গোলায়াথ
দুনিয়াটাকে সবসময় সস্তা আর ধোঁকাবাজির জায়গা ভেবে এসেছি-এ দাবী আমি করতেই পারি। আমার মনে হত, গ্রহটাকে বানানোই হয়েছে আরও অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক কিছু একটা লুকোবার জন্য। সে দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে, সত্যটা আমি প্রথম থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সত্যটা যে আসলেই সত্য, তা আমি এখন নিশ্চিত ভাবে জানি। আর এই চিঠিটা পড়লে, তুমিও জানতে পারবে। এখনো দুনিয়াটাকে আমার সস্তা আর ধোঁকাবাজির জায়গা বলে মনে হয়। আলাদা দুনিয়া, অন্য রকম সস্তা। কিন্তু সস্তা আর ধোঁকার আধার বটে!
যখন কেউ আমায় বলে, এটাই সত্যি। আর আমি বলি, আসলেই কি তাই? উত্তরে শুনতে পাই, পুরো না হলেও কাছাকাছি…মানে, আমাদের জানামতে এটাই সত্য।
১৯৭৭ সালের কথা বলছি। কম্পিউটার কী জিনিস তা জানতামই না। জটিল যন্ত্ৰ বলতে আমার ছিল একটা বড় আর দামি ক্যালকুলেটর। দুর্ভাগ্যক্রমে ম্যানুয়াল হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই বাসায় এসে দেখি, জিনিসটা যে আসলে কী করতে সক্ষম, সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই! কেবল যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে পারতাম। আর যেহেতু সাইন, কস বা অন্য কোন ধরনের হিসাবের দরকার আমার পড়েনি, তাই সমস্যাও হয়নি কখনো। আর.এ.এফ… আমাকে বাদ দিয়ে দেবার পর, আমি নর্থ লণ্ডনের এজওয়্যারে ছোট একটা কার্পেট ওয়্যারহাউজে হিসাব- রক্ষণের কাজ নেই। দুনিয়া যখন আমার চারপাশে গলে গলে পড়ছিল, তখন আমি আমার ডেস্কেই বসে ছিলাম।
হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই গলে পড়ছিল আমার দুনিয়া।
সত্যি বলছি। মনে হচ্ছিল দেয়াল আর সিলিং আর কার্পেটের বস্তা এমনভাবে গলে পড়ছে, যেমনটা আগুনের সংস্পর্শে এসে মোম গলে যায়। আমি দেখতে পেলাম-দালান, আকাশ আর মেঘও গলে গলে পড়ছে। তাদের পেছনে কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।
গলে পড়া দুনিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে অদ্ভুত কিন্তু উজ্জ্বল রঙের তরল। আমার চামড়ার জুতায় লেগে যাচ্ছিল বার বার। (আমার পায়ের সাইজ অনেক বড়, তাই অর্ডার দিয়ে জুতা বানাতে হয়, বহুত খরচা হয় এতে।)
যদি কেউ আমাকে বলত যে যা দেখছি তা সত্য, তাহলে আমি বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম, হয় আমাকে ড্রাগ দেয়া হয়েছে অথবা স্বপ্ন দেখছি! কিন্তু জানি, এগুলো সত্যি। বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এরপর যখন কিছুই ঘটল না, তখন এক পা দু’পা করে এগোলাম, চিৎকার করে ডাকা শুরু করলাম।
‘হাই।’ একটা কণ্ঠস্বর কানে এলো। উচ্চারণ শুনে আমেরিকান মনে হলো, কিন্তু আবার ঠিক আমেরিকানও না।
‘হ্যালো।’ বললাম আমি।
চোখের সামনে ঝাপসা একটা অবয়ব দেখতে পেলাম। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ নড়েই স্থির হয়ে গেল তা। দেখতে পেলাম, একজন স্মার্ট পোশাক পরিহিত চশমা-পরা ভদ্রলোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
‘তুমি যে বিশালাকার মানুষ, সে কথা জানো তো?’ বলল সে।
তা তো জানিই। আমার বয়স মাত্র উনিশ, উচ্চতা প্রায় সাত ফুটের কাছাকাছি, আঙুলগুলো কলার মতো মোটা। বাচ্চারা আমাকে দেখে ভয় পায়। আমার সাইজের লোকেরা চল্লিশের কোঠা পেরোতে পারে না, আগেই মারা যায়।
‘কী হচ্ছে এখানে?’ আমি জানতে চাইলাম, ‘তুমি জানো?’
‘শত্রুদের ছোঁড়া মিসাইল, একটা সি.পি.ইউ… ধ্বংস করে ফেলেছে,’ বলল সে, ‘দুইশো হাজার মানুষ, সমান্তরালে সংযুক্ত ছিল; কিমা হয়ে গিয়েছে একেবারে। অবশ্য সমস্যা নেই, আমরা একটা মিরর চালাচ্ছি। আবার চালু করতে সময় লাগবে না। কয়েক ন্যানো সেকেণ্ড অপেক্ষা করতে হবে শুধু। লণ্ডন প্রসেসিং করা শেষ হলেই হলো।’
‘তুমি কি ঈশ্বর?’ জানতে চাইলাম। লোকটা কি বলল, তার বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারিনি।
‘হ্যাঁ… উম, না,’ বলল ও। ‘অন্তত তুমি যেরকম ভাবছ, সেরকমভাবে আমাকে ঈশ্বর বলা চলে না।’
ঠিক সেই মুহূর্তে কেঁপে উঠল ধরণী, নিজেকে অফিসে আবিষ্কার করলাম, চা ঢালছি কফিতে। পরবর্তী বিশটা মিনিট কাটল অদ্ভুত এক দে জা ভ্যু-তে। কেউ কিছু বলার আগেই আঁচ করতে পারছিলাম যে সে কী বলতে চাচ্ছে। অবশ্য বিশ মিনিট পর থেকে স্বাভাবিক হয়ে এলো সবকিছু। নিয়ম অনুযায়ী চলতে শুরু করলো ঘড়ির কাঁটা। সেকেণ্ডগুলো বয়ে যেতে শুরু করল।
সেকেণ্ডের পর এলো ঘণ্টা, তারপর দিন…তারপর বছর।
কার্পেট কোম্পানির চাকরিটা চলে গেল, এরপর পেলাম বিজনেস মেশিন বিক্রি করে এমন একটা কোম্পানিতে অ্যাকাউন্ট দেখার চাকরি। স্যান্দ্রা নামের এক মেয়ের সাথে দেখা হলো, বিয়ে করে ফেললাম ওকে। স্বাভাবিক আকৃতির বাচ্চা-কাচ্চাও হলো দুটো। ভেবেছিলাম, দু’জনে মিলে যে-কোন সমস্যা সামলে উঠতে পারব। কিন্তু তা হলো কই! বিচ্ছেদ হয়ে গেল আমাদের। তখন আমার বয়স বিশের কোঠা ছাড়িয়ে ত্রিশ ছুঁই ছুঁই করছে। ১৯৮৬ সালে টটেনহাম কোর্ট রোডে কম্পিউটার বিক্রির চাকরি পেলাম একটা, দেখা গেল আমি বেশ দক্ষ একজন সেলসম্যান!
কম্পিউটার যন্ত্রটাকে ভালো লেগে গেল আমার। এমনকি ওগুলোর প্রথম শিপমেন্টের কথাও আমার স্পষ্ট মনে আছে। কয়েকটার তো চল্লিশ মেগাবাইটের হার্ড ড্রাইভও ছিল…আসলে তখন খুব সহজে ইমপ্রেসড হয়ে যেতাম।
এজওয়্যারে বাস করতাম, নর্দার্ন লাইনের কমিউটার ট্রেন ছিল আমার যাওয়া- আসার মাধ্যম। এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছি, কেবল ইউস্টোন ছেড়ে এসেছে ট্রেন। অর্ধেক যাত্রী নেমেও গিয়েছে।
হঠাৎ টানেলের মাঝে থেমে দাঁড়ালো বাহনটা।
অন্তত সে মুহূর্তে তাই ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম: ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
আর তারপর ইউস্টোন পার হয়ে এলাম, নেমে গেল অর্ধেক যাত্রী।
আর তারপর ইউস্টোন পার হয়ে এলাম, নেমে গেল অর্ধেক যাত্রী।
আর তারপর এমনভাবে সবকিছু কেঁপে উঠল যে ভয় পেয়ে গেলাম, মনে হচ্ছিল আরেকটা ট্রেন আমাদের ট্রেনের সাথে বাড়ি খেয়েছে!
আর তারপর ইউস্টোন পার হয়ে এলাম, নেমে গেল অর্ধেক যাত্রী। টানেলের মাঝে থেমে দাঁড়ালো ট্রেন-
(যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, স্বাভাবিক করে ফেলা হবে সবকিছু, মাথার মাঝে ফিস ফিস করে বলল কেউ)।
এবার যখন ট্রেনটা ইউস্টোনের দিকে এগোতে শুরু করল, নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়ে নিজেই সন্দেহে পড়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, আমি ভিডিও টেপে রেকর্ড করা কোন চরিত্র! আর কেউ একজন বার বার রিওয়াইণ্ড করছে আমায়। জানি, আসলেই ঘটছে ব্যাপারটা। কিন্তু করার কিছু নেই।
পাশে বসা কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটি আমাকে একটা নোট ধরিয়ে দিল: আমরা কি মরে গেছি?
শ্রাগ করলাম, আমি জানি না। হতেও পারে।
ঠিক তখনই সাদা হয়ে গেল দুনিয়া।
আমার পায়ের নিচে কোন মাটি নেই, নেই মাথার উপরে আকাশ, দূরত্ব বোঝার কোন নেই, উপায় নেই সময় আন্দাজ করার। সাদা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি আমি, কিন্তু একা নই।
ওই চশমা পরিহিত লোকটাও আছে। ‘তুমি? আবার?’ বলল সে, ‘আমি তো কেবলই তোমার সাথে কথা বললাম।’
‘আমার তা মনে হয় না।’ বললাম আমি
‘বলেছি। আধ ঘণ্টা আগে। মনে নেই, মিসাইল আঘাত হেনেছিল?’
‘কার্পেট ফ্যাক্টরি ছিলাম যখন? সে তপ অনেক বছর আগের কথা।
উম…নাহ। ঘড়ি ধরে সাঁইত্রিশ মিনিট হবে। তখন থেকে অবশ্য আমরা ফাস্ট মুডে চলছি। নষ্ট সময়টাকে পুষিয়ে নিতে হবে না!’
‘কে পাঠিয়েছে মিসাইল?’ জানতে চাইলাম, ‘ইউ.এস.এস.আর.? নাকি ইরানিরা?’
‘এলিয়েনরা।’
‘ঠাট্টা করছ?’
‘মনে হয় না। কয়েকশো বছর ধরে মহাকাশে স্পেস প্রোব পাঠাচ্ছি আমরা। মনে হচ্ছে, ও-গুলোর পিছু পিছু এলিয়েন চলে এসেছে। মিসাইল আঘাত করার আগে কিছু টেরই পাইনি! কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তা বের করতে করতে আরও বিশ মিনিট লেগে গিয়েছে। এজন্যই ফাস্ট মুডে চলছে সবকিছু। কেন, গত এক দশকটা খুব দ্রুত পার হয়েছে বলে মনে হয়নি?’
‘হুম, তা বলা যায়।’
‘তাহলে বুঝতেই পারছ।’
‘এখন কী করবে?’
‘আঘাত দিয়েছে, প্রত্যাঘাত করব। তবে সময় লাগবে। নতুন যন্ত্রপাতি বানাতে হবে।’
সাদা রঙ আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসা শুরু করেছে। এতক্ষণে এই প্রথম চোখ খুলে চাইলাম।
এতটা তীক্ষ্ণ…টিউব দিয়ে ভর্তি, অন্ধকার, অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য দৃশ্য আগে দেখিনি। বিভ্রান্তিকর, তবে বাস্তব। বাস্তব, তবে দুঃস্বপ্ন যেন। ত্রিশ সেকেণ্ড দেখতে পেয়েছি, কিন্তু এই প্রতিটা সেকেণ্ড যেন অনন্ত কালের সমান।
আর তারপর ইউস্টোন পার হয়ে এলাম, নেমে গেল অর্ধেক যাত্রী।
কালো মেয়েটার সাথে গল্প করা শুরু করলাম, জানলাম-ওর নাম সুসান। কয়েক সপ্তাহ পর আমার অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এলো মেয়েটি। বয়ে চলল সময়।
এক রাতে মেয়েটিকে কিছু কিছু ব্যাপার বলে বসার মতো ভুল করে ফেলি আমি। বলি আমরা আসলে একধরনের যন্ত্র। তারের মাধ্যমে কোন না কোন সি.পি.ইউ… বা মেমোরি চিপের সাথে সংযুক্ত। আমাদেরকে হ্যালুসিনেশন গেলানো হচ্ছে। আমাদের মস্তিষ্ক ব্যবহার হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ বা হিসাব নিকেশের কাজে।
‘তুমি কি আসলেই এসব বিশ্বাস করো?’ কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইল সুসান।
সত্যি বলছি, মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চাইনি কোনদিন। তাই চুপ করে গেলাম।
কাজ হলো না। পরের সপ্তাহে আমাকে ছেড়ে চলে গেল ও।
দে জা ভ্যু এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে।
একদিন সকালে উঠে দেখি, আবারো ১৯৭৫ সালে ফিরে এসেছি। বয়স সেই ষোলো! আর.এ.এ.এফ… রিক্রুটিং এজেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
‘বেশ বড়-সড় সাইজের ছেলে তুমি।’ বলল অফিসার। আমার মনে হয়েছিল, সে আমেরিকান। কিন্তু নিজেকে কানাডিয়ান বলে পরিচয় দিচ্ছিল। চোখে ছিল চশমা।
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি উড়তে চাও?’
‘অন্য যে-কোন কিছুর চেয়ে বেশি চাই।’
‘হুম,’ বলল চশমা চোখের লোকটা। ‘কিছু নিয়ম বাঁকাতে হবে, তবে তোমাকে ওড়ার ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে।’ হলোও তাই।
পরের কয়েকটা বছর কাটল অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। বিভিন্ন ধরনের প্লেন নিয়ে আকাশে ভাসলাম আমি। প্রথমে পেলাম সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স। এরপর নোবেল ক্লিয়ারেন্স, যার সামনে সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স নস্যি। অবশেষ পেলাম গ্রেসফুল ক্লিয়ারেন্স, যা প্রধান মন্ত্রীও পান না। বিভিন্ন আকৃতির সসার চালাতে শুরু করলাম।
স্যান্দ্রা নামের মেয়েটির সাথে পরিচয় হলো, বিয়ে করে ফেললাম ওকে। কারণ বিবাহিতরা ‘ম্যারিড কোয়ার্টার’-এ থাকার সুযোগ পায়। আমাদেরকে ডার্টমুরের এক আপাত নির্জন এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। বাচ্চা-কাচ্চা নেইনি, কেননা আমাকে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল এই বলে: অনেক বেশি রেডিয়েশনের মুখোমুখি হয়েছি আমি। বাচ্চা জন্ম দেবার উপযুক্ত নই আর।
১৯৮৫ সালে চশমা পরা লোকটা আমার ঘরে এসে প্রবেশ করল।
আমার স্ত্রী ওর মায়ের কাছে গিয়েছিল। আমাকে নাকি আর সহ্য করতে পারছে না। আমার উপস্থিতি ওর স্নায়ুর উপর চাপ ফেলছিল। কারণ ছিল না, তা বলব না। সবাই বলছিল-এরপর কী হবে তা যেন আঁচ করতে পারছি আমি! কিন্তু সত্যি কথা হলো, এটা সবার সাথেই ঘটছিল। যেন সবাই একই জীবন সহস্রবারের মতো যাপন করতে করতে, কী হবে না হবে তা মুখস্থ করে ফেলেছে।
সান্দ্রাকে বলতে চেয়েছিলাম একবার, কিন্তু কেন জানি বুঝতে পেরেছিলাম: মুখ খুললেই মেয়েটাকে হারাতে হবে। অবশ্য হারাচ্ছিলাম এমনিতেও। বসে বসে মগ ভর্তি চা পান করছিলাম, এমন সময় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল লোকটা।
সময় দেখে নিয়ে বলল, ‘যাবার সময় হয়েছে। পি.এল.-৪৭ এর মতো দেখতে একটা বিমান ওড়াবে তুমি।’
এমনকি গ্রেসফুল ক্লিয়ারেন্স প্রাপ্ত সবাই-ও পি.এল.-৪৭ এর কথা জানে না। আমি অবশ্য ডজনখানেক বার উড়িয়েছি ওটাকে। চায়ের কাপের মতো দেখতে, যেন স্টার ওয়ার্সের কোন বাহন।
‘সান্দ্রার জন্য একটা নোট লিখে গেলে ভালো হয় না?’ জিজ্ঞাসা করল।
‘না,’ সরাসরি নিষেধ করে দিল, ‘মেঝের ওপর বসে পড়। বুক ভর্তি করে শ্বাস নাও আর ছাড়ো। নাও আর ছাড়ো।’
লোকটার আদেশ অমান্য করার কথা ভাবিনি কোনদিন, আজকেও করলাম না।
নাও…
ছাড়ো…
নাও…
তীব্র এক ঝলক ব্যথা অনুভব করলাম।
নাও…
ছাড়ো…
চিৎকার করে উঠলাম ব্যথায়, কিন্তু আওয়াজ বেরোল না কণ্ঠ দিয়ে
নাও…
ছাড়ো… …
মনে হচ্ছিল, কেবল যেন জন্মালাম। খুব একটা আরামদায়ক ছিল না ব্যাপারটা। তবে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর পূর্ণ মনোযোগ থাকায়, কিছুটা হলেও অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলাম ব্যথাটুকু। চোখ খুললাম আমি।
আট ফুটের মতো চওড়া একটা ধাতব ডিস্কের উপর আবিষ্কার করলাম নিজেকে। নগ্ন আর ভেজা শরীরে শুয়ে আছি। চারপাশে শুধু তার আর তার।
নিজের নগ্ন দেহের দিকে তাকালাম। কোন পশম নেই, আবার চামড়াও ভাঁজ খায়নি। আসলে বয়স কতো আমার? আঠারো? বিশ? কোন ধারণাই নেই আমার।
মেটাল ডিস্কটার মেঝেতে একটা কাচের স্ক্রিন আছে। ওখানে দেখা যাচ্ছে চশমা পড়া লোকটাকে।
‘সব স্মৃতি আছে তো?’ জানতে চাইল সে। ‘স্মৃতিভ্রষ্ট হবার কথা না।’
‘আমার তো তাই মনে হয়।’ বললাম।
‘ভালো। আচ্ছা শোন,’ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল লোকটা, ‘তুমি একটা পি.এল.-৪৭ ওড়াবে। কেবল বানানো শেষ হয়েছে। একদম গোড়া থেকে কাজ করতে হয়েছে বলতে পার। বিশ্বাস করবে না, ওগুলো বানাবার জন্য নতুন করে ফ্যাক্টরির যন্ত্রও বানাতে হয়েছে! এই মুহূর্তে আমাদের হাতে একটা মাত্র পি.এল.-৪৭ আছে। কালকের মাঝে আরও অনেকগুলো তৈরি হয়ে যাবে।’
‘তাহলে আর সমস্যা কি? এই পি.এল.-৪৭ দিয়ে কাজ না হলে, অন্য একটা দিয়ে হবে।’
‘যদি কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারি, তবে না! আবার মিসাইল ছোঁড়া শুরু হয়েছে। পনেরো মিনিট হবে, কিন্তু তাতেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আমাদের তো মনে হয়, আসল আক্রমণ শুরুই হয়নি।
‘কী ফেলছে ওরা? নিউক্লিয়ার বোমা?’
‘পাথর।’
‘পাথর!’
‘হুম। পাথর। উপগ্রহ। বিশাল বড় বড় পাথর। আমাদের তো আশঙ্কা হচ্ছে, আত্মসমর্পণ না করলে হয়ত চাঁদটাকেই…
‘ঠাট্টা করছ।’
যদি তাই হতো!’ স্ক্রিন কালো হয়ে গেল।
অগোছালো আর জট পাকানো তারের জঙ্গল এড়িয়ে এগোল ধাতব ডিস্ক অগণিত মানুষের ঘুমন্ত, নগ্ন দেহ দেখতে পেলাম আমি।
পি.এল.-৪৭টা যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
গাছের গুঁড়ির মতো মোটা আমার দুই পা এখনো কাঁপছে। কোনক্রমে পাইলটের সিট পর্যন্ত নিয়ে গেলাম নিজেকে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমার জন্যই যেন বানানো হয়েছে এটাকে। স্ট্র্যাপ বেঁধে নিলাম। বহুদিনের অভ্যাসে পরিণত হাত দুটো নিজে থেকে উড়ে বেড়াতে লাগল কনসোল জুড়ে। টের পেলাম, আমার মেরুদণ্ডের একদম নিচের দিকে এসে লাগল একটা প্লাগ। আরেকটা লাগল ঘাড়ের উপর দিকে।
পুরো শিপটা এখন আমার সাথে এক হয়ে গিয়েছে। উপর, নিচ সবকিছু একই সাথে দেখতে পাচ্ছি আমি।
বাম পাশের ছোট স্ক্রিনটাকে ভেসে উঠল চশমা পড়া লোকটার চেহারা, ‘গুড লাক।’
‘ধন্যবাদ। শেষ একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘অবশ্যই, কেন নয়?’
‘আমাকেই কেন?’
‘আসলে,’ বলল সে, ‘সংক্ষিপ্ত উত্তরটা হলো, তোমাকে এ কাজের জন্যই ডিযাইন করা হয়েছে। শুধু কিছু বাড়তি বৈশিষ্ট্য যোগ করেছি আমরা। তুমি আকারে বড়, সাধারণের তুলনায় অধিক গতি সম্পন্ন। তোমার রি-অ্যাকশন টাইম দ্রুত।’
‘আমি সাইজে বড়, তবে দ্রুত নই।’
‘আসল জীবনে তুমি দ্রুত।’ বলল সে, ‘কাল্পনিক দুনিয়ার কথা বাদ দাও।’
চলতে শুরু করল আমার পি.এল.-৪৭।
এলিয়েনদের দেখতে পাইনি, কিন্তু ওদের শিপটাকে দেখেছি। ফাঙ্গাসের মতো দেখতে। চাঁদকে ঘিরে পাক খাচ্ছিল। আকারে তাসমানিয়ার সমান হবে। দীর্ঘদিন সমুদ্রের পানিতে কাঠ ডুবিয়ে রাখলে তার উপর যেমন আগাছা জন্মে, অনেকটা সেরকম।
দুইশো মাইল লম্বা আঠালো শুঁড় দিয়ে গ্রহাণুকে টেনে আনছে ওটা।
শিপটার কয়েক হাজার মাইলের কাছে পৌঁছলে, আমাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে দিল এলিয়েনরা।
মিসাইল ছোঁড়ার বাটনটার উপর ঘোরাঘুরি করছিল আমার আঙুল। কিন্তু, কেন করছি আমি এ-কাজ? আমার চিরচেনা দুনিয়ার জন্য? না তো! সেটা এক কাল্পনিক দুনিয়া, শূন্য আর একের মিলনে তৈরি। আমি বাঁচাচ্ছি এক দুঃস্বপ্নকে…
কিন্তু এই দুঃস্বপ্নকে না বাঁচালে, কল্পনাও যে বাঁচবে না।
সুসান নামের এক মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল আমার। অনেক আগের কোন এক জীবনে দেখা হয়েছিল। এখনো কি বেঁচে আছে মেয়েটা? (কতক্ষণ আগে দেখা হয়েছিল ওর সাথে? কয়েক ঘণ্টা? নাকি কয়েক জীবন?) নাকি অন্য সবার মতো কোন এক তারের মাথায় ঝুলছে?
একদম কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি শিপটার। এখন ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ছে আমার দিকে। এলিয়েনদের অন্তত একটা বৈশিষ্ট্য প্রশংসার দাবী রাখে: বোমার পেছনে টাকা আর রিসোর্স নষ্ট না করে, শুধু গতি শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে ওরা।
একটাও যদি আমার পি.এল.-৪৭ এ লাগে, তাহলে আমি শেষ।
একমাত্র দ্রুত গতিই পারে ওদেরকে হারাতে, আর তাই কাজে লাগালাম আমি।
শিপটার ঠিক মাঝখানে একটা বড় চোখ আকৃতির নিউক্লিয়াস। কয়েকশো গজ দূর থেকে ছুঁড়ে দিলাম মিসাইল। এরপর পালালাম।
মিসাইলটা যখন বিস্ফোরিত হয়, তখনও নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছাতে পারিনি আতশবাজি ফেটে উঠল যেন আমার চারপাশে। নানা রঙের, নানা ডিজাইনের বিস্ফোরণ দেখতে পেলাম।
‘পেরেছি!’ চিৎকার করে বললাম। ‘আমি পেরেছি!’
জ্বলে উঠল স্ক্রিন। চশমা পড়া লোকটা আমার দিকে চেয়ে আছে। ‘হ্যাঁ, তুমি পেরেছ।’ একমত হলো সে।
‘ল্যাণ্ড করব কোথায়?’ জানতে চাইলাম।
একমুহূর্ত ইতস্তত করে জবাব এলো, ‘ল্যাণ্ড করতে হবে না। আমরা সেই ব্যবস্থা রাখিনি। খরচ বেশি পড়ে যায়।
‘তাহলে আমার কী হবে? পৃথিবীকে এইমাত্র বাঁচালাম আমি, আর এখন দম বন্ধ হয়ে মারা যাব?’
‘ব্যাপারটা সেরকমই দাঁড়ায়।’
এক এক করে বন্ধ হতে শুরু করল আলো। এরপর বন্ধ হলো কন্ট্রোল। চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় একটা চায়ের কাপে বসে মহাকাশে ভাসছি আমি 1
‘কতক্ষণ সময় আমার হাতে আছে?’
‘ঘণ্টা দুয়েক হবে। কন্ট্রোল বন্ধ করে দিলেও, বাতাস সরিয়ে নিচ্ছি না। অমানবিক হবে কাজটা।’
‘আচ্ছা তুমি কি জানো? যে দুনিয়ায় আমার বাস, সেখানে এই কাজের জন্য আমাকে মেডেল দেয়া হতো?’
‘আমরা কৃতজ্ঞ।’
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এরচেয়ে ভালো উপায় পেলে না?’
‘নাহ। তুমি আসলে একটা ইউনিট, এরকম ইউনিট অনেক আছে। একটা মাত্র মৌমাছি মারা গেলে কি পুরো মৌচাক শোক প্রকাশ করে? করে না।
‘আর তোমাদের বিরুদ্ধেই এই ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করা হোক, এটাও তোমরা চাও না। তাই তো?’
‘তাও বলতে পার।’
কালো হয়ে গেল স্ক্রিন, এমনকি একবার বিদায় পর্যন্ত বলল না লোকটা।
শ্বাস-প্রশ্বাস আমরা সচেতনভাবে নেই না বটে, কিন্তু যখন জানা থাকে যে অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই বাতাস ফুরিয়ে যাবে, তখন…
শ্বাস, দম বন্ধ, প্রশ্বাস, দম বন্ধ।
শ্বাস, দম বন্ধ, প্রশ্বাস, দম বন্ধ।
আচমকা বলে উঠলাম, ‘কেউ আছ?’
জ্বলে উঠল স্ক্রিন, ‘বলো।
‘আমার একটা অনুরোধ আছে। তোমরা, মানে মানুষ, যন্ত্র বা আর যা-ই হও না কেন-আমার কাছে তোমরা ঋণী। এ-কথা স্বীকার করো তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার হাতে আর ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে-’
‘সঠিক হিসাব অনুযায়ী সাতান্ন মিনিট।’
‘আমাকে কি আবার দুনিয়ায় ফেরত পাঠানো যায় না? মানে আমার নিজের দুনিয়ায়?’
‘উম, ঠিক নিশ্চিত না। দাঁড়াও, দেখি।’
শ্বাস, দম বন্ধ, প্রশ্বাস, দম বন্ধ।
অপেক্ষারত নিজেকে বেশ প্রশান্ত মনে হলো।
আচমকা কথা বলে উঠল কেউ, ‘ব্যবস্থা করছি।’
খুলির গোড়ায় ব্যথা অনুভব করলাম। এরপর কয়েক মিনিটের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল সব।
এরপর…
পনেরো বছর আগের, মানে ১৯৮৪ সালের কথা। কম্পিউটারের বিনিয়োগ করলাম। এখন টটেনহাম কোর্ট রোডে আমার নিজের দোকান আছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তোমাকে লিখছি। এবার সুসানকে বিয়ে করেছি আমি, খুঁজে বের করতে মাসখানেক সময় লেগেছিল। একটা ছেলে আছে আমাদের।
চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে আমার বয়স। আমার সাইজের মানুষ এরচেয়ে বেশি সাধারণত বাঁচে না। হৃদপিণ্ড হাল ছেড়ে দেয়। তোমার হাতে যখন এই চিঠি পৌঁছবে, তখন আমি মৃত। তোমার সামনে তখন থাকবে বিশাল এক কফিন, যাতে দু’জন মানুষ সহজে এঁটে যায়। কিন্তু ওতে শোয়া থাকব এই আমি।
কিন্তু জেনে রেখ সুসান, আমার মিষ্টি ভালোবাসা: আমার আসল কফিন চাঁদকে ঘিরে পাক খাচ্ছে, চায়ের কাপের মতো দেখতে। অল্প সময়ের জন্য হলেও ওরা ফিরিয়ে দিয়েছে আমার দুনিয়া, ফিরিয়ে দিয়েছে তোমাকে। গতবার আমি সত্যিটা তোমাকে… .নাহ, ভুল হলো তোমার মতো একজনকে বলেছিলাম। আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল সে। সেই ঝুঁকি আর দ্বিতীয়বার নিতে চাইনি। তাই লিখে যাচ্ছি সব কিছু। গুড বাই।
হতে পারে ওরা পাষাণ, হৃদয়হীন, কম্পিউটারের ওপর নির্ভরশীল হারামজাদা। কিন্তু ওদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
এই শেষ বিশটা মিনিট ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ক’টা বছর।
***