সমালোচক কাব্য । মূল্য এক আনা ।
সমালোচনা স্থলে ভারতী বর্তমান গ্রন্থকারের কোনো একটি কাব্যকে ভালো বলেন নাই, এই অপরাধে ভারতীকে আক্রমণ করিয়া এই গ্রন্থখানি লিখিত হইয়াছে । কিন্তু এই কাব্যখানি পড়িয়া তাঁহার পূর্বতন গ্রন্থ সম্বন্ধে আমাদের মতের কিছুমাত্র পরিবর্তন হইল না। এই লেখার দরুন পাঠকদিগের নিকটেও যে তাঁহার পূর্বগ্রন্থের বিশেষ আদর বাড়িবে, তাহাও নহে। তবে লিখিয়া ফল কী হইল ? লেখক কি মনে বড়ো আনন্দ উপভোগ করিতেছেন ? তবে তাহাই করুন, তাহাতে আমরা ব্যাঘাত দিব না ।
কথাটা এই যে, নিজের লেখা ভালো বলিয়া লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস থাকিতে পারে, তাহা লইয়া কেহ তাঁহার সহিত বিবাদ করিবে না, কিন্তু সমালোচকেরও যে সে বিষয় তাঁহার সহিত মতের সম্পূর্ণ ঐক্য হইয়া যাইবে এরূপ আশা করাটা কিছু অতিরিক্ত হয় । আমাদের মতে অনর্থক গালিমন্দ দেওয়া বা ঠাট্টা বিদ্রূপ করা সমালোচকের কর্তব্য কাজ নহে । কিন্তু যে সমালোচক কোনো প্রকার অভদ্রাচরণ না করিয়া শুদ্ধ মাত্র নিজের মত ব্যক্ত করিয়াছেন, তাঁহার সহিত লেখকের ঝগড়া করা ভালো দেখায় না । সমালোচকের কাজটা দেখিতেছি, ঘরের কড়ি খরচ করিয়া বনের মহিষ তাড়ানো , মাঝে মাঝে গুঁতাটাও খাইতে হয় ।
তৃণপুঞ্জ । শ্রীজ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ বিরচিত । মূল্য আট আনা ।
ইহা একখানি কাব্যগ্রন্থ । মনে হয় যেন,ইহার অনেকগুলি কবিতাতে লেখকের যাহা মনে আসিয়াছে তাহাই লিখিয়াছেন ; তাহার একটা বিশেষ ভাব নাই, একটা দাঁড়াইবার স্থান নাই, একটা উদ্দেশ্য নাই– অথচ তাহার একটা নাম আছে ও তাহার সহিত মিল বা অমিল বিশিষ্ট, বাংলায় বা বিকৃত বাংলায় লিখিত কয়েকটি ছত্র সংলগ্ন আছে । তবে, স্থানে স্থানে কবিত্বের রেখা পড়ে, কিন্তু আবার তখনি মুছিয়া যায়– কবিত্বে সমস্ত ছত্রগুলি ভরিয়া উঠে না, কঠিন ও বিকৃত ভাষার উৎপীড়নে ও ভাবের অভাবে কল্পনা ক্লিষ্ট হইয়া পড়ে । লেখক অনেক স্থলে অনেক ইংরাজি ভাব বাংলায় আনিতে চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা দোষের কথা নহে , কিন্তু তিনি ইংরাজিকে বাংলা করিতে পারেন নাই , মাঝের হইতে বাংলাকে কেমন ইংরাজি করিয়া তুলিয়াছেন। এই গ্রন্থ পড়িয়া স্পষ্ট বুঝা যায়, লেখক বাংলায় কবিতা লিখিতে নূতন প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এই নিমিত্ত এখনো তাঁহার ভাবের প্রবাহ উন্মুক্ত হয় নাই, এখনো তিনি প্রতিকূল ভাষাকে আপনার অনুকূল করিয়া লইতে পারেন নাই, ভাষা তাঁহাকে অপরিচিত দেখিয়া তাঁহার ভাবগুলির প্রতি ভালোরূপ আতিথ্য-সৎকার করিতেছে না । দেখা যাউক ভবিষ্যতে কী হয় ।
শান্তি-কুসুম। শ্রীবিহারীলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ।
বিষয়টা কিছুই নহে, লিখিবার যোগ্যই নয় । বোধ করি গ্রন্থখানি ব্যক্তিবিশেষের জন্য লিখিত, সাধারণের জন্য লেখা হয় নাই । সুতরাং এ গ্রন্থ সমালোচনা করিবার কোনো আবশ্যক দেখিতেছি না । তবে প্রসঙ্গক্রমে বলিতেছি, লেখাটি বড়ো ভালো হইয়াছে । বাংলা ভাষাটি অবিকল বজায় আছে । আধুনিক গ্রন্থগুলি পড়িতে পড়িতে এ গ্রন্থখানি সহসা পড়িলে ইহার ভাষা দেখিয়া কিছু আশ্চর্য বোধ হয় । কিন্তু ইহার আর কোনো গুণ নাই ।
সুরসভা। শ্রীনগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রণীত। মূল্য দুই আনা।
কৈলাস-কুসূম। …
মণি মন্দির। … মূল্য তিন আনা।
পার্থ প্রসাদন।…
প্রমীলার পুরী। … মূল্য এক আনা।
এই গ্রন্থগুলির মধ্যে শেষোক্ত দুইখানি ব্যতীত আর সকলগুলিই গীতিনাট্য । গীতিনাট্যের যথার্থ সমালোচনা সম্ভবে না, কারণ গীতিগুলি কেবলমাত্র পড়িয়া সমালোচনা করা যায় না। গান লিখিবার সময় কবিত্ব কিছু-না-কিছু হাতে রাখিয়া চলিতে হয়, সমস্তটা প্রকাশ করা যায় না, কারণ তাহা হইলে সুরের জন্য আর কিছুই স্থান থাকে না। গানের লেখাতে কবিত্বের যে কোরকটুকুমাত্র দেখা যায় সুরেতে তাহাকেই বিকশিত করিয়া তোলে। এই নিমিত্ত সকল সময় গান পাঠ করা বিড়ম্বনা, তথাপি বলিতে পারি, এই গীতিনাট্যগুলির স্থানে স্থানে ভালো ভালো গান আছে। মণি-মন্দিরের গানগুলিই আমাদের সর্বাপেক্ষা ভালো লাগিয়াছে।
ষড়ঋতুবর্ণন কাব্য। শ্রীআশুতোষ ঘোষ প্রণীত। মূল্য পাঁচ আনা।
গ্রন্থকার লিখিতেছেন “বহু দিবস হইতে আমার ইচ্ছা ছিল যে, পদ্যে একখানি গ্রন্থ রচনা করিব; অধুনা অনেক কষ্টে দুরাশাগ্রস্ত হইয়া অমিত্রাক্ষর চতুর্দশপদী ষড়ঋতুবর্ণন নামক কাব্যখানি রচনা করিয়া মহানুভাব পাঠক মহাশয়গণের করকমলে উপহার স্বরূপ অর্পণ করিলাম।” গ্রন্থকর্তার এতদিনকার এত আশার গ্রন্থখানিকে ভালো না বলিলে তিনি মনে আঘাত পাইবেন সন্দেহ নাই। কিন্তু কর্তব্যানুরোধ পালন করিতে হইলে এ গ্রন্থখানিকে কোনো মতেই সুখ্যাতি করিতে পারি না।
ভারতী, চৈত্র, ১২৮৯