গ্যাঁড়া

গ্যাঁড়া

আজ রাত্রে আমার কন্যার বিবাহ।

সকালবেলা দার্শনিক মনোভাব লইয়া বাহিরের বারন্দায় বসিয়া আছি। একটা নূতন সম্বন্ধের সূত্রপাত হইতে চলিয়াছে। মানুষের জীবনে নূতন নূতন সম্পর্কের বন্ধন ক্রমাগত বাড়িয়াই চলিতে থাকে।….

বাড়ি আত্মীয়-কুটুম্বে ভরিয়া গিয়াছে। অসংখ্য ছোট ছোট ছেলে মেয়ে পিপীলিকার মতো চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে; কলহ করিতেছে, হাসিতেছে, কাঁদিতেছে, আছাড় খাইতেছে। ইহাদের সকলকে ভাল করিয়া চিনি না।

আকাশে কাক-চিল আমার বাড়িটাকেই লক্ষ্য করিয়া চারিদিকে উড়িয়া বেড়াইতেছে; কারণ তেতলার ছাদে রান্নার আয়োজন ও ভিয়ান বসিয়াছে। কলিকাতায় কাক-চিলের সংখ্যা বড় কম নয়।

সকলের সহিত তাল রাখিয়া উঠানের এক কোণে শানাই বাজিতেছে। বাড়ি সরগরম।

এখনও দু’একজন আত্মীয়-বন্ধু আসিয়া পৌঁছিতে বাকি আছে। ভাগলপুর হইতে ছোট শ্যালকের আসিবার কথা—

বাড়ির সম্মুখে গাড়ি আসিয়া থামিল; ছোট শ্যালক গাড়ি হইতে নামিল। সঙ্গে একটি অপরিচিত যুবক; আদ্দির পাঞ্জাবি-পরা হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ চেহারা, পায়ে বার্নিশ পাম্প্-সু, হাতে সোনার রিস্ট-ওয়াচ—বেশ—ভব্যিযুক্ত মানুষ—’

শ্যালককে সম্ভাষণ করিলাম, ‘এসো হে সমর—’

সমর আসিয়া আমাকে একটা প্রণাম ঠুকিল। অত্যন্ত চট্‌পটে কর্মপটু আমার এই শ্যালকটি! একদণ্ড চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার পাত্র নয়। সর্বদাই ব্যস্ত।

প্রণাম করিতে করিতেই বলিল, ‘এসে পড়লাম। আবার কালই ফিরতে হবে। গ্যাঁড়াকেও নিয়ে এলাম।…গ্যাঁড়া, তুমি বসো, আমি চট্ করে দিদির সঙ্গে দেখা করে আসি।’

সঙ্গীকে আমার কাছে বসাইয়া সমর বাড়ির ভিতর অন্তর্হিত হইল। বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িলাম। এই ভদ্র যুবকটির নাম গ্যাঁড়া তাহাতে সন্দেহ নাই। সম্ভবত ভাল নাম একটা আছে, কিন্তু আমি তাহা জানি না। ইনি সমরের বন্ধু, সম্ভবত ধনী। ইঁহাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিব?

যা হোক, শ্যালকের বন্ধু, আমার কন্যার বিবাহে আসিয়াছেন, আপ্যায়িত করিতে হইবে। বলিলাম, ‘বড় খুশি হলাম, হেঁ হেঁ—ভাগলপুরেই থাকা হয় বুঝি।’

‘আজ্ঞে, বাঙালীটোলায়।’

গ্যাঁড়ার গলার আওয়াজ ঘষা-ঘষা, যেন ধোঁয়ায় বদ্ধ হইয়া গিয়াছে; কিন্তু তাহার কথার ভঙ্গির মধ্যে বেশ একটা তেজস্বিতা আছে। অস্বস্তি আরও বাড়িয়া গেল। যুবককে ঠিক কিভাবে গ্রহণ করিব স্থির করিতে পারিতেছি না। সমকক্ষের মতো ব্যবহার করিব, না সম্মানিত ব্যক্তির মতো? অথবা স্নেহভাজন কনিষ্ঠের মতো? আপনি না তুমি? অবশ্য আমি তাহার চেয়ে বয়সে বড়, কিন্তু কেবলমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠতার জোরে কাহাকেও ‘তুমি’ বলা নিরাপদ নয়। তাহার পায়ের পাম্প্ ও হাতের রিস্ট-ওয়াচ বেশ দামী বলিয়াই মনে হইতেছে।

গ্যাঁড়া! নামটা এমন বেয়াড়া যে উহাকে মোলায়েম করিয়া আনাও এক রকম অসম্ভব। অথচ গ্যাঁড়া বলিতেও বাধিতেছে। মনে মনে কয়েকবার ‘গেঁড়ুবাবু, গেঁড়ুবাবু’ উচ্চারণ করিলাম, কিন্তু খুব শ্রুতিমধুর মনে হইল না।

যুবক নাসিকার প্রান্তভাগ কয়েকবার কুঞ্চিত করিয়া হঠাৎ বলিল, ‘ঘি পুড়ছে— ঘি পুড়ছে—’ কণ্ঠস্বরে একটু অসন্তোষ প্রকাশ পাইল।

আমি বলিলাম, ‘ছাদে ভিয়েন বসেছে কিনা। আপনার নাক তো খুব তীক্ষ্ণ, গেঁড়ুবাবু…’

‘গ্যাঁড়া—গ্যাঁড়া। বাবু-টাবু নয়। আমাকে সবাই গ্যাঁড়া বলে ডাকে।’

বিশেষ বিচলিত হইয়া পড়িলাম। কি করা যায়? শেষ পর্যন্ত কি ভদ্রলোককে গ্যাঁড়া বলিয়াই ডাকিতে হইবে? কিন্তু মনের ভিতর সায় পাইতেছি না যে!

সমস্যা যখন এইরূপ সঙ্গীন হইয়া উঠিয়াছে, এমন সময় সমর ফিরিয়া আসিল—

‘নাও নাও, গ্যাঁড়া, আর দেরি কোরো না—কাজ আরম্ভ করে দাও। তেতলার ছাদে ভিয়েন বসেছে, তুমি সটান সেখানে চলে যাও। দিদি সব ব্যবস্থা করে দেবেন।’

গ্যাঁড়া চক্ষের নিমেষে পাঞ্জাবি, পাম্প্ ও রিস্ট-ওয়াচ খুলিয়া তৈয়ার হইয়া দাঁড়াইল। সমর আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘খাজা তৈরি করবার জন্যে গ্যাঁড়াকে নিয়ে এসেছি। ও হল ভাগলপুরের সেরা কারিগর।’

মুহূর্ত মধ্যে গ্যাঁড়ার সহিত আমার সম্পর্ক সহজ ও সরল হইয়া গেল; তাহাকে গ্যাঁড়া এবং তুমি বলিতে মনের মধ্যে আর কোনও দ্বিধা রহিল না।

হাসিয়া বলিলাম, ‘বেশ, বেশ, তাহলে আর দেরি নয়, গ্যাঁড়া, তুমি কাজে লেগে যাও। বিকেল থেকেই বড় বড় অতিথিরা আসতে আরম্ভ করবেন—চিংড়িদহের কুমার বাহাদুর, স্যার ফজলু—দেখো, যেন ভাগলপুরের নিন্দে না হয়।’

৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *