গোরু
গৌঃ গাবৌ গাঃ। বিসর্গগুলি ঠিক বসালাম কি? ব্যাকরণ কৌমুদী হাতের কাছে থাকলে মিলিয়ে দেখতে পারতাম।
গোরু সম্পর্কে আমার বিদ্যা সপ্তম শ্রেণীর শব্দরূপ পর্যন্ত। অবশ্য ইচ্ছে করলে এ বিষয়ে আমি আরও কিঞ্চিৎ জ্ঞান আহরণ করতে পারতাম। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু কালীঘাট মন্দিরের সামনের ফুটপাথ থেকে ‘সরল গো চিকিৎসা’ নামে একটা চটি বই ছয়আনা দিয়ে কিনে আমাকে উপহার দিয়েছিল, তাতে লিখে দিয়েছিল,
‘নিজের চিকিৎসা নিজে করো।’
বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা সেই সময়ে খুব সম্মানজনক মনে হয়নি। তবে জীবনের ষাট বছর পার হয়ে এখন আর সম্মান-অসম্মানের সূক্ষ্ম পার্থক্য আমাকে মোটেই ভাবায় না, ধরতেও পারি না। গল্পের খাতিরেই ঘটনাটা লিখলাম।
এখন তো গোরু ব্যাপারটা খুবই গুরুতর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতবর্ষের হিন্দিভাষী অঞ্চলের বিশাল অংশর নামকরণ হয়েছে গো-বলয়।
গো-বলয়ের একটি প্রধান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম রাবড়ি দেবী। তাঁর নাকি রমরমা দুধের ব্যবসা। বছরে লক্ষাধিক টাকা আয়। তাঁরই টাকায় তাঁর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী স্বামী বাড়ি-ঘর, জোত-জমি করেছেন। সে ভদ্রলোক আবার গাওলার মানে গোখাদ্য চুরির মামলায় আসামি, যে মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত জামিন না-মঞ্জুর করেছেন। ভদ্রলোকের কপালে লাপসি ভক্ষণ (লাপসি জেলের খাবার) অনিবার্য। তিনি বিপদ বুঝে সহধর্মিণী রাবড়িদেবীকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
অনায়াসে এ বিষয়ে লাপসির বদলে রাবড়ি এই নামে একটি চমৎকার সুরক্ষা নিবন্ধ লেখা যায়।
কিন্তু তা আমি লিখব না। আমার লেখাকে রাজনীতির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিতে আমি ইচ্ছুক নই। (বাচ্চালেক তালি লাগাও।)
এবার আমি গোরুর গল্প বলব।
প্রথমে স্কুলে যাই। স্কুলের মাঝারি ক্লাশে ‘গোরু’ বিষয়ক রচনা প্রশ্নকর্তাদের খুব প্রিয় বিষয়।
যথারীতি একটি পরীক্ষায় গোরুর বিষয়ে রচনা এসেছিল। দুটি ছেলে পাশাপাশি বসে লিখছিল। হঠাৎ একটি ছেলে শিক্ষককে ডেকে বলল, ‘স্যার, ভুবন টুকছে।’ পাশের ছেলেটি ভুবন, সে প্রতিবাদ করতেই অভিযোগকারী ছেলেটি বলল, ‘স্যার, ওই জানলার ওপাশে দেখুন।’
স্যার দেখলেন জানলার ওপাশে কিছু নেই। স্কুলের দারোয়ানের একটা গোরু কাঁঠালগাছের নীচে শুয়ে আছে। অভিযোগকারী জানাল, ‘ওই গোরুটাকে দেখে টুকে টুকে ভুবন ওর গোরুর রচনা লিখছে।’
পরের গল্পটি আরও গোলমেলে।
ছাত্র গোরুর রচনা অবশ্যই আসবে জেনে মুখস্থ করে গিয়েছে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষক রচনা লিখতে দিয়েছেন, ‘আমার বাবা।’
ছাত্রটি আর কী করবে? সে ভেবেচিন্তে বাবাকে গোরুর স্থলাভিষিক্ত করল। বেশ গুছিয়ে লিখল।
‘আমার বাবা খুব উপকারী জন্তু। আমার বাবা ঘাস খায়। দু’বেলা দু’ বালতি দুধ দেয়। বাবার দুটো শিং আছে, চারটে পা আছে। বাবা আমাদের খুব কাজে লাগে। বাবার চামড়া দিয়ে জুতো তৈরি হয়।’
এ হল শিশুসুলভ ব্যাপার। অবশেষে গোরু বিষয়ে বয়স্কোচিত কাহিনী বলি।
এক গ্রাম্য গৃহস্থ সারাদিন বনে বাদাড়ে, মাঠে-ঘাটে তার পালিয়ে যাওয়া গোরুকে খুঁজেছেন এবং পাননি। তারপরে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, কাঁটাঝোপের আঁচড়ে কিঞ্চিৎ রক্তাক্ত অবস্থায় সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এসেছেন।
উঠোনে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি দাওয়ায় বসা ছেলেকে বললেন, ‘ভাই, এক গেলাস জল খাওয়াতে পারো।’
গৃহস্থী (= গৃহস্থের স্ত্রী) পাশের রান্নাঘরে বসে রাতের রান্না করছিলেন। স্বামী ছেলেকে ভাই বলছে শুনে তাঁর মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি উঠোনে নেমে স্বামীকে বললেন, ‘বানরমুখো, মিনসে। বদমায়েসির জায়গা পাওনি। সাঁঝবেলায় ঘরে ফিরে এসে ছেলেকে বলছ, ‘ভাই।’
স্ত্রীর এই কঠোর ব্যবহারে গৃহস্থের কিন্তু কোনও ভাববিকার দেখা গেল না। সহধর্মিণীর পদপ্রান্তে সাষ্টাঙ্গে পড়ে তিনি নরম গলায় বললেন, ‘মা, মাগো। গোরু হারিয়ে গেলে মানুষের কী দশা হয়, তোমাকে আর কী বলব মা জননী।’
এ গল্প এর আগে সবাই শুনেছে। আমিই তো কতবার বললাম কিন্তু এসব গল্প পুরনো হয় না।