গ্রন্থকার আবুল ফজলের ভূমিকা – মঙ্গলাচরণ
দয়াময় ভগবানের নাম স্মরণ করিয়া গ্রন্থ আরম্ভ করিলাম। হে ভগবান! তোমার মায়া দুরভিগম্য। তুমি অনাদি, অনন্ত এবং অজ্ঞেয়। তোমাতেই আদি-অন্তলীন হইয়াছে। আমি তোমাকে ধন্যবাদ করিতেছি। আমি তোমাকে নমস্কার করি।
আলামী আবুল ফজল ভগবানকে ধন্যবাদ করিতেছেন যে, তিনি তার রাজার অক্ষয় যশ; এবং অতুল কীৰ্ত্তি ঘোষণা করিবার অবসর পাইয়াছেন। তাঁহার পাদশা শা-ইন-শা জ্বালাল-উদ্দীন আর ভারতের প্রজাপুঞ্জকে সুশাসনে রাখিবার জন্য যে সকল নিয় এবং কার্যপদ্ধতি বিধিবদ্ধ করিয়াছিলেন, সেই সকল এই পুস্তকে লিখিত হইল।
প্রজা রাজার অনুরক্ত থাকে, দুই কারণে;-প্রথম, রাজার সুশাসন-ব্যবস্থা দেখিয়া, নিরপেক্ষ বিচার-পদ্ধতি দেখিয়া, রাজার প্রতি ভক্তিমান্ ও শ্রদ্ধাবান্ হইয়া রাজার অনুগত হয়; দ্বিতীয়, যাহারা শাসনভয়ে ভীত হয়, তাহারা সেই ভয়ের তাড়নায় নিরুপায়ে রাজার অনুগত থাকে।
যিনি প্রজার অগ্রণী হইয়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিতে পারেন তিনিই রাজা; যিনি অবিচলিতচিত্তে উচিত-অনুচিত পরিদর্শন করিতে পারেন, যিনি রাজবিদ্রোহে ভীত বা ব্যথিত হন না, যিনি সমকক্ষ ভিন্নদেশীয় রাজার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে ইতস্তত করেন না, তিনিই রাজা; যিনি অকাতরে অর্থদান করিয়া উচ্চ নীচ সকলকে সুখী রাখিতে পারেন, যিনি ভগবানের ইচ্ছার উপর নির্ভর করিয়া শান্তচিত্তে কাৰ্য্য করিতে পারেন, যিনি দারিদ্রে ব্যথিত হন না, ঐশ্বর্যে মত্ত হইয়া ভগবানকে বিস্মৃত হন না, রাজকার্যে অবহেলা করেন না, ক্রোধকে সংবরণ করিতে পারেন এবং লোভকে সংযত রাখিতে পারেন, তিনিই প্রকৃত রাজা; যিনি প্রজাকে সুখে-স্বচ্ছন্দে রক্ষা করিতে পারিলে ভগবানের কাৰ্য্য করিতেছেন বলিয়া মনে করেন, প্রজাগণের স্তুতিবাদে যিনি বিচলিত হন না এবং সুখ্যাতি-লোলুপ হইয়া জ্ঞান ও সদযুক্তির পথ ত্যাগ করেন না, যিনি সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয় পুরুষগণের আদর করিতে পারেন, যিনি আপাতঃ কঠোর পরিণামমধুর উচিতকথা শুনিয়া আনন্দিত হন, যিনি অত্যাচারী উৎপীড়নের অবসর দেন, যিনি প্রজাকে সুস্থদেহে সবলশরীরে আনন্দিতচিত্তে রক্ষা করিতে পারেন, তিনিই প্রধান রাজা।
রাজা প্রজাবৰ্গকে চারি-বিভাগে বিভক্ত করিয়া রাখেন। প্রথম–যোদ্ধাগণ, ইহারা অগ্নির স্বরূপ, এই অগ্নিশিখার বিস্তারে রাজবিদ্রোহ প্রভৃতি জঞ্জাল ভস্মীভূত হইয়া যায়। দ্বিতীয়,–শিল্পী এবং ব্যবসায়ী; হঁহারা সমীরণস্বরূপ, যেমন বায়ু না থাকিলে জীব-জগৎ থাকে না, ভগবান্ যেমন বায়ুর প্রভাবে তাঁর করুণা সৰ্ব্বত্র বিস্তীর্ণ করিয়া দেন, তেমনি শিল্পী এবং ব্যবসায়িদিগের প্রভাবে রাজ্যে অর্থাগম হয়, সুখ-স্বাচ্ছন্দতা হয়, প্রজাগণ সুখে থাকে। তৃতীয়,–পণ্ডিত, জ্ঞানী, চিকিৎসক জ্যোতিষ্য; ইঁহারা সলিলস্বরূপ; জল যেমন সৃষ্ট-জগৎকে স্নিগ্ধ ও শোভাময় করিয়া রাখে, জলসেচনে যেমন পৃথিবীর উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পায়, যেমনি জ্ঞানীর জ্ঞানগবেষণায়, পণ্ডিতের উদ্ভাবনী-শক্তিপ্রভাবে দেশে নিত্য নিত্য নূতন নূতন সামগ্রীর আবির্ভাব হয়, লোকে অর্থোপার্জনে নূতনপন্থা দেখিতে পায় এবং প্রজা ধন-সম্পত্তিতে ভূষিত হয়। চতুর্থ,–কৃষি এবং শ্রমজীবিগণ; ইহারা পৃথিবীতুল্য; ধরিত্রীর যেমন অসীম অনুপম সহিষ্ণুতা আছে, কৃষি এবং শ্রমজীবিগণের তেমনি ধৈৰ্য্যগুণ আছে। কৃষি ধীর ও শান্ত না হইলে, কৃষি সহিষ্ণু এবং পরিশ্রমশীল না হইলে কৃষিকাৰ্য্যই হয় না, ধনধান্যে দেশ পূর্ণ হয় না; তাই ইহারা ধরিত্রীর তুল্য সহিষ্ণু। রাজা প্রজাকে এই চারি বিভাগে বিভক্ত রাখিয়া সুশাসনে নিরপেক্ষ-বিচারে এবং সৎপাত্রে দান ও উৎসাহ দ্বারা সকলকে সুখী করেন।
প্রজার যেমন চারিটী বিভাগ আছে, রাজার রাজশক্তিরও তেমনি চারি শ্ৰেণী আছে। প্রথম,–সেনা; ইহারা নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করিয়া, সংসারের স্নেহ-মায়া-শৃঙ্খলকে ছিন্ন করিয়া, রাজার জন্য অম্লানবদনে রণক্ষেত্রে দেহপাত করিতে পারে। ইহারা অগ্নি-স্বরূপ। যেমন অগ্নি না হইলে আলোক হয় না, যেমন অন্ধকারে আলোক না হইলে সুখের হাসি দেখা যায় না, তেমনি সেনারূপ অগ্নিশিখা শত্রুরূপী অন্ধকারকে দূর করিয়া সুখের ও শান্তির হাসি দেখাইয়া দেয়। ইহাদের প্রধান হইতেছেন উকীল; ইনি পরিচিত। ইনি সকল বিষয়ে রাজার দক্ষিণ হস্তস্বরূপ; রাজকর্মচারিগণের নিয়োগ, উন্নতি, অবনতি, কৰ্ম্মচ্যুতি ইহার দ্বারাই হইয়া থাকে। এই জন্য ইনি উচ্চবংশীয়, বহুজ্ঞ, দাতা, কুসংস্কারশূন্য, সমদর্শী, সদ্বক্তা, সত্যবাদী ও তীক্ষ্ণদৃষ্টি হইবেন। রাজ্যের সমস্ত গূঢ় বিষয় ইহার জানা থাকিবে। যদিচ ইহাকে রাজস্বের এবং আয়ব্যয়ের কোন বিষয় দেখিতে হয় না, তথাপি সে সকল বিষয়ও তাহার জানা উচিত। মীরমহল, মীরবক্সী, উজবেগী, কোরবেগী, মরি আউজিক, মীরবহর, মীরবের, মীর মন্জল, খ সালার মুন্সী এবং খুস্কবেগী, এই সকল কৰ্ম্মচারী হঁহার অধীনে থাকিবে।
দ্বিতীয়,–দেওয়ান; যাহারা রাজস্ব আদায় করেন, রাজ্যের আয়ব্যয়ের হিসাব নিকাশ দেখেন, তাঁহারা বায়ুর ন্যায়। যেমন মলয়সমীরণ মনোমুগ্ধকারী, সেইরূপ ইহারাও নিরপেক্ষ সাধু হইলে প্রজার মনোমুগ্ধকারী হইয়া থাকেন। ইহারা অত্যাচারী প্রজাপীড়ক হইলে ইঁহাদিগকে উষ্ণ পশ্চিমবাতাসের সহিত উপমিত করা যাইতে পারে। এই বিভাগের প্রধান কর্মচারীর নাম উজীর। ইনি অঙ্কশাস্ত্রবিৎ হইবেন, মিতব্যয়ী, নির্লোভ ও ধার্মিক হইবেন এবং মিষ্টভাষী ও সদালাপী হইবেন। ইনি আবার রাজ্যের দপ্তরখানার প্রধান কর্মচারী। মুস্তৌফী-বিভাগের সকল কাৰ্য্য ইনি বুঝাইয়া দিবেন এবং যাহা বুঝিতে পারিবেন না, তাহা উকীলের সহিত পরামর্শ করিয়া মীমাংসা করিবেন। মুস্তৌফীগণ চোতা-বহি লিখিয়া থাকেন এবং দৈনন্দিন সকল ঘটনা লেখেন। মীর সামন সকল কাছারীর পরিদর্শন; মুসরেক খাজনাখানার পরিদর্শক আকে-নবীস, আমীন এবং খালাসা উজীরের অধীনে কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। কোন কোন রাজা উজীরের পদ বা ওজারৎ ওকালতের বা উকীলের পদের অধীনে রাখিয়া থাকেন এবং এক ব্যক্তিকে মুসরেফ-দেওয়ান নিযুক্ত করেন। এই ব্যক্তি উকীলের অধীনস্থ।
রাজার সহযোগী এবং সঙ্গীগণ জলের সহিত উপমিত হইতে পারেন। যেমন জল নদীগর্ভে প্রবাহিত থাকিলে দেশের সকল ময়লা ধুইয়া বাহির করিয়া লইয়া যায়, তেমনি রাজপারিষদৃগণ আইনকানুনের অধীনে থাকিয়া কাৰ্য্য করিলে রাজার মনের অনেক ময়লা দূর করিতে পারেন। আবার জল যদি নদীর দুই কূল ভাসাইয়া দেশ প্রাবিত করে, তাহা হইলে প্রজাগণের মধ্যে হাহাকার পড়িয়া যায়। রাজপরিষদ আইন-কানুনের সীমা
অতিক্রম করিয়া যদি কাৰ্য্য করেন এবং রাজাকে তদনুরূপ পরামর্শ দেন, তাহা হইলে প্রজার মধ্যে হাহাকার পড়িয়া যায়। জ্ঞানী ও ধার্মিক রাজার প্রধান পারিষদ, সাধু ও ফকীর রাজার প্রধান পরামর্শদাতা। হঁহাদের পরে সদর,–এবং মীর আদর কাজী, চিকিৎসক, জ্যোতিষী, কবি এবং ভবিষ্যদ্বক্তা, ইঁহারাও রাজার পারিষদৃরূপে গণ্য হইয়া থাকেন।
রাজার সেবক ও ভত্যমণ্ডলী,–ইহাদিগকে পৃথিবীর সহিত তুলনা করা চলে। পৃথিবীর ন্যায় সহিষ্ণু হইয়া ইহারা রাজার সেবা না করিলে রাজা রাজকাৰ্য্য করিতে পারেন না। খাওয়াস, কীর্জি, সরবৎদার, আবদার, তোষকী, কার্কেরা, ধীমনগার প্রভৃতি রাজার ভৃত্যগণ অহরহ রাজসমীপেই থাকে।
প্রজার মধ্যে পাঁচরকমের লোক আছে, রাজা এই পাঁচরকমের লোকের আচার ও রীতিনীতি জানিয়া রাখিবেন। প্রথম,–যিনি সকল কার্যের সময়নির্ধারণ করিয়া যথারীতি তৎপরতার সহিত কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে পারেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি,–যাহারা পরের উপকারও করেন না, কিন্তু অপকারও করেন না। তৃতীয়,যাহাদের উপকার-অপকার কোন কাৰ্য্যেই চেষ্টা নাই; বিধিবদ্ধ কার্য করিয়া দিনাতিপাত করিলেই যাহারা সন্তুষ্ট হন। চতুর্থ,–যাহারা অতিবুদ্ধিতে নিজেরই অনিষ্ট করিয়া ফেলেন, কিন্তু পরের ইষ্টানিষ্ট করিবার যাহাদের সামর্থ্য নাই। পঞ্চম,–অতি দুষ্টব্যক্তি, যাহারা নিজের ইষ্ট হউক বা নাই হউক, পরের অনিষ্ট করিতে সদা তৎপর। দুষ্টব্যক্তিকে রাজা নগর হইতে তাড়াইয়া দিবেন, ইহাতেও যদি সে নিজের দুষ্টপ্রবৃত্তিকে দমন করিত না পারে, তবে রাজা তাহাকে অন্ধ করিয়া এবং পঙ্গু করিয়া রাখিবেন। কোন প্রজার জীবন লইবার অধিকার রাজার নাই। ভগবান দেহ প্রাণ দিয়া মানুষকে মানুষ সাজাইয়া দিয়াছেন, রাজা ভগবানের দত্ত প্রাণ লইতে পারেন না।
রাজা কখনও নীচব্যক্তিকে রাজকার্যে নিযুক্ত করিবেন না, অপরিচিত ব্যক্তিকে সদাসর্বদা রাজসিংহাসনের নিকটে আসিতে দিবেন না; যাহারা দরবারে উপস্থিত হয়, তাহাদের সকলের সহিত সমভাবে ব্যবহার করিবেন না। রাজা গুপ্তপরামর্শ কাহাকেও বলিবেন না।
ভগবানের জয় হউক! যেন আমি উপরিলিখিত ব্যবস্থানুযায়ী শাসনকথা যথাযথ লিখিতে পারি।