদের খেতে বলেছে। ও অফিস থেকে সোজা যাবে, আমি একটা জিনিস কিনে নিয়ে যাব।

খুব ভালো। বেশ। বেশ। যাও।

রমেনবাবু ও হরেনবাবু দুজনেই বললেন।

রমা চলে গেল।

একটুক্ষণ পর রমেনবাবু বললেন, কীরকম বুঝলি?

বোঝার আর আছে কী? আজ ম্যারেজ-অ্যানিভার্সারি, কাল জন্মদিন, পরশু ইংরিজি-খাওয়া, তার পর দিন চীনে-খাওয়া এই চলেছে আর কী! আরে তোর ছেলে-বউরা করলেও করতে পারে। প্রত্যেকে ভালো রোজগার করে। তোর এমন প্রাসাদের মতো বাড়িতে থাকে। ভাড়া লাগে না। আমার তো তোর মতো অবস্থা নয়। তাও আমার ছেলে-বউয়েরাও সমানে তাল দেয়। এই আমি, হরেন মৈত্র হাজার টাকা মাইনেতে পাঁচ-পাঁচটা ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শেখালাম, মানুষ করলাম, আর তারা প্রত্যেকে চাকরিতে ঢুকে এখনই দু-তিন হাজার টাকা রোজগার করে, কিন্তু সবই স্বামী-স্ত্রীতে একা একা ফুঁকে দেয়। বাড়ির খরচ সব আমার। যতদিন বেঁচে থাকব, যতদিন ধড়ে প্রাণ থাকবে, ততদিন আমাকেই চালিয়ে যেতে হবে সব কিছু।

সে কী রে? তোর ছেলেরা সংসারে কিছুই দেয় না?

দেয় না বললে মিথ্যা বলা হয়। যে হাজার পায়, সে এক-শো দেয়। যে দু-হাজার পায়, সে পঞ্চাশ দেয়। সকলেই বলে, যে তাদের নিজেদের পার্সোনাল খরচ আছে। ভবিষ্যৎ আছে। ছেলেপিলে হয়েছে। অথবা হবে। আজকাল ছেলেপিলে হলেও তো একটি কি দুটি। তার জন্যেই এত বড়ো বড়ো কথা। ওনাদের সকলেরই ভবিষ্যৎ আছে, কেবল আমাদের বুড়ো-বুড়িদেরই নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের ভবিষ্যৎ স্থবির হয়ে গেছে; ফসিল হয়ে গেছে।

রমেনবাবু বললেন, চা খাবি?

না। চা আজকাল শুধু সকালেই এককাপ খাই। অম্বল হয়।

কী খাবি বল?

কিছু খাব না। নলিনী কোথায়?

নলিনী গেছে রানুর বাড়ি। নাতির চিকেন-পক্স হয়েছে, দেখতে। নলিনীর বাতের ব্যথাটা বড়োই বেড়েছে। আজ তো আবার পূর্ণিমা।

অ। যাই বলিস, নলিনী, সেই গানটা বড়ো ভালো গাইত রে। মনে আছে রমেন? সেই যে আমরা সকলে মিলে একবার হাজারিবাগে গেছিলাম। দোলের দিন ছিল, না রে? কী যেন লাইনগুলো? এখন আর মনে থাকে না সব। ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা’, তাই না?

হুঁ।

হুঁ কী রে?

কিছু না, এমনিই হুঁ।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইলেন। কথাবার্তা হল না।

রমেনবাবুর বড়োছেলের ছোটোছেলে ভেতর থেকে বাইরে এল লাফাতে লাফাতে, গান গাইতে গাইতে।

‘হাম তো গ্যয়ে বাজারসে লানেকা রোট্টি, রোট্টি মোট্টি কুছ না মিলু পিচ্ছে পড়ে মো—ট্টি।’

এই জিজো, চুপ কর। রমেনবাবু ধমকে উঠলেন।

জিজো অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেল।

বলল, দাদু। বাবা না টেলিফোন করেছিল। মাকে বলতে বলেছে, আজকে লছমনদাসের বাড়িতে ককটেল-পার্টি আছে। আসতে দেরি হবে।

তা আমাকে বলছিস কেন?

বারে? মা তো নেই। মামাবাড়ি গেছে।

মাকে ফোন করে বলে দে।

বারে, মামাবাড়ির সকলে আজ মুনলাইট পিকনিকে গেছে, এখন তো কলকাতায় কাটাকাটি কম হচ্ছে, তাই।

বুঝেছি। যা পড় গিয়ে।

জিজো, ‘রে মাম্মা। রে মাম্মা। রে—এ—এ’…করতে করতে সিঁড়ি টপকে চলে গেল দোতলায়।

আজকাল এই ককটেল-পার্টিও কেমন বেড়ে গেছে দেখেছিস? মদ খাওয়া যেন জল-ভাত হয়ে গেছে। আবার শীতের মধ্যে মুনলাইট পিকনিক। পারেও বাবা এরা! ভাব দেখে মনে হয়, জীবনে সব যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা চাই, সব এক্ষুনি চাই।

হরেনবাবু মুখ নীচু করে বললেন—বলিস না আর, মেয়েরা পর্যন্ত খাচ্ছে।

কী?

আর কী? মদ।

আচ্ছা এরা কী আনন্দ পায় বল তো? এমন করে ওরা কী পায়? মাঝে মাঝে, বুঝলি রমেন; আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, এরা সুখী কি না! যে ভুলগুলো ওরা এখন করছে, এগুলো কীভাবে ওরা শোধরাবে? তোর কী মনে হয়?

মনে অনেক কিছুই হয়। কিন্তু বলে লাভ কী?

আরও কিছুক্ষণ ওঁরা চুপচাপ বসে রইলেন। রমেনবাবু বাটা খুলে আর একটা পান খেলেন। তার পর নিজের মনেই বললেন, নলিনী এখনও ফিরল না। ফেরা উচিত ছিল।

হরেনবাবু বললেন, তুই আজকাল হাঁটতে যাস না? সকালে বিকেলে?

যাই। তবে বিকেলে বড়ো একটা যাই না। আগে তো যাওয়া একেবারেই বন্ধ ছিল। নকশালদের কাটাকাটির ভয়ে। আর এখন আবার ঠাণ্ডাটা বড়ো জোর পড়েছে।

পড়বেই তো। যা বৃষ্টি গেল! মনে আছে, নাইনটিন থার্টিফোরে, আমার বিয়ের বছর ঠিক এইরকম ঠাণ্ডা পড়েছিল।

তুই এখনও সেরকমই মিথ্যুক আছিস। বুঝলি হরেন।

কেন? কেন? একথা বলছিস কেন?

নতুন বউয়ের সঙ্গে শুয়েছিলি, শীত বুঝলি কী করে?

হরেনবাবু হেসে উঠলেন। রমেনবাবুও হাসলেন। এতক্ষণ পর ওঁরা এই প্রথম হাসলেন। হরেনবাবু বললেন, ঘরভরতি নাতি-নাতনি। শালা, তোর মুখ এখনও ঠিক হল না।

রমেনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তুই কি এখনই উঠবি? তাহলে চল তোকে বাস-স্টপ অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি।

চল-না, তা হলে খুব ভালো হয়।

তুই একটু বোস, আমি বাঁদুরে টুপি আর লাঠিটা নিয়ে আসি। প্যান্টটাও পরে আসি।

তাই যা। আর শোন, তোর কাছে চ্যবনপ্রাশ আছে?

আছে, কিন্তু বড়োবউমা চ্যবনপ্রাশ খেতে দেয় না। বলে তেলাপোকার ডিমের মতো গন্ধ বেরোয় ও-থেকে। আমাকে একগাদা ভিটামিন-সি ট্যাবলেট কিনে দিয়েছে। তাই নিয়ে আসছি। ক-টা নিয়ে যা পকেটে পুরে। এবেলা ওবেলা খাস। ভালোই হবে। বউমা ভাববে, আমি নিয়মিত খেয়ে খেয়ে ফুরিয়ে ফেলেছি। লক্ষ্মী শ্বশুর।



রমেনবাবু ও হরেনবাবু যখন বাড়ি থেকে বেরোলেন তখন প্রায় সাতটা বাজে। তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে সাদার্ন অ্যাভিনিউতে এসে পড়লেন। চারিদিকে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব। ধোঁয়ার জাল গাছগুলির মাথা ছেড়ে উঠতে পারেনি। তারইমধ্যে বাসগুলো ডিজেলের কালো ভারী ধোঁয়া ছেড়ে তাকে আরও ভারী করে তুলছে। এখানে ওখানে কেরোসিনের বাতি জ্বেলে ফুচকাওয়ালা ভেলপুরিওয়ালারা ফুটপাথের পাশে পাশে বসে আছে। চারিদিকে কেমন যেন একটা অস্বাস্থ্যকর থমথমে পরিবেশ। নি:শ্বাস-রোধকারী বিষণ্ণতা।

হাঁটতে হাঁটতে রমেনবাবু ভাবছিলেন, তাঁর মনের যেখানে যেখানে যতগুলি আনন্দের উৎস ছিল, সবই যেন একে একে শুকিয়ে গেছে। আয়নায় নিজের দিকে তাকালেই আজকাল রমেনবাবুর বড়ো কষ্ট হয়। তোবড়ানো গাল, সাদা শণের মতো চুল, তাও সামনের দিকের চুল সবই উঠে গেছে। দু-চোখে পৃথিবীর সমস্ত নিরাশা আর রিক্ততা। চোখে কোনো ঔজ্জ্বল্য নেই। ব্যাঙের পিঠের মতো নিষ্প্রভ ঠাণ্ডা চোখ। অথচ আয়নার ঠিক ওপরেই তাঁর আর নলিনীবালার একটি ফোটো আছে বিয়ের সময়কার। সে ফোটো এখন যে দেখে, সেই তাকিয়ে থাকে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের সেই প্রয়োজনীয় চকচকে যুবক আজকের এই অপ্রয়োজনীয় খসখসে বৃদ্ধকে যেন উপহাস করে সবসময়।

কিছুক্ষণ পরে রমেনবাবু হরেনবাবুকে শুধোলেন, কী রে? তোদের দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেল। একবার যাবি না এবারে।

না। হরেনবাবু বললেন অভিমানের গলায়। শালা, তোর দেশ বুঝি হল না?

আমার তো উত্তরবঙ্গ আর তোর তো খাস পূর্ববঙ্গ। তা, যাবি না কেন?

দুর, আমার নিজের ঘর, যে ঘরে বারো মাস, গতপঁয়তাল্লিশ বছর কাটালাম, তাই-ই এখন আমার কাছে বিদেশ। ছেলে-মেয়ে স্ত্রী, সকলেই বিদেশি। আজ আর অত দূরের দেশে গিয়ে আমার কোন আপনজনের দেখা পাব বল? আসলে এখন আমাদের একমাত্র দেশ, যে দেশে আমাদের যাবার সময় হয়েছে, তা একটাই। সেই অজানা দেশ। কী বলিস—?

বলেই, আঙুল দিয়ে ওপরের দিকে দেখালেন।

হুঁ।

হুঁ না। সেটাই সত্যি।

একটু পর রমেনবাবু বললেন, দেশের কথা তোর মনে পড়ে না? একবারও পড়ে না?

পড়ে। মাঝে মাঝেই পড়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। স্বপ্ন দেখি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে ইলিশমাছের নৌকো এসে লেগেছে ঘাটে। নাকে যেন জলের গন্ধ, নৌকোর গন্ধ, মাঝির গায়ের গন্ধ, সকালের গন্ধ, মাছের গন্ধ পাই। কখনো-সখনো গঞ্জের স্বপ্ন দেখি, পাটালি গুড়ের পাহাড়, ঝোলা গুড়ের হাঁড়ি, এইসব। এইসব তো আজকাল স্বপ্নই! বল? তবে কী জানিস? স্বপ্নগুলোকে, আমাদের জীবনের সব স্বপ্নগুলোকেই নির্ভেজাল স্বপ্ন রাখাই ভালো। স্বপ্নের মধ্যে বাস্তবের বেনো জল ঢুকলেই সব শেষ। কাল আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমার ছোটোবউমা থোড় আর নারকেল দিয়ে একটা তরকারি রেঁধেছে আমার জন্যে। আমি মাটিতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে খাচ্ছি। সুনীতি একটা মটরবালা পরে, লাল কস্তাপেড়ে শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়ে, লাল টুকটুকে পান-খাওয়া মুখে আমার সামনে বসে খাওয়া-দাওয়া তদারকি করছে। ছোটোবউমা বলছে, বাবা! আর একটু নিন। আপনি এই তরকারি খেতে ভালোবাসেন। আর একটু নিন।

বা:। রমেনবাবু স্বগতোক্তি করলেন। ভাবলে, অবাক লাগে, না রে? আমরা যা ভালোবাসি, ভালোবাসতাম, তা আজকাল আর কেউই ভালোবাসে না। আমরা যা ভালোবাসি, তা কেউই করতে বা দিতে চায় না। আশ্চর্য লাগে। আসল ব্যাপারটা কী জানিস? ওদের মধ্যে আর আমাদের মধ্যে কোনো কমিউনিকেশন নেই। আমাদের যাই বলার ছিল, ওদের তার কিছুমাত্রই বলতে পারি না। আর ওদেরও…

ওদের আবার বলার কী থাকবে? ওদের যা বলার সবই আমরা বুঝতে পারি। ওরাই বুঝতে চায় না আমাদের কথা। কখনো বুঝতে চাইলে তো বুঝতে পারবে?

আমরাও কি বুঝতে চাই? জানি না। ওদের যা বলার ছিল তাও হয়তো ওরা বলতে পারে না আমাদের।

হরেনবাবু বললেন, রমু। একটা জায়গায় যাবি?

কোথায়?

বাবা জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্রর কাছে।

তিনি আবার কে? তুই জোটাসও যত বাবা-মা। তুই কি সারাজীবনই অনাথই থাকবি?

সে কী রে? নাম শুনিসনি? তাঁর কত শিষ্য? একবার চল, মনের এই অশান্তি দূর করে আসব। আমার সম্বন্ধী এঁর খোঁজ দিয়েছেন। একদিন চল, সকাল আটটা কুড়ির লোকালে চলে যাই। আধ ঘণ্টার পথ। যাবি?

ইচ্ছে তো করে। কিন্তু বিপদ আছে।

কীসের বিপদ?

আরে নলিনীকে নিয়ে বিপদ। সারাজীবন তাকে গুরু করতে মানা করে এলাম, কত ধমকে-ধামকে বললাম, এসব বুজরুকি, আর শেষে কিনা বুড়োবয়সে নিজেরই এই অধঃপতন। যেতে পারি, তবে নলিনী যেন ঘুণাক্ষরে না জানে।

আরে পতন তো চিরকাল অধোলোকেই হয়। কে আর কবে ঊর্ধ্বলোকে পড়েছে বল? তা ছাড়া নলিনী জানবে কী করে? আমি তো বলব মাছ ধরতে যাচ্ছি। সুনীতিও কি জানতে পেলে রক্ষা রাখবে নাকি? সারাজীবন আমি তো ওকে বলে এসেছি, পতি পরমগুরু, এর চেয়ে বড়ো গুরু আর কে আছে!

আচ্ছা ভেবে দেখ, একটা কথা, আমার ও তোর স্ত্রীরা সারাজীবন বেশ বাধ্য রইল, চমৎকার ব্যবহার করল। আমাদের গুরুজ্ঞানে দেখল, অথচ এই শেষবয়েসে এসে এমন বিদ্রোহ করে উঠল কেন বল তো?

সেই তো ভাবি। কিছু বুঝতে পারি না। কেন এমন হল। আমার মনে হয়, বউমাদের সঙ্গ-দোষে। দেখাদেখি শ্যাখা নাচে। চল যাওয়া যাক। আমি তা হলে আগামী রবিবার সব বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলি। বাবার ওখানেই প্রসাদ খাব। বিকেলের দিকে ফিরে আসব সকালে গিয়ে।

রবিবার, মানে তো পরশু। আজ তো শুক্রবার। তাই না?

হ্যাঁ। পরশু।

ঠিক আছে। বলে রমেনবাবু পথে লাঠিটা একটু ঠুকলেন।

ওই একটা ন-নম্বর বাস আসছে। আমি তা হলে চলি। হরেনবাবু বললেন।

আচ্ছা, আয়। সাবধানে উঠিস। থামুক ভালো করে আগে।

ন-নম্বর বাসটা এসে গেল। হরেনবাবু উঠে গেলেন। বাসটা ছেড়ে দেবে এমন সময় দোতলা থেকে একটি ফুটফুটে অল্পবয়েসি মেয়ে তরতর করে নেমে এল। পথে নেমেই, দোতলার জানলায় মুখ তুলে চাইল। রমেনবাবুও মুখ তুলে চাইলেন, দেখলেন একটা সুদর্শন ছেলে মুখ বাড়িয়ে আছে ওপর থেকে। ওরা দুজনে দুজনকে হাত নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। বাসটা ছেড়ে দিল। বাসটা ছেড়ে দিতেই মেয়েটি এদিকে মুখ ফেরাল। মুখ ফেরাতেই রমেনবাবু দেখলেন, তাঁর বড়ো নাতনি হাসি।

রমেনবাবু ও হাসি পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে অপলকে চেয়ে রইলেন। রমেনবাবুর মনে হল, হাসির সমস্ত মুখে একটা দারুণ খুশি ছড়িয়ে আছে। ওর উজ্জ্বল দুটি চোখ আনন্দে উত্তেজনায় চকচক করছে। এই বিষণ্ণ নিরাশ শীতার্ত রাতে কুয়াশা আর ধোঁয়ায় ম্লান পথের ঘোলাটে আলোর নীচে দাঁড়িয়ে হঠাৎ রমেনবাবুর মনে হল, হাসি যেন অন্য কোনো গ্রহের মানুষ। ওর সঙ্গে রমেনবাবুর, তাঁর চারিধারের পৃথিবীর; যেন কোনোই মিল নেই।

অনেকক্ষণ পর হাসি রমেনবাবুর দিকে এগিয়ে এসেই হেসে উঠল। বলল, ও-ও-ও, আমার ডার্লিং দাদু, আমার লক্ষ্মী দাদু, এটা কী পরেছ মাথায়? তোমাকে ঠিক একটা ভাল্লুকের মতো দেখাচ্ছে।

রমেনবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, তা কী হবে! বুড়োদের ঠাণ্ডা বেশি!

ঠাণ্ডা বেশি বলে তুমি মাথায় ওইরকম একটা জিনিস পরবে? না, কালই আমি তোমার জন্যে একটা ভালো টুপি কিনে আনব। তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি। তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম যে! কোথায় চললে, এই পোশাকে? কার অভিসারে। বলো না দাদুমণি?

রমেনবাবু এই নাতনিকে বড়ো ভালোবাসেন। ও যখনই আসে, ওর হাসি, ওর প্রাণের উচ্ছ্বাসে রমেনবাবুর সব গুমোট ও ফুঁ দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। মনে মনে ওকে খুব ঈর্ষা করেন রমেনবাবু। হয়তো ওদের জেনারেশানের সকলকেই করেন।

এই নাও দাদু। তোমার জর্দা। তোমার ফেভারিট ব্র্যাণ্ড।

রমেনবাবু হাত বাড়িয়ে লাল-রঙা জর্দার কৌটোটা নিয়ে বললেন, হাত নাড়লি কাকে? ছেলেটি কে?

হাসি কিছুক্ষণ দাদুর মুখের দিকে চেয়ে রইল, তার পর বলল, তোমার চোখ তাহলে যত খারাপ বলো, তত খারাপ হয়নি। দেখেই যখন ফেলেছ তখন কেমন দেখলে বলো?

দেখতে পেলাম আর কই? দেখার আগেই তো বাস ছেড়ে দিল।

ও তোমার নাতজামাই।

রমেনবাবু স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। চুপ করে রইলেন।

হাসি বলল, চলো আমরা এগোই। লেকের দিকে যাবে? চলো না, একটু পায়চারি করি। তুমি যেন আমার বয়ফ্রেণ্ড!

রমেনবাবু কথা না বলে অন্যমনস্কের মতো হাঁটতে লাগলেন। তার পর হঠাৎ বললেন, কী? রেজিস্ট্রিও হয়ে গেছে নাকি?

হাসি হেসে উঠল। বলল, কী মুশকিল? রেজিস্ট্রি কেন, ভালো করে জাঁকজমক করেই বিয়ে হবে, যখন হবে। এখনও হয়নি। কিন্তু একটা কথা, তোমার তো পুটুর-পুটুর করে সব কথা দিদাকে বলা চাই। দিদাকে বা আমার মাকে যেন এসব কথা বোলো না। বললে, কিন্তু তোমার সঙ্গে কখনো কথা বলব না।

বলবে না তো? বলো? প্রমিস?

প্রমিস।

রমেনবাবু বললেন।

তার মানে, তোর বাবা এসব জানে এবং সে তাকে প্রশ্রয় দেয়?

রমেনবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন।

‘প্রশ্রয় দেয়’ বলছ কেন দাদু? আমি তো কোনো অন্যায় করছি না।

হুঁ।

হুঁ কী?

কিছু না। ছেলেটি করে কী? কার ছেলে?

অত প্রশ্নের জবাব একবারে দেওয়া যায় নাকি! এসো এই বেঞ্চে বসি। চিনাবাদাম খাবে দাদু?

না।

আইসক্রিম?

না। কাশি হয়েছে।

ফুচকা? খাও না দাদু। খেয়ে দেখোই কেমন লাগে। এই বলে, হাসি ফুচকাওয়ালার দোকানের সামনে দুটি শালপাতার ঠোঙা চেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

রমেনবাবু এমনই কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিলেন যে, কোনো কথা বলতে পারলেন না। তা ছাড়া, কথা বলার আগেই হাসি একটা জলভরা ফুচকা তাঁর মুখে পুরে দিল।

ফুচকা খেয়ে দাদুর হাত-টাত ধুইয়ে হাসি দাদুকে নিয়ে এসে বেঞ্চে বসল। তার পর বলল, এবার বলো দাদু তোমার কী কী প্রশ্ন আছে?

না কোনো প্রশ্ন নেই। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। আমরা তোদের এই দুনিয়ায় একেবারে অচল হয়ে গেছি।

দাদু একটা কথা বলব?

বল কী বলবি?

দাদু, ব্যাপারটা কী জানো, তোমরা সবসময় তোমাদের নিজেদের সুখ নিয়ে বড়ো বেশি মাথা ঘামিয়েছ। জগতে যা কিছু ঘটছে সব কিছুকেই তোমাদের নিজেদের দিক ও স্বার্থ দিয়েই বিচার করে এসেছ। ফলে, আমার সুখ, মামা-মামিদের সুখ, দিদার সুখটাও যে তোমারও সুখ এই কথাটাই তুমি কখনো বুঝতে পারোনি। তুমি কখনোই ভাবো না যে, তুমি একটা বড়ো গাছের মতো। তুমি হচ্ছ গিয়ে ‘ফাদার অফ দ্য ফ্যামিলি’। তোমাকে ঘিরেই আমরা সকলে হয়েছি, আছি। এই দারুণ পৃথিবীতে এসেছি। তাই তোমার এই টুকরো টুকরো তুমিগুলো যদি খুশি হয়, সুখী থাকে, তা হলে তোমার মধ্যে তো এই সমস্ত সুখের যোগফলই জমে থাকা উচিত। বুঝলে দাদু, আমার মনে হয়, একটা বয়েসের পর মানুষের নিজের সুখ আর তার নিজের সুখ থাকে না, তার ছেলে-মেয়ের সুখ, নাতি-নাতনির সুখ নিয়েই তখন তাদের সুখ। তুমি কি এটা মানো না দাদু?

রমেনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, মানবার, বোঝবার চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনি এখনও।

এখনও পারোনি, কিন্তু চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই পারবে। তোমাদের সময় আর আমাদের সময় এক নয় দাদু। জীবন সম্বন্ধে ধারণা বদলে গেছে। জীবনের মানে, সম্পর্ক, সে ছেলের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কই বলো, বাবার সঙ্গে ছেলে-মেয়ের সম্পর্কই বলো, সবই বদলে গেছে। প্রতিমুহূর্তেই বদলাচ্ছে। এখনও যদি তোমার নিজের চারপাশে তোমার পুরোনো জানাগুলোরপরিমন্ডল গড়ে তারমধ্যে তুমি একটা আর্টিফিশিয়াল স্যাটেলাইট হয়ে বসে থাকো তা হলে তোমার তো মন খারাপ লাগবেই দাদু। কী বুঝলে?

বোঝার চেষ্টা করছি।

হ্যাঁ তাই ভালো। আমার দাদুর মতো এমন একজন ইন্টেলিজেন্ট লোক এটুকু বুঝতে পারবে না, তা আমি কখনোই মানি না।

তোর লেকচার তো শুনলাম, এবার আমার নাতজামাই-এর কথা বল।

হাসি আবার হাসল। বলল, তা পাত্র ভালোই। চেহারা আমার তো ভালোই লাগে। আশা করি, তোমারও লাগবে। ডাক্তারি পড়ে। ফাইনাল ইয়ার। প্রত্যেকবার ফার্স্ট—কি সেকেণ্ড হয়। নাম চাঁদ। চাঁদ মালহোত্রা।

রমেনবাবু চমকে উঠলেন, বললেন, বলিস কী রে? পাঞ্জাবি?

হাসি আবার হাসল। বলল, বারে! কত লোক চাঁদে চলে গেল, আর আমি একহাজার মাইলও যেতে পারব না?

হুঁ। ছেলের বাবা কী করে?

বাবা নেই। পাঞ্জাবের দাঙ্গার সময় পাকিস্তানিরা কেটে ফেলেছিল। মা আছেন। মা খুব ভালো। দারুণ মুরগি রাঁধতে পারেন। তুমি কি রাজমা খেয়েছ কখনো দাদু? তোমাকে খাওয়াব।

রাজমাটা আবার কী জিনিস?

দারুণ ভেজিটেবল প্রোটিন। খেলে বুঝবে। চাঁদের এক বড়ো দাদা আছেন, তিনি ইণ্ডিয়ান এয়ারফোর্সে। নো ননদিনি। চাঁদের মা আমাকে খুব ভালোবাসেন।

আর সে ছোকরা?

কে? চাঁদ?

হুঁ।

রমেনবাবু বললেন।

হাসি মুখ ফিরিয়ে দাদুর দিকে চেয়ে হাসল। বলল, জানি না। বোধ হয় বাসে। তবে, তুমি দিদাকে যতখানি ভালোবাসো ততখানি কি আর বাসে? না, বাসা সম্ভব?

হুঁ।

কী যে তুমি সবসময়ে হুঁ হুঁ করো না দাদু ভালো লাগে না। চলো এবারে বাড়ি চলো। ঠাণ্ডা লাগলে, দিদা আমাকে বকে একসা করবে।

চল।

রমেনবাবু, নাতনির পাশে পাশে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন। পথে হাসি আবার বলল, তোমার প্রতিজ্ঞা মনে আছে তো? মাকে আর দিদাকে যেন বলবে না।

তোর দেখছি নিজে মেয়েমানুষ হয়েও মেয়েমানুষের ওপর মোটে ভরসা নেই।

আমরা যে মেয়ে, এতদিন তো আমরা কূপমন্ডূক হয়েই ছিলাম দাদু। ছেলেরা যতখানি উদার হয়, হতে পারে; আমরা তা এখনও যে হতে পারি না। জানাব না কেন? সময় হলে আমি নিজেই জানাব। তবু কুরুক্ষেত্র সামলাবার ভার কিন্তু তোমার আর বাবার।

তার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলেন দুজনে।

হঠাৎ হাসি বলল, আচ্ছা দাদু, তুমি সামনের রবিবার কী করছ?

আমি আবার কী করব? বাংলা ইংরিজি দুটি খবরের কাগজ পড়ব তন্ন তন্ন করে। তার পর আর কী? খাব, ঘুমোব, বিকেলে বারান্দায় বসে থাকব, সন্ধেয় বাঁদুরে টুপি পরে বেড়াতে বেরোব, রাতে তোর দিদার সঙ্গে ঝগড়া করব, তার পর ঘুমুবার চেষ্টায় সারারাত জেগে থাকব। এই বয়েসে আবার করার মতো আর কিছু থাকে নাকি? যা করার ছিল সবই শেষ।

তা হলে শোনো দাদু, এবার থেকে প্রত্যেক রবিবার তুমি আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবে।

কোথায়?

আমরা যেখানে যেখানে নিয়ে যাব। কোথায় যাব তা আমরা আগে থাকতে ঠিকই করি না।

কী যে বলিস। তোদের সঙ্গে আমি বুড়োমানুষ কী করে যাব?

তুমি যেতে চাও না বলো? বুড়ো তো তুমি জোর করে নিজেকে করে রেখেছ। পৃথিবীর মধ্যে থেকে, তোমার হাতে তৈরি সংসারে থেকেও তুমি মঙ্গলগ্রহের লোকের মতো একলা বসে আছ। তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবেই। কাল আমি চাঁদকে ফোন করে সব ঠিক করে রাখব। রবিবার ঠিক ছ-টার সময় সাদার্ন অ্যাভিনিউ আর লেক রোডের মোড়ে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা তোমাকে তুলে নেব। যদি না আসো, তা হলে খুব খারাপ হবে।

রমেনবাবু বললেন, রবিবার?

হ্যাঁ রবিবার। কেন? আমার চেয়েও বেশি সুন্দরী কারো সঙ্গে তোমার রবিবারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে নাকি?

হাসি বলল।

না, তা না; তবে।

তবে-ফবে না। তুমি আসবে।

হুঁ।

ঠিক আসবে তো?

হুঁ।



শনিবার ভোরবেলা রমেনবাবুর চাকর বামাচরণ হরেনবাবুর বাড়িতে একটি খাম নিয়ে উপস্থিত হল। হরেনবাবু কানে গরম সরষে তেল ঢেলে খোল পরিষ্কার করছিলেন রোদে বসে। চিঠিটা খুলে দেখলেন।

১৬/১২/৭২

‘ওঁ সত্যমেব জয়তে’

ভাই হরেন,

অদ্য সকাল হইতে আমার রক্তচাপ অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছে। সর্বদা মস্তক ঘূর্ণন হইতেছে। এমতাবস্থায় তোমার সহিত জ্ঞানানন্দবাবাকে দর্শন করিতে যাওয়া অবিবেচকের কাজ হইবে বলিয়া মনে করি।

পত্রে তোমার কুশল জানাইবে। মনে কিছু করিবে না।

রবিবার সন্ধ্যায় আমাকে ডাক্তারের নিকট যাইতে হইবে। অতএব ক্লেশ স্বীকার করিয়া আমাকে দেখিতে আসিয়ো না। তোমার বাড়িতে ফোন না থাকায় বাধ্য হইয়া পত্র লিখিতে হইল। আমার জন্যে কোনোরূপ চিন্তা করিয়ো না। ইতি—

শ্রীরমেন্দ্রমোহন রায়
শ্রীহরেন্দ্রচন্দ্রমৈত্র
বন্ধুবরেষু

সেদিনের দুপুর যেন আর পার হয় না।

অনেক বার রমেনবাবু বারান্দায় পায়চারি করলেন। শীতের বিকেলের বিষণ্ণ সোনালি রোদ বারান্দার রেলিং-এর ক্ষীণকায় ছায়াগুলির পাশ থেকে সরে গেল। লাফিয়ে লাফিয়ে। যেন এক্কা-দোক্কা খেলে।

এক সময় রমেনবাবু একসঙ্গে দুটি পান মুখে ফেলে পথে বেরোলেন। আজ আর বাঁদুরে টুপি পরেননি। আলমারি খুলে একটা ফুল-তোলা টুটালের টাই বের করে পরেছিলেন, একটি ছাই ছাই গরম স্যুটের সঙ্গে। রিটায়ারমেন্টের আগে ওই শেষ স্যুট। কালো জুতো বামাচরণকে দিয়ে ভালো করে পালিশ করিয়ে নিয়ে পরেছিলেন।

ঘড়ি দেখে, সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় নলিনীবালা বললেন, অনেকদিন পর তোমাকে বেশ সাহেব সাহেব দেখাচ্ছে গো। কত্তদিন এসব জামাকাপড় পরো না। পরো না কেন? পরলেই পারো। চাটুজ্জেসাহেবের বাড়ি যাচ্ছ, একটু সেজেগুজে তো যেতে হয়। জামাকাপড়ের ওপরও মনের ভাব নির্ভর করে।

প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল রমেনবাবু লেক রোড আর সাদার্ন অ্যাভিনিউর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কারুর দেখা নেই।

হঠাৎ তাঁর প্রায় গা ঘেঁষে একটা স্কুটার চলে গেল। স্কুটারটা একটু এগিয়ে গিয়েই থেমে গেল। হাসি নেমে পড়ে দৌড়ে এল। স্কুটারটা পার্ক করিয়ে ছ-ফুট লম্বা বেশ হ্যাণ্ডসাম একটি ছেলে এসে রমেনবাবুর হাত দু-হাতে চেপে ধরে বলল, হ্যালো দাদু। নাইস মিটিং উ্য।

হাসি বলল, শিগগিরি চলো দাদু। আমরা প্রথমে সিনেমায় যাব। খুব ভালো একটা ছবি হচ্ছে। রাজেশ খান্না-শর্মিলা ঠাকুরের। ছবি দেখে, তার পর চাঁদের বাড়িতে যাব। সেখানে আমাদের নেমন্তন্ন। চাঁদের মা তোমার জন্যে সরষু-শাক আর আণ্ডা-তড়কা রেঁধে রাখবেন। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি শুনে তিনি ভীষণ খুশি।

রমেনবাবু কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত পেলেন না।

তিনি দেখলেন, তিনি স্কুটারের পেছনে বসে আছেন, তাঁর সামনে হাসি চাঁদের গায়ে লেপটে বসে আছে। আর চাঁদ চালাচ্ছে। রমেনবাবুর চোখের সামনে হাসির সবুজ শাড়ির আঁচলটা পতপত করে উড়ছে, মনে হচ্ছে আঁচল নয়, যেন কোনো নিশান; কোনো বিশেষ যুগের নিশান। কোনো অন্য গ্রহর নিশান।

প্রথমে খুব ভয় করছিল। জীবনে এই প্রথম স্কুটারে চড়লেন তিনি। কিন্তু এখন ভয় কেটে গেছে। ঝাঁকুনি দিয়ে স্কুটারটা দারুণ জোরে ছুটে চলেছে। হাওয়ার ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। হঠাৎ রমেনবাবুর মনে হল স্কুটারটা যেন একটা উল্কাপিন্ড।

কোনো অন্য গ্রহের দিকে প্রচন্ড বেগে দৌড়োচ্ছে তাঁকে নিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *