গোপন দরজা

গোপন দরজা

রাইয়ের মৃতদেহটা আমার সামনেই পড়েছিল! পরনে আমারই উপহার দেওয়া লাল বেনারসি শাড়ি৷ সেই লাল শাড়িতে চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে৷ পুলিশ অফিসার সন্তর্পণে হত্যার অস্ত্র, তথা প্রমাণ আকৃতির অ্যান্টিক ছুরিটাকে মনোযোগ দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিলেন৷ দেখতে দেখতেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘নো ফিঙ্গারপ্রিন্টস! অথচ এটা দিয়েই একাধিকবার স্ট্যাব করা হয়েছে!’

রাইয়ের গলার হিরের নেকলেসটা এখন মাটিতে অযত্নে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ এই নেকলেসটা গতকালই ওকে গিফট করেছিলাম আমাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে৷ রাই চিরদিনই অসম্ভব সুন্দরী! তার ওপর এই বিশেষ দিনটার জন্যই ও আরও সুন্দর করে সেজেছিল৷ জমকালো লাল শাড়িতে, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ঝলমলে হিরের হারটা পরে যখন সে রুপোলি জ্যোৎস্নার আলোয় আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন মনে হয়েছিল, ও আমার চিরপরিচিত স্ত্রী নয়! হয়তো ও রাই-ই নয়! বরং বহু পুরোনো লোকগাথায় বর্ণিত বিক্রমগড়ের রানি চন্দ্রকলা! সেই রানি চন্দ্রকলা, যাঁর রূপের খ্যাতি আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে৷ এই রাজবাড়ির দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে যে প্রাচীন সুন্দরীশ্রেষ্ঠার একাধিক তৈলচিত্র, সে যেন জীবন্ত হয়ে এসেছিল রাইয়ের মূর্তি ধরে! সেই দীঘল চোখের কোণে বিনম্র লজ্জার সঙ্গে মিশ্রিত তীর্যক দহনকারী কটাক্ষ৷ যক্ষিণী সুন্দরীদের মতো গর্বিত, উদ্ধত দেহসৌন্দর্য! অবিকল সেই মোহিনীমূর্তি! আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না! অস্ফুটে নিজের অজান্তেই বলে ফেলেছিলাম, ‘চ-ন্দ্র-ক-লা!’

রাই হেসে উঠেছিল৷ কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে মুখটা নিয়ে এসেছিল আমার মুখের খুব কাছাকাছি৷ ফিসফিস করে বলেছিল, ‘বলুন রাজা বিক্রমনারায়ণ সিংহ৷’

অদ্ভুত একটা সুখে, চরম আশ্লেষে আমার চোখ বুঁজে আসে৷ মনে হয়, এই মুহূর্তে প্রাচীন রাজবাড়ির বিরাট বিলাসবহুল শয়নকক্ষে কোনও সাধারণ দম্পতি নয়; স্বয়ং রাজা বিক্রমনারায়ণ সিংহ এবং তাঁর প্রিয়তমা পত্নী রানি চন্দ্রকলা বসে আছেন৷ আমরা কোনও সাধারণ মানব-মানবী নই! বরং এক প্রাচীন কিংবদন্তির দুই পাত্রপাত্রী৷

কিন্তু তখন কে জানত যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে! রাইয়ের ভাগ্যরেখা যে রানি চন্দ্রকলার অভিশপ্ত পরিণতির দিকেই ইঙ্গিত করছে তা তখন আমার জানা ছিল না! একটা সুন্দর রাত কাটিয়ে দুজনেই চরম সুখ ও তৃপ্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ কোথাও কোনও আশঙ্কা অনুভব করিনি৷ হঠাৎ আচমকা শেষরাতে রাইয়ের আর্তচিৎকার! আর সেই লোকটা…! এবং ওর হাতের রক্তাক্ত ছুরি…!

বেশ কিছুক্ষণ ঘরটাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখার পর তদন্তকারী অফিসার লাশ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন৷ পোস্টমর্টেম হবে৷ আমি ক্লান্ত, অসহায় চোখে দেখলাম, রাই চলে যাচ্ছে! এই তিন বছরের দাম্পত্যজীবনে কখনও ও আমাকে ছেড়ে যায়নি৷ কিন্তু আজ ওর মৃত্যুকঠিন, ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, ও বোধহয় ভীষণ রাগ করে আমায় ছেড়ে যাচ্ছে৷ মুহূর্তের জন্য ওর হাত স্পর্শ করেই ছেড়ে দিলাম৷ এত শীতল ছিল রাই! এত শীতলতা কি ছিল তার মধ্যে? রাই মানে তো ভীষণ আগ্রাসী এক দাবানল! ভীষণ উত্তপ্ত একটা মেয়ে! সে এমন হিমশীতল হয়ে গেল কী করে!

আচমকা আমার সেই গল্পটার কথা মনে পড়ল৷ ‘স্নো কুইন’! রাই আজ সত্যি সত্যিই ‘স্নো কুইন’ হয়ে গিয়েছে৷

‘লোকটার চেহারা আপনার স্পষ্ট মনে আছে?’ পুলিশ অফিসার গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘প্রয়োজন পড়লে স্কেচ তৈরি করাতে পারবেন?’

আমি স্থির দৃষ্টিতে রাইয়ের চলে যাওয়া দেখছিলাম৷ অফিসারের প্রশ্নটা শুনেই কেমন যেন গা শিরশিরিয়ে উঠল৷ মনে আছে! স্পষ্ট মনে আছে৷ এত সহজে কী করে ভুলে যাব লোকটাকে! ও মুখ সারাজীবনে ভুলতে পারব না৷ সেই জোড়া ভুরু, সেই কোটরাগত দুটো চোখ! সেই হিসহিসে কণ্ঠস্বর!

আমি মৃদু মাথা নেড়ে সায় দিলাম৷ লোকটার মুখ এখনও চোখের সামনে ভাসছে৷ স্মৃতি থেকে হাতে আঁকা ছবি কেন, যদি ফটোগ্রাফও বের করে দেওয়া সম্ভব হত, তবে তাই দিতাম৷

তিনি এবার ফিরে দাঁড়ালেন রাঁধুনি পার্বতী, মালি বিরজু ও চাকর রতনের দিকে৷ ওদের তিনজনের পরিবারই বংশানুক্রমে এ মহলের সেবা করে আসছে৷ রাজা-রানিদের আমলেও ওদের পূর্বপুরুষরা এ বাড়িতে কাজ করেছে৷ সময় বদলেছে৷ কিন্তু ওদের বিশ্বস্ততা বদলায়নি৷

অফিসার ভারী গলায় ধমকে বললেন, ‘বাড়িতে একটা আস্ত মানুষ খুন হয়ে গেল আর তোমরা কেউ কিছু দেখতে পেলে না! ম্যাডামের চিৎকার শুনতে পাওনি? লোকটাকে এক ঝলকও দেখোনি! বললেই হল!’

তিনজনেই মাথা নীচু করে ভয়ে কাঁপছে৷ ওদের অবস্থা দেখে খারাপ লাগল৷ রতনের স্বাভাবিকভাবেই কিছু দেখতে পাওয়ার কথা নয়৷ তার গঞ্জিকাসেবনের অভ্যেস আছে৷ রাত হলেই কয়েক ছিলিম টেনে ব্যোম ভোলা হয়ে বসে থাকে৷ বিরজু বাড়ির বাইরে বাগান সংলগ্ন ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকে৷ এ মহলে কিছু ঘটলে তারও জানার কথা নয়৷ আর পার্বতীর ঘুম কুম্ভকর্ণকেও লজ্জা দেবে! কিন্তু ওরা যদি জেগে থাকত, তাহলেও কি দেখতে পেত? আমার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে অনুরণন করে উঠল সেই হিসহিসে কণ্ঠস্বর :

‘গোপন দরজা স্যার! গোপন দরজা দিয়ে খুনি এসেছিল৷ আবার সেই পথেই পালিয়ে গিয়েছিল৷ একমাত্র রাজা বিক্রম সিংহ ছাড়া তাকে আর কেউ দেখতে পায়নি৷ রানি চন্দ্রকলার খুনি তাই কখনও ধরা পড়েনি৷’

আমি আস্তে আস্তে বললাম, ‘গোপন দরজা!’

‘গোপন দরজা!’ অফিসার অবাক হয়ে এবার আমার দিকে তাকান, ‘কী বলছেন! কোথায়?’

‘এ বাড়িতে একটা গোপন দরজা আছে, যার খবর কেউ জানে না৷’ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলি, ‘আমি সঠিক জানি না৷ কিন্তু সেই লোকটা আমায় বলেছিল৷’

‘ওই লোকটা আপনাকে একটা সিক্রেট ডোরের কথাও বলেছিল! কবে? কখন?’ তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘স্ট্রেঞ্জ! আপনার কিছু সন্দেহ হয়নি?’

‘না৷ আমি ভেবেছিলাম লোকটা হয় পাগল, নয় বাচাল৷’

‘ইন্টারেস্টিং!’ অফিসার আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন, ‘আর ঠিক কী কী বলেছিল লোকটা আপনাকে?’

‘বিক্রমগড়ের রাজা ছিলেন বিক্রমনারায়ণ সিংহ৷ স্বভাবে চরম শৌখিন৷ গান-বাজনা ভালোবাসতেন৷ শিকার করতেন নিয়মিত৷ আর ভালোবাসতেন নারীর রূপ৷ লোকে বলে, তাঁর বেশ কয়েকজন রানি ও অঢেল উপপত্নী ছিল৷ তবে অতগুলো রানি ও উপপত্নী থাকা সত্ত্বেও রাজার মনে সুখ ছিল না! কারণ তাঁর কোনও রানিই তাঁকে ওয়ারিশ দিতে পারেননি৷ রাজা বিক্রম সিংহের দুশ্চিন্তা আর যায় না! এত বৈভব, এত সম্পদ কার জন্য রেখে যাবেন! অনেক জড়ি-বুটি খেলেন, যাগ-যজ্ঞ করালেন৷ কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না! যখন হতাশ রাজা প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছেন ঠিক তখনই দেখা পেলেন চন্দ্রকলার! রাজার তখন বয়েস হয়েছে৷ আর চন্দ্রকলা ষোড়শী! চন্দ্রকলা নয়, একেবারে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ৷ রাজা একেবারে মজে গেলেন!’

কথাগুলো বলে লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়৷ ওর জোড়া ভুরু দুটো যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে! লোকটাকে দেখতে ভারী অদ্ভুত৷ কপালের ওপর ভুরুদুটো দেখলে মনে হয়, কোনও শিশু বোধহয় আঁকার খাতায় সমুদ্রের ঢেউ আঁকতে গিয়ে ভুল করে ওর কপালে এঁকে দিয়েছে! চোখদুটো বসা৷ নাকটা খাড়া৷ ঠোঁটজোড়া এমনই বিপজ্জনক রকমের চওড়া যে ভয় হয়, একটু হাসলেই বুঝি মুখ ছাড়িয়ে কান পর্যন্ত চলে যাবে! এমন মুখ কার্টুন ক্যারেক্টারে অনেকবার দেখেছি৷ কিন্তু বাস্তবে এই প্রথম দেখলাম!

‘চন্দ্রকলা এতটাই সুন্দরী ছিলেন যে রাজার তাঁকে দু-চোখ ভরে দেখেও মন ভরত না৷ রাজা বিক্রমনারায়ণ একটু খ্যাপাটে স্বভাবের ছিলেন৷ তিনি প্রথমে চিত্রশিল্পী ডেকে চন্দ্রকলার ছবি আঁকালেন৷ নানা বিভঙ্গে আঁকা সেই সব ছবি রাজবাড়ির দেওয়ালে টাঙালেন৷ কিন্তু তাতেও রাজার পাগলামি গেল না৷ এরপর তিনি সারা বাড়িতে, ছাতে, দেওয়ালে দামি কাচের আয়না বসালেন৷ ফলস্বরূপ রানি চন্দ্রকলা যখন হেঁটে যেতেন, চতুর্দিকে তাঁর প্রতিবিম্ব পড়ত৷ এমনকি দরবারেও এমন কৌশলে আয়না বসানো হয়েছিল যে চন্দ্রকলা অন্দরমহলে থাকলেও রাজা দরবারে বসে তাঁকে দেখতে পেতেন!’

আমি মনে মনে একটু বিরক্ত হচ্ছিলাম৷ লোকটার ঘ্যানঘ্যান শুনতে মোটেই ভালো লাগছে না৷ এই মুহূর্তে একটু একা থাকতে চাইছিলাম৷ রাজবাড়ির সামনে চমৎকার একটা বাগান আছে৷ সেখানে বসে থাকতে খুব ভালো লাগছিল৷ শহরের কান ঝালাপালা করা যান্ত্রিক চিৎকারে অতিষ্ঠ কান এখানে বড় শান্তি খুঁজে পেয়েছে৷ চতুর্দিকে ফুলের মিষ্টি সুবাস এবং অনাহত নিস্তব্ধতা! এই নীরবতাকে আপ্রাণ উপভোগ করতে চাইছি৷ অথচ এই লোকটা কোথা থেকে হঠাৎ এসে উদয় হল৷ কথা নেই বার্তা নেই, দুম করে আমার পাশের চেয়ারে বসে প্রথমে খেজুরে আলাপ শুরু করল৷ কিছুক্ষণ এটা-সেটা বলার পর বলল, ‘বিক্রমগড়ে নতুন বুঝি?’

আমি তখন নিবিষ্টমনে পাখিদের ঘরে ফিরে আসা দেখছিলাম৷ তারা এখন আকাশে দীঘল ডানার ছায়া বিস্তার করে দিয়েছে৷ সূর্যাস্তের সিঁদুরে-সোনালি আলোয় স্নান করছে গোটা প্রকৃতি৷ এই মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না৷ অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিই, ‘হুঁ৷’

‘তা কদ্দিন থাকা হবে?’

খ্যানখ্যানে গলার প্রশ্নটা ভালো লাগল না৷ তবু ভদ্রতাবশত বলি, ‘আপাতত দিন পনেরো৷ তবে মাঝেমাঝে সময় পেলেই আসব৷’

‘অ!’ স্বরবর্ণের প্রথম অক্ষরটা উচ্চারণ করে ও একটু থামল৷ তারপর বলল, ‘তার মানে ঠিকই শুনেছি৷ এ বাড়িটা বিক্রি হয়েছে৷ নিশ্চয়ই আপনিই কিনেছেন৷ তাই না?’

আমি ওর দিকে তাকালাম৷ বলা ভালো, মাপলাম৷ লোকটা পাজি না পাগল বোঝা মুশকিল৷ তবু সংক্ষেপে জানাই, ‘হ্যাঁ৷’

তারপর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে ওর গল্প৷ সে গল্প আর থামেই না! অদ্ভুত লোক৷ শ্রোতা আদৌ শুনছে কি না সে খেয়ালও নেই৷ আপনমনেই ক্রমাগত বকবক করে চলেছে! যদিও ওর কাছে নতুন কিছু জানার নেই৷ এই রাজবাড়িতে রানি চন্দ্রকলার ছবিগুলো আর আয়নার বহর আমরা প্রথমদিনই দেখেছি৷ রাই কৌতূহলী হয়ে জানতে চেয়েছিল, ‘এত আয়না কেন এখানে?’

রাজবাড়ির বহুবছরের বিশ্বস্ত চাকর রতন মৃদু হেসে জানিয়েছিল রাজা বিক্রমনারায়ণ সিংহ এবং রানি চন্দ্রকলার ইতিহাস! সব শুনে রাইয়ের সপাট মন্তব্য, ‘রাজামশাই মোটেই পাগল ছিলেন না৷ বরং বহুত চালু মাল! নির্ঘাত বৌকে সন্দেহ করতেন৷ নিজে বুড়ো বয়েসে একটা ছুঁড়িকে বিয়ে করেছেন কি না! তার ওপর আবার ওরকম মার্ভেলাস রূপসি! সে আমলে তো সিসিটিভি ছিল না৷ তাই এমন করে আয়না বসিয়েছিলেন যাতে বৌয়ের ওপর প্রতিমুহূর্তে নজরদারি করা যায়৷’

রতন হেসে ফেলল৷ তারপর জানাল, ‘কী জানি ম্যাডাম৷ আমরা তো ছোটবেলা থেকেই বাপ-দাদার মুখে রাজা-রানির পাগলামির গল্প শুনে আসছি৷ এভাবে তো কোনওদিন কেউ বলেনি!’

‘রাজার পাগলামি তো শুনলাম৷ রানির পাগলামিটা আবার কীরকম?’ রাই কৌতূহলী৷

‘রানি চন্দ্রকলা নিজের নিখুঁত রূপ রাজপ্রাসাদের চতুর্দিকে দেখতে দেখতে এত বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে নিজের সুন্দর চেহারার ওপরই তাঁর ঘেন্না ধরে গেল৷ শেষমেশ বিরক্ত হয়ে এমন একটা আয়নার আবদার করে বসলেন যাতে তাঁকে মোটেই সুন্দর না দেখায়!’

রাই অবাক হয়েছিল৷ ওর সঙ্গে আমিও! অবাক হয়ে বললাম, ‘এরকম আবার হয় নাকি! এ কী জাতীয় অসম্ভব আবদার!’

‘রাজা-রানির ব্যাপার স্যাপার স্যার৷’ রতন মৃদু হাসে, ‘ওঁরা কি আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ? ওঁদের কাছে কিছুই অসম্ভব ছিল না৷’

‘তারপর?’

‘রাজা বিক্রমনারায়ণ আর কী করেন! প্রিয় রানির আবদার বলে কথা৷ ফেলতে তো পারেন না৷ তিনি তখন অনেক খুঁজে-পেতে, প্রচুর টাকা খরচ করে একখানা অদ্ভুত আয়না আমদানি করলেন! সে আয়না এমনই যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটাকেও সে আয়নায় সবচেয়ে বিচ্ছিরি দেখাবে৷’

রাই প্রায় লাফিয়ে ওঠে, ‘সে আয়নাটা কি এখনও আছে?’

‘আছে ম্যাডাম৷’ সে জানায়, ‘রানিমা’র মহলেই আছে৷ বিশ্বাস না হলে নিজেই দেখে নিতে পারেন৷’

রাই তখনই আয়নাটাকে দেখার জন্য দৌড়ল৷ আমিও পেছন পেছন গেলাম৷ আয়নাটাকে দেখার কৌতূহল আমারও ছিল৷ শৈশব থেকে আয়না সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি৷ স্নো-হোয়াইটের ‘ইভিল কুইন’-এর সত্যবাদী আয়না, ‘স্নো কুইনে’র শয়তানি দর্পণ থেকে ‘ব্লাডি মেরি’, ‘ব্লু বেবি’; সব মিথই জানা ছিল৷ তাই এরকম একটা অদ্ভুত আয়নার কথা শুনে সেটাকে দেখার কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারলাম না৷

রানি চন্দ্রকলার সেই অদ্ভুতুড়ে আয়নাটাকে খুঁজে পেতে অবশ্য আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি৷ ওটা রাজা-রানির শয়নকক্ষেই সগৌরবে বিরাজমান৷ দেখতে এমন কিছু নয়৷ আয়নাটার চতুর্দিকে রুপোর কারুকার্যমণ্ডিত ফ্রেমটা এখনও চকচকে! দেখলেই বোঝা যায় যে ওটাকে রীতিমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়৷ এমনিতে আর কোনও বিশেষত্ব নেই৷ নেহাতই আর পাঁচটা সাধারণ আয়নার মতোই৷ কিন্তু রাই যখন ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন আয়নায় ওর প্রতিফলন দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! অমন সুন্দরী মেয়েটাকে কী ভয়ংকর লাগছে! কোথায় তার অগাধ সৌন্দর্য! একঝলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিই! কী কুৎসিত আয়নাটা! কী কদাকার তার প্রতিবিম্ব!

অদ্ভুত ব্যাপার! রাই কিন্তু তার কুৎসিত প্রতিবিম্ব দেখে একটুও ঘাবড়াল না! বরং হেসেই কুটোপাটি! হাসতে হাসতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখো, দেখো, আমাকে কেমন লাগছে!’

রাইকে অবিকল একটা রাগি ভামবিড়ালের মতো লাগছিল৷ একটা বিশ্রী রসিকতার মতো ওর প্রতিবিম্ব যেন আমায় ভেংচি কাটছে৷ বিরক্ত হয়ে বলি, ‘রানি চন্দ্রকলার রুচির প্রশংসা করা যাচ্ছে না৷ এত টাকা দিয়ে এরকম কুৎসিত জিনিস আমদানি করার কোনও মানে হয়!’

‘রিল্যাক্স সোনা৷’ রাই নরম হাসল, ‘এটা জাস্ট একটা রিফ্লেকশন৷ আসলে কাচটায় কিছু কারিকুরি আছে৷ দেখোনি, উত্তল, অবতল আয়নায় মানুষের মুখের ধরন কেমন পালটে যায়? কখনও মুখটা হাঁড়ির মতো দেখায়, কখনও বাঁশের মতো লম্বাটে৷ এটাও সেরকমই কিছু৷ জাস্ট সায়েন্স৷’

‘যাই হোক!’ আমি আস্তে আস্তে বলি, ‘তুমি এটার সামনে আর দাঁড়িও না রাই৷ আমার ভালো লাগছে না৷’

‘আমার তো ভারী মজা লাগছে৷’ ও ওর চিরপরিচিত ছেলেমানুষি ঢঙে ঘাড় কাত করে বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা বলো৷ আমি যদি সত্যিই ওই রিফ্লেকশনটার মতো দেখতে হতাম, তবে কি তুমি আমায় এমন করে ভালোবাসতে?’

ওর প্রশ্নটা আমায় আঘাত করল! এই তিন বছরের দাম্পত্যজীবনে আমাদের দুজনকেই অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে৷ কিন্তু এরকম মোক্ষম প্রশ্নের সামনে কখনও দাঁড়াতে হয়নি! টের পেলাম, মনের মধ্যে একটা অশুভ আশঙ্কা ফণা বিস্তার করছে৷ মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘স্নো কুইন’ গল্পের সেই আয়নাটার কথা! সেই আয়নাটাও সব সুন্দরকে কুৎসিত করে দিত! সেই আয়নার কাচের টুকরো যার চোখে বা হৃদয়ে প্রবেশ করত, তার হৃদয় হয়ে যেত বরফের মতো শীতল৷ কঠিন, প্রেমহীন ও নিষ্ঠুর! তার চোখ দুনিয়ার কোনও সৌন্দর্য আর দেখতে পেত না! সব সুন্দরকেই সে কুৎসিত দেখত!

আমার ভয় হল, রাইয়ের সঙ্গেও তেমন কিছু ঘটবে না তো! তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে ইতিমধ্যেই একটা নিষ্ঠুর কৌতুক ঝিকমিক করছে৷ ও জানে, এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না৷…

‘কী ভাবছেন স্যার?’

অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম৷ লোকটার কথায় সংবিৎ ফিরল৷ তাকিয়ে দেখি, সে অদ্ভুত ভাবে হাসছে৷ হাসতে হাসতেই বলল, ‘আপনার স্ত্রীর খুব পছন্দ না আয়নাটা? প্রায়ই ওটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন; তাই না?’

আমি চমকে উঠলাম! লোকটা একথাটা জানল কী করে! সত্যিই রাই সময় পেলেই ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে৷ আজকাল এটা ওকে প্রায় নেশার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে! এমনকি গভীর রাতেও অনেক সময় ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করেছি যে রাই আয়নাটায় ওর প্রতিফলন দেখছে৷ আমার ভয় হয়…! খুব ভয় হয়…!

‘ওই আয়নার সামনেই রানি চন্দ্রকলার মৃতদেহটা পড়ে ছিল!’ লোকটা বিড়বিড় করে বলে, ‘চন্দ্রকলা তখন গর্ভবতী ছিলেন৷ অবশেষে রাজা বিক্রম সিংহের এতদিনের আশা পূর্ণ হতে চলেছিল! সেই আনন্দে মহাভোজ হল! গোটা বিক্রমগড় উপস্থিত ছিল সেই অনুষ্ঠানে৷ রানি চন্দ্রকলাকে সেদিন স্বর্গের দেবীর মতো দেখাচ্ছিল৷ তিনি পরিপূর্ণ নারীত্বের অধিকারী হয়েছিলেন৷ মা হতে চলেছিলেন৷ অথচ…!’

সে একটু থেমে যোগ করল, ‘আপনার স্ত্রীও তো…!’

আবার চমক! কে এই লোকটা! অন্তর্যামী? রাই যে অন্তঃসত্ত্বা এ খবরটা আমরা এখনও পর্যন্ত আমাদের পরিবারের কাউকে বলিনি৷ অথচ এই লোকটা ওই গোপনতম কথাটাও জানে! তা ছাড়া ও কী বলতে চায়! আমার মনের মধ্যে আবার সেই অশুভ আশঙ্কা জাঁকিয়ে বসল৷ কোনওমতে বললাম, ‘কী বলতে চাইছেন?’

‘একটা গোপন দরজার কথা৷’ সে মুচকি হাসল, ‘‘গোপন দরজা স্যার! সেই গোপন দরজা দিয়ে খুনি মহলের ভেতরে এসেছিল৷ আবার সেই পথেই পালিয়ে গিয়েছিল৷ একমাত্র রাজা বিক্রম সিংহ ছাড়া তাকে আর কেউ দেখতে পায়নি৷ রানি চন্দ্রকলার খুনি তাই কখনও ধরা পড়েনি৷’

আমি স্তম্ভিত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ লোকটা কি সত্যিই খাপছাড়া কথা বলছে? না কি…!

‘ওই একবারই দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে?’ অফিসার কৌতূহলী স্বরে জানতে চান, ‘নাকি পরে আবার দেখেছিলেন?’

আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল৷ রাইয়ের মৃত্যুটা আমাকে বিধ্বস্ত, বিপন্ন করে দিয়ে গিয়েছিল৷ মনে হচ্ছিল, একটা জোরদার ভূমিকম্প এসে আমার স্বপ্নের বাড়িটাকে দুমড়ে মুচড়ে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে! সেই কম্পন এখনও বুকের ভেতরে টের পাচ্ছি৷ কোনও রিখটারস্কেলে সেই কম্পনকে মাপা যায় না৷ শুধু বুঝতে পারছি, অভ্যন্তরে কিছু ভেঙে যাচ্ছে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে!

আমি ক্লান্ত চোখ তুলে তাকালাম ওঁর দিকে৷ কিন্তু জবাব দেওয়ার আগেই এবার রতন কুণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘স্যার…!’

অফিসারের দৃষ্টি রতনের দিকে নিবদ্ধ হয়, ‘কিছু বলবে?’

‘হ্যাঁ স্যার৷’ সে ঢোঁক গিলে বলে, ‘খুনের সময়ে আমি কাউকে দেখতে পাইনি ঠিকই৷ কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই একটা বিটকেল দেখতে লোক বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল৷ সাহেব যেমন বলছেন, অবিকল তেমনই! আমি তো প্রথমে দেখেই আঁতকে উঠেছিলাম! ভেবেছিলাম, বোধহয় কোনও ভয় দেখানো মুখোশ পরেছে!’

‘আই সি!’ অফিসারের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘লোকটাকে এর আগে কখনও দেখেছ? ও কি বিক্রমগড়ের লোক?’

‘বিক্রমগড় খুব ছোট জায়গা স্যার৷ এখানে সবাই সবাইকে চেনে৷ আমি জন্ম থেকে এখানেই আছি৷’ রতন বলল, ‘কিন্তু এই লোকটাকে কখনও দেখিনি৷ সত্যি কথা বলতে ওরকম ভয়ংকর মুখ আমি জন্মেও দেখিনি৷ আর যাই হোক, ও বিক্রমগড়ের লোক নয়৷’

‘হুঁ৷’ তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘তবে তুমি লোকটাকে চেপে ধরলে না কেন? জানতে চাইলে না কেন যে এই বাড়ির চতুর্দিকে ওর ঘুরঘুর করার উদ্দেশ্য কী?’

রতন একটু থেমে সসঙ্কোচে বলে, ‘আমি ওকে বিরজুর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলাম৷ ভেবেছিলাম ও হয়তো বিরজুর চেনা কেউ হবে৷ তাই আর কিছু বলিনি৷’

অফিসারের সপ্রশ্ন দৃষ্টি এবার বিরজুকে স্পর্শ করেছে৷ তিনি কিছু বলার আগেই বিরজু হাঁউমাউ করে উঠল, ‘মাইরি বলছি হুজুর! আমি ওই লোকটাকে আগে কখনও দেখিনি৷ কিছুদিন আগে ওঁকে সাহেবের সঙ্গে বাগানের চেয়ারে বসে থাকতে লক্ষ করেছিলাম৷ তাই ভেবেছি হয়তো উনি সাহেবের বন্ধু হবেন৷ ভদ্রলোক নিজেও তাই বলেছিলেন’৷

‘ইন্টারেস্টিং! কী বলেছিলেন উনি তোমাকে?’

বিরজু একটু ভেবে বলে, ‘বলেছিলেন যে উনি সাহেবের পরিচিত৷ আমার কাছে এই মহলের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে চাইছিলেন৷ আর জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে গোপন দরজাটা ঠিক কোথায়!’

‘আবার সেই গোপন দরজা!’ তিনি মাথা ঝাঁকালেন, ‘তুমি কী বললে? সত্যিই কি এখানে কোনও গোপন দরজা আছে?’

সে দু-হাত জোড় করে গড়রুপক্ষীর মতো ভঙ্গি করে বলল, ‘হুজুর, আমি এখানে মালির কাজ করি৷ বাইরে, বাগানে থাকি৷ বাড়ির ভেতরে আসা-যাওয়া নেই৷ মহলের ভেতরের খবর রাখব কী করে? তবে এরকম পুরোনো রাজবাড়িতে শুনেছি গুপ্ত কুঠুরি, দরজা, গুম ঘর-টর থাকে! এখানে থাকাও অসম্ভব নয়৷ কিন্তু থাকলেও সেটা আমার জানার কথা নয়৷ ওই বাবুকেও আমি একই কথা বলেছিলাম৷ উনি আমাকে দরজার খোঁজ করার জন্য জোরাজুরিও করেন৷ এমনকি দরজাটা খুঁজে দিতে পারলে অনেক টাকাও দেবেন বলেছিলেন৷’

‘তুমি দরজাটা খুঁজে বের করেছিলে?’ অফিসারের কণ্ঠস্বরে সন্দেহের ছায়া প্রকট৷

বিরজু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘বিশ্বাস করুন হুজুর৷ মা কালীর দিব্যি, আমি ওসব পারি না৷ ছাপোষা মানুষ৷ বাগানের দেখভাল করি৷ ওসব দরজা-টরজা খুঁজে বেড়ানো আমার কাজ নয়! তার ওপর এই এতবড় মহলে দরজা-জানলার কোনও শেষ নেই! এর মধ্যে কোথায় কোন দরজা লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করা কি আমার সাধ্যি?’

অফিসারের মুখ দেখে মনে হল রতন আর বিরজুর কথা তাঁর আদৌ বিশ্বাস হয়নি৷ তিনি হয়তো ওদের দুজনকেই সন্দেহ করছেন৷ আমার মনেও একটা প্রচ্ছন্ন আশঙ্কা উঁকি মারল৷ ওদের কারোর সঙ্গে লোকটার যোগসাজশ নেই তো! ওরা দুজনেই বহুবছর ধরে এ মহলে আছে৷ ওদের বাপ-দাদারাও এ বাড়িতে চাকরি করেছে৷ তাই গুপ্ত কুঠুরি, বা গোপন দরজার খবর জানা ওদের পক্ষে অসম্ভব নয়! টাকার লোভে ওরাই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি তো?

‘আপনাদের একবার আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে৷’ শীতল স্বরে বললেন অফিসার; ‘লোকটার স্কেচ করানো জরুরি৷ আপনারা তিনজনেই ওই লোকটিকে দেখেছেন৷ তাই…৷’ একটু থেমে আমার কাছে এসে যোগ করলেন, ‘আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি৷ কিন্তু আমাদেরও তো তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে৷ এটা একটা মার্ডার কেস৷’

‘ইটস ওকে অফিসার৷’

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই৷ ব্যাপারটা তিক্ত হলেও সত্য যে, এই মুহূর্তে ওঁর চোখে রতন এবং বিরজুর চেয়েও বেশি সন্দেহভাজন স্বয়ং আমি! স্ত্রী মারা গেলে প্রাথমিক সন্দেহটা চিরদিনই স্বামীর ওপর পড়ে৷ আমি বুঝতে পারছিলাম, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না৷

‘রানি চন্দ্রকলা কেন ওই কুৎসিত আয়নাটাকে আমদানি করেছিলেন বলুন তো?’

লোকটার প্রশ্নে আমি বিরক্ত হলাম৷ তার সঙ্গে একটু সতর্কতাও অবলম্বন করতে হল৷ কারণ আমি কিছু বললেই ও ফের গ্রামাফোন রেকর্ডের মতো বাজতে শুরু করবে৷ সত্যি কথা বলতে কী, রানি চন্দ্রকলাকে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই! ওসব রাজা-রানিদের কিসসা ঢের শুনেছি৷ এ লোকটা কি আমায় বাচ্চা পেয়েছে যে রূপকথার গপ্পো শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখবে! আর ওর মতো বে-আক্কেলে লোক আমি আর দেখিনি৷ যখনই বাগানে বসে সন্ধ্যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই, তখনই ব্যাটা যেন মাটি ফুঁড়ে এসে হাজির হয়! এবং যথারীতি জ্বালাতে শুরু করে!

আমি স্বাভাবিকভাবেই নিরুত্তর হয়ে বসে রইলাম৷ লোকটা চোখ পিটপিট করে আমাকে ভালো করে জরিপ করে নিয়ে বলল, ‘আপনার কী মনে হয়? এটা নেহাতই একটা খেয়াল?’

এবার একটু কঠিন স্বরে বললাম, ‘আমার কিছুই মনে হয় না৷ ওসব নিয়ে আমি ভাবি না৷’

ও একটু অর্থপূর্ণ হাসল৷ তারপর বলল, ‘আপনি দেখতে ভারী সুন্দর৷ যদি একটু কুৎসিত হতেন, এই আমার মতো দেখতে হতেন, তবে নিশ্চয়ই ভাবতেন৷’

‘মানে?’ ওর কথাটা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল৷ ইচ্ছে করছিল ব্যাটাকে এখনই অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করি৷ কিন্তু সে ইচ্ছে মনের মধ্যেই চেপে রাখলাম৷

‘মানে চন্দ্রকলা কুৎসিত জিনিস পছন্দ করতেন! সেই জন্যই আয়নাটাকে আনিয়েছিলেন৷ কুৎসিতের প্রতি সব সুন্দরী নারীরই একটা অমোঘ আকর্ষণ থাকে৷ সব সুন্দরীই আসলে মনে মনে একজন কুদর্শন পুরুষকে কামনা করে৷ ওদের একটা অদ্ভুত মোহ থাকে৷ চতুর্দিকে অঢেল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যায়৷ বুঝলেন…?’ লোকটা বলেই চলল, ‘সৌন্দর্য যখন কমন জিনিস হয়ে দাঁড়ায়, তখন কদাকারকেই আনকমন মনে হয়! আর মেয়েরা সবসময়ই আনকমনের পূজারি!’

কী অদ্ভুত থিওরি! আমার রীতিমতো হাসি পেল! যদি সত্যিই তাই হত, তবে রাই আমাকে বিয়ে করত না৷ আমি এবং আমার বহুদিনের বন্ধু কাম বিজনেস পার্টনার প্রণব একসঙ্গে রাইয়ের প্রেমে পড়েছিলাম৷ কিন্তু প্রণব দেখতে সত্যিই কুদর্শন ছিল! লোমশ গরিলার মতো দানবীয় চেহারা, কুচকুচে কালো রং, মাথার টাকটা কালাহারি মরুভূমির মতো সর্বগ্রাসী ভঙ্গিতে ক্রমাগতই এগিয়ে চলেছে! ওর পাশে স্মার্ট ঝকঝকে চেহারার আমি তো রীতিমতো রাজপুত্রের সামিল! স্বাভাবিকভাবেই রাই আমাকেই বেছে নেয়৷ অবশ্য তাতে আমার আর প্রণবের সম্পর্কে ভাঙন ধরেনি৷ ও ব্যাপারটাকে খুব স্পোর্টিংলি নিয়েছিল৷ আমার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি লম্ফঝম্ফ ও-ই করেছিল৷ এমনকি আজও আমার বাড়িতে প্রণবের অবাধ আসা-যাওয়া৷

‘আপনি ওথেলোর গল্প শোনেননি? সুন্দরী ডেসডিমোনা কেন তাঁর প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিল বলুন তো?’ লোকটার বকবক আর থামে না, ‘কিংবা ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদামের’ কুঁজো, কুদর্শন কুয়াসিমোডোকে মনে আছে? সুন্দরী এসমারেলডা আর তার প্রেমকাহিনি? ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ পড়েছেন নিশ্চয়ই৷ অথবা ‘শ্রেক’ দেখেছেন? রাজকুমারী ফিওনা এক বিতিকিচ্ছিরি রাক্ষসকে ভালোবেসেছিলেন! কেন বলুন তো?’

‘জানি না৷’ একটু কঠোর স্বরে বললাম, ‘জানতেও চাই না৷’

লোকটা কেমন অদ্ভুত ভাবে খিঁক খিঁক করে হাসল, ‘তার কারণ নায়কেরা সবাই হতকুচ্ছিত ছিলেন৷ আর সুন্দরী মেয়েরা অসুন্দরকেই বেশি পছন্দ করে৷ এটাই নিয়ম!’

নিকুচি করেছে নিয়মের! আমি এবার বিরক্তি প্রকাশ না করে আর পারলাম না৷ তিতো গলায় বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, এই মুহূর্তে আমি একটু একা থাকতে চাইছি৷’

‘অবশ্যই একা থাকবেন৷’ বলতে বলতেই সে উঠে দাঁড়াল৷ কান এঁটো করা হাসি হেসে বলল, ‘রাজা বিক্রমনারায়ণ সিংহ রীতিমতো সুদর্শন পুরুষ ছিলেন! আর আপনিও…!’

কথাটা শেষ করেই লোকটা যেন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল!

ততক্ষণে চারপাশে ছায়াঘেরা আঁধার নেমে এসেছে৷ পাখিরা ফিরে গিয়েছে নীড়ে৷ আশেপাশে ঝিঁঝিঁর ডাকও শুনতে পাচ্ছি৷ শান্ত, স্তিমিত স্ফুলিঙ্গ নিয়ে জোনাকিরা টুপটুপ করে জ্বলছে-নিভছে৷ কোথা থেকে যেন সন্ধ্যারতির সুমধুর শঙ্খ-ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল! এখন চতুর্দিকে জমাট অন্ধকার৷ বাগানে বসে থাকলে মশা কিংবা অন্যান্য কীট-পতঙ্গের কামড় খাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল৷ তাই বাধ্য হয়েই উঠে পড়লাম৷

দোতলার সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমের দিকে যেতে যেতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে ঝাপ্টা মারল৷ পাখির দানা, শুকনো ফুল আর সুগন্ধী মোমবাতির মিশ্রিত সুবাস! সারা মহলে জ্বলজ্বল করছে বিজলিবাতি৷ অর্থাৎ কারেন্ট আছে৷ তবে মোমবাতি কে জ্বালল! অবাক হয়ে বেডরুমের দিকে তাকাই৷ একমাত্র সেখানেই ইলেক্ট্রিকের তীব্র আলো নেই৷ বরং অদ্ভুত স্নিগ্ধ আলোয় ঘরটা ভরে আছে৷ রাই মোমবাতি জ্বেলেছে নাকি! কেন? ফিউজ উড়ে যায়নি তো!

ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে গেলাম বেডরুমের দিকে৷ রাইয়ের আবার লোডশেডিং বা অন্ধকার বিশেষ পছন্দ নয়৷ যদি ফিউজ উড়ে গিয়ে থাকে তবে এখনই রতনকে বলতে হবে৷ কে জানে, ইলেক্ট্রিসিটির অভাবে আবার আমার মহিষী গোঁসায় নাকের পাটা ফুলিয়ে বসে আছেন কি না!

নাঃ, রাই রাগ করেনি৷ ফিউজও যায়নি৷ ঘরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমারই ফিউজ উড়ে যাওয়ার উপক্রম!

রাই ঘরে প্রচুর মোমবাতি জ্বেলে রেখেছে! নানা রঙের মোমগুলোর আলো একসঙ্গে মিলেমিশে সোনালি প্রভা তৈরি করেছে! সেই অপূর্ব বিচ্ছুরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ও৷ মনে হচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো সোনালি অভ্র চিকমিক করছে ওর মুখে, দুই বাহুতে, সারা গায়ে৷ রাইয়ের চোখে অদ্ভুত মোহ-মদির দৃষ্টি! ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই আয়নাটার দিকে! দু-চোখে পরম ভালোবাসা নিয়ে দেখছে ওর বিকৃত প্রতিবিম্বকে!

আমি স্তম্ভিত!

‘তাহলে পুলিশকে আমার স্কেচ দিয়েই এলেন শেষ পর্যন্ত!’

এই মুহূর্তে আমি আবার সেই লোকটার মুখোমুখি! সেই লোকটা! সেই খুনি! আমার রাইয়ের হত্যাকারী! একদম আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ইচ্ছে করলেই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি৷ কেটে-ছিঁড়ে কুচি কুচি করতে পারি৷ নিষ্ঠুর হাতে কেটে দিতে পারি শয়তানটার গলার নলি…!

একটু আগেই পুলিশ স্টেশন থেকে ফিরেছি৷ অফিসার আর্টিস্টকে দিয়ে স্কেচ তৈরি করিয়েছেন৷ আমি দেখলাম এক অদ্ভুত ম্যাজিকে সাদা পাতায় অবিকল ফুটে উঠেছে সেই মুখ! সেই জোড়া ভুরু, কোটরাগত চোখ, প্রসারিত ঠোঁট! সেই শয়তানটা…!

তিনি ছবিটা রতন আর বিরজুকে দেখালেন, ‘এই লোকটাকেই তোমরা দেখেছিলে? শিওর?’

ওরা দুজনেই সম্মতি জানাল৷ অফিসার আরেকবার স্কেচটার দিকে তাকিয়ে কনস্টেবলকে ছবিটা দিয়ে দিলেন, ‘এটা ইমিডিয়েটলি গোটা বিক্রমগড় আর আশেপাশের সমস্ত এলাকায় সার্কুলেট করাও৷’

‘ওকে স্যার৷’ একটা স্যালুট ঠুকে কনস্টেবল ছবিটা নিয়ে হুকুম তামিল করতে চলে গেল৷ অফিসার এবার আমার দিকে ফিরলেন, ‘আপনার বাড়িটা আমরা কাল খুঁজে দেখব৷ সিক্রেট ডোরটা যদি থেকে থাকে তবে সেটা খুঁজে পাওয়া জরুরি৷ আশা করি আমাদের সার্চ করতে দিতে আপনার কোনও আপত্তি নেই৷’

‘নো অফিসার৷’ আমি সম্মতি জানালাম৷

‘ঠিক আছে৷’ তিনি একটু ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এখন আপনারা যেতে পারেন৷ বডি পোস্টমর্টেমের পর পেয়ে যাবেন৷ তবে যতক্ষণ না তদন্ত শেষ হচ্ছে, শহর ছেড়ে যাবেন না৷’

এই সব নিয়মকানুন আমি খুব ভালো করেই জানি৷ তাই পুলিশকে সবরকম সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ফিরে এলাম রাজমহলে৷

কিন্তু তখন কে জানত যে পুলিশ যাকে তন্নতন্ন করে চতুর্দিকে খুঁজছে, যার নামে হুলিয়া জারি করেছে, সে স্বয়ং আমার শয়নকক্ষেই অপেক্ষা করছে আমার জন্য! খুনি আর কোথাও নয়, একদম মার্ডার স্পটেই উপস্থিত৷ ও ফিরে এসেছে এখানেই! কী করতে এসেছে?…

‘ওরা বিশ্বস্ত৷ তাই না?’ লোকটা হাসল৷ মনে হল ওর ঠোঁটদুটো মুখের বেড় ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাবে৷ মৃদু হাসতে হাসতে বলল, ‘ওদের পূর্বপুরুষরাও এমনই বিশ্বস্ত ছিল৷’

আমি ওর দিকে অনির্বাণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম৷ এই আমার রাইয়ের খুনি! ও আমার প্রেমের বুকে ছুরি বসিয়েছে৷ অথচ আশ্চর্য! আমার মধ্যে কোনও রাগ নেই! কোনও প্রতিশোধস্পৃহা নেই! সমস্ত অনুভব যেন বরফের মতো শীতল! হৃৎপিণ্ডটা বুঝি বরফ হয়ে গিয়েছে৷

‘রাজা বিক্রম সিংহ জানতেন যে তিনি কখনও সন্তানের জনক হতে পারবেন না’৷ লোকটার মুখের প্রত্যেকটা শব্দ যেন ছুরির মতো বারবার আমার বুকে কোপ বসাচ্ছে, ‘আর আপনি?’

আমি যথারীতি নিরুত্তর৷ কিছু কিছু কথা প্রকাশ্যে না আনাই ভালো৷ সেগুলোকে সবসময় গোপন দরজার পেছনেই রাখতে হয়!

আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাইয়ের খুনি৷ অবিকল সেই মুখ! সেই ভয়ংকর জোড়া ভুরু, সেই বসা চোখ! একটু আগেই পুলিশ স্টেশনের আর্টিস্টকে ওর বর্ণনা দিয়ে এসেছি আমি৷ এই মুহূর্তে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে একদম মুখোমুখি৷ আমাদের বেডরুমের আয়নার ভেতরে৷ সেই আয়না, যাতে সবকিছুই কুৎসিত দেখায়৷ ওই আয়নায় দাঁড়িয়েই এখন হাসছে আমার বিকৃত প্রতিবিম্ব! মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে শুনতে পেলাম তার হিসহিসে কন্ঠস্বর :

‘এবার বুঝেছেন কি যে গোপন দরজাটা ঠিক কোথায়?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *