গোপাল

গোপাল

আজ কলকাতায় বৃষ্টি নেমেছে বহুদিনের প্রতীক্ষার পরে। কিছুক্ষণ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির পরে এখন ফিসফিস করে বৃষ্টি পড়ছে। ছোটনাগপুর মালভূমিতে, মুন্ডারিদের ‘সোনারূপান রূপালেকান ছোটা নাগাপুরাহো, ছোট নাগাপুরা’তেও বৃষ্টি এমনই ফিসফিসিয়ে পড়ে।

আমার হাজারিবাগের শিকারের বন্ধু গোপাল সেন। ওদের গয়া রোডের (এখন যার নাম বড়হি রোড) বাগান—ঘেরা ‘পূর্বাচল’ বাড়ির পশ্চিমমুখো বারান্দাতে এমনই এক বৃষ্টির দিনে আমি আর গোপাল বসে আছি। ইউক্যালিপটাস গাছেদের বৃষ্টি—ভেজা গা থেকে সুন্দর ঝাঁজালো গন্ধ উড়ছে।

আমরা দুজনে সামনের দিকের যে ঘরে দুটি নেয়ারের খাটিয়াতে শুতাম, তার সামনেই একটি মস্ত ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরার গাছ ছিল। তাতে ফুল এসেছে। সেই গন্ধে সারা বাড়ি ম—ম করছে। সামনের পিচরাস্তার ওপারে তখন মস্ত এক মোরব্বা ক্ষেত ছিল। এখন বনবিভাগ সেখানে বড় গাছের প্লান্টেশন করেছে। মোরব্বা মানে, সিসাল হেম্প—যা দিয়ে দড়ি তৈরি হত। সেই মোরব্বা ক্ষেত তিতির, খরগোশ আর নানা সাপের আড্ডা ছিল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা দুজনে বিকেলবেলা বন্দুক কাঁধে বেরোব। তিতির বা খরগোশ মারতে পারলে আমিষ। নয়ত খিচুড়ি। প্রায় দু’বেলাই খিচুড়ি খেতাম।

গোপাল একটি বেতের চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা তুলে দিয়ে পায়জামাটা হাঁটু অবধি তুলে বিড়ি খেতে খেতে (সিগারেটকে ও বিড়ি বলত) ওর স্বভাবসিদ্ধ ইয়ার্কির সঙ্গে গাইছে ‘ওগো তোরা কে যাবি পারে। আমি তরী লিয়ে বইস্যে আচি লদী কিলারে—এ—এ’।

পূর্বাচলের পাশের বহু বিঘা হাতাওয়ালা প্রাচীন সব গাছে—ছাওয়া হক সাহেবের বাড়িতে অভিনেত্রী মঞ্জু দে একজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে কলকাতা থেকে ভরা বর্ষাতে গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। প্রায়ই আসতেন। তবে বাড়ির মধ্যে একবার সেঁধিয়ে গেলে তাঁদের আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না। মঞ্জু দে সে সময়ের তুলনাতে একজন দুঃসাহসী মহিলা ছিলেন। সমাজকে ডোন্ট—কেয়ার করার মতো দুর্জয় সাহস তাঁর ছিল। অনেক বছর পরে অপর্ণা সেন এবং তসলিমা নাসরিন—এর মধ্যে এই দুঃসাহসের রেশ দেখতে পেয়েছি। খাতা কলমে নারীবাদী অনেকেই কিন্তু জীবনে নারীবাদী হতে সাহস লাগে, যে সাহস অনেক পুরুষের মধ্যেও দেখা যায় না।

গোপালের বাবা বিলেতের ইনকর্পোরেটেড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। ওঁরও নিজস্ব ফার্ম ছিল—মেসার্স জে সেন অ্যান্ড কোং। গোপালও সে কারণেই আমারই মতো ওর বাবার ফার্মে আর্টিকেল্ড ক্লার্ক হয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়ত। ও—ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি কম পাস করেছিল। আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল। পরে গোপালও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়েছিল।

তখনকার দিনে দশটা গাধা মরে একটা বড় ছেলে হত। এবং বড় ছেলেরা কী করবে বা করবে না সে সিদ্ধান্ত বাবাই নিতেন। তাদের নিজেদের ইচ্ছা—অনিচ্ছার প্রশ্নই উঠত না। ওর ভাল নাম ছিল মিহির সেন। তবে তখন আমাদের দুজনেরই হোল—টাইম অকুপেশন ছিল যার যার বাবার অফিসে সবুজ পেন্সিল দিয়ে বিভিন্ন মক্কেলের ক্যাশবুক লেজার আর জার্নালের পোস্টিং চেক করা, সি এ পরীক্ষাতে ফেল করা এবং অন্তর্বর্তী সময়ে হাজারিবাগে বা অন্যত্র শিকারের জন্যে যাওয়া।

গোপাল ফ্লাইং মারত দারুণ। ওদের মক্কেল ছিলেন হাওড়ার দাশনগরের আলামোহন দাশ। তাঁর তিন ছেলেই, প্রভাত, রবি ও চাঁদু গোপালের এবং গোপালের মাধ্যমে আমারও বন্ধুস্থানীয় ছিল যদিও বয়সে ওরা তিন ভাইই ছোট ছিল আমার চেয়ে। বড় ভাই শিশিরদা আলাদা থাকতেন। প্রভাত ছিল মেজ ছেলে। খুবই অল্পবয়সে সে হঠাৎ দুদিনের জ্বরে মারা যায়। ওর মতো উদার—হৃদয়, সদাহাস্যময়, প্রকৃত স্পোর্টসম্যান জীবনে কমই দেখেছি।

দাশনগরে ওরা একটি গান—ক্লাব করেছিল। পুরো পূর্বভারতে তখন আর কোনও গান—ক্লাব ছিল বলে জানি না। সেখানে ট্র্যাপ ও স্কিট শুটিং প্র্যাকটিস করত ওরা। আমিও গোপালের সঙ্গে মাঝে মাঝে যেতাম। এখন যে আর্মি অফিসার রাঠোর অলিম্পিকে সোনার মেডেল পাচ্ছেন তা ওই ট্র্যাপ ও স্কিট শুটিংয়েই। রাঠোরের যে বন্দুকটির ছবি আপনারা কাগজে ও টিভিতে দেখেন এবং যা মাঝে হারিয়ে যাওয়াতে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল, তার নাম ‘ওভার—আন্ডার’। সাধারণত দোনলা বন্দুকের দুটি নল পাশাপাশি থাকে, কিন্তু ওভার—আন্ডারের নল থাকে ওপর—নিচে। রাজা—মহারাজারা ওই সব বহুমূল্য বন্দুক আমদানি করতেন। ট্র্যাপ ও স্কিট শুটিংয়ের অনুশীলনে যে পরিমাণ বন্দুকের গুলি খরচ হত তার দাম লক্ষ লক্ষ টাকা। প্রভাত দাশ এবং আমাদের আরেক শিকারি বন্ধু ও অনুজ, আসানসোলের নর্থব্রুক কলিয়ারির প্রণব রায়, অলিম্পিকের ট্রায়ালে যেত দিল্লিতে। একবার ঋতুর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম থাকায় এবং আমারও পেশার কাজ থাকাতে ঋতুকে নিয়ে দিল্লিতে যখন গিয়েছিলাম তখন সফদরজং এয়ারপোর্টের কাছে শুটিং রেঞ্জে অলিম্পিকের ট্রায়াল হচ্ছিল। গোপাল, প্রভাত এবং তার ভায়েরা, বিকানিরের মহারাজা, বিকানিরের রাজকুমারী, কোটার মহারাজা এবং আরও অনেক রাজা—মহারাজারা সেই ট্রায়াল—এ বেশ অনেকদিন প্র্যাকটিস করতে যেতেন। রাজকুমারী অবশ্য এয়ার—রাইফেল ছুড়তেন, বন্দুক নয়।

তখন আকাশবাণীর সব ন্যাশনাল প্রোগ্রামই হত দিল্লির আইফ্যাক্স হল—এ। সেখান থেকে সারা ভারতের বিভিন্ন আকাশবাণী কেন্দ্রে রিলে করে সেই অনুষ্ঠান শোনানো হত। ষাটের দশকের মাঝামাঝির কথা বলছি। মনে আছে, ঋতু ‘বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’ গানটি গেয়েছিল। বিমানদা (বিমান ঘোষ) আকাশবাণীর আর্কাইভ থেকে টেপ দিয়ে ওকে খুব সাহায্য করেছিলেন। ওই গানটি শান্তিনিকেতনের সাবিত্রী দেবী কৃষ্ণান খুব ভাল গাইতেন। ঋতু গাইবার পরে অবশ্য অনেকেই সেই গানটি গেয়ে থাকেন।

প্রভাতই জোর করে ঋতুকেও যেতে বলত ট্রায়াল দেখতে। তখন দিল্লিতে এত হোটেল ছিল না। আমরা উঠেছিলাম নবনির্মিত জনপথ হোটেলে। কোটার মহারাজার বাড়ি ছিল কাছেই। যাওয়ার সময়ে আমরা ট্যাক্সিতে যেতাম। ফেরার সময়ে উনিই আমাদের নামিয়ে দিতেন। সেই প্রথম কোনও ফ্লুইড—ড্রাইভ গাড়িতে চড়ি। ফ্লুইড—ড্রাইভ মানে, যে গাড়িতে গিয়ার থাকে না, অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিলেই গাড়ি চলে।

প্রভাত, প্রণব এবং গোপাল তিনজনই স্কিট ও ট্র্যাপ প্র্যাকটিস করে করে এমনই হাত করেছিল যে কোনও হাঁকোয়াতে কোনও পাখি একবার উড়লে সে ওপর দিয়েই উড়ুক কি নিচ দিয়ে, তার আর রক্ষা ছিল না। গান ক্লাবে যেমন বলে ‘পুল’ আর অমনি মাটির তৈরি ডিস্ক মেশিন থেকে উৎক্ষিপ্ত হয় প্রচণ্ড বেগে। শিকারেও কোনও পাখি উড়লে কেউ বলত ‘বার্ড’ আর পরক্ষণেই গুলি ছুটত আর সে পাখি ধরাশায়ী হত। যারা ট্র্যাপ ও স্কিট শুটার তারা বাহু ও কাঁধের সন্ধিতে লাগিয়ে বন্দুক ছোড়েন না, ঊরুর ওপরে বা কোমরে বন্দুকের Butt রেখে ট্রিগার টানেন।

গোপাল অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিল। ভাল ছবি আঁকত। ভাল ফোটোগ্রাফার ছিল। সোসাইটি অফ কনটেমপোরারি আর্টিস্টস—এর জন্মলগ্ন থেকে গোপাল তার অডিটর ছিল। শ্যামলদা (দত্ত রায়), অনিলদা (অনিলবরণ সাহা) এবং আরও অনেক চিত্রকরের সঙ্গে ওর হৃদ্যতা ছিল। ওর সঙ্গে সোসাইটির প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোডের অফিসেও গেছি বহুবার এবং অনেক চিত্রীর সঙ্গে আলাপিতও হয়েছি। তখন অনিলদার বাড়িতেই অফিস ছিল সোসাইটির, যতদূর মনে পড়ে। গোপাল খুব সুন্দর চিঠিও লিখত। চিঠির মধ্যেই ছবি আঁকত। প্রতি বছরই হাজারিবাগ থেকে ও বিজয়ার চিঠি লিখত আমাকে একটি করে। আজ ই—মেইল আর মোবাইল—এর দিনে সেই সব চিঠির দিনের কথা মনে হলে মন ভারী হয়ে ওঠে।

ওই আমাকে আতরের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করায় হাজারিবাগে। এক জাপানি চিত্রকর হাজিমিসো জাপান থেকে এসে গোপালের খুব বন্ধু হয়ে যায়। সে আমাদের সঙ্গে জঙ্গলেও যেত। পরে সে নেপালে গিয়ে খুবই অল্পবয়সে মারা যায়। তার মা—বাবার আমন্ত্রণে গোপাল পরে একবার জাপানে যায়। আমি জাপানে গেছি তার অনেক আগে। জাপান থেকে ফিরে হাজারিবাগের ‘পূর্বাচলের’ সামনের বাগানে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের বাড়ির পেছনে যেমন আছে তেমন একটি জাপানিজ গার্ডেনও করে। উচ্চচাঙ্গ সঙ্গীত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও খুবই ভক্ত ছিল ও। ছাত্রাবস্থায় ওর ট্রায়াম্ফ গাড়ির মধ্যে বসে অথবা ফুটপাথে খবরের কাগজ বিছিয়ে সারারাত উচ্চচাঙ্গ সঙ্গীত শুনেছি আমরা। এই অগায়কের রবীন্দ্রসঙ্গীতও গোপাল খুব ভালবাসত। বর্ষার দিনে অর্ডার করে করে ‘বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল’, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে গগনে গগনে ডাকে দেয়া’, ‘পুব—হাওয়াতে দেয় দোলা’ ইত্যাদি গান শুনত। হাজারিবাগে এক বর্ষার রাতে ওর সেতারি বন্ধু, উস্তাদ মুস্তাক আলি খাঁ সাহেবের শিষ্য পণ্ডিত দেবু চৌধুরি, আমি আর গোপাল, রাতে খিচুড়ি আলুভাজা আর ডিমভাজা খেয়ে দেবুর বাজনা শুনতে বসলাম। চতুর্থ কেউ ছিল না। দরবারি দিয়ে শুরু করে রাত শেষে ভৈরবী দিয়ে শেষ করল। সারারাত বাইরে বৃষ্টির ফিসফিসানি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক—এর কাজ করল। কোনও তবলিয়াও ছিল না। দেবু পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও সম্ভবত পদ্মবিভূষণও হয়েছিল পরে। তবে সাহিত্য, গান—বাজনা এবং অন্যান্য অনেক পুরস্কারই শুধুমাত্র গুণেরই কারণে দেওয়া হয় না। তাই ও আমাদের বন্ধু হলেও পদ্মবিভূষণটা বাড়াবাড়িই ঠেকেছিল আমাদের চোখে।

সেইসব দিনের কথা মনে হলে মন বড় ভারী হয়ে আসে। যখনই একা থাকি, তখনই সময়ে সময়ে মনে হয়, গোপাল দুবার ওর স্মোকার্স কাফ কেশে পেছন থেকে বলছে, লালসাহেব? কী করছ?

প্রথম যৌবনের উন্মাদনায় ও দুরন্ত সাহসে দুই বন্ধু, সঙ্গে কোনও জংলি অনুচর নিয়ে বন্দুক আর টর্চ নিয়ে সারারাত পায়ে হেঁটে শিকারের খোঁজে গভীর জঙ্গল ও টাঁড়ে ঘুরে জীবনীশক্তির শেষ বিন্দু খরচ করে ‘পূর্বাচল’—এ ফিরতাম ভোরের আলো ফুটলে। কোনওদিন শিকার হত, কোনওদিন খালি হাতেই ফিরতে হত। আমি ফিরেই বন্দুক গান—র‌্যাকে রেখে হাত—পা ধুয়ে শুয়ে পড়তাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে অচৈতন্য হয়ে যেতাম। প্রচণ্ড শৌখিন গোপাল অত্যন্ত স্নানবিলাসী ছিল। যখনই ফিরুক না কেন, গরম জলে স্নান করে গায়ে পাউডার আর পারফিউম ছিটিয়ে জাপানিজ কিমোনো পরে সে রান্নাঘরে যেত। ‘পূর্বাচলের’ রান্নাঘরটি ছিল দেখার মতো। গোপালের মা, মাসিমা, অত্যন্তই লক্ষ্মী মহিলা ছিলেন। তাঁর রান্নাঘর ও ভাঁড়ার ঘর সত্যিই দেখার মতো ছিল। যদি কোনও শিকার হত, দিনের বেলা হলে, মুরগি, তিতির, কালি তিতির, খরগোশ, রাতের বেলাতে কোটরা হরিণ, শুয়োর বা অন্য কিছু, চান করার আগে তার man friday চমনলাল এবং প্রয়োজনে আমাদের তৈলমর্দনকারী, ভূত ও ডাকাতের গা—শিউরানো গল্প—বলা হাজাম মহাবীর এবং মালি করমের সাহায্যে সেই মৃত জানোয়ার স্কিন করে কেটেকুটে নিজে হাতে রান্না করত। স্কিনিং বা কাটাকুটির মধ্যে আমি কোনওদিনই থাকতাম না। পাখিই হোক, শম্বরই হোক কী বাঘ বা লেপার্ডই হোক রক্ত আমি দেখতে পারতাম না। আমার বাবা আমাকে ভণ্ড বলতেন। আজ বুঝি যে, আমি ভণ্ড ছিলাম না কিন্তু শিকারি হলেও আমার মধ্যে একজন কবি ছিল। অথবা walt whitman—এর ভাষাতে বলতে গেলে বলতে হয়, ‘Do I contradict myself ? Very well Then, I do contradict myself. I contain multitudes.’ গোপাল তার স্বাভাবিক ঔদার্যে এ নিয়ে কখনও অনুযোগ করত না। রান্না হলে খাবার ঘরের টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমাকে নিজে ডাকতে আসত, অথবা চমনলালকে পাঠাত। ঘুম থেকে তুলে বলত, চলো, লালা, খাবে চলো। ও কত যে নিজস্ব সব নাম দিত এক—একটি পদের তা কী বলব! অ্যামেরিকান, রাশ্যান, চাইনিজ, জ্যাপানিজ, বার্মিজ, থাই নামের ফুলঝুরি ফুটত—আর তেমন স্বাদুও হত সেই সব পদ।

শিকার হলে, পূর্বাচলের লাগোয়া একটি দারুণ সুন্দর দোতলা বাড়ির অতি—বৃদ্ধ কেয়ারটেকার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মিস্টার স্মিথকে রান্না—করা খাবার গোপাল অবশ্যই পাঠাত। স্মিথ সাহেবও খুবই ভালবাসতেন গোপালকে। মাঝে মধ্যেই কেক অথবা ক্যারামেল কাস্টার্ড করে আমাদের জন্যে পাঠিয়ে দিতেন। বিকেলবেলা কখনও কখনও গল্পও করতে আসতেন। সহায়সম্বলহীন কিন্তু ভারি ভদ্র, সমাহিত, নির্লোভ, সুদর্শন, সম্ভ্রান্ত মানুষ ছিলেন স্মিথ সাহেব। যে বাংলোর উনি কেয়ারটেকার ছিলেন তার হাতাতে কয়েকটি জ্যাকারান্ডা গাছ ছিল। ওই দু’বাড়ির পেছনেই ছিল বিস্তীর্ণ টাঁড় এবং খোয়াই, যা গিয়ে শেষ হয়েছিল একেবারে কানহারী পাহাড়ের পাদদেশে। পঞ্চাশের দশকের কথা বলছি। তখন মাঝে মাঝে কানহারী থেকে নেমে সন্ধের পরে চিতাবাঘও চলে আসত। রেড বা ইয়ালো ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ নিস্তব্ধ নির্জন বৃষ্টি—ভেজা টাঁড়ের ওপরে চমকে চমকে ডাকত ‘ডিড উ্য ড্যু ইট?’ ডিড উ্য ড্যু ইট? ডিড উ্য ড্যু ইট?

এই পাখির ডাক পূর্বভারতে বিশেষ শোনা যায় না। কিন্তু রুখু অঞ্চলে এরা থাকেই। বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, এমনকী মহারাষ্ট্রেও এদের দেখা যায়। এদের প্রথম দেখি আমি স্কুলছাত্র থাকাকালীন উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের কাছে বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরসংলগ্ন মালভূমিতে এবং তাদের ডাক শুনে মুগ্ধ হই। তখন তাদের ইংরেজি নাম বা অর্নিথলজিক্যাল নামও জানতাম না। তাদের ডিড উ্য ড্যু ইট ডাকটি দূর থেকে টিটির—টি—টিটির—টি শোনাত। বাবার রাইফেল হাতে একদল চিঙ্কারা হরিণের (যে হরিণ এখন মারলে জেল হবে) পেছন পেছন ঘুরে বেড়ানো বিস্ময়াভিভূত এক কিশোরের কানে সেই পাখির চমক ভরা থমকে দেওয়া ডাক জাদুর স্পর্শ ছুঁইয়ে দিত। পরবর্তী জীবনে যত লেখা লিখেছি— সাম্প্রতিক অতীতের ছত্তিশগড়ের বেশকালঘাটির অভয়ারণ্যের পটভূমিতে লেখা ‘সম’—এ পর্যন্ত এই পাখির ডাকের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। আমার মৃত্যুর সময়ও, যার হয়তো খুব দেরিও নেই, ওই পাখির ডাক দূরের টাঁড়ের ওপরে শুনতে শুনতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে পারলে বড় শান্তিতে যেতে পারব।

চমনলালের বাঁ কানটা ডান কানের চেয়ে বড় ছিল। ওর যখন ইচ্ছে হত ও কানে শুনত, ইচ্ছে না হলে শুনত না। ড্যাবা—ড্যাবা চোখে এক আশ্চর্য অভিব্যক্তি ছিল। খিচুড়িটা খুবই ভাল রাঁধত। তখন ছাত্র, যে টাকা ট্যাঁকে করে বন্দুক কাঁধে রাতের ট্রেনে থার্ড ক্লাসে (তখন থার্ড ক্লাস ছিল) চড়ে পড়তাম হাজারিবাগে যাওয়ার জন্যে, তাতে দু’বেলা খিচুড়ি ছাড়া অন্য খাদ্য বিশেষ জুটত না। শিকার করলে মাংস খেতে পারতাম। মাছের মুখও দেখতাম না—রাগ করে নয়, সামর্থ্যের অভাবে। কিন্তু তাতে আমাদের কোনও ঘাটতি ছিল না। যৌবন ঈশ্বরের সর্বোত্তম দান। যৌবন থাকলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। সব সময়েই হাসি, গান, নির্জনতা উপভোগ করা—আনন্দই আনন্দ। প্রতিটি মুহূর্ত অপার আনন্দে কাটত।

গোপালের কথা সব বলতে গেলে একটি আলাদা বই লিখতে হয়। শুধু গোপালের কথাই নয়, এই বইয়ে উল্লিখিত সকলের কথাই। তবে ‘জংলি—মহলের’ অন্যান্য নানা চরিত্রর কথা বলতে গিয়ে গোপালের কথা আবারও নিশ্চয়ই আসবে। বিশেষ করে নাজিম সাহেব, ভুতো পার্টি, সুব্রত চ্যাটার্জি এদের কথা বলার সময়ে।

নাপিত মহাবীরও খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র ছিল। ও আমাদের তেল মাখাতে মাখাতে এমন এমন সব গল্প বলত, যা মনে রাখার মতো। ওরই বলা ডাকাত দিগা পাঁড়ের নামটিকে আমি মাধুকরীর সন্ত দিগা পাঁড়ে করেছি। মাধুকরীর অনেকই চরিত্রের বীজ হাজারিবাগ থেকে নেওয়া।

গোপাল এবং হাজারিবাগের স্মৃতির কথা বলতে গেলে সত্যিই আলাদা বই লিখতে হয়।

একবার আমরা দুজনে গেছি হাজারিবাগে। তখনও আমরা সি.এ.—র ছাত্র। তবে আর্টিকেলশিপ শেষ হয়েছে। যার—যার বাবার অফিসে কাজ করি এবং সামান্য মাইনে পাই।

একদিন বিকেলে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি, পূর্বাচলের করম মালি নিজের কাজ থামিয়ে এসে বলল যে সীতাগড়া পাহাড়ে একটি মস্ত বড় বাঘ নাকি পাহাড়ের উপরের পিঁজরাপোলের গোরু—বলদ মেরে একসা করে দিচ্ছে। দুটি মানুষও নাকি মেরেছে ইতিমধ্যেই।

তখন আমাদের দুজনেরই শুধুমাত্র একটি করে দোনলা বন্দুক। রাইফেল নেই। জিপ তো নেইই, গাড়িও নেই। টাকাও নেই যে জিপ বা গাড়ি ভাড়া করব। ‘পূর্বাচল’ থেকে ‘সীতাগড়া’ অনেকই দূর। অথচ বাঘ এবং এমনি বাঘ নয়, মানুষখেকো বাঘ মারার এমন সুযোগ আর আসবে না।

গোপাল বলল, গতকাল সকালে বাজারফেরত নাজিম সাহেবের দোকানে গেছিলাম। তিনি বললেন যে হাজারিবাগের পুলিশ সাহেবের বড় ছেলে আমাদেরই বয়সি এবং তারও শিকারের শখ আছে। পুলিস সাহেবের ছেলেকে কব্জা করতে পারলে আমাদের গাড়ি না থাকার দুঃখ ঘুচে যাবে। তুমি তো বাংলাটা ভাল লেখো—একখানা চিঠি লেখো তো ভাল করে যাতে এক চিঠিতেই সেই পার্টি কুপোকাত হয় আর সে কুপোকাত হলে তো কম্মো ফতেই হয়ে গেল। গোপাল আমার সঙ্গে ওই রকম ভাষাতেই কথা বলত।

অতএব পূর্বাচলের পশ্চিমমুখো বারান্দাতে বসে আমি সুব্রত চ্যাটার্জি নামক অদেখা অজানা এক সমবয়সি ছেলের উদ্দেশে একটি চিঠি মক্সো করে গোপালকে পড়ে শোনালাম। গোপাল বলল, এক্কেবারে অ্যালফাম্যাক্স—এর লেথাল বল এর মার হয়েছে। এ চিঠিতে পুলিশ সাহেবের ছেলে ধরাশায়ী না হয়েই যায় না।

তারপর চিঠি খামবন্দি করে করম মালির হাত দিয়ে পাঠানো হল। করমের বাড়ি ছিল সিঁদুর বস্তিতে—কানহারী পাহাড়ের নীচের জঙ্গলের মধ্যের শর্টকার্ট লাল মাটির পথ দিয়েই সে তার গাঁয়ে ফিরত আর পুলিশ সাহেব সত্যচরণ চ্যাটার্জির বাংলো ছিল কানহারী হিল রোডেরই উপরে। এস. পি. সাহেবের নাম, তাঁর বড় ছেলের নাম এসব নাজিম সাহেবই আমাদের দিয়েছিলেন। নাজিম সাহেবের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক ছিল কারণ পুলিশ দপ্তরেও উনি ইউনিফর্ম, জুতো, বেল্ট, টুপি এসব সরবরাহ করতেন। সুব্রতর নাম উনি লিখে দিয়েছিলেন বটে কিন্তু সুব্রত নামটি উনি উচ্চচারণ করতে পারতেন না। চিরদিন সুব্রতকে ‘সুরবোতো’ বলতেন। নয়তো, সুব্রতর মা, পরে আমাদের প্রিয় মাসিমা সুব্রতকে যে ডাকনামে ডাকতেন সেই ‘খোকা’ নামেই ভর করেছিলেন। বলতেন ‘খোকাবাবু।’

করম তো চিঠি নিয়ে চলে গেল। সে কাজে আসবে আবার পরদিন সকালে। আমাদের টেনশন শুরু হল।

পরদিন করম যথাসময়ে কাজে এল আর জানাল যে পুলিশ সাহেবের বাংলার একজন গার্ড চিঠিটি নিয়ে বাংলোর ভিতরে সেঁধিয়ে গেছে। চিঠি যে যথাস্থানে পৌঁছেছে তা নিয়ে কোনও সংশয়ের কারণ নেই। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। দুপর গড়িয়ে, বিকেল, তবুও কোনও উত্তর নেই।

আমি অনুযোগ করে গোপালকে বললাম, মিছিমিছি ছোট করা হল নিজেদের। মধ্যে দিয়ে সীতাগড়ার বাঘের খবরটা সে পেয়ে গেল। আমাদের কলা দেখিয়ে রিসোর্সফুল এস. পি. সাহেবের ব্যাটাই বাঘটা মেরে দেবে।

গোপাল হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে বলল, পার্কালাম।

তখন তামিলনাড়ুর লুঙি—পরা গুঁফো নেতা কামরাজ নাদার প্রায়ই শব্দটি ব্যবহার করতেন। সব কাগজেই শব্দটি প্রকাশিত হত। তার মানে নাকি wait and see।

তারপর গোপাল পরপর তিনবার বলল, পার্কালাম। পার্কালাম! পার্কালাম!

আমি তখন পাইপ খেতাম। প্রায় পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর খেয়েছিলাম। পাইপে ভাল করে তামাক ঠুসে আবার পাইপটা যখন ধরাচ্ছি একটি কালো—রঙা ঢাউস মার্কারি—ফোর্ড গাড়ি পূর্বাচলের গেট—এ এসে দাঁড়াল। করম দৌড়ে গিয়ে গেট খুলতে গাড়িটি ভিতরে এল। ড্রইভিং সিট থেকে একটি ফর্সা, বুদ্ধিমান, লম্বা এবং ছিপছিপে ছেলে নেমে হাতজোড় করে বলল, আমিই সুব্রত। আমরাও নমস্কার করে তাকে বসালাম। গোপাল ভিতরে গিয়ে চমনলালকে চা আনতে বলল। এবং বিড়ি এগিয়ে দিল। দেখলাম আগন্তুকও গোপালেরই মতো প্রায় চেইন স্মোকার।

সুব্রত বাঘ সম্বন্ধে যা জানার তা জেনে নিয়ে বলল, কাল আমি বাবার সঙ্গে কোডারমা যাচ্ছি—বাবা কোডারমা থানা ইনসপেকশানে যাচ্ছেন। পরশুর পর দিন আমি ফিরে আবার যোগাযোগ করব। তারপরই বলল, আপনারা কদিন আছেন?

অফিসে আমার জরুরি কাজ ছিল। আমি বললাম, আমি তিনদিন আছি তবে গোপাল থাকবে আরও কদিন।

সুব্রত বলল, হুমম।

এই রকম হুমম বলা ওর অভ্যেস ছিল।

তারপর চা—টা খেয়ে আমাদের স্বার্থ পুরোপুরি অসিদ্ধ রেখে ‘আজ তাহলে চলি’ বলে সুব্রত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, আপনারাও আসবেন একদিন। আমরাও ওকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে নমস্কার করলাম।

গোপাল বলল, পার্টি চালিয়াত আছে। এই টুকু তো পথ, হেঁটে আসতে পারল না, নিদেনপক্ষে সাইকেল? বাবার গাড়ি তো আমাদেরও অনেকেই আছে। বাবার গাড়ি দেখিয়ে আমাদের ইমপ্রেস করতে এসেছিল। ফুঃ।

সুব্রতর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার পরে বুঝেছিলাম যে ও চালিয়াত নয় তবে ওর নিজস্ব স্টাইল ছিল সব ব্যাপারেই। ভীষণই বুদ্ধিমান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং মিতভাষী ছিল ও। রসবোধও ছিল প্রচণ্ড। পরবর্তী জীবনে ‘থ্রি—কমরেডস’ এর মতো হয়েছিল আমাদের বন্ধুত্ব, প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের অঢেল অমিল থাকা সত্ত্বেও।

ও চলে গেলে, গোপাল স্বগতোক্তি করল, আগামীকাল ভুতো পার্টির আসবার কথা আছে কলকাতা থেকে। ওর বন্ধু তুতুল, তার সেকেন্ড হ্যান্ড সিঁত্রয় গাড়ি আর নতুন দোনলা বন্দুক নিয়ে আসবে।

খবর শুনেই আমি কুঁকড়ে গেলাম। গোপালের সঙ্গে আমার ওয়েভ—লেংথ—এর মিল হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আড্ডা টাড্ডা খুব একটা মারতাম না—অন্য ওয়েভ—লেন্থ—এর মানুষের সঙ্গে চট করে মিশতে পারতাম না। তাছাড়া ছেলেবেলা থেকেই আমার পছন্দ অপছন্দ অত্যন্তই তীব্র ছিল। যাকে বা যাদের আমি পছন্দ করি তাদের জন্যে প্রাণ দিতে পারি আর যাদের করি না তাদের সহ্যই করতে পারি না। হয়তো তাদের প্রাণও নিতে পারি। এটা অত্যন্তই দোষের কথা। নীরেনদা (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) পরবর্তী জীবনে আমাকে বলেছিলেন, যেখানে প্রেমের সম্পর্ক সম্ভব নয়, সেখানে প্রীতির সম্পর্কও রাখতে পারবে না কেন?

তেমন করে নীরেনদার কথা মানা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। এই অপারগতার জন্যে মূল্যও কম দিতে হয়নি।

সেই কারণেই, কারা আসবে না আসবে ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

ভুতো পার্টি কে? কী করে?

ভুতো আমাদের চেয়ে অনেক ছোট। তবে আলাপ হলে জানতে পাবে সে কী যন্ত্র অথবা যন্ত্রণা!

জিজ্ঞেস করলাম করেটা কী? ইংরেজিতে যেমন বলে, হোয়াট ইজ হি?

ওর একটা ছোট মোটর গ্যারাজ আছে—মানে মেরামতির গ্যারাজ। আমাদের গাড়িও মেরামত করে। স্কুলের গণ্ডিও পেরোয়নি, কেন পেরোয়নি সে এক ইতিহাস। তবে প্রচণ্ড ইন্টেলিজেন্ট এবং ভেরি গুড কোম্পানি।

আমি চুপ করে রইলাম। গাড়ির মিস্ত্রি!

গোপালের মধ্যে এই ব্যাপারটা ছিল। ও নিজের চেয়ে উৎকৃষ্ট মানুষদের এড়িয়ে চলত আর অনেক ক্ষেত্রেই দোস্তি করত ওর চেয়ে সবদিক দিয়েই নিকৃষ্ট মানুষদের সঙ্গে। পরে বয়স বাড়লে অভিজ্ঞতা বাড়লে বুঝে ছিলাম কোনও ব্যাপারেই শ্রেণিভেদ করলে জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে কম শিক্ষিত, কম বিত্তশালী, কম সামাজিক পরিচয়ের মানুষরাই উচ্চচশিক্ষিত, প্রভূত বিত্তশালী এবং সমাজের উচ্চচতম সোপানে অবস্থানকারী মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি নিটোল মানুষ, অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। ‘মাধুকরী’র পৃথু ঘোষের গড়নে গোপালের প্রভাব অবশ্যই ছিল এবং মোটর মেকানিক ভুচুর মধ্যে পরে আমাদের অত্যন্তই পরিচিত ভুতোর প্রভাবও ছিল কিছুটা। উপন্যাসের কোনও চরিত্রই হুবহু একজন অন্য মানুষের মতো হয় না। তা হলে উপন্যাসের চরিত্রহানি হয়। তবে অন্য এক বা একাধিক মানুষের ছায়া উপন্যাসের নায়ক নায়িকার উপরে পড়েই।

সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিল। সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়েছিল। চোখ মেলেই দেখি বারান্দায় তিন—চারটি ছেলে। নিম্নাঙ্গে ফেডেড জিনস এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন। প্রত্যেকেরই বুকে চুলের কম্বল।

‘জিনস’ এখন সকলেই পরে। পঞ্চাশের দশকের শেষে জিনস খুব কম মানুষই পরতেন। মেয়েদের মধ্যে জিনস পরার চল তো একেবারেই ছিল না। ঘুম থেকে উঠেই একটা ধাক্কা খেলাম। চোখমুখ ধুয়ে বারান্দাতে চা—এর টেবলে গিয়ে বসার পরে গোপাল সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

তুতুল নামের ছেলেটি বলল, নতুন বন্দুকের লাইসেন্স করেছি তাই হাজারিবাঘে এলাম। যেখানে হাজার বাঘ আছে, সেখানে কি আমার জন্যে একজনও আত্মহত্যা করতে রাজি হবে না?

কী কী শিকার করেছেন?

ভুতো বলল, বকও মারেনি। বাঘ দিয়ে অ্যাকাউন্ট ওপেন করতে চায়।

গোপাল বলল শব্দটা হাজারিবাঘ নয়, হাজারিবাগ—মানে যেখানে হাজার বাগিচা।

তাই?

তুতুল বলল লজ্জিত হয়ে। ওরা থাকত দেশপ্রিয় পার্কের গায়ের লেক টেরাসে। ওর কাকা জজসাহেব ছিলেন। বহু বছর হল আমেরিকাতে থাকে। মাঝে মাঝে এয়ারপোর্টে দেখা হত।

চা খাওয়ার পরে গোপাল আমাকে ডেকে নিয়ে পেছনের বারান্দাতে গিয়ে বলল, লালসাহেব, বন্দুক দুটো ভেঙে বাজারের বড় থলেতে ঢুকিয়ে রিকশা করে আমরা সীতাগড়া পাহাড়ের নিচু অবধি যাব। নাজিম মিঞাও যাবেন অন্য রিকশাতে। উনি আমাদের জন্যে কাছারির মোড়ে অপেক্ষা করবেন। এস. পি.র ছেলে বাঘটা মারার আগেই আমাদের একটা চেষ্টা করতে হবে। আর এই পার্টিদের গাড়ি থাকলেও গাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে না আমাদের। কী কেলো হল বলো তো!

ব্রেকফাস্টের পরে ‘বাজারে যাচ্ছি’ বলে আমরা তো ডি. ভি. সি.র মোড় থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সীতাগড়াতে পৌঁছতে অনেকক্ষণ লাগল। সেখানে রিকশাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ওয়েটিং চার্জ দেবার লোভ দেখিয়ে নিজের নিজের বন্দুক জোড়া লাগিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে এগোলাম। বাঘ মারা খুব সহজ কর্ম নয়—আসলে আমরা সেই সকালে গেছিলাম স্কাউটিং করতেই।

ঈশ্বর বড় দয়ালু। আধ মাইলটাক গিয়েই পথের ডান দিকে একটি নালার মধ্যে বাঘের থাবার দাগ আবিষ্কার করলেন নাজিম সাহেব। গত রাতের বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে ছিল। সেই মাটিতে বাঘের পায়ের দাগ দেখে আমাদের পিলে চমকে গেল। এত বড় বাঘ! বাঘের না, যেন হাতির পায়ের দাগ। শোনা গেল বাঘ এই নালা দিয়েই জঙ্গলের ভিতর থেকে এসে পথে ওঠে। এরপর রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের জঙ্গলে যায়। সে জঙ্গলেই পিঁজরাপোল—এর গাই বলদ চরাবরা করে। রাস্তার ও—পাড়ে একটি বড় আমগাছ দেখিয়ে নাজিম সাহেব বললেন, ওই গাছে মাচা বেঁধে আজই বিকেলে এসে বসতে হবে। কপালে থাকলে এস. পি. সাহেবের ছেলে মারার আগে আমরাই বাঘ মেরে দেব। তবে একটা কাঁড়া জোগাড় করতে হবে। সেটা বেঁধে মাচায় বসতে হবে।

নালা থেকে উঠে আমরা কাঁচা পথে সবে উঠেছি এমন সময়ে দেখি সিঁত্রয় গাড়িটি আসছে। কাছে আসতেই গাড়ি থামিয়ে ‘হাজারিবাঘে’ বাঘ মারতে—আসা শিকারিরা নেমে পড়ে আমাদের মারে আর কী! গোপালেরই গালাগালিটা শুনতে হল বেশি। ওরা বলল ”হাউ মিন অফ উ্য”। এই ভাবে আমাদের সঙ্গে মিথ্যাচার করে একা একা বাঘ মারতে চলে এলেন আপনারা।

কে বলল তোমাদের?

কে আবার? চমনলাল। তাকে অবশ্য একটা বড় পাত্তি দিতে হয়েছিল। তবু কিছুতেই কবুল করে না। শেষে গুলি করার ভয় দেখিয়ে ফ্যাক্টটা জানা গেল।

গোপাল বলল, আমরা স্কাউটিং করতে এসেছি। তোমরা গিয়ে সীতাগড়া গ্রামের মুখিয়ার কাছে বোসো। আমরা আসছি।

তারপরের ঘটনা আমরা মুখিয়ার মুখেই শুনি। আম গাছটাকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে মুখিয়ার কাছে একটি কাঁড়া অর্থাৎ মোষের কথা বলে এবং গাছটার বর্ণনা দিয়ে সেখানে একটা মাচা বাঁধতে বলে আসবেন নাজিম সাহেব—টাকা—পয়সাও দিয়ে দেবেন। কাঁড়া যদি বাঘের হাতে মারা যায় তবে তার দাম দিয়ে দেওয়া হবে আর বেঁচে থাকলে মোষের ভাড়া বাবদও কিছু টাকা দেওয়া হবে। নাজিম সাহেব মুখিয়াকে ভাল করে জানতেন।

আমরা যখন সীতাগড়া গ্রামের কাছে পৌঁছেছি তখন দেখি সিঁত্রয় গাড়িটা ফিরে আসছে। কী হল? ফিরে আসছে কেন?

গাড়িটা কাছে আসতেই ওরা বলল, সারা রাত ড্রাইভ করে এসেছি, ঘুম পাচ্ছে। আমরা ফিরে যাচ্ছি। গিয়ে চান করে ভাত খেয়ে ঘুমুব।

মুখিয়ার মুখ থেকেই ওদের ফিরে যাওয়ার কারণ জানা গেল।

ওরা গ্রামের বড় অশ্বত্থগাছের তলাতে গিয়ে পৌঁছতেই মুখিয়া তাদের চৌপাই পেতে বসতে দিয়ে জল আর গুড় খেতে দিয়েছিল। জল খেয়ে তুতুল বলল, আরে এ বুঢঢা, বাঘ হ্যায় হিঁয়া? বাঘ দিখা দো, বাঘ মারে গা।

মুখিয়া তার বুকের কাছে ডান হাতখানা তুলে বলল, বাঘোয়া তো হ্যায়ই হুজৌর মগর ডাবল বাঘোয়া। দিখকর আপলোগোঁকা দিমাগ খরাব হো যায়েগা। বাঘোয়া মারা আপনে কভি?

বহুত মারা। সুন্দরবনকে কিতনা বাঘোয়া মারা!

মুখিয়া বলল, তবতো ঠিক্কেই হ্যায়। বাঘোয়া দিখা দেগা। মগর ইক বাত পুছনা থা।

ক্যা বাত?

আপলোগোঁকি কন্টিপেটাং হ্যায় ক্যা?

কন্টিপেটাং? মতলব?

তব শুনিয়ে, বাতাতা হ্যায়। কলকাত্তাসে চুনী বাবু আয়া থা বাঘোয়া শিকার কি লিয়ে। মাচ্চচা বান্ধা গ্যায়া, খানা—পিনা, নাচনা—গানা, ফালানা— চোমকানা। ম্যায় ঔর চুনীবাবু মাচান পর বৈঠে হুয়ে থে। সুরজ ডুবা নেই উসকি পহিলেই বহুত বড়কা বাঘোয়া আ পৌঁছা মাচানকি নীচে। কাঁড়াতো ডরকে মারে ধড়ফরানে লাগা। চুনী বাবুকো ডাইনে রাইফেলোয়া, বাঁয়া বন্দুকোয়া। ম্যায়নে বোলিন, মারিয়ে চুনীবাবু, মারিয়ে। বাঘোয়া খাড়া হ্যায়।

বাঘোয়া তো ইস্মে—উস্মে গামাতা হ্যায়। মগর চুনীবাবু না বন্দুক উঠাইস না রাইফেলোয়া।

ম্যায়নে বোলা, মারিয়ে চুনীবাবু, মারিয়ে। ওহি টাইম পর—ক্যা বোলিন বাবু—যেই সা আওয়াজ ঐসা বদবু। আওয়াজ না শুনকর বাঘোয়া তো কুদকর ভাগ গ্যায়া। ওর ম্যায়নে গিড়া বহতই মুসীবতমে—উপরমে চুনীবাবু নিচুমে বাঘোয়া—ক্যা করে ম্যায়, ছঁওড়াপুত্তানিয়া। ম্যায়তো তুরন্ত মাচানকে নীচে উতরা ঔর অংগলি সে নাক বন্ধ করকে বোলা আপনে ক্যা কিহিন চুনীবাবু। চুনীবাবু বোলিন, চুপ রহো, সুরতহারাম। জলদি তানবুমে যাও, পায়জামা লাও। হামারা কন্টিপেটাং থা। তিন মাহিনাসে কিলিয়াড় নেহি হোতা যা। বাঘোয়া দিখকর ………….।

গল্প শুনে ভুতো অ্যান্ড তুতুল কোম্পানি তো হতভম্ব।

ভুতো বলেছিল, মানে বুঝলি তুতুল?

তুতুল বলল, হ্যাঁ। কনস্টিপেশান।

মুখিয়া বলল, আপলোগোঁকো কন্টিপেটাং নেহি রহনেসে ম্যায় বাঘোয়া দিখা দেগা। বোলিয়ে, হ্যায় ক্যা নেহি?

হাইলি ইনটেলিজেন্ট ভুতো ও তুতুল সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে গাড়ি ঘুরিয়ে হাজারিবাগ শহরের দিকে ‘অ্যাবাউট—টার্ন। সেই সময়েই তাদের সঙ্গে দেখা আমাদের।

গল্প শুনে আমরা হাসব না কাঁদব ভেবে পাই না। নাজিম সাহেব হো হো করে হাসতে লাগলেন। ঘটনার ঘোর কাটিয়ে ওঠার পরে আমরাও।

সে দিন সীতাগড়াতে আমাদের আর ফেরা হয়নি। কারণ, গোপালের একটি দুরারোগ্য রোগ ছিল। হাজারিবাগে থাকাকালীন সে দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর একগাছা বিড়ি খেয়ে পায়জামার দড়িটি ঢিলে দিয়ে নেয়ারের চৌপায়াতে শুয়ে পড়ত। ওর হাতে পায়ে ধরলাম সেদিন না—ঘুমোনোর জন্যে। আমরা সীতাগড়া থেকে ফিরেইছিলাম প্রায় দেড়টার সময়ে। গোপালের ঘুম যখন ভাঙল তখন সূর্য অস্ত গেছে। তখন আর নাজিম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে সীতাগড়াতে গিয়ে মাচা বাঁধিয়ে এবং মাচার নীচে মোষ বেঁধে বসার সময় ছিল না। তবে, গেছিলাম পরদিন। কিন্তু সেদিনও গেছিলাম গোপালের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার পরে। ফলে মাচা বাঁধানো গেলেও মোষ বাঁধার সময় ছিল না। সীতাগড়ার মুখিয়া আগের দিন সব জোগাড়যন্ত্র করে রেখেছিল কিন্তু আমরা না—যাওয়াতে বিরক্ত হয়ে পরদিন কাঁড়া আর জোগাড় করেনি। তবে অদম্য এবং জিনিয়াস নাজিম সাহেব এক গাছা গোরু বাঁধা দড়ি ও গোরুর গলার ঘণ্টা জোগাড় করে দড়ির এক প্রান্তে বাঁধা ঘণ্টাটিকে মাচা থেকে অনেক দূরে একটি ঝোপের মধ্যে শক্ত করে কিন্তু ঢিলে দিয়ে বেঁধে দড়ির অন্য প্রান্ত হাতে করে মাচাতে বসলেন এবং অন্ধকার হয়ে যাবার পর থেকেই মাঝে মাঝেই দড়িটিতে হ্যাঁচকা টান মেরে ঘণ্টাটাকে বাজাতে লাগলেন। শব্দ শুনে শুনে আমাদেরও মনে হতে লাগল যেন কোনও গোরু ঘরে ফেরেনি জঙ্গল আর টাঁড়ের মধ্যের কেলাউন্দা ঝোপের কাছেই চরা—বরা করছে। আমাদের মনে হলে বাঘেরও মনে হতে পারত। এবং বিশ্বাস করুন আর নাই করুন তাইই মনে হয়েছিল সেই বাঘেরও।

যে গাছে ঘণ্টা বাঁধা ছিল তার বেশ খানিকটা পেছনে একটি বড় কালো পাথর ছিল—কাছিম পেঠা। তার উপরে এসে বাঘটি বসে ছিল। পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলোতে কালো পাথরের উপরে হাজারিবাগে বাঘের পাটকিলে রঙা শরীরের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল কিন্তু তার অবস্থান ছিল বন্দুকের পাল্লার অনেকই বাইরে। নাজিম সাহেবের, গোপালের এবং আমার তিনজনেরই কাছে দোনলা বন্দুক ছিল বারো বোরের কিন্তু তিনটি বন্দুক থাকলেও বন্দুকের পাল্লা তো আর ত্রিগুণান্বিত হয়ে যায় না।

ইতিমধ্যে ভুতো অ্যান্ড তুতুল পার্টির সঙ্গে আমাদের শান্তি চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। ‘কন্টিপেটাং না থাকলেও এ বাঘ মারার আর কোনও উৎসাহ তারা দেখায়নি বরং তাদের গাড়ি করে আমাদের অকুস্থলে পৌঁছে দিয়ে হাজারিবাগে ফিরে গিয়েছিল। কথা ছিল যে তারা রাত দশটা নাগাদ ওই গাছতলাতে ফিরে আসবে আমাদের ফেরত নিয়ে যেতে। তবে তাদের বারবার করে বলে দিয়েছিল গোপাল তারা যেন গাড়ি থেকে না নামে এবং হেডলাইট জ্বালিয়ে যেন গাড়ি গাছতলাতে দাঁড় করিয়ে রাখে।

বাঘ কোনও বুড়ো ঋষির মতো সেই পাথরে বসে রইল তো বসেই রইল। ভুলেও সে মাচার দিকে এল না। গতকাল সকালে আমরা তার পায়ের থাবার দাগ দেখেছিলাম। আমাদের কারওরই সাহস ছিল না ওই বাঘকে রাতের বেলা পায়ে হেঁটে গিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে গুলি করি। অভিজ্ঞ নাজিম সাহেবেরও সেই দুঃসাহস ছিল না। কলকাতার শিকারি চুনীবাবুর একারই নয়, প্রায় অধিকাংশ বাঘ—প্রত্যাশী শিকারিরই বোধ হয় সুপ্ত কন্টিপেটাং থাকে। সময় বিশেষে তা ধরা পড়ে, এটাই যা।

রাত দশটাতে সিঁত্রয় গাড়ি এল এবং দুজন টিন এজার এবং অনভিজ্ঞ শিকারি তাদের লোকাল গার্জেন নাজিম সাহেবের সঙ্গে মাচা থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে গিয়ে সিঁত্রয় গাড়ির কাচ—বন্ধ নিরাপত্তাতে ফিরে আশ্বস্ত বোধ করেছিল সেই ফিস ফিস করে বৃষ্টিঝরা রাতে।

আমি পরদিন ফিরে যাব কলকাতাতে। গোপাল ফিরবে তিনদিন পরে। গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, খাল কেটে কুমির আনলাম আমরা। এ বাঘ পুলিশ সাহেবের ছেলের অ্যাকাউন্টেই জমা পড়ল। বুঝলে, লালসাহেব।

আমি বললাম হুঁ।

গোপাল একবার হাজারিবাগে গেছে গরমের সময়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে। ও ড্রাইভার রাখেনি কখনও। বলত, ‘প্রাইভেসি থাকে না।’ সেখানে গিয়ে তার পুত্র গুটুগুটবাবু ও একমাত্র বোনের ছেলেকে নিয়ে পয়েন্ট টু—টু রাইফেল ছোড়া প্র্যাকটিস করাচ্ছিল পেছনের বাগানের খড়—ছাওয়া ঘরের সিমেন্টের বেঞ্চে বসে। গুলি ছোড়া হচ্ছিল রীতিমতো প্রতিযোগিতার কার্ড—এ। কার্ড—এর মধ্যে ‘বুলস আই’, তার পরের বৃত্তটির নাম ‘ইনার’, তার পরে ‘ম্যাগপাই’, তার পরে ‘আউটার’। কার কটা গুলি বুলস—আইতে লাগছিল তাই দেখা হচ্ছিল। যাদের হাত খুব ভাল তাঁরা বুলস—আইয়ের একই ছ্যাঁদা দিয়ে একাধিক গুলি ঢোকাতে পারে। তাতে সেই ছ্যাঁদাটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। আমার বাবা, রাঁচির ‘Gonda House’—এ, এখন যেখানে কোল ইন্ডিয়ার অফিস, তখন আমাদের মক্কেল, কলিয়ারি—কিং অর্জুন আগরওয়ালার বাড়ি ছিল (তৎকালীন সাহেব গভর্নরের শাশুড়ির বাড়ি, তাঁরা বিলেত চলে যাওয়ার সময়ে অর্জুনবাবু কিনে নিয়েছিলেন) সেই বাড়ির পেছনে ১২০ বিঘা হাতার মধ্যে একটি পাহাড় ছিল। সেখানে শুটিং রেঞ্জ ছিল। সেই শুটিং রেঞ্জের সামনে ফোটা গ্যাঁদা ফুলের পাপড়িগুলোকে বাবাকে গুলি করে একটি একটি করে ছিঁড়তে দেখেছি আমি—পয়েন্ট টু—টু রাইফেল দিয়ে। তখন দারুণ হাত ছিল বাবার।

গোপালের প্র্যাকটিস যখন জমে উঠেছে তখন হঠাৎ ওর ডান চোখের মণিটা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। গোপাল বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে সেই অবাধ্য মণিকে ভেতরে ঠেলে দিয়ে ছেলে ও ভাগ্নেকে বলল, প্যাক—আপ। কলকাতা যেতে হবে। ততক্ষণে রক্তে তার মুখ ভেসে যাচ্ছে।

ভাগ্নেকে বলল, সিগারেটটা ধরিয়ে দে তো বিটকেল। আদরের ভাগ্নেকে সে বিটকেল বলে ডাকত। তারপর চমনলাল গাড়িতে মালপত্র চাপালে, ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালিয়ে কলকাতা চলে এল। আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন। তার কিছুদিন আগেই ওর একই সঙ্গে সেরিব্রাল ও করোনারি স্ট্রোক হয়েছিল, অফিসে বসে কাজ করতে করতে।

অফিসের কাজে সে অবশ্য কখনও তেমন মন দেয়নি। ওর মন পড়ে থাকত হাজারিবাগে। এদিকে মন দেওয়ার দরকারও ছিল না। ওরা এমনিতেই এত ধনী ছিল যে কয়েক পুরুষ অনায়াসে বসে খেতে পারত। ওর ভালবাসার জায়গা ছিল হাজারিবাগ। কোনও নারীকেও সে জীবনে এত ভালবাসেনি। আর ভালবাসার জিনিস বলতে ছিল বন্দুক—রাইফেল, পারফিউম, নানা রকম ক্যামেরা, নানা রকম ওরিজিনাল জামাকাপড়। কোনও ক্লাবেরই মেম্বার ছিল না—। আমি কলকাতায় প্রায় সবকটি ক্লাবের মেম্বার ছিলাম এক সময়ে, কিন্তু ওকে কোনও দিনও কোনও ক্লাবেই নিয়ে যেতে পারিনি। ও বলত, দুসস, মেকি পরিবেশ।

হাজারিবাগে, গরমের সময়ে, আমরা একবার রাজডেরোয়া ন্যাশনাল পার্কে আছি। তখন আমি, গোপাল এবং আমাদের আরেক বন্ধু সুব্রত, সবাই প্রতিষ্ঠিত। সকালবেলাতে একটি ছোট ঝোলাতে দুটি বিয়ারের বোতল এবং সাইলেন্সার—লাগানো পিস্তলটি নিয়ে শর্টস এবং স্পোর্টস গেঞ্জি পরে টুকটুক করে হেঁটে জঙ্গলের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যেত গোপাল। দু—তিন ঘণ্টা পরে ফিরত ঝোলার মধ্যে একটি মোরগ বা দুটি তিতির নিয়ে। সাইলেন্সার—লাগানো পিস্তল দিয়ে মারাতে কোনও শব্দ হত না।

ব্যাপারটা পুরোপুরিই বেআইনি ছিল। কিন্তু গোপালের মধ্যে রাজা মহারাজা নবাবদের মতো এক ধরনের রহিসি ছিল বলেই হয়তো কোনও রকম আইন—কানুনেরই ও তোয়াক্কা রাখত না। তাচ্ছিল্যের গলাতে বলত, ‘ছাড়ো তো লালা। আমি দুগাছা তিতির মারলেই দেশের সব্বোনাশ হবে? দেশে যে সব মহাচোর ঘুরে বেড়াচ্ছে, দিনদুপুরে ডাকাতি করছে, সেই সব শিল্পপতি আর নেতাদের পোরো না দেখি জেলে! যত্ত সব আদিখ্যেতা!’

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমনভাবে বলতেন, ‘যত্ত সব ফোতো’— গোপালের ‘যত্ত সব আদিখ্যেতা’ বলার ধরনটাও ছিল তেমনই। তবে এ কথা ঠিক যে, তখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য আইন হয়নি। তা ছাড়া সব প্রাণীই ছিল অঢেল। কিন্তু অভয়ারণ্যের মধ্যে শিকার করা তো বেআইনি ছিলই।

আমি জরুরি কাজে দিল্লি গেছি। সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস—এর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কাজ। রাতে হোটেল থেকে কলকাতাতে ঋতুকে ফোন করে জানলাম, গোপাল খুবই অসুস্থ হয়ে বেলভিউতে ভর্তি হয়েছে। আমি বললাম, পরশু সকালের ফ্লাইটে ফিরছি, ফিরেই নার্সিংহোমে যাব। তার আগে ফিরতে পারব না।

কলকাতায় ফিরে সকালে দেখা হল না। দেরি হয়ে গেছিল। গোপাল আই সি ইউ—তে ছিল। বিকেলে গেলাম। গোপালের স্ত্রী জয়শ্রীর খুবই আপত্তি, আমরা বন্ধুরা কেউই যেন দেখা না করি। কারণ, করলে ও উত্তেজিত হবে। হয়তো সত্যিই হবে। কিন্তু দেখা না করেই বা কী করি? ১৯৫২ থেকে বন্ধুত্ব। তা ছাড়া, জঙ্গলের বন্ধুত্ব। শহরে একশো বছরেও যে বন্ধুত্ব হয় না, পাশাপাশি রাইফেল বা বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে হাজারো বিপদের মুখে হেঁটে গেলে পাঁচ বছরেই সেই বন্ধুত্ব হয়। সেই বন্ধুত্বে যে ‘জান কবুল’ করতে হয়।

বিকেলে জয়শ্রীর কাছ থেকে প্রায় জোর করেই পাসটি নিয়ে গেলাম আই সি ইউ—তে। দেখি গোপালের চোখ বন্ধ। নানা নল ও ছুঁচে শরীর ভর্তি। আমি ওর মাথার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদুস্বরে ডাকলাম, ‘গোপাল’। গোপাল যেন অন্ধকারের দিশেহারা নাবিক, লাইট—হাউস দেখেছে, এমন করে চাইল একবার। তারপরই ওর মুখের ওপরে আমার ঝুঁকে পড়া মুখ দেখেই দু—চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতে লাগল ওর। কথা বলার শক্তি ছিল না কোনও।

আমি বললাম, তাড়াতাড়ি ভাল হও, আমরা আবার হাজারিবাগে যাব, বিরিয়ানি আর বটি—কাবাব খাব, কুসুমভা গ্রামে গিয়ে। আবার শিকার করব—চাতরা, সীমারিয়া, টুটিলাওয়া, টাটিঝারিয়া, সীতাগড়া সব জায়গাতেই যাব। আমি, তুমি, সুব্রত, ভুতো পার্টি সকলে মিলে।

তারপরই আমার চোখও জলে ভেসে গেল। আমি বেরিয়ে এলাম ওর কপালে হাত ছুঁইয়ে। তার পরদিন গোপাল চলে গেল। আজ ১৭—১৮ বছর হতে চলল।

ওদের রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের পৈতৃক বাড়ি থেকে যখন বেলা এগারোটা নাগাদ শবযাত্রা বেরল, সকলে বলল, লালাদা, আপনার শরীর ভাল না (বুকের একটু সমস্যা ছিল, তার কিছুদিন পরই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিও করতে হয়েছিল) আপনি হেঁটে যাবেন না—এতগুলো গাড়ি রয়েছে, আপনার গাড়িও রয়েছে—গাড়িতে যান।

গোপালকে তার শিকারের, পেশার, রাইফেল ক্লাবের অগণিত বন্ধু শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল। মনে পড়ে গেল, আমি আর গোপাল ১৯৪৭—এ সাউথ ক্যালকাটা রাইফেল ক্লাবের সভ্য হয়েছিলাম এবং পয়েন্ট টু—টু রাইফেল ছুড়তাম। ক্যাপটেন বি. টি. ঠাকুর তখন ওই ক্লাব চালাতেন। আমরা দুজনেই তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়তাম।

গোপালকে কাচ ঢাকা গাড়িতে না নিয়ে তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়াই সাব্যস্ত করেছিল বন্ধুবান্ধবরা। আমি বললাম, যৌবনের সেই সব প্রমত্ত সময়ে দিনে—রাতে আমরা পাশাপাশি দুজনে বন্দুক কাঁধে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটেই ঘুরেছি। আমার শরীর যতই খারাপ হোক না কেন, আমি হেঁটেই যাব, খালি পায়ে, এবং কাঁধও দেব মাঝে মাঝে।

মির্জা ঘালিবের সেই বিখ্যাত শায়রিটি আছে না?

‘গুস্তাকি ম্যায় স্রিফ করেঙ্গে ইকবার

যব সব পায়দল চলেঙ্গে, ম্যায় কান্ধেপর সওয়ার।’

অর্থাৎ, জীবনে বেয়াদবি আমি একবারই করব। যখন সকলে আমার শবদেহ বয়ে নিয়ে হেঁটে যাবে আর আমি সকলের কাঁধে চড়ে যাব।

না, গোপাল কোনও গুস্তাকি করেনি। তার পূর্ণ যোগ্যতা ছিল আমাদের কাঁধে চড়ে যাওয়ার।

প্রসঙ্গত বলি, আমার দ্বিতীয় গদ্যগ্রন্থ ‘বনবাসর’—এর উৎসর্গে আমি লিখেছিলাম :

‘টিটি পাখি,

গেরুয়া মাটি,

কুসুমভার নিমগাছটি,

টুটিলাওয়ার চাঁদ,

টাটিঝারিয়ার চা,

এবং হাজারিবাগের গোপাল সেনকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *