ভলিউম ১০ – গোলাপী মুক্তো – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
১
এই জিনা, মা বললেন, কি হয়েছে তোর? এরকম করছিস কেন? জিনিসপত্র গোছাতে দিবি না নাকি?
ভাল্লাগছে না কিছু!
কিছু একটা করার চেষ্টা কর গিয়ে, তাহলেই ভাল লাগবে।
কি করব? আকাশের যা অবস্থা, বাইরে বেরোতে পারলে তো। বৃষ্টি আর বৃষ্টি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। ওই দেখ, আবার নেমেছে। জানালায় বসে যে সাগর দেখব, তারও উপায় নেই, কিচ্ছু দেখা যায় না। আমার দ্বীপটা পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। কি যে করব।
বৃষ্টির দিন, বৃষ্টি তো হবেই, মা বললেন। অবাক করছিস তুই আমাকে, জিনা। ছুটির পয়লা দিনেই বিরক্ত হয়ে গেলি?
ছুটি শব্দটা হাসি ফোঁটাল জিনার মুখে। আবার ছেলে সাজার শখ হয়েছে তার। মাঝে মাঝেই করে এরকম। নামটা পর্যন্ত পাল্টে ফেলে তখন। জরজিনা বা জিনার বদলে তখন তাকে জর্জ বলে ডাকলেই খুশি হয়। মনমেজাজের কোন ঠিকঠিকানা নেই তার। চুল ছেটে আবার ছেলেদের মত করে ফেলেছে। আশা করছে, আবার তাকে কিছুদিন ছেলে ভাবা হবে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, ঘাড় নেড়ে বলল জিনা। ছুটির পয়লা দিনেই ওরকম বিরক্ত হওয়া উচিত না। কিন্তু হয়ে গেছি, কি করব? ভাগ্যিস বাবা আমাদেরকে নিয়ে যাবে বলেছে। এখানে থাকলে মরেই যেতাম! মাঝেমাঝেই বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্যে বিদেশে যান মিস্টার পারকার। এবারেও যাচ্ছেন। সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন জিনা আর তিন গোয়েন্দাকে। মা, লণ্ডনেও কি এরকমই আবহাওয়া থাকবে?
কিছুই বলা যায় না। আরও খারাপ হতে পারে। তবে জায়গা বদল তো হবে, তাতেই আমি খুশি। কিছুদিনের জন্যে এখান থেকে ভাগা দরকার। মেয়েকে আস্তে করে দরজার দিকে ঠেলে দিলেন মা। যা, আর কিছু করতে না পারলে রাফিকে নিয়ে খেলগে। আমি ততক্ষণে গোছগাছটা সেরে ফেলি।
জিনা যেখানে যাবে, রাফিয়ানও সঙ্গে যাবে। জিনার ধারণা, দনিয়ার সব চেয়ে ভাল এবং বুদ্ধিমান কুকুরটা তার। আয়, রাফি, জিনা বলল, এখানে কিছু নেই। চল, রান্নাঘরে গিয়ে দেখি খাবার কিছু মেলে কিনা।
রান্নাঘরে কাজ করছে আইলিন। অনেক সময় কাজ বেড়ে যায়, একা সামলাতে পানে না মিসেস পারকার, তখন খবর দেন আইলিনকে। এই গাঁয়েরই মেয়ে, এসে কাজ করে দিয়ে যায়।
এই যে জিনা, আইলিন বলল। রাফিও যে। তা কি দরকারে এই আন্টির কাছে আগমন? খাবারের খোঁজে নিশ্চয়ই? একটু রাখ, হাতের কাজটা শেষ করে নিই। আপেলের জেলি বানাচ্ছি, তাড়াহুড়ো করলে নষ্ট হয়ে যাবে।
চুলায় কি? জিনা বলল। দারুণ গন্ধ বেরোচ্ছে। টেবিলে বসে পড়ল সে। মিনিট কয়েক পরেই হাজির হয়ে গেল বেশ বড় এক মগ গরম গরম কোকো, আর এক প্লেট সদ্য বানানো বনরুটি। রাফিয়ানও বাদ গেল না, তাজা, রসালো দেখে একটা হাড় দেয়া হয়েছে তাকে।
ছুটিতে বাড়ি এলে খিদে খুব বেড়ে যায়, না? হেসে বলল আইনি। বাড়বেই। হোস্টেলে কি না কি খাও, খাওয়া হয় নাকি।
পেট ভরি আরকি কোনরকমে। হোস্টেলের বাবুর্চিও রাধে, আর তুমিও রাধা। আমার তো মনে হয় দুনিয়ার সেরা বাবুর্চি তুমি, লিনুআন্টি! কিশোররাও তোমার রান্নার খুব প্রশংসা করে।
কালই তো আসছে ওরা, না? প্রশংসায় খুশি হল আইলিন। দেখি, ওদের জন্যে ভাল কিছু বানিয়ে রাখতে হবে।
হ্যাঁ, তাই কর। খাওয়ানোর সুযোগ অবশ্য এবারের ছুটিতে বেশি পাবে না।
না, তা পাব না। কাউকে তো আর রেখে যাচ্ছেন না মিস্টার পারকার।
দারুণ মজা হবে, তাই না? বন চিবাতে চিবাতে বলল জিনা। কিশোররা এখনও জানে না। ওরা আসছে, ভেবেছে এখানেই ছুটি কাটিয়ে যাবে। লণ্ডনে যাচ্ছি, সেটা জানে না। জানাইনি। সারপ্রাইজ দেব। কালই আসছে। কিন্তু ভয় লাগছে, যা পচা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, যদি না আসে!
পরদিন বৃষ্টি থামল। আবার ফিরে এল শীতের ঠাণ্ডা, শুকনো, পরিষ্কার আবহাওয়া, বড়দিনের সময় যেরকম থাকে। সকালের বাস ধরল তিন গোয়েন্দা। এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেল গোবেল বীচে। খুশিতে কলরব করতে করতে এসে জিনাদের বাড়িতে ঢুকল ওরা। বসার ঘরেই রয়েছেন মিসেস পারকার।
কেমন আছেন, আন্টি? হেসে বলল কিশোর।
ভাল, কেরিআন্টি বললেন। তোমরা কেমন?
ভাল, জবাব দিল কিশোর।
ভুরু কুঁচকে জিনার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। এই জিনা, আবার ছেলে সেজেছ…
জিনা নয়, জর্জ বলবে, গম্ভীর হয়ে বলল জিনা।
হা-হা করে হাসল মুসা। বুঝেছি। তা কদ্দিন চলবে এটা?
যদ্দিন জর্জের ইচ্ছে হয়, রবিন বলল হেসে।
হুফ! হুফ! সায় জানাল রাফিয়ান। রবিনের হাত চেটে দিল।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল মিস্টার পারকারের স্টাডির দরজা। ভুরু কুঁচকে। তাকালেন ছেলেমেয়েদের দিকে। ও, এসে গেছ। এজন্যেই এত হৈ-চৈ, বলে আবার লাগিয়ে দিলেন দরজা হট্টগোল একদম সহ্য করতে পারেন না তিনি।
রাগলেন না তো! মৃদু শিস দিয়ে উঠল মুসা। আঙ্কেল বদলে গেছেন মনে হচ্ছে? যাক, ছুটিটা তাহলে ভালই কাটবে। ধমক খেতে হবে না।
হ্যাঁ, ভালই কাটবে, কিশোর বলল, কারণ এখানে থাকতে হচ্ছে না আমাদের। পত্রিকায় পড়লাম, লণ্ডনের কাছের আরেকটা শহরে স্পেস ট্রাভেলের ওপর একটা সম্মেলন হচ্ছে। আক্কেল নিশ্চয় দাওয়াত পেয়েছেন। জিনা যখন এত করে আমাদের আসতে বলেছে, ধরেই নেয়া যায়, কোন কারণ আছে। আর সেই কারণ একটাই হতে পারে, আমাদেরকেও সঙ্গে নেয়া হবে।
তুমি বুঝে ফেলেছ! সারপ্রাইজ দিতে না পেরে হতাশ হল জিনা।
রবিন আর মুসা অবাক হল। রবিন বলল, কই, আমাদেরকে তো কিছু। বলনি?
হাসল শুধু কিশোর। জবাব দিল না।
রাফি যাচ্ছে তো? মুসা জানতে চাইল।
নিশ্চয়ই, বলল জিনা। বাৰা ভাল করেই জানে, আমি ওকে ছাড়া কোথাও যাই না। চল, বাগানে, ঘরে দম আটকে আসছে। কপাল ভাল আমাদের, আজ বৃষ্টি নেই।
বলা যায় না, রবিন বলল। আবার এসে যেতে পারে।
তা ওখানে গিয়ে কোথায় উঠছি, জিনা…থুড়ি জর্জ? কিশোর জানতে চাইল। হোটেলে?
দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জিনা। তারপর হাসল। থাক, জর্জ বলার দরকার নেই, তোমরা আমাকে জিনাই ডেকো।…না, হোটেলে উঠছি না আমরা। এখন ছুটির সময়, খরচ অতিরিক্ত ঘর পাওয়াও কঠিন। তাছাড়া হোটেলে কুকুর জায়গা দেয়ার নিয়মও বোধহয় নেই। সম্মেলন যেখানে হচ্ছে, সেই শহরে মার এক বোনের বাসা আছে। খালাম্মা-খালু ছুটিতে বাইরে চলে যাচ্ছেন, ফ্ল্যাটটা খালিই থাকবে। মাকে বলেছেন, ওখানে থাকতে পারব আমরা।
চমৎকার। হোটেলের চেয়ে অনেক ভাল হবে। স্বাধীনতা থাকবে।
সাগরের পাড়ে হাঁটতে বেরোল ওরা। চলল নানারকম আলোচনা। ছুটি কি করে কাটাবে সে-সম্পর্কে আলোচনাই বেশি হল। ফিরল দুপুরের খাবার সময়। মুরগীর রোস্ট করেছে আইলিন। আপেলের জেলি। মাংসের কিমা আর নানারকম শাকসবজীর পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচ। সাগরের খোলা হাওয়া আর বৃষ্টিধোঁয়া রোদে ঘুরে খিদেও পেয়েছে ছেলেময়েদের। খাবারের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা। মিনিট পনেরো মুসা তো মুখই তুলল না।
দুপুরের পরে আবার খারাপ হয়ে গেল আকাশ। মেঘে ঢাকা পড়ল সূর্য। নামল ঝমঝম বৃষ্টি। বাইরে বেরোনো বন্ধ। তবে আজ আর জিনার খারাপ লাগল না। তিন তিনজন বন্ধু এসেছে, ঘরের ভেতরেই সময় খুব ভাল কাটবে।
পরদিন সকালে রওনা হল ওরা। বাস ধরে এল এয়ারপোটে। সেখান থেকে বিমানে লওন। তারপর ঘন্টা দুয়েকের রেলযাত্রা। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে করে এল জিনার খালার ফ্ল্যাটে।
বেশ ব্যস্ত একটা সড়কের দিকে মুখ করে রয়েছে বাড়িটা। বড় ফ্ল্যাট। কয়েকটা ঘর। মাঝে চওড়া বারান্দা। বেডরুমগুলো সব পুবমুখো, অন্যান্য বরগুলো পশ্চিমে।
বাড়িটা পছন্দ হল ছেলেমেয়েদের। ঘরের আসবাবপত্রও ভাল। আয়-রোজগার বেশ ভালই মনে হয় জিনার খালু-খালাম্মার। অন্যের ঘরে রয়েছে, এটুকু বোঝার বুদ্ধি আছে রাফিয়ানের, কাজেই জিনিসপত্র যাতে নষ্ট নাহয় সেভাবে চলাফেরা করল। বাড়িতে হলে এতক্ষণে লাফালফি করতে গিয়ে অন্তত একটা ফুলদানী তো উল্টে ফেলতোই।
নিজেদের জিনিসপত্র খুলে গুছিয়ে ফেলল ছেলেমেয়েরা। তারপর গেল মিসেস পারকার কতখানি কি করেছেন দেখার জন্যে।
তিনিও গুছিয়ে ফেলেছেন। বললেন, এখন আমাদের প্রথম কাজ হল, খাবার কিনে আনা। একসাথে দুকাজ হয়ে যাবে। খাবারও কেনা হবে, শহরও ঘোরা
হবে। তোমাদের আঙ্কেল কাজ নিয়েই ব্যস্ত, তিনি যেতে পারবেন না। যেতে হবে, আমাদেরকেই।
তাতে খুশিই হল ছেলেমেয়েরা।
শহরটা আমেরিকার শহরের চেয়ে অন্যরকম, কিশোর বলল। বাস, লোকের ভিড়। বেশি গাদাগাদি মনে হয়।
সকলেই একমত হল তার সাথে।
দোকানে দোকনে ঘুরল ওরা। চলে এল কাছের বড় স্কোয়্যারটায়। বিশাল এক বাগান রয়েছে সেখানে, অনেকটা পার্কের মত, ছেলেমেয়েরা খেলছে। দিকে দিকে ছুটে যাচ্ছে বাস। এত বিভিন্ন পথে, মনে রাখতেই কষ্ট হয়, শেষ নোটবুকে লিখে নিতে লাগল রুটগুলো রবিন। খাবারের বাক্স, পোটলা নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এল ওরা। রান্নাঘরে জিনার মাকে সাহায্য করল সবাই, মিস্টার পারকার বাদে, তিনি তার কাজে ব্যস্ত। আধুনিক, সুন্দর রান্নাঘর। প্রয়োজনীয় সব জিনিস হাতের কাছে রয়েছে। কাজ করতে কোন অসুবিধে হল না।
রাতের বেলা খাবার টেবিলে সকলের সঙ্গে কথা বলার ফুরসত মিলল মিস্টার পারকারের। জানালেন, সম্মেলন যতদিন চলবে, রোজ খুব সকালে বেরিয়ে যাবেন – তিনি, ফিরতে অনেক দেরি হবে। রাতও হয়ে যেতে পারে কোন কোনদিন।
সেটা আমি জানি, মিসেস পারকার বললেন। তোমার কাজ তুমি করে যাও, আমাদের জন্যে ভাবতে হবে না। আমাদের দিক আমরা সামলাতে পারব। রান্না করতে তো আর বেশি সময় লাগবে না। তারপর বেরিয়ে পড়ব শহর ঘুরতে। দেখার অনেক জিনিস আছে। তাছাড়া, কাগজে দেখলাম এক জায়গায় অ্যানটিক নিলাম হচ্ছে। ওখানে যাব। কিন্তু পছন্দও হয়ে যেতে পারে, কেনার ইচ্ছে আছে।
হাসল ছেলেময়েরা। ওরা জানে, পুরানো জিনিসের প্রতি খুব শখ মিসেস পারকারের, বিশেষ করে অ্যানটিক। বেছে বেছে দেখার মত জিনিস জোগাড় করে নিয়ে আসেন। নিলামের ব্যাপারে মায়ের যেমন আগ্রহ, মেয়ের তেমনি নিরাসক্তি। সে ভাবল–মা যাক নিলামে, আমরা চলে যাব অন্য কোথাও ঘুরতে। অনেক জায়গা আছে দেখার, যেগুলো সে দেখেনি। পরদিন সকালেই মাকে সেটা পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে, ঠিক করল।
সুতরাং পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে মাকে বলল জিনা, আমাদেরকে নিশ্চয় একা একা ঘুরতে দেবে, তাই না, মা?
দেবো, রাস্তাঘাট চেনা হয়ে যাবার পর, মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে
হাসলেন মা। তবে কথা দিতে হবে, খুব সাবধানে থাকবি।
থাকব, বলতে একমুহূর্ত সময় নষ্ট করল না জিনা।
আর গোলমাল বাধাবি না। ঝগড়া করবি না কারও সঙ্গে।
করব না।
হেসে ফেলল মুসা।
এই এতে হাসির কি দেখলে রেগে গেল জিনা। হাসির কি দেখলে? খারাপ কিছু বললাম নাকি?
এই তো শুরু করে দিলি, হেসে বললেন মা। এইমাত্র না বললি ঝগড়া করবি না?
অ! লজ্জা পেল জিনা। ও এরকম করে হাসল না…আচ্ছা, আর করব না।
তাহলে তো যেতে দিতে আপত্তি নেই, মা?
না, নেই।
২
ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বেরোলেন মিসেস পারকার। ঘুরে ঘুরে শহর দেখলেন, কেনাকাটা করলেন বড়দিনের জন্যে, উপহার কিনলেন।
পরের দিনও একইভাবে কাট।
তার পরের দিন সকালে উঠে জিনার মা বললেন, রাস্তার মোড়ে একটা সিনেমা হল আছে না? তাতে ডিজনির একটা ছবি চলছে। বিকেলে যাবি নাকি দেখতে? আমি অবশ্য যেতে পারব না। কাল নিলাম হবে, আজই গিয়ে জিনিসগুলো দেখে আসতে হবে। পছন্দ করে রেখে আসব। চাইলে যেতে পারিস আমার সঙ্গে।
মায়ের সঙ্গেই যেতে চাইল জিনা। সিনেমা পছন্দ করে না সে তা নয়। কিন্তু হলে রাফিয়ানকে ঢুকতে দেয়া হবে না, আর ওকে ফেলে যেতে রাজি নয় সে। তাড়াতাড়ি বলল, আমি তোমার সাথে যাব। নিলাম ডাকাই দেখব।
কিশোর বলল। আমিও।
আমিও যাব, রবিন বলল।
মুসার সিনেমা দেখতে যাবারই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সবাই যাচ্ছে অন্যখানে, সে। একা যায় কি করে?
বেশ, মা বললেন, যাবে। কাগজে পড়লাম, এক বৃদ্ধা মহিলার মাল নিলাম। হবে। মারা গেছেন। তাঁর নাম ছিল মিস আরনিকা মেয়ারবাল। আত্মীয়স্বৰ্জন কেউ নেই। অনেক ভাল ভাল জিনিস আছে শুনেছি। সেল-রুমে দেখানোর জন্যে আজ ওগুলো রাখা হবে। আগ্রহী যে-কেউ গিয়ে দেখতে পারে।
সেদিন বিকেলে ট্যাক্সিতে করে রওনা হল ওরা। শহরের একপ্রান্তে বাড়িটা। দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে ৮ নাম্বার কামরায়। ইতিমধ্যেই ভিড় হয়ে গেছে। পুরানো আসবাবপত্র আর অন্যান্য জিনিস দেখছে। ছোটখাট কিছু জিনিস রয়েছে কাচের বাক্সে, নিশ্চয় খুব দামি ওগুলো। প্রহরী রয়েছে, যারা আসছে যাচ্ছে নজর রাখছে তাদের ওপর।
দরজার পাশে রাখা হয়েছে বাক্সগুলো। সুন্দর সুন্দর চীনা অলঙ্কার, ব্রোঞ্জের ছোট মূর্তি, হাতির দাঁতে খোদাই করা নানারকম চমৎকার জিনিস। অনেকক্ষণ ধরে পঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওগুলো দেখলেন মিসেস পারকার, ছেলেময়েরাও দেখল। কারোরই বুঝতে অসুবিধে হল না জিনিসগুলো অনেক দামি। তারপর ওরা চলল আসবাব দেখতে। বড়গুলোর দিকে একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন মিসেস পারকার তারপর হোট একটা আর্মচেয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন।
এই আদলের চেয়ারগুলোকে বলে টাব চেয়ার, বললেন তিনি। সুন্দর, না?
হ্যাঁ, রবিন বলল, সুন্দর।
বসতেও বোধহয় খুব আরাম,মুসা বলল। তার কথায় হেসে উঠল সবাই।
খুব দ্র হয়ে রইল রাফিয়ান। ঢোকার সময় প্রহরীরা তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেও পরে নিশ্চয় তাদের মত পরিবর্তন করেছে। মুসার কথায় যেন একমত হয়েই চেয়ারটার দিকে তাকাল সে, যেন বলতে চাইছে, হা, কওলী পাকিয়ে ওয়ে ঘুমাতে বেশ আরাম লাগবে।
ওটা নেবে নাকি তুমি, মা? জিনা জিজ্ঞেস করল।
বাড়িতে সিটিং রুমে রাখলে ভালই হবে, কি বলিস? মা বললেন।
হ্যাঁ, তা লাগবে, জবাবটা দিল কিশোর।
দেখি, দামে বলে নিয়ে নেব কাল, মা বললেন।
চেয়ারটাকে কাছে থেকে আরও ভালমত দেখার ইচ্ছে মিসেস পারকারের, কিন্তু একটা লোকের জন্যে পারছেন না। ঢাকার পর থেকেই সেই যে ওটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, ঘুরেফিরে চারপাশ থেকে দেখছে। সরার নামও নেই। চেয়ারটার সামনের দিকে এসে ঘাড় কাত করে দেখতে লাগল। মখমলে মোড়া গদি, রঙ চটে গেছে। এছাড়া আর সব ভালই আছে জিনিসটার। চেয়ারের পিঠে হাত বুলিয়ে দেখল সে, হাতল দেখল, পায়া দেখল। তারপর যেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরে গেল ওখান থেকে।
এইবার মিসেস পারকারের দেখার পালা।
লোকটাকে সুবিধের লাগল না, নিচু গলায় বলল জিনা, তাই না? আমি শিওর, কাল নিলামে সে-ও আসবে। চেয়ারটা নিতে চাইবে।
জিনার অনুমান ঠিকই হল। পরদিন লংফীন্ডের সেল-রুমে পৌঁছে ওরা দেখল, লোকটা আগেই চলে এসেছে। ভিড়ের মধ্যে দেখা গেল তাকে।
ওই যে, ফিসফিসিয়ে জিনা বলল। টাব চেয়ারের আরেক ক্রেতা।
বেড়টা বেশ সাইজমত, হেসে বলল মুসা, চেয়ারটা ওরই নেয়া উচিত। বসলে মানাবে ভাল। মুখটা দেখছ? আস্ত এক কোলাব্যাঙ।
হাসি চাপল কিশোর। কিন্তু রবিন ফিক করে হেসে ফেলল। ঠিকই বলেছে মুসা। ব্যাঙই। ব্যাঙের মত চওড়া পাতলা ঠোঁট, গোল গোল চোখ যেন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে কোটর থেকে।
ডাক শুরু হল। চড়া দামে বিক্রি হয়ে গেল কয়েকটা আসবাব। তারপর দুজন লোক চেয়ারটা ধরাধরি করে এনে রাখল মঞ্চে, যাতে সবাই দেখতে পায়। ডাক শুরুর অনুরোধ জানাল নিলামকারী।
তিরিশ পাউন্ড থেকে শুরু হল।
চল্লিশ! বলল একজন।
পয়তাল্লিশ! আরেকজন।
পঞ্চাশ! বলল অন্য আরেকজন।
দাম উঠছে। চেয়ারটার ওপর অনেকের চোখ পড়েছে বোঝা গেল। তবে পঁচাত্তরের পর দুজন বাদে সবাই চুপ হয়ে গেল। সেই দুজন হল কোলাব্যাঙ, আর মিসেস পারকার।
আশি! লোকটা বলল।
নব্বই! মিসেস পারকার বললেন।
পঁচানব্বই!
একশো!
ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারল, এর বেশি আর দাম দেবেন না মিসেস পারকার। সামান্য একটা চেয়ারের জন্যে, অ্যানটিক মূল্য যতই থাক ওটার, একশোই যথেষ্ট। আগের রাতে জিনার বাবার সঙ্গে চেয়ারটা নিয়ে কথা হয়েছে তাঁর। ঠিক করেছেন দুজনেই, একশোর বেশি হলে নেবেন না। লোকটা কি এর বেশি দেবে? কিছু বলল না লোকটা। ভাবহে বোধহয়। কাশলো একবার।
হাতুড়ি ঠকতে শুরু করল নিলামকারী, একশো পাউও!…একশো পাউওে গেল গেল…আর কেউ কিছু বলবেন…নেই?…বেশ…ওয়ান…টু…।
ছেলেমেয়েরা জানে, লোকটা থ্রি বললেই ডাক শেষ হয়ে যাবে। তারমানে যে বেশি হেঁকেছে, জিনিসটা তার হয়ে যাবে। হাতুড়ি তুলল লোকটা। নামিয়ে আনতে শুরু করল। ঠুকবে, এবং খ্রি বলবে।
শেষ মুহর্তে হাত তুলতে আরম্ভ করল কোলাব্যাঙ। তারমানে আরও বেশি ডাকতে যাচ্ছে সে। হাতটা পুরো তুলতে পারলেই হয়ে যেত, কিন্তু সেই মুহূর্তে ভাগ্য বিরূপ হল তার। ভিড়ের মধ্যে আঁউ করে উঠল একজন লোক। পরক্ষণেই ধাক্কা খেয়ে যেন কাত হয়ে গেল মুসা, পড়ল একেবারে লোকটার ওপর। কখন তার পাশে চলে গেছে, উত্তেজনায় খেয়াল করেনি জিনা কিংবা রবিন।
ব্যাঙমুখো লোকটা আর ডাকতে পারল না, তার আগেই নিলামকারীর হাতুড়ি ঠকাস করে পড়ল টেবিলে, বলল, থ্রি!
টাব চেয়ারটার মালিক হয়ে গেলেন মিসেস পারকার। খুব খুশি হলেন জিনিসটা পেয়ে।
ভিড় থেকে বেরিয়ে এল ছেলেমেয়েরা।
হেসে মুসা বলল, আমার জন্যেই পেয়েছেন তিনি ওটা, তাই না? একেবারে সময়মত ধাক্কা মারল আমাকে পাশের লোকটা।
তুমি ওখানে গেলে কখন? জিনার চোখে সন্দেহ। কিভাবে?
গেছি। দায়সারা জবাব দিয়ে দিল মুসা।
ইচ্ছে করেই গেছো, তাই না? ভুরু কোঁচকালো রবিন।
চট করে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
একসাথে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে ঘুরে গেল রবিন আর জিনা।
হেসে আরেক দিকে মুখ ফেরাল কিলোর।
একেবারে রামচিমটি কেটেছি, বুঝলে, হেসে বলল মুসা। পাশের লোকটাকে এমন জোরে চিমটি দিলাম, আঁউ করে উঠে ধাক্কা মারল আমাকে। সহজেই সামলে নিতে পারতাম ধাক্কাটা। কিন্তু কেন সামলাব বল?
কাজটা কিন্তু উচিত হল না, জিনা বলল। মা শুনলে রাগ করবে। চেয়ারটা নেবে না, লোকটাকে দিয়ে দেবে।
বলতে যাচ্ছে কে তাঁকে? কিশোর বলল। আমরা বলছি না। তুমি বলবে?
নাহ্, হেসে ফেলল জিনা।
হুফ! করে উঠল রাফিয়ান। যেন কথা দিল, সে-ও মুখ বন্ধ রাখবে।
মিসেস পারকার চেয়ারটা পেয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েরা খুবই খুশি হল। ওরা। কথা বলছে, তিনি ওটার দাম মিটিয়ে দিয়ে এলেন। তিনি যেমন খুশি হয়েছেন, তেমনি বেজার হয়েছে ব্যাঙমুখখা। সেল-রুম অ্যাসিসটেন্টকে বললেন মিসেস পারকার, চেয়ারটা কোথায় দিয়ে আসতে হবেঃ ১৬ লাইম অ্যাভেন্য, ৩ নাম্বার ফ্ল্যাট।
এই সময় তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল লোকটা। জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল, বিরক্ত করতে এলাম, ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। ওই চেয়ারটা সত্যিই আমার খুব পছন্দ…না না, দরকার। আপনি বিক্রি করে দিন আমার আছে। আপনি যা দিয়েছেন, তার চেয়ে অবশ্যই বেশি দেব।
লোকটার দিকে মুখ তুলে তাকালেন মিসেস পারকার। ভাল পোশাক পরেছে লোকটা, কথাবার্তাও বেশ দ্র। কিন্তু তারমাঝেও সূক্ষ্ম একটা হুমকির ভঙ্গি রয়েছে, এবং সেটা তাঁর কান এড়ালো না। এই ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হল না তাঁর। সরি, শীতল কণ্ঠে বললেন তিনি। চেয়ারটা আমারও খুব পছন্দ। বিক্রি করব না।
তর্ক করার চেষ্টা করল লোকটা। থামিয়ে দিলেন মিসেস পারকার। আশেপাশের লোকেরাও ধমক লাগাল লোকটাকে, চুপ করার জন্যে, নিলামের ডাক শুনতে অসুবিধে হচ্ছে। রাগে গটমট করে দরজার দিকে এগোল ব্যাঙমুখখা।
।খাইছে! মুসা বলল। লোকটা বুঝতে পারেনি, আমি ইচ্ছে করে… জিনার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল সে। খুব খারাপ লোক!
হ্যাঁ, আনমনে মাথা ঝাঁকালেন মিসেস পারকার। মুসার কথা বুঝতে পারেননি।
নিলাম দেখার জন্যে আরও কিছুক্ষণ থাকলেন ওখানে মিসেস পারকার। আরেকটা জিনিস পছন্দ হল তাঁর। আগের দিন ওটা চোখে পড়েনি। ছোট একটা লেখার টেবিল। ওটার জন্যে তেমন প্রতিযোগিতা হল না, সস্তায়ই কিনে ফেললেন। সেল-রুম অ্যাসিসটেন্ট জানাল, আগামী দিন জিনিসগুলো পৌঁছে দেয়া হবে ঠিকানামত।
এখানে তো নাহয় পৌঁছে দিল, জিনা বলল, কিন্তু বাড়িতে নেমে কি করে, মা?
সেটা দেখা যাবে। স্টীমারেও নেয়া যায়। প্লেনেও।
একজায়গায় ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভাল লাগছে না রাফিয়ানের। এই কোলাহল, লোকজন তার পছন্দ হচ্ছে না। তাছাড়া মঞ্চের ওপর কি ঘটছে, তা-ও দেখতে পাচ্ছে না। উসখুস শুরু করল সে। মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করল জিনা।
ফ্ল্যাটে ফিরে এল ওরা। কিছু নাস্তা খেয়ে রাফিয়ানকে নিয়ে হাঁটতে বেরোল জিনা আর তিন গোয়েন্দা।
একেকজন একেক কথা বলছে। কিশোর হাঁটছে নীরবে। আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটিও কাটল বার দুই।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করল রবিন। জিজ্ঞেস করল, এই কিশোর, কি ভাবছ? সেই সেল-রুম থেকেই দেখছি, বড় বেশি চুপচাপ তুমি। কি ব্যাপার?
ভাবছি ব্যাঙমুখোর কথা। চেয়ারটার জন্যে বড় বেশি আগ্রহ তার। একজন কিনে নেবার পরও সেটা বেশি দাম দিয়ে তার কাছ থেকে কিনতে চাইল। ভাবনার বিষয়, তাই না?
পরদিন সকালে দিয়ে গেল টাব, চেয়ার আর ছোট ডেস্কটা। যারা নিয়ে এসেছে, তাদেরকে বকশিশ দিতে গেলেন মিসেস পারকার। ইতিমধ্যে মালগুলো বয়ে সিটিং রুমে নিয়ে এল ছেলেময়েরা। ডিসেম্বরের উজ্জ্বল সূর্যালোকে ভরে গেছে ঘর। ময়লা হয়ে আছে চেয়ার, ডেস্ক, দুটোই। পরিষ্কার করতে লেগে গেল ওরা।
লোকগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর সবে দরজা বন্ধ করেছেন মিসেস পারকার, আবার বেজে উঠল দরজার ঘন্টা। অবাক হলেন তিনি। কারও তো আসার কথা নয়! দরজা খুললেন আরেকবার।
দাঁড়িয়ে রয়েছে কোলাব্যাঙ! আগের দিন নিলামে তার সঙ্গে যে লোকটা প্রতিযোগিতা করেছিল। মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন তিনি, তার আগেই বলে উঠল সে, ঠিক একইরকম দ্র কঠে, প্লীজ, ম্যাডাম, আমাকে অন্তত কথা বলতে দিন। আপনাকে বার বার বিরক্ত যে করছি, তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা।
কি বলবেন বুঝতে পারলেন না মিসেস পারকার। সরে দাঁড়ালেন। ঘরে ঢুকল লোকটা। পরিচয় দিল, আমার নাম রবার্ট ম্যাকি। একটা দোকান আছে আমার, কিউরিও আর ভনির বিক্রি করি। মিমোসা অ্যাভেন্যুতে। কাল যে চেয়ারটা আপনি কিনে এনেছেন, ওটার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করেছি…যার জিনিস তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। ওই চেয়ারটা আমি তার স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে চাই। প্রায়ই বসতেন তিনি ওটায়। আর যে ডেটা কিনেছেন আপনি, লেখাপড়ার কাজ ওটাতেই বেশি করতেন মিস মেয়ারল। টেবিল আমার দরকার নেই, শুধু চেয়ারটা পেলেই চলবে। দেখে মনে করতে চাই তাঁর কথা।
গল্পটা আন্টিকে নাড়া দিত অবশ্যই, যদি লোকটা আন্তরিক হত, কিন্তু তার কথা আর মুখের ভাবে কোন মিল দেখলেন না তিনি।
ঠাণ্ডা গলায় বললেন মিসেস পারকার, চেয়ারটা আমার খুব পছন্দ, কালই বলেছি। আমি ওটা রাখার জন্যেই কিনেছি। আর স্মৃতির ব্যাপার তো? মিস মেয়ারবালের ব্যবহার করা আরও অনেক জিনিস আছে, ওগুলো থেকে কোন একটা বেহে কিনে রেখে দিন।
কিন্তু আমি…মানে…ওই চেয়ারটাই…ওটা আমার দরকার! ওটাই বেশি ব্যবহার করতেন কিনা মিস মেয়ারবাল… যাকগে। ভাল দাম দিতে রাজি আছি। আমি। এই ধরুন, একশো পঞ্চাশ ডলার?
খুব বিরক্ত হলেন আন্টি। কড়া গলায় জবাব দিয়ে দিলেন, দাম ডাবল করে দিলেও বেচবেন না তিনি। তারপর বললেন, ব্যাপারটা টাকার নয়, পছন্দের। আমি ওটা কোন দামেই বেচব না। ঠিক আছে?
চেয়ার ঝাড়ার জন্যে একটা ঝাড়ন আনতে রান্নাঘরে চলেছিল জিনা, যেতে হয় হলঘর পেরিয়ে, এই সময় বেল বাজিয়েছে ম্যাকি। লোকটাকে দরজায় দেখেই তাড়াতাড়ি সিটিং রুমে ফিরে এসে বন্ধুদেরকে খবর জানিয়েছে জিনা। পা টিপে টিপে তিন গোয়েন্দাও এসে দাঁড়িয়েছে তখন দরজার বাইরে। কেরিআন্টি আর লোকটার সব কথা শুনেছে।
চেয়ার বিক্রি করতে তাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারল না লোকটা। ও চলে গেলে দরজাটা আবার ভালমত লাগিয়ে দিলেন আন্টি।
ছেলেমেয়েরা এসে ঢুকল হলঘরে।
আস্ত শয়তান! জিনা বলল। আবার এসে হজির হয়েছে চেয়ার কিনতে। ব্যাটা ঠিকানা পেল কোথায়?
ওটা কোন ব্যাপার না, মা বললেন। সেলস-রুম অ্যাসিসটেন্টদের ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। ওদের কাছ থেকে জোগাড় করে নিয়েছে হয়ত।
কিংবা আপনি যে বলেছেন কাল, সেটাই হয়ত শুনেছে, কিশোর বলল। বেশ জোরেই তো বললেন।
হ্যাঁ, মুসা মাথা দোলাল, ব্যাটা শুনেছে। তারপর এসে দাঁড়িয়েছিল বাড়ির বাইরে। লোকগুলো জিনিস রেখে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসে বেল বাজিয়েছে।
অতি আগ্রহ, রবিন বলল। চেয়ারটা সুন্দর, সন্দেহ নেই, তবু পুরানো একটা চেয়ারের জন্যে এত আগ্রহ কেন?
ভ্রূকুটি করল কিশোর। সৃতি-ফিতি সব বাজে কথা। অন্য কারণ আছে। এমন কোন দামি চেয়ার নয় ওটা, দুর্লভও নয়। খুঁজলে ঠিক ওরকম মডেলের চেয়ার অনেক পাবে এই শহরে। মিথ্যে কথা বলছিল সে, বোঝাই গেছে। স্মৃতির জন্যে ওই চেয়ারটাই একমাত্র জিনিস নয়, আন্টি ঠিকই বলেছেন।
এর মাঝেও রহস্য খুঁজে পেলে নাকি? হাসতে হাসতে বলল মুসা। পেয়ে গেছ গন্ধ?
হ্যাঁ, পেয়েছি, বেশ জোর দিয়ে বলল কিশোর। ওই ব্যাঙমুখো লোকটাকে মোটেই ভাল লাগেনি আমার।
আমারও না, বলে বেরিয়ে গেলেন আন্টি। রান্নাঘর থেকে ব্রাশ আর একটা হোট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার নিয়ে এলেন। এই নাও, ওগুলো পরিষ্কার করে ফেল গিয়ে। আমি রান্না করতে যাচ্ছি।
সিটিং রুমে ফিরে এল ওরা। পুরানো জিনিস সাফ করতে অভ্যস্ত তিন গোয়েন্দা, প্রায়ই একাজ করতে হয় তাদেরকে স্যালভিজ ইয়ার্ডে। জিনা পারে না এসব। করতে দিলে আরও নষ্ট করবে।
ডেস্কটায় হাত লাগাল কিশোর আর মুসা। রবিন ব্রাশ দিয়ে চেয়ারের গদির ধুলো ঝাড়তে লাগল। জিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। রাফিয়ান শুয়ে আছে রোদে পিঠ দিয়ে। আয়েসী ভঙ্গিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তিন গোয়েন্দার কাজ।
ধুলো বেশি নেই,ব্রাশটা রেখে দিল রবিন।
ব্যাঙটা তো বললই, জিনা বলল। বুড়ো মহিলা নাকি প্রায়ই বসতেন এই চেয়ারে। মুছে-টুছে রাখতেন আরকি।
চেয়ারের হেলানের সঙ্গে সিটটা যেখানে জোড়া দেয়া হয়েছে, ওই ফাঁক, আর হাতলের নিচের ধুলো বের করা সব চেয়ে কঠিন। ধুলো ওসব জায়গায়ই জমে। বেশি, রবিন বলল। হাত ঢুকিয়ে দিল ফাঁকটায়। হঠাৎ স্থির হয়ে গেল সে। কিশোর, কি যেন লাগছে! কোনভাবে ঢুকে গিয়েছিল ফাঁকের মধ্যে!…না, আপনাআপনি ঢুকতে পারবে না, বেশ বড়ই লাগছে। নিশ্চয় ইচ্ছে করে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে ওখানে।
বকের মত গলা বাড়িয়ে এল জিনা। কি জিনিস? বের করা যায় না?
বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর বের করে আনতে পারল রবিন। চ্যাপ্টা একটা বাক্স, ফ্যাকাসে নীল রঙ।
আরি, গহনার বাক্স মনে হচ্ছে! জিনা বলল।
ডেস্ক মোছা বাদ দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর আর মুসা।
খোলো খোলো, জলদি! মুসা বলল।
রবিনের হাত থেকে নিয়ে বাক্সটা খুলল জিনা। মুক্তাআ! চেঁচিয়ে উঠল সে।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল কিশোর।
দারুণ একখান নেকলেস! মুসা বলল। কটা মুক্তো আছে?
আসল তো? রবিনের প্রশ্ন।
মনে তো হচ্ছে, জিনা বলল। চলো, মাকে দেখাই।
রান্নাঘরে ছুটে এল ওরা। পেছনে লাফাতে লাফাতে এল রাফিয়ান।
মা, মাআ! চেঁচিয়ে বলল জিনা, দেখ, কি পেয়েছি!
৩
হাতের তালুতে হারটা রেখে আঙুল বুলিয়ে দেখছেন মিসেস পারকার। খুব অবাক হয়েছেন। হালকা গোলাপী রঙ মুক্তাগুলোর।
আসলই মনে হয়, বললেন তিনি। এক্সপার্টকে দেখাতে হবে।
আসল হলে অনেক দাম, তাই না, মা?
হ্যাঁ।
ওটার মালিক এখন কে? নিশ্চয় তুমি?
তাই তো হওয়ার কথা, জবাবটা দিল কিশোর। চেয়ারটা তিনি কিনে এনেছেন। ওটার ভেতরে বাইরে যা থাকবে, সব কিছুর মালিকই তিনি হবেন। তাছাড়ামিস মেয়ারবালের কোন আত্মীয়ও নেই যে ফিরিয়ে দেয়ার কথা ভাবা যাবে।
বাহ, তাহলে তো খুব ভাল! হাততালি দিয়ে বাচ্চা মেয়ের মত লাফিয়ে উঠল জিনা। আমি ওটা পরব, মা!
দেখি, চিন্তিত ভঙ্গিতে মা বললেন, তোর বাবা আসুক, আলাপ করে দেখি। পুলিশকে জানাতে হতে পারে। চোরাই মাল কিনা কে জানে!
আসলই হবে, কিশোর বলল। ম্যাকি সেটা জানে। আর জানে বলেই চেয়ারটা কেনার জন্যে পাগল হয়ে আছে সে। তবে চেয়ারের ভেতরেই ছিল এটা, জানা ছিল না তার, শুধু সন্দেহ ছিল। জানা থাকলে কিছুতেই আমরা কিনতে পারতাম না, অনেক বেশি দাম হেঁকে প্রথমেই নিয়ে যেত ওটা।
তা ঠিক, একমত হল রবিন। লোকটা অসৎ, মুসা মন্তব্য করল। চেহারা দেখেই বোঝা যায়।
শুধু চেহারা দেখে কারও সম্পর্কে ওরকম মন্তব্য করা ঠিক না, আন্টি বললেন। লোকটার ব্যবহার খারাপ নয়। তবে এটা ঠিক, আমারও ভাল লাগেনি ওকে …এহহে, আলু পুড়ে যাচ্ছে…
রান্নায় মন দিলেন আবার আন্টি। ছেলেমেয়েরা ফিরে এল সিটিং রুমে। চেয়ার আর ডেক মোছা শেষ হয়নি, কাজটা সেরে ফেলতে লাগল। তবে এখন ওই গোলাপী মুক্তার কল্লা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না।
চেয়ারের মধ্যে মুক্তা লুকিয়েছে,মুসা বলল, অত কাণ্ড!
হ্যাঁ, মাথা দোলাল রবিন।
চেয়ারটার প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখছে কিশোর। যদি আর কিছু পাওয়া যায়? কাছে দাঁড়িয়ে আছে জিনা।
কিন্তু আর কিছু পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে আরেকটা আবিষ্কার করে বসল মুসা। বলে উঠল, এই দেখ দেখ, ডেস্কটার ড্রয়ার দেখিয়ে বলল সে। হোট একটা নব। কালো। সহজে চোখে পড়ে না। বলতে বলতেই টিপে দিল ওটা। কিট করে একটা শব্দ হল। তারপর যেন পিছলে সরে গেল একটা ছোট পান্না, বেরিয়ে পড়ল গোপন খোপ।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল সে। চেয়ারের ফাঁকে মুক্তা..এই গোপন খোপে টাকার তোড়া কিংবা মোহর পেলে অবাক হব না!
সবাই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রয়েছে পোপটার দিকে।
খোপটায় খুঁজতে শুরু করেছে মুসা। কিন্তু নিরাশ হতে হল তাকে। টাকাও নেই, মোহরও নেই, আর কোন গহনাও নেই। শুধু একটা সাধারণ হলদেটে খাম।
মুসার হাত থেকে ওটা প্রায় ছিনিয়ে নিল কিশোর। ভেতর থেকে বেরোল একপাতা কাগজ। লেখাটা জোরে জোরে পড়ল সে, আমি মিস আরনিকা মেয়ারবাল, ২৮, অ্যালমণ্ড রোড, আমার একটা মুক্তার নেকলেস আমার বান্ধবী মনিকা ডিকেনসকে উপহার হিসেবে দিয়ে যাচ্ছি, আমার স্মৃতি হিসেবে। এটা আমি পেয়েছিলাম আমার খালার কাছ থেকে। দুই ছড়ায় মোট আটানববইটা মুক্তা আছে এতে…
আটানব্বই! বলে উঠল জিনা। আমরা যেটা পেয়েছি সেটার কথাই বলেছে। আটানব্বইটাই আছে। গুনে দেখেছি।
দুই ছড়া। হাঁ, ঠিকই আছে, মুসা বলল।
বিশ বছর আগে লেখা হয়েছে এই দলিল, কাগজটায় আরেকবার চোখ বলিয়ে বলল কিশোর। অথচ মিস মেয়ারবাল মারা গেছেন মাত্র কয়েকদিন আগে।
রবিন বলল, নেকলেসটার মালিক এখন তাহলে মনিকা ডিকেনস। কি করে খুঁজে বের করব তাকে?
বের করতেই হবে, যেভাবেই হোক, জিনা বলল। যেহেতু দলিল করে রেখে গেছেন মিস মেয়ারবাল, মনিকা ডিকেনসই এখন এটার আসল মালিক। বিশ বছর আগেই তিনি উইল করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর নেকলেসটা পাকেন তাঁর বান্ধবী। এতদিন ওটা টেবিলের গোপন ড্রয়ারে থেকে থেকে পুরানো হয়েছে। তিনি নিশ্চয় ভাবেননি এতদিন বাঁচবেন।
চিঠিটা আন্টিকে দেখানো দরকার, মুসা বলল।
দলিলটা পড়ে অবাক হলেন না মিসেস পারকার। তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছি আমি, আসল মুক্তাই। অনেক দামি জিনিস। এক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি। আজ বিকেলেই গিয়ে একজন উকিলের সাথে দেখা করব। ওই মহিলাকে খুঁজে বের করে তার জিনিস ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে।
উকিলের কাছে যাবেন? কিছুটা হতাশ মনে হল যেন কিশোরকে। আরেক কাজ করলেই তো পারি। ওই মহিলাকে আমরাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি।
তার মানে গোয়েন্দাগিরি? হাসলেন কেরি আন্টি। কোন কাজ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে গেছ নিশ্চয়।
হ্যাঁ, মা, অনুরোধ করল জিনা। উকিলের কাছে তো যে-কোন সময় যেতে পার। তারচে আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি না। সময় কাটবে ভাল।
হ্যাঁ, আমারও তাই মত, রবিন বলল।
বেশ, তিন গোয়েন্দার ওপর ভরসা আছে আন্টির। দেখ চেষ্টা করে। তবে ঘরে রাখা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। এত দামি একটা জিনিস।
কেউ তো আর জানছে না ওটা আমাদের কাছে আছে, কিশোর বলল। -তা ঠিক।
উত্তেজনার মাঝে খুব দ্রুত দুপুরের খাবার শেষ হলসেদিন ছেলেময়েদের। তারপর আলোচনায় বসল ওরা। অবশ্যই তাদের সঙ্গে রইল রাফিয়ান।
প্রথমেই, কিশোর বলল, মনিকা ডিকেনসের নাম খুঁজতে হবে টেলিফোন বুকে।
ঠিক, বলতে বলতে মোটা ডিরেকটরিটা টেনে নিল রবিন। দেখি।
দ্রুত পাতা উল্টে চলল সে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে বুকে এল অন্য তিনজন। ডিকেনস কয়েকটাই পেল, কিন্তু মনিকা ডিকেনস একজনও নেই।
আরেকবার দেখা যাক, মুসা পরামর্শ দিল।
দরকার নেই, কিশোর বলল। এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিশ্চয় লুকিয়ে থাকেনি নামটা।
হয়ত মহিলার টেলিফোন নেই, রবিন বলল।
হতে পারে, জিনা বলল।
কিংবা এ-শহর থেকে চলে গেছে,বলল মুসা।
বিয়েও হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, অনুমান করল রবিন। স্বামীর নাম হয়ত ডিকেনস নয়।
অথবা মিস মেয়ারবালের মত মরেও গিয়ে থাকতে পারে, ঘোষণা করল যেন কিশোর।
তাই তো, এটা তো ভেবে দেখিনি, জিনা বলল। বিশ বছর আগে উইলটা করা হয়েছে। আর এত ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যখন, মিস মেয়ারবালের সমবয়সীও হতে পারে। তাহলে মরে যাবারই কথা।
কিন্তু সেটা জানব কিভাবে আমরা? মুসার জিজ্ঞাসা।
হুফ! রাফিয়ানও যেন একই প্রশ্ন করল।
গম্ভীর হয়ে গেল সবাই। কিশোর বাদে। কাজ জটিল হলেই তার আনন্দ। হাসিমুখে বলল, সহজেই সেরে ফেলব ভেবেছিলাম আমরা, শুধু টেলিফোন বুক দেখেই। হল না।
ইস, ঠিকানাটাও যদি লিখে রেখে যেতেন মিস মেয়ারবাল! জিনা আফসোস করল।।
নিজের কপালে টোকা দিল কিশোর। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। মিস মেয়ারবালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক। খুঁজলে কিছু বেরিয়েও পড়তে পারে। তার ঠিকানা আছে দলিলে।
ঠিক বলেছ! তুড়ি বাজালমুসা। কিন্তু গিয়ে কি খুঁজব ওখানে?
মিস মেয়ারবালের পড়শী থাকতে পারে। তাকে বা তাদেরকে জিজ্ঞেস করব। ওরা হত এমন কোন সূত্র জানাতে পারে, যাতে মনিকা ডিকেনসকে খুঁজতে সুবিধে হয়।
হ্যাঁ, ভাল বলেছ, একমত হল রবিন। তা-ই করা উচিত।
জিনা খুশি হতে পারছে না। মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোরের কথায় সায় জানাল, হ্যাঁ, বুদ্ধিটা ভাল। কিন্তু যাব কিভাবে?
কেন, বাসে, রবিন বলল। ট্রেনেও যেতে পারি। লণ্ডনের মত এই শহরেও পাতালরেল রয়েছে। ট্রেনে করে যেতে অসুবিধে কি?
আমাদের অসুবিধে নেই, জিনা বলল। কিন্তু রাফি যাবে কিভাবে? বাক্সে ভরে নেব নাকি? ওকে বাড়িতে রেখে যেতে পারব না।
তাই তো, চোয়াল স্কুলে পড়ল রবিনের। ঋড়িতে করে ছাড়া পাতালরেলে কোন জানোয়ার নেবার অনুমতি নেই। না হয় ভরলাম। কিন্তু যা ভারি ও। কতক্ষণ বয়ে নিতে পারব? কি করা যায় বলতো?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব মিলল না। ভাবছে সবাই। বার দুই নীরবে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। উজ্জ্বল হল মুখ। ঝুড়িতে করেই যাবে। কিন্তু আমাদের বয়ে নিতে হবে না ওকে। ওর বোঝা ও-ই বইবে।
ধাঁধা বললে নাকি? মুসা ভুরু নাচাল।
মোটেও না,মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওঠো। রওনা হই।
কিশোরের পিছে পিছে চলল সবাই। অবাক হয়ে ভাবছে, কি করবে গোয়েন্দাপ্রধান?
রান্নাঘরে ঢুকল কিশোর। বেতের বড় একটা বাজার করার ঝুড়ি বের করল। চলো, বাই, বলল সে।
কাছের টিউব-রেল স্টেশনটায় চলে এল ওরা। শহরের একটা ম্যাপ জোগাড় করে নিতে কষ্ট হল না। অ্যালমণ্ড রোডটা কোথায় খোঁজ করল তাতে। …
ছুরি বের করে ঝুড়ির নিচের দিকে চারটে গোল ফোকর কাটল কিশোর। তারপর ঝুড়ির মুখ খুলে ইশারা করল রাফিয়ানকে। একান্ত বাধ্য ছেলের মত ঋড়িতে ঢুকে পড়ল বুদ্ধিমান রাফিয়ান। বুড়ির আঙটা ধরল কিশোর, আরেকটা মুসা। দুজনে মিলে কুকুরটাকে বয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল প্ল্যাটফর্মে।
টিকেট ক্লার্কের চোখে পড়বে না এমন একটা জায়গায় এসে নামিয়ে রাখল ঝুড়িটা। কিশোর আদেশ দিল, এবার হাঁট রাফি। দেখ চেষ্টা করে পারিস কিনা।
চার ফোকরে চার পা ঢুকিয়ে ঝুড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়াল রাফিয়ান। হাঁটতে শুরু করল। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হো হো করে হেসে উঠল মুসা। তার হাসিতে যোগ দিল রবিন আর জিনা।
এই, অত হেসো না, হুঁশিয়ার করল কিশোর। স্টেশনের কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হবে।
কুকুরের পা নিয়ে হাঁটছে একটা বুড়ি। ওই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা। মুচকি হাসল কেউ কেউ।
প্ল্যাটফর্মের একধারে এসে রাফিয়ানকে বলল কিশোর, বসে থাক!
বাধ্য ছেলের মত ঝুড়ি নিয়ে বসে পড়ল কুকুরটা।
রবিন গিয়ে টিকেট কেটে আনল। এরপর ট্রেনের অপেক্ষা।
ট্রেন এল। ধরাধরি করে ঝুড়িটা তোলা হল। মুখোমুখি দুটো সিটে বসল ছেলেময়েরা, একেক সিটে দুজন করে।
খুব লক্ষ্মী ছেলে, রাফিয়ানের প্রশংসা করল জিনা। ওর মত কুকুরই হয় না। কেমন চুপচাপ রয়েছে। অবশ্যই লক্ষ্মী রাফিয়ান, অনেক কুকুরের চেয়ে বুদ্ধিও ধরে বেশি। তবে জাতে সে কুকুর। আর কুকুরের যা স্বভাব, বেড়াল দেখতে পারে না।
জিনা যখন তার প্রশংসা করছে, ঠিক ওই সময় বাতাসে না-পছন্দের জিনিসের গন্ধ পেয়েছে রাফিয়ান। ওই কামরারই একধারে এক মহিলা বসেছে, পায়ের কাছে একটা বেতের ঝুড়ি, মুখ বন্ধ। নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে ওটার ভেতর। বেড়াল!
ঘাউ করে উঠল রাফিয়ান। বিকট চিৎকার। ঝুড়িতে ওকে চুপচাপ থাকতে হবে একথা আর মনে রইল না। লাফ দিয়ে উঠে বুড়ি নিয়েই ছুটল।
তুমুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল কামরার ভেতরে। যাত্রীরা অবাক। বুড়ি হাঁটে কি করে! তারপর ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিশাল এক কুকুরের মুখ। ভয়ে কুঁকড়ে গেল কেউ। তবে বেশির ভাগই উপভোগ করল ব্যাপারটা। হাসিতে ফেটে পড়ল ওরা।
রাফিয়ানের কোনদিকে কান নেই। চেঁচিয়ে ডাকছে জিনা, শুনতেই পেল না। চোখের পলকে পৌঁছে গেল বেড়ালের ঝুড়ির কাছে।
ঘাউ! ঘাউ! প্রচণ্ড চিৎকার করছে নাক দিয়ে ঠেলে খোলার চেষ্টা করছে বেড়ালের বুড়ির মুখ।
মিয়াঁওও! ভেতর থেকে এল রাগতঃ প্রতিবাদ। ছিটিক হিটিক করে জোরে জোরে থুথু ছেটানোর শব্দ, তারপর তীক্ষ্ণ হিসহিস। ঝট করে বেরিয়ে এল একটা রোমশ কালো থাবা, বেরিয়ে পড়েছে ধারালো নখগুলো। আঘাত হানল রাফিয়ানের নাকে।
আঁউও! করে আর্তনাদ করে উঠল রাফিয়ান। পিছিয়ে এল। বদমেজাজী কুকুর নয় সে, বেড়াল তাড়া করে স্বভাবের কারণে, মজা করার জন্যে, মারার জন্যে নয়। কিন্তু খুড়ির ভেতরে বোকা গাধাটা তার মতলব বুঝতে পারেনি, ভয়ঙ্কর হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। আরে বাবা, অন্য সময় যেমন গাছে উঠে পালিয়ে যাস, তেমনি পালিয়ে গেলেই পারতিস! যত্তোসব!
হতভম্ব হয়ে গেল রাফিয়ান। তার পিঠের ওপরে ঝুড়ির দুটো হ্যাণ্ডেল বাড়ি খাচ্ছে। নাক থেকে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোঁটা রক্ত।
দারুণ দেখিয়েছিস, ম্যাগি! বলল বেড়ালের মনিব। খুব ভাল করেছিস। আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে বেয়াদব কুকুরটার।
জবাবে আরেকবার হিসিয়ে উঠল ম্যাগি। যেন কুকুরটাকে ডেকে বলল, আর লাগতে আসবি আমার সাথে, কুকুর কোথাকার!
হতবাক হয়ে পড়েছে জিনাও। রাফিয়ানেরই দোষ। তাই মহিলাকে কিছু বলল না, শুধু চোখের আগুনে একবার ভ করার চেষ্টা চালাল। রাফিয়ানের কলার চেপে ধরল একহাতে, আরেকহাতে ঝুড়ির আঙটা আরেকটা আঙটা ধরতে বলল মুসাকে। বয়ে নিয়ে এল কুকুরটাকে। যার যার সিটে এসে বসল। কামরায় প্রচণ্ড হাসাহাসি চলছে। কুকুরটাকে বসতে বলার কথা পর্যন্ত ভুলে গেছে জিনা। ঝুড়ি পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়েই আছে রাফিয়ান। বিচিত্র দৃশ্য। তাতে হাসি আরও বাড়ছে লোকের।
ছেলেমেয়েরা হাসল না। এত গোলমাল কিসের, বুঝতে পারল না রাফিয়ান।
অবশেষে যাত্রা শেষ হল।
খোলা বাতাসে বেরিয়ে এল আবার ওরা। রাফিয়ানকে ঝুড়ি থেকে বের করে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল।
নিশ্চয় সামনের ওই চওড়া রাস্তাটাই অ্যালমণ্ড রোড, রবিন বলল।
২৮ নাম্বার খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। অনেক পুরানো একটা বাড়ি। তবে বেশ সুরক্ষিত, নতুন রঙ করা হয়েছে। ধনী একজন ইংরেজ ভদ্রমহিলা এরকম জায়গায়ই বাস করবেন আশা করেছিল ছেলেমেয়েরা।
ঘন্টা বাজাল কিশোর। দরজা খুলে দিল এক মহিলা, বাড়ির কেয়ারটেকার, ওদের সঙ্গে হাসি মুখেই কথা বলল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মহিলা বলল, অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন মিস মেয়ারবাল। একাই থাকতেন। বিশেষ কেউ আসতও না তার কাছে, শুধু একজন ছাড়া। তার মতই বৃদ্ধা, মিসেস ডিকেনস। হ্যাঁ, মিস মেয়ারবালকে যেদিন কবর দেয়া হল সেদিনও এসেছিলেন মহিলা, শেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে…
একনাগাড়ে বলে চলেছে মহিলা, কথা যেন আর ফুরায়ই না। খানিকক্ষণ উসখুস করে শেষে তাকে থামানোর জন্যে কিশোর বলল, মিসেস ডিকেনস-এর প্রথম নামটা জানেন? মনিকা, তাই না?
মনিকা? হ্যাঁ, বোধহয়। হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার শুনেছি বলেও মনে পড়ছে…
কোথায় থাকে জানেন? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মুসা।
নিশ্চয় জান। একদিন মিসেস মেয়ারবাল আমাকে বললেন, একটা জিনিস নিয়ে গিয়ে মিসেস ডিকেনসকে দিয়ে আসতে…
ঠিকানাটা বলুন, জলদি! আর ধৈর্য রাখতে পারছে না জিনা। চেঁচিয়ে উঠল।
তার কথায় থমকে গেল মহিলা। ভুরু কুঁচকে তাকাল। এখুনি যেন নিজেকে গুটিয়ে নেবে শামুকের মত। তাড়াতাড়ি সামাল দেয়ার জন্যে হাসল রবিন। ব্যাপারটা খুব জরুরি, ম্যাম, প্লীজ! মিসেস ডিকেনসকে আমাদের খুব দরকার। একমাত্র আপনিই জানাতে পারবেন তাঁর ঠিকানা।
আবার হাসি ফুটল কেয়ারটেকারের মুখে। তবে জিনার দিকে আর ফিরেও তাকাল না। বলল, দরকার, না? বেশ। লিখে নেবে নাকি? হিরনু স্ট্রীটে থাকেন তিনি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।
হেঁটেই যাবার সিদ্ধান্ত নিল ওরা।
ঠিকানামত আরেকটা মস্ত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। ওটারই একটা ফ্ল্যাটে থাকেন মিসেস ডিকেনস। কিশোর বেল বাজালে দরজা খুলে দিল এক তরুণী, কোলে বাচ্চা। হেসে বলল, হাল্লো, কি করতে পারি?
কেন এসেছে জানাল কিশোর। বিষণ্ণ হয়ে গেল মেয়েটা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেরি করে ফেলেছ। গত হপ্তায় মারা গেছেন তিনি। মিস মেয়ারবালের শেষ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, বেশি রাত করে ফেলেছিলেন। ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়ায় ধরল। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই শেষ।
নীররে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল ছেলেমেয়েরা। তদন্ত এখানেই শেষ। যার নামে নেকলেসটা উইল করে দিয়ে গেছেন মিস মেয়ারবাল, তিনিও আর বেঁচে নেই।
দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, মিসেস ডিকেনসের কোন আত্মীয় স্বজন আছে, জানেন? স্বামী, কিংবা ছেলেমেয়ে?
স্বামী মারা গেছেন অনেকদিন আগেই। তবে শুনেছি, এক মেয়ে আছে।
কোথায় থাকে বলতে পারবেন?
না। এখানে মাত্র দুমাস হল এসেছি। তবে আরও ফ্ল্যাট আছে, পুরানো লোকও আছে, তারা হয়ত কিছু বলতে পারবে। একজন থাকেন মিসেস ডিকেনসের পাশের ফ্ল্যাটে, বৃদ্ধা। তিনি জানতে পারেন।
ভাবল কিশোর। সবার দরজায় টোকা দিয়ে লাভ নেই। বরং ওই বৃদ্ধাকেই জিজ্ঞেস করা যাক।
ঠিক জায়গাতেই এল সে। প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বললেন, হ্যাঁ, জানি। মনিকার মেয়ের নাম মিলি। অনেক আগে বিয়ে হয়েছে। দাওয়াতে আমিও গিয়েছিলাম।
ওখানেই আছে এখনও?
ওটা ওর শ্বশুরের বাড়ি, ভাড়া বাড়ি নয়, থাকারই তো কথা।
ঠিকানাটা জানেন? –
মনে নেই, তবে লিখে রেখেছি কোথাও। দেখি। উঠে গিয়ে একটা আলমারি খুললেন তিনি। একটা নোটবুক বের করলেন। পাতা উল্টে উল্টে একজায়গায় এসে থামলেন। হ্যাঁ, আছে। তার স্বামীর নাম রিচার্ড ব্যানার। সাত নাম্বার পার্ক অ্যাভেন্য। এখনও আছে কিনা কে জানে…অনেকদিন মিলির কোন খবর জানি না। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে সেই যে চলে গিয়েছিল, আর আসেনি। বড্ড জেদী মেয়ে।
নোটবুকে দ্রুত ঠিকানাটা টুকে নিল রবিন।
বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
ঠিকই আছে, বাইরে বেরিয়ে জিনা বলল। মায়ের জিনিস মেয়েই পাবে। এখন পার্ক অ্যাভেনুটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। কোথায় ওটা, কিশোর?
ম্যাপ দেখল কিশোর। বোট্যানিক গার্ডেনস-এর কাছে বাসে যেতে হবে।
ঝট করে রাফিয়ানের দিকে তাকাল মুসা, তারপর হাতের ঝুড়ির দিকে। হেসে বলল, রাফি, আবার ঢুকতে হবে এটাতে। খবরদার, এবার বেড়াল এসে নাকের কাছে দাঁড়ালেও কিছু করতে পারবি না।
আর কোন গোলমাল হল না। বিশ মিনিট পর নিরাপদেই বাস থেকে নামল ওরা। এসে দাঁড়াল আরেকটা বাড়ির সামনে। যেখানে বাস করে মিলি ব্যানার। এখনও করে, নাকি করত?
৪
বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা হলঘর। ঝাট দিচ্ছে একজন লোক। ছেলেমেয়েদের পথ আটকাল। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, কি চাই?
এখানকার কেয়ারটেকার কে? জানতে চাইল কিশোর।
আমি। বল। লোকটা মোটেই আন্তরিক নয়।
আচ্ছা, মিসেস ব্যানার কোন ফ্ল্যাটে থাকেন, বলতে পারবেন?
মিসেস ব্যানার? তিনি তো নেই। কয়েক বছর হল অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তার স্বামী আর মেয়ের জামাইটাও মরেছে। ওই ছোকরাই গাড়ি চালাচ্ছিল। বেপরোয়া চালাত। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোর স্বভাবই ওরকম। সব কিছুতেই তাড়া। আমার গাড়ি থাকলে…
কেয়ারটেকারকে থামিয়ে দিল জিনা, তার মেয়ে বেঁচে আছেন? আবার বাধা দিল জিনা।
আছে। কপাল খারাপ…
কোথায় থাকেন? ঠিকানাটা বলবেন? আবার বিয়ে করেছেন?
বার বার বাধা পেয়ে মেজাজ বিগড়ে গেল কেয়ারটেকারের। কড়া গলায় বলল, আচ্ছা ছেলে তো! জিনাকে ছেলে বলে ভুল করল সে। কোন কথাই শুনতে চায় না! এই, এত তাড়া থাকলে নিজেই গিয়ে খুঁজে বের কর না। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? যাও এখন। কুত্তা ঢুকিয়েছ কেন? পায়ের ময়লা দিয়ে সারা ঘর তো দিলে নোংরা করে…
রেগে উঠতে যাচ্ছিল জিনা, তাকে থামিয়ে দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, যাচ্ছি। ওপরে গিয়ে দেখি আর কেউ কিছু জানে কিনা…
খবরদার, ওপরে যাবে না বলে দিচ্ছি! গর্জে উঠল কেয়ারটেকার। মাত্র পরিষ্কার করলাম। ময়লা করতে দেব না।
কুকুরটাকে বয়ে নিয়ে যাব আমরা, বলল মুসা।
ভালমত পা মুছে যাব, রবিন বলল।
হবে না! কেয়ারটেকার বলল। বেরোও। কোত্থেকে এক কুত্তা নিয়ে ঢুকেছে! তোমাদের সঙ্গে বকবক করে সময় নষ্ট করতে পারব না।
আর সামলানো গেল না জিনাকে। বকবক তো আপনি করলেন। সেটাই মাতে চাইছিলাম।
রেগে লাল হয়ে গেল কেয়ারটেকার। পারলে ঝাড় দিয়ে বাড়ি মারে। এটা বোধহয় আন্দাজ করে ফেলল রাফিয়ান। দাঁত খিঁচিয়ে লাফ দিয়ে সামনে এগোল। এমন জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল, ভীষণ চমকে গিয়ে হাত থেকে ঝাড়ু ছেড়ে দিল কেয়ারটেকার।
রাফিয়ানের কলার টেনে ধরে থামাল জিনা। আমাদেরকে আটকানোর কোন অধিকার নেই আপনার। কার সঙ্গে দেখা করতে যাব, না যাব, সেটা আপনার ব্যাপার নয়। আর এত ধমকাচ্ছেন কেন? কি করেছি আমরা? কয়েকটা কথাই শুধু জানতে চেয়েছি।
আমি…তোমরা…, রাগ এবং একই সাথে কুকুরটার ভয়ে কথা আটকে যাচ্ছে কেয়ারটেকারের।
দেখুন, মুসা বলল, ভাল চাইলে পথ ছাড়ুন। নইলে আবার ছেড়ে দেয়া হবে ওকে, রাফিয়ানকে দেখাল সে।
আর আমার বিশ্বাস, সহজে রাগে না কিশোর, কিন্তু এই লোকটার ওপর রেগে গেছে, ওটা আপনাকে কামড়াতে পারলে খুশি হবে। কামড় খেতে চান। নাকি?
খেতে চাইল না কেয়ারটেকার। রাগে গটমট করে চলে গেল একটা দরজার দিকে। টান দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকল, তারপর দড়াম করে বন্ধ করে দিল পাল্লা।
হাসতে শুরু করল জিনা। যাক, ভয় তাহলে পেয়েছে। রাফিয়ানের মাথায় আলতো চাপড় দিয়ে বলল, খুব ভাল করেছিস।
এসো, বলে সিঁড়ির দিকে রওনা হল কিশোর।
দোতলায় উঠে প্রথম যে দরজাটা পড়ল, ওটার বেল বাজাল কিশোর। খুলে দিল এক অল্প বয়সী মহিলা।
গুড আফটারনুন, বিনীত কণ্ঠে বলল কিশোর। বিরক্ত করলাম আপনাকে, সরি। মিসেস ব্যানারের মেয়ের খোজে এসেছি আমরা। তিনি কি এখানে থাকেন?
ব্যানার? নাহ্, এই বুকে ওই নামে কেউ আছে বলে জানি না। তবে আমি এসেছি নতুন, এই কদিন হল।…আচ্ছা, এক কাজ কর না। পাঁচতলায় চলে যাও। একজন বুড়ো ভদ্রলোক থাকেন ওখানে, নাম মিস্টার উইলিয়ামস। গানের শিক্ষক। তিরিশ বছর ধরে আছেন ওই ফ্ল্যাটে। তিনি কিছু বলতে পারবেন। মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার সিঁড়ির দিকে এগোল ওরা। পাঁচতলায় উঠে দেখতে পেল, একটা দরজায় পেতলের নেমপ্লেট লাগানো রয়েছেঃ ডেভিড উইলিয়ামস-পিয়ানো টীচার।
বেল বাজাল কিশোর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল দরজা। লম্বা এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, সব সাদা। হাসলেন। গুড আফটারনুন, ইয়াং ফ্রেণ্ডস, বললেন তিনি। পিয়ানো শিখতে চাও?
জ্বী না, দ্রলোকের হাসিটা ফিরিয়ে দিল কিশোর। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে। সময় হবে?
এসো, বলে সরে দাঁড়ালেন তিনি। রাফিয়ানকে নিয়ে ঢুকবে কিনা দ্বিধা করছে জিনা, দেখে তিনি বললেন, না না, অসুবিধে নেই। নিয়েই এসো। কুকুরটা তোমার,, ইয়াং ম্যান? কেয়ারটেকারের মতই জিনাকে ছেলে বলে ভুল করেছেন মিস্টার উইলিয়ামসও। – হাসল জিনা। নিতান্তই ভদ্রলোক এই মানুষটি, তাঁকে ফাঁকি দিতে চাইল না সে। বলল, হ্যাঁ, স্যার, আমারই। আর আমি ছেলে নই, মেয়ে, জরজিনা। ওর নাম রাফিয়ান।
একে একে সকলের সঙ্গে হাত মেলালেন উইলিয়ামস। দেখাদেখি রাফিয়ানও একটা পা তুলে দিল। ভুরু কুঁচকে এক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর হেসে পা ধরে ঝাঁকিয়ে দিলেন।
আসার কারণ জানাল কিশোর।
হ্যাঁ, বললেন মিস্টার উইলিয়ামস, কেয়ারটেকার ঠিকই বলেছে। ভাবলে খারাপই লাগে। খুব ভাল লোক ছিল ওরা। মিলিও মারা গেছে, তার স্বামীও। জামাইটাও বাঁচেনি। তবে মিলির মেয়ে এরিনা বেঁচে আছে। ওই গাড়িতে তখন ছিল না সে। এখানেই ওর জন্ম। ওকে পিয়ানো বাজানো শিখিয়েছিলাম আমি। খুব ভাল হাত ওর, আমার ছাত্রদের মধ্যে ওর মত কমই পেয়েছি। এখন তার বয়েস সাতাশ। আর বিয়ে-থা করেনি। আমার মতই এখন পিয়ানো বাজানো শিখিয়ে পেট চালায়। একটা মেয়ে আছে। নাম মলি।
পুরো নাম কি তার? জিজ্ঞেস করল কিশোর। মানে, স্বামীর নাম কি ছিল?
কোথায় থাকে? যোগ করল মুসা।
স্বামীর নাম ছিল কলিনস। দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটে থাকে এরিনা, কাছেই, সাইক্যামোর রোডে।
আনন্দে উজ্জ্বল হল কিশোর গোয়েন্দাদের মুখ।
থ্যাঙ্ক ইউ ভেরিমাচ, স্যার, কিশোর বলল। আপনাকে বলতে অসুবিধে নেই, জরুরি একটা ব্যাপারে তাকে খুঁজছি। একটা খুব দামি জিনিস আছে আমাদের কাছে, ওটার মালিক এখন মিসেস কলিনস।
জিনিসটা কি জানতে চাইলেন না মিস্টার উইলিয়ামস। সত্যিই তিনি দ্রলোক। বললেন, শুনে খুশি হলাম। অনেক কষ্ট করে মেয়েটা। জিনিসটা পেলে সাহায্য হবে।
সাইক্যামোররোডটা কোথায়, স্যার? মুসা জিজ্ঞেস করল।
এই সময় ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল এক তরুণ। বয়েস আঠারো মত হবে। চমকে গিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল রাফিয়ান।
আরে আরে, এত রাগ করার কিছুই নেই, রাফিয়ানকে শান্ত করার জন্যে হাসলেন উইলিয়ামস।ও আমার নাতি, টনি। তোকে মারবে না।
সবার সঙ্গে টনির পরিচয় করিয়ে দিলেন মিস্টার উইলিয়ামস। ওদেরকে সাইক্যামোর রোড দেখিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিল টনি। বলল, কাছেই। চলো, দেখিয়ে দিই।
মিস্টার উইলিয়ামসকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। টনির সাথে চলল। ছেলেটাকে ভালই মনে হল ওদের, প্রচুর কথা বলে। বলল, তোমাদের কথা আমি শুনেছি। আমেরিকায় গিয়েছিলাম একবার, লস, অ্যাঞ্জেলেসে। তোমরা তিন গোয়েন্দা, অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করেছ। পত্রিকায়ও অনেকবার উঠেছে, তোমাদের নাম। শেষবার বোধহয় কয়েকটা জটিল ধাঁধার সমাধান করেছিলে, এক বুড়ো লোকের লুকিয়ে রেখে যাওয়া গুপ্তধন বের করেছিলে।
হ্যাঁ, হেসে বলল মুসা। তোমার স্মৃতিশক্তি খুব ভাল।
অনেক নাম তোমাদের লস অ্যাঞ্জেলেসে। তোমাদের নাম আরও ছড়িয়েছেন বিখ্যাত ফিল্ম প্রডিউসার ডেভিস ক্রিস্টোফার। তাই না? তা, আমাদের শহরে বেড়াতে এসেছ বুঝি? ভাল। তোমাদেরকে সব রকমের সাহায্য করব আমি। যেকোন দরকার হলেই আমাকে ডেকো। আমার বাবার গাড়ি আছে, আমাকেও চালাতে দেয়। কাগজ আছে? আমাদের টেলিফোন নাম্বার লিখে রাখো। বলতে বলতে নিজেই মানিব্যাগ থেকে একটুকরো কাগজ বের করে ফোন নাম্বার লিখে দিল টনি।
কাগজটা পকেটে রাখল কিশোর।
এরিনা কলিনসের বাড়ি দেখিয়ে দিল টনি! নতুন বন্ধুকে ধন্যবাদ এবং গুডবাই জানিয়ে বাড়িটার দিকে এগোল ওরা। টনি ফিরে চলল তার দাদার বাসায়।
মিস মেয়ারবাল বা মিসেস ডিকেনসের বাড়ির মত জমকালো নয় এই বাড়িটা। সাধারণ। সিঁড়ির গোড়ায় কাঠের বোর্ডে নামের তালিকা টাঙানো রয়েছে। তাতে দেখা গেল এরিনা কলিনস থাকে তিনতলায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজাল।
জবাব এল না।
কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে আবার বোম টিপল কিশোর। এবারও সাড়া নেই। আরেকবার টিপে নিশ্চিত হল সে, এরিনা বাড়িতে নেই।
দূর! নাকমুখ কুঁচকে মুসা বলল, আবার কাল আসতে হবে! মাথা আঁকাল কিশোর।
একটা ব্যাপারে একমত হল, সবাই, বিকেলটা মন্দ কাটেনি। বেশ উত্তেজনা গেছে। খুঁজতে হয়েছে বটে অনেক, তবে নেকলেসের আসল মালিককে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
বাসায় ফিরে এল ওরা। কেরিআন্টিকে জানাল সব। শুনে তিনিও খুশি হলেন।
সেরাতে সকাল সকাল শুতে গেল ছেলেমেয়েরা। সারাটা বিকেল অনেক পরিশ্রম করেছে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা।
মাঝরাতে রাফিয়ানের চাপা ঘড়ঘড় শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জিনার। তার বিছানার পাশেই শুয়ে ছিল কুকুরটা, উঠে দাঁড়িয়েছে।
কি হয়েছে রে, রাফি! ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা।
সিটিং রুমের দরজার দিকে মুখ করে আছে রাফিয়ান। কান খাড়া।
মৃদু শব্দটা এবার জিনার কানেও এল। সিটিং রুমে নড়াচড়া করছে কেউ।
৫
মাথায় হাত রেখে রাফিয়ানকে শব্দ না করার ইঙ্গিত করল জিনা। তারপর পা টিপে টিপে এগোল সিটিং রুমের দিকে। ও জানে, ফ্ল্যাটে কোথাও না কোথাও বার্গলার অ্যালার্ম রয়েছেই, থাকে এসব বাড়িতে। তাহলে বেজে উঠছে না কেন? হয়ত অফ করা রয়েছে।
আস্তে দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল জিনা। টর্চের আলো চোখে পড়ল। নড়ছে। আর ঠেকানো গেল না রাফিয়ানকে। চিৎকার করতে করতে গিয়ে ঢুকল সিটিং রুমে। বিপদের পরোয়া না করে জিনাও ঢুকল ঘরে। চেঁচাতে লাগল, চোর! চোর!
টাব চেয়ারটার কাছে ছিল লোকটা। টর্চের আলো নিচের দিকে, ফলে তার চেহারা দেখতে পেল না জিনা, শুধু আবছা একটা অবয়ব। রাফিয়ান চিৎকার করে উঠতেই ঝট করে সোজা হল সে, ফিরে তাকাল।
জিনার চোর চোর চিৎকার শুনে দিল জানালার দিকে দৌড়।
রাফি! ধর ওকে! ধর ধর! আবার চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
মস্ত জানালা, ফ্রেঞ্চ উইনডো। খোলা। ওটার দিকেই গেল লোকটা। সে জানালা ডিঙানোর আগেই পৌঁছে গেল রাফিয়ান। পা কামড়ে ধরতে গেল। দাঁত বসে গেল প্যান্টে, পায়ে লাগল না। ঝাড়া দিয়ে সেটা ছুটিয়ে নিয়ে একলাফে ব্যালকনিতে গিয়ে পড়ল লোকটা।
ইতিমধ্যে ছুটে এসেছে তিন গোয়েন্দা। মিস্টার পারকারেরও হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে।
জানালার কাছে ছুটে গেল কিশোর, তার পরপরই মুসা।
লোকটাকে দেখতে পেল না। অনুমান করল ওরা, নিশ্চয় লাফিয়ে পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে গিয়ে পড়েছিল লোকটা, তারপর ফায়ার এসকেপ বেয়ে নেমে চলে গেছে।
কেরিআন্টি আর মিস্টার পারকারও সিটিং রুমে এসে ঢুকেছেন।
চোরই, জিনা বলল। চেহারা দেখিনি। কিন্তু আমি শিওর, ওই কোলাব্যাঙটাই, রবার্ট ম্যাকি। টাব চেয়ারটার ওপর ঝুঁকে খুঁজছিল।
নিশ্চয় নেকলেসটা, মুসা বলল।
হ্যাঁ, ওটাই, আর কি খুঁজবে, কিশোর বলল। ওই চেয়ারেই লুকানো আছে। ওটা, আগে থেকেই জানে ব্যাটা।
এজন্যেই চেয়ার কেনার এত আগ্রহ ওর, কেরিআন্টি বললেন।
দেখ ছেলেরা, কেশ, একটু রুক্ষ স্বরেই বললেন মিস্টার পারকার। না জেনে অযথা কারও ওপর দোষ চাপানো ঠিক নয়। তার চেহারা দেখনি, কোন প্রমাণ নেই, ম্যাগিই যে এসেছিল কি করে বুঝলে?
যুক্তি দিয়ে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর।
দেখ কিশোর, তোমার বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা আছে। তবু, সব চেয়ে বুদ্ধিমান লোকটিও ভুল করে। তোমরা যা বলছ, পুলিশ সেটা বিশ্বাস না-ও করতে পারে। ওরা প্রমাণ চাইবে, সলিড প্রমাণ। চোর ঢুকেছিল, এটুকুই বলতে পারব, ব্যস। অ্যাটেমপৃড় টু বার্গলারি। পুলিশকে অবশ্যই জানাব কাল, তবে রবার্ট ম্যাকিই এসেছিল, একথা বলব না।
দ্রুত্ত, একবার সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলেন কেরিআন্টি। জানালেন, সব ঠিকই আছে, কিছু চুরি যায়নি। জানালায় কিছু দাগ আবিষ্কার করল কিশোর, যেগুলো জোর করে খোলার ফলে হয়েছে। আর কোন সূত্র নেই। এ দিয়ে পুলিশ চোর ধরতে পারবে না যে, ভাল করেই বুঝল।
আবার শুতে গেল ছেলেমেয়েরা। জিনা, মুসা আর রবিন নিশ্চিত, রবার্ট ম্যাকিই এসেছিল। কিশোরের মনে কিছুটা সন্দেহ রয়ে গেল। সত্যি ম্যাকি? অন্য কেউ না তো?
পুলিশ কিছু করলে করুক না করলে নেই, জিনা বলল। আমরাই এর বিহিত করব।
হুফ! একমত হল রাফিয়ান।
ভাগ্যিস, রবিন বলল, আগেই পেয়ে গিয়েছিলাম নেকলেসটা। নইলে আজ নিয়ে যেতোই। আমরা জানতেও পারতাম না ওটা ছিল, চুরি গেছে। আন্টি কোথায় রেখেছে ওটা, জিনা?
দৈখলাম তো মার হাতব্যাগে রাখল। পরে সরিয়ে-টরিয়ে রেখেছে কিনা জানি না।
পরদিন সকালে যথারীতি সম্মেলনে চললেন মিস্টার পারকার। বললেন, যাবার পথে পুলিশকে জানিয়ে যাবেন।
নাস্তার টেবিলে বসে চোর আসার ব্যাপারটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চালাল ছেলেময়েরা। কেরিআন্টি রান্নাঘরে ব্যস্ত।
আমি এখনও বলছি, জিনা বলল, রবার্ট ম্যাকিই এসেছিল।
আমি অতোটা শিওর না, মাথা নাড়ল কিশোর। রাতে শুয়ে শুয়ে ভেবেছি। কিউরিও আর সুভনির বিক্রি করে ম্যাকি, ওসব জিনিসের খুব ভাল লাভ। অনেক সময় আসল দামের বহুগুণ। টাব চেয়ারটা কিনতে চাওয়ার কারণ সেটাও হতে পারে। যদি সে জানতোই, নেকলেসটা রয়েছে ওটার মধ্যে, তাহলে আরও আগেই হাতানোর চেষ্টা করল না কেন? আর সেদিন নিলাম ডাকার সময় এত কিসের দ্বিধা ছিল তার? একবারেই দুশো-তিনশো পাউণ্ড দাম হেঁকে নিয়ে নিতে পারত। আর রাতের বেলা লোকের ব্যালকনি থেকে লাফঝাপ করাও ঠিক মানায় না তাকে। পারবে বলে মনে হয় না।
তারমানে, মুসা বলল, তুমি বলতে চাইছ, অন্য কেউ জানে নেকলেসটার কথা। কে সেই লোক?
ম্যাকিকে কিন্তু খুব একটা ভাল লোকও মনে হয় না, রবিন বলল। সেটা নিশ্চয় স্বীকার করবে, কিশোর? কাল রাতের চোর সে হতেও পারে।
সে-ই! জোর দিয়ে বলল জিনা।
সে নয়, একথা কিন্তু আমি বলছি না, কিশোর বলল। আমি অন্যান্য সম্ভাবনার কথা বলছি। যুক্তি দিয়ে ঠিক মেলাতে পারছি না, এই আরকি। তাছাড়া প্রমাণ কোথায়?
হাসল জিনা। নিজের ওপর খুব বেশি আস্থা তোমার, কিশোর পাশা। প্রমাণ চাও? দেখ, বলতে বলতে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। টেনে বের করে বলল, এই দেখ।
ভুরু কুঁচকে জিনিসটার দিকে তাকাল কিশোর। নীল রঙের একটুকরো। কাপড়।
কাল রাতে লোকটার প্যান্ট কামড়ে ধরেছিল রাফি, জিনা বলল। ছিঁড়ে রেখে দিয়েছে। এটা প্রমাণ নয়? এতে লোকটার গায়ের গন্ধ লেগে আছে। লোকটাকে এখন সামনে পেলে চিনতে পারবে রাফি। ম্যাকির দোকানে ওকে নিয়ে যাব। ওকে দেখলেই রেগে যাবে রাফি, দেখ…
তাতেও কিছু প্রমাণ হয় না। রাফি ওকে দেখতে পারে না। রেগে তো যাবেই।
তবু, যাবই। নেকলেসটার কথা যদি জেনে থাকে সে, সহজে ক্ষান্ত হবে না।
কিন্তু ওখানে গেলেই বুঝে ফেলবে, আমরা তাকে সন্দেহ করছি, যুক্তি দেখাল রবিন। তখন তার ওপর নজর রাখা কঠিন হয়ে যাবে আমাদের জন্যে।
ও আমাদেরকে ভালমত চেনে না। চেনে? জিনা বলল। সেল-রুমে ভিড় ছিল। তাছাড়া মার সঙ্গেই কথা বলছিল সে, আমাদের দিকে বিশেষ নজর দেয়নি।
তা ঠিক, মুসা বলল। কাল রাতেও আমাদেরকে দেখেনি। আমরা আসার আগেই পালিয়েছে।
আমাদের দেখেনি, কিশোর মনে করিয়ে দিল। কিন্তু জিনাকে দেখেছে।
দেখলেও আবছাভাবে দেখেছে। আমি যেমন দেখেছি।
কিন্তু রাফি? রবিন বলল। ওকে তো দেখেছে। শুধু দেখেইনি, দাঁতের আঁচড়ও খেয়েছে নিশ্চয়।
হুফ! মাথা ঝাঁকাল রাফিয়ান।
চুপ হয়ে গেল জিনা। ভাবছে। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ। ঝুঁকি একটা নিতেই পারি আমরা। আমি আগে রাফিকে নিয়ে দোকানে ঢুকব, তোমরা বাইরে থাকবে। যদি আমাদের চিনেই ফেলে, সন্দেহ করে, এরপর থেকে আমি আর ওর
সামনে যাব না! তোমরা তখন নজর রাখবে। কাজেই নজর রাখার অসুবিধের কথা যে বলছ, তা হবে না।
তর্ক করলে করতে পারত কিশোর, কিন্তু করল না। জিনার কথায় যুক্তি আছে। অবশ্যই।
ঘন্টাখানেক পর রওনা হল ওরা। কাপড়টা সঙ্গে নিল জিনা। মিমোসা অ্যাভেনুতে পৌঁছে আলাদা হয়ে গেল ওরা। জিনা আর রাফিয়ান চলল আগে, ছেলেরা রইল পেছনে। ম্যাকির দোকানের কয়েক দোকান আগেই থেমে গেল তিন গোয়েন্দা।
পকেট থেকে কাপড়ের টুকরোটা বের করে ভালমত শোকাল রাফিয়ানকে জিনা। তারপর তাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল দোকানে।
দোকানেই রয়েছে ম্যাকি। জিনাকে দেখে তৈলাক্ত হাসি হেসে এগিয়ে এল। মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার জন্যে কি করতে পারি? কিন্তু জবাব দেয়ার সময় পেল না জিনা। রাতের অতিথিকে বোধহয় চিনে ফেলেছে রাফিয়ান। ঘেউ ঘেউ শুরু করল। ছুটে যেতে চাইছে জিনার হাত থেকে। লাফিয়ে গিয়ে ম্যাকির টুটি কামড়ে ধরতে চায়।
এই, চুপ! রাফিকে ধমক লাগাল জিনা। লোকটার দিকে চেয়ে লজ্জিত কণ্ঠে বলল, সরি, এমন করছে কেন বুঝতে পারছি না। ওর স্বভাব খুব ভাল। সহজে কাউকে কামড়াতে যায় না।
ভয় দেখা দিল লোকটার চোখে। সন্দেহে রূপ নিল সেটা। জিনা নিশ্চিত হয়ে গেল, ম্যাকিই গিয়েছিল রাতে। চিনে ফেলেছে রাফিয়ান, নইলে এত উত্তেজিত হত না। আর লোকটাও, বুঝে গেছে, এই কুকুরটাই তাকে কামড়াতে চেয়েছিল।
যাও, বেরোও তোমার কুত্তা নিয়ে! ধমকে উঠল ম্যাকি। জানোয়ারটানোয়ার ঢুকতে দিই না দোকানে এজন্যেই!
কিশোরের কথা না শুনে ভুল করেছে, বুঝতে পারল এতক্ষণে জিনা। হুঁশিয়ার হয়ে গেছে ম্যাকি। ভিড়ের মধ্যে দেখেছে বটে, কিন্তু দেখেছে তো, তিন গোয়েন্দাকেও চিনে রেখেছে কি না কে জানে!
বন্ধুদের কাছে ফিরে এল সে।
খবর শুনে খুশি হল না কিশোর। সে আগেই আন্দাজ করেছে এরকম একটা কিছু ঘটতে পারে। আরেকটা ব্যাপার জিনা খেয়াল করেনি, সে বেরোনোর পর পরই দোকান বন্ধ করে দিয়েছে ম্যাকি। দরজায় বন্ধ নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়ে তার পিছু নিয়েছে। উল্টো দিক থেকে বইছে বাতাস, ফলে তার গন্ধ পায়নি রাফিয়ান। একটা গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে বসে এখন ওদের সব কথা শুনছে।
ঠিক আছে, কিশোর, হাত তুলে বলল জিনা, স্বীকার করছি, ওভাবে শত্রুর ঘরে ঢুকে ভুল করেছি। কিন্তু শিওর তো হওয়া গেল, নেকলেস চুরি করার জন্যে ওই লোকটাই এসেছিল কাল রাতে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এরিনা কলিনসের জিনিস তাকে পৌঁছে দেয়া দরকার।
এখুনি যাই না কেন তাহলে? পরামর্শ দিল মুসা। গিয়ে তাকে জানাই খবরটা।
হ্যাঁ, যাওয়া যায়, রবিন বলল। আজ বাসায় পেতেও পারি।
সুতরাং আবার সাইক্যামোর রোডে চলল ওরা। বাড়িটার কাছে পৌঁছল। সদর দরজা দিয়ে ঢোকার সময় হঠাৎ কি মনে করে পেছন ফিরে তাকাল জিনা। এই! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে। দেখেছি! ম্যাকিকে দেখলাম মোড়ের ওপাশে চলে যেতে!
দূর, কি যে বল না, বিশ্বাস করল না মুসা। তোমার মাথায় এখন ম্যাকি ঢুকে রয়েছে তো, যেখানে যাও সেখানেই দেখ। এসো।
এরিনা কলিনসকে পাওয়া গেল সেদিন। ঘন্টা শুনেই এসে দরজা খুলে দিল। বয়েস কম। লম্বা কালো চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। পাশে তার ছোট্ট মেয়েটি, মলি। সুন্দর চেহারা, তবে নাকটা সামান্য বোচা, হাসিটা খুব মিষ্টি। বয়েস বছর ছয়েকের বেশি না।
নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর। বলল, জরুরি কথা আছে।
হাসল এরিনা। বেশি জরুরি?
হ্যাঁ।
এসো। ছেলেমেয়েদেরকে ঘরে নিয়ে গেল এরিনা। বল।
সব কথা খুলে বলতে লাগল ওরা। রাফির সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে মলির, খানিকক্ষণ পর সে-ও ওদের কথা শোনায় মনোযোগী হল, কৌতূহল জেগেছে।
আশ্চর্য! ছেলেদের কথা শেষ হলে বলল এরিনা। অবিশ্বাস্য!
কিন্তু সত্যি, জিনা বলল। বিশ্বাস না হলে নাম্বার দিচ্ছি, ফোন করুন আমার মাকে।
টেলিফোনের কাছে উঠে গেল এরিনা। কথা বলল মিসেস পারকারের সঙ্গে। জানল, ছেলেমেয়েরা মিথ্যে বলেনি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল সে। মলিকে কোলে নিয়ে আদর করল, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল তিন গোয়েন্দাকে, জিনাকে, এমনকি রাফিয়ানকেও।
তোমাদেরকে বলতে অসুবিধে নেই, এরিনা বলল, সময় খুব খারাপ যাচ্ছে আমার। পিয়ানো বাজানো শিখিয়ে আর কত আয় হয় বল। কোনমতে টেনেটুনে চলে আরকি মা-মেয়ের। মিস মেয়ারবাল মস্ত উপকার করে গেলেন আমাদের।
হারটা খুব দামি, কিশোর বলল। গোলাপী মুক্তা দুর্লভ তো, দাম বেশি।
আর খুব সুন্দর, রবিন বলল। দেখলে রেখে দিতে ইচ্ছে হবে আপনার।
কিন্তু ইচ্ছে করলেও রাখতে পারব না, এরিনা বলল, কারণ আমার টাকা দরকার। তাছাড়া মিসেস পারকার একটা ভাল পরামর্শ দিলেন, বললেন, সাথে সাথে যেন বিক্রি করে টাকাটা ক্যাশ করে ফেলি। রেখে দিলে বিপদ হতে পারে। চোরের উপদ্রব নাকি শুরু হয়েছে। খোয়া যেতে পারে।
হ্যাঁ, পারে, জিনা বলল। চলুন আমাদের সঙ্গে। এখুনি নিয়ে নেবেন।
খানিকটা মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতেই যেন হাসল এরিনা। যেতে পারলে তো ভালই হত। কিন্তু সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হবে আমাকে। ছাত্ররা আসবে। আজ ডেট আছে অনেকের। কাল হয়ত যেতে পারব। একমুহূর্ত থামল সে। এতই অবাক হয়েছি কথাটা শুনে, তোমার মাকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেছি, জিনা। লাইনটা লাগাও না আরেকবার।
ডায়াল করল জিনা। সাথে সাথেই ধরলেন মা। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এরিনা বলল কাল সে আসছে, মিসেস পারকারের কোন অসুবিধে হবে কিনা। হবে না, তিনি জানালেন। বলে দিলেন সারা সকাল বাসায়ই থাকবেন। ঠিক হল, দশটা নাগাদ যাবে এরিনা।
ফোন রেখে দিয়ে এরিনা বলল, তাহলে কাল আবার দেখা হচ্ছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে, অনেক কষ্ট করেছ আমার জন্যে।
কাল দেখা হবে! অনেকটা মায়ের মত করেই বলল মলি। রাফিকে ছাড়তে চাইছে না সে। ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে কুকুরটাকে। আর রাফিও বাচ্চা পছন্দ করে, সহজেই মন জয় করে নিতে পারে ওদের।
পরদিন সকালে মস্ত জানালার কাছে বসে পথের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেমেয়েরা। ২
ওই যে, আসছে, হঠাৎ বলে উঠল ওরা। মা-মেয়ে দুজনেই। নিশ্চয় বাসে এসেছে। বাস থেকে নেমে হেটে আসছে।
মেয়েটা সুন্দর, না? রবিন বলল।
মাথা ঝাঁকাল জিনা আর মুসা।
কিশোর বলল, যাই, আন্টিকে খবরটা দিই।
কিশোরের সঙ্গে জানালার কাছ থেকে সরে এল রবিন আর মুসা, কিন্তু জিনা বসেই রইল। একটা লোক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার।
পথের মোড়ে দেখা যাচ্ছে লোকটাকে। দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাকিয়ে আছে এরিনার দিকে। জিনার মনে হল, মা-মেয়েকে অনুসরণ করে এসেছে লোকটা।
ভুলও হতে পারে আমার, বিড়বিড় করল সে। দূর থেকে ঠিক চিনতে পারছি না…। এগোল লোকটা। আরি! এ তো রবার্ট ম্যাকি! এই রাফি, দেখ দেখ!
জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দেখল রাফিয়ান। চাপা গরগর করে উঠল।
কাপড় কি পরেছে দেখেছিস! যেন একটা কাকতাড়ুয়া পুতুল। লম্বা ওভারকোট, কলার তুলে দেয়া, হ্যাট টেনে নামিয়েছে কপালের ওপর..ভেবেছে আমাদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে। হুহ! ভালই ছদ্মবেশ নিয়েছে ব্যাটা!
হুফ! যেন একমত হল রাফিয়ান।
চল, ওদেরকে গিয়ে বলি। তিন গোয়েন্দাকে রান্নাঘরে পেল জিনা। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, এই, গণ্ডগোল হয়েছে! রবার্ট ম্যাকি এরিনা কলিনসের পিছু। নিয়েছে। চলে এসেছে এখানে।
৬
আবার কল্পনা করছ তুমি, মুসা বলল। ও কিভাবে জানবে…?
ঘন্টার শব্দে থেমে গেল সে।
দরজা খুলে দিতে ঘরে ঢুকল এরিনা আর মলি। গিয়ে ওদেরকে এগিয়ে আনলেন কেরিআন্টি। কুশল বিনিময় করলেন। তারপর ওদেরকে বসতে দিয়ে চলে গেলেন শোবার ঘরে। নীল বাক্সটা বের করে এনে তুলে দিলেন এরিনার হাতে। কাঁপা কাঁপা হাতে ঢাকনা খুলল সে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল মুক্তাগুলোর দিকে।
অনেকক্ষণ পর কথা ফুটল তার মুখে, অপূর্ব! বড়দিনের উপহারই আমি ধরে নেব এটাকে.দাম নিশ্চয় অনেক, তাই না?
তা তো নিশ্চয়, হেসে বলল কেরিআন্টি। যাআক, বা, যার জিনিস তার হাতে তুলে দিয়ে আমি বাঁচলাম। কি টেনশনেই না ছিলাম।
টেনশন তো হবেই। এটার পেছনে লোক লেগেছে জানেন যে, মুসা বলল। মিসেস কলিনস, রাতে চোর ঢুকেছিল এ-বাড়িতে। জিনা আর রাফি ওকে তাড়িয়েছে।
তাই নাকি? অস্বস্তি দেখা দিল এরিনার চোখে। এই হারের জন্যেই এসেছিল?
তাই তো মনে হয়। আর কিসের জন্যে আসবে? ব্যাপারটা খুলে বলল মুসা। চোর কোনখান দিয়ে ঢুকল, কিভাবে চেয়ার হাতড়াল, তারপর কিভাবে তাড়া খেয়ে পালাল, সব।
আমি জানি চোরটা কে? বলে উঠল জিনা। রবার্ট ম্যাকি।
জিনা, না জেনে কারও সম্পর্কে ওভাবে কথা বলা ঠিক না, বেশ একটু কড়া গলায়ই মেয়েকে বললেন মিসেস পারকার।
মা, না জেনে বলছি না, রেগে উঠল জিনা। এইমাত্র দেখে এলাম লোকটাকে, রাস্তায়। ছদ্মবেশে মিসেস কলিনসের পিছু পিছু এসেছে।
তোমার কল্পনা, আগের কথাই বলল আবার মুসা। ও কিভাবে জানবে মিসেস কলিনস কোথায় যাচ্ছেন?
তা বলতে পারব না, হাত ওল্টাল জিনা। তবে আমাদেরকে ওখানে যেতে দেখেছে, এখন আমি শিওর, কাল ওকেই দেখেছিলাম। তারপর নিশ্চয় ও-বাড়ির ওপর চোখ রেখেছে। মিসেস কলিনস বেরোতেই তার পিছু নিয়েছে।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল এরিনার মুখ। তাহলে ভুল দেখিনি আমি!
ভুল দেখেননি মানে? আগ্রহী হয়ে উঠল কিশোর।
আমি…ইয়ে, মানে…লম্বা ওভারকোট পরা একটা লোককে দেখেছি, বাড়ি থেকে বেরিয়ে…পিছে পিছে এল, একই বাসে চড়ল, একই স্টপেজে নামল…চেহারা দেখতে পারিনি।
মুহূর্ত দেরি করল না আর মুসা। দৌড় দিল জানালার দিকে। কিশোর গেল পিছে। ব্যালকনিতে বেরিয়ে ভালমত চোখ বোলালো রাস্তায়। কিন্তু লোকটাকে চোখে পড়ল না।
রবিন এসে দাঁড়াল পাশে।
কেউ নেই, তার দিকে ফিরে বলল কিশোর। আবার সিটিং রুমে ফিরে এল তিনজনে।
চলে গেছে লোকটা, মুসা বলল। ইচ্ছে করে পিছু নেয়নি। এদিকেই আসছিল হয়ত কোন কাজে।
এখন তা আর মনে হয় না আমার, মাথা নাড়ল কিশোর। মিসেস কলিনসকেই অনুসরণ করেছে সে। জিনা কাল দেখেছে, আজও দেখেছে। মিসেস কলিনসও দেখেছেন। চোখের ভুল আর বলা যাবে না।
ব্যাটা লুকিয়ে পড়ল নাকি কোথাও? মুসা বলল। বেরিয়ে দেখব?
না, দরকার নেই, তাড়াতাড়ি হাত নাড়লেন কেরিআন্টি। লোকটা খারাপ। শেষে কি করে বসে!
শুনুন, এরিনাকে বলল কিশোর, এখন যত তাড়াতাড়ি পারেন, গিয়ে হারটা কোন ব্যাংকের ভল্টে রেখে দিন।
তাই করতে হবে। আমি যেখানে থাকি তার কাছেই একটা ব্যাংক আছে।
তাহলে সোজা ওখানে চলে যান। একা যেতে পারবেন তো? নাকি আমরা। আসব আপনার সাথে? বলা যায় না, আপনাকে একা দেখলে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে ম্যাকি। তোক বেশি দেখলে সাহস, করবে না।
এলে তো ভালই হয়, খুশি হয়ে বলল এরিনা। তবে মিসেস পারকার যদি অনুমতি দেন।
গেলে যাক, আন্টি বললেন। তবে মনে হয় না কোন দরকার আছে। হাসলেন তিনি। ট্রেনে করে যান, তাতে বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না। তাছাড়া হারটা যে আপনার কাছে আছে, তা-ও জানছে না কেউ। বিপদ ঘটবে কেন?
বাক্সটা ব্যাগে ভরল এরিনা। মিসেস পারকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এল। ওদের সঙ্গে চলল তিন গোয়েন্দা, জিনা আর রাফিয়ান। রাস্তায় বেরিয়ে লোকটাকে খুঁজল ওরা। কোথাও দেখা গেল না ম্যাকিকে।
পাতালরেলের একটা স্টেশন রয়েছে কাছেই। সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে এল ওরা। রাফিয়ানকে এবারও ঝুড়িতে ভরে নেয়া হচ্ছে, তবে এটা আগেরবারের মত। আর ফোকর কাটা নয়। তাতে সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি। এই ঝামেলা পোহাতে আর রাজি নয় কেউ।
ট্রেন আসার অপেক্ষায় নীরবে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। উৎকণ্ঠায় ভুগছে এরিনা, কখন ব্যাংকে গিয়ে বাক্সটা রাখবে, তারপর নিশ্চিন্ত। তার আশেপাশে গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে ছেলেমেয়েরা, বডিগার্ডের মত। মলির হাত ধরে রেখেছে রবিন। রাফিয়ানের ঝুড়ি মাটিতে নামানো।
ট্রেন এল। হাতে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে প্ল্যাটফর্মের একেবারে কিনারে চলে এসেছে এরিনা। হঠাৎ পেছন থেকে ধেয়ে এল একটা লোক, এক থাবায় তার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে, ধাক্কা মেরে তাকে প্রায় ফেলে দৌড় দিল। দুদিক থেকে এরিনাকে ধরে ফেলল.কিশোর আর মুসা, নইলে আরেকটু হলেই চলে যেত ট্রেনের চাকার নিচে।
যাত্রী নামছে, উঠছে, এই হুড়াহুড়ির মাঝে বেরোনোর পথের দিকে দৌড় দিল লোকটা। বেশির ভাগ মানুষই খেয়াল করল না ঘটনাটা, ট্রেনে উঠতেই ব্যস্ত ওরা। ঝুড়ির মুখ খুলে দিল জিনা। তাড়া করল লোকটাকে রাফিয়ান। পেছনে ছুটল মুসা।
দেখে মনে হয় ভবঘুরে ধরনের লোক, বুড়ো, রাফিয়ান তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই চিৎকার করে উঠল। পরমুহূর্তে তাকে ধরে ফেলল মুসা। কেড়ে নিল ব্যাগটা।
ডান হাতকে যেন বর্ম বানিয়ে মুখ আড়াল করতে চাইছে আতঙ্কিত লোকটা, বাঁ হাত কামড়ে ধরে ঝুলছে রাফিয়ান। এই সময় বেরিয়ে এল ষ্টেশনের একজন কর্মচারী। রাফিয়ানের কলার টেনে তাকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, সর, সর বলছি! শয়তান কুত্তা! মানুষ দেখলেই কামড়াতে ইচ্ছে করে? মুসার দিকে তাকাল সে। তোমার কুকুর, না? দাঁড়াও, মজা বুঝবে। লোকের ওপর কুত্তা লেলিয়ে দাও…।
বোঝানোর চেষ্টা করল মুসা। শুনলই না লোকটা। হ্যাঁচকা টান মারল রাফিয়ানের কলার ধরে। সুযোগটা কাজে লাগাল ভবঘুরে। চোখের পলকে ছুটে গিয়ে মিশে গেল লোকের ভিড়ে। হারিয়ে গেল।
এই ছেলে, কি বলছি শুনছ? রেগে গিয়ে বলল কর্মচারী।
এই সময় এখানে এসে দাঁড়াল কিশোর, রবিন, জিনা। মেয়ের হাত ধরে এল এরিনা। এখনও কাঁপছে। মলির চোখে পানি।
আমার কুকুর ধরেছেন কেম! ছাড়ুন! রাগে চিৎকার করে উঠল জিনা। চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি? দেখলেন না চোর ধরেছিল ও!
হ্যাঁ, ও-লোকটা আমার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল, এরিনা বলল। আরেকটু হলেই দিয়েছিল আমাকে ট্রেনের নিচে ফেলে। ছেলেময়েগুলো না, থাকলে কুকুরটা না থাকলে, শিউরে উঠল সে, কথা শেষ করতে পারল না।
মুসার কথা কানে না তুললেও এরিনার কথা বিশ্বাস করা কর্মচারী। খুলে পড়ল নিচের চোয়াল। প্রায় তোতলাতে শুরু করল, তা-তাই নাকি, ম্যাম! আআমি কি করে জানব, বলুন…।
তাগাদা দিল কিলোর, এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করে লাভ নেই। জলদি চলুন, আগে গিয়ে ব্যাংকে রাখুন বাটা। তারপর নিরাপদ।
আবার ঝুড়িতে ঢোকানো হল রাফিয়ানকে। ট্রেন চলে গেছে। পরের ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হল ওদের। ট্রেনে কেউ আর কোন কথা বলল না। গন্তব্যে পৌঁছে বাইরে বেরোলো খুব সাবধানে। কিন্তু কাছেপিঠে সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়ল না।
কুইক! এরিনা বলল। পাশের গ্রীটেই আমার ব্যাংক।
হ্যাঁ হ্যাঁ, চলুন, জিনা বলল। আগে ব্যাংকে রাখুন হারটা। তারপর ম্যাকির ব্যবস্থা করছি।
ম্যাকি! আঁতকে উঠল এরিনা। বুড়োটাই ম্যাকি নাকি?
নিশ্চয়ই। ভবঘুরের হরবেশ নিয়েছে বটে, কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
তারমানে, রবিন বলল, বাড়ি থেকে বেরোনোর পরই আমাদের পিছু নিয়েছে সে?
আমার তাই মনে হয়, কিশোর বলল। পথের ধারে একটা খবরের কাগজের দোকান আছে না, তার আড়ালেই বোধহয় লুকিয়েছিল। পোশাক-আশাক খুব একটা বদল করতে হয়নি। যাটটা মুচড়ে নষ্ট করেছে। হাতে, মুখে আর কোটে ধুলো লাগিয়েছে, যাতে মনে হয় নোংরা ভবঘুরে। সে ভেবেছিল মিসেস কলিনস একলা আসবেন, তাঁকে ফাঁকি দিতে অসুবিধে হবে না।
ধরেই তো ফেলেছিলাম, মুসা বলল। স্টেশনের ওই বলদ কর্মচারীটার জনেই পারলাম না। নইলে এতক্ষণে হাজতে ঢুকে যেত ম্যাকির বাচ্চা।
তা ঠিক, একমত হয়ে মাথা দোলাল রবিন।
ওই যে ব্যাংক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এরিনা। তোমরা মলিকে দেখ। আমি গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে ব্যবস্থা করে ফেলছি। লবিতে থেকো।
খানিক পরে নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে এল এরিনা।
সব ভাল যার শেষ ভাল, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল জিনা। হাসল। যাক, বাঁচা গেল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। হার পেলাম, দলিল পেলাম, মালিককেও খুঁজে বের করলাম। থ্রি চিয়ার্স ফর তিন গোয়েন্দা…।
আমি আর রাফি বাদ নাকি! কোমরে হাত দিয়ে, চোখ পাকিয়ে জিনা বলল। হেসে উঠল সবাই।
.
ওরা মনে করেছিল, এখানেই এই ঘটনার ইতি। কিন্তু পরদিন সকালে অযাচিত ভাবে এল এরিনার ফোন। মা তখন বাড়ি নেই, ফোন ধরল জিনা।
হ্যালো? শোনা গেল এরিনার উত্তেজিত কণ্ঠ, কে, জিনা?…সর্বনাশ… সর্বনাশ হয়ে গেছে…
কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল জিনা।
আজ সকালে একটা উড়ো চিঠি এসে হাজির। দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে রেখে গেছে। আমাকে হুমকি দিয়ে লিখেছেবুঝতে পারছি না কি করব!
মেরুদণ্ডে শিরশিরে অনুভূতি হল জিনার। শান্ত হোন, বলল সে, যদিও নিজেও শান্ত থাকতে পারছে না। কি লিখেছে?
লিখেছে…লিখেছে, হারটা যদি না দিই, মলিকে কিডন্যাপ করবে!
কী-করবে!
কিডন্যাপ! জিনা, আমি মনস্থির করে ফেলেছি। মলির চেয়ে হারটা বেশি। নয়। যা বলহে করব, দিয়ে দেব ওটা।
দাঁড়ান, ফোনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জিনা, এক মিনিট ধরুন! কিশোরকে বলছি…
পাশের ঘরে ছিল তিন গোয়েন্দা। ডাক শুনে এসে ঢুকল। দ্রুত ওদেরকে সব কথা জানাল জিনা।
ব্যাটা তো মহা পাজী! নিশ্চয়…
ম্যাকি, কিশোরের কথাটা শেষ করে দিল জিনা। কিশোর, কি করব? পুলিশকে জানাব?
দেখি, দাও আমার কাছে, জিনার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে কানে ঠেকাল কিশোর। মিসেস কলিনস, শুনছেন? হারটা এখুনি দেবেন না। পুলিশকে জানাচ্ছি আমরা। আপনাদের অসুবিধে হবে না। নিশ্চয় ব্যবস্থা করবে পুলিশ।
না না, কিশোর, তাড়াতাড়ি বলল এরিনা, লোকটা পুলিশকে জানাতে মানা করেছে। মলিকে পাহারা দিতে আসবে পুলিশ, ছদ্মবেশে এলেও ঠিক চিনে ফেলবে ম্যাকি। পুলিশ তো আর সারাজীবন পাহারা দেবে না। ওরা চলে গেলেই আবার বিপদে পড়বে আমার মেয়ে।
দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। কি করবে? আরেকবার বোঝানোর চেষ্টা করল এরিনাকে, ভালমত ভেবে দেখুন। লোকটা হুমকি দিল, আর অমনি হার দিয়ে দেবেন?
কি করব, বল? লোকটা বেপরোয়া, কাল স্টেশনেই বুঝেছি। তার কথা না শুনলে যা বলছে তা করবেই। কাউকে জানাতে বারণ করেছে, তা-ও তো তোমাদের জানিয়ে ফেললাম। খুব ভয় লাগছে আমার… এক মুহূর্ত থামল এরিনা, তারপর বলল, আমি মনস্থির করে ফেলেছি। ব্যাংকে গিয়ে হারটা নিয়ে লোকট যেখানে দেখা করতে বলেছে সেখানে চলে যাব। হারের দরকার নেই আমার। মেয়ে ভাল থাকলেই ভাল।
মহিলাকে কিছুতেই বোক্কতে না পেরে কিশোর বলল, দেখুন, বলে যখন ফেলেছেন আমাদেরকে, এরকম একটা অন্যায় কিছুতেই ঘটতে দিতে পারি না। আপনি জানতে না চান, জানাবেন না, কিন্তু আমরা পুলিশকে বলবই।
না না, দোহাই তোমাদের! বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল এরিনা, ওকাজ কোরো না। পুলিশ বিশ্বাস করবে না তোমাদের কথা। শুধু একটা উড়ো চিঠি, আর কোন প্রমাণ নেই লোকটার বিরুদ্ধে। হেসেই উড়িয়ে দেবে পুলিশ, মাঝখান থেকে বিপদে পড়বে আমার মলি। বুঝি, আমার ভালই চাইছ তোমরা। থ্যাঙ্ক ইউ।
এরিনা রিসিভার রেখে দেবে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, মিসেস কলিনস, শুনুন। বেশ, পুলিশকে নাহয় জানালাম না। কিন্তু ঠিঠিতে কি লিখেছে আমাদেরকে খুলে বলতে তো আপত্তি নেই। কোথায় দেখা করতে বলা হয়েছে আপনাকে?
ওসব কিছু বলব না তোমাদেরকে। জানিয়েই ভুল করে ফেলেছি, ফোঁস করে নিঃশাস ফেলল এরিনা। থ্যাঙ্ক ইউ। রাখি। ডাই।
কেটে গেল লাইন।
এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। চিন্তিত। বলল, কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। ভয় দেখিয়ে হার নিয়ে যাবে ম্যাকি, আর আমরা চুপ করে বসে থাকব, হতেই পারে না। চল, ব্যাংকের বাইরে গিয়ে লুকিয়ে থাকি।
এরিনার ওপর নজর রাখব। তারপর আর পিছু নিয়ে দেখব কোথায় যায়।
কিভাবে? প্রশ্ন তুলল রবিন। এরিনা নিশ্চয় এতক্ষণে ব্যাংকে রওনা হয়ে গেছে। তার ফ্ল্যাট থেকে ব্যাংকটা কাহে, এখান থেকে অনেক দূরে। গিয়ে ধরতে পারব না।
হয়ত পারব, বলতে বলতে পকেট থেকে নোটবুক বের করল কিশোর। পাতা উটে বের করল টনির ফোন নাম্বার-কাগজের টুকরোটা থেকে পরে লিখে নিয়েছিল নোটবুকে। দ্রুত গিয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল শুরু করল সে।
৭
পাওয়া গেল টনিকে। কিশোরকে ঘিরে এল সবাই।
টনি, কিলোর বলল, আমি কিশোর পাশা, তোমার দাদার বাসায় দেখা হয়েছিল, মনে আছে? শোনো, তোমার সাহায্য দরকার। গাড়িটা নিয়ে আসতে পারবে? দশ মিনিটের মধ্যে?…গুড। খুব জরুরি।…এলে সব বলব। ঠিকানা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। বন্ধুদেরকে জানাল, আসছে। হয়ত ধরতে পারব এরিনাকে। মলিকে কারও কাছে রেখে আসতে হবে তার, তাতে সময় লাগবে। ব্যাংকে গিয়ে জিনিসটা বের করতেও কিছু সময় লাগবে। আশা করছি, ততোক্ষণে চলে যেতে পারব আমরা।
রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল টনি। ওঠো ওঠো, জলদি!
গাড়িটা বড় না, কিন্তু জায়গা হয়ে গেল সকলের।
কোথায় যেতে হবে? জানতে চাইল টনি।
বলল কিশোর।
দ্রুত ফুটল গাড়ি। ভাল চালায় টনি। রাস্তাও সব চেনা। শর্টকাটে চলল সে।
তবুও গোয়েন্দাদের মনে হল, বড় আয়ে চলছে গাড়ি। লাফ দিয়ে দিয়ে এগোচ্ছে যেন ঘড়ির কাঁটা। টনিকে সব খুলে বলল কিশোর।
ব্যাংক থেকে বেরিয়েই গেল কিনা, পেছনের সিট থেকে বলল উদ্বিগ্ন জিনা, কে জানে!
সময়মতই পৌঁছল ওরা। সবে ব্যাংকের দরজার বাইরে পা রেখেছে এরিনা। হাতে সেই ব্যাগটা, নিশ্চয় ওটার ভেতরেই রেখেছে হারের বাক্স।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে চত্বর পেরোল সে। রাস্তায় উঠে হনহন করে হাঁটতে লাগল। একবারও পেছনে তাকাল না
আমি ভেবেছিলাম ট্যাক্সি নেবে,মুসা বলল।
নেয়নি যখন, কিশোর বলল, বোঝাই যাচ্ছে, বেশি দূরে যাবে না। নামো নামো, হেঁটে যাব আমরাও।
গাড়ি থেকে বেরোল গোয়েন্দারা। টনিও নামল।
একসাথে থাকা ঠিক হবে না, কিশোর বলল। চোখে পড়ার ভয় আছে। টনি, তুমি আগে আগে থাক। তোমাকে চেনে না এরিনা। দেখে ফেললেও সন্দেহ করবে না।
ডানে মোড় নিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল এরিনা। দ্বিধা করল একমুহূর্ত। তারপর ফিরে তাকাল। তবে টনিকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না সে। কিশোরের অনুমান ঠিক, টনিকে চিনতে পারল না সে।
নিশ্চিন্ত হয়েই যেন আবার দ্রুত হাঁটতে লাগল এরিনা। তারপর একসময় গতি কমিয়ে দিল। সময় এসে গেছে, বুঝল গোয়েন্দারা।
বেশ দূরে রয়েছে ওরা। তবু দেখতে পাচ্ছে, রাস্তার লোকের নজর নেই এরিনার দিকে। যে যার পথে চলেছে। তারমানে, ম্যাকি ওদের মাঝে নেই।
চলার গতি আরও কমালো এরিনা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লোকটাকে খুঁজছে? নাকি অন্য কিছু?
হঠাৎ যেন মনস্থির করে ফেলল এরিনা। বা বগলের তলায় ছিল ব্যাগটা, ডান হাতে নিল। তারপর ছুঁড়ে দিল পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দিকে।
গাড়ির সামনের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ব্যাগটা।
মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা।
ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়েই চলার গতি আবার বাড়িয়ে দিল এরিনা।
সবাইকে আসতে বলে দৌড় দিল কিশোর। টনি আগেই দৌড়াতে শুরু করেছে। চোখের পলকে তার পাশে চলে গেল রাফিয়ান। অবাক হয়ে পথচারীরা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
এত তাড়াহুড়ো করেও লাভ হল না।
ইঞ্জিন চালই ছিল গাড়িটার। রাস্তায় উঠেই হটতে শুরু করল।
থমকে দাঁড়াল কিশোর আর টনি দুজনেই। রাফিয়ান দাঁড়াল না। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল গাড়িটার ওপর। লাভ কিছুই হল না, শুধু তার নখের সামান্য আঁচড় লাগল গাড়ির বডিতে।
দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল গাড়িটা।
চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছে এরিনা। ফিরে তাকিয়ে গোয়েন্দাদের দেখে অবাক। চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, আমাকে খুঁজে বের করলে কিভাবে?
জানাল কিশোর।
চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এরিনার। সর্বনাশ! ও তোমাদেরকে নিশ্চয় দেখেছে…
দেখুক, দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। ধরতে পারলে হত আজ! ব্যাটাকে…
মলিকে না আবার ধরে নিয়ে যায়…
হারটা তো দিয়েই দিয়েছেন, বেশ একটু ঝাঝের সঙ্গেই বলল জিনা। তাহলে আর নেবে কেন? অযথাই কষ্ট করলাম আমরা, মিসেস কলিনস। জিনিসটা দিলাম আপনাকে, কিন্তু রাখতে পারলেন না।
হার গেছে যাক। আমার মলির কিছু না হলেই হয়।
ব্যাটা পালাল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে আনমনে বলল কিশোর। ও-ই জিতল শেষ পর্যন্ত! দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।
ভূল হয়ে গেছে, মুখ কালো করে বলল টনি। ট্যাক্সিতে করে পিছু নিতাম, সেটাই ভাল হত।
টনির সঙ্গে এরিনার পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর।
সামলে নিয়েছে এরিনা। সবাইকে ধন্যবাদ দিল। মাথা চাপড়ে দিল রাফিয়ানের। বলল, দেখ, কিছু মনে কোরো না তোমরা। অনেক কষ্ট করেছ আমার জন্যে। কপাল খারাপ, রাখতে পারলাম না জিনিসটা।
এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়, কিশোর পাশা। ড্রাইভারের চেহারা দেখেছেন?
না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি…
হুঁ, আমরাই দেরি করে ফেলেছি! মুঠো শক্ত হয়ে গেল মুসার।
আর কিশোর মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করছে। কেন একবারও ভাবেনি, গাড়িতে করে আসতে পারে লোকটা?
আবার ফিরে এসে টনির গাড়িতে উঠল ওরা। এরিনারও জায়গা হয়ে গেল।
তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাবটা টনিই দিয়েছে।
এক পড়শীর কাছে মলিকে রেখে এসেছে এরিনা। বাসার সামনে গাড়ি থামলে আরেকবার সবাইকে ধন্যবাদ জানাল সে। নামল। বলল, হারটা গেছে, যাক, কিন্তু ওটার বদৌলতে তোমাদের মত বন্ধু পেয়েছি। এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া।
এরিনা চলে গেলে টনি বলল, চল, তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। গাড়ি চলছে। খানিক পর আবার বলল, চোরটা তাহলে পালালই শেষতক।
পালিয়ে যাবে কোথায়? দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। চোরটা যদি ম্যাকি হয়ে থাকে, ধরা তাকে পড়তেই হবে।
যদি না হয়? রবিন বলল।
ওই ব্যাটাই, ফুঁসে উঠল জিনা। এরিনার কাছে হার আছে, এই খবর একমাত্র ওই শয়তানটাই জানে। হারটা ফিরিয়ে আনতেই হবে।
কিভাবে? প্রশ্ন রাখল মুসা।
হ্যাঁ, কিভাবে? টনিও জানতে চাইল। ম্যাকির বাড়িতে গিয়ে খুঁজবে নাকি? অনেকটা সেরকমই, জবাব দিল কিশোর।
তোমার সাহস আছে, কিশোর পাশা, টনি বলল। বাঘের গুহায় গিয়ে ঢুকতে চাইছ। লোকটা ভারি বদ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে লোক কিডন্যাপ করার হুমকি দিতে পারে…যাকগে। যখন যাও, আমাকে ডেকো.ওই যে, তোমাদের বাসায় এসে গেছি।
লাঞ্চের পর হইতে বেরোল গোয়েন্দারা। চলে এল স্কোয়্যারটার পাশের পার্কে। চমৎকার রোদ। এক কোণে একটা ঝাড়ের কাছে বসে আলোচনা শুরু করল ওরা।
ম্যাকির দোকানের ওপর চোখ রাখতে হবে, কিশোর বলল। খদ্দের ছাড়া আর কে কে আসে দোকানে, জানতে হবে। দরকার হলে ওর পিছু নেব। হারটা নিয়ে গিয়ে তো আর বসে থাকবে না, বিক্রি করতে হবে।
যদি টাকা চায়, রবিন বলল।
হ্যাঁ, যদি টাকা চায়, বলল মুসা। কিশোর, শুধু দোকানের ওপর চোখ রেখে যে লাভ হবে না, সেটা ভাল করেই জানো তুমি। অন্য কোন মতলব করেছ। সেটা কি, বলবে?
দোকানে ঢোকার চেষ্টা করব।
মানে?
ভেতরে ঢুকে না খুঁজেলে কিভাবে জানব কোথায় রেখেছে হারটা?
কিন্তু আমাদেরকে এখন চেনে সে। দরজা থেকেই তাড়াবে।
সেজন্যেই তো না দেখিয়ে চুকব। চুরি করে। মুচকি হাসল কিশোর। চুরি করে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পেরেছে সে, আমরা কেন পারব না? তেমন বুঝলে রাতের বেলাই ঢুকব।
ভ্রূকুটি করল জিনা। না, কিশোর, মা রাতে বেরোতে দেবে না। আর যদি দেয়ও–জানতে চাইবে কোথায় যাচ্ছি।
তা তো চাইবেনই। সেজন্যেই তো কাজে নামার আগে আলোচনা করতে চাইছি ভালমত। রাতে গিয়ে সুবিধে হবে কিনা সেকথাও ভাবতে হবে। কারণ, রাতের বেলা দোকান তালা দেয়া থাকবে। নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটল কিশোর। ম্যাকি কোথায় থাকে জানি না। দোকান কথন বন্ধ করে তাও জানি না। আসলে, ওর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। জানতে হলে নজর রাখতে হবে ওর ওপর।
নজর রাখার ব্যাপারে কারোই অমত নেই।
পরের তিন দিন তা-ই করল ওরা। পালা করে। চোখ রাখল ম্যাকির দোকানের ওপর। জানা হয়ে গেল অনেক তথ্য।
পাঁচটায় দোকান বন্ধ করে, রবিন জানান।
বিক্রি বন্ধ করে আরকি, মুসা বলল। বেরোয় ছটার সময়।
ওই এক ঘন্টা হিসেব-নিকেশ করে, বলল জিনা। এখানে ওখানে ফোন করে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখোচ্ছ।
তারপর ছটার সময় বেরিয়ে, একটা রেস্টুরেন্টে যায়, কিশোর বলল, খাওয়ার জন্যে। থাকে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায়। অনেক কিছুই জানলাম। এখন কাজ শুরু করা যেতে পারে…
পরিকল্পনার কথা বন্ধুদের জল সে। দোকান বন্ধ হওয়ার আগেই ঢুকে পড়তে চায় ওখানে, লুকিয়ে বসে থাকতে চায় কোথাও। তারপর ম্যাকি বেরিয়ে গেলে জিবে হারটা। মুখ খুলতে যাচ্ছিল মুসা, হাত তুলে তাকে থামাল গোয়েন্দাপ্রধান। না না, ভয় নেই, বিপদে পড়ব না। তোমরা বাইরেই থাকবে। দরকার পড়লে সাহায্য করতে পারবে আমাকে। আর যদি ম্যাকি ধরেই ফেলে, আমাকে, সোজা গিয়ে পুলিশকে জানাবে। ঠিক আছে?
অমত করে লাভ হবে না, বুঝতে পারল সহকারীরা। একবার যখন মনস্থির করে ফেলেছে কিশোর পাশা, আর তাকে ফেরানো যাবে না। যা ভাল বুঝবে, করবেই। কাজেই অহেতুক তর্ক করল না কেউ।
ঠিক হল, সেদিন সন্ধ্যায়ই দোকানে ঢুকবে কিশোর।
৮
দোকান বন্ধ হওয়ার সামান্য আগে এগিয়ে গেল মুসা। সাবধানে উঁকি মেরে দেখে নিল, দোকানে কোন খদ্দের আছে কিনা। তারপর ঢুকে পড়ল ভেতরে।
কয়েক গজ দূরে একটা বিজ্ঞাপনের বোর্ডের ওপাশে লুকিয়ে বসে রইল জিনা, রবিন আর রাফিয়ান। কিশোর মুসার পেছন পেছন এসেছে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগল মুসা কি করে।
স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ম্যাকির দিকে এগোল মুসা।
তাকে দেখে ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল লোকটার। মনে হল চিনে ফেলেছে। পরমুহূর্তে সামলে নিয়ে হাসল। বলল, গুড ইভনিং ইয়াং ম্যান। কি লাগবে?
মুসা বুঝল, তার ওপর থেকে নজর সরাবে না ম্যাকি। এটাই আশা করেছিল কিশোর।
গুড ইভনিং, ভদ্রভাবে জবাব দিল মুসা। আমার মার জন্যে একটা উপহার কিনতে এসেছি। বাহ, বেশ চমৎকার ফুল তো। দেখতে পারি? হাত তুলে ফুলের তোড়াটা দেখাল সে।
দেয়ালের তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কিছু ফুলের তোড়া। সেদিকে এগোল ম্যাকি। এইই সুযোগ, জানালা দিয়ে দেখে বুঝল কিশোর। চট করে ঢুকে পড়ল সে। মাথা নিচু করে শো-কেসের আড়ালে আড়ালে চলে গেল আরেকটা দরজার দিকে সেটা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল। ম্যাকির নজর মুসার দিকে। ফলে সে তাকে দেখতে পেল না।
ঘরটায় ঢুকে চারদিকে চোখ বোলাল কিশোর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। মুসা ওদিকে নিয়ে ফুল দরাদরি করছে, সময় দেবে কিশোরকে কিন্তু কতটা আর দিতে পারবে।
ঘরটা বেশ বড়। বাঁয়ের দেয়ালের কাছে বিশাল একটা আলমারি। আর পেছনের দেয়ালের কাছে একটা ডিভান। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার! ভান পাশের দেয়ালের কাছে…গুড! আনমনে বিড়বিড় করল সে, ওয়ারড্রোবটা বেশ বড়। লুকানো যাবে।
কোটস্ট্যাণ্ড থেকে ঝুলছে ম্যাকির কোট। তারমানে আপাতত আর ওয়ারড্রোব খুলবে না সে। ভেতরে দেখে আরও নিশ্চিত হল কিশোর। শুধু একটা রেইনকোট, আর কিছু নেই। ওটার জন্যে খুলবে না ম্যাকি। ভেতরে ঢুকে দরজা টেনে দিল সে, ওরে সামান্য ফাঁক রাখল বাতাস চলাচলের জন্যে। এখন শুধু অপেক্ষা।
খানিক পরে মুসার কথা থেকেই বোঝা গেল ফুল কিনে, দাম চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সে। দরজার ছিটকানি আটকানোর শব্দ কানে এল। তারমানে বন্ধ হয়ে গেল দোকান। দরজা লাগিয়ে ভেতরের ঘরে এসে ঢুকল ম্যাকি। দরজার ফাঁক দিয়ে কিশোর দেখল, আলমারির কাছে গেল লোকটা, খুলল, একটা বড় খাতা বের করল।
ওটা ওর অ্যাকাউন্ট বুক, বুঝতে পারল কিশোর।
আলমারির খোলা ফেলে রেখেই দোকানে গিয়ে ঢুকল আবার ম্যাকি। পরপর তিনদিন তার দোকানের ওপর চোখ রেখেছে গোয়েন্দারা, লোকটা এখন কি করছে বুঝতে অসুবিধে হল না কিশোরের। দোকানের ডেস্কে বসে দিনের বেচা-কেনার হিসেব করছে ম্যাকি। বাইরে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেই এখন যে কেউ তার কাজ দেখতে পাবে। দোকান বন্ধ করে যখন একবারে বেরিয়ে যায়, তখন লাগায় পুরানো ধাঁচের জানালার ধাতব পাল্লা।
লোকটা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে খোঁজা আরম্ভ করব, ভাবল কিশোর। আলমারিটার দিকে তাকিয়ে আরেকটা কথা জাগল মনে। যদি তালা লাগিয়ে দিয়ে যায় ম্যাকি? ওটার ভেতরে আর তখন দেখতে পারবে না সে। তবে কি এখনই…
ঝুঁকিটা নিল কিশোর। হাতুড়ি পিটতে শুরু করল যেন বুকের ভেতর। আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওয়ারড্রোব থেকে। কান খাড়া রেখে পা টিপে টিপে এগোল আলমারির দিকে। কাছে এসে ভেতরে তাকাল। ছোট-বড় নানারকম বাক্স, গাদা গাদা খাম…আর কোণের দিকে ফ্যাকাসে নীল একটা বাক্স, হারটা যেটায় ছিল ওরকমই দেখতে। হাত বাড়াল কিশোর…
ঠিক এই সময় মচমচ করে উঠল চেয়ার। নিশ্চয় ম্যাকির। বোধহয় উঠে দাঁড়িয়েছে সে, ফিরে আসছে। তিন লাফে আবার ওয়ারড্রোবের কাছে চলে এল কিশোর। সে ঢুকে পড়ার সাথে সাথে ম্যাকিও ঢুকল ঘরে। আলমারিতে খাতাটা রেখে, ওটার দরজা খোলা রেখেই আবার চলে গেল দোকানে। জানালা লাগানোর শব্দ কানে এল।
লাগাতে বেশিক্ষণ লাগবে না। আবার আলমারির ভেতরটা দেখার সুযোগ চলে গেল। বেরোনোর সাহস করল না আর সে।
বেরোলে ভুলই করত, বুঝল খানিক পরেই। জানালা লাগিয়ে ফিরে এল ম্যাকি। ওয়ারড্রোবের দরজার ফাঁক দিয়ে কিশোর দেল, আবার আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।
এইবার নিশ্চয় বন্ধ করে ফেলবে, ভাবল কিশোর।
না, বন্ধ করল না। বরং ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল নীল বাক্সটা। হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল একমুহূর্ত। তারপর খুলে বের করল টা। আঙুল বুলিয়ে দেখতে লাগল। যেন কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না ওটার ওপর থেকে।
হঠাৎ বেজে উঠল টেলিফোন। ঝট করে সেদিকে ফিরল ম্যাকি। তারপর তাড়াতাড়ি আবার হারটা বাক্সে ভরে আলমারিতে রেখে লাগিয়ে দিল দরজা। কিট করে তালা লেগে গেল।
গেল! ডাবল কিশোর। হারটা দেখলাম। জানি এখন কোথায় আছে, কিন্তু চেষ্টা করেও হাত লাগাতে পারব না!
শুনতে পেল ম্যাকির কণ্ঠ, টেলিফোনে কথা বলছে, হ্যালো, হেইকি? কি ব্যাপার? এই অসময়ে?…হা হা, বন্ধ করে দিয়েছি।উচিত হল না। দোকানে কাস্টোমার থাকতে পারত এখন। তাহলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে হত না? যাকগে, ভবিষ্যতে আর এভাবে ফোন করবেন না। যখন করতে বলব তখন করবেন। চালে সামান্য ভুল হলেই সব শেষ…কি বললেন?…না না, নিশ্চয়ই না। তবে সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।…আরে বাবা, এত দামি একটা জিনিস, পেয়েছি কিনা জানার জন্যে উদ্বিগ্ন তো হবেনই। সবাই হবে। তাই বলে হুঁশিয়ার থাকতে হবে না? যা-ই হোক, এভাবে আর ফোন করবেন না। আপনার বন্ধুদেরকেও মানা করে দেবেন।
নীরবে কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনল ম্যাকি, তারপর আবার বলল, শুনুন, আগেও বলেছি, আবার বলছি, মুক্তার নতুন চালান এল কিনা জানতে চাইলে সোজা চলে আসবেন। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললেই তো হয়ে যায়। ফোন করাটা সব সময়ই বিপজ্জনক। আপনিও তা বোঝেন, বার বার বলে দিতে হয় কেন? তো রাখি এখন। গুডবাই।
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হল।
ওয়ারড্রোবের ভেতর দম বন্ধ করে বসে রইল কিশোর। বুঝতে পেরেছে, কতটা ভয়ঙ্কর লোকের ঘরে এসে ঢুকেছে। লোকটা শুধু ওই একটাই নয়, আরও অনেক মুক্তা চুরি করেছে। চোরাই মুক্তার ব্যবসা করে। ওরকম পেশাদার একজন লোক অবশ্যই বিপজনক।
ফিরে এল ম্যাকি। আবার খুলল আলমারি। আরেকবার বাক্স খুলে মুক্তাটা বের করে দেখল। তারপর রেখে দিয়ে দরজা লাগাল। এলোমেলো করে দিল তালার কম্বিনেশন নাম্বারগুলো।
ফাঁক দিয়ে দেখছে কিশোর, ওভারকোট পরল লোকটা। যাক, বেরোলে বাঁচা যায়। সে-ও বেরোতে পারবে। বাইরে নিশ্চয় অস্থির হয়ে উঠেছে তার বন্ধুরা।
বেরিয়ে গেল ম্যাকি। দোকানের সদর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে এল কিশোর। এগোল ডিভানটার দিকে। তার জানা আছে, ওটার পেছনে নিচে নামার সিঁড়ি আছে, ওই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া যাবে মাটির নিচের ঘরে। ওখানে দোকানের স্টোররুম, মাল জমিয়ে রাখা হয়। বেশ কায়দা করে এই খবরটা জেনে নিয়েছে রবিন।
ঢুকেছে যখন সবকিছুই দেখে নিতে চায় কিশোর। সুযোগ সব সময় আসে। বলা যায় না কখন কোন তথ্যটা কাজে লেগে যাবে। সেলারের দেয়ালের ওপরে একটা ছোট জানালা, আলো আসছে ওটা দিয়ে। ওখানে পৌঁছতে পারলে ওটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে সে। জিনিসপত্রগুলো দেখল সে। সাধারণ জিনিস, দোকানে যা বেচাকেনা হয়। বিশেষ কিছু দেখার নেই। একটা পুরানো টেবিল টেনে এনে জানালার নিচে রাখল। উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কাউকে চোখে পড়ল না। বেরোতে খুব একটা কষ্ট হল না।
উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে বন্ধুরা।
এসেছ? বলে উঠল মুসা। আমরা তো ভাবছিলাম আটকাই পড়লে নাকি। তা কি দেখলে?
চল, হাঁটতে হাঁটতে বলছি। ট্রেন ধরতে হবে, কিশোর বলল।
বলেছিলাম না! সব শুনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জিনা, ব্যাটা একটা আন্ত শয়তান! আর কোন বেআইনী ব্যবসা করে কে জানে!
বন্ধ করতে হবে এসব, রবিন বলল।
সহজ হবে না,মুসা বলল।
না, তা হবে না, একমত হল কিশোর। তবে অসম্ভবও নয়। ভাগ্যিস আমি থাকতে থাকতেই ফোনটা বেজেছিল। নইলে কিছু জানতেই পারতাম না। মূল্যবান একটা সূত্র পেয়েছি।
কী? জানতে চাইল মুসা।
মাল এল কিনা জানার জন্যে দোকানের জানালায় এসে দাঁড়াবে হেইকি বা তার কোন সহকারী। চোখ রাখব আমরা। কে আসে দেখতে পারব। দলবলসুদ্ধ ম্যাকিকে ধরার ব্যবস্থা করা যাবে তখন।
গুড আইডিয়া, তুড়ি বাজাল জিনা।
হুফ! করে রাফিয়ানও যেন একমত হল।
পরদিন সকালে আবার বেরোল ওরা। এলাকাটায় সেদিন লোকের বেশ ভিড়। ব্যস্ত হয়ে লোকজন বড়দিনের উপহার কিনছে। এতে সুবিধে হল গোয়েন্দাদের। ওদের ওপর চোখ পড়বে না সহজে ম্যাকির দোকানের ওপর চোখ রাখল ওরা।
তার পরদিন রোববার। সম্মেলন বন্ধ। কিন্তু ঘরে বসে রইলেন না মিটার পারকার, স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন এক বন্ধুর বাড়িতে। সুবিধেই হল গোয়েন্দাদের। দুপুরে খাবার পর বেরিয়ে পড়ল ওরাও।
চল, চিড়িয়াখানা দেখতে যাই, প্রস্তাব দিল মুসা। শুনেছি, এখানকার চিড়িয়াখানাটা নাকি বেশ বড়।
সুতরাং চিড়িয়াখানায় চলল ওরা। আর যা ভাবতেও পারেনি তা-ই ঘটে গেল। জন্তুজানোয়ার দেখছে আর ঘুরছে ওরা, হঠাৎ মুসার চোখে পড়ল খোয়া বিছানো একটা পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রবার্ট ম্যাকি। জাপানী একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। খানিক পরে পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে লোকটার হতে দিল সে।
হারের বারটাই দিল মনে হয়, ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর।
এক কাজ করলে হয়, রবিন বলল। আলাদা আলাদা হয়ে দুজনেরই পিছু নিতে পারি আমরা। কোথায় যায় দেখতে পারি।
কিন্তু কাছেই যে একটা শিম্পাঞ্জী রয়েছে, গোল বাধাবে ওটা, ভাবতে পারেনি সে। রাফি চলে গেছে ওটার খাঁচার কাছে। বেশ কিছুক্ষণ থেকেই তক্কে তক্কে ছিল বানরটা, পেয়ে গেল সুযোগ। চোখের পলকে দোলনা থেকে নেমে এসে শিকের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে চেপে ধরল রাফিয়ানের লেজ। মারল হ্যাঁচকা টান। ব্যথায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কুকুরটা।
বেশ কিছু ছেলেমেয়ে কাও দেখে দৌড়ে এল। হাসতে শুরু করল অনেকে। তাদের ওপর ভীষণ রেগে গেল জিনা। দৌড়ে এল চিড়িয়াখানার একজন লোক, অনেক চেষ্টা করে শিপাত্রীর হাত থেকে রাফির লেজ ছাড়াল।
এই গোলমালের মাঝে ম্যাকি আর তার সঙ্গীর কথা ভুলেই গেল গোয়েন্দারা। আবার যখন মনে পড়ল, ফিরে তাকিয়ে দেখে দুজনেই চলে গেছে।
গেল সর্বনাশ হয়ে! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। আবার নতুন কোন বুদ্ধি বের করতে হবে আমাদের।
কি মনে হয়? রবিন বলল কিশোরকে, ওই বাক্সে হারটা ছিল?
কি জানি! ভালমত দেখিনি বাটা, জবাব দিল কিশোর। বোধহয় রোববারেই মাল ডেলিভারি দেয় ম্যাকি।
জিনা কোন কথা বলছে না। গভীর হয়ে বসে রাফিয়ানের লেজের পরিচর্যা করছে, আর মাঝেমাঝে জ্বলন্ত চোখে তাকাচ্ছে শিম্পাঞ্জীটার দিকে।
পরদিন আবার ম্যাকির দোকানে চোখ রাখার জন্যে গেল ওরা।
জানালার কাছে চলে গেল কিশোর। একটু পরেই ফিরে এল উত্তেজিত হয়ে। কি দেখলাম জানো?
কী! প্রায় একসাথে জানতে চাইল অন্য তিনজন।
নতুন বাক্স এসেছে অনেকগুলো, দেখে এলাম, কিশোর জানাল। অদুত বাক্সের ওপরে আস্ত ঝিনুক বসানো।
তাই নাকি! বুঝে ফেলেছে রবিন।
খাইছে! কিছুই তো বুঝলাম না, মুসা বলল। ঝিনুকের বাক্স দেখে এত উত্তেজিত হওয়ার কি আছে?
চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, ওরকম ভনির আজকাল আর লোকে তেমন কেনে না। তাহলে এত মাল এনেছে কেন ম্যাকি? –
হয়ত কম দামে পেয়েছে কোথাও, রবিন বলল। নিলামে-টিলামে এনেছে। এই দেখ, দেখ!
সবাই দেখল, হালকা-পাতলা ছোটখাট একজন মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ম্যাকির দোকানের দিকে।
জাপানী! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। বিনকিউলার নিয়ে এসেছে আজ সাথে করে। সেটা চোখে লাগিয়ে তাকাল জানালার দিকে। লোকটা দোকানে ঢুকল। কয়েক মিনিট পরেই বলে উঠল মুসা, এই, ঝিনুকের একটা বাক্স নিয়ে যাচ্ছে ম্যাকি!
আরও কয়েক মিনিট পর দোকান থেকে বেরিয়ে এল জাপানী। হাতে সেই বাক্স।
ভ্রূকুটি করল কিশোর। আনমনে বলল, ভালই চালাচ্ছে ম্যাকি।
কি করব? অধৈর্য হয়ে বলল মুসা। পিছু নেব লোকটার? বাক্সটা কেড়ে নেব? যদি সত্যি সত্যি ও অপরাধী না হয়ে থাকে?
দোকানের ওপর চোখ রাখব আমরা, কিশোর বলল, যেমন রাখছি।
সুতরাং চোখ রাখল ওরা। অনেককে দোকানে ঢুকতে দেখল। বেরিয়ে এল হাতে কোন না কোন জিনিস নিয়ে। নিশ্চয় বড়দিনের উপহার। ওদের মধ্যে তিনজনের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হল। দুজন জাপানী, একজন ইউরোপিয়ান। তিনজনেই ঝিনুকের বাক্স কিনেছে।
এতে কিন্তু কিছু প্রমাণ হয় না, জিনা বলল।
না, তা হয় না, স্বীকার করল কিশোর।
তাহলে প্রমাণ জোগাড় করি, চল।
কিভাবে? প্রশ্ন রাখল রবিন।
তিনজনেই তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের মুখের দিকে।
বার কয়েক ঘনঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল গোয়েন্দাপ্রধান। তারপর বলল, রবিন, এবার তুমি যাবে।
আমি?
হ্যাঁ আমার বিশ্বাস, তোমার ওপরই নজর কম দিয়েছে ম্যাকি। বলতে বলতে সাথে করে আনা ঝোলায় হাত ঢোকাল কিশোর। বের করল একটা কালো পরচুলা। এটা পরে নাও, ভাল হবে। আমাদের শোবার ঘরের তাকে পেয়েছি। আরও আছে কয়েকটা। আর এই সানগ্লাসটা পরে নাও, বলে নিজের চোখেরটা খুলে দিল সে। অন্য চেহারা হয়ে যাবে তোমার। চিনতে পারবে না ম্যাকি।
বেশ, উইগ পরতে পরতে রবিন বলল, গেলাম। কি করতে হবে আমাকে?
সাধারণ কাস্টোমারের মত গিয়ে ঢুকে ঝিনুকের বাক্স দেখিয়ে বলবে, ওরকম একটা কিনতে চাও।
তাতে কি হবে?
ম্যাকির প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারবে। হয়ত খুশি হয়েই বিক্রি করবে…
তাহলে সেটা খুশির ব্যাপার হবে না আমাদের জন্যে, হেসে বলল রবিন।
বিক্রি করতে রাজি না-ও হতে পারে। তাহলে আমরা বুঝব ঠিক পথেই এগোচ্ছি। যাও, আর দেরি কোনো না। বিক্রি করুক আর না করুক, বিপদে পড়বে বলে মনে হয় না।
পরচুলা আর সানগ্লাস পরে অন্য মানুষ হয়ে গেল রবিন। এগিয়ে চলল দোকানের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধা করল এক মুহূর্ত, তারপর আস্তে ঠেলে ফাঁক করল পালা। ম্যাকি একা। খরিদ্দার ঢুকছে দেখে বিগলিত উজ্জ্বল হাসি হাসল। এসো এসো। তা, কি চাই? রবিন বুঝল, তাকে চেনেনি ম্যাকি। বলল, একটা স্যভনির চাই। জানালার দিকে তাকাল। বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে পছন্দ করার ভান করল। বাহ্, দারুণ তো! নিশ্চয় ওগুলোতে কড়ি আছে? খুব ভাল হবে।
সরি, ওগুলো বিক্রির জন্যে নয়, দ্রুত বলল ম্যাকি। এমনি সাজিয়ে রেখেছি, দোকানের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যে।…এই যে দেখ, চমৎকার সব জিনিস আছে……
কিন্তু আমি তো এসব চাই না, হতাশ হয়েছে যেন রবিন। কড়িগুলো কি সত্যি বেচবেন না?
না, দৃঢ়কণ্ঠে বলল ম্যাকি।
নিরাশ ভঙ্গিতে অন্যান্য জিনিসের দিকে তাকাতে লাগল রবিন। শেষে, আর কিছুই পছন্দ হয়নি বলে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। পেছন পেছন এল ম্যাকি। যত তাড়াতাড়ি পারে রবিনকে বের করে দিয়ে হাঁপ ছাড়তে চায় যেন।
সরাসরি সাইনবোর্ডের দিকে না এগোনোল্প মত বুদ্ধি আছে রবিনের। বলা যায়, পেছন থেকে তাকিয়ে থাকতে পারে ম্যাকি। উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল সে। গোটা দুই বুক ঘুরে আরেক দিক দিয়ে ফিরে এল সাইনবোর্ডের কাছে।
সত্যিই বেচল না হলে! সব নে বলে উঠল মুসা।
ঠিকই সন্দেহ করেছি, কিশোর বলল। চল, জলদি বাড়ি চল। সময় নষ্ট করা যাবে না। আরেকটা উইগ দরকার। ফিরে আসতে আসতে বাকি বাক্সগুলো বিক্রি করে ফেললেই হয়।…
ফেরার পথে তার পরিকল্পনার কথা জানাল কিশোর। ছদ্মবেশ নিয়ে আমিও যাব ঝিনুকের বার কিনতে। দেখি কি বলে!
৯
আমার বোনের জন্যে, বুঝেছেন, বলল আমেরিকান কিশোরের ছদ্মবেশধারী কিশোর। ছোট বোনের জন্যে কিনতে চাই। ভাল কি আছে আপনার দোকানে? জানালার দিকে তাকাল সে। আর মাত্র দুটো বাক্স অবশিষ্ট রয়েছে।
অনেক কিছুই আছে, ইয়াং ম্যান, হেসে বলল ম্যাকি। কিশোরের লা লালচে চুলের দিকে তাকাল। এই যে দেখ, কত জিনিস…
আমি ওই কড়ি কিনতে চাই, হাত তুলে বার দেখাল কিশোর।
সরি, মাথা নাড়ল ম্যাকি, ওগুলো বিক্রির জন্যে নয়।
হতাশ হল কিশোর। তাই নাকি? আহ-হা…
তার কথায় বাধা পড়ল। দোকানে ঢুকল একজন লোক। পকেট থেকে বের করল একটা খাম, বেশ পুরু। অনুমান করতে পারল কিশোর, কি আছে ওর মধ্যে। টাকা! নোটের বাণ্ডিল।
খাম দেখে চমকে গেল ম্যাকি, কিশোরের চোখ এড়াল না সেটা। বলল, আমি ওই কড়ির বাক্সই চাই, অন্য কিছু না। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, ভূরু কুঁচকে গেহে আগন্তুকের।
বিশেষ ধরনের খামে টাকা নিয়ে যারা ঢোকে, তাদেরকে ঝিনুকের বাক্স দিয়ে দেয় ম্যাকি, বুঝতে পারল কিশোর। ওই খামই হল সঙ্কেত।
অনেক চাপাচাপি করল কিশোর, কিন্তু কিছুতেই তার কাছে বাক্স বিক্রি করতে রাজি হল না ম্যাকি।
অবশেষে পুরানো আমলের ছোট একটা পেপারওয়েইট কিনে বেরিয়ে এল কিশোর। কয়েক পা এগিয়ে ফিরে তাকাল। দেখল, জানালার কাছের দুটো বাক্সের একটা নেই। মুচকি হাসল সে। চলার গতি বাড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, দোকান থেকে বেরিয়ে আসছে সেই লোকটা, হাতে বার। আর কোন সন্দেহ রইল না, চোরাই মুক্তোর ব্যবসা করে ম্যাকি।
উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে বন্ধুরা। তাদেরকে সব জানাল কিলোর।
আবার বাড়ি ফিরল ওরা। রাফিয়ানকে নিয়ে চলাফেরা বড় মুশকিল, বাসে ট্রেনে যেখানেই উঠুক, ঝুড়িতে ভরে নিতে হয়। এই বয়ে নেয়া আর ভাল লাগছে
তিন গোয়েন্দার। জিনাকে বোঝাতে অবশ্য কষ্ট হল, তবে শেষ পর্যন্ত বুঝল সে।
বাড়িতে আটকে থাকতে মোটেও ভাল লাগল না কুকুরটার। ঘাউ ঘাউ করে, আরও নামারকম বিচিত্র শব্দ করে সেটা জানান দিল রাফি, কিন্তু তার অনুনয় কানে তুলল না কিশোর।
বাড়ির কাছেই একটা বাজার। সেখানে পুরানো, মাল বিক্রি হয় এরকম কয়েকটা দোকান দেখে গেছে কিশোর। তারই একটাতে ঢুকল ওরা।
ওই দেখ, হাত তুলে দেখাল রবিন, ম্যাকির দোকানে যেরকম দেখে এসেছে। ওরকম বক্স। ওরকম জিনিসই তো চাও?
হ্যাঁ।
বাক্সটা কিনে নিল কিশোর। তারপর ট্যাক্সিতে করে চলে এল আবার মিমোসা অ্যাভেন্যতে। ম্যাকির দোকানের জানালায় দেখা গেল, আরেকটা বাক্স তখনও রয়েছে।
রবিন, মুসা আর জিনাকে সাইনবোর্ডের কাছে থাকতে বলে, বাক্সটা ঝোলায় ভরে দোকানের দিকে এগোল কিশোর। যেভাবেই হোক, দেখতেই হবে, ঝিনুকের বাক্সের ভেতরে সত্যি সত্যি মুক্তো আছে কিনা।
কিশোর দোকানে ঢুকে দেখল, দুজন মহিলা জিনিস ঘাটাঘাটি করছে। ম্যাকি ওদের নিয়ে ব্যস্ত। আমেরিকান ছেলেটাকে দোকানে ঢুকতে দেখল সে, কিন্তু একবার চেয়েই আবার ফিরল মহিলাদের দিকে। ছেলেটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না।
কিশোরও এটাই চায়। কয়েকটা পুতুল দেখতে দেখতে সরে যেতে লাগল জানালার কাছে। সুযোগের অপেক্ষায় রইল। কয়েকটা স্যভনির পছন্দ করল দুই মহিলা। টাকা বের করে দিল। দাম রেখে বাকি টাকা ফেরত দেয়ার জন্যে ক্যাশবাক্সের ওপর ঝুঁকেছে ম্যাকি, এই সময় চট করে ঝোলা থেকে বাক্স বের করে ঝিনুকের বাক্সের সঙ্গে বদল করে ফেলল কিশোর। দ্রত সরে এল জানালার কাছ থেকে। একটা পুতুল তুলে নিয়ে এগিয়ে এল কাউন্টারের দিকে। দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল দোকান থেকে।
সেরে ফেলেছি! তুড়ি বাজিয়ে হেসে বন্ধুদেরকে জানাল কিশোর।
চল, ভাগি, মুসা বলল।
না। শেষ বাক্সটা কার কাছে বিক্রি করে দেখব। দোকানে বাক্স খোলে না ক্রেতা। কারণ, জানাই আছে ভেতরে কি আছে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না ওদেরকে। একটা লোক ঢুকল দোকানে। বরিয়ে এল ঝিনুকের শেষ বাক্সটা অর্থাৎ কিশোর যেটা রেখে এসেছে সেটা নিয়ে।
এক কাজ করলে তো পারি, হঠাৎ বলল রবিন, ওর পিছু নিই না কেন? দখি না কোথায় যায়? একটা চোরের বাসা তো অন্তত চেনা থাকবে। পুলিশকে বলতে পারব।
ঠিক বলেছ, সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। চল।
বেশ দূরে থেকে লোকটাকে অনুসরণ করে চলল ওরা। কিছুক্ষণ পর মোেড় নয়ে কতগুলো দোকানের দিকে এগোল লোকটা। শহরের সব চেয়ে বড় অলঙ্কারের দোকানগুলো রয়েছে ওখানে। তারই একটাতে গিয়ে ঢুকল সে।
তাড়াতাড়ি দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল গোয়েন্দারা। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল। লোকটা কোন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায়নি, সোজা ঢুকে গেল একটা দরজা দিয়ে ভেতরের ঘরে। ভাবসাবে মনে হল এই দোকানের মালিকই সে।
হুঁ, বুঝলাম! মাথা দোলাল কিশোর। বেআইনী ভাবে মুক্তা আমদানি করে ম্যাকি। সেগুলো বিক্রি করে তারই মত ব্যবসায়ীর কাছে। এভাবে দেদার টাকা কামায় ওরা।
শয়তানটার মুখোশ খোলার সময় হয়েছে, নাকি? মুসা বলল। পুলিশকে এখন বলা যায়। প্রমাণ তো আমাদের সাথেই আছে, তোমার ঝোলায়।
চল, আগে বাড়ি যাই, কিশোর বলল। বাড়ি গিয়েই খুলব বাক্সটা।
বন্ধুদের ফিরতে দেখে খুব খুশি হল রাফিয়ান। আনন্দে চেঁচাতে শুরু করল। তড়িং তিড়িং করে লাফ দিল কয়েকটা। ছুটে আসতে চাইল ওদের কাছে, কিন্তু শেকল ছিড়তে পারল না। তাড়াতাড়ি গিয়ে খুলে দিল জিনা।
কেরিআন্টি ফিরে এসেছেন। রান্নাঘরে ব্যস্ত। খাবারের ডাক পড়তে দেরি আছে।
কিশোররা যে ঘরে থাকে, সেঘরে চলে এল সবাই, রাফি সহ। বাক্সটা ঝোলা থেকে বের করে টেবিলে রাখল কিশোর। সবাই তাকিয়ে আছে ওটার দিকে। ডালা খুলতে এগোল না কেউ, অথচ ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে প্রত্যেকে।
আল্লাহই জানে কি আছে! মা বলল।
আছে হয়ত সাত রাজার ধন! বলল রবিন।
জিনা, খোল, কিশোর বলল।
এগিয়ে গেল জিনা। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলল বাক্সটা। ঝাঁকুনি দিল। ঝনঝন করে উঠল ভেতরে।
খোল! খুলে দেখ।
ডালা তুলেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল জিনা। সবাই ঘিরে এল তাকে। হফ! করে উঠল রাফিয়ান, এতক্ষণ পর এসেও তার দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না, এটা পছন্দ হচ্ছে না তার।
অনেকগুলো ঝিনুক রয়েছে বাক্সে। তাড়াতাড়ি ওগুলো খুলে দেখতে শুরু করল ওরা। শেষ ঝিনুকটাও ভোলা হল। কিন্তু একটা মুক্তাও পাওয়া গেল না কোনটার ভেতরে।
তাহলে কি ভুল করলাম?–ভাবছে কিশোর। বিশ্বাস করতে পারছে না। না, মনের কথাটাই মুখে বলল সে, ভুল করতে পারি না। নিশ্চয় মুক্তা আছে!
জিনার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে নিল রবিন। ভেতরে আঙুল বুলিয়ে দেখল। কাগজের আচ্ছাদন, শক্ত কোন কিছু আঙুলে লাগল না।
ফলস বটম নেই তো? মুসা বলল।। এত জোরে গুলো দিল রবিন, বাক্সের তলা ফুটো হয়ে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল আঙুল।
না, ফলস বটম নেই, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। ভুলই করলাম বোধহয় আমরা।
হুফ! করে যেন সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল রাফিয়ান।
রবিনের হাত থেকে বাক্সটা নিল কিলোর। তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগল ভেতরটা। বিড়বিড় করে বলল, ফলস বটম নেই! দেয়ালের লাইনিঙের নিচেও কিছু নেই। ডালাটায় নেই তো?
না, পাতলা, মুসা বলল। ওর ভেতরে লুকানোর জায়গাই নেই।
ডালার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ওপরে বসানো ছোট ঝিনুকটার ওপর দৃষ্টি স্থির। জ্বলজ্বল করছে চোখ। পকেট থেকে ছুরি বের করে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল ডালাটা। ঝিনুকের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল চোখা ফলা। চাড় দিয়ে খুলে ফেলল ডালা দুটো।
উত্তেজিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সবাই।
বেশ কায়দা করে আঠা দিয়ে আটকানো ছিল ঝিনুকের ডালাদুটো। ভেতরে গোলাপী খুঁজে তুলো ঠাসা। সাবধানে তুলোর দলাটা বের করে টেনে টেনে ছিঁড়ল কিশোর। বেরিয়ে পড়ল চমৎকার মুক্তোটা।
হাতের তালুতে ওটা রেখে তাকিয়ে রইল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে অন্য তিনজনও।
খাইছে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুসা। এই তাহলে ব্যাপার! এভাবেই মুক্তা চোরাচালান করে!
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে।
জিনা আর রবিনের মুখেও হাসি।
কলরব শুরু করে দিল ওরা। পাল্লা দিয়ে ঘেউ ঘেউ জুড়ল রাফিয়ান। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হৈ-চৈ শুনে কি হয়েছে দেখতে এসেছেন জিনার বাবা।
কি ব্যাপার? এত গোলমাল কিসের? রাস্তা থেকে চেঁচানি শোনা যাচ্ছে।
বাবা, বললে বিশ্বাস করবে না, জিনা চেঁচিয়ে বলল। দেখ কি পেয়েছি!
মুক্তা! ভুরু কুঁচকে গেল মিস্টার পারকারের। কোথায় পেলে?
অনেক লম্বা কাহিনী, বাবা।
বেশ, তাহলে খেতে খেতে শুনব। চল, গিয়ে দেখি, তোমার মায়ের হল কিনা।
খেতে খেতে সমস্ত কথা শুনলেন মিস্টার এবং মিসেস পারকার। মাঝে মাঝে দুএকটা মন্তব্য করলেন কেরিআন্টি, কিন্তু জিনার বাবা একেবারে চুপচাপ রইলেন।
কাজেই, বুঝতেই পারছ, বাবা, মুক্তা চোরের ঘাটি আবিষ্কার করে ফেলেছি আমরা, জিনা বলল।
আর মিসেস আরনিকা মেয়ারবালের হারটাও খুঁজে পেয়েছি, মুসা বলল। পুশিকে বলা যায় এবার, বলল কিশোর।
তা-ই করা হল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাছের থানায় চললেন মিস্টার পারকার। ডিউটি অফিসারকে সব খুলে বললেন। মুহূর্ত দেরি না করে পুলিশ সুপারের বাসায় ফোন করল অফিসার। ছুটে এলেন সুপারিনটেনডেন্ট। গোড়া থেকে আরেক দফা মুক্তা-চোরের গল্প শোনানো হল তাকে।
কাল থেকেই শুরু করব কাজ, বললেন তিনি। ওয়ারেন্ট নিয়ে গিয়ে ম্যাকিকে অ্যারেস্ট করব। তারপর চাপ দিলেই সুড়সুড় করে দলের সমস্ত লোকজনের নাম বলতে দিশে পাবে না।
ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে আবার বাড়ি ফিরে এলেন মিটার পারকার। সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে, ক্লান্ত লাগছে এখন। তবু ঘুমোতে গেল না জিনা। বাবাকে জিজ্ঞেস করল, কাল পুলিশ আমাদেরকে সঙ্গে নেবে, বাবা?
কি জানি। মনে হয় না। পুলিশের কাজের সময় তোমাদেরকে নেবে কেন?
বা-রে, আমরাই করে দিলাম সব। আর আমাদেরকে নেবে না?
না।
আর কিছু বলল না জিনা। ঘুমোতে চলল নিজের ঘরে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আগামী দিন যখন ম্যাকিকে গ্রেফতার করতে যাবে পুলিশ, ওরাও থাকবে তখন ওখানে। পুলিশের সঙ্গে যাবার দরকার নেই, ওরা আলাদাই যাবে।
পরদিন সকালে উঠে এ-নিয়ে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে আলোচনা হল জিনা। সবাই রাজি।
দেখ, জিনা বলল, লোকটা মহা শয়তান। পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, যাবে।
ভাবছি, টনিকে সঙ্গে নিলে কেমন হয়? কিশোর বলল।
সবাই একমত হল এ-ব্যাপারে।
টনিকে ফোন করা হল। সংক্ষেপে জানানো হল সব কথা। সাঘাতিক উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। বলল, বাবার গাড়ি নিয়ে চলে আসবে। গোয়েন্দাদের নিয়ে যাবে মিমোসা অ্যাভেন্যুতে।
একেবারে সময়মত পৌঁছল ওরা। রাস্তার পাশের দোকানগুলো সবে খুলতে আরম্ভ করেছে। সাইনবোর্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। এল পুলিশের কালো গাড়ি। গাড়ি থেকে নামল সাদা পোশাক পরা দুজন পুলিশ। দোকানের দিকে এগোল। পুলিশের আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়াল প্রথম গাড়িটার কাছে।
বিড়বিড় করে বলল টনি, দোকান সার্চ করবে। ধরে বের করে আনবে ম্যাকিকে।
এখান থেকে কিছু দেখতে পাব না আমরা, মুসা বলল। ভেতরে কি ঘটে দেখা দরকার।
কিন্তু আমাদেরকে কি কাছে যেতে দেবে? রবিনের প্রশ্ন।
এসো আমার সঙ্গে, উঠে দাঁড়াল কিলোর।
গাড়ির দরজায় তালা লাগাল টনি। তারপর দ্রুত রওনা হল কিশোরদের পেছনে।
দোকানের পেছনের ওই যে গলিটা, চলতে চলতে বলল কিশোর, প্রায় নির্জন থাকে, দেখেছি। ওখানে গিয়ে জানালা দিয়ে দোকানের সেলারে নামা যাবে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে পেছনের ঘরে ঢুকে আরামসে দেখতে পারব দোকানের ভেতরে কি হচ্ছে।
এক এক করে জানালা দিয়ে সেলারে নেমে পড়ল ওরা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে, এই সময় কানে এল কড়া পুলিশী কণ্ঠ, জলদি আলমারি খোল! ভেতরে কি আছে দেখব।
মিনমিন করে কি বলতে যেয়ে আবার ধমক খেল ম্যাকি।
আলমারি খোলার শব্দ হল। মিনিটখানেক পর বলে উঠল আরেকজন পুলিশ, এই তো! মিসেস মেয়ারবালের নেকলেস!
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। তাকাল সঙ্গীদের মুখের দিকে। প্রমাণ পেয়ে গেছে পুলিশ। বল ধরেছে ম্যাকিকে।
ব্যাটার খেল খতম, হাসতে হাসতে মুসা বলল। আর শয়তানী করতে পারবে না।
যেপথে ঢুকেছিল সেপথেই আবার বেরিয়ে এল ওরা। ভাবতেই পারেনি, বাইরে কি চমক অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে।
গলি থেকে মিমো অ্যাভেন্যুতে বেরিয়েই দেখল, দোকানের দরজা দিয়ে সবেগে বেরিয়ে আসছে ম্যাকি। দৌড় দিল একদিকে। হাতে হাতকড়া নেই। পুলিশ নেই পেছনে। হাতে সেই নীল বাক্সটা। কাপড়-চোপড়ের অবস্থা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, খুব একচোট ধস্তাধস্তি করে এসেছে।
পালাচ্ছে! চেঁচিয়ে উঠেই পিছু নিতে গেল মুসা।
তার হাত টেনে ধরল কিশোর। না। ওই দেখ।
বেরিয়ে এসেছে পুলিশ দুজন। একজনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আরেকজন হাত নাড়তে নাড়তে বলল, ধর, ধর ব্যাটাকে! দৌড় দিল ম্যাকির পেছনে।
ইতিমধ্যেই ক্রেতার ভিড় বেড়ে গেছে রাস্তায়। বড়দিনের উপহার কিনতে এসেছে লোকে। সেদিকে দৌড়াচ্ছে ম্যাকি, লোকের ভিড়ে মিশে যাওয়ার ইচ্ছে।
হুড়াহুড়ি করে পুলিশের গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে ইউনিফর্ম পরা পুলিশেরা।
পালাল তো! ধর, ধর ব্যাটাকে! চেঁচিয়ে উঠল আবার সাদা পোশাকধারী পুলিশ।
পিস্তল ধরছে না কেন? মুসা বলল।
নেই হয়ত। এখানে পিস্তল-বন্দুক কমই ব্যবহার করে পু মরিকার মত সব সময় পিস্তল বয়ে নিয়ে বেড়ায় না, টনি বলল।
রাফি! চেঁচিয়ে বলল জিনা। ধর ব্যাটাকে!
আদেশ পেয়ে মুহূর্ত দেরি করল না রাফিয়ান। দুটল ম্যাকির পেছনে। তার পেছনে দৌড় দিল কিশোর গোয়েন্দারা।
তারপর খুব দ্রুত ঘটে গেল সমস্ত ঘটনা। লোকের কোলাহল আর পুলিশের হুইসেলে কান ঝালাপালা। বাঘের মত গিয়ে ম্যাকির ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশাল কুকুরটা। কোট কামড়ে ধরে ঝুলে রইল বিচিত্র ভঙ্গিতে।
ঝাড়া দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করল ম্যাকি। পারল না। দৌড়াতেও পারল না আর। চোখের পলকে এসে তাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ। দুদিক থেকে চেপে ধরল হাত।
হাতকড়া পড়ল রবার্ট ম্যাকির হাতে।
সেদিন বিকেলের কাগজেই একেবারে সামনের পৃষ্ঠায় ছাপা হল খবরটা। তিন। গোয়েন্দা, জিনা আর রাফিয়ানের ছবি ছাপা হল তাতে। মিসেস এরিনা কলিন্স, তার মেয়ে মলি আর হারটার ছবিও ছাপা হয়েছে।
এরিনা আর মলিকে বড়দিনের দাওয়াত দিলেন কেরিআন্টি। টনিকেও। আর মাত্র একদিন দেরি আছে বড়দিনের। কয়েকদিনের জন্যে ছুটি, বৈজ্ঞানিক সম্মেলন বন্ধ। কাজেই বাড়িতেই থাকছেন মিস্টার পারকার। ছেলেমেয়েরা খুব খুশি। উৎসব ভালই জমবে মনে হচ্ছে।
সত্যিই ভাল জমল।
সারাদিন জিনাদের ওখানে কাটিয়ে বিকেলে বাসায় ফিরে গেল এরিনা। তার ওখানে পরদিন বিকেলে চায়ের দাওয়াত করে গেল সবাইকে।
পরদিন বিকেলে বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়ায় এরিনার বাসায় যেতে পারলেন না কেরিআন্টি আর জিনার বাবা। ছেলেমেয়েদেরকে পাঠিয়ে দিলেন। টনির বাড়িতে কাজ থাকায় সে-ও আসতে পারল না।
হার ফেরত পেয়ে খুব খুশি এরিনা। গতদিন থেকে কয়েকবার ধন্যবাদ দিয়ে ফেলেছে ওদেরকে। চা খেতে খেতে আবারও বলল, কি বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ দেব, বুঝতে পারছি না। আমার জন্যে অনেক করেছ তোমরা, ঝুঁকি নিয়েছ। অনেক ধন্যবাদ। হারটা বিক্রি করলে অনেক টাকা পাব। টাকার জন্যে আর ভাবতে হবে না কখনও আমাকে। কি বাঁচা যে বেঁচেছি বলে বোঝাতে পারব না তোমাদেরকে।
ম্যাকির সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছে এরিনা, তবু আরও কিছু জানা বাকি। পুলিশের কাছে যা যা শুনে এসেছে ছেলেময়েরা, চা আর চমৎকার নাস্তা খেতে খেতে সেগুলোই বলল।
সব স্বীকার করেছে ম্যাকি, কিশোর বলল। যারা যারা জড়িত আছে এই মুক্তা চোরাচালানের সঙ্গে, বলে দিয়েছে। ওদের বেশির ভাগই এখন হাজতে। জাপান থেকে বেআইনী ভাবে ওই মুক্তা আমদানি করা হত। এতে মধ্যস্থতা করত ম্যাকি।
লোক খারাপ, জিনা বলল। কাজেই হারটার কথা শুনে আর স্থির থাকতে পারেনি। চুরি করতে উঠেপড়ে লেগেছিল।
জানল কিভাবে হারটার কথা? কাপে আরও চা ঢেলে দিল এরিনা। চকোলেট কেকের প্লেটটা ঠেলে দিল। সবাইকে সাধাসাধি করল আরও নেয়ার জন্যে।
ম্যাকির দাদী ছিলেন মিসেস মেয়ারবালের বান্ধবী, রবিন জানাল। দাদীর মৃত্যুর পর তাঁর ডেস্কের ড্রয়ার ঘাঁটতে গিয়ে কতগুলো চিঠি পেয়ে যায় সে। ওগুলো পড়েই জানতে পারে র কথা। কোথায় লুকিয়ে রাখেন জিনিসটা কথায় কথায় একদিন ম্যাকির দাদীকে বলেছিলেন মিসেস মেয়ারবাল। সেটা ম্যাকির দাদীর ডায়েরীতে লেখা ছিল। চোরের ভয় বরাবরই ছিল মিসেস মেয়ারবালের, সে-কারণেই ওরকম একটা জায়গায় হারটা লুকাতেন। প্রায় সারাদিনই ওটার ওপর বসে থাকতেন তিনি, রাতে টাব চেয়ারটা থাকত তার বেডরুমে।
কিন্তু আমার কথা জানল কিভাবে ম্যাকি? এরিনা জিজ্ঞেস করল।
আমাদের পিছু নিয়েছিল, বলল মুসা। কেকের গোটা চারেক টুকরো শেষ করে আরও চারটে তুলে নিল নিজের প্লেটে। আরও হুঁশিয়ার থাকা উচিত ছিল আমাদের।
হুফ! করে মাথা দেলাল রাফিয়ান, যেন মুসার সঙ্গে একমত। আসলে কেক চাইছে সে। :
দুটো টুকরো তাকে দিল এরিনা। হেসে মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল, আসল কাজটা তুইই করেছিস, রাফি। চোরটাকে পাকড়েছিস।
তোমার কুকুরটা খুব ভাল, জিনা, রাফিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল -মলি। এরকম একটা কুকুর যদি আমার থাকত! মা, দেবে কিনে একটা?
দেব।
হুফ! হুফ! বলল রাফিয়ান। যেন বোঝাতে চাইল, খুব ভাল হবে তাহলে মেয়েটাকে আর একা থাকতে হবে না।
তার মাথা দোলানোর ধরন দেখে না হেসে পারল না কেউ।