গোপন কথা
প্রথম নাতিনী হইয়াছে, তাহাকেই দেখিবার জন্য ট্রেনে চড়িয়া বহুদূরের পথে যাত্রা করিয়াছিলাম।
প্রথম নাতিনী হইলে মনের ভাব কেমন হয়, তাহার বর্ণনা করিব না, সুহৃদ্বর তারাশঙ্কর সম্ভবত তাঁহার স্বীয় মনঃসমীক্ষণের বিবরণ সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন,—পঞ্চদশ বৎসর পরে তাঁহার নাতিনীটি পঞ্চদশ বৎসরের হইবে, এই সুমধুর ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া তিনি বিভোর, ইহা আমরা জানি। সুতরাং অলমিতি।
ট্রেনে অর্ধেক পথ অতিক্রম করিয়াছি, এখনও অর্ধেক বাকি। একটা বড় স্টেশনে গাড়ি থামিয়াছিল, আমি বোধ করি নবীনা নাতিনীর কথা ভাবিতে ভাবিতে একটু আচ্ছন্নের মতো হইয়া পড়িয়াছিলাম, পাশের প্ল্যাটফর্মে উল্টা দিক হইতে একটা গাড়ি আসিয়া থামিতে সচেতন হইয়া উঠিলাম।
দুই গাড়ির মধ্যে হাত দুই-আড়াই ব্যবধান। জানালা দিয়া মুখ বাড়াইতেই ও-গাড়ির জানালায় একটি মহিলার সঙ্গে চোখাচোখি হইয়া গেল। যুবতী নয়, বয়স চল্লিশ পার হইয়া গিয়াছে; ভারিভুরি গড়ন। কিন্তু মুখ হইতে যৌবনের কমনীয়তা সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। শাড়ির চওড়া লাল পাড় কাঁধের উপর খসিয়া পড়িয়া তাঁহার মুখটিকে যেন অপরাহ্নের অস্তরাগে মণ্ডিত করিয়া দিয়াছে। ও-গাড়ির ভিতর দিকে বোধ হয় আরও দুই-চারিটি স্ত্রীলোক ছিলেন, কিন্তু আমার চোখে তাঁহারা অস্পষ্ট পশ্চাৎপটের মতো আবছায়া হইয়া রহিলেন; আমি কেবল এই মহিলাটির দিকেই বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া রহিলাম।
তিনি প্রথমটা মুখ ফিরাইয়া লইয়া, আবার যেন দ্বিগুণ আগ্রহভরে আমার মুখের পানে চাহিলেন। দুইজন অপরিচিত প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া নির্লজ্জ উৎকণ্ঠায় পরস্পর মুখের পানে তাকাইয়া আছি। কিন্তু—সত্যই কি অপরিচিত? তাঁহার অধরোষ্ঠ ঈষৎ খুলিয়া গেল; দেখিলাম, সম্মুখের দুইটি দাঁতের মধ্যে অপরটির উপর সামান্য অনধিকার অভিযান করিয়াছে।
পঁচিশ বৎসরের রুদ্ধ কবাট মুহূর্তে খুলিয়া গেল; একসঙ্গে অনেকগুলা কথা হুড়মুড় করিয়া কণ্ঠ দিয়া বাহির হইতে চাহিল, কিন্তু কোনটাই বাহির হইতে পাইল না। এই সময় হেঁচকা দিয়া আমার গাড়ি ছাড়িয়া দিল।
ক্ষণকাল জড়বৎ বসিয়া রহিলাম, তারপর জানালা দিয়া গলা বাড়াইয়া চিৎকার করিয়া বলিলাম, ‘গোপন কথা!’
তিনি তখন দূরে সরিয়া যাইতেছেন; দেখিলাম শাড়ির লালপাড় আঁচলটা মাথায় তুলিয়া দিয়া তিনি মুখ বাড়াইয়া হাসিলেন, তারপর সঙ্কেত-ভরা একটি তর্জনী তুলিয়া ঠোঁটের উপর রাখিলেন। পঁচিশ বছরের পুরানো একটি দিন চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল। ওই হাসি ও সঙ্কেতের মর্ম আমরা দুইজন ছাড়া পৃথিবীতে আর কেহ জানে না।
গোপন কথা! একটি নবীন যুবক ও একটি সম্পূর্ণ অপরিচিতা নব-যুবতীর মধ্যে একদিন একটি নির্জন স্থানে কিছু গোপন কথার বিনিময় হইয়াছিল। নিন্দনীয় কথা নয়, জানিতে পারিলে পুলিসে বাঁধিয়া লইয়া যাইবে এমন কথা নয়—তবু গোপন কথা! শতাব্দীর একপাদ ধরিয়া এই কথাটি বুকের মধ্যে লুকাইয়া রহিয়াছে; ইহজীবনে যে নারীটির সহিত সর্বাপেক্ষা নিবিড়তম ঘনিষ্ঠতা হইয়াছে, তাঁহার কাছেও কোনদিন প্রকাশ করি নাই। পাঠকের হয়তো কৌতুহল হইতেছে, কি এমন গোপন কথা! কিন্তু বলিব না। হয়তো তাহার মধ্যে একটু অম্লমধুর কৌতুকের রস ছিল, হয়তো যৌবনের অর্থহীন চপলতা ছাড়া তাহাতে আর কিছুই ছিল না। তবু বলিতে পারিব না, এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যিনি এই গোপন কথার অংশভাগিনী ছিলেন, যিনি এইমাত্র চকিতের জন্য দেখা দিয়া কোন্ অজানা নিরুদ্দেশের অভিমুখে চলিয়া গেলেন, যাঁহার সহিত ইহজীবনে বোধ হয় আর কখনও চোখাচোখি হইবে না, তিনিও এই কথা সযত্নে অতি সন্তর্পণে সকলের নিকট হইতে লুকাইয়া রাখিয়াছেন; যে পুরষটির সহিত তাঁহার সর্বাপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠতা হইয়াছে, তাঁহাকেও একটি কথা বলেন নাই।
মনটা কিছুক্ষণ পূর্বে দূরভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিতেছিল, এখন দূরতর অতীতের পানে ফিরিয়া চলিল। কি আশ্চর্য এই মানুষের মন! শুধু অতীত আর ভবিষ্যৎ লইয়াই কি তাহার অস্তিত্ব? বর্তমান কতটুকু? স্মৃতি ও আকাঙক্ষার মাঝখানে দ্রুতসঞ্চরমান একটি বিন্দু! তাহাকে ধরিয়া রাখিবার উপায় নাই, এক ফোঁটা পারার মতো কেবলই সে পিছলাইয়া হাতের বাহিরে চলিয়া যায়, ধাবমান ট্রেনের জানালা দিয়া দৃষ্ট নিসর্গের মতো মুহূর্তে সম্মুখ হইতে পশ্চাতে অদৃশ্য হয়—
আমার নাতিনী যখন পনেরো বছরের হইবে, তখন তাহার কানে কানে আমার গোপন কথাটি বলিব কি? না, বলিব না। অতীতের এই সামান্য কথাটি ভবিষ্যতের কাছে চিরদিনের জন্য অকথিত থাকিয়া যাইবে। এইখানেই আমাদের গোপন কথার পরম পরিপূর্ণতা।
স্থানটি লোকালয় হইতে দশ-বারো মাইল দূরে। পাহাড় আছে, ভগ্নস্তুপ আছে, একটি মুখরস্রোতা গিরিনির্ঝরিণী আছে—আর আছে তন্দ্রানিবিড় মুগ্ধ নির্জনতা। একদিন ফাগুনের আরম্ভে একটি কবোষ্ণ দ্বিপ্রহরে বাইসিক্লে আরোহণ করিয়া একাকী এই স্থানে বেড়াইতে গিয়াছিলাম।
স্থানটি বড় ভাল লাগিয়াছিল। সুদূর অতীত যেন কর্মক্লান্ত বৃদ্ধার মতো সংসারের কাজ শেষ করিয়া একান্তে বসিয়া ঝিমাইতেছে; আর তাহার কর্ম নাই, কর্মে আসক্তিও নাই, হয়তো তাহার স্বপ্নের মধ্যে পুরাতন স্মৃতি ছায়ার মতো আনাগোনা করে। ভাঙা পাথরের ভূমিশয়ান মূর্তির উপর দিয়া শিকারসন্ধী বন্য গিরগিটি যখন সরসর করিয়া ছুটিয়া যায়, বুড়ি তন্দ্রার মধ্যে একটু উসখুস করে—
কিন্তু সেদিন আমার মনে ঐতিহ্যের রস ভাল করিয়া জমিতে পায় নাই। তাহার প্রধান কারণ, দুইটা কোকিল ভগ্নস্তূপের দুই প্রান্তের কোন পল্লব-পুঞ্জে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া বড় তর্ক আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল। একটি তার্কিকের মেজাজ কিছু কড়া, অপরটি মৃদু ব্যঙ্গপ্রিয়। একজন যতই মোলায়েম সুরে ব্যঙ্গ করিতেছিল, অন্যটি ততই ঝাঁঝিয়া উঠিয়া রূঢ়কণ্ঠে জবাব দিবার চেষ্টা করিতেছিল। কি লইয়া তর্ক তাহা অনুমান করিতে পারি নাই, কিন্তু লক্ষ্যহীনভাবে এদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে ঈষৎ কৌতুকের সহিত মনে হইয়াছিল, বুড়ি কাজ শেষ করিয়া যতই ঝিমাক, পৃথিবীতে যৌবন বসন্ত ও কোকিলের কাজ কোনও দিনই শেষ হইবে না।
তার্কিকদের তর্ক ক্রমশ উষ্ণতর হইয়া উঠিতেছিল। হঠাৎ এক সময় একটা ভাঙা মন্দিরের মোড় ঘুরিয়া দেখিলাম, ব্যঙ্গপ্রিয় কোকিলটি পাখি নয়—একটি মেয়ে। তাহার উৎকণ্ঠনিঃসৃত কুহুধ্বনি আমাকে দেখিয়া অর্ধপথে থামিয়া গেল।
মেয়েটি মন্দিরের দেয়ালে পিঠ দিয়া পা ছড়াইয়া বসিয়া আছে; আমার পানে অবাক হইয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল। তারপর বলিল, ‘আপনি কোথা থেকে এলেন?’
আমিও কম অবাক হই না। তাহার বয়স ষোল কি সতেরো; দীঘল তন্বী, মুখখানি মোমের মতো সুকুমার, গলাটি মিষ্ট; কিন্তু কোকিলের গলা যে অবিকল নকল করিতে পারে, তাহার গলা সম্বন্ধে অধিক বলাই বাহুল্য। আমি বলিলাম, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি কোকিল।’
সে হাসিল। সম্মুখের একটি দাঁতের উপর অন্য দাঁতটি একটু অনধিকার অভিযান করিয়াছে, তাহা লক্ষ্য করিলাম। সে মৃদু তরল কণ্ঠে বলিল, ‘আপনি বুঝি অন্য কোকিলটা?’
সত্যকার অন্য কোকিলটা অপর পক্ষের সাড়া না পাইয়া থামিয়া গিয়াছিল, এখন সহসা বিজয়োৎফুল্ল কণ্ঠে কয়েকবার দ্রুতচ্ছন্দে ডাকিয়া উঠিল, কু-কু-কু-কু-কু—
দুইজনে একসঙ্গে হাসিয়া উঠিলাম।
তারপর ভাব হইতে বিলম্ব হয় নাই। এত শীঘ্র এত ভাব হইয়া গিয়াছিল কি করিয়া এখন ভাবি। এ দেশটা বিলাত নয়, অন্তত তখনও বিলাত হইয়া উঠে নাই। অনাত্মীয়া যুবতীর সহিত নির্জনে আলাপ করিবার অভ্যাসও ছিল না। অথচ মুহুর্তের জন্যও বাধোবাধো ঠেকে নাই। বালক-বালিকা যেমন সহজ প্রীতির সহিত কিছুমাত্র আত্মসচেতন না হইয়া পরস্পর মিলিত হয়, আমরাও তেমনই মিলিত হইয়াছিলাম। তাহার নাম তটিনী; সে সপরিবারে এখানে বেড়াইতে আসিয়াছে; আর সকলে দুই মাইল দূরে আর একটা ভগ্নস্তুপ পরিদর্শন করিতে গিয়াছেন, তটিনী কিন্তু অনর্থক ঘুরিয়া বেড়ানোর চেয়ে এখানে বসিয়া কোকিলের সহিত কলহ করাই অধিক উপাদেয় মনে করিয়াছে—এসব কথা পরিচয়ের আরম্ভেই জানিতে পারিয়াছিলাম। আমিও পরিচয় দিতে কার্পণ্য করি নাই।
সেদিন বসন্তের বাতাস আতপ্ত আলিঙ্গনে আমাদের জড়াইয়া লইয়াছিল। কোকিল তো ডাকিয়াছিলই; কয়েকটা নবজাত প্রজাপতি চারিপাশে নাচিয়া নাচিয়া অকারণ চটুলতা প্রকাশ করিয়াছিল। কিন্তু সেদিনকার স্মৃতির মঞ্জুষায় যে কথাটি কাজও আমার মনে আনন্দের প্রভা বিকিরণ করিতেছে তাহা এই যে, বসন্ত আমাদের জয় করিয়া লইয়াছিল বটে, কিন্তু বসন্তসখার দেখা সেদিন পলকের জন্যও পাই নাই। বাঙালীর স্বর্গে কৌতুকের কোনও দেবতা আছেন কিনা জানি না; সম্ভবত আছেন, কারণ তিনিই সেদিন আমাদের যৌবন-যজ্ঞে পৌরোহিত্য করিয়াছিলেন।
দুইজনে ছুটোছুটি করিয়াছিলাম, লুকোচুরি খেলিয়াছিলাম; নির্ঝরিণীর ধারে পাশাপাশি হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া অঞ্জলি ভরিয়া জল পান করিয়াছিলাম। এমন স্বাদু ও এত শীতল জল আর কখনও পান করি নাই। সেই ঝরণার জলের স্বাদ আজও আমার মুখে লাগিয়া আছে।
ক্রমে বিদায়ের কাল উপস্থিত হইয়াছিল।
‘আপনি এবার চলে যাবেন?’
‘হ্যাঁ। দূরে গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। ওঁরা এসে পড়বার আগেই চলে যাই। নইলে আজকের এই নিখুঁত দিনটার ওপর দাগ পড়ে যাবে। —আচ্ছা, চললুম।’
অকপট সৌহার্দ্যে তাহার পানে হাত বাড়াইয়া দিয়াছিলাম। সে আমার হাতখানা দুই হাতে তুলিয়া লইয়া আমার মুখের পানে চাহিয়াছিল।
‘আর কখনও আমাদের দেখা হবে না!’
‘সম্ভব নয়। কিন্তু এই ভাল।’
‘হ্যাঁ। আজকের দিনটা আমার অনেক দিন মনে থাকবে।’
হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসিল।
‘এস, এক কাজ করি। তাহলে কেউ কাউকে ভুলব না। আমি তোমাকে আমার একটি গোপন কথা বলি, তুমি আমাকে গোপন কথা বল। কিন্তু শপথ রইল, কেউ কোনও দিন আর কারুর কাছে একথা বলব না।’
সে ক্ষণকাল ভাবিয়াছিল; ভাবিতে ভাবিতে তাহার চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল।
‘আচ্ছা।’
আমি তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া একটি গোপন কথা বলিয়াছিলাম— শুনিয়া সে চকিত সকৌতুক দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়াছিল। তারপর একটু হাসিয়া একটু লাল হইয়া আমার কানে কানে তাহার গোপন কথাটি বলিয়াছিল।
সে দাঁড়াইয়া রহিল, আমি চলিয়া গেলাম। কিছুদূর গিয়া একবার ফিরিয়া দেখিলাম। সে একটু হাসিয়া ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিল।
১৪ ভাদ্র ১৩৫০