গোলাম মাওলা ধীর-স্থির মানুষ। কঠিন বিপদেও মেজাজ হারান না। শান্ত গলায়, হাসিমুখে কথা বলেন। এই কারণেই খুব দ্রুত তিনি সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি যে রাজনীতির সঙ্গে খুব বেশিদিন যুক্ত, তাও না। বরং তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ইতালিতে। খুব অল্প বয়সেই শ্রমিক হিসেবে ইতালিতে চলে গিয়েছিলেন। ফিরেছেন প্রায় বছর কুড়ি পর। এই কুড়ি বছরে তিনি তার ভাগ্য ফিরিয়েছেন। ইতালিতে নিজের একাধিক রেস্টুরেন্ট হয়েছে তার। হয়েছে নানা ধরনের ব্যবসাও। এই ব্যবসা দেখাশোনার জন্য একে একে ছোট তিন ভাইকেও তিনি ইতালি নিয়ে গেছেন। তারা ব্যবসাটা বুঝে উঠতেই বেশ কবছর হয় দেশে ফিরে এসেছেন গোলাম মাওলা। এসে ইট-বালির ব্যবসা শুরু করেছেন গ্রামে। যদিও অর্থ তার যথেষ্টই হয়েছে, এখন দরকার সামাজিক সম্মান, পরিচিতি। সেই লক্ষ্যেই রাজনীতিতে নেমেছিলেন তিনি। দু হাতে টাকাও খরচ করেছেন।
বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত মানুষের দিকে সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সঙ্গে বাড়িয়েছেন তাঁর স্বপ্নের জালও। যাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন, মাত্র কয়েক বছরেই তাদের অনেককেই রাজনীতি থেকে ঝেরে ফেলেছেন গোলাম মাওলা। খুব দ্রুতই ওপর মহলেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার এই হঠাৎ উত্থান অনেকে মেনে নিতে না পারলেও সরাসরি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি কেউই। একমাত্র ব্যতিক্রম চুন্নু মিয়া। গোলাম মাওলার কঠিন প্রতিপক্ষ। এই দুজনই জানেন, মুহূর্তের সুযোগে একজন আরেকজন ছিটকে ফেলে দেবেন খেলার মাঠ থেকে।
.
গোলাম মাওলা চুপচাপ বসে আছেন বারান্দায়। তাঁর সামনে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সবুর। সবুরের দশাসই শরীর। বিশাল বুকের ছাতি। সেই তুলনায় তার মাথা ছোট। চোখ দুটোও সরু, তাকায় পিটপিট করে। জগতে কাউকে যদি সে ভয় পায়, তবে তা তার সামনে থাকা ওই হাসি-খুশি চেহারার ছোটখাটো মানুষটাকে। গোলাম মাওলা বললেন, আর কি কি বলেছেন চুন্নু ভাই?
অনেক কিছু বলছে ভাই। সব আপনেরে বলন যাইত না।
কেন?
আপনে শুনলে কষ্ট পাইবেন।
যা শুনলে আমি কষ্ট পাব, সেগুলো আমাকে সবার আগে বলতে হবে। কেন বলতে হবে জানিস?
কেন?
তাহলে আমি বুঝতে পারব, আমার দুর্বলতাগুলা কী? কীসে কীসে আমি আঘাত পাই। আঘাতের বিষয় না জানলে শক্ত হওয়াও যায় না, বুঝেছিস?
জি ভাই, বুঝেছি।
বল।
আপনার নামে অনেক আজেবাজে কথা বলছে। বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজও করছে। আর বলছে, আপনে যে এই খুন করছেন, সেই প্রমাণ নাকি তার কাছে আছে।
আর?
সে নাকি আপনের নামে মামলা করব। মার্ডার কেসের মামলা।
গোলাম মাওলা কোনো কথা বললেন না। সবুরই বলল, এখন কি করবেন ভাই?
কোন বিষয়ে?
সে যদি মামলা করে?
মামলা করলে আর কী? জেলে যেতে হবে।
কিন্তু ভাই বিনা দোষে আমরা জেলে যাব কেন?
বিনা দোষে যাব কে বলল?
খুনতো আমরা করি নাই।
তাহলে কে করেছে?
এই প্রশ্নে সবুর থতমত খেয়ে গেল, বুঝলাম না ভাই।
আমরা না করলে তার ভাগ্নেরে খুনটা করল কে?
সবুর কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে হতবুদ্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। গোলাম মাওলা বললেন, এই এলাকায় চুন্নু ভাইয়ের ভাগ্নেরে যদি কেউ খুন করতে পারে, তবে তা একমাত্র আমরাই। আমরা ছাড়া এই কাজ করার সাহস আর কে করবে?
সবুর এবারেও জবাব দিল না। গোলাম মাওলা বললেন, আর যদি আমরাও না করে থাকি, তাহলেতো বিরাট চিন্তার বিষয়। চিন্তার বিষয় না?
জে ভাই। শুধু শরীর থাকলেই হবে না সবুর। মাথাও থাকতে হবে। মাথা খাটা। মাথা খাটালে এই শহর অন্যের হয়ে যেতে সময় লাগবে না।
জে ভাই।
দুনিয়ার সব বড় শহর হচ্ছে নদীর পারে। নদী মানেই জীবন, সম্ভাবনা। এই যে শহর, এই শহর গত কয়েক বছরে কেমনে পাল্টে গেল দেখেছিস?
জে ভাই।
এখনোতো আসল পাল্টানো শুরুই হয় নাই। আসল শুরু হবে সামনে। দেখেছিস, কত বড় বড় ব্যাংক, বীমা, নানা কোম্পানির ডিলার আসতেছে? মানে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। আরো অনেকেই আসবে। খুব দ্রুতই বিশাল বড় শহর হবে এটা। তাই সাবধানে পা ফেলতে হবে, খুব সাবধানে।
.
গোলাম মাওলা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নুরু মিয়াকে ডাকলেন। নুরু মিয়া তার ইটের ভাটা আর বালির ব্যাবসাগুলো দেখে। সম্পর্কে গোলাম মাওলার চাচা হয় সে। কিন্তু বয়সে প্রায় সমান। তারা পরস্পরকে তুমি করে সম্বোধন করেন। নুরু মিয়ার চিমসানো গাল, থুতনিতো সামান্য দাড়ি। সে এসে দাঁড়াতেই গোলাম মাওলা শান্ত গলায় বললেন, হাতে কিন্তু সময় বেশি নাই, নুরু মিয়া।
নুরু মিয়া মিনমিন করে বললেন, আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করতেছি না।
সারা জীবন পড়াশোনা করে পরীক্ষায় ফেল করলে কোনো লাভ নাই। চেষ্টা করতেছো, ভালো। কিন্তু ফল না দিলে চেষ্টার কিন্তু কোনো মূল্য থাকবে না।
বোঝোইতো, বিষয়টা কত সাবধানে করা লাগতেছে।
সেই জন্যইতো প্রেসার দিতেছি না। তবে খেয়াল রাইখো, লিখনের খুনের ঘটনায় কিন্তু আমরা বড়সড় রকমের ফাঁদে পড়ে গেছি।
মানে! সবুরের কথা তাহলে সত্যি?
কী কথা?
চুন্নু মিয়ার কাছে নাকি আমাদের বিরুদ্ধে কী প্রমাণ আছে!
আরে ধুর, কীসের প্রমাণ থাকব? প্রমাণের কিছু নাই। কিন্তু সে যা চাইতেছে, তা সে আদায় করে নিতেছে। চেষ্টাও করতেছে জানপ্রাণ দিয়া। নির্বাচনের আগে আগে পাল্লাটা তার দিকে ভারী হয়ে গেল।
এখন?
এখন এই পাল্লা সমান করতে হবে।
বুঝছি।
তবে মাথা ঠাণ্ডা। তাড়াহুড়া করা যাবে না। মনে রাইখো, এখন তাড়াহুড়া মানেই ভুল।
জে, আচ্ছা।
খুব সাবধানে করবা যা করার। কিন্তু ব্যর্থ হওয়া যাইব না। বুঝলা?
হু।
এখন যাও। আমি দেখতেছি থানা-পুলিশের বিষয়টা নিয়ে কি করা যায়।
আচ্ছা।
.
গোলাম মাওলা শুয়ে পড়লেও তার ঘুম এলো না। লিখনের খুনের ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তিনি চিন্তিত। দলের নীতি নির্ধারক মহল থেকে এখনো তার প্রতি বিরূপ কোনো আচরণ তিনি পাননি। কিন্তু গত কয়েক বছরে চুন্নু মিয়ার প্রতি দলের ভেতরে ভেতরে যে একটা অনাস্থা তৈরি হচ্ছিল, সেটি যেন খানিকটা হলেও থমকে গেল। শুধু তা-ই না, দল হয়তো নির্বাচন নিয়ে নতুন করে ভাবতেও শুরু করবে। আর চুন্নু মিয়াও এই সুযোগ হেলায় হারানোর মানুষ না। দলের প্রভাবশালী এক নেতার সঙ্গে আজ তার কথাও হয়েছে। সেই নেতা আকারে ইঙ্গিতে গোলাম মাওলাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তারা লিখনের ঘটনায় একদমই সন্তুষ্ট না। এই ঘটনায় যে-ই জড়িত থাক, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তারা নিশ্চিত করতে চান। কিন্তু দলের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করেই চুন্নু মিয়াকে তার বিরুদ্ধে মামলা করা থেকে আপাতত বিরত রাখা হয়েছে। তবে নির্বাচনের যত আগে সম্ভব, তারা এর একটা সুষ্ঠু, সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান চান। চুন্নু মিয়া দলের বহু পুরনো, পোড় খাওয়া নেতা, সুতরাং তার প্রতিও দলের একটা দায়িত্ব রয়েছে।
পরদিন বিকেলে থানায় গেলেন গোলাম মাওলা। তার সঙ্গে নুরু মিয়া ও সবুর। তারা দীর্ঘ সময় রেজার জন্য অপেক্ষা করলেন। রেজা জরুরি কাজে খুব ভোরে জেলা শহরে গিয়েছেন। তিনি ফিরলেন সন্ধ্যার আগে আগে। গোলাম মাওলাকে দেখে তিনি সালাম দিয়ে বললেন, ব্যাপার কী? এই মাসের বখরা নিয়ে একদম নিজে চলে আসলেন? প্রতি মাসেতো সবুর বা নুরু মিয়াকে দিয়ে পাঠান।
গোলাম মাওলা হাসলেন, এই মাসে বখরা দিতে না, নিতে আসছি।
পুলিশ বখরা দেয়, এই কথা শুনেছেন কোনোদিন?
কোনোদিন যা শুনিনি, তেমন কত কথাইতো আজকাল শুনি। এটাও না হয় শুনলাম।
আর কী কী শুনলেন এমন?
চুন্ন ভাই নাকি ইলেকশনের ফিল্ড নিজের দিকে নেয়ার জন্য নিজেই এই ঘটনা ঘটাইছে?
কোন ঘটনা?
লিখনের ঘটনা। ইলেকশনের জন্য নিজের আপন ভাগ্নেকে কেউ নিজে…।
কার কাছে শুনলেন এই কথা?
লোকজন হাটে-মাঠে ঘাটে বলাবলি করছে।
কার লোকজন? আপনার?
আমার লোকজন হবে কেন?
আপনার লোক না?
নাহ। এরা সাধারণ মানুষ।
আচ্ছা, তাহলে এমনই আরো কিছু সাধারণ মানুষ আছে, যারা হাটে-ঘাটে মাঠে বলে বেড়াচ্ছে যে এই খুন করিয়েছেন আপনি। তো এরা কারা?
এরা আবার কারা? এরা চুন্নু মিয়ার লোক। এগুলা অপপ্রচারের অংশ বুঝলেন? কথার ছলে মুখে মুখে মানুষের কানে মিথ্যা তথ্য পৌঁছে দেয়া। চুন্নু মিয়া তার লোকজনরে টাকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে এইসব ছড়াচ্ছে।
আর আপনি কী দিয়ে ছড়াচ্ছেন?
মানে?
মানে যারা হাটে-ঘাটে-মাঠে ছড়াচ্ছে যে চুন্নু মিয়া ইলেকশনের ফিল্ড নিজের দিকে নেয়ার জন্য নিজের ভাগ্নেকে নিজে খুন করেছে, তাদেরকে আপনি কি দিয়ে এগুলো বলাচ্ছেন? টাকা, না অন্য কিছু?
আমি বলাব কেন? তারা এমনি এমনিই বলছে।
রেজা চা-পুরির অর্ডার দিলেন। তারপর চায়ের কাপে পুরি ডুবিয়ে কামড় দিতে দিতে বললেন, এগুলো ছাড়েন বুঝলেন। দুজন মিলে যা শুরু করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে খুনটা বুঝি দুইজন মিলেমিশেই করেছেন। এ ছাড়াতো কোনো হিসাব মিলাতে পারছি না।
রেজার কথা বলার ধরন দেখে গোলাম মাওলা কিছুটা দমে গেলেন। তিনি নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। রেজা হঠাৎ নুরু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী খবর নুরু ভাই, আপনার ইটের ভাটাতো এবার শেষ। যে হারে পানি বাড়ছে নদীতে, এবারতো মনে হয় তুমুল বন্যা হবে।
তাতো মনে হয় হইবই।
তবে বন্যা হলেও একটা কারণে রক্ষা। চুন্নু ভাই নির্বাচন আসার আগেভাগেই একটা ভালো কাজ অন্তত করেছেন?
বন্যা রক্ষা বাঁধের কথা বলতেছেন? গোলাম মাওলা মাঝখান থেকে কথা বললেন।
হুম। এবার যদি ওই বন্যা রক্ষা বাঁধটা না থাকত তাহলে আশপাশের সব ফসলি জমি তলিয়ে যেত। লোকজন তাকে গালি দিক, অপছন্দ করুক, এই একটা কাজ কিন্তু তিনি ভালোই করেছেন।
এবার নুরু মিয়া কথা বলল, করছেন ভালো। কিন্তু এই বাঁধের জইন্য যেই পরিমাণ টাকা সরকারের বরাদ্দ ছিল, তার অর্ধেকও খরচ করছেন কিনা কে জানে! দেখেতো তা মনে হয় না। পানি আরেকটু বাড়লে কিন্তু বিপদই আছে।
সে দেখা যাক। এখনওতো মনে হচ্ছে, বাধটাই এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিবে।
ভালো হইলেই ভালো। তবে এই মেয়াদে নিজের পকেটও সে কম ভারী করে নাই।
রেজা গোলাম মাওলার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, এই দিক থেকে অবশ্য আপনি চেয়ারম্যান হলে ভালোই হয়, কী বলেন? আপনারতো আর টাকা-পয়সার দরকার নাই, আপনার দরকার ক্ষমতা, নাম, খ্যাতি।
নুরু মিয়া বলল, একবার হলেই দেখবেন, কেমন ধাই ধাই করে পলাশবাড়ির উন্নতি হয়। কিন্তু ভালো মানুষের ভালো কেউ সহ্য করতে পারে না। দেখেন না, এই জন্যই পেছনে কী পরিমাণ লোক লাগছে?
রেজা হাসলেন। গোলাম মাওলা আর তার মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথা হলো। থানা থেকে বের হতে গিয়েও গোলাম মাওলা আবার থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বিগলিত হেসে পকেট থেকে একটা খাম বের করে রেজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ভুলে গিয়েছিলাম রেজা সাব। এইখানে দুই মাসেরটা একসঙ্গে আছে।
রেজা বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন, সামনের মাসে বাড়ি যাব। এই সময়ে খামটা খুব দরকার ছিল, বুঝলেন? সঠিক সময়ে সঠিক কাজে আপনার কোনো জুড়ি নাই মাওলা ভাই।
.
০৭.
নতুন শহর হলেও রাত আটটা-নটার মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে পলাশবাড়ি। দোকানপাটও বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে যায়। শুধু হারাধন মুচি আর মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানটাতে তখনো আলো জ্বলে। হারাধন তার দুই কর্মচারীকে নিয়ে মাঝ রাত অবধি জুতা বানানোর কাজ করে। আর মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানে সবসময় ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে। রাতে শরিফুলকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন রেজা। আকাশজুড়ে মেঘ করেছে বলে চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। রেজা যখন মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন প্রায় সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টির আশঙ্কায়ই সম্ভবত সবাই একটু আগেভাগে বাড়ি চলে গেছে। রেজা চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের কি অবস্থা মোবাশ্বের?
মোবাশ্বের হাতের গামছা দিয়ে দুধের ডেকচির ওপর পড়া মাছি তাড়াচ্ছিল, সে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালোই চলতেছে ছার।
সামনেতো আরো ভালো চলবে, তাই না?
জে ছার, আশা করা যায়।
তোর দোকানের জায়গাটা কিন্তু ভালো হয়েছে। নতুন ব্যাংকটাও হলো ঠিক দোকানের পাশেই।
জে, ছার। এইটা একখান কাজের কাজ হইছে। ব্যাংকের সবাই এখন আমার বান্ধা কাস্টোমার।
শরিফুল বলল, দুপুরে ভাতের ব্যবস্থাও শুরু কর। অনেকেই এখনো পরিবার নিয়া আসতে পারে নাই। তোর এইখানে লাঞ্চ সাইরা নিতে পারব।
মোবাশ্বের দাঁত বের করে হাসল, এইটা একখান ভালো কথা বলছেন ছার। এই বুদ্ধিতো আগে মাথায় আসে নাই।
রেজা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, এইজন্য শরিফুলকে কমিশন দিস। এত ভালো বিজনেস আইডিয়া দিল, কমিশন না দিলে কিন্তু হবে না।
আইচ্ছা, দিমুনে।
চায়ের কাপ রেখে আরো একটা সিগারেট ধরালেন রেজা। প্রথম টানটা খুব আরাম করে দিলেন। তারপর কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। ধোয়ার ছোট ছোট বৃত্ত দূরে ভেসে যেতে যেতে ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছে। সেই মিলিয়ে যাওয়া বৃত্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন রেজা, যেন খুব জরুরি কিছু মনে পড়েছে! তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে উঠে দাঁড়াল শরিফুলও। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রেজার দিকে তাকাল। রেজা অবশ্য তাকে কিছু বললেন না। তিনি মোবাশ্বেরের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাই রে মোবাশ্বের। ভাতের ব্যবসার কথা মাথায় রাখিস, মাঝে মাঝে আমিও এসে খাবো।
.
রেজা অন্ধকারে খানাখন্দ এড়িয়ে খুব সাবধানে হটছেন। হারাধনের দোকান, মসজিদ পেরিয়ে উত্তর দিকে মূল রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলেন। রাতের নিস্তব্ধতায় হারাধনের দোকানের ভেতর থেকে একনাগাড়ে ঠোকাঠুকির শব্দ ভেসে আসছে। সম্ভবত নতুন কোনো জুতো বানাচ্ছে হারাধন। তার জুতা বানানোর হাত ভালো। তবে সে বানায় খুব অল্প। পরিমাণের চেয়ে মানের দিকে তার নজর বেশি। এই কারণেই তার বানানো এই হারাধন স্পেশাল জুতা স্যান্ডেলের খুব চাহিদা।
রেজা লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে তাল মেলাতে পারছে না শরিফুল। অনেকটা দূর গিয়ে সে হঠাৎ বলল, এত রাইতে এই দিকে আমরা কই যাইতেছি স্যার?
প্রফেসর সাহেবের বাড়ি।
এত রাতে সেই বাড়িতে কী? শরিফুল ভারি অবাক হলো।
এখনো জানি না, তবে আমার মনে হয় কোনো একটা ঘটনা আছে।
কী ঘটনা?
আমার ধারণা তাদের বাড়ির দারোয়ান ছেলেটাকে আমি কিছুক্ষণ আগে শহরে দেখেছি।
তাতে কী? শহরে আসা কী অন্যায় নাকি?
তা-না। ছেলেটা মাথায় করে কিছু একটা নিয়ে যাচ্ছিল। ভারী কিছু।
বুঝলাম না, স্যার। তাতে সমস্যা কি?
সমস্যা হয়তো কিছুই না, কিন্তু অনেক সময় হয় না, মন সতর্ক হয়ে যায়? তেমন একটা ফিলিংস হলো আমার। ইনফ্যাক্ট, প্রথমে ছেলেটাকে আমি চিনতেই পারিনি। সে অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছিল। মোবাশ্বেরের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দোকানের লাইটের আলোতে মুহূর্তের জন্য তার মুখটা আমি দেখেছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারিনি বলেই হয়তো আলাদা করে খেয়ালও করিনি। তবে মনের মধ্যে কি যেন একটা খচখচ করছিল। ছেলেটাকে যে আমি আগেও কোথাও দেখেছি, সেটাই সম্ভবত আমার ব্রেন মনে করিয়ে দিতে চাইছিল। তারপর আচমকা মনে পড়ে গেল। ছেলেটার মাথায় কী ছিল জানো?
কী?
আমার ধারণা জানালার গ্রিল। গ্রিল?
হুম।
তো, তাতে সমস্যা কী? এই দেশে রাতের বেলা জানালার গ্রিল কেনা-বেচা কি নিষিদ্ধ?
তা না। তবে কোথায় যেন একটা ঝামেলা আছে।
কী ঝামেলা?
সেটাইতো বুঝতে পারছি না। কিন্তু ঝামেলা একটা কিছু আছে।
তারা দুজন অনেকটা সময় পায়ে হেঁটে লতিফুর রহমানের বাড়ির সামনে এলেন। বাড়ির প্রধান গেট বন্ধ। অন্ধকারে সুনসান নিস্তব্ধ একটা বাড়ি। দেখলে কেমন গা ছমছমে একটা অনুভূতি হয়। রেজা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দক্ষিণ দিকটায় চলে এলেন। এখানেই সেদিন ভোরে তারা দুজন এসেছিলেন। নদীর পানি আজ আরো বেড়েছে। এবার বন্যা না হয়ে যায়ই না। রাস্তা প্রায় ছুঁই ছুঁই হয়ে গেছে। পানি। রেজা সেখানে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ শিস দিয়ে উঠলেন, আমার ধারণা ঘটনা আমি বুঝতে পেরেছি।
শরিফুল বোকার মতো তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল, কী বুঝতে পেরেছেন স্যার?
তিনি আঙুল তুলে তিনতলার একটা জানালার দিকে নির্দেশ করলেন, আমার ধারণা ওই জানালাটায় কোনো গ্রিল নেই। আর এই জন্যই লতিফুর রহমান দারোয়ান ছেলেটাকে দিয়ে গ্রিল আনতে পাঠিয়েছিলেন।
তো, গ্রিল না থাকলেতো গ্রিল আনতে পাঠাবেই! এতে এত আশ্চর্য হবার কী আছে স্যার?
জানালাটায় যে গ্রিল নেই, সেটি সম্ভবত আমি ওইদিন ভোরেই খেয়াল করে ছিলাম। কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারিনি। আজ ছেলেটাকে গ্রিল নিয়ে আসতে দেখার পর থেকেই ব্যাপারটা মাথায় ঘুরছিল। গ্রিলতো দিনের আলোতেই আনা যায়। এতরাতে অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে আনার কী দরকার?
শরিফুল এবার খানিক বিরক্তই হলো, এটা কোনো কথা বললেন স্যার? আপনে জোর করে প্রফেসর সাহেবকে দোষী বানাতে চাচ্ছেন। যে যার সুবিধা মতোইতো কাজ করবে, তাই না?
সেটাই। রাতের অন্ধকারে যেন কেউ না দেখতে পারে, সেটাও কিন্তু কারো সুবিধা হতে পারে। পারে না?
শরিফুল এবার আর জবাব দিল না। রেজার এমন আজগুবি এবং অতি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত কথাবার্তা তার পছন্দ হচ্ছে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষ বিরক্তই লাগছে।
রেজা বললেন, আবারও বলছি, মানুষ অতি সতর্ক হতে গিয়ে অনেক অস্বাভাবিক কাজ করে ফেলে। উনি যে সেদিন টু লেট’-টা সরিয়ে ফেলেছিলেন, হতে পারে সেটিও এমন অতিরিক্ত সতর্ক আচরণের ফল।
আপনি স্যার শুধু শুধু…।
হুম, শুধু শুধুও হতে পারে। হয়তো অযথাই সন্দেহ করছি, আজগুবি যোগসূত্র মেলাচ্ছি। তবে কথায় আছে না, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিবে তাই…?
শরিফুল এবার আর জবাব দিল না। রেজা বললেন, এক কাজ করলে কেমন হয়?
কী কাজ?
একটা বাজি ধরা যাক।
কীসের বাজি?
আমি একটা অনুমান করব। আমার অনুমান যদি সত্যি হয়, তুমি আমাকে পাঁচ শ টাকা দেবে। আর মিথ্যে হলে আমি তোমাকে এক হাজার টাকা দিব। ওকে?
শরিফুল কিছুক্ষণ ভেবে বলল, কি অনুমান?
আমার ধারণা, আজ গভীর রাতে প্রফেসর সাহেব একা একা জানালার গ্রিল লাগানোর চেষ্টা করবেন।
শরিফুল ভারি বিরক্ত হলো, উনি কেন জানালার গ্রিল লাগাবেন? উনি কী মিস্ত্রি নাকি? আর চাইলেই কি যে কেউ এই কাজ করতে পারবে?
উনি পারবেন। কেন তুমি শোনোনি, উনি সেদিন কি বললেন? মিস্ত্রিদের সঙ্গে থেকে থেকে উনি নিজেও রোজ কাজ করতেন। এটা-সেটা করে হেল্প করতেন। এমনকি এই বছরখানেকের কাজে অনেক কাজ উনি শিখেও গেছেন?
শরিফুল এবার আর কথা বলল না। চুপচাপ তিনতলার জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরে রাজ্যের মশা। সেই মশার কামড় খেয়েই গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন রেজা আর শরিফুল। কিন্তু রেজার অনুমান ঠিক হলো না। রাতে লতিফুর রহমান গ্রিল লাগাতে এলেন না।
.
প্রায় ভোর রাতের দিকে তারা থানায় ফিরল। মশার কামড়ে হাত-পা ফুলে গেছে দুজনেরই। শরিফুল হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্যার টাকা।
রেজা বললেন, কিসের টাকা?।
বাজির এক হাজার টাকা।
রেজা হতাশ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ শরিফুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে শরিফুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এই দিন দিন না, বুঝলে?
শরিফুল বত্রিশ দাঁত বের করে হাসল, বুঝব না কেন স্যার, বুঝেছি।
.
পরের সারাটা দিন থম ধরে বসে রইলেন রেজা। আপাতদৃষ্টিতে সহজ-সরল একটা ঘটনাকে তিনি কি খুব জটিল করে ফেলছেন? লতিফুর রহমানকে সন্দেহ করাটা কি পুরোপুরিই অযৌক্তিক? তিনি কি জোর করেই, বা নিজেকে নিজের কাছেই খুব তীক্ষ্ণ, আলাদা পুলিশ অফিসার হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন? রেজা নিজের ভেতরের এই দ্বন্দ্বটা সারা দিনেও তাড়াতে পারলেন না। বরং দুপুর নাগাদ তার মনে হলো, কেসটা মোটেই সহজ কোনো কেস নয়, তা এই খুনের সঙ্গে যে-ই জড়িত থাকুক না কেন!
সবচেয়ে সহজ হতে পারত যদি এই কেসের সঙ্গে গোলাম মাওলাকে সরাসরি অভিযুক্ত করা যেত। সেটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, সবচেয়ে যৌক্তিক বিষয় ছিল। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। অন্যদিকে, অস্বাভাবিক হলেও চুন্নু মিয়াকেও পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত ভাবতে পারছেন না। তবে, যে বিষয়টি পুরো ঘটনাটিকে সবচেয়ে বেশি জটিল করে ফেলছে, তা হলো লতিফুর রহমানের প্রতি তার অনর্থক আগ্রহ। এই আগ্রহটি নিয়ে তিনি দ্বিধান্বিত, বিরক্ত। হয়তো এর কোনো যুক্তিসংগত কারণই নেই। কিন্তু রেজা এটিও জানেন, অপরাধ সবসময় সহজ, স্বাভাবিক, যৌক্তিক বা অনুমেয় পথেই ঘটেনা। ঘটে অননুমেয় পথেও।
এই দ্বিধা কাটাতেই পরদিন বিকেলে আবারো লতিফুর রহমানের বাড়ির দিকে গেলেন রেজা। কিন্তু পথে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চুন্নু মিয়ার। বন্যার পানি এই একরাতেই আরো বেড়েছে। লতিফুর রহমানের বাড়ি থেকে শহরের দিকে আসার রাস্তাটা একটা জায়গায় সামান্য নিচু। সেই নিচু জায়গায় পানি উঠেছে। খবর পেয়ে চুন্নু মিয়া লোকজন নিয়ে রাস্তার অবস্থা দেখতে এসেছেন। নির্বাচনের আগে আগে এই রাস্তা, আর উত্তর দিকের বিস্তীর্ণ ফসলি জমির বন্যা রক্ষা বাঁধ নিয়ে তিনি ভীষণ চিন্তিত। এর কোনটা যদি এই বন্যায় ভেঙে যায় বা তলিয়ে যায়, তবে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের যেমন সীমা থাকবে না, তেমনি নির্বাচনের আগেই পরাজয়েরও আর বাকি থাকবে না চুন্নু মিয়ার। আর সকলের মতো এই বাস্তবতা তিনি নিজেও জানেন।
রেজাকে দেখে চুন্নু মিয়া অবশ্য কথা বললেন না। সেদিনের পর থেকে রেজাকে তিনি এড়িয়ে চলছেন। তবে তার সঙ্গে থাকা সোহরাব মোল্লা এগিয়ে গিয়ে সালাম দিল, রাস্তা দেখতে আসছেন স্যার?
রেজার হয়ে জবাব দিল শরিফুল, আমরা রাস্তা দেখতে আসব কেন? রাস্তা দেখাতো আমাদের কাজ না।
সোহরাব মোল্লা বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল, না না, সেইটা না, ভাবলাম খবর শুইনা আসছেন। চেয়ারম্যান সাব দুয়েকদিনের মইধ্যেই রাস্তার দুই পাশে ইট আর বালির বস্তা দিয়া উঁচু করার ব্যবস্থা নিতেছেন।
রেজা বললেন, বন্যার অবস্থাতো ভালো মনে হচ্ছে না। অপেক্ষা করার দরকার কী? গোলাম মাওলা সাহেবেরতো ইট বালির ব্যবসা আছে, ওখান থেকে কিছু বস্তা নিয়ে আসলেইতো হয়?
সোহরাব মোল্লা জিভ কেটে আঁতকে ওঠার ভঙ্গিতে বলল, এই কথা বইলেন না স্যার। চেয়ারম্যান সাব শুনলে মাইন্ড খাইব। গোলাম মাওলার কাছেরতন সে নিব ইট? জীবনেও না। চিন্তা কইরেন না, ইট-বালির ব্যবস্থা হইতেছে।
যা করার, তাড়াতাড়ি করেন, অবস্থা কিন্তু ভালো না।
সবই আল্লাহর ইচ্ছা। কথায় আছে না, আল্লাহর মাইর, আলমের বাইর?
তা অবশ্য ঠিক।
তা আপনেরা কই যাইতেছেন?
রেজার ইচ্ছে ছিল না বলে, কিন্তু পাশ থেকে শরিফুল ফট করে বলে বসলো, এই একটু প্রফেসর সাহেবের বাড়িতে।
সেই বাড়িতে কী? দাওয়াত?
পুলিশের আবার দাওয়াত কী? তাদের কাজতো ওই একটাই…।
শরিফুল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রেজা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তেমন কিছু না, শরিফুলের সামনে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর বউ নিয়ে আসলে তখন সে থাকবে কই? এইজন্যই তার জন্য বাসা ভাড়া দেখতে যাচ্ছি।
.
শরিফুল এবং সোহরাবকে আর কোনো কথা বলতে দিলেন না রেজা। তিনি এগিয়ে গেলেন সামনে। লতিফুর রহমানের বাড়ির গেটে এনায়েত বসা। সে লতিফুর রহমানকে খবর দিয়ে নিয়ে এলো। রেজা সালাম দিয়ে বললেন, আপনার জন্য একজন নিশ্চিন্ত ভাড়াটে আছে স্যার।
লতিফুর রহমান নিস্পৃহ গলায় বললেন, কে?
এই যে শরিফুল। খুব ভালো ছেলে। সে বিয়ে করবে সামনে, কিন্তু বউ নিয়ে এসে এখানে থাকবে কই? এইজন্যই বাসা খোঁজা। আর তখুনি আপনার বাসার কথা মনে পড়ল।
লতিফুর রহমান বিগলিত হাসলেন, সেটাতো শুভ সংবাদ। আর আমার বাড়িতে আপনাদের কেউ থাকা মানেতো আমিও নিশ্চিন্ত। একা এত বড় বাড়ি নিয়ে সবসময়ই দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়তো সেই একটাই, ঘরগুলো এখনো থাকার মতো অবস্থায় নেই।
সেটা কোনো সমস্যা না। আমরা পুলিশের চাকরি করি। আরাম-আয়েশের জীবনতো আর নয়, সবকিছুতেই আমাদের অভ্যাস আছে।
শরিফুলকে একে একে নিচের ঘরগুলো দেখালেন লতিফুর রহমান। রেজা অবশ্য ওপরের ঘরগুলো দেখতে চাইলেন। ওপরের একটি ফ্ল্যাটের কাজই শেষ হয়েছে। বাকি অংশের ছাদ করা যায়নি বলে অসমাপ্ত। ঘরের দরজা খুলে প্রথমে ঢুকলেন লতিফুর রহমান। এ ঘরে জানালার আলো সেভাবে আসে না বলে ভেতরটা অন্ধকার। রেজা দেয়ালের সুইচ টিপে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ হলো না। লতিফুর রহমান বললেন, এখানে এখনো কারেন্টের লাইন লাগানো হয় নি।
রেজা পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালালেন। সময় নিয়ে এটা-সেটা দেখলেন তিনি। তারপর ঢুকে গেলেন মূল বেড রুমে। বাথরুমের দরজাটাও খুলে দেখলেন, কোথাও সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। লতিফুর রহমান বললেন, বাথরুমের পানির লাইনও এখনো পুরোপুরি ঠিক হয় নি। কবে যে করতে পারব, তাও বুঝতে পারছি না।
রেজা বললেন, যেভাবে এত বড় বাড়ি করেছেন, সেভাবেই ধীরে ধীরে হয়ে যাবে। এত চিন্তা করবেন না। তারপর শরিফুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, থাকবে তুমি, তোমারই ভালো করে দেখে নেয়া উচিত। ওই দিকের জানালার পর্দাটা সরিয়ে জানালা খুলে দাও, আলো আসবে।
শরিফুল জানালার পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিল। বিকেলের বিষণ্ণ আলোয় অন্ধকার ঘরটা মুহূর্তেই কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। রেজা সেই অন্যরকম আলোয় জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে বিস্তীর্ণ জলরাশি। দূরে নির্জিব ইটের ভাটা। ফুরফুরে হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে ধানের ডগা। তিনি দীর্ঘসময় বাইরে তাকিয়ে রইলেন। লতিফুর রহমান বললেন, এই ঘটরটাই যা একটু ভালো, কিন্তু ওই যে, ইলেক্ট্রিসিটি, পানি, বাথরুমের সমস্যা। ওই সমস্যাগুলো না থাকলে থাকার জন্য এটা বেশ ভালোই হতো।
রেজা বললেন, হ্যাঁ, জানালাগুলোও বেশ বড়োসড়ো, আলো-হাওয়াটাও বেশ খেলবে।
আমার একটু বড় জানালাই পছন্দ। সেদিন দেখেননি, নিজের ঘরে দেয়ালজোড়া জানালা করেছি!
হ্যাঁ, তা দেখেছি। বলতে বলতে একহাতে গ্রিলের নিচের দিকটা ধরলেন রেজা। তারপর বললেন, কিন্তু স্যার, এই জানালার গ্রিলটা কী আলাদা লাগানো নাকি? দেখে মনে হচ্ছে নতুন লাগানো?
লতিফুর রহমান তখন বাথরুমের দরজাটা আটকাচ্ছিলেন। তিনি ঘুরে তাকালেন, যেন ঠিকমতো বুঝতে পারেননি রেজার কথা। জিজ্ঞেস করলেন, কোন জানালা?
এই যে এটা। নিচের ওয়াল দেখে মনে হচ্ছে দুয়েকদিন আগে কেবল জানালাটা লাগানো হয়েছে, রংও করা হয়নি। অথচ অন্য সব জানালার গ্রিলেই রঙ করা।
লতিফুর রহমান হাসলেন, ওই যে বললাম, রোজ একটু একটু করে বাড়িটা গড়েছি। এখনো গড়ছি। একসঙ্গেতো সব করার ক্ষমতা নেই। আজ এই গ্রিল করছি, কাল ওই দরজা করছি, এভাবেই চলছে।
রেজা অবশ্য জবাব দিলেন না। তিনি আরো খানিক ঘোরাঘুরি করে নিচে নেমে এলেন।
.
রাতে শরিফুলকে নিয়ে হাঁটতে বের হলেন রেজা। শরিফুল বলল, এবার বুঝলেনতো স্যার, আপনি শুধু শুধু সন্দেহ করতেছিলেন?
শুধু শুধু কীভাবে?
স্যারতো বললেনই কেন তিনি আলাদা গ্রিল লাগিয়েছেন। গ্রিলে কি সমস্যা, সেটাইতো বুঝতে পারতেছি না।
আমিও বুঝতে পারছি না।
তাহলে?
তাহলেও প্রশ্ন আছে। আচ্ছা ধরো, যেই ঘরে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, বাথরুমে পানি নেই, এমনকি এর আগে কেউ কখনো সেই ঘরে থাকেনি, তেমন একটা ঘরে জানালায় পর্দা থাকা অস্বাভাবিক কী না? ধরে নিলাম জানালায় পর্দা থাকাটা অস্বভাবিক না, স্বাভাবিকই, কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সব জানালাতেই পর্দা থাকার কথা। বাট দ্যা ফ্যাক্ট ইজ, সব জানালাতে কিন্তু পর্দা ছিল না। পর্দা ছিল ওই একটিমাত্র জানালাতেই। ঘটনা কী?
শরিফুল ঝট করে তাকাল, এটা সে খেয়াল করেনি। রেজা বললেন, এবং সেই জানালাটাতেও গ্রিল লাগানো হয়েছে নতুন। সেই গ্রিল নিয়ে আসা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে, যেন কেউ না দেখতে পারে এমনভাবে। বিষয়টি কী এমন যে কোনো কারণে এই জানালার গ্রিল কেটে ফেলা হয়েছিল? এবং সেটি যাতে বাইরে থেকে না বোঝা যায়, এইজন্যই আলাদা পর্দা লাগানো হয়েছিল? ওটা হয়তো কেউ খেয়ালই করত না, কিন্তু কথায় আছে না, চোরের মনে পুলিশ পুলিশ!
গ্রিল কেন কেটে ফেলা হবে স্যার?
তিনতলা থেকে ভারি কিছু নামানোর জন্য? যেটা দিনের আলোয়, বা অন্যদের নিয়ে নামানো যাবে না। নামাতে হবে লুকিয়ে, একা একা?
শরিফুল চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ বলল, আপনি বলতে চাইছেন যে লিখনের লাশটা এখান থেকে নামানো হয়েছে? সে এইখানে খুন হয়েছে!
আমি তা বলতে চাইছি না। এমন চট করে বলে ফেলার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। ওরকম বলার জন্য আমাদের আরো তথ্য-প্রমাণ দরকার। সেগুলো আমাদের হাতে নেই। তবে বিষয়টা সন্দেহজনক।
কিন্তু স্যার… কিছু একটা বলতে গিয়েও শরিফুল থেমে গেল। রেজা বললেন, হ্যাঁ, বলো?
না মানে প্রফেসর সাহেবের মতোন কেউ খুনের সঙ্গে জড়িত থাকবে, এইটা আপনের বিশ্বাস হয়? আমার হয় না।
এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন না শরিফুল। এটা তথ্য-প্রমাণের বিষয়।
কিন্তু তারপরও স্যার। ধরেন উনি যদি এই কারণেই গ্রিল কাটতেন, এবং এটা যেন কেউ না বুঝতে পারে সেই ভয় থেকেই নতুন গ্রিল লাগিয়েছেন, তাহলে নতুন গ্রিল লাগাতে এত দিন সময় কিন্তু উনি নিতেন না, নিতেন? উনি যত দ্রুত সম্ভব নতুন গ্রিল লাগাতেন।
উনি দ্রুতই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। দেরি করতে বাধ্য হয়েছেন। দোকানে রেডিমেড অবস্থায় কিন্তু গ্রিল বিক্রি হয় না। কারণ গ্রিল বানাতে হয় জানালার মাপ মতো। শুধু তাই না, অন্য গ্রিলগুলো যেই ডিজাইনের, সেই ডিজাইনের সঙ্গে মিলিয়ে বানাতে হয়। সো অর্ডার দেয়ার পর দোকানদারতো বানাতে দুয়েকদিন সময় নেবে, নেবে না?
তা অবশ্য ঠিক। শরিফুল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল।
রেজা হঠাৎ শরিফুলের কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, শোন শরিফুল, স্যারকে সন্দেহ করতে আমারও ভালো লাগছে না। কিন্তু এতদিন পুলিশের চাকরি করি। এত মানুষ, এত ঘটনা-অপরাধ দেখেছি, আমাদেরওতো কিছু ক্রাইম সেন্স তৈরি হয়েছে, তাই না? কোনো একটা ঘটনা এখানে আছেই। আর সেটা না জানতে পারলে এই কেস সলভ করা সহজ হবে না।
.
০৮.
লতিফুর রহমান একটা তীক্ষ্ণ চাপা আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তার সবসময় মনে হচ্ছে কোনো এক ভয়ংকর অশুভ শক্তি সারাক্ষণ তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। তিনি কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কী ভাবছেন এ সবই সেই শক্তি দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তিনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না, জানতে পারছেন না, বুঝতে পারছেন না। এ এক ভয়াবহ অস্বস্তিকর, আতঙ্কময় অনুভূতি। এর থেকে বের হবার কোনো উপায় তার জানা নেই। লাশটা বাড়ির বাইরে বের করতে পেরে তিনি একটা বড় বিপদ থেকে হয়তো বেঁচে গেছেন। কিন্তু এতদিনেও তিনি কোনোভাবেই ভেবে বের করতে পারলেন না, ওই লাশটা ওখানে আসার পেছনের ঘটনাটা কী!
এক অব্যাখ্যেয়, অবিশ্বাস্য ঘটনা। এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা তিনি খুঁজে পাননি। ফলে এখন আর কোনো কিছু নিয়েই তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। সারাক্ষণ মাথার ভেতর এই অনুভূতি নিয়ে তার সময় কাটছে, যেন মাথার ঠিক পেছনেই, ঘাড়ের কাছটাতে কোনো এক অদৃশ্য আততায়ী ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে!
.
নাসিমা বেগম আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে সৈকত তাকে চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠি পেয়ে তিনি যেন পুরোপুরি সুস্থই হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সৈকতের পরের চিঠিটিই তাকে আবার অসুস্থ করে দিয়েছে। সৈকতের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয় না। গত পাঁচ বছরে এই নিয়ে তিনটি চিঠি সে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেই চিঠিতে সে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও দেয়নি। তারপরও খামের ওপরে প্রাপকের যে সংক্ষিপ্ত ঠিকানা রয়েছে, সেই ঠিকানায় নাসিমা বেগম কিছু চিঠি পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সৈকত তা পেয়েছে কি না, তিনি জানেন না। এর আগে বহুবছর কোনোধরনের খবরই ছিল না সৈকতের। তারপর হঠাৎ একদিন তার শৈশব, কৈশোর এবং তারুণ্যেরও একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে যাওয়া বাড়ির ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠিয়েছিল সে। তারপর এই পাঁচটা বছর আবার অপেক্ষায় ছিলেন নাসিমা বেগম।
সন্ধ্যায় নাসিমা বেগমের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিল ডালিয়া। এই সময়ে ঘরে ঢুকলেন লতিফুর রহমান। নাসিমা বেগম বললেন, তুমি আবার এই সময়ে এখানে আসছো কেন?
লতিফুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
কথা থাকলে পরে বলা যাবে না? নাকি আমি আজ রাতেই মরে যাব?
কী সব কথা বলছ!
কি সব কথা বলি তুমি বুঝতে পারছো না?
লতিফুর রহমান কথা বললেন না। নাসিমা বেগম বললেন, মনে মনে আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করার কী দরকার? আমিতো একভাবে মরেই আছি। এই যন্ত্রণা মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েতো কম কিছু না। কম কিছু? এক কাজ করো, আমাকে ঘুমের মধ্যে গলা টিপে মেরে ফেলো।
তুমি কি একটু চুপ করবে?
চুপ করতেইতো চাই। চুপ। আর কোনোদিন জানি কাঁদতে না হয়।
নাসিমা বেগম কাঁদতে থাকলেন। এই সময়টায় তিনি পাগলের মতো হয়ে যান। শোয়া থেকে উঠে বসে আচমকা শরীরের কাপড় খুলে ফেলতে লাগলেন তিনি। দু হাতে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন। ডালিয়া তাকে ধরার চেষ্টা করতেই তিনি ঝাড়া দিয়ে তার গা থেকে ডালিয়ার হাত ফেলে দিলেন।
ডালিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে একপাশে সরে গেল। লতিফুর রহমান কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এই মুহূর্তগুলো খুব ভয়ংকর। সৈকত আসার খবর শুনে অনেকটাই সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন নাসিমা বেগম। কিন্তু এখন আবার ধীরে ধীরে তার অসুস্থতাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে।
লতিফুর রহমান চোখের ইশারায় ডালিয়াকে সরে যেতে বললেন। ডালিয়া চলে যেতেই তিনি নাসিমা বেগমের কপালে আলতো হাত রাখলেন। নাসিমা বেগম প্রথম কিছুটা সময় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন লতিফুর রহমানের দিকে। তারপর আচমকা তার হাত কামড়ে ধরলেন। লতিফুর রহমান এতটা খারাপ পরিস্থিতি আশা করেননি। তিনি তীব্র চিৎকারে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। নাসিমা বেগমের দাঁত বসে গেছে তার হাতে, দরদর করে রক্ত বেরুচ্ছে। কিন্তু তিনি তার হাত ছাড়াতে পারছেন না। এই যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করল ডালিয়া। চিৎকার শুনে ডালিয়া ছুটে এলো। তাকে দেখে যেন আরো খেপে গেলেন নাসিমা বেগম। তিনি কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেছিলেন, এই ফাঁকে হাতছাড়িয়ে নিলেন লতিফুর রহমান। নাসিমা বেগম পাগলের মতো হাত পা ছুঁড়তে লাগলেন। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলেন। তারপর সৈকতের জন্য বুক চাপড়ে কান্না শুরু করলেন।
লতিফুর রহমানের হাতের অবস্থা খারাপ। তীব্র ব্যথায় যেন অবশ হয়ে আসছে। হাতটা। তিনি ডান হাতে বাঁ হাত ধরে ঘর থেকে বের হলেন। ডালিয়াকে ইশারায় বললেন নাসিমা বেগমের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে। নাসিমা বেগম অবশ্য তখন আর চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন না। তিনি করুণ স্বরে কাঁদছিলেন। সেই কান্নায় মিশে আছে সন্তানহীন মায়ের সুতীব্র যন্ত্রণা।
.
নিজের ঘরে বসে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন লতিফুর রহমানও। ব্যথায় ভারী হয়ে গেছে হাতটা। দুটো দাঁত পুরোপুরি বসে গেছে হাতে। সেখানে এখনও রক্ত জমে আছে। তিনি ডালিয়াকে গরম পানি আর স্যাভলন আনতে বললেন। ডালিয়া গরম পানি এনে তার হাত ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। ধীরে ধীরে ব্যথা কমে আসলেও সেই সারাটা রাত লতিফুর রহমান ঘুমাতে পারলেন না। তিনি ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু তারপরও চারপাশের পৃথিবীটা যেন ক্রমশই দুঃসহ হয়ে উঠছে।
.
পরদিন ভোরে তিনি আবারো নাসিমা বেগমের ঘরে গেলেন। নাসিমা বেগমকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল ডালিয়া। কিন্তু নাসিমা বেগম ঘুম থেকে উঠে গেছেন তাড়াতাড়িই। লতিফুর রহমান ঘরে ঢুকতেই তিনি মুখ তুলে তাকালেন। তবে কোনো কথা বললেন না। লতিফুর রহমান তার পাশে বসে নরম গলায় বললেন, একটা কথা বলব নাসিমা?
নাসিমা বেগম তাকিয়েই রইলেন, প্রশ্নের জবাব দিলেন না। লতিফুর রহমান তার হাতটা নাসিমা বেগমের সামনে তুলে ধরে বললেন, কাল সারাটা রাত এই হাতের যন্ত্রণায় আমি ঘুমাতে পারিনি নাসিমা। না ঘুমাতে ঘুমাতে আমার একটা উপলদ্ধি হয়েছে।
নাসিমা বেগম ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আবার কী নাটক?
লতিফুর রহমান স্নান হাসলেন, আমার কোনো কিছুই তোমার সত্যি মনে হয় না?
হবে না কেন? তোমার সবকিছুইতো সত্যি।
লতিফুর রহমান খানিক চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, কাল রাতে আমি বুঝতে পেরেছি, ঠিক কতটা বছর এর চেয়েও বেশি যন্ত্রণায় তুমি ঘুমাতে পারো না! তোমার ওই কষ্ট বোঝার সাধ্য আমার নাই। কিন্তু কোনো মানুষের পক্ষে এতগুলো বছর এই কষ্ট সহ্য করা অসম্ভব!
তাহলে এখন কি করবে? আমার কষ্টতো কমাতে পারবে না, এক কাজ করো, আমাকে মেরে ফেলো।
লতিফুর রহমান আচমকা কেঁদে ফেললেন, তোমার কি ধারণা সৈকতের জন্য আমার একটুও কষ্ট হয় না? আমি হয়তো ভালো বাবা না, কিন্তু বাবাতো!
লতিফুর রহমান সামান্য থামলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, তুমি কষ্ট পাও, সেটা তুমি প্রকাশ করতে পারো, বলতে পারো, কাঁদতে পারো। কিন্তু আমি? আমি তার কিছুই করতে পারি না। এর চেয়ে বড় কষ্টের আর কিছু নেই নাসিমা।
লতিফুর রহমান মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলেন। টুপটুপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগল তার কোলে। নাসিমা বেগম অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাইরে। জানালার বাইরে মেঘ করেছে। আবারো বৃষ্টি নামবে হয়তো। নদীর পানি বাড়ছে হু হু করে। এবার বর্ষাকালটা খারাপ যাবে। খুব খারাপ।
.
০৯.
খুব ভোরে ঘুম ভাঙল রেজার। তার ঘুম ভাঙাল শরিফুল। সে জানালো থানার সামনে তুমুল হইহট্টগোল শুরু করেছেন চুন্নু মিয়া আর তার লোকজন। রেজাকে এখনই যেতে হবে। রেজা ঘটনা কিছুই বুঝলেন না। তিনি চোখ কচলাতে কচলাতে থানায় এলেন। থানার সামনে রীতিমতো উত্তপ্ত অবস্থা। তিনি থানার সামনে আসতেই চুন্নু মিয়া তার সামনে একজোড়া স্যান্ডেল ছুঁড়ে দিলেন। রেজা ঘুম ঘুম চোখে বুঝতে পারলেন না, স্যান্ডেল জোড়া আসলেই তার দিকে ছুঁড়ে মারা হয়েছে কি না? তিনি দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
চুন্নু মিয়া চিৎকার করে কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু রেজা তাকে শান্ত ভঙ্গিতে একা ভেতরে এসে কথা বলতে বললেন। চুন্নু মিয়া অবশ্য একা ঢুকলেন না, তার সঙ্গে ঢুকল সোহরাব মোল্লাও। রেজা হাই তুলতে তুলতে বললেন, বলুন, ঘটনা কী?
সোহরাব মোল্লা স্যান্ডেল জোড়া সঙ্গে নিয়ে এসেছে। স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেটে মোড়া স্যান্ডেল জোড়া সে টেবিলের ওপর রাখতেই চুন্নু মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এই স্যান্ডেল জোড়া কার, জানেন?
রেজা মুখে কথা বললেন না, তবে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। চুন্নু মিয়া বললেন, লিখনের। এই স্যান্ডেল জোড়া লিখনের। গত ঈদে হারাধন মুচির কাছ থেকে আমি তার জন্য স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলাম।
এখন এটা কোথায় পেয়েছেন?
গোলাম মাওলার বালির স্তূপে।
গোলাম মাওলার বালির স্তূপে? রেজা খানিক অবাকই হলেন। সোহরাব মোল্লা অবশ্য শুধরে দিল, মানে রাস্তার জন্য আর্জেন্ট ইট-বালি দরকার। আপনেতো জানেনই স্যার। এখন সমস্যা হইছে, বর্ষার মৌসুমে গোলাম মাওলা ছাড়া কাছাকাছি আর কারো কাছে ইট-বালি নাই। এদিকে বন্যার অবস্থাও গতরাত থেকে খুব খারাপ। এই জন্য আইজ সূর্য ওঠার আগেই আমরা গেছিলাম লতিফুর রহমান ছারের কাছে। তার বাড়ির কাজে অনেক ইট-বালি এখনো বেঁচে গেছে। তো আমরা…।
চুন্নু মিয়া সোহরাবকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলা শুরু করলেন, তো আমি গেলাম স্যারের কাছ থেকে কিছু ইট-বালি ধার হিসেবে নেয়ার জন্য। বললাম, তার আবার যখন লাগবে, তখন দিয়ে দিব। তিনি খুশি মনেই রাজি হইলেন। গোলাম মাওলার থেকেই প্রফেসর সাব ইট-বালি কিনছিলেন। কিন্তু জায়গার অভাবে সব ইট-বালি তখন বাড়ির ভেতরে নিতে পারেন নাই। বাড়ির বাইরে রাস্তার পাশে যে উঁচু জায়গাটা আছে সেইখানে রাখছিল সেগুলা। আজ আমরা সেই বালি আনতে গিয়া দেখি সেই বালির মধ্যে এই স্যান্ডেল জোড়া।
রেজা সঙ্গে সঙ্গে কথা বললেন না। এই ঘটনা তিনি আশা করেননি। হতে পারে চুন্নু মিয়া ইচ্ছে করে মিথ্যে বলছে। কারণ লিখনের বস্তাবন্দি লাশের পায়ে জুতা ছিল, সুতরাং এখানে তার স্যান্ডেল পাওয়া আলাদা কোনো অর্থ বহন করে না। কিন্তু গোলাম মাওলাকে যে তিনি যেকোনো উপায়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করবেন, সেটিতো অনুমেয়ই। কিন্তু ঘটনা যদি সত্যিই হয়, তাহলে বিষয়টা অন্যদিক থেকে সমস্যাজনক। এই ঘটনা লতিফুর রহমানের প্রতি তার সন্দেহকে আরো জোরালো করে। লতিফুর রহমানের বালির স্তূপে লিখনের স্যান্ডেল পাওয়াটা রেজার এতদিনকার আর সকল সন্দেহকে কোথায় যেন শক্ত একটা ভিত্তি দেয়। যদিও বিষয়টি অন্য কারো ভাবনায় নেই।
রেজা বললেন, কিন্তু ওগুলোতে এখন আর গোলাম মাওলা সাহেবের না, তার থেকে সেই কবেই কিনে নিয়েছেন প্রফেসর সাহেব। আপনারা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছেন? আগেতো তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত, তাই না?
চুন্নু মিয়া এবার চটে গেলেন, তাকে কী জিজ্ঞাস করব? ওই ষাইট-সত্তর বছরের বুড়া প্রফেসর আমার ভাগ্নেকে খুন করেছে? আপনার সমস্যা কি বলেনতো রেজা সাহেব? আমি আগেও শুনছি, আপনি নাকি স্যাররে সন্দেহ করতেছেন? একাধিকবার তার বাড়িতেও গেছেন? এখন কি, আসল ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য নিরীহ একজন মানুষের ওপর দোষ চাপানোর ধান্দায় আছেন?
আপনি শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান সাহেব। আমি সেটা বলছি না, আমি বলছি সবকিছুরইতো একটা লজিক থাকে তাই না? এই ইট-বালি তিনি কবে গোলাম মাওলার কাছ থেকে কিনেছেন, এখন এসে সেখানে কিছু পাওয়া গেলে তার জন্য তো আমরা গোলাম মাওলাকে দায়ী করতে পারি না, তাই না? বা সেটা ঠিকও হবে না। এটলিস্ট, একবারতো প্রফেসর সাহেবকে ঘটনা জিজ্ঞেস করা উচিত, নাকি? আর লিখনের লাশের পায়ে কিন্তু জুতা ছিল। সুতরাং এই স্যান্ডেল সেখানে পাওয়া না পাওয়া নিয়ে আমরা কিন্তু দুম করে খুব বড় কোনো ডিসিশনেও যেতে পারি না! এমনওতো হতে পারে যে স্যার কিংবা গোলাম মাওলা, কেউই হয়তো এর কিছু জনেনই না। অন্য কেউ হয়তো এই স্যান্ডেল এখানে রেখে গেছে, হতে পারে না এমন?
.
চুন্নু মিয়া এবারেও হম্বিতম্বি করলেন। পুলিশ কিছু না করলে তিনি নিজে গোলাম মাওলাকে দেখে নেয়ার হুমকিও দিয়ে গেলেন। কিন্তু রেজা তখন ভাবছেন অন্য কথা। এই মামলার এরই মধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু সেই অর্থে কোনো অগ্রগতিই নেই। এখনই যদি কিছু না করা যায়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে নিশ্চিত। চুন্নু মিয়া হয়তো রাগের মাথায় কোনো অঘটনও ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। খুন খারাবি করে ফেলাও বিচিত্র কিছু নয়। পরিস্থিতি তখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। রেজা বিষয়টি নিয়ে সরাসরি লতিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন।
.
লতিফুর রহমানকে কিভাবে থানায় নিয়ে আসা হবে, এই নিয়েও ভাবলেন রেজা। তিনি এই এলাকার সম্মানিত মানুষ। একটি খুনের মামলায় তাকে হুট করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, বিষয়টি কেউই স্বাভাবিকভাবে নেবে না, এবং সামাজিকভাবেও তার সম্মানহানি হবে। রেজা চাইলে তার বাসায় গিয়ে নিজেই খোলামেলা কথা বলতে পারেন। কিন্তু তিনি সেটি করতে চাননি। তার এইটুকু জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানার চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। অপরাধী থানা এবং পুলিশ, এই দুটো জিনিসকে চেতনে-অবচেতনে যেকোনো উপায়ে এড়িয়ে যেতে চায়। ফলে থানায় আসা মাত্রই তার সাহস এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে।
লতিফুর রহমানকে থানায় আনা হলো গোপনে। তিনি একটা আবছা অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে আছেন। গত আধাঘণ্টায় এই ঘরে আর কেউ আসেনি। তিনি প্রতি মুহূর্তে কারো না কারো আসার অপেক্ষা করছেন। ঠিক এই মুহূর্তে পাশের রুম থেকে একজনের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো। লতিফুর রহমান চমকে গিয়ে তাকালেন। কিন্তু পাশের রুমে কী হচ্ছে তা এখান থেকে দেখার উপায় নেই। তিনি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন। তীব্র যন্ত্রণাকাতর চিৎকার ভেসে আসছে এখন। সঙ্গে আঘাত এবং অশ্রাব্য গালির শব্দ। তার বুকের ভেতরটা ধরফর করে কাঁপছে। আরো মিনিট কুড়ি পরে রেজা ঘরে ঢুকলেন। তার সারা শরীর ঘর্মাক্ত, তিনি একটা তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মুছলেন।
লতিফুর রহমানের সামনের খালি চেয়ারটাতে বসে তিনি নরম গলায় সালাম দিয়ে বললেন, স্যার আমি খুবই দুঃখিত যে আপনাকে এখানে এভাবে আনতে হয়েছে, কিন্তু সত্যি কথা হলো এ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না।
লতিফুর রহমান শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, কোন সমস্যা নেই, যদিও আমি একটু নার্ভাস ফিল করছি।
রেজা বললেন, নার্ভাস ফিল করার কিছু নেই স্যার।
লতিফুর রহমান একইরকম শান্ত এবং ঋজু ভঙ্গিতেই বললেন, অবশ্যই আছে। আপনাকে আমি যদি এখন কলেজের বাংলা ক্লাসে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিই, তাহলে সেখানেও আপনার নার্ভাস লাগবে।
তা অবশ্য ঠিক।
আর এর আগে আমি কখনো থানায় আসিনি। তা ছাড়া আমি এখনো জানি না, আমাকে কেন এখানে ডাকা হয়েছে।
রেজা স্পষ্ট গলায় বললেন, আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে চুন্নু চেয়ারম্যানের ভাগ্নে লিখনের খুনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।
লতিফুর রহমান অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, কী!
জি স্যার। আমরা এই বিষয়ে আপনার কাছ থেকে স্পষ্ট এবং সত্য কিছু তথ্য : আশা করছি।
এই বিষয়ে আমি আপনাদের কী তথ্য দেব? বরং আপনারা আমাকে তথ্য দিতে পারেন। এই ঘটনার আমি কিছুই জানি না। কেবল লোকমুখে বিচ্ছিন্ন কিছু কথা শুনেছি, বিস্তারিত কিছুই জানি না। আপনার জানার কথা, আমি খুব একটা বাইরের মানুষের সঙ্গে মিশিও না। সুতরাং কি ঘটেছে সেটা আপনি বরং আমাকে বিস্তারিত জানাতে পারেন।
রেজা সামান্য অবাক হলেন। তিনি লতিফুর রহমানের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করেননি। বরং ভেবেছিলেন লতিফুর রহমান ভেঙে পড়বেন। অথচ তিনি তার পুরো উল্টো আচরণ করছেন। রেজা খানিক নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর মাথা তুলে স্থির দৃষ্টিতে লতিফুর রহমানের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এই খুনের মামলায় আমি যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারি, সেই অথরিটি আমাকে দেয়া হয়েছে স্যার। প্রমাণ তৈরি করা পুলিশের জন্য কোনো বিষয় না। সুতরাং আপনি যে-ই হোন না কেন, তাতে আমার কিছু যাবে আসবে না। কোনো প্রমাণ ছাড়াই আপনাকে এই মুহূর্তে আমি গ্রেপ্তার করে চালান করে দিতে পারি।
আপনি আমাকে অযথা অন্যায়ভাবে ভয় দেখাচ্ছেন।
অন্যায়ভাবে হতে পারে কিন্তু অযথা নয়।
আপনার কি মনে হয় না আপনি ইলজিক্যালি একজন ইরেলিভেন্ট মানুষকে এই মামলায় ইনভলভ করছেন?
রেজার বিস্ময় আরো বাড়ছে। তিনি শান্ত গলায় বললেন, আমি পৃথিবীতে এই একটা কাজ শুধু করি না। ইলজিক্যাল কোনো কাজ।
তাহলে আমাকে এখানে আনার পেছনে আপনার লজিকটা কি?
রেজা এবার সামান্য কঠিন গলায় বললেন, আপনাকে এখানে প্রশ্ন করার জন্য আনা হয়নি, উত্তর দেয়ার জন্য আনা হয়েছে।
লতিফুর রহমান সামান্য নরম হলেন, বলুন, কি জানতে চান?
লিখনের বিষয়ে আপনি কি জানেন?
বললে আপনি বিশ্বাস করবেন?
সত্য হলেতো অবশ্যই বিশ্বাস করব।
আমি কিছুই জানি না।
এই স্যান্ডেল জোড়া চেনেন? চুন্নু মিয়ার রেখে যাওয়া স্যান্ডেলজোড়া রেজা টেবিলের ওপর রাখলেন।
স্যান্ডেল দেখে লতিফুর রহমানের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললেন, কেউ কি কখনো কারো স্যান্ডেলের কথা আলাদা করে মনে রাখে? আমি ঠিক জানি না। তবে আমার কখনো এমন স্যান্ডেল ছিল না।
মানে আপনি এটা চেনেন না?
ঠিক মনে করতে পারছি না। কেন বলুনতো?
আপনার বাড়ির বাইরে আপনার যে ইট-বালির স্তূপটা আছে সেখান থেকে স্যান্ডেলজোড়া উদ্ধার করা হয়েছে। এবং…। রেজা লতিফুর রহমানের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছেন।
লতিফুর রহমান বললেন, এবং কী?
এবং স্যান্ডেল জোড়া লিখনের।
এই প্রথম লতিফুর রহমান সামান্য চমকালেন। এবং ঠিক তখনই তার মনে পড়ল, সেদিন রাতের অন্ধকারে হারাধন মুচির দোকান থেকে এই স্যান্ডেল জোড়াই তিনি পরে এসেছিলেন। দিন দুই বাদে তিনি এনায়েতকে বলেছিলেন যে সে যেন স্যান্ডেল জোড়া হারাধন মুচিকে দিয়ে আসে। এর পরে আর এই স্যান্ডেলের কথা তার মনেই ছিল না। এমনকি এখন স্যান্ডেল জোড়া দেখে প্রথমে তিনি আসলেই চিনতে পারেননি। লতিফুর রহমান খানিক বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তিনি এখন বুঝতে পারছেন না কী বলবেন!
মুহূর্তের জন্য হলেও তার চমকে যাওয়াটা চোখ এড়াল না রেজার। তবে লতিফুর রহমান সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিলেন, দেখুন, বাড়ির বাইরে ওই বালির স্তূপ থেকে কিছু উদ্ধার করলেই সেটির সঙ্গে আমার যোগসূত্র থাকবে, এটি ভাবলেতো মুশকিল।
লতিফুর রহমান সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, স্যান্ডেলের বিষয়ে তিনি সত্যিটাই বলে দেবেন কি না! তবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে বুঝে নিতে চান।
রেজা হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর লতিফুর রহমানের চোখে চোখ রেখে স্থির গলায় বললেন, আপনি যে রাতের অন্ধকারে আপনার তিনতলার বাসার জানালার গ্রিল কেটে দড়ি বেঁধে একটা লাশ নামিয়েছেন নিচে, এবং তার পরপরই যে আপনার বাড়ির পাশে জলাশয়েই লিখনের লাশ পাওয়া গেল, এ দুটো ঘটনার মধ্যে কি আপনি কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন, স্যার?
লতিফুর রহমান এটা আশা করেননি। তিনি বুঝতে পারছিলেন, কোনো কারণে তার প্রতি পুলিশের নজর পড়েছে। কিন্তু তিনি ঠাণ্ডা মাথার সতর্ক, বুদ্ধিমান মানুষ, সুতরাং তার জায়গা থেকে যতটা সম্ভব সন্দেহমুক্ত থাকার চেষ্টা তিনি করেছেন। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেরেছেনও। তা ছাড়া, লাশ যেহেতু তার বাড়িতে পাওয়া যায়নি, এবং সত্যিকার অর্থেই এই খুনের বিষয়ে যেহেতু তিনি কিছু জানেনও না, সেহেতু পুলিশের পক্ষে তার বিরুদ্ধে কোনো অকাট্য প্রমাণ হাজির করা প্রায় অসম্ভব। তিনি জানেন, পুলিশ সর্বোচ্চ যেটি করতে পারে, তাহলো চাপ প্রয়োগ করে, বা ভয়-ভীতি দেখিয়ে তার কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিংবা তিনি নিজে যদি ভয় পেয়ে বা ভুল করে বেস কিছু বলে ফেলেন, তবেই কেবল পুলিশ সেটিকে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু রেজা এখন যেটি বললেন, সেটি লতিফুর রহমানের আত্মবিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছে। না দেখে, বা কোনো স্পষ্ট প্রমাণ হাতে না রেখে এমন করে কারো পক্ষে বলে দেয়া সম্ভব নয়। তিনি তারপরও যতটা সম্ভব শক্ত গলায় বললেন, আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না!
রেজা এক মুহূর্তের জন্যও লতিফুর রহমানের চোখ থেকে চোখ সরাননি। তিনি সেই একইভাবে বললেন, আপনি শিক্ষক মানুষ, সারা জীবনে এত এত ছাত্র ছাত্রীদের এত এত কঠিন জিনিস বুঝিয়েছেন। আর এখন শেষ বয়সে এসে এমন সহজ একটা জিনিস নিজে না বুঝলে হবে?
আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। আমার অসহায় এবং অপমানিত লাগছে।
আপনি কি বিশ্বাস করেন যে আপনাকে অপমানিত হতে দেখতে আমার ভালো লাগবে না?
লতিফুর রহমান এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। রেজাই আবার বললেন, একটা কথা বলি স্যার। মন দিয়ে শুনুন। আমি এমনি এমনি আপনাকে এখানে ডেকে আনিনি, এটা আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। এখন আপনি যদি আমাকে কো-অপারেট না করেন, তাহলেও কিন্তু সিচ্যুয়েশন কিছু পাল্টাবে না। কারণ এই ঘটনায় যত দ্রুত সম্ভব কোনো একজনকে আমার গ্রেপ্তার দেখাতেই হবে। না হলে পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ঝামেলায় পড়ে যাবে। আমি চাইছি, সত্যিকারের অপরাধীকেই গ্রেপ্তার করতে। সমস্যা হচ্ছে, আপনি ছাড়া আর কারো বিষয়ে আমার কাছে বিন্দুমাত্র কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। আর আপনাকে গ্রেপ্তার করলে আমাকে কোনো পলিটিক্যাল প্রেসারেও পড়তে হবে না। সুতরাং আমার কাছে আপনার বিরুদ্ধে যেসব এভিডেন্স এবং সাসপেকশন আছে, সেসবের ভিত্তিতেই আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারি। এবং হয়তো সেটাই করব। আর সেই আপনার তখনকার অপমান এবং অসহায়ত্ব এখনকার চেয়ে অসংখ্যগুণ বেশি হবে। সেটা দেখতে আপনার যেমন ভালো লাগবে না, আমারও না।
লতিফুর রহমান তারপরও কোনো কথা বললেন না। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন! তার কি পুরো ঘটনাই খুলে বলা উচিত, নাকি শুধু স্যান্ডেলের ঘটনাটা? তিনি মুহূর্তখানেক সময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালেন, তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললেন, একটা বিষয় আমি সম্ভবত মিস করে গেছি। ইচ্ছাকৃত নয়, ভুলে।
বলুন?
সেদিন সন্ধ্যায় পলাশবাড়ি মসজিদে মাগরিবের নামাজ শেষে কিভাবে নিজের জুতো হারিয়ে হারাধনের দোকান থেকে আরেক জনের স্যান্ডেল পায়ে বাড়ি ফিরেছিলেন, সেই ঘটনা বিস্তারিত বললেন লতিফুর রহমান। তারপর বললেন, দিন দুই পরে আমার বাড়ির দারোয়ান এনায়েতকে দিয়ে আমি স্যান্ডেল জোড়া হারাধন মুচিকে ফেরত দিতে পাঠিয়েছিলাম। সে সেটি ফেরত দিয়েছিল কি না। আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। আসলে ওটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আর সন্ধ্যার অন্ধকারে পায়ে পরে বাড়ি ফিরেছিলাম, ঠিকমতো খেয়ালও করিনি স্যান্ডেল জোড়া। ফলে এখন এটা দেখেও ঠিক মনে করতে পারছি না, এটাই সেই স্যান্ডেল জোড়াই কী না!
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে থানায় নিয়ে আসা হলো এনায়েত ও হারাধন মুচিকে। এনায়েত বলল, ঘটনা সত্য, বাজারের মুচির দোকান থেইকাই ছারে এই স্যান্ডেল পায় দিয়া আইছিল।
এরপর ফেরত দেয়ার জন্য তোকে দিয়ে পাঠানো হয়েছিল?
জ্বে, ছার।
তুই ফেরত দিয়েছিলি?
না।
কেন?
ছারে আমারে ফেরত দিয়াসতে বলল। আমি বাড়ির থেকে বাইর হইয়া কিছুদূর গেলাম। এর মধ্যেই দেখি ছারে আবার আমারে ফোন দিয়া বাড়ি যাইতে বলল। কী একটা জানলার গ্রিল নাকি বানাইতে দিব। সেই গ্রিলের মাপ আর ডিজাইনের কাগজ নিয়া যাইতে হইব। তো আমি ভাবলাম, স্যান্ডেল হাতে নিয়া আবার এতটা পথ যাব, আবার আসব, তার চাইতে পলিথিনে প্যাচানো স্যান্ডেল জোড়া রাস্তার পাশে বালির মধ্যে ঢুকাইয়া রাইখ্যা যাই। যাওনের সময় ওইখান থেকে নিয়া গেলেই হইব।
তারপর?
তারপর বাড়িতে যাওনের পর ছারে আরো কয়েকটা কাজ দিল। সেগুলা করতে দেরি হইয়া গেল। তখন ছারে বলল, এখন আর যাওন লাগতো না, বিকালে বাজারে যাইস। আর গ্রিলের অর্ডার দিয়াসিস।
গ্রিলের অর্ডার দিয়েছিলি কার নামে?
এনায়েত চুপ করে রইল।
.
হারাধন বলল, ঘটনা সত্য, ছারে আমার কাছ থেইকাই স্যান্ডেল নিছে।
পরে আর ফেরত দেয়নি?
না।
তো, তুইও আর স্যান্ডেলের কোনো খবর নেস নাই? স্যান্ডেল যার, সেও আর তার স্যান্ডেল নিতে আসেনি?
আসব কেমনে? সেতো নাই।
নাই মানে? কই গেছে?
মারা গেছে। এইটাতো লিখন ভাইর স্যান্ডেল।
লিখন তোর কাছে সেলাই করতে দিয়েছিল?
হুম।
তা তুই তখনই জানতি যে লিখন মারা গেছে?
মারা গেছে জানব কী করে? তখনতো তারে খুঁইজা পাওয়া যাইতেছে না, চাইরদিকে হৈ চৈ। তো ছারে আইসা স্যান্ডেল চাইল, এহন তারেতো আর না করন যায় না। সে সম্মানী মানুষ। কিন্তু কার স্যান্ডেল দেব? যার স্যান্ডেলই দিই, দেখা গেল একটু পরেই আইসা চাইল। তখন আমি বিপদে পড়বো না? এই জন্য ভাবলাম লিখন ভাইরটা দিই। ছারেতো বলছেই যে পরদিনই ফেরত পাঠাই দিব। আর লিখন ভাইর তখনো কোনো খোঁজ নাই। এই জন্য আমি ভাবলাম, এইটা দেওয়াই নিশ্চিন্ত।
.
রেজা খুব আশাবাদী ছিলেন যে বড় কোনো একটা ব্লু বা প্রমাণ হয়তো তিনি এবার পেয়েই যাবেন, কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং হতাশাই বাড়ল। সঙ্গে কিছুটা অপরাধবোধও। লতিফুর রহমানকে শুধু শুধুই অমন অপদস্ত করলেন! কিন্তু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আচমকা মনে হলো, একটা বড় প্রমাণ তিনি পেয়ে গেছেন। অন্তত সেটি দিয়ে হলেও আরো কিছুটা দূর এগুতে পারেন তিনি।
পরদিন লতিফুর রহমান আর এনায়েতকে তিনি আবারো ডাকলেন। আলাদা আলাদা বসিয়ে দুজনকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করলেন তিনি। লতিফুর রহমানকে বললেন, স্যার, আপনার তিনতলার ফ্ল্যাটের একটি জানালা ছাড়া বাকি আর সব জানালা একই সময়ে লাগানো হয়েছে, একই সময়ে একই রকম রং করা হয়েছে, কিন্তু একটি জানালা আলাদা। সেটাতে কোনো রং নেই এবং মাত্র দু-তিন দিন আগে সেটি লাগানো হয়েছে। এটাতো সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। আপনি সেটি নিজ চোখেই দেখেছেন এবং কারণটিও আমি আপনাকে বলেছি।
কিন্তু আপনি যেটি বলেননি সেটি হচ্ছে এই বাড়ির জন্য যখন যা লেগেছে, একটি পেরেক অবধি, আপনি নিজের নামে অর্ডার করেছেন, ক্যাশম্যামোতে বিল করিয়ে নিয়েছেন। কারণ আপনি হিসেবি মানুষ।
রেজা নানা ধরনের বিলের একগাদা কার্বন কপি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর বললেন, আপনি যেসব দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনেছেন, তার কয়েকটা দোকান থেকে আমরা এগুলো কালেক্ট করেছি। সবগুলোতে আপনার নাম আছে। কিন্তু আপনার বাড়ির প্রয়োজনে আপনি কিনেছেন, এমন একটা মাত্র অর্ডার এবং বিলে আপনার কোনো নাম নেই। সেই বিলটি হচ্ছে ওই গ্রিলটার।
লতিফুর রহমান মৃদু হাসলেন, বাকিগুলো সব আমি নিজে কিনেছি, কিন্তু ওটা কিনেছে এনায়েত। সো, সে তার নামেই করেছে।
না স্যার। সে তার নামেও করেনি। যেহেতু তাকে এখানকার কেউ সেভাবে চেনে না, সো সে অন্য একটি ভূয়া নাম দিয়ে গ্রিলের অর্ডার করেছে, বিল করেছে। এবং সেটি আপনি তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন।
আমি!
জি, আপনি। শুধু তা-ই না, আপনিই এনায়েতকে নিষেধ করেছেন আপনার নামে যেন সে গ্রিলটা না কেনে।
এগুলো আপনাকে কে বলেছে?
এনায়েতই বলেছে?
অসম্ভব।
অসম্ভব কেন?
কারণ সে আমাকে…। লতিফুর রহমান কিছু একটা বলতে গিয়েও মাঝ পথে হঠাৎ থেমে গেলেন।
রেজা বললেন, কারণ এখান থেকে গতকাল বাড়িতে গিয়ে সে আপনাকে এসব বিষয়ে কিছু বলেনি, তাই না? তার বলার কথাও না। কারণ, তাকে আমি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলাম উল্টাপাল্টা কিছু হলেই তাকে আমি ক্রস ফায়ারে দিয়ে দিব।
লতিফুর রহমান কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি মাথা নিচু করে বসে রইলেন। এই মুহূর্তে একজন কনস্টেবলের সঙ্গে ঘরে ঢুকল এনায়েত। তার পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকালেন লতিফুর রহমান। রেজা বললেন, এনায়েত, প্রফেসর সাহেব কি তোকে তার নামে গ্রিলের অর্ডার এবং বিল করতে নিষেধ করেছিলেন?
এনায়েত ভয়ার্ত গলায় বলল, হুম।
তাহলে কার নামে করতে বলেছিলো?
এনায়েত জবাব দিলো না। চুপ করে রইলো। রেজা বললেন, অন্য কোন ভুয়া নামে করতে বলেছিলেন?
এনায়েত একবার আড় চোখে লতিফুর রহমানের দিকে তাকালো। তারপর অস্ফুট স্বরে বললো, হুম।
রেজা লতিফুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটি কেন করেছিলেন স্যার? নিশ্চয়ই এটিরও একটা চমৎকার, গ্রহণযোগ্য উত্তর আপনার কাছে রয়েছে।
লতিফুর রহমান আতিপাতি করেও এর কোনো জুতসই শব্দ খুঁজে পেলেন না।
রেজা বললেন, আপনি অতি সতর্কতায় অতি অস্বাভাবিক কিছু ভুল করেছেন। যেগুলোই আপনার প্রতি আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিল। যেমন আপনার তিন তলার ঘরের ওই একটি মাত্র জানালাতেই আপনি পর্দা ব্যবহার করেছেন। আর কোনো জানালায় পর্দা নেই। এর কারণ কী?
লতিফুর রহমান বুঝতে পারছিলেন যে তিনি ধরা পড়ে গেছেন। শেষ একটা চেষ্টা করার জন্য ভেতরে ভেতরে তিনি বেপরোয়াও হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু জুতসই কোনো ব্যাখ্যাই তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
রেজা বললেন, লিখনের লাশটাতো ওই জানালাটা দিয়েই নামিয়েছিলেন তাই না? তো কাজটা কি আপনি একাই করেছিলেন? নাকি সঙ্গে আরো কেউ ছিল?
লতিফুর রহমান এবারও কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। তিনি যেমন মাথা নিচু করে তাকিয়ে ছিলেন, তেমনই তাকিয়ে রইলেন। রেজা শেষ প্রশ্নটা করলেন, ছেলেটাকে আপনি কেন খুন করেছিলেন, স্যার?
.
১০.
পলাশবাড়ি শহরটা অনেক বছর ধরেই একটু একটু করে বিস্তৃত হচ্ছিল। তবে সেই বিস্তৃতি গত বছরখানেক ধরেই খুব বেশি দ্রুত এবং অপরিকল্পিতভাবেই শুরু হয়েছে। ফলে শহরের অগোছালোভাবও বেড়েছে। বেড়েছে যত্রতত্র খনন, খানাখন্দ, বহুতল ভবন, দোকান-পাটের নির্মাণ কাজও। অনেকদিন ধরেই যে নতুন ব্যাংকটির এখানে আসার কথা ছিল, মাস দুয়েক হয় সেটিও চালু হয়েছে। সঙ্গে চালু হচ্ছে দামি-দামি খাবারের রেস্টুরেন্টও। তবে মোবাশ্বেরের দোকানে এখনো সকাল থেকে গভীর রাত অবধি খদ্দেরের ভিড়। যদিও তার বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে নির্মাণ ও খনন শ্রমিকের দল। আজ দুপুরে সেখানে দুই দল শ্রমিকের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়ে গেল। তাতে মাথা ফেটে একজনের রক্তারক্তি অবস্থা। খবর শুনে থানা থেকে শরিফুল ছুটে এলো। দেলোয়ার নামে একজনের বেলচার আঘাতে এক নির্মাণ শ্রমিকের মাথা ফেটেছে। দেলোয়ার দেখতে ছোটখাটো মানুষ। শরিফুল তার সামনে দাঁড়াতেই সে পায়ে পড়ে চিৎকার করতে করতে কাঁদতে লাগল। সব শুনে রেজা বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। দেলোয়ারকে দুদিন থানায় আটকে রেখে ছেড়ে দিতে বললেন। সে গরিব দিনমজুর মানুষ, একটা দিন কর্মহীন থাকা মানেই তার পরিবারের ওপর বিশাল চাপ পড়ে যাওয়া। তা ছাড়া শ্রমিকদের মধ্যে এমন অহরহই হয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়টি রেজাকে ভাবিয়েও তুলল। এই শহরে এখন বড়োসড়ো অপরাধ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। লিখনের ঘটনা ছিল কেবল শুরু। সামনে হয়তো আরো বড় বড় ঘটনা অপেক্ষা করছে। এখনই সতর্ক না হলে বিপদ। এমনকি এই যে এত এত শ্রমিকরা এক সঙ্গে থাকছে, পক্ষ-বিপক্ষ হচ্ছে, এদের নিয়েও সতর্ক হতে হবে। এর মধ্যেই ইয়াবা ছড়াতে শুরু করেছে। সঙ্গে আরো নানা কিছু।
রেজার অভিজ্ঞতা বলে, সতর্ক হবার সময় এখনি। তিনি ছেড়ে দেয়ার আগে দেলোয়ারের সঙ্গে কথা বললেন, বাড়ি কই?
ভোলা।
এইখানে কত দিন?
তিন-চাইর মাস।
কী কাজ করিস? আগে স্যুয়ারেজের লাইনে দিন ঠিকা কাজ করতাম। এখন এইখানে পাঠাইছে সর্দার।
সর্দার কী?
আমগো এইসব কাজে একজন সর্দার থাকে। তার আন্ডারেই সবাই কাজ করি। সে-ই কন্ডাক্টরগোর তন কাজের অডার পায়। কতজন লেবার লাগব সেইটা কন্ডাক্টর সর্দারের লগে বোঝাঁপড়া কইরা ঠিক করে। তারপর আমাগো সে কাজে পাঠায়। আমরা তার কথা মতোই চলি।
কন্ট্রাক্টের টাকা সব সর্দারই পায় আর সে তখন সেখান থেকে তোদেরকে দেয়?
জে।
ঠকায়?
সর্দারে ঠকায় না। তয় সর্দারতো সব জায়গায় কাজে থাকতে পারে না, তার হইয়া আরেকজন থাকে, সেকেন ম্যান, সর্দারের বদলে সাইটে থাইকা সে-ই সব দেখাশোনা করে। সেই হারামজাদা ঠকায়।
কিছু বলিস না তোরা?
অভ্যাস হইয়া গেছে, এহন আর গায়ে লাগে না।
তা গায়ে না লাগলে আজকে ওই লোকটার মাথায় মারলি কেন?
মাথা গরম হইয়া গেছিল ছার।
গরম হয়েছিল কেন?
ও আমার বউরে লইয়া গাইল দিছিল।
বউর জন্য খুব মায়া?
বউ পোয়াতি ছার। পোয়াতি বউরে লইয়া গাইল দিলে গায় সয় না।
রেজা কথাটা ভাবলেন। তিনি এখনো বিয়েই করেননি, সুতরাং পোয়াতি বউয়ের প্রতি স্বামীর অনুভূতি তার বোঝার কথা না। তিনি বললেন, সন্তানরে খুব ভালোবাসিস?
দেলোয়ার জবাব দিল না, মাথা নিচু করে ফেলল। রেজা বললেন, যেই সন্তানের জন্য এত কষ্ট করিস, তাকে নিয়ে একটা বাজে কথা সহ্য করতে পারিস না। এখন ওই লোকটা যদি মারা যেত, বা সিরিয়াস কিছু হতো, তাহলে তোর কি অবস্থা হতো একবার ভেবে দেখেছিস? আর তোর কিছু হলে তোর বউ-বাচ্চা কে দেখত?
ভুল হইয়া গেছে ছার। আমার মাথাটা একটু গরম।
মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
জে, ছার।
তোদের সর্দার কে?
আলাউদ্দিন হাজি।
হাজি কেন? সে কি হজ করেছে নাকি?
জে, ছার। তিনবার।
সে এখানে আছে?
না ছার, তার সেকেন ম্যান আছে, আজগর। আমরা তারে অজগর সাপ বইলা ডাকি। হা হা হা।
সর্দার আসে না কেন?
তার এরকম আরো কত সাইটে লেবার আছে। সেই সব সাইট বড় বড়, ঢাকায়। সেইগুলাতে সে থাকে। দূরে আসে না। আজগররে পাঠায়।
আচ্ছা, আজগরের সঙ্গে আমি কথা বলব। এইখানে কোনো গণ্ডগোল করা চলবে না। সব লেবারদের সেটা বলে দিতে হবে। প্রথম বলে তোকে ছেড়ে দিলাম, কিন্তু পরের বার সামান্য কোনো ঝামেলা দেখলেই খুব খারাপ হবে। আমি চাই না
আমার এখানে কোনো ঝামেলা হোক।
আর হইব না ছার।
.
গভীর রাতে গোলাম মাওলা নুরু মিয়া এবং সবুরের সঙ্গে মিটিং এ বসেছেন। নুরু মিয়া বলল, পরিস্থিতিতো খুব একটা ভালো মনে হইতেছে না।
গোলাম মাওলা উৎসুক চোখে তাকালেন। নুরু মিয়া বলল, থানায় মনে হয় অতিরিক্ত পুলিশ আসছে। ভেতরে ভেতরে কিছু একটা হইতেছে।
অতিরিক্ত পুলিশ?
হুম। সঙ্গে এসপি সাব, এএসপি সাবও আসছিলেন আজকে।
ঘটনা কী?
সেইটাই বুঝতে পারতেছি না। তবে একটা কথা শুনলাম।
কী কথা?
লতিফ পোরবেচাররে নাকি থানায় নিয়া যাওয়া হইছিল?
কী বলো! এই ঘটনা কখন ঘটল?
সেইটা বলতে পারব না। এক পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক, সে হঠাৎ সেই দিন বলল।
কেন নিছে, কিছু বলে নাই?
নাহ। সেও নাকি জানে না। খুব গোপনে কাজ করতেছে রেজা সাব।
গোলাম মাওলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এই লোক বহুত ঝামেলার। কী চিন্তা করে, কী ভাবে, বোঝার কোনো উপায় নেই। এই মনে হয় সে আমার সবচেয়ে কাছের লোক, আবার পরক্ষণেই মনে হয় আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। এরে এইখান থেকে সরাই দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হইতো!
একটু ধৈর্য ধরো। এতদিন যখন এত কষ্ট করে ধৈর্য ধরছো, আরেকটু ধরো। খালি নমিশেনটা পাই আমরা, ইলেকশনে জেতা নিয়া চিন্তা করি না। আর তারপর এর ব্যবস্থা করা যাবে।
সবুর এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। মনোযোগী শ্রোতার মতো সব চুপচাপ শুনছিল সে। এবার যেন কথা বলার সুযোগ পেল, আচমকা বলল, রাইত বিরাইতেতো দেখি একলা-একলাই এইখানে-সেইখানে হাঁটাহাঁটি করে, আপনে বললে সরানোর ব্যবস্থা করতে পারি।
গোলাম মাওলা ঝট করে সবুরের দিকে তাকালেন। তার চোখ রক্তবর্ণ। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সবুর আর কথা বলার সাহস পেল না। গোলাম মাওলা চোখের ইশারায় সবুরকে তার সামনে থেকে সরে যেতে বললেন। তারপর বললেন, তারপর? কাজের কতদূর?
নুরু মিয়া যেন একটু নড়েচড়ে বসল, ঝামেলাতো পিছু ছাড়তেছে না। তারপর আজকাল রাইতেও পুলিশ টহল শুরু হইছে। রেজা সাব লেবারগো থানায় নিয়া নানা ভয় ডর দেখাইতেছে। এইখানে কেউ যেন কোনো ঝামেলা টামেলা না করে।
এইগুলা বললেতো হবে না। কাজটাতো শেষ করতে হবে। সময় কিন্তু বেশি নাই। যেকোনো সময় আসল ঘটনা কিন্তু পুলিশ জেনে যাবে। ধরা পড়ে গেলে তখন কিন্তু আমও যাবে, ছালাও যাবে।
সেইটা বুঝতেছি। এইজন্যই এত সাবধান থাকতেছি।
সাবধান থাকতে থাকতে যেন আবার সময় চলে না যায়। ইলেকশনের কিন্তু বেশি বাকি নাই আর! যা করনের এখনই করতে হবে।
আর তোমার ব্যাপারে নেতারা কি বলল?
আমার পক্ষেতো দুয়েকজন আছেই। ওইটা নিয়া চিন্তা করি না। রাজনীতি করতেছি, দুয়েকটা মার্ডার কেস, খুন-টুনই যদি না সামলাইতে পারলাম, তাইলে আর কি! চুন্নু বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখনই কিছু বইলো না। এখন চুপ মাইরা পইড়া থাকতে হইবে। পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা হোক।
নুরু মিয়া খানিক উসখুশ করতে করতে বলল, একজন লোক আছে, দেখা করব।
গোলাম মাওলা খুব অবাক হলেন, এত রাতে আবার কে?
কাজের লোকই, অকাজের না।
নুরু মিয়া চোখের ইশারা দিতেই সবুর একজন লোক নিয়ে ঘরে ঢুকল। সে এতক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করছিল। ঘরে ঢুকেই গোলাম মাওলাকে সালাম দিল সে। গোলাম মাওলা অবাক চোখে তাকালেন, কে?
নুরু মিয়া বলল, ওর নাম আজগর। সবাই ওরে অজগর সাপ বাইলাই ডাকে। হা হা হা সামান্য হাসল নুরু মিয়া। গোলাম মাওলা অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নুরু মিয়া আবার বলল, পলাশবাড়িতে যে নতুন পানির লাইন, স্যুয়ারেজ লাইন হইতেছে, সেই সাইটে যে লেবাররা কাজ করতেছে, তাদের দেখাশোনার দায়িত্বে আছে। ও খুব কাজের মানুষ। হাত পাকা।
তো ও এইখানে কেন?
ওরে দিয়া কিছু কাজ আমি করাইতে চাইতেছি। সে বিশ্বাসী লোক। টাকায় বনিবনা হইলে অসুবিধা হইব না। আর সাহসী লোক, হাতও পাকা। দিন রাইতে সমানে কাজ করতে পারে।
গোলাম মাওলা কিছুক্ষণ চুপচাপ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কিছু না বলেই ভেতরের ঘরে চলে গেলেন।
.
রেজার অনুরোধের ভিত্তিতে পলাশবাড়িতে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। শুরু হয়েছে রাতের টহলও। এসপি ও এএসপি সাহেবও এসেছিলেন। চারদিকের পরিস্থিতি হঠাৎ করেই যেন চুপচাপ শান্ত হয়ে গেছে। রেজার ধারণা, ঝড়ের ঠিক আগে আগে পরিবেশ যেমন শান্ত হয়ে যায়, এ হচ্ছে সেই অবস্থা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কী ঘটছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। মাঝখানে নতুন ব্যাংকের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম একদিন থানায় এসে তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলেন। এতদিন পর দেখা করতে আসার কারণে তিনি দুঃখ প্রকাশও করলেন। ব্যাংকের পলাশবাড়ির নতুন শাখা কেবল শুরু হয়েছে, এই সময়ে সবকিছুই গুছিয়ে আনার জন্য দিন-রাত অমানুষিক পরিশ্রম যাচ্ছে তার। সে কারণেই দেখা করতে দেরি হয়েছে। এই নিয়ে ম্যানেজার রফিকুল আলম বারবার দুঃখ প্রকাশও করলেন। সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ব্যাংকের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিতেও একটু খেয়াল রাখতে বললেন।
ভদ্রলোককে খুবই পছন্দ হলো রেজার। কিছু মানুষই এমন, দেখলে, খানিক কথাবার্তা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। রফিকুল আলম তেমনই একজন মানুষ। কথা প্রসঙ্গে রেজা বললেন, তা ভাই এখানে উঠেছেন কোথায়?
এখনোতো সেভাবে উঠিনি। আমার এক আত্মীয়ের বাসা আছে, এখান থেকে দশ-পনেরো কিলোমিটার হবে। আপাতত সেখান থেকে এসেই অফিস করছি।
কিন্তু ফ্যামিলি আনবেন না?
সেটাই ভাবছি। বাচ্চাদের ভালো কোনো স্কুলওতো নেই এখানে। তারওপর ভালো কোনো বাসাও পাওয়া যাচ্ছে না।
কিছু ভালো বাসা কিন্তু আছে। দেখতে পারেন।
হ্যাঁ, একদম যে দেখিনি, তা নয়। সেভাবে পছন্দ হয়নি। তবে প্রফেসর সাহেবের বাড়িটা কিন্তু বেশ।
রেজা চকিতে তাকালেন, গিয়েছিলেন সেখানে?
হ্যাঁ, একবার গিয়েছিলাম। কথাও হয়েছিল, কিন্তু সেভাবে এখনো রেডি না বাসা, তিনি বললেন পরে জানাবেন। কিন্তু পরেতো আর কিছু জানালেন না।
আপনি খোঁজ নিয়েছিলেন আর?
হ্যাঁ নিয়েছিলাম। কিন্তু শুনলাম উনি নাকি বাসা ভাড়া দেবেন না এখন। টু লেটও নাকি সরিয়ে ফেলেছেন, এই জন্য আর গেলাম না।