গোয়েন্দা-লেখক গুপ্তসভা – বিমল কর

গোয়েন্দা-লেখক গুপ্তসভা – বিমল কর

কাগজে সব খবর ছাপা হয় না। বিশ্বসংসারে যা ঘটে রোজ, তার কতটুকুই বা ছাপা হয়। এ-খবরটাও ছাপা হয়নি। অবশ্য আমরা ছাপানোর চেষ্টাও করিনি। না করার দুটো কারণ ছিল। আগে আগে দু’-চারবার কাগজঅলাদের অনেক বলে-কয়ে হাতে-পায়ে ধরেও কোনওদিন আমাদের খবর ছাপাতে পারিনি। ওরা আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করেছে, মজা করেছে। বলেছে, আপনারা ব. গো, গ, স, নয়, আপনারা হলেন বোগাস। কাজেই আমরা আর ও-পথ মাড়াই না। কে যাবে অপমান সইতে কাগজঅলাদের কাছে। বঙ্গীয় গোয়েন্দা গল্পলেখক সমিতিকে যারা বোগাস বলে, তারা অভদ্র ছাড়া আর কী।

এবারে আরও একটা কারণ ছিল, যার জন্যে কারও কাছে আমাদের যাবার উপায় ছিল না। আমরা ঠিক করেছিলাম এবার আমরা যা করব— একেবারে গোপনে করব, শুধু গোপনেও নয়, এমনভাবে করব যাতে কাকপক্ষীও না জানতে পারে। আমরা তাই এবারের সভার নাম দিয়েছিলাম, গোয়েন্দা-লেখক গুপ্তসভা। কার্যকরী সমিতির সভা আর কী। সভা বড় করার ইচ্ছে আমাদের ছিল না। মাত্র দশ-বারোজনের সভা। সত্যি বলতে কী এটা একরকম প্রস্তুতি-সভা। মোটামুটি সব ঠিক হয়ে গেলে বেশ বড় করে এক সারা ভারত গোয়েন্দা-লেখক-সভা করার ইচ্ছে ছিল।

কালীকরালী বিশ্বাস, যিনি ‘আলেয়া’ ছদ্মনামে চল্লিশ-পঞ্চাশটা রহস্য কাহিনি লিখেছেন, তিনি অতি সজ্জন লোক। এবং ধনী লোক। বই লিখে ধনী নয়, পৈতৃক ধনে ধনী। করালীবাবু প্রস্তাব করেছিলেন, পাণ্ডবেশ্বরের কাছে তাঁদের একটা ভাঙা কুঠি আছে। কোলিয়ারি উঠে যাবার পর ওই কুঠি ভূতের বাড়ি হয়ে পড়ে আছে, জায়গাটা বেশ গা-ছমছম-করা, কাছাকাছি কোনও গাঁ-গ্রাম নেই, গোয়েন্দা গুপ্তসভার উপযুক্ত জায়গা হতে পারে।

আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলাম। থাকা, খাওয়া, অণ্ডাল থেকে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করালীবাবুই করবেন বললেন। আমরা হব তাঁর অতিথি।

গুপ্তসভায় যোগ দিতে গিয়ে দেখি, আমাদের বারোজনের মধ্যে তিনজন আসতে পারেননি। একজন ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়েছেন, একজন বাতে কাবু। আর দুলাল দত্ত মিনিবাসের গুঁতো খেয়ে হাত ভেঙেছে। দুলাল বেশ বলিয়ে-কইয়ে ছেলে। কম বয়েস, গোটাদশেক মাত্র বই লিখেছে, তাতেই তার নামডাক হয়েছে যথেষ্ট। সে নাকি ফরাসি কায়দায় গোয়েন্দা-গল্প লেখে।

তা আমরা ন’জনে পাণ্ডবেশ্বরে জমায়েত হলাম গুপ্তসভা করতে। কুঠি-বাড়ি দেখে চোখ-মন ভরে গেল। বেশ পুরনো বাড়ি। ভাঙাচোরা। দেওয়ালে ফাটল। মাথার ছাদ ভেঙে পড়ো পড়ো। ইঁদুর, গিরগিটি, ছুঁচো, আরশোলার অভাব নেই। ভাঙা দরজা-জানলা। সাপখোপও হয়তো আছে। তবে ডিসেম্বর মাসের কড়া শীত বলে আর গর্ত ছেড়ে বেরোচ্ছে না।

কুঠির চারদিক আগাছায় ভরা। দু’-চারটে বড়সড় গাছ ছাড়া বাকি সবই আগাছা। কুলঝোপ, বনতুলসী, আকন্দ, কাঁটাগাছ, নয়নতারা।

বাড়ি যেমনই হোক, কালীবাবু লোকলশকর লাগিয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা মন্দ করেননি। টাকা ফেললে কী না হয়। বাঘের দুধও জুটে যায়।

রাত্রে আমাদের গুপ্তসভার অধিবেশন বসল। চমৎকার ব্যবস্থা। বসার জায়গা বলতে ভাঙা চেয়ার, তে-পায়া টুল, মচকানো বেঞ্চি। প্যাকিং বাক্স। একটা হেলে-পড়া গোল টেবিলও ছিল। আলো বলতে লণ্ঠন। লণ্ঠনের কাচ ছিল নীল রং করা। ফলে আলোর চেয়ে অন্ধকারটাই বেশি জমছিল। আর আমরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত, যে যা পেরেছি, গরম পোশাকে মুড়ে বসে পড়েছি। চা, সিগারেট, চুরুট, যার যা ইচ্ছে নাও আর খাও।

করালীবাবুকে সভাপতি করে আমাদের সভা যখন মাঝপথে, বেশ জমে উঠেছে আলোচনা, তখন কে একজন ভারী গলায় বারকয়েক কেশে উঠল। আমরা কান করলাম না। আমাদের মধ্যেই কেউ হবে। যা শীত আর ঠান্ডা, হাঁচি-কাশি তো হবেই।

প্রতুল মুখুজ্যেকে লোকে বলে বাঙালি গোয়েন্দা-লেখকদের রাজা। গোয়েন্দা সম্রাট। ওঁর বইয়ের সংখ্যা বিরাশি। উনি বলছিলেন, আমাদের উচিত একটা গিল্ড করা। বিদেশে এ-রকম অনেক গিল্ড, অ্যাসোসিয়েশান আছে গোয়েন্দা লেখকদের। গিল্ড না থাকলে আমরা নিজেদের স্বার্থ আর বাঁচাতে পারব না। লোকে আমাদের ছোট নজরে দেখবে। সাহিত্যিক, সমালোচক, মায় পাবলিশাররাও সম্মান দেবে না। আমরা কোনওদিন মেডেল বা পুরস্কার পাব না।

প্রতুল মুখুজ্যের কথা শেষ হতে আমরা সবাই যখন হাততালি দিচ্ছি, তখন হঠাৎ আবার সেই কাশির শব্দ। এবার ভারিক্কি কাশি। তারপর কার যেন বিশ্রী গলা শুনলাম, “স্টপ ইট। যত্ত সব ফেকলুর দল।”

কে? কে কথা বলল? ফেকলুর দল মানে?

আমরা সবাই মুখ ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। অন্ধকারে ঠাওর করা যায় না।

প্রতুল মুখুজ্যে কড়া গলায় বললেন, “কে কথা বলল?”

“আমি।” গলা তো নয়, যেন ইঞ্জিনের ভোঁ।

“কে আপনি?”

“পাঁচকড়ি পালিত।”

পাঁচকড়ি পালিত! আমরা অবাক। এমন নাম তো আমাদের কারও নয়। কে পাঁচকড়ি পালিত? জীবনেও এমন নাম শুনিনি। পাঁচকড়ি নামে এক বিখ্যাত গোয়েন্দা-লেখক ছিলেন এককালে। কিন্তু তিনি তো স্বর্গে। পাঁচকড়ি?

করালীবাবু বললেন, “পাঁচকড়ি পালিত বলে কেউ এখানে নেই। তুমি কে? ঠিক করে বলো।”

অট্টহাসি না হলেও একটা হাসি শোনা গেল। তারপর দেখি, প্রায় দরজার কাছ থেকে একটা লোক উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারে ছাই দেখাই যায় না ভাল করে, তবু মনে হল লোকটা বেজায় মোটা, বেঁটে। একেবারে পিপের মতন। কালো কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে রাখলে যেমন দেখায় মানুষকে, ভূতের মতন, সেইরকম দেখাচ্ছিল। বোধহয় কালো কম্বল কেটে প্যান্ট-কোট বানিয়েছে, কিংবা ভুট কম্বলের অলেস্টার চাপিয়ে এসেছে। গলায় মাফলার। মাথায় টুপি।

“হিয়ার আই অ্যাম, পাঁচু পালিত। পি. পি.”

খগেনবাবু বললেন, “তুমি পি, পি. হও, আর হিপি হও, তুমি এখানে কেন? কে তোমায় ঢুকতে দিয়েছে? এটা আমাদের গুপ্তসভা। সিক্রেট মিটিং। তুমি এলে কেমন করে! আশ্চর্য!”

পাঁচু পালিত রগড়ের গলায় বলল, “আমি কেমন করে ঢুকলাম সেটা তোমাদের মাথায় ঢুকলে তোমরা তো মানুষ হতে। তোমরা গাধা।”

আমরা গাধা। লোকটা বলে কী। আমাদের এখানে প্রতুল মুখুজ্যে, রজনী সারখেল, খগেন পুরকায়স্থর মতন বিখ্যাত গোয়েন্দা-লেখকরা রয়েছেন, রয়েছেন করালীবাবু, এঁরা শুধু সুপরিচিত লেখক নন, বয়স্ক ব্যক্তি, এঁদের গাধা বলছে লোকটা। কী আস্পর্ধা।

জগদীশ বসাকের গলা পেলাম। রেগে গিয়েছে। চিৎকার করে বলল, “তুমি কে হে, অসভ্য বাঁদর ইতর কোথাকার? হু আর ইউ? এখানে কেমন করে ঢুকেছ? তোমায় কে আসতে দিয়েছে? আর-একটা যদি কথা বলো, মেরে ফ্ল্যাট করে দেব। যাও, বেরিয়ে যাও। না গেলে, ঘাড় ধরে বার করে দেব।”

জগদীশের হুংকার শুনে মনে হল, পাঁচু পালিতকে সে হয়তো সত্যিই মারধর করবে। জগদীশ সেটা করতে পারে। রগচটা লোক। বয়েসও বছর চল্লিশ। এক সময় বক্সিংয়ে মেডেল পেয়েছে মুঠো মুঠো।

ভেবেছিলাম পাঁচু পালিত ভয় পাবে। কিন্তু হায় হরি, ভয় কোথায়, লোকটা বরং আরও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলল, “ঘাড় ধরবে কে? জগদীশ বসাক নাকি? এসো, ধরো ঘাড়। তারপর দেখো তোমার কী অবস্থা হয়। কান ধরে দু’ গালে দুটি থাপ্পড় মেরে থানায় ভরে দেব।”

থানা! থানায় ভরে দেবে? ব্যাপারটা কী? পাঁচু পালিত থানায় ভরে দেবার ভয় দেখাচ্ছে। তা ছাড়া ও জগদীশের নাম জানল কেমন করে?

জগদীশ প্রায় উঠে পড়তে যাচ্ছিল, করালীবাবু তাকে বসিয়ে দিয়ে বললেন পাঁচুকে, “এ বাড়ি আমার। আমি এখানে বন্ধুদের নিয়ে বসে মিটিং করছি। তুমি কার হুকুমে এখানে এসেছ? কেন এসেছ? আমরাই তো তোমাকেই থানায় দিতে পারি। তুমি কে?”

পাঁচু তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “আমায় থানা চেনাবেন না, করালীবাবু। আমার নাম পাঁচকড়ি পালিত, ওরফে পাঁচু পালিত, ওরফে পি, পি., ওরফে পাজির পাঝাড়া, ওরফে পাষণ্ড পীড়ন, ওরফে পুলিশ…”

“পুলিশ।” আমরা যেন আঁতকে উঠলাম।

পাঁচু পালিত উপহাসের গলায় বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। দেখেছেন পুলিশ?”

প্রতুল মুখুজ্যে হঠাৎ নরম হয়ে বললেন, “পুলিশ। দেখব না! কত রকম পুলিশ দেখলাম। থানা-পুলিশ, ট্রাফিক-পুলিশ, রেল-পুলিশ, জল-পুলিশ। আমাদের তো ভাই পুলিশ নিয়েই কারবার।”

পালিত, মানে পি. পি. একটা সিগারেট ধরাল। ওর কাছেই ছিল বোধহয়। বলল, “লাশ-পুলিশ নিশ্চয় দেখেননি।” পালিত এবার আর তুমিটুমি বলল না। সম্মান দেখিয়েই কথা বলল।

লাশ শুনে আমরা থ। সে আবার কী?

প্রতুল মুখুজ্যে হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “সেটা কী ভাই?”

পাঁচু পালিত শোঁ শোঁ করে সিগারেট টানতে লাগল। গন্ধটা বিড়ির মতন। বারকয়েক কাশল। তারপর বলল, “লাশ-পুলিশ হল সেই পুলিশ, যারা লাশ উদ্ধার করে।”

“মানে?” করালীবাবুর গলা উঠল না ভাল করে।

পালিত বলল, “মানে আজ একটা লাশ পড়ার কথা।”

“লাশ। কোথায়?”

“এ বাড়িতে।”

“এ বাড়িতে?” আমরা চমকে উঠে বললাম।

“আজ্ঞে হ্যাঁ, এ বাড়িতে। এখানে। এই ঘরে।”

আমরা শিউরে উঠলাম। এ বাড়িতে, এখানে লাশ। লোকটা বলে কী।

করালীবাবু বললেন, “কে বলল লাশ পড়বে?”

“আমি বলছি,” পাঁচু যেন ধমক মারল। তারপর হঠাৎ বলল, “আপনারা এই ভুতুড়ে বাড়িতে কেন এসেছেন, মশাই?”

“সভা করতে।”

“সভা করার আর জায়গা ছিল না।”

“থাকবে না কেন? …তবে কী জানেন পাঁচুবাবু, আমরা হলাম গোয়েন্দা বইয়ের লেখক। বাঙালি লেখক। আমরা একটু অন্যভাবে সভাটা করব ভেবেছিলাম। রোমাঞ্চকরভাবে, নতুন ভাবে।”

পাঁচু বলল, “আপনারা যে কী, আমি জানি। আপনাদের খবরাখবর অল্পবিস্তর জেনে নিয়েছি। আপনারাই শুধু জানেন না, কাল আপনারা এখানে আসার পর থেকে আপনাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।”

খবরটা সত্যিই আমাদের জানা ছিল না। চমক লাগল। কে বা কারা যে আমাদের ওপর নজর রাখছে, তাও বুঝলাম না। নজর রাখার লোক কোথায়? আমরা ছাড়া আছে তো মাত্র তিনটি লোক, রাখাল, ভোলা আর পন্টু। তিনজনই কাজের লোক। রান্নাবান্না-জল তোলা, বিছানা পাতা, ফাইফরমাশ খাটা— সবই তারা করছে। পন্টুটা আবার ছোঁড়া গোছের। এরা সকলেই করালীবাবুর লোক। তা হলে নজরটা রাখবে কে? সিকি মাইলের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই। শুধু মাঠ আর ঝোপঝাড়।

প্রতুল মুখুজ্যে বিনীতভাবে বললেন, “আমাদের ওপর চোখ রেখেছেন মানে? আমরা কি ক্রিমিন্যাল?”

পাঁচু বলল, “আপনারা ক্রিমিন্যাল নন তার প্রমাণ কী? এত জায়গা থাকতে এখানে এভাবে আপনারা আসবেন কেন সভা করতে?”

করালীবাবু বললেন, “এ তো বড় অন্যায় কথা পাঁচুবাবু। আমরা আমাদের খুশিমতন জায়গায় সভা করতে পারব না? বিশেষ করে এই বাড়ি যখন আমার।”

পাঁচু বলল, “আপনারা এমন বাড়িতে আসবেন কেন, যে বাড়িতে একটা লাশ পাওয়া যাবে।”

“লাশের কথা আমরা জানতাম না, বিশ্বাস। করুন।”

পাঁচু সিগারেটটা ফেলে দিল। নিবিয়ে দিল। বলল, “ও-কথা আমার কাছে বলে লাভ নেই। কোর্টে বলবেন।”

“কোর্ট?” খগেনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “এর মধ্যে আবার কোর্টকাছারি আসে কেন? সভা করতে এসে ফ্যাসাদে পড়ে গেলুম যে!”

আমাদের মধ্যে বটকৃষ্ণ সেন খুবই ঠান্ডা মাথার মানুষ। বটকৃষ্ণ একসময় আইন পড়তে ঢুকেছিলেন। ছেড়ে দিয়ে এক সওদাগরি অফিসে কাজ করতে ঢোকেন। কুড়ি বছর বয়েস থেকে গোয়েন্দা গল্প লিখছেন। এ-যাবৎ পঞ্চাশটা বই লিখেছেন। তাঁর বইপত্র তেমন বিকোয় না। তবে তিনি লেখেন ভাল।

বটকৃষ্ণ এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। এবার বললেন, “আমাদের সন্দেহ করার কারণ?”

পাঁচু বলল, “কারণটা সহজ। আপনারা আমায় কারণ জিজ্ঞেস করবেন না। এখন বলুন, লাশটা কার হবে, বা হতে পারে?”

এ তো মহা মুশকিল হল। যে-লাশ আমরা দেখলাম না, কোনও সম্পর্ক নেই যে লাশের সঙ্গে, সেই লাশের লোকটা কে তা আমাদের বলতে হবে? পাঁচু কি পাগল? না, আমাদের সঙ্গে অকারণ ফাজলামি করছে?

বটকৃষ্ণ বলল, “এটা কেমন কথা হল পাঁচুবাবু? লাশ কি আমরা দেখেছি, না জানি?”

পাঁচু বলল, “মশাই, লাশ দেখে তাকে চেনা সহজ। আপনার লাশ যদি পড়ে থাকে, আমরা সবাই চিনতে পারব। কিন্তু বাজে কথা থাক। রাশি রাশি গোয়েন্দা বই লিখেছেন, আর একটা লাশের বেলায় সবাই ন্যাকা সাজতে চাইছেন।”

“এ তত বড় জ্বালা হল করালীবাবু? এ আপনি আমাদের কোথায় নিয়ে এলেন?” প্রতুল মুখুজ্যে বললেন।

করালীবাবু বিরক্তবোধ করছিলেন। বললেন, “পাঁচুবাবু, আপনার মাথায় ঘিলু আছে?”

“কেন?”

“ঘিলু থাকলে এসব কথা বলতেন না।”

পাঁচু বলল, “আপনাদের মাথায় যতটা ঘিলু আছে, আমার মাথায় তার চেয়ে বেশি বই কম নেই। তবে কী জানেন করালীবাবু, আপনাদের মাথার ঘিলু ভেজাল। তাতে কোনও কাজ হয় না।”

“কী বলতে চান আপনি?”

পাঁচু রঙ্গ করে বলল, “ডোন্ট মাইন্ড করালীবাবু। আপনারা যারা এখানে এসেছেন, তাঁরা এক-একটি গবেট।”

“হোয়াট?”

“রাগ করবেন না।…ওই যে আপনাদের গোয়েন্দা সম্রাট কিং… মানে প্রতুল মুখুজ্যে। উনি পাঁচ ধামা বই লিখেছেন। উনি নাকি লাশের পর লাশ ফেলেন, গায়েব করেন। কিন্তু আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, উনি জীবনে একটা লাশও দেখেননি। কী মশাই, ঠিক কি না। সত্যি কথা বলবেন। মিথ্যে বললে আপনাকে থানায় ভরব।”

প্রতুল মুখুজ্যে বললেন, “রাস্তা দিয়ে মড়া বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি, লাশ দেখিনি। পাড়ায় কেউ মারা গেলে দেখেছি।”

“ওগুলো লাশ নয়, মৃতদেহ। সোজা বাংলায় মড়া। লাশের গ্ল্যামার আছে, মড়ার নেই। যাকগে, খগেনবাবু, আপনি কি লাশ, রিভলভার, পিস্তল, ছোরা দেখেছেন?”

খগেনবাবু বললেন, “ছোরা দেখেছি। আর পিস্তল না দেখলেও কলকাতার সার্জেন্টদের কোমরে বাঁধা চামড়ার খাপ দেখেছি পিস্তলের।”

পাঁচু হেসে উঠল। তারপর ধরল, জগদীশকে। টিপ্পনী কেটে বলল, “এই যে জগদীশ বসাক। তুমি চাঁদ, ‘বিষ’-এক্সপার্ট। তোমার ওই ছেলেভুলোনো বইগুলোতে ফটাফট বিষ খাইয়ে লোক মার। তুমি বিষ দেখেছ? আর্সেনিক কাকে বলে জানো? কভি-ভি দেখা হ্যায়? পটাসিয়াম সায়োনাইড-এর গন্ধ শুঁকেছো কখনও? সাপের বিষ কতরকম হয় জানো? কোন কোন সাপের বিষ থাকে বলতে পারো? …তুমি তো সারা জীবনে বাতের মালিশ ছাড়া কিছু দেখোনি। কী জানো হে তুমি বিষের?”

জগদীশ একেবারে চুপ। কথা বলতে পারল না।

তারপর আমার পালা। পাঁচু আমায় যেন খোঁচা মেরে বলল, “ওহে অখিলবন্ধু, তুমি তো একটা চোর। তুমি যা বই লেখো সব চুরি। কলকাতার রাস্তা থেকে চার-ছ’ আনা দিয়ে ছেঁড়া-ফাটা ময়লা বই কেনো, আর সেইসব মেরে মেরে তোমার বই লেখো। তোমার ওই বইটা আমি পাতা উলটে দেখেছি। কী যেন নাম বইটার, ‘তুফান এক্সপ্রেসে খুন।’ অখাদ্য বই, অখাদ্য লেখা। চুরি বিদ্যে জানতে হয়, তুমি তাও জানো না। তোমার আবার বারো আনা খুন গলায় ফাঁস লাগিয়ে। ওরে গাধা, নাইলন রোপ গলায় ফাঁস লাগিয়ে টানলেই মানুষ মরে না। কার গলা, কেমন গলা দেখতে হবে। একটা দেড়মনি মানুষের গর্দানে ফাঁস লাগাতে হলে কত মোটা, কী স্ট্রেংথ রোপ চাই, বলতে পারো? জানো, এর জন্যে অঙ্ক জানা দরকার। গর্দানের বেড় আর দড়ির স্ট্রেংথ হিসেব করতে হবে। তুমি অঙ্কেতে অক্কা। কেন বুজরুকি করতে চাও হে?”

আমি একেবারে হতভম্ব। ভাগ্যিস সব অন্ধকারের মতন হয়ে আছে, নয়তো আমায় দেখে থেকে অন্যরা হাসত।

অবশ্য আমার দশা আর অন্যদের দশায় তফাত কী? পাঁচু পালিত কাউকেই ছাড়ছে না। এক-একজনকে ধরছে আর কচুকাটা করছে। খগেনবাবু, বটকৃষ্ণ, করালীবাবু কাউকেই রেহাই দিল না সে। মণি সমাদ্দারকে পথে বসালে। ধীরাজ, গৌতমকে নাকানিচোবানি খাওয়ালে। মানে, আমাদের সক্কলকে একেবারে যেন গাঁটরি বেধে আছাড় মারল।

আর ঠিক এই সময় আচমকা শুনি অ্যালার্ম বাজছে। মানে, অ্যালার্ম ঘড়ির ক্রিরিরিং ক্রিরিরিং আওয়াজ। আমরা একেবারে থ। অ্যালার্ম ঘড়ি বাজল কেমন করে? আমাদের সঙ্গে কেন, এ বাড়িতে কোথাও অ্যালার্ম ঘড়ি নেই। ব্যাপারটা কী?

ঘরের মধ্যে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজছে তো বাজছেই। শেষে যখন থামল, তখন গম্ভীর গলায় পাঁচু পালিত বলল, “সময় হয়ে গেছে। আর তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে লাশ পড়বে। বি রেডি।”

কী সর্বনাশ, তা হলে কি ওই ঘড়িটায় টাইম বোমা ফিট করা আছে? আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ।

অন্যদেরও একই অবস্থা।

পালাবার জন্যে উঠেই পড়েছিলাম, হঠাৎ একটা আওয়াজ হল। গুলির আওয়াজের মতন। আলোর চিড়িক মারল একটু। তারপর কী যেন পড়ে গেল মেঝেতে শব্দ করে। নীল কাচের লণ্ঠন ভেঙে চুরমার। টেবিলটাও উলটে গিয়েছে। ঘর অন্ধকার। ঘুটঘুট করছে।

কার লাশ পড়ল? আমার যে নয়, আমি বুঝতে পারছিলাম। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। গলা দিয়ে শব্দ ফুটছে না। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এসেছে।

ঘরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। শুধু একটা বারুদ বারুদ গন্ধ বেরোচ্ছিল।

অনেকক্ষণ পরে করালীবাবুর গলা পেলাম, “হায় ভগবান।”

করালীবাবু তা হলে বেঁচে আছেন। আমি সাড়া দিলাম, “করালীবাবু।”

“অখিলবন্ধু। তুমি আছ। কে গেল তা হলে?”

প্রতুল মুখুজ্যের গলা পাওয়া গেল। বললেন, “আমি আছি।”

একে একে সবাই সাড়া দিতে লাগল। দেখলাম, আমরা সবাই বেঁচে আছি। তা হলে লাশটা কার পড়ল? কেই বা গুলি চালাল। পাঁচুর কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন?

জগদীশ পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বালল। দেখি, বিরাট একটা লাশ মেঝেতে পড়ে আছে। পাঁচু পালিতেরই।

কী সর্বনাশ!

করালীবাবু ‘আলো আনো, আলো আনো’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। আমরা তখন ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। পাঁচু পালিতকে খুন করার দায় যে আমাদের বর্তাবে। হায় ঈশ্বর।

রাখাল আর ভোলা আলো নিয়ে ছুটে এল।

হ্যাঁ, পাঁচু পালিতই মেঝেতে পড়ে আছে। তার ওভারকোটের বোতাম খোলা। একটা অ্যালার্ম ঘড়ি তার বুকের কাছে ঝুলছে। দড়ি দিয়ে বেঁধে গলায় ঝুলিয়েছিল। ডান হাতে একটা পিস্তল।

আশ্চর্য, কোথাও কোনও রক্তের দাগ নেই। কপালে না, গলায় না, মাথায় নয়।

তা হলে?

করালীবাবু ভয়ে ভয়ে বসে পড়ে পাঁচুর নাড়ি দেখতে লাগলেন, বললেন, “ব্যাটা বেঁচে আছে।”

জগদীশ পাকা গোয়েন্দার মতন পকেট থেকে রুমাল বার করে পাঁচুর পিস্তলটা হাত থেকে টেনে নিল। দেখল ভাল করে। তারপর বলল, “করালীদা, এটা থিয়েটার-যাত্রার পিস্তল। দেখুন। টোটা লাগিয়ে ঘোড়া টেপে।”

আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম পিস্তল দেখতে।

আর তখন পাঁচু তার বাঁ হাত তুলে মুঠোয় রাখা কাগজটা এগিয়ে দিল।

আমিই নিলাম কাগজটা। দেখলাম। লেখা আছে, ‘মফসসলের এক গোয়েন্দা-লেখকের কেরামতি দেখালাম। পি, পি.।’

১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭

ছবি: দেবাশিস দেব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *