গ্যেটে ও তাঁর দেশকাল
গ্যেটের বয়স যখন চল্লিশ তখন ইউরোপের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে—ফরাসি বিপ্লব। গ্যেটের ব্যক্তিগত জীবনেরও একটা অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। এই ঘটনার জন্যে নয়, অথচ এর সঙ্গে একটা প্রচ্ছন্ন সম্বন্ধও ছিল। সমষ্টির জীবনের সঙ্গে ব্যক্তির জীবন নানা অদৃশ্য সূত্র দিয়ে বাঁধা।
ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে, যে ঘটনা ঘটবে তার ছায়া পড়ে তার পূর্বে। ফরাসি বিপ্লবের ছায়া কেবল ফ্রান্সে নয়, ফ্রান্সের বাইরেও পড়েছিল বেশ কিছুকাল আগে। জার্মানিতে এই ছায়াপাতের যুগটাকে বলা হয় ঝড়ঝাপটার যুগ। এর অগ্রণীদের মধ্যে ছিলেন গ্যেটে স্বয়ং। তাঁর বাইশ-তেইশ বছর বয়সে লেখা ‘গ্যোটস’ নাটক ও তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সে লেখা ‘ভের্টর’ উপন্যাস জার্মানিতে যে ভাবাবেগের সূচনা করে তা কেবল জার্মানিতেই আবদ্ধ থাকে না। ইউরোপের সর্বত্র ‘ভের্টর’-এর অনুবাদ হয়। তা পড়ে বহু যুবক আত্মহত্যা করে। তরুণের প্রাণে তখন এক অভূতপূর্ব অশান্তি। তার যেন কত কী করবার আছে, না করতে পারলে তার জীবন বৃথা, অথচ সময় অনুকূল নয়। সময়ের জন্যে সবুর করতে হবে। সবুর করতে করতে জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ অতিবাহিত হবে। ততদিনে বল বয়স চলে যাবে। কে করবে সবুর!
গ্যেটে হয়তো এই জ্বালা থেকে মুক্ত হবার জন্যে আত্মহত্যা করতেন, কিন্তু তাঁকে উদ্ধার করল তাঁর ভাগ্য। ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি ভাইমারের সামন্তরাজার মন্ত্রীপদে নিযুক্ত হন। রাজকার্যের দায়িত্ব তাঁর অশান্ত অন্তরকে প্রশান্তি দিতে না পারলেও নিত্যনতুন প্রয়াসে ব্যাপৃত রাখল। তাঁর প্রয়াসের বিষয় ছিল কৃষি ও খনি। অন্য কোনো ভাগ্যবান হলে অবিলম্বে বিবাহ করতেন। উপযুক্ত গৃহলক্ষ্মীর অভাব ছিল না। কবি কিন্তু সেদিকে উদাসীন। থাকতেন একটি ছোটো বাগানবাড়িতে। ওটি যদি না পেতেন তাহলে মন্ত্রীপদ স্বীকার করতেন না, ভাইমার থেকে চলে যেতেন। ওই তপোবনে তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল তাঁর মালি ও একমাত্র সঙ্গিনী ছিলেন বিশ্বপ্রকৃতি। সঙ্গিনীর সঙ্গে আলাপের ভাষা হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞান তাঁকে তন্ময় করে রাখল।
এইভাবে কেটে গেল দশ-এগারো বছর। বিপ্লবের ছায়া পড়ছে দেশে-বিদেশে। ঝড়ঝাপটার যুগ সমানে চলছে। লোকে আশা করছে গ্যেটে থাকবেন যুগের পুরোভাগে। তিনি কিন্তু ধীরে ধীরে পেছিয়ে পড়লেন। তেমন লেখা আর তাঁর হাত দিয়ে বেরোয় না। দিন দিন তিনি নিজেকে সংযত ও অনাসক্ত করতে লাগলেন। অথচ সন্ন্যাসীর মতো নয়। ঈশ্বরে তাঁর বিশ্বাস ছিল, মহাপুরুষদের তিনি শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু প্রচলিত ধর্মমতের ওপর তাঁর আস্থা ছিল না। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের নেতাদের সমানধর্মা, রুশো-ভলতেয়ারের সগোত্র। সাঁইত্রিশ বছর বয়সে যখন তিনি ইটালিযাত্রা করেন তখন তাঁর জীবন নানা বিপরীত শক্তির সংঘাতে দোলায়মান ও বিক্ষুব্ধ। কবি ও নাট্যকার হিসেবে তিনি ঝড়ঝাপটার যুগ অতিক্রম করেছেন, কিন্তু কোনখানে নোঙর ফেলবেন তা ঠিক করতে পারছেন না। বিজ্ঞানসাধক হিসেবে তিনি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞান তো মানুষের সৌন্দর্যপিপাসা মেটাতে পারে না। সামাজিকতা তিনি পরিহার করেছেন, ভলতেয়ার ও রুশোর মতো তিনি অবন্ধন। কিন্তু এমন কোন পাখি আছে যার নীড় নেই, সঙ্গিনী নেই, সন্তান নেই? স্বাধীনতা ভালো, কিন্তু অতিমাত্র স্বাধীনতা ভালো নয়।
বছর দুই পরে যখন তিনি ইটালি থেকে ফেরেন তখন তাঁর সাহিত্যের আদর্শ স্থির হয়ে গেছে। ঝড়ঝাপটা এরপর থেকে তাঁর বাইরে। ভিতরে তার প্রবেশ নেই। জানালার খড়খড়ি ও শার্সি তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। প্রাচীন গ্রিক ও রোমকদের মতো তাঁর সৌন্দর্যের আদর্শ ক্লাসিক। স্বদেশের ও স্বকালের রোমান্টিক আদর্শ তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন। কিংবা বলা যেতে পারে তিনিই পেছিয়ে যেতে যেতে প্রাচীন গ্রিস ও রোমে পৌঁছে গেছেন। আর কেউ অমন করে পিছু হটেনি। অথচ বিজ্ঞানে তিনিই সবচেয়ে আধুনিক। তখনকার দিনে বিবর্তনবাদের উদয় হয়নি। গ্যেটেই তার পূর্বদ্রষ্টা। বিজ্ঞানের অন্যান্য বিভাগেও তাঁর দান সেকালের পক্ষে বিস্ময়কর। কোনো বৈজ্ঞানিকের কোনো মতবাদই চিরস্থায়ী হয় না, তাঁর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
ইটালি থেকে ফিরে তিনি সঙ্গিনী গ্রহণ করলেন। শ্রেণির বাধা ছিল বলে হোক বা ধর্মের প্রতি অনাস্থা ছিল বলেই হোক বিবাহের অনুষ্ঠান ঘটল না। হয়তো এক্ষেত্রেও তাঁর ওপর রুশোর প্রভাব পড়েছিল। গৃহিণীকেই গৃহ বলা হয়। গৃহ পেয়ে তিনি স্থিতি পেলেন। অথচ সামাজিক মানুষ হলেন না। সমাজ থেকে যেমন দূরে ছিলেন তেমনি দূরেই, বোধ হয় তার চেয়েও দূরে রইলেন। ওদিকে ডিউক দিলেন তাঁকে রাজকীয় রঙ্গমঞ্চের পরিচালনার ভার। থিয়েটার তাঁকে চিরকাল আকর্ষণ করেছে। এবার সুযোগ জুটল ইচ্ছামতো পরীক্ষানিরীক্ষা করবার।
এসব নিয়ে যখন তিনি সুশৃঙ্খল ও শান্ত, তখন এল কিনা ফরাসি বিপ্লব। আর পাঁচ-দশ বছর আগে আসতে কে বারণ করেছিল! এমন অকস্মাৎ আসবে বলে কোনো নোটিশ দিল না! দেখুন দেখি কী দারুণ অভদ্রতা! মানুষ একটু শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বাদ পাবে চল্লিশ বছর বয়সে, তাও বরাতে নেই। গ্যেটে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করলেন। ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে তাঁর আপত্তির প্রথম কথা হল ওটা শান্তি ও শৃঙ্খলার পরিপন্থী। ভুলে গেলেন যে জার্মানির ঝড়ঝাপটাও আইন বাঁচিয়ে চলবে বলে অঙ্গীকার করেনি। মোট কথা, সবুর করতে পারবে না বলে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছিল। সবুর করতে করতে কেউ কেউ বোঝাপড়া করেছিল। অনেকের বেলায় সে-বোঝাপড়া আপোশের পর্যায়ে পড়ে। গ্যেটের বেলায় তা হয়নি। তাঁর জীবনযাত্রা আর দশজন অভিজাতের মতো ছিল না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও ফিউডাল যুগের নয়। যেসব শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব, তাদের চেয়ে তিনি নিকটতর ছিলেন যেসব শক্তির অনুকূলে বিপ্লব, তাদের। তাঁর স্ত্রী জনগণের কন্যা, যেমন ‘এগমন্ট’-এর ক্লারা। তাঁর প্রকৃতি-আরাধনা বিপ্লবী নায়কদের ধর্ম। তাঁর ‘হেরমান ও ডরোথেয়া’ নতুন ধরনের লোকসাহিত্য। বিপ্লবের পূর্বে রচিত ঝড়ঝাপটা যুগের নাটক উপন্যাস প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ ঘোষণা। বিপ্লবের পরে রচিত ‘স্বয়ংবৃত সম্পর্কাবলি’ সামাজিক বিধিনিষেধের চেয়ে মানব-মানবীর স্বাধীন সম্পর্ককেই বড়ো স্থান দিয়েছে। ‘ফাউস্ট’ নাটকের জীবনদর্শন যে অক্লান্ত ও অনাসক্ত কর্মযোগ সে তো বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেও পুরাতন হয়নি।
ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী পঁচিশ বছর ইউরোপের জীবন যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি দুঃখে দ্বন্দ্বে ভরা। যুদ্ধবিগ্রহের দ্বারা বিপর্যস্ত ইউরোপ কবিকে হয়তো পাগল করে তুলত, যদি-না থাকত তাঁর বিজ্ঞানসাধনা ও ক্লাসিক মার্গ। আপনাকে বাঁচাবার জন্যে তিনি একপ্রকার বানপ্রস্থ অবলম্বন করেছিলেন। সেটা এক হিসাবে ছাব্বিশ বছর বয়স থেকেই, কিন্তু বিশেষ করে চল্লিশের পর। নেপোলিয়নের পতন হলে যখন বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের যুগ শেষ হয়ে যায় তখন গ্যেটের জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় সারা হয়। তখন বাইরের জগতে শান্তি আসে, শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়। জানালার শার্সি-খড়খড়ি বন্ধ করে রাখার দরকার থাকে না। পত্নীর সঙ্গে সম্বন্ধ ইতিমধ্যে বিধিবদ্ধ হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর কবির ঘরসংসারের ভার নেন উচ্চবংশীয়া পুত্রবধূ। বাগানবাড়ি থেকে ইতিপূর্বে উঠে আসা হয়েছিল বাসগৃহে। গ্যেটের জীবনের অবশিষ্ট সতেরো বছর যেকোনো একজন পদস্থ রাজপুরুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে তুলনীয়। নানা দিগবিদিক থেকে ভক্তেরা আসতেন তাঁর দর্শন পেতে। আরাম ও সম্ভ্রমের অভাব ছিল না। লোকে বলত, ‘ইয়োর একসেলেন্সি’। পদবি মিলেছিল ‘ফন গ্যেটে’। এই বয়সেও তাঁর প্রকৃতিপূজার বিরাম ছিল না। তাঁর ক্লাসিক মার্গও ছিল অপরিত্যক্ত, কিন্তু একটু তফাত ছিল।
নেপোলিয়নের ফরাসি ফৌজ বার বার জার্মানি আক্রমণ করায় জার্মানিদের জাতীয় ঐক্যবোধ নতুন করে উদ্দীপিত হয়। এ বোধ যে কোনো কালে ছিল না তা নয়। বহু বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ও বোহেমিয়া-হাঙ্গেরি প্রভৃতি অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় জার্মানির রাজনৈতিক জীবনে ঐক্য ছিল না। কিন্তু সংস্কৃতিতে, সংগীতে, সাহিত্যে জার্মান মাত্রেরই একটা মিলনভূমি ছিল, যদিও সেখানেও প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিকের ভেদবুদ্ধি ছিল। এবার রাজনৈতিক জীবনকেও একসূত্রে বাঁধবার প্রয়োজন দেখা দিল। ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্স রাজনৈতিক ঐক্যের দরুন দিগবিজয়ী হয়েছে, ভূমন্ডলের সর্বত্র রাজ্যলাভ করেছে, অর্থে ও সামর্থ্যে তারা অগ্রগণ্য। জার্মানি তাদের চেয়ে সব বিষয়ে শ্রেষ্ঠ হয়েও সব বিষয়ে পশ্চাৎপদ শুধু রাজনৈতিক ঐক্যের অভাবে। জার্মানি যদি এক রাষ্ট্র হত, জার্মানরা যদি এক নেশন হত তাহলে কি নেপোলিয়নের হাতে বার বার লাঞ্ছিত ও পরাজিত হত?
এমনি করে ন্যাশনালিজমের সূত্রপাত হয়। সারা শতাব্দী ধরে এর মরশুম চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমরা এর পরিণাম দেখেছি। ন্যাশনালিজমের সঙ্গে তথাকথিত সোশ্যালিজম মিলিত হয়ে যে বিভীষিকা সৃষ্টি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারও পরিণাম লক্ষ করেছি। গ্যেটে গোড়া থেকেই এর বিরোধী ছিলেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ফরাসিদের প্রাণকেন্দ্র প্যারিস, ইংরেজদের লণ্ডন। জার্মানদের প্রাণকেন্দ্র কিন্তু ভিয়েনা নয়, বার্লিন নয়; জার্মানির প্রাণ বহুকেন্দ্রিক। ফ্রাঙ্কফোর্ট, লাইপজিগ, মিউনিখ প্রভৃতি ভিয়েনা-বার্লিনের মতো প্রাণবন্ত। জার্মানির মতো দেশকে ইংল্যাণ্ডের মতো নেশন করতে গেলে তার সভ্যতার মূলসূত্রটি হারিয়ে যাবে। প্রাণধারার ঐক্যই আসল ঐক্য, রাজনৈতিক ঐক্য তা নয়। গ্যেটের কথা যদি তাঁর দেশ মনে রাখত তাহলে তার আজ এ দশা হত না। কিন্তু তখনকার দিনের জার্মানরা তাঁর কথা শুনে তাঁকে গালমন্দ দিয়েছিল, তারপরেও তাঁকে ঠিক বোঝেনি, এখনও ভুল বোঝে। তিনি তাঁর দেশকে, তাঁর জাতিকে কারও চেয়ে কম ভালোবাসতেন না। কিন্তু তাঁর নেশনবিরোধিতার কদর্থ করা হল এই বলে যে, তিনি বিশ্বপ্রেমিক তাই আর-সকলের মঙ্গল চান, স্বদেশের চান না। তিনি নেপোলিয়নের ভক্ত, তাই স্বদেশের বিপদে সাড়া দেন না, ছেলেকে যুদ্ধে পাঠান না। তিনি ফরাসি জাতির গুণমুগ্ধ, জার্মান জাতির নিন্দা ছাড়া প্রশংসা করেন না। অর্থাৎ তিনি পোয়েট, কিন্তু পেট্রিয়ট নন।
গ্যেটের শেষজীবন তাই অবিমিশ্র শান্তিময় ছিল না। শিলারকে তাঁর দেশবাসী মাথায় তুলে নিয়েছিল। শিলারের জনপ্রিয়তার একাংশও গ্যেটের ভাগ্যে জোটেনি। তিনি জানতেন যে, তাঁর লেখা সকলের জন্যে নয়। সকলে যেদিন বুঝবে সেদিন অবশ্য সকলের হবে, তার দেরি আছে। সেইজন্যে জনপ্রিয়তার প্রত্যাশা রাখেননি। কিন্তু যশ তিনি আজীবন পেয়েছিলেন। স্বদেশে বিদেশে—সব দেশে। নেপোলিয়ন তাঁকে দেখে বলেছিলেন, একটা মানুষ বটে। দিগবিজয়ী তাঁর ‘ভের্টর’ পড়েছিলেন সাত বার। যুদ্ধযাত্রার সময় যেসব বই নেপোলিয়নের সঙ্গে যেত ‘ভের্টর’ তার একটি।
গ্যেটের মৃত্যুর পর এক শতাব্দীর ওপর কেটে গেছে। এখনও তিনি জনপ্রিয় হতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর যশ তাঁকে অলিম্পাস পর্বতের গ্রিক দেবতাদের সঙ্গে আসন দিয়েছে। আর কোনো জার্মান সাহিত্যিক এ সম্মান লাভ করেননি। দান্তে ও শেক্সপিয়রের পরবর্তী ও টলস্টয়ের পূর্ববর্তী আর কোনো ইউরোপীয় সাহিত্যিক তাঁর সঙ্গে এক সারিতে বসার যোগ্য নন। ইউরোপের বাইরে একালে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ তাঁর তুল্য। হাজার বছরে সারা পৃথিবীতে যে পাঁচ জন অমর সাহিত্যিক অবতীর্ণ হয়েছেন গ্যেটে তাঁদের মধ্যমণি। মধ্যম পান্ডবের মতো তিনি সব্যসাচী ছিলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘ফাউস্ট’, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ভিলহেলম মাইস্টার’ ও অজস্র প্রেমের কবিতা বিশ্বসাহিত্যে চিরস্মরণীয়।
কিন্তু তাঁকে যে অলিম্পিয়ান বলা হয় এ শুধু তাঁর সাহিত্যসাধনার জন্যে নয়। এ তাঁর জীবনদর্শনের জন্যেও। জীবনকে তিনি দেখেছিলেন বাহির থেকে, ভিতর থেকে, উপর থেকে, তলা থেকে। দেখেছিলেন মানুষের চোখে, প্রকৃতির চোখে, দেবতাদের চোখে। তন্নতন্ন করে দেখেছিলেন, নেতি নেতি করে দেখেছিলেন। যেটি যেখানকার সেটিকে সেখানে রেখে দেখেছিলেন, তার আশেপাশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছিলেন, সমগ্রের মধ্যে স্থাপন করে দেখেছিলেন। দৃষ্টির তপস্যা তাঁর মতো আর কেউ করেননি সর্বতোভাবে। গাছ-পাতা-ফুল-প্রজাপতি-হাড়-দাঁত-কঙ্কাল-করোটি-গ্রহ-তারা-মেঘ-বাষ্প-রং-রেখা-রূপ-স্পর্শ কিছুই তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে ছিল না। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক, নারীর সঙ্গে নরের সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, এমনি করে কতরকম সম্পর্ক তাঁর দৃষ্টির বিষয় ছিল। তাঁর ধ্যানের বিষয় অন্তহীন প্রগতি, যার মূলে অবিরাম পরিশ্রম, পরীক্ষা ও পরিত্যাগ। কোনো কিছুতে আসক্ত হয়ে থাকলে প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তা সে যতই পুরাতন, যতই পরিচিত, যতই প্রিয় হোক। মনে হবে হৃদয়হীনতা, আসলে বেদনার পর বেদনার অভিজ্ঞতা।
আজ কি তাঁকে আমাদের দরকার আছে এই উন্মত্ত পৃথিবীতে? প্রগতির পথ ধরে ধ্বংসের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা সভ্যমানব। বিজ্ঞান আমাদের বন্ধু নয়, যেমন ফাউস্টের বন্ধু নয় মেফিস্টোফেলিস। গ্যেটে পাঠ করে কী আমাদের সান্ত্বনা?
এর উত্তর নানা পাঠক নানাভাবে দেবেন। একজন পাঠক হিসেবে আমার উত্তর দিই। ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ের মতো রুশ বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায় এখন চলছে। এ অধ্যায় কবে শেষ হবে, কে হারবে, কে জিতবে, গ্যেটের মতো আমাদেরও অজানা। তাঁর দৃষ্টান্ত যদি অনুসরণ করি তাহলে বাইরের শত অশান্তি সত্ত্বেও আমরা প্রকৃতিস্থ থাকব, আত্মস্থ থাকব, ধ্যানস্থ থাকব। এ অধ্যায় একদিন শেষ হবেই। ততদিন যদি বেঁচে থাকি তাহলে বাইরেও শান্তি আসবে। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন সাধ্যমতো বাইরের শান্তির জন্যেও চেষ্টা করব। গ্যেটের হৃদয়ে জাতিপ্রেম ছিল। কিন্তু জাতিভেদ তিনি মানতেন না। তাঁর জন্ম উচ্চ শ্রেণিতে, কিন্তু বিবাহ নিম্ন শ্রেণিতে। স্বয়ং অভিজাত হয়েও জনগণের সঙ্গে তাঁর সাযুজ্য। মানুষে মানুষে হিংসা-দ্বেষ এক দিনের জন্যেও তাঁর মনে ঠাঁই পায়নি। তাঁর কোনো শত্রু ছিল না; না ব্যক্তিগত জীবনে, না সমষ্টিগত জীবনে। বহু অত্যাচার তাঁর জীবদ্দশায় ঘটেছে, তার দরুন তিনি বেদনাবোধ করেছেন কিন্তু মানুষকে তারজন্যে ঘৃণা করেননি। হিংসার বদলে হিংসার কথা ভাবেননি। তাঁর মতো আমাদের অন্তঃকরণ নির্মল হোক, নির্বিষ হোক। তাঁর স্বাস্থ্য যেন আমরাও পাই। মত্ততার যুগে তিনি ছিলেন অপ্রমত্ত। আমরাও যেন তাই থাকি।
অপ্রমাদের জন্যে তাঁকে করতে হয়েছিল একহাতে বিজ্ঞানচর্চা, আর একহাতে ক্লাসিকচর্চা। একসঙ্গে প্রকৃতির আরাধনা তথা শাশ্বত সৌন্দর্যের উপাসনা। এই দুই ডিসিপ্লিন এখনও আমাদের পরম প্রশান্তি প্রদান করতে পারে। তাহলেও আধুনিক সাহিত্যিকের চিত্ত সান্ত্বনা মানে না। দিনের পর দিন যে প্রশ্ন তাঁকে অস্থির করে তুলেছে সে-প্রশ্ন কি গ্যেটের মতো অলিম্পিয়ানকে আকুল করেনি? আমরা কি কেবল নীরব সাক্ষীর মতো দেখে যাব, পরে সাক্ষ্য দেব? আমরা কি কোনো অবস্থায় হস্তক্ষেপ করব না, কন্ঠক্ষেপ করব না? এই নিষ্ক্রিয় স্তব্ধতা কি পুরুষোচিত? এ কি অমানুষিক নয়?
গ্যেটের কাছে এর উত্তর আশা করা বৃথা। তারজন্যে যেতে হবে টলস্টয়ের কাছে, রবীন্দ্রনাথের কাছে।