গ্রন্থি-রহস্য
গোদার মতো এমন সচ্চরিত্র এবং গম্ভীর প্রকৃতির বানর আমি আর দেখি নাই। ইহার একটা কারণ এই হইতে পারে যে, গোদা বাংলাদেশের বানর নয়। শুনিয়াছি, সুমাত্রা কি বোর্নিও কি ঐ রকম একটা দ্বীপ তাহার জন্মস্থান।
গোদাকে বানর না বলিয়া অতি-বানর বলা চলে। শুধু তাহার স্বভাব-চরিত্রের জন্য নয়, তাহার চেহারাটাও সাধারণ বানরের তুলনায় প্রকাণ্ড। সোজা হইয়া দাড়াইলে তাহার খাড়াই পাঁচ ফুটের কম হইত না। গায়ে জোরও ছিল অমানুষিক, তিন সুতের লোহার ছড়্ দুই হাতে বাঁকাইয়া দু’ভাঁজ করিয়া দিতে পারিত।
কিন্তু গোদার গুণগ্রাম ব্যাখ্যা করিবার আগে তাহার মালিক শশধরবাবুর কথা বলা উচিত। শশধরবাবু সম্বন্ধে এমন অনেক কথা আমি জানি যাহা আর কেহ জানে না; পনেরো বছর ধরিয়া আমি তাঁহার পারিবারিক চিকিৎসক ছিলাম। পারিবারিক চিকিৎসক কথাটা বোধ হয় ঠিক হইল না। কারণ শশধরবাবুর পরিবারের মধ্যে তিনি স্বয়ং এবং তাঁহার বানর গোদা ছাড়া আর কেহ ছিল না।
শশধরবাবু আদৌ দরিদ্র ছিলেন। তারপর পঁচিশ বছর বয়সে তিনি এক ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা করেন যে, পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উপার্জন না করিয়া তিনি সংসারধর্ম কিছুই করিবেন না। অতঃপর ত্রিশ বছর কাটিয়া গিয়াছে। শশধরবাবু নানাবিধ ব্যবসা করিয়া ধনী হইয়াছেন, কলিকাতার সবচেয়ে মূল্যবান পাড়ায় বাগান-ঘেরা বাড়ি করিয়াছেন। কিন্তু বিবাহাদি করেন নাই। তিনি মিশুক এবং মিষ্টভাষী লোক কিন্তু বাজারে তাঁহার দুর্নাম ছিল। পরদ্রব্য সম্বন্ধে তাঁহার নাকি তিলমাত্র বিবেকবুদ্ধি নাই। তাঁহার সমধর্মী ব্যবসায়ীরা সকলেই তাঁহাকে ভয়ে ভক্তি করিত এবং আড়ালে শশধরবাবু না বলিয়া বিষধরবাবু বলিত।
শশধরবাবুর বয়স এখন পঞ্চান্ন বছর। বছর চারেক আগে তিনি কোথা হইতে গোদাকে আনিয়া বাড়িতে পুষিলেন। গোদা তখনও পূর্ণবয়স্ক হয় নাই, কিন্তু তাহার আকৃতি দেখিয়া পাড়া-পড়্শীর তাক্ লাগিয়া গেল। তবু কেহই বিস্মিত হইল না। শশধরবাবুর মতো যাহাদের একক অবস্থা তাহারা টিয়াপাখি পোষে, কুকুর বেড়াল পোষে, শশধরবাবু বানর পুষিয়াছেন, ইহাতে বিস্ময়ের কী আছে? ইহার মধ্যে যে বহুদূরদর্শী বিষয়বুদ্ধি থাকিতে পারে, তাহা কাহারও মাথায় আসিল না।
গোদা কিছুদিন শিকলে বাঁধা রহিল, তারপর শশধরবাবু তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। বাড়ির সর্বত্র তাহার গতিবিধি, কিন্তু সে কোনও প্রকার দৌরাত্ম্য করিল না, একটা কাচের গ্লাস পর্যন্ত ভাঙিল না। বাগানেও সে যথেচ্ছ ঘুরিয়া বেড়ায়, কিন্তু কখনও গাছের একটা পাতা ছেঁড়ে না। বানরের এইরূপ আদর্শ চরিত্র দেখিয়া সকলে মুগ্ধ। ক্রমে শশধরবাবু তাহাকে এ-বাড়ি ও-বাড়ি যাতায়াত করিতে শিখাইলেন। আমাকে ডাকিবার প্রয়োজন হইলে গোদার হাতে চিঠি দিয়া আমার কাছে পাঠাইতেন। গোদা আসিয়া দ্বারের কড়া নাড়িত, দ্বার খুলিলে চাকরের হাতে চিঠি দিয়া গম্ভীর মুখে বেঞ্চিতে বসিয়া থাকিত। তারপর চিঠির উত্তর লইয়া মন্দমন্থর পদে ফিরিয়া যাইত।
গোদার কার্যকলাপ প্রথমটা পাড়ায় খুবই উত্তেজনার সৃষ্টি করিয়াছিল কিন্তু ক্রমে তাহা সহিয়া গেল। গোদা পরিচিত দশজনের একজন হইয়া দাঁড়াইল।
এইভাবে দিন কাটিতেছে, শশধরবাবু একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। গোদা চিঠি লইয়া আসিয়াছিল, তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া রাস্তায় বাহির হইলাম। শশধরবাবুর বাড়ি আমার বাড়ি হইতে মিনিট পাঁচেকের পথ।
শশধরবাবু একাকী ড্রয়িং-রুমে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, আমরা প্রবেশ করিলে বলিলেন— ‘এই যে ডাক্তার, এসো। গোদা, তুই ঐ কোণের চেয়ারে বোস্ গিয়ে।’
গোদা মুখে অমায়িক গাম্ভীর্য লইয়া কোণের চেয়ারে বসিল। শশধরবাবু তখন সোফায় আমার পাশে উপবিষ্ট হইলেন। লক্ষ্য করিলাম তাঁহার মুখে-চোখে একটা চাপা উত্তেজনা, পঞ্চান্ন বছরের শুষ্ক শরীরেও যেন এই উত্তেজনার আমেজ লাগিয়াছে। তিনি গলায় গিট্কারি দিয়া একটু হাসিলেন, বলিলেন— ‘একটা সুখবর আছে। আজ থেকে কাজকর্ম ছেড়ে দিলাম। এবার সংসারধর্ম করব।’
বুঝিলাম, এতদিনে তাঁহার জীবন-ব্রত উদ্যাপিত হইয়াছে। তিনি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা রোজগার করিয়াছেন। আমি তাঁহার মুখের পানে চাহিলাম। শীর্ণ গাল- বসা মুখ, চোখের কোলে চামড়া কুঞ্চিত হইয়াছে, মাথার কঁচা-পাকা চুলগুলি সংখ্যালঘু মস্তকের লজ্জা নিবারণ করিতে পারিতেছে না। ঝুনা চেহারা। কাজকর্ম হইতে অবসর লইবার উপযুক্ত সময় বটে। কিন্তু সংসারধর্ম! জীবনের তিন ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্যে কাটাইয়া এই শরীরে নূতন করিয়া সংসার পাতা চলে কি?
মুখে মামুলী অভিনন্দন জানাইয়া বলিলাম— ‘তা বেশ তো, ভালই। আপনার এত টাকা ভোগ করবার লোক চাই তো!’
তিনি বলিলেন— ‘শুধু তাই নয়, নিজেরও তো ভোগ করা চাই। তোমাকে ডেকেছি, আমার শরীরটা ভাল করে পরীক্ষা করবে। শরীর অবশ্য ভালই আছে। তুমি তো জানোই, রোগ-টোগ আমার কিছু নেই। তবে— ’
তাঁহার মনের কথা বুঝিলাম। পরীক্ষা করিয়া দেখা গেল শরীরে ব্যাধি কিছু নাই বটে, কিন্তু সর্বাঙ্গীণ ক্ষয়িষ্ণুতা দেখা দিয়াছে। এ বয়সে তাহা অস্বাভাবিক নয়। কাশিয়া বলিলাম— ‘হ্যাঁ— তা— শরীর তো বেশ ভালই। তবে সংসারধর্ম করার ধকলও তো আছে— আপনার অভ্যেস নেই— ’
শশধরবাবু বলিলেন— ‘তোমার কথা বুঝেছি। আমি এর জন্যে তৈরি ছিলাম। তবে শোনো, আমি মতলব করেছি ভিয়েনায় যাব।’
‘ভিয়েনা!’
‘হ্যাঁ, ভরোনফ্ চিকিৎসার কথা জানো তো?’
‘ভরোনফ্ চিকিৎসা! ওঃ— ’
‘আমার সন্দেহ ছিল, তাই গোদাকে পুষেছি। ওকে সঙ্গে নিয়ে যাব— সস্তায় ভাল জিনিস হবে। বুঝেছ?’
চোখের ঠুলি খসিয়া পড়িল। শশধরবাবু প্রকৃতির নিকট পরাজিত হইবেন না, তাই চার বছর ধরিয়া গোদাকে পুষিতেছেন! এখন ভিয়েনায় গিয়া গোদার গ্ল্যান্ড্ নিজের দেহে কলম লাগাইবেন, গোদার যৌবন আত্মসাৎ করিয়া নিজে যুবক হইবেন। তাঁহার বৈষয়িক দূরদর্শিতা দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গেলাম।
শশধরবাবু ডাকিলেন— ‘গোদা, এদিকে আয়।’
গোদা তৎক্ষণাৎ পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া আমার পানে চাহিয়া হাসিলেন, বলিলেন— ‘কেমন হবে মনে হয়?’
আমি ডাক্তার, গ্রন্থি-বদল বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা। সুতরাং সায় দিতে হইল। গোদাকে লক্ষ্য করিলাম, সে সপ্রশ্নভাবে আমাদের মুখের পানে চাহিতেছে, যেন আমাদের আলোচনার মর্মানুসন্ধান করিবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু সে বানর, আমাদের কুটিল অভিসন্ধি বুঝিল না।
নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম— ‘গোদা কিন্তু বাঁচবে না। তখনি তখনি মরবে না বটে, কিন্তু দুচার মাসে শুকিয়ে মরে যাবে।’
শশধরবাবু বলিলেন— ‘সে কথাও ভেবেছি। আমার গ্ল্যান্ড্ তো ফেলাই যেতো, ওর গায়ে বসিয়ে দেব। তাতে কিছুদিন টিকবে।’
হয়তো টিকিবে এবং মানুষের গ্রন্থি বানরের গায়ে বসাইলে কিরূপ ফল হয়, তাহারও একটা পরীক্ষা হইবে। পরীক্ষার ফল যে কিরূপ অদ্ভুত দাঁড়াইবে, তাহা তখনও জানিতাম না। শশধরবাবুকে নমস্কার করিয়া এবং গোদার সঙ্গে শেক্হ্যান্ড করিয়া চলিয়া আসিলাম।
তারপর শশধরবাবু গোদাকে লইয়া ভিয়েনা গেলেন এবং মাস কয়েক পরে ফিরিয়া আসিলেন।
দেখা করিতে গেলাম। ফটকের কাছে গোদা বসিয়া আছে। তাহার চেহারার কোনও তারতম্য দেখিলাম না; মুখ তেমনি গম্ভীর। আমার পানে কপিশ-পিঙ্গল চোখ তুলিয়া একবার চাহিল। মনে হইল তাহার চোখে একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ ঝিলিক মারিয়া উঠিল।
বাড়ির বারান্দায় শশধরবাবু ছিলেন। চেহারার সত্যই উন্নতি হইয়াছে; বয়স দশ বছর কম বলিয়া মনে হয়। আমি সহাস্যে বলিলাম— ‘এই যে, দিব্যি উন্নতি হয়েছে দেখছি।’
অতঃপর তিনি যেরূপ ব্যবহার করিলেন, তাহাতে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। তিনি আরক্ত নয়নে বলিলেন— ‘উন্নতি হয়েছে? তুমি আমার সর্বনাশ করেছ! তুমি যদি মানা করতে তাহলে একাজ আমি করতাম না। যাও— বেরোও! আর যদি আমার বাড়িতে পা দাও, মার খেতে হবে!’ বলিয়া ফটকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।
হতভম্ব হইয়া ফিরিয়া আসিলাম। মাথার মধ্যে একঝাঁক দুশ্চিন্তা তাল পাকাইতে লাগিল। এ কী অভাবনীয় পরিবর্তন! শশধরবাবু হাসিমুখে মানুষের গলায় ছুরি দিতে পারেন, কিন্তু কটু কথা বলিতে আজ পর্যন্ত তাঁহাকে কেহ শোনে নাই। তবে কি হিতে বিপরীত হইয়াছে? গোদার তেজালো গ্রন্থি শশধরবাবুর বুড়ো শরীরে প্রবেশ করিয়া সমস্ত ওলট-পালট করিয়া গিয়াছে? কোন্ দিক হইতে তাঁহার সর্বনাশ হইয়াছে?
এই ঘটনার কয়েকদিন পর হইতে পাড়ায় অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিল। একদিন সকালবেলা আমার ডিস্পেন্সারিতে গিয়া দেখি রাত্রে জানালা ভাঙিয়া কেহ ঘরে ঢুকিয়াছিল, ঔষধের শিশি বোতল সমস্ত ভাঙিয়া তচ্নচ্ করিয়া দিয়াছে। প্রায় পাঁচ হাজার টাকার ঔষধাদি ছিল।
এমন অর্থহীন ধ্বংসলীলায় কাহার কী লাভ? শশধরবাবুর উপর ঘোর সন্দেহ হইল। তিনি আমার উপর চটিয়াছেন, তার উপর বানরের গ্রন্থি তাঁর শরীরে আছে। হয়তো এই সর্বনাশের কথাই তিনি বলিয়াছিলেন। বানরের গ্রন্থি তাহার স্বভাবকে বানরের ন্যায় করিয়া তুলিয়াছে।
তারপর আরও কয়েকটা বাড়িতে উপর্যুপরি অনুরূপ ব্যাপার ঘটিয়া গেল। অজ্ঞাত চোর রাত্রিকালে জানালা ভাঙিয়া বাড়িতে প্রবেশ করে এবং জিনিসপত্র ভাঙিয়া-চুরিয়া চলিয়া যায়; কখনও সোনারূপার দ্রব্য চুরি করিয়া লইয়া যায়!
পাড়ায় হৈ হৈ পড়িয়া গেল। পুলিসে খবর দেওয়া হইল। পাড়ার ছেলেরা লাঠি-সোঁটা লইয়া রাত্রে পাড়া পাহারা দিতে লাগিল।
ইহা যে শশধরবাবুর কীর্তি, তাহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল। কিন্তু একথা কাহাকেও বলিবার নয়। বলিলে কেহ বিশ্বাস করিবে না, উপরন্তু শশধরবাবু হয়তো মানহানির মোকদ্দমা আনিবেন।
আরও কয়েক দিন কাটিল। তারপর হঠাৎ একদিন চোর ধরা পড়িয়া গেল। বিস্ময়ের উপর বিস্ময়! চোর শশধরবাবু নয়, গোদা! আমাদের নিরীহ শান্ত-শিষ্ট গোদা, যে-গোদা বিনা অনুমতিতে গাছের একটা পাতা পর্যন্ত ছিঁড়িত না, সে এই কাণ্ড করিয়া বেড়াইতেছে!
আমার হিসাবের গোড়াতেই গলদ ছিল। বুঝিলাম, গোদার নিষ্পাপ শরীরে শশধরবাবুর দুষ্ট গ্রন্থি প্রবেশ করিয়া এই অনর্থ ঘটাইয়াছে, গোদাকে দুর্জয় চোর করিয়া তুলিয়াছে। গোদা বানর, তাই এত শীঘ্র ধরা পড়িয়া গেল, শশধরবাবু ত্রিশ বছরেও ধরা পড়েন নাই।
শশধরবাবু যে আমার উপর চটিয়াছিলেন, তাহার প্রকৃত কারণ বুঝিতেও বাকি রহিল না। তিনি বৃদ্ধ বয়সে জীবন সম্ভোগ করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু গোদার শুদ্ধ-সাত্ত্বিক গ্রন্থি তাঁহার দেহে প্রবিষ্ট হইয়া উল্টা ফল দিতে আরম্ভ করিয়াছিল, আশাহত শশধরবাবুর সমস্ত আক্রোশ আমার উপর পড়িয়াছিল।
কিন্তু এখন বোধ হয় আমার উপর আর তাঁহার আক্রোশ নাই। যত দিন যাইতেছে, ততই তাঁহার আধ্যাত্মিক উন্নতি হইতেছে। তিনি নাকি বিবাহ করিবেন না, সংসারধর্মের সঙ্কল্প ত্যাগ করিয়াছেন। শুনিতেছি তিনি যোগ অভ্যাস আরম্ভ করিয়াছেন, শীঘ্রই শ্রীমৎ হনুমানদাস বাবাজী নামক সাধুর নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করিবেন।
গোদার জন্য কিন্তু বড় দুঃখ হয়। পুলিস তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া লোহার খাঁচায় পুরিয়া রাখিয়াছে, আর শশধরবাবু তাহার গ্রন্থি চুরি করিয়া ব্ৰহ্মলাভ করিবেন! এর চেয়ে অবিচার আর কি হইতে পারে?’
৩০ আষাঢ় ১৩৫৮