গোল্ড ফিংগার
প্রথম পর্ব
মদের পেয়ালা ও মদির স্মৃতি
জেমস্ বন্ড বর্তমানে মানুষের জীবন-মৃত্যুর সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছেন। ইতিমধ্যে পরপর বড় দু পেগ বুর্বে তিনি গলাধঃকরণ করেছেন। মায়ামি এয়ারপোর্টে বহির্যাত্রীদের লাউঞ্জে চিন্তান্বিত জেমস বন্ড অপেক্ষারত।
জেমস্ বন্ড আসলে ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। অতএব নরহত্যা করার সাংকেতিক লাইসেন্সও তাঁর আছে, সেটি হল 007, বোঝা যায় সুদুর্লভ ডাবল জিরো প্রতীক ব্রিটিশ সংস্থার সঙ্গেই সংযুক্ত। কিন্তু নরহত্যা তার পেশার অঙ্গ হলেও মন থেকে তিনি কোনও দিনই একে মানতে পারেননি। প্রয়োজনের তাগিদে কাজ-মিটিয়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে ভুলে থাকতে চান বিষয়টিকে। এ নিয়ে অনুতাপ করা তাঁর সাজে না, তাই কর্তব্য হিসেবে মেনে নেওয়াই ভাল। না হলে বিবেকের তাড়না তার পেশার এবং অবশ্যই আত্মার কাছে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।
একটি কথা কিন্তু বন্ড কিছুতেই ভুলতে পারছেন না–সেই মেক্সিকান কাপুজোটির মৃত্যুর ঘটনা। যে মানুষটা মাত্র চল্লিশ পেপোস বা প্রায় তেইশ টাকার বিনিময়ে অপর যে কোন লোককে খুন করতে পারে, তাকে মারা যে ঠিক হয়নি। একথা তিনি মনে করেন না, তবু তার এই ঘটনার মধ্যে যেন কিছু একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। লোকটার চেহারাই তার চরিত্রকে প্রকাশ করে সারা জীবন সে যত মানুষের ক্ষতি করেছে, তাতে তার মৃত্যু দণ্ড অনেকদিন আগেই পাওয়া উচিৎ ছিল। যে বন্ডকে হত্যা করতে সে তার প্রথারহিত আরো কিছু বেশি টাকা নিয়েছিল, সেই বন্ডই তাকে চব্বিশ ঘণ্টা আগে শেষ করেছে। এত পাপী লোকটার প্রাণটাও যখন বেরিয়ে গেল তখন যেন খুব স্বাভাবিক মনে হল। চির প্রচলিত হাইতি দ্বীপের আদিবাসীদের মুখে শোনা প্রবাদকে সে অতিক্রম করতে পারল না। পাপী লোকটার প্রাণপাখি কত। সহজে তার ভোলা মুখ দিয়ে উড়ে গিয়ে শান্তি দিয়ে গেল।
কত পরিবর্তন ঘটে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। এক জনৈক মেক্সিকান এখন তার নাম-ধাম-অস্তিত্ব ছেড়ে শুধু মাত্র এক বস্তু পিণ্ডতে পরিণত হল।
বন্ডের হাতে রয়েছে সেই মরণকারী অস্ত্রটি, ডান হাতের তালুটি যেখানে লাল হয়ে ফুলে গেছে, বন্ড সেই দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মেক্সিকো থেকে সে পালিয়ে এসেছে প্লেনে করে, তবু ব্যথাটা কমেনি, ক্রমাগত মালিশ করে করে রক্ত চলাচল বন্ধ হতে দেয়নি বন্ড। তার হাত থেমে থাকলে তো চলবে না, কখন আবার এই অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে সেই কথা ভেবে বন্ড নিজের মনেই তিক্ত হাসি হেসে উঠল।
এয়ারপেন্ট থেকে ঘোষকের গলা ভেসে এল ন্যাশনাল এয়ার লাইন্সের আন্ডারে নিউইয়র্কের লা গার্ডিয়া এয়ারপোের্টগামী ফ্লাইট, NA 106-এবার ছেড়ে যাবে। যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে তারা যেন সাত নম্বর গেট থেকে প্লেনে উঠে পড়েন।
বন্ডের ঘড়িতে প্লেন ছাড়তে তখনও অন্তত দশ মিনিট দেরি। বন্ডের প্রিয় বুর্বোর অর্ডার দিলেন তিনি একজন ওয়েট্রেসকে ডেকে।
কাপুঙ্গোটিতে মেরে বন্ডের হাত যেন এক নোংরা কাজের থেকে নিস্তার পেল, এর জন্য অবশ্য বন্ড হেডকোয়ার্টার্সের চার দেওয়ালের বাইরে আসতে পেরেছিলেন কিছু দিনের জন্য।
বন্ড আবার স্মৃতিচারণ শুরু করলেন মেক্সিকানে জনৈক ব্যক্তির কয়েকটি পেপি ফুলের ক্ষেত ছিল, সেই ফুল ছিল আফিঙের সব চেয়ে বড় উৎস। ফুল থেকে বের করা আফিঙ মাদ্রে দ্য ক্যাকাত্ত নামক ছোেট রেস্তোরাঁর ওয়েটারদের মাধ্যমে তাড়াতাড়ি, বেশ সস্তায় খদ্দেরদের কাছে বিক্রি হয়ে যেত। এই রেস্তোরাঁয় আফিঙের কেনাবেচা চলত পানীয়ের সঙ্গে সঙ্গে। অবশ্য সরাসরি না হয়ে সংকেতেই সেটা বেশি হত।
ব্যবসা যখন এইভাবে চলছিল, তখন একদিন রাষ্ট্রসংঘ হিরোইন বিক্রি ও মাদক দ্রব্যের চোরাচালানের বিরুদ্ধে ইস্তাহার বার করল। ইংল্যান্ডের সর্বত্র একটা হৈ চৈ পড়ে গেল। শুধু মাদকসেবীরাই নয়, ডাক্তাররা পর্যন্ত তাদের চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটার আশংকায় বিচলিত হলেন। সুবিধে বুঝে চোরাপথে হিরোইন আসতে লাগল ইংল্যান্ডে, উৎস ছিল মূলতঃ চীন, তুরস্ক, ইটালী।
ব্ল্যাকওয়েল ছিলেন মেক্সিকো সিটির এক ব্যবসায়ী। এই অমায়িক ভদ্রলোকের বোন হিরোইনের নেশায় আক্রান্ত হলে তিনি তার দুর্ভাগ্যের বিষয় চিন্তিত হলেন। বোন তাঁকে জানাল হিরোইন না পেলে তার পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। ব্ল্যাকওয়েল তার কথায় বিশ্বাস করে মেক্সিকোর বেআইনি মাদকদ্রব্যের চোরা কারবার সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। যথা সময়ে বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে খবর পেয়ে তিনি পৌঁছলেন মাদ্রে দ্য ক্যাকাওয়ে এবং সেখান থেকে পরি ক্ষেতের মালিক মেক্সিকান বড় কর্তাটির কাছে। ব্ল্যাকওয়েল চোরা ব্যবসার বিপুল পরিমাণ লাভের কথা। জানতে পেরে ঠিক কররেন নেশাখোরদের সাহায্য করবেন এবং সেই সঙ্গে নিজের পকেটটাও ভারি করবেন। মেক্সিকান বড় কর্তাটিকে ব্ল্যাকওয়েল বোঝালেন তার যেহেতু সারের কারবার, গুদাম এবং সয়েল টেস্টিং ও গবেষণার জন্য কিছু কর্মচারি আছে তাই ব্যবসার আড়ালে চোরা কারবার করতে কোন অসুবিধা হবে না। সেই মত মাল ইংল্যান্ডে পৌঁছনোর ব্যবস্থা হয়ে গেল। মেক্সিকান সরকারের কূটনৈতিক বার্তাবাহক যে মাসে একবার করে লন্ডনে যেত তার হাত দিয়ে বাড়তি একটা সুটকেস পাঠান হল। যার জন্য তার পারিশ্রমিক এক হাজার পাউন্ড প্রতিবার। কিন্তু শোয়ার নামে যে ব্যক্তিটির হাতে সুটকেস পৌঁছত তার আসল দাম কুড়ি হাজার পাউন্ড।
শোয়ার লোকটির চরিত্র ভাল ছিল না। সে জানত আমেরিকার বিপথে যাওয়া ছেলে মেয়েরা বছরে কোটি কোটি টাকার হিরোইন ওড়ায়, অতএব ইংল্যান্ডের ছেলে মেয়েদের পক্ষে এটা অসম্ভব কিছু নয়। শোয়ারের শাকরেরা হিরোইনের সঙ্গে স্টমাক পাউডার দ্বিগুণ করে মিশিয়ে বিভিন্ন আড্ডায় পাঠাতে শুরু করল।
গুপ্ত অপরাধী অনুসন্ধানকারী স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা দল গোস্ট স্কোয়াড বা প্রেত বাহিনী শেষ পর্যন্ত শোয়ারকে খুঁজে বার করল। কিন্তু তার আগেই শোয়ার হয়েছে প্রচুর অর্থের মালিক বহু তরুণ তরুণীর সর্বনাশ করে। তাকে গ্রেফতার করা হল না কারণ চোরাই হিরোইনের মূল উৎস সেই জানে। তাই শোয়ারের গতিবিধির ওপর নজর রাখতেই মেক্সিকান বার্তাবহটির সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটি বিদেশী রাষ্ট্র ব্যাপারটিকে সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত। তাই গোয়েন্দার বদলে ডাক পড়ল ব্রিটিশ গুপ্তচরবাহিনীর। হিরোইনের উৎস সন্ধান ও চোরাই চালকের মূল ঘাঁটি ধ্বংস করবার ভার পড়ল জেমস বন্ড-এর উপর।
বন্ড প্লেনে করে পৌঁছল মেক্সিকো। সেখান থেকে মাদ্রে দ্য ক্যাকাও। তারপর হিরোইন কেনবার অজুহাতে দেখা করল মেক্সিকান বড় কর্তাটির সঙ্গে। তিনি বন্ডের সাথে আলাপ করে বললেন ব্ল্যাকওয়েলের কাছে যেতে। ব্ল্যাকওয়েলের জীবনের ইতিহাস না জেনেও বন্ড বুঝতে পারল সে পেশাদার নয়। তাছাড়া ইংল্যান্ডে হিরোইন নিষিদ্ধ করা সম্পর্কে তার ইচ্ছা আন্তরিক। একদিন গভীর রাতে ব্ল্যাকওয়েলের গুদামে আগুন বোমা থার্মিট রেখে এল।
মাইল খানেক দূরে কফি হাউজে বসে বিস্ফোরণের তীব্রতা, দমকলের ছোটাছুটি দেখতে লাগল। পরের দিন সকালে ফোনে রুমাল চাপা দিয়ে ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
বলল, গতরাত্রে আগুনে তোমার কারবারের ক্ষতি হল বলে দুঃখিত, আরো দুঃখের বিষয় এই যে, গুদামে সব মাল জমা ছিল, সেগুলো বোধহয় ইনসিওর করা নয়।
কে? কে কথা বলছেন?
-আমি ইংল্যান্ড থেকে আসছি। তোমার চালান দেওয়া হিরোইন আমার দেশের বেশ কয়েকজন তরুণ তরুণীর প্রাণ নিয়েছে, দৈহিক ও মানসিক ক্ষতি করেছে আরো অনেকের। তোমার বন্ধু স্যান্টোস আর কোনদিন কূটনৈতিক বার্তা নিয়ে ইংল্যান্ডে আসবে না। আজ রাতেই শোয়ার জেলে ঢুকবে। বন্ড নামে যে লোকটি তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল সেও রেহাই পাবে না কারণ পুলিশ ইতিমধ্যেই তার পিছু নিয়েছে।
লাইনের ওপার থেকে ভয়ার্ত শব্দ ভেসে এল।
বন্ড আবার বলল, ঠিক আছে এবার ছেড়ে দেওয়া হল কিন্তু ভবিষ্যতে এ পথ আর মাড়িও না। সারের কারবার নিয়েই খুশি থাক। ফোন নামিয়ে রাখল বন্ড।
ব্ল্যাকওয়েল ধরতে না পারলেও মেক্সিকান বড়কর্তাটি বন্ডের ধাপ্পা ধরে ফেলেছিল। সাবধান হয়ে অন্য হোটেলে গিয়ে উঠলেও সেই রাত্রেই যখন হোটেলে ফিরছিল তখন রাস্তার পাশে দাঁড়ান নোংরা সুট পরা মাথায় বেঢপ টুপি, মুখে সিগারেট, টুথপিক। দেখলে বোঝা যায় গাঁজাখোর। এসে বন্ডের সামনে দাঁড়াল। এবং প্রথমেই তার কথা– মেয়ে মানুষ চাই নাকি?
-না।
–শ্যামলা রঙের দেশী মেয়ে। দারুণ জিনিস।
–দরকার নেই।
–তাহলে খারাপ ফটো নিন?
বলেই এমন ভান করল যেন ছবি বার করছে। কিন্তু বন্ড এই ভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত। তাই পর মুহূর্তের যখন লম্বা রূপালি ছোরাটা তার কণ্ঠনালীর কাছে, তখন বন্ড সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
চিরাচরিত নিয়মে ডান হাত আড়াআড়িভাবে ঘুরে গেল, সেই সঙ্গে শরীরও। দু জনের বাহু দু জনের শরীরের মাঝখানে ধাক্কা খেল। লোকটির ছোরা পড়ে গেল আর বন্ডের বাঁ হাতের আঘাতে তার চিবুক সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। বন্ড আবার ভয়ঙ্কর আঘাত হানল লোকটির চিবুকের নিচে। সেই ধাক্কায় সে মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল, কিন্তু টলতে টলতে মাটিতে পড়বার আগেই অন্তিম আঘাত হানল কণ্ঠনালীর ওপর–এই সেই মারা যা কম্যান্ডোরা ব্রহ্মাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। এর ফলে নিশ্চিত মৃত্যু যা মেক্সিকানটির কপালে জুটেছে।
বন্ড কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভূলুঠিত দেহটার দিকে তাকাল। রাস্তায় কেউ নেই, শুধু দু একটা গাড়ি বেরিয়ে গেল। তাদের লড়াই করতে কেউ দেখতে পায়নি ছায়ার ভিতরে থাকার জন্য। বন্ড লোকটির পাশে বসে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। নাড়ির স্পন্দন বন্ধ, ঝকঝকে চোখ ঝাপসা, আর আত্মা ইহলোক ছেড়ে পরলোকে।
বন্ড মৃতদেহটাকে ঘন ছায়ার ভিতরে একটা দেওয়ালের গায়ে বসিয়ে দিয়ে নিজে ঠিক হয়ে হোটেলের দিকে রওনা। হল।
পরদিন ভোর বেলায় উঠে বন্ড প্রথম প্লেনেই চড়ে মেক্সিকোর বাইরে চলে গেল। প্রথমে ক্যারাকাস সেখান থেকে মায়ামি এবং মায়ামি হয়ে নিউইয়র্ক।
ইতিমধ্যে লাউড স্পীকারে শোনা গেল যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য তাদের প্লেন ছাড়বে পরদিন সকাল আটটায়। তাই যাত্রীদের আজ রাত্রের মত হোটেলে থাকতে হবে।
বন্ড চিন্তায় পড়ে গেল। আজ রাতটা মায়ামিতে কাটাবে না অন্য প্লেন ধরবে। বরফ সহ বাকি পানীয়টুকু গলায় উজাড় করে ঠিক করল মায়ামিতেই থাকবে আর সুরা পান করবে। বেশ কয়েক বছর মাতাল হওয়া যায়নি। এই রাতটা উপরি পাওয়ার মত তার হাতে এসে পড়েছে, যেটাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে হবে।
কিন্তু ঐ মেক্সিকান কাপুজোটা তাকে কেন মারতে এসেছিল, সারা পৃথিবী জুড়ে চিরকাল এই হত্যার খেলা চলছে, চলবে। একজন আরেকজনকে গাড়ি চাপা দিচ্ছে, অন্যের শরীরে মারাত্মক জীবাণু সংক্রামিত করছে। একটা হাইড্রোজেন বোমা তৈরির জন্য কতজন লোক দায়ী? যে মজুরটি খনির ভেতর থেকে ইউরোনিয়াম খুঁড়ে বার করছে, তার থেকে শুরু করে সেই খনির শেয়ার হোল্ডাররা পর্যন্ত প্রত্যেকের আংশিক দায়িত্ব আছে। পৃথিবীতে কি এমন কোন মানুষ আছে যার ওপর কখনও কোনও মৃত্যুর অন্তত আংশিক দায়িত্ব বর্তায়নি?
বন্ড ভাবল ঢের হয়েছে, এবার আজে বাজে চিন্তা রেখে কঠোর জীবন যাপনে ক্লান্ত শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন–যার জন্য দরকার সহজ, সুন্দর বিলাসবহুল উপভোগ্য জীবন।
কার যেন পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বন্ড মুখ তুলে চাইল। একজন পরিচ্ছন্ন সম্ভ্রান্ত চেহারার প্রৌঢ়। কিন্তু মুখের ভাব বিব্রত! বললেন, মাফ করবেন। আপনি নিশ্চয়ই মিঃ বন্ড, তাই না? মিঃ…ইয়ে…জেমস বন্ড?
.
জীবনের স্বাদ
নিজের পরিচয় জানাজানি হোক এটা কোন গুপ্তচরেরই কাম্য নয়। সুতরাং বন্ড, আজ্ঞে হ্যাঁ, বলল নিতান্ত দায়মারা ভাবে।
-আরে, কি আশ্চর্য যোগাযোগ! ভদ্রলোক করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বন্ড হাতটায় চাপ দিয়েই ছেড়ে দিল। ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম ডুপন্টু। আপনার হয়ত মনে নেই, কিন্তু তার আগেও আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। বসতে পারি?
স্মৃতির পাতা ওলটাতে লাগল বন্ড হা…ভদ্রলোকের চেহারা, ভদ্রলোকের নাম কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে।
মিঃ ডুপন্ট সামনের চেয়ারটায় বসে পকেট থেকে সিগারেট ও সোনার লাইটার বের করলেন, বন্ড তাকে লক্ষ্য করতে লাগল, ভদ্রলোকের চেহারা ও চরিত্রে কোন পার্থক্য নেই। তাদের ইতি পূর্বে দেখা হয়েছে কিন্তু কোথায় তা একেবারেই মনে পড়ছে না।
আসুন।
ধন্যবাদ, বন্ড সিগারেট নিল এবং নিজের লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাল।
-ফ্রান্সে দেখা হয়েছিল আমাদের। ১৯৫১ সালের হোটেল রয়েল লে উফসস, ডুপন্টু আগ্রহের সঙ্গে বন্ডের দিকে। তাকালেন। সেই ক্যাসিনো রয়েলের কথা মনে পড়ছে? ফরাসি ভদ্রলোকটির সাথে আপনি সেদিন সেই বিরাট তাসের জুয়া খেলছিলেন। আমি আর ইথেল, অর্থাৎ আমার স্ত্রী, বসেছিলাম আপনার ঠিক পাশে।
বন্ড পৌঁছে গেল কয়েক বছর আগের সেই দিনটিতে। তারা ৪ ও ৫ নম্বরে বসেছিল, বন্ড ছিল ৬ নম্বর চেয়ারে। তাদেরকে ভাল মানুষ বলে মনে হয়েছিল। সেই দিন শত্রুপক্ষের দুদে গুপ্তচর ল্য শিফকে জুয়ায় সর্বস্ত করেছিল। সমস্ত দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সবুজ টেবিলের ওপর আলোর বন্যা, গোলাপী হাতগুলো কাঁকড়ার পঁাড়ার মত এগিয়ে আসছে, নাকে এসে লাগছে সিগারেটের ধোয়া আর ঘামের কটু গন্ধ। কি অদ্ভুত এক রাত। বন্ড, ডুপন্টের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ খুব মনে পড়ছে আমার। তবে দেরি হল বলে কিছু মনে করবেন না, কারণ তাস ছাড়া সে দিন কিছুই নজরে ছিল না আমার।
মিঃ ডুপন্টও একমুখ হেসে বললেন, এতে মনে করবার কিছু নেই, আর আপনিও আমাকে মাফ করুন উড়ে এসে জুড়ে বসবার জন্য। কিন্তু তার আগে আমাদের সাক্ষাতকে সেলিব্রেট করা দরকার, কি নেবেন আপনি? বলে একজন ওয়েট্রেসকে ডাকলেন।
ধন্যবাদ। বুবো অন্ দ্য রকস।
এবং এক পেয়ালা পানি মেশানোর জিম্পল হেগ।
মিঃ ডুপন্ট একমুখ হেসে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে বললেন, আমি জানতাম এ আপনি ছাড়া আর কেউ নয়। আপনাকে বসে থাকতে দেখেই চিনেছিলাম। তখন আমি নিজেকে বললাম, জুনিয়াস, মুখ চিনতে তো তুমি ভুল কর না। তবু নিশ্চিত হয়ে নিলাম। ঐ ট্রান্স আমেরিকান প্লেনের আমি যাত্রী ছিলাম। যখন মাইক্রোফোনে জানলাম যে প্লেনটা আজ ছাড়বে না তখন আপনার মুখের ভাব লক্ষ্য করলাম, বুঝলাম ঐ প্লেনের যাত্রী আপনিও। তাই দৌড়ে গিয়ে কাউন্টার যাত্রী তালিকা জানতে চাইলাম আর বলা বাহুল্য সেখানে লেখা জে বন্ড।
যেন নিজের চতুরতায় পরিতৃপ্ত মিঃ ডুপন্ট। পানীয় এসে পড়ল, নিজের গ্লাস তুলে ধরে তিনি বসলেন আপনার সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে স্যার। আমার ভাগ্য ভাল যে আজ আপনার দেখা পেয়েছি।
বন্ড একটু হেসে গেলাসে চুমুক দিল। অবাক ঝুঁকে বসলেন মিঃ ডুপন্ট, চারপাশটা দেখে নিলেন সব ফাঁকা। তবু তিনি নিচু গলায় বললেন, আপনি হয়ত ভাবছেন, জুনিয়াস ডুপন্টের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে ভালই লাগল।…কিন্তু আসল ব্যাপারটা কিঃ মিঃ ডুপন্ট দুই ভুরু তুলে তাকালেন, আরো ঝুঁকে বসলেন, কিছু মনে করবেন না, মিঃ বন্ড; অন্যের গোপনীয়…মানে ব্যাপারে নাক গলানো আমার অভ্যেস নয়। ক্যাসিনো রয়েলের সেই জুয়াখেলার পর আমি কানাঘুষো শুনেছিলাম যে আপনি একজন অসামান্য জুয়াড়ী নন, আপনি হচ্ছেন একধরনের…মানে…গোয়েন্দা গোছের মানুষ। অর্থাৎ কিনা, নানান গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তদন্ত করে থাকেন। কথাটা বলে ফেলে মিঃ ডুপন্ট অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে উদ্বিগ্ন চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন রুমাল দিয়ে।
বন্ড তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। তার নীল ধূসর চোখ কঠোর থেকে নরম হল, সেই সঙ্গে ফুটে উঠল ব্যাঙ্গ আর আত্মগ্লানি। বলল, সত্যিই সে সময় ঐ ধরনের ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম, বীরত্ব টীরত্ব ফলাতে মজা লাগল আর কি। তবে আজকাল পৃথিবী শান্ত হয়ে এসেছে। ওসবের কাজকর্মও ফুরিয়েছে।
-নিশ্চয়, নিশ্চয়, মিঃ ডুপন্ট ডান হাতের সাহায্যে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার মত ভঙ্গি করল। পরের প্রশ্নটা করলেন বটে তবে জানতেন উত্তরটা ডাহা মিথ্যে হবে, তা এখন নিশ্চয় আপনি বেশ গুছিয়ে বসতে পেরেছেন? এক টুকরো পিতৃসুলভ হাসি হেসে বললেন, কোন লাইনে আছেন আপনি? অবশ্য আপনার যদি সেটা জানাতে আপত্তি না থাকে…
আমি আমদানি রপ্তানির ব্যবসা ধরেছি। ইউনিভার্সাল এ কাজ করি আমি। ওদের সঙ্গে আপনারও কারবার আছে বোধহয়?
মিঃ ডুপন্ট লুকোচুরি খেলাটা বেশ চালিয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন বন্ড তার পুরনো পেশাতেই আছে। বললেন, হুমম্, ইউনিভার্সাল। দাঁড়ান দাঁড়ান, আরো হ্যাঁ নিশ্চয় শুনেছি ওদের কথা। অবশ্য কারবার চালানোর সৌভাগ্য হয়নি কখনো। ভদ্রলোক চওড়া হাসি হাসলেন। আমেরিকার প্রতিটি আনাচে কানাচে আমার ব্যবসা ছাড়ানো আছে। কেমিক্যালস ছাড়া অন্য সব ব্যবসাতেই প্রায় নাক গলিয়েছি আমি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের পরিবারের অনেকেই কেমিক্যালসের ব্যবসায় বিশ্ববিখ্যাত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মিঃ বন্ড ও লাইনটি আমাদের একেবারেই অপছন্দ।
বন্ড কোন মন্তব্য করল না কারণ বোঝাই যায় ভদ্রলোক নিজের পছন্দসই ব্যবসা নিয়েই যথেষ্ট সুখী। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিঃ ডুপন্টকে তাঁর বক্তব্য শেষ করার ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করল বন্ড। মিঃ ডুপন্টের প্রস্তাব খুব সাবধানে বিবেচনা করতে হবে কারণ ভদ্রলোককে দেখে শান্তশিষ্ট আমেরিকান টুরিস্ট মনে হলেও আড়ালে রীতিমত পোক্ত ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির এক মানুষ।
বন্ডের ইঙ্গিতটা মিঃ ডুপন্টের সতর্ক দৃষ্টি এড়াল না তাই নিজেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ওরে বাস! সাতটা বেজে গেল, আর আমি কিনা আপনাকে আসল কথা না বলে বকবক করে যাচ্ছি। শুনুন, মিঃ বন্ড, আমি আপতত এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন এবং এর জন্য আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। আজকের রাতটা যদি মিয়ামিতেই কাটান আর হাতে যদি আপনার সময় থাকে তাহলে একটা দিনের জন্য আমার অতিথি হয়ে থাকুন। কথা দিচ্ছি, সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোনরকম ত্রুটি হবে না। আসলে এখানে গত বড়দিনের সময় আমি একটা হোটেল খুলেছি। জানেন নিশ্চয়ই? ব্যবসা ভালই চলছে, তো আপনি বলুন রাজি তো? হোটেলের সব থেকে সেরা কামরা আপনার জন্য, তাতে অন্য খদ্দের অখুশি হয় হোক। মিঃ ডুপন্ট মিনতি ভরা চোখে বলে উঠলেন কাজটা করে দিতে পারলে আমার অত্যন্ত উপকার হয়।
বন্ড মনস্থির করেই ফেলেছিল ব্ল্যাকমেল, গুণ্ডামি, নারী–যে সমস্যা নিয়েই হোক না কেন ডুপন্টের প্রস্তাবে সে রাজি হবে। তার বদলে সে পাবে এক টুকরো আনন্দোচ্ছল জীবন।
বন্ড বিনয়ের সঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিঃ ডুপন্ট বাধা দিলেন, দয়া করে না বলবেন না মিঃ বন্ড। আর বিশ্বাস করুন, আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হব। এরপর ওয়েট্রেসকে ডেকে টাকা মিটিয়ে দিলেন পানীয়ের। অন্যান্য অনেক বড়লোকের মত ইনিও নিজের টাকা জাহির করা বা কত টিপস দিলেন সেটা জাহির করা অসভ্যতা বলে মনে করেন সেটা তার পেছন ফিরে বিল মেটান দেখেই বোঝা গেল। তারপর টাকাটা পকেটে রেখে দিয়ে বন্ডের বাঁ হাতে হাত রাখলেন। কিন্তু পরক্ষণেই হাত সরিয়ে নিলেন বন্ডের ঠিক ভাল লাগছে না দেখে। দু জনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে হলঘরে চলে এলেন এবার।
-আচ্ছা এবার আপনার প্লেনের রিজার্ভেশন-এর ব্যাপারটা ঠিক করে নেওয়া যাক, বলে ডুপন্ট টিকিট কাউন্টারের দিকে এগোলেন। সংক্ষিপ্ত কথায় কাজ সারা হতে বোঝাই গেল তাঁর নিজস্ব আমেরিকান দুনিয়ায় কতদূর প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা।
বাইরে বেরোতেই চকে এক ক্রাইস লার ইরিপরিয়াল এসে দাঁড়াতেই ইউনিফর্ম পরা এক সোফার চটপট গাড়ির দরজা খুলে ধরল। বন্ড দেখল গাড়ির ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। সে জমিয়ে বসল। ট্রান্স আমেরিকার এক কর্মচারি বন্ডের সুটকেস সোফারের হাতে তুলে দিয়ে সেলাম করে চলে গেল। মিঃ ডুপন্ট সোফারকে সমুদ্রতীরের নাম করা রেস্তোরাঁ বিলস্ অন দ্য বীচ এ নিয়ে যেতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল গাড়িটি রাস্তায় এসে গন্তব্যস্থলের দিকে এগোল।
মিঃ ডুপন্ট হেলান দিয়ে বসে বললেন, পাথুরে কাঁকড়া খেতে আপনার ভাল লাগে মিঃ বন্ড? খেয়েছেন তো?
বন্ড জানাল তার স্বাদ সে পেয়েছে এবং খেতে ভালই লাগে।
গাড়ি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল, আর মিঃ ডুপন্ট বকবক করতে লাগলেন রেস্তোরাঁ সম্পর্কে, পাথুরে কাঁকড়া ও আলাস্কা কাঁকড়ার তুলনামূলক গুণাবলী সম্পর্কে।
রেস্তোরাঁর ওপর গোলাপী নিয়নের অক্ষরে লেখা–বিলস্ অন্য দ্য বীচ। বন্ড গাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে শুনল মিঃ ডুপন্ট-এর সঙ্গে সোফারের কথোপকথনে কিছু অংশ। আলোহা সুইট-টি এই ভদ্রলোকের জন্য রিজার্ভ করে রাখ।…যদি কোন অসুবিধে হয়, ম্যানেজারকে বল আমাকে ফোন করতে।
সিঁড়ি দিয়ে এসে ভেতরে একটা বড় সাদা রঙ করা ঘরে এসে পৌঁছল বন্ড। জানালায় গোলাপী মসলিন পর্দা। অনেক স্ত্রী-পুরুষ এখানে, যাঁদের গায়ের রঙ বাদামী, পোশাক ঝকঝকে চটকদার, চোখে জড়োয় কাজ করা চশমা, হাতে সোনার চুড়ি।
রেস্তোরাঁর ইটালিয়ান মালিক বিল শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল, আরে মিঃ ভুঃ পন্ট! কি সৌভাগ্য আমার, স্যার! আজ রাতে ভিড়টা একটু বেশি, তবে আপনাদের জায়গা করে দিচ্ছি। মাথার ওপর একটা মেনু কার্ড নিয়ে একেবেঁকে চলে এলেন শ্রেষ্ঠ টেবিলটির দিকে। দুটো চেয়ার টেনে তাদের বসতে বলে বেয়ারা ও ওয়েটারকে ডেকে, মেনু কার্ড রেখে সৌজন্য বিনিময় করে চলে গেলেন।
মিঃ ডুপন্ট বন্ডকে বললেন, খাবার পছন্দের ব্যাপারটা আমার ওপরেই ছেড়ে দিন। পছন্দ না হলে খাবার ফেরত পাঠিয়ে দেব। হেড বেয়ারাকে অর্ডার দিলেন টাটকা পাথুরে কাঁকড়া সঙ্গে গলানো মাখন আর মোটা টোস্ট।
মিঃ ডুপন্ট মৌজ করে সিগারেট বার করলেন। চারপাশে দৃষ্টি বোলালেন, দু একজনের দিকে হাত নাড়লেন হাসি মুখে। তারপর বন্ডের কাছে ঘেঁষে এসে বললেন, বড় আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু কোন উপায় নেই। কুণ্ঠিত গলায় বললেন, কাঁকড়া খাওয়ার জন্যই এখানে আসতে হয়। অদ্ভুত ভাল কাঁকড়া রান্না করে এরা। আশা করি আপনার এলার্জি-ট্যালার্জি নেই। একবার একটি মেয়েকে কাঁকড়া খাইয়ে খুব লজ্জায় পড়ে গেছিলাম, তার ঠোঁটটা সাইকেলের চাকার মত ফুলে গেছিল।
মিঃ ডুপন্টের আচরণ দেখে বন্ড বুঝতে পারল তার ধারণা তিনি বন্ডকে ম্যানেজ করে ফেলেছেন তাই এত কর্তৃত্ব দেখাচ্ছেন। এয়ারপোর্টের সেই লাজুক ব্যক্তির সঙ্গে কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যায় না। এতক্ষণে বোধহয় নিশ্চয়ই জানা যাবে ভদ্রলোক কি চান বন্ডের কাছ থেকে।
বন্ড জানাল যে তার এলার্জি নেই। শুনে ভদ্রলোক নিশ্চিত বোধ করলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ, মিঃ ডুপন্ট লাইটারের আওয়াজ করতে গিয়েও করলেন না। টেবিলের ওপর দু-হাত রেখে বললেন, রামি খেলেছেন কখনো, মিঃ বন্ড?
-হ্যাঁ বেশ ভাল খেলা। আমার ভালই লাগে।
–খেলাটা যদি দুজনের মধ্যে হয়?
—খেলেছি কিন্তু তাতে মজা নেই। হার জিৎ তেমন হয় না। খেলাটা একঘেয়ে লাগে।
মিঃ ডুপন্ট ও মাথা নেড়ে সায় দিলেন। জিন রাখি বা ওকালাহোমা-র মত খেলা নয় ঠিকই তবে সময় কেটে যায়। অনেকগুলো তাস নিয়ে খেললেও শেষ পর্যন্ত সমান সমানই দাঁড়ায়। ওয়াইন ওয়েটার নির্দেশমত দু পেগ মার্টিনি আনলে মিঃ ডুপন্ট তাকে আরও দু গ্লাস আনতে বলল।
দুজনে গ্লাসে চুমুক দিয়ে আবার কথা শুরু করল। মিঃ ডুপন্ট বললেন, আমি যদি আপনাকে বলি মিঃ বন্ড, যে আমি একজনের সঙ্গে রামি খেলে এক সপ্তাহে পঁচিশ হাজার ডলার হেরেছি, তাহলে আপনার বক্তব্য কি? বন্ড কিছু বলার আগেই মিঃ ডুপন্ট বলে উঠলেন–মনে রাখবেন আমি একজন ভাল তাস খেলোয়াড়, রিজেন্সি ক্লাবের মেম্বার। বাঘা বাঘা লোকেদের সঙ্গে খেলেছি যেমন চার্লি গোরেন, জনি ক্রফোর্ড। সুতরাং তাসের টেবিলে বোকামি করবার পাত্র আমি নই। বলে সন্ধানী দৃষ্টিতে বন্ডের দিকে তাকালেন।
–যদি একই লোকের সঙ্গে আপনি সমানে খেলে থাকেন তাহলে জোচ্চুরি করা হয়েছে আপনার সঙ্গে।
— ঠিক-তাই বলে মিঃ ডুপন্ট সজোরে টেবিলে চাপড়ালেন। পরপর চারদিন হারবার পর আমার এই কথাটাই মাথায় এসেছিল, যে নির্ঘাৎ আমাকে ঠকান হচ্ছে। অতএব একবার যদি তাকে বার করতে পারি কি করে জোচ্চুরি করে তবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মায়ামি শহর থেকে বার করে দেব।
পরের দিন থেকে দ্বিগুণ বাজি ধরতে শুরু করলাম। প্রতিটি তাস, প্রতিটি চালচলন লক্ষ্য করলাম কিন্তু কিছুই ধরতে পারলাম না। ইশারা নেই, ইঙ্গিত নেই, যখন ইচ্ছে তাসের প্যাকেট বদলাচ্ছি, আমার হাত দেখাও সম্ভব নয় উল্টোদিকে বসতাম বলে। আশে পাশেও কেউ নেই যে ইশারায় জানিয়ে দেবে। আজ সকালে এমনকি বিকেলেও হেরেছি আমি। বন্ড তাঁর খেলোয়াড়ী মনোবৃত্তির অভাব আছে মনে করবে বলে বলল, শেষে খেলটার ওপর চটে গেলেও আচরণে তা প্রকাশ পেতে দিইনি। ভদ্রভাবে সব টাকা মিটিয়ে দিয়ে ভদ্রলোকের কাছ থেকে পালাবার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়ে নিউইয়র্কগামী প্লেনের টিকিট কেটে ফেললাম। ভাবতে পারেন। মিঃ ডুপন্ট শূন্যে দু হাত ছুঁড়ে বলে উঠলেন–স্রেফ পালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পঁচিশ হাজারকে লাখে পৌঁছতে দেখে, লোকটি আমায় ঠকাচ্ছে বুঝলেও অসহ্য লাগছিল কোন উপায় নেই দেখে। ভাবতে পারেন, আমি শ্ৰীযুক্ত জুনিয়াস ডুপন্ট ল্যাজ গুটিয়ে পালাচ্ছি।
বন্ড সহানুভূতি সূচক শব্দ করল। আরেক প্রস্থ পানীয় এল। এবার তার আগ্রহ জাগছে কারণ তাস খেলায় তার নেশা আছে। ডুপন্টের কথাগুলো তার চোখে ছবির মত ভেসে উঠল। মিঃ ডুপন্টকে ঠকান হচ্ছে সে বিষয়ে সন্দেহ। নেই। বন্ড বলল, পঁচিশ হাজার ডলার তো অনেক। পয়েন্ট পিছু কত বাজি ধরছিলেন আপনারা?
মিঃ ডুপন্ট হেসে বললেন, এক পয়েন্টে সিকি, তারপর আধ ডলার, সবশেষে এক ডলার। উঁচু বাজি সন্দেহ নেই। পয়েন্ট পিছু সিকি ডলার ধরলেও এক এক গেমে পাঁচশ ডলার আর এক ডলার ধরলে তো মারাত্মক ব্যাপার।
– এক দু বার আপনিও জিতেছেন নিশ্চয়?
-সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু যখনই আমি বিরাট পয়েন্টে হারাবার চেষ্টা করি তক্ষুনি যেন বুঝতে পেরে মিলে যাওয়া তাসগুলো সব ফেলে দেয়। ফলে জেতার অঙ্গ খুব সামান্য। একবারও ফাঁদে ফেলতে পারিনি, কিন্তু ওর ফাঁদে আমি ধরা পড়ে একরাশ পয়েন্ট হেরে গিয়েছি। মনে হয় আমার হাতের প্রত্যেকটা তাস ওর জানা।
-ঘরে কোন আয়না থাকে নাকি?
-আরে না! আমরা সর্বদা খোলা মাঠে বসে খেলি। ওর নাকি সূর্যস্নান খুব দরকার। তা করেছে বটে ব্যাটা রোদে পুড়ে পুড়ে লাল গলদা চিংড়ির মত চেহারা হয়ে গেছে। সকাল আর বিকেল ছাড়া খেলে না। রাত্রিবেলা খেললে নাকি ঘুম চটে যায়।
লোকটি কে বলুন তো? নাম কি?
গোল্ডফিংগার।
প্রথম নাম।
–অরিক। অর্থাৎ সোনালি, তাই না? লোকটা যে সোনালি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। চুলগুলো পর্যন্ত লাল।
–কোন দেশের লোক?
আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না, লোকটা আসলে ইংরেজ। আমেরিকার নাসো-তে থাকে। নাম শুনে ইহুদী মনে হয়। কিন্তু চেহারায় নয়। বয়স বিয়াল্লিশ, অবিবাহিত, পেশা দালালি। নাসো-র পাসপোর্টের সবকিছু লেখা আছে। তাস খেলা শুরু করার আগে ডিটেকটিভ দিয়ে ওর পাসপোর্ট দেখিয়ে নিয়েছিলাম।
-কিসের দালাল?
মিঃ ডুপন্ট শুকনো হাসি হেসে বললেন, সে কথা জিজ্ঞাসা করাতে ও ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল, সোজাসুজি প্রশ্ন করলে মুখে তালাচাবি, কিন্তু আজে বাজে ব্যাপারে অনর্গল বক্ক্ করে যাবে।
ভদ্রলোকের টাকা পয়সা কেমন?
–আরে! মিঃ ডুপন্ট প্রায় ফেটে পড়লেন, সেইটাই তো আসল ব্যাপার। অগাধ টাকা পয়সা লোকটার। আমার ব্যাংক মারফৎ নাসোতে খোঁজ নিয়েছি। বড়লোকের জায়গা নাসো। অলিতে গলিতে কোটিপতি। কিন্তু তাদের মধ্যের এ লোকটা এক নম্বর বা দুনম্বর। সব টাকা নাকি সোনার বাটে রাখে। কাগজের টাকায় বিশ্বাস নেই। এইজন্যই হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনকুবেরদের একজন হতে পেরেছে। ব্যবসা পদ্ধতিতেও নিশ্চয় কিছু সার বস্তু আছে। কিন্তু লোকটা যদি অতই বড়লোক তবে ঠকিয়ে পঁচিশ হাজার ডলার রোজগার করে কেন?
প্রশ্নের উত্তরের জন্য বন্ডকে ভাবতে হল না তার আগেই সাড়ম্বরে টেবিলে এসে গেল বিরাট প্লেট ভর্তি কাঁকড়া। রূপার বাটি ভর্তি গলান মাখন আর উঁচু এক থাক টোস্ট। সবশেষে এল গোলাপী শ্যাম্পেন।
মিঃ ডুপন্ট সহর্ষে, যত পারেন নিন, বলে নিজের প্লেটে কয়েক টুকরো কাঁকড়া ও গলানো মাখন নিয়ে খেতে শুরু করলেন। বন্ডও হাত চালাল এবং খেতে শুরু করল। গিলতে লাগল বলা যায় কারণ এমন উপাদেয় জিনিস সে জীবনে খায়নি।
পাথুরে কাঁকড়ার মাংস অতি নরম মিষ্টি। টোস্ট ও গলা মাখনের ধোঁয়াটে গন্ধ মাংসের সঙ্গে চমৎকার লাগছিল। বরফ-ঠাণ্ডা শ্যাম্পেনে মৃদু স্ট্রবেরীর গন্ধ। নিবিষ্ট মনে খেতে এত ব্যস্ত যে আর কোন কথাবার্তা হল না।
শেষ পর্যন্ত একটা ঢেকুর তুলে মিঃ ডুপন্ট হেলান দিয়ে বসলেন। মুখ লাল, সগর্বে বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ বন্ড, পৃথিবীর আর কেউ বোধহয় আমাদের মত এত ভাল খাবার খায়নি কি বলেন?
বন্ড ভাবছিল প্রাচুর্যে ভরা সহজ জীবন চেয়েছিল সে। এখন কেমন লাগছে, কেমন লাগছে গান্ডে পিন্ডে গিলতে আর হাস্যকর মন্তব্য শুনতে? সহসা মনে হল আর যেন একত্রে খেতে না হয়। নিজের বিরক্তিতে নিজেই লজ্জা পেল বন্ড। যা চেয়েছিল তাই তো পেয়েছে। ভিতরের অতিভদ্র সত্তাটি একটাকে সহ্য করতে পারছে না। তার মনের ইচ্ছা কেবল পূর্ণ হয়নি জোর করে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। বন্ড বলল, সে অবশ্য বলা মুশকিল, তবে খাওয়াটা সত্যিই ভাল।
মিঃ ডুপন্ট সন্তুষ্ট হয়ে কফি আনতে বললেন। বন্ড নিজের জন্য কিছু আনতে মানা করল। একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রস্তাব শোনার অপেক্ষায় রইল কারণ এই খাওয়া দাওয়া সবকিছু সেই প্রস্তাবেরই উপক্রমনিকা।
মিঃ ডুপন্ট কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন, এবার মিঃ বন্ড আপনার কাছে এক প্রস্তাব আছে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করতে লাগলেন।
–বলুন?
-এয়াপোর্টে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটা এক আশ্চর্য যোগাযোগ, মিঃ ডুপন্টের গলার স্বর গম্ভীর ও অকপট; হোটেল রয়্যালে জুয়ার টেবিলে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কথা এখনও মনে আছে। এমনকি সে রাতের প্রতিটি মুহূর্ত। আপনার স্থৈর্য; আপনার সাহস, আপনার তাস খেলার দক্ষতা… বন্ড টেবিলের দিকে চোখ নামিয়ে নিল। মিঃ ডুপন্ট তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, মিঃ বন্ড আমি আপনাকে দশ হাজার ডলার দেব; আপনি আমার হোটেলে থেকে ঐ গোল্ডফিংগার লোকটা কি করে হারায় তা খুঁজে বার করুন।
বন্ড মিঃ ডুপন্টের চোখে চোখ রাখল আপনার প্রস্তাবটা বড় ভাল ডুপন্ট। কিন্তু আমায় লন্ডন ফিরতে হবে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনগামী প্লেন ধরে। আপনারা যদি নিয়ম মাফিক সকালে ও বিকেলে তাস খেলেন তাহলেই রহস্য ভেদ করার যথেষ্ট সময় পাব। কিন্তু আপনার কাজ শেষ হোক না হোক কাল রাতে নিউইয়র্ক যেতেই হবে।
– আমি রাজি। বললেন, মিঃ ডুপন্ট।
.
রোগের নাম অ্যাগারোফোবিয়া
ঘুম ভাঙলে বন্ড চাদর সরিয়ে সুদৃশ্য জানালার দিকে এগিয়ে গেল, সেখান থেকে ব্যালকনিতে।
ব্যালকনি ইতিমধ্যেই গরম হয়ে উঠেছে। সমুদ্র থেকে ঝরঝরে হাওয়া আসছে। হোটেলের লাগোয়া জেটির ওপর সব দেশের পতাকা উড়ছে।
বার তলা নিচের হোটেলের বাগানে সারি সারি পাম গাছ, ক্রোটিন ফুলের বাগিচা, পরিষ্কার রাস্তায় দু ধারে বুগনভিলার ঝাড়। বন্ডের ঠিক নিচে বিশাল কাবানা ক্লাব -এর দোতলা বাড়ি বেঁকে চলে গেছে সমুদ্রহীর পর্যন্ত, তার ছাদে অনেক টেবিল চেয়ার সাজান আর বেশ কয়েকটা লাল সাদা বড় ছাতা। বাঁকের মধ্যে অলিম্পিক সাইজ সুইমিং পুল। তার চারপাশে কার্পেটে মোড়া ইজিচেয়ার যেখানে কিছুক্ষণ পরে লোকেরা জড় হবে পঞ্চাশ ডলার মূল্যের সূর্যস্নানের উদ্দেশ্যে।
কাপড়ের আলমারি খুলতে গিয়ে বন্ড একটি কার্ড দেখতে পেল যাতে লেখা এই অ্যালোহা সুইট-এর দৈনিক ভাড়া দু শ ডলার (বন্ডের কামরা-র)। বন্ড মনে মনে হিসেব করল, পকেট থেকে যদি তাকে এই কামরার ভাড়া দিতে হত, তাহলে তিন সপ্তাহর মধ্যে তার সমস্ত মাইনে শেষ। বন্ডের হাসি পেল এ কথা মনে করে। শোবার ঘরে গিয়ে একরাশপ্রাতঃরাশ এক কার্টন কিং সাইজ চেষ্টার ফিল্ড সিগারেট ও খবরের কাগজের অর্ডার দিল ফোনে। দাড়ি কামিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে রেডি হতে আটটা বেজে গেল। সুদৃশ্য বসবার ঘরে ঢুকতেই দেখল লাল সোনালি উর্দি পরা বেয়ারা টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রাখছে। মায়ামি হেরাল্ড কাগজের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল বন্ড। সামনের পাতা জুড়ে শুধু দুটি খবর গতকাল আমেরিকার কেপ কাণাভেরালে এক আন্ত মহাদেশিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ব্যর্থতা এবং হিয়ালিতে এক বিরাট গোড়দৌড়ে চাঞ্চল্যকর আপসেট।
কাগজ মেঝেতে ফেলে দিয়ে বন্ড বসে পড়ল। জলখাবার খেতে খেতে ভাবছিল মিঃ ডুপন্ট ও মিঃ গোল্ডফিংগারের কথা।
অনেক ভেবেচিন্তেও কোন সুরাহা করতে পারল না। হয়ত মিঃ ডুপন্ট অনেক নিকৃষ্ট মানের খেলোয়াড়। তবে যতটুকু চেনা যায় তাতে এধরনের সম্ভাবনা খুব কম, টাকার প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও গোল্ডফিংগারের যদি তাস খেলায় এরকম জোচ্চুরির অভ্যেস থাকে তাহলে তার বড়লোক হবার মূল্যে হয়ত এরকম কোন সন্দেহজনক ব্যাপার আছে। আঁদরেল অপরাধীদের সম্বন্ধে বন্ডের আগ্রহ কম নয়, তাই গোল্ডফিংগারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার যথেষ্ট আগ্রহ হচ্ছিল তার। তার চেয়েও বেশি আগ্রহ ছিল রহস্যময় অথচ সুপরিকল্পিত জোচ্চুরির রহস্য ভেদ করার।
মিঃ ডুপন্ট ও বন্ড মিলে ঠিক করল সকাল দশটায় বাগানে গিয়ে বন্ড, ডুপন্টের সঙ্গে দেখা করবে। বন্ডের পরিচয়। নিউইয়র্ক থেকে আসা এক ব্যক্তির যে মিঃ ডুপন্টকে জনৈক ইংরেজের কাছ থেকে এক খনিজ কোম্পানির কিছু শেয়ার কিনতে রাজি করান। ব্যাপারটা খুবই গোপনীয় সুতরাং গোল্ডফিংগার এ বিষয়ে বন্ডকে প্রশ্ন করার কথা চিন্তাও করবেন। না। বন্ডকে শুধু তিনটি কথা মনে রাখতে হবে–শেয়ার, খনিজ গ্যাস এবং কানাডা।
তারা দুজনে কাবানা ক্লাবের ছাদে যাবে এবং ডুপন্ট ও গোল্ডফিংগার তাস খেলবে, বন্ড কাগজ পড়ার ভান করে। তাদের লক্ষ্য করবে। মধ্যাহ্ন ভোজের সময় ডুপন্ট ও বন্ড ব্যবসা সংক্রান্ত কথা সেরে নেবে। তারপর আবার ডুপন্ট ও গোল্ডফিংগার তাস খেলতে শুরু করবেন।
মিঃ ডুপন্ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন বন্ডের আর কোন কিছুর প্রয়োজন হবে কিনা। বন্ড গোল্ডফিংগারের ঘরের নম্বর জানতে চেয়েছিল, আর একটা ডুপ্লিকেট চাবি। গোল্ডফিংগার যদি পেশাদার তাসের জুয়াড়ী এমন কি জুয়াচোরও হন তাহলে জিনিসপত্রের মধ্যে ববসার জিনিসও থাকবে যেমন দাগ দেওয়া তাস, তাস লুকিয়ে রাখবার সরঞ্জাম ইত্যাদি। মিঃ ডুপন্টকে এই বলে বোঝান হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন ম্যানেজারের কাছ থেকে ম্যানেজ করে চাবি এনে বাগানে এসে বন্ডকে চাবিটা দেবেন।
সাড়ে ন টার সময় বন্ড নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইচ্ছা করেই যেন পথ হারিয়ে ফেলল, হোটেলের ভূগোলটা ভালভাবে পরখ করার জন্য। শেষে একই পরিচারিকার সঙ্গে দু বার দেখা হয়ে যাওয়ায় ভালমানুষের মত রাস্তা জেনে নিয়ে লিফটে করে নিচে নেমে এল। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সোজা চলে গেল বাগানে। যেকানে মিঃ ডুপন্ট তাকে চাবি দিলেন। তারপর তারা ধীরে ধীরে কাবানা ক্লাবের ছাদের দিকে রওনা দিলেন।
মিঃ গোল্ডফিংগারকে দেখে বন্ড চমকে গিয়েছিল। সে ছাদের এক কোণে ঠ্যাং তুলে শুয়েছিল। পরনে একটা হলদে মার্টিনের জাঙ্গিয়া, চোখে কাল চশমা, থুতনির নিচে অদ্ভুত একজোড়া টিনের পাখনা যেটা তার গলায় আটকান। সেখান থেকে দুই কাঁধের ওপর জড়িয়ে গেছে। তারপর একটু বেঁকে গিয়েছে ওপর দিকে।
বন্ড জিজ্ঞাসা করল গলায় ওটা কী?
-আপনি দেখেননি কখনও এর আগে। মিঃ ডুপন্ট বিস্মিত হয়ে বললেন ওটি সূৰ্য্যস্নানে সাহায্য করে। পাখনাটার পালিশ করা টিনে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে পৌঁছয় চিবুকের নিচে আর কানের পিছনে যে সব জায়গায় এমনিতে সূর্যের আলো লাগে না।
-বটে, বটে বলল বন্ড।
সেই লোকটির কাছে এসে মিঃ ডুপন্ট চড়া গলায় ডাকলেন–ও মশাই!
শায়িত লোকটি একটুও নড়ল না।
মিঃ ডুপন্ট স্বাভাবিক গলায় বললেন, লোকটা কানে ভীষণ কম শোনে। এবার তারা পায়ের কাছে গিয়ে আবার হাঁক দিলেন।
এবার গোল্ডফিংগার তাড়াতাড়ি করে উঠে বসলেন। চোখের চশমা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, আরে, কি ব্যাপার! গলা থেকে টিনের পাখনা খুলে উড়ে দাঁড়ালেন। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বন্ডের দিকে তাকালেন।
–মিঃ বন্ডের সঙ্গে আলাপ করুন। মিঃ জেমস বন্ড আমার বন্ধু, নিউইয়র্ক থেকে আসছে। আপনার দেশের লোক। এখানে এসেছে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে।
মিঃ গোল্ডফিংগার হাত বাড়িয়ে দিলেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম মিঃ বন্ড।
বন্ড হাত মেলাল, কঠিন শুকনো হাত এক মুহূর্তের জন্য মিঃ গোল্ডফিংগারের স্বচ্ছ নীল চোখ খুলে গিয়ে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল বন্ডের উপর। যেন মনে হল হাড় চামড়া ভেদ করে সেই দৃষ্টি খুলির শেষপ্রান্তে গিয়ে পড়ল। তারপরেই এক-রে যন্ত্রের লেন্সের ওপর ঢাকনা দেওয়ার মতন চোখের পাতা মেলে এল। আর বন্ডের ছবিটা গোল্ডফিংগার তার স্মৃতির মণিকোঠায় এক কোণে রেখে দিলেন।
-আজ আর তাহলে খেলা হচ্ছে না, ভোতা বর্ণহীন গলায় প্রশ্ন নয় যেন মন্তব্য করা হল।
-খেলা হবে না মানে? মিঃ ডুপন্ট গর্জে উঠলেন। আপনি কি ভেবেছেন, আমায় গো হারান হারিয়ে গঁাট হয়ে বসে থাকবেন? ও টাকা উসুল না করে আমি এ হোটেল ছেড়ে এক পা নড়ছি না।
মিঃ ডুপন্ট মেজাজের মাথায় হাসলেন, স্যামকে বলেছি টেবিল লাগাতে। জেমস্ তাসখেলা না জানলেও শিখতে তো তেমন আপত্তি নেই, কি বল? বন্ডের দিকে ঘুরে বললেন, খবরে কাগজ নিয়ে বসে থাকতে খারাপ লাগবে না তো?
একটু বিশ্রাম করতে পারলে আমি বেঁচে যাই। ভীষণ ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে তো! বন্ড বলল।
আবার গোল্ডফিংগারের দুই চোখ অন্তভেদী দৃষ্টি ফেলল বন্ডের ওপর। তারপর বললেন, আমি বরং গায়ে কিছু জামাকাপড় পড়ে নিই। ভেবেছিলাম বিকেল বেলা গলফ খেলার কোচিং নেব। কিন্তু তাস খেলা আমার সবচেয়ে বড় নেশা। বন্ডের দিকে অনুসন্ধিৎ সুদৃষ্টি ফেলে বললেন, আপনি গল্ফ খেলেন, মিঃ বন্ড?
বন্ড গলা চড়িয়ে বলল যাতে শুনতে পান ইংল্যান্ডে থাকাকালীন খেলতাম মাঝে মাঝে।
কোন মাঠে খেলেন?
–হান্টারকোব্ব।
-বাঃ সুন্দর ছোট মাঠটা। আমি সম্প্রতি স্যান্ডউইচ শহরের রয়্যাল সোটা মার্কস ক্লাবে যোগ দিয়েছি। ওখানে কাছাকাছি আমার একটা ব্যবসা আছে। ক্লাবটা চেনেন?
খেলেছি ওখানে।
–কত হ্যান্ডিক্যাপ আপনার
—নয়।
–কি আশ্চর্য যোগাযোগ। আমারও তাই। আপনার সঙ্গে খেলতে হবে একদিন। মিঃ গোল্ডফিংগার নিচু হয়ে টিনের পাখনাটা তুলে নিলেন। মিঃ ডুপন্টকে বললেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
বন্ডের বেশ মজা লাগল। এই সংক্ষিপ্ত ভদ্রতাটুকু করা হল নিতান্তই অভ্যস্ত ভঙ্গিতে। বন্ড মরল কি বাচল তাতে গোল্ডফিংগারের কিছু এসে যায় না। যেহেতু বন্ড সশরীরে এখানে এসে গেছে যখন, তখন সৌজন্যবশত দু একটা কথা বলতে ক্ষতি কি?
মিঃ ডুপন্ট সাদা কোট পরা এক পরিচারককে কি সব নির্দেশ দিলেন। অন্য দু জন বেয়ারা তাসের টেবিল লাগাতে শুরু করেছে। বন্ড ছাদের রেলিঙে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিঃ গোল্ডফিংগারের কথাই ভাবছিল।
ভদ্রলোক বন্ডের মনে রেখাপাত করেছে, কারণ এরকম উত্তেজনাবিহীন মানুষ কমই দেখা যায়। ভদ্রলোকের প্রতিটি চালচলন, অভিব্যক্তি একেবারে মাপা। বোঝাই যায় মস্তিষ্ক কতদূর শান্ত। কোন ব্যাপারে সামান্যতম শক্তি অপচয় হয় না। তবু যেন এই চঞ্চলতার মধ্যে কি একটা সতর্ক অবরুদ্ধ শক্তি লুকান আছে।
গোল্ডফিংগারকে দেখে মনে হয় সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন বেখাপ্পা ভাব। দৈর্ঘ পাঁচ ফুটের বেশি নয়। থ্যাবড়া চাষাড়ে পা। আর কাঁধের ওপর বসান বিরাট মাথা। কোন অঙ্গই যেন তার নিজের নয়, বিভিন্ন জনের। হয়ত তাই কুশ্রীতা ঢাকবার জন্য রোদে পোড়বার এত উৎসাহ। বন্ড মনে মনে ভাবল গায়ের রঙ যদি সাদা ফ্যাকাসে হয় তবে ভয়াবহ দেখাবে। চুলের পাহাড়ের নিচে মুখও অদ্ভুত, চাঁদের মত গড়ন হলেও আকৃতি মোটেই চাঁদের মত নয়। সব মিলিয়ে এক বিচিত্র মিশ্রণ এই গোল্ডফিংগার।
আর কি বলা যায়? বেঁটেদের ওপর একটু অবিশ্বাস আছে চিরকালের। ছোট থেকেই এদের মনে হীনমন্যতা জন্মায়। ফলে জীবন তারা বড় হতে চায়, অনেক বড়। যার ছোটবেলায় তাদের বিদ্রূপ করেছে তাদের থেকেও। উদাহরণ নেপোলিয়ন, হিটলার। পৃথিবীর সব গণ্ডগোলের মূলে আছে বেঁটে লোকেরা। বেঁটে হয়ে কুৎসিত মুখশ্রী নিয়ে অষ্টবক্র চেহারা নিয়ে গোল্ডফিংগারকে কি পরিমাণ অবদমন সহ্য করতে হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। অথচ ভদ্রলোকের প্রাণক্তি প্রবল। কোন্ পথে এ প্রাণশক্তি খরচ করেন গোল্ডফিংগার? টাকা রোজগার? ইন্দ্রিয়াশক্তিতে ক্ষমতালিপ্সয়? হয়ত সবদিকেই।
ভদ্রলোকের ইতিহাস কি? ইহুদী নয়–কিছুটা হয়ত রক্ত আছে। লাতিন আমেরিকান বা তার দক্ষিণের লোক নন। স্লাভ দেশীয়ও নন। হয়ত জার্মান-না না, নির্ঘাত বাল্ট অর্থাৎ রাশিয়ার বাল্টিক প্রদেশের মানুষ। হয়ত রাশিয়া থেকে। পালিয়ে এসেছেন। হয়ত সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল গোল্ডফিংগারকে কিংবা তার বাপ-মা বিপদের গন্ধ পেয়ে তাকে রাশিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। তারপরে? কি করে পৃথিবীর বৃহত্তম ধনীদের একজন হলেন? ভদ্রলোকের পূর্ব ইতিহাস জানতে যথেষ্ট আগ্রহ হচ্ছে তবে, এখন তাসের জোচ্চুরি ধরতে পারলেই যথেষ্ট।
তৈরি? মিঃ ডুপন্ট গোল্ডফিংগারের প্রতি হাঁক দিলেন। গাড় নীল সুট আর গলা খোলা সাদা শার্ট পরিহিত গোল্ডফিংগার ছাদ বেয়ে এগিয়ে আসছেন। জামাকাপড় ভদ্ৰস্ত লাগলেও লাল রঙের ফুটবলের মত মাথাটা আর ঢাকা যায়নি। তার ওপর কানে একটা চামড়ার রঙের থিয়াবিং এইড।
মিঃ ডুপন্ট বসলেন হোটেলের দিকে পিছন করে। গোল্ডফিংগার তার সামনে। প্রথমবার তাস দেওয়ার পালা। গোল্ডফিংগারের উপর।
বন্ড ধীরে সুস্থে একটা চেয়ারে টেনে মিঃ ডুপন্টের পাশে এসে হেলান দিয়ে বসে কাগজের খেলার পাতাটা দেখবার ভান করল। আর চোখ রইল গোল্ডফিংগারের উপর।
বন্ড ধীরে সুস্থে একটা চেয়ারে টেনে মিঃ ডুপন্টের পাশে এসে হেলান দিয়ে বসে কাগজের খেলার পাতাটা দেখবার ভান করল। আর চোখ রইল গোল্ডফিংগারের তাসের ওপর।
বন্ড আগেই আন্দাজ করেছিল এবার নিশ্চিত হল-তাস দেওয়ার সময় কোন জোচ্চুরি হয় না। বেশ দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে তাস বাটছেন, বাঁ হাতে তাস ধরছেন সহজভাবে। কুখ্যাত জুয়াড়ী মেকানিস্ গ্রীপ অনুযায়ী বাঁ হাতের তিনটি আঙ্গুল তাসের লম্বা স্কিটার বিশেষ ভঙ্গিতে বেঁকে আঙ্গুল তাসের লম্বা দিকটায় বিশেষ ভঙ্গিতে বেঁকে থাকবে, তর্জনী তাসের মাথার একপাশে। অনায়াসে ফতে তাস বেটে দেওয়া যায়। কিন্তু সেভাবেও তাস ধরা হয়নি। হাতে আংটিও নেই তাসে দাগ দেওয়ার জন্য, স্টিকিং প্লাস্টারও নেই চিহ্নিত করার জন্য।
মিঃ ডুপন্ট বন্ডের দিকে ফিরে বললেন, পনের তাসের খেলা। প্রত্যেকে দুটো করে তাস টানবে আর একটা ফেলবে। বাকি সাধারণ রামির মতন।
তাস তুললে লক্ষ্য করল বন্ড মিলে যাওয়া তাস পরপর সাজালেন না, এমনকি বেমিল তাসগুলো একপাশে রাখলেন না–কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী সতর্ক হলে কিছুই তার নজর এড়াবে না। মিঃ ডুপন্টও দক্ষ ভঙ্গিতে তাস সাজালেন। ভাল তাসগুলিকে মাঝখানে রেখে।
খেলা শুরু হল। মিঃ ডুপন্ট প্রথম টানলেন, বাজে তাস উঠলেও মুখে তার চিহ্ন দেখা গেল না। সহজ ভাবেই খেলছেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বার দুয়েক ভাল তাস পেলে তার খেলা হয়ে যাবে।
গোল্ডফিংগার সতর্ক হয়ে এত আস্তে খেলছেন যে অন্যেরা বিরক্ত বোধ করছে। তাস নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলেন, তারপর একটা কোনরকমে খেললেন।
তৃতীয়বার তাস টানবার পর দেখা গেল মিঃ ডুপন্ট পাঁচটা তাসের যে কোন কোট পেলেই গোল্ডফিংগারের কাছে। অনেক পয়েন্টে জিতে যেতে পারেন। হঠাৎ গোল্ডফিংগার সব মিলে যাওয়া তাস ফেলে দিল, শুধু কটা রেখে। ফল– মিঃ ডুপন্ট নিতান্ত অল্প পয়েন্টে জিতলেন।
মাইরী, আরেকটু হলেই ফেঁসে গিয়েছিলেন আপনি, মিঃ ডুপন্টের গলা বিরক্তি অথচ ধারাল গলায় বললেন। হঠাৎ হাত হাল্কা করে দিলেন যে?
গোল্ডফিংগার উদাস ভঙ্গিতে বলে উঠলেন–বিপদের গন্ধ পেয়ে আর কি। এরপর পয়েন্ট লিখে তাস ভেঁজে হেলান দিয়ে বসে কৌতূহলের দৃষ্টিতে বন্ডের দিকে চাইলেন।
ক দিন থাকছেন এখানে মিঃ বন্ড?
বন্ড হাসল, নামটা হচ্ছে বন্ড, B-O-N-D আমায় আজই রাত্রে নিউইয়র্ক ফিরতে হবে।
-আহা, মুখে আপসোসের ভঙ্গি করলেন। এবার আবার খেলা শুরু হল। বন্ডের চোখ কাগজে থাকলেও কান। রইল তাসের টেবিলে। ক্রমে দেখা গেল পুরো গেমটা জিতে নিলেন গোল্ডফিংগার। পয়েন্টের ব্যবধান দেড় হাজার অর্থাৎ জেতার মূল্য দেড় হাজার ডলার।
-এই আবার শুরু হল মিঃ ডুপন্টের হতাশ গলা শোনা গেল।
বন্ড কাগজ সরিয়ে নিস্পৃহভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কি প্রায় জেতেন নাকি?
-প্রায়ই মানে? মিঃ দুপন্টের গলায় বিতৃষ্ণা ঝড়ে পড়ল। প্রত্যেকবার।
গোল্ডফিংগার তাস দিতে শুরু করলেন। বন্ড বলল, আপনারা চেয়ার বদলে তো দেখতে পারেন। মাঝে মাঝে দেখা যায় এতে খেলোয়াড়দের কপাল খুলে যায়।
গোল্ডফিংগার থেমে গেল। বন্ডকে বললেন, দুঃখিত মিঃ বন্ড, চেয়ার পাল্টালে আর আমার পক্ষে খেলা সম্ভব নয়। আমার অ্যাগারোফোবিয়া নামে এক ব্যাধি আছে। খোলা মাঠ বা ফাঁকা জায়গা সহ্য করতে পারি না, তাই হোটেলের দিকে মুখ করেই বসি।
-ওঃ, আমি দুঃখিত, বন্ডের গলায় সমবেদনার সুর, এ রোগের নাম তো শুনিনি ক্লস্ট্রোফোবিয়া শুনেছি। কি করে হল এ রোগ?
গোল্ডফিংগার তাস সাজাতে সাজাতে বললেন, কি জানি।
বন্ড উঠে পড়ল, ঠিক আছে, আমি একটু সুইমিং পুলটা ঘুরে আসি, অনেকক্ষণ বসে আছি।
-তাই যাও, একটু ঘুরে এস জেমস্। লাঞ্চের পর অনেক সময় পার কথা বলবার। আমি বরং গোল্ডফিগারকে হারাবার চেষ্টা করি যদি কিছু পয়সা আসে। আচ্ছা, আবার দেখা হবে -বলে ডুপন্ট খেলায় মনে দিলেন।
বন্ড ছাদ দিয়ে সবার পাশ কাটিয়ে ও প্রান্তে রেলিঙের দিকে চলে গেল। নিচেই সুইমিং পুল। চেয়ারে এলান। শরীরগুলো দেখে কিছু চিন্তা করল।
তারপর ঘুরে দাঁড়াল আবার ডুপন্টদের দিকে। গোল্ডফিংগারের কথাটা অন্যভাবে ধরলে বলা যায়, ডুপন্ট হোটেলের দিকে পিছন করে বলুন, কিন্তু কেন? আচ্ছা ঘরের নম্বর যদি ২০০ হয় তবে বন্ডের ঘরের ঠিক নিচে। অর্থাৎ ছাদের তাসের টেবিল থেকে বিশ গজ দূরে। বন্ড নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে নিচে নেমে গেল গোল্ডফিংগারের ঘর পর্যন্ত। কিছু নেই, সামনে ফাঁকা বারান্দা, পেছনের দরজা খোলা। কিন্তু পাশের ঘরটা অন্ধকার। বন্ড মনে মনে হিসেব করে গোল্ডফিংগারের বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না।
.
ঘুঘু ও ফাঁদ
লাঞ্চের পরে বিকেল থেকে আবার খেলা শুরু হবে তার আগে বন্ড কিছু কথাবার্তা সেরে নিল।
ইতিমধ্যে ডুপন্ট দশ হাজার ডলার হেরে গেছেন। বন্ড তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারল গোল্ডফিংগার এর এক মহিলা সাহায্যকারিনী আছে যে সব সময় ঘরেই থাকে। সম্ভবত নমসহচরী সঙ্গ দিতে এসেছে। মিঃ ডুপন্ট তিক্ত হাসি হাসলেন, কেন বলুন তো? কোন সূত্র-টুত্র পেয়েছেন নাকি?
প্রশ্নটা এড়িয়ে বন্ড বলল, বলতে পারছি না, তবে বিকেলে আর খেলা দেখতে আসব না। ওকে বলে দেবেন আমি শহরের দিকে ঘুরতে গেছি। তারপর কিছুক্ষণ পরে বলল, অদ্ভুত কিছু ঘটলে চমকাবেন না। চুপচাপ দেখে যাবেন। আমি নিশ্চিত নই তবে মনে হয় লোকটিকে বাগে পেয়েছি।
মিঃ ডুপন্ট উৎসাহ চাপতে পারলেন না। বহুৎ আচ্ছা, একবার বাগে পেলে হয়। ব্যাটাকে দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।
বন্ড নিজের ঘরে এসে একটা M3 লাইকা ক্যামেরাতে একটি MC এক্সপোজার মিটার, K2 ফিল্টার, ফ্ল্যাশ ভালব। হোল্ডার লাগিয়ে দুরত্ব মেপে ফিল্ম ভরল।
আবার বার করল একটা মোটা বই বাইবেলের সাহিত্যরূপ। যাতে রয়েছে ওয়াথে পি. পি. কে. আগ্নেয়াস্ত্র। পিস্তলটা পরখ করে নিল। এবার নিজের ঘরটা দেখে গোল্ডফিংগারের ঘরটা সন্ধান লাগাতে শুরু করল। নিচের ঘরে যাবার আগে নকল চাবি দিয়ে তালা খোলা প্র্যাকটিস করল কিছুক্ষণ। তারপর ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে বিকেলের অপেক্ষা করতে লাগল। ভাবনা মাথায় একটাই গোল্ডফিংগারের সঙ্গে কি কথা বলবে।
সোয়া তিনটের সময় উঠে ব্যালকনির নিচে তাকিয়ে ছাদে তাসের টেবিলে দুটি ক্ষুদ্র মূর্তি দেখতে পেল। সুতরাং খেলা শুরু। ঘরে এসে জামা পরে, ক্যামেরা নিয়ে নিজের ঘরটা একবার দেখে বেরিয়ে গেল। লিফটে নিচে নেমে একটু ঘোরাঘুরি করে আবার দোতলায় উঠে গেল। চলে এল ২০০ নম্বর ঘরের সামনে। কেউ কোথাও নেই, নকল চাবি দিয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল। ছোট একটা লবী তার ওপারে ঘরের দরজা, তালা লাগানো না থাকায় খুলে গেল সেটা।
যা দেখবে বলে আশা করেছিল তা চোখে পড়ার আগেই মৃদু আকর্ষণীয় মেয়েলী গলা কানে এল। ইংরেজদের মত টান করে বলছে চার আর পাঁচ টেনেছে। দুটো দুই-এর সাহায্যে পাঁচের পুরো ক্যানাস্তা তৈরি করলেন। হাতে সাহেব, গোলাম, নওলা আর সাতের সিংগলটন আছে।
বন্ড ঘরে ঢুকল।
ব্যালকনির দরজার সামনে একটা টেবিলে কুশন দিয়ে উঁচু করে বসবার জায়গা করে বসে রয়েছে মেয়েটি। পরনে সামান্য বস্ত্র। ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা নাচিয়ে বা হাতে নেল পালিশ লাগাচ্ছিল। এবার রেভাল নেল পালিশের শিশি রেখে দিল। মেয়েটির সামনে একটা শক্তিশালী দূরবীন। তার নিচে মাইক্রোফোন লাগান। সেই তার গেছে একেটা চৌকো বাক্সয় সেখান থেকে ইনডোর এরিয়াল পর্যন্ত। অর্থাৎ একটি ট্রান্সমিটারের সাহায্যে মেয়েটি ডুপন্টের হাতের তাস দূরবীন দিয়ে দেখে গোল্ডফিংগারকে বলে যাচ্ছে, আর হিয়ারিং এইড কাম রিসীভার দিয়ে তা শুনছে গোল্ডফিংগার।
মেয়েটি সামনে ঝুঁকে দূরবীনে চোখ রাখল–এবার টানছেন সাহেব আর বিবি। দুটোরই সিরিজ পুরো হয়ে গেল। সাত ফেলছেন বলে মাইক্রোফোন বন্ধ করে দিল।
মেয়েটি যখন এই কাজে ব্যস্ত তখন পুরো ছবিটা ধরার জন্য মেয়েটির পিছনের চেয়ারে দাঁড়িয়ে ভিউ ফাইন্ডারে উঠে এল দু জন। এমনকি ডুপন্টের তাসের লাল কালো ফোঁটা। শাটার টিপতেই ফ্ল্যাশ ভাল জ্বলে ওঠার তীব্র আলোয় ও শব্দে মেয়েটি সভয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
বন্ড চেয়ার থেকে নেমে পড়ল, বলল, গুড আপটার নুন।
—কে আপনি? কি চান? ভয়ে মেয়েটির চোখ বড় হয়ে গেছে, হাত মুখের উপরে উঠে এসেছে।
আমি যা চাই তা পেয়ে গেছি। ভয় পেও না আমার নাম হল বন্ড, জেমস্ বন্ড।
ক্যামেরাটা নামিয়ে রেখে মেয়েটির কাছে এল বন্ড। ভারি সুন্দর দেখতে। মাথায় একরাশ সোনালি চুল। নিচ চোখ, চওড়া ঠোঁট, হাসলে ভালই লাগে মনে হয়। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মত লম্বা। হাত পায়ের গঠনে বোঝা যায় সাঁতার কাটে। শরীরে যৌবনের ঢেউ।
মেয়েটি নিচু গলায় বলল, এবার তুমি কি করবে?
–তোমার ভয়ের কিছু নেই। লক্ষ্মী মেয়ের মত একটু সর, আমি ব্যাপারটা একটু দেখি।
মেয়েটির জায়গায় বসে আছে বন্ড। খেলা চলছে। ট্রান্সমিটারে কথা শোনা যাচ্ছে না বলে একটুও বিব্রত নয় গোল্ডফিংগার।
বন্ড জিজ্ঞাসা করল, কথা বন্ধ হয়ে গেলে খেলা কি থামিয়ে দেন নাকি?
মেয়েটি উত্তরে জানাল আগেও এরকম হয়েছিল। তিনি বসে ছিলেন। ট্রান্সমিটারটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না সারান হল এইভাবেই বসে থাকেন।
বন্ড তার দিকে তাকিয়ে হাসল, বেশ তাহলে খানিকটা হয়রান হোক। তুমি একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বস। মেয়েটিকে সিগারেট অফার করল বন্ড। মেয়েটি নিল। যা এবার তুমি ডান হাতে নেল পালিশ লাগিয়ে নাও।
মেয়েটি একটা হেসে বলল, কতক্ষণ এখানে চুপিচুপি এসে বসে আছ, ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম।
–বেশিক্ষণ না। তবে চমকে দেবার জন্য দুঃখিত।
তোমার থেকেও তো বেশি মিঃ ডুপন্ট এক সপ্তাহ ধরে চমকাচ্ছিলেন।
–হ্যাঁ মেয়েটা দ্বিধার সঙ্গে বলে উঠল, কাজটা হয়ত খারাপ কিন্তু ডুপন্টের প্রচুর টাকা তাই না?
–সে তো নিশ্চয়। মিঃ ডুপন্টের হয়ত কিছু ক্ষতি হয়নি কিন্তু ভবিষ্যতে এমন কারোর ওপর কোপ বসালে যার হেরে যাওয়াটা নিতান্ত কষ্টকর হবে। তাছাড়া গোল্ডফিংগার তো কোটিপতি, তাহলে জাল জোচ্চুরি কেন?
মেয়েটি এতক্ষণে উচ্ছল হয়ে উঠল, আমিও বুঝতে পারি না কেন এরকম করেন। এই অভ্যাস উনি ছাড়তে পারবেন না, রোগে দাঁড়িয়ে গেছে মনে হয়। আমি একবার জিজ্ঞাসা করায় উনি বললেন, মওকা পেয়ে সেটা কাজে না লাগান বোকামি। সব সময় ঐ সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন, আমাকেও এই কাজে রাজি করিয়েছেন। আমি জানতে চাইলাম–এই বিশ্রী-ঝুঁকি নেবার দরকার কি? উনি শুধু বললেন তাস খেলায় সবসময় জেতা যায় না, তাই জেতার সুযোগ করে নিতে হয়।
বন্ড বলল, ভদ্রলোকের কপাল ভাল কাছে পিঠে ডিটেকটিভ এজেন্সী বা মায়ামী পুলিশ দপ্তরে লোক নেই। মেয়েটি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল সে বিষয়ে চিন্তার কিছু নেই। টাকা দিয়ে যে কোন লোকের মুখ বন্ধ করে দেন। টাকার লোভ তো কেউ সামলাতে পারে না।
-তার মানে।
উদাসীনভাবে মেয়েটি বলে উঠল, সঙ্গে সবসময় উনি দশ লাখ ডলারের সোনা রেখে দেন। কাস্টসের ঝামেলা থাকলে বেল্ট বা সুটকেসের গায়ে পাতলাগান থাকে। অর্থাৎ চামড়ার বদলে সোনায় মোড়া সুটকেস।
-মোটর গাড়িতে যাতায়াত করেন সবসময়, আর ড্রাইভারের গায়েও বেশ জোর। সেই বাক্সগুলো বয়। অন্য কেউ হাত দেয় না।
অত সোনা নিয়ে ঘোরেন কেন?
–যদি দৈবাৎ প্রয়োজন হয়। সোনা দিয়ে তো সব জিনিস কেনা যায়। তাছাড়া অন্য লোকেদের যেমন টাকা পয়সা, গয়নাগাটি, ডাকটিকিট এমন কি মেয়ে মানুষের ওপর লোভ, ওঁর তেমনি সোনার।
বন্ড হাসল, উনি তোমায় ভালবাসেন?
মেয়েটি লজ্জায় লাল হলেও রেগে গেল, বলে উঠল কখনো না। তারপর শান্ত হয়ে বলল, সত্যিই তেমন কিছু নেই। উনি চান যে লোকেরা ভাবুক আমাদের মধ্যে ওরকম একটা সম্পর্ক আছে। একটু অহঙ্কা আছে বোধহয়, তবে আমার ওপর তেমন ঝোঁক নেই।
-হুম বুঝেছি। তুমি তাহলে নেহাৎই সেক্রেটারি?
-সঙ্গিনী মেয়েটি শুধরে দিল। কাগজে কলমে কোন কাজ আমায় করতে হয় না। হঠাৎ মুখ হাত চাপা দিয়ে বলে উঠল–তোমাকে বলছি, তুমি সব বলে দেবে না তো? তাড়িয়ে দেবেন তাহলে আমাকে। মেয়েটি ভীত গলায় বলে উঠল– ওর অসাধ্য কিছুই নেই।
–না, না, কিছু বলব না। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। কেন নিলে এ চাকরি?
তিক্ত গলায় মেয়েটি বলে উঠল, সপ্তাহে একশ পাউন্ড আর সব প্রাচুর্যের উপকরণ। এ সব তো গাছে ফলে না। আমি টাকা জমাচ্ছি, কিছু জমে গেলেই চাকরি ছেড়ে দেব। বন্ড ভাবল, কিন্তু গোল্ডফিংগার কি যেতে দেবেন? মেয়েটা অনেক গোপন কথা জানে, গোল্ডফিংগার নিজের স্বার্থের জন্য সুন্দর মেয়েটাকে বিপদে ফেলতে একটুও দ্বিধা করবে না।
মেয়েটি হঠাৎ অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলে উঠল আমি একটু ভদ্রস্থ হয়ে আসি।
বন্ড বুঝতে পারছিল না, মেয়েটিকে বিশ্বাস করবে কিনা। কারণ টাকাটা সে গোল্ডফিংগারের কাছ থেকে পায়। তাই কাছ ছাড়া না করার জন্য বলল, বেশ দেখাচ্ছে তোমায়। সুইমিং পুলের চারপাশে যারা আছে তারা এমন কিছু ভদ্রস্থ নয়। আচ্ছা এবার গোল্ডফিগারের অবস্থা ঢিলে করে দিই কেমন।
বন্ড মাঝে মাঝে দূরবীন দিয়ে তাস খেলা লক্ষ্য করছিল। এবার দেখল ডুপন্টের চেহারায় খুশি, উল্লাস উপছে পড়েছে। টেবিলের ওপর দিন তাস ফেলে দিলেন–খেলা হয়ে গেছে। এবার গোল্ডফিংগারকে লক্ষ্য করলেন সে শান্তভাবে অপেক্ষা করছে ট্রান্সমিটারের নির্দেশ পাবার জন্য, আবার জেতার জন্য।
বন্ড চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, চমৎকার যন্ত্রটা তো। কোন ওয়েভলেংথে ট্রান্সমিট করছে?
-কি যেন একটা বলেছিলেন আমায়, একশ সত্তর কি যেন। মেগা দিয়ে কোন শব্দ আছে?
– মেগাসাইকস্। হতে পারে। কিন্তু ওটা তো পুলিশ ব্যবহার করে, তার মধ্যে থেকে তোমার গলা চিনে নেওয়া রীতিমত মনঃ সংযোগের ব্যাপার।
বন্ড হাসল, এবার তাহলে কাজটা সেরে ফেলি।
সহসা মেয়েটি হাত বাড়িয়ে তাকে অনুনয় করল, এটা না করলেই কি নয়? ওঁকে ছেড়ে দাও না। জানি না আমার ভাগ্য কি আছে। মেয়েটি মুখ লাল করে বলে উঠল, তোমায় খুব ভাল লেগেছে, অনেকদিন এরকম মানুষ দেখিনি তো, আর একটু থাক না। মাটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ওকে ছেড়ে দিলে যা বলবে তাই করব।
বন্ড হাসল। হাতের ওপর থেকে মেয়েটির হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি দুঃখিত। এ কাজের জন্য আমায় টাকা দেওয়া হয়েছে। অতএব কাজ না শেষ করে উপায় নেই। তাছাড়া গোল্ডফিংগারকে শায়েস্তা করার ইচ্ছে আমার খুব, একচোট উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত, বুঝতে পেরেছ?
উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে বন্ড দূরবীন দিয়ে দেখল গোল্ডফিংগারের মুখ। বন্ড গলা পরিষ্কার করে– মাইক্রোফোনের সুইচ অন করল।
ট্রান্সমিটার চালু হয়েছে বুঝতে পেরে গোল্ডফিংগার আকাশের দিকে তাকাল যেন আশীর্বাদ চেয়ে নিচ্ছে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে।
বন্ড কঠিন গলায় আস্তে বলল, শোনো-জেমস্ বন্ড কথা বলছি। মনে পড়ছে। খেলা শেষ তোমার। পুরো ব্যাপারটা এখন আমার হাতে। তুমি যদি আমার কথামত চল তাহলে এই কারসাজির খবর পুলিশ ও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে দেব না। আমার কথা বুঝে থাকলে একবার মাথা নাড়।
গোল্ডফিংগার কথামত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। হাতের তাসগুলো সোজা করে টেবিলের ওপর বিছিয়ে দাও। সঙ্গে সঙ্গে তাসগুলো ছড়িয়ে পড়ল টেবিলের ওপর।
চেকবই থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলারের চেক কেটে ডুডন্টকে দাও। পঁয়ত্রিশ ডুপন্টের, আমার দশ, বাকি পাঁচ মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়ার জন্য।
বন্ড দেখল তার আদেশ মত কাজ হচ্ছে। আবার কিছু কাজ বলল, এবার যা বলছি বইয়ের পেছনে লিখে নাও। আমার জন্য সিলভার মেটিওর ট্রেনে একটা কামরা বুক করে তাতে স্যান্ডউইচ ও পানীয়ের ব্যবস্থা রাখবে। আর হ্যাঁ কোনরকম ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করবে না, তাহলে কীর্তিকলাপের পুরো রিপোর্ট চলে যাবে পুলিশের হাতে। গোল্ডফিংগারকে ঘামতে দেখা গেল।
-ঠিক আছে। এবার চেকটা ডুপন্টকে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নাও। বন্ড দেখল গোল্ডফিংগার শান্ত হয়ে ডুপন্টকে কিছু বলল।
–একটু দাঁড়াও, কাজ শেষ হয়নি। এবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার নাম জিজ্ঞাসা করল।
জিল মাস্টারটন।
গোল্ডফিংগার পা বাড়াতে আবার তীক্ষ্ণ স্বর ভেসে এল দাঁড়াও সে থমকে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ব্যালকনির দিকে তাকাল। যেন নিঃশব্দে বলে উঠল আজকের ঘটনা আমি ভুলব না মিঃ বন্ড।
বন্ড নরম সুরে বলে উঠল, একটা কথা। আমি জামিন হিসাবে মিস্ মাস্টারটনকে নিউইয়র্ক নিয়ে যাচ্ছি। তার পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবে। আর হ্যাঁ ট্রেনের কামরাটা যেন বেশ বড় হয়।
.
রাতের বেলার কাজ
এক সপ্তাহ পরে বন্ডকে দেখা গেল লন্ডনে ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের সদর দপ্তরের জানালায়। পূর্ণিমার রাতে লন্ডন শহর ঘুমিয়ে কাদা। বিগ বেন ঘড়িতে রাত তিনটের ঘণ্টা। এই সময় অন্ধকার ঘরে ফোন বেজে উঠল। বন্ড রিসিভারটা তুলে বলল, ডিউটি অফিসার কথা বলছি।
-স্টেশন H থেকে ফোন এসেছে স্যার।
–লাইন দিন।
সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন H, অর্থাৎ হংকং এর ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ করতে একটা সরু গলা পাওয়া গেল, ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট?।
-বলছি।
এবার লন্ডন অফিসের অপারেটরের গম্ভীর গলা, হংকং এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দয়া করে জোরে কথা বলুন।
বন্ড অধীর হয়ে বলে উঠল, আপনি লাইন খালি করে দিন।
আবার সরু গলার একই কথার পুনরাবৃত্তি জোরে কথা বলুন।
এবার আরেকজনের গলা, হ্যালো! ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট
–হ্যাঁ।
– জিকসন কথা বলছি। শুনতে পাচ্ছেন।
— পাচ্ছি।
–জাহাজে আম পাঠানোর বিষয়ে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি জানেন?
-জানি, এখানেই আছে। বন্ড আসল ব্যাপারটা জানে। এটা সাংঙ্কেতিক কথাবার্তা। আসলে কিছুদিন আগে তিনটি চৈনিক স্পাই জাহাজ ব্রিটিশ পণ্যবাহী জাহাজ থামিয়ে খুঁজে দেখছিল কোন ব্যক্তিকে–জাহাজে পাচার করা হচ্ছে কিনা, যারা চীন থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এই স্পাই জাহাজগুলিকে অবিলম্বে ধ্বংস করা দরকার।
দশ তারিখের মধ্যে পাওনা মেটাতে হবে। অর্থাৎ ঐ দশ দিনের মধ্যে ধ্বংস না করতে পারলে হয় জাহাজগুলো সরে যাবে নয়ত সুরক্ষা ব্যবস্থা দ্বিগুণ করে নেবে।
বন্ডের সংক্ষিপ্ত জবাব, ঠিক আছে।
-ধন্যবাদ। গুডবাই।
-বাই বলে কালো রঙের ফোনটি নামিয়ে রেখে সবুজ রঙের রিসিভার তুলে Q বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করল। লিস্পেট মাইন অর্থাৎ যেটি দিয়ে জাহাজ ধ্বংস করা হবে সেটি যাতে সকালবেলা BOAC-র প্লেনে যায় তার দায়িত্ব দেওয়া হল ঐ বিভাগকে।
সিগারেট ধরিয়ে গা এলিয়ে দিল বন্ড। মন চলে গেল হংকং-এর গুপ্তচর বিভাগের স্পাই ২৭৯ ডিকসন এর কাছে। এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই জেনে গেছে মাইন পৌঁছে যাবে।
বন্ড মনে মনে হাসল। স্টেশন H ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরেছে। ওদের সমস্যা ওরাই মেটাক বন্ড এই ঝামেলায়। নাক গলাবেন না। কিন্তু নিরুপায়। বড়কর্তা M শত্রুপক্ষকে তাদের অস্তিত্বের কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে চান।
তিন তিনেক আগে বন্ডকে নাইট ডিউটি দেওয়া হয়েছে শুনে M-এর সঙ্গে তর্ক বাধিয়ে দিয়ে ছিল। কি? না, দীর্ঘ ছ বছর ডাবু জিরো বিভাগের কাজ করে অফিসের কাজ সব ভুলে গেছে অতএব নাইট ডিউটির মত গুরু দায়িত্ব তার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।
–M পরিষ্কার জানিয়ে দেয় শিখে নিতে সময় লাগবে না, তবে কোন অসুবিধা হলে অন্য ডিউটি অফিসাররা সাহায্য করবে। প্রয়োজন হলে তিনি নিজে। (মনে মনে পরিস্থিতি চিন্তা করে হাসল বন্ড। কোন ব্যক্তি বিপদে পড়েছে তার জন্য রাত দুপুরে তাকে টেনে তুলে M সে খবর জানাচ্ছে)। তাছাড়া আমি ঠিক করেছি উচ্চপদস্থ অফিসারদের কিছুদিন অফিসের কাজ করতে হবে। শীতল দৃষ্টিতে বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, অর্থদপ্তরের ধারণা ডাবল জিরো বিভাগ এখন অচল, তাই ওটা তুলে দেওয়া উচিত। ওদের সঙ্গে তর্ক করে জানিয়ে দিলাম ধারণাটা ভুল। যাগগে; ছাড় ওসব কথা, এখন যখন লন্ডনেই আছ তখন বাড়তি কিছু কাজ করলে মন্দ হবে না। আর হাত পা গুলোও সচল থাকবে।
নাইট ডিউটি চলছে সপ্তাহখানেক হল। অল্প বুদ্ধি খাঁটিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় সব কাজই উদ্ধার হয়ে গেছে। ভালই লাগছিল, চুপচাপ বসে থাকা, কিছু তথ্য আর ক্যান্টিনের সুন্দরী মেয়ের আনা খাবার।
প্রথমদিন মেয়েটা চা আনাতে রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের কারণ কাপভর্তি কাদা বলে চা কে উল্লেখ করেছিল, এবং তার পরিবর্তে কফি চেয়েছিল। মেয়েটি হেসে কফি এনে দিলেও চা-এর বিশেষণগুলো সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল।
এই কর্মহীন নাইট ডিউটি ভাল লাগার আর একটি কারণ বই লেখা। বইটির নাম বাঁচতে শেখ। অস্ত্রহীন অবস্থায় লড়াইয়ের কৌশল থাকবে এতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গুপ্তচরদের শেখান প্যাঁচ থেকে বিশেষ প্যাঁচ বেছে নেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার কথা কেউ জানে না, তবে M যদি এটাকে গুপ্তচর বিভাগের পাঠ্য পুস্তকের তালিকাভুক্ত করে তবে মন্দ হবে না।
তথ্য বিভাগ থেকে সংগ্রহ করে মৌলিক বিষয়গুলি লেখা হয়েছে। বইগুলির কিছু M উপহার পেয়েছেন কিছু বিদেশী গুপ্তচর বা চরচক্রের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। এখন তার কাছে যে অনুবাদ করা বইটি আছে তার নাম ডিফেন্স। এটি সোভিয়েট রাশিয়ার চর-নিধন ও প্রতিহিংসার জন্য SMERSH নামক যে সংঘ তার লেখা।
দ্বিতীয় অধ্যায় টেনে আনা ও বাধাদানের কৌশল পড়া শেষ করে উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়াল। রাশিয়ানদের বিশ্রী ধাচের লেখা পড়ে বিতৃষ্ণা মন ভরে গেল। যেমন হয়েছিল মেক্সিকান লোকটিকে হত্যা করবার সময়। কি হল বন্ডের? মানসিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে নাকি? কিছুক্ষণ মেঘের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এল।
যে জায়গাটা পড়তে গিয়ে উঠে পড়েছিল, সে সেখানে আবার চোখ রাখল–মত্তস্ত্রীলোককে বাগে আনবার আরেকটি সাধারণ নিয়ম বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট ও তর্জনীর সাহায্যে নিচের ঠোঁট চেপে ধরা। ঠোঁট চেপে ধরে টান মারলে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি চলে আসবে।
কি অসহ্য অভিব্যক্তি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট ও তর্জনী মনে ভাবে বন্ড একটা সিগারেট ধরায়। সকাল নটায় চীফ অফ স্টাফ বা M-কে রিপোর্ট দিয়ে তবেই ছুটি এবং সেটা অনেক দেরি। কিন্তু একটা কথা সমানে মাথায় খচখচ করছে, কি যেন? কি দেখে মনে পড়ে গেল?
হুম, তর্জনী মনে পড়েছে। ফোর ফিংগার, ফোর…ফিঙ্গার এর সঙ্গে মিল গোল্ডফিংগার ভদ্র লোকটি সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানা দরকার। পরমুহূর্তেই সবুজ টেলিফোনে তথ্যবিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ।
বক্তব্য শুনে অফিসারটি বলল, নামটা তো অচেনা, তাই ফাইল দেখে কিছু পেলে জানাব স্যার। বন্ড ফোন রেখে দিল।
মায়ামি থেকে নিউইয়র্ক আসার-সময়টা চিন্তা করে বন্ড। তার সঙ্গিনী ছিল জিল মাস্টারটন। মেয়েটি কামাতুর প্রকৃতির। তাই বন্ড তার সঙ্গে মিলিত হলেও কোন আপত্তি করেনি বরং একাধিকবার তার সঙ্গ চাইছিল।
এখনও যেন বন্ড-এর কানে আসছে লেভেল ক্রসিংয়ের ঘণ্টি, ট্রেনের সিটি, স্টেশনের লোকজনের চিৎকার… অন্যদিকে কামরায় তাদের দৈহিক প্রেমালাপ।
জিল জানিয়েছিল বন্ডের কাছে পরাজয় নিয়ে একটু বিচলিত নয় গোল্ডফিংগার, বরঞ্চ ইংল্যান্ডে কিছুদিনের মধ্যেই তো আসছেন তখন স্যান্ডউইচ শহরে বন্ডের সাথে গলফ খেলবেন, এবং জিল যেন পরের ট্রেনেই ফিরে আসে। এটুকুই তার বক্তব্য। বন্ড বারণ করলেও মেয়েটির ইচ্ছা ছিল যাবার, কারণ চাকরিটা ছিল লোভনীয়।
মিঃ ডুপন্টের দেওয়া দশ হাজার টাকা মেয়েটিকে দিয়ে দিল বন্ড। আমি কি কাজে লাগাব ভেবে পাচ্ছি না। তুমি রাখ, দরকার পড়লে পালাতে পারবে। এবং গত রাত্রি ও আজ সঙ্গ দেবার জন্য ধন্যবাদ। বন্ড বলল।
বন্ড জিলকে বিদায়ী চুম্বন দিয়ে, স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে একলা ফিরে এসেছিল। ট্যাক্সীতে আসতে আসতে একটা কথা মনে পড়ল তার, কিছু প্রেম আগুনের মত, কিছু মরচে পড়া। কিন্তু লালসা বোধহয় সবচেয়ে পরিষ্কার আর চমৎকার। বন্ড মনে মনে ভাবল তারা কি পাপ করেছে? দৈহিক পবিত্রতা নষ্ট করে অনুতপ্ত হচ্ছে সেন্ট অগাস্টিন একটি মজার কথা বলেছিলেন-হে সৃষ্টিকর্তা, আমায় দৈহিক পবিত্রতা দাও তবে এখুনি না।
আবার সবুজ টেলিফোন জানাল তিনজন গোল্ডফিংগার আছে, তার মধ্যে দুজন মৃত একজন জীবিত। সে জেনেভায় রাশিয়ার হয়ে খবর আদান প্রদান করে। চুল কাটার দোকান আছে তার। সেখানেই চুল কেটে ব্রাশ দিয়ে গা ঝেড়ে দেওয়ার সময় কোটের পকেটে গুপ্ত সংবাদ পাচার করে দেয়। একেই কি খুঁজছিলেন? একটা পা নেই এছাড়া আরো অনেক খবর আছে।
-না, এ অন্য লোক। ধন্যবাদ।
লোকটার কোন ছবি থাকলে পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরে খোঁজ নিতে পারেন স্যার।
বন্ডের মনে পড়ে গেল লাইকা ক্যামেরায় তোলা ছবি এখনও ডেভলপ করা হয়নি। আইডেন্টিকাস্ট এর সাহায্যে ছবি পাওয়া যেতে পারে। জিজ্ঞাসা করল, আইডেন্টিকাস্টের ঘর খালি আছে?
–আছে, আপনি বললে যন্ত্রটা চালাতে পারি স্যার।
-ধন্যবাদ। আমি যাচ্ছি এখনি।
বন্ড অপারেটরকে কোথায় যাচ্ছে বলে চলে এল তথ্য বিভাগে।
ডিউটি অফিসারটি আইডেন্টিকাস্ট তৈরি করতে করতে বলল, লোকটির একটু বর্ণনা দিতে পারলে কাজের সুবিধা হয়।
বন্ড একটা বর্ণনা দিয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
এই যন্ত্রের সাহায্যে ফেরারী সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মোটামুটি ছবি পাওয়া যায়। এমন কি এক পলকের দেখা একটি লোকের ছবিও। সামনের স্ক্রীনে ছবি দেখে সাক্ষী উক্ত ব্যক্তিকে চিনতে পারলে সেই পর্দার ওপর রেখে, সেই মুখের ওপর যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের চুল, ও অন্যান্য অঙ্গ যোগ করে দেখান হয়। যেটি ঠিক হয় সেটির ফটো তুলে নেওয়া হয়।
গোল্ডফিংগারের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে এমন একটা ছবি পাওয়া গেল। বন্ড আরো দু একটা কথা যোগ করে চুল, চোখ সম্পর্কে, শেষ পর্যন্ত কাজ উতরে গেল।
তথ্য বিভাগের লোকটি বলে ওঠে অন্ধকারে এ চেহারা দেখলে ধড়ে প্রাণ থাকবে না। আমি গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানিয়ে দেব।
নিজের ঘরে ফিরে এসে কাজকর্ম সারতে আটটা বাজল। ফোনে জলখাবার অর্ডার দিয়ে বসতে যাচ্ছে, M-এর ঘর থেকে ফোন এল। ভদ্রলোক সময়ের আগেই চলে এসেছেন।
–ইয়েস স্যার।
অফিসে চলে এস, 007, ডিউটি শেষ হবার আগে কিছু কথা বলতে চাই।
–আচ্ছা স্যার।
কোট গায়ে দিয়ে চুল ঠিক করে ন তলায় M-এর ঘরের দিকে পা বাড়াল। তখনও সেক্রেটারি মিস মানিপেনী, চীফ অফ স্টাফ কেউই আসেনি। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল বন্ড।
-বস, পাইপ ধরিয়ে প্রশ্ন করলেন, রাতটা কেমন কাটল? ঠাণ্ডা?
প্রায় ঠাণ্ডাই, তবে স্টেশন H থেকে–M হাত তুলে বাধা দিলেন, ছেড়ে দাও। ব্যাপারটা পরে পড়ব, ফাইলটা দাও।
বন্ড অত্যন্ত গোপনীয় ফাইলটা তাকে দিলে তিনি সেটি সরিয়ে রেখে বললেন, সময় বদলাচ্ছে, তোমায় আর নাইট ডিউটিতে রাখছি না আ07। মুখে যেন মনে হল ব্যঙ্গের হাসি।
দায়সারা গোছের একটা হাসি ভাব দেখা দিল বন্ডের মুখে তবে এই ঘরটাতে এলে নাড়ির স্পন্দন যেন বেড়ে যায়। বুঝতে অসুবিধা হল না M নতুন কাজের ভার দিতে যাচ্ছে। তবে মুখে বলল, কাজটা শিখে নিতে খুব দেরি হয়নি স্যার।
-তা অবশ্য পরে শেখার সময় অনেক পাবে। আপাতত এখন একটা অদ্ভুত কাজ এসেছে। তোমার লাইনের না হলেও অন্যদিক থেকে দেখলে… M তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বললেন, সে দিক দেখার প্রয়োজন নেই।
বন্ড কোন কথা না বলে অপেক্ষা করতে লাগল।
-ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের গভর্নরের সাথে গতরাত্রে ডিনারে একটা নতুন বিষয় জানতে পারলাম। সোনার স্মাগলিং জালিয়াতি এসব নানা গণ্ডগোলের কথা বলছিলেন। মুদ্রার মান রক্ষার কাজ বলেই তিনি হয়ত এত কিছু জানেন। M প্রশ্ন করলেন, এ ব্যাপারে কিছু জান?
-না স্যার।
-ঠিক আছে। বিকেলে চারটের সময় ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডে কর্নেল স্মিার্স-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই অনেক কিছু জানতে পারবে। এর ফাঁকে তুমি একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও।
-আচ্ছা স্যার।
মিঃ স্মিদার্স ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের বড়কর্তা। গভর্নর যা জানাল তা হল সিঁদার্সদের কাজ হল ইংল্যান্ডের সমস্ত ব্যাংকের কাজকর্মের ওপর নজর রাখা, যাতে সরকারের সঞ্চিত সোনা ও মুদ্রামান নিয়ে দু নম্বরী করতে না পারে। কিছুদিন আগে নকল স্বর্ণমুদ্রা তৈরির অভিযোগে কয়েকজন ইটালিয়ানকে অনেক কষ্টে ধরা গেছে। আবার বেইরুটের কেলেঙ্কারী, এসব কাগজে পড়েছে নিশ্চয়ই। এই সব ষড়যন্ত্রের হদিশ তাদের খুঁজে বের করতে হয়।
গভর্নরের এত কথা বলার একটাই কারণ স্মিার্স সন্দেহ করছে যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে প্রচুর সোনা ইংল্যান্ড থেকে চোরাচালানি হচ্ছে। তবে তেমন কোন সূত্র পাওয়া না গেলেও এর গুরুত্ব গভর্নরকে বোঝন গেছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। M কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বন্ডকে প্রশ্ন করলেন, কোনদিন ভেবেছ, ইংল্যান্ডের সব থেকে ধনী ব্যক্তি কে?
-না, স্যার।
–একবার চেষ্টা কর না! সবচেয়ে বিত্তশালী কারা।
বন্ড চিন্তা করতে লাগল, অনেকে তো আছে, যাদের দেখে মনে হয় ধনী, বা কাগজের লোকেরা যাদেরকে ধনী বলে। কিন্তু এদের মধ্যে কে? ইতস্তত করে জবাব দিল, স্যার স্যামুন আছে, জাহাজ ব্যবসায়ী এলারম্যান আছে, লর্ড কাউড্রেও বেশ ধনী। ব্যাংকারদের মধ্যে রথ চাইল্ড, বেরারিং, হ্যাঁস্ ব্রো, হীরের ব্যবসায়ী উইলিয়ামসনও আছেন। বন্ড মৃদু গলায় ওপেন হাইমার ও ডিউকদের নাম করে চুপ করে গেল।
-বাঃ ভালই। কিন্তু আসল লোকের নামই তো করলে না। গভর্নর না বললে মাথায় আসত না নামটা-অরিক গোল্ডফিংগার।
বন্ড শুনেই জোরে হেসে উঠল।
M বিরক্তি প্রকাশ করল–হ্যাঁসার কি হল?
-মাফ করবেন। আমি গতরাত্রেই আইডেন্টিকাস্টের সাহায্যে তার ছবি তৈরি করছিলাম। তাছাড়া গোয়েন্দা বিভাগকেও খোঁজ নিতে বলে দিয়েছি।
M চটে গেলেন–ব্যাপার কি? ছেলেমানুষী কর না।
বন্ড এবার সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।
M ঝুঁকে পড়ে মন দিয়ে শুনছিলেন। শেষ হলে হাত দুটো মাথার পেছনে রেখে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে রইলেন। বন্ড হাসতে গিয়েও হাসতে পারছিল না। হঠাৎ M প্রশ্ন করল–সেই দশ হাজার ডলার কি হল?
-মেয়েটিকে দিয়েছি।
–তাই নাকি। হোয়াইট ক্রসকে দিলে পারতে।
হোয়াইট ক্রস এর তহবিল থেকে মৃত গুপ্তচরদের পরিবার বর্গকে সাহায্য করা হয়।
–দুঃখিত স্যার। এ ব্যাপারে কোন কথা বলার ইচ্ছা নেই। বউ বলল।
—হুম্, M বন্ডের নারী আসক্তি কোন দিনই সমর্থন করেননি, তার মনে হয় এটা পাপেরই নামান্তর। তাই অন্য প্রসঙ্গে চলে এলেন। বিকেলে সব কিছু জানতে পারবে। গোল্ডফিংগারকে অবশ্য দেখেছি ব্লেডস ক্লাবে ব্রিজ খেলতে। তা ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের মত তোমারও একই কাজ গোল্ডফিংগারের ওপর নজর রাখা। বলে বন্ডের দিকে তাকালেন।
.
স্বর্ণমঙ্গল কথা
ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের অপূর্ব সুন্দর প্রবেশ দ্বার দিয়ে সোনালি মোজাইক করা বিরাট একটি ঘরে এসে ঢুকল বন্ড।
ফ্রক কোট পরা সুঠাম চেহারার এক দারোয়ান এগিয়ে এসে বলল, বলুন স্যার।
—কর্নেল স্মিার্স আছেন?
-আপনি কমান্ডার বন্ড এইদিকে আসবেন দয়া করে। কর্নেল স্পিদার্সের ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, বসুন, সিগারেট বন্ড রূপার কেস থেকে একটা সিনিয়র সার্ভিস সিগারেট তুলে ধরাল।
স্মিদার্সের নামের সঙ্গে চেহারার বেশ মিল। মসৃণ পালিশ করা গম্ভীর চালচলন।
একঘেয়েমি কাটাতে ভদ্রলোককে বন্ড বলল, আপনি সোনার ব্যাপারে জানাবেন আমায়?
-জানি, নির্দেশমত আপনাকে সব জানাতে হবে কিছু গোপন না করে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যা বলব সবটাই অত্যন্ত গোপনীয়।
বন্ড কোন জবাব না দিয়ে কঠিন হয়ে বসে রইল। বন্ডের মুখ দেখে কলে বুঝতে পারলেন এভাবে বলাটা উচিত হয়নি। তাই শুধরে নিয়ে বললেন, আপনি অভিজ্ঞ মানুষ এ কথা বলার প্রয়োজন ছিল না।
বন্ড বলল, না, আপনি ভালই করেছেন। অন্যের গোপন কথা কেউ নিজের গোপন কথার মত অত গুরুত্ব দেয় না। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি বড় কর্তা ছাড়া কাউকে বলব না।
-নিশ্চয়ই। আমার কথায় কিছু মনে করেননি তার জন্য ধন্যবাদ। আসলে ব্যাংকের কাজে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয় তো বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে এলেন। সোনার ব্যাপারে আসি। এ বিষয়ে হয়ত তেমন মাথা ঘামাননি? বলল কর্নেল।
-দেখলে চিনতে পারি এই টুকুই যা।
–ঠিক আছে। এখন আসল কথা হল পৃথিবীতে সব থেকে মূল্যবান ও বিক্রয় উপযোগী পদার্থ সোনা। এক টুকরো সোনার বদলে যে কোন জিনিস পেয়ে যাবেন।
স্মিদার্সের দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কথা বলতে বলতে। বন্ড চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
-কর্নেল স্মিার্স শাসানির ভঙ্গিতে পাইপটা তুলে ধরে বললেন, আরেকটা কথা। সোনাকে সনাক্ত করা যায় না, কারণ স্বর্ণ মুদ্রার ওপর নম্বর থাকে না, তাছাড়া সোনার বাটের টাকশালের ছাপ ফেঁচে তুলে দেওয়া যায় তাই-এর উৎস বা কোথায় কোথায় চোরা চালান হচ্ছে তা ধরা যায় না। যদি ইংল্যান্ডে কত সোনা আছে জানতে চাওয়া হয় তাহলে ভল্টের, টাকশালের, স্যাকরার দোকানের সমস্ত একসঙ্গে যোগ করে একটা মোটামুটি পরিমাণ বলতে পারি।
-দেশের কত সোনা আছে তার হদিশ পাবার জন্য এত ব্যস্ত কেন?
-বিদেশের বাজারে আমাদের আর্থিক সঙ্গতির মাপকাঠি এটাই। আমাদের দেশীয় মুদ্রার ভিত নির্ভর করে কতটা। সোনা আছে তার ওপরে। সোনা কমে গেলে টাকার দামও কমে যায়। তীক্ষ্ণ চোখে এবার বলে ওঠে কর্নেল–অতএব ইংল্যান্ড থেকে সোনা পাচার হচ্ছে কিনা তাই দেখা আমাদের প্রধান কর্তব্য। যদি এরকম কোন ছিদ্রপথ ধরতে পারি তখন স্বর্ণ সন্ধানী বাহিনীর কাছে খবর গেলে তারাই সোনা কোষাগারে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, সেইসঙ্গে অপরাধীদেরও। এইবার হতাশ গলায় বলে উঠলেন–এই লোভনীয় জিনিসে পৃথিবীর শক্তিশালী, বুদ্ধিমান। অপরাধীরাও আকৃষ্ট হয়েছে। তাদেরকে ধরা অত্যন্ত শক্ত।
-কিন্তু এটা তো সাময়িক ব্যাপার। সোনার ঘাটতি বেশিদিন থাকবে কেন? দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সে সোনা। আসছে সেটাই তো ঘাটতি পূরণের পক্ষে যথেষ্ট। উৎপাদনের বেশি থাকলে চোরাকারবার তো সেরকম হয়ই না। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেনিসিনিলন নিয়ে হয়েছিল।
কিন্তু মিঃ বন্ড ব্যাপারটা অত সহজ নয়। পৃথিবীতে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার চারশ করে জনসংখ্যা বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সোনা জমানো লোকের সংখ্যা। কেউ সোনা পুঁতে রাখে বাগানে, মেঝেতে, কেউ দাঁত বাঁধাতে। ব্যবহার করে, কেউ চমশার ফ্রেমে লাগায়, আর কেউ গয়না বানায়। এরাই তো বাজার থেকে মণ মণ সোনা নিচ্ছে।
আজকাল সোনার তার, গোল্ড প্লেটিং অথবা অ্যামালগাম তৈরির জন্যও সোনা লাগে। সোনা জিনিসটার আশ্চর্য গুণ আছে তাই যত দিন যাচ্ছে নতুন নতুন ভাবে নানা জিনিসে ব্যবহার করা হচ্ছে। মন্দ দিকও আছে। এক তো ধাতুটা কঠিন নয়। শুধু নাড়াচাড়া করাতে প্রত্যেক বছর খানিকটা করে সোনা নষ্ট হয়। তাছাড়া, করুন মুখে স্মিার্স বললেন, শুধু দুদিনের জন্য সোনা জমিয়ে রাখে এমন লোকও আছে। যেন ভয় তাড়াবার মাদুলী। আজ আমাদের এমন অবস্থা, রাতারাতি দেশের চেহারা বদলে যেতে পারে, অর্থনীতি পাল্টে যেতে পারে। তাই টাকা পয়সা নয় সোনা জমিয়ে দুর্দিনের সঙ্কট মোকাবিলা করাই নিশ্চিন্ত পথ। এ কথা বললে কি বেশি বলা হবে। একপ্রান্ত থেকে সোনা বের করে তৎক্ষণাৎ তা চলে যাচ্ছে পৃথিবীর অপর প্রান্তে মাটির ভিতরে, এই আতঙ্কগ্রস্ত লোকেদের জন্য।
কর্নেলের বক্তৃতা শুনে বন্ড হাসল। ভাবল ভদ্রলোকের শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধু সোনা আর সোনা জিনিসটি আকর্ষনীয় বটে তবে সব তথ্য জেনে নেওয়া দরকার। এর আগে যখন হীরে স্মাগলারদের সন্ধানে নেমেছিল তখন হীরে সম্বন্ধে মানুষের মোহ ও কুসংস্কারের অনেক কিছু জেনেছিল। বন্ড প্রশ্ন করল, আর কি কি জানা দরকার, আমার এই সমস্যা সমাধানে নামতে হলে।
-আপনার একঘেয়ে রাগছে না তো?..তা আপনি এইমাত্র বলছিলেন না, খনি থেকে অজস্র সোনা বার হচ্ছে তাতেই খদ্দেরদের চাহিদা মিটে যাবে। তা কিন্তু নয়। সত্যি কথা হল পৃথিবীর সোনা শেষ হয়ে আসছে। হয়ত ভাবছেন কিছু অনাবিষ্কৃত খনি রয়ে গেছে। এটা ভুল। যদি কোথাও থেকে থাকে না হলে সমুদ্রতলে মাটির নিচে। বহুবছর ধরে। লোভী মানুষরা সোনার খোঁজে সারা পৃথিবী চষে ফেলেছে। আগে প্রাচীন মিশর ও মাইমিনিতে প্রচুর সোনা পাওয়া যেত। অ্যাজটেকের রাজা মন্টেজুমা আর ইংকাদের কাছেও ছিল অঢেল সোনা, রোমান সম্রাট ক্রোয়েসাস ও মিডাস মধ্যপ্রাচ্যের যাবতীয় সোনা দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া রাইন উপত্যকা, পো মালাগা এবং গ্রানাডার সমতলভূমি থেকেও সোনা বার করা হয়েছিল।
ভারতবাসীরাও এ নেশায় মেতে উঠেছিল। প্রবাদ আছে, মাটির নিচে থেকে পিপঁড়েদের সোনার দানা নিয়ে বেরতে দেখে ভারতীয়রা প্রথম খনির সন্ধান পায়। মধ্যযুগে সবচেয়ে বড় সোনার খনি ছিল মেক্সিকো ও পেরুতে। ইউকন ও এলডোরাডোের বিখ্যাত স্বর্ণ উৎপাদন হয় দুর্গম অঞ্চলে। সোনা খুঁজতে গিয়ে প্রাণ হারান অনেকে। শেষে ইউরেকায় স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর শুরু হল প্রথম আধুনিক স্বর্ণযুগ।
ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় সোনা উৎপাদন হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লেনা ও উরাল অঞ্চলের প্রকাণ্ড সোনার খনির দৌলতে পৃথিবীর সব থেকে বড় স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ ছিল রাশিয়া। দ্বিতীয় স্বর্ণ যুগের সূচনা হল উইটওয়াটার্সর্যান্ড-এ স্বর্ণ পাওয়া গেলে। সেই সময় থেকেই শুরু হল সায়ানাইডিং প্রথা।
দক্ষিণ আফ্রিকার খনিগুলো খোলবার সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছে। কর্নেল দু-হাত শূন্যে তুলে বলে উঠলেন আজ পৃথিবীর গর্ভ থেকে অঢেল সোনা বেরিয়ে আসছে। ভাবতে পারেন ক্লনডাইক, হোমস্টেক এলডোরাডোর স্বর্ণখনিকে আফ্রিকার স্বর্ণখনি টেক্কা দিয়ে দিয়েছে। আপনাকে একটা আন্দাজ দিচ্ছি ১৫০০–১৯০০ এই চারশ সালে মোট ১৮ হাজার টন সোনা বার হয়েছিল ১৯০০-১৯৫৮ পর্যন্ত বার করা হয়েছে ৪১ হাজার টন সোনা। এইভাবে চালিয়ে গেলে যেটুকু সোনা আছে তা যদি পঞ্চাশ বছরে শেষ হয়ে যায় তাহলে একটুও অবাক হব না–মিঃ বন্ড।
সোনার ইতিহাসের ধাঁধায় পড়ে বন্ডও দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। বলল, চমৎকার ইতিহাস শোনালেন। সমুদ্র গর্ভ থেকে যখন তেল বার করতে পারা গেছে তখন সোনাও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আচ্ছা এবার সোনা স্মাগলিং-এর কথা বলুন।
টেলিফোন বেজে উঠতেই কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে রিসিভার তুলে বললেন, স্মিার্স বলছি। অপর প্রান্তের কথা শুনে বিরক্তির স্বরে বলে উঠল, গ্রীষ্মকালে কি কি খেলা আছে তার লিস্ট তো পাঠিয়ে দিয়েছি মিস্ ফিলবি। আগামী শনিবার ডিসকাউন্ট হাইসেস-এর সঙ্গে পরের ম্যাচ আরও কিছুক্ষণ চুপ করে শুনে বললেন, তা মিসেস ফ্লোক যদি গোলকীপার হয়ে খেলতে না চান তাহলে তার খেলা হয় না। একমাত্র গোলেই ওকে খেলান যাবে। সবাই তো আর সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলতে পারে না! হ্যাঁ তাই বলুন, আর বলবেন এবারকার মত গোলকীপারের কাজটা করে দিলে ধন্য হয়ে যাব। ধন্যবাদ মিস ফিলবি।
রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বললেন, মাফ করবেন। খেলা আর শ্রমিক কর্যাণ নিয়ে ব্যাংক কর্মচারিদের এত মাতামাতি যে কি বলব। তার ওপর ব্যাংকের মহিলা হকি টিমের ম্যানেজারীর ভার আমার ওপরে। যাকগে…যে কথা বলছিলাম, প্রথমত কেবল ইংল্যান্ড ও স্টার্লিং এলাকাতেই স্মাগালক্তে বিশাল ব্যবসা। মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের হাজার জনের মধ্যে কম করে পাঁচশ জন, এদের মধ্যে আমার স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাহিনীও আছে, এদের কাজ হল, যারা সোনা চোরাই পথে বাইরে পাঠাচ্ছে, মদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনকে ফাঁকি দিচ্ছে তাদের খুঁজে বের করা।
আপনাদের লোকসংখ্যা তো অনেক! বন্ড বলল ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনীর মোট কর্মীই তো দু হাজার। তা সোনা স্মাগলিং-এর একটা উদারহণ দিতে পারেন, এটা আবার আমার ঠিক মাথায় ঢোকে না। কর্নেল বিজ্ঞের মত অলস গলায় বলল, ভাল কথা, ধরুন আপনার পকেটে একজোড়া সিগারেট প্যাকেটের মাপে একটি সোনার বাট আছে, যার ওজন সোয়া পাঁচ পাউন্ড। জিনিসটা আপনি চুরি করে থাকতে পারেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারেন বা অন্য কোন সূত্রে। যাই হোক, আইন অনুসারে এটি ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডকে বিক্রি করলে আপনি পাবেন কন্ট্রোল দর, আউন্স পিছু সাড়ে বার পাউন্ড, অর্থাৎ মোট হাজার পাউন্ড। কিন্তু আপনি হয়ত কিছু লোভী হয়ে উঠলেন। কোন বন্ধু হয়ত ভারতে যাচ্ছে। বা কোন ভারতগামী প্লেনের পাইলট বা স্টুয়ার্ড আপনার চেনা জানা, তাদের হাত দিয়ে সোনা পাঠাতে চান। শুধু আপনার কাজ বাটটিকে পাতলা চাকতির মত কেটে কোমরে বেল্টের সঙ্গে সেলাই করে দেবেন বন্ধুকে কোমরে পরবার জন্য। এরজন্য সে কমিশন পাবে। এবার বন্ধুটি বোম্বাইতে যে কোন সোনা কারবারীকে ওটা বিক্রি করে পেল সতেরশ পাউন্ড। অর্থাৎ বাড়তি সাতশ পাউন্ড আপনার পকেটে। মনে রাখবেন, এই মুনাফা এমন কিছু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত যদি এরকম স্মাগলিং চালিয়ে যেতেন তাহলে রাতারাতি বড়লোক হয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে পারতেন।
M জানতে চাইবেন এই ভেবে সে জিজ্ঞাসা করল ভারতবর্ষে সোনার দাম এত কেন?
-সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। তবে প্রধান কারণ হয়ত অত্যধিক সোনার গয়না পরার রেওয়াজ।
–ভারতে চোরাপথে কি পরিমাণ সোনা যায়?
— প্রচুর ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তর ও কাস্টমস বিভাগের লোকেরা ১৯৫৫ সালে ৪৩ হাজার আউন্স বেআইনি সোনা। ধরেছিল। ঐ বছরের চোরাচালানের একশ ভাগের একভাগ হবে কিনা সন্দেহ। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সোনা জমা হচ্ছে ভারতবর্ষে, সেই সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে স্মাগলিং-এর নতুন নতুন পন্থা। স্মাগলাররা ম্যাকাও থেকে প্লেনে করে ভারতের ওপর দিয়ে যাবার সময় নির্দিষ্ট জায়গায় এক টন সোনা ভর্তি একটা প্যারাসুট ফেলে।
-আচ্ছা, অন্য কোন দেশে বেশি দামে সোনা বেচা যায় না?
–ইংল্যান্ডের চেয়ে বেশি দর অনেক দেশই দেয়। যেমন–সুইজারল্যান্ডে, তবে সব থেকে ভাল বাজার ভারতবর্ষই।
এবার বুঝতে পারছি, এখন বলুন বর্তমান সমস্যা কি? সিগারেট ধরিয়ে গোল্ডফিংগারের পরিচয় জানার অপেক্ষায় রইল।
কর্নেল কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ১৯৩৭ সালে রিগা শহর থেকে অরিক গোল্ডফিংগার উদ্বাস্তু হয়ে ইংল্যান্ডে আসে। বয়স তখন কুড়ি। তবে বুদ্ধি সে তুলনার বেশিই ছিল। আন্দাজ করতে পেরেছিল রাশিয়া সরকার তার দেশকে কুক্ষিগত করে নেবে কিছুদিনের মধ্যেই। বাপ ঠাকুর্দারা স্বর্ণকার ছিল, এবং সোনার পাতভর। একটা বেল্ট ছিল যেটার কথা একটু আগেই বলেছি আপনাকে। ভদ্রলোক সেই বেল্টটি সম্ভবত হাত সাফাই করেছিলেন।
যাইহোক ইংল্যান্ডে বেশ জমিয়ে নিয়েছিলেন। নিরীহ মানুষ, ব্যবসাটা ভাল, তাই লাইসেন্স সহজেই পেয়ে গিয়েছিল। এরপর দেশের ছোটখাট বন্ধকী কারবারের দোকান কিনে বেশি মাইনেতে কর্মচারি নিযুক্ত করে প্রত্যেক দোকানের নাম রাখলেন গোল্ডফিংগার। দোকানে সস্তা গয়না বিক্রি হয় আর পুরনো সোনা ন্যায্য দামে কেনা হয়। নিজে একটা স্লোগানও তৈরি করেছিলেন পুরনো লকেট দাদীমার বদলে কিনুন নতুন আংটি প্রেয়সীর। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত দুই শ্রেণীর মানুষের বাসস্থানের সংযোগ স্থলে দোকান হওয়াতে ব্যবসা জমে উঠল। বেআইনি কাজ করেন না বলে পুলিশের সঙ্গে খাতির ছিল খুব। গোল্ডফিংগার নিজে লন্ডনে থাকলেও মাসে একবার করে সব দোকানে গিয়ে গতমাসের কেনা সমস্ত পুরনো সোনা নিয়ে আসতেন। বাকি কাজ তার ম্যানেজাররাই নিজের মত চালাত।
কর্নেল বন্ডের দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আপনি ভাবছেন লকেট, ক্রস এসব তো ছোটখাট জিনিস। ঠিকই, তবে নিয়মিত সপ্তাহ আধ ডজন করে ছোট সোনার জিনিস কিনলে মোট পরিমাণ ভালই দাঁড়ায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অন্য স্বর্ণকারদের মত গোল্ডফিংগারকেও জানাতে হল তার কত সোনা আছে। জানা। গেছে তিনি নাকি বলেছিলেন একজন স্যাকরার ব্যবসা চালাতে ন্যূনতম পরিমাণ যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই মাত্র পঞ্চাশ আউন্স! সুতরাং তাকে বলা হল এটুকু সোনা আর সরকারকে দেবার দরকার নেই। যুদ্ধের সময়টুকু তিনি গা ঢাকা দিলেও যতগুলো সম্ভব দোকান খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন।
যুদ্ধ শেষ হলে টেমস নদীর মোহনার কাছে একটা সুন্দর বাড়ি কিনলেন, তার সঙ্গে মজবুত ট্রলার জাহাজ ও পুরনো সিলভার গেস্ট রোলস রয়েস গাড়ি। এই গাড়িটি আসলে লোহার পাতে মোড়া সুরক্ষিত গাড়ি। দক্ষিণ আমেরিকার এক গৃহযুদ্ধ বিক্ষুব্ধ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির জন্য তৈরি করা হলেও তিনি নিতে পারেননি কারণ গাড়ি নেওয়ার আগে তার মৃত্যু হয়েছিল। তারই মালিক বর্তমানে গোল্ডফিংগার।
নিজের বাড়ির কাছেই থ্যানেট অ্যালয় রিসার্চ নামে একটা কারখানা খুললেন। যুদ্ধের পর আর দেশে ফিরে যেতে চাননি, এমন একজন ধাতু বিশেষজ্ঞকে কারখানার ভার দিয়েছিলেন। লিভারল বন্দর থেকে ছ জন কোরিয়ানকেও রাখলেন। এরা কেউই সভ্যদেশের ভাষা জানতেন না বলে গুপ্ত কথা ফাঁস হয়ে যাবার ভয় ছিল না। তারপর গত দশ বছরে তার গতিবিধি সম্পর্কে এই টুকুই জানি বছরে একবার ভারতবর্ষে যেতেন ট্রলারে, আর গাড়ি করে সুইজারল্যান্ড। অ্যালয় কোম্পানির শাখা খুলেছিলেন জেনিভাতে সেগুলোও ভালই চলছে। এখন তিনি নিজে আর সোনা নিয়ে যান, এক কোরীয়ান ড্রাইভার গিয়ে নিয়ে আসে। গোল্ডফিংগার তেমন সাধুপুরুষ না হলেও আচার ব্যবহার ভাল, পুলিশের সঙ্গে সদ্ভাব আছে বলে গতিবিধির ওপর আমরা সেরকম নজর দিইনি, সারা দেশে ওর থেকেও বড় বড় জোচ্চোর আছে।
কর্নেল স্মিার্স ক্ষমাপ্রার্থীর মত করে বললেন, মিঃ বন্ড আপনার বিরক্তি লাগছে না তো? আসলে লোকটির চরিত্র : বোঝানোর জন্যই এসব বলছি। যাই হোক একটা দুর্ঘটনাই ভদ্রলোকের ওপর আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিল। ১৯৫৪ সালে গরমের সময় তার ট্রলার গুড উইনস-এর কাছে ভেঙে পড়লে সস্তা দরে সেটিকে বেচে দিলেন ডোভার ম্যালভেজ কোম্পানির কাছে। কোম্পানির লোকেরা জাহাজের খোল ভাঙতে গিয়ে কাঠের ভেতর এক ধরনের বাদামী রঙের গুড়ো দেখতে পায়। সেই গুড়ো পরীক্ষা করে জানা যায় সেটি আসলে সোনা। রাসায়নিক ফমূলা না দেখিয়ে কি করে বাদামী খুঁড়ো করা হয় সেটাই বলছি। হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণে সোনাকে গলিয়ে রিডিউসিং এজেন্টের সালফার ডাই অক্সাইড কিংবা অক্সালিক অ্যাসিডের সাহায্যে এটি বাদামী গুড়োতে পরিণত হয়। এই গুড়োকে হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে গলিয়ে আবার খাঁটি সোনা করা যাবে। প্রক্রিয়াটা খুবই সোজা, যদিও এর থেকে বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস বের হয়।
স্যালভেজ কোম্পানির কেউ গল্পছলে ঘটনাটি বলে কাস্টমস্-এর এক কর্মীকে। সেখান থেকে পুলিশও গোয়েন্দা মারফত আমাদের কাছে। রিপোর্টের সঙ্গে ভারত ভ্রমণের সময়কার মাল খালাসের কাগজপত্রও ছিল। তাতে লেখা সার তৈরির জন্য ব্যবহৃত খনিজ পদার্থের গুড়ো। আজকাল সব সারেতেই খনিজ পদার্থ ব্যবহার করা হয় বলে কেউ অবিশ্বাস করেনি। গোন্ডফিগার পুরনো সোনা শোধন করে খাঁটি সোনা তৈরি করে সেগুলিকে আবার বাদামী রঙের গুড়োয় পরিণত করে সার বলে ভারতবর্ষে পাঠাচ্ছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল এই অপরাধের জন্য গোল্ডফিংগারকে দায়ী করার যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। ভদ্রলোকের ব্যাংক ব্যালেন্স মাত্র কুড়ি হাজার পাউন্ড আর ইনকাম ট্যাক্স যথাসময়ে জমা দেওয়া হয়। একটা সুসংগঠিত গহনার ব্যবসায় যতটা উন্নতি হওয়া সম্ভব খাতা পত্রে সেইভাবেই সব দেখান আছে।
অতএব আমাদের বাহিনীর দুজনকে তার কারখানায় পাঠালাম। নিজেদের শ্রম মন্ত্রণালয়ের ক্ষুদ্রশিল্প বিভাগের লোক বলে পরিচয় দিয়ে শ্রমিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যবস্থা দেখার জন্য এসেছে বলতে গোল্ডফিংগার তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। মনে রাখবেন আমরা যে নজর রাখছি তা ব্যাংকের ম্যানেজার আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। যাই হোক একটু আধটু সোনার চিহ্ন, দু হাজার ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তাপ তোলার ফার্নেস পাওয়া গেলেও ধাতু তৈরির গবেষণার জিনিসই বেশি। পেশায় স্বর্ণকার তাই ঢালাইলের জিনিস থাকবেই, সুতরাং সন্দেহ করবার কোন কারণ নেই। আমাদের লোক ফিরে এলে আইন সংক্রান্ত বিভাগ জানাল ঐ টুকু গুড়ো মামলা করবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আরও প্রমাণ চাই। ব্যাপারটা এখানে শেষ হলেও আমি খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম বিভিন্ন ব্যাংকে।
কর্নেল স্মিার্স থামলেন। বাইরে থেকে শহরের কোলাহল কানে আসছে। বন্ড লুকিয়ে ঘড়ি দেখে নিল, পঁচটা বাজে। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে বললেন, মিঃ বন্ড পাঁচ বছর পর আমি জানতে পারলাম গোল্ডফিংগার ইংল্যান্ডের সব থেকে ধনী ব্যক্তি। জুরিখ, নাস, পানামা এবং নিউইয়র্কের বিভিন্ন সেফ ডিপোজিট ভল্টে মোট দু কোটি পাউন্ড মূল্যের সোনা আছে, সেটা দেখার জন্য নামো গিয়েছিলাম। অন্য সব শিল্পীর মত তিনি নিজের সব সোনার বাটে ছোট একটা z অক্ষর খোদাই করে রেখেছেন। ঐ সব সোনা ইংল্যান্ডের। ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড কিছু করতে পারবে না তাই আপনাকে অনুরোধ করছি মিঃ বন্ড, ঐ সব সোনা দেশে ফেরত নিয়ে আসুন। সাম্প্রতিককালের মুদ্রা সঙ্কটের বাজারে ইংল্যান্ডের ঐ সোনা অত্যন্ত প্রয়োজন।
.
প্রস্তুতি
কর্নেল স্মিদার্সের সঙ্গে লিফটের কাছে এল বন্ড। অপেক্ষা করতে করতে প্যাসেজের শেষের জানালটা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে ব্যাংকের পেছনের মাঠে একটা চকলেট রঙের লরী এসে থামল। লরী থেকে চৌকো কার্ডবোর্ডের বাক্স নামিয়ে একটা কনভেয়ার বেল্টের ওপর রাখার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ব্যাঙ্কের ভেতর চলে যাচ্ছে।
কর্নেল পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, এগুলো পাঁচ টাকার নোট। লটনে যে ছাপাখানা আছে সেখান থেকে এল।
লিফট এল দুজনেই ঢুকল, বন্ড বলল, এগুলো ভাল লাগে না, অন্য কোন দেশের টাকার মতন দেখতে, তবে পুরনো নোটগুলো সব থেকে বেশি ভাল ছিল। তারা এখন বিরাট হলঘরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে। আলো কম, লোকজনও নেই। কর্নেল বললেন, আমিও আপনার সঙ্গে একমত, কিন্তু যুদ্ধের সময় জার্মানীর রাইখম ব্যাংক যে পাঁচ পাউন্ডের জাল নোট তৈরি করেছিল সেগুলো হুবহু এক রকম। রাশিয়ানরা যখন বার্লিন অধিকার করে তখন অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে সেই জাল ব্লকগুলিও তাদের হাতে পড়ে।
যুদ্ধের পর তাদের কাছ থেকে ব্লক ফেরত চাইলে তারা তা দিতে অস্বীকার করে। আমরা দেখলাম ব্যাপারটা ভীষণ বিপজ্জনক, মস্কো সরকার ইচ্ছা করলেই ইংল্যান্ডের বাজারে রাশি রাশি পাঁচ পাউন্ডের নোট ছেড়ে মুদ্রা ব্যবহার সর্বনাশ করতে পারে, তাই বাধ্য হয়ে পুরনো নোট তুলে নতুন নোট বাজারে ছাড়তে হল। দেখতে ভাল না হলেও এ নোট জাল করা খুব শক্ত।
সিঁড়ির ওপর নৈশ প্রহরী দাঁড়িয়েছিল, রাস্তা ছেড়ে দিল। শহরে রাত অনেক হয়েছে, রাস্তা ফাঁকা, কর্নেলকে বিদায় জানিয়ে পাতাল রেলের দিকে পা চালাল বন্ড। এই ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের কাজকর্ম দেখে ধারণা পাল্টে গেল তার। বয়সে প্রবীণ হলেও কর্মক্ষমতা নবীনের মত।
সন্ধ্যা ছ টার সময় M-এর সঙ্গে দেখা করতে হবে। সেখানেই গেল। M-এর মুখ সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত, ক্লিষ্ট। বন্ড লক্ষ্য করল অতিকষ্টে মাথা পরিষ্কার করে নতুন সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য M তৈরি হলেন। সোজা হয়ে পাইপ হাতে নিয়ে বললেন, বল!
বন্ড সব গুছিয়ে বলে দিল।
কথা শেষ হতেই চিন্তাগ্রস্ত ভাবে M বললেন, এই কাজটা না নিয়ে উপায় নেই তাহলে। ব্যাংক রেট সম্পর্কে কিছুই জানা নেই আমার, কিন্তু আজকাল দেখছি সবাই জানে। আমি ভাবতাম আমাদের দেশের টাকার দাম কর্মক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, সোনার ভাঁড়ারে নয়। যুদ্ধের পর জার্মানদের হাতে তো কিছু ছিল না, কিন্তু এখন কি উন্নতি হয়েছে তা তো দেখতেই পাচ্ছ। যাকগে গোল্ডফিংগারের সঙ্গে কিভাবে ঘনিষ্টতা করবে, কিভাবে এগোবে ভেবেছে? ওর কোন নোংরা কাজে সাহায্য করার প্রস্তাব করলে কেমন হয়।
বন্ড বলল, ওর কাছে বিনয়ের সঙ্গে গেলে পাত্তাই পাব না স্যার। আমার ধারণা ওর থেকে বেশি বুদ্ধিমান লোককেই। ও শ্রদ্ধা করতে পারে। একবার ওকে আমি তাস খেলায় হারিয়েছি তার জন্য আমায় গল খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সুতরাং সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করাই ঠিক হবে।
M ব্যাঙ্গ করে বলে উঠলেন–আমার একজন কর্মচারি সারাদিন মাটে গলফ খেলে বেড়াবে। বাঃ চমৎকার। ঠিক আছে। তাই কর, তবে খেলায় ওকে হারাতেই হবে। তাছাড়া কি বলবে তাকে?
বন্ড তাচ্ছিল্য করে বলল, সেটা এখনও ভাবিনি। ধরুন, বলব–ইউনিভার্সাল এক্সপোর্টের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি, এতে সেরকম উন্নতির আশা নেই। আপাতত ছুটি নিয়েছি, ভাবছি কানাডা চলে যাব। এই সব আর কি। তবে গুছিয়ে বলতে হবে গোল্ডফিংগারের অত সহজে বোকা বনে যাবার লোক নয়।
-ঠিক আছে। কি হল না হল আমায় জানাবে। এ কাজটায় আমারও আগ্রহ আছে, শুধু শুধু যে মাথা ঘামচ্ছি তা নয়। M-এর গলার স্বরে বদলে গেল, বললেন এখন একা তথ্য তোমায় জানাব যা ব্যাংক বলেনি। মিঃ গোল্ডফিংগারের বাটগুলো কেমন দেখতে তা আমাদের জানা আছে। আসলে আজই এ রকম ২ খোদাই করা বলে বাট হাতে এসেছে। গত রাত্রে তাঞ্জিয়াসে রেডল্যান্ড কোম্পানির ডিরেক্টরের বাড়িতে আগুন লাগলে সেখান থেকে অনেক কিছু হাতিয়ে নিয়ে এসেছি। ঘটনাটা শুনেছ তুমিও, সেখানেই এটা পেয়েছি। এ নিয়ে কুড়িটা হল যা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে।
বন্ড বলে উঠল, কিন্তু এই বাটটা তো SMERSH-এর গোপন সিন্দুক থেকে পাওয়া।
-ঠিক তাই। খোঁজ নিয়ে জেনেছি-এর আগে ২ চিহ্ন দেওয়া উনিশটি সোনার বাট সবকটিই SMERSH সংস্থার গুপ্তচরদের কাছ থেকে পাওয়া। M একটু থেমে মৃদু কণ্ঠে বললেন, জান 007, শেষ পর্যন্ত যদি জানা যায় গোল্ডফিংগার SMERSH-এর বৈদেশিক ব্যাংকার হিসাবে কাজ করে, তাহলে একটুও অবাক হব না।
জেমস্ বন্ড তার DB III গাড়িটাকে জোরে ছুটিয়ে নিয়ে চলে এল রোচেস্টারের উপকণ্ঠে ছোট পাহাড়টার গায়ে। এখানে এসে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ল। গাড়ির গতি আস্তে হওয়াতে একটা সিগারেট ধরাল।
M-এর কথাগুলি ভাবছিল বন্ড। কর্মচারিদের টাকা দেয় না নাকি রাশিয়ানরা। বিদেশে বিভিন্ন রাশিয়ান গুপ্তচর সংস্থায় টাকার অভাব। সেখানকার কর্মীরা মস্কোর কাছে অভিযোগ করেছে দু বেলা খাবার মত টাকাও তাদের দেওয়া হয় না। হয়ত রাশিয়ার গুপ্তচক্র SMERSH-ঠিকমত টাকা আদায় করতে পারে না। যাই হোক ব্যাপারটা সেই একই রয়ে গেছে। অর্থ সঙ্কটের জন্য অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। সুতরাং গোল্ডফিংগারের মত একজন ধূর্ত ব্যবসায়ীকে রাশিয়ার বাইরে বসিয়ে তার মুনাফার সাহায্যে আন্তর্জাতিক কেন্দ্রগুলিকে অর্থ সাহায্য করাটা যথেষ্ট বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু তাই নয়, SMERSH-কে টাকা দিতে গিয়ে শক্ত রাষ্ট্র ইংল্যান্ডের মুদ্রাব্যবস্থার ক্ষতি সাধন করছে গোল্ডফিংগার। M-এর বক্তব্য সত্যি হলে এমন কাজ SMERSH-এর পক্ষেই সম্ভব–দুর্দান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত ষড়যন্ত্র, নিখুঁত পরিকল্পনা, যা চালনা করছে গোল্ডফিংগারের মত মানুষ।
চ্যাথাম শহরের দিকে এগোতে এগোতে ভাবছিল বন্ড, ঐ জন্যই বোধহয় তার অন্তহীন লালসা, মওকা পেলেই দশ বিশ হাজার ডলার কামান।
এসবের পেছনে SMERSH-এর প্রতি নিষ্ঠা ছাড়াও হয়ত আছে সোভিয়েট রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মান অর্ডার অব লেনিন করায়ত্ত করার বাসনা। দেশে দেশে বিপ্লব জাগিয়ে তোলার জন্য প্রচুর টাকার দরকার। গোন্ডফিংগার বিশ্বের প্রয়োজনে টাকা রোজগার করছে। সে জন্য ধরা পড়বার ঝুঁকি নিলেও তার গুরুত্ব নিতান্তই কম। কেননা ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড গোল্ডফিংগারের সমস্ত অপরাধের জন্য তাকে দায়ী করলেও শাস্তি স্বরূপ দু তিন বছরের বেশি জেল হবে না।
বন্ড ধীরে সুস্থে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। হাত ও পায়ের সঙ্গে মস্তিকও কাজ করছে।
তাহলে ১৯৩৭ সালে SMERSH-ই সোনার পাতে ভরা বেল্ট তাকে দিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। লেনিন গ্রডের স্কুলে তাকে বোধহয় বলা হয়েছিল আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে, তাই কোন রকম নোংরা কাজ না করে ইংল্যান্ডে ভালভাবে জাকিয়ে বসে রোজগার শুরু করা। কোন ব্যক্তিগত যোগাযোগ চলবে না। একটা নিয়ম তাকে পালন করতে হবে। বিশেষ কাগজে বিশেষ বিজ্ঞাপন দেখে নির্দিষ্ট কয়েকটি গুপ্তস্থানের হাজার দুয়েক বা হাজার পাঁচেক সোনার বাট রেখে আসতে হবে। গাছের কোটর ব্রীজের খোপর তাদের গুপ্তস্থান। মস্কো থেকে নির্দেশ আসবে SMERSH-এর গুপ্তচরদের কাছে কিভাবে সোনা নিয়ে আসতে হবে।
যুদ্ধের শেষে গোল্ডফিংগারের আর্থিক অবস্থা ভাল হয়ে গেল। তখন গুপ্তস্থান গাছের কোটর, ব্রীজের খোপর বদলে এল ব্যাংকের সে ডিপোজিট ভল্ট বা স্টেশনের মালপত্র রাখার লকার। আগের সেই নির্দেশ এখনও রইল। সোনা রাখার পর সেদিক মাড়াবে না। বছরে একবার করে SMERSH-এর কোন কর্তা ব্যক্তি কোন এক পার্কে, অথবা ট্রেনে দেখা করে গোপনে চিঠি পকেটে দিয়ে আসবে। কিন্তু টাকাটা দিতে হবে নগদে, সোনায় নয়। যাতে ধরা না পড়তে হয়। ফাঁস হয়ত হত না কোন দিন, যদি গোল্ডফিংগার নিজেকে জাহির করার জন্য ২ অক্ষর না খোদাই করত, আর কর্নেল স্মিার্স ব্যাপারটা আবিষ্কার করতেন।
বন্ড ভাবছিল গোল্ডফিংগার SMERSH-কে দশ-বিশ লক্ষ পাউন্ড দিচ্ছে, সেই সঙ্গে নিজের টাকাও স্থূপীকৃত করে চলেছেন, আর অপেক্ষা করছেন সেই দিনের জন্য, যেদিন ক্রেমলিন থেকে নির্দেশ আসবে তার সমস্ত সোনা বিশ্বব্যাপী অভ্যুত্থানের জন্য নিয়োজিত হবে।
এই বিরাট ষড়যন্ত্রের কথা কেউ জানে না। গোল্ডফিংগারকে যারা স্বর্ণকার, ধাতু বিশেষজ্ঞ, রেকুলভার ও নাসোর বাসিন্দা ব্লেডস ক্লাব ও রয়্যাল সেন্ট মাকর্স ক্লাবের সম্মানীয় সভ্য বলে চেনে তারা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ষড়যন্ত্রকারীদের একজন এই লোকটি। SMERSH আজ পর্যন্ত যে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে তার টাকা জুড়িয়েছে এই গোল্ডফিংগার। SMERSH-হল রাশিয়ান কথা Smiert Spionan-এর সংক্ষিপ্ত রুব। কথাটির অর্থ গুপ্তচরের শাস্তি মৃত্যু। এদের কাজ বিদেশী গুপ্তচর ও সহকর্মীদের শেষ করে দেওয়া।
M ছাড়া কেউ গোল্ডফিংগারকে সন্দেহ করেনি আর বস্তও সেই কথা জানে। পৃথিবীর অপর প্রান্তে প্লেন ছাড়তে দেরি শুরু যা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বন্ডকে গোল্ডফিংগারের বিরুদ্ধে।
বন্ড বিষণ্ণ হাসি হাসল। তার চাকরিতে এরকম শতবার হয়েছে। সামান্য ঘটনা থেকে কত বড় ঘটনা তৈরি হচ্ছে। আজ আবার সেই বড় ঘটনাকে শেষ করতে হবে একটা গলফ খেলার লাঠি নিয়ে?
একটা চৌমাথায় সাইন পোস্টে লেখা রেকুলভার বাঁদিকে। বন্ড সেই দিকে এগিয়ে চলল। চোখ খোলা রেখে এগিয়ে চলল। গোল্ডফিংগার মাল ওটা নামার জন্য এই শান্ত বন্দরটি ব্যবহার করেন। রাস্তা ও সমুদ্র তীরের মাঝখানে ঘন একসারি গাছ। কিছু দূরে কারখানা চিমনি ও কতগুলো বাড়ির ছাদ দেখা গেল। চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এটাই বোধহয় কারখানা। একটু পরেই একটা গেট দেখা গেল যেখানে সাইন বোর্ডে লেখা থ্যানেট অ্যালয়েজ। তার নিচে বিনা প্রয়োজনে প্রবেশ নিষেধ। বেশ সম্ভ্রান্ত ব্যাপার। বন্ড ধীর গতিতে গাড়ি চালিয়ে র্যামসগেটের কাছে চলে গেল।
বন্ড তার গলফ খেলার লাঠির ব্যাগ নিয়ে চলে গেল সোজা ক্লাবের দোকানঘরে। বৃদ্ধ আলফ্রেড ব্ল্যাকিং বসে একটা লাঠির এক প্রান্তে নতুন হাতল বসাচ্ছিলেন।
-হ্যালো অ্যালফ্রেড।
প্রবীন গলফ খেলোয়াড়ের রোদে পোড়া লোমচর্ম মুখে সহসা হাসির রেখা দেখা দিল–আরে মিস্টার জেমস। করমর্দন করে বলল, কুড়ি বছর পর দেখা। এখানে কি জন্য এসেছেন স্যার। কিছুদিন আগে শুনলাম কূটনৈতিক দপ্তরে কাজ করছেন বলে দেশের বাইরে থাকতে হয়। আমার তো ইংল্যান্ডের বাইরে পা-ই দেওয়া হল না। সেই বেখাপ্পা ক্লাব চালানোর অভ্যেস এখনো আছে বলে বন্ডের গলফ বল মারার ভঙ্গির অনুকরণ করলেন।
এখনো আছে আলফ্রেড। বদ অভ্যাসটা যায়নি। মিসেস ব্ল্যাকিং আর তোমার ছেলে মিসিলের কি খবর?
-ভালই স্যার। গত বছর ললাট জেলার গলফ চ্যাম্পিয়ন শিপে দ্বিতীয় হয়েছিল মিলি। এ বছর যদি সময় নষ্ট করে দোকানের পেছনে, তবে অনায়াসেই প্রথম হতে পারবে।
বন্ড ক্লাবগুলো দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে বাবল–লাঠির ব্যাগ–অনেকদিন পর এসে ভালই লাগছে। অনেকদিন আগে এক সঙ্গে তারা দুজনে প্রতিদিন দু রাউন্ড করে গলফ খেলত, তখনও কুড়ি বছর বয়স হয়নি। ব্ল্যাকিং-এর খুব ইচ্ছে ছিল বন্ড একজন গল্ফ খেলোয়াড় হোক। তাই বলতেন, আর একটু অভ্যাস করলেই আপনি পাকা খেলোয়াড় হয়ে উঠবেন। এটা ঠাট্টা নয়, সত্যিই আপনি পারবেন। কিন্তু খেলার উন্নতি করতে আপনার এত গাফিলতি কেন? দুটি বদ অভ্যাস আছে আপনার, বেখাপ্পা ক্লাব চালান আর বিনা কারণে জোরে বল মেরে বল দৃষ্টি সীমার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া। গলফ খেলোয়াড়ের যেরকম মেজাজ দরকার আপনারও সেরকমই। আপনি যদি এক বছর ঠিক মত প্র্যাকটিস করেন তবে অপেক্ষাদারদের প্রতিযোগিতায় আপনাকে দাঁড় করিয়ে দেব।
কিন্তু বন্ড যেন বুঝতে পেরেছিল এসব খেলা ভাল লাগলেও-এর পিছনে সময় দিতে পারবে না। তাই ট্রেনিং না নিয়ে ইচ্ছামত খেলাই ভাল। কুড়ি বছর আগে একবার এই মাঠে খেলেছিল। মুনরেকার রকেট নিয়ে বিশ্রী ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছিল কিংসটাউনে, তবু এদিকে আসেনি। কৈশোরের স্মৃতি মনে করে আর কষ্ট পেতে চায়নি।
কিন্তু হেড কোয়ার্টাসে থাকাকালীন ছুটির দিনগুলোতে যথেষ্ট গলফ খেলেছে বন্ড। হ্যাঁন্ডিক্যাপ বেড়ে দাঁড়িয়ে হয়েছে নয়। যথেষ্ট ভাল খেলে বলে অন্তত দশ পাউন্ডের বাজি না ধরে খেলে না।
-একহাত হবে নাকি অ্যালফ্রেড?
পেশাদার বৃদ্ধ খেলোয়াড়টি জানালা দিয়ে বাইরে দেখে নিয়ে বলল, মনে হয়, না স্যার। এই সময় খুব কম খেলোয়াড় এখানে আসে।
-তুমি তো আছ।
-মাফ করবেন স্যার। আজ একজন মেম্বারের সঙ্গে খেলার কথা আছে। প্রতিদিন দুপুর দুটোর সময় আমায় তাকে সঙ্গ দিতে হয়। মিসিলও নেই আচ্ছা ঝামেলা। (আর কোন বাজে শব্দ কখনও ব্যবহার করেন না) ঠিক এখনই ভদ্রলোকের না আসলে যেন চলত না? কতক্ষণ থাকছেন স্যার?
-বেশিক্ষণ না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না। আমি একা একাই বল পেটাই কিছুক্ষণ। কার সঙ্গে খেলবে তুমি।
– ভদ্রলোকের নাম গোল্ডফিংগার।
–ও চিনি লোকটাকে। কিছুদিন আগে আমেরিকায় আলাপ হয়েছে।
–চেনেন? মিঃ গোল্ডফিংগারকে চিনে রাখাটা তার কাছে অদ্ভুত মনে হল।
–খেলে কেমন?
–মোটামুটি। নয়ের হ্যাঁন্ডিক্যাপ হিসেবে ভালই।
–তোমার সঙ্গে যখন প্রত্যেকদিন প্র্যাকটিস করে তখন খেলার ব্যাপারে আগ্রহ আছে বলতে হবে।
-তা অবশ্য আছে। অ্যালফ্রেডের মুখে বিরক্তি। এই মুখভঙ্গির অর্থ লোকটার সম্পর্কে তার ধারণা খুব উঁচু নয় কিন্তু ক্লাবের খদ্দেরকে বিমুখ করতে বাধছে বলেই তার সঙ্গে রোজ খেলে চলেছেন।
বন্ড হাসল–তুমি একটুও বদলাওনি অ্যালফ্রেড। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, অন্য কেউ তার সঙ্গে খেলতে রাজি হবে না। ফাহারসনের কথা মনে আছে? ভদ্রলোক ইংল্যান্ডের সব থেকে বাজে গলফ খেলোয়াড়। মনে আছে। তোমার? তার সঙ্গেই রাউন্ডের পর রাউন্ড গলফ খেলেছ তুমি। তা গোল্ডফিংগারের গণ্ডগোলটা কোথায়?
অ্যালফ্রেড হাসলেন। বললেন আপনিই বরং বদলাননি মিঃ জেমস্। কৌতূহলও আগের মত? এবার কাছে সরে এসে বললেন, আসল কথা কয়েকজন মেম্বারের ধারণা মিঃ গোল্ডফিংগার চোট্টামি করেন। যেমন ধরুন, বল একটু গর্ত মতন জায়গায় পড়েছে সে অবস্থায় চালাকি করে বলের পজিশন ঠিক করে নেন। অ্যালফ্রেড নিজেই বল মারবার ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে দেখাল এই মিঃ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন বলটা বেশ চমৎকার দাঁড়িয়ে আছে তাই না, তোমার কি মনে হয়? এই বলে হাসতে হাসতে বলটার আশেপাশের মাটি এমন ঠুকবেন যাতে সত্যিই সত্যিই বলটা মাটি ঠেলে ইঞ্চি তিনেক উপরে উঠে আসবে।
অ্যালফ্রেড থামলেন অবশ্য এটা গুজবও হতে পারে স্যার, আমি নিজে কখনও দেখিনি। ভদ্রলোকের হাবভাব বেশ। ভাল, রেকুলভারে নিজের বাড়ি আছে। আগে নিয়মিত এখানে আসতেন। কিন্তু এখন অল্পই আসেন। এমনকি সপ্তাহ। দুয়েকের জন্য এলেও জানতে চায় কোন খেলোয়াড় পাওয়া যাবে কিনা। কেউ না থাকলে মিসিল বা আমিই সঙ্গ দিই। আজ সকালেই ফোন করেছিলেন কেউ আছে কি না জানতে। মাঝে মাঝে বাইরের দু একজন খেলোয়াড় এসে পড়ে তো। অ্যালফ্রেড বন্ডকে প্রশ্ন করেন, আপনি খেলবেন ওর সঙ্গে? তাছাড়া এতদূর এসেছেন, ফিরে যাবেন? ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় আছে তো বললেন। উনি ভাবতে পারেন আমি হয়ত তাকে ধরে রাখবার চেষ্টা করছি। সেটা ভাল হবে না।
-কোন মানে হয় না অ্যালফ্রেড। তোমাকেও তো রোজগার করতে হবে?
আমার রোজগার নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। দোকানের কাজ পড়ে আছে। তাই আজ দুপুরটা খালি পেলে সুবিধেই হত। কাজগুলো সেরে ফেলতাম। অ্যালফ্রেড হাতঘড়ি দেখে বললেন, সময় হয়ে গেছে আসার। আপনার। জন্য একজন ক্যাডী দিই (গলফ-এর ব্যাগ ইত্যাদি বয়ে বেড়ানর বেয়ারা) হকার কে মনে আছে? অ্যালফ্রেড হেসে বললেন সে একই রকম আছে, আপনাকে এতদিন পর দেখে খুশি হবে।
বন্ড বলল, ধন্যবাদ। ভদ্রলোক কেমন খেলেন তা আমি একটু দেখব। কিন্তু তার আগে একটা কাজ করা যাক। তুমি গোল্ডফিংগারকে বেশ সহজভাবে বলবে আমি এখানকার পুরনো সভ্য, একটা গলফ ক্লাব কিনতে এসেছি। আমাকে যা বললে ওসব কথা ওঁকে বলতে যেও না। আমি দোকান ঘরে আছি, উনি ভেবে চিন্তে যাতে খেলবার প্রস্তাব করতে পারেন।
–তাই হবে, মিঃ জেমস্। এ কাজটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। ঐ দেখুন ওঁর গাড়িও এসে গেছে। আধ মাইল দূরে একটা হলুদ রঙের গাড়ি বড় রাস্তা থেকে প্রাইভেট রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। গাড়িটার চেহারা বড় অদ্ভুত, ছোট বেলায় এরকম গাড়ি দেখেছি অ্যালফ্রেড বললেন। বন্ড দেখল, পুরনো মডেলের সিলভার গোস্ট রোলস রয়েস, রাজসিক চালে এগিয়ে আসছে। অপূর্ব সুন্দর গাড়ি! রূপালী রেডিয়েটরের ওপর সূর্যের আলো পড়ে ঝকমক করছে।
ড্রাইভারের আসনে ডাস্ট কোট, টুপি পরে একজন বসে; বিশাল মুখের অনেকখানি ঢাকা ড্রাইভিং গগলসে। তার পাশে গোল্ডফিংগারের মাথায় বোলার হ্যাট। তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোন শবাধার বয়ে নিয়ে আসছে।
গাড়িটা কাছে এসে পড়েছে, গাড়ির ভিতরে দুজোড়া চোখ আর হেডলাইট জোড়া যেন তাকিয়ে আছে বন্ডের দিকে।
সহজাত প্রবৃত্তির বলেই ঘরের এক অন্ধকারে কোণে চলে গেল বন্ড। নিজের কর্ম দেখে নিজেই হেসে ফেলল। একটা পড়ে থাকা গলফ ক্লাব নিয়ে মেঝের দিকে চিন্তিত মনে তাকিয়ে রইল।
.
দ্বিতীয় পর্ব
দৈবাৎ
খেলা হল শুরু
–গুড আফটারনুন ব্ল্যাকিং। সব রেডি তো? গোল্ডফিংগারের সহজ গলা কানে এল। বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে, কেউ খেলতে এসেছে বোধহয়?
-ঠিক জানি না স্যার। তবে একজন পুরনো সভ্য এসেছেন গলফ ক্লাব তৈরি করাবার জন্য। উনি খেলবেন কি না জিজ্ঞেস করব?
বন্ড কান খাড়া করে রাখল পরের কথাগুলো শোনবার জন্য, মুখে হাসি।
-মিঃ বন্ড স্যার।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর বললেন, বন্ড গলায় সামান্য আগ্রহের সুর দেখা গেল, কিছুদিন আগে একজন বন্ডের সাথে আলাপ হয়েছিল তা প্রথম নামটা কি
-জেমস্ স্যার।
–হা হ্যাঁ, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ওকি জানে আমি এখানে এসেছি। গোল্ডফিংগার পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখছে।
-উনি কারখানায় আছেন স্যার। হয়ত আপনার গাড়ি আসতে দেখেছে। অ্যালফ্রেড জীবনে মিথ্যে বলেনি, এই বয়সে যে বলবে তার সম্ভবনা নেই।– ওর সঙ্গে একহাত খেললে মন্দ হয় না। কেমন খেলে লোকটি হ্যাঁন্ডিক্যাপ কত? ব্ল্যাকিং-এর কাছ থেকে খবর নিচ্ছেন গোল্ডফিংগার।
-ছোট বেলায় তো ভালই খেলতেন। এখন জানি না।
–হুম।
বন্ড বুঝল ভদ্রলোক টোপ গিলবেন। বন্ড ব্যাগ থেকে একটা গলফ ক্লাব বার করে এক টুকরো গালা ঘষতে লাগল হাতলে। দরজার দিকে পিছন করে কাজ করে চলল, মেঝেতে ক্যাচকোচ আওয়াজ করে।
আমাদের বোধহয় এর আগে দেখা হয়েছিল–পেছন থেকে মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
বন্ড চট করে পেছনে তাকিয়ে বলল, আমায় চমকে দিয়েছিলে। আচ্ছা যেন চিনতে পারল এমন ভান করে বলে উঠল–গোন্ড, গোল্ডম্যান না, নাঃ-গোন্ডফিংগার। অভিনয়টা বেশি হয়ে যাচ্ছে তবুও গলার স্বরে অসন্তোষ ও সন্দেহ মিশিয়ে বলল, তুমি আবার কোথা থেকে।
-আমি তো বলেছিলাম আমি এখানে খেলতে আসি মনে আছে? তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বন্ডকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে।
-না।
মিস মাস্টারসনকে বলেছিলাম তোমাকে একটা খবর দিতে, পেয়েছিলে?
–না, কি খবর?
— আমি এখানে গলফ খেলতে আসব আর তোমার সঙ্গে একহাত খেলার ইচ্ছে।
–তাই নাকি? না, খেললেই হবে একদিন -দ্রতার সুরে বলে উঠল বন্ড।
গোল্ডফিংগার টোপ গিললেও বন্ড অত সহজে ধরা দেবে না।
-অন্য একদিন খেললে হয় না। আমি শুধু অর্ডার দিতে এসেছিলাম, তাছাড়া প্র্যাকটিসও নেই অনেকদিন। ক্যাডীও পাওয়া যাবে না এখন -বন্ড যেন ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছে এমন ভাব করল।
–আমিও অনেকদিন খেলিনি। (বন্ড মনে মনে বলল, শালা মিথ্যুক) তাছাড়া ক্লাবের অর্ডার দিতে এক মিনিট লাগবে না। গোল্ডফিংগার দোকানের দিকে ঘুরে ব্ল্যাকিং কে বললেন, মিঃ বন্ডের জন্য একজন ক্যাডী দাও না।
দিচ্ছি স্যার।
–তাহলে তো কোন অসুবিধাই নেই।
বন্ড যেন অলসভাবে বলে উঠল, বেশ, ঠিক আছে। তাহলে এবার গোল্ডফিংগারকে নিরুৎসাহ করার চেষ্টায় বলে উঠল, আমি কিন্তু বাজি রেখে খেলি তা আগেই বলে দিচ্ছি। শুধু শুধু বল পিটিয়ে ঘুরে বেড়াতে আমার ভাল লাগে না। বন্ড খুশি হল গোল্ডফিংগারের চোখে নিজের ইমেজ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে বলে।
গোল্ডফিংগারের চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল কি, নির্বিকার চিত্তে বলে, আমার তাতে আপত্তি নেই। তোমার হ্যাঁন্ডিক্যাপ তো নয়, না?
-হ্যাঁ।
গোল্ডফিংগারের সতর্ক প্রশ্ন কোন মাঠে জানতে পারি?
-হান্টার কোম্বা। সানিংডেল মাঠেও আছে। তবে হান্টার কোম্বের মাঠে অনেক সহজ খেলা। গোল্ডফিংগার যাতে ভয় না পান তাই এভাবেই বলল বন্ড। আমার হ্যাঁন্ডিক্যাপও নয় এই মাঠে। এই দেখ বোর্ডে লেখা আছে। সুতরাং সবকিছু সমান সমান।
বন্ড উদাসভাবে বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে অনেক ভাল খেল।
-সে বিষয় সন্দেহ আছে। যাই হোক এক কাজ করা যাক। সহজ গলায় বলে উঠল গোল্ডফিংগার, মায়ামিতে তুলে আমার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে ছিলে মনে আছে, কত? দশ হাজার, জুয়া খেলতে তো আমি ভালই বাসি, তো ঐ টাকাটাই বাজি হিসাবে ধরা যাক।
বন্ড নিরাসক্তভাবে বলল, বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে। তারপর যেন একটু ভেবে, নিজের জেতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে বলল, গলায় ধূর্ততার সুর মিশিয়ে অবশ্য ওটা ফাঁকতালে পাওয়া টাকা সুতরাং হেরে গেলে আফসোেস-এর কিছু নেই। উড়ে আসা টাকা উড়েই চলে যায়। তো দশ হাজারই বাজি রইল। সমান সমান।
গোল্ডফিংগার মিষ্টি গলায় বললেন, সব ঠিক হয়ে গেল তাহলে মিঃ ব্ল্যাকিং। অনেক ধন্যবাদ। তোমার প্রাপ্য টাকা আমি মিটিয়ে দেব। আজ আর তোমার সঙ্গে খেলা হল না বলে দুঃখিত। ও হ্যাঁ, ক্যাডী দুজনের মজুরী নিয়ে নাও।
অ্যালফ্রেড কারখানায় এসে বন্ডের গলফ ক্লাবগুলো নিয়ে বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন চোখের ইশারা করে– আপনাকে যা বললাম মনে রাখবেন স্যার, বল মারবার কায়দাটা বড় বেখাপ্পা, সবসময় খেয়াল রাখবেন।
বন্ড হাসল। সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে এ খেলায় নিশ্চয়ই কোন গুরুত্ব আছে। বন্ড বলল, ধন্যবাদ অ্যালফ্রেড। আমার মনে থাকবে। চারটে হার্টস ছাপ দেওয়া বল বার কর আমার জন্য আর এক ডজন টী। আমি আসছি।
বন্ড দোকানের ভিতর দিয়ে নিজের গাড়ির কাছে এসে কিটব্যাগটা বার করতে গিয়ে দেখল ড্রাইভারটা গাড়ি মোছা। থামিয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে! চৌকো চ্যাপ্টা হলদেটে মুখ। গোল্ডফিংগারের কোরিয়া ভৃত্যদের একজন।
গলফ খেলবার ভাড়া মিটিয়ে পোশাক বদলে, সিগারেট আর লাইটার নিয়ে তৈরি হয়ে নিল বন্ড।
বন্ড আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে মনস্থির করতে চেষ্টা করল। সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে সে গোল্ডফিংগারকে এই চড়া বাজির খেলায় নামতে বাধ্য করেছে। বন্ডের সম্পর্কে তার ধারণা হয় যে সে বেপরোয়া, জাদরেল অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ–যাকে গোল্ডফিংগারের প্রয়োজন হলেও হতে পারে।
বন্ড ভেবেছিল বড়জোর শ খানেক ডলার বাজি ধরবে, সে জায়গায় দশ হাজার! দ্বৈত গলফ খেলার ইতিহাসে বোধহয় এমন কখনও হয়নি। আমেরিকা ও কলকাতার অপেশাদারী প্রতিযোগিতা ছাড়া যেখানে দর্শকরাই বাজি ধরে। মায়ামির পঞ্চাশ হাজার ডলার-এর কিছুটা ফেরৎ নেবার জন্য সে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই বাজি ধরার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ-এর সদ্ব্যবহার করল। তাই হোক, তবে বন্ডের এই খেলায় হারা উচিত হবে না।
দোকান ঘরে গিয়ে গলফ বল আর টী গুলো নিল বন্ড।
ব্ল্যাকিং বলল, আপনার ক্লাবগুলো হকারের কাছে স্যার।
বন্ড মাঠে এল, গোল্ডফিংগার বল মারা প্র্যাকটিস করছেন আর ক্যাডী দাঁড়িয়ে একটা করে বল গড়িয়ে দিচ্ছে তার দিকে। গোল্ডফিংগারের নতুন কায়দা দেখে বন্ড উৎসাহিত হল। সে জানত এখানে প্র্যাকটিস করে লাভ নেই। সেন্ট মার্কস এ প্র্যাকটিসের জমি আর আসল গলফ কোর্সের জমির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।
বন্ডের ক্যাডী হকার নিজের মনে কাল্পনিক বলকে একটা গলফ ক্লাব নিয়ে ঠেঙাচ্ছিল। হাঁটার ভঙ্গিটা অবিন্যস্ত, বেপরোয়া। বন্ড এসে বলল, গুড আফটারনুন হকার।
গুড আফটারনুন স্যার। গলফ ক্লাবটা দিয়ে তিনটে বল মাটিতে ফেলে দিল। ধূর্ততা ও বিদ্রূপ মাখান মুখে। জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন স্যার? গত বিশ বছরে আর গলফ খেলেছিলেন? এখনও পারেন স্টার্টারের ঘরের ছাদে বল পাঠাতে?
বহুদিন আগে ইচ্ছা করে বন্ড দুটো বল মাঠের অপর প্রান্তে স্টার্টারের জানালা দিয়ে গলিয়ে গিয়েছিল।–দেখা যাক। প্র্যাকটিসের মধ্যে গোল্ডফিংগার থেমে গেছে। বন্ড লক্ষ্য স্থির করে ক্লাব হাকাল। বলটা সোজা উপরে উঠে গেল। আবার চেষ্টা করল এবার বলকে স্পর্শও করতে পারল না। ক্লাবের ধাক্কায় খানিকটা দূরে গিয়ে থেমে গেল।
বন্ড হকারের দিকে তাকিয়ে বলল ও দুটো মার লোক দেখান, যাতে আমায় প্রতিপক্ষ সতর্ক না হয়ে যায়। এইবার তোমার মনের মত মার। তৃতীয় বলটাকে এমন জোরে মারল যে সেটা নক্ষত্ৰবেগে একশ ফুট উঁচুতে উঠে গিয়ে আশিফুট দূরের স্টার্টারের চালের ওপর ঠিকরে পড়ল।
বন্ড ক্লাবটা হকারকে দিয়ে দু জনে হকারের পরিবার সম্পর্কে গল্প করতে করতে প্রথমটার দিকে এগিয়ে চলল। গোল্ডফিংগারও তাদের সঙ্গে যোগদিল। তাকে নির্বিকার নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে। গোল্ডফিংগারের ক্যাডীকে অভিবাদন জানাল বন্ড। এই ফুলস নামের খোসামুদে লোকটাকে একেবারেই পছন্দ করে না সে। গোল্ডফিংগারের গলফ ক্লাবগুলির দিকে তাকিয়ে দেখল আমেরিকার বেন হেগান কোম্পানির নতুন ঝকঝকে সেট। দেখতে জমকালো না হলেও খেলার পক্ষে সেরা জিনিস।
এসো টস করি বলে রূপার মুদ্রা ওপরের দিকে ছুঁড়লেন।
টেল।
হেড উঠল। গোল্ডফিংগার জিতলের। নতুন গলফ বলের মোড়ক খুলতে খুলতে বললেন ডানলফ ৬৫, ১ নম্বর। সবসময় এটাতেই খেলি, তোমারটা কি?
পেনফোল্ড। হার্টস।
গোল্ডফিংগার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বন্ডকে বললেন, পুরোটাই গলফ খেলার নিয়ম অনুযায়ী খেলবেন তো?
–নিশ্চয়ই।
-ঠিক আছে। গোল্ডফিংগার মাটিতে পোঁতা টীর ওপর বলটা রাখলেন। ক্লাব চালানোর কায়দা দেখে বোঝা যায় অনেক অধ্যবসায়, অনেক বই পড়ে, পেশাদার প্রশিক্ষকের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তবেই নিখুঁত, যান্ত্রিক ভঙ্গি রপ্ত করেছেন। এ মার অতি কার্যকর, অভ্রান্ত, অত্যন্ত সংকটেও ভুলচুক হবার সম্ভাবনা নেই। বন্ডের হিংসা হল।
গোল্ডফিংগারের ক্লাবের মাথা নিখুঁত ভঙ্গিতে নেমে এল বলের ওপরে। বলটা সোজা গিয়ে পড়ল শ দুয়েক গজ দূরে।
চমৎকার মারা, দেখলেই বোঝা যায় দীর্ঘদিনের অভ্যাস, এখন যতবার ইচ্ছা এইরকম মার মারবেন।
বন্ড নিজের জায়গায় গিয়ে টেনিস র্যাকেট ঘোরাবার ভঙ্গিতে ক্লাব চালাল, গোল্ডফিংগারের থেকে আরও পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে পড়ল বলটা।
দু জনেরই প্রথম মারটা ভালই হল। ক্লাবটা হকারের হাতে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বন্ডের মনে হল এই সর্বশ্রেষ্ঠ মাঠে; চমৎকার দিনটায় কঠিন একহাত গলফ খেলা শুরু হতে চলেছে।
গোল্ডফিংগার আবার সেই নিখুঁত মার মারলেন, সোজা উড়ে গিয়ে বলটা উঁচু জমির কিন্তু আগে মাটিতে পড়ে ডানদিকে ঘুরে গেল। গ্রীন-এর পাশের অসমতল জায়গায় থামল। বল গর্তে ফেলতে হলে তিনবার সময় লাগবে। কিন্তু ভালভাবে মারলে দু বারেই হয়ে যাবে। তার মারটা মারের মত মার হওয়া চাই।
বন্ড এবার নিজের বলের কাছে গেল। বেশ উঁচু আছে বলটা, এবার জোরে মারতে হবে যাতে গ্রীনে গিয়ে পড়ে, আর দু বারেই গর্তে পড়ে যায়। পেশাদার খেলোয়াড়দের একটা নীতির কথা মনে পড়ে গেল বন্ডের–জিততে হলে গোড়া থেকেই জিততে হবে।
কিন্তু বলে আলত মারতেই সে বুঝতে পারল মারটা ভুল হয়েছে। গলফ খেলার ভাল মার ও খারাপ মার এর পার্থক্য অনেক। সুশ্রী ও সুন্দর এ দুটোর মধ্যে যা পার্থক্য তাই। ক্লাবের মাথাটা বলের একচুল নিচে লাগাতে অনেকখানি উপরে উঠলেও বেশিদূর গেল না বলটা।
খারাপ মারলে তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না বন্ড। যা হবার হয়ে গেছে, পরের মারটা এখন ভাল হওয়া দরকার। বালি ভর্তি এক এক বাংকারের ভিতর পড়ে ছিল বলটা, গর্ত তার থেকে কুড়ি গজ দূরে। বল বেশ খাড়া হয়ে আছে। বাংকারে নেমে মারল বন্ড কিন্তু অতিরিক্ত মনঃসংযোগর জন্য আবার বাজে মার হল। গ্রীনের একপাশে গিয়ে বলটা আটকে গেল।
গোল্ডফিংগার মাথা নিচু করে ক্লাব ঘোরালেন, বল এসে থামল গর্তের তিন ইঞ্চি দূরে। বন্ড পরাজয় স্বীকার করবার আগেই সে এগিয়ে গেল দ্বিতীয়টির দিকে। প্রথম গেম হেরে গেছে বন্ড।
বন্ড নিজের বল তুলে হকারের কাছ থেকে ক্লাব নিতে হকার প্রশ্ন করল, ওর হ্যাঁন্ডিক্যাপ কত স্যার?
নয়, আমারও তাই। তবে এর চেয়ে আরো ভাল খেলতে হবে আমায়, দু নম্বর মারটা ভুল হয়েছিল।
হকার তাকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করল এই তো সবে শুরু স্যার।
কিন্তু বন্ড বুঝতে পারছিল কপালে অশেষ দুঃখ থাকলে তবেই এরকম হয়।
.
তীর ও তরী
গোল্ডফিংগার ইতিমধ্যে টীর ওপরে বল বসিয়ে দিয়েছে। বন্ড তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, সঙ্গে হকার। বন্ড বলল, গলফের নিয়ম মেনে চলার কথা হয়েছিল সুতরাং বলটা গর্তে ফেলা উচিত ছিল। যাইহোক তুমি বলটা গর্তে ফেলতে পারতে, এখন এক গেম এগিয়ে গেলে।
গোল্ডফিংগার মাথা নাড়লেন। আবার চমৎকার ভঙ্গিতে বলটা মারলেন।
তিনশ পঁচাত্তর গজ দূরে ২ নম্বর গর্তে এক মারে বল পাঠাবার চেষ্টা করল বন্ড। মনপ্রাণ দিয়ে গায়ের জোরে মারল, আর হাওয়া দিচ্ছিল বলে বলটা উড়ে গিয়ে পড়ল গ্রীনের ঠিক আগে। আর তিনবারে বলটা গর্তে ফেলতে হবে, কিন্তু দু বারেও হয়ে যেতে পারে।
গোল্ডফিংগার হেঁটে চলল সামনের দিকে, বন্ড তার কাছে গিয়ে বলল, তোমার সেই অ্যাগাররা ফোবিয়া কেমন আছে? চারদিক এত ভোলা খারাপ লাগছে না?
-না।
গোল্ডফিংগার গর্তের পাশে লাগান পতাকার দিকে তাকিয়ে পরের মারটা সম্বন্ধে ভাবতে লাগলেন। তারপর সুন্দর মার মারলেন কিন্তু গ্রীনের আগে মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গিয়ে ঘাসজমির মধ্যে পড়ল। বন্ড জানে ওখান থেকে বল বের করা সহজ নয়।
বন্ড নিজের বলটাকে তুলে মারল গ্রীনের দিকে। বলটা থামল গর্তের এক গজ দূরে। গোল্ডফিংগার পরের বলটাকে। পাঠালেন গর্তের থেকে বার ফুট দূরে। বন্ড যদি দু বারের মধ্যে এই এক গজ দূরে থেকে বল গর্তে ফেলতে পারে তাহলেই সে জিতে যাবে। গোল্ডফিংগার হেরে যাবে জেনেও এগিয়ে গিয়ে বল মারল, আবার এক ইঞ্চি দূরে থামল। বলটা। এই খেলায় বন্ড জিতে গেল, গেম দুজনের সমান।
৩ নম্বরের দৈর্ঘ্য দুশ চল্লিশ গজ। প্রথম বলটা বেশ ভাল মারল বন্ড, যেটা গ্রীনের কাছাকাছি কোথাও পড়ল বলটা। গোল্ডফিংগারের ছকে বাঁধা মারটা তেমন জোর হল না। গ্রীনের কাছে না গিয়ে এবড়ো-খেবড়ো মাটির ভিতর আটকে গেল বলটা। এমন জায়গায় পড়েছে বলটা তার ঠিক আগে এক গোছা ঘাস দাঁড়িয়ে। গোল্ডফিংগার স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ কি মনে করে ক্যাডীর কাছে গেলেন ক্লাব নেবার জন্য। যেতে গিয়ে এমনভাবে বাঁ পা ফেললেন বলের আগে, তাতে উঁচু জায়গাটা সমান হয়ে গেল। এবার বল মারতে আর অসুবিধা হল না, গর্তের তিন ফুট দূরে এসে থেমে গেল।
বন্ড এই নির্ভেজাল জোদুরি দেখে ভুরু কোঁচকাল। গলফ-এর ক্ষেত্রে কেউ জোচ্চুরি করলে তার সঙ্গে আর কোনদিন না খেলাই-এর প্রতিকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিকার খাটবে না। এই লোকটির সঙ্গে দ্বিতীয়বার খেলার কোন ইচ্ছাই তার আর নেই। যতক্ষণ না বড় সড় কোন চোট্টামি ধরা না যায় ততক্ষণ এইসব ছোটখাট ছিঁচকেমি নিয়ে। তর্কাতর্কি করায় কোন মানে হয় না। আর বন্ডের কাজ হল তাকে হারান তা সে যতই জোচ্চুরি করুক না।
বন্ডের বল গর্ত থেকে দূরে গিয়ে পড়ল। এখানে থেকে অর্থাৎ কুড়ি ফুট দূরে থেকে গর্তে ফেলা মুখের কথা নয়। কিন্তু বলটাকে গর্তের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। ফের মারতে এক গজ দূরে এসে পড়ল। এবারে খুব কষ্ট করেই বলটা গর্তে ফেলতে হল। গোল্ডফিংগারের বলটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মেনে নিল সে একবারের মারেই গর্তে ফেলতে পারত। এ দানটা ড্র হয়ে গেল।
এখনও খেলা সমান সমান। ৪ নম্বরের দৈর্ঘ্য চারশ ষাট গজ। এ দানটাও ড্র হল।
৫ নম্বরের টীতে বলে বসিয়ে বন্ডের দৃষ্টি চলে গেল দূরে ঝকঝকে সমুদ্র আর পেগওয়েল উপসাগরের ওপারে ঢেউ খেলান সাদা পর্বতমালার দিকে। তারপর নিজের লক্ষ্যস্থল সবুজ ঘাসজমিটা দেখে নিল। আস্তে আস্তে ক্লাব তুলে জোরে মারল বলের গায়ে। হঠাৎ ঠং করে আওয়াজ হয়ে থামতে গিয়েও থামল না, প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল বলকে সঠিক জায়গায় পাঠাতে। ঠং করে আওয়াজ হল, তবে কি মারটা ঠিকমত লাগেনি। দ্রুত মাথা তুলে বলকে দেখল অনেক ওপরে উঠে গেছে। বেশিদূর যেতে পারবেন না বোধহয়। বলটা একটা মাটির ঢিবির ওপর ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে গেল, ঠিক জায়গায় পৌঁছল না বোধহয়।
জ্বলন্ত চোখে গোল্ডফিংগার ও ক্যাডীদের দিকে তাকাল বন্ড। নির্বিকারভাবে গোল্ডফিংগার মাটি থেকে ক্লাবটা তুলছেন। বন্ডের চোখে চোখে রেখে বললেন, দুঃখিত, এটা হাত থেকে পড়ে গেছিল।
-আর যেন না হয়, বন্ড বলল, টী থেকে ঘরে এসে হকারকে ক্লাব ফেরৎ দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। এদিকে গোল্ডফিংগার প্রথম মারে বলকে দুশ গজ দূরে পাঠিয়ে দিলেন।
তারা দুজনে উঁচু জমি থেকে নিচে নেমে আসার সময় অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন ভেসে উঠল, কোথায় যেন কাজ কর তুমি?
[এখানে গলফ খেলার নিয়ম সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া প্রয়োজন। দ্বৈত গল খেলা হয় দু জনের মধ্যে। একটি বিরাট খোলা মাঠে। নির্দিষ্ট স্থানে ১৮টি ছোট গর্ত থাকে। খেলোয়াড়দের কাজ হল গলফ ক্লাব অর্থাৎ গলফ খেলার লাঠি দিয়ে ছোট্ট সাদা বলকে মেরে মেরে এই গর্তগুলিকে ফেলা। যে যত কম শটে বল ফেলতে পারবে তারই জিত। এক একটি গর্তে বল পড়া মানে এক একটি গেম শেষ। যে খেলোয়াড় সব থেকে বেশি গেম জিততে পারবে তারই জয় হবে। প্রত্যেক গেমের শুরুতে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে প্রথম শট মারতে হয় একটা ছোট রবারের টীর ওপর বল রেখে। খেলোয়াড়দের যাচাই করার জন্য মাঠে বিভিন্ন জায়গায় বাধা তৈরি করা হয়। যেমন অসমতল বুনো জমি, উঁচু নিচু জায়গা (বাংকার) ইত্যাদি। গর্তের চারপাশে শুধু খানিকটা সাফ সবুজ জমি থাকে-এর নাম গ্রীন।]
-ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট।
–সেটা কোথায়?
–লন্ডনে। রিজেন্টস পার্কে।
–কি এক্সপোর্ট কর?
তার মনঃসংযোগ নষ্ট করার জন্য এই যাত্রা যে শয়তানী করল তার জন্য বন্ড রীতিমত ফুসফিল রাগে। এবার সজাগ হয়ে উঠল। এটা আসল গলফ খেলা নয়, চাকরির অঙ্গ। লোকটা মার নষ্ট করার চেষ্টা করলেও ওর কথার খোঁচায় গল্প না ফেঁসে যায়, যেটা সে এখুনি বলবে। যে কোন জিনিস–সেলাইয়ের কল থেকে যুদ্ধের ট্যাংক পর্যন্ত।
-তুমি নিজে কি কর?
বন্ড বুঝতে পারল গোল্ডফিংগার তার দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, অস্ত্রশস্ত্রের দিকটা। আরবদেশের শেখ, ভারতের রাজা মহারাজাদের কাছে অস্ত্র বিক্রিতেই সময় কেটে যায়। আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের মতে যারা কোনদিন আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না একমাত্র তাদের কাছেই অস্ত্র বেচা যেতে পারে। — বেশ মজার কাজ গোল্ডফিংগারের গলা বর্ণহীন শোনাল।
-সোজা কোথায়, চাকরি ছেড়ে দেব ভাবছি। ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্যই এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এখানে এসেছি। ভাবছি কানাডা চলে যাব, ইংল্যান্ডে তেমন ভবিষ্যৎ নেই।
-তাই নাকি।
অসমান জমিটা পেরিয়ে এসে বন্ড দেখল বলটা বেশ ভাল জায়গায় পড়েছে। গোল্ডফিংগারের থেকে কয়েক ফুট এগিয়েই আছে সে। গোল্ডফিংগার এবার কিন্তু তার বাঁধাধরা মার মারল না, বদলে শোনা গেল বেমক্কা মারের কেঠো আওয়াজ। বল গড়িয়ে থামল নুড়ি আর পাথরে ভর্তি ভাঙ্কারে।
ভাগ্যলক্ষ্মী তাহলে মুখ তুলে চেয়েছেন। বন্ড যা বলল তাই বোধহয় ভাবছিল গোল্ডফিংগার। কিন্তু এখনো তিনবারে বল গর্তে ফেলা যাবে। বন্ড ক্লাব হাতে নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে নিল।
সহসা তার ডানদিকে টুংটাং আওয়াজ শুনে দেখে বন্ডের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে পকেটের পয়সা নাড়াচাড়া করছে গোল্ডফিংগার। বন্ড তিক্ত হেসে বলল, আমার বল মারা পর্যন্ত তোমার ধনরত্ন নাড়াচাড়াটা বন্ধ করলে ভাল হয়।
গোল্ডফিংগার মুখে কিছু না বললেও আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল।
বন্ড প্রাণপণ চেষ্টা করল এ মারটা ভাল করে মারতে। হকারের কাছ থেকে ক্লাব নিয়ে বলটা ভালই মারল সে। বলটা ভাল জায়গাতে থামল।
গোল্ডফিংগারও নিজের বল বাংকার থেকে বার করে গর্তের কাছাকাছি নিয়ে গেল। কিন্তু বন্ড নিজের দোষে এ গেমটাও ড্র করল।
৬ নম্বর গর্তটাকে কুমারী কন্যা বলে লোকে। পৃথিবীর অন্যতম স্বল্প দৈর্ঘ্যের কোর্ট এটি। টী থেকে গর্ত পর্যন্ত চারদিকে অজস্র বিপজ্জনক বাংকার রয়েছে। বন্ড তুলে মারল যাতে হাওয়ায় বলটা সোজা রাস্তা ধরে উড়ে যায়। গর্ত থেকে কুড়ি ফুট দূরে বলটা। আর দু বারে বল গর্তে ফেলা উচিত। গোল্ডফিংগারের বল গিয়ে পড়ল এক নিচু বাংকারে। ভালই হল, তিনবারের মধ্যে গর্তে ফেলা যাবে না বলটাকে।
চুপচাপ হেঁটে চলল দু জনে। বন্ড বাংকারে দেখল বলটা গভীর গর্তে পড়ে আছে। বন্ড ভাবল এ দানটা সে জিতে যাবেই। ক্লাব নিতে যাবে হকারের কাছ থেকে। দেখে হকার গোল্ডফিংগারের মার দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। একবার গর্তের অবস্থানটা দেখে নিয়ে মারের জন্য প্রস্তুত হল। বন্ড ভাবল বল বারকরার পক্ষে এ মার অচল। এক্ষেত্রে গায়ের জোরে বালি থেকে বল বার করে আনতে হবে। বন্ডকে অবাক করে দিয়ে বলটা বাংকার থেকে উঠে গর্তের মুখের কাছে এসে থামল।
বন্ড ভাবল কি করে এত ভাল মার মারল? যাইহোেক দু বারের মধ্যে বল গর্তে না ফেললে গোল্ডফিংগার জিতে যাবে। বন্ড বল মারল। বলটা গর্তের এক ইঞ্চি পাশ দিয়ে বেরিয়ে এক গজ দূরে থামল। কোথায় তার এগিয়ে যাবার কথা সে পিছিয়ে পড়ল। দূর হতছাড়া, নিজের মনে বলল বন্ড। মন এত বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে যে শেষ মারটারও ঠিকমত মারতে পারল না। এক গেমে পিছিয়ে পড়ল বন্ড।
নিজের ওপর চটে গিয়ে নিজেকেই দায়ী করল এ জন্য। কুড়ি গজ দূর থেকেও ফেলতে পারল না। এবারে মন দিয়ে খেলতে হবে।
পরের দুটো গেম জিতে নিলেন গোল্ডফিংগার আর বন্ড পিছিয়ে পড়ল। হকারের কাছ থেকে নতুন বল নিয়ে তার মোড়ক খুলতে লাগল, গোল্ডফিংগার পরের টীর দিকে যেতেই হকার বলে উঠল, ৬ নম্বরে লোকটা কি করল দেখলেন?
দেখলাম বৈকি। আশ্চর্য মার মেরেছে।
হকার অবাক হয়ে বলল, আরে বাংকারে কি কাণ্ড করল দেখেননি?
-না, আমি খানিকটা তফাতে ছিলাম, কেন বলতো? অন্য দুজন এখন ঢিবির আড়ালে। হকার কোন কথা না। বলে ৯ নম্বরের একটা বাংকারে গেল। সেখানে বলের ওপর গর্ত তৈরি করে বলটাকে রাখল, তারপর ঠিক সেই বলের পিছনে পা জড়ো করে দাঁড়াল। বন্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, বলের অবস্থান দেখতে একবার লাফিয়ে ছিল মনে আছে? বলে নিজেও ছোট একটা লাফ দিল গোল্ডফিংগারের মত। বন্ড দেখল পায়ের ধাক্কায় বালির গর্তটা সমান হয়ে গেছে। বলও অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। বন্ড বুঝতে পারল গর্তের মধ্যে ছিল না বলেই অত সুন্দর মার মারতে পেরেছিল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ক্যাডীকে বলল, ধন্যবাদ, ব্যাট বল আমার হাতে দাও। এ খেলায় তো একজন হারবেই, তবে সেই দলে আমি নেই।
-হ্যাঁ স্যার হকার বলে উঠল। খুঁড়িয়ে হেঁটে চলল ১০ নম্বরের দিকে।
বন্ডও ধীরে সুস্থে এগিয়ে চলল। গোল্ডফিংগার সেখানে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বন্ড তার দিকে না তাকিয়ে মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করল। সৃষ্টিকর্তা যদি দয়া করেন তবেই আডনের মত খেলা দেখাবে সে।
রয়্যাল সেন্ট মার্কস-এর ১০ নম্বর গর্তটি সব থেকে শক্ত। গ্রীনের দিকে দ্বিতীয় শটটা মারতে গেলে ডান বা দুদিকে থাকে অজস্র বাংকার আর তার ওপর উঁচু ঢিবি। এই ১০ নম্বর গর্তে বল ঢোকাতে চৌদ্দটা মার লেগেছিল। তার মধ্যে সাতটা শট শুধু গ্রীনের ওপারে থেকে এপারে, এক বাংকার থেকে অন্য বাংকারে। বন্ডকে কিন্তু চার শটেই শেষ করতে হবে।
পরপর দুটো ভাল মারলেন গোল্ডফিংগার। দ্বিতীয় মারের পর বল এমন জায়গায় পৌঁছল যেখানে দুটো সটে বল গর্তে ফেলা যাবে না। বন্ড হাওয়ার গতি বুঝে নিয়ে বলটাকে আকাশে তুলে দিল। প্রথমে ডান দিকে সরছে মনে হলেও বাঁদিকে সরে এসে বাংকার থেকে দূরে গ্রীনের একপাশে পড়ল যেখান থেকে গর্তের পরিমাপ পনের ফুট। বন্ডের কপাল ভাল থাকলে খেলটা ড্র হবে।
গোল্ডফিংগার যথারীতি ভালভাবে মারলেন, গর্তের এক গজ দূরে দাঁড়াল বলটা। বন্ড মনে মনে বলল, গোল্ডফিংগারকে গর্তে ফেলতে হবে বলটাকে। নিজের বল সে তুলে মারল। মসৃণ ঘাসের ওপর দিয়ে বল চলে যাচ্ছে। সহসা অদৃশ্য চুম্বকের টানে বলটা গর্তে গিয়ে পড়ল। ভাগ্য দেবতা মুখ তুলেছেন। বন্ড হকারের কাছে ফিরে গেল। তার দিকে চোখ টিপে ক্লাব বদলে নিল।
দু জনে ঢাল বেয়ে পরবর্তী টীর দিকে এগিয়ে গেল। গোল্ডফিংগার বললেন, বলটা গর্তে পড়বার বল ছিল না। বন্ড তাচ্ছিল্যভাবে বলল, কপাল ভাল থাকলে সবই হয়। বনই টীর ওপর বল রেখে সব থেকে সুন্দর শটটা মারল। গোল্ডফিংগার তার চিরাচরিত মার মারলেন, তারপর আবার সামনের দিকে এগোলেন। বন্ড জিজ্ঞাসা করল জিল মাস্টারটনের কি খবর?
গোল্ডফিংগার সামনে তাকিয়ে বলল, সে আমার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
বন্ড ভাবল মেয়েটার কপাল ভাল তবে ওর সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে। কোথায় আছে সে?
-বলতে পারব না। গোল্ডফিংগার বলের দিকে এগিয়ে গেলেন। বন্ডের এবারের শর্টটাও দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। গর্তের গজ পঞ্চাশের মধ্যেই আছে কোথাও। গোল্ডফিংগারের মনের অবস্থা বন্ড বুঝতে পারল–সে নার্ভাস হয়ে গেছে। কয়েক গেমে এগিয়ে থেকে হঠাৎ ব্যবধান কমতে শুরু করেছে দেখে। এবারের শটটা যদি দ্রুত শেষ হয়ে যায় তবে বন্ড তেমন আশ্চর্য হবে না, ঠিক তাই হল। গোল্ডফিংগারের বল উঁচু হয়ে গ্রীনের বাঁদিকে বাংকারে পড়ল।
এই হল ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। বন্ড যদি এ সুযোগে খেলা নিজের হাতে না আনতে পারে তবে আর কখনো পারবে না। বন্ডের বল ঢালু জায়গা ছিল, সেখান থেকে মারের চোটে বল গিয়ে পড়ল ছ ফুট দূরে। গোল্ডফিংগার বাংকার থেকে ভালভাবে বল বের করে গর্তে ফেলতে পারল না। বন্ড জিতে গেল। গোল্ডফিংগার মাত্র এক গেমে এগিয়ে। ১২ ও ১৩ নম্বর গর্ত ড্র হয়ে গেল। দু বারই দুজনের পাঁচ শট করে লাগল।
এবার গোল্ডফিংগারের চওড়া কপারে চিন্তার রেখা দেখা দিল। ১৪ নম্বর টীর পাশের কল থেকে পানি খেয়ে নিল। যতক্ষণ না পানি খাওয়া হল বন্ড দাঁড়িয়ে রইল। কারণ বন্ড যদি এখন মারতে যায় তবে হাতে টিনের কাপটি সশব্দে মাটিতে ফেলবেন তাকে বিরক্ত করার জন্য। এই গেমটাও ড্র হল। আর চারটে গেম বাকি, বন্ড এখনো এক গেম পেছিয়ে।
সূর্যের আলো ক্রমশ কমে আসছে আর মানুষের ছায়াগুলি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ১৫ নম্বর গর্তের দ্বিতীয় শর্টটি মারার জন্য তৈরি হল বন্ড। এ শর্টটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গোল্ডফিংগারের থেকে বেশি দূরত্বে বলটা ফেলতে হবে। ক্লাব তুলে মারতে শুরু করবে হঠাৎ বিশাল মাথার ছায়া ঢেকে দিল বলটাকে। বন্ড ক্লাবটা অতিকষ্টে নামিয়ে নিল। তারপর বলের কাছ থেকে সরে এসে মুখ তুলে চাইল। গোল্ডফিংগার নিবিষ্ট মনে আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটার ভান করে যাচ্ছিল।
-তীব্র আক্রোশ চাপা দিয়ে বন্ড বলে উঠল, ছায়া সরাও গোন্ডফিংগার।
গোল্ডফিংগার থেমে গেলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে সরে গেলেন।
বন্ড নিজের বলের কাছে ফিরে গিয়ে সেটাকে গর্তে পাঠান যায় কি করে তার চিন্তা করতে লাগল। কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীর গতিকে স্তব্ধ করে দিয়ে কি করে যে বলটাকে বাংকার গুলির উপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল বন্ড! তারপর সেখান থেকে ছিটকে এসে গর্তের ঠিক মুখটিতে।
হকার এগিয়ে এসে বন্ডের হাতের ক্লাবটা নিয়ে নিল। একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হকার বলল, এমন শর্ট তিরিশ বছরে আমি খুব কম দেখেছি। ভেবেছিলাম ব্যাটা আপনার নার্ভ খারাপ করে দিয়েছে।
-তাই দিয়েছিল হকার। এ শর্টটা আমি মারিনি মেরেছে স্বয়ং অ্যালফ্রেড ব্ল্যাকিং। বন্ড শান্তভাবে বলল, খেলা এখন সমান সমান, আর তিনটে বাকি গেমে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। পাছে আবার না চোট্টামি করে।
–কিছু ভাববেন না স্যার আমি ওর ওপর নজর রাখব।
তারা দু জনে গ্রীনে এসে দাঁড়াল। গোল্ডফিংগারের বল গ্রীনের ওপরে গর্ত থেকে বেশ দূরে। আর বন্ডের বল গর্তের ঠিক দু ইঞ্চি দূরে। গোল্ডফিংগার কোন কথা না বলে নিজের বল তুলে নিলেন। বন্ড জিতে গেল।
১৬ নম্বর গর্তটা ড্র হল। দু জনেরই তিন শর্ট লাগল আর বাকি থাকল দু টো গেম। বন্ড মাঝবরাবর চমৎকার এক শর্ট মারল, গোল্ডফিংগারের মার পড়ল এবড়ো-খেবড়ো জমির মধ্যে। বন্ড উল্লাস চেপে হেঁটে চলল। না, এখান বিভোর হলে চলবে না। এ গেম যদি জিততে পারি তবে পরেরটা ড্র করে দিলেই সে জিতে যায়। মনে মনে প্রার্থনা করল গোল্ডফিগারের খারাপ অবস্থা যেন হয়। বেশি ভাল হয়, বল যদি হারিয়ে যায়।
হকার আগে আগে এগিয়ে গেল। তারা যখন পৌঁছল তার আগে সে ব্যাগ নামিয়ে বল খুঁজতে শুরু করেছে ব্যস্ততাটা বাড়াবাড়ি রকমের মনে হল।
বলটা সত্যি বাজে জায়গায় পড়েছে। বুনোজমি, লম্বা ঘাস, ঘাসের ডগায় শিশির এখনো লেগে আছে। এরকম জায়গা থেকে বল খুঁজে পাওয়া কপালের ব্যাপার। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে পরিষ্কার জমির দিকে তারা এগিয়ে গেল। বন্ড মনে মনে ভাবল ভালই হল বলটা এদিকে আসেনি। হঠাৎ পায়ের তলায় বলের উপস্থিতি। কি করবে মাটির ভেতর বসিয়ে দেবে, হতাশ ভঙ্গি করে বলটার ওপর থেকে ঘাস সরিয়ে দেখল ডানলপ ৬৫ একটা। পেয়েছি বলে হাঁক দিল সে। পরক্ষণেই বলে উঠল না না, তুমি তো ডানলপের–১ নম্বর বলে খেল তাই না।
-হ্যাঁ, গোল্ডফিংগার অধীরভাবে বললেন।
–এটা একটা ৭ নম্বর বল বলে সেটা তুলে নিয়ে গোল্ডফিংগারের দিকে গেল বন্ড।
গোল্ডফিংগার বলটাকে দেখে বললেন আমার নয়। বলে চপার দিয়ে ঘাস সরিয়ে সরিয়ে বল খুঁজতে লাগলেন।
বন্ডের খুঁজে পাওয়া বলটা রীতিমত নতুন। অন্য কোন খেলোয়াড় হারিয়েছিল নিশ্চয়ই। বলটা পকেটে পুরে আবার খোঁজা শুরু করল। হাতঘড়িতে দেখল সময়। খেলার নিয়মানুসারে হারিয়ে যাওয়া বল পাঁচ মিনিটের মধ্যে না পেলে যার বল সে হেরে যাবে। পাঁচ মিনিট হয়ে এসেছে। আধ মিনিটের মধ্যে পাওয়া না গেলে সে বলবে তার জিৎ হয়েছে। গোল্ডফিংগার বলেছিলেন আগাগোড়া নিয়ম মেনে খেলবেন। ঠিক আছে দেখাচ্ছি তোমায় নিয়ম কানুন।
গোল্ডফিংগার খুঁজতে খুঁজতে বন্ডের দিকেই আসছিলেন।
বন্ড বলল, সময় তো প্রায় শেষ।
গোল্ডফিংগার কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার ক্যাভীর চিৎকার, পেয়েছি স্যার এই যে।
বন্ড গোল্ডফিংগারের সঙ্গে এগিয়ে গেল। ক্যাডী দাঁড়িয়ে ছিল অল্প উঁচু জমিতে। নিচের দিকে আঙ্গুল করে বন্ড নিচু হয়ে বলটাকে দেখল। হ্যাঁ, তবে রীতিমত নতুন। আর আশ্চর্য রকমের ভাল জায়গায় বসে আছে। অলৌকিক ব্যাপার। গোল্ডফিংগার ও ক্যাডীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বন্ড বলল, জোর বরাত।
ক্যাডী কাঁধ ঝাঁকাল। গোল্ডফিংগার শান্ত গলায় বলল, সেইরকমই মনে হচ্ছে।
বন্ড চিন্তিতভাবে কয়েক পা হেঁটে ঘুরে দাঁড়াল। গোল্ডফিংগারের সেরা শর্ট হল এটা, অসমতল জমির ওপর দিয়ে গ্রীনের দিকে গেল। ডানদিকের বাংকারেও অবশ্য থাকতে পারে।
বন্ড হকারের কাছে এগিয়ে এল। সে ঘাসের শীষ চিবোতে বিচোতে গোল্ডফিংগারের মার পর্যবেক্ষণ করছিল।
বন্ড তিক্ত হেসে জিজ্ঞাসা করল, প্রিয়বন্ধু বল কি বাংকারে না গ্রীনে পড়ল?
হকার জবাব দিল গ্রীনে পড়েছে স্যার।
বন্ড নিজের বলের কাছে আসতে আসতে ভাবল ভাগ্য লক্ষ্মী আবার বিমুখ হতে চলেছেন। নিশ্চিত জয়ের পথ আবার ড্রয়ের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। দূরের গর্তটাকে মনে মনে মেপে নিয়ে হকারের কাছ থেকে ক্লাব তুলে নিল।
ক্লিক করে আওয়াজ হতে বলটা উঁচু হয়ে গিয়ে গ্রীনের কাছে পড়ল। বাজে শট হল এবার দ্বিতীয়বার ড্রপ খেয়ে গ্রীনের একপাশে থেমে গেল, তারপর গড়িয়ে নিচে এসে দাঁড়াল বলটা। দূর গ্রীনের নিচে থেকে বল মেরে গর্তের কাছে নিয়ে যাওয়া খুব শক্ত। পরের শটটা ঠিকমত মেরে গেম ড্র করে দেবে। মাথায় কেবল একটাই চিন্তা, অবশ্য যদি গোল্ডফিংগার তিরিশ ফুট দূর থেকে বলটা গর্তে ফেলে দেয়, তাহলে আলাদা কথা।
পাশাপাশি হাঁটার সময় বন্ড বলল, বলটা যে কি করে খুঁজে পেল জানি না। আশ্চর্য ব্যাপার।
—ওটা ওর বল নয় স্যার হকার বলল।
-মানে উত্তেজিত হয়ে পড়ল বন্ড।
ওর ক্যাডীকে ঘুষ খাইয়েছে, আমি নিজে দিতে দেখেছি। নোট দেখে মনে হল পাঁচ পাউন্ড। ফুকস অন্য একটা বল রেখে দিয়েছিল ওখানে। বন্ড দেখল গোল্ডফিংগার ঘড়ি গ্রীনের দিকে হেঁটে চলেছে, সে হকারকে কড়া গলায় প্রশ্ন করল, তুমি একথা বলতে পার কি করে? এত নিশ্চিত হলেই বা কি করে?
হকার অপ্রস্তুত, বাঁকা হাসি হাসলেও মুখের ধূর্ত ভাব বজায় রেখে বলল, তার আগে আমি বলটা লুকিয়ে ফেলেছিলাম স্যার।
বন্ড আশ্চর্য হয়ে গেছে দেখে সে না চেয়ে বলল, দ্রলোক যেরকম জোচ্চুরি করছে আপনার সঙ্গে তাতে এ কাজ করে থাকতে পারলাম না। আপনাকে জানতাম না, কিন্তু আরও একটা বড় রকমের চোট্টামি করেছেন বলেই কথাটা বললাম। বন্ড হেসে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে তুমি একটা শয়তান হকার! নিজের চেষ্টায় আমাকে জেতাচ্ছিলে! তারপর তেতো গলায় বলল, কিন্তু লোকটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ওকে শায়েস্তা করতেই হবে, দাঁড়াও মাথা খাঁটিয়ে বার করি একটা ব্যাপার।
বন্ডের বাঁ হাত ছিল প্যান্টের পকেটে। একটু আগের হারিয়ে পাওয়া বলটা নিয়ে নাড়া চাড়া করছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত একটা মতলব চলে এল মাথায়। হকারের কাছে সরে সে বললেন এই নাও ধর। বলে একটা বল গুঁজে দিয়ে বলল, এই গেমের শেষে তুমি বল কুড়িয়ে নিয়ে এই বলটা রেখে দেবে। সে যেই জিতুক না কেন।
হকার সহজ ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বলল বুঝেছি স্যার।
হকার গ্রীনের ওপর উঠে গেল। গোল্ডফিংগার দাঁড়িয়ে আছে গ্রীনে নিজের বলের পাশে। ক্যাডী নিচে দাঁড়িয়ে। বন্ড বল মারবার জন্য ঝুঁকে পড়ল। ক্লাবের ঠিক মাঝখানে লেগে বল সোজা এগিয়ে চলল, গিয়ে থামল গর্তের তিন ইঞ্চি দূরে।
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট তুলে নিল বন্ড গোল্ডফিংগারের দিকে তাকাল। এস! এক শর্টে বল গর্তে ফেলেছে তো তোমার গলা কাটব বন্ড ভাবল। কিন্তু গোল্ডফিংগার তেমন সাহস করল না, বল গর্তের দু ফুট দূরে এসে থামল।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে। উদার ভাবে বলে উঠল বন্ড। খেলা সমান সমান, আর এক গেম বাকি। বলটা যদি হকার না তোলে তো প্ল্যানটা বানচাল হয়ে যাবে, যদি গোল্ডফিংগারকে বল গর্তে ফেলতে বলত তবে শেষ বল তিনিই গর্ত থেকে বার করতেন। তাছাড়া বন্ড চায়ও না যে গোল্ডফিংগার হেরে যান। এটা মতলবের অঙ্গ নয়।
হকার নিচু হয়ে বলজোড়া তুলে নিল বন্ডের দিকে একটা দিয়ে অন্যটা দিল গোল্ডফিংগারের হাতে।
গ্রীন থেকে বেরিয়ে এল তারা। গোল্ডফিংগার আগে আগে হাঁটছেন। বন্ড লক্ষ্য করল হকার সবার অলক্ষ্যে হাত পকেটে ঢোকাচ্ছে, এখন টীতে বসাবার সময় গণ্ডগোল না করলেই রক্ষে।
গলফ খেলার অন্যতম নিয়ম এখন থেকে শেষ পর্যন্ত একই বলে খেলতে হবে। কোন গেমে অন্য বল নিয়ে খেলা মানে গেম হেরে যাওয়া।
কিন্তু সতের গেম পরে কোন খেলোয়াড়ের বল পরীক্ষা করার কথা মাথায় আসে না। হাত পা গুলো যন্ত্রের মতে চলতে শুরু করে। কিভাবে বল মারতে হবে, বল ফেলতে হবে, হাওয়া কোনদিন এবং সব থেকে বড় কথা চার শর্টে গেম শেষ করা যায় কিনা সে চিন্তাই মাথায় থাকে।
বন্ড এখন শুধু ভাবছে গোল্ডফিংগার যদি বলটাকে শর্ট মারতে পারেন তাহলেই কেল্লাফতে। এরকম চিন্তা করা সত্ত্বেও বন্ডের প্রথম মার ভালই হল, পরের মারেই পৌঁছে যাবে সে।
এবার গোল্ডফিংগার টীতে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঝুঁকে পড়ে বল বসালেন, সোজা হয়ে বসে আছে বলটা। সতর্ক স্থির পায়ে বলের কাছে এসোঁড়ালেন, একদৃষ্টে বলের দিকে চেয়ে আছেন।
বুঝতে পারবেন নিশ্চয় জোচ্চুরিটা, কিন্তু না। বাঁ হাটু সঠিকভাবে মুড়ে ক্লাব চালালেন। কড়াৎ করে শব্দ হল। চমৎকার মার হয়েছে গোল্ডফিংগারের। .
বন্ড মেতে উঠল খুশিতে। এইবার তোমায় বাগে পেয়েছি। প্রফুল্ল মেজাজে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, মনে মনে পরের শটগুলো ভাবছে। এখন যে রকম খুশি মারলেও কিছু যাবে আসবে না। গোন্ডফিংগার নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে গেছেন। এবার তাকে আস্তে আস্তে খেলিয়ে ওপরে তুলতে হবে।
কোনরকম অনুশোচনা নেই বন্ডের। দু দুবার চোট্টামি করলেও রেহাই পেয়ে গেছেন। গোল্ডফিংগার অনেকবার ছোটখাট অপরাধ, বন্ডের মনে বিক্ষিপ্ত করতে চেষ্টা করছিলেন তাছাড়া সব ছেড়ে দিলেও ১৭ নম্বরে যেটা করলেন সেটা না করলে অনেক আগেই বন্ড জিতে যেত। এখন যদি একটা মাত্র জোছুরি দিয়ে সব শোধ তোলা যায় তাহলে কোন ক্ষতি নেই। এই খেলায় জিততেই হবে বন্ডকে। হেরে গেলে শোধ হয়ে যাবে। আর জিতলে দু ধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে। গোন্ডফিংগার নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে করেন, তাই দুবার পরাস্ত হওয়ার ধাক্কা হজম করা তেমন সহজ হবে না, ফলে গোল্ডফিংগার মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে এই বেপরোয়া মেজাজের লোক, মাথায় বুদ্ধিও আছে একে কাজে লাগান যেতে পারে। বন্ড ভাবল হয়ত তেমন কোন কাজই পাবে না সে। হয়ত গোল্ডফিংগারের মনস্তত্ত্ব সে বুঝতে পারেনি, আর লোকটার ওপর প্রভাব বিস্তার করার অন্য কোন পথ অজানা বন্ডের।
গোন্ডফিংগারের পরের শটটা ভালই হল। পাঁচ কি চার শর্টে গেম শেষ বুঝতে পারলেন। অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না।
প্রচুর মনঃসংযোগের অভিনয় করে ক্লাব চালাল বন্ড, বল গিয়ে পড়ল বাংকারের ওপরে। পরের শর্টে সেটা গ্রীনের ওপরে গর্ত থেকে কুড়ি ফুট দূরে হবে। এটাই চাইছিল সে। গোল্ডফিংগারকে খুব খেটে তবেই এ গেম জিততে হবে।
এবার গোল্ডফিংগার সত্যি-সত্যিই ঘামছেন, একাগ্রতা ও লোভ মেশান অদ্ভুত বন্য হাসি তার মুখে। বল মারবার জন্য ঝুঁকে পড়লেন বেশি জোরে না, বেশি আস্তেও না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছয় পদক্ষেপে গ্ৰীনের ওপর দিয়ে গর্তের কাছে গিয়ে দেখলেন বলের লাইন ঠিক আছে কিনা। তারপর আবার নিজের জায়গায় এসে ক্লাব দোলালেন–কপালে গভীর মনঃসংযোগের খাজ।
বল মারলেন গোল্ডফিংগার। গল্পে ছ ইঞ্চি দূরে গিয়ে থামল। পরের শর্টেই বল গর্তে ঢুকে যাবে। বন্ড যদি তার বল চতুর্থ শটে না ফেলতে পারেন তাহলেই ম্যাচ জিতে যাবেন তিনি।
বল মারার আগে অনেক ভনিতা করল বন্ড, যাতে একটু সাসপেন্স তৈরি হয়।
-ফ্ল্যাগ সরিয়ে নাও, সোজা গর্তে ফেলব বল আমি যেন কেউ প্রতিজ্ঞা করল। তারপর ঝুঁকে পড়ে গর্তের বেশ খানিকটা ডানদিক দিয়ে বল বার করে দিল।
–দুত্তোর পারলাম না! গলায় যথেষ্ট পরিমাণ তিক্ততার সুর। তারপর গর্তের কাছে গিয়ে তোক দেখিয়ে বলটা তুলে নিল।
গোল্ডফিংগার আনন্দে নেচে উঠল, বললেন, ধন্যবাদ আমার সঙ্গে খেলার জন্য। সত্যই আমি তাহলে ভাল খেলি।
– নয়ের হ্যান্ডিকাপ ভালই খেল। গোল্ডফিংগারের বল ফেরত দেবার জন্য হাতের বল দুটোর দিকে তাকাল। পরক্ষণেই যেন ভীষণ চমকে উঠল, এ কি ব্যাপার? তুমি তো ডানলপের ১ নম্বর বলে খেল তাই না?
-হ্যা! অজানা আশঙ্কায় গোল্ডফিংগারের মুখ শুকিয়ে গেল, কেন কি হয়েছে।
-দুঃখিত, তুমি ভুল বল নিয়ে খেলছিলে। এই আমার পেনফোল্ড হার্টস আর এটা ৭ নম্বর ডানলপ। বল দুটো গোল্ডফিংগার ছিনিয়ে নিয়ে উত্তেজিতভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগল।
আস্তে আস্তে গোল্ডফিংগারের মুখ টকটকে লাল হয়ে গেল। একবার বন্ডের দিকে একবার বলের দিকে তাকাল।
বন্ড বলল, দূর্ভাগ্যবশতঃ এ খেলায় গলফের সব নিয়ম মেনে চলার কথা হয়েছিল। তার মানে এ গেমটা হেরে গেল ভুল বলে খেলার জন্য। এবং সেই সঙ্গে গোটা ম্যাচটাতেও।
-কিন্তু কিন্তু…।
বন্ড ঠিক এটাই চাইছিল, তীরে এসে তরী ডুবল। মুখের কাছ থেকে কেউ যেন খাবার ছিনিয়ে নিল।
গোল্ডফিংগারের মুখ সহসা রাগে ফেটে পড়ল ঐ বুনো জমিটাতে তুমি ৭ নম্বর ডানলপ পেয়েছিলে। আর তোমার ক্যাডীই তো ওটা আমায় দিয়েছিল। ও নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে ভুল বল দিয়েছে আমায়, ব্যাটা জোচ্চর।
–আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আর এগোলে মানহানির মামলায় পড়বে। হকার তুমি কি কোন ভুল করে বা অন্য কারণে গোল্ডফিংগারকে ভুল বলে দিয়েছিলেন?
-না স্যার, হকার নির্বিকার। বলল আমার মতামত যদি চান স্যার আমি বলব আগের গেমেই কিছু গোলমাল হয়েছিল। তখন বল যেদিকে গিয়েছিল তার অনেক দূরে বলটা পাওয়া গেল। ডানলপের ১ ও ৭ একই রকম দেখতে। আমার মনে হয় ভুল বলটা পেয়েছিলাম আমরা। আর ভদ্রলোক যেভাবে শর্ট মেরেছিলেন তাতে ঐ জায়গায় পড়া অসম্ভব।
-যত্তো সব বাজে কথা। সক্রোধে বন্ডকে বলল, আমার ক্যাডী যে বলটা পেয়েছিল সেটা তো ১ নম্বরই ছিল।
বন্ড বলল, দুঃখের বিষয় আমি অতটা খেয়াল করিনি। তাছাড়া বল ঠিক আছে কিনা দেখে নেওয়া খেলোয়াড়ের কর্তব্য তাই না? যদি ভুল বলে নিয়ে শর্ট মেরে থাক তাহলে তোমারই ভুল। যাক খেলবার জন্য ধন্যবাদ! আবার একদিন খেলব তোমার সঙ্গে।
গোল্ডফিংগার-এর দীর্ঘ শরীর ছায়ায় মিশে যাচ্ছে, চিন্তাগ্রস্তভাবে বন্ডকে দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলেন।
.
বাগানবাড়ি
কিছু কিছু বড়লোক আছেন যারা নিজেদের সম্পত্তিকে মুগুরের মত ব্যবহার করেন। আরাম করে বাথটবে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল বন্ড। গোল্ডফিংগার-সেই জাতেরই লোক। তারা মনে করে পৃথিবীটাকে ঐশ্বর্যের পদাঘাতে চ্যাপ্টা করা যায়, অপমানিত করা যায়–সবরকম বিরক্তিকর ব্যাপার ও বিরোধিতাকে। তিনি ভেবেছিলেন দশ হাজার পাউন্ড বাজি ধরে বন্ডের নার্ভ নষ্ট করে দেবেন–কারণ টাকার অঙ্কটা তুচ্ছ হলেও বন্ডের কাছে ছোটখাট ঐশ্বর্যের সমান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কায়দা ফলপ্রসু হতে বাধ্য, কারণ আঠার গেম ধরে প্রতিটি শর্টে একটা বিশাল অঙ্কের বোঝা নিয়ে বাজি, তাতে খেলা খুব শক্ত।
কিন্তু বন্ডের কথা আলাদা। বন্ড এই উত্তেজনায় অভ্যস্ত। দীর্ঘদিন ধরে একটানা স্নায়বিক চাপ আর বিপদের ঝুঁকি সহ্য করতে করতে তার স্নায়ু শক্ত হয়ে গেছে।
কিন্তু সত্যিই কি গোল্ডফিংগার পরাজিত? চিন্তিত মুখে গা মুছতে শুরু করল বন্ড। গোল্ডফিংগার এখন নিশ্চয়ই চিন্তা করতে শুরু করেছে কি করে দু দুবার বন্ড তার সব প্ল্যান বানচাল করে দিল। বন্ড কি ঠিক পথে চলছে গোল্ডফিংগার এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবেন না কি বন্ডের ক্ষমতা বুঝে সতর্ক হয়ে যাবেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আর কখনও বন্ডের ধারে। কাছে আসবে না সে, অগত্যা তদন্ত থেকে বিদায়, এবং এক অন্য পথ খুঁজে বার করতে হবে। মাছ টোপ গিলেছে কি না কি করে জানতে পারবে?
শোবার ঘরে দরজায় টোকা পড়ল, বন্ড খুলে দেখল একজন বেয়ারা।
-কি ব্যাপার।
–মিঃ গোল্ডফিংগার নামে একজন আপনাকে টেলিফোনে সংবাদ পাঠিয়েছেন। তিনি অনুরোধ করেছেন আজ নৈশভোজ তাঁর বাড়িতে করতে হবে। সে জন্য রেকুকারে সন্ধ্যা সাড়ে ছ টার মধ্যে চলে আসতে বলেছেন স্যার।
–ওনাকে ফোনে বলে দাও নিমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করেছি। দরজা বন্ধ করে খোলা জানালায় দাঁড়াল বন্ড। শান্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে-ভাবল তাহলে মাছ টোপ গিয়ে ফেলল।
ছ টার সময় বন্ড নিচে নামল, একটা গাড়ি নিল, বারটা একেবারে ফাঁকা তবে কিছু বিমান বাহিনীর অফিসার আছে। বন্ড আপন মনে ভাবল এরা হয়ত প্লেনে করে যেতে যেতে আমাদের দেখে থাকবে।
ধীরে সুস্থে গন্তব্যস্থলের দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার আবহাওয়া, পানীয়, গাড়ির এগজস্টের মৃদু গুঞ্জন উপভোগ করতে করতে চিন্তা করল নৈশভোেজটায় একটু কিছু ভুল হলে সব ভেস্তে যাবে। তারপরে তদন্তে নামা দুরুহ। হবে। তাছাড়া সঙ্গে কোন অস্ত্র নেয়নি। মুহূর্তের জন্য দ্বিধা হল নিরস্ত্র অবস্থায় শত্ৰু পুরীতে পা রাখার জন্য, পরক্ষণেই সে দ্বিধা কেটে গেল। তাদের দুজনের মধ্যে তো মিত্রতাই আছে এখনও।
বিকেলে বিদায় নেবার সময় যথেষ্ট শিষ্টতা বজায় রেখেছিলেন গোল্ডফিংগার। জিজ্ঞেস করেছিলেন বাজির টাকা কোথায় পাঠাবেন। বন্ড তাকে ইউনিভার্সাল এক্সপোর্টের ঠিকানা দিয়েছিল। তারপর কোন হোটেলে আছে জিজ্ঞাসা করেছিল। বন্ড তাকে হোটেলের নাম দিয়েছিল আর বলেছিল র্যানসগেটে থেকে ভবিষ্যতের প্ল্যান করবে সে। গোল্ডফিংগার তাকে জানিয়েছিল সে এখন ফ্রান্সে যাচ্ছে কবে ফিরবেন ঠিক নেই। তারপর তার এক্সরে দৃষ্টি বন্ডের দিকে চালিয়ে হলুদ গাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল।
বড় রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা ধরল বন্ড। এগিয়ে চলল নুড়ি বিছান পথ দিয়ে। বাগান বাড়িটা পুরনো আমলের এক প্রাসাদ, কেমন বাজে দেখতে। বাড়িটার পিছন দিক থেকে একটানা গমগমে আওয়াজ ভেসে আসছে। এ শব্দ কারখানার। উঁচু গাছগুলো ছাড়িয়ে চিমনিটা মাথা উঁচু করে আকাশে দাঁড়িয়ে আছে।
দরজার সামনে এসে বেলা বাজাল বন্ড। নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল, সামনে গোল্ডফিংগারের কোরিয়ান ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। নিরুৎসাহ চাহনি দিয়ে বন্ডের দিকে তাকাল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাত সিগন্যালের মত তুলে দিল ছায়ায় ঘেরা হল ঘরের দিকে।
বন্ড পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকল। কেন যেন সহ্য করা যাচ্ছে না লোকটাকে। মনে হচ্ছে পালিশ করা জুতার ওপর পাটা দিয়ে পিঠে দিতে, নয়ত কালো সুটে মোড়া স্ফীত মধ্য প্রদেশে লাথি কষাতে। এ চাপা ঘরের আবহাওয়াকে এক উন্মত্তের মত ধাক্কা দিয়ে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
এই নির্জন হলঘরটি এ বাড়ির প্রধান ঘর। প্রশস্ত চুল্লীতে আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি, সামনে একজোড়া চেয়ার ও একটা সোফা যেন চুপচাপ পড়ে আছে। চেয়ারগুলোর পেছনে নিচু সেন্টীর ওপর ট্রে ভর্তি পানীয়ের বোতল। এছাড়া সমস্ত ঘরে পুরনো জামানার আসবাবপত্র। বন্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখার মধ্যে কোরিয়ান লোকটি এগিয়ে এল। আরেকবার হাত তুলে পানীয়ের ট্রে ও চেয়ার কে দেখাল। বন্ড ঘাড় নাড়লেও নিজের জায়গা থেকে সরল না। লোকটি অন্য একটি ঘরের ভেতর চলে গেলে আন্দাজে বোঝা গেল সেটা চাকরদের ঘর। বিশাল আকৃতির কারুকার্য করা দেওয়াল ঘড়ির শব্দ নৈঃশব্দকে আরো গভীর করে তুলেছে।
বন্ড ফায়ার প্লেসের সামনে গিয়ে পিঠ করে দাঁড়াল। সেখান থেকে ঘরটাকে ভীষণ বিশ্রী লাগছে। বন্ড ভাবতে লাগল, বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে যখন অনেক জায়গা, প্রচুর আলো বাতাস রয়েছে তখন সেগুলো ছেড়ে এই চিরহরিৎ গাছ গাছালিতে ঘেরা বিলাসবহুল কুঠুরিতে কি করে মানুষ দিন কাটাচ্ছে। সিগারেট ধরিয়ে আবার ভাবল গোল্ডফিংগারের জীবন, আনন্দেও দৈহিক সুখ কিভাবে উপভোগ করেন, না তার এসবের দরকার হয় না। সোনার পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে হয়ত এ সবের সময় পান না।
দূর থেকে টেলিফোনের তীক্ষ্ণ শব্দ আসছিল। কিন্তু দু বারের পরেই বন্ধ হয়ে গেল। একজনের মৃদু গলা শোনা গেল, তারপরই পায়ের আওয়াজ কানে ভেসে এল। সিঁড়ির দরজা খুলে গোল্ডফিংগার এলেন। আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা। খয়েরি রঙের ডিনার জ্যাকেট পরে পালিশ মেঝের ওপর দিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন। সৌজন্যবশত করমর্দন করে দেতো হেসে বললেন, তুমি যে সংক্ষিপ্ত নিমন্ত্রণে এসেছ তার জন্য ধন্যবাদ, আমরা দুজনেই তো একলা তাই ভাবলাম একটু গল্প করা যাক।
এ ধরনের কথাবার্তা উচ্চবিত্তদের সমাজেই হয়। গোল্ডফিংগার যে বন্ডকে নিজের সমকক্ষ হিসেবে দেখছেন এতে মজা পেয়ে বন্ড বলর, নেমন্তন্ন পেয়ে তো আমি খুশি। ঝামেলা দিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। তাছাড়া র্যামসগেটে সময়ে কাটাবার জায়গাও তো নেই।
-তা নেই। আচ্ছা, কিছু যদি মনে করো, আমার এই মাত্র একটা ফোন এসেছিল, আমারই এক কোরিয়ান কর্মচারি কাছের এক মেলায় কি গণ্ডগোল করেছে মাথা গরম করে, তাই পুলিশী ঝামেলা হয়েছে একটু সেটা মেটাতে আমাকে বেরতে হবে। ড্রাইভার আমার সঙ্গেই যাবে। আমার আধ ঘণ্টা মতন লাগবে কাজ সারতে, তা তুমি ততক্ষণ বই পড়, পানীয়ও নিতে পার। আশা করি আমার মাফ করে দেবে। কথা দিচ্ছি আমরা এখনই ফিরে আসব।
-তাতে কি হয়েছে। মুখে এই কথা বললেও বন্ড যেন একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেল, গোল্ডফিংগারের কি যে মতলব বোঝা যায় না।
-ঠিক আছে, চলি তাহলে, কিন্তু তার আগে আলো জ্বালিয়ে দিই, ঘরটা বড় অন্ধকার। গোল্ডফিংগার একরাশ সুইচ টিপতেই সারা ঘর ঝলমল করে উঠল। সাধারণ বাতি, ব্র্যাকেটে লাগান বাতি, ঝাড়বাতির আলোর বন্যায় ঘর ভেসে যেতে যেতে দেখল গোল্ডফিংগার বেরিয়ে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গেই অন্য গাড়ির একটা শব্দ।
পুরনো অভ্যেসমত দরজার বাইরেটা একবার খুলে দেখে নিল। সব ফাঁকা। গোল্ডফিংগারের গাড়িটা বাদিকে ঘুরে রাস্তায় পড়ল, তারপর মার্কেটের দিকে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল বন্ড। শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ। ঘরের অন্যদিকে গিয়ে অন্য একটা দরজা খুলল, একটা লম্বা, অন্ধকার সুরু রাস্তা চলে গেছে বাড়ির পিছনদিক পর্যন্ত। দরজা বন্ধ করে আলোয় ভরা ঘরটাকে দেখে মনে হল এই ঘরের যাবতীয় গুপ্তরহস্য জানবার জন্য একলা রেখে দেওয়া হয়েছে বন্ডকে। কিন্তু কেন?
ট্রে থেকে কড়া এক গ্লাস জিন অ্যান্ড টনিক ঢালল। সে ভাবল ফোন এসেছিল ঠিকই, তবে পাশের কারখানা থেকেও তো ফোন আসার ব্যবস্থা করা যায়, চাকরের পুলিশে ধরার কাহিনীটাও যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য, তাছাড়া বারবার বলেছেন আধঘন্টা দেরি হবে, আর বন্ডকে একলা থাকতে হবে। তবে কি বন্ডের সামনে টোপ ফেলেছেন। কেউ কি নজর রাখছে। তার ওপর? একজন কেউ আছে এ বাড়িতে, এইসব চিন্তা করতে করতে ঘড়ির দিকে তাকাল, পাঁচ মিনিট হয়েছে। সবে।
বন্ড মনস্থির করল, ফাঁদ হোক আর যাই হোক এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। ঝট করে বাড়িটা একবার দেখে নিতে হবে–তবে এমনভাবে যাতে ধরা পড়লে অজুহাত দেওয়া যায়। কি জবাব দেবে সে? গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই মিস্ত্রী ডাকতে কারখানায় গিয়েছিল। এতেই মনে হয় কাজ চলে যাবে বলে পানীয়টুকু শেষ করে বেরিয়ে এল।
আলোর সুইচটা দেখতে পেয়ে আলোটা জ্বালিয়ে দ্রুত প্যাসেজ ধরে এগিয়ে গেল। প্যাসেজের শেষে দেওয়াল আর দুদিকে দুটো দরজা। একটার থেকে রান্না বান্নার শব্দ আসছে। ডানদিকের দরজা খুলে দেখল একটা উঠোন আর আশ্চর্যের বিষয় উঠোনে আলো ঝলমল করছে। উঠোনের ওপাশ থেকে যন্ত্রপাতির শব্দ কানে আসছে, কারণ ওটাই কারখানার দেওয়াল।
ঠিক সামনের দেওয়ালে একটা কাঠের দরজা। বন্ড এদিক-ওদিক স্বাভাবিক ভাবে দেখে ভোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল। সামনেই ছোট একটা অফিসঘর, আরো জ্বলছে। সামনে ডেস্কে কিছু কাগজ, একটা টাইম লক, দুটো ফাইলিং ক্যাবিনেট আর একটা টেলিফোন। অফিস থেকে কারখানায় যাবার জন্য একটা দরজা, পাশে ছোট জানালা-কর্মীদের ওপর নজর রাখার জন্য বোধহয়। এটা ফোরম্যানের অফিস। বন্ড এবার জানালার বাইরে তাকাল।
বিশেষ কিছু দেখতে পাবে না জানত, তবে যা দেখল তা ঢালাইয়ের কারখানাতেই থাকে। সামনে দুটো ফার্নেস, তার পাশে একসারি ধাতু গলানোর চুল্লী, দেওয়ালে নানা রঙের নানা সাইজের ধাতুর পাত দাঁড় করান। ডানদিকে আর্কলাইটের নিচে পাঁচজন লোক কাজ করছে, চারজনই তাদের মধ্যে কোরিয়ান, যেটা নিয়ে কাজ হচ্ছে সেটি গোল্ডফিংগারের রোলস রয়েস গাড়ি।
গাড়িটা, আলোয় ঝকঝক করছে, শুধু সামনের ডানদিকের দরজাটা খুলে নেওয়া হয়েছে। দরজাটা রাখা হয়েছে। একটা বেঞ্চে, ধাতব প্যানেলটা এতে নেই। দু জন মিস্ত্রী অ্যালুমিনিয়ামের নতুন প্যানেল এনে দরজার ফ্রেমে লাগল। বন্ড ভাবল এবার বোধহয় ওটাকে আটকে রঙ করে দেওয়া হবে। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে সহজ মনে হল। বিকেলের দিকে হয়ত প্যানেলটা দুমড়ে গিয়েছিল তাই তাড়াতাড়ি সারিয়ে দেওয়া হচ্ছে কালকের জন্য। বন্ড হতাশ চোখে একবার সব দিকটি দেখে জানালা থেকে সরে এল। কারখানার দরজাটা বেরিয়ে এসে বন্ধ করে দিল। দূর, কিছু নেই। কিন্তু এই পালিয়ে আসার জবাব কি দেবে? বলবে যে ভেবেছিল খাওয়া দাওয়ার পর একেবারে কাজটা করিয়ে নেবে।
বন্ড আর কোনখানে না গিয়ে সোজা নিজের জায়গায় চলে এল।
ঘড়ি দেখল আর দশ মিনিট বাকি, এবার দোতলায় যেতে হবে। যে কোন বাড়ির যাবতীয় গোপন তথ্য থাকে। বাথরুমে বা শোবার ঘরের এই সব জায়গাতেই, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল বিছানার পাশের দেরাজ ইত্যাদি। বন্ড মাথা ধরার অভিনয় শুরু করে ওপরের দিকে তাকাল তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল দোতলায়। উপরে সামনে গ্যালারী, তারপর প্যাসেজ। দরজা খুলে এক ঝলক দেখে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। প্রথমে কয়েকটা বাড়তি শোবার ঘর। বড়ই অগোছাল, ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে। হঠাৎ বাদামী রঙের বড় একটা বেড়াল তার কাছে এসে ঘুর ঘুর করতে লাগল। প্যাসেজের শেষে গোল্ডফিংগারের শোবার ঘরে ঢুকে দরজাটা একটু খুলে রাখল।
ঘরের সব আলো জ্বলছে। বাথরুমে কেউ আছে ভেবে সোজা গিয়ে দরজা খুলল। না জনপ্রাণী নেই। বাথরুমটা বেশ বড়। অনেক ব্যায়ামের সরঞ্জাম আছে। আলমারিতে নানান জাতের জোলাপ ছাড়া অন্য কোন ওষুধ নেই। পুরুষ মানুষের শোবার ঘর যেমন হওয়া উচিত এটাও সেরকমই আরামদায়ক, বহু ব্যবহৃত। দেওয়ালে অনেকগুলো ছোট আলমারি, বিছানার একপাশে একটা বুককেসে ইতিহাস ও জীবনী সাজান–সবই লেখা ইংরাজি ভাষায়। পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে প্যারিসের প্যালেডিয়ান পাবলিকেশান-এর প্রেমের গোপন কথা বইটি পাওয়া গেল। এই একটিই বিশ্রী জিনিস পাওয়া গেল।
বন্ড ঘড়ি দেখল, তার আসতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়ে ষষ্ঠইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। কোথাও অসামঞ্জস্য আছে এই ঘরে, কোন অস্বাভাবিক রঙ, গন্ধ? শব্দ? ঠিক! এখান থেকে শোনা যাচ্ছে। অতি মৃদু মশার বো বো আওয়াজের মত একঘেয়ে শব্দ। আওয়াজটা এত ক্ষীণ যে শোনাই যায় না। কোথা থেকে আসছে এই শব্দ?
উত্তেজিতভাবে বন্ড দরজার পাশের দেয়ালে লাগান আলমারিটার ডালা সন্তর্পণে খুলল। হা-এর ভিতর থেকেই আসছে শব্দটা, কোট সরিয়ে জিনিসটা দেখামাত্র বন্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
আলমারির ওপরের দিকে তিনটে ফুটো আর তার ভিতর দিয়ে তিন লাছি ১৬ মিলিমিটার ফিলন একে বেঁকে জমা হচ্ছে সাজান ড্রয়ারগুলোর পেছনে রাখা পাত্রের মধ্যে। রাশিকৃত ফিল্মে পাত্রটা ইতিমধ্যে ভর্তি হয়ে গেছে।
এই তাহলে গোল্ডফিংগারের পঁাচ, তার ওপরে নজর রাখা হচ্ছে। তিনটে মুভি ক্যামেরা কোথায় লাগান আছে কে জানে! বাড়ি থেকে বেরোবার আগে তাহলে ক্যামেরা অন করে দিয়ে গেছে এবং সেই জন্য জ্বালিয়েছে অজস্র আলো। তার মানে প্রথম থেকেই তার গতিবিধির ছবি উঠে গেছে। বন্ডের কি কল্পনাশক্তি কমে আসছে না হলে এই আলো জ্বলার তাৎপর্য সে বুঝতে পারল না কেন?
কোন অজুহাত আর দেখান যাবে না। আর সব থেকে বাজে ব্যাপার এত করেও তার গোপন খবর সে আবিষ্কার করতে পারেনি। গোল্ডফিংগার তার সব কীর্তিকলাপ ধরে ফেলেছে। বন্ড কি করবে ভেবে পেল না, স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল ফিল্ম-এর দিকে।
অজুহাত তৈরির চেষ্টা করলেও সেগুলো বাতিল করতে হল। আচ্ছা আলমারি খোলার সময় আলো লেগে কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে কি? তাহলে সবটাই নষ্ট করে ফেললে হয়; অবশ্য বুঝতে পারবে এটা বন্ডেরই কাজ।
হঠাৎ বিড়ালটার ডাক কানে এল। বিড়ালটাকে দিয়ে কিছু একটা করাতে হবে, যেই ভাবা অমনি কাজ। দরজার বাইরে থেকে বিড়ালটাকে নিয়ে এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। বন্ড ঝুঁকে পড়ে আলমারি থেকে ফিল্মগুলো নিয়ে আলোয় ধরতে লাগল শেষে যখন নিশ্চত হল ফিল্মের বারটা বেজে গেছে তখন সেগুলো নামিয়ে রেখে বিড়ালটাকে তার ওপর বসিয়ে দিল। বেড়ালটা এখান থেকে বেরোতেও পারবে না আর বন্ডের যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তবে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়বে।
এবার আলমারির দরজাটা একটু ফাঁক করে দিল যাতে বাকিগুলো নষ্ট হয়ে যায় আলো লেগে। শোবার ঘরের দরজাও সেই পরিমাণ ফাঁক রেখে দৌড়ে প্যাসেজ পেরিয়ে এসে সিঁড়ির কাছে এসে আস্তে আস্তে নিচে নামতে লাগল। নিচে এসে গ্লাসে খানিকটা মদ ঢেলে দ্য-ফিল্ড পত্রিকাটি নিয়ে গলফ সংক্রান্ত ডারউইনের লেখার বিষয়বস্তুটা পড়ে, চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল।
কিছু পেল বন্ড, এত কাণ্ডকারখানাই সার হল। শুধু গোল্ডফিংগারের চরিত্র, নোংরা মনোবৃত্তি, এইসব জেনে কিছুই লাভ হল কি? বন্ডকে যাচিয়ে নেবার প্রক্রিয়াটা SMERSH-এরই উপযুক্ত, কোন আনাড়ীর কর্ম নয়। যার কিছু গোপন করার থাকে তারই মাথায় এত প্যাঁচ আসে।
এখন একটাই কথা বেড়ালের অ্যালিবাই ধোপে টিকবে কি? ঘটনাটা অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব বলেই ভাববে গোল্ডফিংগার, একটা বিড়াল আলমারির ভিতর ঢুকে পড়ে কি করে? গোল্ডফিংগার নিশ্চিত জানবে যে বন্ডই তার ঘরে ঢুকেছিল, আর ফিল্ম নষ্ট সেই করেছে।
বন্ড উঠে দাঁড়িয়ে আরো কয়েকটা পত্রিকা নিয়ে এসে জড় করল চেয়ারে। এখন একমাত্র কর্তব্য ভবিষ্যৎ বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য সতর্ক হওয়া। এরপর থেকে তাকে সাবধান হতে হবে, নইলে বিপদে পড়লে জগতের সব বাদামী বেড়াল মিলেও তাকে উদ্ধার করতে পারবে না।
ঘাড়ের ওপর এক ঝলক হাওয়া লাগলেই বুঝতে পারল গোল্ডফিংগার এসে গেছে। আশ্চর্যের বিষয় গাড়ির আওয়াজ হয়নি, শব্দও শোনা যায়নি।
.
লোকটির নাম অড–জব
সদর দরজা বন্ধ হবার শব্দে
হাতের পত্রিকা রেখে বন্ড উঠে দাঁড়াল। পিছন ফিরে বলল–আরে! তোমার গাড়ির আওয়াজ পেলাম না তোর ওদিকে কি হল!
গোল্ডফিংগারও সহজ ভাবে বলল, ওঃ ওসব আপনা থেকেই ঠিক হয়ে গেছে। মদের আড্ডায় মার্কিন বিমান। বাহিনীর লোকের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিল। তারা নাকি চাকরটিকে জাপানি বলে গালাগাল দিয়েছিল। আমি পুলিশের লোকদের বুঝিয়ে বললাম কোরিয়ানদের জাপানি বললে অপমানিত বোধ করে। তাই পুলিশ আমার লোকটিকে সতর্ক করে ছেড়ে দিল। দেরি হল বলে দুঃখিত, তা তোমার কোন অসুবিধা হয় নি তো? আর এক গ্লাস নাও।
ধন্যবাদ। তুমি যাবার পর সময় কোথা দিয়ে কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি, চৌদ্দটা ক্লাব নিয়ে লেখা ডারউইনের বক্তব্য পড়ছিলাম, বেশ অদ্ভুত চিন্তাধারা… বলে নিজের মতামত সহ বিস্তৃত বিবরণ দিতে শুরু করল।
গোল্ডফিংগার সবটা শুনে বললেন, হ্যাঁ ব্যাপারটা বেশ জটিল। তোমার খেলার ধরনটা আমার থেকে আলাদা। আমি যেভাবে খেলি তাতে সবরকম গলফ ক্লাব ব্যবহার করতে পেলে সুবিধে হয়। যাগে তুমি বস। আমি হাত মুখ ধুয়ে এখনি আসছি।
বন্ড আর এক গ্লাস পানীয় ঢেলে নিয়ে গোল্ডফিংগারকে দেখল, সিঁড়ি দিয়ে উঠে করিডোরে গেল। উত্তেজনায় খেয়াল করেনি বইটা উল্টে ধরে আছে। বই সোজা করে নিয়ে একটা প্রাসাদের ফটোর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল।
দোতলায় সব চুপচাপ। শুধু বাথরুমের চেন টানার শব্দ, দরজার খট করে আওয়াজ। বন্ড গ্লাসে আর এক চুমুক দিল, দেখল গোল্ডফিংগার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন। গোল্ডফিংগার তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বন্ড বই নামিয়ে তাকাল তার দিকে, দেখে হাতে সেই বাদামী বিড়ালটা। ফায়ার প্লেসের কাছে নিচু হয়ে বেল টিপলেন।
বন্ডের দিকে ফিরে বললেন, বিড়াল ভাল লাগে তোমার?
বেশ ভালই লাগে।
চাকরদের ঘর থেকে ড্রাইভারটা বেরিয়ে এল, নিরুত্তাপ চোখে গোল্ডফিংগারের দিকে তাকিয়ে রইল। ইশারায় কাছে। ডাকলেন।
এবার বন্ডের দিকে ফিরে বললেন, এ হল আমার পার্শ্বচর। কথাটা অবশ্য ইয়ার্কির মত শোনাচ্ছে। ওকে অড় জব বলে ডাকি, কারণ ওর কাজ হচ্ছে টুকিটাকি কাজকর্ম করা অর্থাৎ অডজব। তোমার হাতটা একটু দেখাও তো বন্ডকে অডজব।
কোরিয়ান লোকটি হাতের দস্তানা খুলে সামনে এসে দু হাত বাড়িয়ে দিল। বন্ড উঠে দাঁড়িয়ে হাত দুটো দেখাল। বিশাল তালু, সুকঠিন পেশিতে ভরা। সবকটা আঙ্গুল সমান মাপের, তবে ডগাগুলো ভেত, আর এত চকচকে যেন মনে হয় হলদে হাড়ের তৈরি।-হাত উপুড় করে পাশের দিকটা দেখাও।
আঙ্গুলগুলোর নখ নেই, তার বদলে শক্ত হলদে খোলে ঢাকা। লোকটা হাত কাত করে ধরল, হাতের পাশ বরাবর একই হাতের মত বস্তু।
বন্ড গোল্ডফিংগারের দিকে তাকাতে সে বলল, এবার ওর কেরামতিটা দেখ। সিঁড়ির ধার বরাবর কাঠের রেলিংটা ছ ইঞ্চি চওড়া, চার ইঞ্চি পুরু, সেই দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। কোরিয়ান লোকটি বাধ্য ছেলের মত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। গোল্ডফিংগার ঘাড় নাড়াতে কোরিয়ান লোকটি নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে ডান হাতটা সোজা মাথার ওপর তুলে কুঠারের মত আঘাত হানল পালিশ করা রেলিংয়ের ওপর। অতএব রেলিংটা ভেঙে ঝুলে পড়ল। আরেকবার হাতটা ওঠা নামা করাতেই শুধু হাঁ করা কতগুলো এবড়ো-খেবড়ো গর্ত দেখা গেল। ঘরের মেঝেতে কাঠের টুকরো ভর্তি হয়ে গেছে। কোরিয়ান লোকটি পরবর্তী জিনিসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু তার মুখে পরিশ্রমের বা গর্বের কোন চিহ্নই নেই। গোল্ডফিংগার ইশারা করতে নিচে নেমে এল। তিনি বললেন ওর পায়ের অবস্থাও একইরকম। লোকটিকে আদেশ দিলেন, অডজব.ফায়ার প্লেসের তাকটা। ফায়ার প্লেসের ওপর ভারি কারুকাজ করা একটা তাক, মেঝে থেকে সাত ফুট আর কোরিয়ান লোকটির টুপির চেয়ে ছ ইঞ্চি ওপরে।
গার্চ আ হায়?
–হ্যাঁ। কোট আর টুপি খুলে রাখ। গোল্ডফিংগার বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেচারার টাকায় একটা গর্ত আছে তাই কথাগুলো ঐ রকম, আমি ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না।
বন্ড ভাবল ব্যাপারটা বেশ সুবিধের। একজন ক্রীতদাস যার কথা মালিক ছাড়া কেউ বোঝে না, হারেমের বোবা কালা দাসেদের থেকেও কাজের, কারণ এরা বেশি অনুগত হতে বাধ্য।
অডজব কোট, টুপি খুলে প্যান্টের পা দুটো হাঁটু পর্যন্ত মুড়ে জুজুৎসু খেলোয়াড়ের মত সুদৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়াল, দেখে মনে হল ভারি হাতি যদি তার দিকে আসে তাহলেও সে নড়বে না।
-তুমি একটু সর মিঃ বন্ড? এই আঘাতের মানুষের মাথা পর্যন্ত গুঁড়িয়ে যায়। কথা বলার সময় দাঁতগুলো যেন। ঝকঝক করে উঠল। গোল্ডফিংগার লম্বা সোট আর পানীয়ের ট্রে সরিয়ে দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে দিলেন। কিন্তু অত উঁচু তাকের নাগাল সে কি করে পাবে?
মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল বন্ড। অডজবের হলদেটে চ্যাপ্টা মুখ একাগ্রতায় জ্বলজ্বল করছে। বন্ড মনে মনে ভাবল এমন আগ্রাসনের সামনে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য।
গোল্ডফিংগার হাত তুলে ইশারা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এক পা এগিয়ে গেল, পরক্ষণেই দু পা সহসা উঠে গেল শূন্যে। হাওয়ার বুকে দুই পা সশব্দে ঠোক্কর খেয়ে আরও উঁচুতে উঠে গেল, তারপর শরীরটা বা দিকে বাঁকিয়ে, ডান পা ছুটিয়ে দিল লক্ষ্য স্থলের দিকে। মড়াৎ করে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অডজব স্বচ্ছন্দ গতিতে মাটিতে নেমে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
অডজবের পায়ের আঘাতে তাকের তিন ইঞ্চি গভীর অংশ উড়ে গেছে। তার চোখে মুখে এখন সাফল্যের চাপ।
বন্ড গভীর বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। দু রাত আগে সে কিনা নিরস্ত্র লড়াইয়ের ওপর বই লিখতে যাচ্ছিল। এ বিষয় তার যা জ্ঞান আছে তা নেহাতই তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে-এ লোকটির ক্ষমতার কাছে। এ যেন রক্তমাংসের মানুষ নয়, এক জীবন্তু মুগুর, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী। বন্ড এই আশ্চর্য মানুষটিকে সম্মান জানাবার জন্য করমর্দন করতে চাইল।
-আস্তে অডজব কড়া গলায় বললেন গোল্ডফিংগার।
কোরিয়ান লোকটি মাথা নিচু করে করমর্দন করল। বন্ডের মনে হল এক টুকরো কাঠ ধরে আছে। এরপর সে পোশাকের দিকে এগিয়ে গেল।
-কিছু মনে কর না বন্ড, তোমার এ ব্যবহারে আমি খুশিই হয়েছি। কিন্তু নিজের গায়ের জোর সম্পর্কে অডজব মোটেই সচেতন নয়–বিশেষ করে যখন উত্তেজিত থাকে। ওর হাতগুলো হচ্ছে যন্ত্রের মত। ও নিজের অজান্তেই তোমার হাতটাকে পিষে ফেলত। আচ্ছা এবার… বলে অডজবের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাল কাজ দেখিয়েছ তুমি, তোমার ট্রেনিং ঠিকমত চলছে দেখে খুশি হয়েছি। এই নাও বলে বিড়ালটা তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। গোন্ডফিংগার বললেন, বিড়ালটা আমাকে জ্বালাতন করে খুব। তুমি এটাকে খেয়ে ফেলতে পার। আর রান্নাঘরে বল আমাদের ডিনারের ব্যবস্থা করতে।
অডজব মাথা নেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
বন্ড অতিকষ্টে নিজের বিতৃষ্ণা চাপা দিল। সে বুঝতে পারল এই প্রদর্শনীর সাহায্যে তাকে জানিয়ে দিলেন, আমার ক্ষমতা দেখলে তো বন্ড। আমি সহজেই তোমায় মেরে ফেলতে পারতাম, অজুহাত দেখাতাম কসরত করার সময় ভুলে অডজবের সামনে এসে পড়েছিলে। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হতাম। তোমার বদলে বেড়ালটাকে শাস্তি পেতে হল, বেচারা।
বন্ড সহজভাবেই প্রশ্নটা করল, লোকটা সব সময় বোকার হ্যাট পরে থাকে কেন?
–কোরিয়ান লোকটি চাকরের দরজার কাছে চলে গেছে তাকে সেখান থেকে ডাকলেন গোল্ডফিংগার অডজব টুপিটা। বলে ফায়ার প্লেসের পাশে একটি কারুকার্য করা কাঠের প্যালেসের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
বেড়ালটাকে কোলে নিয়েই ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরের মাঝ বরাবর এসে টুপিটা খুলে নিল, সবটুকু গায়ের জোর দিয়ে ছুঁড়ে দিল আড়াআড়ি ভাবে। ঘটাং করে শব্দ হতে দেখা গেল টুপির কানাটা গোল্ডফিংগারের ঘরের প্যানেলের গায়ে। গেঁথে ঝুলে আছে। তারপর ঠং করে বসে পড়ল মেঝেতে।
বন্ডের দিকে স্মিতভাবে তাকিয়ে হেসে উঠলেন, বললেন, টুপিটা একরকম হাল্কা অথচ কঠিন মিশ্ৰধাতু দিয়ে তৈরি মিঃ বন্ড। তার ওপর বেল্ট দেওয়া। একবার ছুঁড়তে বেল্টের আবরণটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওর সেলাইয়ের হাত খুব ভাল আর একটা লাগিয়ে নেবে। নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে ঐ টুপির আঘাতে যে কোন মানুষের মাথা কেটে যেতে পারে অথবা গলা দু টুকরো। একটা সহজ সুন্দর গুপ্ত অস্ত্র সে বিষয়ে সন্দেহ নেই মিঃ বন্ড।
–হ্যাঁ নিশ্চয়ই। হাতের কাছে এমন একটা লোক থাকলে খুব কাজ দেয় হেসে বলল মিঃ বন্ড।
অডজব চলে যেতে একটা ঘণ্টার শব্দ শুনে গোল্ডফিংগার বলল, ডিনার তৈরি খাওয়া যাক।
ফায়ার প্লেসের কাছে লুকনো একটা বোতাম টিপতেই এক অদৃশ্য দরজা খুলে গেলে তারা ভিতরে ঢুকল।
খাবার ঘরটাও অন্যান্য অংশের মত জমকালো। ঝাড়লণ্ঠন ও টেবিলের একরাশ মোমবাতির আলোয় ঘর ভরে। গেছে। টেবিলে রূপোর আর কাঁচের বাসন আলোয় ঝকমক করছে। সাদা মেস জ্যাকেট পরা বেয়ারা পাশের সার্ভিং টেবিল থেকে এনে খাবার দিচ্ছে। প্রথম পদটা ঝোলমাখা ভাত-এর মত কি একটা, দেখে ইতস্তত করছে বলে বন্ডকে বললেন, ভয়ের কিছু নেই মিঃ বন্ড ওটা চিংড়ি মাছ-এর পদ, বিড়ালের নয়।
-আচ্ছা নির্বিকার ভাবে জবাব দিল বন্ড।
–জার্মান মদটা একটু খেয়ে দেখ না। ভালই লাগবে। নিজে নিয়ে নাও নয়ত ঐ লোকগুলো গ্লাসের বদলে প্লেটে ঢেলে দিতে পার।
বন্ডের সামনেই একটা বরফের বাক্সের মধ্যে মদটা রাখা ছিল। অল্প একটু খেয়ে দেখল, চমৎকার স্বাদ মদটার। বন্ড গৃহকর্তাকে অভিনন্দন জানালে সে মাথা নিচু করে তা গ্রহণ করল।
আমি নিজে মদ, তামাক কোনটাই খাইনা, মিঃ বন্ড। মানুষের এই একটা আচরণ খুব হাস্যকর লাগে আমার। তাছাড়া এটা তো প্রকৃতি বিরুদ্ধও। মুখে এক ছিটে আবেগ প্রকাশ করে বলল, জঘন্য অভ্যাস। কল্পনা করা যায় কোন জানোয়ার একগাদা ধূমায়িত খড় মুখে নিয়ে ধোয়া টানছে আর ছাড়ছে।
আর মদের ব্যাপারে বলতে গেলে, একজন রাসায়নিক হিসেবে আমি বলতে পারি প্রত্যেক মদে অন্তত কয়েক প্রকারের বিষ আছে। এর মধ্যে কিছু মারাত্মক। ওগুলোর যে কোন একটা খেলে মারা যাবার সম্ভাবনা। যে সামান্য বিষটুকুও পেটে যায় তাতেই নানা উপসর্গ দেখা যায়, যে গুলোকে হ্যাংওভার বলে চালান যায়।
খেতে খেতে থেমে গেলেন গোল্ডফিংগার। বললেন মদ খাওয়া যখন হয়, তখন একটা ভাল উপদেশ দিই। নেপোরিয়ন ব্র্যান্ডি কখনো খেওনা, ওতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিষাক্ত বস্তু আছে। বলে আবার খাওয়ায় মন দিলেন।
-ধন্যবাদ, মনে থাকবে। তাছাড়া সেই জন্যই ভদকা ধরেছি। ভদকাকে পরিস্রত করা হয় বলে অনেক বিষাক্ত জিনিস বাদ পড়ে যায়। একটা প্রবন্ধ এই কথাটা পড়েছিল বন্ড, সেটা দিয়েই নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করল সে। এইজন্য মনে মনে গর্বও অনুভব করল সে।
গোল্ডফিংগার তীক্ষ্ণ চোখে বলে উঠল কিছু কিছু জ্ঞান আছে দেখছি তোমার। কেমিষ্ট্রি পড়েছ?
-এই অল্প স্বল্প বলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। তোমার ড্রাইভারটার কাণ্ড দেখে তো আশ্চর্য হয়ে গেছি। ঐ সব কায়দা কোত্থেকে শিখেছে। কোথাকার বিদ্যে এটা? কোরিয়ানদের সবাই এসব জানে নাকি? গোল্ডফিংগার ন্যাফকিন দিয়ে মুখ মুছে তুড়ি দিলেন। এবার খানসামা খালি প্লেট সরিয়ে নিয়ে হাঁসের রোস্ট আর বন্ডের জন্য ১৯৪৭ এর সুতো রথসচাইল্ড মদ এনে দিয়ে আবার সার্ভিং টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গোল্ডফিংগার শুরু করলেন, কখনও ক্যারাটে-এর নাম শুনেছ ক্যারাটে বিদ্যের সর্বোচ্চ সম্মান ব্ল্যাক বেল্ট, সারা পৃথিবীতে মাত্র তিনজন অর্জন করেছে। আমার লোকটি তাদের মধ্যে পড়ে। ক্যারাটে আসলে জুজুৎসুর একটি শাখা, গুলতি ও মেশিনগানের যেমন তফাৎ জুজুৎসু ও ক্যারাটের তাই।
–সে তো দেখতেই পেলাম।
ওর যেটুকু কেরামতি দেখলে সবটাই ছেলেখেলা। হাঁসের ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে বললেন, অডজব যদি তোমার শরীরের সাতটি জায়গার কোন একটিতে ঠিকমত আঘাত করে তবে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত। গোল্ডফিংগার পরম তৃপ্তির সঙ্গে মাংস খেতে লাগলেন কথাটা বলে।
বন্ড গম্ভীরভাবে বলে উঠল, বল কি? আমি তো মাত্র পাঁচ রকম জানি, যাতে অজ-এর মত লোককে একঘায়ে শেষ করা যায়।
গোল্ডফিংগার না শোনার ভান করে খাওয়া থামিয়ে পানি খেল। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন, ক্যারাটের মূল তথ্য হল মানুষের শরীরে পাঁচটি অঙ্গকে আঘাত করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এছাড়াও সাইত্রিশটা দুর্বল জায়গা আছে, অবশ্য সেট বিশেষজ্ঞরাই জানতে পারে। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে হাত পা ওরকম শক্ত হয়ে যায়, রোজ অব এক ঘণ্টা ধরে হাত পা মোটা ডালের দড়ি দিয়ে খুঁটি মেরে শক্ত করে রাখে। সেইসঙ্গে নানারকম শারীরিক কসরত।
–আর টুপি ছোঁড়া প্র্যাক্টিস করে কখন?
— কথায় বাধা পড়তে পোন্ডফিংগার ভুরু কোঁচকালেন। সে আমি কোনদিন দেখিনি তবে বুঝতে পারছ তো সবরকম দক্ষতা অভ্যাসের সাহায্যে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। যাই হোক ক্যারাটের কথা জানতে চাইছিলে তো, এর উৎপত্তি চীনদেশে। সেখানকার পরিব্রাজ করা নিরস্ত্র অবস্থায় থাকত আর চোর ডাকাতদের সহজ শিকার ছিল। তারাই তখন এই কৌশল নিজেরাই আবিষ্কার করল। পরবর্তী কালে জাপান অধিকৃত ওকি নাওয়া দ্বীপে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হওয়ায় তারাই ক্যারাটে বিদ্যাটাকে আরো আধুনিক, উন্নত করে তোলে। যাতে শরীরের পাঁচটি অঙ্গ পাঁচটি মারাত্মক অস্ত্রে পরিণত হয়। এই পাঁচটি অঙ্গ হল–মুষ্টি, হাতের পাশের দিক, আঙ্গুলের ডগা, পায়ের গোড়ালি, কনুই। দীর্ঘ– অভ্যাসের সাহায্যে এগুলোকে শক্ত করে নিতে হয়। আমি দেখেছি ইটের দেওয়ালে গায়ের জোরে আঘাত করলেও অডজবের হাতে একটুও লাগে না। পরপর তিন লাইন আধইঞ্চি কাঠের তক্তাও টুকরো করে দেয়, আর পা দিয়ে কি করে তা তো দেখলে।
বন্ড মদে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, অঞ্জবের জন্য তোমার আসবাবপত্রের কি হাল হচ্ছে।
তাচ্ছিল্যভরে গোল্ডফিংগার বলে উঠল, এ বাড়িতে আর বেশিদিন থাকছি না। তাছাড়া আমি ভাবলাম ওর কেরামতি তোমার ভাল লাগবে। আশা করি বিড়ালটা ওকে বখশিশ দিয়ে ভুলে করিনি।
-ও কি বিড়ালের ওপর ক্যারাটে প্র্যাকটিস করবে নাকি?
-বেড়াল ও সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। ছোট বেলায় ওদের দেশে দুর্ভিক্ষ হওয়াতে তখন থেকেই অভ্যাসটা শুরু হয়েছে।
বন্ড আলোচনার গভীরে যেতে চাইল এরকম এক লোককে তোমার কেন দরকার সঙ্গী হিসেবে, ও তো সুবিধের নয়।
–তুড়ি মেরে চাকরদের ডেকে বললেন, মিঃ বন্ড; আমি ধনী লোক। আর ধনী লোকেদের সম্পত্তির মত নিরাপত্তা বাড়ানোরও প্রয়োজন আছে। যে সব দেহরক্ষী বা গোয়েন্দা পাওয়া যায় তারা সবাই অবসর প্রাপ্ত পুলিশকর্মী। এরা কাজ করতে পারে না। হাত পা চালায় আস্তে আস্তে, সেকেলে কাজকর্ম, আর ঘুষ খেতে ওস্তাদ। নিরাপত্তার প্রয়োজনে। এদের চলে না। কোরিয়ানদের এরকম কোন দুর্বলতা নেই। সেজন্য গত মহাযুদ্ধে এদেরকে বন্দী শিবির পাহারা দেবার কাজে লাগান হয়েছিল। এরা পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর, নির্ভীক জাত।
এইসব গুণাগুণ দেখেই আমি আমার চাকরদের বাছাই করেছি। ভাল কাজ দিয়েছে বলে কোন অভিযোগ নেই। আমার। বদলে আমিও দিয়েছি ভাল মাইনে, ভাল খাবার, বাসস্থান। যখন ওদের মেয়েমানুষের প্রয়োজন হয় লন্ডন থেকে নিয়ে আসা হয়। উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিই। মেয়েদের দেখতে ভাল না হলেও গায়ের রঙ সাদা। এই সাদা চামড়ার ওপর কোরিয়ানদের প্রবল আসক্তি। মাঝে মাঝে এ নিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে, তবে টাকা এমনই জিনিস সব চাপা পড়ে যায়।
বন্ড হাসল।
কথাটা ভাল লাগল বুঝি? এটা আমার নিজের তৈরি। নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে তারা। দু জনে অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। বন্ড রীতিমত আশ্বস্ত। গোল্ডফিংগার কিছু কিছু কথা জানিয়ে দিচ্ছেন তাকে, হয়ত বন্ড যে বাড়ি ঘুরে দেখেছে এটা আন্দাজ করে গোল্ডফিংগার খুশি হয়েছেন। মনে মনে যে বন্ড নিপাট ভদ্রলোক নয় তার ভেতরেও যে প্যাচ আছে এটা।
বন্ড চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল। বলল গাড়িটা তোমার চমৎকার। ঐ সিরিজের একেবারে শেষের দিকের নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, ১৯২৫-এর মডেল তাই না?
ঠিক ধরেছ, তবে আমি কয়েকটা বাড়িতে জিনিস লাগিয়েছি। স্প্রীং শক্ত করেছি, ব্রেকের জোড় বাড়াবার জন্য ডিস্ক ব্রেক লাগিয়েছি।
তাই নাকি! কেন বল তো? গাড়িটার সর্বোচ্চ গতি তত ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইলের বেশি হবে না। তাছাড়া ওজনই বা কত যে জোরাল ব্রেক লাগিয়েছ।
গোল্ডফিংগার জ তুলে তাকিয়ে বললেন, তাই নাকি? পুরো এক টন ওজনের লোহার পাত আর আর্মারড গ্লাস লাগানোর পরে গাড়িটা আর তেমন হাল্কা নেই।
বন্ড হাসল, আচ্ছা, তাই নাকি? তুমি দেখছি তোমার নিরাপত্তার জন্য কোন ব্যবস্থা বাদ দাও না। কিন্তু প্লেনে করে অত বড় গাড়ি ইংলিশ চ্যানেল পার কর কি করে প্লেনের মেঝে ভেঙে যাবে তো?
–আমার বিশেষ প্লেন আছে। সিলভার সিটি কোম্পানির যারা প্লেন ভাড়া দেয় তারা গাড়িটা চেনে। বছরের দু বার আমি গাড়ি নিয়ে পারাপার করি।
-ইওরোপ বেড়াতে যাও বুঝি?
গলফ খেলতে।
দারুণ ব্যাপার তো। আমারও ইচ্ছা ওরকম একটা ট্রিপ দেওয়ার।
গোল্ডফিংগার টোপটা গিললেন না। বলে উঠলেন তোমার তো পকেটে যথেষ্ট টাকা, গেলেই হয়।
বন্ড হেসে বলল, ও ঐ বাড়তি দশ হাজার ডলারের কথা বলছ! কিন্তু আমি যদি কানাডায় চলে যাব ঠিক করি তাহলে ওটা তো দরকার হবে না।
-তোমার কি মনে হয় কানাডায় গিয়ে ভাল রোজগার করতে পারবে, তা খুব বেশি টাকার দরকার নাকি?
বন্ড সাগ্রহে বলল নিশ্চয়ই, না হলে খেটে লাভ কি।–দুঃখের বিষয়; বেশি টাকা রোজগার করতে সবেতেই বেশি সময় লাগে। শেষ পর্যন্ত যখন টাকা আসে তখন ফুর্তি করার বয়স থাকে না।
–সেটাই তো ঝামেলা। আমি দাও মারার তালে আছি। এ দেশে হবে না, বড় ট্যাক্স দিতে হয়।
–ঠিক তাই, আইনকানুনও খুব কড়া।
–হুঁ, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
–তাই নাকি?
-হিরোইনের চোরাকারবারে নাক গলিয়েছিলাম, শেষে কোনরকমে পালিয়ে বেঁচেছি। আশা করি একথা কাউকে বলবে না।
গোল্ডফিংগার কাঁধ ঝুঁকিয়ে বলে উঠলেন, মিঃ বন্ড, কোন এক পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছিলেন, আইন জিনিসটা জমাট বাঁধা সামাজিক সংস্কার। আমারও ওই এক মত। বিশেষত মদের চোরাচালান সম্পর্কে। তা যদি নাও হত তাহলেও পুলিশকে সাহায্য করার কোনরূপ ইচ্ছে আমার নেই।
-বেশ, ঘটনাটা মোটামুটি এই রকম বলে মেক্সিকোর হিরোইন স্মাগলিং-এর গল্পটা বলে গেল নিজেকে ব্ল্যাকওয়েল বানিয়ে। তারপর বলল, আমার কপাল ভাল যে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম, অবশ্য এর জন্য দুর্নামও হয়েছে।
-সে তো খুব স্বাভাবিক। চমৎকার গল্প বেশ বুদ্ধিমানের মত মেলামিশা করেছিলে। তা ঐ লাইনের ঢোকার ইচ্ছে আছে নাকি?
বন্ড কাঁধ ঝাঁকাল, লাইনটা প্যাচাল, তাছাড়া মেক্সিকান বড়কর্তাটিকে দেখে বিচার করলে কারবারের চাঁইরা তেমন শক্তিশালী নয়। শক্ত ফাঁদে পড়লে শুধু গালাগালি দেওয়া ছাড়া আর কিছু কাজ জানে না ওরা। –আচ্ছা মিঃ বন্ড, গোল্ডফিংগার উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে বন্ড সন্ধ্যেটা বড় ভাল কাটল। জানিনা আমাকে আবার স্মাগলিং এ ঢুকতে হবে কিনা। বড় টাকা রোজগারের আরও অনেক পথ আছে। সবদিক না দেখে ঝুঁকি নেওয়া উচিত না, তাছাড়া পকেটের টাকা ডবল করা তো সোজা নয়। আমার একটা চুটকি শুনবে?
-বল।
গোল্ডফিংগার পাতলা হেসে বললেন মিঃ বন্ড টাকা ডবলের সবচেয়ে বড় নিরাপদ উপায় হল ডবল ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেওয়া।
বন্ড শুনল, কিছু বলল না। সহজাত বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারল, আর চাপাচাপি করে কোন লাভ হবে না।
হলঘরে ফিরে এসে বন্ড করমর্দনের জন্য হাত বাড়াল চমৎকার ডিনারটার জন্য ধন্যবাদ। এবার আমি হোটেলে গিয়ে ঘুমের চেষ্টা করি। আবার একদিন দেখা হবে, কেমন?
গোল্ডফিংগার বন্ডের হাতে চাপ দিয়েই ছেড়ে দিলেন, যেন অন্যের স্পর্শ সহ্য করতে পারছেন না। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বন্ডের কথার উত্তরে বললেন, সেটা আর আশ্চর্য কিঃ মিঃ বন্ড।
চাঁদনী রাতে থ্যানেট দ্বীপের ওপর দিয়ে হোটেলে যাওয়ার সময় গোল্ডফিংগারের শেষ উক্তিটাই মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়েও সেই কথার গূঢ় অর্থ আবিষ্কার করতে পারল না। দুরকম মানে হতে পারে, হয় নিজেই বন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, নয়ত বন্ডের কাজ হবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। বন্ড বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা মুদ্রা তুলে নিয়ে টস করল। হেড হলে প্রথমটা, টেল হলে দ্বিতীয় টা। টেলই হল।
তাই হোক তবে। কিন্তু আরেকবার যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাহলে বন্ডের একটা ভাল কৈফিয়ৎ দেওয়া চাই, নইলে কেলেংকারী।
.
স্রোতের পশ্চাতে
পরদিন সকাল ন টার সময় বন্ড তাদের চীফ অফ স্টাফের সঙ্গে যোগাযোগ করল ফোনে। সাঙ্কেতিক ভাষায় বলল, জেমস্ বলছি। সম্পত্তি দেখেছি। গতকাল তার মালিকের সঙ্গে ডিনারও খেয়েছি। আমি নিশ্চিত যে ম্যানেজিং ডিরেক্টর-এর কথাই ঠিক, সম্পত্তিতে গলদ আছে। পুরো রিপোর্ট পাঠাবার মত তথ্য নেই। তবে কাল মালিকটি বিদেশ যাচ্ছেন ফেরিফিল্ড থেকে প্লেন ধরবেন। কখন প্লেন ছাড়ছে জানলে সুবিধা হয়। ভদ্রলোকের গাড়িটা একবার দেখার ইচ্ছে আছে, সেই সঙ্গে একটা বেতার যন্ত্র উপহার দেব। আপাতত আমি কোথায় থাকব সেটা বলতে পারব না। যোগাযোগ রাখব। তোমার কাছে কোন খবর আছে।
গলফ খেলার কি হল?
–জিতেছি।
অপর প্রান্তে হাসির শব্দ আমিও তাই ভাবছিলাম চড়া দরের বাজি হয়েছিল?
–তুমি জানলে কি করে।
-মিঃ স্পটল্যান্ড (অর্থাৎ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড) গতকাল আমাদের কাছে এসে উপস্থিত। বলল কে যেন তাকে খবর দিয়েছে যে তোমার নামের এক ব্যক্তির কাছে প্রচুর পরিমাণ ডলার আছে। জানিতে চাইল খবরটা সত্যি কি আর ঐ নামে কেউ কাজ করে কি? লোকটা তেমন উচ্চপদস্থ নয় আর ইউনিভার্সালের ব্যাপার কিছুই জানে না। সোজা বলে দিলাম কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে নিতে। লোকটা আজ সকালে ক্ষমা চেয়েছে আর একই সময় তোমার সেক্রেটারি দশ হাজার ডলার ভর্তি খাম পেয়েছে। তোমার খদ্দেরটি অনেক বুদ্ধি ধরে। কি বল?
বন্ড হাসল। নিখুঁত গোল্ডফিংগার সুলভ পঁাচ। দশ হাজার ডলার-এ ফাঁসিয়ে দেবার চেষ্টা। তার মানে গলফ খেলা শেষে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করেছিল। বন্ডকে জানিয়ে দিল যে গোেল্ডফিংগার কে ঘায়েল করলে একটু চোট পেতে হয়। তবে বন্ড যে ইউনিভার্সালে কাজ করে সেটা বিশ্বাস করেছে। বাইরের খুব কম লোকই এর আসল পরিচয় জানে। এই এক্সপোর্ট কোম্পানির ছদ্ম কাজ কর্মের আড়ালে ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনীর যাবতীয় ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়।
বন্ড বলল লোকটা মহা প্যাচাল তো। তুমি ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে বল টাকাটা হোয়াইট ক্রসে দিয়ে দিচ্ছি। অন্য ব্যাপারগুলো ম্যানেজ করতে পারবে?
–নিশ্চয়ই। কয়েক মিনিটের মধ্যে ফোন করে জানাচ্ছি তোমায়, আর তুমি সাবধানে থেকো আর একঘেয়ে লাগলে (বিপদ) কিংবা সঙ্গীর (দেহরক্ষীর) প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিও।
-গুডবাই বন্ড রিসিভার নামিয়ে রাখল। উঠে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। মানচোখে দেখল তারা টেপ করা এখনকার কথাগুলো আরেকবার শুনছে। মিস মানিপেনী M-এর সেক্রেটারি, সাঙ্কেতিক ভাষা গুলিকে সহজ ভাষায়। বলে দিচ্ছেন– জেমস বলেছে গোল্ডফিংগার যে বড় মতলব আঁটছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে সেটা কি বোঝা যায়নি। গোল্ডফিংগার আজ সকালে তাঁর রোলস রয়েস গাড়ি নিয়ে ফেরিফিল্ড থেকে প্লেন ধরছেন। 007 তাঁর পিছু নিতে চায়, তাই রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা করা হোক। ও চাইছে আমরা যেন কাস্টমস-এর সঙ্গে কথা বলে নিই, যাতে রওনা হবার আগে গাড়িটা ভাল করে চেক করে গাড়ির পেছনের খোপে দিকদর্শক বেতার যন্ত্র বা Homer লাগিয়ে দেওয়া যায়। যদি কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয় আমাদের বিভিন্ন স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে…ইত্যাদি।
বন্ডের ব্যাগ গোছান হলে লন্ডন থেকে ফোনে নির্দেশ এল। তারপর হোটেলের বিল মিটিয়ে বন্ড বেরিয়ে পড়ল।
লন্ডন থেকে জানিয়েছে সকাল বারটায় একটা বিশেষ প্লেনে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। বন্ড ফেরিফিন্ডে পৌঁছাল এগারটা নাগাদ। চীফ পাসপোর্ট কন্ট্রোল আর কাস্টমস-এর অফিসাররা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। নিজের গাড়িটাকে একটা হ্যাঁঙ্গারের ভেতর রেখে নিজের পরিচয় দিল। পাসপোর্ট বিভাগের অফিসারদের সঙ্গে গল্প করে জানল এরা ভেবেছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোক বন্ড। বন্ড ভুল শুধরে দিল। বলল যে গোল্ডফিংগারের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। তবে তার সততা সম্পর্কে সে নিশ্চিত। কিন্তু চাকরদের কেউ স্মাগল করে। ব্যাপারটা গোপনীয়, তাই মিনিট দশেকের জন্য তাকে একলা ছেড়ে দিলে ভাল হয়। বন্ড গাড়িটা একবার পরীক্ষা করবে। তার আগে কাস্টমস-এর লোকেরা যদি দেখে নেয় গাড়িতে কিছু লুকানো আছে কিনা তবে ভাল হয়। অফিসাররা রাজি হয়ে গেলেন।
এগারটা পয়তাল্লিশে একজন অফিসার খবর দিল ওরা এসে গেছে, প্লেনে উঠে পড়েছে। বললেই হবে যে গাড়িটা কোথায় রাখা হবে সে নিয়ে অংক কষতে হচ্ছে। ভাববেন না যেন এটা ভুল, আমরা গাড়িটাকে চিনি, ওজন তিন টন। প্লেনে ঢোকাতে রীতিমত মাথা ঘামাতে হয়।…ঠিক আছে কাজ হলে ডাকবেন।
ধন্যবাদ, ঘর ফাঁকা, বন্ড একটা প্যাকেট বার করে তার থেকে একটা বেতার ট্রান্সমিটার বার করল। ভাল করে দেখে নিয়ে পকেটে রেখে দিল।
এগারটা পঞ্চান্ন বাজতে দরজা খুলে গেল। অফিসারটি ইশারা করল সব ঠিক আছে।
বিশাল ঝকঝকে গাড়িটা কাস্টমস এলাকায় এমন জায়গায় রাখা হয়েছে যে প্লেন থেকে দেখা যাবে না। আর একটা মাত্র গাড়ি আছে এখানে ছাই রঙের TR3 কনভার্টিবল মোটর গাড়ি। বন্ড গাড়িটার কাছে গিয়ে দেখল অফিসাররা যন্ত্রপাতি রাখবার জায়গাটা স্কু শুদ্ধ খুলে ফেলেছে। বন্ড সেগুলো পরীক্ষা করার ভান করে দু পাশ হাতড়াতে হাতড়াতে। ট্রান্সমিটারটা চুপিসাড়ে ঢুকিয়ে দিল।
তারপর ট্রেটা যথাস্থানে রেখে হাত ঝেড়ে উঠে পড়ে বলল কিছু নেই।
অফিসারটি কোটরের ওপর প্লেটটা স্কু দিয়ে এঁটে বললেন, গাড়ির চ্যাসিসে বা বড়িতে কোন কারসাজি করা নেই। তবে গাড়ির ফ্রেম ও সীটের চামড়ার চাকার ফাঁকে অনেক জায়গা আছে। কিন্তু তার জন্য ভাঙাভাঙি করতে হবে…আপনার কাজ আশা করি শেষ।
আজ্ঞে হ্যাঁ, ধন্যবাদ। বড় অফিসে চলে এল। গাড়ির আওয়াজ শুনে বুঝল ওটাকে প্লেনে ভোলা হচ্ছে।
প্লেনটা রানওয়ের ওপর আসতেই বন্ড গাড়িতে গিয়ে নিচে একটা সুইচ অন করে রাখল, কিছুক্ষণ পর একটা কর্কশ আওয়াজ ভেসে এল লুকানো লাউডস্পীকার থেকে। শব্দটা হঠাৎ কানে গিয়ে গুঞ্জনের মত শোনাল। বন্ড চুপচাপ বসে রইল। প্লেনটা সমুদ্রতীরের দিকে বেরিয়ে যেতেই গুঞ্জনের তীব্রতা কমে এল। পাঁচ মিনিট পর সেটাও শোনা গেল না।
সুইচ ঘোরাতে যখন আওয়াজটা আবার হল তখন ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে পৌঁছান পর্যন্ত রিসিভার চালু রাখলেও পরে বন্ধ করে দিল।
বন্ড কাস্টমস অফিসে গিয়ে জানাল দুটোর প্লেন ধরবে সে, তারপর ধীরে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল রেস্তোরাঁর দিকে। গোল্ডফিংগারের গাড়ি থেকে একশ মাইলের মধ্যে থাকলেই হোমার তার বার্তায় জানিয়ে দেবে আর বন্ডের সুবিধা হবে পিছু নেওয়ার।
ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইউরোপের রাস্তায় চোর পুলিশ খেলবে দু জনে। বন্ড চিন্তা করেই রোমাঞ্চ অনুভব করল। ঠাণ্ডা এক টুকরো কঠোর হাসি ফুটিয়ে তুলে মনে মনে বলল, গোল্ডফিংগার! জীবনে এই প্রথম তুমি এমন বিপদে পড়েছ যার ফল মারাত্মক।
ফ্রান্সের N38 শান্ত রাজপথটি বিশাল N। এর সাথে মিশেছে। সেই মোড়টিতে অপেক্ষা করতেই বন্ড দেখল একজন সাইকেল আরোহী আসছে। জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, গাড়িটাকে দেখেছে, কারণ এরকম সম্ভ্রান্ত গাড়ি চোখ এড়ায় না। ডানদিকে সোজা আবেভিল-এর দিকে গেছে। এর সঙ্গে যোগ করল ওটা ঘণ্টাখানেক আগে গেছে তবে আপনার গাড়িতে করে ওটাকে ধরে ফেলতে…।
এয়ারপোর্টে কাগজপত্রের ঝামেলা মিটতে হোমার-এর সংকেত ধরার জন্য গাড়ি ছোটাল বন্ড। কিন্তু গোল্ডফিংগার যে কোন্দিকে যাচ্ছে তা বোঝা মুশকিল। উত্তরে অস্ট্রিয়া বা জার্মানির দিকেও যেতে পারেন অথবা দক্ষিণ দিকেও যেতে পারেন। এটুকু খুঁজে বার করার জন্য সাইকেল আরোহীর সাহায্য নিতেই হল।
লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে জোরে গাড়ি চালিয়ে দিল। নিশ্চয়ই গোল্ডফিংগার এতক্ষণে আবেভিল পেরিয়ে প্যারিস অথবা রুয়েনের দিকে গেছেন। বন্ড যদি ভুল করে তবে তাকে ধরতে সময়, দুরত্ব দুটোই নষ্ট হবে।
উঁচুনিচু রাস্তা ধরে বন্ড তেতাল্লিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করল ঠিক পনের মিনিটের মধ্যে। হোমার-এর আওয়াজ ক্রমশ জোর হচ্ছে। তার মানে গোল্ডফিংগার এখন কুড়ি মাইল এগিয়ে। তেমাথায় পৌঁছে প্যারিসের দিকে আন্দাজে গাড়ি ঘোড়াল। জোরে ড্রাইভ করে গোল্ডফিংগারের কাছাকাছি চলে এসেছে মনে হচ্ছে, কিন্তু কোথায় হোমারেরও আওয়াজ কমে গেল।
দূর! এখন কি গাড়ি ঘুরিয়ে ডান দিকে ঘুরে গেল সে। প্রথমে ভিড়ে গাড়ি আটকে গেলেও শেষ পর্যন্ত জন বিরল রাজপথ N30-তে এসে পড়ল। তারপর হোমারের বেতার সংকেত অনুযায়ী রুয়েন এসে পৌঁছল।
শহরের বাইরে যেতে সংকেত আরও জোরাল হল। তার মানে গোল্ডফিংগারের আগেই সে রুয়েনে চলে এসেছে। এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না গোল্ডফিংগার রুয়েন ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
মিনিট পনের পর যখন রোলস রয়েসটা অনেক দূর চলে গেল তখন বন্ড স্টার্ট দিয়ে আরেকটা তেমাথায় এসে বাঁদিকে ঘুরল। বেতারের সংকেতের গুঞ্জন ক্রমশ গর্জনে পরিণত হল। গাড়ির গতি কমিয়ে আনল। সঙ্গে রিসিভারের গর্জনও শোনা যেতে লাগল। বন্ড মনে মনে ভাবল গোল্ডফিংগার কোথায় যেতে পারে?
পাঁচটা থেকে সাতটা বাজল, সূর্য অস্ত চলে গেছে তাও রোলস রয়েসের বিরাম নেই চলার। অর্লিয়েন গাড়ি রাস্তা ধরে তারা এতক্ষণে এসেছে পঞ্চান্ন মাইল। রাত্রে যদি গোল্ডফিংগার অর্পিয়নসে থামেন তাহলে বলতে হবে গাড়িটা ভালই এসেছে, ছ ঘণ্টায় আড়াইশ মাইল। মোটর চালানোর ব্যাপারেও তার আলসেমি নেই। বন্ড দুই গাড়ির মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে লাগল।
সামনে আরেকটা গাড়ির হেড লাইট দেখা যাচ্ছে, হেডলাইট জ্বেলে দেখল একটা ছাই রঙের ট্রায়ন টু-সীটার। পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সামনের গাড়িটার কাছে আসতেই হেডলাইট নিভিয়ে দিল, ফগ লাইট জ্বালাল।
সামনের গাড়িটা মাইল খানেক এগিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কাছে একে দেখে নিল গাড়িটা রোলস্ রয়েস কিনা। সন্দেহ মেটতে আবার পিছিয়ে এল। ড্রাইভিং আয়নায় TR3 গাড়ির আলো চোখে পড়ল তার। অর্পিয়নস শহরের বাইরে পৌঁছে গাড়ি থামাল। কিছুক্ষণ পরই ট্রায়ন টু সীটার তাকে ছাড়িয়ে চলে গেল।
এই অলিয়নস শহরটার রোমাঞ্চও নেই, উজ্জ্বলতা নেই বলে বন্ডের কোনদিন ভাল লাগে না। বন্ডের ইচ্ছা হচ্ছিল শহরে না গিয়ে নদীর ধারে আরাম করে ঘুমিয়ে নিতে। কিন্তু গোল্ডফিংগার বোধহয় কোন হোটেলে উঠবে। শিকারের পিছনেই নানা দরকার এই ভেবে ঠিক করল হোটেল দ্য লা গেরু-এ উঠবে আর স্টেশন বুফেতে ডিনার খাবে।
দশ মিনিট ধরে রিসিভারের গুঞ্জন একই আছে। বন্ড শহর ঢুকে নদীর পাড় বরাবর এক ভাল হোটেলের কাছে যেতেই দেখে গেটের কাছে রোলস রয়েস দাঁড়িয়ে। বন্ড শহরের ভেতর দিকে গিয়ে স্টেশনের কাছে চলে গেল।
হোটেলে দ্য লা গের সস্তা সেকেলে মার্কা। আরাম করে গরম পানিতে গোসল সেরে স্টেশনের রেস্তোরাঁর দিকে গেল। রোলয় রয়েস তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। সাড়ে দশটার সময় ডিনার সেরে বেরিয়ে এসে ঘণ্টাখানেক রাস্তায় ঘুরল। তারপর শেষ একবার রোলস রয়েস দেখে এসে শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকাল বেলাতেও যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল গাড়িটাকে। বন্ড হোটেলের বিল মিটিয়ে রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা সেরে নিল। পরে গাড়ি করে গোল্ডফিংগারের হোটেলের সামনে এসে একটা গলির ভিতর ঢুকিয়ে রাখল গাড়িটাকে। এবার আর ভুল করা চলবে না। গোল্ডফিংগার হয় নদী পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে N7 ধরে যাবেন রিভিয়েরার দিকে, কিংবা লোর নদীর উত্তর পাড় বরাবর এগিয়ে যাবেন। দ্বিতীয় পথ ধরে রিভিয়েরাও যাওয়া চলে, আবার সুইজারল্যান্ড অথবা ইটালীও যাওয়া যায়।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নদীর পাড়ে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে নজর রাখল রোলস রয়েসের দিকে। সাড়ে আটটার সময় দুটি লোক বেরিয়ে এর দরজা দিয়ে। চালু হল রোলস রয়েস। যতক্ষণ না নদীর পাড় বেয়ে চোখের বাইরে চলে যায় ততক্ষণ অপেক্ষা করল বন্ড। চোখের আড়াল হলে বন্ড গাড়ি স্টার্ট দিল।
লোর নদীর পাড় ধরে চলল বন্ড। গ্রীষ্মকালের প্রভাতী রোদে চারদিক ভরে গেছে, এই অংশটি বন্ডের বড্ড প্রিয়। এই মে মাসে ফলের গাছগুলো সাদা হয়ে গেছে, চওড়া নদী বৃষ্টির পানিতে ভরে আছে, সমস্ত উপত্যকা সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে।
বন্ড নিবিষ্ট মনে এইসব কথাই ভেবে চলেছে। হঠাৎ জোড়া হর্নের তীব্র তীক্ষ্ণ শব্দ করে ছোট ট্রায়নয়টা বেরিয়ে গেল সামনে দিয়ে। চালাচ্ছে ঘন নীল গগলসে অধাবৃত্ত শুরু একটি মেয়ে, মুখের একপাশ লাল টুকটুকে ঠোঁট, সাদা বুটি দেওয়া গোলাপী রুমালে বাধা চুল ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি বন্ড। মেয়েটির দৃপ্ত ভঙ্গি প্রমাণ করে সারাজীবন সে পেয়ে এসেছে প্রশংসা, কর্তৃত্ব করার মনোভাব। এই মনোভাব থেকেই চটকদার গাড়িওয়ালা যুবককে গতির প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলে দিতে চাইছিল সে।
বন্ড মনে মনে ভাবল, আহা অন্যদিন যদি এমন হত তাহলে মেয়েটাকে অনুসরণ করত; মহ্যাহের আগেই তাকে ধরে ফেলে নদীতীরের কোন এক রেস্তোরাঁয় বসে আলাপ পর্ব সেরে নিত। এরপর আঙ্গুরলতার ছায়ায় বসে লাঞ্চ সেরে নিয়ে পরস্পর গাড়ি চালাতে চালাতে একে অন্যকে বোঝাবার চেষ্টা করত। সুন্দর একটা জায়গা দেখে গাড়ি থামিয়ে চারদিকে অলিভ গাছের সারি, নীল বনে ঝি ঝি পোকার ডাকের মধ্যে আবিষ্কার করতে পরস্পর পরস্পরকে ভাল লেগে গেছে। যেখানে যাচ্ছিল সেখানে পরে গেলেও চলবে এই ভেবে পরের দিন মেয়েটির গাড়ি হোটেলের গ্যারেজে রেখে, নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। বড় রাস্তা এড়িয়ে পশ্চিম দিকে চলে যেত তারা যেখানে একটা মিষ্টি নামের গ্রাম আছে, যদিও সেখানে তার যাবার খুব ইচ্ছে কিন্তু হোটেল না থাকায় পাশের শহরে দুটো ঘর নিত। রাত্রে চমৎকার ডিনারের শেষে প্রথানুযায়ী শ্যাম্পেন খেয়ে তারপর…।
কাল্পনিক গল্পের পরিণতিটা ভেবে হাসল বন্ড। কিন্তু ঐ গোল্ডফিংগারের জন্য তার আজকে কিছু হবে না। সে মেয়েটির সেন্টের বদলে গোল্ডফিংগারের আফটার শেভ-এর গন্ধ শুকবে।
বন্ড রিসিভার চালিয়ে সংকেত দেখে নিয়ে অলসগতিতে ড্রাইভ করে চলল। মন পড়ে আছে সেই মেয়েটার দিকে, ও কি অর্লিয়েনসে কোন হোটেলে রাত কাটিয়েছিল? একটা সুযোগ চলে গেল! অবশ্য পথে আবার দেখা যেতে পারে তাদের।
আরে দাঁড়াও দাঁড়াও; সহসা বন্ড-এর স্বপ্নভঙ্গ হল। গাড়িটার খোলা হুড দেখে একটা কথা মনে পড়ে গেল তার। কোথায় যেন আগে দেখেছে। ফোরফিল্ড এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েছিল, গোল্ডফিংগারের পরের প্লেনে এসেছে বোধহয়। মেয়েটার গাড়ির নম্বর লক্ষ্য করেনি, কিন্তু এ যে সেই গাড়িটা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই যদি হয় তবে এখনও গোল্ডফিংগারের পেছনে লেগে রয়েছে। গতরাত্রে মেয়েটা আবার হেডলাইট জ্বালিয়ে চালাচ্ছিল। তাই তো ব্যাপারটা কি।
বন্ড অ্যাসিলেটরে চাপ দিল। সামনেই মেভরম শহর, পরের মোড় আসার আগে গোল্ডফিংগারের আরও কাছাকাছি এগিয়ে যেতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারবে সে কোন পথে সে গেল আর মেয়েটার উদ্দেশ্য। যদি মেয়েটা তাদের মধ্যে নাক গলাতে আসে তাহলে ঝামেলার ব্যাপার। একে গোল্ডফিংগারকে সামলান ঝামেলা তার ওপর উড়ে এসে জুড়ে বসবে মেয়েটা।
মেয়েটা যথাস্থানেই আছে, রোলস রয়েসের সঙ্গে মাইল দুয়েক দূরত্ব রেখে অনুসরণ করছে মেয়েটির গাড়ির পিছন দিকটা চোখে পড়তেই গাড়ির গতি কমল। মেয়েটির অজানা পরিচয়, উদ্দেশ্য চিন্তা করতে করতে ড্রাইভ করে চলল বন্ড।
N7 রাজপথটা ফ্রান্সের বুক চিরে চলে গেছে। রাস্তাটা বেশ চওড়া, তার ওপর দিয়ে চলেছে পরপর তিনটি গাড়ি। মূলা বলে জায়গায় আর একটু হলে গোল্ডফিংগারের হদিশ হারিয়ে ফেলে ছিল পরক্ষণেই আবার তা পেয়ে যায়। N7 থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ইটালী বা জেনিভার দিকে রোলস রয়েস এগোচ্ছ।
হোমারের আওয়াজের বদলে ট্রায়নফ গাড়িটা এখন মাথায় ঘুরছে। হঠাৎ গভীর গর্জনের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ব্রেক করল, নয়ত রোলস রয়েসের ওপর গিয়ে পড়ত।
শম্বুক গতিতে চলতে চলতে একটা চড়াইয়ের মাথায় এসে চোখে পড়ল মাইল খানেক দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।
বরাত ভাল, পাশেই একটা মেঠো রাস্তা ছিল, গাড়িটা ভেতরে উঁচু ভুট্টা ক্ষেতের আড়ালে থামল। ছোট একটা দূরবীন বার করে চোখে লাগিয়ে দেখল নদীর ধারে গোল্ডফিংগার বসে লাঞ্চ খাচ্ছেন। পরনে সাদা কোট, মাথায় হেলমেট। খাবার দেখে তারও যেন খিদে পেয়ে গেল।
গাড়িটার দিকে তাকাতে ড্রাইভারের আসনে বসা কোরিয়ান লোকটিকে দেখা যাচ্ছে, ট্রায়ন গাড়িটা ধারে কাছে কোথাও নেই। যদি সেও পিছু নিয়ে থাকে তবে ঘাপটি মেরে আছে কোন জায়গায়। বন্ড মনে হয় বেশি কল্পনা করে ফেলছে। সে হয়ত তার আত্মীয় বা প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেছে।
গোল্ডফিংগার উঠে দাঁড়িয়ে খাওয়া কাগজগুলো ব্রিজের তলায় খুঁজে দিলেন। কিন্তু নদীতে ফেলল না কেন? হঠাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। কি যেন মনে হচ্ছে কাগজ গোঁজা দেখে। তবে কি এই ব্রীজ গোল্ডফিংগারের পোস্ট অফিস। তিন দেশের নাগালের মধ্যে এই ব্রীজ ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইটালী, জায়গাটাও খোলামেলা। হয়ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওখানে সোনার বাট রেখে যেতে।
গোল্ডফিংগার নদীর পাড় বেয়ে উপরে উঠলেন, গাড়ির স্টার্ট দেওয়ার শব্দ হল। গাড়িটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি চেয়ে রইল বন্ড।
সুন্দর নদীর ওপর সুন্দর ব্রীজ। জরীপ বিভাগের একটা নম্বরও লাগান আছে গায়ে 79/6-অর্থাৎ N79 নং রাজপথের ওপর নির্দিষ্ট কোন শহর থেকে 6 নম্বর ব্রীজ। খুঁজে বার করা একটুও শক্ত নয়। বন্ড গাড়ি থেকে নেমে নদীর নিচু পাড়ে নেমে এল। নদীটি পরিষ্কার, নুড়ি বিছানো পানিতে মাছেদের ছায়া পড়েছে। ঠিক মাঝখানে, রাস্তার নিচে ব্রীজের গাঁথুনির গায়ে একজোড়া মোটা ঘাস হেলান দিয়ে আছে। ঘাসগুলো ফাঁক করে দেখে সদ্য খোঁড়া মাটি, বন্ড মাটির ভিতর আঙ্গুল চালিয়ে দিয়ে দেখে একটা মাত্র সোনার বাট। মসৃণ হঁটের মত দেখতে, তুলতে বেশ জোর লাগল। মাটি ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিয়ে রুমালে বেঁধে কোটের পকেটে করে ফাঁকা রাস্তায় উঠে এল।