গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বাগচী

গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বাগচী

বাগচীবাবুকেই দুর্গাকাকু আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন না বাগচীবাবুই দুর্গাকাকুকে নিয়ে এসেছিলেন আজ আর মনে নেই। বাগচীবাবুর অনেক মোটর বোট—এর একটির ওপরের ডেকে মোটের ‘সুকান’ ধরে বসে আছি। ‘সুকান’ মানে, স্টিয়ারিং। ওপরের ডেক থেকে একটি দড়ি নেমে গেছে ইঞ্জিন রুমে। সারেঙ দড়ি ধরে টান দিয়ে সংকেত দিলে ইঞ্জিনম্যান গিয়ার বদলাবে। ইঞ্জিন রুমে গেলে ডিজেলের ধোঁয়ার গন্ধে চোখ জ্বালা করে।

শীতের নির্মেঘ নীল আকাশ ওপরে। কাচের মতো জলে বনের কালো ও আকাশের নীল ছায়া পড়েছে। একজোড়া কার্লু ধীরে ধীরে ডানা নেড়ে এই চওড়া খালের এপার থেকে ওপারে উড়ে যাচ্ছে। তাদেরও ছায়া পড়েছে নিস্তরঙ্গ জলে। গুট গুট গুট গুট শব্দ করে জলের শান্ত ছবিকে দু’ভাগ করে চিরে দিয়ে বোট চলেছে। সারেঙ আর বাগচীবাবু এবং কখনও বাবাও পাশে বসে আছেন। হু হু করে শেষ বিকেলের মাঘী হাওয়া এসে ঢুকছে আগলহীন ওপরের ডেকে। আগল যে একেবারেই নেই তা নয়, ত্রিপলের পর্দা আছে। এখন গোটানো। তা রাতের বেলা এই ডেকে ঘুমোবার সময়ে অথবা অন্য সময়ে বৃষ্টি হলে ফেলে দেওয়া হয়।

বোট যে বেশিক্ষণ চালাতাম তা নয়। কোনচৌকিতে বাবার খামারে রাশ্যান ট্রাঙ্কটরও চালাতাম, চালানোর আনন্দেরই জন্যে। হয়তো কখনও সেই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছি কোথাও যে আমার এক অভিলাষ ছিল এয়ারফোর্সের পাইলট হওয়ার। তাই হয়তো দুধের সাধ ঘোলে মেটানো।

সারেঙ ঘণ্টুবাবু ক্যানিং থেকে বোট ছাড়তেই বলেছিলেন, ‘বোঝলেন কি না লালাবাবু, ইকানে খাদ্য—খাদকের বড়ই অভাব। কাল সকালে একটা হরিণ কিন্তুক মেইরে দেতেই হবেক।’

খাদ্যর অভাব হয়তো ছিল কিন্তু খাদকের অভাব কখনও ছিল না। বৈয়াকরণ পবিত্র সরকারের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য। তাঁরা বাংলা ভাষাকে গুলে খেয়েছেন। কিন্তু বাংলা ভাষা সারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে ব্যবহৃত হয় এবং যে ভাষাতে ভাব আদান—প্রদানে কোনও অসুবিধেও হয় না, ব্যাকরণে তা অশুদ্ধ হলেও, এ কথা হয়তো তাঁর ও তাঁদের জানা নেই। তাছাড়া, নিজের অভিজ্ঞতাতেও জেনেছি দেবীর পায়ে নিবেদিত নৈবেদ্যর ফুল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেবীর পদযুগল অবধি না পৌঁছে পুরোহিতের টাকে গিয়েই পথভ্রষ্ট হয়।

অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। বাগচীবাবুর কথাতে ফিরি।

উজ্জ্বল গৌরবর্ণ মাঝারি উচ্চচতার পুরুষ। উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমির ব্রাহ্মণদের নিশানানুযায়ী তীক্ষ্ন নাসা, প্রশস্ত ললাট, চন্দ্রবিন্দু সহকারে নানা শব্দ ব্যবহারকারী, তীক্ষ্নবুদ্ধিধারী সত্তর ছুঁইছুঁই মানুষ। পরনে সব সময়ই ধুতি তার সঙ্গে বাড়িতে কাচা ইস্ত্রিবিহীন পাতলা কাপড়ের খাকি ফুলশার্ট, পায়ে মোকাসিন পরা, এক সুরসিক ভদ্রলোক। গাড়ি নিজে চালান। বাড়িতে শিকারের বইয়ের ভাণ্ডার। আগ্নেয়াস্ত্র বিশারদ। ওঁর কাছেই ‘ওভার—আন্ডার’ এবং ‘প্যারাডক্স’ বন্দুক প্রথম দেখি। বাগচীবাবু প্রায় ত্রিশ বছরেরও বেশি গত হয়েছেন আজ কবুল করা উচিত যে তাঁর লাইব্রেরি থেকে পৃথিবীবিখ্যাত আফ্রিকান হোয়াইট হান্টার ‘জন টেইলর’—এর, যাঁকে সকলে ‘পন্ডোরো’ বলে জানতেন, লেখা একটি প্রামাণ্য বই নিয়ে এসে আর ফেরত দিইনি এবং কালের অমোঘ নিয়মে আমিও কোনও শিকারি বন্ধুকে তা ‘ভালবেসে’ পড়তে দেওয়ার পরে সে ‘ভালবেসে’ মেরে দিয়েছে। কোনও ভাল বইই, কোনও ভদ্রলোকের মালিকানাতে শেষ পর্যন্ত থাকে না, কোনও না কোনও ভালবাসার জন তা মেরে দেনই। চৌর্যবৃত্তি প্রশংসার নয়, কিন্তু বইচুরি অবশ্যই ক্ষমার্হ অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত। কোনও—না—কোনও বই প্রত্যেক জ্ঞান—পিপাসু মানুষই চুরি করে থাকেন এবং সেই মানুষেরও কোনও—না—কোনও প্রিয়জনে চিরদিনই পড়তে নিয়ে মেরে দেন। ভাল বই ও ভাল রেকর্ড একা পড়ে বা শুনে সুখ হয় না। দশজনে মিলে পড়তে এবং শুনতে হয়।

বাগচীবাবুর মোটর বোট তৈরির কারখানা ছিল গঙ্গার তীরে কোথাও। সেই কারখানায় দুর্গাকাকুর সঙ্গে বাবার নিত্য যাতায়াত ছিল। কোম্পানির নাম ছিল ক্লেব্যাক বোট কোম্পানি। তাছাড়া ক্যানিং গোসাবা এবং সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে ওঁর লঞ্চ সার্ভিস ছিল। নানা লঞ্চ চলত নিয়মিত এবং লঞ্চ ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের তিনি সভাপতিও ছিলেন। সর্বমান্য মানুষ। আমরা যখন সুন্দরবনে শিকারে অথবা ওঁর ভাষাতে ‘যাত্রা’ করতে যেতাম তখন লাইন থেকে প্রয়োজনানুসারে একটি বোট তুলে আমাদের দিতেন। অবশ্য বাগচীবাবু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের সঙ্গী হতেন। খেতে খুব ভালবাসতেন এবং তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে গল্প বলতেন শিকারের এবং শিকারিদের। সুন্দরবনের সব নদী, খাল নিজের হাতের রেখার মতো মুখস্থ ছিল তাঁর। যাঁরাই সুন্দরবনের গভীরে গেছেন তাঁরাই জানেন যে সুন্দরবন কত বড় ধাঁধা। হাতের রেখার মতো না জানলে সেই ভয়াবহ এবং সুন্দর বনে পথ হারিয়ে ফেলা অত্যন্ত স্বাভাবিক। মাতলা, গোসাবা, হাড়িয়াভাঙা, ওদিকের বিদ্যা এবং অন্যান্য নদী এবং দুর্গাদোয়ানি খাল এবং অগণ্য নাম জানা ও না—জানা খাল বাগচীবাবুর যেন চিরচেনা ছিল।

ওঁর সঙ্গে আমরা যে কতবার চামটা, বড় বালি, ছোট বালি হয়ে বঙ্গোপসাগরের মুখ অবধি গেছি তা বলার নয়। এক এক ট্রিপে চার—পাঁচদিন করে থাকতাম। বঙ্গোপসাগরের বুকের কাছে পৌঁছে বোট নোঙর করে বাংলাদেশের নানা দ্বীপও দেখা যেত। প্রতিবারের বর্ষাতে ঝড়ের তাণ্ডবে বন যে কীভাবে তছনছ হত তা শীতে গিয়েও প্রত্যক্ষ করতাম আমরা। নানা দ্বীপের মধ্যে ছেলেরা উলু দিতে দিতে বনের মধ্যে খালপাড় থেকে অদূরে মিষ্টি জলের ছোট ছোট জলাশয় থেকে খাবার ও রান্নাবান্নার জন্যে মিষ্টি জল তুলে নিত। তা বাগচীবাবুই দেখিয়েছিলেন। সেই জল নিতে গিয়ে অনেক সময়ে তাদের প্রাণও যেত। আমাদের লঞ্চে, বাবার কৃপায় খাদ্য—পানীয়র বা ঘণ্টুবাবুর ভাষাতে ‘খাদ্য—খাদকের’ কোনওই অভাব থাকত না। বড় বড় ড্রামে করে আমরা খাওয়ার জল নিয়ে যেতাম।

সুন্দরবনে টাকার কোনও মূল্য নেই, সেখানে বার্টার সিস্টেম এখনও চালু যেমন চালু গভীর এবং প্রায় অগম্য নানা মহারণ্যের ভেতরে আদিবাসীদের হাটে। মাছ—বিলাসী বাবা পানীয় জল, নুন, কিছু তরিতরকারির বিনিময়ে জেলে নৌকো থেকে মাছ নিতেন। মাছবিলাসী বলে বাবার বদনাম হত কিন্তু বাগচীবাবু এবং দুর্গাকাকুর বঙ্কিমী ভাষায় ‘সৈন্যদলের’ কারও খাবার উৎসাহ কিছু কম ছিল না। যে পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি—গোলা আমাদের সঙ্গে থাকত, তা দিয়ে সহজেই বাংলাদেশের কোনও দ্বীপ আমরা জয় করে আনতে পারতাম।

কত সাহেব—সুবো রাজা—মহারাজা এবং নবাবদের নিয়ে যে বাগচীবাবু সুন্দরবনে এসেছেন ত্রিশের দশক থেকে তার লেখাজোখা ছিল না। কত যে মজার সব কাহিনি!

একবার আমাদের সঙ্গে জলপাইগুড়ির তরুণ নবাব গেছিলেন শিকারে। ওড়িশাতে এবং ঝাড়খণ্ডে পকেটমারের মতো বা রাক্ষসের মতো দেখতে অনেক রাজা দেখেছি ছোট ছোট রাজ্যের। কিন্তু সেই নবাবের আপাদমস্তক কল্পনার নবাবের সঙ্গে মিলে গেছিল। ছ ফিট লম্বা, অত্যন্ত সুদর্শন এবং রহিস ছিলেন সেই নবাব। এবং নবাবের সঙ্গে তাঁর একজন ‘ভ্যালো’ গেছিলেন—তিনি যে কী সুদর্শন এবং সপ্রতিভ তা কী বলব। নবাব ও দুর্গাকাকু এবং সামসিং চা—বাগানের ম্যানেজার আর ম্যাকেঞ্জি স্কচ—হুইস্কি দিয়ে সন্ধ্যা আহ্নিক সারার পরে নবাব ঠিক দশটাতে শুয়ে পড়লেন। ভ্যালে তাঁরা সাদা সিল্কের স্লিপিং স্যুট বের করে নবাবের বেশ পরিবর্তনে সাহায্য করলেন। সঙ্গে করে একটি পেটমোটা হোল্ডঅল এনেছিলেন নবাব। সেটি খুলে ভ্যালে তাঁর জন্য বিছানা পেতে দিলেন। সেই হোল্ডঅল থেকে একটি অবিশ্বাস্যরকম মোটা কোলবালিশ বেরিয়ে ছিল। আমরা সবিস্ময়ে নবাবি হরকত দেখেছিলাম। মাথার বালিশ, কোলবালিশ এবং বিছানার চাদর থেকে অম্বর আতরের গন্ধ উড়ছিল। অম্বর ইস্তেমাল করতে হয় শীতকালেই।

তবে আমার অভিজ্ঞতাতে বলে, রাজা মহারাজা নবাব বাদশারা সকলেই ওইরকম প্রকাণ্ড বড় কোলবালিশ ব্যবহার করেন। জলপাইগুড়ির রায়কত রাজবাড়িতে এক রাত ছিলাম। কিরণকাকু নিজে হাতে রেঁধে অতি সুস্বাদু ইলিশ মাছের ঝোল খাইয়েছিলেন আর যে ঘরে শুয়েছিলাম সে ঘরের খাটে উঠতে জলচৌকি ব্যবহার করতে হয় এবং সেই খাট বিরাট চওড়াও বটে। আর বিছানাতে যে কোলবালিশটি ছিল সেটি দেখে বহুদিন আগে বাগচীবাবুর জলপাইগুড়ির নবাবের কোলবালিশের কথা মনে পড়ে গেছে। কোলবালিশের ওপাশে যদি নববিবাহিত দম্পতিও শুয়ে থাকে তাদের প্রাইভেসির কোনও ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা ছিল না।

বম্বেতে একটি সুইস মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির আয়করপরামর্শদাতা ছিলাম একুশ বছর। মাসে দু—তিনবার যেতে হত। প্রতিবারই তাজমহল হোটেলের ওল্ড উয়িং—এই থাকতাম। তাজই আমার বাড়িঘর ছিল বম্বেতে। একবার কী এক কনফারেন্স ছিল কোনও বড় গ্রুপের। রাতের ফ্লাইটে বম্বে পৌঁছে হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে শুনি কোনও ডাবল—রুম এমনকী স্যুইটও খালি নেই। অনেক ক্ষমাটমা চেয়ে আমাকে লবিতে দশ মিনিট বসিয়ে রেখে ফ্রন্ট অফিসের মেয়েটি জানাল যে, আমি ওদের নিয়মিত অতিথি এবং আমার মক্কেল পৃথিবীবিখ্যাত মাল্টিন্যাশনালড। তাই আমাকে ওঁরা ডাবল—রুমের টারিফেই পেন্ট—হাউসে প্রেসিডেন্সিয়ার স্যুইটটি দিচ্ছেন। সেই স্যুইটে রাজা—মহারাজা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীটন্ত্রীরা থাকেন। স্যুইটের লাগোয়া প্রাইভেট সেক্রেটারির স্যুইট। সে এক অভিজ্ঞতা। স্যুইটের বাইরে একজন ইংরেজি ও ফরাসি জানা ভ্যালে ডিউটিতে আছে চব্বিশ ঘণ্টা। বেডরুমে ঢুকে দেখি জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির মতো খাট, জলচৌকি দিয়ে তাতে উঠতে হয় এবং বেডশিটের ওপরে ওইরকম একটি কোলবালিশ। দুটি চানঘর। একটিতে শাওয়ার অন্যটিতে বাথটাব। দুটিতেই কমোড এবং ‘বিদে’।

‘বিদে’ প্রথমবার দেখি প্যারিসের হোটেলে বহু বহু বছর আগে। সে কথা অবান্তর। কোলবালিশের প্রসঙ্গেই এত কথা টেনে আনতে হল।

বাগচীবাবু একবার গ্রেগরি নামের এক ইংরেজকে নিয়ে সুন্দরবনে এসেছিলেন। একটি বড় মার্কেন্টাইল কোম্পানির মেজ সাহেব। তাঁর খুব ইচ্ছে সুন্দরবনে বাঘ মারবেন। গ্রেগরি সঙ্গে করে একটি পাঁঠা নিয়ে এসেছিলেন। পাঁঠা বেঁধে বাঘকে আকর্ষণ করাবেন বলে। বাগচীবাবু প্রস্তাব শুনেই বলেছিলেন, শুয়োর বাঁধলেই ভাল হয়, সুন্দরবনের বাঘ পাঁঠা তো দেখে অভ্যস্ত নয়, শুয়োরের সংখ্যা কমে গেলেও, দেখে।

ছোটবালিতে এমনিতেই বাঘের আড্ডা। বালিতে নেমে একটু ভেতরে ঢুকলেই দুপাশের বড় বড় গাছে বাঘের পায়ের নখ আঁচড়ানোর অজস্র চিহ্ন এবং বালিতেও বাঘের প্রসেশনের দাগ। সেখানে পাঁঠা না বেঁধে কোনও বুদ্ধিমানকে বাঁধলেও বাঘ আসত। কিন্তু গ্রেগরি নাছোড়বান্দা। কলকাতা থেকে বয়ে এনেছে, তার সদ্গতি সে করবেই। সুরসিক বাগচীবাবু বিড়বিড় করে বললেন, বাঘকে না খাইয়ে নধর পাঁঠাটাকে নিজেরা খেলেই ভাল হত।

চাঁদনি রাত ছিল। ঘাসীবনে পাঁঠা বেঁধে তার পাশে মাচা বেঁধে গ্রেগরি বিকেল বিকেল উঠে বসল। সন্ধে লাগার একটু পরেই যখন চাঁদের আলোতে চরাচর উদ্ভাসিত হল, তখন বাঘ এল। বাঘ, পাঁঠা না দেখলেও পাঁঠারা জন্ম—জন্মান্তর থেকে বাঘ দেখে আসছে, বড় বাঘ ছোট বাঘ সব বাঘই। বাঘ দেখেই পাঁঠা ভয়ে ব্যাঁ—এ—এ করে উঠতেই বাঘ অদৃষ্টপূর্ব সেই বোঁটকাগন্ধ জানোয়ার দেখে এক লাফে পগারপার।

এই গল্প ‘জঙ্গল মহল’—এ লিখেছিলাম চল্লিশ বছর আগে। গল্পের নাম ছিল ‘অজ মাহাত্ম্য’।

বাবা ও বাগচীবাবু দুই জিনিয়াসে মিলে ডিজাইন করে বাগচীবাবুর কারখানাতে এক বিরাট অ্যালুমিনিয়ামের বোট বানালেন। তাতে এয়ার ট্যাঙ্ক ছিল সামনে ও পেছনে, যাতে জলে উল্টে গেলেও ডুবে না যায়। বাবার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রেইন অত্যন্ত ক্ষুরধার ছিল। ছিলেনও বিজ্ঞানের ছাত্র। পরে অ্যাকাউন্টেন্সি পড়েন। বাগচীবাবুর কারখানাতে বাবার খামারের খালে চলবার জন্য বেশ কয়েকটি প্যাডলিং বোটও বানানো হয়েছিল। খামারে পিকনিকে আজ মানুষজন যে রোয়িং করতেন সেই সব নৌকোতে। কিন্তু অ্যালুমিনিয়ামের নৌকো বানানো হয়েছিল ওড়িশার চিলিকা হ্রদে পাখি শিকারের জন্য। তখন প্রতি বছরই শীতের শেষে আমরা চিলিকাতে যেতাম কালুপাড়াঘাট নয়তো বালুগাঁ হয়ে চিলিকা হ্রদে পৌঁছতাম।

অগণ্য শিকারির দৌরাত্ম্যে চিলিকার নানা জাতের পরিযায়ী পাখিরা শিকারিদের বন্দুকের রেঞ্জের বাইরেই থাকত সব সময়ে। নৌকো এক হাত এগোলে তারাও এক হাত পেছিয়ে যেত। নৌকোতে আমেরিকান আউট—বোর্ড ইঞ্জিন লাগিয়ে দুরন্ত বেগে সে অ্যালুমিনিয়ামের নৌকো নিয়ে ধেয়ে গিয়ে পাখিদের ওপরে যাতে অতর্কিতে হামলা করা যায়, সেই মতো বোট বানানো হয়েছিল। চিলিকাতে আমরা তিন—চারদিন থাকতাম। বিরাট নৌকোতে বিরাট বাঁশের ছেঁচা বেড়ার মস্ত পাল লাগানো থাকত। রাতে সে পাল পনেরো ডিগ্রিতে নামিয়ে রেখে জলজ ঠান্ডার হাত থেকে বেঁচে ঘুমনো যেত। নৌকোতেই খাওয়াদাওয়া তবে নৌকো মাঝ—হ্রদে নোঙর না করে ছড়পড়িয়ার বালির পাশেই নোঙর করা হত বেশিরভাগ সময়। সেই বালির ঢিবির মধ্যে একদল কৃষ্ণসার হরিণ ব্ল্যাকবাক ছিল। তাদের নাচ দেখার মতো ছিল। একবার বাগচীবাবুও আমাদের সঙ্গে ছিলেন, একটি কৃষ্ণসার হরিণ মেরেছিলাম বহু দূর থেকে। বাগচীবাবু, বাবা এবং বাবার সঙ্গীরা সকলেই খুব তারিফ করেছিলেন। সলমন খান রাতের বেলা জিপ থেকে ওই কৃষ্ণসার মেরেই বিশনোই সম্প্রদায়ের কোপে পড়েছেন এবং বন বিভাগের রোষে পড়েছেন। যখনকার কথা বলছি তখন দেশ সবে তিন—চার বছর হল স্বাধীন হয়েছে। আইন—কানুনের বালাই বড় ছিল না এবং ভারতে প্রায় কোনও রাজ্যের বন বিভাগই আজকের মতো এমন সজাগ হয়নি। সেই সময়ের দু যুগেরও পরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী মানুষের মধ্যে বিশেষত, শিকারিদের মধ্যে এ ব্যাপারে বিশেষ সচেতনতাও ছিল না।

যা—ই হোক, বাবার অ্যালুমিনিয়ামের বোট টুকরো করা অবস্থাতে কাঠের ক্রেটে করে ব্রেকভ্যানে বুক করে হাওড়া থেকে মাদ্রাজ মেলে কালুপাড়া ঘাটে গিয়ে শেষ রাতে নামিয়ে দুটি গরুর গাড়ি পাশাপাশি বেঁধে অনেক কাণ্ড করে হ্রদের পাড় পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তাকে অ্যাসেম্বল করে জলে নামানো হল। শিকারিসমূহ যার যার অস্ত্রসহকারে তাতে আরোহণ করার পরে আমেরিকান আউট—বোর্ড ইঞ্জিন তাতে ফিট করে স্টার্ট করা হল। তিরবেগে ধেয়ে চলল সেই বিচিত্র চেহারার জলযান বিচিত্র চেহারার শিকারিদের নিয়ে। কিন্তু পক্ষীকুলের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট সি বি আইয়ের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের চেয়েও ভাল। অনেক বেশি দক্ষ। পাখিদের মধ্যে খবর চালাচালি হয়ে গেছিল ইতিমধ্যেই যে, তাদের নিধন করার জন্যে ক্লেব্যাক কোম্পানির বানানো বিচিত্র জলযান প্রচণ্ড বেগে জলে ফোয়ারা তুলে ধেয়ে আসছে। অ্যালুমিনিয়ামের বোট যত দ্রুত এগোয় পাখিরাও তত দ্রুততর গতিতে জলের বুকে ভাসতে ভাসতে নাচতে নাচতে বন্দুকের রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। পয়েন্ট টু টু রাইফেল দিয়ে আমি একটা সাইবেরিয়ান গিজ মেরেছিলাম নইলে সেই যাত্রায় শূন্য হাতেই ফিরতে হত। ট্রাক ভাড়া করে সেই যন্ত্র হাওড়ার মাল—এর প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার ওপরেই পড়েছিল। বিফল হয়ে ফেরার পর সেই অলৌকিক জলযানের আর কোনও খবর আমার জানা ছিল না। বাগচীবাবু এবং বাবাই বলতে পারবেন।

আমার হাজারিবাগী বন্ধু সুব্রত চ্যাটার্জি একবার চিঠি লিখল, দারুণ একটা শিকারের জায়গা খুঁজে পেয়েছি। তুমি মেসোমশাইকে নিয়ে চলে এসো। হাজারিবাগ থেকে সব বন্দোবস্ত করে আমি নিয়ে যাব।

সুব্রত তখন গোমিয়ার ইন্ডিয়ান এক্সপ্লোসিভস—এর অফিসার। তখন আমি সি এ পাস করে বাবার পার্টনার হয়েছি। বাবা যেতে রাজি হলেন। আমার নতুন অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে বাবা আর বাগচীবাবুকে নিয়ে হাজারিবাগ পৌঁছলাম সুব্রতদের বাড়িতে।

বাগচীবাবু খুব ভাল গাড়িও চালাতেন। উনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন হাইওয়েতে গাড়ি চালাবার সময়ে কিছুক্ষণ পরে গতির বোধ মরে যায়। একশো একশো কুড়িতে গাড়ি চালালেও মনে হয় আশিতে চলছে গাড়ি। তাই হাইওয়েতে সব সময়ে স্পিডোমিটারে চোখ রেখে গাড়ি চালানো উচিত। দ্বিতীয়ত, শিখিয়েছিলেন যে হাইওয়েতে গরু বা ছাগল পড়লে সব সময়ে তাদের পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সবচেয়ে বিপদ ছাগল—বুদ্ধি মানুষ যদি পড়ে। তারা টোটালি আনপ্রেডিকটেবল। বাগচীবাবুর এই উপদেশ সারাজীবন যে লক্ষ লক্ষ মাইল গাড়ি ও জিপ দুর্ঘটনাহীনভাবে চালিয়েছি তাতে খুবই কাজে লেগেছে।

হাজারিবাগ থেকে আমরা টুটিলাওয়া হয়ে সীমারিয়া ডাকবাংলোতে এসে থাকলাম রাতে।

যাওয়া হবে কোথায়?

সুব্রত বলল, সজনী।

আজও সেই নাম মনে রোমাঞ্চ আনে।

সুব্রতই জিপের বন্দোবস্ত করেছিল। ড্রাইভারই পথপ্রদর্শক। সজনী জায়গাটা সম্ভবত চাতরা জেলার অন্তর্গত ছিল, ঠিক জানা নেই। রাতটা সীমারিয়ার ডাকবাংলোতে কাটিয়ে সকালে আর্লি ব্রেকফাস্ট করে জিপে করে বেরিয়ে পড়লাম। সজনীর পথের যে সৌন্দর্য তা বলার নয়। যেন, মিনি—সারান্ডা। সারান্ডার অন্য নাম ‘ল্যান্ড অফ সেভেন হান্ড্রেড হিলস’। ইংরেজ সাহেবরা বনবিভাগ থেকে শুনেছিল। একটার পর একটা পাহাড় পেরিয়ে গভীর জঙ্গল। মুখ্যত শালগাছের মধ্যে দিয়ে পথ গেছে সারান্ডার। তিন নদীর রাজ্য, সম্ভবত আগেও এ কথা বলেছি, কোয়েল, কারো এবং কয়না। সজনীর পথেও ওইরকম পাহাড়ের পর পাহাড়, তারপরে আরও পাহাড় তবে মাপে সারান্ডার পাহাড়গুলির চেয়ে অনেকই ছোট, প্রায় টিলা বললেই চলে। আর দুপাশে শুধু বাঁশের জঙ্গল। এত বাঁশ যখন আছে তখন বাঘ ও শম্বরের প্রিয় বিচরণভূমি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কোনও কাগজকলের ঠিকাদার নিশ্চয়ই এই বন থেকে বাঁশ চালান দেন। মাইলের পর মাইল ধূলিধূসরিত ওই নাগরদোলার পথ বেয়ে শেষ বিকেলে সজনীতে গিয়ে পৌঁছলাম। অতক্ষণ এক নাগাড়ে জিপের ঝাঁকুনি খেতে খেতে গিয়ে সত্তরোর্ধ্ব দুজনেরই অবস্থা শোচনীয়। সুব্রত নিজে সেখানে আগে যায়নি। দুই বৃদ্ধ এবং যাঁরা যথেষ্ট আরামে অভ্যস্ত তাঁদের নিয়ে যাওয়ার আগে ওর একবার স্কাউটিং করা উচিত ছিল। অন্যের মুখে শুনেই ও আমাদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে থাকার মতো কোনও বাংলো বিশেষ নেই। অনেক গরু—মোষ চরছে দেখলাম। ছাড়া ছাড়া তৃণভূমি। বাড়ির মালিক সম্ভবত গোয়ালা, দুধের ব্যবস্থা করে কিন্তু এই পাণ্ডববর্জিত জায়গা থেকে দুধ কোথায় চালান দেন তা বোঝা গেল না। পানীয় জলের জন্যও কোনও কুয়ো নেই। বাড়ির সামনেই একটি ছোট ডোবা মতো। তালাও বলা চলে না তাকে। গরু—মোষও সেই জলই খায় এবং হয়তো অবগাহনও করে। আমাদেরও সেই জলই ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই—নইলে আবার সারারাত জিপ চালিয়ে সীমারিয়া বা হাজারিবাগে ফিরে যেতে হয়। ওই দীর্ঘ পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এসে বাগচীবাবু এবং বাবা দুজনেরই অবস্থা অতি শোচনীয়। বাবার তাও পর্যাপ্ত মেদ ছিল। বাগচীবাবু একেবারেই মেদহীন। তাঁর পেছনের হাড়ে চিড় ধরে যাওয়াও বিচিত্র নয়। ওঁরা চৌপাইয়ের ওপরে নিজেদের কম্বল বিছিয়ে এবং কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। সুব্রত জোগাড়যন্ত্র করে আটার গরম গরম রুটি, ঘি—দেওয়া অড়হরের ডাল আর আলু ভাজার বন্দোবস্ত করল। খাদ্যরসিক বাবা ও বাগচীবাবু এতই কাবু হয়ে পড়েছিলেন যে খাওয়া নিয়ে কোনও উচ্চচাবাচ্য করলেন না। তার ওপরে যেমন শীত তেমন মশা। ওঁরা বললেন, আমরা আর নড়াচড়া করছি না। কাল সকালেই ফিরে যাব। বেচারি সুব্রত খুবই অপ্রতিভ হল।

খাওয়াদাওয়ার পরে আমি আর সুব্রত বাড়ির মালিকের দেওয়া একজন লোককে নিয়ে টর্চ নিয়ে কাছাকাছি জঙ্গলে ঘুরে এলাম। অতগুলো পাহাড়ের পর ওই জায়গাটা সমতল এবং আশ্চর্য শাল, সেগুন, ঘোড়া নিম, গামহার আর মহুয়ার জঙ্গল। বাঁশঝাড় এখানে একটিও নেই। ঘণ্টাখানেক ঘুরে অন্য কোনও জানোয়ার তো দূরস্থান একটি খরগোশেরও দেখা পেলাম না। সঙ্গী যুবকটি বলল, জঙ্গলমে বিষ্ণু ভগবানকি থান হ্যায়। হামারা মালিক ত ভৈষ্ণবই হ্যায় না।

সুব্রত মরতে এতদূরে কোমর ভেঙে ওই বৈষ্ণবের কাছে কী মতলবে নিয়ে এল কে জানে। ছেলেটি আরও বলল, তার মালিক প্রাণীহত্যা একেবারেই পছন্দ করে না। সে একবার গুলতি দিয়ে একটি পাণ্ডুক (ঘুঘু) মেরেছিল, তাতেই মালিক তাকে মেরে পাট করে দাঁত ভেঙে দিয়েছিল। সুব্রত শুনে বলল, আমাকে মধু যাদব চেনে না। তার ভাই সিধু যাদব কাজ বাগিয়ে নিয়ে এত বড় তিড়ি মারল আমাকে! ফিরে যাই গেমিয়া, ওর কনট্রাক্টই ক্যানসেল করে দেব। আমরা পরদিন সকালেই সেই দুঃস্বপ্নের রাতটি কাটিয়েই ফিরে এলাম। মেসোমশাইকে নিয়ে এলাম। ছিঃ, মুখ দেখাতে পারব আর কখনও! আমার শিকারি বন্ধুরা আমার পিতৃদেবের ঘোর অনুরাগী ছিল। বাবার মধ্যে একটা ‘মাই—ডিয়ার’ ভাব ছিল, যা তখনকার দিনের বাবাদের মধ্যে বিরল ছিল। তা ছাড়া, বাবা আমাকে সবরকমের বিপদের মধ্যে পাঠিয়ে পিট পিট করতেন না, রাইফেল বন্দুক আনিয়ে দিতেন, গুলির সরবরাহ অবিচ্ছিন্ন ছিল।

গোপাল বলত, আমার যদি এরকম বাবা থাকত!

‘সজনী’ আজও আমার কাছে এক রহস্যই হয়ে রয়েছে। সুব্রতও খুব লজ্জা পেয়েছিল। বাগচীবাবু এবং বাবার যে শারীরিক কষ্ট এবং অসুবিধে হয়েছিল তাই—ই নয়, ফিরে এসে, ওই ডোবার জল খাওয়ার কারণে দুজনেরই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল এবং তারপরই দুজনের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যায়। ওই বয়সে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার ধকল কাটিয়ে ওঠা সোজা কথা নয়।

ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার প্রসঙ্গ ওঠাতে বলতে হয় যে আমার তিন—তিনবার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছে এবং বেঁচে গেলেও তারপর থেকে স্মৃতিশক্তি খুবই খারাপ হয়ে গেছে। দুবার হয়েছিল সিমলিপালের জেনাবিল এবং জোরান্ডা— গুড়গুড়িয়াতে গিয়ে। আরেকবার ওড়িশারই লবঙ্গীতে। তিনবারই নার্সিংহোমে ভর্তি হতে হয়েছিল, তবে সিমলিপালে গিয়ে দুবার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হলেও এ বছরও আবার যাব কারণ সিমলিপালের মতো মোহময় সৌন্দর্য আফ্রিকার কিনিয়া ও তাঞ্জারিয়াতেও নেই। বেপাড়ার মেয়েকে চুমু খেয়ে এলে সে পাড়ার ছেলেরা তো হাড়গোড় ভেঙে দেবেই—তাই ভয় করলে চলবে কেন? নানা কারণে ভয়াবহ বলেই তো এত আকর্ষণ সিমলিপালের।

বাগচীবাবুর তখন প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়স। একদিন ফোন করে বললেন, লালাবাবু, সুন্দরবনের ডি এফ ও একবার সেখানে যেতে অনুরোধ করেছেন। চামটা ব্লকে নাকি মানুষখেকো বাঘের অত্যাচারের কারণে জঙ্গলের সব কাজকর্মই বন্ধ। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে, হাতও কাঁপে রাইফেল তুললে। আপনি যদি রাজি থাকেন তো নেমন্তন্ন নিই, নইলে একা যাব না।

কোনও দুর্জ্ঞেয় কারণে উনি পুত্রসম আমাকে ‘লালাবাবু’ বলে সম্বোধন করতেন। আর আমার রাইফেল—বন্দুকের হাতের ওপরে ওঁর বিশেষ আস্থা ছিল অকারণেই।

আমি তো লাফিয়ে উঠলাম। বললাম, যাব।

ওঁর নিজস্ব একটা ছোট বোট ছিল। তাতে একটি কামরা। দু’পাশে দুটি বার্থ। অ্যাটাচড বাথরুম, কমোড লাগানো। সেই বোটটির নাম ছিল ‘লীলা’। রবীন্দ্রনাথের বোটের নামে নাম।

আমি বললাম, সঙ্গে একটি জলি বোট আবশ্যই নেবেন কিন্তু। সেই দাঁড়—বাওয়া বোটে ছোট ছোট খালে খালি গায়ে গামছা পরে বাউলে, মৌলে বা জেলে সেজে ঘুরে বেড়ালে বাঘকে কব্জা করা যাবেই।

নেব। ভাল বুদ্ধি।

আমি কী নেব সঙ্গে রাইফেল ছাড়া?

এক বোতল কনিয়াক নেবেন।

ই গরমে কনিয়াক?

আমার বয়স তো আপনার বয়সের তিনগুণ। যে বয়সে যা।

ঠিক আছে।

তখন আমি লায়েক হয়েছি। আমাদের মক্কেল ছিল জন ডেওয়ার্স—এর সাকসেসর আর ডি অ্যান্ড সন্স—হোয়াইট লেবেল স্কচ হুইস্কির ইমপোর্টার। তখন হোয়াইট লেবেল হুইস্কির দাম ছিল সাতান্ন টাকা। ফোন করে হুইস্কির কেস আনাতাম। বারো বোতল থাকত এক একটি কেস—এ। সেই কোম্পানির মালিকই ছিলেন ডালি রাতানজি। অলিম্পিয়া (এখন অলিপাব) এবং রাতানজি কোম্পানিরও মালিক ছিলেন। পরে যিনি জার্মান নো—হাউতে কল্যাণীতে ব্ল্যাক লেবেল বিয়ার তৈরি করেন। হোয়াইট—হর্স স্কচ হুইস্কি এবং কাম্যুজঁ কনিয়াকের এজেন্ট হিউ ফক্সওয়েও মক্কেল ছিলেন, তাই কোনও অসুবিধেই ছিল না।

তখন গ্রীষ্মকাল। ওই সময়ে মাতলা নদীতে এমন ঝোড়ো হাওয়া থাকে যে অনভিজ্ঞ মানুষের উপায় থাকলে গরমের সুন্দরবনকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলেন। তবে পেটের দায় যাদের সেই জেলে, বাউলে, মৌলেরা যায়ই—না গেলে খাবে কী? প্রতি বছরই অনেক লোকের প্রাণ যায়, তবু তাদের যেতে হয়ই। গরজ বড় বালাই।

ষাটের দশকের কথা। যেদিন সেবারে সুন্দরবন থেকে ফিরেছিলাম সেদিন ক্যানিং থেকে বালিগঞ্জ স্টেশনে নেমেই দেখি সব শুনশান। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না যে আগাম জানান দেব বাড়িতে গাড়ি পাঠাবার জন্যে। ক্যানিং থেকে ট্রাঙ্ক কল করাও প্রয়োজন মনে করিনি, ভেবেছিলাম বালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে নেব। সেদিনই অথবা আগের দিন রাতে জওহরলাল নেহরু মারা গিয়েছিলেন।

ক্যানিং থেকে রওয়ানা তো হওয়া হল ‘লীলা’ বোটে। দেখলাম বাগচীবাবু জলি বোট নেননি। বললেন, চামটাতে গিয়ে ডিঙি নৌকো নিয়ে নেব একটা। তা ছাড়া ‘জলি বোট’—এর কাছে বাঘের আসার সম্ভাবনা কম। তারা যে মহা ঘুঘু।

বোট দুপুরে ছাড়া হল ক্যানিং থেকে। মাতলাতে একটু ভেতরে এসে ঢুকতেই এমন হাওয়া দিতে লাগল যে বোট নদীতে ডুবে যায় আর কী! হাওয়ার তোড়ে বোটের প্রপেলার জল পাচ্ছিল না—লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে হাওয়া কাটছিল। ভয়ে তো আমার মুখ শুকিয়ে গেল। সাঁতার যে জানতাম না তা নয়, কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের ভাষাতে বলতে গেলে আমার সাঁতারের রকমটি গোয়ালন্দী স্টিমারের চাল—এর মতো ছিল। যে পরিমাণ জল ছড়াতাম চারদিকে সে তুলনায় আদৌ এগোতাম না। অবস্থা বেগতিক দেখে বাগচীবাবু তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে সারেঙকে নির্দেশ দিলেন সামনের বাঁদিকের একটি খালে বোট তৎক্ষণাৎ ঢুকিয়ে দিতে। সুন্দরবনকে তিনি হাতের রেখার মতো চিনতেন বলেই তা করা সম্ভব হল।

বাগচীবাবু এক হাঁড়ি মাগুর মাছ আর খুব ভাল চাল নিয়ে গেছিলেন সঙ্গে। সত্যি সত্যিই শুধুই তাই। যে ক’দিন সে যাত্রা বোটে কাটিয়েছিলাম সে ক’দিন দুপুরে ও রাতে মাগুর মাছের ঝোল আর ভাত। ঘণ্টুবাবুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘ইকেনে খাদ—খাদকের বড়ই অভাব’। আমার বাবাকে বন্দোবস্ত করতে বললে ব্যাপার অন্যরকম হত। বাবা জানলেনও না যে তাঁর বড় ছেলে কী দুর্দশাতে পড়েছে। বাগচীবাবু হয়তো সঙ্গত কারণেই ভেবেছিলেন ‘বাপ কি বেটা সিপাহিকি ঘোড়া’ হিসেবে খাদ্যদ্রব্য আমিও ভারে ভারে নেব। গুরুজনের অতিথি হয়ে যাচ্ছি, ভেবেছিলাম, উনিই নেবেন, আমার খেয়াল হয়নি।

সুন্দরবনে যতবার গেছি আগে, সব সময়েই শীতকালেই গেছি। গরমে ওই প্রথমবার যাওয়া। প্রচণ্ড প্যাচপেচে গরম। দুপুরে একটু হাওয়া থাকে না। খালি গায়ে শর্টস পরে হাতের কাছে লোডেড রাইফেল রেখে বই পড়ি। আর কতরকমের যে পোকামাকড়। বুক পিঠ পোকার কামড়ে ফুলে গেল।

সঙ্গে করে মায়ের মামাতো দাদা, আমার পলুমামা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করাতে জি এল নন্দার লেখা মহাত্মা গান্ধীর একটি জীবনী সঙ্গে নিয়েছিলাম। বইটি দেখেই বাগচীবাবু টিপ্পনী কাটলেন, ‘গেঁদোর জীবনী নিয়ে শিকারে এসেছেন! শিকার হবে, না, ছাই হবে।’

দু’দিনের মাথাতে যখন চামটাতে পৌঁছলাম তখন পরিস্থিতি ভয়াবহতার একটা আন্দাজ পেলাম। পুরো এলাকা শুনশান। জেলে, বাউলে, মৌলেদের একটিও নৌকোর দেখা পেলাম না। ডিঙি নৌকো আমাদের ধার দেবে কে?

কলকাতাতে ফেরার পরে ঘটনাপ্রবাহ জেনেছিলাম। এমনি এমনিই কি ডি এফ ও সাহেব বাগচীবাবুর শরণাপন্ন হয়েছিলেন!

চামটার দুটি ভাগ। বড় চামটা আর ছোট চামটা, যেমন বঙ্গোপসাগরের মোহানার কাছাকাছি বড় বালি আর ছোট বলি। মধু পাড়তে, কাঠ কাটতে ও মাছ ধরতে আসা মানুষদের অনেককেই চামটার বাঘে নিয়েছিল। বাঘ একটি ছিল না, একাধিক ছিল। মানুষ তো প্রতি বছরই নেয়, কিন্তু সে বছর তারা এমন খেপে গেছিল কেন, কে জানে! বাঘের অত্যাচার যখন তুঙ্গে তখন ডি এফ ও সাহেবের নির্দেশে রেঞ্জার তাঁর বোট নিয়ে খবরদারি করতে চামটাতে ক্যাম্প করেছিলেন। ক্যাম্প মানে, তাঁর বোট নোঙর করে রেখে জলের ওপরে ক্যাম্প। তার অল্প ক’দিন আগেই কয়েকজন ভাল শিকারি (আমাদের মতো শৌখিন শিকারি নন, যাঁরা খালি পায়ে, ধুতি, লুঙি পরে সুন্দরবনের কেওড়ার শুলো, সাপ, বিছে, স্যালামান্ডার ভরা প্যাচপেচে কাদাতে পায়ে হেঁটে শিকার করে অভ্যস্ত, তাঁরা এসেছিলেন চামটার বাঘেদের শায়েস্তা করতে। প্রথম দিনেই যখন তাঁরা জঙ্গলে ঢোকেন মাচা বেঁধে রাতে বসার বন্দোবস্ত করতে, তখনই বাঘ তাঁদের আক্রমণ করে। তিন—চার বন্দুকধারী অভিজ্ঞ শিকারির গুলিবর্ষণ অগ্রাহ্য করে বিদ্যুৎগতিতে এদিকে—ওদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। হাতে বন্দুক থাকা সত্ত্বেও দুজনকে নাকি আহতও করে। তাঁদের নৌকোর এক মাল্লা, যে মাথাতে তক্তা চাপিয়ে ওঁদের সঙ্গে যাচ্ছিল মাচা যেখানে বাঁধা হবে, সেদিকে। বাঘের রণংদেহি মূর্তি দেখে শিকারি এবং সেই লোকটি তাদের পাড়ে—বাঁধা নৌকোর দিকে দৌড় লাগায়। শিকারিরা, ঈশ্বরের কৃপাতে নৌকোতে পৌঁছে যান এবং মাল্লাও নৌকোর কাছে পৌঁছে অবশেষে তক্তাগুলোর মায়া ত্যাগ করে সেগুলোকে ফেলে দিয়ে নৌকোর দিকে যখন দৌড়ে যাচ্ছে বাঘ পেছন থেকে তাকে ঘাড় কামড়ে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলে। পাছে মাঝির গায়ে গুলি লাগে তাই ওই ঘটনার সাক্ষী হলেও গুলি করতে পারেননি শিকারিরা কেউই। হতভম্ব তাঁদের সামনেই বাঘ মাল্লাকে মেরে ফেলেই বড় বড় লাফ মেরে জঙ্গলের আড়ালে চলে যায়।

পাঠক! আপনাদের মনে হতে পারে যে ওঁরা কীরকম শিকারি যে তিন—চারজন থাকা সত্ত্বেও বাঘকে মারতে পারলেন না? আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলি যে সুন্দরবনের বাঘের সংহারমূর্তি যাঁরা স্বচক্ষে কখনও দেখেছেন শুধুমাত্র তাঁরাই জানেন যে সুন্দরবনের বাঘ কী জিনিস! হাতে বন্দুক ধরা শিকারিরাও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন, খবরের কাগজের ভাষাতে যাকে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বলে তাই হয়ে যান। তাঁদের কারোকেই কিছুমাত্র দোষ দেওয়া যায় না। সবাই তো আর্জান সর্দার নন।

দিনান্তবেলায় রেঞ্জার নিজের বোট একটি খালের মাঝখানে নোঙর করে হাতের কাছে গুলিভরা দোনলা বন্দুক রেখে ট্রানজিস্টারে গান শুনছিলেন। সার সার বড় বড় গোলপাতার নৌকোও মাঝখানেই নোঙর করা আছে। তাদেরই সাহস জোগানোর জন্যে রেঞ্জারের তাদের সঙ্গে থাকা। বড় বড় নৌকোর সঙ্গে একটি করে ছইওয়ালা ডিঙি নৌকো বাঁধা থাকে—নৌকো যখন চলে তখন নৌকোর পেছন পেছন সে ডিঙি ভাসতে ভাসতে যায়। সেই নৌকোতে প্রত্যেক বড় নৌকোর মাঝি মাল্লাদের জন্যে রান্নাবান্না হয়। গোলপাতার ওরকম একটি নৌকোর সঙ্গে বাঁধা ছোট ডিঙিতে মশলা বাটা হচ্ছিল। রাতের রান্নার জন্যে। সব ডিঙিতেই রাতের রান্নার তোড়জোড় চলছিল। পূর্ণিমা রাত। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। গ্রীষ্মের পূর্ণিমার রাত যাঁরা কখনও জলের ওপরে কাটিয়েছেন, শুধু তাঁরাই সেই জলজ সৌন্দর্যের কথা জানেন।

নৌকোর ছইয়ে হেলান দিয়ে কেউ হুঁকো খাচ্ছে, কেউ বা নিচু গলাতে সুখ—দুঃখের গল্প করছে, কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে অথবা গান গাইছে। সব নৌকোই অনেক চওড়া খালের মাঝখানে নোঙর করা আছে। পাড়ের কাছাকাছি বাঘের ভয় নেই বলেই সবাই মাঝখালে নিশ্চিন্ত। এমন সময়ে একটি ডিঙি নৌকোর মশলা বাটার আওয়াজ থেমে গিয়ে হঠাৎ ঝপাং করে আওয়াজ হল। ডিঙিটা ভীষণ জোরে নড়ে উঠে বড় নৌকোর পেটে ধাক্কা খেল। এবং পরক্ষণেই চন্দ্রালোকিত খালের মধ্যে দেখা গেল একটি বাঘের কালো হাঁড়ির মতো মাথা ভেসে যাচ্ছে অন্য পাড়ের দিকে আর তার মুখে ধরা আছে রাঁধুনির কাঁধ।

রেঞ্জার সাহেব তড়াক করে উঠে বন্দুক বাগিয়ে ধরলেন বটে কিন্তু মানুষটির গায়ে গুলি লেগে যেতে পারে এই ভয়ে গুলি করতে পারলেন না। বাঘ ওপারে সাঁতরে পৌঁছে রাঁধুনির মাথাটা শেয়ালে যেমন করে কইমাছ চিবিয়ে মাঠের আলের ওপরে ফেলে দেয়, তেমন করে চিবিয়ে তাকে ফেলে রেখে এতগুলো মানুষকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করে ওদিকের হেঁতালের জঙ্গলে ঢুকে গেল। রেঞ্জার সাহেব ইতিমধ্যে শূন্যে দু’বার গুলি করেছিলেন। বাঘ হয়তো সেই ভয়েই শিকারকে মুখে করে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে না খেয়ে পাড়েই ফেলে রেখে চলে গেল।

সেই ঘটনার পরই চামটার পুরো এলাকা ছেড়ে বাউলে, মৌলে এবং জেলেরা চলে গেছিল। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন পুরো এলাকাটাকেই শ্মশানের মতো দেখাচ্ছিল। কোনও নৌকো বা মানুষজনের চিহ্নমাত্র নেই।

বলতে একটুও লজ্জা নেই যে জীবনে যদি কিছুকে সত্যিই ভয় করে থাকি তা সুন্দরবন। ভারতের এবং আফ্রিকারও যে কোনও জঙ্গলে যেখানে শক্ত মাটিতে পা ফেলা যায়, নিজের রাইফেল বা বন্দুক হাতে দিনে—রাতের যে—কোনও সময়েই আমি যে—কোনও জানোয়ারের, সে মানুষখেকোই হোক কী না হোক, মোকাবিলা করতে রাজি কিন্তু সুন্দরবনের বাঘের মোকাবিলা করার মতো সাহস আমার নেই। সুন্দরবনের মতো eerie, uncanny অনুভূতিও কোনও বনে হয় না।

সুন্দরবন অত্যন্তই সুন্দর, এই আশ্চর্য জলজ জঙ্গল, এই জোয়ার—ভাটার খেলা, জোয়ারের সময়ে ভাসমান জঙ্গল আবার ভাটার সময়ে তার ন্যাংটা রূপের কোনও তুলনা হয় না। জোয়ারের সময়ে সুতিখালে তোড়ে জল ঢুকতে থাকে আর ভাটির সময়ে সেই জল তোড়ে বেরিয়ে আসে। নানা মাছ লাফালাফি করে—আর মাছরাঙা, কার্লু এবং অন্য পাখিরা তখন ছোঁ মেরে মেরে মাছ ধরে খায়। সুন্দরবনের মতো অপার নিস্তব্ধতাও সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের যে সৌন্দর্য তা হয়তো কিছুটা দেখা যায় ওড়িশার ভিতরকণিকাতে এবং আন্দামানে। কিন্তু সেই সব অঞ্চলের সৌন্দর্যের সঙ্গেও সুন্দরবনের সৌন্দর্যের তুলনা চলে না। কৃষ্ণপক্ষের রাতে আকাশভরা তারাদের ছায়া পড়ে জলে, শুক্লপক্ষের রাতে লক্ষ লক্ষ সাপের মতো চাঁদের চাঁচর কিলবিল করে হাওয়া—লাগা জলে। রাতে বোটে শুয়ে কাঠকুটো পাতাপুতার বোটের সঙ্গে গা ঘষটানির অবিরত শব্দ ঘুমপাড়ানি গানের মতো শোনায়। ডেক—এ উঠে অন্ধকার রাতে হঠাৎ যদি টর্চের বা বোটের সার্চ লাইটের আলো ফেলা যায় জলে, তাহলে দেখা যায় কাঠকয়লার আগুনের মতো কুমিরের চোখ জ্বলছে জলের ওপরে। জলে কুমির আর কামট এবং ডাঙাতে বাঘ আর সাপ। যেমনই সুন্দর এই জলজ বন, তেমনই ভয়ঙ্কর। সত্যিই ভয়ঙ্কর বনের প্রায় সর্বত্রই এই নিশ্ছিদ্র জঙ্গল।

একজন বড় জ্যোতিষী (আমি বিশ্বাস করি না যদিও) লিখে দিয়েছিলেন একটা এক্সারসাইজ বুকে, মায়ের কাছ থেকে আমার কুষ্ঠি চেয়ে নিয়ে বিচার করে যে, যতদিন আমার মা বেঁচে থাকবেন ততদিন বাঘের মুখে মাথা ঢোকালেও আমার মৃত্যু নেই। মা তখন বেঁচে ছিলেন।

সঙ্গে জলি বোট না নিয়ে যাওয়াতে এবং কোনও ডিঙি নৌকোও না পাওয়া যাওয়াতে বাগচীবাবুর নির্দেশে সারাদিন বোট নোঙর করা অবস্থাতে খালি গায়ে অসহ্য গরমে হাঁসফাঁস করে ও নানা বিচিত্র আকারের এবং রঙের পোকার কামড় খেয়ে আধো—ঘুমে আধো জাগরণে থেকে সন্ধের আগে আগেই বোটের নোঙর তুলে আমরা বেরিয়ে পড়তাম, বোট যে সব ছোট খালে ঢুকতে পারে সেই সব খালে। ডেকের ছাদে লোডেড রাইফেল হাতে আমি পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম আর বাগচীবাবুর নির্দেশে একজন মাল্লা বোটের মাথার শক্তিশালী সার্চ লাইট একবার এদিক আরেকবার ওদিক করে জঙ্গল চষে ফেলত।

সুন্দরবনের জঙ্গল যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন যে সে জঙ্গলের প্রকৃতিই আলাদা। গরান বা হেঁতাল বা গোলপাতার জঙ্গল যেখানে সেখানে জঙ্গল একরকম নিশ্ছিদ্রই বলা চলে। সেখানে বড় বড় কেওড়াগাছ থাকে। তাদের নিচটা পরিষ্কার—অনেকদূর নজর চলে কিন্তু পায়ে হেঁটে যাওয়া অত্যন্তই দুষ্কর। এরিয়াল রুটস—এ জন্যে—যাদের স্থানীয় ভাষাতে বলে ‘শুলো’। একবার পা পিছলে তাদের ওপরে পড়ে গেলে একেবারে ভীষ্মের শরশয্যা। সুন্দরবনের জঙ্গলের অধিকাংশ জায়গাতেই নামা যায় একমাত্র ভাটির সময়েই। জোয়ারের সময়ে পুরো বন একটি ভাসমান বাগান হয়ে যায়—সে দৃশ্য সত্যিই দেখার মতো। আমরা চাররাত পাঁচদিন চামটাতে ছিলাম এবং প্রতিরাতেই সন্ধে থেকে রাত একটা—দেড়টা ওইভাবে ঘুরেছি কিন্তু আশ্চর্য! বাঘের চোখ তো নয়ই, অন্য কোনও জানোয়ারের চোখও জ্বলে ওঠেনি একবারের জন্যেও। ওখানে কি বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য হরিণ, শুয়োর ইত্যাদি একেবারেই কমে গেছিল ওই সময়ে? কী কারণ জানি না, তবে ওই ছিল ঘটনা।

যেদিন আমরা ক্যানিংয়ের দিকে বোটে ফিরব তার আগের সন্ধে থেকে বাগচীবাবু মরিয়া হয়ে বললেন, আজ চামটার এমন এক খালে বোট ঢোকাব যে বাঘের সঙ্গে মোলাকাত হবেই। এ খালের দুদিকে যে কত ঝামটি পোঁতা আছে তা দেখলেই বুঝবেন। সুন্দরবনে যেখানেই বাঘে মানুষ নেয় সেখানেই জেলে মৌলে বাউলেরা একফালি ন্যাকড়া, অধিকাংশ সময়েই সাদা, একটি সরু গাছের মাথায় বেঁধে দেয় জলের পারে—অন্য আগন্তুককে সাবধান করে যে, সেখানে বাঘের ভয় আছে। কিন্তু সুন্দরবনে যে সব মানুষের বাস তাদের পেটের খিদে এত প্রবল যে প্রাণের ভয় করলে তাদের চলে না। চৌরঙ্গিতে পথ পেরুতে গেলে যেমন ট্রাম—বাস চাপা পড়ার ভয় থাকেই তেমনই ওখানে বাঘের হাতে প্রাণ যাওয়ার ভয় থাকেই, ভয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না—তবে অসম্ভব না হলে ঝামটি—ওড়া জায়গাকে ওরা এড়িয়ে চলে। ঝামটি কিছু কিছু সব খালের পাশেই দেখা যায় কিন্তু সেই খালটিতে এত পরিমাণ ঝামটি যে মনে হয় কোনও রাজনৈতিক দলের শোভাযাত্রা যাবে বোধহয়। তাদেরই ফেস্টুনে ভরা দুদিক। দুদিকেই অতি ঘোর গোলপাতার জঙ্গল।

বাগচীবাবুর সুন্দরবনের নদী ও খাল সবই শুধু তাঁর হাতের রেখার মতো মুখস্থ যে তাই নয়, বোটের ছাদের ডেকের ওপর বিরাট একটি মানচিত্র সবসময়েই মেলা থাকত যাতে জানা বিষয়েও ভুল না হয়। আর হাতের কাছেই থাকত জোয়ার—ভাটার ম্যানুয়াল। প্রতিটি কৃষ্ণপক্ষে এবং শুক্লপক্ষে কখন জোয়ার শুরু হবে এবং পুরো হবে এবং কখন ভাটি দিতে আরম্ভ করবে ও ভাটি শেষ হবে তার সব তথ্য থাকত সেই বইয়ে। আমরা যখন গেছিলাম তখন কৃষ্ণপক্ষ। বাতি নিবোলেই ঘোর অন্ধকার তবে বোটের মধ্যে আলো ছিল। কিন্তু খালের মধ্যে দিয়ে বোট চলাকালীন সেই বাতি নেভানো থাকত।

ভগবানেরও ভুল হয়। সে রাতে বাগচীবাবুরও ভুল হয়েছিল। খালটি খুবই সরু। ডিঙি নৌকো যাওয়ার উপযুক্ত, বোট যাওয়ার নয়। কিন্তু দুপাশে গোলপাতার জঙ্গল জলের ওপরে ঝুঁকে পড়েছে। বোটের সার্চ লাইট দিয়ে কাছ থেকে তাকে দেখা এবং গুলি করা অপেক্ষাকৃত সহজ বলেই সেই খালে বাগচীবাবু বোট ঢুকিয়েছিলেন রাত আটটা নাগাদ। তার আগে আমরা অপেক্ষাকৃত বড় খালের তির ঘেঁষে ঘুরছিলাম। একটি বড় খালের পাশে উঁচু ডাঙায় বা ট্যাঁকে একদল হরিণ দেখেছিলাম। কিন্তু সারেঙ ও মাল্লাদের ‘খাদ্য—খাদকের’ যতই অভাব হোক না কেন হরিণ মারতে যাইনি সেবারে আমরা। যতক্ষণ জেগে—থাকা ততক্ষণই বাঘের নাম জপ করা, একই প্রার্থনা।

রাত যখন সাড়ে নটা হঠাৎ বাগচীবাবুকে যেন বিছে কামড়াল। সারেঙের নাম ধরে তাকে গাল পেড়ে বললেন, আমার না হয় বয়স হয়েছে, তোমাদেরও কি ভীমরতি ধরেছে কালী? ভাটি শুরু হয়ে গেছে একবারও তা খেয়াল করোনি? ভাটি আর একটু দিলে এবং ভাটি পুরো হলে এই বোট তো কাদাতে বসে যাবে আর দুপাশ থেকে বাঘ এসে তোমাদের সব কটাকে চিবিয়ে খাবে। তাকে তো এক হাতও সাঁতরাতে হবে না। মাটিতে দাঁড়িয়েই তোমাদের নাগাল পাবে।

আমরা সকলে সভয়ে তাকিয়ে দেখলাম সড়সড় আওয়াজ করে জল সরে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, আর বোট ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাটি পূর্ণ হলেই বোট কাদাতে বসে যাবে। যতক্ষণ না আবার জোয়ার আসে পুরো না হলেও জোয়ারের কিছু সময় কাটে ততক্ষণ বোটের ভাসার উপায় নেই। যতক্ষণ না প্রপেলার জলে ডুবছে ততক্ষণ বোট চালাবারও উপায় নেই। সামনে ভীষণা কালরাত্রি। ওই রাত্রি এই ভয়াবহ বনে সাংঘাতিক মানুষখেকোদের মারতে এসে তাদেরই খাদ্য হতে হবে আমাদের।

আমার মন বলল, ভালই হল। বাঘ যদি আমাদের ধরতে আসে চেহারা যদি সে একবার দেখায়, তবে সে যতই মানুষ মারুক না কেন তার নিজের প্রাণ নিয়ে ফেরা তার হবে না। তখন আমার একত্রিশ—বত্রিশ বছর বয়স। আমার প্রিয়তম রাইফেল পয়েন্ট থ্রি সিক্সটি সিক্স ম্যানলিকার শুনার হাতে থাকতে যমকেও আমি ভয় করি না। কখনও একটির বেশি দুটি গুলিও খরচ করতে হয়নি দিনে কী রাতে এই রাইফেলে। ওড়িশার সাতকোশিয়া গণ্ডে তো এই রাইফেল কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। মনে মনে খুশি হলেও মুখে কিছু বললাম না। জলি বোট না নিয়ে আসার কারণে বাগচীবাবুর ওপর খুবই ক্ষোভ হয়েছিল কিন্তু একে গুরুজন তায় পিতৃবন্ধু তাঁকে কিছু বলার মতো ধৃষ্টতা আমার ছিল না। ভাবলাম, ভগবান জলি বোটের অভাব এবার পুরিয়ে দিলেন। বাগচীবাবুর ‘লীলা’ বোটই জলি বোট হয়ে গিয়ে বাঘেদের লীলা খেলা সাঙ্গ করবে।

তাড়াতাড়ি করে নিয়মিত খাদ্য (আর গেলা যাচ্ছিল না) মাগুর মাছের ঝোল আর ভাত খাওয়ার পর (ওই খাদ্যই দুবেলা) বাগচীবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, শোনেন লালাবাবু, প্রথম রাত আমি সামনে ডেকে বসে পাহারা দিচ্ছি। আপনি ঘুমোন। রাত দুটো নাগাদ আমি আপনাকে তুলে দিয়ে কেবিনে এসে শোব। বয়স হয়েছে সারারাত জাগা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তখন আপনি খুব সজাগ দৃষ্টি রাখবেন মনে রাখবেন, শুধুমাত্র আপনার নিজেরই নয়, ওই সারেঙ আর তিনজন মাল্লার জীবনও আপনার সজাগ থাকার ওপরে নির্ভর করছে।

সারেঙ এবং মাল্লারা সবাই খাওয়াদাওয়ার পরে বোটের ছাদে সারেঙের ঘরে গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছে। ছাদটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচু। সেটুকুই ভরসা তাদের। আর ভরসা আমাদের ওপরে তারা সম্পূর্ণই নিরস্ত্র।

বাগচীবাবুর অনেকগুলি বিশ্ববিখ্যাত রাইফেল—বন্দুক ছিল। জেমস পার্ডির বারো বোরের দোনলা বন্দুক, হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড—এর থ্রি সেভেনটি ফাইভ ডাবল ব্যারেল রাইফেল, আরও অজস্র প্রাইজ—পজেশান। শর্ট রেঞ্জে রাইফেলের চেয়ে বন্দুকই ভাল। তা ছাড়া বিপজ্জনক প্রাণী মরবে নিশ্চয়ই গুলি লাগলে কিন্তু মরার আগে শিকারিকে মেরেও মরতে পারে। আজ আর মনে নেই সেই রাতে বাগচীবাবু তাঁর কোন প্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে নিশিযাপন করবেন বলে ঠিক করেছিলেন।

আগেই বলেছি, সারাদিনে প্রচণ্ড গরম ও পোকার কামড় এবং কর্মহীনতার একঘেয়েমি। রাইফেলটিকে কোলবালিশ করে শুয়ে পড়লাম আমি এবং শোওয়ামাত্র গভীর ঘুম।

বাগচীবাবু যখন আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিলেন রাত তখন দুটোই হবে। হাতে ঘড়ি থাকতেও দেখিনি। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে সামনের ডেকে উঠে বাঁদিকে কেবিনের গায়ে হেলান দিয়ে বসে লোডেড রাইফেলটি কোলের ওপর আড়াতাড়ি রেখে গভীর এবং নিঃশব্দ অন্ধকারে চেয়ে বসে রইলাম। ডানদিকে পাঁচ ব্যাটারির ‘বন্ড’—এর টর্চ। কিছুক্ষণ বাদে বাদে আলোটা ফেলে ঘুরিয়ে দেখছি। জঙ্গলের কোনও প্রাণ নেই মনে হচ্ছে। অন্য যে—কোনও বনের তুলনাতে সুন্দরবনে পাখি কম। দিনে ও রাতে পাখির আওয়াজ খুব বেশি শোনা যায় না। মনে হয় পুরো বনই বাঘের ভয়ে মরে গেছে। এবং সেই নৈঃশব্দ্য যেন পেয়ে বসে, গলা টিপে ধরে। সেই নৈঃশব্দ্যের একঘেয়েমি একেবারেই অসহ্য। তার ওপরে যে—কোনও মুহূর্তে মৃত্যুর দূতের সঙ্গে মোলাকাত হতে পারে।

এখানের গরিব মানুষরা, যারা এই প্রচণ্ড ভয়াবহ এবং ভূতুড়ে জঙ্গলে জীবিকার জন্যে প্রতি বছর আসে তাদের প্রত্যেককে পরমবীরচক্র দিতাম, যদি আমি ভারতের প্রেসিডেন্ট হতাম।

সেই যে কেবিনের গায়ে হেলান দিয়ে বসলাম সেইটেই মারাত্মক ভুল হল। রাত কত হল জানি না। চারিদিকে প্রাণের কোনও চিহ্নমাত্র নেই, মাথার ওপরে ঝকঝক করছে কালপুরুষ, আরও কত নক্ষত্র। এখনকার দিনে আজকের মতো আকাশে স্যাটেলাইটের উপদ্রব ছিল না। এখন বনের রাতে আকাশে তাকালেই ধীর গতিষ্মান স্যাটেলাইট চোখে পড়ে। বলাই বাহুল্য, তারা অন্যান্য গ্রহ—নক্ষত্রের থেকে পৃথিবীর অনেক কাছ দিয়ে আবর্তিত হয়, তাই তাদের দেখতে অসুবিধে হয় না।

কখন যে পাহারাদার নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই দেখিনি। হঠাৎ কে যেন জোরে আমাকে ধাক্কা দিল। তাকিয়ে দেখি বাগচীবাবু। আতঙ্কে তাঁর মুখ ফ্যাকাসে। তখন সবে পুবের আকাশ সাদা হচ্ছে। হতচকিত আমি দেখলাম সারেঙ ও সব মাল্লাও সামনের ডেকে এসে হাজির।

বাগচীবাবু বোটের পাশের মাটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, দেখেছেন!

তাকিয়ে দেখি বোটের পাশে বাঘ ও বাঘেদের শোভাযাত্রার দাগ যেমন ছোট বালিতে দেখা যায়। বোটের চারপাশ দিয়ে কতবার সে সে বা তারা ঘুরে গেছে (মাটিতে নেমে ভাল করে থাবার দাগ দেখলেই বোঝা যাবে এক বাঘ না একাধিক) অথচ ঘুমন্ত আমাকে নেয়নি। পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে তারা যেমন করে মোটা গাছের গুঁড়িতে নখ আঁচড়ে নখে ধার দেয় এবং নখের নোংরা পরিষ্কার করে তেমনি করে দাঁড়িয়ে এক হ্যাঁচকাটানে আমাকে নিয়ে নেওয়া একটুও মুশকিল ছিল না।

সংস্কার। বহু যুগ ধরে জেলে বাউলে মৌলেদের নৌকো থেকে বাঘ মানুষ নিচ্ছে। মাঝনদীতে সাঁতরে এসেও মানুষ নিচ্ছে (যেমন চামটার খালে সেই পূর্ণিমার রাতে নিয়েছিল) কিন্তু আজ অবধি কোনও বোট থেকে নাকি একজনও মানুষ নেয়নি। সাহেবদের আমলে যখন তাঁরা সুন্দরবনে নিয়মিত শিকারে আসতেন তখন থেকেই মোটর বোটের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রর সহাবস্থান সম্বন্ধে ওরা বোধহয় সচেতন। তা নইলে আমাকে সে রাতে না নেওয়ার কোনও কারণই আমি দেখি না। নইলে বলতে হয়, আমার মায়ের আশীর্বাদই আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।

রোদও উঠল। জোয়ারও ছিল। আস্তে আস্তে ছলছল শব্দ করে খালে জল ঢুকতে লাগল। সারেঙ ও মাল্লারা যার যার জায়গাতে চলে গেল। প্রপেলার অবধি জল উঠলে বোট চালু হবে।

বাগচীবাবু তখনও ঘোরের মধ্যে ছিলেন। বিড়বিড় করে বলছিলেন তিন বছরের মেয়ে, স্ত্রী, আপনার মা ও বাবা, আপনার অর্ধভুক্ত লাশ নিয়ে গিয়ে কোন মুখে আমি দাঁড়াতাম তাঁদের কাছে?

ওপরের ডেক থেকে সুকানে—বসা সারেঙ চেঁচিয়ে বলল, পেরানটা যখন ই যাত্রা বেঁইচেই গেল, তখন আমাদের জন্য একটা হরিং মেইরে দ্যান। খাদ্য—খাদকের বড়ই অভাব লালাবাবু।

এবেলা ওবেলা মাগুর মাছের ঝোল খেয়ে খেয়ে আমার অবস্থাও একেবারেই ভাল নয়।

বাগচীবাবু উত্তর বঙ্গীয় ভাষাতে বললেন, সোজা ক্যানিংয়ের পথ ধরো সারেঙ। গেঁদোর জীবনী ধরি আইছেন বাবু, ই যাত্রা আর কিছুই শিকার হবেক নাই।

জল ভরল খালে, যেমন করে বাথটাব জলে ভরে ওঠে আস্তে আস্তে। বোটের প্রপেলার জলে ডুবতেই ওপর থেকে ঘণ্টা শোনা গেল টুং টুং করে। ইঞ্জিনম্যান ইঞ্জিন স্টার্ট করল।

সুন্দরবনের জেলে মৌলে বাউলেদের নিয়ে লেখা আমার একটি উপন্যাস আছে, নাম—’সারেঙ মিঞা’। দে’জ পাবলিশিং প্রকাশক। আমার খুব প্রিয় উপন্যাস।

পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগ এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি ওয়াচ টাওয়ার করেছেন সাম্প্রতিক অতীতে, যার নাম দিয়েছি আমি ‘বনী’ক্ষ। বনবিভাগের একটি মোটর বোটেরও নাম দিয়েছি—’সারেঙ মিঞা’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *