গোহ – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাণ্ড বট গাছের মাঝে পাতায় ঢাকা ছোটোখাটো পাখির বাসাটি যেমন, গগনস্পর্শী বিন্ধ্যাচলের কোলে চন্দ্রাবতীর শ্বেতপাথরের রাজপ্রাসাদও তেমনি সুন্দর, তেমনি মনোরম ছিল৷ ম্লেচ্ছদের সঙ্গে যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে শিলাদিত্য একদিন জনকতক রাজপুত বীরকে সঙ্গে দিয়ে চন্দ্রাবতীর রাজকন্যা গর্ভবতী রানি পুষ্পবতীকে সেই চন্দ্রাবতীর রাজপ্রাসাদে বাপমায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন৷ তাঁর মনে বড়ো ইচ্ছা ছিল যে, যুদ্ধের পর শীতকালটা বিন্ধ্যাচলের শিখরে নির্জনে সেই শ্বেতপাথরের প্রাসাদে রানি পুষ্পবতীকে নিয়ে আরামে কাটাবেন; তারপর রানির ছেলে হলে দু-জনে একসঙ্গে রাজপুত্রকে কোলে নিয়ে বল্লভীপুরে ফিরবেন৷ কিন্তু হায়, বিধাতা সে-সাধে বাদ সাধলেন, বিধর্মী শত্রুর বিষাক্ত একটা তির তাঁর প্রাণের সঙ্গে বুকের সমস্ত আশা বিদীর্ণ করে বাহির হয়ে গেল-শিলাদিত্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারালেন৷ তাঁর আদরের মহিষী পুষ্পবতী চন্দ্রাবতীর সুন্দর প্রাসাদে একাকিনী পড়ে রইলেন৷
বিন্ধ্যাচলের গায়ে রাজ-অঃন্তপুরে যেদিকে পুষ্পবতীর ঘর ছিল, ঠিক তার সম্মুখে, পাহাড় থেকে পঞ্চাশ গজ নীচে, বল্লভীপুরে যাবার পাকা রাস্তা৷ পুষ্পবতী সেইবার চন্দ্রাবতীতে এসে, যত্ন করে নিজের ঘরখানির ঠিক সম্মুখে দেওয়ালের মতো সমান সেই পাহাড়ের গায়ে পঁচিশ গজ উপরে যেন শূন্যের মাঝখানে ছোটো শ্বেতপাথরের বারান্দা বসিয়েছিলেন৷ সেইখানে বসে, রাস্তার দিকে চেয়ে, তিনি প্রতিদিন একখানি রুপোর চাদরে সোনার সুতোয়, সবুজ রেশমে, সবুজ ঘোড়ায়-চড়া সূর্যের মূর্তি সোনার ছুঁচ দিয়ে সেলাই করতেন আর মনে মনে ভাবতেন-মহারাজা যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে, পাখির পালকের মতো হালকা এই পাগড়িটি মহারাজের মাথায় নিজের হাতে বেঁধে দেব; তারপর দু-জনে মিলে পঁচিশ গজ ভাঙনের গায়ে-পাতলা একখানি মেঘের মতো শাদা শ্বেতপাথরের সেই বারান্দায় বসে মহারাজের মুখে যুদ্ধের গল্প শুনব৷
মাঝে মাঝে পুষ্পবতী দেখতেন সেই বল্লভীপুরের রাস্তার বহুদূরে একটি বল্লমের মাথা ঝকমক করে উঠত; তারপর কালো ঘোড়ার পিঠে বল্লভীপুরের রাজদূত দূর থেকে হাতের বল্লম মাটির দিকে নামিয়ে অঃন্তপুরের বারান্দায় রাজরানি পুষ্পবতীকে প্রণাম করে তিরবেগে চন্দ্রাবতীর সিংহদ্বারের দিকে চলে যেত৷
যেদিন দাসীর হাতে মহারাজা শিলাদিত্যের চিঠি পুষ্পবতীর কাছে আসত, পুষ্পবতী সেদিন সমস্ত কাজ ফেলে শূন্যের উপরে সেই বারান্দায় মহারাজার সেই চিঠি হাতে বসে থাকতেন৷
সেই আনন্দের দিনে যখন কোনো বুড়ো জাঠ গান গেয়ে মাঠের দিকে যেতে যেতে, কোনো রাখাল বালক পাহাড়ের নীচে ছাগল চরাতে চরাতে, চন্দ্রাবতীর রাজকুমারীকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করত, তখন পুষ্পবতী কারও হাতে এক ছড়া পান্নার চিক, কারও হাতে-বা একগোছা সোনার মল ফেলে দিতেন৷
রাজকুমারীর প্রসাদ মাথায় ধরে হাজার হাজার আশীর্বাদ করতে করতে সেই সকল রাজভক্ত প্রজা সকাল বেলায় কাজে যেত; সন্ধ্যা বেলায় সেই রাজদূত কালো ঘোড়ার পিঠে বল্লম হাতে মহারানি পুষ্পবতীর চিঠি নিয়ে বল্লভীপুরের দিকে ফিরে যেত৷
পুষ্পবতী নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় পাহাড়ে পাহাড়ে কালো ঘোড়ার খুরের আওয়াজ অনেকক্ষণ ধরে শুনতে পেতেন-কখনো কোনো বুড়ো জাঠের মেঠো গান আর সেই সঙ্গে রাখাল বালকের মিষ্টি সুর সন্ধ্যার হাওয়ায় ভেসে আসত! তারপর বিন্ধ্যাচলের শিখরে বিন্ধ্যবাসিনী ভবানীর মন্দিরে সন্ধ্যাপূজার ঘোর ঘণ্টা বেজে উঠত, তখন পুষ্পবতী মহারাজের সেই চিঠি খোঁপার ভিতর লুকিয়ে রেখে পাটের শাড়ি পরে দেবীর পূজায় বসতেন; আর মনে মনে বলতেন-‘হে মা চামুণ্ডে, হে মা ভবানী, মহারাজকে ভালোয় ভালোয় যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনো৷ ভগবতী, আমার যে ছেলে হবে, সে যেন মহারাজেরই মতো তেজস্বী হয়, তাঁরই মতো যেন নিজের রানিকে খুব ভালোবাসে৷’ হায় মানুষের সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয় না! পুষ্পবতী রাজারই মতো তেজস্বী ছেলে পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর মনে যে বড়ো সাধ ছিল-সেই শ্বেতপাথরের বারান্দায় বসে মহারাজের মুখে যুদ্ধের গল্প শুনবেন-তাঁর যে বড়ো সাধ ছিল নিজের হাতে মহারাজের মাথায় হাওয়ার মতো পাতলা সেই সুন্দর চাদরখানি জড়িয়ে দেবেন-সে সাধ কোথায় পূর্ণ হল? তাঁর সে মনের ইচ্ছা মনেই রইল, এ জন্মে আর মহারাজের সঙ্গে দেখা হল না৷
যেদিন বল্লভীপুরে শিলাদিত্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলেন সেই দিন চন্দ্রাবতীর রাজপ্রাসাদে রানি পুষ্পবতী মায়ের কাছে বসে সেই রুপোর চাদরে ছুঁচের কাজ করছিলেন৷ কাজ প্রায় শেষ হয়েছিল, কেবল সূর্যমূর্তির নীচের সোনার অক্ষরে শিলাদিত্যের নামটি লিখতে বাকি ছিল মাত্র৷
পুষ্পবতী যত্ন করে নিজের কালো চুলের চেয়ে মিহি, আগুনের চেয়ে উজ্জ্বল, একগাছি সোনার তার, সরু হতেও সরূ একটি সোনার ছুঁচে পরিয়ে একটি ফোঁড় দিয়েছেন মাত্র, আর চাঁপার কলির মতো পুষ্পবতীর কচি আঙুলে সেই সোনার ছুঁচ বোলতার হুলের মতো বিঁধে গেল৷ যন্ত্রণায় পুষ্পবতীর চোখে জল এল; তিনি চেয়ে দেখলেন একটি ফোঁটা রক্ত জ্যোৎস্নার মতো পরিষ্কার সেই রুপোর চাদরে রাঙা এক টুকরো মণির মতো ঝকঝক করছে৷ পুষ্পবতী তাড়াতাড়ি নির্মল জলে সেই রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলতে চেষ্টা করলেন; জলের ছিটে পেয়ে সেই একবিন্দু রক্ত ক্রমশ ক্রমশ বড়ো হয়ে, একটুখানি ফুলের গন্ধ যেমন সমস্ত হাওয়াকে গন্ধময় করে, তেমনি পাতলা ফুরফুরে চাদরখানি রক্তময় করে ফেলল৷
সেই রক্তের দিকে চেয়ে পুষ্পবতীর প্রাণ কেঁপে উঠল; তিনি ছলছল চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বললেন-‘মা, আমাকে বিদায় দাও, আমি বল্লভীপুরে ফিরে যাই, আমার প্রাণ কেমন করছে, বুঝিবা সেখানে সর্বনাশ ঘটল!’ রাজরানি বললেন-‘আর ক-টা দিন থেকে যা, ছেলেটি হয়ে যাক৷’ পুষ্পবতী বললেন-‘না, না, না, মা!’
সেইদিন সন্ধ্যা বেলা বল্লভীপুরের আশি জন রাজপুত বীর, ‘আর দুটো উটের পিঠে নীল রেশমি-মোড়া একখানি ছোটো ডুলি, বড়ো রাস্তা ধরে বল্লভীপুরের দিকে চলে গেল৷ চন্দ্রাবতীর রাজপ্রাসাদ শূন্য করে রাজকুমারী পুষ্পবতী বিদায় নিলেন৷
চন্দ্রাবতী থেকে বল্লভীপুর যেতে হলে প্রকাণ্ড একটা মরুভূমি পার হতে হয়৷ মালিয়া পাহাড়ের নীচে বীরনগর পর্যন্ত চন্দ্রাবতীর পাকা রাস্তা, তারপর মরুভূমির উপর দিয়ে আগুনের মতো বালি ভেঙে, উটে চড়ে বল্লভীপুরে যেতে হয়, আর অন্য পথ নেই৷ পুষ্পবতী সেই পথের শেষে মরুভূমির সম্মুখে এসে শুনতে পেলেন যে, শিলাদিত্য আর নেই৷ বিধর্মী ম্লেচ্ছ বল্লভীপুর ধ্বংস করেছে৷ পুষ্পবতীর চোখে এক ফোঁটা জল পড়ল না, তাঁর মুখে একটিও কথা সরল না, কেবল তাঁর বুকের ভিতরটা সম্মুখের সেই মরুভূমির মতো ধু-ধু করতে লাগল; তিনি লক্ষ লক্ষ টাকার হিরের গহনা গা থেকে খুলে বালির উপর ছড়িয়ে দিলেন, সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেললেন৷ তারপর উদাস প্রাণে বিধবার বেশ ধরে শিলাদিত্যের আদরের মহিষী পুষ্পবতী সন্ন্যাসিনীর মতো সেই মালিয়া পাহাড়ের প্রকাণ্ড গহ্বরে আশ্রয় নিলেন৷
মরুপারে দশ মাস দশ দিন পূর্ণ হলে সন্ন্যাসিনী রানির কোলে অন্ধকার গুহায়, রাজপুত্রের জন্ম হল৷ নাম রইল গোহ৷
রানি পুষ্পবতী সেইদিন বীরনগর থেকে তাঁর ছেলেবেলার প্রিয়সখী ব্রাহ্মণী কমলাবতীকে ডেকে পাঠিয়ে সেই আশি জন রাজপুত বীরের সম্মুখে তাঁর বড়ো সাধের রাজপুত্র গোহকে সঁপে দিয়ে বললেন-‘প্রিয় সখী, তোমার হাতে আমার গোহকে সঁপে দিলুম, তুমি মায়ের মতো একে মানুষ কোরো৷ তোমায় আর কী বলব ভাই? দেখো রাজপুত্রকে কেউ না অযত্ন করে! আর ভাই, যখন চিতার আগুনে আমার এই দেহ ছাই হয়ে যাবে, তখন আমার সেই একমুঠো ছাই কার্তিক পূর্ণিমায় কাশীর ঘাটে গঙ্গাজলে ঢেলে দিয়ো-যেন আমাকে জন্মান্তরে আর বিধবা না হতে হয়৷’ ঝরঝর করে কমলাবতীর চোখে জল পড়তে লাগল৷
সেইদিন সন্ধ্যা বেলা সেই আশি জন রাজভক্ত রাজপুত চন্দনের কাঠে চিতা জ্বালিয়ে চারিদিকে ঘিরে দাঁড়াল; শিলাদিত্যের মহিষী, রাজপুত রানি, সন্ন্যাসিনী সতী পুষ্পবতী হাসিমুখে জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিলেন৷ দেখতে দেখতে ফুলের মতো সুন্দর পুষ্পবতীর কোমল শরীর পুড়ে ছাই হল৷ চারিদিকে রব উঠল-‘জয় মহারানির জয়! জয় সতীর জয়!’ কমলাবতী ঘুমন্ত গোহকে এক কোলে, আর সেই ছাই মুঠো এক হাতে নিয়ে, চোখের জল মুছতে মুছতে বীরনগরে ফিরে গেলেন; সঙ্গেসঙ্গে সেই আশি জন রাজপুত বীর রাজপুত্রকে ঘিরে সেদিন থেকে বীরনগরে বাসা নিলেন৷
চন্দ্রাবতীর রাজরানি অনেকবার গোহকে চন্দ্রাবতীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বল্লভীপুরের তেজস্বী সেই রাজপুত বীরের দল গোহকে কিছুতেই ছেড়ে দেননি৷ তাঁরা বলতেন-‘আমাদের মহারানি আমাদের হাতে রাজপুত্রকে সঁপে গেলেন, আমরাই তাঁকে পালন করব৷ বল্লভীপুরের রাজকুমার বল্লভীপুরের রাজপুতদের রাজা হয়ে এই মরুভূমিতেই থাকুন! এই তাঁর রাজপ্রাসাদ!’
গোহ সেই বীরনগরে কমলাবতীর ঘরে মানুষ হতে লাগলেন৷
কমলাবতী গোহকে ব্রাহ্মণের মতো নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত করতে চেষ্টা করতেন; কিন্তু বীরের সন্তান গোহের লেখাপড়া পছন্দ হত না, তিনি বনে বনে, পাহাড়ে পাহাড়ে, কোনোদিন ভিলদের সঙ্গে ভিল বালকের মতো, কোনোদিন-বা সেই রাজপুত-বীরদের সঙ্গে রাজার মতো, কখনো ঘোড়ার চড়ে মরুভূমির উপর সিংহ শিকার করে, কখনো বা জাল ঘাড়ে বনে বনে হরিণের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন!
মালিয়া পাহাড়ের নীচে বীরনগর৷ সেখানে যত শিষ্ট, শান্ত, নিরীহ ব্রাহ্মণের বাস, আর পাহাড়ের উপরে যেখানে বাঘ ডেকে বেড়ায়, হরিণ চরে বেড়ায়, যেখানে অন্ধকারে সাপের গর্জন, দিবারাত্রি ঝরনার ঝরঝর, আশ্চর্য আশ্চর্য ফুলের গন্ধ, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বনের ছায়া, সেখানে সেই সকল অন্ধকার বনে বনে, ভিলরাজ মাণ্ডলিক, সাপের মতো কালো, বাঘের মতো জোরালো, সিংহের মতো তেজস্বী, অথচ ছোটো একটি ছেলের মতো সত্যবাদী, বিশ্বাসী, সরলপ্রাণ ভিলের দল নিয়ে রাজত্ব করতেন৷
গোহ একদিন সেই সকল ভিল বালকদের সঙ্গে ভিল রাজত্বে ঘোড়ায় চড়ে উপস্থিত হলেন৷ সেখানে বল্লম হাতে বাঘের ছালপরা হাজার হাজার ভিল বালক, ঘোড়ায় চড়া সেই রাজপুত রাজকুমারকে ঘিরে ‘আমাদের রাজা এসেছে রে! রাজা এসেছে রে!’ বলে, মাদল বাজিয়ে নাচতে নাচতে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ ক্রমে সেই ছেলের পাল গোহকে নিয়ে রাজবাড়ি উপস্থিত হল৷ তখন খোড়ো চালের রাজবাড়ি থেকে ভিলদের রাজা বুড়ো মাণ্ডলিক বেরিয়ে এসে বললেন-‘হাঁ রে, কোথায় রে তোদের নতুন রাজা?’ ছেলের পাল গোহকে দেখিয়ে দিলে৷ তখন সেই বুড়ো ভিল গোহকে অনেকক্ষণ দেখে বললেন-‘ভালো রে ভালো, নতুন রাজার কপালে তিলক লিখে দে৷’ তখন একজন ভিল বালক নিজের আঙুল কেটে বুড়ো রাজা মাণ্ডলিকের সামনে রক্তের ফোঁটা দিয়ে গোহের কপালে রাজতিলক টেনে দিল, ভিলদের নিয়মে সে রক্তের তিলক মুছে দেয়, এমন সাধ্য কারও নেই
গোহ সত্য সত্যই রাজা হয়ে ভিলদের রাজসভায় বুড়ো রাজার কাঠের রাজসিংহাসনের ঠিক নীচে একখানি ছোটো পিঁড়ির উপর বসলেন৷ এই পিঁড়িখানি অনেকদিন শূন্য পড়ে ছিল৷ কারণ মাণ্ডলিক চিরদিন নিঃসন্তান৷ তাঁর দীনদুঃখী সামান্য প্রজা, তাদের ঘর আলো করা কালো বাঘের মতো কালো ছেলে; কিন্তু হায়, রাজার ঘর চিরদিন অন্ধকার, চিরকাল শূন্য ছিল! সেদিন যখন সমস্ত ভিলদের মধ্যস্থলে রক্তের তিলক পরে গোহ যুবরাজ হয়ে পিঁড়েয় বসলেন, তখন বুড়ো মাণ্ডলিকের দুই চক্ষু সেই সুন্দর রাজকুমারের দিকে চেয়ে আনন্দে ভেসে গেল৷
ভিলরাজের এক ছোটো ভাই ছিলেন৷ দশ বৎসর আগে একদিন কী জানি কী নিয়ে দুই ভাইয়ের খুব ঝগড়া হয়েছিল, সেই থেকে বিচ্ছেদ, দেখাশোনা পর্যন্ত বন্ধ ছিল৷ গোহ যুবরাজ হবার দিন মাণ্ডলিকের ছোটো ভাই হিমালয় পর্বত থেকে ভিল রাজত্বে হঠাৎ ফিরে এলেন, এসে দেখলেন, রাজপুতের ছেলে আসন জুড়ে বসেছে৷ রাগে তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল, তিনি রাজসভার মাঝে মাণ্ডলিককে ডেকে পাঠালেন-‘এ রে ভাইয়া! বুড়ো হয়ে তুই কি পাগল হয়েছিস? বাপের রাজ্যি ছেলেতে পাবে, তোর ছেলে হল না, তোর পরে আমি রাজা; রাজপুতের ছেলেকে পিঁড়েয় বসালি কী বলে!’ মাণ্ডলিক বললেন-‘ভাইজি, ঠান্ডা হ৷’ ভাইরাজ বললেন-‘ঠান্ডা হব যেদিন তোরে আগুনে পোড়াব৷’ এই বলে মাণ্ডলিকের ভাইজি রাগে ফুলতে ফুলতে রাজসভা থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ মাণ্ডলিক বললেন-‘দূর হ, আজ হতে তুই আমার শত্রু হলি৷’ তারপর সোজা সিংহাসনে বসে গোহকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে সমস্ত ভিল সর্দারদের ডেকে গোহের কপালে হাত দিয়ে শপথ করালেন, যেন সেইদিন থেকে সমস্ত ভিল সর্দার বিপদে-আপদে সুখে-দুঃখে গোহকে রক্ষা করে-গোহের শত্রু যেন তাদেরও শত্রু হয়৷ তারপর রাজসভা ভঙ্গ হল৷ অনেক আমোদ-আহ্লাদ করে গোহ বীরনগরে ফিরে গেলেন৷
সেইদিন কী ভেবে গভীর রাত্রে ভিলরাজ মাণ্ডলিক গোহের কাছে চুপিচুপি গিয়ে বললেন-‘গোহ, আমি তোকে ছেলের মতো ভালোবাসি, তোকে আমি রাজা করেছি, তোর ছুরিখানা আমায় দে, আমি নিজের হাতে তোর শত্রুকে মেরে আসব৷’ গোহ কোমর থেকে নিজের নাম-লেখা ধারালো ছুরি খুলে দিলেন৷
ভিলরাজ সেই ছুরি হাতে বেরিয়ে পড়লেন৷ পাহাড়ের গায়ে তখন জোনাকি জ্বলছে, ঝিঁঝি ডাকছে, দূরে দূরে দু-একটা বাঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে৷ মাণ্ডলিক সেই ছুরি হাতে রাতদুপুরে ভাই-রাজার দরজায় ঘা দিলেন-কারও সাড়াশব্দ নেই! ভিলরাজ ধীরে ধীরে ভাইয়ের ঘরে প্রবেশ করলেন; দেখলেন, তাঁর ছোটো ভাই সামান্য ভিলের মতো মাটির উপরে এক হাতে মুখ ঢেকে পড়ে আছেন৷
ভিলরাজের প্রাণে যেন হঠাৎ ঘা লাগল; তিনি কালো পাথরের পুতুলটির মতো ছোটো ভাইয়ের সুন্দর শরীর মাটির উপর পড়ে থাকতে দেখে আর চোখের জল রাখতে পারলেন না৷ মনে ভাবলেন আমি কী নিষ্ঠুর! হায়, ছোটো ভাইয়ের রাজ্য পরকে দিয়েছি, আবার কিনা শত্রু ভেবে ঘুমন্ত ভাইকে মারতে এসেছি!
মাণ্ডলিক কুড়ি বৎসরের সেই ভিল-রাজকুমারের মাথার শিয়রে বসে ডাকলেন-‘ভাইয়া!’ একবার ডাকলেন, দু-বার ডাকলেন, তারপর মুখের কাছ থেকে তার নিটোল হাতখানি সরিয়ে নিয়ে ডাকলেন-‘ভাইয়া৷’-কোনোই উত্তর পেলেন না৷ তখন বুড়ো রাজা ছোটো ভাইয়ের মুখের কাছে মুখ রেখে তার কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুল হাত বুলিয়ে বললেন-‘ভাইয়া রাগ করেছিস? ভাইয়া আমার সঙ্গে কথা কইবিনে ভাইয়া? আমি তোর জন্যে হিমালয়ের আধখানা জয় করে রেখেছি, সেইখানে তোকে রাজা করব; তুই উঠে বস, কথা ক! ওরে ভাই, কেন তুই এই দশ বছর আমায় ছেড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ালি৷ কেন আমার কাছে কাছে চোখে চোখে রইলিনে ভাই? আমি সাধ করে কি রাজপুতের ছেলেকে ভালোবেসেছি? তুই ছেড়ে গেলে আমার যে আর কেউ ছিল না; সে সময়ে গোহ আমার শূন্য ঘর আলো করেছিল! ভাই ওঠ, আমি তোর রাজত্ব কেড়ে নিয়েছি, আবার তোকে শত্রু বলে মারতে এসেছি, এই নে ছুরিখানা-আমার বুকে বসিয়ে দে, সব গোল মিটে যাক৷’
মাণ্ডলিক ভাইয়ের হাতে ছুরিখানা জোর করে গুঁজে দিলেন৷ ধারালো ছুরি ভাইরাজের মুঠো থেকে খসে পড়ল-বুড়ো রাজা চমকে উঠলেন, ছোটো ভাইয়ের গা-টা যেন বড়োই ঠান্ডা বোধ হল! কান পেতে শুনলেন, নিশ্বাসের শব্দ নেই! তিনি ‘ভাইয়া! ভাইয়া!’ বলে চিৎকার করে উঠলেন৷
তাঁর সমস্ত রাগ মাটির উপর মরা ভাইকে ছেড়ে রাজসিংহাসনে গোহের উপরে গিয়ে পড়ল৷ গোহ যদি না থাকত, তবে তো আজ দশ বৎসর পরে তিনি ছোটো ভাইটিকে বুকে ফিরে পেতেন; তবে কি আজ ভিলরাজকুমার রাজ্যহারা হয়ে রাগে-দুঃখে বুক ফেটে মারা পড়ত? মাণ্ডলিক অনেকক্ষণ ধরে ছোটো ভাইটির বুকে হাত বুলিয়ে দিলেন; কিন্তু হায়, খাঁচা ফেলে পাখি যেমন উড়ে যায়, তেমনি সেই ভিল বালকের সুন্দর শরীর শূন্য করে প্রাণপাখি অনেকক্ষণ উড়ে গেছে৷
মাণ্ডলিক আর সে ঘরে বসে থাকতে পারলেন না, ছুরি হাতে সদর দরজা খুলে বাইরে দাঁড়ালেন৷ তাঁর প্রাণ যেন কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল-‘গোহ রে তুই কী করলি? আমার রাজ্য নিলি, রাজসিংহাসন নিলি, ভাইয়ে ভাইয়ে বিচ্ছেদ ঘটালি; গোহ তুই কি শেষে আমার শত্রু হলি?’ হঠাৎ পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে দু-টি ভিলের মেয়ে গলা ধরাধরি করে চলে গেল৷ একজন বলে গেল-‘আহা কী সুন্দর রাজা দেখেছিস ভাই!’ আর একজন বললে-‘নতুন রাজা যখন আমার হাত ধরে নাচতে লেগেছিল, তখন তার মুখখানা যেন চাঁদপারা দেখলুম৷’ মাণ্ডলিক নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, হায় এরই মধ্যে আমার প্রজারা বুড়ো রাজাটাকে ছেঁড়া কাপড়ের মতো ছেড়ে ফেলেছে! ভিলরাজের মনে হল যেন পৃথিবীতে তাঁর আর কেউ নেই৷
তিনি শূন্য মনে পূর্ণিমার প্রকাণ্ড চাঁদখানার দিকে চেয়ে রইলেন; সেই সময় কালো ঘোড়ায় চড়ে দুই জন রাজপুত ভিলরাজের সামনে দিয়ে চলে গেল৷ একজন বললে-‘ভাই, রাজকুমার আজ শুভদিনে ভিলরাজত্বের সিংহাসনে না বসে সকলের সামনে যুবরাজের আসনে বসে রইলেন কেন?’ অন্যজন বললে-‘গোহ প্রতিজ্ঞা করেছেন, যতদিন বুড়ো রাজা বেঁচে থাকবেন ততদিন তিনি যুবরাজের মতো তাঁর পায়ের কাছে বসবেন৷’ মাণ্ডুলিকের প্রাণ যেন আনন্দে পরিপূর্ণ হল; তিনি হাসিমুখে মনে মনে বললেন, ‘ধন্য গোহ! ‘ধন্য তার ভালোবাসা৷’ হঠাৎ সেই অন্ধকারে কার নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল৷ মাণ্ডলিক ফিরে দেখলেন, ছোটো ভাইয়ের প্রকাণ্ড শিকারি কুকুরটা নিঃশব্দে অন্ধকারে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে৷ বুক যেন তাঁর ফেটে গেল, তিনি ‘ভাই রে!’ বলে পাহাড়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়লেন৷ পাথরের গায়ে লেগে গোহের সেই ছুরি, শিকারি কুকুরের দাঁতের মতো ভিলরাজের বুকে সজোরে বিঁধে গেল-পাহাড়ে পাহাড়ে শিয়ালের পাল চিৎকার করে উঠল-হায় হায়, হায় হায় হায়, হায় হায় হায়!
পরদিন সকালে একজন রাজপুত পাহাড়ের পথে বীরনগরে যেতে যেতে একজায়গায় দেখতে পেলেন-ভিলরাজের রক্তমাখা দেহ, বুকে মহারাজ গোহের ছুরি বেঁধা! রাজপুত সেই ছুরি হাতে গোহের কাছে এসে বললেন-‘মহারাজ করেছ কী! আশ্রয়দাতা চিরবিশ্বাসী ভিলরাজকে খুন করেছ?’ গোহ তৎক্ষণাৎ সেই রাজপুতের মাথা কেটে ফেলতে হুকুম দিলেন৷ তারপর সেই রক্তমাখা ছুরি কোমরে গুঁজে, দুই হাতে চক্ষের জল মুছে, ভাইরাজার সঙ্গে প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাণ্ডলিককে চিতার আগুনে তুলে দিয়ে, সূর্যবংশের রাজপুত্র গোহ ভিলরাজের রাজসিংহাসনে বসে রাজত্ব করতে লাগলেন৷