গোয়েন্দার নাম গোগো – গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু
মেজাজটা রীতিমতন খারাপ হয়ে রয়েছে গোগো-র।
তার ছোটকাকার সঙ্গে কতখানিই বা বয়সের তফাত গোগো-র? তবু যেহেতু ছোটকা কলেজে পড়ে, কলেজের দলের সঙ্গে একা দার্জিলিং বেড়াতে গেছে। আর গোগো? যেহেতু স্কুলের চৌকাঠ পেরুতে এখনও তার দু’ বছর বাকি, অতএব কলকাতার ভ্যাপসা গরমে পচছে। একা হাওড়া ঘুরে আসার অধিকার পর্যন্ত তার নেই। তা হলেই হইচই পড়ে যাবে বাড়িতে। শুধু রোদে ঘামতে ঘামতে রোজ স্কুলে যাও আর ফিরে এসো। ফিরে এসে ছোটকার চিঠিতে পড়ো, দার্জিলিঙে আ-হ, কীরকম ঠান্ডা! টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য কী ম্যাগনিফিশেন্ট। তেনজিং নোরকের সঙ্গে কীভাবে আলাপ করেছে ছোটকা, আর সেই আলাপে তেনজিং নোরকে এতই ইমপ্রেসড যে নিজে পাহাড়ে-চড়া শেখাতে চেয়েছে ছোটকাকে!
শুধু ওই সবই যদি লিখত ছোটকা তবু সহ্য হত! গোগোর মনের ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে সেই সঙ্গে প্রতি চিঠিতে একা একা কোনও গোয়েন্দাগিরি না-করতে যদি না উপদেশ দিত! গোগো যেহেতু স্কুলে পড়ে অতএব ছেলেমানুষ, অতএব একা কোথায় কোন বিপদে পড়ে যাবে বলে সাবধান না-করত।
ছোটকার এই সাবধানতা কী জন্যে সেটা অবশ্য গোগো বোঝে। না-বোঝার মতন বোকা বা খোকা সে নয়। ছোটকা ছাড়াই একটা কোনও রহস্যের কিনারা যদি গোগো করে ফেলে, সেইটাই আসলে ভয় ছোটকার। তা হলে ছোটকার আর মুখ থাকবে না কারুর কাছে। আর স্কুলে পড়ে অতএব ছেলেমানুষ বলে গোগোর উপর হামবড়াইও বন্ধ হয়ে যাবে।
আর ভগবানও তেমনি। গোগোর বাড়ির লোকজনদের মতনই ইস্কুলে-পড়া ছেলেদের প্রতি সমান অবুঝ আর নিষ্ঠুর। নইলে ছোটকা দার্জিলিঙে থাকতে থাকতে তেমন একটা গভীর রহস্যময় ঘটনা কি ঘটতে পারে না যা গোগো অক্লেশে সমাধান করে ফেলতে পারে! স্কুলে যাতায়াতের পথে কিংবা বিকেলে যখন গোগোর খেলার ছুটি—সেই সময়ের মধ্যে! অন্য সময় তো আর বাড়ি থেকে তার বেরুনোর উপায় নেই! হে ভগবান, তুমি তো সব পারো! দাও না একটা তেমন রহস্যের ব্যবস্থা করে! তেনজিং নোরকের কাছে পাহাড়ে-চড়া শেখার মজাটা তা হলে বেরিয়ে যায় ছোটকার।
কী করে বুঝি কথাটা ভগবানের কানে পৌঁছেছিল। আর শুধু তেমন একটা রহস্যের ব্যবস্থা নয় সেই সঙ্গে হঠাৎ একটা ছুটির দিনের ব্যবস্থা এবং কারুকে কোনও কৈফিয়ত না দিয়ে অসময়ে বাড়ি থেকে গোগোর বুক ফুলিয়ে বেরুনোর ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়ে গেল।
হঠাৎ ছুটির ব্যবস্থাটা হয়ে গেল মহাবীরের আড়াই হাজারতম জন্মদিন উপলক্ষে। তা ছুটি তো কী? স্কুলেই শুধু যেতে হবে না, সকালবেলায় পড়া থেকে তো আর গোগোর ছুটি নেই। সকালের জলখাবার খেয়ে গোগো উঠে তাই চারতলায় তার পড়ার ঘরে যাচ্ছিল সিঁড়িতে মেজকার সঙ্গে দেখা। তাড়াহুড়ো করে মেজকা কোথায় যেন বেরুচ্ছেন, গোগোকে দেখে সিঁড়ি জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আর কী যেন ভাবতে লাগলেন গোগোর মুখের দিকে তাকিয়ে।
হাইকোর্টের নামজাদা উকিল মেজকা। কী হল, কী ঘটল হঠাৎ তাঁর গোগোর মুখের দিকে ওভাবে তাকিয়ে ভাববার?
ভেবে কী যেন স্থির করলেন মেজকা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ তো তোর স্কুল ছুটি?’
গোগো ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘তবে চট করে জামা পরে আয়। আমার সঙ্গে যাবি এক জায়গায়।’
‘কোথায়?’ অনেকটা ঢোক গিলে গোগো বলল, ‘মানে, কীরকম জামাকাপড় পরব?’
‘আমার এক মক্কেলের বাড়ি। একটা রহস্যময় চুরি হয়েছে সেখানে। ছোটুটা থাকলে ওকেই নিয়ে যেতাম। যা, চটপট কর।’
কী শুনছে গোগো? ঠিক শুনছে তো কানে। ছোট্টু মানে ছোটকা আর গোগো মিলে গোয়েন্দাগিরি করে বেড়ায়, মেজকা সেটা জানে। আর সেই সঙ্গে যেটা মেজকা ভাবে সেটা হল সেইসব গোয়েন্দাগিরির আসল কৃতিত্ব ছোটকার। ধারণাটা যে কত ভুল, সেটা যদি আজ গোগো প্রমাণ করে দিতে পারে! হে ভগবান, আমার কথা যখন শুনেছ, ছোটকা না- থাকার সময় একটা রহস্যের ব্যবস্থা যখন করেইছ তখন বাকিটা মানে সমাধানের ব্যবস্থাটাও কোরো।
মেজকা গাড়িতে গিয়ে বসেছিলেন। গোগো গিয়ে পাশে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। মেজকা বলেন, ‘ঘটনাটা এখন পর্যন্ত আমি যেটুকু জানি, মানে মি. বিলমোরিয়া ফোনে যেটুকু বললেন, শুনে নে। বাকিটা ওঁর কাছে গিয়ে শুনবি।’
‘মি. বিলমোরিয়া, মানে পার্শি?’
‘হ্যাঁ। কলকাতা শহরের একজন বড় হিরের ব্যাবসাদার। কাল সন্ধেবেলা ওঁর একজন পুরনো খদ্দের একটা হিরে যাচাই করার জন্যে ওঁর বাড়িতে নিয়ে আসে—’
‘বাড়িতে কেন? ওঁর দোকান নেই?’
‘আছে। বেশ বড় দোকান। আমি সেই দোকানে অনেকবার গিয়েছি। খদ্দেরটির বাড়িতে আসার কারণ দোকান তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আজও আবার বন্ধ। অথচ আগামীকাল সকালে খদ্দেরটি আবার বম্বে চলে যাবে বিশেষ কাজে। তাই খদ্দেরটিকে বাড়িতে আসতে বলেছিলেন মি. বিলমোরিয়া। তারপর যথাসময়ে খদ্দেরটি এসেছিল, হিরেটি দেখিয়েছিল। হিরেটি মাপে খুব বড় নয় কিন্তু এত ভাল জাতের যে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাম হবে। তবে সেরকম দাম কবুল করার আগে মি. বিলমোরিয়া হিরেটিকে আরও ভাল করে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তাই খদ্দেরটিকে বলেছিলেন হিরেটি তাঁর কাছে রেখে যেতে আর আজ সকাল দশটায় আসতে।’
“তারপর?”
‘রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মিসেস বিলমোরিয়া শুয়ে পড়েন আর সেই ঘরে বসেই মি. বিলমোরিয়া ঘুমোবার আগে হিরেটি আবার পরীক্ষা করতে বসেন। পরীক্ষা করে বোঝেন হিরেটি এত ভাল যে সত্তর হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া চলে। তারপর হিরেটি লোহার আলমারিতে তুলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখেন মিসেস বিলমোরিয়া যথারীতি নীচে কিচেনে নেমে গেছেন। তারপর রোজকার অভ্যেসমতন মি. বিলমোরিয়া বাথরুমে যান এবং বাথরুম থেকে তাঁর লোহার আলমারি খোলার আওয়াজ পান। যেহেতু মিসেস বিলমোরিয়ার তখন উপরে উঠে আসার কথা নয়, তাই মি. বিলমোরিয়া সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসেন আর দেখেন আলমারি খোলা, হিরের কৌটোটি উধাও। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসেন কিন্তু কাউকে দেখতে পান না। ওঁর তিন ভাইপো ওঁর সঙ্গে থাকে, তাদের ঘরে গিয়ে দেখেন তারা তিনজনই ঘরে রয়েছে—’
‘মিসেস বিলমোরিয়া আর ওই তিন ভাইপো ছাড়া আর কে থাকে বাড়িতে?’
‘বেয়ারা, খানসামা, ড্রাইভার। পুরনো বিশ্বাসী লোক তিনজনই। তার মধ্যে ড্রাইভার সেই সময়ে বাজারে গিয়েছিল আর খানসামা আর চাকর নীচে কিচেনে তাঁর কাছে ছিল বলে মিসেস বিলমোরিয়া বলছেন।’
‘ওই ক’জন ছাড়া আর বাড়িতে কেউ ছিল না?’
‘না। একটি মাত্র মেয়ে রয়েছে মি. বিলমোরিয়ার। বিয়ে হয়ে বম্বেতে থাকে।’
‘সন্দেহটা তাই তিন ভাইপোর উপর?’
‘হ্যাঁ। যতদূর মি. বিলমোরিয়ার কাছে শুনেছি, লোক তিনজনের কেউই সুবিধের নয়। তিনজনের একজনকেও মি. বিলমোরিয়া দেখতে পারেন না। মি. বিলমোরিয়া অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ পার্শি। কিন্তু তিন ভাইপোই চেন স্মোকার। অথচ পার্শিদের দেবতা হল আগুন— তাই ধূমপান একটা মস্ত অপরাধ।’
গোগো জানত না ব্যাপারটা, অবাক হয়ে শুনল। তারপর কোনও প্রশ্ন করার আগেই দেখল গাড়িটা একটা বাগানওয়ালা বাড়ির মধ্যে ঢুকছে। তাড়াতাড়ি মেজকাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পুলিশে খবর দিয়েছেন মি. বিলমোরিয়া?’
‘এখনও দেননি। তবে ব্যাপারটা তো এখনও ঘণ্টাখানেকের বেশি হয়নি। পুলিশে খবর দেবার সময় যায়নি। মি. বিলমোরিয়ার যেটা বড় চিন্তা এখন সেটা হল দশটার সময় সেই খদ্দের তাঁর হিরে ফেরত নিতে এলে তিনি কী করবেন। আর সেই পরামর্শের জন্যই আমাকে ফোন করেছেন।’
মেজকার আসার খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতেই বুঝি নীচে নেমে এলেন মি. বিলমোরিয়া। ষাটের উপর বয়েস, শুকনো চেহারা। আরও বেশি শুকিয়ে গিয়েছেন বোধহয় এই চুরির ঘটনায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বসার ঘরে ঢুকলেন আর তারপর চেয়ারে বসে মেজকাকে বললেন, ‘যাক, আপনি এসে গিয়েছেন। এবারে বলুন মি. মুখার্জি, আমি কী করব?’
মেজকা বললেন, ‘বলছি। তার আগে আমার ভাইপো গোগো-র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেই।’
মি. বিলমোরিয়া সখেদে বললেন, ‘বেচারাকে আজ কেন আনলেন? অন্য একদিন আনলে ওকে আমি অনেক হিরের গল্প শোনাতে পারতাম। তা, এনেছেন যখন, ও তখন বরঞ্চ একটু গিয়ে বাগানের ফুল দেখুক।’
মেজকা বললেন, ‘না, এখানেই বসুক। হ্যাঁ, আপনি কী করবেন আমায় জিজ্ঞেস করছিলেন—’
‘হ্যাঁ। বলুন, আমার সেই খদ্দেরের আসার সময় হয়ে এল। কী বলব তাকে?’
‘হিরেটা যদি ফেরত দিতে পারেন তা হলে কী বলবেন সেটা নিশ্চয়ই আমাকে জিজ্ঞেস করছেন না—’
‘না। কিন্তু হিরেটা ফেরত দিচ্ছি কোত্থেকে?’
‘চুরির ঘটনার পর আপনার বাড়ি থেকে কেউ কি বাইরে গিয়েছে?’
‘না। আমার মেজভাইপো রুসি বেরুতে যাচ্ছিল, আমি বেরুতে দেইনি।’
‘তা হলে যে-ই চুরি করে থাকুক, হিরেটা এখনও এই বাড়িতেই আছে। আপনার আলমারি থেকে খোয়া গেলেও বাড়ি থেকে খোয়া যায়নি।’
শুনে মি, বিলমোরিয়া উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আমি কি সেটা ভাবিনি মনে করছেন? এতক্ষণ হোমি, রুসি আর জাল— আমার তিন ভাইপোর ঘর আমি তন্নতন্ন করে তল্লাশ করছিলাম—জানেন?’
মেজকা হেসে বললেন, ‘শুধু তাঁদের ঘর নয়, সেইসঙ্গে তাদের শরীরও যে তন্নতন্ন করেছেন, বুঝতে পারছি। আরও বুঝতে পারছি— ফল তাতে কিছু হয়নি। কেননা, যে-ই হিরেটা চুরি করে থাকুক, ধরা পড়ার জন্যে নিজের ঘরে বা কাছে কখনই সে রাখবে না।’
মি. বিলমোরিয়া অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘তা হলে কোথায় রাখতে পারে আমায় বলুন? আমি আবার খুঁজে দেখি—’
মেজকা বললেন, ‘তার আগে হিরের সাইজটা আমাকে একটা কাগজে এঁকে দেখান।’
সঙ্গে সঙ্গে টেবিল থেকে কাগজ কলম নিয়ে মি. বিলমোরিয়া এঁকে ফেললেন। মেজকার হাতে কাগজটা দিতে গোগো ঝুঁকে দেখল— আকারে একটা মটরদানার মতন। কাগজটা দেখতে দেখতে মেজকা বললেন, ‘এবার বলুন, ওই হিরেটি যে কাল রাতের জন্যে আপনার কাছে থাকছে, এ-কথা আপনি ছাড়া আর কে কে জানত?
মি, বিলমোরিয়া বললেন, ‘রাতে খেতে বসার আগে ড্রয়িংরুমে বসে হিরেটি আমার স্ত্রীকে আমি যখন দেখাই আমার তিন ভাইপোই সেখানে উপস্থিত ছিল।’
‘চাকরবাকরদের কেউ তখন ঘরে এসেছিল?’
‘না।’
‘অর্থাৎ আপনাকে ও আপনার স্ত্রীকে বাদ দিলে মোট তিনজন— আপনার তিন ভাইপো শুধু জানত যে হিরেটি রাতে বাড়িতে থাকছে।’
‘হ্যাঁ’
গোগো মনে মনে মাথা নেড়ে বলল, তিনজন নয়া, চারজন। যে খদ্দের হিরেটি দিয়ে গিয়েছিল, খবরটা সে-ও জানত!
মেজকা আবার প্রশ্ন শুরু করলেন, ‘আপনার ভাইপোদের তিনজনেরই নিশ্চয় হিরে-জহরত সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান রয়েছে?’
মি. বিলমোরিয়া জবাব দিলেন, ‘কিছু তো থাকার কথা। একসময় তিনজনই আমার সঙ্গে দোকানে বেরুত।’
‘এখন আর বের হয় না?’
‘না, এ-ব্যবসায়ে তিনজনের কারুরই কোনও উৎসাহ নেই দেখে আমি ওদের অন্য কাজকর্ম দেখতে বলে দিয়েছি। প্রত্যেককে টাকাও দিয়েছি সেইজন্যে।
‘কী করে এখন তারা?’
‘বড় ভাইপো হোমি সেই টাকা নিয়ে একটা হোটেল খুলেছিল, চলেনি। আবার টাকা চাইছে আমার কাছে অন্য ব্যাবসা করবে বলে।’
‘মেজো ভাইপো রুসি?’
‘সে টাকা নিয়ে বম্বে গিয়েছিল সিনেমা তুলতে। সব টাকা খুইয়ে তারপর ফিরে এসে বাড়িতে বসে আছে।’
‘আর টাকা চায়নি?’
‘না। হোমিকে দেইনি দেখেই বোধহয় চায়নি।’
‘আর ছোটজন? যার নাম জাল?’
‘সে টাকা নিয়ে সোজা ইংল্যান্ডে চলে গেল। কী করল সেখানে জানি না। তারপর বছরখানেক হল ফিরে এসে আবার টাকা চাইছে জাপানে গিয়ে মোটরগাড়ি তৈরি শিখবে বলে।’
‘অর্থাৎ, তিনজনেরই টাকার খুব প্রয়োজন।’
‘হ্যাঁ।’
গোগো মনে মনে বলল, টাকার প্রয়োজন সকলেরই। যার আছে, যার নেই—দু’জনেরই। তবে অসাধু যে সেই শুধু চেষ্টা করে চুরি, বাটপাড়ি করবার।
মেজকা আবার আরেক দফা প্রশ্ন শুরু করলেন, ‘আচ্ছা, হিরেটি আলমারি থেকে উধাও দেখেই তো আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে তখনই তিন ভাইপোর ঘরে গিয়েছিলেন?
‘হ্যাঁ।
‘গিয়ে কাকে কী অবস্থায় দেখলেন?’
‘প্রথমে গিয়েছিলাম জাল-এর ঘরে। গিয়ে দেখলাম সে ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়ছে আর হাতে সদ্য-ধরানো একটা সিগারেট জ্বলছে। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি সেটা বইয়ের আড়ালে লুকোল।’
‘তারপর কার ঘরে গেলেন?’
‘তারপর মেজো ভাইপো রুসির ঘরে। সে দেখলাম তার তামাক খাওয়ার পাইপটা পরিষ্কার করে তাতে তামাক ভরছে। আমাকে দেখে পাইপটা তাড়াতাড়ি পকেটে পুরে ফেলল।’
‘তারপর বড় ভাইপোর ঘরে গিয়ে কী দেখলেন?’
‘সামনে খালি চায়ের কাপ আর হাতে খবরের কাগজ, মুখে চুরুট। দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে জানলার কাছে বসে ছিল সে। আমার পায়ের শব্দে মুখ ঘুরিয়ে আমাকে দেখে শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল আর চুরুটটা ফেলে দিল তাড়াতাড়ি জানলা দিয়ে।’
মনের মধ্যে হিসেব টুকে নিল গোগো— তিন ভাই ধূমপান করে। বড় হোমি—চুরুট, মেজো রুসি পাইপ, ছোট জাল—সিগারেট। তারপর মেজকা-কে ফিসফিস করে বলল, ‘কোন ঘরের কোন আলমারি থেকে চুরি গেছে সেটা একবার দেখা দরকার।’
মি. বিলমোরিয়ার কান খুবই সতর্ক। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বলছে আপনার ভাইপো?’
মেজকা হেসে বললেন, ‘খুব ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ে তো। তাই বলছে, কোন জায়গা থেকে চুরি হয়েছে সেটা দেখা দরকার। তা, কথাটা ঠিকই বলেছে। চলুন, জায়গাটা দেখি—’
মি. বিলমেরিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে গোগোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভেরি ব্রাইট বয়’, তারপর মেজকাকে বললেন, ‘চলুন—’
মি. বিলমোরিয়ার পিছন পিছন তার বাংলো প্যাটার্নের দোতলা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সিঁড়ির দু’পাশে সাজানো ফুলের টবগুলি লক্ষ করল গোগো। ওই মটরদানা মাপের একটা হিরে কত সহজেই না এই ফুলের টবগুলির মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়। কিংবা বাইরের বাগানে অত যে ফুলের গাছ, তার যে-কোনও একটার তলার মাটি খুঁড়ে। যে লুকোবে, তার নিশানা তাতে ঠিকই থাকবে কিন্তু অন্যের পক্ষে খুঁজে পেতে হলে সবগুলি টব বা গাছের গোড়া খুঁড়ে দেখতে হবে।
সিঁড়ির শেষে দোতলায় প্রথমে একটা ল্যান্ডিং বা ঢাকা জায়গা। তারপর একটা করিডোর আর সেই করিডোরের দু’পাশে পরপর ঘর। মি. বিলমোরিয়া হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘বাঁদিকের প্রথম ঘরটা আমার বেডরুম যেখান থেকে আজ ভোরে হিরেটি খোয়া গেছে।’
মেজকা বললেন, ‘ডানদিকের প্রথম ঘরটায় কে থাকে?’
‘কেউ না—ওটা ড্রয়িংরুম।’
‘আপনার ছোট ভাইপো জাল কোনটায় থাকে?’
‘ড্রয়িংরুমের পর ডানদিকের দ্বিতীয় ঘরটায়। তারপর তৃতীয় বা শেষ ঘরটায় রুসি।’
‘আর বড় ভাইপো হোমি?’
‘বাঁদিকের শেষ ঘরটায় অর্থাৎ রুসির উলটোদিকে।’
‘আর বাঁদিকের দ্বিতীয় ঘরটায়? মানে, আপনার আর হোমির ঘরের মাঝখানের ঘরটায়?’
‘জাল-এর ঘরের উলটোদিকে ওটা ডাইনিং রুম। ওই ঘরটা থেকেই দরজা রয়েছে ওপাশের খোলা ছাদ বা বারান্দায় যাবার।’
অর্থাৎ, গোগো মনে মনে হিসেব করে নিল, যে গাড়ি-বারান্দার তলায় এসে ওরা গাড়ি থেকে নেমেছিল, তারই উপরের বারান্দা।
‘এক সেকেন্ড দাঁড়ান!’ বলে মি. বিলমোরিয়া পরদা সরিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে গেলেন। একটু পরেই আবার বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আসুন।’
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই একজন প্রৌঢ়া মহিলা গুড মর্নিং বলে অভ্যর্থনা জানালেন। মি. বিলমোরিয়া আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘আমার স্ত্রী। আর ইনি আমাদের লইয়ার মি. মুখার্জি। সঙ্গে ব্রাইট ছেলেটি মি. মুখার্জির ভাইপো।’
স্বামীর কাছাকাছি বয়েস মিসেস বিলমোরিয়ার। তবে চেহারা অত শুকনো নয়। মেজকাকে বললেন, ‘যাক, আপনি এসে গেছেন। সকাল থেকে ওকে বলছি পুলিশে খবর দিতে, তা ও বলছে আপনি এলে পর পরামর্শ করে যা করার করবে।’
মেজকা বললেন, ‘হ্যাঁ, আগে ব্যাপারটা একবার নিজেরা আমরা বুঝেনি।’
মিসেস বিলমোরিয়া বললেন, ‘যাই, ততক্ষণ আমি আপনাদের জন্যে একটু চায়ের ব্যবস্থা করিগে।’
মিসেস বিলমোরিয়া চলে গেলেন। ইতিমধ্যে গোগো ঘরটা ভাল করে দেখে নিয়েছে, এঁকে নিয়েছে মনে।
প্রথমে জানলা-দরজা। ঘরের দরজা দুটো। একটা যেটা দিয়ে তারা ঘরে ঢুকেছে এবং মিসেস বিলমোরিয়া বেরিয়ে গেলেন। অন্য দরজাটা ঘরের বাঁদিকে—নিশ্চয়ই বাথরুমের, সেখান থেকে তাঁর আলমারি খোলার আওয়াজ পেয়েছিলেন মি. বিলমোরিয়া। জানলাও ঘরের দুটো—একদিকে। ঘরে ঢোকার দরজার উলটোদিকে গাড়ি-বারান্দার দিকে।
তারপর আসবাব। জোড়াখাট পাতা রয়েছে ঘরের মাঝখানে। বাঁদিকের দেওয়ালে ড্রেসিং টেবিল। জানলা দুটোর গায়ে ডিভান, ডানদিকের দেওয়ালে ওয়ার্ডরোব আর স্টিলের একটা আলমারি জানলার উলটোদিকের দেওয়ালে, ঘরে ঢোকার দরজার ডানপাশে। আলমারিটার পাল্লা খোলা অর্থাৎ মি. বিলমোরিয়ার, যেটা থেকে হিরেটি খোয়া গেছে। শুধু তাই নয়, কাল রাতে যখন মি. বিলমোরিয়া ওই আলমারিতে হিরেটি তুলে রাখছেন তখন জানলার বাইরে অন্ধকার গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে-কেউ সে-দৃশ্য দেখে থাকতে পারে। যে-কেউ বলতে তাঁর ভাইপোদের যে-কেউ।
মি. বিলমোরিয়ার সঙ্গে গিয়ে মেজকা পাল্লা খোলা স্টিলের আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। গোগো লক্ষ করল— জামাকাপড় আর জিনিসে ঠাসা। মেজকা সেগুলি দেখতে দেখতে বললেন, ‘চুরির পর আলমারি আর বন্ধ করেননি দেখছি—’
মি. বিলমোরিয়া বললেন, ‘আমার স্ত্রী বলেছেন পুলিশ না-আসা পর্যন্ত যা যেমন রয়েছে তেমনি রেখে দিতে।’
‘ঠিকই বলেছেন। আচ্ছা, এই আলমারিতে দামি জিনিস মানে হিরেজহরত আর কিছু ছিল?’
‘না। আমার ব্যাবসা কীসের, এ-পাড়ার সবাই জানে। যা দিনকাল, বাড়িতে কখনও ওসব আনি না। কালকের ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল।’
‘হিরেটি কোথায় রেখেছিলেন?’
‘দ্বিতীয় তাকে—’ মি. বিলমোরিয়া আঙুল দিয়ে দেখালেন, ‘বাঁদিকে ওই জামাকাপড়ের ভাঁজে।’
‘ওইখানেই কি আপনি সাধারণত টাকাকড়ি বা প্রয়োজন পড়লে দামি জিনিসপত্তর রাখেন?’
‘না, তার কোনও ঠিক নেই। ওই দেখুন না, আমার মানি-ব্যাগটা উপরের তাকে একেবারে চোখের সামনে রাখা রয়েছে।’
‘ব্যাগটা তো নেয়নি দেখছি। কত টাকা ছিল আপনার ব্যাগে?’
‘চারশো মতন—’
‘আর কোনও টাকা রয়েছে কোথাও?’
‘না।’
আলমারিতে গোগোর যা দেখবার, দেখা হয়ে গিয়েছিল। ফিসফিস করে মেজকাকে বলল, ‘ওই গাড়ি-বারান্দায় গিয়ে জানলাদুটোর বাইরেটা একবার দেখা দরকার।’
ভুরু কুঁচকে মেজকা বললেন, ‘কেন?’
‘বেশ তো। চলুন না—’
মি. বিলমোরিয়ার পিছন পিছন ঘর থেকে বেরিয়ে এল গোগো আর মেজকা। তারপর করিডোর ধরে এগিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকল। ঢোকার আগে ডানদিকের ঘরের দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিল গোগো। পরদার ফাঁক দিয়ে দেখল ইজিচেয়ারে বসে রয়েছে একজন যুবক মানে জাল। হাতে বই কিন্তু চোখ বইতে নয়। তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে গোগোদের দিকে।
ডাইনিং রুমের অন্য দরজা দিয়ে গাড়ি-বারান্দায় বেরিয়ে এসে গোগো লক্ষ করল গাড়ি-বারান্দায় যাতায়াতের দরজা শুধু ওইটাই। মি.বিলমোরিয়ার ঘরের মতন অন্য ঘরগুলিরও শুধু দুটো করে জানলা রয়েছে গাড়ি-বারান্দার দিকে।
মি. বিলমোরিয়ার ঘরের জানলা দুটোর কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল গোগো—একটা পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি পড়ে রয়েছে একটা জানলার কাছে। নিচু হয়ে কাঠিটা তুলে নিল গোগো। তারপর যা করল, হাঁ করে তা দেখতে লাগলেন মেজকা আর মি. বিলমোরিয়া।
পকেট থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে সেই জায়গার মেঝেটা পরীক্ষা করতে লাগল গোগো। হামাগুড়ি দিয়ে ওই জানলার পাশের মেঝের প্রতিটি ইঞ্চি। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়াল।
মেজকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু পেলি?’
গোগো হাসিমুখে বলল, ‘না। চলো, আমার কাজ হয়ে গিয়েছে।’
‘কিছুই তো পেলি না, বলছিস—’
‘এই পোড়া দেশলাইয়ের কাঠিটা পেয়েছি—আর কিছু নয়।’
মিসেস বিলমোরিয়া চা সাজিয়ে বসে ছিলেন ড্রয়িংরুমে। আর সকলের জন্যে চা, গোগোর জন্যে কোকো। সেই কোকোর কাপে একটা চুমুক দিয়ে গোগো মি. আর মিসেস বিলমোরিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ বা কাল, আপনাদের দু’জনের মধ্যে কেউ কি ধূপ বা কোনও কিছু জ্বালিয়ে একটা দেশলাইয়ের কাঠি আপনাদের ঘরের জানলার বাইরে ফেলেছেন?’
মি. বিলমোরিয়া বললেন, ‘আমি ফেলিনি।’
মিসেস বললেন, ‘আমিও না। কেন?’
গোগো বলল, ‘আপনাদের ঘর যেরকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তাতে ওরকম অভ্যেস আপনাদের থাকার কথা নয়। তবু সাবধানের মার নেই। যাক, হিরেটি তা হলে কে চুরি করেছে সেটা জানা গেল।’
মেজকা বললেন, ‘বলিস কী? কে?’
মি. বিলমোরিয়া উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কে? শিগগির বলো—’
মিসেস বিলমোরিয়া হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন গোগোর মুখের দিকে।
গোগো বলল, ‘হিরেটি চুরি হয়েছে খুবই তাড়াতাড়ি, কেননা আলমারি খোলার আওয়াজ পেয়েই মি. বিলমোরিয়া বেরিয়ে এসেছিলেন। অত অল্পসময়ের মধ্যে ওই আলমারি ঘেঁটে চোরের পক্ষে হিরেটি খুঁজে পাওয়া কখনই সম্ভব হত না যদি হিরেটি আলমারির কোন তাকে কোথায় রাখা রয়েছে সেটা চোরের আগে থেকে দেখা না থাকত।’
মেজকা ঘাড় ঝুঁকিয়ে সায় দিলেন। মি. বিলমোরিয়া বললেন, ‘রাইট।’ মিসেস বিলমোরিয়া হাঁ করে শুনতে লাগলেন।
কোকোর কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে নিয়ে গোগো বলতে শুরু করল, ‘মি. বিলমোরিয়া আলমারিতে হিরেটি তুলে রেখেছিলেন কাল রাতে। কোন তাকে, কোথায় সেটা তার আগে কারু পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আলমারি বন্ধ হওয়ার পরেও নয়। দেখতে হলে চোরকে সেইসময়ে অর্থাৎ হিরেটি রাখার সময়ে দেখতে হয়। আর, দরজা বন্ধ ঘরে সেই দৃশ্য তাকে দেখতে হলে দেখতে হয় জানলার বাইরে ওই গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলে তাকে দেখতে পাচ্ছে না কেউ।’
আবার সায় দিলেন মেজকা। মি. বিলমোরিয়া আবার বললেন, ‘রাইট।’ মিসেস বিলমোরিয়া আরও হাঁ করে শুনতে লাগলেন।
গোগো আবার বলতে শুরু করল, ‘মি. বিলমোরিয়া হিরেটি কোথায় রাখেন সেটা দেখার জন্যে চোরকে ওইখানে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল আর সে-সময়ে সে যে ধূমপান করেছিল, এই পোড়া দেশলাইয়ের কাঠিটাই তার প্রমাণ। এই কাঠিটা ওইখানে পড়ে থাকার অন্য কোনও কারণ নেই। অর্থাৎ, চোর ধূমপান করে এবং সে আপনার একজন ভাইপো।’
মি. বিলমোরিয়া একটু হতাশ হয়ে বললেন, ‘আমার ভাইপোদের একজন সে তো আমি গোড়া থেকেই জানি। কিন্তু কোন জন?’
গোগো হেসে বলল, ‘জানলার বাইরে শুধু এই পোড়াকাঠিটা পাওয়া গেছে, আর কিছু নয়। তাতেও কি আপনি বুঝতে পারছেন না তিনজনের কোন জন?’
মি. বিলমোরিয়া বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী করে বুঝব?’
‘আপনার ভাইপোদের মধ্যে একজন চুরুট খায় আপনি জানেন?’
‘হোমি খায়। তাতে কী?’
‘অন্য একজন পাইপ খায়?’
‘সে রুসি। তাতেই বা কী?’
‘আরেকজন সিগারেট খায়?’
‘জাল। তাতেই বা কী হচ্ছে?’
হতাশ হয়ে মেজকার দিকে তাকাল গোগো। মেজকা-ও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন। মিসেস বিলমোরিয়া অবাক বিস্ময়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন গোগোর মুখের দিকে।
গোগো হেসে বলল, ‘তবে শুনুন—চোর আপনার যে ভাইপো পাইপ টানেন, তিনি। অন্য দু’জনের একজন চুরুট খান, অন্যজন সিগারেট। তারা হলে কিছু ছাইও পাওয়া যেত জানলার বাইরে। সে-ছাই এমনি চোখে দেখা না গেলেও আমার ম্যাগনিফাইং গ্লাসে নিশ্চয় কিছুটা দেখা যেত। গুঁড়ো ছাই এমনকী ছাই রঙের কিছুটা ধুলো নিশ্চয়ই জানলার বাইরে যেখানে পোড়া কাঠিটা পড়ে ছিল, তার আশপাশে আমি দেখতে পেতাম। একমাত্র চোর যদি পাইপ খায় তা হলে সেরকম কিছু না পাওয়া সম্ভব।’
মি. বিলমোরিয়া উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ‘রাইট। তার মানে রুসি৷’ আর বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ছুটে যেতে চাইলেন রুসির ঘরে।
গোগো বলল, ‘দাঁড়ান। চোর যে আপনার পাইপ-টানা ভাইপো রুসি তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু তাকে গিয়ে বললেই বা ধমকালেই কি সে অপরাধ স্বীকার করবে, হিরেটি ফেরত দেবে?’
মি. বিলমোরিয়া গর্জে উঠলেন, ‘আমি ওকে পুলিশে দেব।’
গোগো হেসে বলল, ‘তা যদি পারতেন তা হলে আমার কাকাকে না ডেকে আপনার স্ত্রীর কথামতন প্রথমেই পুলিশ ডাকতেন।’
মি. বিলমোরিয়া যেন নিভে গেলেন। চুপসে বসে পড়লেন চেয়ারে।
গোগো জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার পুলিশ না-ডাকার কারণটা কি আমি বলব?’
মি. বিলমোরিয়া কোনও উত্তর দিলেন না। মিসেস বিলমোরিয়া সাগ্রহে বললেন, ‘বলো, আমি জানতে চাই।’
‘মি. বিলমোরিয়া যদি তাঁর খদ্দেরের ওই হিরেটা স্মাগল্ড বা চোরাই নয় বলে নিশ্চিত থাকতেন, তা হলে পুলিশে খবর দিতেন প্রথম।’
শুনে চোখ বুজে ফেললেন মি. বিলমোরিয়া, হাঁ হয়ে গেল আবার মিসেস বিলমোরিয়ার মুখ। সেই সঙ্গে কিছুটা বুঝি মেজকারও।
গোগো বলল, ‘কী হল, মি. বিলমোরিয়া? যান, গিয়ে হিরেটি নিয়ে আসুন রুসিসাহেবের ঘর থেকে। কোথায় লুকনো রয়েছে আমি বলে দিচ্ছি—’
শোনামাত্র ফট করে চোখ খুলে গেল আবার মি. বিলমোরিয়ার। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রেখেছে?’
‘ওর তামাক খাওয়ার ওই পাইপের মধ্যে। ওই কারণেই আপনি চুরির পর তার ঘরে গিয়ে তার পাইপ পরিষ্কার করে তাতে তামাক ভরতে দেখেছিলেন। অত তাড়াতাড়ি হিরেটি লুকিয়ে রাখার মতন অত ভাল জায়গা আর কী হতে পারে, আপনিই বলুন না।’
মি. বিলমোরিয়া ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে দুরদুর করতে শুরু করল গোগোর বুক। চোখ বুজে একমনে প্রার্থনা করতে শুরু করল গোগো, হে ভগবান, হিসেবটা যেন শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় আমার। আসলে না-হলেও তুমি ঠিক করে দিয়ো—এতটাই যখন এ-পর্যন্ত করেছ!’
যেমন গিয়েছিলেন, তেমনি ছুটতে ছুটতে ফিরে এলেন মি. বিলমোরিয়া। তাঁর একহাতে প্যাঁচ-খোলা একটা পাইপের দুটো অংশ, অন্য হাতের দু’আঙুলে ধরা মটরদানার মতন একটা হিরে। গোগোর মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার কী যেন বলার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি, শেষ পর্যন্ত পারলেন না। এগিয়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন গোগোকে।
তারপর মি. বিলমোরিয়া ছাড়েন তো মিসেস বিলমোরিয়া! তিনি ছাড়েন তো বাড়ির অমন গম্ভীরমুখে ঘুরে বেড়ানো মেজকা!
আর তারপরই বেয়ারা এসে জানাল মি. চিমনলাল দেখা করতে এসেছেন। গোগোকে মুক্তি দিয়ে মেজকা হাতের ঘড়ি দেখলেন, বললেন, ‘দশটা বাজে। অর্থাৎ যার হিরে, সেই ভদ্রলোক। মি. বিলমোরিয়া, হিরেটি চোরাই বলে যদি এতটুকু সন্দেহ থাকে আপনার, তা হলে পুলিশে জানানো যে আপনার কর্তব্য সেটা আপনার উকিল হিসেবে। আপনাকে আমি জানিয়ে গেলাম।’
* * *
এবারের গরমের ছুটিতে মেজকা সপরিবার কাশ্মীর যাচ্ছেন। গোগোও যে তাঁর সঙ্গে যাচ্ছে সেটা মেজকা জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর দাদা-বউদিকে। আর ছোটকা দার্জিলিং থেকে ফেরার আগেই রওনা হবেন মেজকা। ফিরে সব খবর শুনে কি আর ছোটকার মেজাজ থাকবে তেনজিং নোরকে-র গল্প করবার?
আষাঢ় ১৩৮২
অলংকরণ: মদন সরকার