গোপন বাক্স খুলতে নেই

গোপন বাক্স খুলতে নেই

ক্লাস সেভেনের গণপতির কাছে একটা গোপন বাক্স আছে। আমরা গণপতিকে ডাকি, গণা বলে। গণা চুপচাপ ধরনের ছেলে। কারও সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্টতা দেখায় না। নিজের টিফিন নিজে খায়। স্যারেরা পড়া ধরবার সময় ফিসফিস করে কাউকে সাহায্য করে না। তবে ভালো ছেলে কিনা তা নিয়ে বির্তক আছে। ক্লাসের কেউ কেউ বলে, গণা থাকে নিজের মতো। কোনও সাতে পাঁচে নেই। আবার কেউ কেউ বলে, ওই ছেলেটা বিরাট স্বার্থপর আর মিটমিটে পাজি। শুধু নিজেরটুকু হলেই খুশি।

গণপতির বাক্সের খবর স্কুলে ফাঁস করল চন্দন। চন্দন আমাদের ক্লাসের মোস্ট ওয়ান্টেডের মতো মোস্ট চালিয়াত টাইপ। কথায় কথায় সবজান্তা ভাব। অন্যরা কেউ কিছু বললে বলে, ‘ও তো আমি আগেই জানতাম। পরীক্ষা করে দেখছিলাম, তোরা কেউ জানিস কিনা।’

একথা শুনে ধ্রুব ভিজে বিড়ালের মতো মুখ করে বলল, ‘ও এই কারণে তুই পরীক্ষার খাতায় অনেক সময় ভুল উত্তর লিখে দিস। পরীক্ষা করে দেখিস, মাস্টারমশাইরা ঠিকটা জানেন কিনা। তাই তো?’

চন্দন ধ্রুবর দিকে তেড়ে গেলে, ধ্রব দে দৌড়।

তবে একথা সত্যি যে চন্দন মাঝে মাঝে জমজমাট খবর দিয়ে আমাদের চমকে দেয়। গোপন বাক্সের খবরটাও সেরকম। সেদিন টিফিনের সময় মাঠে বসে টিফিন খেতে খেতে গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমার কাছে একটা দারুণ খবর আছে। শুনলে তোদের চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে যাবে। টিফিনের সঙ্গে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করবে।’

অর্চি বলল, ‘বাজে না বলে বল, কী খবর?’

চন্দন বলল, ‘আগে তোর টিফিন থেকে আদ্দেকটা ডিমসিদ্ধ দে, তারপর বলব।’

সপ্তর্ষি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘সত্যি? নাকি ডিমসিদ্ধ বাগাবার জন্য বানাচ্ছিস?’

চন্দন হাত নেড়ে বলল, ‘যা শুনতে হবে না।’

অহিরথ বল, প্লিজ বল। আমার টিফিন থেকে একটা স্যান্ডুউইচ দিচ্ছি।’

চন্দন মুখ গোমড়া করে বলল, ‘লাগবে না। খবরও বলব না।’

বিশ্বনাথ বলল, ‘আহা রাগ করছিস কেন? নে খানিকটা চাওমিন নে। আজ মা চাওমিনটা হেভি বানিয়েছে।’

বিশ্বনাথ নিজের টিফিন কৌটোটা চন্দনের দিকে এগিয়ে দিল।

চন্দন খাবলা মেরে অনেকটা তুলে নিয়ে মাথা উঁচু করে মুখে পুরল। চাওমিন সুতোর মতো ঝোলে বলে মাথা উঁচু করে খেতে হয়। চন্দন খাওয়া শেষ করে বলল, ‘তোরা কি জানিস গণপতির একটা গোপন বাক্স আছে? যাকে বলে সিক্রেট বক্স। জানিস তোরা?’

খবর শুনে সত্যি আমাদের চোখ ছানাবড়া সাইজের বড় বড় হয়ে গেল। ধাতস্থ হতে সময় লাগল। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘গোপন বাক্স! সেটা আবার কী?’

চন্দন আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন এমন বোকা সে আগে দেখেনি। বলল, ‘গোপন বাক্স মানে গোপন বাক্স। যার কথা কেউ জানে না।’

মানস হাতের পেয়ারায় কচ করে কামড় দিয়ে বলল, ‘তুই জানলি কী করে?’

চন্দন বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি দেখিছি।’

তন্ময় বলল, ‘কীভাবে দেখলি?’

চন্দন প্রথমটায় বেশি রহস্য তৈরি করতে চাইলেও পরে সব বলল। গণপতি রোজই ছুটির পর সবার শেষে ক্লাস থেকে বের হয়। আমাদের মতো তার তাড়াহুড়োর ব্যাপার নেই। গুটগুট করে ব্যাগ গোছায়। তারপর ডেস্কের আনাচে কানাচে সন্ধান চালিয়ে দেখে, পেন পেনসিল, ইরেজার ফেলে যাচ্ছে কিনা। এমনকী ব্যাগ থেকে বের করে বইখাতাও গোনে। যটা এনেছিল, ঠিক ততগুলো নিয়ে ফিরছে তো? আমরা প্রথম প্রথম হাসাহাসি করতাম। পরে বুঝতে পেরেছি, ওর চরিত্রটাই এরকম। পিটিরপিটির টাইপ। এই ব্যাগ গোছানোর সময়েই একদিন চন্দন গোপন বাক্স দেখতে পায়। সবাই তখন ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছে। চন্দনও বেরিয়ে যেত। নেহাত তার বুট জুতোর ফিতেতে গিট পাকিয়ে গেছে, তাই দেরি হয়ে যাচ্ছিল। মাথা নীচু করে গিঁট খুলছিল। আর তখনই চোখ পরে, খানিকটা দূরের ডেস্কে বসা গণপতি ব্যাগ থেকে বাক্সটা বের করে দেখছে। চন্দনের সঙ্গে চোখ পড়তেই সুড়ৎ করে ঢুকিয়ে ফেলল।

চন্দনের কথার মাঝখানেই বিতশোক বলল, ‘বাক্সটা যে গোপন, সেটা বুঝলি কী করে? টিফিন বাক্সও তো হতে পারে।’

চন্দন গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি কি তোর মতো বোকা? টিফিনবক্স চিনি না?’

অর্চি বলল, ‘বাক্সটা কীরকম।’

চন্দন বলল, ‘একঝলক দেখেছি। ডেস্কের ওপর টিফিনবক্সের পাশে রেখে গণা বইখাতা গুছোচ্ছিল। তোরা তো জানিস, স্কুল ছুটির পর বইখাতা গুছিয়ে তবে ও বাড়ি যায়। যতদূর মনে পড়ছে বাক্সটা টিফিনবাক্সের থেকে সামান্য বড়। গায়ে নকশা কাটা। হলুদ রং। টিনের সুটকেশে যেমন তালা দেবার ব্যবস্থা আছে, সেরকম আছে।’

মানস চোখ গোল গোল করে বলল, ‘তালা দেওয়া?’

চন্দন একটুক্ষণ চোখ বুজে ভাবল। তারপর বলল, ‘না, তালা দেওয়া নয়।’

আমি বললাম, ‘তুই জিগ্যেস করলি না?’

চন্দন ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী জিগ্যেস করব?’

অর্চি বলল, ‘বা:, জিগ্যেস করবি না, বাক্সটা কীসের?’

চন্দন বলল, ‘আমি তাকাতেই গণা সট করে বাক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল।’

ধ্রুব বলল, ‘এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বাক্সটায় কোনও গোলমাল আছে। নইলে লুকোবে কেন?’

সপ্তর্ষি বলল, ‘চন্দন ঠিকই বলেছে, নিশ্চয় ওটা সিক্রেট বক্স।’

এরপর আমরা পরিকল্পনায় বসলাম, কী করে বাক্সটা দেখা যায়? কিন্তু বেশিক্ষণ আলোচনা করা গেল না। টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়ে গেলে আমরা ক্লাসের দিকে ছুটলাম। ক্লাসে গিয়ে দেখলাম, গণপতি ভূগোল বই খুলে মন দিয়ে পড়ছে। সে এরকমই করে। টিফিন খাওয়া হয়ে গেলে বই খুলে বসে। তবে মাস্টারমশাই পড়া ধরলে কান চুলকোয়। মানস আমাকে ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই, গণাকে জিগ্যেস করব, বাক্সটা কীসের?’

আমি বললাম, ‘লাভ হবে না। বলবে না।’

অর্চি বলল, ‘আমরা যদি জোর করি?’

তন্ময় বলল, ‘জোর করলেও বলবে না।’

এই সব কথার মাঝখানেই স্যার ঢুকে পড়লেন। আমরা চুপ করে গেলাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা চলতেই লাগল। চলবেই তো। কোনও সহপাঠী যদি সঙ্গে একটা গোপন বাক্স নিয়ে ঘোরে তাহলে উত্তেজনা হবে না? স্যারের পড়া শুনব কী, মনে তখন নানা প্রশ্ন। বাক্সটা গণপতি গোপন করে কেন? বাক্সের ভিতর কী আছে? বাক্সটা কি ও সবসময় সঙ্গে নিয়ে ঘোরে? রাতেও পাশে নিয়ে শোয়? ওর বাবা-মা কি জানেন? না জানাটাই স্বাভাবিক। যদি গোপন কিছু থাকে, তাহলে জানাবে কেন? কবে থেকে ও বাক্সটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে?

বাকি দিনটা আমরা বারবার গণপতির দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাতে লাগলাম। ঠিক গণপতির দিকে নয়, গণপতির ব্যাগের দিকে। গণপতি মনে হয় বুঝতে পারল। মনে হয় কেন, বুঝতে পারল। ফিফথ পিরিয়ডের সময় দেখি গণপতি ব্যাগটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বসেছে। ক্লাসে স্যার আসবার আগে সে জিগ্যেস করল, ‘অ্যাই, তোরা আমার ব্যাগের দিকে বারবার তাকাচ্ছিস কেন রে?’

মানস আর চেপে থাকতে পারল না। বলল, ‘তোর কাছে নাকি একটা গোপন বাক্স আছে?’

গণপতি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কে বলল?’

অর্চি ওর পিছনের বেঞ্চে বসে। ফিসফিস করে বলল, ‘আছে কিনা বল।’

গণপতির ভুরু আরও কুঁচকে গেল। বলল, ‘কীসের বাক্স? টিফিন? সে তো তোদের কাছেও আছে।’

মানস চাপা গলায় বলল, ‘না, টিফিন নয়, তাছাড়া আরেকটা আছে। সত্যি?’

গণপতি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা বলতে গেল। তার আগে বিমানস্যার ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। বিমানবাবু আমাদের ইতিহাস পড়ান। সন তারিখ ঠিক মতো না শুনলে একশোবার করে লিখতে দেন। আমরা গোপন বাক্স নিয়ে আলোচনা বন্ধ করে দিলাম। ছুটির পর মানস, অর্চি, ধ্রুব, সপ্তর্ষি গণপতিকে চেপে ধরল। গণপতিও তার ব্যাগ কাঁধ থেকে খুলে দু-হাতে শক্ত করে চেপে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল দ্রুত পায়ে।

‘কী রে সত্যি তোর কাছে গোপন বাক্স আছে?’

গণপতি বলল, ‘আমার শরীর ভালো লাগছে না।’

‘বাক্সটা একবার দেখা না।’

গণপতি বলল, ‘মাথা টিপটিপ করছে।’

‘আচ্ছা, দেখাতে হবে না। বাক্সটার ভিতরে কী আছে সেটা তো বলবি।’

গণপতি ওর সাইকেলে উঠতে উঠতে বলল, ‘মনে হচ্ছে জ্বর আসছে।’

এইটুকু বলে মুচকি হেসে গণপতি সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। শুধু চলে গেল না, গোপন বাক্সের রহস্য আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেল।

পরদিন সত্যি জ্বরের কারণে কামাই করল গণপতি। আমরা পুরোদমে পরিকল্পনায় নামলাম। কীভাবে গোপন বাক্সের রহস্য ভেদ করা যায়। সবাই মিলে অনেক প্রস্তাব দিল। সেই প্রস্তাব আবার কাটাও হল। যাকে ভালো বাংলায় বলে ‘যুক্তি খণ্ডন’। বাক্সে কী আছে জানবার জন্য বাক্সটা দেখা দরকার। কীভাবে দেখা হবে? ভালো কথায় চাইলে গণপতি দেবে বলে মনে হয় না। মনে হয় না কেন, দেবেই না। যে বাক্স নিয়ে ঝেড়ে কাশছে না, সে বাক্স চাইলে গুটিগুটি দিয়ে দেবে কেন? তাহলে জোর করে নিয়ে দেখতে হয়। এটা খুব একটা শক্ত কাজ নয়। গণপতি একা আমাদের এতগুলো ছেলের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তিনজন মিলে ওকে চেপে ধরবে, একজন ব্যাগ খুলে বাক্স নিয়ে পালাবে। যদি নাও পালায়, ওর সামনেই বাক্সটা খুলে আমরা চট করে দেখে নিতে পারব। কোনও সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে তার পরে। জোর করে বাক্স কেড়ে নেবার কারণেও নির্ঘাত মাস্টারমশাইদের নালিশ করবে। বলা যায় না হেডস্যারকেও লাগাতে পারে। সেটা খুবই বিপজ্জনক হবে। তাহলে আর একটা পথই খোলা রইল। বাক্সটা চুরি করে দেখা যায়। বাক্সে কী আছে দেখবার পর আবার রেখে দিলেই চলবে।

মানস বল, ‘এইটাই বেস্ট আইডিয়া।’

অর্চি রাগ দেখিয়ে বলল, ‘বেস্ট আইডিয়া না কচুর মাথা। কীভাবে চুরি করবি? গণর বাড়িতে যাবি? জলের পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠবি। তারপর ওর পড়ার টেবিল থেকে ব্যাগ চুরি করবি?’

সপ্তর্ষি বলল, ‘তা কেন? গণপতি যখন স্কুলে আসবে তখনই হবে।’

তন্ময় বলল, ‘কীভাবে হবে? ওকে কখনও দেখেছিস ব্যাগ, খাতা, বই, পেন, পেনসিল রেখে কোথাও যায়? দেখেছিস কখনও?’

ধ্রুব বলল, ‘তারওপর এখন জেনে গেছে, আমরা ওর বাক্সটাকে টার্গেট করেছি। এখন থেকে আরও বেশি করে ব্যাগটাকে আঁকড়ে থাকবে। দেখিসই তো, ও টিফিন টাইমেও ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মুখ ধুতে যায়।’

মানস বলল, ‘দুর, ক্লাসের মাঝখানে যখন ছোট বাইরে যাবে তার মধ্যে আমরা কাজ করে ফেলব।’

মানস যাই বলুক, এটা অসম্ভব। গণপতি ক্লাস চলাকালীন ব্যাগ ছেড়ে বেরোলে কোনও লাভ হবে না। ক্লাসে তখন স্যার থাকবেন। তার সামনে ওর ব্যাগে কীভাবে হাত দেব? না, সহজ একটা ব্যাপার বিরাট জটিল হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, ব্যাগে কী থাকতে পারে?

তন্ময় বলল, ‘সোনাদানা? হিরে?’

অর্চি বলল, ‘হাবিজাবি বইপড়ে তোর মাথাটাই গেছে। আমার মনে হয়, ওই বাক্সে বিভিন্ন দেশের কয়েন আছে।’

সপ্তর্ষি বলল, ‘আবার স্ট্যাম্পও থাকতে পারে।’

আমি বললাম, ‘কয়েন বা স্ট্যাম্প থাকলে গণ আমাদের ডেকে ডেকে দেখাত। যারা কালেক্টর হয় তাদের স্বভাবই হল সংগ্রহের জিনিস অন্যকে দেখানো।’

মানস বলল, ‘হয়তো ভয় পাচ্ছে। ভাবছে আমাদের দেখালে যদি কেড়েটেড়ে নিই।’

চন্দন বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘তাহলে বাক্সটাই আনত না।’

ধ্রুব বলল, ‘হয়তো বাড়িতে রাখতে গেলে বাবা-মা দেখে ফেলবে। ওর তো আর নিজের কোনও তালাচাবি দেওয়া আলমারি নেই।’

তন্ময় বলল, ‘জিনিস লুকোতে গেলে সবসময় যে তালাচাবি দিয়ে রাখতে হবে তার কী মানে আছে? বাবা যাতে দেখতে না পায় তার জন্য আমি কি ঘুড়ি লাটাই আলমারিতে রাখি? মোটেই না। আমার ঘুড়িগুলো সব লুকোনো আছে ড্রেসিং টেবিলের পিছনে।’

সপ্তর্ষি বলল, ‘আমারও মার্বেল গুলি সব পুরোনো জ্যামিতি বক্সের ভিতর থাকে। মা টেরও পায় না।’

অহিরথ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আচ্ছা, গোপন বাক্সে ঘুড়ি নেই তো?’

আমরা তো অহিরথকে এই মারি কী সেই মারি। বোকাটা বলছে টিফিনবক্সের মাপের একটা বাক্সের ভিতর ঘুড়ি লুকোনো থাকবে! এই ছেলে তো বিরাট বোকা! আমাদের ধমক শুনে অহিরথ আমতা আমতা করে বলে, ‘কেন, ফোল্ডিং ঘুড়ি পাওয়া যায় না?’

মানস চোখ কটমট করে বলল, ‘আর একটা কথা যদি বলবি, গাট্টা দিয়ে মাথায় পোটাটো চিপস বানিয়ে দেব।’

বিশ্বনাথ গলা নামিয়ে ভয় ভয় বলল, ‘আচ্ছা, ছুরি, রিভলবারের মতো কোনও ভয়ংকর অস্ত্রটস্ত্র নেই তো?’

অর্চি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘বাজে বকা থামাবি?’

সপ্তর্ষি বলল, ‘আমার কী মনে হয় জানিস? আমার মনে হয়, গণপতি ওই বাক্সের ভিতর লুকিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে আসে।’

মানস বলল, ‘ভিডিয়ো গেমস হতে পারে।’

আমার সন্দেহ হচ্ছে। বললাম, ‘সঙ্গে আনে আবার নিয়েও যায়! একবারের জন্য বের করে না! এটা ঠিক বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।’

তন্ময় কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘এবার কিন্তু আমার পেটের ভিতরটা কেমন যেন করছে। কৌতূহলে ফেটে না যায়। যতক্ষণ না গোপন বাক্স দেখছি, ততক্ষণ রাতে ঘুম হবে না।’

গোপন বাক্সের ভিতরে কী আছে তা নিয়ে নানা ধরনের মতামত থাকলেও, আমরা সবাই একমত হলাম যে বাক্স আমাদের দেখতেই হবে। ও যদি জিনিসটা আর স্কুলে না আনে, তাহলে ওর বাড়িতে গিয়ে দেখতে হবে। শুধু মুখে চেয়ে, জোর করে বা চুরি করে হবে না। গণপতিকে লোভ দেখাতে হবে। পেয়ারা, চাওমিন, হজমিগুলি খাওয়াতে হবে। তাতে রাজি না হলে, পেন, পেনসিল ইরেজার দিতে হবে। এতেও যদি কাজ না হয় তাহলে ঘুড়ি লাটাই, মার্বেল গুলি নিয়ে যেতে হবে। দরকার পড়লে আমরা আমাদের কালেকশন থেকে স্ট্যাম্প, কয়েন, ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবলের ফটোও দিতে পারি। মোদ্দা কথা হল বাক্স আমাদের দেখতেই হবে।

দুদিন পরে জ্বর থেকে উঠে গণপতি স্কুলে এল। আমরাও সাধাসাধি শুরু করলাম। গণপতি গম্ভীর মুখে পেয়ারা খেল, পেনসিল নিল, নেইমার আর মেসির ছবি নিল। তারপর বলল, ‘বাক্সটা দেখাতে পারি, তবে আজ নয়।’

আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘কবে?’

গণপতি ভুরু কুঁচকে হাতের কর গুনে বলল, ‘ঠিক সাতদিন পরে।’

আবার দুদিনের জন্য ডুব দিল গণপতি। আমরা ভাবলাম, এই রে! আবার অসুখ-বিসুখে পড়ল নাকি? না, অসুখে পড়েনি। ঠিক সাতদিনে মাথায় খবর পেলাম গণপতি স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। বাবার বদলির চাকরি। শিলিগুড়ি না কোথায় যেন চলে গেছে। আমরা কেউ জানতেও পারিনি। ওর বাবা এসে স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে গেছেন।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ইস, গণপতির গোপন বাক্স দেখা হল না।

তবে মন খারাপের পর একটা মজার ঘটনা ঘটল। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে দেখলাম, আমাদের ক্লাসের অনেকেই একটা করে গোপন বাক্স তৈরি করে ফেলছে! কোনওটা ফেলে দেওয়া টিফিনবক্স, কোনওটা পিচবোর্ডের, কোনওটা কাঠের। মানস, চন্দন, অর্চি, সপ্তর্ষি, তন্ময়—কার নেই? কেউ কাউকে বাক্স খুলে দেখায় না। ভিতরে কী আছে জানতে চাইলে মুচকি হাসে। গণপতি চলে গেছে, কিন্তু তার গোপন বাক্সটা সকলকে দিয়ে গেছে। মজার না? অবশ্যই মজার।

আরও একটা মজার ব্যাপার আছে। ওই গোপন বাক্সগুলোর ভিতর কী কী ছিল তখন জানতে পারিনি, কিন্তু এখন বড় হবার পর জেনেছি। বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছি। বাক্সগুলোর ভিতর ছিল আমাদের ছেলেবেলার কৌতূহল, কল্পনা আর স্বপ্ন। আর এই কারণেই গোপন বাক্স খুলতে নেই। যত্ন করে রেখে দিতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *