বঙ্গসাহিত্যে বঙ্কিম। শ্রীহারাণচন্দ্র রক্ষিত প্রণীত। মূল্য চারি আনা।
লেখক এই গ্রন্থে স্বহস্তে একটি উচ্চ মঞ্চ নির্মাণ করিয়া তাহার উপরে চড়িয়া বসিয়াছেন, এবং বঙ্কিমকেও সেইসঙ্গে বঙ্গসাহিত্যের আর কতকগুলি পরীক্ষোত্তীর্ণ ভালো ছেলেকে হাস্যমুখে ছোটো বড়ো পারিতোষিক বিতরণ করিয়া লেখকসাধারণকে পরম আপ্যায়িত এবং উৎসাহিত করিয়াছেন। লেখক স্পষ্টই বলিয়াছেন তিনি কাহাকেও খাতির করিয়া কথা কহেন নাই। ভাষা সম্বন্ধে আলোচনা করিতে গিয়া লিখিয়াছেন “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা খুব মিষ্ট বটে, কিন্তু তাহাতেও যেন প্রাণের অভাব দেখিতে পাই। … স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে যখন আমাদের এই মত। তখন অন্য (?) পরে কা কথা।”
শুনিয়া ভয়ে গাত্র রোমাঞ্চিত হইয়া উঠে এবং বড়ো দোর্দণ্ড-প্রতাপের নিকট সহজেই অভিভূত হইয়া পড়িতে হয়। তথাপি কর্তব্যবোধে দুই-একটি কথা বলা আবশ্যক বোধ করি। বর্তমান গ্রন্থকার পাঠকদিগকে নিতান্ত যেন ঘরের ছেলে অথবা স্কুলের ছাত্রের মতো দেখিয়া থাকেন। এক স্থলে শুদ্ধমাত্র বঙ্কিমের “বন্দে মাতরং” গানটি তুলিয়া দিয়া লেখক প্রবীণ হেড্মাস্টারের মতো লিখিতেছেন “বঙ্কিমের কবিত্ব বুঝিলে?” তাহার পরেই প্রতাপ ও শৈবলিনীর সন্তরণ দৃশ্যটি উদ্ধৃত করিয়া দিয়া লেখক নবীন রসিক পুরুষের মতো বলিতেছেন “কবিত্ব কাহাকে বলে দেখিলে? আ মরি মরি! কী সুর রে!” পরপৃষ্ঠায় পুনশ্চ অতি পরিচিত কুটুম্বের মতো পাঠকদের গায়ে পড়িয়া বলিতেছেন “আরও শুনিবে? তবে শুন ।” এক স্থলে দামোদরবাবুর রচিত “কপালকুণ্ডলার অনুবৃত্তি’ গ্রন্থের প্রতি লক্ষ্য করিয়া লেখক নথ-পরিহিতা প্রৌঢ়ার মতো বলিতেছেন– “সে,মৃন্ময়ী আবার পুনর্জীবিতা হইয়া সুখে ঘরকন্না করিতে লাগিল। পোড়াকপাল আর কি!” ভাষার এই-সকল অশিষ্ট ভঙিমা ভদ্র সাহিত্য হইতে নির্বাসনযোগ্য।
গ্রন্থকার, বঙ্কিম-রচিত উপন্যাসের পাত্রগুলির মধ্যে কে কতটা পরিমাণে হিন্দুত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে তাহাই অতি সূক্ষ্মরূপে ওজন করিয়া তাহাদিগকে নিন্দা ও প্রশংসা বণ্টন করিয়া দিয়াছেন। এমনকি, সেই ওজন অনুসারে “মডেল ভগিনী’কেও “চন্দ্রশেখরে’র সহিত তুলনা করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এই যে, এ কথা আমাদের সমালোচকদিগকে সর্বদাই স্মরণ করাইয়া দিতে হয় যে, সাহিত্য-সমালোচনা-কালে মনুসংহিতা আদর্শ নহে, মানবসংহিতাই আদর্শ।
সাধনা, আষাঢ়, ১৩০২