রঘুবংশ। দ্বিতীয় ভাগ। শ্রীনবীনচন্দ্র দাস এম.এ. কর্তৃক অনুবাদিত। মূল্য এক টাকা।
বাংলা ভাষায় সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ করা নিরতিশয় কঠিন কাজ; কারণ, সংস্কৃত কবিতার শ্লোকগুলি ধাতুময় কারুকার্যের ন্যায় অত্যন্ত সংহতভাবে গঠিত– বাংলা অনুবাদে তাহা বিশিষ্ট এবং বিস্তীর্ণ হইয়া পড়ে। কিন্তু নবীনবাবুর রঘুবংশ অনুবাদখানি পাঠ করিয়া আমরা বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছি। মূল গ্রন্থখানি পড়া না থাকিলেও এই অনুবাদের মাধুর্যে পাঠকদের হৃদয় আকৃষ্ট হইবে সন্দেহ নাই। অনুবাদক সংস্কৃত কাব্যের লাবণ্য বাংলা ভাষায় অনেকটা পরিমাণে সঞ্চারিত করিয়া দিয়াছেন ইহাতে তাঁহার যথেষ্ট ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু পঞ্চদশ সর্গে তিনি যে দ্বাদশাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা আমাদের কর্ণে ভালো ঠেকিল না। বাংলার পয়ার ছন্দে প্রত্যেক ছত্রে যথেষ্ট বিশ্রাম আছে– তাহা চতুর্দশ অক্ষরের হইলেও তাহাতে অন্যূন ষোলোটি মাত্রা আছে– এইজন্য পয়ার ছন্দে যুক্ত অক্ষর ব্যবহার করিবার স্থান পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বাদশাক্ষর ছন্দে যথেষ্ট বিশ্রাম না থাকাতে যুক্ত অক্ষর ব্যবহার করিলে ছন্দের সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া যায়; যেন কুঠির পানসিতে মহাজনী নৌকার মাল তোলা হয়। দ্বাদশাক্ষর ছন্দে ধীর গমনের গাম্ভীর্য না থাকাতে তাহাতে সংস্কৃত কাব্যসুলভ ঔদার্য নষ্ট করে। আমরা সমালোচ্য অনুবাদ হইতে একটি পয়ারের এবং একটি দ্বাদশাক্ষরের শ্লোক পরে পরে উদ্ধৃত করিলাম:
প্রসবান্তে কৃশা এবে কোশল-নন্দিনী,
শয্যায় শোভিছে পাশে শয়ান কুমার–
শরদে ক্ষীণাঙ্গী যথা সুরতরঙ্গিণী
শোভিছে পূজার পদ্ম পুলিনে যাঁহার।
সে প্রভামণ্ডলী মাঝে সমুজ্জ্বলা
ফণীন্দ্রের ফণা-উৎক্ষিপ্ত আসনে
রাজিলা বসুধা স্ফুরিত কিরণে,
কটিতটে যাঁর সমুদ্র-মেখলা।
শেষোদ্ধৃত শ্লোকটির প্রত্যেক যুক্ত অক্ষরে রসনা বাধাপ্রাপ্ত হয় কিন্তু পূর্বোদ্ধৃত পয়ারে প্রত্যেক যুক্ত অক্ষরে ছন্দের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিয়াছে। এমন-কি, দ্বিতীয় ছত্রে আর-একটি যুক্ত অক্ষরের জন্য কর্ণের আকাঙক্ষা থাকিয়া যায়।
ফুলের তোড়া। শ্রীঅরবিন্দ গঙ্গোপাধ্যায় প্রণীত। মূল্য এক আনা।
কএই ক্ষুদ্র কাব্যগ্রন্থখানির মধ্যে ” ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি কোকিল” কবিতাটি আমাদের ভালো লাগিয়াছে।
নীহার-বিন্দু। শ্রীনিতাইসুন্দর সরকার প্রণীত। মূল্য চারি আনা।
গ্রন্থকার ভূমিকায় লিখিতেছেন– “পাখি গান গাহিয়া যায়– সুর,মিষ্টি কি কড়া– মানুষে শুনিয়া, ভালো কি মন্দ বলিবে– সে তার কোনো ধার ধারে না; সে শুধু, আপন মনে আপনিই, নীলাকাশ প্রতিধ্বনিত করিয়া, গাহিয়া যায়।’ অতএব ভরসা করি আমরা এই গ্রন্থলিখিত গান ক’টি ভালো না বলিলেও গ্রন্থকারের নীলাকাশ প্রতিধ্বনিত করিবার কোনো ব্যাঘাত হইবে না।
সাধনা, বৈশাখ, ১৩০২